৬২৭ খৃস্টাব্দের শেষে মুহাম্মদ আবার একটা বিয়ে করেন । সেটা তাঁর
সপ্তম বিয়ে। ভিন্ন মতে অষ্টম বিয়ে অর্থাৎ জারিয়া ছিলেন তাঁর ৮ম স্ত্রী। তখন তাঁর হারেমে পাঁচজন
স্ত্রী বর্তমান, কারণ তাঁর স্ত্রীদের
মধ্যে প্রথম স্ত্রী খাদিজা ও পঞ্চম স্ত্রী
জয়নব বিনতে খোযাইমা ইতিমধ্যেই মারা গেছেন । সপ্তম স্ত্রীর নাম ছিলো বাররা
যিনি ছিলেন খৃস্টান সম্প্রদায়ের বনি মুস্তালিক কবিলার সর্দার হারেসা ইবনে আবু দিরার আল - মুস্তালিক - এর
কন্যা । বনি মুস্তালিকরা অন্য মতে ইহুদি
ছিলো । হারেসা কন্যা বাররা কিন্তু
বিবাহিতা ছিলেন, তাঁর স্বামী মুসাফে
ইবনে শাফওয়ান আল – মুস্তালিক মুহাম্মদের শিষ্যদের হাতে নিহত হয়েছিল । বিয়ে করার পর
মুহাম্মদ বাররার নতুন নাম রাখেন জুয়াইরিয়া । এই বিয়েটাকে মুসলিম ঐতিহাসিক ও লেখকদের অনেকেই এবং
ধর্মগুরুগণ সকলেই দারুণভাবে মহিমান্বিত করে উপস্থাপনা করে থাকেন ।
তাঁরা বলেন যে, বানু মুস্তালিক গোষ্ঠী ছিলো মুহাম্মদের জাতশত্রু । তথাপি তাদের শত্রুতাকে ক্ষমা করে দিয়ে তাদেরই গোষ্ঠীর একজন মেয়েকে অর্থাৎ শত্রুকন্যাকে বিয়ে করে যে উদারতা ও মহানুভবতার দৃষ্টান্ত
স্থাপন করেছেন পৃথিবীতে তার তুলনা নেই । এই বিয়ের মাধ্যমে
যেভাবে পরম শত্রুকে পরম আত্মীয় করে নেওয়ার
মহৎ গুণ তিনি প্রদর্শন করেছেন
তা করা কেবল তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিলো । যে ব্যক্তি পাঁচ জন স্ত্রীর মনঃপীড়া শতগুণ বাড়িয়ে দিয়ে
আরো একজন
যুবতীকে বিনা সংকোচে ও নির্দ্বিধায় বিয়ে করেন তাঁর মধ্যে উদারতা, মহানুভবতা,ও ক্ষমশীলতার গুণ অন্বেষণ করার প্রয়াস যাঁরা করেন
তাঁদের মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়ে সংশয় জাগে । থাক সে কথা, বরং মুহাম্মদের সেই
‘উদারতা ও মহানুভবতার দৃষ্টান্ত’ স্থাপন করা বিয়েটা কীভাবে সম্পন্ন হুয়েছিলো সেই ইতিহাসটার প্রতি চোখ রাখা
যাক ।
মদিনা আসার ছ’বছর পর মুহাম্মদ
স্থির করেন
যে তিনি
বনি মুস্তালিক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান করবেন । এর আগেও এরূপ কয়েকটা সফল অভিযান করেছেন তিনি । ‘অভিযান’ মানে চম্বলের
দস্যুদের মতো নিরীহ মানুষদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র হানা এবং তাদের সর্বস্ব লুঠ করে নিয়ে আসা । এই ‘অভিযান’ হলো ইসলামের
পরিভাষায় আল্লাহর পথে পবিত্র যুদ্ধ বা জিহাদ ।
বনি মুস্তালিকদের প্রতি তাঁর চোখ পড়েছিল দুটো কারণে । প্রথমতঃ তারা ছিলো খুব ধনী এবং তাদের প্রচুর ধন-সম্পদ
ছিলো । দ্বিতীয়তঃ মুহাম্মদের ভয় ছিলো যে তারা মদিনা আক্রমণ করতে পারে মদিনার ইহুদিদের
বিতারণ ও গণহত্যা করার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে । এই আসল মনোভাব গোপন করে মুহাম্মদ
তাঁর শিষ্যদের জানালেন যে, তিনি খবর
পেয়েছেন যে বনি মুস্তালিকরা মুসলিমদের সমূলে উৎপাটন করার জন্যে মদিনা আক্রমণ করার ষড়যন্ত্র ও
পরিকল্পনা করেছে । সুতরাং আমি তার আগেই তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তাদের
ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করতে এবং তাদের পদানত করতে চাই । সেই মতো তিনি আবু বকরকে মুজাহিরদের [মক্কা থেকে আসা
মুসলমান] নেতা এবং সা’দ ইবন ওবাইদাকে
আনসারদের [মদিনার মুসলমান] নেতা করে ১৫০০
জনের বাহিনী নিয়ে ৬২৭ খৃষ্টাব্দের ২৭ শে ডিসেম্বর অভিযানে বের হন । বনি
মুস্তালিকরা মুহাম্মদের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র করেছিলেন কিংবা মদিনা আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেছিলেন এর কোনো
প্রমাণ পাওয়া যায় না । মুহাম্মদ বলেছিলেন যে তিনি গোয়েন্দা পাঠিয়ে সে খবর জানতে
পেরেছিলেন । কিন্তু তিনি যে দাবি করেছিলেন তা প্রশ্নাতীত নয় । ঐতিহাসিক মার্গোলিউথ
এ প্রসঙ্গে লিখেছেন –
·
They were rich and probably contemplating a raid on
Medina, though there is no proof of this except the accounts of Muslim
chronologists. The tribe was ambushed near Muraysi, which was well [or spring] near
the coast. [Vide: Women and the Koran, Anwar Hekmat, p-
53]
বনি মুস্তালিকদের বাসস্থানের
নিকটবর্তী মুরাইসি নামক স্থানে মুহাম্মদ
পৌঁছালে সেখানেই তাদের সঙ্গে প্রায় নিরস্ত্র বনি মুস্তালিকদের সংঘর্ষ বাধে । বনি
মুস্তালিকরা মদিনা আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেছিলো এই অভিযোগ যে মিথ্যে তার প্রমাণ
পাওয়া যায় সেই সংঘর্ষে । মুহাম্মদ তাঁর যোদ্ধাদের নিয়ে যেহেতু অতর্কিতেই মুরাইসি
পৌঁছে গিয়েছিলেন, এবং আগে থেকে যেহেতু বনি মুস্তালিকদের মদিনা আক্রমণ করার কোনো
পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি ছিলো না তাই তারা কিছুক্ষণের মধ্যে রণে ভঙ্গ দিয়ে রনাঙ্গন
ত্যাগ করে পালিয়ে যায় । সেই সংঘর্ষে এমজন মুসলমান ও দশ জন বনি
মুস্তালিকের মৃত্যু হয় যাদের মধ্যে বাররার স্বামীও ছিলেন । মুসলিম ভাষ্যকারদের মতে
মুহাম্মদ প্রচুর ধনদৌলত ও ব্যাপক গবাদি পশু লুণ্ঠন করে নিয়ে আসেন এবং
তৎসহ শতাধিক পরিবারের [কেউ কেউ বলেছেন ২০০টি] লোকজনকেও বন্দি করে নিয়ে আসেন । ধর্মপ্রাণ মুসলিম ঐতিহাসিক ড.ওসমান গণি লিখেছেন, “মুসলমানগণ তাদের
সমস্ত পরিত্যক্ত জিনিষের অধিকারী হলেন । এবং সবকিছু এমনকি শত্রুদের ছেলেমেয়েদেরও
নিয়ে মুসলমানগণ মদিনায় প্রত্যাবর্তন করলেন ।” [দ্রঃ মহানবী, পৃ-২৭৮] সবকিছু বলতে তা কতো সে কথা
গণি সাহেব বোধ হয় লজ্জায় উল্লেখ করেন নি । সেই পরিমাণটা অবশ্য অনেক ঐতিহাসিকদের লেখা থেকে পাওয়া যায় । যেমন বিখ্যাত ঐতিহাসিক রডিনসন ও আল-ওয়াকিদি লিখেছেন –
·
‘Two thousand camels, five thousand heads of sheep and
goats, and two hundred women.” [Vide: aforesaid]
কেউ কেউ বলেছেন শতাধিক পরিবারের কথা যার অর্থ হলো বন্দি নারীর সংখ্যা ২০০-এর দ্বিগুণ বা তারো বেশি । যেমন বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিম লেখক
মহম্মদ সাদাত আলি লিখেছেন-
·
মহানবী
(সাঃ) – এর রণকৌশলের কাছে দুশমন চক্র বনি মুস্তালিক গোষ্ঠী পরাজিত হয় । দলপতি
হারেসা পালিয়ে জীবন রক্ষা করে । অসংখ্য
মালে গণিমত মুসলমানদের হস্তগত ও শতাধিক পরিবারের নর-নারীদের মধ্যে দলপতি হারেসার
যুবতী কন্যা সদ্য বিধবা বাররাও ছিলেন ।” [মহানবী (সাঃ) – এঁর বিবাহ, পৃ-৮৮]
কোনো ঐতিহাসিক লিখেছেন যে ২০০টি
পরিবারের লোকজনকে মুহাম্মদ গণিমতের মাল হিসেবে বন্দি করে এনেছিলেন । উইকিপিডিয়া লিখেছে -
Two hundred families were taken as captives, two hundred
camels, five thousand sheep, goats, as well as a huge quantity of household goods
which were captured as booty. The household goods were sold in an auction to
the highest bidder.[4]
মদিনায় ফিরে এসে মুহাম্মদ লুণ্ঠনের সব
মালামাল বণ্টন করে দেন তাঁর সহযোদ্ধাদের মধ্যে । হারেসার যুবতী কন্যা ২০ বছরে
বাররা সাবিত ইবনে কায়েস নামক একজন আনসার মুসলমানের ভাগে পড়েন । বাররা ছিলেন
তেজস্বিনী নারী । দাসত্ব স্বীকারে প্রবল
আপত্তি জানিয়ে অর্থের বিনিময়ে তিনি মুক্তির দাবি জানান তাঁর মালিক সাবিতের
কাছে । কিন্তু সাবিতের সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো মীমাংসা না হওয়ায় বাররা সরাসরি মুহাম্মদের কাছে
গিয়ে তাঁর নালিশ ও দাবি পেশ করেন । ইতিমধ্যেই বনি মুস্তালিক
গোষ্ঠীর কিছু লোকজন মদিনায় মুহাম্মদের
কাছে এসে গিয়েছে তাঁদের লোকগুলোকে অর্থের বিনিময়ে মুক্ত করার বিষয়ে চুক্তি করার জন্যে
। এ বিষয়ে
ঐতিহাসিক মুর লিখেছেন –
·
“The captives of Beni-Mustalik having been carried to
Medina, with the rest of the booty, men from their tribe soon arrived to make
term for their release. One of them was Juwayriya, a damsel of birth and
beauty, almost twenty years of age, and married with the chief of the tribe.” [Vide: Women and the Koran, Anwar Hekmat,
p- 54]
কুড়ি বছরের যুবতী বাররার
রূপ-সৌন্দর্য দেখে মুহাম্মদ মুগ্ধ হয়ে পড়েন । তিনি তখন মুক্তিপণের টাকা দিয়ে সাবিতের নিকট থেকে
বাররাকে কিনে নেন যাতে তাঁকে বিয়ে করে তাঁর হারেমের নতুন অতিথি করে নিতে পারেন ।
মুহাম্মদ কত টাকা দিয়ে বাররাকে কিনে ছিলেন তা নিয়ে মতভেদ আছে । কেউ বলে নয় উকিয়া
স্বর্ণমূদ্রা, কেউ বলে ঊনিশ উকিয়া স্বর্ণমূদ্রা । মুহাম্মদ তারপর তাঁকে বিয়ে করেন
এবং তাঁর নতুন নাম দেন জুয়াইরিয়া ।
আগেই বলেছি যে, মুসলিমরা এই
বিয়ের ঘটনাটিকে মুহাম্মদের উদারতা ও মহানুভবতার একটা মহান নিদর্শন বলে অভিহিত করেছেন । তাঁরা সাবিত ও
জুয়াইরিয়ার মধ্যেকার দ্বন্দটিকে এভাবে বর্ণনা করে থাকেন - জুয়াইরিয়া নাকি মুহাম্মদকে বলেছিলো যে, আমি বনি
মুস্তালিকদের সর্দারের কন্যা, আর সাবিত
একজন সাধারণ দিন মজুর, আমার সামাজিক মর্যাদার সঙ্গে তার তুলনা করা যায় না, সুতরাং আমার পক্ষে তার
দাসী হয়ে জীবন কাটানোর চাইতে মৃত্যু শ্রেয়
। মুহাম্মদ এই কথা শুনে সাবিতের কাছ থেকে মোটা অর্থের বিনিময়ে তাঁকে মুক্ত করেন ।
তারপর তাঁর যথোপযুক্ত সামাজিক মর্যাদার কথা ভেবে
তিনি বনি মুস্তালিকদের সঙ্গে চির বৈরিতার কথা ভুলে তাঁকে বিয়ে করে তাঁর
হারেমে তুলে নেন ।
কিন্তু এই ঘটনাটিকে, মস্তিষ্কের
বিকৃতি বা প্রতিবন্ধকতা না থাকলে, কোনভাবেই উদারতা ও মহানুভবতার নিদর্শন বলে
অভিহিত করা যায় না । একটা নিরীহ ও নিরস্ত্র জনগোষ্ঠীর উপর সশস্ত্র হানা সংগঠিত করে তাদের হত্যা
ও সর্বস্ব লুঠ করে, বাকি জীবিত
নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষ সবাইকে বন্দি করে নিয়ে এসে তাদের মধ্যে থেকে একজন সদ্য স্বামী ও স্বজন হারানো শোকাতুর যুবতীকে
বিয়ে করা যদি উদারতা হয় তবে অভিধান থেকে নৃশংসতা, নিষ্ঠুরতা, পৈশাচিকতা, অমানবিকতা
ইত্যাদি শব্দগুলো হয় মুছে দিতে হয়, না হয় শব্দগুলোর অর্থ পাল্টে দিতে হয় । তিনি
যদি সত্যিই মহানুভব হতেন তবে, তিনি সাবিতকে বলতে পারতেন যে তুমি অন্য একজন বন্দিনীকে নিয়ে ওঁকে ছেড়ে দাও, আমি
ওঁকে মুক্তি দিয়ে ওঁর মা-বাবার কাছে ফিরিয়ে দিতে চায়, অথবা তিনি মুক্তিপণের টাকা
দিয়ে মুক্ত করার পর বিয়ে না করে তাঁকে
তাঁর মা-বাবার কাছে ফিরিয়ে দিতে পারতেন । অথবা তিনি উচ্চ সামাজিক মর্যাদা সম্পন্ন কোনো মুসলিম
যুবককে বলতে পারতেন তাঁকে বিয়ে করার জন্যে – মুহাম্মদ তেমন নির্দেশ দিলে তা
স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নেওয়ার লোকের যে
অভাব ছিলো না তা বলা বাহুল্য । কিন্তু
তিনি এগুলোর কোনোটাই করেন নি । করেন নি, কারণ তিনি মুক্তিপণের টাকা নিজে শোধ
করেছিলেন তাঁর নিজের জন্যে, তাঁর সামাজিক ও বংশ মর্যাদা রক্ষা করার
জন্যে নয় । কুড়ি বছর বয়সী অসাধারণ ও অপরূপ
সুন্দরী জুয়াইরিয়ার রূপ-লাবণ্য তাঁর মনে কামনার যে আগুন জ্বেলে দিয়েছিলো সেই আগুন নিভানোই ছিলো একমাত্র কারণ । তাঁকে বিয়ে করার মধ্যে মুহাম্মদের মনে ও চিন্তায় শত মাইল দূরেও উদারতা বা মহানুভবতার লেশমাত্র ছিলো না । যুবতী বাররা তথা জুয়াইরিয়ার
নয়ন জুড়ানো মন ভুলানো হৃদয় মথিত করা রূপের বাহারই যে একমাত্র কারণ ছিলো তার
একটা বড়ো প্রমাণ
পাওয়া যায় আয়েষার একটা উক্তি থেকে । তিনি জুয়াইরিয়ার রূপ ও সৌন্দর্য দেখে এতোটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তাঁর রূপের বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন যে, যে
তাঁকে এক পলক দেখবে সেই তাঁর প্রেমে না
পড়ে পারবে না । এ প্রসঙ্গে ইবন সা’দ, ইসলামের একজন ঘটনাপঞ্জী লিপিবদ্ধকারী
একজন মুসলিম ঐতিহাসিক বলেছেন –
·
Aisha described Iuyairiya as “so cute that whoever
caught a glimpse of her fell for her”
[Vide: Women and the Koran, Anwar Hekmat, p- 54,55]
নিশ্চিতভাবেই মুহাম্মদের
প্রিয়তম স্ত্রী ও সর্বাপেক্ষা ঘনিষ্ঠ সাথী হিসেবে
মুহাম্মদের চরিত্র ও আচার-আচরণ সম্পর্কে যতটা সঠিক মূল্যায়ন করতে পারতেন তা
ধর্মান্ধ মুসলিমদের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয় । জুয়াইরিয়া যদি কম বয়সের একজন অপরূপ সুন্দরী যুবতী না হতেন তা
হলে মুহাম্মদ তাঁকে বিয়ে করতেন ? এটা ভীষণ সন্দেহজনক ।