Tuesday, January 10, 2023

কারবালাঃ মিথ ও মিথ্যা (সম্পূর্ণ বই)

 

MAHASVETA DEVI                   GD 3O, Rajdanga Main Road, Kolkata - 700107

“আমরা এক সভেতন প্রয়াস” এর এই বইটি পাঠকের সংগ্রহ করে রাখা উচিত হবে। তিনি লাভবান হবেন।

বইটির নাম “কারবালাঃ মিথ ও মিথ্যা”। লেখক গিয়াসউদ্দিন

এই বইটি পাঠক সমাজে যথার্থ সমাদৃত হওয়া প্রয়োজন

মহাশ্বেতা দেবী

৬।১।২০১৪

প্রকাশকের কলম

ইতিহাস যেভাবে বর্ণিত হয় বহু ক্ষেত্রে তার পেছনের ইতিহাস সম্ভব হয় না। সেখানে সময়, রাজনীতি, ইতিহাসকারের কৌম অবস্থান ও ঘটনার পরম্পরার ভূমিকা থাকে। একজন ঐতিহাসিক তার অর্জিত জ্ঞান ও বিশ্বাস (যা তার পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে গড়ে ওঠে) নিয়ে রচনা কর্ম শুরু করেন নিরপেক্ষ ইতিহাস হয় না, বস্তুত সমাজবিজ্ঞানে নিরপেক্ষ শব্দ ক্রমেই এক অসম্ভবের বিশেষণ হয়ে উঠেছে। এমনকি অধিবিদ্যা (Metaphisics) নিয়েও বিতর্ক আছে, আছে মত ও পাল্টা মতের লড়াই। মজার কথা হল এই অনুবাদ থেকেই তথ-নিষ্ঠ হওয়ার প্রয়াস চলছে।

এই প্রয়াসে মৌলবাদ এক বাধা। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় মৌলবাদ হল একই কর্মের পুনঃ পুনঃ আবৃত্তির নীতি। এক সংস্কারের পুনরাবৃত্তি, আচারের পুনরাবৃত্তি, সর্বোপরি পুরাতনের পুনরাবৃত্তি বলা যায়। এই পুন্নরাবৃত্তির নীতি জীবনকে এক অনিশ্চিত খাতে প্রবাহিত করে, সাধারণের পক্ষে এই নিশ্চিন্তি অনেক শ্রেয়তর বলে মনে হয়। নূতন ভাবনা যা প্রবহমান বিশ্বাসকেকেই চ্যালেঞ্জ করে, তা গ্রহণে আড়ষ্টতা কাজ করে। কাজ করে ভীতি। ভাবা হয় বা ভাবানো হয়, প্রচলনকে ও প্রবচনকে চ্যালেঞ্জ করার অর্থ নৈরাজ্যকে আবাহন করা। তাই দ্বৈরাজ্যে বসনাস চলে।

‘যুগ  যুগ ধরে চলে আসছে’ বা ‘মহান পুরুষ বলে গেছেন’ বা ‘তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ’ এসব কিছুর সাথে মৌলবাদ নিজেকে জুড়ে দেয়। অবতার, তীর্থঙ্কর, পয়গম্বরদের ঘিরে গড়ে ওঠে মিথ  ও মিথ্যার প্রাচীর। অতিকথা আঁতুড় পেরিয়ে আসমূদ্রে বসতি স্থাপন করে। ক্রমে তা তালু, মূর্ধা, দন্তমূল, জিহ্বা জুড়ে উচ্চারিত হতে থাকে, তাকে ঘিরে রচিত হতে থাকে সংবেদ ও সংস্কৃতির যাপন ও উদযাপন।

বাংলা সাহিত্যে ‘কারবালার যুদ্ধ’ নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা, লোকপগান, পদাবলী, এমনকি পটচিত্রও। লোকজীবনে এর প্রভাব যথেষ্ট। মীর মোশারাফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ পড়ে চোখের কোণ আদ্র হয়নি এমন মানুষ পাওয়া বিরল। যুদ্ধক্ষেত্রে কাশেমের মৃত্যুতে সদ্য বিবাহিতা সখনার বিলাপের সাথে কোথায় যেন একাকার হয়ে যায় ঘরের মেয়ের বৈধব্য যন্ত্রণা। ঠিক যেমন অযোধ্যায় রাজবধূ সীতার অগ্নিপরীক্ষার সাথে এক কাতারে দাঁড়াত অসংখ্য গৃহবধূ। উমার সাথে বাপের বাড়ি ফেরে যেমন অযুত মেয়ে।  প্রতিদিন কারবালা ঘিরে তঘাকে আমাদের। ফোরাতের জলের জন্য হাহাকার গুমরে ওঠে বারেন্দ্র-রাঢ়-গৌড়-চট্টলের বাংলা। ঠিক এখানেই গিয়াসুদ্দিনের গবেষণা এক ব্যতিক্রমী প্রয়াস। ত্বনিষ্ঠ ও সংশুদ্ধির আলোয় উজ্জ্বল। পারিবারিক ও লোকজ অভ্যাসের প্রাচীর ও পরিখা অতিক্রম করে, প্রচলিত ইতিহাসকে অনুসন্ধিৎসু প্রচেষ্টা দিয়ে ইশ্লেষণ করেছেন তিনি। ইতিহাসকে ইতিহাস দিয়ে বিশ্লেষণ। প্রশ্ন রেখেছেন সরাসরি, যা নড়বড়ে করেছে বিওাসাএর বুনিয়াদকেকেন্দ্র চরিত্রে রাম থাকবে না রাবণ, তা মেঘনাথবধ কাব্যের রচিয়তা স্থির করে নেয় পূর্বেই। বিবিধ ভাষায় রচিত রামায়ণে পাওয়া রসদ থেকে। এ ছিল মহাকাব্যকে নিজ কাব্য দিয়ে সমান্তরালে আনা। যেখানে মর্যাদাপুরুষোতম পরিণত হন কাপুরুষ ও আর্য চরিত্রে। বিপরীত স্রোতের এই কাব্য সমাদৃত হয়েছিল তার সমগ্রতার নিরিখেও। এই ধারায় গিয়াসুদ্দিনের রচনা এক নবতম সংযোজন। এখানে নবীর দোহিত্রের ‘নিষ্পাপ সুন্দর’ চরিত্রকে ভাঙা হয়েছে নিপুণ ভাস্কর্যে। ফুটে উঠেছে ক্ষমতালিপ্সু হোসেনের অবয়ব। তিনি লিখেছেন কারবালা যুদ্ধের ভরকেন্দ্র ছিল ক্ষমতা। ঘটনার আবর্তন হয়েছে খলিফার মসনদকে কেন্দ্র করে। যুদ্ধের জন্য দায়ী শুধু মাবিয়া ও তাঁর পুত্র এজিদ, হোসেন সম্পূর্ণ নির্দোষ – ইতিহাসেরেই মূল্যায়নকে করেছেন নস্যাৎ। যথার্থ ও অকাট্য যুক্তির বুনোটে। তাই ভবিষ্যতের কাব্য রচিত হওয়ার সম্ভাব্যতায়, রসদ পাওয়ার সকল সম্ভাবনা রইল্ল এই বইটিতে।

শুভ প্রতিম রায়চৌধুরি

আমরা (আমরা এক সচেতন প্রয়াস) প্রকাশনীর মুখবন্ধ

কারবালা যুদ্ধ মহাভারতের কুরুক্ষেত্র কিংবা রামায়নের রাম-রাবণের যুদ্ধের মতো কোনো পৌরাণিক যুদ্ধ নয়। এটি একটি ঐতিহাসিক যুদ্ধ। যুধটি সংঘটিত হয় তের’শ  বছরের পূর্বে ইরাকের অন্তর্গত ইউফ্রেটাস নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে। এই তের’শ বছরের ইতিহাসে অসংখ্য যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে পৃথিবীতে। তার মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য দুটি ভয়ঙ্কর বিশ্বযুদ্ধ যেমন আছে, তেমনি আছে ইসলামের ইতিহাসেও বহু স্মরণীয় যুদ্ধ। এইসব যুদ্ধের কথা ইতিহাসের ছাত্র-ছাত্রী ব্যতীত অন্যান্য মানুষ খুব কমই জানেন। কিন্তু কারবালা যুদ্ধের কথা আজও মুসলমানদের মুখে মুখে ঘোরে। যুদ্ধটি কার্যত পৌরাণিক যুদ্ধের মর্যাদা লাভ করেছে।

যুদ্ধটি সংঘটিতে হয়েছিল ইসলামের ষষ্ঠ খলিফা ইয়াজিদের সৈন্যবাহিনী ও হযরত মহম্মদের নাতি ইমাম হোসাইনের মধ্যে। যুদ্ধে হোসাইন পরাস্ত ও নিহত হন।

কারবালা যুদ্ধ নিয়ে কত যে ইতিহাস এবং গল্প, উপন্যাস, নাটক, ছড়া, কবিতা, মুর্সিয়া, জারিগান প্রভৃতি লেখা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সে লেখার আজও বিরাম নেই। সব লেখায় এক সুরে, এক ছন্দে, এক তারে বাঁধা। কারবালা যুদ্ধের প্রধান হোতা ইয়াজিদের পিতা ৫ম খলিফা মুয়াবিয়া। তিনি ইসলামি সাম্রাজ্যের খলিফা পদের ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকার ইমাম হোসাইনকে বঞ্চিত করেন এবং তাঁর অযোগ্য পুত্র ইয়াজিদকে খলিফা মনোনীত করেনএর মধ্য দিয়ে তিনি রাজতন্ত্র কায়েম করে ইসলামী গণতন্ত্রের এবং প্রকৃত ইসলামি খেলাফতের সমাধি রচনা করেন। হোসাইন একজন সৎ, নিষ্ঠাবান ও নির্ভিক মুসলমান, তিনি ইসলামী খেলাফত ও ইসলামকেই রক্ষা করার জন্য আদর্শভ্রষ্ট, লম্পট ও স্বৈরাচারী ইয়াজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে আত্মবলিদান করেন। হোসাইন তাই একজন আদর্শবান, আত্মত্যাগী ও সাচ্চা মুসলমানের মূর্ত প্রতীক। অপরদিকে ইয়াজিদ একজন ক্ষমতালোভী, লম্পট, নিষ্ঠুর, নির্দয় ও স্বৈরাচারী শাসক এবং মুসলমানদের কলঙ্ক। এই হলো কারবালা যুদ্ধ নিয়ে লেখা সব ইতিহাসের মূল কথা।

কারবালা যুদ্ধ নিয়ে লেখা এই ইতিহাস কিন্তু আদৌ প্ররকৃত ইতিহাস নয়। এই ইতিহাস সম্পূর্ণ একপেশে এবং বিকৃত ইতিহাস। মুসলিম ঐতিহাসিজকগণ দায়বদ্ধতা প্রকাশ করেছেন মুহাম্মদের প্রতি, ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধ থাকেন ন।। ফলে কারবালা যুদ্ধের আসল ইতিহাস চাপা পড়ে গেছে অসত্য ও বিকৃত ইতিহাসের নীচে। এই বইতে কারবালা যুদ্ধের আসল ও নিরপেক্ষ ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

 

 

ভুমিকা 

ইসলাম সম্পর্কে শুনেছি অনেক গল্প, পড়েছি অনেক বই। কোরান হাদিস তো সেই ছোটবেলাতেই পড়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু গিয়াসউদ্দিনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে টের পাই ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে আমার জ্ঞান তাঁর জ্ঞানের তুলনায় অনেক কম। অনেক কিছুই আমি জানি না। কৈশরে মীর মোশারফ হোসেনের লেখা ‘বিষাদ সিন্ধু’ পড়ে কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছি, কিন্তু বইটিতে যে প্রচুর ভুল তথ্য ছিল জানতাম না। মোহাম্মদের ছলচাতুরী আবিষ্কার করতে ব্যস্ত ছিলাম, ঘুর্ণাক্ষরেও ভাবিনি তার নাতিরাও ছিলেন প্রচণ্ড ক্ষমতালোভী।

মোহাম্মদের মৃত্যুর প্রায় পঞ্চাশ বছর পর ষষ্ঠ খলিফা বা সম্রাট ইয়াজিদকে সমগ্র মুসলিম সাম্রাজ্য স্বাগত জানালেও, মোহাম্মদের নাতি জানাননিতিনি নিজে খলিফা হতে চেয়েছিলেন। সে কারণে ইয়াজিদকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য মক্কা থেকে কুফা শহরের দিকে যান। সেই যাত্রাপথে কারবালা নামক এক জায়গায় ইয়াজিদের সৈন্যবাহিনী তাকে বাধা দেয় এবং সেখানেই যুদ্ধে তিনি নিহত হন। এ হল ঘটনা। কিন্তু নানারকম মিথ্যা গল্প রচনা করা হয়েছে মোহাম্মদের বংশধরদের সুখ্যাতি গাইতে, অন্য অর্থে ইসলামকে কালিমা থেকে মুক্ত করতে। শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষ চোখ কান বন্ধ করে বিশ্বাস করে গেছে সেসব।

সত্যি ইতিহাসটা মানুষ জানুক। মিথ্যে টিকিয়ে রাখা হয়েছে ধর্ম টিকিয়ে রাখার জন্য। হাজার বছর ধরে মানুষ মিথ্যাকে সত্যি বলে জেনে আসছে। কোরানের রূপকথাগুলোকেও সত্যি বলে মনে করেছে মানুষ। আজ যদি সত্যি ইতিহাস মানুষকে জানতে দেওয়া হয়, কে লিখেছে, কেন লিখেছে কোরান, তাহলে ধ্বসে যাবে তথাকথিত এই শান্তির ধর্ম ইসলাম।

গিয়াসউদ্দিন আমাদের ভুল আর মিথ্যের অন্ধকার সরিয়ে একটু আলো ফেলবেন ইতিহাসে। আমাদের আলোকিত করবেন।

তসলিমা নাসরিন

 

প্রাক-কথন

কারবালা যুদ্ধ মহাভারতের কুরুক্ষেত্র কিংবা রামায়নের রাম-রাবণের যুদ্ধের মতো কোনো পৌরাণিক যুদ্ধ নয়। এটা একটি ঐতিহাসিক যুদ্ধ যুদ্ধটি সংঘটিত হয় তের’শ বছরেরও পূর্বে ইরাকের অন্তর্গত ইউফ্রেটাস নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরেএই তের’শ বছরে ইতিহাসে অসংখ্য যুদ্ধ হয়েছে পৃথিবীতেতার মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য দুটি ভয়ঙ্কর বিশ্বযুদ্ধ যেমন আছে, তেমনি আছে ইসলামের ইতিহাসেও বহু স্মরণীয় যুদ্ধ এসব যুদ্ধের কথা ইতিহাসের ছাত্র-ছাত্রী ব্যতীত অন্যান্য মানুষ খুব কমই জানেনকিন্তু কারবালা যুদ্ধের কথা আজও মুসলমানদের মুখে মুখে ঘোরে যুদ্ধটি কার্যতঃ পৌরাণিক যুদ্ধের মর্যাদা লাভ করেছে

যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল ষষ্ঠ খলিফা ইয়াজিদের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে ও হযরত মুহাম্মদের দোহিত্র ‘ইমাম হোসাইনে’রযুদ্ধে হোসাইন পরাস্ত ও নিহত হন

কারবালা যুদ্ধ নিয়ে কত যে ইতিহাস এবং গল্প, উপন্যাস, নাটক, ছড়া, কবিতা, মুর্সিয়া, জারিগান প্রভৃতি লেখা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সে লেখার আজও বিরাম নেই সব লেখাই এক সুরে, এক ছন্দে, এক তারে বাঁধাকারবালা যুদ্ধের প্রধান হোতা  ইয়াজিদের পিতা ৫ম খলিফা মুয়াবিয়াতিনি ইসলামি সাম্রাজ্যের খলিফা পদের  ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকার ইমাম হোসাইনকে বঞ্চিত করেন এবং তাঁর অযোগ্য পুত্র  ইয়াজিদকে খলিফা মনোনীত করেনএর মধ্য দিয়ে তিনি রাজতন্ত্র কায়েম করে ইসলামি গণতন্ত্রের এবং প্রকৃত ইসলামি খেলাফতের সমাধি রচনা করেন  হোসাইন একজন সৎ,  নিষ্ঠাবান ও নির্ভিক মুসলমান, তিনি ইসলামি খেলাফত ও ইসলামকে রক্ষা করার জন্য আদর্শভ্রষ্ট, লম্পট ও স্বৈরাচারী ইয়াযিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে আত্মবলিদান করেন হোসাইন তাই একজন আদর্শবান, আত্মত্যাগী ও সাচ্চা মুসলমানের মূর্ত প্রতীকঅপরদিকে ইয়াজিদ একজন ক্ষমতালোভী, লম্পট, নিষ্ঠুর, নির্দয় ও স্বৈরাচারী শাসক এবং মুসলমানদের কলঙ্কএই হলো কারবালা যুদ্ধ নিয়ে লেখা সব ইতিহাসের মূল কথা

কারবালা যুদ্ধ নিয়ে লেখা এই ইতিহাস কিন্তু আদৌ প্রকৃত ইতিহাস নয়এই ইতিহাস সম্পূর্ণ একপেশে এবং বিকৃত ইতিহাসমুসলিম ঐতিহাসিকগণ দায়বদ্ধতা প্রদর্শন করেছেন মুহাম্মদের প্রতি, ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধ থাকেন নিফলে কারবালার যুদ্ধের আসল ইতিহাস চাপা পড়ে গেছে অসত্য ও বিকৃত ইতিহাসের নীচেআমি চেষ্টা করেছি আমার বইয়ে কারবালা যুদ্ধের আসল ও নিরপেক্ষ ইতিহাস তুলে ধরতে  

লেখক

১ম অধ্যায়  

পৌরাণিক যুদ্ধ নয়

বিশ্ব ইতিহাসে যুদ্ধের ইতিহাসটি সব দিক থেকেই বিশাল। কত যুদ্ধ যে সংঘটিত হয়েছে সাড়া বিশ্বে তার ইয়ত্তা নেই। অবশ্য খুব কম যুদ্ধই হয়েছে মানুষের স্বার্থে ও প্রয়োজনে। কিন্তু সব যুদ্ধেই খুন-জখম হয়েছেন মানুষই, মানুষ বলতে সাধারণ মানুষ। প্রাক-পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায়, বলা ভালো করা হয়েছে ক্ষমতা বিস্তার, কিংবা ক্ষমতা দখল, কিংবা ক্ষমতা পুনরুদ্ধের জন্যে।  সে সব যুদ্ধ হতো রাজায় রাজায় কিংবা রাজা-বাদশা-সম্রাটদের মধ্যে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় মানবসভ্যতা যখন প্রবেশ করে তখন যুদ্ধের প্রকৃতি পাল্টে যায়। কারবালা যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছে মধ্য যুগে, অর্থাৎ পুঁজিবাদী যুগে মানবসভ্যতা প্রবেশ করবার ঢের পূর্বে। স্বভাবতই সে যুদ্ধের বৈশিষ্ট আলাদা কিছু ছিলো না। কিন্তু যে ইতিহাস আওমরা পড়ি সে ইতিহাস এই যুদ্ধটাকে সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছে। কী সেই বৈশিষ্ট্য সে প্রসঙ্গে আসবো পরে

 যুদ্ধ বিষয়ে এখানে আর একটা কথা উল্লেখ করা আবশ্যক। ইতিহাসে সত্যি সত্যি ঘটে যাওয়া যুদ্ধ ছাড়া আমরা অনেক যুদ্ধের কথা শুনতে পাই। সে সব যুদ্ধ হলো পৌরাণিক যুদ্ধ। এ সব যুদ্ধের কথা মানুষের মুখে মুখে ঘোরে। অপরদিকে যে যুদ্ধগুলো সত্যি সংঘটিত হয়েছে তার কথা মানুষের মুখে মুখে ঘোরা তো দূরের কথা, মানুষ সে সব যুদ্ধ সম্পর্কে খুব কমই অবহিত। কিন্তু এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম হলো কারবালা যুদ্ধ। এই যুদ্ধটির কথা মুসলিম সমাজের মানুষের মুখে মুখে আজও সমানে ঘোরে।  শুধু তাই নয়, প্রতি বছর এই যুদ্ধের দিনটি স্মরণও করা হয়একটি সত্যিকারের যুদ্ধ হয়েও পরিণত হয়ে গিয়েছে পৌরাণিক যুদ্ধে। তাই এই যুদ্ধটির একটা আলাদা তাৎপর্য আছে ইতিহাসে। অথচ খুবই দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এই যুদ্ধটির ইতিহাশ ্যা লেখা হোয়েছে এবং প্রকৃত যা ঘটেছিল তার সঙ্গে পাহাড় প্রমাণ পার্থক্য রয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী, এই যুদ্ধের আসল ইতিহাসতাই হারিয়ে গেছে, আর তার পরিবর্তে একটা সম্পূর্ণ বিকৃত, অর্ধসত্য ও অসত্য ইতিহাস লেখা হয়েছে যা আমরা যুগ যুগ ধরে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি।

বলা বাহুল্য  যে, যে ইতিহাসের কথা আমি বলছি তা মুসলিম ঐতিহাসিকদের লেখা ইতিহাস আমি বলছি তা মুসলিম ঐতিহাসিকদের লেখা ইতিহাস। কারবালা যুদ্ধ নিয়ে ইতিহাসের বাইরেও প্রচুর লেখালেখি হয়েছে সাহিত্যের অঙ্গনে। কবিতা, ছড়া, মুর্শিয়া, জারিগান, গল্প, নাটক, থিয়েটার, উপন্যাস প্রভৃতি কতো লেখা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই এবং আজও তা সমানে অব্যাহত রয়েছে।এ সব রচনায় ঐ একই ধারা - যে ধারা ইতিহাসে অনুসরণ করা হয় – চালু আছে। 

 

কারবালা যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিলো অধুনা ইরাকে অবস্থিত ইউফ্রেটাস (ফোরাত) নদীর ধারে কারবালা নামক একটি প্রান্তরে। সে জন্যে ইতিহাসে এটি কারবালা যুদ্ধ নামে খ্যাত। এটা আবার মহরম নামেও পরিচিত। কারণ, যেদিন  যুদ্ধটি সংঘটিত হয় সেদিন ছিলো আরবি বছরের মহরম মাসের দশ তারিখ। তাই প্রতি বছর ১০ই মহরম এই দিনটি উদযাপিত হয় গোটা দুনিয়ায় মুসলিম সমাজে। এটা উদযাপন করা হয় অবশ্য শোক দিবস হিসাবে। কারণ, এই যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন ইমাম হোসেন যিনি ছিলেন মুহাম্মদের নাতি এবং ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলির পুত্র। বলা বাহুল্য একমাত্র সেই কারণেই এই যুদ্ধটি পৌরাণিক যুদ্ধের মতন মানুষের মুখে মুখে ঘোরে।

মুসলমান ঐতিহাসিকগণ এই যুদ্ধের ইতিহাস লিখতে গিয়ে ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতার পরিবর্তে দায়বদ্ধতা প্রদর্শন করেছেন মুহাম্মদ ও তাঁর বংশধরদের প্রতিএকই অবস্থা হয়েছে যাঁরা কারবালা নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন তাঁদের ক্ষেত্রেও। যুদ্ধটি হয় হোসেন ও ইসলামি সাম্রাজ্যের ষষ্ঠ খলিফা এজিদ (ইয়াজিদ) – এর সৈন্যবাহিনীর সাথে। মুসলিম ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিকদের কলমের আক্রমণের অভিমুখ থেকেছে তাই এজিদ ও তাঁর পিতা ইসলামের পঞ্চম খলিফা  মাবিয়ার (মুয়াবিয়া) দিকে। অপরদিকে সমস্ত প্রশংসা উজার করে ঢেলে দেওয়া হয়েছে হোসেন ও নবীর (মুহাম্মদের) প্রতি। দেখানো হয়েছে হসেনকে দুগ্ধপোষ্য শিশুর মতন নিষ্পাপ এবং আল্লাহ্‌, ইসলাম, আদর্শ ও মানুষের জন্যে আত্মবিসর্জনকারী এক বিশ্বশ্রেষ্ঠ এক মহান ত্যাগী পুরুষ হিসাবে।

২য় অধ্যায়

কারবালা যুদ্ধের বীজ পোঁতা হয়ে যায় ১ম খলিফা নির্বাচনের সময়েই

যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছে ৬৮০খ্রিষ্টাব্দের ১০ই অক্টোবর। তার আগের বছর মাবিয়া পরবর্তী খলিফা হিসাবে মনোনীত করেন তাঁর পুত্র এজিদকে। মুসলিম ঐতিহাসিকগণ বলেছেন সেটাই হলো কারবালা যুদ্ধের মূল সূত্রপাত। অর্থাৎ তাঁদের মতে কারবালা যুদ্ধের সময়কাল সীমাবদ্ধ মাত্র দুবছর বয়সকালের মধ্য। এই যুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে কিন্তু জড়িয়ে আছে অনেকটা দীর্ঘ সময়। এর সূত্রপাত মূলতঃ ঘটে মুহাম্মদের মৃত্যুর অব্যবহতি পরেই তাঁর উত্তরসূরী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। মুসলিম ঐতিহাসিকগণ যেহেতু ইতিহাস লিখেছেন এটা প্রমাণ করার জন্যে যে, হোসেন ইসলামি সাম্রাজ্য ও ইসলাম ধর্মকে রক্ষা করার জন্যেই কারবালা প্রান্তরে আত্মবলিদান করেছেন। সেজন্যে তাঁরা কারবালার সময়কালকে সীমায়িত করেছে মাত্র দুবছরের অতি স্বল্প সময়কাল ও ততোধিক ক্ষুদ্র পরিসরের সময়সীমার মধ্যে।

যে যে কারণগুলিকে কারবালা যুদ্ধের জন্যে দায়ী করা হয়েছে সেগুলি হলো এ রকম মাবিয়া যখন খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হন তখন কথা ছিল তাঁর পরে খলিফা পদে মনোনীত করতে হবে ইমাম হোসেনকে। এ রকম একটা চুক্তি হয়েছিল মাবিয়া ও ইমাম হাসান (মুহাম্মদের জ্যেষ্ট নাতি ও আলীর জ্যেষ্ঠ পুত্র ) এর সঙ্গে। মাবিয়া এই চুক্তি লঙ্ঘন করে তাঁর পুত্র এজিদকে খলিফা মনোনীত করেন। এর মধ্যে দিয়ে শুধু যে হোসেনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন মাবিয়া তা নয় , আসলে বিশ্বাসঘাতকতা করেন ইসলাম , মুহাম্মদ ও গোটা মুসলমান সমাজের সঙ্গে। এভাবেই বিষয়টিকে চিত্রিত করা হয়েছে। এজিদের খেলাফত মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না আরো একটা কারণে বলে উল্লেখ করা হয়েছেসেটা হলো, এজিদ ছিল স্বৈরাচারী, উচ্ছৃঙ্খল, মদ্যপ ও লম্পট প্রকৃতির যুবক। তার হাতে খেলাফত হস্তান্তর মানেই ইসলামের অপমৃত্যু। সুতরাং ইসলামকে বাঁচাতে এজিদকে ক্ষমতা থেকে সরানো ব্যতীত অন্য বিকল্প ছিল না। তারজন্যে হোসেনকে এজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতেই হয়েছিল। কেন মাবিয়া বিশ্বাসঘাওতকতা করেছিলেন? সে কি অন্ধ পুত্রস্নেহের বশেই কেবল? ঐতিহাসিকগণ বলেছেন, না তা নয়। তাঁরা এর জন্যে দায়ী করেছেন মাবিয়ার বংশ পরম্পরাকেও। মক্কায় হাসেমি ও উমাইয়া এই দুটি বংশের মধ্যে প্রবল বিরোধ ছিল প্রাক-ইসলাম যুগে। মুহাম্মদ ছিলেন হাসেমি বংশের প্রতিনিধি। তিনি যখন ধর্ম প্রচার শুরু করেন তখন সব থেকে বেশী বাধা পেয়েছিলেন উমাইয়া বংশের নিকট থেকে। মুহাম্মদের যাঁরা প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন তাঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন উমাইয়া বংশের প্রতিনিধি আবু সুফিয়ান। এই আবু সুফিয়ান একেবারে বাধ্য হয়েই মুহাম্মদের কাছে আত্মসমর্পণ করে মুসলমান হয়েছিলেন মুহাম্মদ মক্কা জয় করার পরসেই আবু সুফিয়ানের পুত্র ছিলেন মাবিয়া । মুসলিম ঐতিহাসিকগণ তাই বলেছেন যে পিতার পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতেই মাবিয়া ইসলামি সাম্রাজ্যের ক্ষমতা মুহাম্মদের বংশধরদের হাতে না দিয়ে নিজের বংশ ও বংশধরদের হাতে তুলেদিয়েছিলেন। তাঁরা তাই এজিদকে নয় , মাবিয়াকেই কারবালার ঘটনার প্রধান ষড়যন্ত্রী ও প্রধান হোতা বলে চিহ্নিত করেছেন।

কেউ কেউ মাবিয়াকে নয়, প্রধান হোতা বলেছেন এজিদকেই। তাঁরা বলেছেন জয়নব নামে একজন বিধবা কিন্তু অসাধারণ সুন্দরীও এই যুদ্ধের পেছনে বড় কারণ হিসাবে কাজ করেছে। ইমাম হাসান জয়নইবের রূপ-লাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিয়ে করার প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। একই প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন এজিদও। জয়নব সম্মতি জানিয়েছিলেন হাসানের পক্ষেই কিন্তু নাছোড় বান্দা ছিলেন এজিদযে কোনো মূল্যে তিনি জয়নবকে পেতে চেয়েছিলেন। আর এটা সম্ভব করার জন্যে ইসলামি সাম্রাজ্যের ক্ষমতা হাসিল করা তাঁর কাছে অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। সেজন্যে তিনি পিতার উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে তাঁকে বাধ্য করেছিলেন তাঁকে খলিফা মনোনীত করার জন্যেমাবিয়া সেই চাপের কাছে নতি স্বীকার করেছিলেন বাধ্য হয়েই। এদিকে জয়নবের প্রশ্নে শেষ হাসি হেসেছিলেন হাসানই । তারপরে হাসানকে বিষ খাইয়ে হত্যা করিয়েছিলেন এজিদ একজন মহিলার সাহায্য নিয়ে । এজিদ এখানেই ক্ষান্ত হন নি, পরবর্তী পর্যায়ে হাসানের ভাই হোসেনকেও হত্যা করে চূড়ান্ত প্রতিশোধও নিয়েছিলেন।  

খোলা মনে ও নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে বিচার করলে অবশ্য কারবালার ঘটনার জন্যে মাবিয়াকে কোনো প্রকারেই দায়ী করা যায় না এবং এজিদকেও খুব একটা দায়ী করা যায় না। মাবিয়া যেদিন তাঁর উত্তরসূরী হিসাবে তা৬র পুত্রকে নির্বাচিত করেন সেদিনই কারবালা যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরী হয় বলে মুসলিম ঐতিহাসিকরা যে কথা লিখেছেন সেটা ইতিহাসের অতি সরলিকরণ বৈ নয় । পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে এই যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরী হয়েছিল মুহাম্মদের মৃত্যুর পরপরই।  হ্যাঁ, ঠিক তাই। কারণ, মুহাম্মদের মৃত্যুর পর প্রথম খলিফা নির্বাচনে প্রচণ্ড কলহপূর্ণ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিলো। সে পরিস্থিতি কীরূপ প্রকট ও কুৎসিত ছিলো তা শোনা যাক একজন মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতার মুখ থেকেই। তিনি লিখেছেন – “অন্তিম শয্যায় তাঁহারই উম্মমতগণ তাঁহার মুখের উপর তাঁহার নির্দেশ অমান্য করিয়া সত্যের বিজয় তরী বিশাল বিক্ষুব্ধ সাগর অতি কষ্টে পাড়ি দিয়া সবে মাত্র কূলে ভিড়িবার অবস্থায় আসিয়াছে তখনই আরম্ভ হইল অন্তর-বিপ্লব এবং উহার ভরাডুবি।

বিরোধী দল অন্তর-বিপ্লব শুরু করিয়া দিল যাহাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নবীর নিয়োজিত প্রতিনিধি মাওলা আলির হস্তগত না হয়। বিরোধী দল সমস্ত ভিতরে ভিতরে দল পাকাইয়া ফেলিল আলির বিরুদ্ধেএমনই পরিস্থিতির মধ্যে নবী এন্তেকাল করিলেন। এন্তেকালের সময় বিরোধী দলের নেতা ওমর নবীর পার্শ্বে ছিলেন না। আবু বকর ও ওসমানও তথায় ছিলেন না। তাঁহারা তলে তলে সংগঠন করার ব্যাপারে জনমত সৃষ্টি করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন।” (দ্রঃ ইসলামে মতভেদের কারণ, সদর উদ্দিন আহমদ চিশতি, পৃ – ৫৯, প্রকাশনা, ইমামীয়া নিজামীয়া চিশতি সংঘ)। ইসলামি সাম্রাজ্যের খলিফা হতে তথা অসীম ক্ষমতার পদটি পেতে লালসা হয়েছিল অনেকেরই। এ প্রশ্নে সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছিল না। অবস্থা এমন কঠিন হয়েছিলো যে মুহাম্মদের দাফন-কাফনের কাজ তথা অন্তিম সৎকারের কাজ তিন দিন স্থগিত রাখতে হয়েছিলোমুহাম্মদের মৃতদেহ সমাধিস্থ করা হয়েছিলো তিন দিন পর। এ কথাটি ইসলামকে হেয় করার জন্যে মনগড়া কোনো বিদ্বেষমূলক অপপ্রচার নয়। এই কলঙ্কজনক ঘটনাটির বিবরণ যা পাওয়া যায় তা হলোঃ “নির্বাচন একেবারে নির্বিবাদী সম্পন্ন হয় নাই। কারণ, এই নির্বাচন সম্পন্ন করতে দীর্ঘ তিন দিন অতিবাহিত হইয়াছিল।  যাহা হোক রাসূলের দেহত্যাগের তৃতীয় দিবসে আবু বকর খলিফা নির্বাচিত হইয়া দলবল লইয়া মদিনায় ফিরিতেছেন। এদিকে হাসমীগণ এবং মদিনার আনসারগণ নবীর বিয়োগে শোকসন্তপ্ত অবস্থায় অভিভূত হইয়া পড়েন এবং তৃতীয় দিবসে আলির নেতৃত্বে রাসূলুল্লাহর কাফন-দাফন সম্পন্ন করেন(দ্রঃ - প্রাগুক্ত, পৃ –৬০)। অবশেষে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো গিয়েছিলো বটে, কিন্তু সেই সমাধানে সকলের সম্মতি ছিলো না। অনেক হৈ হট্টগোলের পর আবু বকর মুহাম্মদের উত্তরসূরী নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই নির্বাচনে সব চেয়ে বেশী ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন আলী (মুহাম্মদের জামাই)। আলি মুহাম্মদের আপন খুড়তুতো ভাইও ছিলেন। অর্থাৎ সে সময় তিনি ছিলেন মুহাম্মদের একমাত্র জীবিত বংশধর। তিনি মুহাম্মদের জীবনের ছায়াসঙ্গীও ছিলেন। পুরুষদের মধ্যে তিনিই প্রথম ইসলামকে কবুল (স্বীকার) করেছিলেন। অর্থাৎ মুহাম্মদের মৃত্যুর পর তিনিই ছিলেন সবচেয়ে অগ্রবর্তী (senior most as a Muslim)মুসলমান। আলী যখন ইসলাম কবুল করে মুসলমান হন তখনও তিনি নাবালক ছিলেন। তাই তাঁর মতে তিনিই ছিলেন একমাত্র মুহাম্মদের সঠিক উত্তরসূরী এবং সব দিক থেকেই খলিফা পদের সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি। তাই তিনি একদিকে আবু বকরের খলিফা নির্বাচনে যেমন অবাক হয়েছিলেন অপরদিকে তেমনই প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। এবং বলা বাহুল্য যে আলির অনুগামীরাও যারপরনাই অবাক ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। আর ঠিক তখনই কারবালা যুদ্ধের বীজটি পোঁতা হয়ে গিয়েছিল। সেই বীজটি অঙ্কুরিত হয়ে ক্রমে ক্রমে সবার অলক্ষ্যে কারবালা যুদ্ধ নামক বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছিল।

৩য় অধ্যায়

নবীকন্যা ফতেমা আবু বকরকে খলিফা মানেন নি

নিজে খলিফা পদ তথা ক্ষমতা না পেয়ে আলী যতটা হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তার থেকে অনেক বেশী ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন আলীর পত্নী বিবি ফাতেমা। ফাতেমা ছিলেন মুহাম্মদের অতি আদরের একমাত্র কন্যা। তিনি কত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তা ভাষায় প্রকাশ সাধ্যের অতীত। আলী ও ফাতেমার ক্ষোভের সম্পর্কে অবহিত হলে কাল বিলম্ব না করে তাঁদের গৃহে গিয়েছিলেন তাঁদের ক্ষোভ প্রশমিত করার জন্যে। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন মুহাম্মদের আর একজন অতি ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত সাহাবী (অনুগামী ও অনুচর) ওমর ফারুককে। তাঁরা আলীর গৃহের ভিতর প্রবেশ করার পূর্বেই দরজার মুখে দাঁড়িয়েই বিবি ফাতেমাকে সালাম জানান। ফাতেমা মুসলমানদের চোখে অতি আদরণীয় ও আদর্শস্থানীয় রমণী। তিনি খাতুনে জান্নাতউপাধিতে ভূষিত হওয়ার দুর্লভ সম্মানের অধিকারী হয়েছিলেন এবং এখনও তাঁকে সেই উপাধিতে সম্মান প্রদর্শন করা হয়। খাতুনে জান্নাতমানে স্বর্গীয় রমণী বা জান্নাতের (স্বর্গ) নারীদের নেত্রী। সেই ফাতেমা আবু বকর ও ওমরকে তাঁদের গ্ররহের অভ্যন্তরে আমন্ত্রণ করার সৌজন্যটুকু প্রদর্শন কর নি। এ প্রসঙ্গে যে কথাটি খেয়াল রাখা দরকার তা হলো তখন আবু বকর একজন ব্যক্তিমাত্র শুধু নন, তিনি একধারে একটি দৌর্দন্ড প্রতাপশালী রাষ্ট্রের প্রধান এবং আর একধারে তাঁরই (ফাতেমা) পিতার সবচেয়ে প্রিয় , ঘনিষ্ট ও সর্বাধিক  বিশ্বস্ত। ওমরও ছিলেন মুহাম্মদের অতি প্রিয় ও বিশ্বস্ত সাহাবী। তবুও তাঁদের প্রতি তিল পরিমাণ সৌজন্য ও সম্মান প্রদর্শন করেন নি বিবি ফাতেমা উল্টে অপমান করে গৃহের দরজা থেকেই অনেক কটু কথা বলে তাঁদের তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ফাতেমা ওঁদেরকে অনেক রূঢ় স্বরে বলেন, ‘আপনারা খলিফা নির্বাচনে পক্ষপাতিত্ব করেছেন। তারপরেও আপনারা কোন মুখে জনগণের নিকট হতে বয়াত গ্রহণ করেছেন। (দ্রঃ হযরত আবু বকর [রাঃ] , ড. ওসমান গণী, পৃঃ ৬৪) সে সময় ঈখানে মদিন্নার অনেক মানুষ জড়ো হয়েছিলেন, তাঁদেরকে তিনি নালিশের সুরে বলেন, “আপনারা রাসূলের উম্মত, আপনারাই বলুন, খলিফা নির্বাচনে কি ন্যায়-নীতির অনুসরণ করা হয়েছে? শের-ই-খোদা আলি কি মহানবীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ নন? তাছাড়া, তাঁর গুণাগুণ সকলের অপেক্ষা কোনো অংশে কম? তাঁর যোগ্যতা, দক্ষতা, জ্ঞান-গরিমার কথা, বীরত্বের কাহিনী কে না জানেন? বিদায় হজে আব্বাজান (মহানবী) তাঁর সম্পর্কে কী বলে গেছেন?” (দ্রঃ ঐ) ফতেমা কোনো মতেই তাঁর জীবদ্দশায় আবু বকরকে খলিফা বলে স্বীকার করেন নি এবং মেনেও নেন নি। আলীও তাঁর কাছে বয়াত নেন নি (অর্থাৎ খলিফা বলে স্বীকার করেন নি)

অনেক পরে আলি অবশ্য আবু বকরের কাছে বয়াত নেন। সেটা কমপক্ষে ছ’ মাস পর। ফতেমা মারা যান মুহাম্মদের মৃত্যুর ছ’মাস পর, ফতেমার জীবদ্দশায় আলি বয়াত নেন নি। বয়াত নিলেও শেষ পর্যন্ত তাঁর মনের ক্ষোভ মুছে যায় নি। পরিস্থিতি তাঁকে বয়াত নিতে বাধ্য করেছিল এবং একটি বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল বয়াত নেওয়ার পশ্চাতে বলে মনে হয়। তিনি যে মন থেকে আদৌ বয়াত গ্রহণ করেন নি তার অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। সে বিষয়ে একটু পরে আলোচনা করবো। এখন দেখা যাক কেন এবং কোন পরিস্থিতিতে তিনি খলিফা আবু বকরের কাছে বয়াত নেন।

৪র্থ অধ্যায়

আলিও আবু বকরকে মন থেকে খলিফা মানেন নি     

আবু বকর মুহাম্মদের মৃত্যুর পর প্রথম খলিফা হওয়ার পর ইসলামি সাম্রাজ্য কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে নিমজ্জিত হয়। সে সব নিয়ে আলোচনা করার অবকাশ এখানে নেই। আবু বকর কিন্তু দৃঢ় অত্যন্ত হস্তে পরিস্থিতি সামাল দেন এবং ইসলামি সাম্রাজ্যকে বিপদ মুক্ত করে অনেকখানি শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে দিতে সক্ষম হন। মুহাম্মদের মৃত্যু পরবর্তী কালের সঙ্কট যখন কেটে গেল তখন আবু বকর মন দিলেন ইসলামি সাম্রাজ্য বিস্তারের দিকে এবং এক্ষেত্রেও একের পর এক সাফল্য অর্জন করতে তিনি সক্ষম হলেন। এ সময় আলীর ভূমিকা ছিল হতাশাব্যঞ্জক। ফলে একদিকে মুহাম্মদের সাহাবী ও সাধারণ উম্মতদের উপর আবু বকরের নেতৃত্ব ক্রমে দৃঢ় হতে থাকলো, অপরদিকে মুহাম্মদের জামাই ও বংশর হিসাবে আলির প্রতি যে আবেগ ও সহানুভূতি ছিলো তা ক্রমশ ফিকে হতে শুরু করলো। এই সুযোগকে কাজে লাগালেন আবু বকর ও ওমর ফারুক । তাঁরা প্রভূত ক্ষমতার মালিক এখন, সেই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে আলির অনুগামীদের তাদের পক্ষে টানার কাজ শুরু করলেন। আলির অনুগামীরাও ক্ষমতার প্রসাদ লাভের জন্যে তাদের প্রিয় মহানবীর প্রিয় জামাই আলির সঙ্গ ত্যাগ করে আবু বকররের দিকে ঝুঁকতে শুরু করলেন। আলী এক সময় আবিষ্কার করলেন যে তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন। কেউ আর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে চায়ছে না, সবাই তাঁকে চলছেন। এদিকে আবু বিকর থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্যে তাঁর উপার্জনও (গণিমতের মালের অংশ পাওয়া) বন্ধ। ফলে শুরু হয়েছে আর্থিক সংকট। আলিকে আর একটা বিষয় ভাবিয়ে তুলেছিলো, তা হলো ইসলামি সাম্রাজ্যের পরবর্তী খলিফার পদটি হাসিল করার ভাবনা। আবু বকরের কাছ থে দূরে সরে থাকলে তো সেই পদটি তথা ক্ষমতাটি কব্জা করা সম্ভব হবে না। তাই শেষ অবধি তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে আবু বকরের আনুগত্য মেনে নেবেন। তাই তিনি পরবর্তী খলিফা হওয়ার লোভের বশবর্তী হয়ে নিরুপায় হয়েই আবু বকরে কাছে আত্মসমর্পণ করেন ও বয়াত নেন।

আলীর পক্ষে কিন্তু খুবই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হলো এই যে, যে উদ্দেশ্যে তিনি আবু বকরের কাছে মাথা নোয়ান ও বয়াত নেন সে আশা পূর্ণ হয় নি।  আবু বকর খলিফা হওয়ার পর মাত্র দু বছর বেঁচে ছিলেন। তিনি মারা যান ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে। তিনি যখন বুঝতে পারলেন তাঁর মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে তখন সবাইকে ডেকে জানিয়ে দিলেন যে পরবর্তী খলিফা পদে তিনি ওমর ফারুককে মনোনীত করছেন। উপস্থিত সকলেই তাঁর সিদ্ধান্তকে স্বাগত ও সমর্থন জানালেন। একমাত্র আলীই আশা করেছিলেন মুহাম্মদের সবচেয়ে প্রিয় ও বিশ্বস্ত বন্ধু ও সাহাবী (অনুচর) আবু বকর নিশ্চয়ই মুহাম্মদের হাতে গড়া সাম্রাজ্য তাঁর জামাই ও বংশধর আলির হাতে অর্পণ করে মুহাম্মদের প্রতি শ্রদ্ধা কৃতজ্ঞতা নিবেদন করবেন। কিন্তু  আলী গভীর হতাশা নিয়ে শুনলেন যে ইসলামি সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় খলিফা মনোনীত হলেন ওমর ফারুক। এই ঘোষণা (ওমরকে খলিফা করা)  উপস্থিত সকলেই সহর্ষে ওমরকে খলিফা মেনে নিলেন, এটা তাঁর কাছে ছিল সম্পূর্ণ আশাতীত ও অনাকাঙ্ক্ষিতআলীকে পরবর্তী খলিফা মনোনীত না করার জন্যে কোনোদিক থেকেই কোনো প্রশ্ন ওঠে নি। এর কারণ হলো মুহাম্মদের মৃত্যুর পরের দু বছর যে সীমাহীন সংকট ও দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়েছে মুহাম্মদের সাহাবী ও উম্মতদের সেক্ষেত্রে আলীর ভূমিকা ছিল খুবই হতাশাব্যঞ্জক ও নৈরাশ্যজনক , ফলে আলীর প্রতি যে আবেগ ও সহানুভূতি ছিল তা ক্রমশঃ বিরক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। ফলে সবকিছুই আলীকে মুখ বন্ধ করে মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। তাই আবু বকরের মৃত্যুর পর বিনা বাক্য ব্যয়ে ওমররের নিকট গিয়ে বয়াত নিতে আর বিলম্ব করেন নি।

ওমরের প্রতি আলীর আনুগত্য ছিল নিতান্তই মুখোশ মাত্র, অন্তর থেকে তাঁকে তিনি খলিফা মেনে নিতে পারেন নি। ওমরের দশ বছরের খেলাফতকালে এর অজস্র প্রমাণ রয়েছে। এখানে তারই একটা দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যাক। ওমরকে প্রকৃত পক্ষে ইসলামি সাম্রাজ্যের নির্মাতা রূপে ইতিহাস আখ্যায়িত করেছে। কারণ আবু বকর যে সাম্রাজ্যটিকে চারিদিকের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে একটা শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, ওমর সেখান থেকে ইসলামি সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তার ঘটিয়েছিলেন এবং প্রকৃত অর্থেই শিশু ইসলামি রাষ্ট্রটিকে একটি সাম্রাজ্যের চেহারা দিয়েছিলেন। রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যটি জয় করে সেই কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন । সেই কারণে তাঁকে ইসলামি সাম্রাজ্যের নির্মাতা বলে অভিহিত করা হয়। যে ঘটনাটি উল্লেখ করতে চাইছি সেটা পারস্য সাম্রাজ্যকে আক্রমণের পূর্বেকার ঘটনা। ৬৩৮ থেকে ৬৪২ সালের মধ্যেকার ঘটনা। ইসলামের ইতিহাসে কাদিসিয়ার যুদ্ধের একটি বিশেষ জায়গা আছে। এই যুদ্ধটির উদ্দেশ্য ছিল পারস্য সাম্রাজ্য আক্রমণ করা । কাদিসিয়ার যুদ্ধকে মুসলিম ঐতিহাসিকগণ ইতিহাসের একটি সন্ধিক্ষণ বলে বর্ণনা করেছেন, কারণ এই যুদ্ধে ওমরের বাহিনীর পরাজয় হলে ইসলামি সাম্রাজ্যের ধ্বংস অনিবার্য ছিল। আর তা যদি হতো তবে ইসলাম ধর্মটাই ইতিহাসের পাতা থেকে চিরদিনের জন্যে হারিয়ে যেত। যুদ্ধের এমন গুরুত্ত্বের কথা বিচার করে ওমর কয়েকটি নতুন রণকৌশল ও রণনীতি রচনা করেছিলেন। তার মধ্যে একটি হলো তিনি সর্বাধিনায়কের পদ ও গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। আর একটি হলো তিনি ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সামরিক পরিষদ গঠন করেছিলেন। এই সামরিক পরিষদই ওমরের  রণকৌশলের একটি পরিবর্তন করার প্রস্তাব দিয়েছিল যা ছিল অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ ও বাস্তবসম্পন্ন বিবেচনায় ওমর তা মেনে নিয়েছিলেন। প্রস্তাবটি ছিল এ রকম যদি যুদ্ধে পরাজয় ঘটে তবে শত্রুরা চারদিক থেকে মদিনা (ইসলামি রাষ্ট্রের রাজধানী) আক্রমণ করবে, তাই খলিফার মদিনা ছেড়ে যাওয়া সমীচীন হবে না, শত্রুর আক্রমণ থেকে মদিনাকে রক্ষা করার জন্যে কিছু সৈন্য নিয়ে তাঁর মদিনায় থাকা বাঞ্ছনীয় হবে এবং সেক্ষেত্রে সর্বাধিনায়কের গুরুদায়িত্বটি পালনের সব থেকে উপযুক্ত মানুষটি হলেন আলী, তাই আলীকেই এই যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক করা হোক। ওমরের সম্মতিতে ও সর্বসম্মতিতে যখন এই সিদ্ধান্তটি সামরিক পরিষদে গৃহীত হলো তখন আলী বেঁকে বসলেন। সবাইকে বিস্মিত করে তিনি জানিয়ে দিলেন তাঁর অসম্মতি ও অক্ষমতার কথা। আলী কেন খলিফা ও সামরিক পরিষদের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখান করলেন তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। ওমরকে খলিফা হিসাবে মনের ভিতর  থেকে গ্রহণ করতে না পারার জন্যেই এই যুদ্ধে তিনি ইসলামের জয়ের জন্যে ব্যাকুলতাবোধও করেন নি কিংবা ইসলামের পরাজয় ও মুছে যাওয়ার আশঙ্কাতেও বিচলিত হন নি। খলিফা ওমর শেষ পর্যন্ত মুহাম্মদের খালাতো (মাসতুতো) ভাই ও বিশিষ্ট সাহাবী সাদ বিন আক্কাশকে সর্বাধিনায়ক করে যুদ্ধাভিযানের নির্দেশ দেন । এইরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যদিও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এই যুদ্ধে ওমর বিজিয়ীর হাসি হেসেছিলেন তা বলা বাহুল্য এবং তখন আলীর মনের কী অবস্থা হয়েছিল তা সহজেই অনুমেয় ।

৫ম অধ্যায়

নিঃসঙ্গ আলি তৃতীয় খলিফা হতেও ব্যর্থ   

 ওমর ফারুকের রাজত্বকালের সময়সীমা ছিল দশ বছর। এই সময়কালে স্বাভাবিকভাবেই ওমর ও আলীর মধ্যে মানসিক দুরত্ব আরও অধিক বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং এর জন্যে যে আলীই দায়ী ছিলেন তা বলা বাহুল্য। ওমর ছিল ভীষণ ধর্মনিষ্ঠ ও কড়া ধাতের মানুষ। মুহাম্মদের নির্দেশ ও কোরানের বাণী অনুসারে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন, কোনো রকম আপোষ-রফা করতেন না। মুহাম্মদের নির্দেশ ছিল সমগ্র আরবকে মোশরেক মুক্ত (অমুসলমানদের থেকে মুক্ত) করা। মুহাম্মদ যেহেতু মক্কা বিজয়ের মাত্র দু বছর পর আকস্মিকভাবে মারা যান, তাই এই কাজটি নিজে সম্পূর্ণ সম্পন্ন করে যেতে পারেন নি। মৃত্যুর প্রাক -মূহুর্তে এই কাজটি সম্পাদন করার নির্দেশ দিয়ে যান তাঁর সাহাবীদের উপর। আবু বকরও সময় পান নি। ওমর এটা একশভাগ সম্পন্ন করেন। এর ফলে যাঁরা নিরুপায় হয়ে প্রাণে বাঁচার তাগিদে স্বধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে মুসলমান হয়েছিলেন তাঁরা খুব স্বাভাবিকভাবেই ওমরের বিরুদ্ধে ক্রুদ্ধ ও ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন অধিকাংশই। তাঁদেরই কেউ ওমরকে হত্যা করার উদ্দেশ্য ছুরিকাহত করেন এবং সেই আঘাতের কারণেই তাঁর জীবনাবসান হয়। মৃত্যুর পূর্বে তিনিও আবু বকরের পথ অনুসরণ করে একজন বিশিষ্ট সাহাবীকে খলিফা মনোনীত করে যেতে চেয়েছিলেন ব্যাপারে তাঁর পছন্দ ছিল আব্দুর রহমান নামের একজন বিশিষ্ট সাহাবী খলিফা পদের দাবীদার ছিলেন অনেকেই, যাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী আকাঙ্খা আশা ছিল যাঁর তিনি হলেন আলী যাঁরা দাবীদার ছিলেন তাঁদের কারও প্রতি আস্থা বিশ্বাস ছিল না ওমরের, এদিকে আব্দুর রহমানও খেলাফতের দায়িত্ব নিতে অসম্মত হলেন ওমর তখ একটি কমিটি গঠন করে পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের দায়িত্ব সেই কমিটির হাতে তুলে দিলেন এই কমিটির পক্ষে খলিফা নির্বাচনের কাজ দুরূহ হয়ে উঠেছিল, কারণ খলিফা পদের দাবীদার যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে আলী ওসমান গণি দুজনেই শেষ অবধি নিজের নিজের দাবীতে অটল ছিলেন খলিফা তখন কমিটির সম্প্রসারণ করেন এই কমিটিকে খলিফা পদে একজনকে নির্বাচিত করার জন্যে শেষ অবধি ভোটাভুটি করতে হয় ভোটে আলী পরাস্ত হন এবং ওসমান সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে পরবর্তী খলিফা তথা ইসলামি সাম্রাজ্যের তৃতীয় খলিফা নির্বাচিত হন। আলীর তখনও যাঁরা অতি অল্প কয়েকজন অনুগামী ছিলেন তাঁরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং ওসমানকে তাঁরা মানবেন না বলে জানিয়ে দিয়ে সভাস্থল ত্যাগ করেন। খলিফা ওমর কিন্তু কমিটির সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত বলে জানিয়ে দিলেন এবং খেলাফতের দায়িত্ব ওসমান গণির হাতে সঁপে দিলেন। তৃতীয় খলিফা এই ওসমান গণিও ছিলেন মুহাম্মদের আর এক জামাই। তৃতীয় খলিফা হিসাবে ওসমান গণিকে আলী একেবারেই মেনে নিতে পারেন নি। ওসমান গণির খেলাফতকালে নানাভাবে ওসমানকে সমস্যায় ফেলার চেষ্টায় আলী নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। এরই ফলশ্রুতিতে ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দানা বাঁধে এবং শেষ অবধি বিদ্রোহীদের হাতেই তাঁর মৃত্যু হয়। তৃতীয় খলিফা ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং সেই বিদ্রোহে খলিফার মৃত্যুর ঘটনাই কারবালার ঘটনাকে অবধারিত করে তুলেছিল। কিভাবে পরিস্থিতি দ্রুত কারবালা প্রান্তরের যুদ্ধের দিকে এগুচ্ছিল তা নিয়ে আলোচনার পূর্বে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে আলোচনা করে নিতে চায় যা এই লেখার জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক। মুহাম্মদের মৃত্যুর পর খলিফা নির্বাচন কোনোবারই সুষ্ঠ, সুন্দর সাবলীলভাবে যে সম্পন্ন হয় নি তা ইতিপূর্বের আলোচনায় স্পষ্ট প্রতিবারই বেশ কঠিন সমস্যা তৈরী হয়েছে প্রথম খলিফা আবু বকর তাঁর নিজের খলিফা হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা চিন্তা করে পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের জন্যে আলোচনার পথে হাঁটেন নি, খেলাফতের ক্ষমতাবলে মুসলিম উম্মার উপর দ্বিতীয় খলিফা হিসাবে ওমর ফারুককে চাপিয়ে দিয়েছিলেন তিনি যেহেতু খলিফা তাই তাঁর বিরোধিতা করার সাহস কারো হয় নি ওমর খলিফাও সেই পথ ধরে তৃতীয় খলিফা নির্বাচন পর্ব সম্পন্ন করে যেতে চেয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর পূর্বে, কিন্তু পারেন নি তা উপরের আলোচনায় বর্ণনা করা হয়েছে চতুর্থ খলিফা নির্বাচনে সংকট হয়েছিল আরো তীব্র যা কারবালা কান্ডের পরিস্থিতিকে অনিবার্য অধিক নিকটবর্তী করে তুলেছিল কেন এরূপ সমস্যাগুলির উদ্ভব হয়েছিল তার কারণগুলি বুঝতে খুব অসুবিধা হয় না প্রধান কারণগুলি দুটি হলো এরূপঃ এক) খলিফা নির্বাচনে মুহাম্মদ কোনো নীতি ঠিক করে যান নি এটা তাঁর অদূরদুর্শিতার জন্যে হয়ে থাকতে পারে তিনি ভাবতেই পারেন নি যে তাঁর মৃত্যু খুবই সন্নিকটে দুই) মুহাম্মদের সাহাবীরা ছিলেন প্রচন্ড ক্ষমতালোভী প্রধানতঃ এই দুটি কারণের জন্যে খলিফা নির্বাচনের সময় সংকট সৃষ্টি হয়েছে এই সত্যটি কোনো মুসলিম ঐতিহাসিক স্বীকার করেন নি এবং সযত্নে গোপন করে গেছেন অথচ তাঁরাই পঞ্চম খলিফা মাবিয়ার বিরুদ্ধে একটা গুরুতর অভিযোগ করেছেন যে, তিনি তাঁর পরবর্তী খলিফা নির্বাচনে ইসলামের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি লঙ্ঘন করেছেন এবং এটাকে কারবালা যুদ্ধের একটা বড়ো কারণ বলে তাঁরা চিহ্নিত করেছেন। কারবালা যুদ্ধের প্রধান হোতা হিসাবে আসামীর কাঠগড়ায় মুসলিম ঐতিহাসিকগণ মাবিয়াকেই দাঁড় করিয়েছেন এবং তার সপক্ষে তাঁর বিরুদ্ধে আরও বহু অভিযোগ উত্থাপন করেছেন যা অতিশয় পক্ষপাতদুষ্ট। সে সব বিষয় আলোচনা হবে আরো পরে, এখন ফেরা যাক ওসমান গণির খলিফা নির্বাচনোত্তর কালের ঘটনায়।

 

৬ষ্ঠ অধ্যায়

খলিফার বিরুদ্ধে গোষ্ঠীদ্বন্দ মাথা চাঁড়া দিলো – নেপথ্যে আলি

৩য় খলিফা ওসমান গণির খেলাফতকাল (৬৪৪-৬৫৬ খৃঃ) ছিলো খুবই ঘটনাবহুল এবং গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহ হয়েছিলো এবং তিনি বিদ্রোহিদের হাতেই নিজ বাসভবনে নৃশংসভাবে খুন হয়েছিলেন। যে যে কারণে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিলো বলে বলা হয় (অন্ততঃ মুসলিম ঐতিহাসিকগণ যেমনটি বলেছেন) তা মোটেই বস্তুনিষ্ঠ ও সত্যাশ্রয়ী নয়। বিদ্রোহের প্রধান ও আসল কারণটি চতুরতার সঙ্গে মুসলিম ঐতিহাসিকগণ চেপে গেছেন। সে বিষয়ে অতি সংক্ষেপেই আলোচনা করবো কারণ এ লেখায় বিস্তারিত আলোচনা করার পরিসর ও অবসর নেই। কী সেই প্রধান কারণটি সে আলোচনায় যাওয়ার আগে এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখি যে, কারবালা যুদ্ধের সঙ্গে খলিফা ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। প্রথমেই দেখে নেবো মুসলিম ঐতিহাসিকগণ বিদ্রোহের পেছনে কোন কোন কারণগুলিকে দায়ী করেছেন। তাঁরা যে কারণগুলিত কথা উল্লেখ করেছেন সেগুলি হলো – এক). ওসমান গণির কোরান পুড়ানো, দুই). ইসলামি ভূমিনীতি কৃষিনীতির  পরিবর্তন, তিন). রাজস্বনীতির পরিবর্তন, চার). দুর্নীতি ও স্বজন-পোষণ, পাঁচ). উমাইয়া বংশের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট ভুমিকা ইত্যাদি। কোরান গ্রন্থাকারে প্রথম সংকলিত করেন খলিফা ওসমান গণিই। শুধু এই কাজটির জন্যেই তিনি ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারেন তিনি অন্য কোনো কাজ না করলেও। কারণ তিনি এ কাজটি না করলে কোরানের  কথাগুলি হয় তো কালের গর্ভে বিলীন হয়েই যেতো চিরতরে। কোরানের কথাগুলি সংকলিত করে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করার জন্যে তাঁকে জামেউল কোরান বলা হয়। তবুও কোরান সংকলন করার কাজ সম্পন্ন করার জন্যে তাঁকে কম মাশুল দিতে হয় নি। এ কাজটি করার জন্যে বিভিন্ন প্রান্তে বহুজনের কাছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কোরানের বাণিগুলি একত্রিত করে তারমধ্যে যেগুলি জাল বা বিকৃত সেগুলি বাদ দিয়ে একটি আসল কোরান সংকলিত করার জন্যে তিনি একটি কমিটি গঠন করেছিলেন। সেই কমিটির বিবেচনায় যেগুলি জাল ও বিকৃত সেগুলি চিহ্নিত করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো। তারজন্যে মুসলিম জাহানে মুসলিমদের একাংশের মধ্যে এরূপ ধারণা তৈরী হয়েছিলো যে খলিফা তাঁর নিজের স্বার্থে আল্লাহর বাণী পুড়িয়ে নষ্ট করে দিয়ে প্রচণ্ড গর্হিত ও অমার্জনীয় অপরাধ করেছেন।  মুসলিমদের একাংশের মধ্যে তৈরী হওয়া এরূপ ধারণাকে সাহাবিদের কয়েকজন উস্কেও দিয়েছিলেন তাঁদের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে। কিন্তু সমগ্র বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ মনে করে যে কোরান পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ মিথ্যে ও অভিসন্ধিমূলক, তাঁরা সেই কোরানের প্রতিই সম্পূর্ণ আস্থা ও  ভরসা রেখেছেন। খলিফা ওসমানকে সেই সময়ের বিশেষ পরিস্থিতিজনিত কারণে এমন কিছু পদক্ষেপ করতে হয়েছিলো যেগুলি মুসলিম জনতার মধ্যে কিছু বিভ্রান্তি, সংশয় ও সন্দেহের বাতাবরণ সৃষ্টি করেছিলো। একটি স্বার্থাণেষী গোষ্ঠী মানুষের মধ্যেকার সেই সংশয় ও সন্দেহকে খলিফার বিরুদ্ধে জনমত তৈরী করতে ব্যবহার করেছিলো।  খলিফা ওসমানের সময়কালে ছোট্ট ইসলামি রাষ্ট্রটি তখন সাম্রাজ্যে পরিণত হয়ে গিয়েছে। রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা এবং উট ও ঘোড়ার সংখ্যা বিপুলকায় আকার ধারণ করেছে। ফলে আবশ্যক হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয়চারনভূমি। পরিস্থিতির এই দাবি অনুযায়ী খলিফাকে কিছু জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছিলো যার ফলশ্রুতিতে কিছু কৃষককে অনিবার্য কারণেই উচ্ছেদও করতে হয়েছিলো। অন্যদিকে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর জিহাদ ভীষণ লাভজনক পেশা হয়ে উঠেছিলো। জিহাদে অংশগ্রহণকারীগণ সমস্ত লুণ্ঠিত দ্রব্যের (টাকা-পয়সা, ঘোড়া-উট, বন্দি নারী-পুরুষ প্রভৃতি) বখরা (ভাগ)  পেতো।  ইসলামের পরিভাষায় লুণ্ঠিত দ্রব্যগুলি গণিমতের মাল। গণিমতের মাল হিসেবে বন্দি নারীদের ভোগ করাকে ইসলাম আল্লাহর নামে বৈধতা দিয়েছিলো। পুরুষ-বন্দিরা ক্রীতদাস এবং নারী-বন্দিরা ক্রীতদাসী – এই ছিলো আল্লাহর নামে মুহাম্মদের বিধান। এসব কারণে রাষ্ট্রীয় সৈন্যবাহিনীতে নাম লেখানোর জন্যে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে  মদিনায় এসে ভিড় করতো যাদের মধ্যে এমনকি বিধর্মীরাও অনেকেই থাকতো। অপরদিকে ২য় খলিফা ওমর ফারুক ‘লাঙ্গল যার জমি তার’ এই  আইন প্রণয়ন করায় জমি কেনাবেচার সুযোগ অনেকতাই কমে গিয়েছিলো। ফলে গ্রামাঞ্চলে বসবাসের আগ্রহ মানুষের মধ্যে ভীষণভাবেই হ্রাস পেয়েছিলো। এর ফলশ্রুতিতে মদিনায় জনসংখ্যার চাপ এতো বৃদ্ধি পায় যা একটা গভীর সংকটের সৃষ্টি করে। এই সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে ওসমান জমিদারী প্রথার প্রবর্তন করেন। এই নতুন ভূমিনীতি স্বভাবতই ছিলো খলিফা ওমরের ভূমিনীতির পরিপন্থী। কৃষকদের উচ্ছেদ-সহ এই নতুন ভূমিনীতি গ্রহণ করায় খলিফা ওসমানের বিরুদ্ধে  আওয়াজ উঠেছিল যে তিনি ইসলামি নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। খলিফা এসব সিদ্ধান্ত এককভাবে গ্রহণ করেছিলেন এমন নয়।  তৎসত্ত্বেও যাঁরা খলিফার বিরোধী ছিলেন তাঁরা এই ইস্যুগুলিতে মুসলমানদের ভুল বুঝিয়েছিলেন। তার সঙ্গে প্রশাসন পরিচালনায় ছোটখাটো যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিলো সেগুলিকেও অস্ত্র হিসেবে খলিফার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিলো। তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছিলো মক্কার মানুষের মধ্যে বহুকাল থেকে চলে আসা স্পর্শকাতর  বংশ-গোত্রের বিরোধটিকেও।  মুহাম্মদ ছিলেন হাসিম বংশের  লোক আর ওসমান ছিলেন উমাইয়া বংশের লোক। এই দু’ই বংশের মধ্যে কলহ-বিবাদ ছিলো খুবই তীব্র ও পুরানো। মুহাম্মদ মক্কা বিজয় করার পর তাঁর একচ্ছত্র শাসনের কারণে তাঁর জীবদ্দশায়  সেই কলহ-বিবাদ অনেকটাই থিতিয়ে এসেছিলো যা ওসমান খলিফা হওয়ায় আবার মাথা চাড়া দিয়েছিলো। খলিফা ওসমানের পূর্বে মুহাম্মদ এবং আবুবকর ও ওমর ফারুকের খেলাফত কালে প্রশাসনে সর্বদা প্রাধান্য পেয়েছিলো হাসিম বংশ, অপরিদিকে বঞ্চিত থেকে ছে উমাইয়া বংশ। উমাইয়া বংশের লোক ওসমানের আমলে উমাইয়া বংশ সেই বঞ্চনা থেকে কিছুটা মুক্তি পায় এবং প্রশাসনে তাদের প্রতিনিধিত্ব কিছুটা বৃদ্ধি পায়।  এটা মুহাম্মদের বংশধর হাসিম বংশের একটা বড়ো কারণ হয়ে দাঁড়ায়ফলে মদিনার মাটিতে ওসমানের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং খলিফার পায়ের তলার মাটি ক্রমশঃ আলগা হতে থাকে। সেই সুযোগটা নিয়েছিলো বিদ্রোহিরা যারা কুফা, বসরা, মিশর প্রভৃতি অঞ্চল থেকে এসে মদিনায় জড়ো হয়েছিলো। তারা এক সময় একেবারে বিনা বাধায় খলিফার প্রাসাদ অবরোধ করে তাঁকে প্রাসাদে বন্দি রাখতে সমর্থ হয়। সেই অবরোধ ছিলো টানা ৪০ দিন। সে সময় মদিনার মানুষ কেউ খলিফার পাশে দাঁড়ায় নি। তখনও আলি, তালহা, জুবায়ের প্রমুখ সাহাবিগণ (যাঁরা মুহাম্মদের সঙ্গে অসংখ্য জিহাদে বীরের ভুমিকা পালন করেছিলেন) জীবিত ছিলেন, কিন্তু সবাই নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। একজন খলিফার কিছু দোষ-ত্রুটি থাকা স্বাভাবিক নয়, তাই বলে খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে একদল মুসলমান, ৪০ দিন ধরে তাঁকে  বন্দি করে রেখেছে তাঁর বাসভবনে,  বাহির থেকে কোনো খাবার, এমনকি পানীয় জল ঢুকতে পর্যন্ত দিচ্ছে না খলিফার প্রাসাদে, এমন অবস্থা চোখের সামনে দেখেও সাহাবিদের নীরব বসে রয়েছেন ৪০ দিন ধরে – এমন ঘটনা ইতিহাসে সম্পূর্ণ বিরল। খলিফার দোষ-ত্রুটির অন্ত ছিলো না  বলেই সাহাবিগণ তাঁকে রক্ষা করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন – এটা কখনোই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। তাঁদের অবিশ্বাসযোগ্য ও চরম বিষ্ময়কর এই নীরবতার  পেছনে নিশ্চয় কোনো কারণ ছিলো যেটা মুসলিম ঐতিহাসিকগণ চতুরতার সাথে আড়াল করে গেছেন।     

খলিফা ওসমানের জীবনী ও তাঁর খেলাফতকালের ইতিহাস লিখতে গিয়ে মুসলিম ঐতিহাসিক ও আলেম সমাজকে কঠিন সমস্যার মুখে পড়তে হয়। কারণ তাঁর জীবনী ও খেলাফতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছেন মুহাম্মদের জামাই আলি যাঁর স্থান মুসলিমদের কাছে মুহাম্মদের ঠিক পরেইওসমানের খলিফা হওয়ার সময় একমাত্র আলীই ছিলেন ছিলেন তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দী। তাঁর খলিফা হওয়াটা আলী এবং তাঁর অনুগামীরা একেবারেই মেনে নিতে পারেন নি। ওসমানের খেলাফতকালে ইসলামি খেলাফত (সাম্রাজ্য) যখন সংকটে পড়েছে, কিংবা স্ব্যং খলিফা যখন কোনো সংকটে পড়েছেন তখন একবারের জন্যেও আলী তাঁর পাশে দাঁড়ান নি, তাঁকে কোনো প্রকার সহায়তা দেন নি। ২য় খলিফা ওমর ফারুকের মৃত্যুর পর ইসলামি খেলাফত কঠিন সংকটে পড়েছিলো। সে সংকট ছিলো প্রধানতঃ বলিষ্ঠ নেতৃত্বের সংকট। কারণ ওসমান ছিলেন অত্যন্ত নরম প্রকৃতির মানুষ এবং সেটা ছিলো সর্বজন সুবুদিত। ফলে ওসমান খলিফা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারিদিক থেকে ইসলামের শত্রুরা ইসলামি রাষ্ট্রের উপর আক্রমণ শুরু করে দেয়, এবং অপরদিকে একই সাথে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেও বিভিন্ন প্রান্তে বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়। এ রকম এক গভীর সংকটকালে আলির ভূমিকা ছিলো রহস্যময়, সংকট মোকাবিলায় তাঁকে কোনো ভূমিকা নিতে দেখা যায় নি। কিন্তু এতদসত্ত্বেও ওসমান সাফল্যের সাথে সমস্ত বিদ্রোহ এবং বহিঃশত্রুদের আক্রমণ মোকাবিলা করে ইসলামি রাষ্ট্রকে বিপদমুক্ত করতে সক্ষম হন। শুধু তাই নয়, তিনি ইসলামি রাষ্ট্রের বিপুল বিস্তারও ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, ওসমান আলির ভূমিকায় ভীষণ অসন্তুষ্ট হওয়া সত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে কোনো সময় খারাপ আচরণ করেন নি। এমনকি আলিকে উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শনে কখনো কার্পণ্য পর্যন্ত করেন নি। এতদসত্ত্বেও আলি কিন্তু সর্বদা খলিফার থেকে দুরত্ব বজায় রেখেই চলতেন। তবুও খেলাফতের যে কোনো সমস্যা বা সংকটে খলিফা উদার মন নিয়ে আলির পরামর্শ ও সহযগিতা চেয়ে গেছেন। খেলাফতের শেষদিকে তাঁর বিরুদ্ধে সাহাবিদের অসন্তোষ ও ক্ষোভের বিষয়টি যখন তাঁর গোচরে আসে তখনও তিনি আলিকে সেটা অবগত করান এবং তাঁর পরামর্শ ও সহযগিতা চান।     অসন্তুষ্ট সাহাবি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের তাঁর বিরুদ্ধে যে অসন্তোষ বা ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে তা দূর করার জন্যে তিনি আলিকে ভূমিকা নিতে অনুরোধ করেছিলেন। আলি কিন্তু সে অনুরোধ নানা অজুহাতে উপেক্ষা করেছিলেন এবং কঠিন সেই পরিস্থিতিতে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে গুটিয়ে রেখেছিলেন।  আলি একই রকমভাবে নির্বিকার ছিলেন যখন ৪০ দিন ধরে খলিফা তাঁর প্রাসাদে বিদ্রোহিদের দ্বারা অবরুদ্ধ ও বন্দি ছিলেন। এই ঘটনাগুলি যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করতে মুসলিম ঐতিহাসিকদের সমস্যা হওয়ার কথা, হয়েছিলোও, এবং এখনো হয়। কারণ, মুসলিম ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে তাঁরা প্রথমে মুসলিম তারপর ঐতিহাসিক। যদিও আলি ও ওসমান দু’জনেই মুহাম্মদের জামাই ও দু’জনেই বিশ্বস্ত সাহাবি, তথাপি তাঁরা দু’জন মুহাম্মদের চোখে এক সমান ছিলেন না। ওসমানের তুলনায় মুহাম্মদ আলিকে অনেক বেশী স্নেহ ও বিশ্বাস করতেন। কারণ, আলি ছিলেন তাঁর আপন চাচাতো ভাই, বংশধর এবং ওসমানের চেয়ে অনেক বড়ো যোদ্ধা। অপরদিকে ওসমান জামাই ও সাহাবি হলেও তিনি ছিলেন উমাইয়া বংশের প্রতিনিধি যে বংশকে মুহাম্মদ ও তাঁর পূর্বসূরীরা কোনোদিন বিশ্বাস করতেন না। এই পার্থক্যগুলো মুসলিম ঐতিহাসিকদের নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের ক্ষত্রে সর্বদা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকে। প্রকৃত ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার পরিবর্তে আলিকে সমস্ত দোষ-ত্রুটির ঊর্ধে স্থাপন করাকে তাঁরা তাঁদের প্রাথমিক কর্তব্য জ্ঞান করেন। সে কারণে আলির  দোষ-ত্রুটি ও এবং নেতিবাচক ভূমিকার  ঘটনা ও তথ্যগুলি তাঁদের লেখায় পাওয়া যায় না। অপরদিকে ওসমানের বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহ করেছিলো তাদের বিরুদ্ধে নিন্দা যতোটুকু করেছেন তার চেয়ে ঢের বেশী খলিফা ওসমানের সমালোচনা তাঁরা করেছেন। ওসমানের খেলাফতকালের শাসনপ্রণালির দোষ-ত্রুটি এবং ইসলামি নীত-আদর্শ থেকে বিচ্যুতিকেই বিদ্রোহের জন্যে দায়ী করেছেন। খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্যে মূলতঃ খলিফার কাঁধেই দায় চাপিয়েছেন। ফলে খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পশ্চাতে নিহিত থাকা প্রকৃত কারণগুলি এবং বিদ্রোহের পেছনে নেপথ্য ভূমিকায় কে বা কারা ছিলেন তা ইতিহাসের আড়ালে চলে গেছে বা মিথ্যা ইতিহাসের নীচে চাপা পড়ে গেছে। চাপা পড়ে গিয়েছে বোধ হয় চিরিতরেই।

ওসমানের বিরুদ্ধে ইসলামের নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুতির যে অভিযোগগুলি উত্থাপন করা হয়েছে সেগুলি প্রকৃত বিচারে বিচ্যুতিই নয়, সেগুলি ছিল কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নীতির সংস্কার মাত্র। একজন খলিফা হিসেবে ইসলামি রাষ্ট্রের স্বার্থেই বাস্তব পরিস্থিতির চাহিদা অনুসারেই সেই সংস্কারগুলি তাঁকে করতে হয়েছিলো। উপরে সংশ্লিষ্ট স্থানে সেগুলি কিছুটা আলোচনা করা হয়েছে। আর এরূপ সংস্কার তিনি প্রথম করেছিলেন এমন নয়। দ্বিতীয় খলিফা ওমরের সময়েই সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছিলোযেমন ওমরই প্রধানতঃ তালাক নীতিতে একটা বিরাট সংস্কার নিয়ে আসেনকোরান প্রদত্ত তিন মাসে তিন তালাক দেওয়ার আইনের সংস্কার করে একসঙ্গে তিন তালাক দেওয়াকে বৈধ তালাক বলে নতুন আইন প্রণয়ন করেন। তিনি যে ভুমিনীতি (লাঙ্গল যার জমি তার) প্রণয়ন করেছিলেন তা ছিলো কোরান বহির্ভূত নীতি। আরব ও অনারবদের মধ্যে বিয়ে দেওয়ার রীতিকে তিনি নিষিদ্ধ করেছিলেন যা মুহাম্মদ করে যান নি। বায়তুল মাল (সরকারী কোষাগার) থেকে মুহাম্মদের নিকটাত্মীয়দের বেশী পরিমাণে অর্থ দেওয়া তিনি প্রচলন করেছিলেন যা মুহাম্মদ ও আবুবকর করেন নি। এর কুফল পড়েছিলো আরবের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে। একদল ধনী লোকের উদ্ভব হয়েছিলো যা মালিক-শ্রমিক দ্বন্দের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল। এই দ্বন্দ খলিফা ওসমানের সময় ধীরে ধীরে প্রকট হতে শুরু করেছিলো।

মুহাম্মদ যা করেন নি তা করার অর্থ হলে মুহাম্মদের নীতি থেকে বিচ্যুত হওয়া। খলিফা ওমর ফারুকের সময় মুহাম্মদের নিকটাত্মীয়দের জন্যে বায়তুল মাল থেকে বেশী অর্থ দেওয়া শুরু করার ফলে সমাজে একদল ধনী লোকের উদ্ভব হয়েছিলো যা মালিক-শ্রমিক দ্বন্দের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল পরে তা বাড়তে বাড়তে খলিফা ওসমানের সময় প্রকট হতে ও প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে   ধর্মীয় উপাসনার ক্ষেরেও  খলিফা ওমর  অনেক সংস্কার করেছিলেন তারাবির নামায (রমজান মাসে এসার নামাযের পরে অতিরিক্ত নামায) জামাতে পড়ার নিয়ম চালু করেন অর্থাৎ একজন ইমামের পেছনে একসাথে নামায পড়া চালু করেন প্রথমে ৮ (আট) রাকাত তারাবির নামায পড়া হতো, সেটা বাড়িয়ে তিনি ২০ রাকাত করেছিলেন  এ সব সংস্কার ওমর যা করেছিলেন তা সবই ছিলো মুহাম্মদের প্রদর্শিত পথের বাইরে ওমরের এ সব সংস্কার নিয়ে সাহাবী ও সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে কোনো প্রশ্ন ও অসন্তোষ ছিলো না এমনটা নয় অনেকের মধ্যেই নানা প্রশ্ন ও অসন্তোষ থাকলেও কেউ ওমরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার কথা ভাবেন নি। অথচ সেই একই প্রশ্নে খলিফা ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংগঠিত হয়ে গেলো।  এ প্রসঙ্গে আর একটা কথা স্মরণ করা প্রয়োজন যা হলো, ওসমান যে সব সংস্কার করেছিলেন সেগুলি মোটেই মুহাম্মদ প্রদর্শিত ও প্রবর্তিত পথের বিপরীত ছিলো না। কারণ এটা দেখা গেছে যে, যে সমস্যাগুলির মুখোমুখি তিনি হয়েছিলেন তার পূর্ব নজির ছিলো না। ফলে কোরানে সেই সমস্যাগুলি সমাধান করার পথনির্দেশ বা দিকনির্দেশ না ছিলো কোরানে, না মুহাম্মদ প্রদর্শিত পথে। জমিদারী প্রথা প্রবর্তন করে তিনি ইসলামের পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছিলেন বলে যে অভিযোগ করা হয় সেটাকে সঠিক ও বাস্তবসম্মত বলা যায় না।  কারণ জমিনীতি, কৃষিনীতি এবং উৎপাদন ও বণ্টননীতি নিয়ে মুহাম্মদ কোনো স্পষ্ট বিধান দিয়ে যান নি কিংবা দিয়ে যেতে পারেন নি।  তারজন্যেই  ২য় খলিফা ওমরকে ভূমিনীতি প্রণয়ন করতে হয়েছিলো তাঁর সেই ভূমিনীতির (লাঙল যার জমি তার) জন্যে আরবে তখন জমি কেনাবেচা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো যা পরে খলিফা ওসমানের সময়ে গভীর সংকট  রূপে প্রকটিত হয়েছিলো  সেই সংকট নিরসনের জন্যে ওসমান ওমরের ভূমিনীতি বাতিল করে পুনরায় জমি কেনাবেচার পুরানো ব্যবস্থা ফিরিয়ে এনেছিলেন এর জন্যে তিনি ইসলামের আদর্শ ও নীতি থেকে বিচ্যুত হয়েছিলেন এমন অভিযোগ প্রমাণিত হয় না  সুতরাং এ দাবীই জোরালো হয় যে খলিফা ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পশ্চাতে অন্য কারণ নিহিত রয়েছে

সেই কারণগুলি এতোই স্পষ্টরূপে দৃশ্যমান হয় যে কয়েক শ’ বছর ধরে সেগুলিকে আড়াল করে রাখার বা চেপে যাওয়ার মরীয়া চেষ্টা করেও মুছে দেওয়া বা নিশ্চিহ্ন করা যায় নি। প্রকৃত সেই কারণগুলি অনুসন্ধান করে সামনে নিয়ে আসার নৈতিক, সামাজিক এবং ঐতিহাসিক দায়িত্ব আমরা এড়িয়ে যেতে বা অস্বীকার করতে পারি না। সেই কারণগুলি অনুসন্ধান করার আগে একটা কথা বলা আবশ্যক। তা না হলে, একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্য আড়ালে থেকে যাবে। কথাটি হলো – খলিফা ওসমান গণি একটি খেলাফতি শাসনে একটা গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করেছিলেন যাতে স্পষ্টতই কোরানের নির্দেশের উল্লঙ্ঘন। বলা বাহুল্য যে এই সংস্কারের ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই সাহাবি ও সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়াও হয়েছিলো। সেই সংস্কারটির উপর আলোকপাত করা হবে একটু পরে। এখন খলিফার বিরুদ্ধে  বিদ্রোহের আসল কারণগুলি কী কী সেই সেই দিকে দৃষ্টি ফেরানো করা যাক।

 

মুসলিম ঐতিহাসিক ও ধর্মগুরুগণ ওসমানের সমালোচনা করলেও তাঁর ত্রুটিপূর্ণ কাজের জন্যে তাঁকেই সম্পূর্ণ দায়ী করতে চান নি। সুন্নি মুসলিমদের বিচারে ইসলামের ইতিহাসে মাত্র যে চার জন খলিফাকে ‘খোলাফায়ে রাশেদিন’ (সৎপথে পরিচালিত খলিফা) এর মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে তাঁদের মধ্যে ওসমান অন্যতমসুতরাং তাঁকে তো ইসলাম থেকে বিচ্যুত বলা যায় না। তাই তাঁর উপর  আরোপিত ও উত্থাপিত সকল দোষ-ত্রুটির দায় চাপানো হয়েছে তাঁর দু’জন অধস্তন প্রশাসকের উপর। তাঁরা হলে তাঁর প্রধান মন্ত্রী (সচিব) মারওয়ান এবং সিরিয়ার গভর্ণর আমির মাবিয়া (মুয়াবিয়া)। মারোয়ান সম্পর্কে মুসলিম ঐতিহাসিকগণ কী বলেছেন তা শোনা যাক। ড. ওসমান গণি লিখেছেন, হযরত ওসমানের চরম দুর্ভাগ্য যে তাঁর নিকটতম সহযোগী বা প্রধান সচিব বা উপদেষ্টার স্থান লাভ করলো তার চাচাতো ভাই ও জামাতা মারওয়ান। মারওয়ান ছিলেন দুর্নীতি পরায়ণ কুচক্রী মানুষ এবং খলিফা ওসমান ছিলেন ন্যায়পরায়ণ সরল মানুষ।  সুতরাং খলিফা সহজেই মারওয়ানের শিকার হলেন। (দ্রঃ- হযরত ওসমান গণী (রাঃ), পৃ-১৮৩) ভারতীয় মুসলিম সমাজের একজন বিশিষ্ট বিদ্বান ও পণ্ডিত ব্যক্তি আমির আলিও ওই একইভাবে মারওয়ানের বিরুদ্ধে দোষারোপ করে লিখেছেন – তিনি (খলিফা) অজ্ঞাতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁর পরিবারের প্রভাবাধীন ছিলেন। মহানবী কর্তৃক একবার বিশ্বাসভঙ্গের অভিযগে বহিষ্কৃত এবং উমাইয়াদের মধ্যে অন্যতম নীতিজ্ঞানবর্জিত ব্যক্তি সচিব মারওয়ান কর্তৃক পরিচালিত হলেন। (সূত্র – ঐ) অবশ্য মারওয়ান অপেক্ষা অনেক বেশী সমালোচনায় বিদ্ধ করা হয়েছে মাবিয়াকে। সে আলোচনা করা হবে পরে। 

ওসমান গণির সঙ্গে মুহাম্মদ তাঁর মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন এবং  তিনি (ওসমান গণি) আলীর থেকে অধিক যোগ্য বিবেচনায় আলীর বাদ দিয়ে তাঁকেই ৩য় খলিফার জন্য নির্বাচিত করা হয়। এই দুটি ঘটনা প্রমাণ করে যে ওসমান একজন সাধারণ মাপের সাহাবী ছিলেন নাতিনি নিশ্চয়   মুহাম্মদের বিশ্বস্ত সাহাবী এবং প্রাজ্ঞ ও ব্যক্তিত্বশালী মানুষ ছিলেন। এমন একজন খলিফা কলের পুতুলের মতো অন্যের দ্বারা পরিচালিত হয়ে ইসলাম প্রদর্শিত পথ পরিত্যাগ করেছিলেন এমন দাবি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না। আর তা ছাড়া তিনি ইসলামি নীতি বর্জন করে খেলাফত পরিচালনা করেছিলেন – এ অভিযোগও যে ভিত্তিহীন সে কথা একটু আগেই আলোচনা করা হয়েছে। আর ইতিহাস থেকে এ প্রমাণও পাওয়া যায় যে মারওয়ান ও মাবিয়ার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগও বহুলাংশেই মনগড়া ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আসলে তাঁদের প্রধান দোষ (!) ছিলো দুটি – এক). তাঁরা দুজনেই ছিলেন উমাইয়া বংশের মানুষ, এবং দুই). তাঁরা খলিফার প্রতিটি সংস্কারমূলক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপকে সমর্থন করেছিলেন ও সেগুলি আন্তরিকতার সাথে কার্যকর করেছিলেন এবং অন্যান্য সাহাবিদের সমালোচনা ও বিরুদ্ধ প্রচারে সামিল হয়ে খলিফাকে বিব্রত করেন নি। এখন প্রশ্ন হলো উমাইয়া বংশের প্রতি সাহাবিদের কেনো এতো রাগ, ক্ষোভ ও অবিশ্বাস? উমাইয়া বংশের উপর সাহাবিদের প্রবল অবিশ্বাস, সন্দেহ, অসন্তোষ, ক্ষোভ ও ক্রোধের পেছনে প্রধান কারণটি এই যে, মক্কার মাটিতে মুহাম্মদের ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে সব চেয়ে বড়ো এবং প্রায় দুর্লঙ্ঘ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো উমাইয়া বংশের লোকজন। মক্কার অধিবাসীদের আদি বংশ ছিলো কোরেশ বা কোরায়েশ বংশ যারজন্যে তাদের কোরেশ বলে ডাকা হতো। সেই বংশের দু’টো গোত্র বা গোষ্ঠী ছিলো যাদের একটা হাসেমি এবং অপরটি ছিলো উমাইয়া গোষ্ঠী। হাসেমি গোষ্ঠীর লোকজন হাসেমি বংশের লোক এবং উমাইয়া গোষ্ঠীর লোকেরা উমাইয়া বংশের লোক নামে ইতিহাসে অভিহিত। এই দু’ই বংশের মধ্যে মতান্তর ও বিরোধ ছিলো অতিশয় তীব্র, সাপে-নেউলে সম্পর্ক বলতে যা বোঝায় ঠিক সে রকম। মুহাম্মদ ইসলামের পক্ষে মক্কায় খুব কম লোকের কাছ থেকে সাড়া ও সমর্থন পেয়েছিলেন। বরং মুহাম্মদ যখন ইসলামের পক্ষে প্রচার করতে গিয়ে কোরেশদের ধর্মের বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য করতেন তখন তারা তাঁকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতেন, এমনকি মুহাম্মদ তাদের ধর্মকে অপমান করার মাত্রা বাড়িয়ে দিলে তারা শেষ দিকে মুহাম্মদকে নানাভাবে উত্যক্তও করতেন। এক সময় তো কোরেশরা মুহাম্মদ ও তাঁর শিষ্যদের বয়কটও করেছিলেন।  এ সব কারণে মুহাম্মদ এক সময় মক্কা ছেড়ে মদিনা চলে যান। সে সময় যে কতিপয় কোরেশ তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে ইসলামকে কবুল করেছিলেন তাঁরা ছিলো সকলেই হাসেমি বংশের লোক। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন ওসমান গণি যিনি উমাইয়া বংশের লোক ছিলেন। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি স্বধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়েছিলেন এবং বংশ, আত্মীয়-স্বজন এবং নিজ বাসভুমি পরিত্যাগ করে মুহাম্মদের সঙ্গে মদিনা চলে গিয়েছিলেন। এ জন্যেই মুহাম্মদ গোটা উমাইয়া বংশকেই তাঁর শত্রু মনে করতেন। মক্কায় বিজয় হাসিল করার পর কোরেশরা সকলেই প্রাণ রক্ষার্থে স্বধর্ম ত্যাগ করে মুহাম্মদের কাছে আত্মসমর্পণ করলেও তিনি উমাইয়া বংশের লোকের প্রতি মুহাম্মদের বিশ্বাস স্থাপন করেন নি।            

মুহাম্মদের মৃত্যুর পর উমাইয়াদের প্রতি অবিশ্বাস,সন্দেহ ও বিরূপ মনোভাব তো কমেইনি বরং বৃদ্ধি পেয়েছিল ।  ঊমাইয়াদের প্রতি অবিশ্বাস এবং হাসিম বংশীয় লোকদের প্রতি অসীম আনুগত্য প্রর্দশনই তখন হয়ে উঠেছিল যেন একজন সাচ্চা মুসলমানের মাপকাঠিওসমানের খেলাফতকালে উমাইয়াদের বঞ্চনার অবসান কিছুটা কমিয়ে প্রশাসনে তাদের খানিকটা গুরুত্ব প্রদানের কারণে সেই বিরূপ মনোভাব অনেকগুণ বেড়ে যায় এবং প্রায় প্রাক ইসলাম যুগের পর্যায়ে পৌঁছে যায়ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পেছনে এটা একটা বড় কারণ ছিল যে  তিনি ছিলেন উমাইয়া বংশের লোক

ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের দ্বিতীয় প্রধান কারণটি হলো তাঁর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ এবং সময়োপযোগী সংস্কারইসলামের নীতি বিধর্মীদের প্রতি ভীষণ সংকীর্ণ, বিদ্বেষপরায়ণ এবং প্রতিশোধপরায়ণইহুদী ও খৃষ্টানদের প্রতি এই মনোভাব আরও কড়া ও উগ্রওঁদের সম্পর্কে ইসলাম ঠিক কী বলেছে সে কথা বলার আগে ওসমান ইসলামের এই নীতির বাইরে গিয়ে যে সংস্কারটি করেছিলেন সে কথাটি আগে বলে নেওয়া যাক । ইসলামি সাম্রাজ্য তখন অনেক প্রসার লাভ করেছেস্বভাবতই অমুস্লিম নাগরিকদের সংখ্যা ক্রমশঃ বৃদ্ধিলাভ করছে ,ফলে তাঁদের প্রতি ক্ষুদ্র ইস্লামি রাষ্ট্রে যেভাবে কঠিন, বৈষম্যমূলক ও অমানবিক এবং রাষ্ট্রীয় স্বৈরাচারী আচরণ করা সম্ভব ছিল তা এখন আর সম্ভম নয়পরিস্থিতির বাস্তব সম্মত মুল্যায়ণ করে খলিফা বিধর্মীদের প্রতি উদার মনোভাব নিলেন এবং তিনিই প্রথম খলিফা যিনি কিছুটা হলেও ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করলেনসেই নীতির ভিত্তিতে একজন ইহুদী কবি আবদুল্লাহকে বাইতুল মাল (সরকারি কোষাগার) থেকে ঋণ মঞ্জুর করলেনইহুদীদের প্রতি এই উদার মনোভাব হাসিম বংশীয় সাহাবিগণের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভের  কারণ হয়েছিল। এবার দেখা যাক ইহুদীদের সম্পর্কে ইসলাম কী বলেছেকোরানে ইহুদী ও খৃষ্টানদের সম্পর্কে অনেক আয়াত বা নির্দেশ আছে । তারই কয়েকটি হলো এই রকম – ‘ইহুদী ,খৃষ্টান ও কাফেরদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করোনা।’ (৫/৫৭)  ‘... ইহুদীরা অভিশপ্ত ... কিয়ামত পর্যন্ত তাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করেছি ।... তাহারা কিয়ামত পর্যন্ত ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়াবে।’ (৫/৬৪)   ‘ওরাই অভিশপ্ত এবং ওদের যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই ধরবে এবং নির্দয়ভাবে হত্যা করবে’ (৩৩/৬১)  এই প্রসঙ্গে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ কথা উল্লেখ করতে চাইওসমানের পরে আরও কয়েকজন উমাইয়া বংশের প্রতিনিধির খলিফা হওয়ার সুযোগ হয়েছিল, তাঁরা সবাই ওসমান যে ধর্মনিরপেক্ষ নীতির সূচনা করে একটি ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী সংস্কার করেছিলেন সেই কাজটির আরও উন্নতি ও বিস্তার ঘটিয়ে ছিলেন। ঐ বংশেরই একজন খলিফা, পঞ্চম খলিফা আমির মাবিয়া, যাঁকে সরর্বাধিক আক্রমণ ও কালিমালিপ্ত করেছেন মুসলিম ঐতিহসিকগণ সেই নীতির আরও বিকাশ ঘটিয়ে এক আবিশ্বাস্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন যা এই যুগেও উদাহরণ হয়ে রয়েছেএবং তারপরেও আব্বাস বংশ তথা হাসমি বংশ তথা মুহাম্মদের বংশধর আরও কয়েকজন খলিফাও সেই নীতিকে আরও বহুদূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন যাঁরা রাষ্ট্রের নীতি হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন মুত্তাজিলা নীতিএই নীতির মূল কথা হলো – আল্লাহ বা কোরান নয়, রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালিত হবে যুক্তি, বিজ্ঞান ও দর্শন উপর ভিত্তি করেবিশ্ব মানব সভ্যতার পক্ষে খুবই দুঃখজনক ঘটনা হলো মুহাম্মদের অন্যান্য বংশধরগণ পরে খলিফা হয়ে এসে  মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল ও যুগান্তকারি সেই  নীতি বাতিল করে দিয়ে ইসলামি সাম্রাজ্য ও বিশ্বের মুসলিম সমাজকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই মুহাম্মদীয় মধ্যযুগেআবার রাষ্ট্রের নীতি হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল – কোরানই হবে রাষ্ট্রর  মূল পরিচালিকা শক্তি, কোরানের উপর কোনো কথা, কারও কথা চলবে না

অবিশ্বাস্য দ্রুততায় যে জাতি (আরব জাতি) ও সাম্রাজ্যটি অগ্রগতি, উন্নতি ও বিকাশ করে নিজেদের সমৃদ্ধ করছিল এবং বিশ্বকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে সামনে থেকে নেতৃত্ব করছিল হঠাৎই তার ছন্দ পতন হলো মুহাম্মদের গোঁড়া বংশধরদের হাতে। আলো থেকে আবার অন্ধকারের দিকে, সামনে থেকে আবার পেছন দিকে পশ্চাদযাত্রা শুরু করলো ইসলামি সাম্রাজ্যবলা বাহুল্য যে সেই পশ্চাদযাত্রা বিশ্বময় মুসলিম রাষ্ট্রে ও সমাজে আজও অব্যাহত রয়েছে

বিদ্রোহের তৃতীয় কারণটি হলো খলিফা তিনজন গুরুত্বপূর্ণ সাহাবির বিরুদ্ধে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেনতাঁরা হলেন আবুযার গিফারি, আম্মার ইবনে ইয়াসার ও আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদএঁরা তিনজনই মুহাম্মদের স্নেহভাজন ও বিশ্বস্ত অনুগামী ছিলেনএঁদের কোরান ও ইস্লামের ওপর এত পান্ডিত্য ছিল যে এঁদেরকে মহান বিপ্লবী বলা হয় এঁদের প্রথম জনকে খলিফা  নির্বাসন দন্ড দিয়েছিলেন, দ্বিতীয় জনকে রাজ প্রাসাদে সর্বসমক্ষে প্রহার করেছিলেন এবং তৃতীয় জনকে  করেছিলেন গৃহবন্দীএর প্রবল প্রতিক্রিয়া হয়েছিল মদিনার মানুষদের মধ্যে খলফা ওসমান এমনিতেই ছিলেন অত্যন্ত নরম প্রকৃতির মানুষ, তবুও তিনি অনিচ্ছা সত্বেও তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, বরং বলা ভালো যে এই সাহাবিগণ ব্যবস্থা তাঁকে নিতে বাধ্য করেছিলেন এঁরা প্রথম থেকেই নানা প্রশ্নে খলিফার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সমালোচনায় মুখর হতেনতথাপি তাঁদের অতীতের অবদানের কথা ভেবে এবং নিজে যেহেতু অতি নরম প্রকৃতির মানুষ তাই তাঁদের এই খলিফার প্রকাশ্য বিরুদ্ধাচারণকে উপেক্ষা করতেন ।খলিফার এই উদারতা ও মহানুভবতাকে তাঁরা তাঁর দুর্বলতা ও অক্ষমতা মনে করে নিজেদের কখনই সংযত করার কথা ভাবেন নি তাঁরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেনতাঁরা মদিনার বাইরে গিয়ে বিভিন্ন প্রদেশে খলিফার বিরুদ্ধে প্রচার ও জনমত গঠন করার কাজ শুরু করেনএই অবস্থায় খলিফার আর কঠোর না হয়ে উপায় ছিলনা, তাঁকে ইসলামি সাম্রাজ্যের শৃঙ্খলা রক্ষা করতেই তাঁর নিজেরই সহকর্মীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল

বিদ্রোহের পেছনের চতুর্থ কারণটি হলো কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির ব্যক্তিগত আকাঙ্খার অপূর্ণ থাকাতাঁরা হলেন মুহাম্মদ বিন আবু বকর, মুহাম্মদ বিন আবু হুজাইফা এবং আবদুল্লাহ বিন সাবাএই তিন জন ব্যক্তির বংশগত ঐতিহ্য ও ইসলামের কঠিন সংগ্রামের ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ব্যাপক পরিচিতি ও মুসলিম সমাজের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ছিলপ্রথম জন হলেন মুহাম্মদের নিকটতম বন্ধু ও দ্বিতীয় খলিফা আবু বকরের কনিষ্ঠ পুত্র, দ্বিতীয় জন মুহাম্মদের অন্যতম প্রধান শত্রু উমাইয়া বংশের প্রভাবশালী নেতা আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দার বংশধরহুজাইফা ওসমানের মতই ব্যতিক্রমীদের একজন যিনি উমাইয়া বংশের লোক হয়েও প্রথম দিকেই মুহাম্মদের শিষ্য হয়েছিলেন এবং যে দলটি প্রথম মক্কা থেকে আবিসিনিয়া হিযরত করেছিল সেই দলে ছিলেনআর তৃতীয় জন ইহুদী সম্প্রদায় থেকে এসে মুহাম্মদের ধর্ম গ্রহণ করেছিলেনআবু বকরের পূত্র মহম্মদের আর একটি পরিচয় আছেআবু বকরের মৃত্যু পর তাঁর কনিষ্ঠ বিধবা পত্নীকে বিয়ে করেছিলেন আলী মহম্মদ তখন নাবালক সন্তান, তিনি আলীর কাছেই প্রতিপালিত হয়েছিলেনতিনি তাই আশা করেছিলেন যে ওসমানের প্রশাসনে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ ও মর্যাদা পাবেন। সে আশা তাঁর পূরণ হয় নিঅন্যদিকে হুজাইফার ইসলামের ইতিহাসে যে অবদান আছে তা অবিস্মরণীয় । তিনি শুধু মুহাম্মদের প্রিয় সাহাবিই ছিলেন না ,তিনি আবু বকরের খেলাফত কালে একটা যুদ্ধে (জেহাদে) মৃত্যুবরণ করেছিলেনতখন তাঁর (হুজাইফা) পূত্র মহম্মদের (এই নামটি স্বয়ং হযরত মুহাম্মদ রেখেছিলেন) শিশু বয়সওসমান গণি তখন সেই অনাথ মহম্মদকে নিজের কাছে রেখে মানুষ করেছিলেনতিনিও আশা করেছিলেন একটা বড় ও ক্ষমতাপূর্ণ পদ পাবেন কিন্তু সে আশা তাঁরও পূর্ণ হয় নিতৃতীয় জন অর্থাৎ সাবার পূত্র আবদুল্লাহ ছিলেন আলীর অন্ধ অনুরাগীতিনি আলীকেও মুহাম্মদের মতই আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ তথা রসুল মনে করতেন । আলী খলিফা হতে না পারায় প্রথম থেকেই ক্ষুব্ধ ছিলেনওসমানের খেলাফত কালে ব্যাপক খলিফা বিরোধী মানুষ পেয়ে অতি সোৎসাহে নেমে পড়েছিলেন খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংগঠিত করার কাজেউক্ত তিন জন নিজেদের স্বার্থ ও অভিলাষ পূরণ হয় নি বলে মিশর গিয়ে ঘুরে ঘুরে বিদ্রোহের পক্ষে জনমত সংগঠিত করেছিলেনএই তিন জন বিশিষ্ট ব্যক্তি খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেনতাঁরা যে ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার আশায় ওসমানকে খলিফা পদ থেকে অপসারিত করতেই বিদ্রোহ সংগঠিত করেছিলেন সে কথা অনেক মুসলিম ঐতিহসিক স্বীকার করেছেনড.ওসমান গণি এ প্রসঙ্গে লিখেছেন –আবু বকরের কনিষ্ঠ পূত্র মুহম্মদ ও বিখ্যাত সাহাবী আবু হুজাইফার পূত্র মুহম্মদ আপন আপন ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধির জন্য , রাষ্ট্রীয় শক্তিকে কুক্ষিগত করার জন্য, যুদ্ধের মাল ও উপসত্বকে ভোগ করার জন্য, উচ্চপদে অধিষ্ঠীত হওয়ার জন্য, সমগ্র মিশরবাসীকে নিয়ে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে আরম্ভ করলেন, বিদ্রোহ দানা বাঁধলযা পরে একদিন মহিরুহতে পরিণত হয়েছিল ( দ্রঃ প্রাগুক্ত, পৃ-৭২ )

 ৭ম অধ্যায়

বিদ্রোহীদের খলিফা ওসমানের মৃত্যু ও আলির খেলাফত হাসিল

পঞ্চম ও প্রধান কারণ ছিল আলি ও আরও দুজন বিশিষ্ট সাহাবির (জুবায়ের ও তালহা)  খলিফা হওয়ার তীব্র খায়েসতাঁরা তিনজনেই বিদ্রোহকে মদত দিয়েছিলেন এই আশায় যে খলিফাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারলেই  তাঁদের সামনে খলিফা হওয়ার রুদ্ধ পথটি খুলে যাবেচারদিকে যখন বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে, বিশেষ করে খলিফা যখন চল্লিশ দিন ধরে অবরুদ্ধ, বিদ্রোহিরা  রাজ প্রাসাদে খাবার জল পর্যন্ত প্রবেশ করতে দিচ্ছেনা, তখন তাঁরা খলিফাকে রক্ষা করার যাবতীয় নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব ভুলে গিয়ে খলিফার সিংহাসনটা কিভাবে হস্তগত করা যায় সে চিন্তাতেই বিভোর হয়েছিলেনকারণ তাঁরা জানেন যে বিদ্রোহিরা তাঁদেরই লোকবিদ্রোহিদের মধ্যে তিনটি দল ছিল এবং তারা উক্ত তিনজন সাহাবির অনুগামী ছিলেনএকদল চেয়েছিল খলিফা পদে আলীকে ,একদল চেয়েছিল যুবায়েরকে এবং একদল চেয়েছিল তালহাকেআলীর অনুগামীরা ছিল বিপুল সংখ্যাগরিষ্, তাই ওদের মধ্যে খলিফা নির্বাচনকে ঘিরে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ খুব প্রকট হয় নিওসমানকে হত্যা করে মদিনাবাসীকে সবাই একমত হয়ে জানিয়ে দিয়েছিল যে তারা আলীকেই খলিফা পদে দেখতে চায়বলা বাহুল্য যে, বিদ্রোহিদের বিরুদ্ধে কথা বলার কোনো পরিবেশ ও পরিস্থিতি ছিল না আলী তাই অতি সহজেই  এবং বিনা বাধায় খলিফার সিংহাসনে আরোহণ করেনএইভাবে বিদ্রোহের রক্তপিচ্ছিল পথ বেয়ে ও বিদ্রোহিদের রক্ত মাখা হাত ধরে বহু আকাঙ্খিত খলিফা পদটি হস্তগত করতে সক্ষম হনমুসলিম ঐতিহাসিকগণ এই ঐতিহাসিকভাবে সত্য ঘটনাকে সম্পূর্ণ আড়াল করে গেছেন ,উল্টে তাঁরা দাবী করেছেন যে ওসমান গণিকে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন বিদ্রোহের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে কিন্তু ওসমানের ভুলের জন্যেই তাঁকে রক্ষা করতে পারেন নিকিন্তু বিদ্রোহের পেছনে আলীর যে মদত ছিল তার বহু প্রমাণ আছে তা আজও দেখতে পাওয়া যায়এখানে পরিসর কম বিধায় মাত্র দুটি প্রমাণ তুলে ধরতে চায়বিদ্রোহিরা খলিফাকে ৪০দিন অবরুদ্ধ রাখার পর তাঁকে হত্যা করেহত্যা করার পর পরবর্তী খলিফা নির্বাচন না করা পর্যন্ত তিন দিন খলিফার মৃতদেহ রাজ প্রাসাদে আটকে রেখেছিলমদিনার বিশিষ্ট সকল মানুষ একে একে গিয়ে অনুনয় বিনয় করে বলেছিল আগে খলিফার দাফন –কাফন (অন্তিম সৎকার) করতে দাও তারপর যাকে তোমরা বলবে তাঁর হাতেই আমরা বয়াত নেব। কিন্তু কারও কথা তারা শোনে নিসবাই তখন আলীকে গিয়ে অনুরোধ করলো, আপনি একবার গিয়ে অনুরোধ করুন ,হয়তো আপনাকে ওরা ফিরিয়ে দিতে পারবে না । আলী তখন বিদ্রোহীদের কাছে গিয়ে মৃত খলিফার লাশ চায়লেনবিদ্রোহিরা তাঁর হাতে ওসমানের লাশ তুলে দিল বলা বাহুল্য যে এই ঘটনা থেকে এটা স্পষ্ট প্রমাণিত হয় - বিদ্রোহিদের ওপর আলীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল এবং বিদ্রোহীরাও ছিল আলির অনুগতএই বিদ্রোহীরা আলির সম্মতি কিংবা ঈশারা ব্যতীত দোর্দন্ড প্রতাপশালী ও অমিত ক্ষমতাধর খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার কথা কল্পনাতেও আনবেনা তা শিশুরাও বোঝে

বিদ্রোহের পেছনে আলির প্রচ্ছন্ন হাত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় খলিফার মৃত্যুর পরবর্তীকালের ঘটনাপঞ্জী থেকেএই বিষয়ে পরে একটু বিস্তারিত আলোচনা হবে, এখন প্রসঙ্গহেতু একটি ঘটনার উল্লেখ করা হচ্ছেখলিফার দাফন-কাফন (অন্তিম সৎকার) শেষ হলে বিদ্রোহীরা মদিনার মানুষকে ডেকে বললো, এবার আপনাদের চতুর্থ খলিফা নির্বাচন করতে হবেচতুর্থ খলিফার হাতে সাম্রাজ্যের ভার তুলে দিয়ে আমরা মদিনা ত্যাগ করতে চাইপ্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে বিদ্রোহীরা মদিনার বাইরে থেকে, মূলতঃ মিশর, কুফা ও বসরা প্রদেশ থেকে এসেছিলবিদ্রোহীরা নিজেরাই চতুর্থ কফলিফার নাম প্রস্তাব করলোতারা বললো, আমরা প্রিয় শেষ নবীর জামাতা ও বংশধর হযরত হায়দার আলির নাম প্রস্তাব করছি, বলুন আপনাদের মতামত কী? যারা খলিফাকে নির্দয়ভাবে হত্যা করার দুঃসাহস রাখে তাদের মতের বাইরে গেলে তার পরিণাম কী হতে পারে তা পাগলেও বোঝেস্বভাবতই কোনো বিকল্প নাম প্রস্তাবিত হয় নি এবং  চতুর্থ খলিফা পদে বিদ্রোহীদের প্রস্তাবে (হুকুমে) আলি অধিষ্ঠিত হনআলি চতুর্থ খলিফা হিসাবে দায়িত্বভার নেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে বিদ্রোহীরা খলিফার হাতে আত্মসমর্পণ করে  তৃতীয় খলিফা ওসমানের নিহত হওয়ার পর চতুর্থ খলিফা হিসাবে আলির নাম প্রস্তাব এবং বিনা বাধায় তা গৃহীত হওয়ার ঘটনাটি যে একটা সাজানো ব্যাপার বা পূর্বপরিকল্পিত তা দিনের আলোর চেয়েও স্পষ্ট

মুসলিম ঐতিহাসিকগণ কিন্তু অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় দাবী করেছেন যে আলি ছিলেন সম্পূর্ণ নির্দোষতিনি এমন জঘন্য কাজ করতেই পারেন না কারণ তিনি ছিলেন শিশুর মত নিষ্পাপসমস্ত ঘটনা প্রবাহ থেকে যেখানে অসংখ্য স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে যে বিদ্রোহের সঙ্গে আলির যোগ ছিল সেখানে আলিকে সম্পূর্ণ নির্দোষ বলে রায় এক জঘন্য মিথ্যাচার বৈ নয়এক কঠিন ও নির্মম সত্যকে এক জঘন্য মিথ্যা দিয়ে ঢাকার এক কুৎসিত এমন অপপ্রয়াস ইতিহাসে বিরলসচেতনভাবে এই মিথ্যাচার করা হয়েছেএবং তা করতে গিয়ে তাঁদের অনেক অসংলগ্ন ও পরষ্পরবিরোধি কথা বলতে হয়েছে বা মন্তব্য করতে হয়েছেতাঁরা বলেছেন আলি নির্দোষ এবং মারওয়ান ও মাবিয়ার দ্বারা ওসমান ভুলপথে  পরিচালিত হয়েছিলেন তাই বিদ্রোহ সংঘঠিত হয়েছে, আবার তাঁরাই অন্য জায়গায় আক্ষেপের সুরে স্বগতোক্তির মত বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়া ও বিদ্রোহে খলিফার মৃত্যুর জন্যে দায়ী করেছেন আলি, যুবায়ের ও আবু তালহার মত জগদ্বিখ্যাত সাহাবিদের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তাকেই.ওসমান গণি তাঁর উপরে উল্লেখিত গ্রন্থের ১৫৮ পৃষ্টায় লিখেছেন-‘... তাঁরা আজ সংখ্যাতে অনেক, সম্পদেও অনেক ধনশালী হয়েও, মাত্রা কয়েক হাজার উচ্ছৃঙ্খল মানুষরূপী বানরের নিকট হীনতা ও বশ্যতা স্বীকার করলো। মদীনাবাসীগণনিশ্চয় সেদিন কাপুরুষের কাপড় পরে নারী অপেক্ষাও অধম হয়ে গিয়েছিলবিশেষ করে তালহা ও যুবায়ের কি করছিলেনতাঁরা কি আপন আপন ধনভান্ডার গোছাতে ব্যস্ত ছিলেন আরো দুঃখ ‘শেরে খোদা’, হযরত আলিকে যখন তারা বাধা দিলেনএবং তিনি বাধা মেনে নিলেন । তাহলে তখন কি তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে তিনিই ইসলামের ‘শেরে খোদা’এরপরও যখন দ্বিতীয় পর্যায়ের ঘটনা ঘটলো নবী পত্নীকে নিয়ে তখনও তিনি কোন কারণে, কিসের ভয়ে খায়বারের সেই ঐতিহাসিক তলোয়ারটি বার করলেন না। বিচক্ষণ আলি,মহাজ্ঞানী আলি, মহাবীর আলি, সেই অবস্থার পূর্ণ মোকাবিলা তিনি যা কিছুই করতেন ,তাতে তাঁর বীরত্ব ও মহত্ব কমে যেত, না বেড়ে যেত ।তাঁদের সেদিনের সেই মনোভাবকে ইসলামের ইতিহাস কোন পথে কোন সূত্রে ক্ষমা করবে’ মুসলিম ঐতিহাসিকরা যাই বলুন না কেন প্রকৃত সত্য ঘটনা হলো খলিফা ওসমান্বর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও তাঁকে হত্যা করার পশ্চাতে আলির প্রচ্ছন্ন ভূমিকা ছিল। এ সত্য ঘটনাটি স্বীকার করেছেন পৃথিবীর খ্যাতনামা বহু ঐতিহাসিকই। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রেনল্ড অ্যালন নিকলসনের লেখা ইতিহাসতেও তার উল্লেখ রয়েছে। তিনি লিখেছেন, “এদিকে পয়গম্বরের ঘনিষ্ঠ যারা প্রকৃত ইসলামের অনুসারী ছিলেন – আলি, তালহা এবং যুবাই-এর নেতৃত্বে সেই মুসলিমরা এই ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে সরব হয়ে ওঠেন। উমাইয়া রাজবংশের দাম্ভিকতা অর্থগৃধ্নুতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের এক পরিস্থিতি তৈরি হয়। বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। শেষ পর্যন্ত প্রবীণ খলিফা নিজ বাড়িতে আবদ্ধ থাকার পর খুব হন। আরবদের ইতিহাসে যুগান্তকারী এই ঘটনা

পয়গম্বরের ভাই এবং জামাতা আলি এতকাল ছিলে নেপথ্যে। এবার সেই খলিফার আসনে বসেন। উসমানের খুনিদের সঙ্গে তাঁর  যোগাযোগ ছিল কি না এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সে প্রশ্নকে না তুলেও বলা যায়, উসমানকে বাঁচানোর না চেষ্টা করে,উসমানের ভাগ্য অনিশ্চিত ভাগ্যের দিকে ঠেলে দিয়ে আলি এক অপবাদ উপযোগী  দুর্বলতা দেখিয়েছিলেন।” (দ্রঃ আরবী সাহিত্যের ইতিহাস, এ আর নিকলসন, পৃঃ ১৮৭-১৮৮) প্রসঙ্গত  এখানে জানাই যে এমন অনেক ঐতিহাসেন আছেন যাঁদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের ইসলামের প্রতি বিদ্বেষের অভিযোগ রয়েছে। নিকলসন কিন্তু সেই দলের মধ্যে পড়েন না। বরং তিনি মুসলিমদের কাছে একজন নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক হিসাবে সমাদৃত। তাঁর এই বইটির বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করেছে কলকাতার একটি মুসলিম প্রকাশনা – মল্লিক ব্রদার্সএই প্রকাশনাটির প্রভূত সুনাম রয়েছে দুই বাংলার (ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের) শিক্ষিত মুসলিম সমাজে। দুই দেশের মুসলিম মুসলিম সমাজে সমাদৃত হন আর একজন সুবিখ্যাত ঐতিহাসিক ফিলিপ কে হিট্টি। তাঁর লেখা ইসলামের ইতিহাস থেকেও এ প্রমাণ পাওয়া যায় যে খলিফা উসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও বিদ্রোহিদের সঙ্গে আলির যোগাযোগ ছিলো। তিনি লিখেছেন, “স্বজনপোষণের অভিযোগ ক্রমেই বাড়তে থাকে। প্রশাসনের বিরুদ্ধে জনরোষ বাড়ছিল দিন দিন। পাশাপাশি কুরাইশপন্থী তিনজন তাঁর উত্তরাধিকারের দাবিদার হয়ে ওঠেন। এঁরা হলেন আলি, তালহা এবং আল-যুবাইর। আলির অনুগামীরা আল-কুফায় বিদ্রোহ করেন। মিশরে যে তাঁর অনুগামীর সংখ্যা বেশ ভালোই ছিল তা বোঝা যায় ওই বিদ্রোহের বহর দেখে। মিশর থেকে ৬৫৬ খৃষ্টাব্দের এপ্রিলে ৫উ বিদ্রোহীকে আল-মদিনায় পাঠানো হয়। বিদ্রোহীরা শরের বিশিষ্ট অশীতিপর খলিফাকে একটি বাড়িতে আতক করে রাখে। এরপর যখন ঐ বাড়িতে কুরআন পাঠে রত ছিলেন, তখনই বাড়িটিকে ধ্বংশ করে দেওয়া হয়। তাঁর পূর্বসূরী বন্ধু আবু-বকরের পুত্র মুহাম্মদ বলপূর্বক তাঁর ঘরে ঢোকেন এবং প্রথমে তাঁর উপর হিংসাত্মক আচরণ করেন। ফলে এই প্রথম মুসলমানের হাতেই এক মুসলিম খলিফার মৃত্যু হয় (৬৫৬ খৃষ্টাব্দের ১৭ই জুন) ইসলামের যুগান্ত সৃষ্টি হয়েছিল মুহাম্মদের প্রেরণা পেয়ে এবং আল-মদিনার মতো পবিত্র স্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত এই বিশাল ইসলামি সাম্রাজ্য শেষ পর্যন্ত সিংহাসনের দাবীদারদের অন্তর্দ্বন্দে দীর্ণ হয়ে পড়ল। আলি এবং তালহা ও আল-যুবাই-এর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত শুরু হল। মুয়াবিয়াও শামিল হলেন এই লড়াইয়ে। (দ্রঃ আরব জাতির ইতিহাস, ফিলিপ কে. হিট্টি, পৃষ্ঠা – ১৬৮) 

৮ম অধ্যায়

আলির বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ শুরু

ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল এক গভীর ষড়যন্ত্রের ভয়ঙ্কর পরণতি এবং সেই বিদ্রোহে তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যু ছিল সেই ষড়যন্ত্রেরই এক অতি বেদনাদায়ক ও বিয়োগান্ত কালা অধ্যায় ইতিহাসের এই মর্মান্তিক ও কলঙ্কজনক ঘটনার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছিলএই ঘটনাটিই একেবারে অনিবার্য করে তুলেছিল কারবালার যুদ্ধের বিয়োগান্ত  অধ্যায়কে এবং কারবালা যুদ্ধের পেছনে অন্যান্য যে সব কারণগুলি আছে তাদের মধ্যে প্রধান কারণ হলো এই ঘটনাটাইখলিফা ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও তজ্জনিত কারণে তাঁর মৃত্যু মোটেই স্বাভাবিক ঘটনা ছিলনাতিনজন সাহাবির ক্ষমতালাভের আকাঙ্খা, বিশেষ করে আলির তীব্র আকাঙ্খা খলিফার বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসন্তোষগুলিকে বিদ্রোহের পরিণতি দিয়েছিলতাঁরা যদি অন্যান্য কম প্রভাবশালী সাহাবিদের এবং সাধারণ মুসলিম জনতার মনে নানা কারণে তৈরী হওয়া অসন্তোষকে মদত ও প্রশ্রয় না দিতেন তবে বিদ্রোহ কখনই দানা বাঁধতে পারতনাঅপরদিকে খলিফা ওসমান যদি আলি, যুবায়ের ও তালহার মত ক্ষমতার প্রতি তীব্র মোহগ্রস্ত হতেন তাহলেও বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে যেত ।তিনি ক্ষমতায় ছিলেন এক যুগ, কিন্তু তবুও ক্ষমতা তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি, তাই ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য তিনি তাঁর ক্ষমতা (একজন খলিফার ক্ষমতা) প্রয়োগ করেন নিতিনি অদ্ভুতভাবে তাঁর জীবনের অন্তিম মূহূর্তেও নিজের জীবন ও ক্ষমতার প্রতি নিরাসক্ত ,নির্মোহ ও উদাসীন ছিলেনআমির মাবিয়া (মুয়াবিয়া) সেই সময় ছিলেন সিরিয়ার গভর্ণর যাঁকে মুসলিম ঐতিহাসিক ও ধর্মগুরুরা কারবালা যুদ্ধের প্রধান হোতা বলে অভিযুক্ত করছেন এবং যাঁর প্রতি জঘন্য জঘন্য কুৎসিত অভিযোগ আরোপ করেছেন  তিনি খলিফার জীবন নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন ছিলেনবিদ্রোহ যে আসন্ন  এবং বিদ্রোহের পেছনে কারা আছেন সে কথা তিনি অনুধাবন করতে পেরে খলিফাকে বাঁচানোর জন্য একটা মরিয়া প্রয়াস চালিয়েছিলেন খলিফাকে তিনি দুটি প্রস্তাব দেনপ্রথম প্রস্তাবে তিনি রাজধানী মদিনা থেকে দামেস্কে(সিরিয়ার রাজধানী) স্থানান্তরিত করার জন্য অনুরোধ করেনদ্বিতীয় ও বিকল্প প্রস্তাবে অনুরোধ করেন সেনাবাহিনী থেকে তাঁর জন্য নিরাপত্তা কর্মীবাহিনী রাখতেতিনি চেয়েছিলেন সিরিয়া থেকে কিছু বিশ্বস্ত ও দক্ষ সেনা পাঠিয়ে খলিফার প্রাণ রক্ষা করতে খলিফা দুটো প্রস্তাবই ফিরিয়া দেনপ্রথম প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, আমার প্রিয় নবী এই মদিনা শহরে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন এবং তিনিই এই মদিনাকে রাজধানীর মর্যাদা প্রদান করেছেন, আমার প্রিয় নবীর পদস্পর্শে ধন্য এবং অসংখ্য ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতিবিজড়িত এই শহরকে আমার তুচ্ছ প্রাণের জন্য আর ততোধিক তুচ্ছ খেলাফত রক্ষার জন্য আমি কখনই মদিনাকে ত্যাগ করতে পারব নানিরাপত্তা রক্ষীর প্রশ্নে বলেন, আল্লাহ ছাড়া আমি কারও প্রতি ভরসা রাখতে চাইনা,আল্লাহই আমাকে রক্ষা করবেন। সেনাবাহিনী মোতায়েন করলে মদিনার সাধারণ মানুষের অসুবিধা হবে,আমি প্রাণের কথা ভেবে জনসাধারণের অসুবিধা করতে পারি নাতিনি চাইলেই বিদ্রোহ দমন করতে পারতেন, পারতেন অতি সহজেই তাঁর প্রাণ ও খেলাফত রক্ষা করতেতা যদি করতেন তাহলে হয়তো কারবালা যুদ্ধের ঘটনাও ঘটতো নাআর এই পথে ইতিহাস এগিয়ে যেতে থাকলে মুসলিম সমাজ শিয়া ও সুন্নি এই দুটি পরষ্পর শত্রুতামূলক দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হতো না

এক ভয়ংকর অস্বাভাবিক পরিস্থিতি ও অস্থিরতার মধ্যে চতুর্থ খলিফার দায়িত্বভার নিজ স্কন্ধে তুলে নিলেন আলিখলিফা ওসমানের বিরুদ্ধে মদিনার মানুষের কিছু অসন্তোষ ছিল ঠিকই, কিন্তু তাঁরা কখনও কল্পনাও করেন নি যে তাঁদের খলিফাকে এভাবে হত্যা করা হবে এবং তারপর এক দঙ্গল খুনির রক্তমাখা হাত ধরে আলি খলিফার সিংহাসন দখল করবেনতাই মদিনা ও সমগ্র মুসলিম জগতে পরিস্থিতি দ্রত পাল্টাতে শুরু করলোএক সময় ওসমানের বিরুদ্ধে কিছু পরিমাণে যে অসন্তোষ ছিল তা খুব শীঘ্রয় সহানুভূতি ও আবেগে পরিণত হলো এবং অপরদিকে আলির প্রতি যে শ্রদ্ধা ও নবীর বংশধর বলে যে আবেগ ছিল তা ক্রমশঃ হ্রাস পেতে শুরু করলোগোটা মুসলিম জাহানে আওয়াজ উঠল ওসমানের হত্যাকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে কঠোর সাজা দিতে হবে  আওয়াজ তুলেছিলেন যুবায়ের, তালহার মত বিশিষ্ট সাহাবিগণওঅবশ্য  সবচেয়ে সোচ্চার ছিলেন সিরিয়ার গভর্ণর আমির মাবিয়াতিনি খলিফা আলির হাতে বয়াতই (আনুগত্যের শপথ) নেন নি, বলেছিলেন, ওসমানের হত্যাকারীদের শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত বয়াত নেবেন নাএদিকে সবার প্রত্যাশা ছিল যে, খলিফা আলি নিশ্চয় ওসমানের হত্যাকারীদের কঠোর সাজা দেওয়ার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ করবেনকিন্তু আলি সবাইকে ভীষনভাবে হতাশ করলেনতিনি হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করে শাস্তি দেওয়ার বদলে তাদেরকে প্রশাসনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে উল্টে পুরুষ্কৃত করলেন আলির এই ভূমিকায় মদিনাবাসীসহ গোটা মুসলিম জগৎ যেমন বিস্মিত হয়েছিল ঠিক তেমনই আলির প্রতি ক্ষুব্ধও হয়েছিলএদিকে যারা ওসমানকে হত্যা করেছিল সেই বিদ্রোহীরা মহা উল্লাসে নৃত্য শুরু করলো এবং মদিনার বুকে শুরু করলো দাপাদাপি ও তান্ডবমদিনা ভদ্রলোক ও শান্তিপ্রিয় লোকদের পক্ষে কার্যত বসবাসের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়লোনিজেদের মান-সম্মান রক্ষার্থে যুবায়ের, তালহা প্রমুখ সাহাবিগণ মদিনা ত্যাগ করে মক্কায় গিয়ে আশ্রয় নিলেন। অন্যদিকে মাবিয়া সহ কয়েকটি প্রদেশের গভর্ণর আলির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করলেন, তাঁরা আলিকে জানিয়ে দিলেন যে যতদিন না ওসমানের হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করে উপযুক্ত শাস্তি না দেওয়া হবে ততদিন আলিকে ইসলামি সাম্রাজ্যের খলিফা হিসাবে মানবেন না। আলি কারও কথায় কান দিলেন নাউল্টে যে সব গভর্ণর ওসমানের হত্যাকারীদের শাস্তির ন্যায়সঙ্গত দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন তাঁদেরকে গভর্ণর পদ থেকে অপসারিত করলেন ফলে সমগ্র সাম্রাজ্য জুড়ে শুরু হলো গৃহযুদ্ধএই যুদ্ধে মুহাম্মদের সবচেয়ে প্রিয় পত্নী আয়েশাও অংশ নিয়েছিলেনতিনি আলির বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধে নেতৃত্বও করেছিলেন যে যুদ্ধটি ইতিহাসে জামালের যুদ্ধ নামে অভিহিত । তবে আলির বিরুদ্ধে বিদ্রোহে প্রধান ভুমিকা নিয়েছিলেন মাবিয়াআলি ও মাবিয়ার মধ্যে বহু  ও ব্যাপক যুদ্ধ হয়েছিলএইসব যুদ্ধে হাজার হাজার মুসলমান প্রাণ হারিয়েছিলেনআলির খেলাফত কাল মাত্র চার বছরের, তিনিও ওমরের মত গুপ্তঘাতকের হাতে ছুরিকা হত হয়ে মারা যানআলি ও মাবিয়ার মধ্যে  চার বছর ধরে যে যুদ্ধ হয়েছিল তাতে কেউ জয়ী বা পরাজিত হন নি

তৃতীয় খলিফা ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পশ্চাতে আলির হাত যে ছিল তা কিছুটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যখন বিদ্রোহিরা নিহত খলিফার লাশ একমাত্র আলির হাতেই তুলে দেয়আর আলির খেলাফত লাভের পর তা স্পষ্ট হয়ে যায় একশ ভাগই যাঁরা কিছুটা সঙ্গত কারণে এবং অনেকটাই ভুল বুঝে, কিছুটা প্ররোচিত ও প্রলুব্ধ হয়ে ওসমানের বিরুদ্ধে অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ ছিলেন তাঁরা (কতিপিয় ষড়যন্ত্রকারী ব্যক্তি ব্যতীত) কেউ স্বপ্নেও ভাবেন নি যে ওসমানকে হত্যা করে আলিকে খলিফা করার গভীর ষড়যন্ত্র আছে বিদ্রোহের পশ্চাতে  ফলে তাঁরা ওসমানের হত্যাকান্ডে যেমন ভীষণ শোকাহত হন  তেমনই ক্ষুব্ধও হন তাঁরা এমনকি  সবাই সোচ্চার পর্যন্ত হয়েছিলেন  ওসমানের হত্যাকারীদের কঠোর শাস্তির দাবীতেকিন্তু আলি সেই দাবীকে নস্যাত করে দিয়ে উল্টে হত্যাকারীদেরই সাথে ও পাশে নিয়ে খেলাফত পরিচালনা শুরু করেন এবং অপরদিকে যাঁরা সেই শাস্তির দাবী জানিয়েছিলেন তাঁদেরকে গভর্ণর ও প্রশাসনের উচ্চপদ থেকে বহিষ্কার করার আদেশ দেন। ফলে সমগ্র সাম্রাজ্য জুড়ে আলির বিরুদ্ধে শুরু যায় বিদ্রোহসেই বিদ্রোহে সামিল হয়েছিলেন খোদ মুহাম্মদ তথা নবির প্রিয়তমা পত্নী তথা আলির শাশুড়ী আয়েশাতিনি  খলিফা আলির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে দ্বিধা করেন নি, এবং তিনি স্বয়ং একটি  যুদ্ধে নেতৃত্বও করেনএই কথাগুলি উপরের আলোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে তবুও পুনরাবৃত্তি করতে হলো প্রধানতঃ যে কারণে তা হলোঃ  যে অমোঘ সত্যটা - ৩য় খলিফা ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নেপথ্যে প্রধান মদতদাতা ছিলেন মুহহাম্মদের সর্বাধিক প্রিয় জামাই  আলি - অজস্র মিথ্যার নীচে চাপা পড়ে গেছে মুসলিম ঐতিহাসিকদের মিথ্যাচারের কারণে তাকে  পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেওয়া।     

আলির বিরুদ্ধে যাঁরা বিদ্রোহ করেছিলেন তাঁরা দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিলেন । একটি গোষ্ঠীতে ছিলেন আয়েশার নেতৃত্বে যুবায়ের, তালহা, আবুযার গিফারী প্রমুখ স্বনামধন্য ও বিশিষ্ট সাহাবিগণ এবং অপর গোষ্ঠীতে ছিলেন আমির মাবিয়ার নেতৃত্বে বিভিন্ন প্রদেশের কয়েকজন গভর্ণর-সহ ব্যাপক মুসলিম জনগোষ্ঠী ফলে গোটা সাম্রাজ্য জুড়ে যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল তা হয়েছিল দুটি ফ্রন্টেএর ফলে বিদ্রোহ দমন করার জন্য আলিক  বেশ কয়েকটি যুদ্ধ করতে হয়েছিলএই যুদ্ধগুলির মধ্যে দুটি যুদ্ধ ছিল সৈন্যসংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে বিশাল ও বিভীষিকাময়সেই যুদ্ধ দুটির একটি হলো জামালের যুদ্ধ। আলির বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন নবী পত্নী আয়েশা যে কথাটি আগেই উল্লেখ করেছি। সেই যুদ্ধে শোনা যায় যে দশ হাজার মুসলমান নিহত হয়েছিলঅন্য যুদ্ধটি সিফফিনের যুদ্ধ নামে ইতিহাসে খ্যাত যে যুদ্ধে আলির বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দেন আমির মাবিয়াব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল সেই যুদ্ধে, এবং নব্বই হাজার মুসলমান নিহত হয়েছিলজামালের যুদ্ধে আলি জয়লাভ করলেও সিফফিনের যুদ্ধে কোনো মিমাংসা হয় নিশেষ পর্যন্ত দুপক্ষই সন্ধি করেছিলো

৯ম অধ্যায়

গুপ্তঘাতকের হাতে আলির মৃত্যু ও মুয়াবিয়ার খেলাফত লাভ

গোটা খেলাফত জুড়ে গৃহযুদ্ধ চলার ফলে আলি ক্রমশঃ শক্তিহীন হয়ে পড়ছিলেনতার প্রধান কারণ ছিলো এই যে, সর্বত্রই মুসলমানরা ক্রমশঃ বেশী বেশী করে খলিফা আলির ভুমিকা মেনে নিতে না  পেরে তাঁর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠছিলেনআলির বাসস্থান এবং নবীর পদধুলি ধন্য দিনার অবস্থাও একই রূপ ধারণ করেছিলোতাই মদিনার মুসলমানদের উপরেও আলি আর বিশ্বাস ও ভরসা রাখতে পারেন নি এবং রাজধানি মদিনা থেকে কুফা নগরীতে (অধুনা ইরাকে অবস্থিত) সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন

আলির কাছে ক্রমশঃ এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিলো যে তাঁর পক্ষে বেশীদিন আর যুদ্ধ পরিচালনা সম্ভব হবে  নাতাই সিফফিনের যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় আর যুদ্ধ চালিয়ে নিয়ে যেতে চান নি মাবিয়ার পক্ষ থেকে সন্ধি  প্রস্তাব এলে সঙ্গে সঙ্গে মীমাংসায় বসতে সম্মত হনমীমাংসার জন্য আলি ও মাবিয়া উভয়েই প্রতিনিধি মনোনীত করেন এবং ওঁরা যা মীমাংসা করবেন তা তাঁরা মেনে নেবেন বলে উভয়েই অঙ্গীকারবদ্ধ হনমীমাংসায় স্থির হয় যে ইসলামি সাম্রাজ্যের খলিফা পদ থেকে আলিকে সরে যেতে হবে এবং তাঁর স্থলে পরবর্তী  খলিফা হবেন আমির মাবিয়াপ্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে ইসলামি সাম্রাজ্যের অন্তর্গত বড় প্রদেশের গভর্ণরদের বলা হতো আমির

এই মীমাংসা পছন্দ না হওয়ায় আলি তা অগ্রাহ্য করেনতিনি এই অজুহাত দেন যে তাঁর মনোনীত প্রতিনিধি তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে মাবিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়েছেফলে উভয় পক্ষ আবার যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু  করেই মীমাংসা  প্রয়াসের কিছুদিনের মধ্যেই আলি আবশ্য গুপ্তঘাতকদের হাতে গুরুতর আহত হন এবং সেই আঘাতের জেরেই মারা যান এভাবেই আলির পাঁচ বছরের খেলাফতকালের করুণতম পরিসমাপ্তি ঘটে আলি যখন মাবিয়ার সঙ্গে মীমাংসায় বসতে সম্মত হন তখনই আলির বিরুদ্ধে তাঁর সৈন্যদের একাংশ বিদ্রোহ করেছিলেন, কারণ তাঁরা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর ছিলেনতাঁরা মাবিয়ার সঙ্গে মীমাংসা করার সমস্ত প্রয়াস বন্ধ করার জন্যে  আলির উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করেন। কিন্তু আলি তাঁদের কথায় কর্ণপাত করেন নিফলে  তাঁরা আলিকে ত্যাগ করে চলে যানতাঁদের পক্ষের কতিপয় লোকই আলিকে অতর্কিতে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করেছিলেন – এ ধারণাটাই  পোষণ করেন  অধিকাংশ ঐতিহাসিক। 

আলির মৃত্যুর সময়  গৃহযুদ্ধের কারণে ইসলামি সাম্রাজ্যের অবস্থা তখন একেবারে সঙ্গিন হয়ে উঠেছেএকে তো ব্যাপক অর্থবল  ও জনবলের ক্ষয়ক্ষতির ফলে সাম্রাজ্য অনেকখানিই শক্তিহীন হয়ে পড়েছে , অন্যদিকে  আবার সমগ্র খেলাফত সরাসরি আড়াআড়িভাবে দুভাগে বিভক্ত একটা অংশের নেতৃত্ব রয়েছে মাবিয়ার হাতে, আর অপর অংশটি ছিল খলিফা আলির নিয়ন্ত্রণেআলির মৃত্যুর পর স্বভাবতই ইসলামি সাম্রাজ্য আক্ষরিক অর্থেই দ্বিখন্ডিত হয়ে পড়লোআলির নিয়িন্ত্রিত এলাকার খলিফা হলেন তাঁর বড় পুত্র ইমাম হাসেন (ইমাম হোসাইন), মাবিয়ার নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের খলফা হলেন মাবিয়া স্বয়ং আলি ছিলেন একজন বিরাট যোদ্ধা এবং বহু যুদ্ধের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ বিশাল ব্যক্তিত্বসেই তিনিই বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হয়ে কার্যত মাবিয়ার কাছে পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে সন্ধি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। আর আলীর পুত্র হাসেন তো নেহাতই অনভিজ্ঞ ও অপরিণত বয়সের একজন তরুণ মাত্র,  কোনোভাবেই আলির সঙ্গে তাঁর তুলনা টানা যায় নাস্বয়ং হাসেন সে কথা আরও ভাল করেই জানতেনতারপর হাসেন ছিলেন সম্পূর্ণ অন্য ধাতে গড়া মানুষতিনি ক্ষমতার প্রতি আকৃষ্ট মোটেই ছিলেন না, তিন ঝগড়া বিবাদ পছন্দ করতেন না আলির বিরুদ্ধে যখন চারিদিকে বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে শুরু করে তখনই তিনি তাঁকে খেলাফত ছেড়ে দিয়ে কেবল দ্বীনের কাজে নিয়োজিত থেকে জীবনের বাকি সময়টা কাটিয়ে দিতে অনুরোধ করেছিলেনএহেন হাসেন স্বভাবতই খলিফা হয়ে খুশী হন নিতিনি বরং উত্তরাধিকার সূত্রে খেলাফতের দায়িত্ব পেয়ে যথেষ্ট বিচলিত হয়ে উঠেছিলেন, কারণ তিনি খুব ভালভাবেই জানতেন তাঁর পিতা যখন মাবিয়াকে যুদ্ধে পরাস্ত করতে পারেন নি, তাঁর পক্ষে সে কাজ সম্ভব করার প্রশ্নই উঠে নাবরং মাবিয়াকে পরাস্ত করার চেয়ে তাঁকে অনেক বেশী চিন্তিত করেছিল তাঁর নিজের খেলাফত রক্ষা করার বিষয়টিমাবিয়া যদি তাঁর সাম্রাজ্য আক্রমণ করে তবে তা প্রতিহত করা তাঁর পক্ষে যে সম্ভব নয়  সে কথা ভেবে বরং তিনি যথেষ্ট বিচলিত ছিলেন।    

হাসেনের চরিত্রে আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট ছিলনারীর প্রতি ছিলো তাঁর তীব্র আসক্তিদু’/একজনের কথা বাদ দিলে ইসলামের খলিফাদের সকলের মধ্যেই অবশ্য কমবেশী এ রোগটা ছিল । তাঁর মাতামহ তথা মুহাম্মদ বিয়ে করেছিলেন কমপক্ষে ১৪টি (মূহাম্মদের ঠিক কতকগুলি বিয়ে হয়েছিল তা নিয়ে প্রচুর মতভেদ আছে । বিভিন্ন মত অনুযায়ী তাঁর বিয়ের সংখ্যা কমপক্ষে ১৪টি, আর সর্বাধিক ২২ টি)তারপর মুহাম্মদের উত্তরসূরী খলিফাগণও সবাই বহুবিবাহ করেছিলেনপ্রথম খলিফা, দ্বিতীয় খলিফা, তৃতীয় খলিফা ও চতুর্থ খলিফার বিয়ের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৪টি, ৭টি, ৮টি, ও ৯টিখলিফাদের বিয়ের সংখ্যাটা নিসন্দেহে অনেক বেশী হতো যদি একসঙ্গে চারটির অধিক পত্নী রাখার উপর নিষেধাজ্ঞা না থাকততাছাড়া খলিফাদের বিবাহিত পত্নী ছাড়াও ছিল বহু উপপত্নী ও দাসী যাঁদেরকে তাঁরা পত্নিরূপে ভোগ করতেন আল্লার বিধান অনুসারেইতবে এটা সর্বজনবিদিত যে হাসেনের নারী-আসক্তি তাঁর পূর্বপুরষদের থেকে অনেক বেশী তীব্র ছিলো তিনি একজন নারীর সঙ্গে বেশীদিন অতিবাহিত করতেন না  কিছুদিন যেতে না যেতেই তাঁর পত্নীগণ তাঁর নিকট পুরানো হয়ে যেত, এবং তাঁদের প্রতি প্রেম-প্রীতি-আগ্রহ হারিয়ে ফেলতেনতখন তাঁদের তালাক দিয়ে আবার বিয়ে করতেননিত্যনতুন নারীর স্পর্শ ও সান্নিধ্য পেতে চাইতেন সর্বদাআর তা পেতে তিনি বিয়ে করেছিলেন ১০০টিএমনও নজির ছিল তাঁর জীবনে যে তিনি একই দিনে ৪টি স্ত্রীকে তালাক দিয়ে সেইদিনেই আবার ৪টি বিয়ে করেছিলেনবিয়ে এবং তালাক দেওয়াটা তার কাছে এক প্রকার মজার খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই জিনিষ দেখে তাঁর পিতা আলিও স্বয়ং বিরক্ত হয়ে মুসলিম সমাজের কাছে আবেদন করেছিলেন তাঁরা যেন হাসেনের সঙ্গে তাঁদের মেয়েদের বিয়ে না দেয়নারীদের এইভাবে ভোগকরে একের পর এক ছূঁড়ে ফেলে দেওয়ার ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে একসময় তাঁরই একজন পত্নী তাঁকে খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে হত্যা করেছিলেন। তা না হলে হাসেনের বিয়ের সংখ্যা যে কোথায় গিয়ে পৌঁছাত তা বলা বা আন্দাজ করা কঠিন ছিলহাসেনের এই সীমাতিরিক্ত নারী-আসক্তিও তাঁকে ভীষণ চিন্তায় ফেলেছিল যখন তিনি পিতার মৃত্যুর পর খলিফা হলেনমাবিয়ার মত প্রবল প্রতিপক্ষ তথা শত্রু যেখানে রয়েছে সেখানে খলিফার ক্ষমতাভোগ এবং নারীভোগ দুটোই একসঙ্গে রক্ষা করা যে সম্ভব নয় তা বুঝতে তাঁর অসুবিধা হয় নি।  এসব ভেবেচিনতে তিনি খেলাফতের দায়িত্বটা  ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং ছ’মাস পর মাবিয়ার হাতে তাঁর খেলাফত তুলে দেন ।        

খেলাফত হস্তান্তরের সময় মাবিয়া ও হাসিনার মধ্যে কিছু বোঝাপাড়া ও চুক্তি হয়েছিলো। সেগুলি কী ছিলো  বলা যায় না। তা নিশ্চিত করা বলা যায় না । এ বিষয়ে নানা রকম মত রয়েছেএক্ষেত্রে দুটি বোঝাপারা বা চুক্তি, যাই বলি না কেন, যা শোনা যায় তা এরূপ- এক). হাসেন যতদিন জীবিত থাকবেন ততদিন তাঁর নিজের এবং তাঁর পরিবারের ভরণ-পোষণের যাবতীয় খরচ মেটানো হবে বায়তুল মাল তথা সরকারি কোষাগার থেকে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের জীবিত সদস্যদের ভরণ-পোষণের খরচও মেটাতে হবে বায়তুল মাল থেকে দুই). মাবিয়া যতদিন জীবিত থাকবেন ততদিন তিনি খলিফা পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর খলিফা  হবেন হোসেন সে ব্যবস্থা তাঁকে (মাবিয়াকে) করে যেতে হবে  প্রথম চুক্তিটি যে হয়েছিল তা নিয়ে কোনও সংশয়ের অবকাশ নেই, এবং মাবিয়া সেই চুক্তিটি রূপায়ণে কোনদিনই কার্পণ্য করেন নিহাসেনের পিতা আলি খলিফা হওয়ার পর মাবিয়াকে সিরিয়ার গভর্ণর পদ থেকে অপসারিত করেছিলেন এবং আলি যতদিন খলিফা পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন ততদিনই মাবিয়া তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেনএই পরিস্থিতিতে হাসেন ও অনেকেরই মনে ভয় ছিল যে, হয়তো  মাবীয়া হাসেনের উপর তাঁর পিতার প্রতিশোধ তুলতে পারেন । কিন্তু মাবিয়া সকলকেই ভুল প্রমাণিত করে ছিলেনিনি হাসেনের সঙ্গে যে উদারতা, মর্যাদা ও সহানুভূতি প্রদর্শন করেছিলেন তা সকলকে অবাক করে দিয়েছিল। এক্ষেত্রে মাবিয়া মানুষ হিসাবে যে মস্ত বড়ো মহানুভব ছিলেন  তার যা  স্বাক্ষর রেখে গেছেন তা ইতিহাসে আজও স্মরণীয় হয়ে রয়েছেদ্বিতীয় চুক্তিটি আদৌ হয়েছিল কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছেএমনকি মুসলিম ঐতিহাসিকগণও সবাই এই দাবীটির সঙ্গে সহমত পোষণ করেন নিবস্তুতঃ হাসেন যখন নিজের গরজেই তথা অক্ষমতার জন্যেই খেলাফতের দায়িত্বভার ছেড়ে দিয়েছিলেন মাবিয়ার হাতে, তখন  তাঁর পক্ষে তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা হোসেনকে মাবিয়া পরবর্তী খলিফা করতে হবে এমন কোনও জোরালো দাবী বা শর্ত মাবিয়ার ওপর আরোপ করা সম্ভম ছিল নাআর তা ছাড়া এ প্রসঙ্গে আর একটা কথা খেয়াল রাখতে হবে, তা হলো এই যে, খলিফা পদের প্রতি  হাসেনের নিজেরই বিশেষ আকর্ষণ ও আগ্রহ ছিলনাতিনি তাঁর পিতাকে খলিফা পদ ত্যাগ করে ইসলামি সাম্রাজ্যে শান্তি স্থাপনের পরামর্শ দিয়েছিলেন সেই তিনি যখন পিতার মৃত্যুতে খলিফা পদে আকষ্মিকভাবেই অধিষ্ঠিত হলেন, তখন উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সাম্রাজ্যটি ধ্বংসের কিনারায় দাঁড়িয়েএ রকম দুঃসময়ে যে পদে তাঁর নিজেরই আগ্রহ নেই সেই পদে তিনি তাঁর ভাইকে বসানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করবেন এটা বিশ্বাসের অযোগ্য।

 

১০ম অধ্যায়              

মাবিয়ার হাতে রক্ষা পেল ইসলাম ও ইসলামি সাম্রাজ্যবাদ  

ইমাম হাসেন স্বেচ্ছায় তাঁর নিজের অংশের খেলাফত মাবিয়ার হাতে তুলে দিলে পর মাবিয়া হন সমগ্র ইসলামি সাম্রাজ্যের খলিফা, কারণ বাকি ভুখন্ডের মুসলমানরা ইতিপূর্বেই তাঁকে খলিফা হিসাবে স্বীকার করে নিয়েছিলেনমাবিয়ার স্কন্ধে যখন(৬৬১খ্রীঃ) পঞ্চম খলিফা হিসাবে ইসলামি সাম্রাজ্যের বিশাল গুরু দায়িত্ব অর্পিত হলো তখন সাম্রাজ্যের অবস্থা গভীর সংকট ও অনিশ্চয়তার গহ্বরে নিমজ্জিতপাঁচ বছর ধরে চলা এক ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধে সাম্রাজ্যটি তখন একেবারেই বিধ্বস্ত এবং অন্তর্কলহে ভিতর থেকেই মুখ থুবরে ভেঙে পড়ার উপক্রমভিতরের  সব শক্তি প্রায় নিঃশেষিত এবং কঙ্কালসার একটি সাম্রাজের কাঠামোটুকুই তার অবশিষ্ট ছিল মাত্রশুধু অন্তর্কলহ, ভগ্নদশা ও আর্থিক দুরাবস্থাজাত এক কঠিন প্রতিকুল পরিস্থিতিই নয়, ইতিমধ্যেই বহিঃশত্রুরাও সক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং যেসব জাতি ও দেশগুলি জয় করে ইসলামি সাম্রাজ্যের অধীনে নিয়ে আসা হয়েছিল তারাও আবার স্বাধীন ও মুক্ত হওয়ার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছেমূল কথা হলো মাবিয়া যখন ইসলামি সাম্রাজ্যের খেলাফতের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হলেন তখন সাম্রাজ্যটির অবস্থা ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট-এ ভর্তিপ্রাপ্ত এক মৃত্যু পথযাত্রী রুগীর মতো এ রকম কঠিন দুঃসময়ে ইসলামি সাম্রাজ্যের হাল ধরতে হয়েছিল মাবিয়াকেখলিফা হওয়ার পর স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ইসলামি সাম্রাজ্যকে অবধারিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করাতিনি অবশ্যই অত্যন্ত সাফল্যের সাথে সেই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছিলেনশুধু রক্ষা করাই নয়, ইসলামি সাম্রাজ্যের আরো ব্যাপক বিস্তারও ঘাটিয়েছিলেন তিনি

চতুর্থ খলিফা আলির মৃত্যুর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছিলঘাতকবাহিনীর হাতে আলির মৃত্যু ইসলামের ইতিহাসকে দুরকমভাবে প্রভাবিত করেছিলএকদিকে কারবালা প্রান্তরে মাবিয়ার পুত্র ষষ্ঠ খলিফা এজিদের সৈন্যবাহিনীর সাথে তাঁর পুত্র হোসেনের যুদ্ধ জড়িয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হওয়া, অপরদিকে ইসলাম ও  ইসলামি সাম্রাজ্যের  নিশ্চিত ধ্বংস হওয়া ও ইতিহাসের পাতা থেকে চিরতরে মুছে যাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়াসেইদিক থেকে বিচার করলে আলির ঘাতকবাহিনী আলিকে হত্যা করে ইসলামকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেছেস্বভাবতঃই আলির সেই ঘাতকবাহিনীর সদস্যদের পরিচয়   জানার গভীর কৌতূহল ও আগ্রহ ঐতিহাসিক এবং ইতিহাসের ছাত্রদের মধ্যে পরিলক্ষিত হতে দেখা যায়বলা বাহুল্য যে, ঐ ঘাতকবৃন্দদের পরিচয় ইতিহাসের নানা সূত্র হতে তাঁরা সংগ্রহ করেন। কিন্তু তাঁরা তাদের পরিচয়ের বিষয়ে একমত হতে পারেন নি, তাঁদের মধ্যে নানা মত আছেএকটা মত হলো এ রকম – আলি যখন ভয়ঙ্কর সেই সিফফিনের যুদ্ধ চলাকালীন যুদ্ধ-বিরিতি করলেন এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা করে নিতে সম্মত হলেন তখন তাঁর অনুগামীরা সবাই এটা মেনে নিতে পারেনিএকটা অংশ আলির এই ভুমিকার তীব্র বিরোধিতা ও বিদ্রোহ করেছিল এই বিদ্রোহীরা ইতিহাসে খারিজী বলে পরিচিততারা আলির ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছিল মীমাংসার পথ থেকে সরে এসে পুনরায় মাবিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করার জন্যকিন্তু আলি তাদের কথায় সম্মত হন নি, কারণ  তিনি লাগাতর যুদ্ধ করে করে তখন এতটাই দুর্বল ও শক্তিহীন হয়ে পড়েছিলেন যে তাঁর পক্ষে তখনই আর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল নাতখন তাঁর যে কোনও মুল্যে প্রয়োজন ছিল একটু নিঃশ্বাস  ফেলার সময় তাই তিনি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসার পথ থেকে সরে আসার চাপের কাছে নতি স্বীকার করেন নিএর ফলে যারা আলাপ-আলোচনার বিপক্ষে ছিল তারা আলির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। একটা মত হলো তারাই আলিকে হত্যা করেএই মতটি প্রধানত মুসলিম ঐতিহাসিকদেরকিন্তু গুপ্তঘাতকদের পরিচয় সম্পর্কে আরও দুটি ভিন্ন মত শোনা যায় তার একটা মত হলো এ রকম - বিদ্রোহীদের মধ্যে একটা অংশ ছিল ধর্মান্তরিত মুসলমান যারা প্রাণ রক্ষার্থে অগত্যা স্বধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয়েছিল তাদের পক্ষ থেকেই কেউ উক্ত পরিস্থিতির সুযোগে নিয়ে আলিকে হত্যা করেছিল তারা আলিকে হত্যা করেছিল এ জন্য নয় যে, আলি মাবিয়ার সঙ্গে মীমাংসায় সম্মত হয়েছিলেনআসলে ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকেই তারা আলিকে হত্যা করেছিল । আর একটি মত হলো জিম্মীরা আলিকে হত্যা করেছিলএদের হত্যা করার পশ্চাতেও ঐ একই কারণ ছিলসেই ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে এবং প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যেহত্যাকারীরা হয় অগত্যা মুসলমান অথবা জিম্মী এই দুটির মধ্যে কোনো একটা হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, কারণ ইসলামি শাসনে অবিশ্বাসীদের (জিম্মী) সঙ্গে যে আচরণ করা হতো তা এতই অমর্যাদাকর ও অবমাননাকর ছিলো যা কোনো আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভম ছিল নাজিম্মীদের কিভাবে মানবেতর জীবন-যাপন করতে হত তা ভাষায় প্রকাশ করা  অসাধ্য ব্যাপার । তাঁদের সেই সময়ের জীবন-যাত্রার দুঃসহ ও দুর্বিষহ ছবিগুলি এখনও বিধৃত রয়েছে হাদিস এবং কোরানের তফসিরে উক্ত বিষয় সম্পর্কে কোরানের ৯/২৮ ও ২৯ নং আয়াতদ্বয়ের তফসিরে ইবনে কাথির কী লিখেছেন তা দেখা যাক, ‘আবদুর রহমান ইবনে গানাম আশআরি বলেন, আমি নিজের হাতে চুক্তি লিখে খলিফা ওমরের (রাঃ) নিকট পাঠিয়েছিলাম যে, সিরিয়াবাসী অমুক অমুক শহরে বসবাসকারী খৃষ্টানদের পক্ষ হতে এই চুক্তিনামা আল্লাহর বান্দা আমীরুল মুমিনীন উমার (রাঃ) – এর নিকট।  চুক্তিপত্রের বিষয়বস্ত হচ্ছে, - “যখন আপনারা আমদের ওপর এসে পড়লেন, আমরা আপনাদের নিকট আমাদের জান, মাল ও সন্তান-সন্ততির জন্যে নিরাপত্তার প্রার্থনা জানাচ্ছি। আমরা এ নিরাপত্তা চাচ্ছি এ শর্তাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে যে, আমরা এই শহরগুলোতে এবং এগুলোর আশে পাশে নতুন কোন গির্জা, মন্দির ও খানকা নির্মাণ করবো না। এরূপ কোন নষ্ট ঘরের মেরামত করবো না। এরূপ কোন ঘরে যদি কোন মুসলিম মুসাফির অবস্থানের ইচ্ছা করেন তবে আমরা তাদেরকে বাধা দেবো না। তারা রাত্রেই অবস্থান করুক বা দিনে অবস্থান করুন। আমরা পথিক ও মুসাফিরদের জন্য ওগুলোর দরজা সব সময় খোলা রাখবযেসব মুসলিম আগমন করবেন তাদেরকে আমরা তিন দিন পর্যন্ত মেহমানদারি করবোআমরা ঐসব ঘরে বা বাসভূমি প্রভৃতিতে কোন গুপ্তচর লুকিয়ে রাখব নামুসলিমদের সাথে কোনরূপ প্রতারণা করব নানিজেদের সন্তানদের কোরান শিক্ষা করতে দেব না নিজেরা শিরক করব না, বা অন্য কাউকে শিরক করতে দেব না আমাদের মধ্যে কেউ যদি ইসলাম  ধর্ম গ্রহণ করতে চায় আমরা তাকে বাধা দেব না। মুসলিমদের আমরা সম্মান করবোযদি তারা আমাদের সঙ্গে বসবাসের ইচ্ছা করেন তবে তাদেরকে জায়গা ছেড়ে দেবকোন কিছুতেই আমরা নিজেদেরকে মুসলমানদের সমান মনে করব নাপোশাক পরিচ্ছেদেও না, আমরা তাদের কথার ওপর কথা বলবো না।  আমরা তাদের পিতৃপদবি যুক্ত নামে ডাকব নাজিনবিশিষ্ট ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হব নাআমরা তরবারি লটকাব না, এবং নিজেদের  সাথেও তরবারি রাখবো না।  অঙ্গুরীর উপর আরবি নকশা অঙ্কন করব না ও মাথার অগ্রভাগের চুল কাটব না। আমরা যেখানেই থাকিনা কেন, পৈতা অবশ্য ফেলে রাখব আমাদের গীর্জার ওপর ক্রশচিহ্ন প্রকাশ করবো না, আমাদের ধর্মীয়গ্রন্থগুলো মুসলিমদের যাতায়াত স্থানে এবং বাজারসমূহে প্রকাশিত হতে দেবো না। গীর্জায় উচ্চস্বরে শংখ বাজাবো না, মুসলমানদের উপস্থিতিতে আমাদের ধর্মীয় পুস্তকগুলি জোরে জোরে পাঠ করবো না, রাস্তাঘাটে নিজেদের চাল চলন ও রীতি নীতি প্রকাশ করবো না, নিজেদের মৃতদের উপর হায়! হায়!! করে উচ্চৈঃস্বরে শোক প্রকাশ করবো না  এবং মুসলিমদের চলার পথে মৃতদেহের সাথে আগুন নিয়ে যাবো না। যেসব গোলাম মুসলিমদের অংশে পড়বে তা আমরা গ্রহণ করব না আমরা অবশ্যই মুসলিমদের শুভাকাঙ্খী হয়ে থাকব ও মুসলিমদের ঘরে উঁকি  মারব নাআমরা অবশ্যই মুসলিমদের শুভাকাঙ্খী হয়ে থাকবো। মুসলিমদের ঘরে আমরা উঁকি মারবো না।” যখন এ চুক্তিপত্র উমা (রাঃ) -এর হাতে  পেশ করা হল তখন তিনি আর একটি শর্ত বাড়িয়ে দিলেন – তা হচ্ছে, “আমরা কখনো কোন মুসলিমকে প্রহার করবো না।” অতঃপর তারা বললোঃ  “এসব শর্ত আমরা মেনে নিলাম। আমাদের ধর্মাবলম্বী সমস্ত লোকই এসব শর্তের উপর নিরাপত্তা লাভ করলো। এগুলোর কোন একটি যদি আমরা ভঙ্গ করি তাহলে আমাদেরকে নিরাপত্তা দানের ব্যাপারে আপনাদের কোন দায়িত্ব থাকবে না এবং আপনি আপনাদের শত্রুদের ব্যাপারে যে আচরণ করেন আমাদের সাথেও সেই আচরণের পযুক্ত হয়ে যাব” (দ্রঃ ইবনে কাথিরের তফসির, ৮-১১ তম খণ্ড, পৃঃ ৬৭৬, ৬৭৭) ইসলামি সাম্রাজ্যে জিম্মী তথা মুশরিক তথা অবিশ্বাসী তথা কাফের তথা অমুসলিমদের কীভাবে জীবন-যাপন করতে হতো তার একটি স্পষ্ট ছবি ফুটে উঠেছে উক্ত তফসিরেএ জীবন-যাপনকে মানুষের জীবন-যাপন বলা যায় নাএ তো গরু- ছাগল, পশু-পাখির মতো মানবেতর জীবন বৈ নয়এমন জীবন যে মানুষের পক্ষে দুঃসহ ও দুর্বিসহ তা বলা বাহুল্যএ রকম মনুষ্যেতর জীবন-যাপনই শেষ কথা নয়, এর পরেও তাদের দিতে হতো চড়া পরিমাণে জিজিয়া কর  এ রকম জীবন-যাপনই তো মানুষকে বিদ্রোহী করে তোলে, করে তোলে প্রতিশোধপরায়পণ ও হিংসাপরায়ণপ্রকাশ্যে প্রতিবাদ করার পথ যেখানে রুদ্ধ, মানুষ তো সেখানেই গুপ্তহত্যার পথ বেছে নেয়সেই পথ ধরে মুক্তির সন্ধান করে মানুষ অথবা প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেইসলামের খেলাফত কালে তাই এমন ঘটনা বারবার ঘটেছেজিম্মীদের অস্ত্র বারবার ঝলসে উঠেছে খলিফাদের ওপরদ্বিতীয় খলিফা ওমরের মৃত্যু হয়েছিল ওই জিম্মী গুপ্তঘাতকদের হাতেইউমাইয়া বংশের খলিফা দ্বিতীয় ওমরকে হত্যা করা হয়েছিল খাবারের সাথে বিষ মিশিয়েএমনকি হযরত মুহাম্মদকেও হত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন তাঁরা বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে খাবারের সঙ্গে বিষ প্রয়োগ করেসেই খাবার খেয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেও অল্পের জন্য সেবার প্রাণে বেঁচে যানসুতরাং আলিকে যারা হত্যা করেছিল তারা জিম্মী সম্প্রদায়ের হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবলঅবশ্য আলির সৈন্যবাহিনীর মধ্যে যারা বিদ্রোহ করেছিল তাদের মধ্যে যারা ধর্মান্তরিত মুসলমান ছিল তাদের একটা অংশও আলির হত্যাকারী হতে পারেকারণ অবিশ্বাসীগণ স্বধর্ম পরিত্যাগ করে এবং ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হলেও সমান মর্যাদা ও বিশ্বাস পেত না, তাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর মুসলমান বলে গণ্য করা হতো এবং কথায় কথায় খোঁটা দেওয়া হতো অগত্যা মুসলমান বলেতারা কেবল জিজিয়া কর থেকেই রক্ষা পেত, কিন্তু মানুষ হিসাবে তাদের সকল সম্মান, মর্যাদা,স্বাধীনতা ও অধিকার থেকে বঞ্চিতই থাকতে হতোফলে তাদের মধ্যেকার কিছু মানুষও আলিকে হত্যা করে তাদের মনের  দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত জ্বালার নিরসন করে থাকতে পারেএ প্রসঙ্গে যেটা মূল কথা তা হলো, আলিকে যারা হত্যা করেছিল তারা ইসলামি শাসনে অপমানিত, অত্যাচারিত, নির্যাতীত, নিপীড়িত,ও অতিষ্ঠ একদল মানুষকিছু চাওয়া বা পাওয়ার জন্য নয়, তারা আলিকে হত্যা করে ছিল তাদের উপর যে অত্যাচার ও নিপীড়ন, অবমাননা ও  দাসত্ব, পরাধীনতা ও শোষণের ষ্টীম রোলার চালানো হচ্ছিল তারই প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আলিকে হত্যা করে তারা অবশ্য তাদের অজান্তেই বাঁচিয়ে দিয়েছিল ইসলাম ধর্ম এবং ইসলামি সাম্রাজ্যকেআলি আর কয়েক বছর বেঁচে থাকলে ইসলাম সাম্রাজ্যটির ধ্বংস অনিবার্য ছিলআর তা যদি হতো তাহলে ইসলাম ধর্মও ধীরে ধীরে অবলুপ্তির দিকে এগিয়ে যেত

 হ্যাঁ, এমন পরিণতি হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল ছিলকারণ ইসলামি রাষ্ট্রের বয়স তখন মাত্র ত্রিশ বছরইসলাম ধর্মের প্রসার ও তার রাষ্ট্রের বিস্তার তখন ঘটছে রাষ্ট্র শক্তির জোরেইসেই রাষ্ট্র ধ্বংস হয়ে গেলে ইসলামের শক্তি যে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে তা বলা বাহুল্য মাত্রএ প্রসঙ্গে যে কথা খেয়াল রাখা প্রয়োজন তা হলো, তখন পর্যন্ত যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছিলেন তাঁরা মনেপ্রাণে তাঁদের ছেড়ে আসা (স্ব)ধর্মের প্রতিই বিশ্বাসী ও অনুরাগী ছিলেন, এবং আত্মরক্ষার্থে নিরুপায় হয়েই  মুসলমান সেজে ছিলেনমক্কার কোরায়েশ তথা কোরেশগণ যে প্রাণের ভয়েই মুসলমান হয়েছিলেন তার ভুরিভুরি প্রমাণ তো  কোরান-হাদিসেই খুঁজলে  পাওয়া যায়মুহাম্মদ মক্কায় প্রায় তের বছর ধরে ইসলাম প্রচার করেন, কিন্তু মক্কার মানুষ তাঁর ধর্ম প্রত্যাখান করায়  তিনি মদিনা চলে যান সে সময় তাঁর অনুগামী ছিল মাত্র আঙুলে গণা কয়েকজনমদিনা গিয়ে তিনি ক্রমশঃ মত ও পথ পাল্টাতে শুরু করেন শুরু করেন ডাকাতি ও লুটতরাজএর পোশাকি নাম দেন জেহাদ (আল্লাহর পথে)ডাকাতি ও লুটপাট থেকে যা পাওয়া যেত তা ভাগ করে দিতেন সবার মধ্যেমুহাম্মদ জেহাদের মুখোশের আড়ালে প্রথম সফল ডাকাতি ও লুটতরাজ করেন মক্কার কোরেশদের ওপরইতিহাসে সেটা বদর যুদ্ধ নামে খ্যাতএরপর তাঁর দলে(ধর্মে) সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করেমদিনার ইহুদীদের সর্বস্ব লুট করে নিয়ে তাঁদেরকে মদিনা থেকে নির্বাসিত করেন, কারণ তাঁরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন নি এবং মুহাম্মদের কাজ কর্ম সমর্থন করেন নি তাঁদের একদলকে (৭০০/৮০০) একসঙ্গে নির্মমভাবে হত্যাও করেনফলে মুসলমানরা দ্রুত ধনবান হয়ে ওঠেন এবং মুসলমানদের সংখ্যাও দ্রুতহারে বাড়তে থাকেতাই মদিনা যাওয়ার মাত্র আট বছরের মধ্যেই তিনি সশস্ত্র ও সুসংগঠিত দশ হাজার সৈন্য হজের নাম করে নিয়ে গিয়ে মক্কা আক্রমণ করেনঅপ্রস্তুত ও অসংগঠিত মক্কার কোরেশগণ মুহাম্মদের কাছে বাধ্য হয়ে  আত্মসমর্পণ করে  আত্মরক্ষা করেন মুহাম্মদের মক্কা বিজয়ের (৬৩০ খৃঃ) পর শুরু হয় মক্কা-মদিনা ও আরবের বাইরে ইসলামের জয়যাত্রাএকের পর এক দেশে অভিযান (আক্রমণ) চালিয়ে ও দখল করে ইসলামি রাষ্ট্রের সীমানা প্রসারের কাজে মত্ত হয়ে ওঠেন মুহাম্মদ ও তাঁর অনুগামী খলিফাগণ যে দেশ দখলে আসে সে দেশের মানুষের উপরেই চাপিয়ে দেওয়া হয় ইসলাম ধর্মকেযাঁরা প্রাণের ভয় উপেক্ষা করেও স্বধর্ম পরিত্যাগে অসম্মত থাকেন তাঁদের জিম্মী আখ্যা দিয়ে তাঁদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হত বৈষম্যমুলক ও অমানবিক যত সব জঘন্য শর্তাবলীসেই শর্তাবলী আক্ষরিক অর্থেই কত হীন ও জঘন্য তা  ঊপরে বর্ণণা করা হয়েছেআলির মৃত্যুর পূর্বে এইভাবে ত্রিশ বছরে যারা মুসলমান হয়েছেন তাঁদের মনে ইসলামের প্রতি আস্থা, আনুগত্য, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার সঞ্চার হয় নি, বরং বিরাগ, বিতৃষ্ণা, ক্ষোভ ও ঘৃণাই যে তাঁদের মনের মধ্যে যথেষ্ট মজুত ছিল তা সহজেই অনুমেয়এ রকম পরিস্থিতিতে ইসলামি সাম্রাজ্যটি ধ্বংস হলে তার পরিণতি কী হতো তা অনুমান করা নিশ্চয় কঠিন নয়দলে দলে অগত্যা ধর্মান্তরিত মুসলমানরা আবার ফিরে যেত স্বধর্মে এবং অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে তাঁরা ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিশোধ নিতে নিশ্চয় ঝাঁপাতসেই অবস্থার মোকাবিলা করে ইসলাম ধর্ম আপন মহিমা ও ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারতো  এমন বিশ্বাস বোধকরি ধর্মান্ধ মুসলমান ব্যতীত আর কেউ করবেন না

একাদশ অধ্যায়

মাবিয়ার পুত্র ইয়াজিদের হাতে খেলাফত হস্তান্তর

মাবিয়ার খেলাফত কালটি সবদিক থেকেই ছিল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণদীর্ঘ কুড়ি বছর (৬৬১-৬৮০) খেলাফত পরিচালনা শেষে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্বে মাবিয়া ইসলামি সাম্রাজ্যকে এমন শক্তিশালী একটি ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে  তার এমন একটি সুসংহত রূপ দিয়ে যান যে সাম্রাজ্যটি তখন হয়ে উঠেছে অপরাজেয় ও অপ্রতিদ্বন্দী পৃথিবীতে ইসলাম ধর্ম তখন দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম হিসাবে বিরাজ করছে, এটা সম্ভব হতোনা যদি না আলির খেলাফতকালের অবসান হতো এবং মাবিয়ার উপর খেলাফতের দায়িত্ব অর্পিত হতোইসলামি সাম্রাজ্যের আব্বাসীয় যুগকে বলা হয় ইসলামের স্বর্ণযুগ, সেই স্বর্ণযুগের ভিত তৈরী করে দিয়ে যান মাবিয়াই

এসব বিষয়ে আলোকপাত করার  অবকাশ এখানে নেইতবুও এটা উল্লেখ করা হলো এই জন্য যে এই মাবিয়ার প্রতি চরম অবিচার করেছেন মুসলিম ঐতিহাসিকগণতাঁরা বল্গাহীনভাবে তাঁর সমালোচনা করেছেনমাবিয়ার খেলাফত কালকে তাঁরা ইসলামি খেলাফতের অধঃপতনের শুরু বলে চিহ্নিত করেছেনযে আলি ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে প্ররোচনা দিয়ে তাঁর প্রাণনাশ ঘটিয়ে খেলাফত অর্জন করেছিলেন সেই আলির খেলাফত কালকেই শেষ প্রকৃত ইসলামি খেলাফত বলে বর্ণণা করেছেন তাঁরাইসলামি সাম্রাজ্য ও ইসলামকেই যে তিনি রক্ষা করেছিলেন সে অবদানের কথা  খোলা মনে স্বীকার করে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের শিষ্টাচার প্রদর্শনে তাঁরা সর্বদা কুন্ঠিত থেকেছেনকিন্তু অমুসলিম ঐতিহাসিকগণ নির্দ্বিধায় স্বীকৃতি প্রদান করেছেন মাবিয়ার সাফল্যকে। হিট্টি লিখেছেন, “বিশৃঙ্খলতার মধ্যে মুয়াবিয়া  শৃঙ্খলা আনয়ন করেন এবং শক্তিপূর্ণ মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন” তিনি আরও লিখেছেন, “মুয়াবিয়ার শাসনকালে ইসলামের খেলাফত শুধু সুসংহত হয় নি, বরং বহুগুণে ইহা সম্প্রসারিতও হয়েছিল” মুসলিম ঐতিহাসিকরাও কেউ কেউ স্বীকার করেছেন যে আলির সময়েই ইসলামি সাম্রাজ্যের কিছু অংশ রোম সম্রাট পূর্নদখল করে নিয়েছিল. ওসমান গণি ‘উমাইয়া খেলাফত’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘কিন্তু ওসমানের খেলাফতের সময়ে গৃহযুদ্ধ ও ভীষণ গোলযোগের সুবর্ণ সুযোগ নিয়ে রোম সম্রাট পরিত্যাক্ত অঞ্চলগুলো পূনর্দখল করে তথাকার মুসলিম অধিবাসীদের উপর অকথ্য অত্যাচার আরম্ভ করেন’ ( পৃ-১৯) এসব স্বীকার করেও ড.ওসমান গণি-সহ অন্যান্য মুসলিম ঐতিহাসিকগণ মাবিয়ার শাসনকাল ও তাঁর চরিত্রকে কালিমালিপ্ত করতে কোনও দ্বিধা করেন নি, এমনকি তাঁর কঠোর সমালোলচনা করতে গিয়ে একজন ঐতিহাসিক হিসাবে যে শিষ্টাচার ও শালীনতার প্রদর্শন করা উচিত সে নিয়ম-নীতিকেও তাঁরা অবলীলায় লঙ্ঘন করেছেনকিভাবে এবং কেন তাঁরা মাবিয়াকে নির্মমভাবে বিদ্ধ করেছেন সে বিষয়ে আরও পরে  যথাস্থানে আলোচনা করা হবেমাবিয়ার মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই কারবালা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, এখন সে প্রসঙ্গে আলোকপাত করা যাক

মাবিয়া ছিলেন অসম্ভব দুরদর্শি মানুষতিনি তাঁর জীবনের অন্তিম সময়টাও চিনতে বা বুঝতে ভুল করেন নিমৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে তিনি তাঁর একমাত্র পুত্র এজিদ তথা ইয়াজিদকে তাঁর পরবর্তী খলিফা মনোনীত করে যাননিজের পূত্রকে খলিফা মনোনীত করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর এই প্রস্তাব সমগ্র সাম্রাজ্য ঘুরে ঘুরে মুসলিম জনগণের দরবারে উপস্থিত করেছিলেন এবং তাঁদের মতামত নিয়েছিলেনখলিফার ক্ষমতাবলে তিনি তাঁর পূত্র এজিদকে সমগ্র মুসলিম জনতার মাথায় খলিফা হিসাবে চাপিয়ে দিতে পারতেন, কিন্তু তা করেন নিসম্ভবত তিনি বুঝে নিতে চেয়েছিলেন এজিদকে খলিফা হিসাবে সমগ্র মুসলিম সমাজ মেনে নিতে সম্মত বা প্রস্তুত আছে কি নামাবিয়া ছিলেন তীব্র মেধা ও গভীর অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন এক বিরল প্রতিভাধর মানুষতিনি মানুষ চিনতে ও মানুষের মন বুঝতে অসম্ভব পারদর্শী ছিলেনতিনি প্রশাসনে সর্বত্র যোগ্য, দক্ষ ও উপযুক্ত ব্যক্তিদেরই নির্বাচন করে নিয়োগ করতেন, এক্ষেত্রে ধর্ম-গোষ্ঠী-জ্ঞাতি নিরপেক্ষ নীতি কঠোরভাবে প্রয়োগ করতেনএজিদকে পরবর্তী খলিফা নির্বাচন করে তিনি সঠিক কাজ করেছিলেন না ভুল করেছিলেন সেটা বুঝে নিতেই সম্ভবত বৃদ্ধ বয়সে গোটা সাম্রাজ্য পরিক্রমা করার কষ্টকে হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছিলেনআপন পূত্রকে খলিফা মনোনীত করা নিয়ে নানা মত আছে, তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আছেঠিক কি কারণে বা কেন নিজের পূত্রকেই মনোনীত করেছিলেন তা ঐতিহাসিকদের গবেষণার বিষয়, তবে এই বিষয়ে মুসলিম ঐতিহাসিকগণ কী বলেছেন এবং তাঁদের সেই বক্তব্য কতটা যথার্থ তা জানার আগ্রহ সকলের মধ্যেই  রয়েছেতবে সে বিষয়ে আলোচনা করা হবে কিছুটা পরে যথাস্থানে।  তার আগে এখন আলোকপাত   করা  যাক সমগ্র মুসলিম জাহানে খলিফা পদে এজিদের মনোনয়নে কী  প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তার প্রতিআগেই বলেছি যে এজিদকে পরবর্তী খলিফা মেনে নিতে সমগ্র মুসলিম দুনিয়া সম্মত ও প্রস্তুত কিনা তা দেখে ও বুঝে নিতে মাবিয়া পুরো সাম্রাজ্য পরিভ্রমণ শুরু করেন, প্রত্যেক প্রদেশের রাজধানি শহরে গিয়ে প্রশাসনের পদাধিকারীদের সঙ্গে মত বিনিময় করেন, এবং প্রাশাসনের পদস্থ আধিকারিক ছাড়াও অন্যান্য বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গেও মত বিনিময় করেনকেন তিনি তাঁর নিজের পুত্রের উপর বিশাল একটি সাম্রাজ্যের পরবর্তী খলিফা পদের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করতে চান তা সকলের সামনে বাখ্যা করেন এবং তাঁদের অভিমত ও প্রতিক্রিয়া আহবান করেনতাঁর এই সফর মোটের উপর তাঁর কাছে বেশ সন্তোষজনক ও তৃপ্তিদায়ক ছিলকারণ, মদিনা প্রদেশ ব্যতীত অন্য সকল প্রদেশ তাঁর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলতিনি তাঁর পক্ষে যে ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছিলেন তা বোধ হয় তাঁর প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলমদিনা শহরে আঙুলে গণা সামান্য কয়েকজন তাঁর প্রস্তাবের সমালোচনা ও বিরোধিতা করেছিলেনএটা অবশ্য তাঁকে বিষ্মিত করে নি, কারণ তাঁরা যে এজিদকে মানবেন না সেটা তিনি নিশ্চিতভাবেই জানতেনশুধু এজিদ বলে নয়, আসলে অন্য কাউকেই যে তাঁরা মানবেন না সেটা তিনি তিনি জানতেন তাঁরা তাঁর (মাবিয়ার) শাসন কালে কখনও এবং কোনোভাবেই তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন নি, বরং তাঁদের ভূমিকা ছিল সর্বদাই তাঁর (মাবিয়ার) সমালোচনা করাতাঁরা কখনই মাবিয়ার শুভাকাঙ্খী ছিলনামাবিয়ার প্রতি তাঁদের বিরোধিতা ছিল একেবারে অন্ধ বিরোধিতা ও আক্রোশ বশতঃ, খলিফা মাবিয়ার বিরোধিতার অর্থ যে ইসলামি সাম্রাজ্যকেই বিপন্ন করতে পারে সে কথা কোনোদিন তাঁরা ভেবেই দেখেন নি, অন্ধ বিরোধিতা ও অন্ধ আক্রোশের ফলে মানুষের স্বাভাবিক বোধ -বুদ্ধির বিনাশ ঘটে সে কথা তো সবার জানা অর্থ, যশ, খ্যাতি ক্ষমতার লোভ এবং প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধপরায়ণতা মানুষকে অন্ধ বিরোধিতা ও অন্ধ আক্রোশের ফাঁদে জড়িয়ে দেয়কারবালা যুদ্ধের নেপথ্যে প্রধান কারণ ছিল ঐ ক্ষমতা ও খ্যাতির প্রতি দুর্দমনীয় লোভই

মদিনায় যে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এজিদের খলিফা মনোনয়নে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তাঁরা ছিলেন সংখ্যায় মাত্র চারজনতাঁরা হলেন আলির পুত্র ইমাম হোসেন, প্রথম খলিফা আবু বকরের পুত্র আব্দুর রহমান, দ্বিতীয় খলিফা ওমরের পুত্র আব্দুল্লাহ ও বিশিষ্ট সাহাবী জুবায়েরের পুত্র আব্দুল্লাহমাবিয়া মাদিনাবাসীদের সামনে পরবর্তী খলিফা হিসাবে এজিদের নাম প্রস্তাব করার সাথে সাথেই ঐ চারজন উঠে দাঁড়িয়ে তার প্রতিবাদ করেনকিন্তু সভার বাকি উপস্থিত মুসলমান জনসাধারণ মাবিয়ার প্রস্তাবে সমর্থন ও সহমত জ্ঞাপন করেন, তখন তাঁরা সভাস্থল পরিত্যাগ করে চলে যানতাঁরা মদিনাবাসীর সমর্থন তাঁদের পক্ষেই আশা করেছিলেন, কারণ তাঁদের ধারণা ছিল মদিনার মুসলমানগণ মুহাম্মদের নাতি এবং আবু বকর ও ওমরের  পুত্রদের পরিবর্তে অন্য কাউকে সমর্থন করতে পারে নাকিন্তু মদিনার মানুষ তাঁদের ভুল প্রমাণিত করে মাবিয়া ও এজিদের পাশে প্রকাশ্যেই দাঁড়িয় যানমদিনার মানুষ বোধহয় ওসমানকে যখন বিদ্রোহিরা হত্যা করে তখন ওদের ভুমিকা দেখে যে কষ্ট পেয়েছিলেন তা বোধহয় ভুলতে পারেন নি। মদিনার মানুষের এই ভুমিকায় হোসেন ও তাঁর বাকি তিনজন সঙ্গী মানসিকভাবে ভীষণ কষ্ট অনুভব করেন এবং হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েনতাই তাঁরা শুধু সভাস্থলই ত্যাগ করেন নি, অচিরেই মদিনাই ত্যাগ করে মক্কা চলে যানইতিহাসের কি নির্মম পরিহাস, মানুষের সমর্থন না পেয়ে প্রবল হতাশা নিয়ে ৫৬/৫৭ বছর পূর্বে মুহাম্মদ, আলি, আবু বকর, ওমর এবং আবু যুবাইয়েরদের মক্কা ত্যাগ করে মদিনা এসে আশ্রয় নিতে হয়েছিল, আর আজ তাঁদেরই উত্তরসূরিরা মানুষের সমর্থন হারিয়ে মদিনা ত্যাগ করে মক্কার পথে পাড়ি দিলেনসেদিন হোসেন এবং তাঁর তিনজন সাথী নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন নি, মদিনার মানুষ নীতিভ্রষ্ট হয়ে মাবিয়ার দালাল হয়ে গেছে বলে তাঁদের প্রতি দোষারোপ করেছিলেন, সেই একই ভুল আজও বহন করে চলেছেন মুসলিম ঐতিহাসিকগণহোসেন যেমন মদিনার মানুষকে দালাল বলে অপমান করেছিলেন, মুসলমান ঐতিহাসিকরাও ঐ একই ভাষায় মদিনার মানুষকে সমানে অপমান করে চলেছেনএ প্রসঙ্গে ড.ওসমান গণি কি বলেছেন তা শোনা যাক, ‘মদীনাবাসীর সম্মুখে তিনি তাঁর প্রস্তাব রাখা মাত্রই সেখানকার প্রধান ব্যক্তিগণ – হযরত আলীর পুত্র হুসাইন, আবু বকরের পুত্র আব্দুর রহমান, ওমরের পুত্র আব্দুল্লাহ এবং জুবায়েরের পুত্র আব্দুল্লাহ মুয়াবিয়ার প্রতি অবজ্ঞাভরে মক্কা ত্যাগ করে মদিনা চলে মক্কায় চলে গেলেন; তখন বাকি সাধারণ জনগণের পক্ষে কিছু দালাল দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিলেন সকলের আনুগত্য।’(উমাইয়া খেলাফত, পৃ –২২) ড.গণির দল শুধু মদিনার মানুষকেই দালাল বলে অপমান করে ক্ষান্ত হতে চান না, তাঁরা সেই য়ুগের তামাম মুসলিম জাহানের সকল মুসলমানকেই দালাল বলে অপমান করেছেন তাঁদের কলমেবিশাল একটি সাম্রাজ্যের তামাম মুসলমান সম্প্রদায়কে দালাল বলে কত কুরুচির পরিচয় দিয়েছেন গণি সাহেব তা তাঁর ভাষাতেই দেখা যাক –‘৬৭৬ খ্রীষ্টাব্দে তিনি জনগণের সম্মুখে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেন, কিন্তু এর পূর্বেই তিনি গোপনে কিছুটা দালাল শ্রেণীর জনমত গড়ে নিয়েছিলেন। তাই আর কোন অসুবিধা হল না দালালের দ্বারা (ট্রাকে না হলেও) উটের পিঠে ভাড়াটে মানুষ এসে তাঁর প্রতি কৃত্রিম আনুগত্য জানাল’ ( দ্রঃ- ঐ)

মাবিয়া তাঁর পুত্র এজিদকে খলিফা মনোনীত করেন তাঁর মৃত্যুর এক বছর পূর্বে ৬৭৯ খ্রীষ্টাব্দেতিনি মারা যান ৬৮০ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে। তারপরেই পরিস্থিতি দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে যায় কারবালা যুদ্ধের দিকেএজিদের খলিফা হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র ছয় মাসের মধ্যে কারবালার যুদ্ধের ঘটনাটি সংঘটিত হয় 

মাবিয়ার মৃত্যুর পর এজিদ ৬৮০ খ্রীষ্টাব্দে ইসলামি সাম্রাজ্যের ষষ্ঠ খলিফা নিযুক্ত হনবলা বাহুল্য যে, যেহেতু তিনি পূর্ব থেকেই ঐ পদে মনোনীত ছিলেন, তাই একদম নির্বিঘ্নে ও মসৃণভাবেই খলিফার সিংহাসনে তাঁর আরোহণ প্রক্রিয়াটি সুসম্পন্ন হয় এমনকি মদিনার মুসলমানরাও এজিদকে খলিফা পদে স্বীকার করে নিতে বিলম্ব করেন নি। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন কেবল ইমাম হোসেন এবং তাঁর মুষ্টিমেয় আঙুলে গণা কয়েকজন সঙ্গী-সাথীতাঁরা এজিদকে খলিফা মানতে অস্বীকার করেনপ্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে এজিদের হাতে সমগ্র মুসলিম জাহানে যখন বয়াত (আনুগত্যের শপথ) নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে তখন হোসেন মদিনাতেই অবস্থান করছিলেনমাবিয়া যখন এজিদের মনোনয়নের প্রস্তাব নিয়ে মদিনা এসে মদিনাবাসীর সঙ্গে মত বিনিময় করছিলেন তখন মাবিয়া আহুত সভাস্থল থেকে উঠে হোসেন একেবারে মদিনা ত্যাগ করে মক্কা চলে গিয়েছিলেনএটা নিয়ে অবশ্য দুরকম মত রয়েছেএকটা মত হলো, মক্কা থেকে পুনরায় মদিনায় ফিরে এসেছিলেন মাবিয়ার মৃত্যুর ঢের পূর্বেই,  আর একটা মত হলো মাবিয়ার মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি মদিনা এসেছিলেন মাবিয়ার মৃত্যু-পরবর্তী পরিস্থিতিতে মদিনার প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করার জন্যকিন্তু বলা বাহুল্য যে তিনি যে পরিস্থিতি নিজের চোখে দেখলেন (মক্কার প্রায় সকলেই এজিদকে খলিফা হিসেবে মেনে নিচ্ছেন স্বতস্ফূর্তভাবে)  তা তাঁকে আরও একবার ভীষণ হতাশ করলোএদিকে দামেস্কে (ইসলামি সাম্রাজ্যের তৎকালীন রাজধানী) এজিদের কাছে যথারীতি খবর পৌঁছে গেল যে হোসেন ও তাঁর মুষ্টিমেয় কয়েকজন সঙ্গী বা অনুচর তাঁকে খলিফা হিসাবে মেনে নিতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেছেনএজিদ মানসিকভাবে এ খবর শোনার জন্য প্রস্তুতই ছিলেন, তিনি শুধু খবরটি কখন এসে পৌঁছায় তারজন্য অপেক্ষা করছিলেন। খবর পৌঁছানো মাত্রই মদিনার গভর্নর ওয়ালিদকে একটি জরুরী বার্তা পাঠান যে বার্তায় ওয়ালিদকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, যাঁরা খলিফার বয়াত নিতে অস্বীকার করেছেন তাঁদেরকে যেন অবিলম্বে বয়াত নেওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়মদিনার গভর্ণর স্বাভাবিকভাবেই হোসেনের নিকট খলিফার বার্তা পৌঁছে দেন এবং তাঁকে খলিফার আনুগত্য স্বীকার করে নেওয়ার অনুরোধ করেন এবং অনুরূপভাবে তাঁর অনুচরদেরও (ওমরের পুত্র, আবু বকরের পুত্র, যুবায়েরের পুত্র এবং আর একজন বিশিষ্ট সাহাবী  আব্বাসের দুই পুত্রকেও) একই অনুরোধ করেনখলিফার নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে ওমরের পুত্র, আবু বকরের পুত্র এবং আব্বাসের দুই পুত্র ইমাম হোসেনকে উপেক্ষা করে ষষ্ঠ খলিফা এজিদের প্রতি আনুগত্যের শপথ নিয়ে নেনশুধু বাকি থাকলেন হোসেন এবং যুবায়ের পুত্র আব্দুল্লাহহোসেন যখন নিজের চোখে দেখলেন তিনি একেবারেই নিঃসঙ্গ, এমনকি এক বছর আগেও যে কয়েকজন তাঁর সাথে ছিল তাঁরাও তাঁকে পরিত্যাগ করে চলে গিয়ে এজিদকে খলিফা হিসাবে স্বীকার করে নিয়েছেন, তখন মদিনায় আর এক মূহুর্তও অবস্থান করা অসমিচীন ভেবে কাল বিলম্ব না করে তিনি মদিনা ত্যাগ করেনস্বাভাবিকভাবেই একমাত্র আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়েরকেই তিনি সঙ্গী হিসাবে পেলেনগভর্ণর সে খবরও যথারীতি খলিফা এজিদের দরবারে পৌঁছে দিলেনওদিকে খলিফার নিকট থেকে হোসেনের উপর বলপ্রয়োগ করে আনুগত্য আদায়ের জন্য কোনও নির্দেশ না আসায় তিনিও এবিষয়ে নীরব থাকায় শ্রেয় ও সমীচীন মনে করলেনসুতরাং হোসেন এবং আব্দুল্লাহ ইবন যুবায়ের বিনা বাধায় মক্কায় গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলেন

মক্কায় গিয়ে হোসেন এজিদের খেলাফতের বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় তা নিয়ে তিনি তাঁর আত্মীয়স্বজন ও শুভাকাঙ্খীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করলেন তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে ইসলামি সাম্রাজ্যের খেলাফতের একমাত্র ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকার হলেন মুহাম্মদের নাতি ও বংশধর ইমাম হোসেন, এবং মাবিয়া যেহেতু সম্পূর্ণ অন্যায় ও অনৈতিকভাবে এবং ইসলামি নীতিবিরুদ্ধ পথে নিজ পূত্রকে খলিফা মনোনীত করে গেছেন, তাই এজিদ কোনোভাবেই বৈধ খলিফা নয় এবং শেষ পর্যন্ত তাঁরা এরূপ সিদ্ধান্তও গৃহণ করেন যে শুধু এজিদের হাতে বয়াত নেওয়া থেকে বিরত থাকলেই হবে না, তাঁর (এজিদের) খেলাফতের বিরুদ্ধে সরব হয়ে জনমত গঠন করতে হবে যার লক্ষ্য হবে এজিদকে ক্ষমতাচ্যুত করে হোসেনের হাতে ইসলামি সাম্রাজ্যের খেলাফত তুলে দেওয়া এমনটা শোনা যায় যে, এরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত বা প্ররোচিত করেছিলেন  নাকি যুবায়ের পুত্র আব্দুল্লাহ এই কথাটার কতটা ভিত্তি আছে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছেতবে বিশাল একটি সাম্রাজ্যের একজন খলিফাকে ক্ষমতাচ্যুত করার দুরূহ ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার ভাবনা কীভাবে হোসেন ও তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের মাথায় ঠাঁই পেয়েছিল সেটাই সবচেয়ে বেশী বিস্ময়করতাঁরা বোধহয় এরূপ আশা করে ছিলেন যে মুহাম্মদের বংশধর বলে হোসেনের পক্ষেই মুসলমানরা রাস্তায় নেমে সমর্থন জ্ঞাপন করবেন কিন্তু এতট আশা করার কোনো উপাদানই যে তখন অবশিষ্ট ছিল না তা তাঁরা কেউ বুঝতে সক্ষম হন নিে যাই হোক, তাঁরা স্থির করলেন যে, এজিদকে বৈধ খলিফা বলে তাঁরা যে স্বীকার করছেন না সে কথা লিখিতভাবে তাঁকে জানিয়ে দিতে হবেসেই সিদ্ধান্ত মতো হোসেনের নেতৃত্বে কিছু মানুষ একজন দূত মারফত এজিদকে একটি চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিলেন যে, মাবিয়া আপনাকে খলিফা পদে মনোনীত করে চরম অন্যায় ও পাপ কাজ করেছেন, তাই আপনি একজন অবৈধ খলিফা বৈ নয়  ইসলামি সাম্রাজ্যের একমাত্র ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকার হলেন ইমাম হোসেনআমরা তাই আপনাকে খলিফা হিসাবে স্বীকার করছি না

দ্বাদশ অধ্যায়

খলিফা ইয়াজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্যে হোসেনের কুফা যাত্রা

এজিদকে সেই চিঠি পাঠিয়ে হোসেন তাঁর পক্ষে জনমত গঠনের কাজে নেমে পড়লেন। প্রথমে তিনি কুফা প্রদেশে নিজে গিয়ে জনমত গড়ার পরিকল্পনা করলেনএই প্রদেশে তাঁর পিতা আলির অনুরাগীর সংখ্যা ছিলো তুলনায় বেশীকুফাবাসীর প্রতি বেশী ভরসা রেখেছিলেন তাঁর পিতা স্বয়ং আলিওতিনি (আলি) যখন খলিফার সিংহাসনে আরোহণ করেন ওসমানের হত্যাকারীদের হাত ধরে তখন মদিনাবাসী তাঁর প্রতি ভীষণ বিরূপ ও বিক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর পাশ থেকে সরে দাঁড়িয়ে ছিলেনতাই তিনি খলিফা হওয়ার কিছুদিন পরেই ইসলামি সাম্রাজ্যের রাজধানী মদিনা থেকে কুফায় সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন অথচ আলির বংশধর ও অনুগামীরা প্রবলভাবে দাবী করে এসেছেন যে, আলি যেহেতু আল্লাহর শেষ নবী তথা মুহাম্মদের বংশধর তাই ইসলামি সাম্রাজ্যের খেলাফতের ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকার একমাত্র আলিই, আর অন্য কেউই হতে পারেন নাআলিও বারবার সেই একই দাবী করেছেন আলির পত্নী ফতেমাও সেই একই দাবী করেছিলেন এবং আবু বকরকে (মুহাম্মদের মৃত্যুর পর প্রথম খলিফা) খলিফা পদে কিছুতেই মেনে নেন নিঅথচ সেই আলিই মুহাম্মদ যে মাটিতে চির নিদ্রায় শুয়ে রয়েছেন সেই মদিনা থেকে রাজধানী কুফা শহরে সরিয়ে নিয়ে যেতে দ্বিধা করেন নিআলির এমনই ছিল আল্লাহর শেষ নবী তথা আপন শ্বশুর তথা আপন চাচাতো দাদার প্রতি শ্রদ্ধা,আবেগ ও ভালবাসা! ওসমান কিন্তু নিজের জীবন বিপন্ন জেনেও মদিনা ছেড়ে যান নি বা মদিনা থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন নি তিনি বলেছিলেন, আমার প্রিয় নবী যে মাটিতে শায়িত রয়েছেন চির ঘুমে সেই মাটির তুলনায় আমার আমার জীবন ও খলিফার সিংহাসন অতিশয়  তুচ্ছ, আমি কোনো কিছুর বিনিময়েই মদিনা পরিত্যাগ করে যেতে পারব নাশেষ নবীর প্রতি প্রেম-প্রীতি-ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা কত গভীর ও কত আন্তরিক ছিল ওসমানের হৃদয়ে তার প্রমাণ নিজের জীবন দিয়ে তিনি দেখিয়ে দিয়ে গেছেনওসমান কিন্তু নবীর উত্তরাধিকার বা বংশধর ছিলেন না, এমনকি তাঁর গোত্রের লোকও ছিলেন নাঅপরদিকে আলি ছিলেন নবীর অতি আদরের চাচাতো ভাইনবী আলিকে এত ভালবাসতেন ও স্নেহ করতেন যে তাঁর নিজের প্রাণাধিক কন্যা ফতেমার সঙ্গে তাঁর(আলি) বিয়ে দিয়েছিলেন, যদিও ইতিমধ্যেই আবু বকর ও ওমর দুজনেই নবীর কাছে ফতেমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব প্রদান করেছিলেন

মুহাম্মদ আলিকে ‘আল্লাহর তরবারি’ (সাইফুল্লাহ) এবং ‘জ্ঞানের দরজা’ এই দুটি অসামান্য উপাধিতে ভুষিত করেছিলেনসেই আলিই নিজের স্বার্থ রক্ষার্থে মুহাম্মদের প্রাণাধিক প্রিয় শহর মদিনাকে ত্যাগ  করে চলে গিয়েছিলেন কুফা শহরেহোসেন সেই কুফা শহরকেই সব আগে তাঁর পক্ষে জনমত গঠনের জন্য বেছে নিলেনকুফা যাওয়ার আগে সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিমকে আগে সেখানে প্রেরণ করলেন

সর্ব প্রথম হোসেন কুফা শহরেই কেন যেতে মনস্থির করেছিলেন তা নিয়ে ভিন্ন মতও শোনা যায়সে মতটি এ রকমঃ এজিদের খলিফা হওয়াটা কুফাবাসী একেবারেই মেনে নিতে পারেন নিতাঁরা হোসেনকেই খলিফা পদে দেখতে আগ্রহী ছিলেনতাঁরা মনে করতেন যে এজিদ একজন স্বেচ্ছাচারী, লম্পট ও মদ্যপ যুবক, এবং খলিফা পদের সম্পূর্ণ অনুপযুক্ততাঁরা এজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে প্রস্তুত, এবং তাঁরা চান যে সেই বিদ্রোহে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বীর আলির সুযোগ্য পুত্র হোসেন যেন নেতৃত্ব করেন সে জন্যে তাঁরা হোসেনকে কুফা শহরে আসতে আহবান করছেনকুফাবাসীগণ তাঁদের এই অভিমত, আহবান ও সঙ্কল্পের কথা লিখে অসংখ্য পত্র হোসেনের কাছে  প্রেরণ করেন । কুফাবাসীদের এ সব পত্র পেয়ে হোসেন এজিদের বিরুদ্ধে এবং তাঁর নিজের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে প্রবল উৎসাহ বোধ করেন এবং সে জন্যেই সর্ব প্রথম তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণের জন্যে কুফা যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনহোসেন খুব শীঘ্রয় কুফা যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন এবং সেখানে যাওয়ার জন্য তাঁর আর তর সইছিলো না কিন্তু তাঁর আত্মীয়স্বজন ও শুভাকাঙ্খীরা তাঁকে সরাসরি কুফা যেতে নিষেধ করেন তাঁরা বলেন কুফাবাসীদের কিছু মানুষের কথায় বিশ্বাস করে হোসেনের সেখানে যাওয়া সমীচীন হবে না, কারণ তাঁরা সিফফিনের যুদ্ধে আলির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন তাই হোসেনের নিজে যাওয়ার আগে কাউকে সেখানে প্রেরণ করে সরেজমিন তদন্ত করে সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হওয়া আবশ্যক বলে তাঁরা হোসেনকে পরামর্শ দেন তাঁরা বলেন যে পরিস্থিতি অনুকূল এমন নিশ্চিত খবর পেলে তবেই হোসেনের যাওয়া উচিত হবেশেষ পর্যন্ত হোসেন সকলের পরামর্শ মেনে নেন এবং হোসেনন তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিমকে গোপনে কুফায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন 

মুসলিম অতি গোপনীয়তার সাথে কুফা যাত্রা করলেন এবং সেখানে গিয়ে জনৈক হানি নামের আলির অতি বিশ্বস্ত একজন ব্যক্তির বাড়িতে ওঠেন এবং তাঁর কাছ থেকে কুফার মানুষদের মনোভাব সম্পর্কে খোঁজ-খবর সংগ্রহ করেনহানি যে আলির অতি ভক্ত তা কুফায় সর্বজন বিদিত ছিল এবং সেই কারণে যাঁরা আলি ও আলির পরিবারের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন কিন্তু প্রকাশ্যে মাবিয়ার বিরোধিতা বা সমালোচনা করা সমীচীন মনে করতেন না তাঁরা এজিদের খলিফা হওয়ায় খুশী ছিলেন নাসেই মানুষগুলো গোপনে সুযোগ পেলেই তাঁদের মনের কথা হানির কাছে ব্যক্ত করতেনএই মানুষগুলোর সংখ্যা ঠিক কত বা এঁরা কুফার জনসংখ্যার কত অংশ তার সঠিক হিসাব হানির কাছে ছিল নাকিন্তু কিছু লোকের কাছ থেকে তাঁদের উক্ত মনোভাবের কথা শুনেই তাঁর বিশ্বাস জন্মেছিল যে ওটাই কুফাবাসীর মনের কথামুসলিমকে অতি সোৎসাহে সে কথাটাই হানি জানালেন, তিনি জানালেন যে কুফার মানুষ কেউ এজিদকে চায় না, তাঁরা সবাই হোসেনকেই খলিফা পদে দেখতে চানএই কথায় বিশ্বাস করে মুসলিম কাল বিলম্ব না করে হোসেনকে পত্র মারফত জানিয়ে দিলেন যে কুফার মানুষ তাঁকেই খলিফা হিসাবে পেতে চায়, তাঁরা এজিদের প্রতি ভীষণ ক্ষুব্ধ ও রুষ্ট, সুতরাং তিনি যেন পত্র প্রাপ্তির সাথে সাথে কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেনহোসেন ভীষণ ঊদগ্রীব ছিলেন মুসলিমের ঠিক এই চিঠির জন্যেই, তাই চিঠি পাওয়া মাত্র কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেনবলা বাহুল্য যে সঙ্গে নিলেন পরিবারের লোকজন সহ অনুগত কিছু লোক-লস্কর

এদিকে এজিদের নিকট এই খবর পৌঁছে গেল যে হোসেন তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পরিকল্পনা নিয়ে কুফা যাওয়ার সিধান্ত করেছেনমুসলিমকে কুফায় পাঠানো হয়েছে সেখানকার পরিস্থিতি বুঝবার জন্যে – এ খবরও যথারীতি এজিদের নিকট পৌঁছে গিয়েছিলএ সব খবর পেয়ে তিনি অতি তৎপরতার সাথে হোসেনের বিদ্রোহের পরিকল্পনা ব্যর্থ করার জন্যে উদ্যোগ গ্রহণ করলেনআর এ কাজে তিনি কুফার তৎকালীন গভর্ণরের প্রতি আস্থা রাখা ও নির্ভর করা সমীচীন হবেনা মনে করে তাঁকে সরিয়ে ওবাইদুল্লাহ ইবন জিয়াদকে গভর্ণর করে পাঠালেনজিয়াদ পুত্র ওবাইদুল্লাহকে এই নির্দেশ দিয়ে পাঠালেন যে হোসেনকে যেন কুফা প্রবেশ করার পূর্বেই আটকে দেওয়া হয়  জিয়াদ ছিলেন মাবিয়ার খুবই বিশ্বস্ত এবং অত্যন্ত যোগ্য, দক্ষ ও বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ প্রশাসক ও যোদ্ধাওবাইদুল্লাহও ছিলেন পিতার যোগ্য উত্তরসূরী এবং এজিদের অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও অনুগতওবাইদুল্লাহ দ্রুত কুফায় পৌঁছে গিয়ে সেখানকার গভর্ণরের দায়িত্বভার বুঝে নিলেন। তারপর কুফায় কি ঘটলো তা বর্ণণা করার পূর্বে জিয়াদ সম্পর্কে এখানে কয়েকটি কথা বলা নেওয়া জরুরী। কারণ, কারবালা যুদ্ধের ইতিহাস আলোচনায় এর যেমন প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে তেমনই জিয়াদ সম্পর্কে খুব বিশ্রী ভাষায় অনেক মুসলিম ঐতিহাসিক এমন কিছু আলোচনা করেছেন যা খুবই অনৈতিক ও কুৎসায় পরিপূর্ণ যার জবাব দেওয়াও একান্তই আবশ্যক

জিয়াদ ইতিহাসে জিয়াদ-ইবন-আবিহ নামে খ্যাতপঞ্চম খলিফা মাবিয়া জিয়াদকে এই নামে ডাকতেন, তারপর থেকে ইতিহাসে তিনি এই নামেই পরিচিত হতে থাকলেনমাবিয়ার জিয়াদকে ঐ নামে ডাকার একটি মহৎ প্রেক্ষাপট রয়েছে। সেটা এ রকমঃ  জিয়াদ জন্ম পরিচয়ের দিক থেকে ছিলেন অত্যন্ত অসম্মান, অগৌরব এবং উপেক্ষা, অবজ্ঞা ও অনুগ্রহের পাত্রএটা যেমন তৎকালীন সমাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল তেমনি এই সময়ের  আধুনিক ও তথাকথিত সভ্য সমাজের ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য কারণ, জিয়াদের মা ছিলেন জন্মসূত্রে তায়েফের অধিবাসী এবং আবু সুফিয়ানের একজন উপপত্নীআবু সুফিয়ান ছিলেন মক্কার একটি অভিজাত পরিবারের সন্তান এবং স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন একজন ধনী বণিকওতখন ধনী ব্যক্তিরা বহু উপপত্নী রাখতেন, সে যুগের সেটাই ছিল রীতিআল্লাহর স্বঘোষিত শেষ নবী তথা মুহাম্মদেরও অনেক উপপত্নী ছিলতাঁর উপপত্নীদের মধ্যে মারিয়ার নাম খুবই পরিচিত। একদিন মুহাম্মদের সঙ্গে তাঁর পত্নী হাফসার প্রবল ঝগড়া হয়েছিল ঐ মারিয়াকে নিয়েইসে কথা থাকনবী মুহাম্মদেরও অনেক উপপত্নী ছিল – এটা উল্লেখ করা আবশ্যক হলো এ কথা বলার জন্য যে উপপত্নী রাখাটা সে সময় দোষের কিছু ছিল নাআর যে মেয়েরা উপপত্নী রূপে কোনো পুরুষের হারেমে থাকতেন তাঁরা খারাপ মেয়ে বা দুশ্চরিত্রা মেয়ে – তা মোটেই নয়হয় তাঁরা ক্রীতদাসী, না হয় হত-দরিদ্র পিতা-মাতার সন্তাননিজের ইচ্ছায় কোনো নারীই ঐ জীবন বেছে নিতেন নাসে যুগে উপপত্নীদের গর্ভে সন্তান জন্ম নিলে সেই সন্তান সে সমাজেই বড় হতো, কিন্তু যার ঔরসে তার জন্ম সে তার পিতৃ পরিচয়ের দায় নিত না এবং তাকে তার উত্তরাধিকার বলে গণ্য করত নাএই নীতি বা প্রথা যতই অন্যায়, অনৈতিক ও অমানবিক হোক না কেন, তবু আল্লাহর স্বঘোষীত নবী তথা মুহাম্মদ সেই নীতিকেই বহাল রেখে যান । শুধু তাই নয়, তিনি এও বলে যান যে, একজন পুরুষ যতখুশী উপপত্নী রাখতে পারবে – এটা আল্লার বিধান যাঁরা উপপত্নী হিসাবে কোনো পুরুষের যৌনসঙ্গী হয়ে থাকতে বাধ্য হতেন তাঁদের এই অভিশপ্ত জীবনের উপর তাঁদের যেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিলনা, তেমনই তাঁদের গর্ভজাত সন্তানদেরও তাঁদের নিজেদের অনাকাঙ্খিত জীবনের উপর কোনো হাত ছিল নাতবুও তাঁদের ঐ অবাঞ্ছিত জীবনের জন্য তাঁদেরকেই মাশুল গুণতে হতোসমাজে তাঁরা আর পাঁচটা মানুষের মত স্বীকৃতি পেতেন না, উপপত্নীগণ পেতেন না পতির পরিচিয় ও স্বীকৃতি এবং তাঁদের সন্তানগণ পেতেন না পিতৃ-পরিচয়এ যুগেও কোনো নারী যদি কোনো পুরুষের দ্বারা প্রতারিত হয়ে বিবাহের পূর্বে সন্তানের জন্ম দেয় তবে তথাকথিত এই সভ্য সমাজের মানুষ সেই নারী ও তাঁর সদ্যজাত সন্তানকে অসভ্য, নোংরা ও কুৎসিত ভাষায় গালাগাল দেয় এবং সমাজ থেকে নির্বাসিত করে।

আলোচনা হচ্ছে জিয়াদ প্রসঙ্গে তিনি ছিলেন যেহেতু আবু সুফিয়ানের একজন উপপত্নীর গর্ভজাত সন্তান, তাই তিনি ছিলেন পিতৃ পরিচয় থেকে বঞ্চিত এবং সমাজের কাছে অবজ্ঞা, উপেক্ষা ও করুণার পাত্রসে যুগের ক্ষেত্রে সেটাই ছিল সামাজিক রীতি, কিন্তু এ যুগের ঐতিহাসিকগণ যদি তাঁদের কে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করেন তবে তা নিশ্চিতভাবেই হবে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। হ্যাঁ, বহু মুসলিম ঐতিহাসিক সেই অপরাধে অপরাধীতাঁরা জিয়াদের নির্দোষ মা’কে অসতী ও দুশ্চরিত্রা রমণী এবং নির্দোষ জিয়াদকে জারজ সন্তান ও তাঁর পুত্র ওবাইদুল্লাহকে জারজের পুত্র বলে অকারণে আক্রমণ করেছেন। মানুষ পূঁথিগত বিদ্যায় যতই উচ্চশিক্ষিত হোক না কে, তিনি যদি প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করতে সফল না হন, তবে তাঁর মন যে কুসংস্কার, কুপ্রথা ও ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক অফুরন্ত গরল ভান্ডারের বিরাট আধার হয়ে বিরাজ করবেই তার প্রমাণ হলেন এই ঐতিহাসিকগণজিয়াদ জন্মসূত্রে অখ্যাত ও অবজ্ঞার পাত্র হলে কি হবে, তিনি তাঁর তীব্র মেধা ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং কঠোর পরিশ্রম, অতুলনীয় সততা ও দায়িত্ববোধের দ্বারা সকলের কাছ থেকে সমীহ ও সম্মান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেনতাঁর এই গুণের জন্য  মাবিয়া তাঁর অত্যন্ত কদর করতেন এবং তাঁকে প্রশাসনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছিলেনতাঁর দায়িত্ব পালনের যোগ্যতায় এবং বিচক্ষণতায় মুগ্ধ হয়ে মাবিয়া তাঁকে প্রথমে বসরার শাসনকর্তা এবং পরে তাঁর একার হাতেই বসরার শাসনভার সহ কুফার শাসনকর্তারও দায়িত্বও অর্পণ করেছিলেনধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠেছিলেন মাবিয়ার দক্ষিণ হাতমাবিয়া তাঁকে শুধু প্রশাসনের উচ্চপদে নিযুক্ত করে সম্মানিত ও পুরস্কৃতই করেন নি, তাঁকে এইসব বিরাট সম্মান অপেক্ষাও অনেক বড় সম্মান প্রদান করেছিলেন যে সম্মানের কোনো তুলনাই হয় নামাবিয়ার পিতা আবু সুফিয়ান জিয়াদকে নিজের সন্তানের স্বীকৃতি প্রদান করেন নি, মাবিয়া কিন্তু জিয়াদকে তাঁর পিতার সন্তানের স্বীকৃতি প্রদান করে এক অমর কীর্তি স্থাপন করে গেছেন । তিনি জিয়াদকে ‘আমার ভাই’ বলে বুকে টেনে নিয়েছিলেন একজন খলিফা হয়েওতিনি জিয়াদকে ডাকতেন ‘জিয়াদ আমার ভাই’ এই নামে ‘জিয়াদ আমার ভাই’ – এই কথাটাই আরবিতে হলো ‘জিয়াদ-ইবন-আবিহ’ মুসলিম ঐতিহাসিকদের চোখে মাবিয়া একজন মুসলমানের শত্রু এবং অতি জঘন্য ব্যক্তি কারণ,  মাবিয়া আলির কাছে বয়াত নেন নি এবং ওসমানের হত্যাকারীদের শাস্তির দাবীতে অনড় থেকে আলির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন আর জিয়াদ যেহেতু তাঁর উপর ন্যাস্ত দায়িত্ব পালন করে মাবিয়ার অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও স্নেহভাজন হয়ে উঠেছিলেন তাই তাঁদের চোখে তিনিও মুসলমানদের শত্রুতাই তাঁর জন্ম পরিচয় তুলে জিয়াদ এবং তাঁর পুত্রকে এই ঐতিহাসিকগণ কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করে নিজেদের অন্তরের জ্বালা প্রাণভরে মিটিয়ে নিয়েছেন। থাক এখন সে কথা, ওবাইদুল্লাহ কুফায় যাওয়ার পরে সেখানকার পরিস্থিতি কি হল তা এবার দেখা যাক

ওবাইদুল্লাহ কুফায় গিয়েই মুসলিমের খবর জানতে পারলেনএটা জানতে পারা খুব স্বাভাবিকই ছিলকারণ মুসলিম সেখানে গিয়ে এজিদের বিরুদ্ধে এবং হোসেনের পক্ষে জনমত গঠনের কাজ গোপনে চালালেও তা গোপন থাকেনি, এজিদের পক্ষের মানুষজন তা জেনে যায় এবং তাঁরা ওবাইদুল্লাহকে জানিয়ে দেনতিনি তখন কাল বিলম্ব না করে মুসলিম ও হানিকে ডেকে পাঠিয়ে তাঁদের কাছ থেকেই তাঁদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে সে সম্পর্কে জানতে চানমুসলিম স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে তিনি যা শুনেছেন তা সবই সত্যিতিনি ঔদ্ধত্যের সঙ্গে বলেন যে, মাবিয়া এজিদকে ইসলামি সাম্রাজ্যের খলিফা মনোনীত করে ইসলামি নীতির লঙ্ঘন ও অবমাননা করেছেনতা ছাড়া এজিদ খলিফা পদের উপযুক্ত ব্যক্তিও নয়াই তাঁকে আমরা খলিফা বলে মানি নাইসলামি সাম্রাজ্যের খেলাফতের উত্তরাধিকার হলেন একমাত্র হোসেন, কারণ তিনি ইসলামের শেষ নবী মুহাম্মদের দৌহিত্র ও বংশধর এবং খলিফা পদের উপযুক্ত ব্যক্তিওএ কথা শোনার পর কুফার গভর্ণর ওবাইদুল্লাহ তাঁকে এবং তাঁর আশ্রয়দাতা ও মদতদাতা হানিকে খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে প্রাণদন্ড দেনহোসেন সদলবলে কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন সে খবর এজিদ ও ওবাইদুল্লাহর কাছে আগেই পৌঁছে গিয়েছিল, সে খবর যে সত্যি তা মুসলিমের মুখ থেকে শোনার পর সংশয় যে টুকু ছিল তাও দূরীভূত হলোমুসলিম ও হাসির মৃত্যুদন্ড কার্যকরার পর ওবাইদুল্লাহ ওমর ইবন সাদের নেতৃত্বে বড় একদল সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করলেন কুফা শহরের বাইরেই হোসেনের গতিরোধ করার জন্যেপরে ওবাইদুল্লাহ স্বয়ং সেই বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেন

ত্রয়োদশ অধ্যায়

কারবালা প্রান্তরে হোসেনের গতিরোধ

এদিকে মহানন্দে কুফার পথে হোসেন যখন এগিয়ে চলেছেন  তখন পথিমধ্যেই বিনামেঘে বজ্রপাতের মত সংবাদটি তাঁর কাছে পৌঁছে গেল যে কুফার গভর্ণর মুসলিমকে হত্যা করেছেখুব স্বাভাবিকভাবেই হোসেনের শিবিরে নেমে এল গভীর শোকের ছায়া এবং তাঁরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেনএই পরিস্থিতিতে কুফা যাত্রা বাতিল করার দাবী উঠলো শিবিরেসবাই তাকিয়ে আছে হোসেনের দিকে তিনি কি বলেন তা শোনার জন্যে  হোসেন কিছুক্ষণ ভেবে জানিয়ে দিলেন যে তিনি কুফা যাত্রা বাতিল করবেন নাহোসেনের এই ঘোষণা সবাই মুষড়ে পড়লেনকারণ এই পরিস্থিতিতে কুফা যাওয়ার অর্থ কী তা সবাই স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেনএমন কি যাঁরা হোসেনের নিজের বংশধর এবং নিকট আত্মীয়স্বজন যাঁরা তাঁরাও অকারণে এবং অযথা আত্মাহুতি দিতে কুফা যাওয়ার কোন অর্থই খঁজে পাচ্ছেন নাকিন্তু হোসেনের মুখের ওপর তাঁদের পক্ষে  সে কথা তাঁরা বলতে পারলেন নাআবার হোসেনের সহযাত্রীরা সবাই যে জেনেশুনে হোসেনের জন্য মরণকূপে ঝঁপ দিতে তাঁর সঙ্গী হয়েছেন তা নয়, অনেকেই আশা করেছিলেন কুফা শহরের মানুষ হোসেনের সাথে নিশ্চয় থাকবেনতাঁরা মুসলিমের নিহত হওয়ার খবরে অসম্ভব বিচলিত হয়ে হোসেনকে বারংবার কুফা যাত্রা বাতিল করার জন্য অনুরোধ করতে লাগলেনকিন্তু হোসেন তাঁর সিদ্ধান্তে অটল ও অনড়ই থাকলেনএই অবস্থায় যাঁরা কুফা যাত্রা বাতিল করার বিষয়ে হোসেনকে পীড়াপীড়ি করছিলেন তাঁরা মক্কা ফিরে গেলেনহোসেন তখন বাকি সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে পুনরায় কুফা অভিমুখে রওনা দিলেনসেই সময় তাঁর সাথে খুব সামান্যই সৈন্য-সাথী ছিলঠিক কতজন সৈন্য ছিল তা সঠিক করে বলা সম্ভব নয়সেই সংখ্যা নিয়ে নানা মত রয়েছে  তবে সংখ্যাটা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই নগণ্য তা সংশয়াতীতবিভিন্ন যে মত রয়েছে তাতে এটা স্পষ্ট যে সেই সংখ্যাটা ৭০ (সত্তর) থেকে ১১০ (একশত দশ) এর মধ্যেসত্তরের মধ্যে ৩০ (ত্রিশ) জন মাত্র অশ্বারোহী এবং ৪০ (চল্লিশ) জন পদাতিক সৈন্য ছিলেনঅপরদিকে ওবাইদুল্লাহ ওমরের নেতৃত্বে যে সৈন্যদল পাঠিয়ে ছিলেন তাতে অশ্বারোহী সেনাই ছিল ৪০০ (চারশত) জনহোসেনের বাহিনীকে প্রথমে আটকে দেয় কুফা শহর থেকে প্রায় ৪০ (চল্লিশ) কিলোমিটার দূরে একটি জায়গায় সেখানকার অধিবাসী তামিম গোত্রের লোকেরাজায়গাটির নাম হলো ইতিহাস প্রসিদ্ধ সেই ‘কারবালা’কারবালা প্রান্তরেই তাই বাধ্য হয়ে হোসেন তাঁবু খাটিয়ে শিবির স্থাপন করেনইউফ্রেটস বা ফোরাত নদী থেকে অতি সামান্য দূরে এই কারবালা প্রান্তর অবস্থিততার কিছু পরে সেখানে ওমরের সৈন্যবাহিনী এসে পৌঁছায়তাঁরা যে খলিফা এজিদের বাহিনী তা প্রথমে হোসেন বুঝতে পারেন নিতিনি ভেবে ছিলেন তাঁরা কুফা থেকে এসেছেন তাঁর সমর্থনেওমর সৈন্যবাহিনী নিয়ে সেখানে পৌঁছালে হোসেন মনে মনে অনেকটাই উৎসাহ বোধ করলেন এবং উৎসাহভরে ওমরকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কারা? তোমরা কি আমার সাথে যোগদান করতে এগিয়ে এসেছো? ওমর তাঁর পরিচয়  দিলেন এবং তাঁর সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলেনতখন মূহুর্তেত মধ্যে হোসেনের মুখমন্ডলে যে আশা ও ভরসার হর্ষভাব ছিল তা মিলিয়ে গেল এবং এক অনিশ্চয়তা ও আশঙ্কার দুশ্চিন্তায় তাঁর মুখমন্ডল কালো হয়ে গেলসেই হতাশা ও আশঙ্কার মেঘ মূহুর্তের মধ্যে হোসেনের শিবিরকে ছেয়ে ফেললো

ফোরাত নদীর তীরে হোসেনের শিবির থেকে কিছুটা দূরে ওমরও তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে শিবির স্থাপন করেনওবাইদুল্লাহ তাঁর সঙ্গে পরে যোগদান করেন আর একদল বড় সৈন্যবাহিনী নিয়েহোসেনের সঙ্গে শুরু হয় তাঁদের আলাপ-আলোচনাঠিক কী কী আলোচোনা হয়েছিল তাঁদের মধ্যে, কে কি প্রস্তাব বা শর্ত রেখেছিল, হোসেন ঠিক কবে সেখানে পৌঁছান, ওবাইদুল্লাহর বাহিনীতে কত সৈন্য ছিল, এবং আলোচনা ভেঙে গেলে কবে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, কতদিন যুদ্ধ চলেছিল, উভয় পক্ষের কতজন হতাহত হয়েছিল ইত্যাদি বিষয়ের  সম্পূর্ণ নির্ভুল তথ্য কোথাও পাওয়া যায় না, সে সময় ইতিহাস লেখার প্রচলন ছিল নাইতিহাস লেখার কাজ শুরু হয়  তার অনেক পর থেকেকয়েক শতাব্দী ধরে মানুষের মুখে মুখে কারবালা যুদ্ধের কথা ঘুরতে ঘুরতে যখন ইতিহাস লেখার কাজ শুরু ততদিনে কারবালার ইতিহাস যে বহুলাংশে বিকৃত হয়ে গেছে তা বলাই বাহুল্যআর এর ইতিহাস বা এটা নিয়ে অজস্র যে গল্প-উপন্যাস-কবিতা রচিত হয়েছে তার রচয়িতাদের সিংহভাগই মুসলমান যাঁরা লিখেছেন এটা প্রমাণ করার জন্য যে এজিদ অনৈতিক পথে খলিফা হয়ে ইসলামের পতাকাকে ধুলায় লুটিয়ে দিচ্ছিল, হোসেন ইসলামের সেই পতাকা উর্দ্ধে তুলে ধরতে গিয়ে শাহাদাত বরণ করেছেনস্বভাবতই সে সব লেখায় লেখকদের নিজেদের মনের কল্পনার রঙ লেগেছে যথেষ্টইতাই এ সব লেখার মধ্যেও দেখা যায় তথ্যগত, পরিসংখ্যানগত এবং আরও নানা বিষয়ে নানা মতসে কথা মুসলিম ঐতিহাসিক ও ধর্মগুরুরাও মানেনএ প্রসঙ্গে মাদ্রাজের (চেন্নাই) গভর্ণমেন্ট কলেজের অধ্যাপক হাজী মাওলানা মির্জা গোলা আব্বাস লিখেছেন,

·         Several authors have attempted to give vivid pictures of stories, whose chronology is not yet traceable and whose antiquity has led many to doubt the reality and genuineness of the stories themselves and to suspect them as of the production of intelligent heads for the inculcation of high moral and ethical principles of the common folk  in the most appealing and dramatic fashion. (source: Wikipedia)

স্বভাবতই কারবালা যুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে লিখতে হলে মূলত নির্ভর করতে হয় মুসলিম লেখকদের লেখা ইতিহাস বা গল্প-উপন্যাসের উপরেইতাঁদের অনেকের মতে হোসেন যুদ্ধ এড়ানোর জন্য তিনটি গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব প্রদান করেছিলেন, কিন্তু ওবাইদুল্লাহ সে প্রস্তাবগুলি প্রত্যাখান করেছিলেন

হোসেনের প্রস্তাব তিনটি হলো – ১) তাঁকে মক্কা কিংবা মদিনা ফিরে যেতে দেওয়া হোক, অথবা ২) এজিদের সঙ্গে আলোচনার জন্য দামেস্কে যেতে দেওয়া হোক, অথবা ৩) তুর্কি সিমান্তে মুসলমানদের শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করবার অনুমতি দেওয়া হোক। কুফার গভর্ণর ঐ তিনটি প্রস্তাবই খারিজ করে দিয়ে তাঁকে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বলেনহোসেন আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করায় যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। মুসলিম ঐতিহাসিকদের দাবী মত হোসেনের দেওয়া উক্ত তিনটি প্রস্তাব কতটা যথার্থ তা নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ট অবকাশ আছেতিন নম্বর প্রস্তাবটি যে অবাস্তব ও মনগড়া তা সহজেই অনুমেয়কারণ মাবিয়ার দীর্ঘ কুড়ি বছরের শাসনে হোসেন মুসলমানদের শত্রুদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন এর প্রমাণ পাওয়া যায় নাএমন কি খলিফা মাবিয়াকে অন্য কোনভাবেও যে তিনি সহযোগিতা করেছেন এমন কথাও শোনা যায় নাসুতরাং তুর্কি প্রান্তে মুসলমানদের শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করার অনুমতি চাওয়ার প্রশ্নটি অবান্তরর হোসেনের সঙ্গে আলোচনা করার নিমিত্ত এজিদের কাছে যেতে দেওয়ার প্রস্তাবটিও যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না কারণ ইসলামি সাম্রাজ্যের খলিফা কে হবেন সে প্রশ্নে আলোচনা করার কোন সুযোগ বা অবকাশই তখন আর ছিল নাএজিদের সঙ্গে হোসেনের মধ্যে আলোচনা করার প্রশ্ন তখনই উঠতো যদি হোসেন এজিদকে খলিফা পদে মেনে নিতে সম্মত হতেনএজিদকে খলিফা মেনে নিয়ে অন্য বিষয়ে কিছু দাবী বা শর্ত থাকলে তা নিয়েই শুধু আলোচনা করার প্রশ্ন উঠতে পারতকিন্তু হোসেন যেহেতু এজিদকে কোন মতেই খলিফা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না  তাই দ্বিতীয় প্রস্তাব মুসলিম ঐতিহাসিকদের নিজেদের মস্তিষ্ক প্রসূত বৈ নয়। সুতরাং একমাত্র সত্যি হলে হতে পারে প্রথম প্রস্তাবটিকিন্তু ঐ প্রস্তাবটি যে কোনো খলিফার পক্ষে মানা সম্ভব নয় তা বলা বাহুল্য

চতুর্দশ অধ্যায়

 

কারবালা যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠলো হোসেনের অনড় মনোভাবে

স্বভাবতই কারবালা প্রান্তরে পরিস্থিতি ক্রমশঃ জটিল হতে থাকলওবাইদুল্লাহ হোসেনের উপর চাপ দিতে থাকলেন এজিদকে খলিফা মেনে নিয়ে তাঁর হাতে বয়াত নেওয়ার জন্যে, অপরদিকে হোসেন সে প্রস্তাবকে তাচ্ছিল্যের সাথে প্রত্যাখান করে তাঁকে মক্কা বা মদিনা ফিরে যেতে দেওয়ার দাবী জানাতে থাকলেনএই অবস্থায় ওবাইদুল্লাহ হোসেনের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করার কৌশল অবলম্বন করলেনওমরকে নির্দেশ দিলেন হোসেনের লোকজনের জন্য ফোরাত নদীর জল বন্ধ করে দিতে এবং তার জন্যে নদীর ধারে সেনা মোতায়েন করার নির্দেশ দিলেনওমর তখন  কয়েক হাজার সেনা নদীর তীর বরাবর দাঁড় করিয়ে দিলেনবাইদুল্লাহ হয়তো আশা করেছিলেন যে, জলকষ্টে যখন সকলের প্রাণ যাওয়ার উপক্রম হবে তখন হোসেন নিজের প্রণের জন্যে না হলেও অন্যদের জন্যে, বিশেষ করে তাঁর সঙ্গের শিশুদের প্রাণ রক্ষার জন্যেও এজিদকে খলিফা মেনে নিতে সম্মত হবেনকিন্তু ওবাইদুল্লাহর আশা বা ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছিলহোসেন জলের জন্য বারবার নদীর ধারে নিজে ছুটে গেছেন, সেনাদের কাছে বহু অনুরোধ করেছেন, অনুরোধ করেছেন ওমরের কাছে, ওবাইদুল্লাহর কাছেও বারবার গিয়ে কাতর আবেদন করেছেন, তবুও একফোঁটা জলের ব্যবস্থা করতে পারেন নি। এ অবস্থাতেও তিনি আপোষ করেন নি, এজিদকে খলিফা মেনে নিতে সম্মত হন নিহোসেন তখন এ রকম ভাবলেন যে, যদি মরতেই হয় তাহলে  জলতেষ্টার অসহ্য কষ্ট ভোগ করে তিলে তিলে মরা অপেক্ষা জলের জন্যে জেহাদ করে মরা অনেক শ্রেয়তিনি এজিদের বাহিনীর সঙ্গে জেহাদ (যুদ্ধ) করাই স্থির করলেন। শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ

সে দিনটি ছিল ৬৮০ খ্রীষ্টাব্দের ১০ ই অক্টোবর (আরবি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৬১ হিজরির ১০ই মহরম)আর একটি মত হলো তারিখটি ছিল ১০ ই অক্টোবর নয় ১৩ ই অক্টোবরএজিদের সৈন্যবাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা কত ছিল তা নিয়েও অনেক মতভেদ আছে। তবে সকলেই একমত যে সৈন্য সংখ্যা ছিল কমপক্ষে তিন হাজার এবং সর্বাধিক দশ হাজারউভয় পক্ষের সৈন্য সংখ্যা যাই হোক না কেন কারবালা প্রান্তরের সেই যুদ্ধটা ছিল একেবারেই অসম যুদ্ধস্বভাবতই ঐ যুদ্ধে হোসেন পরাস্ত হয়েছিলেন এবং তাঁর পক্ষের সকল সৈন্যই নিহত হয়েছিলেনআগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে হোসেনের সঙ্গে সৈন্য সংখ্যা ছিল সত্তর জন থেকে একশ দশ জনহোসেনের প্রতিরোধ করার শক্তি যখন নিঃশেষিত এবং তিনি যখন ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন তখন সিমার নামের একজন সেনাপতি তলোয়ারের আঘাতে তাঁর শিরচ্ছেদ করেন এবং তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই কারবালা যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে, সমাপ্তি ঘটে ইতিহাসের একটি করুণ অধ্যায়ের

পঞ্চদশ অধ্যায়

কারবালা যুদ্ধের বর্ণনায় কাল্পনিক চিত্রনাট্য

কারবালা যুদ্ধের  যে সব বর্ণণা শোনা যায় তাতেও লক্ষ করা যায় একটা বর্ণণার সঙ্গে আর একটা বর্ণণার আকাশ-পাতাল বিভেদতার থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে কারবালা যুদ্ধের উপর মুসলিম ঐতিহাসিক এবং গল্পকারগণ তাঁদের লেখায় এজিদের বাহিনীর বিরুদ্ধে যে নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা, নৃশংসতা, পৈশাচিকতা, বর্বরতা এবং অমানবিকতার কথা লিখেছেন তার অধিকাংশই তাঁদের মনগড়া এটা হওয়ার কারণ হলো এই সব লেখকগণ কারবালা যুদ্ধের ইতিহাস লেখার মনোভাব নিয়ে লিখছেন এমনটা নয়, তাঁরা লিখেছেন এটা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে ইমাম হোসেন ইসলামের নীতি ও আদর্শকে রক্ষা করার জন্য  মুসলমানদের সবচেয়ে বড় শত্রু এজিদের বিরুদ্ধে কারবালা প্রান্তরে যুদ্ধ করে আত্মাহুতি দিয়েছেনস্বভাবতই তাঁদের লেখা ইতিহাসে এবং গল্প-উপন্যাসে যেমন অমিলের ছড়াছড়ি দেখা যায়, তেমনি তাঁদের লেখায় কারবালা যুদ্ধ্বের সত্যিকার ইতিহাসের পরিবর্তে উঠে এসেছে বিকৃত, অর্ধসত্য এবং অসত্য ও মিথ্যা ইতিহাসতাঁরা কতটা আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে কারবালা যুদ্ধের মনগড়া ইতিহাস রচনা করেছেন তা বুঝবার সুবিধার্থে দুটো লেখা থেকে কয়েকটি  বিবরণ এখানে  উদ্ধৃত করা হলো  

·         “... নবীজীর প্রাণের নাতি বারবার অনুরোধ করলেন – তোমরা নদী তীর বন্ধ করো না। আমাদের পানি দাওআমরা সকলেই অত্যন্ত পিপাসার্ত, আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত, আমরা চরম পিপাসাতে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ধরাশায়ী হয়ে যাবো। তোমরা আমাদের জল দাও... জানালেন সকরুণ প্রার্থনা – আমাকে ও আমার পুরুষকুলকে জল দিতে হবে না, তোমরা আমাদের মহিলাদের বাঁচাও , তাদের একটু জল দাও... তারা তোমাদের মা বোনদের মতই অবলা, নিরপরাধ তাদের একটু জল দাও, তারা পিপাসাতে বড়ই কাতর স্বরে ছটফট করছে। বাঁচার মত একটু জল দাও... আমাদের শিশুদের একটু জল দাও, তারা চরম পিপাসায় তাদের মায়ের কোলে চিৎকার করছেতারা কিছুক্ষণের মধ্যে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়বে  এই মরুভূমিতে তাদের জীবন দাও।

 ... মহাত্মা হোসেন আকুল কন্ঠে, ব্যাকুল চিত্তে আকাশ-পাতাল ভেদ করছেন, তখনও নরাধমদের বুকের কোণে এক বিন্দুও করুণার উদ্রেক হয় নি, তখন তারা অট্টহাসিতে মশগুল...

ইমাম শত্রুপক্ষের নিকট শিশুদের জন্য সামান্য পানি প্রার্থী হওয়ার পর শত্রুপক্ষের অগণিত তীর ইমামের শিবিরে ও লোকজনের উওপর পড়তে আরম্ভ করলোএইবার ইমাম হোসেনের ১০ বছরের ভ্রাতুষ্পুত্র কাসেম শাহাদাত বরণ করেনপরে পিপাসার্ত ইমাম পুত্র আসগরকে কোলে নিয়ে পানির জন্য সামান্য অগ্রসর হওয়া মাত্রই আসগরও তীরবিদ্ধ হলেনএইভাবে একের পর এক শিবিরের প্রায় সকলেই মৃত্যুর কোলে ঢোলে  পড়লেন পিপাসার্ত ইমাম সকলের শেষে নদীতীরে যাওয়ার চেষ্টা করলে শত্রুকুল তাঁকে ঘিরে ফেললেনতিনিও শরবিদ্ধ হয়ে ক্ষুধায় পিপাসায় অর্দ্ধমৃত অবস্থায় ভূপতিত হলে নিষ্ঠুর পাপিষ্ঠ সিমার ইমামের শিরচ্ছেদ করতে উদ্যত হলে ইমাম তাকে তাঁর গলার পরিবর্তে ঘাড়ের উপর আঘাত হানতে নির্দেশ দেন এইভাবে ১০ মহরম কুখ্যাত সীমার কর্তৃক একের পর এক ৭০ জনই শাহাদাত বরণ করেন” (দেখুন – উমাইয়া খেলাফত/ড.ওসমান গণি , পৃ – ৪৮-৫২)

ইমাম হোসেনকে নিয়ে লেখা ঐ একই ঘটনায় আর একটি বিবরণ এরূপঃ

·         Hussein ibn Ali told Yazid’s army to offer him single battle , they gave his request. He killed everybody that fought him in single battles. He frequently forced his enemy into retreat, killing a great number of opponents. Hussein and earlier his son Ali al – Akbar ibn Husayn were the two warriors who penetrated and dispersed the core of ibn Sa’ad army (Qualb – e -Lashkar), a sign of extreme chaos in traditional warfare.

Hussein advanced very deep in the back ranks in the Syrian army when the enemies stood between him and  the tents he shouted: ‘ woe betide you oh followers Abu Sufyan ibn Harb’s dynasty! If no religion ever been accepted by you and you have not been fearing the resurrection day then be noble in your world that is if you were Arabs you clam.

Then his enemies evaded back toward him. They continuously attacked each other until his numerous injuries caused him to stay a moment. At this time he was hit on his forehead with a stone. He was cleaning blood from his face while he was hit on the heart with arrow and said: In the name of Allah and by Allah and on the messenger of Allah.’  Then he raised his head up and said: ‘Oh my God! You know that they are killing a man that there is son of daughter of a prophet on the earth except him.’ He then grasped and pulled the arrow out of his chest, which caused heavy bleeding.

He became very weak and stopped fighting. The soldiers approaching him give up confrontation, seeing his position. One soldier, however, walked up to Hussein and hit him his on his head with his sword.

… Hussein got on his horse and tried to leave, but Yazid’s army continued to pursuit. …

Omar bin Sa’ad ordered a man to dismount and finish the job. … then Shimr ibn Dhiljawshan dismounted his horse and cut Hussein’s throat with his sword while Hussein was prostrating to God. Just before his throat was about to be cut, Hussein asked Shimr ibn Dhiljawshan, “Have you done your prayers today? (Source: Wikipedia).

উপরের দুটি বর্ণণা কারবালা প্রান্তরে ১০ ই মহরমের দিনের হোসেনের  ভুমিকা কে কেন্দ্র করেকিন্তু দুটি বর্ণণার মধ্যে কত প্রভেদ? বস্তুত কোনো মিলই নেই এরূপ অসংখ্য দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারেএখানে আর একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া হলোএটা কারবালা যুদ্ধ পরবর্তী একটি ঘটনাকে ঘিরে. ওসমান গণি লিখছেন তাঁর উক্ত পুস্তকে,

·         “পরে ৭০ টি কর্তিত মুন্ডু এবং স্ত্রীলোক ও শিশু সন্তানদের বন্দী অবস্থায় কুফায় উবাইদুল্লাহর নিকট প্রেরণ করা হলযখন রসুলে আকরমের দৌহিত্র ইমাম হোসাইনের রক্তাক্ত শির উবাইদুল্লাহর পদপ্রান্তে হাজির করা হল, তখন কুফার আকাশে-বাতাসে শুধু একটিই রব প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল – হায় হোসেন, হায় হোসেন । অসতী নারীর জারজ সন্তান জিয়াদের পুত্র সমগ্র মনুষ্যকুলের মধ্যে সাক্ষাৎ-শয়তান ইবলিস – উবাইদুল্লাহ অতি তাচ্ছিল্যভাবে যখন ইমামের পবিত্র ছিন্ন মস্তককে একটি ছড়ির দ্বারা নাড়াচাড়া করছিলেন , তখন একজন বৃদ্ধ সাহাবী গগনভেদী আর্তনাদ করে বলে উঠলেন –‘ ধীরে, ওহে ধীরে ! এইটি হযরতের দৌহিত্র, আল্লাহর কসম , আমি স্বচক্ষে  রসুলে করিম হযরত মহম্মদ ( দঃ) – এর পবিত্র মুখদ্বারা এই ওষ্ঠদ্বয়ে বারবার স্নেহ-চুম্বন করতে দেখেছি ।’ বৃদ্ধের মুখদ্বারা এই কথা  সজোরে উচ্চারিত সঙ্গে সঙ্গেই দুরাত্মা উবাইদুল্লাহর শরীর ভুমিকম্পের মত প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল , সত্যের ঘোষণা এমনি অনিবার্য । তাই আজিও ইয়াজিদ, উবাইদুল্লাহ, ওমর ও সীমার প্রমুখ নরাধমদের উপর সমগ্র মনুষ্য জগতের অভিসম্পাত শ্রাবণের বারি ধারার মত ঝরছে ।

... পরে নরাধম উবাইদুল্লাহ হোসেনের ছিন্ন মস্তক ও অন্যান্য পরিজনবর্গকে রাজধানী দামেস্কে প্রেরণ করলে ইয়াজিদ ভীত ও সন্ত্রস্ত অবস্থায় অতি সত্বর ছিন্ন মস্তক প্রত্যর্পণ করেন, এবং কারবালা প্রান্তরে সকলকে সমাধিস্থ করা হয়জীবিত শিশু ও স্ত্রীলোকগণকে ইয়াজিদ সস্মমানে মদিনায় প্রেরণ করেন’ (পৃ -৫২)।

কারবালা প্রান্তরে ১০ই মহরমের ঐ বিয়োগান্ত ঘটনার পরের দৃশ্যের বিবরণ অন্য একটি লেখায় এ রকমঃ কুফায় হোসেনের ছিন্ন মস্তক সহ তাঁর পরিবারের লোকজনদের নিয়ে পৌঁছানোর পর আলীর কন্যা তথা হোসেনের ভগ্নী জয়নব কুফাবাসীদের বলছেন –

·         ‘Oh! People of Kufa! Oh deceitful renege people! Do you weep? So let tears not be dried and let groans not be finished. … Beware, such a bad preparation you have made for yourself that Allah became furious of you and you will be at punishment for ever. Do you weep and cry?  yes, by Allah , do weep numerously and do laugh less ! Since you brought its shame and fault on yourself and you will not be cleanse forever.

বন্দীদের দামেস্কে নিয়ে যাওয়ার পর সূত্রটি লিখছে,

·         ‘(Zaynab) Gave a famous speech in which she denounced Yajid’s claim to be the caliphate and eulogized Hussein’s uprising.’

এজিদে (ইয়াজিদ) প্রাসাদে বন্দীদের কতদিন আটকে রাখা হয়েছিল এবং বন্দীগণ কীরূপ আচরণ করেছিলেন সে বিষয়ে যে বিবরণ দেওয়া হয়েছে তা এই রকমঃ

·         ‘The  prisoners were held in Damascus for a year, some prisoners died of grief, most notably Sukayna bint Husayn . The people of Damascus began to frequent the prison, and Zaynab and Ali ibn al-Husayn used that as opportunity to further propagate the message of Huseein and explain to the people the reason for Hussein’s uprising. As public opinion against Yazid began to foment in Syria and part of Iraq, Yazid ordered their release and return to Medina, where they continued to tell the Hussein,s cause . (Wikipedia).  

কারবালা যুদ্ধের পরবর্তী ঘটনাবলী নিয়ে উক্ত দুটি বিবরণের মধ্যে কোনো সায়ুজ্যই নেই তা বলা বাহুল্যউইকিপিডিয়া যে বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছে তা যে প্রায় সম্পূর্ণই  মনগড়া তা সাধারণ বুদ্ধিতেই বোধগম্য হয়নবীর দোহিত্র হোসেনের প্রতি যাঁদের গভীর ভালবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল তাঁদের মনের গভীরে এজিদের সৈন্যদের প্রতি ভয়-ভীতিও যে ছিল সে কথাও খেয়ালে রাখা প্রয়োজন । সেই ভয়-ভীতি ঊপেক্ষা করে সবাই হোসেনের কাটা মুন্ডু এবং পরিবারের লোকজনদের দেখতে ব্যাপক মানুষ হুমরি খেয়ে পড়েছিল এ কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়দ্বিতীয় দাবী হলো রাজধানী দামেস্ক শহরে কারাগারে দলে দলে মুসলমানরা হোসেনের পরিবারের সদস্যদের দেখতে ভীড় করেছেন এবং সেই লোকজনদের সামনে মনের সুখে বা মনের দুখে হোসেনের পরিবারের লোকেরা এজিদের সমালোচনা করেছেন এবং হোসেনের প্রশংশা করেছেন আর এজিদ ও তাঁর সৈন্য-সামন্ত সবাই চুপচাপ দেখেছেন ওই বিবরণে আরও আছে যে, কারাগার থেকে হোসেনের পরিবারের সদস্যদের প্রচারে সিরিয়ায় এবং ইরাকের বিভিন্ন জায়গায় এজিদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও জনরোষ বাড়তে শুরু করায় এজিদ ভীষণ ভীত হয়ে পড়েন এবং তাঁদেরকে মুক্তি দিয়ে মদিনায় পাঠিয়ে দেনএই সব দাবীগুলি শুধু অসারই নয়,  গল্পের গরুর গাছে ওঠার মতই হাস্যকর এবং কাল্পনিকঅবশ্য হোসেনের কাটা মুন্ডু সহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের কারবালা থেকে কুফা এবং কুফা থেকে দামেস্কে নিয়ে যাওয়া এবং তারপর এজিদের ভুমিকা সম্পর্কে ড.গণির বিবরণের মধ্যে কিছুটা সত্যতা রয়েছেওবাইদুল্লাহ সম্পর্কে তাঁর উচ্চারিত বিশেষণগুলি শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করলেও এজিদের ভূমিকা প্রসঙ্গে যেটা বলেছেন তাতে ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতার কিছুটা ছাপ আছেএজিদ হোসেনের পরিবারের সদস্যদের সাথে যে ব্যবহার প্রদর্শন করেছেন তাতে তাঁর মহানুভবতার ছাপ রয়েছেকোনো মুসলিম ঐতিহাসিক যদি তা স্বীকার করেন তবে তা মুসলিমদের পক্ষে খুবই অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়কিন্তু ড.গণি ওবাইদুল্লাহ সম্পর্কে যা লিখেছেন তা সর্বৈব অসত্য ও আক্রোশমূলকহোসেনের কাটা মুন্ডু নিয়ে ওবাইদুল্লাহ যে পৈশাচিক আচরণ করেছেন বলে তিনি দাবী করেছেন তাতে প্রমাণিত হয় যে হোসেনের প্রতি ওবাইদুল্লাহর মনে অশেষ ক্রোধ ও ঘৃণা যুগযুগ ব্যাপী সঞ্চিত ছিল । কিন্তু এটা কতটা সত্য তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছেবরং হোসেনের প্রতি অনেকটা ঊদার ও সহানুভূতিশীল ছিলেন এমন কথা জানাচ্ছে অন্য একটি সুত্র,  যেটা মুসলিমদের দ্বারা পরিচালিত। সূত্রটি লিখছে,

·         ‘... Upon learning that his army had succeeded to lay a siege around the Imam's camp, Governor Ibn Ziyad sent additional military units to Karbala and appointed Umar Ibn Sa'ad in charge. Imam Husain (a.s.) opened a dialogue with Umar Ibn Sa'ad and convinced him to lift the siege so that the Imam with his family and companions could leave Iraq. Umar Ibn Sa'ad liked the Imam's proposal and sent a message to Governor Ibn Ziyad notifying him about the results of the talks with Imam Husain (a.s.). Ibn Ziyad also found the Imam's proposal acceptable. However before agreeing to it officially, Shimr Bin Dhil-Jawshan, opposed it strongly. As a result Ziyad wrote a letter to Umar Ibn Sa'ad commanding him to either go to war with Imam Husain (a.s.) or be relieved of his duties as commander of the army and Shimr would not only replace him but despatch Ibn Sa'ad's head to Kufa. (www.al-islam.org/short/karbala.htm).  

এখানে যে ইবন জিয়াদের কথা বলা হয়েছে তিনিই হলেন কুফার নব নিয়ুক্ত গভর্ণর ওবাইদুল্লাহ। সুত্রটি বলছে তিনি হোসেনকে মক্কায় ফিরে যেতে দিতে তিনি সম্মত ছিলেন, কিন্তু সীমারের তীব্র আপত্তির কারণে তাঁকে (হোসেনকে) সে সুযোগ দিতে পারেন নিএই ঘটনা থেকে এটা প্রতীয়মান হয় না যে হোসেনের কাটা মুন্ডুকে অসম্মান ও অপমান করার নিকৃষ্ট মনোভব ওবাইদুল্লাহ পোষণ করতেনওবাইদুল্লাহর নেতৃতাধীন বাহিনীর হাতে হোসেন নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন, সুতরাং ওবাইদুল্লাহ একজন নিকৃষ্ট ও নিচু প্রবৃত্তির মানুষ – এই তথ্যটা বা কথাটা ধর্মান্ধ মুসলমানদের যতটা স্বস্তি দেয়, ঠিক ততটি অস্বস্তি দেয় তার উলটো কথাটা । তাই ড.গণি এজিদ সম্পর্কে যা লিখেছেন এবং উক্ত ওয়েব সাইটটি ওবাইদুল্লাহ সম্পর্কে যা লিখেছে তা  ধর্মান্ধ মুসলমানদের কাছে খুবই অস্বতিকর । এইসব অস্বস্তিদায়ক তথ্যগুলি আধুনিক যুগের মুসলিম ঐতিহাসিক ও লেখকগণ সর্বতভাবে চেষ্ট করে থাকেন আড়াল করার বা গোপন করার কিংবা খন্ডন করার । কিন্তু তা সম্ভব নয় কারণ,  আরবের প্রথম যুগের ঐতিহাসিকগণ যে সব ইতিহাস লিখে গেছেন তাতে তাঁরা কোনো তথ্যই গোপন করেন নি তা যতই মুসলিমদের পক্ষে অস্বস্তিকর হোক না কেন । সেই ঐতিহাসিকদের মধ্যে আল তাবারি হলেন একজন । আল তাবারি লিখেছেন যে এজিদ হোসেনের কর্তিত মুন্ডু দেখে ভীষণ মর্মাহত হয়েছিলেন। তিনি তাঁর সেই কর্তিত মুন্ডু সহ অন্যান্য সকল মুন্ডুগুলি মর্যাদার সঙ্গে সমাধিস্থ করার নির্দেশ দেন এবং সসম্মানে হোসেনের পরিবারবর্গকে মদিনায় পাঠাবার ব্যবস্থা করেনআল তাবারি সহ সেই যুগের ঐতিহাসিকপগণ যাঁরা যথাসম্ভব সত্য ইতিহাস লিখে গেছেন সেই ইতিহাস গ্রন্থগুলি পরবার্তীকালে নষ্ট করে ফেলা হয়তাঁদের লেখা ইতিহাসকে খণ্ডন করে অনেক ইতিহাস ও সমালোচনা লেখা হয়েছেএইসব বই ও সমালোচনামূলক লেখাগুলি থেকে প্রথম যুগের ঐতিহাসিদের লেখা  অনেক তথ্য পাওয়া যায়ফলে আলি মহান আর মাবিয়া নিকৃষ্ট এবং হোসেন মহান আর এজিদ নিকৃষ্ট বলে তুলে ধরার বহু শতাব্দী ধরে হাজার চেষ্টা সত্বেও মাবিয়া ও এজিদের মধ্যে যে ভাল গুণাবলীগুলি ছিল তা মুছে দেওয়া যায় নিএবং ঐ কারণে হাজার চেষ্টা করেও ইসলাম ধর্ম এবং  ইসলামি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও তার প্রসারের ক্ষেত্রে যে ব্যাপক বলপ্রয়োগ, খুন-সন্ত্রাস, নারী ধর্ষণ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে তা চাপা দেওয়া যায় নিএ প্রসঙ্গ থাক, ফিরে যাওয়া যাক কারবালার ইতিহাসে

কারবালার যুদ্ধের পরবর্তী ঘটনায় যাওয়ার আগে আরও একবার যুদ্ধের প্রাকমূহুর্তের ঘটনার উপর দৃষ্টিপাত করা আবশ্যকইতিমধ্যেই সেই অধ্যায়ের পরিস্থিতি নিয়ে কিছু আলোচনা করা হয়েছেসেই আলোচনায় আমরা দেখেছি যে হোসেন যুদ্ধ এড়ানোর জন্য যথাসাধ্য প্রয়াস করেছেন এমন দাবী করেছেন ড.ওসমান গণিতিনি লিখেছেন যে হোসেন এজিদের সেনাপতিদের তিনটি গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন যা মেনে নিলে কারবালা প্রান্তরে যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরী হত নাপ্রস্তাব তিনটি কি কি তার উল্লেখ উপরে করা হয়েছেসেই প্রস্তাবগুলি প্রত্যাখান করে এজিদের সৈন্যবাহিনী ফোরাত নদীর জল বন্ধ করে দিয়ে এজিদের বাহিনীকে অবরোধ করা হয় তখন হোসেন পিপাসার্ত শিশু ও নারীদের জন্য হোসেন সকলের কাছে এক ফোঁটা জলের জন্য বারবার কাতর অনুরোধ করেছেন, প্রার্থনা করেছেন, কিন্তু এক ফোঁটা জল না দিয়ে এজিদের বাহিনী সবার বুকে তীর নিক্ষেপ করে সবাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছেনএক্ষেত্রে নরাধম ও পৈশাচিকের দল শিশুদেরও রেহাই দেয় নিএ সব বিবরণের মধ্যে দিয়ে যা বলা হয়েছে তা হলো এজিদের পরিকল্পনা ও নির্দেশই ছিল হোসেনকে হত্যা করা এবং প্রকৃতিগতভাবে এজিদ এবং তাঁর নিযুক্ত গভুর্ণর ওবাইদুল্লাহ ও প্রধান সেনাপতি ওমর বিন সা’দ প্রমুখরা প্রত্যেকে ছিলেন ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর,বর্বর ও পিশাচএজিদ হোসেনকে হত্যা করার জন্য বহু পূর্বেই সঙ্কল্প করেছিলেন এমন দাবী করেছে ‘বিষাদ সিন্ধু’র রচয়িতা মীর মোশারফ হোসেনতিনি লিখেছেন,

·         ‘যদি আমি মাবিয়ার পুত্র হই, তবে হাসান-হোসেনের বংশ একেবারে নিপাত না করিয়া জগৎ পরিত্যাগ করিব নাশুদ্ধ হাসানের মৃতদেহ দেখিয়াই যে, সে মহাগ্নি নির্বাপিত হইবে, তাহা নহে; হাসানের বংশ মধ্যে সকল মস্তক দ্বিখন্ডিত করিয়াই যে এজিদ ক্ষান্ত হইবে তাহাও নহেমোহাম্মদের বংশের একটি প্রাণী বঁচিয়া থাকিতে এজিদ ক্ষান্ত হইবে না; তাহার মন মনোবেদনাও হইতে বিদুরিত হইবে না’ (পৃ - ৩২)

এই সব দাবী সত্যি হলে তবে সবার লেখা ইতিহাসে বা উপন্যাসে এগুলির সমর্থন বা উল্লেখ থাকত। কিন্তু না, পাওয়া যায় নাশধু তাই নয়, এর বিপরীত বিবরণই আমরা দেখতে বিভিন্ন সুত্রের লেখায়এর কিছু প্রমাণ অন্য ঘটনার ক্ষেত্রে আমরা উপরের আলোচনায় দেখেছিএবার আমরা দেখব ড.গণি ও মীর সাহেবের দাবী কত অসার এবং মনগড়া তা অন্য সূত্রের বিবরণ থেকে যে সূত্রটিরও মুহাম্মদ এবং হোসেনের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস ও আনুগত্য বিদ্যমানএই সূত্রটি দাবী বলেছে যে, এজিদের সৈনিবাহিনী যখন হোসেনের গতিরোধ করে তখন তিনি দুটি কথা বলেছিলেন – আমি কুফার মানুষদের আহবানে কুফা যাচ্ছি, আমাকে তোমরা যেতে দাও, যদি কুফার মানুষ আমাকে না চায় আমি ফিরে আসব। আর আমাকে যদি কুফায় যেতেই না দাও তবে অবরোধ তুলে নাও, আমি এখান থেকেই মক্কা ফিরে যাচ্ছিএর বাইরে কোনো  কথা বলেন নি বা প্রস্তাব দেন নিসূত্রটি কি লিখেছ দেখা যাক,

·         The enemy army blocked the camps of Imam Husain (a.s.) from advancing. Tension started to rise between the two. The Imam addressed the enemy explaining to them his motives for going to Kufa, that it was in response to the invitation of the people. He even showed them a bagful of letters he received from Kufa. Hur said that he and his men were not the writers of those letters. Imam told them that if they did not like him to advance with the journey, he was prepared to return to Hijaz.(source:  www.al-islam.org/short/karbala.htm )

ইমামের এই কথা শুনে সৈন্যদলের প্রধান ‘হুর’ ইমামকে জানালেন অকর্কশ ভাষায় জানালেন তাঁর প্রতি কি নির্দেশ রয়েছে গভর্ণর ওবাইদুল্লাহরসেই নির্দেশে তাঁকে (হোসেনকে) হত্যা করার আদেশ ছিল নাহুর’ ইমামকে কি বলেছিলেন তা তাঁর কথাতেই শোনা যাক

·         Hur replied, "We are commissioned to follow you until we take you to Governor Ibn Ziyad, and suggested to the Imam to go towards a station which is neither Kufa nor Medina." Imam Husain found the proposal fair and turned the caravan away from Kufa. Hur and his army marched parallel to the Imam. The two sides reached a village called Nainawa where Ibn Ziyad's messenger (Yazid's governor over Kufa) delivered a message to Hur. The message read, " ... force Husain to a halt. But let him stop in an open space, without vegetation or water." Hur conveyed the contents of the letter to Imam Husain. The Imam, his family and companions defiantly resumed their journey and reached a place where another enemy force blocked their move and forced them to stop. When Imam Husain learned that the place was called Karbala, he felt he reached the destination and ordered his camp to be setup. That day was 2nd of Muharram, Hijri 61.

সেনাধক্ষ্য   হুরের  জবাবের ভাষা ও সুর আদৌ ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও আক্রোশমূলক ছিল না এবং হোসেন স্বয়ং তাঁর জবাব ও আচরণে খারাপ কিছ দেখেন তা উপরের বিবরণে অত্যন্ত স্পষ্ট । যাকে হত্যা করার আদেশ থাকে  তাঁর সঙ্গে সেনাধ্যক্ষরা যেরূপ আচরণ  করেন সেরূপ আচরণ যে হুর করেননি তা বলা বাহুল্য । ড.গণি ও তাঁর মত অনেক মুসলিম ঐতিহাসিক দাবী করেছেন যে এজিদের বাহিনী এত নিষ্ঠুর ও হৃদয়হীন ছিল যে হোসেন যখন এক ফোঁটা জলের জন্য তাদের কাছে ব্যাকুল হয়ে হাত পেতেছেন এবং পাগলের মত একজনের কাছ থেকে আর একজনের কাছে ছুটে গিয়েছেন তখন তারা অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছেন এবং পরপর তীর ছুঁড়ে হোসেন এবং তা৬র লোকজনকে হত্যা করেছেন । কিন্তু এটা  এত বড় মিথ্যাচার য্র তুলনা মেলে ভার । এই দাবী খণ্ডিত হয়ে গেছে উইকিপিডিয়ার ইতিহাসে । উইকিপিডিয়া লিখছে এ প্রসঙ্গে,

·         - Hussein ibn Ali told Yazid's army to offer him single battle, and they gave him his request. He killed everybody that fought him in single battles.[53] He frequently forced his enemy into retreat, killing a great number of opponents. Hussein and earlier his son Ali al-Akbar ibn Husayn were the two warriors who penetrated and dispersed the core of ibn Sa'ad's army (Qalb-e-Lashkar), a sign of extreme chaos in traditional warfare.

Hussein advanced very deep in the back ranks of the Syrian army. When the enemies stood between him and the tents he shouted:

"Woe betide you oh followers of Abu Sufyan ibn Harb's dynasty! If no religion has ever been accepted by you and you have not been fearing the resurrection day then be noble in your world, that's if you were Arabs as you claim."[54]

Then his enemies invaded back toward him. They continuously attacked each other,[55] Until his numerous injuries caused him to stay a moment. At this time he was hit on his forehead with a stone. He was cleaning blood from his face while he was hit on the heart with arrow and he said: "In the name of Allah, and by Allah, and on the religion of the messenger of Allah." Then he raised his head up and said: "Oh my God! You know that they are killing a man that there is son of daughter of a prophet on the earth except him." He then grasped and pulled the arrow out of his chest, which caused heavy bleeding.[56]

He became very weak and stopped fighting. The soldiers approaching him gave up confrontation, seeing his position. One soldier, however, walked up to Hussein and hit him on his head with his sword.

কেউ যদি নিজগুণে বড় ও মহৎ না হন, তাঁকে সেই রূপে জোর করে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে অন্যকে ছোট ও নিকৃষ্ট  করতেই হয় – এটাই নিয়মআলি ও আলির পুত্রদের সেইরূপ বড় ও মহৎ প্রমাণ করতে গিয়ে মুসলিম ঐতিহাসিকগণ মাবিয়া ও এজিদ এবং তাঁদের অনুগামীদের অত্যন্ত ছোট, নীচ ও নিকৃষ্ট করে উপস্থাপিত করেছেন ইতিহাসের পাতায়কিন্তু এতদসত্ত্বেও  মাবিয়া ও এজিদের মধ্যে মানুষ হিসাবে যে দোষ-ত্রুটি বা ক্ষুদ্রতা-সহ যে  মহৎ গুণগুলি ছিল তা ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেওয়া যায় নিবরং যাঁরা তাঁদের চরিত্রের ভাল ও মহৎ দিকগুলিকে অস্বীকার ও নস্যাত করতে গিয়ে তাঁদেরকে কুৎসিত ও কদর্য ভাষায় কালিমালিপ্ত করার প্রয়াস করেছেন তাঁরা নিজেরাই নিজেদের ক্ষুদ্রতা ও নীচতাকেই  অনাবৃত করে ফেলেছেন তাঁদের নিজেদের অজান্তে

 

ষোড়শ অধ্যায়

 কারবালা যুদ্ধের প্রভাব ও ফলাফল

এখন থেকে ১৩৩২ বছর পুর্বে যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছে তবুও তার প্রভাব রয়েছে মুসলিম সমাজেপ্রতিবছর সমগ্র বিশ্বে এই দিনটি উদযাপিত হয় ‘মহরম’ হিসাবেযুদ্ধের তারিখটি ছিল আরবি ক্যালেন্ডারের মহরম মাসের ১০ তারিখ, তাই এই দিনটি ‘মহরম’ দিবস  নামেই অভিহিত হয়ে আসছেদিনটি বলা বাহুল্য যে একটি শোকের দিনকিন্তু মহরম যে ভাবে উদযাপিত তাতে উদযাপনকারীদের মধ্যে শোকের লেশমাত্র থাকে নাভীষণ আনন্দ  সহকারে তাঁরা দিনটি উদযাপন করে থাকেন। ঢাক-ঢোল ও নানা রকম বাদ্যযন্ত্রের বাজনার তালেতালে উদ্দাম নৃত্যে মত্ত হয়ে ওঠেন তাঁরা১০ ই মহরমের  কয়েকদিন পূর্ব থেকেই এই আনন্দ যজ্ঞ শুরু হয় এবং ‘মহরমে’র দিন তার সমাপ্তি ঘটেমহরমের এই ধরণের অনুষ্ঠানে যাঁরা সামিল হন তাঁরা অনেকেই পুরো মাত্রায় আনন্দ উপভোগ করার জন্য মদ পান করেনমহরম দিবসের এইরূপ উদযাপন থেকে এটা স্পষ্ট যে কারবালা যুদ্ধের সত্য-মিথ্যা কোনো ইতিহাসই অধিকাংশ মুসলমানই জানেন নামহরমের দিনে অতি নগণ্য একটি অংশ হোসেনকে স্মরণ করেন বেদনা ভরা মনেতাঁদের মধ্যে আবার একটি অংশ আছে যাঁরা আরও নগণ্য তাঁরা নিজেদের বুকে পেটে খুর দিয়ে আঘাত করে  হোসেন তাঁর মৃত্যুর সময়ে যে শারিরীক যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন সেটা ভাগ করে নিতে চায়এই দৃশ্য  সত্যিই হৃদয় বিদারক। ধর্মান্ধতা মানুষকে কত আবেগপ্রবণ ও নিরেট মূর্খ করে তুলতে পারে এটা তার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণও বটেএই আবেগপ্রবণ ধর্মান্ধ মুসলিম জনতা মুসলিম ঐতিহাসিক এবং ধর্মগুরুগণ কারবালা যুদ্ধ নিয়ে আলি ও তাঁর পুত্রদ্বয় হাসান ও হোসেনের পক্ষে যে নগ্ন পক্ষপাতিত্বপূর্ণ এবং অসত্য ও বিকৃত ইতিহাস প্রচার করেন তাঁরই শিকার

কারবালা যুদ্ধ অখণ্ড মুসলিম জামাতকে সর্ব প্রথম সরাসরি দুভাগে ভাগ করে দেয়। বিশ্ব মুসলিম সমাজ এখন আক্ষরিক অর্থেই বহুধা বিভক্ততবে প্রাধান দুটি ভাগ হলো শিয়া ও সুন্নীশিয়া সুন্নীর বাইরেও রয়েছে ‘আহমদীয়া মুসলিম জামাত’। আবার শিয়া ও সুন্নীদের ভিতরে বহু ভাগ-উপভাগ আছেএই যে আলাদা আলাদা ভাগ বা গোষ্ঠী তাদের মধ্যেকার বিভাজন বা  দ্বন্দগুলো এতই তীক্ষ্ণ ও প্রকট যে একটা গোষ্ঠী আর একটা গোষ্ঠীকে শত্রুতা জ্ঞান করে। মুসলমানদের মধ্যে প্রধান দুটি ভাগের উৎপত্তি হয় কারবালা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। এক পক্ষের মত ছিলো (এখনো আছে) ইসলামি সাম্রাজ্যের খলিফা পদ অলঙ্কৃত করার অধিকার মুহাম্মদের বংশধর ছাড়া আর কারোরই নেই তাঁদের অভিমত ছিলো -   প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় খলিফাগণ খলিফা পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন অন্যায়ভাবে, সেই সময়ে যিনি একমাত্র ন্যায্য ও যোগ্য উত্তরাধিকার ছিলেন সেই আলিকে বঞ্চিত করে, তাই তাঁরা ছিলেন অবৈধ খলিফাশিয়া মুসলমানরা এই মতের অনুসারীবাকিরা সুন্নী মুসলমানএঁরা বিশ্বাস করেন যে নবী ও রসুলদের কোনো উত্তরাধিকার হয় নাতাঁরা এও বিশ্বাস করেন যে আলির পূর্ববর্তী তিন খলিফাই ইসলাম-সম্মত উপায়েই খেলাফত লাভ করেছিলেন এবং তাঁরা ছিলেন অবশ্যই বৈধ খলিফাশিয়া মুসলিমরা তৃতীয় খলিফার খেলাফত কালে সংকলিত কোরানকে (সুন্নী মুসলমানরা এখন যে  কোরানটিকেই আল্লাহর প্রেরিত বলে বিশ্বাস করেন) সত্য ও বিশুদ্ধ কোরান বলে বিশ্বাস করেন না, তাঁরা এই কোরানটিকে ‘খেলাফতি কোরান’ অর্থাৎ নকল বা জাল কোরান বলে মনে করেন

      শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ মনে করেন আলির সঙ্গে প্রতারণা করে যাঁরা খলিফা হয়েছিলেন তাঁরা নিজেদের অন্যায় চাপা দিতে কোরানের কিছু অংশ বাতিল করেছেন, কিছু অংশ সংশোধন করেছেন এবং কিছু অংশ নিজেরা রচনা করে কোরানে জুড়ে দিয়েছেনঅপরদিকে সুন্নী মুসলমানরা এই কোরানকেই সহি তথা আসল কোরান বলে দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করেন এবং এইরূপ বিশ্বাসও পোষণ করেন যে এই কোরানটাই বেহেস্তে আল্লাহর কাছে গচ্ছিত রয়েছেএইরূপ প্রবল মতভেদের কারণে দুপক্ষই পরষ্পরকে প্রতিপক্ষ বলে মনে করে এবং এক পক্ষ অন্য পক্ষকে মুসলমান বলেই মনে করে নাকারবালা যুদ্ধের সময়েই মুসলমানরা দুটো ভাগে হয়ে যায় যাদের একটি ভাগ ছিলো এজিদের পক্ষে,  আর অপর ভাগটি ছিলো হোসেনের পক্ষেহোসেনের পক্ষে যারা ছিলো তারা ছিলো নগণ্য একটি অংশ মাত্রব্যাপক সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমান ছিলেন খলিফা এজিদের পক্ষেই  যাঁরা পরে সুন্নী মুসলমান রূপে পরিচিত লাভ করেন। সেই ধারা আজও  অব্যাহত আছে, পৃথিবীতে শিয়া মুসলমানদের সংখ্যা  তুলনামূলকভাবে আজও নগণ্য, দশ শতাংশ মাত্রঅবশ্য এখন সুন্নী মুসলমানরাও মনে করেন যে মাবিয়ার পর খেলাফতের ন্যায্য দাবীদার ছিলেন শুধু হোসেনই, এজিদ ছিলেন একজন অবৈধ খলিফা, তিনি অনৈসলামিক পথে খলিফা হয়েছিলেন

কারবালা যুদ্ধের পরিপ্রক্ষিতে মুসলমান জগৎ দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়লেও ইসলামি সাম্রাজ্যে তার বিশেষ প্রভাব পড়ে নিঅতি সামান্য প্রভাব যে টুকু পড়েছিল তা  মক্কা ও মদিনা শহরেই মূলত সীমাবদ্ধ ছিলআব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের এজিদকে শেষ পর্যন্ত খলিফা পদে স্বীকার করেন নি এবং তিনি নিজেকেই খলিফা বলে ঘোষণা করেছিলেনএজিদ আব্দুল্লাহর বিদ্রোহোকে খুব সহজেই দমন করে মক্কা-মদিনায় শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেছিলেনএজিদ বেশীদিন জীবিত ছিলেন না, সাড়ে তিন বছর খেলাফত চালানোর পর মাত্র ৪৩ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেনতারপর তাঁর দ্বিতীয় পুত্র দ্বিতীয় মাবিয়া খলিফা হন, কিন্তু তিনি ছিলেন ভীষণ অসুস্থ এবং ৩/৪ মাসের মধ্যে তিনিও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেনতারপর খলিফা হন প্রথম মারোয়ান যিনি খলিফা হওয়ার পর সাম্রাজ্যের মধ্যে যে টুকু অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলা তখনো অবশিষ্ট ছিল তা অচিরেই বন্ধ হয়ে যায় এবং  সাম্রাজ্য বিস্তারের কাজ যেটা থমকে গিয়েছিল তা আবার নতুন উদ্যমে শুরু হয় মারোয়ান তাঁর পুত্র অত্যন্ত যোগ্য ব্যক্তি আব্দুল মালিকের হাতে খেলাফত অর্পণ করে যান আলির পর প্রথমে মাবিয়া ও পরে প্রথম মারোয়ান ইসলামি সাম্রাজ্যকে ধ্বংসের কিনারা থেকে তুলে নিয়ে এসে তাকে এত শক্ত ও সুসংহত ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন যে সেই ইসলামি সাম্রাজ্য ও তার খলিফাতন্ত্র অর্থাৎ  খেলাফতি শাসন-ব্যবস্থা টিকে ছিল কারবালা যুদ্ধের পরও প্রায় ৬০০ বছর (১২৫৮ খৃঃ পর্যন্ত)। এই সময়ের মধ্যে আবার উমাইয়া যুগকে (৬৬১-৭৫০ খৃঃ) বলা হয় ইসলামের সাম্রাজ্য বিস্তারের স্বর্ণযুগমাবিয়া ছিলেন উমাইয়া বংশের লোক তাই তাঁর খেলাফতকাল থেকে শুরু করে ঐ বংশের যিনি শেষ খলিফা (দ্বিতীয় মারোয়ান, ৭৪৪-৭৫০) ছিলেন তাঁর সময়কালকে বলা হয় উমাইয়া যুগআলি ও হোসেনের পক্ষে যদি যথেষ্ট জনসমর্থন থাকত কিংবা মাবিয়া ও এজিদের পক্ষে যদি মুসলিম জাহানের নিরঙ্কুশ সমর্থন না থাকতো তবে এটা কখনোই সম্ভবপর হতো না 

নিশ্চিতভাবে এ কথা বলা যায় যে, মুহাম্মদ প্রবর্তিত ইসলামি সাম্রাজ্যের প্রায় অপমৃত্যু হুতে যাচ্ছিল আলি ও তাঁর পুত্র হোসেনের কবলে পড়েমাবিয়া সেই অপমৃত্যুর হাত থেকে ইসলামি সাম্রাজ্যকে রক্ষা করেছিলেন। সেজন্য তামাম দুনিয়ার মুসলমানদের উচিত ছিল মাবিয়ার নিকট কৃতজ্ঞ থাকাকিন্তু এটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা হলো মাবিয়াই এখন মুসলিম উম্মাহর কাছে সব চেয়ে বড় নিকৃষ্ট ব্যক্তিসে কথা থাক,আলোচনা হচ্ছিল কারবালা যুদ্ধের প্রভাব কতটা পড়েছিল সে প্রসঙ্গেএই প্রসঙ্গে শেষ ও মুল কথাটি হলো, কারবালা যুদ্ধের পর যে ব্যাপকভাবে ইসলামি সাম্রাজ্যের শক্তি ও আয়তনের বৃদ্ধি ও বিস্তার ঘটেছে তাতে এটা প্রমাণিত হয় যে কারবালা যুদ্ধের কোনো নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হয় নি মুসলিম সমাজ ও ইসলামি সাম্রাজ্যের উপর।

 সপ্তদশ অধ্যায়

কারবালা যুদ্ধের কথিত কারণ

কারবালা যুদ্ধ কেন সংঘটিত হয়েছিল, এর পশ্চাতে কি কি কারণ রয়েছে এবং এই যুদ্ধের জন্য কে বা কারা দায়ী এই প্রশ্নগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণআমরা যাঁরা এই যুদ্ধের  ইতিহাস কিছুটা পড়েছি বা শুনেছি তাঁরা প্রায় সকলেই বোধ হয় কম বেশী এটাই জানি যে, এই যুদ্ধের জন্য দায়ী ছিলেন শুধু দুজন ব্যক্তি – পঞ্চম খলিফা মাবিয়া ও তাঁর পুত্র ষষ্ঠ খলিফা এজিদমুসলিম ঐতিহাসিকগণ অবশ্য প্রধান হোতা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন মাবিয়াকেইআর অপরদিকে তাঁদের মতে হোসেন ছিলেন সম্পূর্ণ নির্দোষ, তিনি এজিদ নামধারী  মুসলমান সমাজের একজন কলঙ্ক, মদ্যপ ও লম্পট ব্যক্তির হাত থেকে  ইসলাম, ইসলামি সাম্রাজ্য ও প্রকৃত ইসলামি খেলাফতকে বাঁচাতে  চেষ্টা করেছিলেন। এজিদের চোখে এটাই ছিল তাঁর অপরাধ এবং সেই কারণেই তিনি হোসেনকে নিষ্ঠুর ও নৃশংসভাবে কারবালা প্রান্তরে হত্যা করেছিলেন একটি চরম অন্যায় ও অসম যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে

মাবিয়ার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগগুলি সাজানো হয়েছে এই রকমঃ এক) সৎ ও ধর্মনিষ্ঠ খলিফা আলির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন খলিফা হওয়ার লালসায়  দুই) আলিকে সরাসরি যুদ্ধে পরাস্ত করতে না  পেরে গুপ্তঘাতক লাগিয়ে তাঁকে হত্যা করে অসৎ এবং অনৈতিক পথে খেলাফত দখল করেছিলেনতিন) পরবর্তী খলিফা মনোনয়নে নবীর জ্যেষ্ঠ দৌহিত্র ইমাম হাসানেরর সঙ্গে করা কৃত চুক্তির খেলাপ ও অবমাননা করেছিলেন চার) ইসলামি নীতি এবং আল্লাহর নবী প্রদর্শিত পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে আপন অযোগ্য পুত্রকে খলিফা পদে মনোনীত ও অধিষ্ঠিত করেছিলেনপাঁচ) খলিফা হয়েই নিজের ক্ষমতাকে শক্তশালী ও সংহত করতে ইসলামের সমস্ত নীতি ও আদর্শকে জলাঞ্জলী দিয়ে যে খেলাফত তিনি প্রতিষ্ঠিত করে ছিলেন তা যথার্থ ইসলামি খেলাফত নয়আলির খেলাফতের পর ইসলামের সত্যিকারের খেলাফতি যুগের যে অবসান হয়েছিল তার সূচনা হয়েছিল মাবিয়ার হাত ধরেই 

এজিদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত ও সাজানো অভিযোগগুলি হলোঃ

·         এক) এজিদ ছিলেন একেবারেই অযোগ্যদুই) তিনি ছিলেন মদ্যপ, লম্পট, উচ্ছৃঙ্খল ও স্বেচ্ছাচারী তিন) নিজের সিংহাসনকে নিষ্কন্টক রাখার জন্যে ইমাম হোসেনকে হত্যা করার  নির্দেশ দিয়েছিলেনঅর্থাৎ তাঁর নির্দেশেই হোসেনকে হত্যা করা হয়েছিলো। চার) বিদ্রোহ দমন করার উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে মদিনা লুঠ  এবং মসজিদে নববী-সহ মুহাম্মদ এবং বিশিষ্ট সাহাবীদের কবরগুলির চরম অসম্মান ও অবমাননা করেছিলেনপাঁচ) মক্কা আক্রমণ করে কাবা গৃহে তথা আল্লাহর গৃহে আগুন লাগিয়ে এক নজিরবিহীন জঘন্য অপরাধ সংঘটিত করেছিলেন 

অষ্টাদশ অধ্যায়

মানুষ মাবিয়া ও প্রশাসক মাবিয়া

মাবিয়া ও এজিদের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগগুলি নিয়ে আলোচনা করার পূর্বে দুটি বিশেষ বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করা আবশ্যক যে দুটি বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করা আবশ্যক তা হলো, এক). সাধারণভাবে  মুসলিম ঐতিহাসিক এবং বুদ্ধিজীবীগণ মাবিয়াকে কোন চোখে দেখে থাকেন এবং দুই).  মাবিয়া মানুষ হিসাবে এবং প্রশাসক হিসাবেই বা কেমন ছিলেন? মাবিয়ার সম্পর্কে আধুনিক যুগের উচ্চ শিক্ষিত মুসলিমরা কী মনোভাব পোষণ করেন তা বোঝার জন্যে মুসলিম সমাজের কিছু বিশিষ্ট স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বের মন্তব্যের প্রতি চোখ রাখা যেতে পারে। সৈয়দ আমির আলি বলেছেন, ‘

·         ইমাম হাসেনের পদত্যাগের পর,  মুয়াবিয়া ইসলামের একজন স্বঘোষিত শাসক হলেন, হীন কদর্য ষড়যন্ত্রের সাহায্যে ইমাম হাসেনের জীবনাবসান ঘটিয়ে অবিসংবাদী, অপ্রতিদ্বন্দী ও একচ্ছত্র নৃপতি হলেন’ তিনি আরও বলেছেন, ‘তিনি ছিলেন ধূর্ত, অসৎ, তীক্ষ্ণ মেধা সম্পন্ন কৃপণ অথচ আপন স্বার্থসিদ্ধিতে অস্বাভাবিক উদার’ (উদ্ধৃতি দুটি আমির আলির “দ্য স্পিরিট অব ইসলাম” গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ থেকে নেওয়া)।

মাওলানা আবুল কালাম আজাদ বলেছেন,

·         ‘আমার বিশ্বাস কেয়ামতের দিন যদি জালেমদের ফাছেক দল থেকে পৃথক করে দাঁড় করানো হয়, তাঁদের পয়লা কাতারে বানু উমাইয়ারা থাকবেসে জালেমরাই ইসলামের এ আজাদীর (গণতন্ত্রের) মন্ত্রটিকে জুলুমে পরিণত করল... ব্যক্তিগত স্বার্থে এ আদর্শটিকে পদদলিত করল...  তারা যে শুধু ইসলামের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে রাজতন্ত্রে পরিণত করে ছেড়েছে তাই নয়, অবশ্য এটাও কোরানের দৃষ্টিতে কুফরী বৈ নয় কিন্তু সব চাইতে বড় জুলুম হল, ইসলামের প্রাণশক্তি সত্য প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠার আদর্শটিকে তরবারির জোরে দাবিয়ে দিতে চাইলমুসলমানদের সত্য বলার প্রেরণাকে নষ্ট করে দিল’ ( দ্রঃ - মাওলানা আবুল কালাম আজাদঃ যে সত্যের মৃত্যু নাই)

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মাবিয়া ছিলেন উমাইয়া বংশের একজন প্রতিনিধি এবং ইসলামি সাম্রাজ্যে উমাইয়া খেলাফতের যুগ তথা উমাইয়া যুগের সূচনা তাঁর হাত ধরেই হয়েছিল ড.ওসমান গণি লিখেছেন,

·         “৬৬১ খ্রীষ্টাব্দে মহানবীর(দঃ) ব্যক্তিগত সচিব ও আবু সুফিয়ানের পুত্র প্রথম মুয়াবিয়া ইসলামের গণতন্ত্রের গতিরোধ করেনপ্রথম মুয়াবিয়া উমাইয়া রাজবংশের জন্ম দিয়ে উমাইয়া সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেনমুয়াবিয়া স্বয়ং মহানবী(দঃ) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রকে সমাধিস্থ করে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করত যে পরিমাণ পাপ সঞ্চয় করেছেন, সমগ্র মুসলিম জাহানের সমূহ রাজনৈতিক পাপও তার সমান হবে কিনা সন্দেহ ... এই রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে তাঁর নিকট ন্যায়-অন্যায়ের কোন ভেদ ছিল না। আপন স্বার্থসিদ্ধির জন্য, পথের কাঁটাকে (তিনি যত মহানই হোন না কেন) সরিয়ে দেওয়ার জন্য জগতের এমন কোন জঘন্য কাজ ছিল না, মুয়াবিয়া তাকে ধীরভাবে বরণ করতে দ্বিধা বোধ করেছিলেনএখানে তিনি ছিলেন কামনা ও ইচ্ছার দাস মাত্রএই পরিপ্রেক্ষিতে  মুয়াবিয়াকে মুসলিম জাহানের একজন চির কুখ্যাত মুসলমান ও একজন অনৈসলামিক প্রথার প্রবর্তক  ও রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা গণতন্ত্রের হত্যাকারী এবং ইসলাম জগতের মহাক্ষতিকারক ব্যতীত আর কিছু বলা যাবে না” (দ্রঃ উমাইয়া যুগ, পূর্বাভাষ)

এই হলো মাবিয়া সম্পর্কে মুসলিম জগতের সাধারণ মনোভাব, একেবারে ক্রোধ ও ঘৃণায় কানায় কানায় পরিপূর্ণমাবিয়া তাঁদের চোখে একজন রাজা বা নৃপতি মাত্র, খলিফা মোটেই ননমাবিয়া সম্পর্কে এইরূপ প্রচার চলে আসছে শত শত বছর ধরে, ফলে এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, হচ্ছেন অমুসলিম ঐতিহাসিক ও লেখকরাও  ঐতিহাসিক আরনল্ড “Caesar of the Arabs” গ্রন্থে লিখেছেন,

·         “মুয়াবিয়া উমাইয়া সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলে, প্রাচীন পৌত্তলিক আরবের ভাবধারার পুনর্জাগরণ হয়ধর্মের স্থান গ্রহণ করল – অধর্ম, সত্যের স্থান গ্রহণ করল – মিথ্যা, সাধতার স্থান নিল অসাধুতানিরপেক্ষতার স্থান নিল স্বজনপ্রীতি; ‘মজলিস – উস – শুরার’ স্থান দখল করল – রাজতন্ত্রতাই সেদিনে মুয়াবিয়ার উপাধি ছিল – আরবদের সীজার।” 

মাবিয়া সম্পর্কে  মুসলিমরা যে ধারণা ও মনোভাব পোষণ করেন ও নিরন্তর প্রচার করেন তা কিন্তু কি ব্যক্তি মাবিয়া, কি প্রশাসক মাবিয়া, কোনও ক্ষেত্রেই ইতিহাসের পাতায় যে স্বাক্ষর তিনি রেখে গেছেন তার সঙ্গে একদম মেলে নামাবিয়ার দীর্ঘ জীবনে তিনি কখনও ছিলেন নবী মুহাম্মদের সহকর্মী তথা  সাহাবি, কখনও ছিলেন মুহাম্মদের সর্বাধিক ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত তিন সাহাবা তথা প্রথম তিন খলিফার অধস্তন উচ্চপদস্থ কর্মচারি বা আমলা, আবার কখনও ছিলেন ইসলামি সাম্রাজ্যের প্রধান কর্ণধার তথা খলিফা। তাঁর এই বর্ণময় জীবনের যে পরিচয় পাওয়া যায় ইতিহাসের পাতায় তা এক কথায় অনবদ্য, অতুলনীয়, শিক্ষণীয়, ঈর্ষণীয় এবং অবশ্যই আদর্শ স্থানীয় সেই বর্ণময় জীবনের উপর একটু আলো ফেলা যাক আবু সুফিয়ান ছিলেন প্রথম দিকে মুহাম্মদের প্রধান শত্রুদের অন্যতম একজনমুহাম্মদের মক্কা বিজয়লাভের পূর্বের আগের দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন মুহাম্মদ ও ইসলামকে ইতিহাসের পাতা  থেকে মুছে দেওয়ার লক্ষ্যে এবং সঙ্কল্পে অনড় ও অটলমুহাম্মদ মক্কা জয় ও দখল করার পর তিনি (আবু সুফিয়ান) তাঁর (মুহাম্মদ) কাছে অগত্যা আত্মসমর্পণ করেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমান হনসেজন্য আবু সুফিয়ানকে আজও অগত্যা মুসলমান’ বলে কটাক্ষ করে থাকেন মুসলিমরামাবিয়া ছিলেন সেই আবু সুফিয়ানের পুত্রমানুষ চেনার ব্যাপারে মুহাম্মদের সুখ্যাতি সর্বজন সুবিদিতমক্কা বিজয়ের পর তিনি কৌশলগত কারণে আবু সুফিয়ানের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিশোধ নেন নি, ঘুরিয়ে তাঁর সঙ্গে নানাভাবে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু তাঁকে মন থেকে কোনদিনই বিশ্বাস করেন নিঅথচ আবু সুফিয়ানের পুত্র মাবিয়া হয়ে উঠেছিলেন মুহাম্মদের অতি বিশ্বস্ত ও স্নেহধন্য একজন সহযোদ্ধা (সাহাবী) মুহাম্মদ মাবিয়াকে তাঁর ব্যক্তিগত সচিব নিযুক্ত করেনশুধু তাই নয়, মাবিয়া উপরেই কোরান লিখে রাখার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বপূর্ণ কাজটিও অর্পণ করেন মুসলিমরা দাবী করেন যে মুহাম্মদ নিরক্ষর ছিলেন, একজন নিরক্ষর ব্যক্তি তাঁর মুখনিসৃত বাণী একমাত্র তাঁকেই লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব অর্পণ করতে পারেন যাঁকে তিনি সবার চেয়ে অধিক বিশ্বাস করেনআবু বকর, ওমর ফারুক, আলি প্রমুখ প্রবীণ সাহাবীগণ থাকতে মাবিয়ার উপরে এত আস্থা ও ভরসা রাখাটা নিঃসন্দেহে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণপরে মাবিয়াও কিন্তু এটা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে মুহাম্মদ তাঁর উপর  গভীর আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করে বিন্দুমাত্র ভুল করেন নি মাবিয়ার সততা, বিশ্বাসযোগ্যতা, নিষ্ঠা, দায়িত্ববোধ ও পারদর্শিতা সকলের মনেই গভীর রেখাপাত করেছিলতাই মুহাম্মদ পরবর্তী যুগে যাঁরা খলিফা হয়েছিলেন তাঁরাও তাঁর প্রতি গভীর আস্থা রাখতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন নি তাঁরা সকলেই তাঁকে প্রাশাসনে উচ্চপদে নিয়োগ করেছিলেনমুহাম্মদ থেকে শুরু করে তৃতীয় খলিফা ওসমান গণির খেলাফত পর্যন্ত ইসলামি সাম্রাজ্যের প্রশাসনে মাবিয়া কত বড় বড় ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন তা শোনা যাক মাবিয়াকে যাঁরা পৃথিবীর সব থেকে কুখ্যাত মুসলমান বলে গালাগাল দিয়েছেন তাঁদের অন্যতম একজন ড.ওসমান গণির মুখ থেকেই তিনি  ‘উমাইয়া খেলাফত’ গ্রন্থে লিখেছেন –

·         ‘৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মক্কা বিজয়ের পর নিরুপায় আবু সুফিয়ান বাধ্য হয়েই ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিলেন, সঙ্গে পুত্র মুয়াবিয়া এরপর থেকে মহানবীর সাথে তাঁদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে থাকেমুয়াবিয়া রসুলে আকরমের (সাঃ) ব্যক্তিগত সচিবের পদও লাভ করেন, এবং ‘ওহী’ প্রত্যাদেশ লেখার কাজে নিযুক্ত হন... পরবর্তীকালে মুয়াবিয়ার ভ্রাতা ইয়াজিদ সিরিয়ার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন এবং মুয়াবিয়া জেলা শাসকের পদ লাভ করেন

তখন খলিফা ওমরের যুগসিরিয়াএ শাসনকর্তা ইয়াজিদ ইয়ারমুকের শহীদ হলে খলিফা ওয়মর মুয়াবিয়াকে সিরিয়ার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেনখলিফা ওমরের পর খলিফা ওসমান মুয়াবিয়াকে এই পদে স্থায়ী করেন। মুয়াবিয়া আপন প্রতিভা বলে, কর্মগুণে সিরিয়াতে সুশাসন কায়েম করেনখলিফা থেকে আরম্ভ করে সকল মানুষের নিকট হতেই তিনি সুশাসনের সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হনএকদিন তাঁর চরম নির্ভিকতা ও সামরিক দক্ষতার জন্যই সিরিয়া, বাইজান্টাইন আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছিল” (পৃ-১০)

প্রথমে মুহাম্মদের ব্যক্তিগত সচিব, তারপর প্রথম খলিফা আবু বকরের আমলে জেলা শাসক, তারপর দ্বিতীয় খলিফা ওমর ফারুকের আমলে সিরিয়ার অস্থায়ী গভর্ণর, তারপর তৃতীয় খলিফা ওসমান গণির খেলাফত কালে ঐ প্রদেশেরই স্থায়ী গভর্ণর – এইভাবে পর্যায়ক্রমে একের পর এক গুরুদায়িত্বে অধিষ্ঠিত থাকার ও সুচারুরূপে সেই সব দায়িত্ব পালন করার গৌরবোজ্জ্বল মুকুট ছিল মাবিয়ার ঝুলিতেএটা নিশ্চয় একটা প্রামান্য মাপকাঠি যে, কত সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল তাঁর এবং কত আনুগত্যশীল ছিলেন তিনি মুহাম্মদ এবং তাঁর অগ্রজ খলিফাদের প্রতিসেই মাবিয়ার উপর বিশ্বাসঘাতকতা, অসততা ও প্রতারণার অভিযোগ উত্থাপন করা হলে সেই অভিযোগের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক নিজ কর্ত্যবের প্রতি সততা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং খলিফার প্রতি আনুগত্য  প্রদর্শনের ধারাবাহিকতা বজায় ছিল খলিফা ওসমানের শাসন কালেও ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পূর্বে মাবিয়ার বিরুদ্ধে অসততা, বিশ্বাসযোগ্যতা ও প্রতারণার বিন্দু মাত্র অভিযোগ কেউ কখনো তোলেনি খলিফা ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সময়ে তাঁর (মাবিয়ার) বিরুদ্ধে নানা রকম অভিযোগ উঠতে শুরু করেএই পর্যায়ে খলিফার সঙ্গে আলির দ্বন্দ ক্রমশঃ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়মাবিয়া যথারীতি খলিফার পাশে দৃঢভাবে অবস্থান করেনতিনি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে খলিফাকে প্রথমে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরামর্শ দেন এবং পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে খলিফাকে রাজধানী মদিনা থেকে দামেস্কে স্থানান্তরিত করার অথবা দেহরক্ষী নেওয়ার পরামর্শ দেননিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে বিচার করলে সিরিয়ার গভর্ণর মাবিয়ার ভূমিকা নিয়ে কোনও প্রশ্ন ওঠার কথা নয়একজন সৎ, দায়িত্বশীল এবং নির্ভিক গভর্ণরের পক্ষে খলিফা এবং সাম্রাজ্যের এহেন দুঃসময়ে ও গভীর সঙ্কট কালে যা করা উচিৎ মাবিয়া ঠিক সেই কাজই করেছিলেনতবুও যাঁরা মাবিয়ার সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে তাঁকে প্রবলভাবে বিদ্ধ করেন তাঁরা কতোটা নিরপেক্ষ ও ইতিহাসের প্রতি কতোটা দায়বদ্ধ সে প্রশ্নের জবাবদিহি করতেই হবে। একজন সৎ গভর্ণর যদি তাঁর সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতি দায়বদ্ধ থেকে তাঁর নিয়োগকর্তা খলিফার গভীর বিপদে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেন এমন পরিস্থিতিতে যাঁরা তাঁকে খলিফার কুপরামর্শদাতা ও ক্ষমতালোভী বলে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চান তাঁরা যে কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য তাঁর সমালোচনায় মত্ত তা বুঝতে অসুবিধা হয় না

মাবিয়ার আসল পরিক্ষা শুরু হয় প্রকৃত পক্ষে তাঁর খলিফা পদে আসীন হওয়ার পরতখন তিনি মুহাম্মদ কিংবা তাঁর প্রতিনিধিবৃন্দ তথা খলিফাদের অধীনস্থ উচ্চ পদস্থ আমলা নয় যে তাঁকে শুধু নিয়োগকর্তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও আস্থা অর্জনের জন্যে কাজ করলেই চলবেতখন তাঁর মাথার উপর  কেউ নেয় যাঁদের কাছে জবাবদিহি করতে হবেতদুপরি সাম্রাজ্য তখন দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের কবলে পড়ে ধ্বংসের কিনারায় দাঁড়িয়েরকম সংকট কালে যে কোনো শাসকের পক্ষে ভুল হওয়া খুব স্বাভাবিক ব্যাপারএ রকম এক দুঃসময়ে অভূতপূর্ব এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি তাঁকে দাঁড়াতে হয়েছিলসে পরীক্ষায় তিনি যে চরম ও পরম সাফল্য অর্জন করেছিলেন তা আজ সর্বজন সুবিদিত। এই ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করতে তাঁকে সবচেয়ে বেশী সাহায্য করেছিল তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা ও যোগ্যতা এবং সাম্রাজ্য পরিচালনায় যে নীতিগুলি অবলম্বন করেছিলেন সেই নীতিগুলি ভিতর ও বাইরের বিদ্রোহ দমন করে সাম্রাজ্যের আরও বিশাল বিস্তৃতি ঘটিয়ে সুবিশাল সাম্রাজ্যে অতি নিপুণভাবে তিনি এত সুন্দর শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন যা প্রায় রূপকথা হয়ে উঠেছিলএ কথা তাঁর শত্রুদের পক্ষেও অস্বীকার  করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়সেই শান্তি ও শৃঙ্খলা সম্পর্কে তাঁর সব চেয়ে বড় ও কড়া সমালোচক ঐতিহাসিক ড.ওসমান গণি কি বর্ণণা করেছেন তার উপর চোখ বোলানো  যাকতিনি লিখেছেন, -

·         “সারা দেশে বেজে উঠলো সুশাসনের দামামা, ঘোষিত হলো সুনীতির জয় গানসঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু মানুষ স্থান পেল কারাগারেফলে দেশের অসংখ্য নর-নারী শান্তি ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললোসমগ্র দেশের এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত চুরি নাই-চাপটা নাই। খুন নাই খারাবি নাই। দেশে যেন নিস্তব্ধ পারাবারমুয়াবিয়া যেন সেখানে সরোবরে ফুটন্ত পদ্মগভীর রাত্রিতেও কোন পরমা সুন্দরী, কোন উর্বশী, কোন তিলোত্তমা একাকী দীর্ঘ পথ অতিক্রম করলেও, কোন দুর্ধষ দুরাচারেরও শক্তি বা সাধ্য ছিল না একটি আঙ্গুল হেলানর। এমনি শাসন ব্যবস্থা তিনি প্রণয়ন ও প্রবর্তন করেছিলেনযার  ফলে মুয়াবিয়া জনগণের নিকট যেন ফেরেস্তার সম্মান লাভ করলেন। সমগ্র আরব সমাজে এরূপ কঠোর শাসন আর কখনও লক্ষ্য করা যায় নাসাগরের উত্তাল তরঙ্গরাশিকে তিনি শান্ত পারাবারে পরিণত করেছিলেনবৈশাখির ভয়ালরূপকে বসন্তের স্নিগ্ধ বাতাসে রূপান্তরিত করতে পেরেছিলেন, মহাবর্ষার প্রচন্ড প্লাবনকে সুনির্দিষ্ট খালে পরিচালিত করতে সক্ষম হয়েছিলেনহযরত ওসমান হত্যার পর হতে হযরত আলী পর্যন্ত সমগ্র দেশে যে অরাজকতা ও উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা দিয়েছিল, তা শুধু চিরতরে প্রশমিত ও প্রদমিতই হলো না, সেখানে দেখা দিল শাসনে প্রশাসনে শান্তির সমীরণ ও সবুজ শালবনূরীভূত হলো যত আগাছা, যত অরাজকতা” (দ্রঃ প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃ – ৩৩,৩৪)

একটা সাম্রাজ্যের যাবতীয় আগাছা, অরাজকতা ও অত্যাচার-অনাচার নির্মূল করার বিরলতম নজির স্থাপন করার জন্য ইতিহাসে চিরকালের শ্রেষ্ঠ আরব-নৃপতির অভিধার পালক আজও মাবিয়ার মাথার মুকুটে শোভা পাচ্ছেএই অভিধায় তাঁকে অভিহিত করেছেন ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সকল ঐতিহাসিকগণএই যে প্রায় অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয় নজির ও সাফল্যের কীর্তি স্থাপন - তার পশ্চাতে যে যাদু ছিল তা হলো তাঁর (মাবিয়ার) অনুসৃত নীতিমালাতিনি সাম্রাজ্য পরিচালনায় ইসলামের কট্টর ধর্মীয় সংকীর্ণতা এবং কোরানের নির্দেশিত পথের প্রতি অন্ধ আনুগত্য পরিহার করে একটি সময়োপযোগী, উদারনৈতিক, বিকাশশীল ও যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গী করেছিলেনযে নীতিগুলি তাঁকে সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছিল সেগুলির মধ্যে অন্যতম হলো ধর্মনিরপেক্ষতা, গোষ্ঠী –বংশের সংকীর্ণতা পরিহার করা এবং কোরানের বাইরে বেরিয়ে সমস্যার সমাধান এবং উন্নতির পথের সন্ধান করাতিনি যে ধর্ম নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করেছিলেন তা সর্বজন স্বীকৃতএ প্রসঙ্গে একজন ঈমানদার মুসলমান তথা ঐতিহাসিক আল মাসউদী লিখেছেন,

·         “... পরধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা মুয়াবিয়া চরিত্রের ভূষণ বলে পরিগণিত ছিলতিনি যেমন নিষ্ঠুর ও কঠোর ছিলেন, তেমনি আবার উদার ও দয়ালুও ছিলেনতিনি তাঁর জীবনের সর্বত্র বিনয় ও সংযমের পরিচয় রেখে গেছেন  জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষকে তিনি সমান চোখে দেখতেনতাঁর রাজত্বে অন্যান ধর্মাবল্মবীরা সুখে ও শান্তিতে বসবাস করত একবার ভূমিকম্পে খ্রীস্টানদের ‘এডেসার’ গীর্জা ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে তিনি তা আপন ব্যয়ে পুননির্মাণ করেছেনযে কোন ধর্মের যোগ্য ব্যক্তিকে যে কোন উচ্চ পদে নিয়োগ করতে কোনদিনই কুন্ঠা বোধ করতেন নাতিনি গোঁড়া ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের পরিবর্তে একটি ধর্মনিরপেক্ষ (Secular) রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে মুসলমান ও অমুসলমানদের মধ্যে একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে তুলেন” (দ্রঃ ঐ,পৃ -২৫) 

মাবিয়া কত বড় মাপের ধর্ম নিরপেক্ষ খলিফা ছিলেন তার কয়েকটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাকতিনি সর্ব প্রথম ইসলামি সাম্রাজ্যে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সেনাবাহিনী গড়ে তোলেনতিনি একজন বিখ্যাত খ্রীষ্টান কবি আল-আখতালকে তাঁর দরবারে সভাকবির মর্যাদায় ভূষিত করেনবিখ্যাত খ্রীষ্টান চিকিৎসক ইবন আসলকে তিনি  নিযুক্ত করেছিলেন হিমস প্রদেশের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসাবেবংশ-গোষ্ঠীর সংকীর্ণ চিন্তা এবং বিভিন্ন বংশ ও গোষ্ঠীর মধ্যে কলহ ও রক্তপাত করা ছিল আরবের কোরেশদের পরম্পরা ও মজ্জাগতসেই ভয়ংকর কু-অভ্যাস ও ঐতিহ্য থেকে নিজেকে মুক্ত করে এমন এক নিরপেক্ষ প্রশাসক হিসাবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যে তাঁর শত্রুরাও তা স্বীকার না করে পারেন নাএ প্রসঙ্গে ড.গণি লিখেছেন তাঁর উক্ত গ্রন্থের ৩৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন,

·         “... তিনি নিজে মুদারীয় গোত্রের মানুষ হয়েও প্রতিদ্বন্দী হিমারীয় গোত্রের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখেনএ ক্ষেত্রে তিনি নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করে শ্রেষ্ঠ শাসক বা ন্যায়পরায়ণ বিচারকের পরিচয় দেন...

·         মুয়াবিয়া আপন বংশ বা গোত্র-ভিত্তিক রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন কিন্তু প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রাখার জন্য একমাত্র খলিফা ওসমানের জামাতা মারওয়ানকে হেজাজের গভর্ণর করা ব্যতীত তিনি তাঁর স্বগোত্রীয় কোন ব্যক্তিকেই প্রশাসনিক বা সামাজিক কোন উচ্চপদে অধিষ্ঠিত করেন নি

মাবিয়ার ব্যক্তি জীবনে কোন দোষ-ত্রুটি ছিল এমন অভিযোগও কেউ কোনদিন তুলতে পারেন নিএক্ষেত্রেও মুসলিম ঐতিহাসিকদের কলমেও ছত্রে ছত্রে মাবিয়ার চরিত্রের প্রশংসা আমরা দেখতে পাইঐতিহাসিক আল মাসউদী খলিফা মাবিয়ার দৈনন্দিন অনাড়ম্বর ও সরল জীবন-যাপনের বর্ণণা প্রসঙ্গে বলেছেন,

·         “প্রভাতে ফযরের নামাযের পর তিনি নগরপালের নিকট হতে নগরের খবরা-খবর শুনতেনঅতঃপর কোরআন শরীফ তেলায়াত (পড়তেন)ড়ে সামান্য প্রাতরাশ গ্রহণ করতেন। .. পরে মসজেদে মাকসুরার (একটি বেষ্টনীর) মধ্যে বসে সর্বসাধারণের অভিযোগ শ্রবণ করতেনএই সময় আবার একটু প্রাতরাশ গ্রহণ করতেন, এবং ঐ সময় সচিব তাঁকে বিভিন্ন চিঠিপত্র পড়ে শুনাতেন। তারপর দরিদ্র ব্যক্তিদের খাওয়ানো হত। অতঃপর জোহরের (মধ্যাহ্ন) নামায পড়ে বিশেষ বিশেষ মানুষদের প্রবেশের অনুমতি দিতেন, যাঁরা বহু মুল্যবান উপঢৌকন সহ আসতেন... আসরের (বিকাল) নামাযের পর তিনি সর্বসাধারণের জন্য আবার দরবারে বসতেন। এরপর সান্ধ্যভোজ হতো, এবং মগরেবের (সন্ধ্যা) নামায পড়তেন। ... এশার (রাত্রির) নামাযের পর তিনি আবার একবার দরবারে যেতেনপরে রাত্রির ১/৩ অংশ পর্যন্ত বিভিন্ন রাজা বাদশার কাহিনী শুনতেন ও অধ্যয়নে মনোনিবেশ করতেনএবং সামান্য মিষ্টি খেয়ে শুয়ে পড়তেনতাঁর দৈনন্দিন জীবনযাত্রার প্রণালী দেখে মনে হয়, তিনি খুবই নিয়ম চলতেন, যারজন্য সমগ্র সাম্রাজ্যেও আইন শৃঙ্খলার সুষ্ঠু রূপায়ণ দেখতে পাওয়া যায়।” (সুত্র – ঐ, পৃঃ ২৪, ২৫)

মাবিয়ার চরিত্রের আর একটি অতীব উজ্জ্বল দিক রয়েছেতারও স্বীকৃতি দেখা যায় মুসলিম  ঐতিহাসিকদের লেখায়  ড.গণির ইতিহাসে এ প্রসঙ্গে যা লেখা হয়েছে তা হলো এরূপঃ 

·         “খলিফা আলির সময় ছিলেন খলিফা পদের জন্য উচ্চাভিলাষী কুচক্রী মুয়াবিয়া। শাসক হিসাবে ছিলেন কঠোর, রাজনীতিবিদ হিসাবে ছিলেন দূরদর্শী, ধূর্ত, কপট, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গকারী এমন কি খুনি ও বিশ্বাসঘাতকতবে তাঁর জীবনে কোথাও কোনদিন মদ-ভাঙ, জুয়া ও অবৈধ মেয়েছেলের সমাবেশ দেখা যায় নাএই দিক দিয়ে তাঁর ব্যক্তিজীবন কলুষিত ছিল নাতিনি অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষার বশবর্তী হয়ে অনেক কিছু করেছেন, তাঁর অদম্য চেষ্টায় সে বাসনা-কামনা সফলতা লাভ করেছেএ বিষয়ে মদ ও মেয়েছেলে বিহীন চরিত্র তাঁকে অনেকখানি সাহায্য করেছিল। (সুত্র – ঐ, পৃ -২৬)

পঞ্চম খলিফা মুয়াবিয়ার তথা মাবিয়ার কি ব্যক্তি জীবন কি খলিফা-জীবনের যে পরিচয় পাওয়া যায় তা এক কথায় অতুলনীয়তিনি যে সততা, উদারতা, ধর্ম-বংশ-গোত্র নিরপেক্ষতা, পরধর্ম সহিষ্ণুতা,কর্মদক্ষতা, পারদর্শিতা, দূরদর্শিতা, নৈতিকতা, নিষ্ঠা এবং অধস্তন উচ্চ পদস্থ আমলা বা প্রশাসক হিসাবে নিয়োগকর্তাদের (মুহাম্মদ এবং প্রথম তিন খলিফা আবু বকর, ওমর ফারুক ও ওসমান গণি) প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা, দায়িত্বশীলতা, কর্তব্যপরায়ণতা এবং আনুগত্যের নজির স্থাপন করে গেছেন সে সব গুণ একত্রে আর কোনোও খলিফার মধ্যে লক্ষ্য করা যায় নাএই সকল গুণাবলী যেমন তাঁকে একটা পৃথক স্বকীয়তা এনে দিয়েছে, তেমনি তাঁকে এনে দিয়েছে আরব-শ্রেষ্ঠ নৃপতির (খলিফা) বিরল সম্মানমুসলিম ঐতিহাসিক ও ধর্মগুরুরা কিন্তু তাঁর ব্যক্তি জীবনের এবং প্রশাসক জীবনের এই সব ইতিবাচক ও ভালো গুণাবলিগুলিকে স্বীকার করেও তাঁকে একজন ভালো খলিফার স্বীকৃতি তো দেন নি, অধিকন্তু তাঁকে বিশ্বাসঘাতক, প্রতারক, খুনী, কুচক্রী, নিকৃষ্ট মুসলমান বলে অকথ্য-কুকথ্য ভাষায় নিন্দা-মন্দ এবং তাঁর উপর দিনরাত অভিশাপ বর্ষণ করে চলেছেনমাবিয়া সম্পর্কে মুসলিম ঐতিহাসিকদের এই মূল্যায়নে এত নগ্ন বৈপরীত্য বা স্ববিরোধিতা বিদ্যমান যা আমাদের বিবমিষার উদ্রেক করেএই মূল্যায়ণ যে এক নজিরবিহীন দ্বিচারিতার নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত তা বলা বাহুল্যসমগ্র মুসলিম দুনিয়া একযোগে কেন তাঁদেরই একজন খলিফার বিরুদ্ধে দ্বিচারিতায় মত্ত তা যেমন ভীষণ বিস্ময়কর তেমনই কৌতুহলোদ্দীপকও বটেএই দ্বিচারিতার পশ্চাতে নিশ্চয় কিছু রহস্য রয়েছে। কী সেই রহস্য তার  প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করবো এই বইয়ের শেষাংশেএই পর্যায়ে আমরা দৃষ্টি নিবদ্ধ করবো এই অধ্যায়ের প্রধান আলোচনায় অর্থাৎ  কারবালার যুদ্ধের জন্য দায়ী শুধু মাবিয়া ও এজিদকে দায়ী ও দোষী  বলে তাঁদের উপর যে  দায় চাপানো হয়েছে সেগুলি কতখানি যথার্থ বা আদৌ যথার্থ কী না সে আলোচনায়          

 

ঊনবিংশ অধ্যায়

 

মাবিয়ার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ     

কারবালা যুদ্ধের জন্য পঞ্চম খলিফা মুয়াবিয়া তথা মাবিয়াকে প্রধানত দায়ী করে তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলি উত্থাপন করা হয়েছে এবং ইতিহাসে যা যুগ যুগ ধরে মান্যতা বা স্বীকৃতি পেয়ে আসছে সেই অভিযোগগুলির সত্যতা বা যথার্থতা মোটেই প্রশ্নাতীত ও সন্দেহাতীত নয় মুসলিম ঐতিহাসিকগণের মূল অভিযোগ হলো, কারবালা যুদ্ধের ঘটনা ঘটতোই না যদি তৃতীয় খলিফা ওসমানের নিহত হওয়ার পর আলি যখন চতুর্থ খলিফা হন তখন মাবিয়া যদি তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করে তাঁর হাতে বয়াত (আনুগত্যের শপথ) নিতেন মাবিয়া কেন বয়াত নেন নি আলির হাতে? কারণ, তাঁরা বলেছেন যে  মাবিয়ার প্রবল লালসা ছিল খলিফা হওয়ারসে জন্য তিনি বয়াত না নিয়ে একটা অজুহাত খাড়া করেছিলেন যে আগে ওসমানের হত্যাকারীদের কঠোর শাস্তি দিতে হবেমাবিয়ার বিরুদ্ধে উত্থাপিত এই গুরুতর অভিযোগটির পক্ষে যুক্তিগ্রাহ্য কোন প্রমাণ কিন্তু ঐতিহাসিকরা উপস্থাপিত করতে পারেন নি সুতরাং এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এই গুরুতর অভিযোগটি তোলা হয়েছে মাবিয়ার বিরুদ্ধে তাঁকে স্রেফ কালিমালিপ্ত করার জন্যেওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সময়ের দিনপঞ্জী ও ঘটনা প্রবাহ এবং  ওসমানের হত্যাকান্ড ও তারপর আলির খলিফা হওয়ার ঘটনা এগুলি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার- বিশ্লেষণ করলে কখনই মনে হয় না যে মাবিয়া আলির নিকট ওসমানের হত্যাকারীদের শাস্তির যে দাবী তুলেছিলেন সেটা তাঁর একটা অজুহাত ছিল মাত্র এ প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য স্মরণ করা যেতে পারে। সেটা হলো এই যে, উক্ত দাবিটি (সর্বাগ্রে খলিফা ওসমানের হত্যাকারীদের শাস্তি দিতে হবে)  শুধু  একা মাবিয়ার  ছিলো নাদাবিটি ছিলো ইসলামি সাম্রাজ্যের সমস্ত মুসলমাদেনইসে সময় যে সব সাহাবী জীবিত ছিলেন তাঁরাও সেই দাবিতে মুখর হয়েছিলেন। কিন্তু আলি নানা অজুহাতে দাবিটিকে  অগ্রাহ্য করেছিলেন ফলে তাঁরা এতোই হতাশ ও ক্ষুব্ধ হন যে শেষ পর্যন্ত মদিনা শহর ছেড়ে মক্কা চলে যান। মুহাম্মদের সর্বাধিক প্রিয়তমা বউ আয়েশা একথা শুনে যার পর নাই ক্ষুব্ধ হয়ে ওসমানের হত্যাকারীদের শাস্তি দেবার উদ্দেশ্যে আলির বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দেন। তাঁর ডাকে সাহাবিগণ মক্কা না গিয়ে মাঝপথে ফিরে এসে আয়েশার সঙ্গে যোগ দেন। সাড়া দেয়  কয়েক হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমানও। ফলে আলির বিরুদ্ধে বেধে যায় যুদ্ধ যার নেতৃত্ব করেন আয়েষা। এই যুদ্ধটি ইতিহাসে জামালের যুদ্ধ নামে খ্যাত জামালের যুদ্ধ থেকে যেটা প্রতীয়মান হয় তা হলো, আলি খলিফা ওসমানের হত্যাকারীদের শাস্তি দিতে অস্বীকার করেছিলেন বলেন আয়েষা সহ সাহাবিগণ আলির বিরুদ্ধে জিহাদে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। মাবিয়ার ক্ষেত্রেও অনুরূপ ঘটনাই ঘটেছিলসুতরাং এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে ওসমানের হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবী তোলার মধ্যে মাবিয়ার কোনো প্রকার দুরভিসন্ধি ছিল না, যা ছিল তা হলো একজন বিবেকবান ও আদর্শবান গভর্ণরের সঠিক, নীতিসম্ম, ন্যায়সঙ্গত ও নির্ভিক পদক্ষেপ এটা সংশয়াতীত ঘটনা যে, খলিফা হওয়ার পর আলি যদি ওসমানের হত্যাকারীদের শাস্তি দিতে উদ্যোগী হতেন তবে কেউ তাঁর বিরুদ্ধে যেতেন নাতা না করে উল্টে তিনি হত্যাকারীদের নিয়েই শাসনকার্য পরিচালনা করতে শুরু করে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে এটা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারেকিন্তু না, অবিশ্বাস করার কোনো  অবকাশ নেই কারণ, ধর্মপ্রাণ মুসলিম ঐতিহাসিকগণও যাঁরা আলিকে একজন শিশুর মত নিষ্পাপ বলে শংসাপত্র দিতে সদা দরাজহস্ত তাঁরাও   কথা অস্বীকার করেন নি। . ওসমান গণিও তাঁর বইয়েও এ কথা স্বীকার করেছেন তিনি লিখেছেন,

অন্যদিকে, খলিফা আলির সাথে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সব সাধু চরিত্রের সাহাবী, কিছু সরল জনতা এবং কিছু মানুষ যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ওসমান হত্যার সাথে জড়িত।” (দ্রঃ হযরত আলী (রাঃ), পৃষ্ঠা – ৯৮)

সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, মুসলিম ঐতিহাসিকগণ আলীকে নির্দোষ  প্রমাণ করার যে প্রয়াস করেছেন তা শুধু হাস্যকরই নয়, যথেষ্ট লজ্জাকরও বটে এই লজ্জাকর প্রচেষ্টাকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্যে মুসলিম ঐতিহাসিক ও লেখকগণ কারবালা যুদ্ধের ইতিহাসে বহু মিথ্যা কথা ঢুকিয়ে দিয়েছেন। যেমন .  গণী দাবি করেছেন যে,    

·         আলীর সাথে যাঁরা ছিলেন তাঁরা সব সাধু চরিত্রের সাহাবা, কিছু সহজ সরল জনতা ….’

এই দাবিটি একদিকে পরষ্পরবিরোধী এবং আর একদিকে যাকে বলে ‘হলাহল মিথ্যা’ ঠিক তাই। কারণ, গণী একইসঙ্গে একবার বলছেন আলির সাথে ছিলো সাধু চরিত্রের সাহাবীরা, আবার পরক্ষণেই বলছেন তাঁর সাথে ওসমানের হত্যাকারীরাও ছিলো। তাছাড়া ইতিমিধ্যেই আমরা দেখেছি যে বেশ কয়েকজন প্রবীণ ও প্রথম শ্রেণীর সাহাবী, বহু জিহাদি যাঁরা বহু জিহাদে মুহাম্মদের সঙ্গী ছিলেন তাঁরা এবং মুহাম্মদের প্রিয়তমা পত্নী আয়েষা স্বয়ং আলির বিরুদ্ধে জিহাদ করেছিলেন। এঁরা আলির বিরুদ্ধে জিহাদ করেছিলেন কারণ, আলি ওসমানের হত্যাকারীদের শাস্তি না দিয়ে উল্টে পুরষ্কৃত করেছিলেন প্রশাসনের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে। তথাপি আলিকে নির্দোষ প্রমাণ করতে দ্বিধা করেন এই সব মুসলিম ঐতিহাসিকগণ। আর তা করতে গিয়ে তাঁরা তাঁদের খুবই অন্যায় ও অনৈতিক কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে। এই কুৎসিত কৌশলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো মুয়াবিয়াকে নিকৃষ্ট হিসাবে উপস্থাপন করা। আসল ব্যাপারটা হলো, মাবিয়াকে ‘নিকৃষ্ট’ দেখাতে না পারলে তো প্রমাণ করা যায় না যে আলি ছিলেন একজন মহান ব্যক্তিত্ব। তাছাড়া, মুয়াবিয়ার পাশাপাশি আরও অনেক গুণীজনকেও দেখানো হয়েছে  সুবিধাবাদী, স্বার্থপর ও ক্ষমতালোভী হিসাবে। যেমন ড. গণী এক জায়গায় বলেছেন,

·         “বলতে যদিও খারাপ লাগে আমির মুয়াবিয়া স্রেফ লোভে-প্রলোভনে, পদে-পদবীতে এবং টাকার জোরে আরব মেধাগুলোকে রাতের আঁধারে ছাগল বাঁধা করে বেঁধে ফেললেন।” (দ্রঃ – ঐ)

 

মাবিয়ার বিরুদ্ধে দুটি নৃশংশ হত্যাকান্ড ঘটানোর অভিযোগ অনেকেই উত্থাপন করেছেনপ্রথমটি হলো আলির হত্যাকান্ড এবং দ্বিতিয়টি আলীর জেষ্ঠ পুত্র তথা মুহাম্মদের জ্যেষ্ঠ দৌহিত্র ইমাম হাসানের হত্যাকান্ডআলিকে হত্যা করা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, মাবিয়া সম্মুখ সমরে না পেরে গুপ্তঘাতক লাগিয়ে তাঁকে হত্যা করিয়েছিলেন খলিফা হওয়াত পথে প্রধান কাঁটাটা সরিয়ে দেবার জন্যেকিন্তু এই অভিযোগেরও কোনো ভিত্তি দেখতে পাওয়া যায় না। এই অভিযোগ করার উদ্দেশ্যও একই, তা হলো, মাবিয়াকে জনসমক্ষে হেয় করাযাঁরা অভিযোগ উত্থাপন করেছেন তাঁরা কিন্তু তাঁদের অভিযোগের সপক্ষে কোনো প্রমাণ দেওয়ার ন্যুনতম দায়িত্ব পালন করেন নিঅপরদিকে তাঁরাই কিন্তু আবার এ কথাও বলেছেন যে, আলির অনুগামীদেরই একটা অংশ তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও যুদ্ধ করেছিলেন যখন তিনি সিফফিনের যুদ্ধের সময় যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করেন এবং তাঁরাই আলিকে হত্যা করেছে আলির এই বিদ্রোহীরা ইতিহাসে খারিজি বলে অভিহিত। কিছু ঐতিহাসিক এ প্রসঙ্গে অন্য মত পোষণ করেছেন। সে মতটি হলো এই যে আলি জিম্মিদের হাতে খুন হয়েছেন। . ওসমান গণি খারিজিদের আলির হত্যাকারী বলে চিহ্নিত করেছেন তিনি লিখেছেন এ প্রসঙ্গে,

·         “এবং খারেজীগণ এজাজের মাটিতে বসে পরিকল্পনা নিতে থাকলেন কী করে তিনজনকে অর্থাৎ হযরত আলি, আমির মুয়াবিয়া ও আমরকে বধ করা যায়।

      হত্যার শপথঃ প্রথমে আমর ইবনে বকর শপথ গ্রহণ করে বলল, আমি মিশরের শাসনকর্তা আমরকে বধ করার দায়িত্ব নিলাম। ...  আব্দুর রহমান ... প্রকম্পিত হৃদয়ে বলে উঠলো, আমি আলির দায়িত্ব নিলাম। (দ্রঃ – ঐ, পৃষ্ঠা – ১৬১), ... তিনটি আরবীয় তরবারি একসঙ্গে চমকিয়ে, ঝলসিয়ে ও গর্জিয়ে উঠলো শের-ই-খোদা’র মাথার ওপর।  ... শের-ই-খোদা তরবারির আঘাতে লুটিয়ে পড়লেন” (দ্রঃ - ঐ, পৃঃ ১৬০-১৬৫)            

আবার ড. গণি ওই গ্রন্থেই লিখেছেন,

·         “সিরিয়ার মাটিতে বসে মুয়াবিয়া  প্রাণপণ চেষ্টা করছেন    যেমন করেই হোক আলিকে খেলাফত ছাড়া, প্রয়োজন হলে দুনিয়া ছাড়া করতেই হবে” (দ্রঃ ওই, পৃঃ-১৬১)  

খারিজি মুসলমানরাই আলিকে খুন করেছে এ কথা বলার পরেও পরক্ষণেই তিনি অভিযোগের বর্শামুখ ঘুরিয়ে দিয়েছেন মাবিয়ার দিকে। এ রকম আরো অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে যা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় মুসলিম ঐতিহাসিকগণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে আলিকে মহৎ ও শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করতে গিয়ে মাবিয়াকে বলির পাঁঠা করতে চেয়েছেন। যাঁরা নিরপেক্ষ থেকে ইসলামের ইতিহাস লিখেছেন তাঁরা আলিকে হত্যা করার ঘটনার সঙ্গে কোনোভাবেই মুয়াবিয়ার যোগ দেখতে পান নিতাঁরা বলেছেন খারিজিদের হাতেই আলি খুন হয়েছেনরেনল্ড অ্যালন নিকসন সে কথাই স্পষ্টভাবেব্যক্ত করেছেন। তিনি লিখেছেন, “আলি ৬৬৬ খৃষ্টাব্দে সিরিয়া দখলের যে পরিকল্পনা নেন তা শেষ পর্যন্ত বাতিল করা হয়। মুয়াবিয়ার সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে নেয় আলি। এর কিছুকাল পর কুফার মসজিদে খুন হন। শেষ জীবনে কুফায় ছিল আলির রাজধানী। এক খারিজি চক্রান্তকারী ইবল মুলজাম আলিকে খুন করে” (দ্রঃ আরবী সাহিত্যের ইতিহাস, পৃঃ ১৮৯) একই কথা বলেছেন সংশয়হীনভাবে ঐতিহাসিক ফিলিপ কে হিট্টিওতিনি লিখেছেন, “৬৬১ খৃষ্টাব্দের ২৪শে জানুয়ারী আল-কুফায় মসজিদ যাবার সময় বিষ মাখানো তলোয়ার দিয়ে আলির কপালে সজোরে আঘাত করা হয়। অস্ত্রের আঘাত মস্তিষ্কে পৌঁছয়। ওই তলোয়ারটি তৈরি করেছিলেন এক খারিজী। তাঁর নাম আবদ-আল-রহমান ইবন মুলজাম।  ওঁর এক বন্ধুর আত্মীয়স্বজন নাহরাওয়ান আক্রমণে খুন হয়েছিলেন। সেই খুনের প্রতিশোধ নিতেই উনি এরূপ করতে প্রণোদিত হন। এছাড়া ওই মুলজান আর এক বড়ো চক্রান্তেরও অংশীদার ছিলেন। আলি, মুয়াবিয়া এবং আমর ইবন-আল-আস এই তিন নেতার হাত থেকে মুসলিম সমাজকে মুক্ত করতে যে তিনজন কাবায় শপথ নিয়েছিলেন মুলজাম তাঁদের মধ্যেও ছিলেন” (দ্রঃ আরব জাতির ইতিহাস, পৃ; ১৭৩)          

ইমাম হাসানেরও মৃত্যু হয়েছিল ২য় খলিফা ওমর ফারুক, ৩য় খলিফা ওসমান গণি এবং ৪র্থ খলিফা আলির মতোই ঘাতকের হাতেতবে হাসানের ক্ষেত্রে ঘাতক ছিলেন তাঁর একজন বউ যাঁর নাম ছিল যায়েদা যায়েদা তাঁকে খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে দিয়ে হত্যা করেছিলেনতারজন্যও দোষ চাপানো হয়েছে মাবিয়ার উপরেঅবশ্য অনেকেই এ বিষয়ে আঙুল তুলেছেন মাবিয়া-পুত্র ষষ্ঠ খলিফা এজিদের দিকেওআবার কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন মাবিয়া ও তাঁর পুত্র এজিদ উভয়েই ষড়যন্ত্র করে হাসানকে হত্যা করেনশেষোক্তদের দলে আছেন ড.ওসমান গণি। তিনি হযরত আলী (রাঃ)’ গ্রন্থে এভাবে চার্জশীট লিখেছেন তাঁদের বিরুদ্ধে,

·         “অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় ছলে-বলে-কৌশলে-কায়দায় ইসলামের অগত্যা মুসলমান তদানিন্তন আমির মুয়াবিয়া ও তাঁর চির কুখ্যাত পুত্র ইয়াজিদের গভীর ষড়যন্ত্রে মহানবীর স্নেহের নাতি,  হযরত আলি ও বিবি ফাতেমার চোখের মণি সমগ্র মুসলিম জগতের পরম শ্রদ্ধার পাত্র ইমাম হাসান আপন স্ত্রী যায়েদা কর্তৃক বিষ প্রয়োগে পরলোক গমন করেন” (দ্রঃ পৃ-২২) 

জায়েদা তাঁর বরকে হত্যা করেছিলেন এটা নিশ্চয় অন্যায়,  অমানবিক ও ঘৃণ্য একটি কাজ কিন্তু এই ঘৃণ্য কাজটির জন্যে হাসানও কোনো অংশে কম দায়ী ছিলেন নাতিনি ছিলেন অত্যন্ত নারী-বিলাসী পুরুষ এবং নারীই ছিল তাঁর জীবনে যেন একমাত্র ধ্যান-জ্ঞাননারীর প্রতি তাঁর আকর্ষণ এত তীব্র ও অস্বাভাবিক ছিল যা বর্ণণা করা সাধ্যাতীত ব্যাপারতিনি একজন বা দুজন বা দুচারজন নারীর সঙ্গে দাম্পত্য জীবন যাপনে তৃপ্ত হতে পারেন নিনিত্য-নতুন নারীর সংস্পর্শ  পাওয়ার জন্যে পাগল হয়ে যেতেন আর তা পেতে একশটি বিয়ে করেছিলেন। বউয়ের হাতে তাঁর অকাল প্রয়াণ না ঘটলে সেই সংখ্যাটা অর্থাৎ তাঁর বিয়ের সংখ্যাটা যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াত তা কারও পক্ষে  অনুমান  করা সম্ভব নয়এমন ঘটনাও ঘটেছে যে একদিনে চারজন বউকে তালাক দিয়ে সেদিনই চারটি বিয়ে সম্পন্ন করেছেনএরকম একজন পুরুষের বউদের মানসিক জ্বালাটা কীরূপ হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। জায়েদা তাঁর মনের সেই অসহ্য জ্বালা নিবারণের জন্যেই শেষ পর্যন্ত ঐ পথ বেছে নিয়েছিলেনসমগ্র মুসলিম জগতের পরম শ্রদ্ধার পাত্র ইমাম হাসানের এই মহান(!) চরিত্রটি আড়াল করার জন্যেই যায়েদার সঙ্গে মাবিয়া ও এজিদের নাম জুড়ে দেওয়া হয়েছেএর সাহায্যে তাঁরা এক ঢিলে দুটো পাখি মারতে চেয়েছেন। একদিকে হাসানের চরিত্রকে আড়াল করা এবং অপরদিকে একই সঙ্গে মাবীয়াকে একটা নিকৃষ্ট লোক হিসাবে প্রতিভাত করা। এটা এক ঢিলে দু’টি পাখি মারার হীন কৌশল ব্যতীত নয়। হোসেন মুসলিমদের কাছে পরম শ্রদ্ধেয় কারণ, তিনি মুহাম্মদের নাতি। সেই পরম শ্রদ্ধার মানুষটির চারিত্রিক দিকটি সম্পর্কে সাধারণভাবে মুসলিম সমাজ একেবারেই অজ্ঞ। নিত্য নতুন যুবতী ও সুন্দরী নারীদেহ স্পর্শ করার জন্যে তিনি অসংখ্য (কমবেশি একশ’টি) বিয়ে করেছিলেন। নতুন নতুন নারীদের সাহচর্য লাভ করা ওই ছিলো তাঁর জীবন দর্শন। এমনকি চরম ভোগবিলাসে সমগ্র জীবন কাটিয়ে দেওয়ার জন্যে উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া ইসলামি সাম্রাজ্যের খলিফার মতন মহা মূল্যবান ও ক্ষমতাধর পদটিও তিনি হেলায় তুলে দিয়েছিলেন তাঁর বাবা ও ভাইয়ের পরম শত্রু মুয়াবিয়ার হাতে। হাসানের চরিত্রের এই নিন্দাজনক অন্ধকার দিকটির কথা মুসলমানরা প্রায় কেহই জানে না। তারা এও জানে না যে তাঁর অকাল মৃত্যু হয়েছিলো ঐ চারিত্রিক উচ্ছৃঙ্খলতার দোষেই। এটা জানাজানি হলে মুসলিম সমাজের কাছে হাসানে মর্যাদা ও শ্রদ্ধার আসনটি অক্ষত থাকবে বলে মনে হয় না। তাই মুসলিম ঐতিহাসিক ও ধর্মান্ধ উচ্চ শিক্ষিত মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ হাসানের চরিত্রের এই অন্ধকার ও পুঁতিগন্ধময় দিকটি সর্বদা আড়াল করে রাখেন। শুধু আড়ালই করেন না, তাঁরা সর্বদা তাঁকে একজন মহান ব্যক্তি হিসাবেই তুলে ধরেন। এতো নির্লজ্জ চাটুকারিতার তুলনা সারা পৃথিবীতে মেলা ভার। এই নাগ্ন চাটুকারিতাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতেই একদিকে যেমন হাসানের কুচরিত্রকে আড়াল করা হয়, তেমনি অপরদিকে মুয়াবিয়া ও ইয়াজিদের চক্রান্তে তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে গল্প বানাতে হয়। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও কি সত্যকে চিরদিনের জন্যে মুছে দেওয়া সম্ভব হয়? হয় না। তাই হাসানের ঐ কুৎসিত চরিত্রটিকেও ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলা সম্ভব হয় নি। হাসানের নারীর প্রতি কীরূপ জঘন্য রকমের আসক্তি ছিলো এবং ঠিক সে জন্যেই কীভাবে তাঁকে অকালে জীবন দিতে হয়েছিলো সে সম্পর্কে ইতিহাসে যে বিবরণ পাওয়া যায় তা এরূপঃ “সিংহাসন অপেক্ষা গৃহমধ্যে হারেমে আল-হাসানের আগ্রহ ছিল বেশি। রাজ্য পরিচালনায় তিনি তেমন উৎসাহী ছিলেন না। আল-মদিনায় নিরুদ্বেগ ও পরিতৃপ্ত জীবনযাপনের জন্য তিনি তার প্রতিদ্বন্দীর হাতে সিংহাসন ছেড়ে দিয়েছিলেন। তবে তার আগে মুয়াবিয়ার অনুমোদনে নিজের জন্য বেশ মোটা পরিমাণ অনুদান ও পেনশনের ব্যবস্থা করেছিলেন। এর মোট পরিমাণ ছিল কুফা রাজভাণ্ডার থেকে আজীবন ৫ লক্ষ বা ৫০ লক্ষ দিরহাম এবং পারস্যের একটি জেলা থেকে আদায় করা রাজস্বের সমষ্টি। হারেমের কোনো এক ষড়যন্ত্রের পরিণতিতে, সম্ভবত বিষ প্রয়োগে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে (৬৬৯ খৃষ্টাব্দে) তাঁর মৃত্যু হয়। লিন্তু তার আগে আল-হাসানের বিবাহ ও বিচ্ছেদের সংখ্যা ১০০ তে পৌঁছেছিল বলে শোনা যায়। এ জন্য তিনি মিতলাক (মহান বিবাহ-বিচ্ছেদকারী) আখ্যা পেয়েছিলেন। এই ষড়যন্ত্রের জন্য শীআরা  মুয়াবিয়াকেই দায়ী করেন।” (দ্রঃ আরব জাতির ইতিহাস, ফিলিপ কে হিট্টি, পৃঃ ১৮১, ১৮২) হিট্টি এই ইতিহাসটি সংগ্রহ করেছেন তাবারি, ২য় কঝণ্ড ও ইয়াকুবী ২য় খণ্ড থেকে বলে উল্লেখ করেছেন।   

মাবিয়ার বিরুদ্ধে তৃতীয় অভিযোগ হলো তিনি খলিফা মনোনয়নে ব্যাপারে হাসানের সঙ্গে যে চুক্তি করেছিলেন তা লঙ্ঘন করে এজিদকে খলিফা মনোনীত করেন যারফলে কারবালা যুদ্ধের ঘটনা অনিবার্য হয়ে ওঠে এই যে চুক্তিটির কথা বলা হচ্ছে সেটা ইতিহাসে যেমনটা শোনা যায় তা এ রকমঃ  মাবিয়া তাঁর মৃত্যুর পূর্বে ইমাম হাসানের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ইমাম হোসেনকে (ইমাম হোসাইন) খলিফা মনোনীত করে তাঁর হাতে ইসলামি সাম্রাজ্যের খেলাফত অর্পণ করবেন কথিত এই চুক্তিটি সত্যিই হয়েছিল এমন দাবীর জোরালো প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায় না প্রসঙ্গে ইমাম হাসানের খেলাফত পরিত্যাগের কথা স্মরণ করা যেতে পারে এর কিছু আলোচনা  ইতিপূর্বেই করা হয়েছে সেখানে আমরা লক্ষ্য করেছি যে নিতান্ত বাধ্য হয়ে অবশ্যই স্বেচ্ছায় ইমাম হাসান খেলাফতের দয়ীত্ব মাবিয়ার হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি নারী ধন-দৌলত নিয়ে বিলাস-বৈভবে জীবনযাপন করতেই ভালবাসতেন খেলাফতের মত বিশাল গুরুদায়িত্ব সামলাতে গিয়ে তাঁর সেই শান্তিপূর্ণ, সুন্দর মসৃণ জীবনে বারবার ছন্দপতন ঘটছিল আবার আর একটা বিষয়ে তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, মাবিয়ার সাথে  যুদ্ধ করে তিনি কোনোভাবেই  পেরে উঠবেন না তাই তিনি খেলাফতের গুরু দায়িত্ব নিজের কাঁধ থেকে নামিয়ে দেওয়াই সঠিক কাজ হবে বলে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হন হাসান কর্ত্তৃক মাবিয়ার হাতে খেলাফত হস্তান্তরকরণের পশ্চাতে এই ছিলো মূল কারণ রকম পরিস্থিতিতে হাসান তাঁর ভাইকে খলিফা করতেই হবে এমন শর্ত মাবিয়ার কাছে আরোপ করেছিলেন এবং সেই শর্তে অনড় ছিলেন এমন দাবী বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না হাসান তো নিতান্তই  নিজের গরজে খেলাফত ত্যাগ করছেনছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচিঅবস্থায় সুতরাং এটাই অধিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় যে, খেলাফত ত্যাগ বা হস্তান্তর করার পূর্বে তিনি কোনো শর্তে অনড় থাকার অবস্থায় ছিলেন না সে সময় তাঁর পক্ষে যেটা সম্ভব ছিল তা হলো শুধু মাবিয়ার কাছে কিছু  চেয়ে নেওয়া, তাঁকে কিছু অনুরোধ-উপরোধ করা হ্যাঁ, এটা হলেও হতে পারে যে তিনি যা কিছু চেয়েছিলেন মাবিয়ার নিকট তার মধ্যে হোসেনকে পরবর্তী খলিফা করার চাওয়াটাও ছিল মাবিয়া হাসানের মধ্যে কী কী আলোচনা বা দেওয়া-নেওয়ার কথা হয়েছিলো তা এতো দীর্ঘকাল পরে একশশতাংশ নির্ভুলভাবে বলা  অসম্ভব তবে একটা কথা এক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবেই বলা সম্ভব যে, খেলাফত ত্যাগ হস্তান্তর করার প্রাক্কালে যে যে বিষয়ে উভয়েই (মাবিয়া হাসান) একমত হয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন তা হলো মাবিয়াকে খলিফা হিসেবে হাসান এবং তাঁর পরিবারের ভরণ-পোষণ নিরাপত্তার দায়িত্ত্ব নিতে হবে এরূপ শর্ত বা চুক্তি যে হয়েছিল তার প্রমাণও রয়েছে ইতিহাসে যেমন . ওসমান গণি লিখেছেন,

             ইমাম হাসান হযরত আলীর  প্রথম সন্তান অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির ছিলেন পিতার শাহাদাত বরণের পর মাস খেলাফত পরিচালনা করে আমির মুয়াবিয়ার সাথে রাতদিন খনোখুনি, ঝগড়া, বিসম্বাদ পরিহার করে এক নির্দিষ্ট ভাতার পরিবর্তে খেলাফত ত্যাগ করেন এবং পিতার রাজধানী কুফা ত্যাগ করে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন’ (দ্রঃ - হযরত আলী (রাঃ), পৃ২০৪)  

মাবিয়ার বিরুদ্ধে চতুর্থ ও সব চায়তে বড় অভিযোগটি হলো, মাবীয়া পরবর্তী খলিফা মনোনয়নের ক্ষেত্রে ইসলামি-নীতি ইসলামি-গণতন্ত্রকে পদলিত করেন এবং নিজের পুত্রকে খলিফা মনোনীত করে ইসলামি-গণতন্ত্র তথা খেলাফততন্ত্রের পরিবর্তে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন ইসলামি-নীতি ইসলামি  - গণতন্ত্রকে হত্যা করা, এবং খেলাফততন্ত্রক পরিবর্তে রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করা এই দুটি অভিযোগ শুধু অবাস্তব ভিত্তিহীনই নয়, হাস্যকরও কারণ, ‘ইসলামি-গণতন্ত্রতত্ত্বটা সোনার পাথর-বাটি বা কাঁঠালের আমসত্ত সদৃশ অবাস্তব তত্ত্ব কোনো ধর্মই (religion )  গণতন্ত্রের জন্যে বা পক্ষে সুচ্যগ্র মেদিনীটুকু পর্যন্ত ত্যাগ করেনি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, উদারতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতি প্রভৃতি রাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত পরিভাষাগুলির সঙ্গে সকল ধর্মেরই চির আড়ি আর ইসলামে তো আল্লাহতন্ত্র এবং মুহাম্মদ-তন্ত্রই শেষ কথা তা বলা বাহুল্য কোরান-হাদিসের বাইরে কোনো আইন তৈরী বা প্রণয়ন করা (যা একটি গণতান্ত্রিক কাজ) ইসলামের চরম পরিপন্থী এবার আসা  যাক ইসলামি রাষ্ট্রে খলিফা নির্বাচনে ইসলামি নীতির প্রশ্নে মাবিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো তিনি এই নীতি পদদলিত করেন তাঁর পুত্রকে খলিফা করার জন্যে এই অভিযোগটি আপাত দৃষ্টিতে সত্য যুক্তিগ্রাহ্য মনে হওয়াটা খূব স্বাভাবিক কিন্তু বাস্তবে এই অভিযোগটিরও কোনো ভিত্তি নেই কারণ ইসলামি রাষ্ট্রে খলিফা নির্বাচনের নীতি পদ্ধতি বলে কিছু নেই বিষয়ে মুহাম্মদ কোনো নীতি নির্ধারণ করে যান নি বা করে যাওয়ার সময় পান নি তিনি আসলে এই বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার অবকাশই পান নি, কারণ মাত্র কয়েকদিনের জ্বর অসহ্য মাথাব্যাথায় ভুগে তিনি হঠাৎই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন যেহেতু খলিফা নির্বাচন কীভাবে হবে তার কোনো নির্দেশিকা ছিলো না তাই মুহাম্মদের মৃত্যুর পর প্রথম খলিফা নির্বাচনে তাঁর অনুগামিদের মধ্যে প্রবল মতবিরোধ কলহ হয়েছিল সেই কলহ-লাঞ্ছিত পরিবেশে পরিস্থিতিতে কোনো প্রকারে আবু বকর প্রথম খলিফা নির্বাচিত হলেও সাহাবীদের মধ্যে প্রবল অসন্তোষ ক্ষোভ থেকে গিয়েছিলো  আলি এবং তাঁর বউ (মুহাম্মদের অতি আদরের কন্যা ফাতেমা) আবু বকরকে খলিফা হিসাবে মেনে নেন নি এবং তাঁর কাছে বয়াতও নেন নি ফাতেমা মৃত্যুর দিন পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন এই ঘটনার কথা ইতিপূর্বেই কিছুটা আলোচনা করা হয়েছে সেই আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, দ্বিতীয় খলিফার মনোনয়ন দেবার পূর্বে খলিফা নির্বাচনের প্রশ্নে কোনো নীতি ঠিক করে যান নি। হয়তো তাঁর পক্ষে তা করা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি কারণ খলিফা  হওয়ার  লোভ ও লালসা ছিল সাহাবিদের মধ্যে কী তীব্র খায়েশ ছিলো তিনি খুব ভালো করেই  জানতেন। সেজন্যেই খুব সম্ভববতঃ  তিনি দ্বিতীয় খলিফা নির্বাচনের প্রশ্নে কোনও ঝুঁকি নিতে চান নিসাহাবী ও অন্যান্যদের  নিজ বাসভবনে ডেকে ঘোষণা করে দেন যে, ওমর ফারুককে তিনি দ্বিতীয় খলিফা মনোনীত করলেনঅবশ্য এই ঘোষণা দেবার পূর্বে আর সকল সাহাবিদের সঙ্গে আলোচনা করে  তাঁদের অভিমত জেনে নিয়েছিলেন বলে অনুমান করা যায়ওমর ফারুকও সেই পথ ধরেই তৃতীয় খলিফা মনোনীত করতে উদ্যোগী হয়েছিলেনতিনি তৃতীয় খলিফা মনোনীত করে যেতে চেয়েছিলেন বিশিষ্ট সাহাবী আব্দুর রহমানকেকিন্তু আব্দুর রহমান সেই দায়িত্ব নিতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেনতখন তিনি একটি ছোট্ট কমিটি গঠন করে তৃতীয় খলিফা নির্বাচনের দায়িত্ব সেই কমিটির হাতে তুলে দেনসেই কমিটিতে প্রবল তর্কাতর্কি ও মতবিরোধ চলে কয়েকদিন ধরে এবং অবশেষে ভোটাভুটির মাধ্যমে ওসমান গণি খলিফা নির্বাচিত হনএই হলো অতি সংক্ষেপে ইসলামি রাষ্ট্রের খলিফা মনোনয়নের বা নির্বাচনের পদ্ধতি ও ইতিহাসএই ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে ইসলামি রাষ্ট্রে খলিফা নির্বাচনের কোনও নীতি ছিল নাসুতরাং মাবিয়া ইসলামি নীতি লঙ্ঘন করেছিলেন বলে তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ অবান্তর ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত

মাবিয়া খেলাফতন্ত্রের পরিবর্তে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন বলে যে অভিযোগ রয়েছে এই অভিযোগেরও যুক্তিগ্রাহ্য কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় নাতিনি তাঁর পুত্রকে পরবর্তী খলিফা মনোনীত করে যান এটা কোনো অকাট্য প্রমাণতে পারে না যে তিনি ইসলামি সাম্রাজ্যে খেলাফততন্ত্রের পরিবর্তে রাজতন্ত্র   প্রতিষ্ঠা করেন বরং খলিফা মনোনয়নে তিনি যে তাঁর পূর্বসূরীদের প্রদর্শিত পথেই হেঁটেছেন একথা  অস্বীকার করার অবকাশ নেইপার্থক্য শুধু এক জায়গায় যে তাঁর পুর্বতন খলিফাগণ তাঁদের পুত্রদের খলিফা মনোনিত করেন নি যেটা তিনি করেছিলেনকেন তাঁর পূর্বসূরীরা আপন পুত্রদের খলিফা করেন নি কিংবা মাবিয়া কেন তাঁর পুত্রকেই খলিফা মনোনীত করেছিলেন তা নিয়ে আলোচনা করার যথেষ্ট অবকাশ আছে এবং সে আলোচনা পরে যথাস্থানে করা হবে। এখনকার আলোচনার বিষয় হলো ইসলামি সাম্রাজ্যে মাবিয়া কর্ত্তৃক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা, সেই আলোচনায় আসা যাক এজিদ যখন খলিফা হলেন তারপরই খলিফার ছেলে খলিফা হবে রকম একটা অধ্যায়ের সুচনা হয়েছিল একথা ঠিক, কিন্তু তাই বলে এমন ঘটনা ঘটে নি যে, খলিফার পুত্রই খলিফা হবে এমন কোনো রাষ্ট্রীয় নীতি মাবিয়া কর্তৃক ঘোষণা করা হয়েছিলো না, মাবিয়া রকম কোনো নীতি যেমন প্রনয়ণ করেন নি, এবং এজিদকেও সেরূপ কোনো নির্দেশ প্রদান করে যান নি যে তিনি যেনো তাঁর পুত্রকেই খলিফা মনোনিত করেন সুতরাং মাবিয়া ইসলামি সাম্রাজ্যে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন এমন অভিযোগের কোনো ঐতিহসিক ভিত্তি নেই

        রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার প্রসঙ্গটি বাদ দিলেও প্রশ্নটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, মাবিয়া কেন তাঁর নিজের পুত্রকেই খলিফা মনোনীত করেছিলেন? প্রশ্নটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ অন্তত দুটি বিশেষ কারণে প্রথম কারণ হলো মাবিয়ার পূর্বসূরীরা তৃতীয় খেলাফত পর্যন্ত কেউ সে কাজ করেন নি, তাঁরা সকলেই সাহাবীদের মধ্যে থেকেই একজনকে পরবর্তী খলিফা মনোনীত করে গিয়েছেন মাবিয়া কেন সেই প্রচলিত নিয়ম বা ছক ভেঙে ছিলেন? দ্বিতীয় কারণটি হলো, এজিদ খলিফা হবার পরই পরিস্থিতি দ্রুত কারবালা যুদ্ধের দিকে ধাবিত হতে শুরু করে এবং যুদ্ধটি সংঘটিত হয়ও এর ফলে সাধারণভাবেই এমন ধারণার জন্ম হওয়াটা স্বাভাবিক যে মাবিয়া যদি তাঁর পুত্রকে খলিফা মনোনীত না করে যেতেন তবে কারবালা যুদ্ধ হতো না কিন্তু প্রসঙ্গে কথাটাও মনে রাখা একান্ত আবশ্যক যে, এজিদকে খলিফা মনোনীত করার জন্যেই কারবালা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে ব্যাপারটি মোটেই তা নয় আসলে যুদ্ধ হয়েছে ইমাম হোসেনকে খলিফা না করার জন্যে কারণ, হোসেনের ক্ষোভ হয়েছিলো যতোটা না এজিদকে খলিফা করার জন্যে তার চেয়ে অনেক বেশী তাঁকে খলিফা না করার জন্যে সুতরাং শুধু এজিদ বলে নয়, হোসেনকে বাদ দিয়ে অন্য যে কোনো ব্যক্তিকে খলিফা করলেও কারবালা যুদ্ধটি হতোই যুদ্ধটি হয়তো কারবালা প্রান্তরে এবং ১০ই মহরম হতো না, হতো অন্য সময়ে অন্য কোনো প্রান্তরে, কিন্তু হতোই মাবিয়ার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্যে মুসলিম ঐতিহাসিকগণ একটা সহজ সমিকরণও তৈরী করেছেন তা হলোমাবিয়া মনেপ্রাণে মুসলমান ছিলেন না, তিনি ছিলেন অগত্যা মুসলমান এবং ছিলেন একজন চরম নীতিহীন ও স্বার্থপর ব্যক্তি তাই নিজের পুত্রকে খলিফার আসনে বসিয়ে বসিয়ে যান। কিন্তু মাবিয়ার ব্যক্তি জীবন ও নানা উচ্চ পদে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা প্রশাসকের জীবনের নানা দিকের যে ছবি আমরা দেখেছি তাতে তাঁর সম্পর্কে এরূপ সহজ ও সরল একটা সমীকরণ টানা যায় না। বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার দাবী রাখে মাবিয়া কেনো এজিদকে খলিফা মনোনিত করেছিলেন তা সঠিকভাবে বোঝার জন্যে আমাদের সর্বাগ্রে তৎকালীন পরিস্থিতির প্রতি অনুসন্ধানী নজর রাখতে হবে। মাবিয়া এজিদকে খলিফা মনোনিত করেন ৬৭৯ খ্রীষ্টাব্দে, মুহাম্মদের মৃত্যুর প্রায় পঞ্চাশ বৎসর পর তখন সাহাবীদের যুগ প্রায় শেষ কতিপয় সাহাবী যাঁরা জীবিত ছিলেন তাঁরা কর্মক্ষমতা হারিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন কখন সেই দিনের কথা ভাবছেন সুতরাং বাস্তব পরিস্থিতিটা ছিলো এরূপ যে, মাবিয়ার সামনে তখন এমন একজনও জীবিত ছিলেন না যাঁর খলিফা হওয়ার ক্ষেত্রে প্রশ্নহীন গ্রহণযোগ্যতা ছিলো তখন মুহাম্মদের সাহাবীদের সান্নিধ্যে থাকা বিশিষ্ট জনেরা যাঁদের তাবেয়ী বলা হয় তাঁরা অধিকাংশই মদিনায় থাকেন কিন্তু ইসলামি সাম্রাজ্যের রাজধানী তখন দামেস্কে যেটা অধুনা সিরিয়ায় অবস্থিত আলিই প্রথম রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যান কুফা শহরে, তারপর সেখান থেকে মাবিয়া সরিয়ে নিয়ে যান দামেস্ক শহরেস্বভাবতই তাবেয়ীদের সঙ্গে খলিফা ও প্রশাসনের যোগসুত্র ছিলো অত্যন্ত ক্ষীণঅন্যদিকে খলিফা পদের জন্য যাঁর কথা ভাবা যেত মুহাম্মদের নাতি বলে তিনি মাবিয়াকে তাঁর কুড়ি বছরের দীর্ঘ শাসন কালে কোনরূপ সহযোগিতা করেন নি তো বটে, ঘুরিয়ে তিনি মাবিয়াকে তাঁর পিতা দাদার হত্যাকারী বলে সর্বদা তাঁর সমালচনা বিরোধিতা করেছেন এরূপ আচরণ সত্ত্বেও মাবিয়া কিন্তু তাঁর সঙ্গে খলিফা সুলভ বিন্দুমাত্র খারাপ বিরূপ আচরণ করেন নি, ঘুরিয়ে পাছে আল্লার নবীর প্রতি অসম্মান প্রদর্শিত হয় এই ভাবনায় হোসেন তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যথেষ্ট  ভদ্রতাপূর্ণ সৌজন্যমুলক আচরণ করতেন  আলির পরিবারের সনে মুয়াবিয়ার সম্পর্ক কীরূপ ছিলো এবং তাঁরা পরষ্পরের প্রতি কীরূপ আচরণ করতেন তার একটি চিত্র পাওয়া যায় আর এ নিকলসনের লেখা থেকে। তিনি লিখেছেন,

·         “মুয়াবিয়ার সদয় আচরণ ছিল প্রবাদপ্রতিম। আবার তিনিই প্রয়োজনে কঠোর হতে ইতস্তত করেন নি। একবার দামাস্কাসে আলির পরিবারের লোকজন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। সেবার মুয়াবিয়া তাঁদের সম্মানীয় অতিথির মর্যাদা দেন। তাঁদের জন্য আতিথেয়তার ত্রুটি ছিল না তাঁর। সব সমত তিনি সতর্ক থাকতেন, কখন তাঁদের কী প্রয়োজন। কিন্তু শোনা যায় তাঁরা  তাঁর সঙ্গে রূঢ় আচরণ করত। নিন্দনীয়ভাবে তাঁর সঙ্গে মুখোমুখি হত। এসব দেখে মুয়াবিয়া কখনও তাদের অভব্য আচরণ উপহাস করে গায়ে মাখতেন না। আবার ককঝনও শুনেও না শোনার ভাণ করতেন। সব সময়ই নম্রতা সহকারে তিনি তাঁদের প্রত্যুত্তর দিতেন। প্রচুর উপহার ও টাকা-পয়সা দিতেও পিছ পা হন নি।” (দ্রঃ আরবী সাহিত্যের ইতিহাস, পৃ ১৯০)। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, নিকলসন জানিয়েছেন যে তিনি এই তথ্যটি সংগ্রহ করেছেন ডেরেনবার্গ সম্পাদিত গ্রন্থ আল-ফাখরি থেকে।

মাবিয়া এমন নজিরবিহীন আচরণ প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁর হৃদয়ের আকাশচুম্বী উদারতা এবং হোসেন তাঁর পরিবারের প্রতি হিংসা বিদ্বেষের মনোভাব না থাকার কারণের জন্যেই হৃদয়ে কতো উদারতা থাকলে শত্রুভাবাপন্ন মানুষকেও ক্ষমা করা  যায়, যা করে দেখিয়েছিলেন মাবিয়া হোসেনের প্রতি! তবে ক্ষমা করা এক জিনিষ, আর খলিফা করা তো অন্য জিনিষ যে লোক ব্যক্তিগত ক্ষোভ বিদ্বেষ থেকে খলিফার সঙ্গে শত্রুতামূলক আচরণ করে তাকে আর যাই করা যাক খলিফা করা যায় না তাছাড়া লাগাতার খলিফা খেলাফতের বিরোধিতা করে হোসেন সকল উচ্চ পদস্থ আমলা এবং সাধারণ মুসলমানদের কাছেও নিজের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করে ফেলেছিলেন যদি ধরেও নেওয়া যায় যে মাবিয়া ইমাম হাসানের মধ্যে ইমাম হোসেনকে খলিফা করার চুক্তি সত্যি সত্যিই হয়েছিল, তথাপি ইসলামি খেলাফতের প্রতি হোসেন যে শত্রুসুলভ দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের জন্যে সেই চুক্তি বাস্তবায়িত করার পরিস্থিতি তখন যে আর বিদ্যমান ছিল না তা সহজেয় অনুমেয় সে সময় হোসেনের মাবিয়াবিরোধী আচরণের জন্যে পরিস্থিতি এমনই বিরাজ করছিলো যে, বিভিন্ন প্রদেশের গভর্ণর এবং মাবিয়ার দরবারে উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত অধিষ্ঠিত আমলাদের পক্ষে হোসেনকে খলিফা হিসেবে মেনে নেওয়া মোটেই সম্ভব ছিল না মাবিয়া যে সময়ে তাঁর উত্তরসূরীকে মনোনয়ন দেন সেই সময়টার এই পরিস্থিতির কথা ঐতিহাসিক এবং ইতিহাসের কৌতূহলী ছাত্র পাঠকদের বিচার-বিবেচনার মধ্যে রাখাটা অত্যন্ত জরুরী মাবিয়া দেখেছেন সাহাবীদের যুগেই খলিফা হওয়ার খায়েশ পূরণ করা জন্যে কী নির্লজ্জ দলাদলি রেষারেষি হয়েছে, এমনকি খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ পর্যন্ত হয়েছে তাবেয়ীদের যুগে খলিফা হওয়ার জন্যে দলাদলি, রেষারেষি খনোখুনি হওয়ার আশঙ্কা যে আরও বেশী তা অভিজ্ঞ, দূরদর্শী বিচক্ষণ মাবিয়ার বুঝতে অসুবিধা হয় নি তাই তাঁকে গভীরভাবে ভাবতে হয়েছিল এমন একজনকে পরবর্তী খলিফা মনোনীত করা যাতে তিনি সর্বজনগ্রাহ্য হন এবং আর একটা গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতির উদ্ভব না হয় ঠিক যে যে কারণে মাবিয়া তাঁর পুত্র এজিদকে খলিফা পদে মনোনীত করেছিলেন সেগুলি এক হাজার বছরেরও অধিক সময় পর এখন নিশ্চিত রূপে বলা ভীষণ কঠিন তবে মানুষ হিসাবে এবং প্রশাসক, গভর্ণর খলিফা হিসাবে মাবিয়া যে প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, দায়িত্বশীলতা, নিষ্ঠা, প্রজাপ্রীতি এবং উদারনৈতিক চরিত্র মুল্যবোধের স্বাক্ষর তিনি রেখে গেছেন সর্বক্ষেত্রে তার ফলে এটাই অধিক বিশ্বাসযোগ্য গ্রহণযোগ্য মনে হয় যে নিছক সংকীর্ণ স্বার্থের বশবর্তী হয়ে নয়, তিনি ইসলামি সাম্রাজ্যের বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবেই তাঁর পুত্র এজিদকে খলিফা মনোনীত করেছিলেন এবং এজিদকে খলিফা করার কথা তাঁকে খুব সম্ভবতঃ ভাবতে হয়েছিলো যাতে তাঁর মৃত্যুর পর আর একটা গৃহযুদ্ধের কবলে ইসলামি সাম্রাজ্য না পড় যেমনটা পড়েছিলো আলির খলিফা হওয়ার পর অমুসলিম ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ ঠিক কথাটাই বলেছেন প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক কেনেথ ডব্লিউ মরগান যে কথা বলেছেন তা স্মরণযোগ্য তিনি বলেছেন,

             খেলাফতের উত্তরাধিকার নির্বাচনের ব্যাপারে গৃহ-যুদ্ধ এড়াতে হলে বংশানুক্রমিক নীতি বলবৎ করা ব্যতীত আর কোন বিকল্প ছিল না” (সূত্রঃ  উমাইয়া খেলাফত, .ওসমান গণি, পৃঃ ৩৯)

মাবিয়ার বিরুদ্ধে আরও একটি গুরুতর অভিযোগ হলো, তিনি তাঁর ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে ইসলামের সকল নীতি আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে একটি সম্পূর্ণ অনৈসলামিক খেলাফত প্রতিষ্ঠা করেন মুসলিম ঐতিহাসিকরা তাই মাবিয়ার খেলাফত কালকে প্রকৃত ইসলামিক খেলাফত বলে স্বীকার করেন না তাঁরা মাবিয়া খলিফা হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যে খেলাফতগুলি প্রতিষ্ঠিত ছিল কেবল সেগুলিকেই প্রকৃত খেলাফত বলে মান্যতা দেন তাঁদের মতে আবু বকর, ওমর ফারুক, ওসমান গণি আলিমাত্র এই চারজনই  ছিলেনখোলাফায়ে রাশেদিনঅর্থাৎসৎপথে পরিচালিত খলিফা মাবিয়ার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ একদিক থেকে বিচার করলে আংশিকভাবে নিশ্চয় সঠিক, কিন্তু সামগ্রিকভাবে বিচার করলে এটা  একপেশে   বিদ্বেষ প্রসুত মূল্যায়ন ছাড়া কিছুই নয় কারণ, মাবিয়ার পূর্বে যাঁরা খেলাফত পরিচালনা  করেন তাঁরা সকলেই ইসলামি নীতির কিছু না কিছু সংস্কার করেছিলেন যার অনুমোদন কোরানে ছিলো না বা নেই কিন্তু সংস্কারের ক্ষেত্রে মাবিয়া একটা বিরাট ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি বেশ কয়েকটি বড়ো রকমের সংস্কার করেছিলেন যা স্পষ্টতই কোরান ইসলামের পরিপন্থী সে আলোচনা অল্প হলেও ইতিমধ্যেই করা হয়েছে সেখানে আমরা লক্ষ্য করেছি যে, তিনি মুহাম্মদ নির্দেশিত প্রদর্শিত নীতি পথগুলির ক্ষেত্রে যে সব সংস্কার সাধন করেছিলেন তার কয়েকটা ছিল নিঃসন্দেহে মৌলিক, যুগান্তকারী বৈপ্লবিক এক্ষেত্রে যেটা সব চেয়ে বেশী উল্লেখযোগ্য সংস্কার সেটা হলো, রাষ্ট্র পরিচালনায় ইসলামি এক বগ্গা নীতির অবসান ঘটানো এবং তার পরিবর্তে সীমিত ক্ষেত্রে হলেও ধর্মনিরপেক্ষ নীতির প্রবর্তন যেমন, খোলাফায়ে রাশেদিনের খেলাফত কালে রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীতে প্রশাসনে মুসলমান ছাড়া অমুসলমানদের কোনো স্থান ছিল না বলা বাহুল্য যে সেটাই ইসলামের নীতি বস্তুতঃ এটাই নির্মম সত্যি যে,  অমুসলমানদের বিষয়ে ইসলামের মনোভাব সম্পূর্ণ শত্রুতামূলক প্রতিহিংসামূলক কোরানে বারবার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে মুসলমানদের এই কথা বলে যে, অমুসলমানদের একদম বিশ্বাস করবে না, কারণ তারা মুসলমানদের চরম শত্রু অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় কোরান নির্দেশ রয়েছে যে,  মুসলমানরা  যেনো  কিছুতেই অমুসলমানদের সঙ্গে বন্ধত্ব স্থাপন না  এ কথাটি একবার বা দু’বার কিংবা হাল্কাওভাবেও নয়, গম্ভীরভাবে বহুবারই বলা হয়েছে। ঘৃণা ও তীব্র বিষ মাখানো ভয়ংকর এই নির্দেশ সম্পর্কে কোরানের ভাষ্যগুলির একটি হলোঃ

·         “হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের আপনজন ব্যতীত আর কাউকেই অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে না। তারা তোমাদের বিভ্রান্ত করতে ত্রুটি করবে না। যা তোমাদের বিপন্ন করে তাই তারা কামনা করে, তাদের মুখে বিদ্বেষ প্রকাশ পায় এবং তাদের হৃদয় যা গোপন রাখে তা আরও গুরুতর।” (সুরা আল-ইমরান, ৩/১১৮)  

এখানে ‘আপনজন’ মানে মুসলমান এবং ‘আর কাউকে’ মানে বিধর্মী, এ কথা কোরানের তফসিরে প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে। তফসিরিকার ইবনে কাথির এই আয়াতটির তফসিরে লিখেছেন,

·         “এখানে আল্লাহ্‌ পাক মুসলিমদের কাফির ও মুনাফিকদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে নিষেধ করেছেন” তিনি আরও বলেছেন, “েরা তো তোমাদের শত্রু। তাদের প্রতারণার ফাঁদে পড়ো না, নতুবা তারা সুযোগ পেয়ে তোমাদের ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে …” (দ্রঃ ৪র্থ-৭ম খণ্ড, পৃ ১৫২)   

এই কঠোর নির্দেশ দিয়েই আল্লাহ্‌ তার কর্তব্য শেষ করে নি। যারা এটাকে অমান্য বা অগ্রাহ্য করবে তাদের পরিত্যাগ করার আদেশও দিয়েছেন। এমনকি অমান্যকারীরা বাবা, মা কিংবা ভাইও যদি হয় তাদেরও পরিত্যাগ করতে হবে। আলাহর সেই ভাষ্যটি হলোঃ

·         “হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের পিতা ও ভ্রাতা যদি বিশ্বাস অপেক্ষা অবিশ্বসকে শ্রেয় জ্ঞান করে, তবে তাদের অভিভাবক রূপে গ্রহণ করো না। তোমাদের মধ্যে যারা ওদের অভিভাবক রূপে গ্রহণ করে তারাই সীমালঙ্ঘনকারী।” (সুরা তওবা, ৯/২৩)

ইবনে কাথির এই আয়াতের তফসিরে লিখেছেন,

·         এখানে আল্লাহ্‌ তায়ালা কাফিরিদের সাথে বন্ধুত্ব করতে মুমিনদের নিষেধ  করেছেন, যদিও তারা তাদের পিতা, মাতা, ভাই, বোন যাই হোক না কেন, যদি তারা ইসলামের উপর কুফরীকে পছন্দ না করে নেয়”। (দ্রঃ ৮ম-১০ম খণ্ড, পৃ ৬৬২)

কাফিরদের সঙ্গে মুসলমানদের সম্পর্ক কীরূপ হবে তার যে যে নির্দেশ কোরানে রয়েছে, অনুরূপ নির্দেশ রয়েছে মুহাম্মদ ও তাঁর সাহাবীদের নির্দেশাবলী ও জীবনাচরণেও। এর স্পষ্ট নিদর্শন রেখে গেছেন দ্বিতীয় খলিফা ওমর ফারুক। ইসলামি রাষ্ট্রে কাফিরদের কীরূপ মানবেতর জীবন যাপন করতে হবে তা নিয়ে তিনি একটি আইন প্রণয়ন করেছিলেন যেটা ইতিহাসে ‘ওমরের চুক্তি’ নামে খ্যাত বা কুখ্যাত হয়ে রয়েছে। এই চুক্তিটি পুরোটা উপরে উদ্ধৃত করা হয়েছে। 

শুধু তাই নয়, কোরান বলেছে অমুসলিমদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ করতে এবং তাদের পৃথিবী থেকে মুছে দিতে মাবিয়া ইসলাম ধর্মের এই কট্টর নীতিটি বর্জন করেন এবং সেনাবাহিনী প্রশাসনে বহু ইহুদী খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী মানুষদের নিয়োগ দেন ইসলামের মূল নীতি হলো মুসলমানদের পালন অমুসলমানদের দমন মাবিয়ার নীতি ছিল ঠিক তার বিপরীত - দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন ইসলামের দর্শন অনুসারে গীর্জা-মঠ-মন্দির প্রভৃতি অমুসলমানদের ধর্মীয় উপাসনাগৃহগুলি আল্লাহতন্ত্রের চরম পরিপন্থী তাই ইসলামিক সাম্রাজ্যে এসব উপাসনাগৃহের স্থাপনা নিষিদ্ধ শাস্তিযোগ্য অপরাধ সৌদি আরবে আজো এই নীত কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয় মাবিয়া এই কট্টর নীতিও পরিত্যাগ করেন তাঁকে এমনকি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ গীর্জাগুলির রাষ্ট্রীয় খরচে পূনর্নির্মাণ করে দিতেও দেখা গেছে এই নীতিগুলি অবশ্যই ইসলামী নীতিতে এক একটা বড়ো মাপের সংস্কার এবং ইসলামি নীতির পরিপন্থীও শরিয়তের বিচারে  এগুলো  এক একটা ভয়ঙ্কর বিচ্যুতিও সুতরাং  মাবিয়ার ইসলাম থেকে বিচ্যুতির অভিযোগটি মোটেই ভিত্তিহীন নয়  কিন্তু যেটা তাঁর বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন এবং বড়োই মনগড়া অভিযোগ সেটা হলো এই যে, তিনি এই সংস্কারগুলি করেছিলেন নিজের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্যে না, নিজের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার তাঁর কোনো  অভিপ্রায় ছিলো বলে মনে হয় না আসল কথা হলো, ইসলামি সাম্রাজ্যকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানো এবং তাকে আরো সংহত সম্প্রাসারিত করার  ক্ষেত্রে  উক্ত সংস্কাগুলির বিকল্প  তাঁর সামনে খোলা ছিল না মাবিয়ার পরবর্তী কালের খলিফাগণ অনেকেই তাঁর এই সংস্কার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছিলেন এমনকি তাঁদের অনেকেই সেই সংস্কার প্রক্রিয়াকে আরো অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন আব্বাসীয় যুগে কয়েকজন খলিফা তো রাষ্ট্র পরিচালনায় কোরানের নীতিকে সম্পূর্ণরূপেই বর্জন করে তার পরিবর্তে মুত্তাজিলা নীতি গ্রহণ করেছিলেন মুত্তাজিলা নীতিতে কোরান মুসলমানদের ধর্মীয়গুরুদের তিলমাত্র স্থান ছিল না কিন্তু এই সব খলিফাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হয় নি যে তাঁরা নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার  জন্যে ইসলামি নীতি বর্জন করেছিলেন তাঁদের কথা থাক, খলিফা দ্বিতীয় ওমরের কথাই ধরা যাক যিনি ছিলেন উমাইয়া বংশেরই একজন প্রতিনিধি যে বংশের বিরুদ্ধে আজো মুসলিম ঐতিহাসিকদের কলম  লেখনি সমান খড়গহস্ত সেই খলিফা ২য় ওমরও  মাবিয়ার ধর্মনিরপেক্ষ নীতি নস্যাৎ করেন নি বরং সেই নীতিটিকে আরো উন্নত করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি সেই ধর্মনিরপেক্ষ নীতিগুলি কীভাবে আরো এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তার কিছুটা বর্ণণা শোনা যাক মুসলিম ঐতিহাসিকদের মুখ থেকেই  . ওসমান গণি বর্ণনা করেছেন

             ‘... সাম্রাজ্যবাদী সমরনীতির পরিবর্তে শান্তি সংরক্ষণ সহাবস্থান ... ওমরের রাজ্য শাসনের মূল লক্ষ্য ছিলজাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রজাপালন, মানুষের সেবা তথা মানবতার সেবা করা ... অমুসলমান বা বিধর্মীদের পবিত্র ধর্মস্থানগুলোকে তিনি অত্যন্ত যত্ন সহকারে রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছিলেন ... রাজ্য বিস্তার নয়, বিজিত রাজ্যে শান্তি স্থাপন করা ছিল তাঁর নীতি ... পূর্ববর্তী খলিফাগণের সমস্ত সামরিক অভিযানগুলি বাতিল করে দেন যে সমস্ত সেনাপতি রাজ্য বিদেশে বিস্তারে ব্যাপৃত ছিলেন, তাঁদের গৃহে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেন ... ৭১৮-১৯ খ্রীস্টাব্দে আইন জারী করে অমুসলমানদের নিকট হতে মুসলমানদের জমি ক্রয় নিষিদ্ধ করেন  (দ্রঃ  উমাইয়া খেলাফত, ১২৪-১৩১ পৃষ্ঠা) 

খলিফা দ্বিতীয় ওমরের এই নীতিগুলিও যেমন একধারে যুগান্তকারী বৈপ্লবিক, তেমনি অপরদিকে ইসলামি নীতির পরিপন্থীও তবুও মুসলিম ঐতিহাসিকরা দ্বিতীয় ওমরকেখোলাফায়ে রাশেদিনে পঞ্চম খলিফার বিরল সম্মানে ভূষিত করেছেন অথচ খলিফা মাবিয়াকে মুসলিম দুনিয়া ঠিক তার বিপরীত তকমা প্রদান করেছে মানুষ মাবিয়াকেনিকৃষ্ট মুসলমানআর খলিফা মাবিয়াকেখোলাফায়ে জালেমুনঅর্থাৎ অসৎ অত্যাচারী খলিফা বলে ধ্বিকৃত করেছে

তিনি বলেছেন,

             খেলাফতের উত্তরাধিকার নির্বাচনের ব্যাপারে গৃহ-যুদ্ধ এড়াতে হলে বংশানুক্রমিক নীতি বলবৎ করা ব্যতীত আর কোন বিকল্প ছিল না” (সূত্রঃ  উমাইয়া  খেলাফত, .ওসমান গণি, পৃঃ ৩৯)

এটাকে একটা ভয়ঙ্কর ও নিকৃষ্ট দ্বিচারিতা বললেও কম বলা হয়। এই দ্বিচারিতার পেছনে কাজ করেছে মাবিয়ার প্রতি ঘৃণা ও আক্রোশ। মুসলিম দুনিয়া কেন মাবিয়ার প্রতি এত ঘৃণা ও আক্রোশ লালন-পালন করে সেটা একটা বড় প্রশ্নএ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে এই বইয়ের শেষাংশেএখন মাবিয়া পুত্র ষষ্ঠ খলিফা ইয়াজিদ তথা এজিদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলি কারবালা যুদ্ধের ইতিহাসে মোটা মোটা দাগে লিপিবদ্ধ করে তাঁকে ইতিহাসের একজন কুখ্যাত খলনায়ক হিসাবে  চিহ্নিত ও চিত্রিত করা হয়েছে সেগুলির সত্যতা কতোখানি যথার্থ তা নিয়ে আলোচোনা করা যাক

বিংশ অধ্যায়

এজিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহ    

এজিদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ তোলা হয়েছে পাঁচটিতার মধ্যে যেটা সবচেয়ে গুরুতর সেটা হলো, তিনি নিজের সিংহাসনকে বিপদমুক্ত নিষ্কন্টক রাখার জন্যে ইমাম হোসেনকে হত্যা করার পরামর্শ  দিয়ে ওবাইদুল্লাহকে কুফার গভর্ণর করে পাঠিয়েছিলেন কিন্তু ইতিহাস এই অভিযোগের কোনো প্রামাণ্য তথ্য   দেয় না মুসলিম ঐতিহাসিকদের বর্ণিত ইতিহাসে আমরা দেখেছি যে কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসেনের সাথে ওবাইদুল্লাহর সেনাপতি ওমরের দফায় দফায় আলোচনা হয়েছে সেই আলোচনায় দেখানো হয়েছে যে হোসেন তিন দফা প্রস্তাব দিয়েছিলেন যুদ্ধ এড়ানোর জন্যে কেউ কেউ কিন্তু অন্য কথা বলেছেন, সেটা হলো হোসেন দ্বৈরথ যুদ্ধের প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং তাঁর প্রস্তাব মেনে নেওয়া হয়েছিল কেউ কেউ আবার বলেছেন ২রা মহরম (মহরম মাসের দুতারিখ) কারবালা প্রান্তরে হোসেন তাঁবু খাটিয়ে শিবির স্থাপন করেছিলেন এবং সাতদিন ধরে কারবালা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল রকম বিভিন্ন বয়ান যাঁরা দিয়েছেন তাঁরা কিন্তু প্রায় সকলেই একটা বিষয়ে একই সুরে কথা বলেছেন তা হলো,  হোসেনের সৈন্য সংখ্যা ছিল খুব বেশী হলে সত্তর থেকে একশদশ এবং  ওবাইদুল্লাহর প্রেরিত বাহিনীতে ছিল কমপক্ষে চার হাজার থেকে দশ হাজার সৈন্য এখন প্রশ্ন হলো, হোসেনকে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয়ে থাকলে ওবাইদুল্লাহর সেনাপতি ওমর হোসেনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে যাবেন কেন? কিংবা হোসেনের দ্বৈরথ যুদ্ধের প্রস্তাবেই বা সম্মত হতে যাবেন কেন? কিংবা সত্তর থেকে একশো দশ জনের একটি অতি ক্ষুদ্র বাহিনীর সঙ্গে দশ হাজার সৈন্যের একটি বিশাল বাহিনীর যুদ্ধ শেষ হতে সাতদিন সময় লাগবে কেন? হোসেনকে হত্যা করার নির্দেশ থাকলে দশ হাজার সৈন্য নিশ্চয় ঝাঁপিয়ে পড়তো হোসেনের বাহিনীর উপর এবং নিমেষের মধ্যে হোসেন সহ তাঁর ক্ষুদ্র বাহিনীর সকলকে সাবাড় করে দিতোএটাই কি  বাস্তবসম্মত বিশ্বাসযোগ্য হতো না? সুতরাং মুসলিম ঐতিহাসিকদের দেওয়া বর্ণনা থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে, ওবাইদুল্লাহর প্রতি হোসেন সম্পর্কে যে নির্দেশই থাক না কেন, তাঁকে হত্যা করার নির্দেশ অন্ততঃ ছিল না প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, কারবালা প্রান্তর থেকে দামেস্ক নগর ছিলো সেই যুগে কয়েক দিনের পথ ফলে এটাও অনুমান করা যায় যে, কারবালা প্রান্তরে যে হত্যাকান্ড ঘটেছিল সে বিষয়ে সেই মুহুর্তে এজিদের পক্ষে কিছু জানা সম্ভব ছিলো না প্রসঙ্গে এখানে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, এজিদ কুফার গভর্নর ওবাইদুল্লাহকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়ে পাঠিয়েছিলেন এই অভিযোগটি উত্থাপন করতে গিয়ে মুসলিম ঐতিহাসিকরা প্রচুর পরষ্পরবিরোধী কথা বলেছেন যেমন, .ওসমান গণির কথা ধরা যাক তিনিউমাইয়া খেলাফতগ্রন্থে একদিকে এজিদকে হোসেনের হত্যাকারী সাব্যস্ত করেছেন, আবার তিনিই বলেছেন যে কারবালা প্রান্তরে হোসেনের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এজিদ সম্ভবত যুক্ত ছিলেন না গণির সেই পরষ্পরবিরোধী বর্ণনা এরূপঃ

             ‘‘তবে কারবালা হত্যাকান্ডের সাথে তিনি সরসরি খুব একটা জড়িয়ে ছিলেন মনে হয় না, কেননা, রাজধানী দামেস্ক কুফা হতে প্রায় ২০০ মাইলের ব্যাবধানে অবস্থিত অতি অল্প সময়ের ব্যাবধানে কোথায় কি ঘটছে, সেটি তিনি হয়তো সম্যকভাবে অবগত ছিলেন না তাই যখন ইমামের ছিন্ন মস্তক দামেস্কে পৌঁছাল, তিনি কিছুক্ষণের জন্য হতবাক বা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়েছিলেন (দ্রঃ পৃ - ৫৮) 

একটু পরেই .গণিই আবার লিখছেন,

             ‘‘যাই হোক, কারবালার মর্মান্তিক ঘটনাতে কোনরূপেই তাঁকে সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রমাণ করা যাবে না কেননা, তাঁর মৌন সমর্থন না থাকলে দুরাত্মা ওবাইদুল্লাহ কাজ কখনও করতে সাহস পেতেন না (দ্রঃ- পৃ -৫৯ )

 

হোসেনের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় গুরুতর হলো, সেনাবাহিনী পাঠিয়ে তিনি মদিনা আক্রমণ করে মুহাম্মদ ও প্রসিদ্ধ সাহাবীদের কবর এবং মসজিদে নববীর চরম অপমান ও অসম্মান করেন। এমনকি তিনি সেনাবাহিনী  পাঠিয়ে মদিনাকে লুঠ করতেও দ্বিধা করেন নি। এ প্রসঙ্গে যেটা সত্যিকারের ঘটনা তা হলো এই এরূপঃ  এজিদের একদল সৈন্যবাহিনী মদিনা গিয়েছিল তাঁর নির্দেশে এ কথা ঠিক, কিন্তু তিনি মদিনা লুঠ করতে কিংবা মুহাম্মদ ও সাহাবিদের কবর ও মসজিদে নববীর অসম্মান করতে সৈনিবাহিনী প্রেরণ করতে সৈন্যবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন এ অভিযোগটি সম্পূর্ণ মনগড়া ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতসৈন্যবাহিনী পাঠানোর পেছনে তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো সেখানে শান্তি-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে সেখানকার মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা কারণ হোসেনের নিহত হওয়ার খবর মদিনায় পৌঁছালে সেখানে প্রতিক্রিয়া এতো তীব্র আকার ধারণ করে যে হাসেমি বংশের মানুষরা মদিনার গভর্ণর-সহ  উমাইয়া বংশের মানুষদের উপরেও চড়াও হয়েছিলেন। এহেন পরিস্থিতিতে সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যে তিনি একদল সৈন্য প্রেরণ করেছিলেনপরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে সৈন্যবাহিনীর বাড়াবাড়ি হয়তো কিছুটা হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু এজিদ মদিনা লুঠ করতে সেনা পাঠিয়েছিলেন এই অভিযোগটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন

তৃতীয় ভয়ঙ্কর অভিযোগটি হলো এজিদের বিরুদ্ধে   যে, তিনি মক্কাও আক্রমণ করেছিলেন এবং কাবা গৃহে অগ্নি সংযোগের মত ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ সংঘটিত করেছিলেন এই অভিযোগটিও পূর্বোক্ত অভিযোগের মতোই সম্পূর্ণ বিকৃত উদ্দেশ্য প্রণোদিত আমরা এর আগের আলোচনায় লক্ষ্য করেছি যে, শেষ পর্যন্ত মাত্র দুজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এজিদের কাছে বয়াত নেন নি তাঁরা হলেন ইমাম হোসেন আব্দুল্লাহ-ইবন-জুবাইর হোসেনের মৃত্যুর খবর শোনার পর এই আব্দুল্লাহ নিজেকে মক্কা শহরে ইসলামি সাম্রাজ্যের খলিফা বলে ঘোষণা করে এজিদের প্রতি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এরূপ পরিস্থিতিতে একজন খলিফার দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী ও তার সঙ্গীদের দমনের জন্যে কঠোর পদক্ষেপ করা। এজিদ ঠিক সেই কাজটি করেছিলেনএজিদের সৈন্যবাহিনী যখন মক্কায় পৌঁছয় তখন আবদুল্লাহ ও তাঁর সঙ্গীরা কাবার অভ্যন্তরে আশ্রয় নিয়ে সেখান থেকে এজিদের সৈন্যবাহিনীর উপর আক্রমণ চালাতে শুরু করেএজিদের সৈন্যবাহিনীকে নিরুপায় হয়ে কাবাগৃহে ঢুকতে হয়েছিলো বিদ্রোহীদের দমন করার জন্যেএতে কাবাগৃহের যদি অপমান বা অসম্মান হয়ে থাকে তবে তার দায় বর্তায় আবদুল্লা ইবনে জুবায়ের এর  উপর, এজিদের উপর নিশ্চয় নয়  ইয়াজিদের বিরুদ্ধে মদিনা লুঠপাট ও মক্কায় কাবায় অগ্নি সংগযোগের মারাত্মক অভিযোগ দু’টি যে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নয় তা জানা যায় নিরপেক্ষভাবে যাঁরা ইতিহাস লিখেছেন তাঁদের লেখা থেকে। কারবালা যুদ্ধের পর মদিনায় ঠিক কী কী ঘটেছিলো তার বিবরণ পাওয়া যায় নিকলসন ও হিট্টি এই দু’জনের লেখা ইতিহাস থেকে। নিকলসন তাঁর আরবী সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন,

·         “হুসাইনের হত্যার পরও ইয়াজিদের কাহিনী শেষ হয় নি। এরপর মুহাম্মদের নগরী মদিনা থেকে উমাইয়া রাজ্যপালকে বহিষ্কৃত করা হয়। সে জন্য সিরিয়ার সেনাদল মদীনায় ব্যাপকলুঠতরাজ চালায়। অন্যদিকে মক্কায় আবদুল্লা বিন জুবাইরেক প্রতিদ্বন্দী খেলাফতের সূচনা করে। এর পরিণতিতে মক্কায় অবরোধ শুরু হয়। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় কাবা। এসব ঘটনা পরম্পরায় মুসলিম ভাবাবেগ আহত হয়। ফলে এক বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। হুসাইন হত্যার প্রতিশোধ নিতে এগিয়ে এল মুখতার। মুখতার কুফা দখল করে সেখানকার প্রায় ৩০০ অপরাধী নাগরিককে হত্যা করে। হত্যা করে শামিরকেও। তার সেনাবাহিনী উবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদকে পরাজিত করে হত্যা করে। ইতিহাসের এমন পরিণতি যে মুখতারও নিজে খুন হয়। তাকে খুন করে ইবনে জুবাইর-এর ভাই মুসআব। তার ৭০০-র মত অনুগামীদের ঠাণ্ডা মাথায় খুন করে মুসআব বাহিনী।” (দ্রঃ পৃ ১৯৪)

 

নিকলসনের  বিবরণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ  অন্তত তিনটি বিশ্বাসযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায় যা মুসলিম ঐতিহাসিকগণ সচেতনভাবে চেপে যান বা আড়াল করেন। সেই তিনটির একটি হলো, ইয়াজিদ মদিনায় লুঠপাটের ঘটনা যদি সত্যিই ঘটে থাকে তবে তার দায় সম্পূর্ণ রূপে একা ইয়াজিদের উপর বর্তায় না।  কারণ, কারবালা যুদ্ধে হোসেনের পরাজয় ও নিহত হওয়ার পর মদিনার রাজ্যপালকে বিতাড়িত করেছিলো আলি ও হোসেনের অনুগামীরা। এর পাশাপাশি এটাও সহজেই অনুমান করা যায় যে সেই সময় আলি ও হোসেনের অনুগামীরা উমাইয়া বংশের লোকজনের উপর কী বীভৎস অত্যাচার চালিয়েছিলো। এরূপ পরিস্থিতিতে খলিফার উপর দায়িত্ব বর্তায় মদীনার শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করা এবং অত্যাচারিত ও নিপীড়িত মানুষদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। খলিফা ইয়াজিদ ঠিক সেই কাজটি করেছিলেন মাত্র, মদিনা আক্রমণ কয়ার উদ্দেশ্যে তিনি সেনাবিহিনী পাঠান নি। দ্বিতীয় ঐতিহাসিক সত্যি তথ্যটি হলো, মুহাম্মদের একজন বিশিষ্ট সাহাবী জুবাইর-এর পুত্র আবদুল্লাহ খলিফা ইয়াজিদের খেলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন এবং নিজেকে মক্কার (আল-হেজাজ) একজন বৈধ খলিফা ঘোষণা করে একটা সমান্তরাল খেলাফতি শাসনকার্য শুরু করেছিলেন। তিনিই মক্কা উমাইয়া বংশের লোকজনদের উপর নৃশংস অত্যাচার নামিয়ে এনেছিলেন। স্বভাবতই আবদুল্লাহ-র বিদ্রোহকে দমন করা এবং মক্কার উমাইয়াদের জানমাল রক্ষা করার জন্যে খলিফা ইয়াজিদের সামনে মক্কায় সেনা পাঠানো ব্যতীত অন্য বিকল্প ছিলো না। খলিফার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে পেরে না উঠে আবদুল্লা কাবাকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। নিজের এবং তার লোকজনদের জীবন রক্ষার্থে তিনি কাবার ভিতরে আশ্রয় নেন। ফলে খলিফা ইয়াজিদের সেনাবাহিনীকে বাধ্য হয়েই কাবার ভিতরে ঢুকতে হয়েছিলো। তৃতীয় ঐতিহাসিক তথ্যটি হলো, কারবালা যুদ্ধের পর মক্কা ও মদিনায়  সাধারণ মানুষের উপর ইয়াজিদ কোনো প্রকার অত্যাচার বা উৎপীড়ন করেন ন। বরং সত্যিটা হলো, আলির অনুগামীরাই মক্কা, মদিনা ও কুফায় বসবাসকারী খলিফা ইয়াজিদের অনুগামী এবং সাধারণ উমাইয়াদের উপর ব্যাপক অত্যাচার চালিয়ে তাদের বহু মানুষকে হত্যা করেছিলেন। এগুলোই হলো কারবালা যুদ্ধের পরের প্রকৃত ইতিহাস। এই ইতিহাসকে বিকৃত করে মুসলিম ঐতিহাসিকরা উল্টে ইয়াজিদকেই তুলে ধরেছেন আসামীর কাঠগড়ায়। 

এবার চোখ রাখা যাক ফিলিপ কে হিট্টি কী বিবরণ দিয়েছেন তাঁর আরব জাতির ইয়িহাস গ্রন্থে,

·         “চপলতা ও অসৎ আমদ-প্রমোদে সব সময় ডুবে থাকার জন্য সুপরিচিত ইয়াজিদ যখন সিংহাসনে আরোহণ করলেন, আবদুল্লাহ তখন  প্রকাশ্যে নতুন খলিফার বিরোধিতা শুরু করলেন এবং আল-হুয়াসাইনকে বিপজ্জনক পদক্ষেপ গ্রহণে উৎসাহিত করলেন। আর তার প্রেক্ষিতে তাকে প্রাণ দিতে হল। সুতরাং খলিফা পদের একমাত্র দাবিদার থাকলে আবদুল্লাহ। আবদুল্লাহ সমগ্র আল-হেজাজে সরকারিভাবে নিজেকে খলিফা ঘোষণা করলেন। আল-মদিনার বিরোধিতা নির্মূল করার জন্যে ইয়াজিদ সেখানে দ্রুত এক সেনাবাহিনী পাঠালেন। এই সেনাবাহিনীতে খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী  বহু সিরিয়াবাসী ছিল। এদের নেতৃত্বে ছিলেন মুসলিম ইবন উকবাহ নামে জনৈক এক চক্ষুবিশিষ্ট ব্যক্তি। বার্ধক্য ও অশক্ত শরীরের জন্য তাঁকে সমস্ত পথ পালকিতে করে নিয়ে যেতে হয়েছিল। আল-মদিনার পূর্বদিকে আল-হারাবার আগ্নেয় সমভূমিতে এই সেনাদল ৬৮৩ খৃষ্টাব্দের ২৬ আগষ্ট যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং জয়লাভ করে। দামাস্কাসের সেনাবাহিনী যে তিনদিন লুঠপাট চালাচ্ছিল, তা সন্দেহজনক। যাই হোক, সেই বিজয়ী সেনাবাহিনী তারপর মক্কার দিকে এগিয়ে চলে। যাত্রা পথে মুসলিম মারা যায়। আল-হুসাইন ইবন নুমাইর আল-সাকুনি তার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। মক্কার হারাম (পবিত্র মসজিদ) – এর মাটিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন ইবন-আল-যুবাইর।  সেনাবাহিনীর নতুন জেনারেল সেখানেও আক্রমণ চালায়। অবরোধ করার সময় সেখানে আগুন ধরে যায় এবং সম্পূর্ণ পুড়ে গিয়ে সেটি মাটিতে মিশে যায়। কালো পাথরটি তিনটি খণ্ডে ভাগ হয়ে যায় এবং আল্লাহ্‌র উপাসনালয়টি এক শোকার্ত মহিলার ক্ষতবিক্ষত বক্ষের রূপ ধারণ করে। যখন এই আক্রমণ চলছিল তখন ইয়াজিদের মৃত্যু হয়।” (দ্রঃ পৃ ১৮৩)

হিট্টি উল্লেখ করেছেন ে তিনি এই তথ্যগুলি নিয়েছেন তাবারীর গ্রন্থের ১ম খণ্ড ও ইয়াকুবী গ্রন্থের ২য় খণ্ড থেকে।

 

এজিদের বিরুদ্ধে আরও দুটি অভিযোগ হলো এক). এজিদ ছিলেন মদ্যপ দুশ্চরিত্রের মানুষ, এবং  দুই). তিনি ছিলেন খলিফা পদে সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত ব্যক্তিত্ব এজিদ মদ্যপ দুশ্চরিত্রের মানুষ ছিলেনএই অভিযোগটি সর্বজনগ্রাহ্য মোটেই নয় এই অভিযোগটি কেবল শোনা যায় মুসলিম ঐতিহাসিকদের লেখাতেই অপরদিকে ইমাম হাসান (মুহাম্মদের বড় নাতি) যিনি একশটি বিয়ে করে শেষ পর্যন্ত নিজের বউয়ের দেওয়া বিষ খেয়ে অকালে মারা যান তিনিই হলেন তাঁদের চোখে মুসলিম জগতের চোখের মণি ও এক মহান চরিত্রের মানুষমুসলিমজগত কথিতমদ্যপ দুশ্চরিত্রএই এজিদই কিন্তু অবিশ্বাস্য উদারতা মহানুভবতার পরিচয় দেন হোসেনের কাটামুণ্ড এবং তাঁর বউ পরিবারের অন্যান্য নারী সদস্যদের প্রতি ইমাম হোসেন এজিদকে খলিফা হিসাবে স্বীকৃতি তো দেনই নি, উল্টে তাঁকে অসম্মান অবজ্ঞা করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাঁকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার পরিকল্পনা করেছেন এবং অবশেষে বিদ্রোহ করতে গিয়েই নিহত হয়েছেন সেই শত্রু বিদ্রোহী হোসেনের নিষ্প্রাণ কাটা মুণ্ড তাঁর পরিবারের নারী সদস্যদের বন্দী অবস্থায় নিজের দরবারে হাজির দেখতে পেয়ে এজিদের তো আনন্দে আত্মহারা হওয়ার কথা কেননা, তাঁর খেলাফতের পথের একমাত্র কাঁটাটা চিরতরে শেষ হয়ে গেছে, খেলাফত এখন সম্পূর্ণ কণ্টকশূন্য এবং তাঁর সামনে একদল অসহায় যুবতী নারী সেই চিরশত্রুর ছিন্ন মস্তক পদতলে হাজির যখন, তখন অতীতের সকল অপমান উপেক্ষার প্রতিশোধ নিতে সেই মস্তকের প্রতি তাঁর তো পাল্টা অসম্মান অপমান প্রদর্শন করারই কথা, একজন লম্পট রাজা-বাদশার পক্ষে শত্রুর পরিবারের যুদ্ধবন্দী নারীসদস্যদের সঙ্গে সাধারণতঃ  যে রূপ কুৎসিৎ আচরণ করা হয় তাঁর তো সে রূপ আচরণই করার কথা কিন্তু না, এজিদ সে রূপ কুৎসিৎ আচরণ করেন নি হোসেনের ছিন্ন মস্তক তাঁর পরিবারের মেয়েদের বন্দী অবস্থায় দেখে একটুও আনন্দবোধ করেন নি, তাঁর চরিত্রের নৈতিক স্খলনও হয় নি বরং তাঁর মুখমন্ডলে নেমে এসেছিল প্রবল বিষাদের ছায়া এজিদের এই আচরণ শরিরী ভাষাকে সম্মান না জানিয়ে মুসলমান ঐতিহাসিকরা তাঁকে ঘুরিয়েভীত সন্ত্রস্তবলে কটাক্ষ করেছেন হোসেনের ছিন্ন মস্তক দেখে এজিদ হর্ষোল্লসিত যে হন নি, বরং বেদনাহত বিমর্ষই হয়েছিলেন সে কথা অস্বীকার করেন নি মুসলিম ঐতিহাসিকরাও কিন্তু তাঁরা আবার এজিদের বিমর্ষ হওয়ার এই মহান গুণটিকে স্বীকার সৎসাহসও দেখাতে পারেন নি সেই সময়ের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে . গণি উপরে উক্ত বইয়ে লিখেছেন,

             ‘‘পরে নরাধম উবাইদুল্লাহ হোসেনের ছিন্ন মস্তক অন্যান্য পরিজনবর্গকে রাজধানী দামেস্কে প্রেরণ করলে ইয়াজিদ ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় অতি সত্বর ছিন্ন মস্তক প্রত্যর্পণ করেন, এবং কারবালা প্রান্তরে সকলকে সমাধিস্থ করা হয় জীবিত শিশু স্ত্রীলোকগণকে ইয়াজিদ সসম্মানে মদীনায় প্রেরণ করেন’’ (দ্রঃ পৃ - ৫২)  

যে ইমাম হোসেন তাঁকে খলিফার সিংহাসন থেকে উৎখাত করতে চেয়েছিলেন তাঁর পরিবারের মেয়ে সদস্যদের হাতের মুঠোয় পেয়েও তাঁদের সঙ্গে বন্দীর ন্যায় অমানবিক ও কুৎসিত আচরণ করার পরিবর্তে তাঁদের প্রতি যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন পূর্বক তিনি তাঁদের মক্কায় ফেরৎ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এমন ঘটনা ইতিহাসে নজিরবিহীন এই ঘটনাটি সাক্ষ্য দেয় যে দুশ্চরিত্র’, ‘মদ্যপ’, ‘উচ্ছৃঙ্খলএজিদ  কত বড় হৃদয়ের মানুষ ছিলেন

ইয়াজিদ ছিলেন মদ্যপ, দুশ্চরিত্র ও উচ্ছৃঙ্খল – এগুলো খুবই গুরুতর অভিযোগ। বিশ্বের সমগ্র মুসলিম সমাজ তো বটেই, অমুসলিম সমাজও ইয়াজিদের বিরুদ্ধে আনা এই গুরুতর অভিযোগগুলিকে সত্য বলে নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করে। যে কোনো অভিযোগ একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের উপর উত্থাপন করার সময় একজন ঐতিহাসিকের অবশ্যম্ভাবি কর্তব্য হলো সে বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্য, গ্রহণযোগ্য ও প্রামাণ্য তথ্য পরিবেশন করা। মুসলিম ঐতিহাসিকগণ মুয়াবিয়া ও ইয়াজিদের বেলায় সে দায়িত্ব পালন করেন নি। এ কথা ইতিমধ্যেই উল্লেখ করেছি। এমতাবস্থায় ইতিহাসের যারা কৌতূহলি পাঠক তারা নিশ্চয় জানতে চায়বেন যে ইয়াজিদ একজন ব্যক্তি হিসাবে আসলেই কী রকম প্রকৃতির ছিলেন। এ প্রসঙ্গে প্রায় সকল ঐতিহাসিক যা বলেছেন তা হলো এই যে, তিনি (ইয়াজিদ) নিশ্চয় মদ পান করতেন। কিন্তু তিনি মাতাল, উচ্ছৃঙ্খল ও চরিত্রহীন ছিলেন এ কথা শুধু মুসলিম ঐতিহাসিকরাই বলেছেন, এমন গুরুতর চারিত্রিক বিচ্যুতির কথা অন্য ঐতিহাসিকদের লেখায় পাওয়া যায় না। ইয়াজিদ সম্পর্কে বরং উল্টো বর্ণনা আমরা দেখতে পাই। তাঁদের ইতিহাস থেকে জানা যে তিনি ছিলেন সৎ এবং একজন সহৃদয়বান মানুষ। তিনি ছিলেন ক্রীড়ানুরাগী ও সঙ্গীতানুরাগী এবং উচ্চ শিক্ষিত ও কাব্যিক প্রতিভার অধিকারী। ইয়াজিদ সম্পর্কে নিকলসন লিখেছেন,

·         ইতিহাসের তথাকথিত রায়কে বিচার করে দেখলে মনে হয় ধর্মের রায়, ইসলাম বা আরব সাম্রাজ্যবাদের রায়। এই নিরিখে উমাইয়ারা সঠিকভাবেই নিন্দাযোগ্য। কিন্তু এটা স্মরণ করা উচিৎ যে, মুসলিমদের চোখে ধর্ম ও রাষ্ট্রের কোন পার্থক্য নেই। ইয়াজিদ ছিল একজন দুষ্ট যাজক। তাই সে নিন্দিত, অত্যাচারী। এক্ষেত্রে দুইয়ে মিলে একাকার হয়ে যায়। আমাদের নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে দেখলে মনে হয় ইয়াজিদ ছিল একজন সহৃদয় যুবরাজ। সে মায়ের কাব্যিক প্রতিভার উত্তরাধিকারী হয়েছিল। সে মদ্যপান, সঙ্গীতচর্চাকে প্রচণ্ড পছন্দ করত। পছন্দ করত খেলাধূলাকেও। প্রজাদের ব্যাপারে মাথা ঘামানোই বরং তার অপছন্দ ছিল। সিরিয়ার সন্তানরা উমাইয়াদের বৈধ উত্তরাধিকার বলে মনে করত। তারা উমাইয়াদের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করত।” (সূত্রঃ আরবী সাহিত্যের ইতিহাস, পৃ ১৯৩)

কারবালা কাণ্ডের পর হোসেনের পরিবারের সদস্যদের প্রতি ইয়াজিদের সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ঘটনায় আমরা ইয়াজিদের উদারতে ও সহৃদয়তার পরিচয় পেয়েছি। এ কথা ব্যক্ত করেছেন নিকলসনও তাঁর উক্ত গ্রন্থে। তিনি লিখেছেনঃ

·         “যুদ্ধের পর হুসাইনের পরিবারের মহলা ও শিশুদের খারাপ পরিণতির নিন্দা করেছিল ইয়াজিদ। সে ওদের যোগ্য সমান দেওয়ার চেষ্টা করে। তাদের মদিনায় পাঠিয়ে দেয়। (দ্রঃ পৃ ১৯৩-১৯৪)

 

এজিদের বিরুদ্ধে আর একটি অভিযোগ হলো যে, তিনি খলিফা পদের অযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন তিনি যোগ্য ছিলেন, নাকি সত্যি অযোগ্য ছিলেন তা নিশ্চয় করে বলা সত্যিই খুব কঠিন কারণ খলিফা হওয়ার পর মাত্র সাড়ে তিন বছর তিনি বেঁচেছিলেন মাত্র ৪৩ বছর বয়সেই গুরুতর পীড়ায় অসুস্থ হয়ে তিনি মারা যান তবে ব্যক্তি এজিদের মধ্যে যে সব গুণাবলীর কিছু কিছু শোনা যায় তাতে তিনি একেবারে অযোগ্য ছিলেন বলে মনে হয় না আর তাছাড়া মাবিয়া নিজের পুত্র বলে একজন অযোগ্য মানুষের হাতে সাম্রাজ্যের দায়িত্বভার অর্পণ করে যাবেন এত স্বার্থপর নীচু প্রকৃতির মানুষ কখনই ছিলেন না মুসলিম ঐতিহাসিকগণ তো এজিকে অযোগ্য বোলে ছাপ মরবেনই, কেননা, তা না হলে তো  ইমাম হোসেনই একমাত্র খলিফা পদের উপযুক্ত যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন সেটা তো  প্রমাণ করা যায় না অমুসলিম   ঐতিহাসিকদের চোখে কিন্তু এজিদ ছিলেন খলিফা পদের জন্যে যথেষ্ট যোগ্য উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব বার্ণাড লুইস বলেছেন,

             ইয়াজিদ রাজোচিত গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন তিনি সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন, এবং তাঁর পুত্র খালিদ গ্রীক বিজ্ঞানের অসংখ্যক পুস্তক সংগ্রহ করেন(দ্রঃ উমাইয়া খেলাফত, ড. ওসমান গণি, পৃ – ৫৯)  

লুইসের এই উক্তি থেকে দুটি জিনিষ স্পষ্ট বুঝা যায় , তা হলো - এক) খলিফা মাবিয়া তাঁর পুত্র পৌত্রকে ক্ষমতার বৈভবে বিলাসে ভেসে যেতে দেন নি এবং তাঁদেরকে পশ্চাদপদ কোরান ইসলামি শিক্ষার কানাগলিতে বন্দী রেখে বিজ্ঞান দর্শনের শিক্ষা জ্ঞান লাভের সমস্ত জানালা-দরজাগুলিও বন্ধ করে দেন নি বরং তাঁদের মধ্যে প্রকৃত জ্ঞানের শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন ফলে তাঁদের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন সাহিত্যের জ্ঞানের প্রসার ঘটেছিল এবং তাঁরা তাঁদের জ্ঞান শিক্ষাকে আরব সভ্যতার উন্নতি সাধনের কাজে নিয়োজিত করেছিলেন প্রসঙ্গত একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা এখানে উল্লেখ্যণীয় হলো এই যে, শুধু নিজের সন্তান-সন্ততিদেরকেই নয়, মাবিয়া সমগ্র সাম্রাজ্যের সকল মানুষের জন্যেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের দরজা খুলে দিয়েছিলেন শিক্ষা ব্যবস্থাকে কোরান ইসলামি শিক্ষার বদ্ধ জলাশয় থেকে তুলে নিয়ে এসে তিনিই প্রথম সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়গুলোকে পাঠ্যক্রমের মধ্যে নিয়ে আসার কাজ শুরু করেছিলেন এনং এভাবেই গোটা আরব জাতিকেই বিজ্ঞান-দর্শন-সাহিত্যের শিক্ষা সাধনায় ব্রতী করে তুলতে উদ্যোগী হয়েছিলেন  দুই) মুসলিম ঐতিহাসিকগণ যেমনটা অনর্গল প্রচার করে থাকেন যে এজিদ ছিল একেবারেই অনুপযুক্ত অযোগ্য ব্যক্তিএই প্রচারটিও মিথ্যা বৈ নয় আসল ঘটনাটা বরং ঠিক তার বিপরীত, অর্থাৎ এজিদ ছিলেন রাজোচিত গুণাবলীর অধিকারী, বিজ্ঞান-দর্শন-সাহিত্যের অনুরাগী পণ্ডিত মানুষ সুতরাং আমাদের কাছে এটাই প্রতীয়মান হয় যে মাবিয়া তাঁর অযোগ্য পুত্রের হাতে ইসলামি খেলাফত তুলে দিয়ে যান নি

ইমাম হাসানের মৃত্যুর জন্যেও দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে এজিদকেকেউ কেউ তো বলেছেন মাবিয়া নয় এজিদই হাসানকে ষড়যন্ত্র করে হত্যা করানসাহিত্যিক মীর মোশারাফ হোসেন এই অভিযোগ করেছেন তাঁর উপন্যাসে এক্ষেত্রে অভিযোগটি হলো রকম - যয়নাব নাম্নী একজন অতি সুন্দরী বিধবা নারীকে বিয়ে করতে চেয়েছিল ইমাম হাসান এজিদ উভয়েইযয়নাব বিয়ে করেছিলেন হাসানকে। এজিদ এটা মেনে নিতে পারেন নিযে কোনো মুল্যে তিনি যয়নাবকে তাঁর অঙ্কশায়িনী করতে প্রতিজ্ঞা করেছিলেনতিনিই মাইমুনা নাম্নী একজন নারীকে নিয়োগ করেছিলেন যয়নাবের মনকে হাসানের বিরুদ্ধে বিষাক্ত করে তুলতে এবং পরবর্তীতে খলিফার বউ করার প্রলোভন দেখিয়ে  হাসানকে হত্যা করার জন্যেএরই ফলশ্রুতিতে যায়েদার হাতে হাসানের মৃত্যু হয়এই অভিযোগটি যে হাস্যাষ্পদ ও কাল্পনিক একটা স্থূল চিত্রনাট্য বৈ নয় তা বলা বাহুল্যহাসানকে কেন তাঁর বউ যায়েদা বিষ খাইয়ে হত্যা করেছিলেন সে আলোচনা ইতিমধ্যেই করা হয়েছেসুতরাং সে আলোচনা এখানে নিষ্প্রয়োজনইয়াজিদ সম্পর্কে আরবের একজন বিশিষ্ট ঐতিহাসিকের একটি উদ্ধৃতি এখানে উল্লেখ করা হলে তা খুবই প্রাসঙ্গিক ও বাঞ্ছনীয় হবে এই অধ্যায়টির সমাপ্তি টানার আগে সেই প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবন কাথিবলেছেন,

             ইয়াজিদ উদারপন্থী বাগ্মী ছিলেন (দ্রঃ – ঐ)

 

 

 একবিংশ অধ্যায়

যুদ্ধ নয়, ওটা আসলে ছিলো বিদ্রোহ

 

কারবালা প্রান্তরে ইতিহাস কথিত যে যুদ্ধটি হয়েছিল সেখানে হোসেনের পক্ষে সৈনিবাহিনীতে ছিল সত্তর থেকে একশদশ জন সৈন্য, অপরদিকে কুফার গভর্ণর যে বাহিনী পাঠিয়েছিলেন ওমর ইবন সাদের নেতৃত্বে তাতে চার হাজার থেকে দশ হাজার সৈনিক ছিল অর্থাৎ হোসেন খলিফা এজিদকে উৎখাত করার যে ডাক দিয়েছিলেন তাতে সাড়া দিয়ে দলে দলে মুসলমানরা ছুটে আসেন নি যে কয়জন তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন তাঁরা মূলত তাঁর জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর লোকজন এবং সকলেই মক্কা মদিনার অধিবাসী আবার এই ছবিটাও স্পষ্ট যে, তাঁর সঙ্গে প্রথম দিকে অতি মুষ্টিমেয় যে কয়জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ছিলেন তাঁরাও তাঁর পাশে শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত ছিলেন না শুধু আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর তাঁর সঙ্গে ছিলেন এবং তিনিও এজিদের হাতে বয়াত নেন নি সুতরাং সামগ্রিকভাবে যে ছবিটা আমরা দেখতে পাই তা হলো এজিদের বিরুদ্ধে এবং হোসেনের পক্ষে জনমত প্রায় ছিল না বললে মোটেই অত্যুক্তি হয় না হোসেন তবুও ক্ষমতা লাভের জন্য এত মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন  যে এই বাস্তব পরিস্থিতিটাও উপলব্ধি করতে পারেন নি ভেবেছিলেন তিনি যেহেতু নবীর নাতি তাই সমগ্র মুসলিম সমাজের নৈতিক সমর্থন তাঁর সঙ্গেই আছে সাহস করে এজিদকে উৎখাত করার ডাক দিলে এক বিরাট সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলা কঠিন কাজ হবে না সেই মিথ্যা আশায় যখন তিনি বিভোর ছিলেন তাঁকে  অনেকেই হয়তো তাঁকে অর্থহীন উৎসাহও জুগিয়েছিল কথা বলে যে, মুসলমানরা মনে-প্রাণে আপনাকে চাইছে, আপনি এগিয়ে যান কুফা থেকে আক্ষরিক অর্থেই রকম আশ্বাসবাণী সহ বেশ কিছু চিঠি-পত্র তাঁর নিকট এসে পৌঁছেছিলও বটে ফলে তিনি প্রচন্ড আশাবাদী আত্মবিশ্বাসী হয়ে  ইসলামি সাম্রাজ্যের খলিফা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে সৈন্য সংগ্রহের নিমিত্ত কুফার পথে রওনা দিয়েছিলেন ফল যা হওয়ার তাই হয়েছিল, বড় সৈন্যবাহিনী গড়ে তুলতে পারা তো পরের কথা, কার্যত ক্ষুদ্র একটা বাহিনীও গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছিলেন এবং অসহায়ের মত মাত্র কয়েক ঘন্টার অর্থহীন প্রতিরোধের প্রয়াস চালিয়ে সদলবলে মৃত্যর কোলে ঢোলে পড়েছিলেন এবং এভাবেই একটি করুণ অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছিলো কারবালার এই করুণ ঘটনাকে ইতিহাসকারবালা যুদ্ধবলে কেনযুদ্ধেরমর্যাদা প্রদান করেছে তা কিছুতেই বোধগম্য হয় না প্রকৃত বিচারে এটা একটা রাজদ্রোহ বা বিদ্রোহের ঘটনা বৈ নয়

দ্বাবিংশ অধ্যায়

যুদ্ধ কেন হয়েছিল ? কারা দায়ী ?

 

কারবালা প্রান্তরে যা ঘটেছিল, যুদ্ধ কিংবা বিদ্রোহ যাই বলিনা কেন, সেই ঘটনার ভরকেন্দ্রে ছিলো ক্ষমতা  ঘটনা-উপঘটনা, ঘাত-প্রতিঘাত সবটাই আবর্তিত হয়েছে সেই ক্ষমতা তথা খলিফার মসনদকে কেন্দ্র করে শুধু খলিফার সিংহাসন দখল করার জন্য আরও অসংখ্য যুদ্ধ বা বিদ্রোহ এবং  রক্তপাতের ঘটনা ঘটেছে ইসলামের ইতিহাসে তারফলে শুধু ইমাম হোসেনই নয়, অনেক খলিফারই প্রাণ অকালে ঝড়ে গেছে  গুপ্তঘাতক বা বিদ্রোহীদের হাতে তাঁদের মধ্যে দ্বিতীয় খলিফা ওমর ফারুক, তৃতীয় খলিফা ওসমান গণি, চতুর্থ খলিফা আলি খলিফা দ্বিতীয় ওমরের নাম উল্লেখযোগ্য তবে তাঁদের কথা সাধারণ মানুষ, এমনকিমুসলমানরাও বিশেষ জানেন নাঅথচ হোসেনের নিহত হওয়ার কথা মুসলমানরা সবাই জানে।

এজিদকে খলিফা পদ থেকে সরিয়ে কিংবা হত্যা করে তাঁর ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার জন্য কারবালার প্রান্তরে যে উক্ত ঘটনাটি ঘটেছে  এবং তাতে হোসেনের মৃত্যু হয়েছে সে কথা স্বীকার করে নিয়েও মুসলিম ঐতিহাসিকগণ তাঁদের লেখা ইতিহাস গ্রন্থগুলিতে হোসেনকে অন্য মর্যাদা ও সম্মান প্রদান করেছে তাঁরা বলেছেন যে নিছক ক্ষমতা লাভের জন্যে নয়, হোসেন প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন একটা আদর্শের জন্যে, ইসলামকে পাপিষ্ঠ এজিদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যএই ইতিহাসগুলি যেটা দাবী করে তা হলো মাবিয়া অন্ধ পুত্রস্নেহে ইসলামি আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে তাঁর অযোগ্য উচ্ছৃঙ্খল পুত্র এজিদকে খলিফার সিংহাসনে বসানোর জন্যেই কারবালার যুদ্ধ হয়েছে, নচেৎ হতো না কোনো কোনো তিহাসিক একটু অন্য সুরে সে কথা বলেছেন। তাঁরা লিখেছেন যে, ইয়াজিদ তাঁর পিতার উপর চাপ সৃষ্টি করে তাঁকে বাধ্য করেছিলেন তাঁকে (ইয়াজিদ) খলিফা মনোনীত করতে  এই ইতিহাসগুলি আবার এমনটাও বলে যে কারবালা প্রান্তরে যুদ্ধটা এড়ানো যেত, কিন্তু হোসেনকে হত্যা করবেন বলেই যুদ্ধটা হোসেনের উপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন ইয়াজিদ সুতরাং কারবালার যুদ্ধ বা বিদ্রোহের জন্য সম্পূর্ণ দায়ী এজিদইমূল কথা হলো কারবালা যুদ্ধের জন্যে দায়ী ছিলেন মাবিয়া এবং তাঁর পুত্র এজিদই, হোসেন ছিলেন সম্পূর্ণ নির্দোষ এই হলো সমস্ত ইতিহাসের  মূল্যায়  

কিন্তু ইতিহাসের এই মূল্যায় মোটেই যথার্থ নয়এই ইতিহাস যাঁরা লিখেছেন এবং আজও লিখে চলেছেন তাঁরা  একপেশে, অর্ধ সত্য, বিকৃত এবং অসত্য ইতিহাস লিখেছেন লিখে চলেছেন  আমরা ইতিহাসের পাতা থেকে কারবালার ঘটনাবলী এবং তৎসংক্রান্ত যে সব তথ্য হাতে পেরেছি সেগুলির নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করলে  মূল্যায়টা অন্য রকম হয়এই অধ্যায়ে আলচোনা তা নিয়েই  

কারবালা যুদ্ধের প্রধান হোতা বলা হয়েছে মাবিয়াকে কেন? তাঁর বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগগুলি হলোতিনি পরবর্তী খলিফা মনোনয়নের ক্ষেত্রে ইসলামি নীতি পদ্ধতি লঙ্ঘন করেছেন, খেলাফতের ন্যায্য উত্তরাধিকার থেকে ইমাম হোসেনকে বঞ্চিত করেছেন এবং নিজের অযোগ্য পুত্রকে খলিফা মনোনীত করেছেন কিন্তু আমরা ইতিহাসের পাতা থেকে যে তথ্য পেয়েছি সেখান থেকে এটা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে খলিফা মনোনয়নের বা নির্বাচনের ব্যাপারে ইসলামে কোনো নীতিই ছিল না বিষয়ে উপরে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে সুতরাং খলিফা নির্বাচনে ইসলামি নীতি লঙ্ঘনের অভিযোগ ভিত্তিহীন দ্বিতীয় অভিযোগহোসেনই ছিলেন খলিফা হওয়ার একমাত্র ন্যায্য উত্তরাধিকার, তাঁকে তাঁর সেই উত্তরাধিকার  থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিলো এখানে যে প্রশ্নটি ওঠে তা হলো, হোসেন কি সত্যিই খেলাফতের ন্যায্য উত্তরাধিকারী ছিলেন? একদম না কারণ, খেলাফতের উত্তরাধিকার তত্ত্বে বিশ্বাস করে শুধুমাত্র শিয়া সম্প্রদায় তাঁরা বিশ্বাস করেন যে ইসলামি রাষ্ট্রের খলিফা পদটি সংরক্ষিত কেবল শেষ নবীর বংশধরদের জন্যেই, এটাই আল্লাহর বিধান তাই তাঁরা আলির আগে যাঁরা খলিফা হয়েছেন তাঁদের প্রকৃত খলিফা বলে স্বীকার করেন না কিন্তু সুন্নী সম্প্রদায় এই তত্ত্বকে অনৈসলামিক বলে প্রত্যাখান করেছেন কোরান হাদিসেও কোথাও উল্লেখ নেই যে নবীর বংশধরদের ভিতর থেকেই কাউকে খলিফা করতে হবে বরং হাদিসে উল্লেখ আছে যে, মুহাম্মদ বলে গেছেন যে নবী রাসুলদের উত্তরাধিকার হয় না সুতরাং এই দাবীটিও অযৌক্তিক যে হোসেন ছিলেন খেলাফতের ন্যায্য উত্তরাধিকার সুন্নী মুসলমানরা তাই অন্যভাবে মাবিয়া পরবর্তী খলিফার প্রশ্নে হোসেনই একমাত্র ন্যায্য দাবীদার ছিলেন বলে দাবী করেন তাঁরা বিশ্বাস করেন যে, মাবিয়া হাসানের মধ্যে চুক্তি হয়েছিল মাবিয়ার পর হোসেনকে খলিফা করতে হবে এই বিষয়ে উপরে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে সেখানে আমরা দেখেছি যে, যে পরিস্থিতিতে যে কারণে ইমাম হাসান খেলাফত থেকে ইস্তফা দেন তাতে তাঁর পক্ষে এই রকম শর্ত আরোপ করার শক্তি ছিল না তাছাড়া তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায় যে রকম একটা অনুরোধ হাসান রেখেছিলেন এবং মাবিয়া তাতে সম্মতি প্রদান করেছিলেন, তবুও এটা আমাদের বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন যে সেই চুক্তি সম্পাদনের কুড়ি বছর পর তা রূপায়ণের অনুকূল পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল কিনা সে রকম পরিস্থিতি যে মোটেই বিরাজমান ছিল না, সেটা উপরের আলোচনায় বুঝেছি আর এটাও দেখেছি যে তার জন্যে স্বয়ং হোসেনই দায়ী ছিলেন, মাবিয়া নয় যে খলিফার কাছে আমি দাবী করব যে তিনি আমাকে তাঁর পরে খলিফা মনোনীত করবেন, অথচ সর্বদা তাঁর সঙ্গে শত্রুতামূলক আচরণ করবো,  তা হয় না আমি খলিফা পদে বসবার স্বপ্ন দেখব, কিন্তু তার যোগ্য হয়ে ওঠার প্রয়াস করবো না, তারপরেও বলবো যে আমাকেই খলিফা করতে হবে - এসব ছেলেমানুষী আবদার সুতরাং হাসানের সঙ্গে সম্পাদন করা চুক্তি মাবিয়া লঙ্ঘন করেছিলেন এই অভিযোগটি সারবত্তাহীন তৃতীয় অভিযোগ হলো এজিদ ছিলেন নানান দোষে দুষ্ট খলিফা পদে অযোগ্য ব্যক্তি যাঁরা এই অভিযোগ উত্থাপন করেছেন তাঁরা তাঁদের অভিযোগের সমর্থনে বিশ্বাসযোগ্য কোনো প্রমাণ উপস্থাপিত করতে সক্ষন হন নি অপরদিকে অনেক ঐতিহাসিক এজিদকে সুশিক্ষিত, সাহিত্যানুরাগী, প্রখর বাগ্মী, উদারচেতা ব্যক্তি এবং রাজোচিত গুণাবলী সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব বলে বর্ণণা করেছেন সুতরাং এজিদ অযোগ্য এই অভিযোগের মধ্যে যেমন কোনো প্রকার সত্যতার স্পর্শ নেই তাই মাবিয়া নিজের পুত্র বলে একজন অযোগ্য ব্যক্তিকে খলিফার সিংহাসনে বসিয়ে গিয়েছেন এই অভিযোগও মনগড়া, কষ্টকল্পিত এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বৈ নয় 

হোসেন একটা আদর্শকে রক্ষা করতে গিয়ে, ইসলামের পতাকাকে উর্দ্ধ্বে  তুলে ধরতে গিয়ে কারবালা প্রান্তরে এজিদের সৈন্যদের হাতে শাহাদাত বরণ করেছিলেন (আত্মত্যাগ করেছিলেন) - এই দাবীর  পশ্চাতেও গ্রহণযোগ্য কোনো যুক্তি   প্রমাণ পাওয়া যায় নি, যা পাওয়া গেছে তা কেবলই নবীর বংশের প্রতি অন্ধ আবেগ আনুগত্য এটা কখনোই পরিলক্ষিত হয় নি যে,  এজিদ খলিফা হওয়ার পূর্বে বা পরে কোনো সময়েই ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেছিলেন, কিংবা মুহাম্মদ তাঁর নবিয়তকে অস্বীকার করেছিলেন উলটে এজিদ খলিফা মনোনীত হতে যাচ্ছেন কথা শোনা মাত্রই হোসেন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়েন এমনটা মোটেই ঘটেনি যে এজিদ খলিফা হয়ে ইসলামি সাম্রাজ্যকে এমনভাবে পরিচালনা করতে শুরু করেছিলেন যা দেখে হোসেনের মনে হয়েছিলো যে আল্লাহ, মুহাম্মদ ইসলামের অবমাননা হচ্ছে এবং তা দেখেই একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসাবে হোসেন নিজেকে স্থির রাখতে পারেন নি এবং তার ফলে বাধ্য হয়েই ইসলামকে বাঁচানোর অভিপ্রায়ে এজিদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন এমনটা হলে নিশ্চয় এটা প্রতীয়মান হতো যে, হোসেন ইসলামকে রক্ষা করতে গিয়েই নির্দ্বিধায় একজন প্রকৃত বীরের মত নিজের প্রাণ হাসতে হাসতে বিসর্জন দিয়েছেন কিন্তু রকমটা তা মোটেই ঘটেনি সুতরাং বিষয়ে সংশয়ের তিলমাত্র অবকাশ নেই যে কোনো আদর্শ বা বৃহত্তর কোনো স্বার্থ নয়, সম্পূর্ণ ক্ষমতার  লোভেই ইমাম হোসেন এজিদকে খলিফা হিসাবে মেনে নিতে পারেন নি খলিফা হওয়ার দুর্দমনীয় আকাঙ্খা লোভই তাঁকে মক্কা থেকে কারবালা প্রান্তরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল তাই দেখা যাচ্ছে যে,  মোটের উপর এটাই হলো ইতিহাসের সঠিক মুসলমান যে কারবালা প্রান্তরে হোসেনের অকাল মৃত্যুর কবলে পড়ার মধ্যে আত্মত্যাগের আদর্শের কণা মাত্র ছিলো না, যা ছিলো তা হলো শুধু ক্ষমতা লাভ তথা খলিফা হওয়ার তীব্র লোভ লালসা 

হোসেনের মধ্যে খলিফা হওয়ার যে তীব্র আকাঙ্খা লোভের সঞ্চার হয়েছিল তারজন্য অবশ্য তাঁকে একা   দায়ী করা যায় না কারণ তাঁর মধ্যে এই ধারণাটা তৈরী করে দেওয়া হয়েছিল যে  মাবিয়ার পর একমাত্র তিনিই খলিফা পদের ন্যায্য দাবিদার তিনি ন্যাযি দাবীদার কারণ তিনি মুহাম্মদের বংশধর, সুতরাং উত্তরাধিকার সূত্রেই মুহাম্মদের স্থাপন করা ইসলামি রাষ্ট্রের খলিফার পদটি শুধু তাঁরই প্রাপ্য কিন্তু সুন্নি সম্প্রদায়ের মতে তাঁর এই ধারণাটি সম্পূর্ণই ভ্রান্ত তাদের বক্তব্য হলো কোরানে এমন কোনো কথা বলা নেই, এবং মহাম্মদ কখনো নিজে এমন কথা বলেন নি বরং তিনি  তাঁর জীবদ্দশায় কথাটাই স্পষ্ট করে ব্যক্ত করে যান যে নবী রসুলদের কোনো উত্তরাধিকার হয় না তিনি কথা বলে গিয়েছিলেন বলেই তাঁর মৃত্যুর পর প্রথম খলিফা নির্বাচিত হন আবু বকর মুহাম্মদের বংশধরদের পক্ষ থেকেই খলিফা নির্বাচিত করতে হবে এমন কথা কোরানে লেখা থাকলে, কিংবা মুহাম্মদ স্বয়ং এমন কথা বলে গেলে প্রথম খলিফা নির্বাচনে যে প্রবল কলহ গন্ডোগোল হয়েছিল তা হতো না, বিনা বাক্য ব্যায়েই প্রথম খলিফা নির্বাচিত হতেন আলি এখন প্রশ্ন হলে তা হলে হোসেনের মধ্যে এত বড় একটা ভ্রান্ত ধারণা কীভাবে তৈরী হয়েছিল এই ভ্রান্ত ধারণাটি হোসেন উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছিলেন তাঁর বাবা মা মধ্যে এই ভ্রান্ত ধারণাটি ছিল সেই ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়েই তো আলি বিবি ফাতেমা আবু বকরকে খলিফা মেনে নিতে পারেন নি এবং তাঁরা সরাসরি আবু বকরের মুখের সামনেই অভিযোগ করেছিলেন যে  তাঁরা সবাই মিলে ক্ষমতার লোভে চক্রান্ত করে আলিকে খলিফা পদ থেকে বঞ্চিত করেছেন এবং ঘরের দরজা থেকে আবু বকর ওমর ফারুককে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে ফাতেমা মৃত্যুর দিন পর্যন্ত আবু বকরকে ইসলামের প্রকৃত খলিফা বলে স্বীকৃতি প্রদান করে যান নি আর আলিও আবু বকরের  হাতে বয়াত গ্রহণ করেছিলেন ফাতেমার মৃত্যু পর তিনি অবশ্য আন্তরিকভাবে বয়াত নেন নি,  নিয়েছিলেন আবু বকরকে সন্তুষ্ট করার জন্যে যাতে তিনি মৃত্যুর আগে তাঁকে(আলিকে) পরবর্তী খলিফা মনোনীত করে যান আলি আবু বকরের কাছে বয়াত শুধু এজন্যেই নিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর মধ্যে ধারণা থেকেই গিয়েছিল যে মুহাম্মদের বংশধর হিসাবে তিনিই ছিলেন খলিফা পদের ন্যায্য দাবীদার, আবু বকর চক্রান্ত করে তাঁকে তাঁর ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন আলি ফাতেমার এই ভ্রান্ত ধারণাটি ক্রমে সঞ্চারিত হয়েছিল হোসেনের মধ্যে সুতরাং কারবালা প্রান্তরে যে হৃদয়-বিদারক বিয়োগান্ত কান্ডটি ঘটেছিল তারজন্যে আলি বিবি ফাতেমাও পরোক্ষভাবে কিয়দংশে দায়ী তাঁদের ক্ষমতার প্রতি তীব্র যে লোভ ছিল সেটাই কারবালার যুদ্ধের বীজ পুঁতে দিয়েছিল যেটা ওসমানের বিদ্রোহীদের রক্তমাখা হাত ধরে খলিফার সিংহাসনে আলির আরোহণের ঘটনার মধ্যে দিয়ে মহিরূহে পরিণত হয়েছিল।

ত্রয়ো-বিংশ অধ্যায়

ইতিহাসের বিকৃতি প্রসঙ্গে

 কোনো ইতিহাসই বোধ হয় সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ রূপে লেখা হয় নি, হয় না তাই সমস্ত ইতিহাসেই কিছু না কিছু পক্ষপাতিত্ব পরিলক্ষিত হয় এমনও উদাহরণ রয়েছে যে শুধু পক্ষপাতিত্বই নয়, ইতিহাসকে অনেকাংশে বিকৃতও করা হয়েছে কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে, বিশেষ করে তৃতীয় খলিফা ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ থেকে শুরু করে কারবালা যুদ্ধ পর্যন্ত ইতিহাসের ক্ষেত্রে যে মাত্রায় ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে তার নজির পাওয়া ভার আরও বিশেষ করে যেখানে আলি মাবিয়া এবং ইমাম হোসেন এজিদের কথা রয়েছে সেখানে ইতিহাস লিখনের পরতে পরতে একেবারে নজিরবিহীন নগ্ন পক্ষপাতিত্ব বিকৃতি পরিলক্ষিত হয় মাবিয়া মানুষ হিসেবে ছিলেন অতিশয় নির্মল চরিত্রের মানুষ এবং খলিফা হিসাবে ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ যোগ্য ফলে তিনি ইসলামি সাম্রাজ্যকে একটি বিশৃঙ্খল অরাজক পরিস্থিতির হাত থেকে উদ্ধার করে একটি সুশৃঙ্খল সুসংহত ইসলামি সাম্রাজ্য উপহার দিয়ে  যেতে পেরেছিলেন কথা স্বীকার করেও মুসলিম ঐতিহাসিকগণ তাঁকে ধূর্ত, অসৎ, ক্ষমতালোভী, প্রতারক, ঘাতক, ইসলাম চিরশত্রু প্রভৃতি কুবিশেষণে বিদ্ধ করেছেন অপরদিকে আলী খলিফা হয়েছিলেন ওসমানের হত্যাকারীদের সমর্থনে এবং সেই হত্যাকারীদেরই ক্ষমতার অংশীদার করেছিলেন কথা স্বীকার করেও মুসলিম ঐতিহাসিকগণ ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ তাঁকে হত্যার ঘটনায় আলিকে সম্পূর্ণ নির্দোষ বলে ঢালাও শংসাপত্র প্রদান করেছেন অপরদিকে গায়ের জোরে খলিফা হওয়ার উগ্র বাসনায় ৬ষ্ঠ বৈধ খলিফা এজিদের বিরুদ্ধে অনৈতিক  বিদ্রোহ করাকে একটি মহান আদর্শের জন্য একটি মহান আত্মত্যাগ বলে বর্ণণা করেছেন আবার অকারণে এজিদের চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করে এবং তাঁর খেলাফত প্রাপ্তিকে অনৈসলামিক অবৈধ বলে তীব্র সমালোচনা করেছেন বিশ্বের তামাম মুসলিম ঐতিহাসিকরা কারবালা যুদ্ধ নিয়ে এই যে এত নগ্ন পক্ষপাতিত্বপূর্ণ বিকৃত ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে গেছেন এবং এখনো সমানে  করে চলেছেন তা আমাকে শুধু চরম বিষ্মিতই করে না, আমাকে প্রবলভাবে ভাবায়ও কারবালা যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কেনো এমন নজিরবিহীন নির্লজ্জ মিথ্যাচার? আমাকে ভাবায় এই প্রশ্নটি আমার মনে হয়, এর পশ্চাতে একটা মাত্রই কারণ কাজ করেছে এবং করে, তাহলো, মুহাম্মদের বংশধরদের প্রতি অন্ধ আবেগ আনুগত্য এহেন আবেগ আনুগত্যই সম্ভবত মুসলিম ঐতিহাসিকদের মুক্ত বিচার-বুদ্ধি-বিবেচনা, ন্যায়-অন্যায়, ঠিক-বেঠিক, নৈতিক-অনৈতিক মানবতা-মনুষ্যত্ত্ব বোধগুলি সম্পূর্ণ রূপেই বিনষ্ট করে দিয়েছে কিন্তু তার পরেও প্রশ্ন থেকে যায়মুহাম্মদ তাঁর বংশধরদের প্রতিই বা কেন এত অন্ধ আবেগ আনুগত্য দ্বারা মুসলমান ঐতিহাসিকগণ পরিচালিত হবেন যা তাঁদের সমস্ত উচ্চ মূল্যবোধগুলি নষ্ট করে দিতে সক্ষম হয়?  এর রহস্য কোথায় নিহিত রয়েছে? সেটা কি জাহান্নামের আগুনের ভয়ে?  মুহাম্মদ তাঁর বংশধরদের সমালোচনা করলে আল্লাহ ভীষণ রুষ্ট হবে এবং  তাদের নিক্ষেপ করবে জাহান্নামের তীক্ষ্ণ আগুনেএই ভয়ে?  ছাড়া আর কিছু কি হতে পারে?    

                                                   শেষ 

 

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...