যুদ্ধ
নয়, ওটা
আসলে ছিলো
বিদ্রোহ
কারবালা
প্রান্তরে ইতিহাস
কথিত যে
যুদ্ধটি হয়েছিল
সেখানে হোসেনের
পক্ষে সৈনিবাহিনীতে ছিল
সত্তর থেকে
একশ’ দশ
জন সৈন্য,
অপরদিকে কুফার
গভর্ণর যে
বাহিনী পাঠিয়েছিলেন
ওমর ইবন
সা’দের
নেতৃত্বে তাতে
চার হাজার
থেকে দশ
হাজার সৈনিক
ছিল। অর্থাৎ
হোসেন খলিফা
এজিদকে উৎখাত
করার যে
ডাক দিয়েছিলেন
তাতে সাড়া
দিয়ে দলে
দলে মুসলমানরা
ছুটে আসেন
নি।
যে কয়জন
তাঁর ডাকে
সাড়া দিয়েছিলেন
তাঁরা মূলত
তাঁর জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর
লোকজন এবং
সকলেই মক্কা
ও মদিনার
অধিবাসী।
আবার এই
ছবিটাও স্পষ্ট
যে, তাঁর
সঙ্গে প্রথম
দিকে অতি
মুষ্টিমেয় যে
কয়জন বিশিষ্ট
ব্যক্তিত্ব ছিলেন তাঁরাও
তাঁর পাশে
শেষ মূহুর্ত
পর্যন্ত ছিলেন
না। শুধু আব্দুল্লাহ
ইবনে জুবাইর
তাঁর সঙ্গে
ছিলেন এবং
তিনিও এজিদের
হাতে বয়াত
নেন নি। সুতরাং
সামগ্রিকভাবে যে
ছবিটা আমরা
দেখতে পাই
তা হলো
এজিদের বিরুদ্ধে
এবং হোসেনের
পক্ষে জনমত
প্রায় ছিল
না বললে
মোটেই অত্যুক্তি
হয় না। হোসেন তবুও
ক্ষমতা লাভের
জন্য এত
মরিয়া হয়ে
উঠেছিলেন যে
এই বাস্তব
পরিস্থিতিটাও উপলব্ধি
করতে পারেন
নি।
ভেবেছিলেন তিনি
যেহেতু নবীর
নাতি তাই
সমগ্র মুসলিম
সমাজের নৈতিক
সমর্থন তাঁর
সঙ্গেই আছে। সাহস
করে এজিদকে
উৎখাত করার
ডাক দিলে
এক বিরাট
সৈন্যবাহিনী গড়ে
তোলা কঠিন
কাজ হবে
না।
সেই মিথ্যা
আশায় যখন
তিনি বিভোর ছিলেন তাঁকে অনেকেই
হয়তো তাঁকে অর্থহীন
উৎসাহও জুগিয়েছিল
এ বলে যে, মুসলমানরা
মনে-প্রাণে
আপনাকে চাইছে,
আপনি এগিয়ে
যান।
কুফা থেকে
আক্ষরিক অর্থেই এ
রকম আশ্বাসবাণী
সহ বেশ কিছু
চিঠি-পত্র
তাঁর নিকট
এসে পৌঁছেছিলও
বটে।
ফলে তিনি
প্রচন্ড আশাবাদী
ও আত্মবিশ্বাসী
হয়ে ইসলামি
সাম্রাজ্যের খলিফা
হওয়ার স্বপ্নে
বিভোর হয়ে
সৈন্য সংগ্রহের
নিমিত্ত কুফার
পথে রওনা
দিয়েছিলেন।
ফল যা
হওয়ার তাই
হয়েছিল, বড়
সৈন্যবাহিনী গড়ে
তুলতে পারা
তো পরের
কথা, কার্যত
ক্ষুদ্র একটা
বাহিনীও গড়ে
তুলতে ব্যর্থ
হয়েছিলেন এবং
অসহায়ের মত
মাত্র কয়েক
ঘন্টার অর্থহীন
প্রতিরোধের প্রয়াস
চালিয়ে সদলবলে
মৃত্যর কোলে
ঢোলে পড়েছিলেন
এবং এভাবেই একটি
করুণ অধ্যায়ের
সমাপ্তি ঘটেছিলো। কারবালার
এই করুণ
ঘটনাকে ইতিহাস
‘কারবালা যুদ্ধ’
বলে কেন
‘যুদ্ধের’ মর্যাদা
প্রদান করেছে
তা কিছুতেই
বোধগম্য হয়
না। প্রকৃত
বিচারে এটা
একটা রাজদ্রোহ
বা বিদ্রোহের
ঘটনা বৈ
নয়।
যুদ্ধ কেন
হয়েছিল? কারা
দায়ী?
কারবালা প্রান্তরে যা ঘটেছিল, যুদ্ধ কিংবা
বিদ্রোহ যাই বলিনা কেন, সেই ঘটনার ভরকেন্দ্রে ছিলো ক্ষমতা। ঘটনা-উপঘটনা, ঘাত-প্রতিঘাত সবটাই আবর্তিত হয়েছে সেই ক্ষমতা তথা খলিফার মসনদকে কেন্দ্র করে। শুধু খলিফার
সিংহাসন দখল করার জন্য আরও অসংখ্য যুদ্ধ বা বিদ্রোহ এবং রক্তপাতের ঘটনা ঘটেছে ইসলামের ইতিহাসে। তারফলে শুধু ইমাম হোসেনই নয়, অনেক খলিফারই
প্রাণ অকালে ঝড়ে গেছে গুপ্তঘাতক বা বিদ্রোহীদের হাতে। তাঁদের মধ্যে দ্বিতীয় খলিফা ওমর ফারুক, তৃতীয় খলিফা
ওসমান গণি, চতুর্থ খলিফা আলি ও খলিফা দ্বিতীয় ওমরের নাম উল্লেখযোগ্য। তবে তাঁদের কথা
সাধারণ মানুষ, এমনকি মুসলমানরাও
বিশেষ জানেন না। অথচ হোসেনের নিহত হওয়ার
কথা মুসলমানরা সবাই জানে। এজিদকে খলিফা পদ
থেকে সরিয়ে
কিংবা হত্যা করে তাঁর ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার জন্য কারবালার প্রান্তরে যে উক্ত ঘটনাটি ঘটেছে এবং তাতে হোসেনের মৃত্যু হয়েছে সে কথা স্বীকার করে নিয়েও মুসলিম ঐতিহাসিকগণ তাঁদের লেখা ইতিহাস গ্রন্থগুলিতে হোসেনকে অন্য মর্যাদা ও সম্মান প্রদান করেছেন। তাঁরা বলেছেন যে নিছক
ক্ষমতা লাভের জন্যে নয়, হোসেন প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন একটা আদর্শের জন্যে, ইসলামকে
পাপিষ্ঠ এজিদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। এই ইতিহাসগুলি যেটা দাবী করে তা হলো মাবিয়া অন্ধ পুত্রস্নেহে ইসলামি আদর্শ থেকে বিচ্যুত
হয়ে তাঁর অযোগ্য ও উচ্ছৃঙ্খল পুত্র এজিদকে খলিফার
সিংহাসনে বসানোর জন্যেই কারবালার যুদ্ধ হয়েছে, নচেৎ হতো না। কোনো কোনো ঐতিহাসিক একটু অন্য সুরে সে কথা বলেছেন।
তাঁরা লিখেছেন যে, এজিদ তাঁর
পিতার উপর চাপ সৃষ্টি করে তাঁকে বাধ্য করেছিলেন তাঁকে (এজিদ) খলিফা মনোনীত করতে। এই ইতিহাসগুলি আবার এমনটাও বলে যে কারবালা প্রান্তরে যুদ্ধটা
এড়ানো যেত, কিন্তু হোসেনকে হত্যা করবেন বলেই যুদ্ধটা হোসেনের উপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন এজিদ। সুতরাং কারবালার
যুদ্ধ বা বিদ্রোহের জন্য
সম্পূর্ণ দায়ী এজিদই। মূল কথা হলো কারবালা যুদ্ধের জন্যে দায়ী ছিলেন মাবিয়া এবং
তাঁর পুত্র এজিদই, আর হোসেন ছিলেন সম্পূর্ণ নির্দোষ – এই হলো সমস্ত ইতিহাসের মূল্যায়ন।
কিন্তু ইতিহাসের এই মূল্যায়ন মোটেই যথার্থ নয়। এই ইতিহাস যাঁরা
লিখেছেন এবং আজও লিখে চলেছেন
তাঁরা একপেশে, অর্ধ সত্য, বিকৃত এবং অসত্য
ইতিহাস লিখেছেন ও লিখে চলেছেন। আমরা ইতিহাসের
পাতা থেকে কারবালার ঘটনাবলী
এবং তৎসংক্রান্ত যে সব তথ্য হাতে পেয়েছি সেগুলির
নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করলে মূল্যায়নটা অন্য রকম দাঁড়ায়। এই অধ্যায়ে আলচোনা তা নিয়েই।
কারবালা যুদ্ধের প্রধান হোতা বলা হয়েছে
মাবিয়াকে কেন? তাঁর বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগগুলি হলো – তিনি পরবর্তী খলিফা মনোনয়নের
ক্ষেত্রে ইসলামি নীতি ও পদ্ধতি লঙ্ঘন করেছেন, খেলাফতের ন্যায্য উত্তরাধিকার থেকে
ইমাম হোসেনকে বঞ্চিত করেছেন এবং নিজের অযোগ্য পুত্রকে খলিফা মনোনীত করেছেন। কিন্তু আমরা
ইতিহাসের পাতা থেকে যে সব তথ্য পেয়েছি তা থেকে এটা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে খলিফা মনোনয়ন বা
নির্বাচনের ব্যাপারে ইসলামে কোনো নীতিই ছিল না। এ বিষয়ে উপরে
বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং খলিফা নির্বাচনে ইসলামি নীতি লঙ্ঘনের
অভিযোগ ভিত্তিহীন। দ্বিতীয় অভিযোগ – হোসেনই ছিলেন খলিফা হওয়ার একমাত্র
ন্যায্য উত্তরাধিকার, তাঁকে সেই উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিলো। এখানে যে প্রশ্নটি ওঠে তা হলো, হোসেন কি
সত্যিই খেলাফতের ন্যায্য উত্তরাধিকারী ছিলেন? একদম না। কারণ, খেলাফতের উত্তরাধিকার তত্ত্বে
বিশ্বাস করে শুধুমাত্র শিয়া সম্প্রদায়। তাঁরা বিশ্বাস করেন যে ইসলামি
রাষ্ট্রের খলিফা পদটি সংরক্ষিত কেবল শেষ নবীর বংশধরদের জন্যেই, এটাই আল্লাহর বিধান। তাই তাঁরা আলির
আগে যাঁরা খলিফা হয়েছেন তাঁদের প্রকৃত খলিফা বলে স্বীকার করেন না। কিন্তু সুন্নী সম্প্রদায় এই তত্ত্বকে অনৈসলামিক
বলে প্রত্যাখান করেছেন। কোরান হাদিসেও কোথাও উল্লেখ নেই যে নবীর
বংশধরদের ভিতর
থেকেই কাউকে খলিফা করতে হবে। বরং হাদিসে উল্লেখ আছে যে, মুহাম্মদ বলে গেছেন যে নবী
ও রাসুলদের উত্তরাধিকার হয় না। সুতরাং এই
দাবীটিও অযৌক্তিক যে হোসেন ছিলেন খেলাফতের ন্যায্য উত্তরাধিকার। সুন্নী মুসলমানরা
তাই অন্যভাবে দাবী
করেন যে মাবিয়া পরবর্তী খলিফার প্রশ্নে হোসেনই একমাত্র ন্যায্য দাবীদার ছিলেন। তাঁরা
বিশ্বাস করেন যে, মাবিয়া ও হাসানের মধ্যে চুক্তি হয়েছিল মাবিয়ার পর হোসেনকে খলিফা
করতে হবে। এই বিষয়ে উপরে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে আমরা দেখেছি যে
পরিস্থিতিতে ও যে সব কারণে ইমাম হাসান খেলাফত থেকে ইস্তফা দেন তাতে তাঁর পক্ষে ঐ রকম
শর্ত আরোপ করার শক্তি ও সাহস তাঁর ছিল না। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায় যে ঐ রকম একটা অনুরোধ হাসান
রেখেছিলেন এবং মাবিয়া তাতে সম্মতি প্রদান করেছিলেন, তবুও এটা আমাদের বিবেচনায় রাখা
প্রয়োজন যে সেই চুক্তি সম্পাদনের কুড়ি বছর পর তা রূপায়ণ করার অনুকূল পরিস্থিতি
বিরাজমান ছিল কিনা। সে রকম পরিস্থিতি যে মোটেই বিরাজমান ছিল না, সেটা উপরের
আলোচনায় আমরা স্পষ্ট রূপে বুঝেছি। আর
এটাও দেখেছি যে তার জন্যে স্বয়ং হোসেনই
দায়ী ছিলেন, মাবিয়া নয়। যে খলিফার কাছে আমি দাবী করব বা আশা যে তিনি আমাকে
তাঁর পরে খলিফা মনোনীত
করবেন, অথচ সর্বদা তাঁর সঙ্গে শত্রুতামূলক আচরণ করেই যাবো, আর তারপরেও রিনি আমাকে খলিফা মনোনীত করবেন, তা হয় না, এটা বড্ড ছেলেমানুষী আবদার। আমি খলিফা পদে বসবার স্বপ্ন দেখব,
কিন্তু তার যোগ্য হয়ে ওঠার প্রয়াস করবো না, তারপরেও বলবো যে আমাকেই খলিফা করতে
হবে - এও শিশুসুলভ আবদার। সুতরাং হাসানের সঙ্গে সম্পাদন করা
চুক্তি মাবিয়া লঙ্ঘন করেছিলেন এই অভিযোগটি সারবত্তাহীন। তৃতীয় অভিযোগ হলো এজিদ ছিলেন নানান
দোষে দুষ্ট ও খলিফা পদে অযোগ্য ব্যক্তি। যাঁরা এই অভিযোগ
উত্থাপন করেছেন তাঁরা তাঁদের অভিযোগের সমর্থনে বিশ্বাসযোগ্য কোনো প্রমাণ উপস্থাপিত
করতে সক্ষন হন নি। অপরদিকে অনেক ঐতিহাসিক এজিদকে সুশিক্ষিত, সাহিত্যানুরাগী, প্রখর বাগ্মী,
উদারচেতা এবং রাজোচিত গুণাবলী সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব বলে বর্ণণা করেছেন। সুতরাং এজিদ
অযোগ্য এই অভিযোগের মধ্যে যেমন কোনো প্রকার সত্যতা নেই, তেমনই মাবিয়া নিজের পুত্র বলে একজন
অযোগ্য ব্যক্তিকে খলিফার সিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছেন এই অভিযোগটিও পক্ষপাতদুষ্ট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বৈ নয়।
হোসেন একটা আদর্শকে রক্ষা করতে গিয়ে,
ইসলামের পতাকাকে উর্দ্ধ্বে তুলে ধরতে গিয়ে
কারবালা প্রান্তরে এজিদের সৈন্যদের হাতে শাহাদাত বরণ করেছিলেন (আত্মত্যাগ করেছিলেন)
- এই দাবীর পশ্চাতেও গ্রহণযোগ্য কোনো
যুক্তি ও প্রমাণ পাওয়া যায় না, যা পাওয়া যা তা কেবলই নবীর বংশের প্রতি অন্ধ আবেগ ও আনুগত্য। এটা কখনোই পরিলক্ষিত হয় নি যে, এজিদ খলিফা হওয়ার পূর্বে বা পরে কোনো সময়েই
ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করেছিলেন, কিংবা মুহাম্মদ ও তাঁর নবুয়তকে অস্বীকার করেছিলেন। উলটে এজিদ খলিফা মনোনীত হতে যাচ্ছেন এ
কথা শোনা মাত্রই হোসেন তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। এমনটা মোটেই ঘটেনি যে এজিদ খলিফা হয়ে ইসলামি
সাম্রাজ্যকে এমনভাবে পরিচালনা করতে শুরু করেছিলেন যা দেখে হোসেনের মনে হয়েছিলো যে আল্লাহ,
মুহাম্মদ ও ইসলামের অবমাননা হচ্ছে এবং তা দেখে একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসাবে তিনি নিজেকে স্থির রাখতে পারেন নি এবং তার ফলে তিনি ইসলামকে বাঁচানোর
অভিপ্রায়ে এজিদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন। এমনটা হলে নিশ্চয় এটা প্রতীয়মান হতো
যে, হোসেন ইসলামকে রক্ষা করতে গিয়ে নির্দ্বিধায় একজন প্রকৃত বীরের মত নিজের প্রাণ
হাসতে হাসতে বিসর্জন দিয়েছেন। কিন্তু এ রকমটা মোটেই ঘটেনি। সুতরাং এ বিষয়ে সংশয়ের তিলমাত্র অবকাশ নেই যে
কোনো আদর্শ বা বৃহত্তর কোনো স্বার্থ নয়, সম্পূর্ণ ক্ষমতার লোভেই ইমাম হোসেন এজিদকে খলিফা হিসাবে মেনে নিতে
পারেন নি।
খলিফা হওয়ার দুর্দমনীয় আকাঙ্খা ও লোভই তাঁকে মক্কা থেকে কারবালা প্রান্তরে টেনে
নিয়ে গিয়েছিল। তাই দেখা যাচ্ছে যে,
মোটের উপর এটাই হলো ইতিহাসের সঠিক মূল্যায়ন যে কারবালা প্রান্তরে হোসেনের অকাল
মৃত্যুর কবলে পড়ার মধ্যে আত্মত্যাগের আদর্শের কণা মাত্র ছিলো না, যা ছিলো তা হলো
শুধু খলিফা হওয়ার তীব্র লোভ ও লালসা।
হোসেনের মধ্যে খলিফা হওয়ার যে তীব্র
আকাঙ্খা ও লোভের সঞ্চার হয়েছিল তারজন্য অবশ্য তাঁকে একা দায়ী
করা যায় না। কারণ
তাঁর মধ্যে এই ধারণাটা তৈরী করে দেওয়া হয়েছিল যে মাবিয়ার পর একমাত্র তিনিই খলিফা পদের ন্যায্য
দাবিদার। তিনি ন্যাযি দাবীদার কারণ তিনি মুহাম্মদের বংশধর, সুতরাং
উত্তরাধিকার সূত্রেই মুহাম্মদের স্থাপন করা ইসলামি রাষ্ট্রের খলিফার পদটি শুধু
তাঁরই প্রাপ্য। কিন্তু সুন্নি সম্প্রদায়ের মতে তাঁর এই ধারণাটি সম্পূর্ণই ভ্রান্ত। তাদের বক্তব্য হলো কোরানে এমন কোনো
কথা বলা নেই, এবং মহাম্মদ কখনো নিজে এমন কথা বলেন নি। বরং তিনি
তাঁর জীবদ্দশায় এ কথাটাই স্পষ্ট করে ব্যক্ত করে যান যে নবী ও রসুলদের কোনো
উত্তরাধিকার হয় না। তিনি এ কথা বলে গিয়েছিলেন বলেই তাঁর মৃত্যুর পর প্রথম খলিফা
নির্বাচিত হন আবু বকর। মুহাম্মদের বংশধরদের পক্ষ থেকেই খলিফা
নির্বাচিত করতে হবে এমন কথা কোরানে লেখা থাকলে, কিংবা মুহাম্মদ স্বয়ং এমন কথা বলে
গেলে প্রথম খলিফা নির্বাচনে যে প্রবল কলহ ও গন্ডোগোল হয়েছিল তা হতো না, বিনা বাক্য
ব্যায়েই প্রথম খলিফা নির্বাচিত হতেন আলি। এখন প্রশ্ন হলে
তা হলে হোসেনের
মধ্যে এত বড় একটা ভ্রান্ত ধারণা কীভাবে তৈরী হয়েছিল। এই ভ্রান্ত
ধারণাটি হোসেন
উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছিলেন। তাঁর বাবা ও মা’র মধ্যে এই ভ্রান্ত ধারণাটি ছিল। সেই ভ্রান্ত
ধারণার বশবর্তী হয়েই
তো আলি ও বিবি ফাতেমা আবু বকরকে খলিফা মেনে নিতে পারেন নি। এবং তাঁরা সরাসরি আবু বকরের মুখের সামনেই অভিযোগ
করেছিলেন যে তাঁরা সবাই মিলে ক্ষমতার লোভে
চক্রান্ত করে আলিকে খলিফা পদ থেকে বঞ্চিত করেছেন এবং ঘরের দরজা থেকে আবু বকর ও ওমর
ফারুককে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে ফাতেমা মৃত্যুর দিন
পর্যন্ত আবু বকরকে ইসলামের প্রকৃত খলিফা বলে স্বীকৃতি প্রদান করে যান নি। আর আলিও আবু বকরের হাতে বয়াত গ্রহণ করেছিলেন ফাতেমার মৃত্যু পর। তিনি অবশ্য আন্তরিকভাবে বয়াত নেন নি নিয়েছিলেন আবু বকরকে সন্তুষ্ট করার জন্যে যাতে
তিনি মৃত্যুর আগে তাঁকে(আলিকে) পরবর্তী খলিফা মনোনীত করে যান। আলি আবু বকরের
কাছে বয়াত শুধু এজন্যেই নিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর মধ্যে এ ধারণা থেকেই গিয়েছিল যে মুহাম্মদের বংশধর
হিসাবে তিনিই ছিলেন খলিফা পদের ন্যায্য দাবীদার, আবু বকর চক্রান্ত করে তাঁকে তাঁর
ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন। আলি ও ফাতেমার এই
ভ্রান্ত ধারণাটি
ক্রমে সঞ্চারিত হয়েছিল হোসেনের মধ্যে। সুতরাং কারবালা
প্রান্তরে যে হৃদয়-বিদারক
বিয়োগান্ত কান্ডটি ঘটেছিল তারজন্যে আলি ও বিবি ফাতেমাও পরোক্ষভাবে কিয়দংশে দায়ী। তাঁদের ক্ষমতার প্রতি তীব্র যে লোভ ছিল সেটাই
কারবালার যুদ্ধের বীজ পুঁতে দিয়েছিল যেটা ওসমানের বিদ্রোহীদের রক্তমাখা হাত ধরে
খলিফার সিংহাসনে আলির আরোহণের ঘটনার মধ্যে দিয়ে মহিরূহে পরিণত হয়েছিল।
ইতিহাসের বিকৃতি প্রসঙ্গে
কোনো ইতিহাসই বোধ হয় সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ
রূপে লেখা হয় নি, হয় না। তাই সমস্ত ইতিহাসেই কিছু না কিছু পক্ষপাতিত্ব পরিলক্ষিত হয়। এমনও উদাহরণ রয়েছে যে শুধু পক্ষপাতিত্বই নয়, ইতিহাসকে
অনেকাংশে বিকৃতও করা হয়েছে। কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে, বিশেষ করে তৃতীয় খলিফা ওসমানের
বিরুদ্ধে বিদ্রোহ থেকে শুরু করে কারবালা যুদ্ধ পর্যন্ত ইতিহাসের ক্ষেত্রে যে
মাত্রায় ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে তার নজির পাওয়া ভার। আরও বিশেষ করে যেখানে আলি ও মাবিয়া এবং ইমাম হোসেন ও
এজিদের কথা রয়েছে সেখানে ইতিহাস লিখনের পরতে পরতে একেবারে নজিরবিহীন নগ্ন পক্ষপাতিত্ব
ও বিকৃতি পরিলক্ষিত হয়। মাবিয়া মানুষ হিসেবে ছিলেন অতিশয় নির্মল চরিত্রের
মানুষ এবং খলিফা হিসাবে ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ ও যোগ্য। ফলে তিনি ইসলামি সাম্রাজ্যকে একটি
বিশৃঙ্খল ও অরাজক পরিস্থিতির হাত থেকে উদ্ধার করে একটি সুশৃঙ্খল ও সুসংহত ইসলামি
সাম্রাজ্য উপহার দিয়ে যেতে পেরেছিলেন – এ কথা স্বীকার করেও মুসলিম ঐতিহাসিকগণ তাঁকে
ধূর্ত, অসৎ, ক্ষমতালোভী, প্রতারক, ঘাতক, ইসলাম চিরশত্রু প্রভৃতি কুবিশেষণে বিদ্ধ
করেছেন। অপরদিকে
আলী খলিফা হয়েছিলেন ওসমানের হত্যাকারীদের সমর্থনে এবং সেই হত্যাকারীদেরই ক্ষমতার
অংশীদার করেছিলেন এ কথা স্বীকার করেও মুসলিম ঐতিহাসিকগণ ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ
ও তাঁকে হত্যার ঘটনায় আলিকে সম্পূর্ণ নির্দোষ বলে ঢালাও শংসাপত্র প্রদান করেছেন। অপরদিকে গায়ের জোরে খলিফা হওয়ার উগ্র
বাসনায় ৬ষ্ঠ বৈধ খলিফা এজিদের বিরুদ্ধে অনৈতিক বিদ্রোহ করাকে একটি মহান আদর্শের জন্য একটি মহান
আত্মত্যাগ বলে বর্ণণা করেছেন। আবার অকারণে এজিদের চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করে এবং তাঁর খেলাফত
প্রাপ্তিকে অনৈসলামিক ও অবৈধ বলে তীব্র সমালোচনা করেছেন। বিশ্বের তামাম মুসলিম ঐতিহাসিকরা
কারবালা যুদ্ধ নিয়ে এই যে এত নগ্ন পক্ষপাতিত্বপূর্ণ ও বিকৃত ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে
গেছেন এবং এখনো সমানে করে চলেছেন তা আমাকে
শুধু চরম বিষ্মিতই করে না, আমাকে প্রবলভাবে ভাবায়ও। কারবালা যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে
কেনো এমন নজিরবিহীন নির্লজ্জ মিথ্যাচার? আমাকে ভাবায় এই প্রশ্নটি। আমার মনে
হয়, এর
পশ্চাতে একটা মাত্রই কারণ কাজ করেছে এবং করে, তাহলো, মুহাম্মদের বংশধরদের প্রতি
অন্ধ আবেগ ও আনুগত্য। এহেন আবেগ ও আনুগত্যই সম্ভবত মুসলিম ঐতিহাসিকদের মুক্ত বিচার-বুদ্ধি-বিবেচনা,
ন্যায়-অন্যায়, ঠিক-বেঠিক, নৈতিক-অনৈতিক ও মানবতা-মনুষ্যত্ত্ব বোধগুলি সম্পূর্ণ
রূপেই বিনষ্ট করে দিয়েছে। কিন্তু তার পরেও প্রশ্ন থেকে যায় – মুহাম্মদ ও তাঁর
বংশধরদের প্রতিই বা কেন এত অন্ধ আবেগ ও আনুগত্য দ্বারা মুসলমান ঐতিহাসিকগণ
পরিচালিত হবেন যা তাঁদের সমস্ত উচ্চ মূল্যবোধগুলি নষ্ট করে দিতে সক্ষম হয়? এর রহস্য কোথায় নিহিত রয়েছে? সেটা কি
জাহান্নামের আগুনের ভয়ে? মুহাম্মদ ও তাঁর
বংশধরদের সমালোচনা করলে আল্লাহ ভীষণ রুষ্ট হবে এবং তাদের নিক্ষেপ করবে জাহান্নামের তীক্ষ্ণ আগুনে –
এই ভয়ে? এ ছাড়া আর কিছু কী হতে পারে?