Saturday, August 15, 2020

হ্যাপি স্বাধীনতা দিবস বলি কি করে

Coronavirus disease COVID-19 infection medical with typography and copy space. New official name for Coronavirus disease named COVID-19, pandemic risk background vector illustration

আজ ভারতের চুয়াত্তরতম স্বাধীনতা দিবস। দেশজুড়ে উদযাপিত হচ্ছে দিবসটি। যাদের উদযাপন করার কথা তারা তো করছেই, যাদের উদযাপন করার কোনো মানে হয় না তারাও করছে। যাদের উদযাপন করার কথা নয় তাদের একদল হুজুগে করছে, কিছু না জেনে বুঝেই করছে, সবাই করছে তাই করছে। একদল না করলে দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন উঠবে তাই করছে।

বিশ্বজুড়ে করোনার ভয়ঙ্কর আক্রমণ আজও অপ্রতিরোধ্য। দেশজুড়ে যখন স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হচ্ছে তখন ভারত বিশ্বের করোনা-পীড়িত দেশগুলির উপরের কাতারে উঠে গেছে, একেবারে তৃতীয় স্থানে, আর দৈনিক সংক্রমণের দিক থেকে তো একেবারে প্রথম স্থানে। সংক্রমণের সংখ্যা বিশ্বে ছাড়িয়েছে দু’ কোটি, ভারতে প্রায় পঁচিশ লক্ষ। করোনার মোট বলি সাড়ে সাত লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে, তার মধ্যে ভারতেই অর্ধ লক্ষাধিক। কিন্তু করোনার ভ্যাকসিনের বিশ্বাসযোগ্য কোনো খবর আজ পর্যন্ত নেই। সুতরাং মৃত্যুর সংখ্যা কোথায় গিয়ে ঠেকবে ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। করোনার বিরুদ্ধে আমাদের সরকারগুলি নাকি যুদ্ধ করছে। প্রধানমন্ত্রী আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিলেন এ যুদ্ধ বিজয় আসবে ২১ দিনেই। সেই যুদ্ধের আজ ১১৩ দিন, যুদ্ধ জয়ের ক্ষীণ আলোর শিখাটুকুও দূরবিন দিয়ে দেখা যাচ্ছে না।

যুদ্ধ জেতা যাবে কি করে? যুদ্ধ জেতার জন্যে স্বাস্থ্য পরিষেবার ন্যূনতম পরিকাঠামো তো নেই কোথাও।  ফলে করোনা রোগীরা সবাই হাসপাতালের চিকিৎসা পাচ্ছে না, যারা হাসপাতাল পাচ্ছে সুচিকিৎআ পাচ্ছে না। বেসরকারি হাসপাতাল তো সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। ফলে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে রোজ। চিকিৎসক সহ স্বাস্থ্যকর্মীরাও উপযুক্ত ও পর্যাপ্ত পিপিই কিট পাচ্ছেন না, ফলে তাদেরও মৃত্যু বরণ করতে হচ্ছে। মানুষের স্বাস্থ্যচেতনা স্তর তো একেবারেই তলানিতে। বিশ্বে প্রতিদিন দশ হাজার এবং ভারতে এক হাজার লোক মরছে। তবু মানুষের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। মুখে মাস্ক পরা ও দুরত্ব-বিধি মানার মানার বালাই নেই। স্বাস্থ্যচেতনা নেই, কিন্তু ধর্ম পালন করার চেতনা ষোল আনায় বিশ আনা। দলবেঁধে ঈদের নামাজ পড়া চাই, কুরবানির নামে পশু হত্যা করা চাই-ই চাই! মন্দিরে পূজো দেওয়া চাই-ই চাই! এই হচ্ছে মানুষের চেতনার স্তরের লজ্জাজনক দৈন্যতা।         

যারা করোনা-যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন যাঁরা (প্রধানমন্ত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রী) তাঁদের চেতনাস্তরের দৈন্যতাও লজ্জাজনক। করোনা-যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী ছুটছেন রাম মন্দিরের শিল্যানাস করতে, ফলে বিজেপির নেতা-কর্মীরা দুরত্ব-বিধিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেশজুড়ে মেতে উঠলো সেই আনন্দে। এটাই তো হবার কথা ছিলো যা প্রধানমন্ত্রী বিলক্ষণ জানতেন। জেনেও করলেন দুটো কারণে – নিজের নামকে ইতিহাসে খোদায় করার জন্যে, আর হিন্দু ভোটব্যাংক স্ফীত করার জন্যে। জনগণের স্বার্থকে বলি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রাধান্য দিলেন দলীয় স্বার্থকে।    

 COVID-19 Pandemic Coronavirus Woman in city street wearing face mask protective for spreading of disease virus SARS-CoV-2. Girl with protective mask on face against Coronavirus Disease 2019.

আমাদের মুখ্যমন্ত্রী বোধহয় ভেবেলেন যে তিনি একাই এ যুদ্ধ জিতে যাবেন এবং সেই সাফল্য দিয়েই একুশের ভোটে বাজিমাত করবেন! তাই বিরোধীদের কাউকে ডাকলেন না,  বিরোধিরা পথে নামলেও তাদের পথ আটকে দিলেন পুলিশ দিয়ে। ফলে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু ঠেকাতে তাঁর সরকারও চূড়ান্ত ব্যর্থ। প্রাথমিক পর্যায়ে একদিনে দু’ চার দশটা সংক্রমণ হতো, সেটা তিন হাজারের গণ্ডি টপকেছে। আগে মরেছে দু’চার দিনে একটা, এখন মরেছে পঞ্চাশ/ষাট জন। পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য পরিষেবাও আক্ষরিক অর্থেই বেহাল।  

করোনা সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারিতে মানব সমাজ ও মানব সভ্যতা আজ গভীর এক সংকটে। সংকটে আমাদের দেশ, সংকটে আমাদের রাজ্য, সংকটে মানুষ। প্রতিদিন দশ/বারো হাজার লোক মারা যাচ্ছে, আমাদের দেশে প্রতিদিন মরছে এক হাজার করে। মৃত্যু, মৃত্যু, আর মৃত্যু, শুধু মৃত্যুর খবর চারিদিকে। প্রিয়জন হারানোর শোকে চারিদিকে শুধুই আর্তনাদ আর হাহাকার। গোটা পৃথিবিটাই যেন একটা মৃত্যু পুরী। এই মৃত্যু পুরীতে বাস কয়রে ১৫ই আগস্টকে আর পাঁচটা দিনের থেকে আলদা বলে আমার একদম মনে হয়ে না। আজ স্বাধীনতা দিবস বলে করোনা আমাদের রেহাই দেয় নি। তাই স্বাধীনতা দিবস বলে আজকের দিনটাতে আমি হ্যাপি হই কি করে? হ্যাপি থাকি কি করে? কি করেই বা বলি হ্যাপি স্বাধীনতা দিবস? যারা আমাকে “হ্যাপি স্বাধীনতা দিবস” (Happy Independence Day) জানিয়েছেন তাদের সবিনয়ে জানাই, না, আমি হ্যাপি নই, একদম হ্যাপি নই।

১৫ই আগস্ট’ ২০২০

Friday, August 14, 2020

প্রসঙ্গঃ ব্যাঙ্গালোরে মুসলিম জনতার হিংসাত্মক প্রতিবাদ

 

গত রাত্রে (১২ই আগষ্ট রাত্রে) একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে ব্যাপক হিংসা ছড়ায় ব্যাঙ্গালোরে। পোস্টটিতে ইসলামের প্রবর্তকের বিরুদ্ধে আপত্তিকর কিছু কথা লেখা আছে বলে অভিযোগ। নবীন নামের যার পোস্টকে কেন্দ্র করে ঘটনাটি ঘটেছে সে কংগ্রেস বিধায়ক আখণ্ড শ্রীনিবাস মূর্তির ভাগ্নে। পোস্টটি প্রচারিত হওয়ার পরেই হাজার খানেক উশৃঙ্খল মুসলিম জনতা কংগ্রেস বিধায়কের বাড়ির সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে শুরু করে। তারপর তারা বিধায়কের বাড়ি ভাঙচুর করার লক্ষ্যে ব্যাপক ইট ও পাথর ছোঁড়ে যার ফলে বিধায়কের বাড়ি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হামলাকারীরা বিধায়কের বাড়ির নিরীহ নিরাপত্তা কর্মীকেও তারা বেধড়ক মারধর করে। বিধায়কের বাড়ির আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলি ভাঙচুর করে তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়। হিংসার খবর পেয়ে ডিজে হাল্লি ও কেজি হাল্লির পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছালে উশৃঙ্খল জনতা তাদের উপরে চড়াও হয় এবং তাদের লক্ষ্য করে ইট ও পাথর বৃষ্টি শুরু করে। তারপর তারা ডিজে হাল্লি থানায় চড়াও হয় এবং থানায় ব্যাপক ভাঙচুর করে। থানার ভিতর এবং আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলিও ভাঙচুর করে আগুনে ভষ্মিভূত করে দেয়। ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকরাও আক্রমণের হাত থেকে রেহায় পায় নি।    

 Bangalore Violence

জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ প্রথমে লাঠিচার্জ করে, তারপর কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে এবং শূন্যে কয়েক রাউণ্ড গুলি চালায়। তাতেও উন্মত্ত জনতা ছত্রভঙ্গ না হলে পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায় বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। পুলিশের গুলিতে তিনজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। জনতা-পুলিশ সংঘর্ষে ষাট জন পুলিশ আহত হয়েছে যার মধ্যে এ্যাডিশনাল পুলিশ কমিশনারও আছেন,   এ কথা জানিয়েছেন ব্যাঙ্গালুরু পুলিশ কমিশনার কমল পন্ত। খবরে প্রকাশ যে ঘটনাস্থলে থেকে ২০০/২৫০ জন দুষ্কৃতিকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে যে মুসলিমদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত দিয়েছে বলে অভিযোগ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। পুলিশ আরও জানিয়েছে যে ডিজে হাল্লি ও কেজি হাল্লি অঞ্চলে কারফিউ এবং ব্যাঙ্গালোরের ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। হিংসাত্মক ঘটনাটির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে গণতন্ত্রের লেবাস পরা মুসলিম রাজনৈতিক দল এসডিপিআইও (Social Democratic Party of India)। এটা স্পষ্ট হয়েছে কারণ ধৃতদের মধ্যে মুজামিল পাশা নামে ওই দলের একজন নেতাও রয়েছেন। এ কথা জানিয়েছেন ঐ দলেরই নেতা মুজাহিদ পাশা।

ফেসবুকে ঠিক কী লেখা হয়েছে সেটা জানা যায় নি। সেটা জানার বিশেষ দরকারও নেই। কারণ, ভারত  একটি গণতান্ত্রিক দেশ, এ দেশে বাক-স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংবিধান স্বীকৃত যদিও তা বহুলাংশেই খণ্ডিত। তাই ফেসবুকে আপত্তিকর কিছু লেখা থাকলেও এখানে কেহই আইন হাতে তুলে নিতে পারে না, সে অধিকার সংবিধান কাউকে দেয় নি। ফেসবুকের কোনো পোস্ট যদি কোনো সম্প্রদায়ের কাছে আপত্তিকর মনে হয় তবে তার প্রতিবাদ করার অধিকার তাদের নিশ্চয়ই আছে যেটা করতে হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শান্তিপূর্ণভাবে। ফেসবুকের পোস্ট কিংবা অন্য মিডিয়ায় কোনো লেখা বা মন্তব্য যদি দেশের আইন লংঘন করে তবে তার বিচার করার ভার আদালতের, কোনো ব্যক্তির বা সম্প্রদায়ের নয়। এরূপ ক্ষেত্রে সব চেয়ে ভালো হচ্ছে লেখার মাধ্যমেই প্রতিবাদ করা। তাছাড়া মিছিল, মিটিং, ধরনা ইত্যাদির মাধ্যমে সরকারের কাছে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে শাস্তির দাবি জানানোর রাস্তা খোলা রয়েছে। সরকারের উপর ভরসা না থাকলে আদালত রয়েছে। একটা গণতান্ত্রিক দেশে প্রতিবাদের নামে আইন হাত

তুলে নেওয়া কিংবা হিংসাত্মক প্রতিবাদ করা সমর্থনযোগ্য নয়। এ ধরণের প্রতিবাদ করা আইনের চোখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।   

তাছাড়া আরও দুটো বিষয় খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরুরী। যেমন - এক). কেউ যদি অপরাধ করে তবে তার দায় শুধু তারই, তার কোনো আত্মীয়ের নয়। অথচ উশৃঙ্খল জনতা যে অভিযুক্ত তার মামার বাড়ি ভাঙচুর করলো। মামাকে দায়ী করা কেন? এহেন ঘটনা খুবই নিন্দনীয়। কর্তব্যরত সাংবাদিকদের উপরেও হামলা হলো। পুলিশ গিয়েছিলো হিংস্র জনতার তাণ্ডবের হাত থেকে বিধায়কের বাড়ি এবং তাঁর পরিবারের লোকজনদের রক্ষা করতে। কিন্তু তাদের ওপরেও হামলা সংগঠিত করা হলো। এটা কি মগের মুলুক নাকি? এসব গুণ্ডামি কি গণতন্ত্রে মানা যায়? দুই). অভিযুক্ত ব্যক্তিটি বলেছে যে ঐ পোস্টটি সে করে নি। তার ফেসবুক এ্যাকাউণ্ট হ্যাক করে অন্য কেউ ওটা করেছে। সে সত্য না মিথ্যা বলছে তার তদন্ত হওয়া দরকার। তদন্ত না করে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। আত্মরক্ষা করার অধিকার সংবিধানে স্বীকৃত। সে সুযোগ তারও প্রাপ্য। এটা গণতান্ত্রিক আইন ও রীতি যা সকলকেই মানতে হবে।  

কলমের জবাব কলমে দেওয়া বাঞ্ছনীয়, হিংস্রতা দিয়ে নয়  

সারা বিশ্ব জুড়েই মুসলিমদের মধ্যে একটা বিশেষ প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা হলো – তাদের মধ্যে সহনশীলতার প্রচণ্ড অভাব। এক্ষেত্রে জঙ্গি মুসলমান এবং অজঙ্গি মুসলমানদের মধ্যে কোনো পার্থক্য চোখে পড়ে না। ইসলামের সামান্য সমালোচনাও তারা শুনতে চায় না। বিশ্বের যে প্রান্তেই তা হোক না, মুসলিমরা বিশ্বজুড়েই তার প্রতিবাদে হিংসায় মেতে ওঠে। ভাঙচুর, লুটপাট, ও হত্যা ইত্যাদি হিংসাত্মক কাজের মাধ্যমে তারা প্রতিবাদ জানায়। এ প্রসঙ্গে দৃষ্টান্ত হিসাবে আমরা স্মরণ করতে পারি ফ্রান্সের শার্লি এব্দু (কার্টুন পত্রিকা) অফিসে মুসলিম জঙ্গিদের ভয়ঙ্কর হামলার ঘটনাট। ইসলামের নবীর একটা কার্টুন আঁকার জন্যে ঐ পত্রিকার কয়েকজন কার্টুনিস্টকে তারা নৃশংসভাবে হত্যা করেছিলো। নবীর কার্টুন আঁকার জন্যে আমরা কলকাতার রাস্তাতেও মুসলিমদের দিনভোর তাণ্ডব দেখেছি। সার্টানিক ভার্সেস লেখার জন্যে সলমান রুশদির বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়ার কথাও স্মরণ করা যেতে পারে। ফতোয়া দিয়েছিলেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা খোমেইনি। সেই ফতোয়ার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলো তামাম বিশ্বের মুসলিম সমাজ। তখন তাদের মধ্যে শিয়া-সুন্নির প্রভেদ মুছে গিয়েছিলো। তসলিমা নাসরিনের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ঘটনা ঘটতে আমরা দেখেছি। এ প্রসঙ্গে একটি অতি তুচ্ছ সমালোচনার চরম শাস্তির একটি দৃষ্টান্তের কথা উল্লেখ করতে চাই। সালটা সম্ভবত ২০০৫। কলকাতার শহরতলীর আক্রা হাই মাদ্রাসার একজন মুসলিম শিক্ষক একটি ঈদ সংখ্যার ম্যাগাজিনে একটা নিবন্ধে দু’টো প্রশ্ন রেখেছিলেন। তার একটি হলো, একই বিষয়ে বিজ্ঞান ও কোরান ভিন্ন কথা বললে কোনটা গ্রহণ করবো? দ্বিতীয় প্রশ্নটি এরূপ, মুসলমানদের দাবি হলো তাদের নবী হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। এ প্রসঙ্গে তাঁর প্রশ্ন ছিল, নবী তাঁর যুগের শ্রেষ্ঠ মানুষ হতে পারেন, কিন্তু তাঁকে কি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব বলা যায়? এই দু’টি মামুলি প্রশ্ন তোলার জন্যে মুফতিরা তাঁকে মোরতাদ ঘোষণা করে তাঁর মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া দিয়েছিলো। সেই ফতোয়া কার্যকর করার জন্যে মুসলিমরা দল বেঁধে তাঁর বাড়িতে চড়াও হয়। তাঁকে না পেয়ে তাঁর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটাই হচ্ছে মুসলিম সংস্কৃতি।

এই সংস্কৃতির ধারক ও বাহক শুধু মোল্লা-মুফতিরাই নয়, এই সংস্কৃতির বাহক আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলিম সমাজও। ইসলামের ধর্মগ্রন্থ কিংবা নবীর সমালোচনা হলে তার প্রতিবাদে যে মুসলিমরা রাস্তায় নেমে যে হিংসাত্মক আচরণ করে তার পুরোভাগে থাকে উচ্চ শিক্ষিত মুসলিমরাও। মুসলিমরা বহুদিন থেকেই মাদ্রাসার শিক্ষার বদলে আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করছে। কিন্তু আধুনিক শিক্ষাকে আদর্শ জ্ঞানে এ শিক্ষা গ্রহণ করে বলে মনে হয় না। আসলে ইসলামের আদর্শকে বুকে আগলে রেখেই মুসলিম অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের কেরিয়ারের কথা ভেবে আধুনিক শিক্ষার স্কুলে পাঠায়। কিন্তু বাড়িতে চালু থাকে মুসলিম সংস্কৃতির চর্চা। ফলে মুসলিম সমাজের সন্তানরা আধুনিক শিক্ষা অর্জন করলেও আধুনিক যুগের উন্নত আদর্শ ও সংস্কৃতির শিক্ষা অর্জন করতে পারে না। তার ফলে যা হওয়ার তাই হয়। ইসলামের ধর্মগ্রন্থে ভিন্ন ধর্মের নবী, দেব-দেবী ও মানুষদের বিরুদ্ধে যে কঠিন সমালোচনাগুলি রয়েছে, শিক্ষিত মুসলিমরা মনে করে যে সে সমালোচনাগুলি ন্যায়সঙ্গত এবং তা করার তাদের অধিকার আছে। কিন্তু তারাই আবার এ মনে করে যে, তাদের ধর্ম ও নবীর বিরুদ্ধে কারও সমালোচনা করার অধিকার নেই। সেই ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়েই মুসলিমরা ব্যাঙ্গালোরে হিংস্র হয়ে উঠেছিলো।  

আমরা সমালোচনা করবো, কিন্তু কারো সমালোচনা আমরা শুনবো না – এটা মধ্যযুগীয় চিন্তা-ভাবনা ও সংস্কৃতি। গণতন্ত্রের যুগে সেই সংস্কৃতি আঁকড়ে থাকা চলে না – এ কথা বুঝতে হবে মুসলিম সমাজকে। তাদের উপলব্ধি করতে হবে যে, সমালোচনা করার অধিকার সবার আছে। ইসলামের সমালোচনার জবাব অস্ত্র ও হিংসা দিয়ে নয়, দিতে হবে কলমের সাহায্যে। এটাই এ যুগের বৈশিষ্ট তা তাদের বুঝতে হবে। বুঝতে হবে যে, সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপনের জন্যে এই বৈশিষ্টটা সবাইকে মানতে হবে, মানতে হবে মুসলিম সমাজকেও।   

এটা গভীর দুঃখজনক ঘটনা যে মুসলিম সমাজ আজও মধ্যযুগীয় অন্ধকারে বুঁদ হয়ে রয়েছে। এই জমাট বাঁধা চাপ চাপ অন্ধকারের মধ্যেও আশার একটু ক্ষীণ আলো দেখালেন ব্যাঙ্গালোরের কংগেসের প্রাক্তন মন্ত্রী বি. জেড জামির খান। তিনি ক্রুদ্ধ মুসলিম জনতার হিংসাত্মক কার্যকলাপকে আড়াল করেন নি। এমনকি পুলিশের গুলি চালনারও নিন্দা করেন নি। উল্টে যারা হিংসাত্মক আচরণ করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ করতে সরকারের কাছে অনুরোধ করেছেন এবং মুসলিমদের শান্ত থাকতে অনুরোধ জানিয়েছেন। এটাই তো কাম্য।           

মেকি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক নেতা এবং বিদ্বজনদের নেতিবাচক ভূমিকা  

ভারতবর্ষে গণতন্ত্রের সূচনা হয়েছে ১৯৪৭ সালে। তিয়াত্তর বছর ধরে এ দেশে গণতন্ত্রের চর্চা ও অনুশীলন হচ্ছে (অবশ্য সততার সঙ্গে হচ্ছে এমন বলা যাবে না)। কিন্তু খুবই উদ্বেগের বিষয় হলো মুসলিম সমাজকে সেই চর্চা ও অনুশীলনে আজও সামিল হতে তেমন দেখা যাচ্ছে না। এর জন্যে নিশ্চয়ই প্রধানত মুসলিম সমাজই দায়ী। কিন্তু আমি মনে করি না যে এর দায় শুধু তাদেরই। অনেকখানি দায় বর্তায় গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলির উপরেও। দায় বর্তায় বুদ্ধিজীবী ও বিদ্বজনদেরও যাঁরা  গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী। এটা বলছি এ জন্যে যে, মুসলিমরা যখনই তাদের ধর্মের সমালোচনায় কাতর হয়ে উন্মত্ত ও হিংস্র হয়ে ওঠে তখন রাজনৈতিক দলগুলি এবং বুদ্ধিজীবী ও বিদ্বজনরা কেউই তাদের নিন্দা ও সমালোচনা করে না। অসাম্প্রদায়িক সরকারগুলি হিংসাশ্রয়ী জনতার বিরুদ্ধে কোনো কড়া পদক্ষেপ করে না। বরং তাদের প্রশ্রয়ই দিয়ে থাকে এবং দুষ্কৃতিদের শাস্তি দেবার বদলে আড়াল করে। প্রশ্রয় দেয় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি ও বুদ্ধিজীবী সমাজও। হিংসাত্মক কার্যকলাপের নিন্দা তো করেই না, ঘুরিয়ে যারা ইসলামের করে তাদের বিরুদ্ধেই কড়া সমালোচনায় মুখর হয়। বলে যে, বাক-স্বাধীনতার নামে মানুষের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত দেওয়া মানা যায় না। সরকার, বিরোধী দল ও বুদ্ধিজীবী সমাজের নিরন্তর এরূপ প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ও মদতই মুসলিমদের আজও অসহিষ্ণু থেকে যাওয়ার জন্যে বহুলাংশেই দায়ী।   

বিজেপি সরকারের নেতিবাচক ভূমিকা

হিন্দু ধর্মে ভিন্ন ধর্মের মানুষের বিরুদ্ধে হিংসা ও ঘৃণা ছড়ানোর কথা নেই। হিংসা ও ঘৃণার কথা যা বলা আছে তা হিন্দুদের নিম্ন বর্ণের বিরুদ্ধে। অথচ বিজেপিকে দেখা যাচ্ছে মুসলিম, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও হিংসা ছড়াতে। মুসলিমরা মুসলিম দেশগুলিতে যা করে তারাও সেরূপ আচরণ করছে।  নিরীহ মুসলিমদের জোর করে জয় শ্রীরাম বলাচ্ছে, না বললে মারধর করছে। গো-রক্ষার নামে মুসলিমদের উপর নির্মম অত্যাচার চালাচ্ছে, এমনকি হত্যাও করছে। গো-মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করেছে কয়েকটি রাজ্যে। এভাবে তারা তাদের খাদ্য সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে চাই অহিন্দুদের উপর। চাপানোর চেষ্টা করছে হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষা সহ তাদের হিন্দু সংস্কৃতিও। তারা এক কথায় মুসলিম, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। এসবই গণতন্ত্র এ ধর্মনিরপেক্ষতার পরিপন্থী। বিজেপির সেই ধারাকেই অনুসরণ করতে চেয়ে একটি বাজে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিজেপির সরকার মুসলিমদের গত রাত্রের হিংসাত্মক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। বিজেপি সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, ভাঙচুর ও অগ্নি সংযোগের  ঘটনায় বাইক ও মোটর গাড়ি সহ যে সমস্ত সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ আদায় করা হবে হিংসাত্মক ঘটনার সাথে যারা যুক্ত তাদের কাছ থেকে। এই পদক্ষেপটি বিজেপির প্রতিহিংসার রাজনিতি থেকে উদ্ভুত। গণতন্ত্রে এরূপ হওয়া অবাঞ্ছনীয়। প্রসঙ্গত জানাই যে, হিংসাশ্রয়ী জনতার ওপর পুলিশের গুলি চালানোর সমালোচনা আমি করছি না।   ১৩.৮.২০   

Monday, August 10, 2020

অযোধ্যায় রামমন্দিরের শিলান্যাস শুধু একটা মন্দিরের শিলান্যাসই নয়

Narendra Modi

 

১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর বিতর্কিত বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই ধ্বংসকাণ্ডে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদেরই একজন গত ৫ই আগষ্ট রামমন্দিরের শিল্যান্যাস করলেন। বলা বাহুল্য তিনি নরেন্দ্র মোদি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ৬ই ডিসেম্বর ধ্বংসকাণ্ড সংগঠিত করার নেতৃত্ব যাঁরা করেছিলেন তাঁরা সকলেই ছিলেন জনপ্রিতিনিধি। অর্থাৎ সংবিধান মেনে চলার ও তাকে রক্ষা করার শপথে আবদ্ধ মানুষ। কিন্তু সবাই সেদিন সংবিধানকে অমান্য, অগ্রাহ্য ও পদদলিত করেছিলেন হেলায় এবং সচেতনভাবেই। তাঁদের বিরুদ্ধে তাই ফৌজদারি মামলা হয়েছিলো যা আজও চলছে। অথচ গত ৫ই আগষ্ট সেই বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের ওপরেই হলো ভূমিপূজন ও রামমন্দির নির্মাণের শিল্যান্যাস। আপাতদৃষ্টিতে এসব হলো সংবিধানের উল্লঙ্ঘন না করেই। আপাতদৃষ্টিতে বলার কারণ হলো, বিতির্কিত জায়গাটিতে রামমন্দির নির্মাণ করাকে বৈধতা দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালতের একটি বিতর্কিত রায়। আদালত রায় যাই দিক না কেন, কিন্তু বস্তবটা হলো এই উক্ত বিতর্কিত জায়গাতেই একটি আস্ত মসজিদ ছিলো যেটা সঙ্ঘ পরিবার ও বিজেপির লোকেরা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলো। এ রকম কোনো জায়গায় মন্দির কিংবা অন্য যে কোনো প্রকার ধর্মীয় উপাসনালয় নির্মাণ করা ভারতের সংবিধানের আদর্শের যে পরিপন্থী তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। ভারতের সংবিধানে সকল নাগরিকের নিজের ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করার অধিকার স্বীকৃত এটা ঠিক, কিন্তু তাই বলে কি রাষ্ট্র ধর্ম পালন করবে কিংবা ধর্মীয় আচরণ করবে? রাষ্ট্র তা করতে পারে না, কারণ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকে না। তাই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কর্তব্য হচ্ছে মন্দির, মসজিদ, গীর্জা, গুরুদুয়ারা ইত্যাদি সকল প্রকার ধর্মীয় উপাসনালয় নির্মাণ ও সেগুলির পৃষ্ঠপোষকতা করা থেকে বিরত থাকা। তাই মন্দির নির্মাণে কিংবা তার পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদি ভূমিকা নিতেই পারেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তেমন কোনো কাজ করতে পারেন না।    

   

 অতীতের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ভুল-ভ্রান্তিগুলো অসাংবিধানিক কাজের লাইসেন্স হতে পারে না 

 

 

বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী পারিষদের সদস্যগণ এবং শাসকদলের নেতারা যখনই সংবিধানকে লঙ্ঘন কিংবা সংবিধানের আদর্শের পরিপন্থী কোনো করছেন তখনই তাঁরা সেই কাজগুলিকে বৈধতা দিতে অতীতের শাসকবর্গের অনুরূপ কাজের নিদর্শনগুলিকে তুলে ধরছেন। এখন যেমন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অযোধ্যায় বিতর্কিত জমিতে ভূমিপূজন এবং রামমন্দিরের শিল্যানাস করাকে বৈধতা দেবার জন্যে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতির রাজেন্দ্র প্রসাদের সোমনাথ মন্দিরের দ্বার উদ্ঘাটন অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার দৃষ্টান্তকে তুলে ধরা হচ্ছে। রাষ্ট্রপতি হিসাবে রাজেন্দ্র প্রসাদজীর ঐ অনুষ্ঠানে সেদিন অংশ নেওয়া যেমন সংবিধানের আদর্শ পন্থী কাজ ছিলো না, তেমনি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদিজীরও রামমন্দিরের জন্যে ভূমিপূজা ও শিল্যান্যাস করা  সংবিধানের আদর্শ পন্থী কাজ নয়। অতীতে একজন রাষ্ট্রপতি ভুল করেছেন বলে এখন প্রধানমন্ত্রী তা করতেই পারেন – এটা হাস্যকর ও শিশুসুলভ দাবি। আবার বাবরি মসজিদ ধাংসকাণ্ডকেও তারা একই যুক্তিতে (অপযুক্তিতে) যৌক্তিক ও ন্যায় কাজ বলে মনে করে, যেহেতু মুসলিম শাসকরা ভারতে অতীতে মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। মুসলিম শাসকরা ছিলো বিদেশি এবং সেটা ছিলো সামন্ততন্ত্র ও রাজতন্ত্রের যুগ। সে যুগে মুসলিম শাসকরাই কেবল ভিন্ন ধর্মের উপাসনালয় ভাঙে নি,  খ্রিস্টান সম্রাট ও হিন্দু রাজারাও তেমনি অনুরূপ কাজ করেছিলেন। কিন্তু এটাতো গণতন্ত্রের যুগ যে যুগে কেউ কারও ধর্মাচারণে হস্তক্ষেপে ও বাধা দিতে পারে না। তাই অতীতে একদা মন্দির ভেঙে মসজিদ  বানানো হয়েছিলো বলে সেটা এ যুগে মসজিদ ভেঙে মন্দির নির্মাণ করার লাইসেন্স হতে পারে না।       

কেন্দ্রীয় সরকার ও শাসকদল আসলে অন্য এক সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও আস্থাশীল

 

নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর সরকারের মন্ত্রী এবং শাসক দলের নেতারা খুব ভালো করেই জানেন যে, অতীতের দোহায় দিয়ে বর্তমান সময়ে সংবিধানের আদর্শের পরিপন্থী কাজ করা যায় না। তবু তারা তাদের সমস্ত বেআইনী ও অসাংবিধানিক কার্যকলাপকে ঢাকার জন্যে বারবার অতীতের উদাহরণ তুলে ধরেন। সেটা করেন তাদের আসল অভিপ্রায়কে আড়াল করার জন্যে। শাসকদল আসলে ভারতের বর্তমান সংবিধানের প্রতি আস্থাশীল ও শ্রদ্ধাশীল নয়। কিন্তু যেহেতু বিজেপির নেতারা এই সংবিধান মেনেই জনপ্রিতিনিধি হয়েছেন এবং সরকার তৈরি করেছেন, তাই প্রকাশ্যে তাদের পক্ষে এ কথা বলা সম্ভব নয় যে তারা বর্তমান সংবিধানের প্রতি নয়, অন্য সংবিধানের প্রতি তাদের আস্থা ও আনুগত্য রয়েছে। আইনত বিজেপির কোনো মন্ত্রী ও সাংসদ সংবিধানের পরিপন্থী কথা বলতে পারেন না তবুও অনেক মন্ত্রী ও সাংসদের মুখে অহরহ তেমন কথা প্রায়ই শোনা যায়। তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রায়ই উস্কানিমূলক মূলক বিবৃতি দেন। যেমন প্রায়শই তাদের মুখে এ কথা শোনা যায় - ভারতের মুসলিমরা ভারতে কেন থাকবে? মুসলিমরা তো ভারত ভেঙে তৈরি করেছে পাকিস্তান, সুতরাং তাদের পাকিস্তানই তাদের দেশ, চলে যেতে হবে তাদের সেখানেই। আর যদি একান্তই তারা ভারতে থাকতে চায়, তবে হিন্দুদের অধীনতা মেনে থাকতে হবে। মুসলিমদের উদ্দেশ্যে এ শ্লোগানও এক সময় হরদম তাদের মুখে শোনা যেত - হয় ভারত ছাড়ো, না হয় কোরআন ছাড়ো। এ সব সংবিধান বিরুদ্ধ ভয়ঙ্কর কথা প্রমাণ করে তারা কোন সংবিধান প্রতিষ্ঠা করতে চাই ভারতে।      

রামমন্দিরের শিল্যানাস করে প্রধানমন্ত্রী জানিয় দিলেন হিন্দুরাষ্ট্রই তাঁর লক্ষ্য

 

শিল্যানাসের পর প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেছেন, ‘এত দিনে রামজন্মভূমির মুক্তি ঘটল ...  এত দিন তাঁবুতে মাথা গুঁজে ছিলেন রামলালা বার তাঁর জন্য সুবিশাল মন্দির নির্মিত হবে ...  সরযূ নদীর তীরে সূচনা হল স্বর্ণযুগের।’ তিনি আরও বলেন, ‘‘এই রামমন্দির ভারতের সংস্কৃতির আধুনিক প্রতীক আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাবনার প্রতীক তিনি ৫ই আগষ্টকে ১৫ই আগষ্টের সঙ্গে সমতুল্য বলেছেন। ১৫ই আগষ্টের ভারতের স্বাধীনতা দিবসটি হলো    ভারতীয়দের জন্যে বৃটিশদের দাসত্ব থেকে মুক্তির দিবসও বটে।। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য খোলসা করেন নি ৫ই আগষ্ট কাদের কাছ কাদের মুক্তির দিবস। তিনি খোলসা না করলেও কী বলতে চেয়েছেন তা কারও কাছে অবোধগম্য বা অস্পষ্ট থাকে নি। রামমন্দিরকে ভারতীয় সভ্যতার, সংস্কৃতির ও জাতীয়তাবোধের প্রতীক হিসাবে বর্ণনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। সেটা বলার সময় তিনি আবেগকে সংযত রাখতে পর্যন্ত পারেন নি। সে সময় ভাষণ থামিয়ে তিনি নিজ কণ্ঠেই ‘শ্রী রাম’-এর জয়ধ্বনি দেন। সেই শ্লোগানে সবাইকে গলা মেলাতেও বলেন। ভাষণও শেষ করেন রাম-সীতার নামে জয়ধ্বনি দিয়ে। মোদিজি তাঁর ভাষণে আরও স্পষ্ট করে যা বলতে চেয়েছেন তা হলো, হিন্দুত্বই হলো ভারতের জাতীয়তা আর হিন্দুত্বের মধ্যেই নিহিত রয়েছে ভারতীয়দের সভ্যতা ও সংস্কৃতির শিকড়। তিনি বলেছেন যে ভগবান রামচন্দ্রই হবে ভারত রাষ্ট্রের আদর্শ আর রামরাজ্য স্থাপন করাই হলো তাঁর মূল গন্তব্য। খোলাখুলি না বললেও তিনি স্পষ্টই বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, রামমন্দির নির্মাণের শিল্যানাসের মাধ্যমে আসলে তিনি হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণেরই শিল্যানাস করলেন। তাঁর স্বপ্নের সেই রাষ্ট্রে যে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার স্থান হবে না তা বলা বাহুল্য। 

ইতিহাস সংশোধন করার চেষ্টা ভয়াবহ সর্বনাশ ডেকে আনবে

বাবরি মসজিদকে ভাঙার পর পরই সঙ্ঘ পরিবারের নেতাদের কণ্ঠে কাশি ও মথুরার মসজিদ ভেঙে মন্দির উদ্ধার করার আওয়াজ/হুঙ্কার শোনা গিয়েছিলো। আওয়াজ উঠলেও সেটা নিয়ে কোনো অভিযান তখন হয় নি। কিন্তু ইস্যুটি যে তারা পরিত্যাগ করে নি তা স্পষ্ট হলো রামমন্দিরের শিল্যানাসের পর। শিল্যানাসের অনুষ্ঠানে শেষ হতেই সঙ্ঘ পরিবার পুনরায় কাশি-মথুরার ইস্যুতে সরব হলো। সরব হয়েছে ফতেপুর সিক্রি নিয়েও। একদা পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের কাটরা মসজিদও দখল করতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধিয়েছিলো তারা। বাধাবার চেষ্টা করেছিল হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও। ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধূলিস্যাত করার পরও চারিদিকে দাঙ্গা বেধে গিয়েছিলো যাতে বহু প্রাণহানি হয়েছিলো। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সবচেয়ে খারাপ প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিলো বাংলাদেশে। সেখানে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর নেমে এসেছিলো ভয়ঙ্কর আক্রমণ। অসংখ্য মন্দির গুঁড়িয়ে দেওয়া, অনেক হিন্দু মহল্লা লুট করার পর জ্বালিয়ে দেওয়া, বহু হিন্দুকে হত্যা এবং হিন্দু নারীকে ধর্ষণ করার বর্বর ও নৃশংস ঘটনা ঘটেছিলো। সেই বর্বর ঘটনার জীবন্ত বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন তসলিমা নাসরিন ‘লজ্জা’ নামক একটি উপন্যাসে।   

সঙ্ঘ পরিবারের দীর্ঘদিনের অভিযোগ ছিলো রামমন্দিরটি ধ্বংস করে সেখানে বাবরি মসজিদ তৈরি করা হয়েছিলো। সঙ্ঘ পরিবার কিন্তু তাদের অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ আদালতে দেখাতে পারে নি। আদালতকে তারা বলেছে ওটা তাদের বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসকে সত্যে পরিণত করার জন্যেই ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর তারা ব্যাপক সংখ্যক হিন্দু করসেবক সমবেত করে মসজিদটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। সেই কদর্য ঘটনার ২৭ বছর পর ২০১৯ সালের ৯ই নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট যুক্তি, তথ্য ও প্রমাণ ছাড়াই হিন্দুদের বিস্বাসকেই মান্যতা দিয়েছিলো। সেই রায়ে গোটা বিশ্ব সেদিন সম্ভবত স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলো। গণতন্ত্রের পিলে চমকে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সেদিন পৌরাণিক ও কাল্পনিক রামকে কার্যত ঐতিহাসিক রামের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিলো। সেই বিতর্কিত রায়কে হাতিয়ার করে বিতর্কিত জায়গাতেই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় প্রধানমন্ত্রী এবং উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর অফিস ঝাঁপিয়ে পড়লো রামমন্দির নির্মাণের কাজে। গত ৫ই আগষ্ট তারই প্রথম ধাপের কাজের সুচনা করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।  

ধরা যাক তর্কের খাতিরে যে রামমন্দির ভেঙেই বাবরি মসজিদ নির্মিত হয়েছিলো। কিন্তু তখনকার যুগ তো সামন্ততন্ত্র ও রাজতন্ত্রের যুগ। সে যুগে রাজা-সম্রাটদের ভিন্ন ধর্মের উপাসনালয় ভেঙে নিজ ধর্মের উপাসনালয় নির্মাণ করাই ছিলো দস্তুর। কিন্তু এ যুগ তো গণতন্ত্র যুগ যে যুগে রাষ্ট্রের মৌলিক কর্তব্য হলো সমস্ত  মানুষের ধর্মাচারণের অধিকার সুরক্ষিত রাখা। এ যুগে ভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের উপাসনালয়ের জায়গায় শাসক দলের ধর্মীয় উপাসনালয় তৈরি করা রাষ্ট্রের কাজ নয়। ফলে অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রই এখন সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় উপাসনালয়গুলির সুরক্ষা দেয়, যদিও বহুলাংশেই তারা সংখ্যালঘুদের জান-মালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। অথচ আমাদের প্রধানমন্ত্রী স্বহস্তে বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের ওপর রামমন্দিরের শিল্যানাস করলেন! এ কিসের বার্তা? এটা কি ভারতের ইতিহাসের ত্রুটি সংশোধনের ভয়ঙ্কর কোনো বার্তা?            

ধর্মীয় মৌলবাদীরা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো সাধারণত ইতিহাসের ত্রুটি সংশোধন করার দাবি করে থাকে। এটা একটা বিপজ্জনক প্রবণতা, কিন্তু এর অনিষ্ট করার ক্ষমতা সীমিত। কারণ ধর্মীয় মৌলবাদীদের এই প্রবণতা রাষ্ট্র দমন করতে সক্ষম। কিন্তু রাষ্ট্র যদি স্বয়ং এরূপ কাজ করতে চায় তবে তা তো মানব সমাজের চরম সর্বনাশ ডেকে আনবে। কেননা দেশের অভ্যন্তরে এবং বিদেশেও তার যে ব্যাপক ও তীব্র প্রতিক্রিয়া হবে তা মোকাবিলা বা দমন করা হবে দুঃসাধ্য ব্যাপার। এ ব্যাপারে আমরা স্মরণ করতে পারি বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পর বাংলাদেশে কী ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো এবং তার জন্যে সেখানকার সংখ্যালঘু হিন্দুদের কী নিদারুণ মাশুল গুণতে হয়েছিলো তার কথা।  

 

   

 

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...