আজ আমাদের দেশ ৬৬তম প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন করছে সাড়ম্বরে, মহাসমারোহে। কিন্তু ১২০ কোটি
মানুষের ১০০ কোটিই জানে না এটা আবার
কেমন দিবস? মানুষ
নবি দিবস জানে, শ্রীকৃষ্ণের জন্ম দিবস জানে, রাম নবমী জানে, গুরু নানকের জন্ম দিবস
জানে, আপন গুরুর জন্ম দিবস জানে, একাদশী জানে, কবে কোন দিন কোন তিথিতে স্বামীর মঙ্গল
কামনা করে উপবাস থাকতে হবে জানে, কিন্তু প্রজাতন্ত্র দিবস কী তার কিস্যু জানে না। তবু সাড়ম্বরে, ধূমধাম করে বছর বছর দিবসটি উদযাপন করা হয়, জলের মত খরচ করা
হয় দেদার টাকা। যারা উদযাপন করে ঢাকঢোল পিটিয়ে তারা সবাই ভালো করেই জানে যে দেশের
অধিকাংশ মানুষ প্রজাতন্ত্র কী সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, তবু
তারা মহা উৎসাহে ২৬ শে জানুয়ারীর দিন সকাল বেলা পতাকা তোলে, প্রজাতন্ত্রের মহিমা
কীর্তন করে, প্রজাতন্ত্রের অহঙ্কার করে,
দেশ কত এগোলো তার লম্বা লম্বা ফিরিস্তি
দেয়, হাসপাতালে যারা সারা বছর অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে মেঝেতে পড়ে থাকে অবহেলায় তাদের
কাছে গিয়ে দু-একটা ফল তুলে দিয়ে ক্যামেরার সামনে পোজ দেয়, অর্ধমৃত মানুষগুলো
হঠাৎ এসব দেখে ভ্যাবাচাকা খেয়ে এ ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে চায়, বাবুরা ঝড়ের বেগে আসে আর কিছু ফল বিতরণ করে
আবার ঝড়ের বেগে চলে যায়। এভাবে
প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন করে শাসকশ্রেণী, শোষকশ্রেণি, শাসক দল, বিরোধীদল, সবাই মিলে ফি বছর তারা মানুষকে ঠকায়, ঠকায় বিশ্ববাসীকেও।
শাসক শ্রেণী, শোষক শ্রেণী শাসক দল ও বিরোধী দল, কেউ চাই না যে দেশের মানুষ জানুক প্রজাতন্ত্র দিবস কী, কেন এবং কার স্বার্থ পূরণ করে এই দিবস? খেটে খাওয়া অর্ধভুক্ত, অভুক্ত মানুষগুলো প্রজাতন্ত্রের মানে জানলে তাদের অনেক অসুবিধা, তাদের শ্রম সস্তা দরে কিনে তাদেরকে সহজে ঠকানো যাবে
না, চাষীকে বেশী দামে সার, বীজ, বিষ বিক্রী করে, তাদের ফসল ও
কাঁচামাল সস্তায় কিনে তাদেরকে সহজে ঠকানো
যাবে না, বনবাসীকে বন থেকে উচ্ছেদ করে বনের দখল নেওয়া যাবে না, খাল-বিল-নদী-সমুদ্র থেকে মৎস্যজীবীদের উচ্ছেদ
করে সেগুলো কব্জায় রেখে অনায়াসে ভোগ করে যাবে না, পাহাড়বাসীকে পাহাড় থেকে উচ্ছেদ
করে পাহাড়ের সম্পদ লুঠ করা যাবে না, মানুষের রুজি-রোজগারের প্রতিদিনের সংগ্রামকে
আইনশৃঙ্খলার দোহায় দিয়ে লাঠি-গুলি চালিয়ে দমন করা যাবে না, জাত-পাতের দোহাই
দিয়ে মানুষে মানুষে মারামারি, কাটাকাটিতে বুঁদ করে রাখা যাবে না, অর্ধাহারে-অনাহারে থাকা মানুষগুলোকে ধর্মের গাঁজা-চরস
খাইয়ে মসজিদে-মন্দিরে-গীর্জায় আটকে রাখা যাবে না, অর্ধাহারে-অনাহারে-বেকারত্বে জর্জরিত থাকা মানুষকে ভাগ্যের দোহায় দিয়ে চুপ করিয়ে রাখা যাবে না, দেশের তথা দেশের
মানুষের সকল সম্পদ যেমন বন-জঙ্গল, পাহাড়, নদ-নদী, ইত্যাদি জলের দরে কিংবা বিনা দামেই আত্মসাৎ করা যাবে না।
সুতরাং প্রজাতন্ত্র দিবস কী তা মানুষ জানুক – এটা শাসক শ্রেণী চাই না একদম। চাই না তার আরো বহু কারণ আছে। জানলে তারা তাদের সমস্ত অধিকার বুঝে নিতে চাইবে, বেঁচে থাকার জন্যে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা- স্বাস্থ্য ন্যূনতম এই পাঁচটি জিনিষ ন্যূনতম পরিমাণে সরকারের কাছে দাবী করবে, দাবী করবে এটা জেনে যে এটা তাদের ন্যায্য অধিকার, দাবী করবে তাদের ভাষার অধিকার, সংস্কৃতির অধিকার, জাত-পাত, বর্ণবিভেদের পাঁচিল গুঁড়িয়ে দিয়ে দাবি করবে সমান মর্যাদা পাবার অধিকার, নারী দাবী করবে পুরুষের সমান অধিকার ও ক্ষমতা পাবার, দাবীতে দাবীতে পাগল করে দেবে রাষ্ট্রকে তথা শাসক ও শোষক শ্রেণীকে। এমনি করতে করতে মানুষ একদিন বুঝবে রাষ্ট্রের চোখে সবাই সমান নয়, রাষ্ট্র সকলের সঙ্গে সুবিচার করে না, রাষ্ট্রটা মোটেই নিরপেক্ষ নয়, এবং এই রাষ্ট্রটা তাদের নয়। মানুষ তখন রাষ্ট্রের ক্ষমতায় যেতে চাইবে, একা যেতে না পারলে ক্ষমতার ভাগ নিতে চাইবে। যেদিন মানুষ এ সব বুঝবে সেদিন তাদেরকে ঠেকানো যাবে না কোনোভাবেই, হয় ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে, নয়তো ক্ষমতার ভাগ দিতে হবে। শাসক শ্রেণী তাই প্রাণপণ চেষ্টা করে প্রজাতন্ত্র দিবস, স্বাধীনতা দিবসগুলির অর্থ, তাৎপর্য সম্পর্কে মানুষকে অজ্ঞ করে রাখতে। শাসক শ্রেণী তাই মানুষকে অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখেই স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন করে। এভাবেই ৬৫ বছর ধরে তারা ভারতবাসীকে ঠকিয়ে আসছে।
সুতরাং প্রজাতন্ত্র দিবস কী তা মানুষ জানুক – এটা শাসক শ্রেণী চাই না একদম। চাই না তার আরো বহু কারণ আছে। জানলে তারা তাদের সমস্ত অধিকার বুঝে নিতে চাইবে, বেঁচে থাকার জন্যে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা- স্বাস্থ্য ন্যূনতম এই পাঁচটি জিনিষ ন্যূনতম পরিমাণে সরকারের কাছে দাবী করবে, দাবী করবে এটা জেনে যে এটা তাদের ন্যায্য অধিকার, দাবী করবে তাদের ভাষার অধিকার, সংস্কৃতির অধিকার, জাত-পাত, বর্ণবিভেদের পাঁচিল গুঁড়িয়ে দিয়ে দাবি করবে সমান মর্যাদা পাবার অধিকার, নারী দাবী করবে পুরুষের সমান অধিকার ও ক্ষমতা পাবার, দাবীতে দাবীতে পাগল করে দেবে রাষ্ট্রকে তথা শাসক ও শোষক শ্রেণীকে। এমনি করতে করতে মানুষ একদিন বুঝবে রাষ্ট্রের চোখে সবাই সমান নয়, রাষ্ট্র সকলের সঙ্গে সুবিচার করে না, রাষ্ট্রটা মোটেই নিরপেক্ষ নয়, এবং এই রাষ্ট্রটা তাদের নয়। মানুষ তখন রাষ্ট্রের ক্ষমতায় যেতে চাইবে, একা যেতে না পারলে ক্ষমতার ভাগ নিতে চাইবে। যেদিন মানুষ এ সব বুঝবে সেদিন তাদেরকে ঠেকানো যাবে না কোনোভাবেই, হয় ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে, নয়তো ক্ষমতার ভাগ দিতে হবে। শাসক শ্রেণী তাই প্রাণপণ চেষ্টা করে প্রজাতন্ত্র দিবস, স্বাধীনতা দিবসগুলির অর্থ, তাৎপর্য সম্পর্কে মানুষকে অজ্ঞ করে রাখতে। শাসক শ্রেণী তাই মানুষকে অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখেই স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন করে। এভাবেই ৬৫ বছর ধরে তারা ভারতবাসীকে ঠকিয়ে আসছে।
আজ ২৬শে জানুয়ারী, পতাকা উঠছে, কুচ-কাওয়াজ হচ্ছে, আকাশে কত
যুদ্ধ বিমান উড়ছে, কত বাদ্যি বাজছে, এ সব বসে বসে দেখছি টিভির পর্দায়। পাশাপাশি
শুনছি কত প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি, শুরু হয়ছে এই ফুলঝুরি ছোটানো কয়েকদিন থেকে। অথচ চারিদিকে রোজরোজ নারীর শ্লীলতা হানি হয়, নারীরা ধর্ষিতা হয়, সে সব দেখে রাষ্ট্র কার্যতঃ নীরব থাকে, কিছুই
করে না তা প্রতিরোধ করার, ঘুরিয়ে এ রাজ্যের নারী মুখ্যমন্ত্রী ধর্ষিতা নারীকেই অপবাদ দেন নষ্ট মেয়ে
বলে, তারপরেও নারীর
নিরাপত্তা নিয়ে একের পর এক প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরির ছোটে নেত্রী ও নেতাদের কন্ঠে, আজও সে ফুলঝুড়ি ছুটছে সমানে। আর এদিকে গত
বছর ২০ বছরের সাঁওতাল সমাজের মেয়েটিকে ঐ সমাজের মোড়ল-মাত্তবর যারা গণধর্ষণ করার
ফরমান দিয়েছিলো, যারা ধর্ষণ
করেছিলে পার্ক স্ট্রীট, কাটোয়া প্রভৃতি অসংখ্য জায়গা অসংখ্য নারীকে এবং গতকালই একজন নারীকে বিবস্ত্র
করে যারা গাছে বেঁধে মেরেছে শাসক দলের সেই পোষা গুণধর নেতাকর্মীরা আজ ক্লাবে ক্লাবে, অফিসে অফিসে, স্কুলে স্কুলে গিয়ে জাতীয় পতাকা তুলছে, আর অন্যদিকে শ’য়ে শ’য়ে, হাজারে হাজারে সেই অসংখ্য ধর্ষিতা ও নিগৃহীতা
মেয়েরা ঘরের কোণে মানসিক অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছে, এই মেয়েরা জানে না কী অপরাধে তাদের উপর এতো
অত্যাচার ও নিগ্রহ হয়েছে ও হয়।
আজ ২৬শে জানুয়ারী, পতাকা উঠছে, কুচ-কাওয়াজ হচ্ছে দিল্লীতে, রাজ্যে রাজ্যে সমস্ত রাজধানী শহরে, ভাষণ বিলানো হচ্ছে দেদার, বড়ো বড়ো ভাষণ, যে ভাষণে বলা হচ্ছে, ভারত
প্রজাতান্ত্রিক দেশ, এখানে বাক
স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, স্ব স্ব ধর্ম পালনের স্বাধীনতা, ধর্ম না পালনের
স্বাধীনতা, সসম্মানে ও স্বমর্যাদায় বেঁচে থাকার স্বাধীনতা সহ সমস্ত স্বাধীনতা
সুরক্ষিত। রাষ্ট্র নেতাদের এ সব ভাষণ যে
শুধুই ভাষণ, এবং বিলকুল মিথ্যা ভাষণ সে কথা
দুনিয়া শুদ্ধ লোক জানে। এ সব ভাষণ যে
বিলকুল মিথ্যা তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ বারাক ওবামা। ওবামা আজ দিল্লির অনুষ্ঠানের
মধ্যমণি, প্রধান অতিথি। প্রধান মন্ত্রী মোদি স্বয়ংই যে প্রজাতন্ত্রের পথে একটা
মস্ত বড়ো কাঁটা তা বিশ্ববাসী জানে, কারণ তিনি নিজেকে আরএসএসের পোষ্টার বয় বলে গর্ব করেন। একে মোদি, তারপর ওবামা – এ যে সোনায়
সোহাগা। মোদি চায় ভারতে হিন্দুতন্ত্র কায়েম করতে আর ওবামা চায় বিশ্বকে আমেরিকার নয়া উপনিবেশবাদ বানাতে। সেই লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ১৯৪৫
সালের ৬ই ও ৯ই আগষ্ট জাপানের হিরোসিমা ও
নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা ফাটিয়ে লক্ষাধিক মানুষকে হত্যা করতে আমেরিকার বুক এতটুকুও কাঁপে
নি। ভিয়েতনামে লক্ষ লক্ষ টন বোমা ফেলে
হত্যা করেছিল ভিয়েতনামের হাজার হাজার মানুষকে। অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান,
যুদ্ধাস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে
ধ্বংসলীলা চালিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে এই তো সেদিন আফগানিস্তান ও ইরাকেও। উদ্দেশ্য ছিল দুটো
রাষ্ট্রে তাবেদার সরকার বসিয়ে তাদের সম্পদ লুঠ করা, বিশেষ করে ইরাকের
খনিজ তৈল ভাণ্ডারের দখল নেওয়া। প্রবল শক্তিধর আমেরিকা এ ভাবে একের পর এক দেশে
হামলা চালিয়ে চালিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে, ধন-সম্পদ ধ্বংস করেছে
মানবাধিকারের নামে এবং রষ্ট্রসঙ্ঘ ও বিশ্বের অধিকাংশ দেশের আপত্তি অগ্রাহ্য করেই।
এদিকে মোদিজি প্রধান মন্ত্রীর গদিতে আসীন হওয়ার পর দেখছি ভাগবত, তোগাড়িয়া, সিংঘল,
উমাভারতীরা গর্ত থেকে বেড়িয়ে পড়েছে। বলছে
ভারতবাসী মানেই হিন্দু, ভারতবাসী মানেই
রামের সন্তান, এ কথা যে অস্বীকার করবে সে জারজ সন্তান। মোদিজী সব জেনে শুনেও নীরব থেকে তাদের সাহস জোগাচ্ছেন। অথচ সেই ওবামা ও
মোদিই আজ প্রজাতন্ত্র দিবসে গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব,
বাক-স্বাধীনতা নিয়ে বড়ো বোড়ো ভাষণ দিচ্ছেন। একদিকে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রীয়
সন্ত্রাসবাদ, আর একদিকে আন্তর্জাতিক ইসলামি সন্ত্রাসবাদ, মাঝখানে
ভারতে হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসবাদের ভ্রুকূটি, সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক
দুনিয়ায় শান্তি, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা আজ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। এই
পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের পুরোহিত ওবামা ও হিন্দুত্ববাদের প্রতীক আরএসএসের
পোষ্টার বয় প্রধানমন্ত্রী মোদিজির কণ্ঠে আমাদের শুনতে হচ্ছে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লম্বা-চওড়া ভাষণ। এই
হচ্ছে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের বেহাল অবস্থা। হায়রে প্রজাতন্ত্র দিবসের মহিমা!
লাল কেল্লা থেকে
আমাদের শোনানো হচ্ছে আমাদের বাক-স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র,
ধর্মনিরপেক্ষতা ও শান্তি-সম্প্রীতির ভারী ভারী কথা। কিন্তু কোথায় আমাদের বাক-স্বাধীনতা, মত প্রকাশের
স্বাধীনতা? আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন লেখক তসলিমা নাসরিন আজ দিল্লীতে নির্বাসিত। ভারত সরকার অনেক আগেই তাঁকে এ দেশে থাকার অনুমতি দিয়েছে, মোদিজি
ক্ষমতায় এসে সেই অনুমতি আটকে দিতে বহু
টালবাহানা করলেন। সেই বৈধ অনুমতির জোরে তসলিমা নাসরিনের ভারতের যে কোনো স্থানে যাওয়ার ও থাকার অধিকার আছে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো
তাঁর এ অধিকার যাতে কেউ লঙ্ঘন করতে না পারে তা দেখা ও সুনিশ্চিত করা। অথচ রাষ্ট্রই তাঁকে কলকাতায় আসতে দিচ্ছে না। বদলের
প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা মমতা ব্যানার্জিও বাম সরকারের মতো তাঁকে কলকাতায়
আসতে দিচ্ছেন না। এমনকি গত বছর কলকাতা বই মেলায় তাঁর লেখা একটা বইয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনও আটকে দিয়েছিলো বইমেলা কত্তৃপক্ষ
মমতা ব্যানার্জীর নির্দেশে। তাঁর লেখা একটা
বাংলা সিরিয়ালের প্রচারও তিনি বন্ধ করে দেন। বিশ্বখ্যাত লেখক সলমান রুশদিও
গত বছর কলকাতা বই মেলায় আসতে পারেন
নি মমতা সরকারের বাধায়। কেন তসলিমা ও সলমন রুশদির
অধিকার হরণ করলো সরকার? কারণ তাঁরা মুসলিম ধর্মাবেগে আঘাত করেছেন। কে বলেছে?
মুসলিম ধর্মের নেতারা। তাই ওঁদের কলকাতায়
পা ফেলার অধিকার নেই। এই হলো এ দেশে মানুষের বাক স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ ও সুরক্ষিত রাখার ও থাকার নমুনা। এ দেশে লেখকের বাক
স্বাধীনতা নেই, কিন্তু ধর্মীয় নেতাদের পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। সে স্বাধীনতা লাগামহীন। তারা যা কিছু বলতে পারে,
মুন্ডু কাটার ফতোয়া দিতে পারে, এ ফতোয়া বেআইনী তবুও তাদের অধিকার আছে তা দেওয়ার, এমনকি
মুণ্ডু কাটারও তাদের অবাধ অধিকার আছে। তসলিমার উপর সেই ফতোয়া তারা দিয়েছে পুলিশের
সামনে দাঁড়িয়ে। একই ফতোয়া দিয়েছিলো দঃ চব্বিশ পরগণা জেলার আক্রা হাই মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক মোরসেলিন
মোল্লার উপর একটা নিরীহ প্রবন্ধ লেখার
অপরাধে। তাঁকে না পেয়ে তাঁর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় দুষ্কৃতিরা।
মোরসেলিনকে পুলিশ নিরাপত্তা দেয় নি, দুষ্কৃতিদের বিরুদ্ধে অভিযোগও নেয় নি, ঘুরিয়ে
বলেছিলো ফতোয়াবাজ মোল্লাদের কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করতে।
মোরসেলিন অগত্যা তাই করেছিলেন, হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন এবং আর কোনোদিন ঐ
রকম লেখা লিখবেন না বলে থানায় বসে মোল্লা ও পুলিশের কাছে মুচলেকাও লিখে দিয়ে এসেছিলেন। একই
অবস্থা হয়েছিলো ঐ পত্রিকার সম্পাদক মহাশয়েরও যাঁঁর পত্রিকায় লেখাটা বেরিয়েছিলো। এ ঘটনা বাম
সরকারর আমলের। প্রায় একই সময়ে ঐ একই কারণে আমারও মুন্ডুচ্ছেদ করার ফতোয়া দেওয়া হয়েছিলো। আমাকে পুলিশ
নিরাপত্তা দেয় নি, যারা আমাকে হত্যা করার ফতোয়া দিয়েছিলো তাদের বিরুদ্ধে আমার
লিখিত অভিযোগও নেয় নি। প্যারিসে গত ৭ই জানুয়ারী ব্যাঙ্গ পত্রিকা শার্লি এব্দুর
ব্যাঙ্গ শিল্পী সহ ১২ জন সাংবাদিককে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। সেই হত্যালীলাকে
প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়ে হত্যাকারীদের আর্থিক পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএসপি
নেতা জনৈক কুরেশি। কিন্তু সরকার ও পুলিশ তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় নি। এই হচ্ছে আমার দেশ,
আমাদের প্রজাতন্ত্র, আমাদের যাবতীয় অধিকার সুরক্ষিত থাকার নমুনা। আসল কথা হলো এ
দেশে সীমাতিরিক্ত স্বাধীনতা আছে শাসক শ্রেণীর, শাসক দলের নেতা-কর্মীদের, শাসক দল
আশ্রিত চোর-গুন্ডা-বদমাশদের, ধাপ্পাবাজ ও প্রতারক ধর্মীয় নেতাদের ও পুলিশের,
স্বাধীনতা নেই কেবল সাধারণ মানুষের, লেখকদের ও নারীদের।
তাই প্রজাতন্ত্র দিবসের আসল মানে যাই থাক, আমার কাছে এ দিনটি
প্রতারণা দিবস ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় না। এ দিনটিকে প্রজাতন্ত্র দিবস বলে মনে হয় না শুধু তাই নয়, বরং দিনটিকে প্রজা-নিয়ন্ত্রণ, প্রজা-নিষ্পেষণ ও প্রজা-হরণ দিবস বলেই মনে হয়।