Thursday, February 27, 2025

বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানের পেছনে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাইনি - দুই

 

কোটা সংস্কারের আন্দোলনের প্রথম পর্বে যা দেখেছি ও বুঝেছি

6,791 Student Protest In Bangladesh Stock Photos, High-Res ...

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যেভাবে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন হয়ে ওঠে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিভেদ আনতে একদিকে জঙ্গি ও জামায়াতি তকমা লাগিয়ে অপপ্রচারের সুনামি সৃষ্টি করেছিলেন, অন্যদিকে আন্দোলনকে দমন করতে রাষ্ট্রযন্ত্র এবং  যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র কর্মীবাহিনী তথা গুণ্ডাবাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছিলেন শিক্ষার্থীদের উপর। তাতেও আন্দোলন দমেনি, বরং দমনপীড়ন যত তীব্র হয়েছে, শিক্ষার্থীরা যত রক্তাক্ত ও হতাহত হয়েছে আন্দোলনও তত তীব্র হয়েছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও হাজারে হাজারে আন্দোলনে সামিল হয়েছে, রাজপথে নেমেছে। হাসিনা তাতে আরও ক্ষিপ্ত ও হিংস্র হয়ে ওঠেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা, দফায় দফায় কারফিউ জারি করা, ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখাসহ সমস্ত প্রকার রাষ্ট্রীয় নিপীড়নকারী ব্যবস্থাকে কঠোরভাবে প্রয়োগ করার জন্যে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীকে আদেশ দেন। পুলিশ স্বভাবতই অধিক মাত্রায় ক্ষিপ্ত ও হিংস্র হয়ে ওঠে এবং দমনপীড়নের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়।  কাঁদানে গ্যাসের সেল ফাটিয়ে, নির্মমভাবে ব্যাপক লাঠিচার্জ করে শত শত শিক্ষার্থীদের রক্তাক্ত করে, রক্তাক্ত ও আহত শিক্ষার্থীদের  গণহারে আটক ও গ্রেপ্তার করে গারদে পোরে। তাতেও শিক্ষারথীরা ভয়ে পেয়ে পিছু না হটে বুক চিতিয়ে আরও বেশি বেশি করে দাঁড়িয়ে যায় পুলিশের গুলির সামনে। পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী তখন তাদের উপর মুড়িমুরকির মতন গুলিবর্ষণ করা শুরু করে ছত্রভঙ্গ করতে। ফলে হাজার হাজার শিক্ষার্থী রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে, কয়েক হাজার পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। এর পাশাপাশি পুলিশ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের নেতাদেরও গ্রেপ্তার করে ও গুম করে রাখে, পুলিশ কাস্টডিতে তাদের উপর অকথ্য অত্যাচার নিপীড়ন চালায়। বল্গাহীন এরূপ পৈশাচিক রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নে মধ্যেও  শিক্ষার্থীরা পুলিশকে পিঠ দেখায় নি, রাজপথ ছাড়ে নি।

নিজের সন্তানদের উপর এরূপ বীভৎস, বর্বর রাষ্ট্রীয় অত্যাচার ও সন্ত্রাসের দৃশ্য দেখে বাবা-মা ও অভিভাবকরাও তখন আর বাড়িতে বসে স্থির থাকতে পারেনি, রাস্তায় নেমে সন্তানদের পাশে দাঁড়িয়েছে, পুলিশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার্থীদের বাবা-মা ও অভিভাবক ছাড়াও রাষ্ট্রের দানবীয় বেপরোয়া সন্ত্রাসী অভিযানের বিরুদ্ধে আমজনতাও পথে নেমে ছাত্রদের কোটা আন্দোলনে আন্দোলনে সামিল হয়েছে। কলকারখানার শ্রমিক, গার্মেন্ট শিল্পের নারী শ্রমিক, রিক্সাওয়ালা,  চায়ের দোকানদার, মুদির দোকানদার, দোকানের কর্মচারী, হকারসহ সব পেশার শ্রমজীবী মানুষ নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই জীবন বাজী রেখে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পথে নেমেছে।  ছাত্রদের আন্দোলনে সামিল হওয়া সেই আমজনতার উপরেও হাসিনা সরকারের পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তাদের উপর গুলি পর্যন্ত চালিয়েছে। ফলে বহু সংখ্যক অছাত্র মানুষরাও শিশু, নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা নির্বিশেষে ভয়ংকর রকমের জখম হয়েছে, অনেকেই নিহতও হয়েছে। রাষ্ট্রের পরিকল্পিত বীভৎস এই সন্ত্রাস রাস্তায় টেনে নামায় বুদ্ধিজীবী, বিদ্বজন, শিল্পী, কলাকুশলীসহ সুশীল সমাজের একাংশকেও। তারাও ছাত্রদের আন্দোলনে সামিল হয়, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। এভাবেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সহসা, যেন এ লহমায়, ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন হয়ে ওঠে।

যতদূর মনে পড়ে সুশীল সমাজের যারা সে সময় নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছাত্রদের পাশে রাজপথে নেমে এসেছিলো তাদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল (এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা), আন্তর্জাতিক বহু পুরষ্কারে ভূষিত জলবায়ু ও পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী আইনজীবি সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান (এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা), জনপ্রিয় চলচ্চিত্র শিল্পীদের মধ্যে পথে নেমে রক্তাক্ত, আহত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন শিল্পী বাঁধন ও জাকিয়া বারি মম প্রমুখ। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, সন্তানসম ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলি চালনার নিন্দা করেছিলেন জনপ্রিয় চলচ্চিত্র শিল্পী মোশারাফ করিম ও চঞ্চল চৌধুরি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নারী অধ্যাপককেও রাস্তায় নেমে ছাত্রদের কাতারে দাঁড়িয়ে হসিনা সরকারের রাষ্টড়ীয় দমনপীড়নের তীব্র প্রতিবাদ করতে দেখেছি যার নাম মনে নেই। এই সব বিশিষ্ট গুণীজনরা আধুনিক সভ্য সমাজের এক একজন উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব  ফলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চেহারা শুধু ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনেই থেমে থাকেনি, খুব দ্রুতই তীব্র গণবিক্ষোভের চেহারা নিয়ে নেয়। এসব দেখে শেখ হাসিনা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে তার সরকারকে উৎখাত করার মুসলিম মৌলবাদীদের একটা গভীর ষড়যন্ত্র বলে যে অভিযোগ করেছিলেন সেটা আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য ঠেকেনি। 

গণবিক্ষোভও আর শুধু বিক্ষোভের স্তরে থেমে থাকেনি, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস যত  বল্গাহীন হয়েছে, রাজপথে যত রক্ত ঝরেছে, ছাত্র ও জনতার লাশ যত পড়েছে আন্দোলন ততই তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে, এবং একটা পর্যায়ে অভ্যুত্থানের রূপ নিয়ে ফেলেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও আন্দোলনকে আরও উদ্দীপ্ত করতে, আন্দোলনের ঝাঁজ বাড়াতে নতুন নতুন শ্লোগান, আন্দোলনের নতুন নতুন কর্মসূচী দিয়েছে। ব্লকেড, কমপ্লিট শাট ডাউন ইত্যাদি কঠিন কঠিন কর্মসূচী দিয়ে অভ্যুত্থানকে তীব্র থেকে তীব্রতর করেছে। সেই পর্যায়ে আন্দোলন একটা স্তরে গিয়ে ছাত্ররা আর চাকরিতে কোটা সংস্কারের এক দফা দাবিতে আটকে থাকে নি। এক দফার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও বহু দাবী যোগ করে ৯ দফা দাবির ঘোষণা দেয়। ন’দফা দাবিতে ঢাকার রাজপথ ও গোটা বাংলাদেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। ক্রমশ ...

No comments:

Post a Comment

বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাইনি – পাঁচ

  দ্বিতীয় অধ্যায় শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবের প্রতি তীব্র গণরোষের নেপথ্যে ২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে ৩৬ দিন পর (৫ই ...