আজ ভারতের চুয়াত্তরতম স্বাধীনতা দিবস। দেশজুড়ে উদযাপিত হচ্ছে দিবসটি। যাদের উদযাপন করার কথা তারা তো করছেই, যাদের উদযাপন করার কোনো মানে হয় না তারাও করছে। যাদের উদযাপন করার কথা নয় তাদের একদল হুজুগে করছে, কিছু না জেনে বুঝেই করছে, সবাই করছে তাই করছে। একদল না করলে দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন উঠবে তাই করছে।
বিশ্বজুড়ে করোনার ভয়ঙ্কর আক্রমণ আজও অপ্রতিরোধ্য। দেশজুড়ে যখন স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হচ্ছে তখন ভারত বিশ্বের করোনা-পীড়িত দেশগুলির উপরের কাতারে উঠে গেছে, একেবারে তৃতীয় স্থানে, আর দৈনিক সংক্রমণের দিক থেকে তো একেবারে প্রথম স্থানে। সংক্রমণের সংখ্যা বিশ্বে ছাড়িয়েছে দু’ কোটি, ভারতে প্রায় পঁচিশ লক্ষ। করোনার মোট বলি সাড়ে সাত লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে, তার মধ্যে ভারতেই অর্ধ লক্ষাধিক। কিন্তু করোনার ভ্যাকসিনের বিশ্বাসযোগ্য কোনো খবর আজ পর্যন্ত নেই। সুতরাং মৃত্যুর সংখ্যা কোথায় গিয়ে ঠেকবে ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। করোনার বিরুদ্ধে আমাদের সরকারগুলি নাকি যুদ্ধ করছে। প্রধানমন্ত্রী আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেছিলেন এ যুদ্ধ বিজয় আসবে ২১ দিনেই। সেই যুদ্ধের আজ ১১৩ দিন, যুদ্ধ জয়ের ক্ষীণ আলোর শিখাটুকুও দূরবিন দিয়ে দেখা যাচ্ছে না।
যুদ্ধ জেতা যাবে কি করে? যুদ্ধ জেতার জন্যে স্বাস্থ্য পরিষেবার ন্যূনতম পরিকাঠামো তো নেই কোথাও। ফলে করোনা রোগীরা সবাই হাসপাতালের চিকিৎসা পাচ্ছে না, যারা হাসপাতাল পাচ্ছে সুচিকিৎআ পাচ্ছে না। বেসরকারি হাসপাতাল তো সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। ফলে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে রোজ। চিকিৎসক সহ স্বাস্থ্যকর্মীরাও উপযুক্ত ও পর্যাপ্ত পিপিই কিট পাচ্ছেন না, ফলে তাদেরও মৃত্যু বরণ করতে হচ্ছে। মানুষের স্বাস্থ্যচেতনা স্তর তো একেবারেই তলানিতে। বিশ্বে প্রতিদিন দশ হাজার এবং ভারতে এক হাজার লোক মরছে। তবু মানুষের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। মুখে মাস্ক পরা ও দুরত্ব-বিধি মানার মানার বালাই নেই। স্বাস্থ্যচেতনা নেই, কিন্তু ধর্ম পালন করার চেতনা ষোল আনায় বিশ আনা। দলবেঁধে ঈদের নামাজ পড়া চাই, কুরবানির নামে পশু হত্যা করা চাই-ই চাই! মন্দিরে পূজো দেওয়া চাই-ই চাই! এই হচ্ছে মানুষের চেতনার স্তরের লজ্জাজনক দৈন্যতা।
যারা করোনা-যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন যাঁরা (প্রধানমন্ত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রী) তাঁদের চেতনাস্তরের দৈন্যতাও লজ্জাজনক। করোনা-যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী ছুটছেন রাম মন্দিরের শিল্যানাস করতে, ফলে বিজেপির নেতা-কর্মীরা দুরত্ব-বিধিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেশজুড়ে মেতে উঠলো সেই আনন্দে। এটাই তো হবার কথা ছিলো যা প্রধানমন্ত্রী বিলক্ষণ জানতেন। জেনেও করলেন দুটো কারণে – নিজের নামকে ইতিহাসে খোদায় করার জন্যে, আর হিন্দু ভোটব্যাংক স্ফীত করার জন্যে। জনগণের স্বার্থকে বলি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রাধান্য দিলেন দলীয় স্বার্থকে।
আমাদের মুখ্যমন্ত্রী বোধহয় ভেবেলেন যে তিনি একাই এ যুদ্ধ জিতে যাবেন এবং সেই সাফল্য দিয়েই একুশের ভোটে বাজিমাত করবেন! তাই বিরোধীদের কাউকে ডাকলেন না, বিরোধিরা পথে নামলেও তাদের পথ আটকে দিলেন পুলিশ দিয়ে। ফলে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু ঠেকাতে তাঁর সরকারও চূড়ান্ত ব্যর্থ। প্রাথমিক পর্যায়ে একদিনে দু’ চার দশটা সংক্রমণ হতো, সেটা তিন হাজারের গণ্ডি টপকেছে। আগে মরেছে দু’চার দিনে একটা, এখন মরেছে পঞ্চাশ/ষাট জন। পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য পরিষেবাও আক্ষরিক অর্থেই বেহাল।
করোনা সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারিতে মানব সমাজ ও মানব সভ্যতা আজ গভীর এক সংকটে। সংকটে আমাদের দেশ, সংকটে আমাদের রাজ্য, সংকটে মানুষ। প্রতিদিন দশ/বারো হাজার লোক মারা যাচ্ছে, আমাদের দেশে প্রতিদিন মরছে এক হাজার করে। মৃত্যু, মৃত্যু, আর মৃত্যু, শুধু মৃত্যুর খবর চারিদিকে। প্রিয়জন হারানোর শোকে চারিদিকে শুধুই আর্তনাদ আর হাহাকার। গোটা পৃথিবিটাই যেন একটা মৃত্যু পুরী। এই মৃত্যু পুরীতে বাস কয়রে ১৫ই আগস্টকে আর পাঁচটা দিনের থেকে আলদা বলে আমার একদম মনে হয়ে না। আজ স্বাধীনতা দিবস বলে করোনা আমাদের রেহাই দেয় নি। তাই স্বাধীনতা দিবস বলে আজকের দিনটাতে আমি হ্যাপি হই কি করে? হ্যাপি থাকি কি করে? কি করেই বা বলি হ্যাপি স্বাধীনতা দিবস? যারা আমাকে “হ্যাপি স্বাধীনতা দিবস” (Happy Independence Day) জানিয়েছেন তাদের সবিনয়ে জানাই, না, আমি হ্যাপি নই, একদম হ্যাপি নই।
১৫ই আগস্ট’ ২০২০