Thursday, July 14, 2022

তিউনিসিয়ার সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিদায় আসন্ন

 Create Custom Tunisia Map Chart with Online, Free Map Maker.

আগামী ২৫শে জুলাই তিউনিসিয়ায় অনুষ্ঠিত হতে চলেছে গণভোট। গণভোট হবে নতুন একটি সংবিধান গ্রহণ করার জন্যে। সংবিধান প্রণয়ন কমিটি ইতিমধ্যেই নতুন সংবিধানের খসড়া তিউনিসিয়ার রাষ্ট্রপতি কায়েস সায়েদের হাতে তুলে দিয়েছে। সে কথা নিশ্চিত করেছেন রাষ্ট্রপতি স্বয়ংনতুন সংবিধানটি ২০১৪ সালে  প্রণীত সংবিধানটির স্থান নেবে।  

রাষ্ট্রপতি কায়েস সায়েদ জানিয়েছেন যে নতুন সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকবে না। তিউনিসিয়া রাষ্ট্রের মালিক হবে তিউনিসিয়ার জনগণ যাদের ধর্ম ইসলাম। কেন সংবিধান থেকে রাষ্ট্রের ধর্ম পরিচয়কে মুছে দেওয়া হচ্ছে সে প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন যে, জাতি ও রাষ্ট্র দুটো ভিন্ন জিনিষ। অর্থাৎ মানুষের ধর্ম থাকতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম হয় না। এ কথাগুলি তিনি বলেছেন গত একুশে জুন টিউনিস বিমানবন্দরে সংবাদ সংস্থা এএফপিকে। তিনি ঠিক কী বলেছেন তা ‘দি হিন্দু’ পত্রিকা উদ্ধৃত করে লিখেছে,   

·         Tunisian President Kais Saied confirmed that "The next constitution of Tunisia won't mention a state with Islam as its religion, but of belonging to an umma (community) which has Islam as its religion," he told journalists at Tunis airport. ... "The umma and the state are two different things."  

(সূত্রঃ - https://www.thehindu.com/news/international/tunisias-saied-confirms-no-state-religion-in-new-charter/article65549523.ece)

 

সংবিধান প্রণয়ন কমিটির (ন্যাশনাল কনসালটিভে কমিশন) সমন্বায়ক সাদেক বিলায়েত নিউজ এজেন্সি এএফপিকে এ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন যে, সংবিধানে ইসলাম ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়ে যা যা আছে তার সব কিছুই মুছে ফেলা হবে। সাদেক বিলায়েতকে উদ্ধৃত করে এ প্রসঙ্গে  ‘দি হিন্দু’ লিখেছে, –

·         Sadeq Belaid, the legal expert who headed the drafting committee, had told AFP in an interview this month that he would remove all reference to Islam from the new document in a challenge to Islamist parties.  (সূত্রঃঐ)

তিউনিসিয়া হলো সেই রাষ্ট্র যেখানে ২০১১ সালে আরব বসন্তের (আরব ভূখণ্ডের বিভিন্ন প্রান্তে স্বৈরতান্ত্রিক শাসকদের বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহ) সূত্রপাত হয়েছিলো এবং পরে তা বিভিন্ন রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়েছিলো। আরব বসন্তের ধাক্কায় শাসন ক্ষমতায় পট পরিবর্তন হয়েছিলো আরবের কয়েকটি রাষ্ট্রে। পট পরিবর্তন হয়েছিলো তিউনিসিয়াতেও। দীর্ঘদিনের স্বৈরতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট জাইন আল আবিদিন বেন আলি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তারপর তিউনিসিয়াতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো একটা সীমিত স্তর পর্যন্ত গণতন্ত্র তাই তিউনিসিয়াকেই একমাত্র আরব বসন্তের সাফল্য হিসাবে দেখা হয়। কারণ, আরব বসন্তের মূল দাবি ছিলো স্বৈরতান্ত্রিক শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। আরব বসন্তের পর তিউনিসিয়ায় যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হয় তা হলো রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রাধীন সংসদীয় ব্যবস্থা। সেই ব্যবস্থায় সরাসরি রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচিত হয় জনগণের ভোটে। শুধু অবাধে ভোট দিয়ে রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচন করার অধিকারই সংবিধানে স্বীকৃত হয় নি, স্বীকৃতি পেয়েছিলো সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখানোর অধিকারকেও।    

সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও তিউনিসিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতা তিউনিসিয়ার ছায়াসঙ্গী হয়ে ওঠে। এর জন্যে নব্য চালু হওয়া সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে দায়ী করা যায় না। অস্থিরতার মূল কারণ হলো, আরব বিপ্লবের পর যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলো তারা জনগণকে দেওয়া  প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছিলো। সেই অস্থিরতা একটা সময় এমন পর্যায়ে চলে যায় যে স্বৈরাচারী শাসক জাইন আল আবিদিন বেন আলি উৎখাত হবার পর থেকে তিউনিসিয়ায় নয়টি সরকারের পরিবর্তন হয়েছে। কোনো দলই স্থায়ী সরকার দিতে পারে নি। তার মধ্যে কোনো কোনো সরকারের আয়ু ছিল মাত্র কয়েক মাস।

২০১৯ সালের নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে সাংবিধানিক আইনের অধ্যাপক কায়েস সায়েদ যিনি ছিলেন একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি ৭২% ভোট পেয়ে নির্বাচিত হলেও সংসদে কোনো দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় নি। ফলে একটা কোয়ালিশন সরকার তৈরি হয় যার নেতৃতে ছিলো মুসলিম মৌলবাদী দল আননাহদা। সেই সরকারে যোগ দিয়েছিলো কয়েকটি গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ দলও। সেই দলগুলির সমর্থন নেওয়ার জন্যে আননাহদা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো যে তারা তিউনিসিয়ায় শরিয়ত আইন প্রবর্তন করা থেকে বিরত থাকবে এবং জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করবে। কিন্তু ক্ষমতায় বসার পর আননাহদা যথারীতি কথার খেলাপ করে ইসলামি সন্ত্রাসবাদী দল মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে সম্পর্ক অব্যাহত রাখে এবং একের পর এক জনস্বার্থবিরোধী কাজ চালিয়ে যায়। ফলে তারা তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থা হয়। জনগণ তাই সরকারের বিরুদ্ধে আবার আন্দোলন করতে পথে নামতে বাধ্য হয়। গণ-আন্দোলন এত তীব্র হয়ে ওঠে যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এলিয়েস ফাখফাখ মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় (২০২০ সালের জুলাই মাসে) পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। রাষ্ট্রপতি সায়েদ তখন আননাহদা পার্টির আর এক নেতা মি. মেচিচিকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন।

মি. মেচিচির সরকারের শাসনেও পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত থাকে। দেশের আর্থিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ আরও গভীর সংকটে ডুবে যেতে থাকে।  ২০২০ সালে দেখা যায় যে অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে ন’ শতাংশ (৯%)। বেকারি পৌঁছে যায় আঠারো শতাংশে (১৮%)। আর সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২০ এর শেষে যুবদের মধ্যে বেকারত্বের হার পৌঁছে যায় ছত্রিশ শতাংশে (৩৬%)। অন্য দিকে কোভিড পরিস্থিতি গোটা দেশ জুড়ে ভয়ংকর চেহারা নেয়। গভীর অর্থনৈতিক সংকট, তীব্র বেকারি ও ভয়াবহ কোভিড পরিস্থিতি – ত্রিবিধ এই ভয়াবহ সংকট মোকাবিলায় মেচিচি সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। ফলে ব্যাপক সংখ্যায় জনগণ আবার রাস্তায় নামে এবং বিক্ষোভে সামিল। বিক্ষোভ বহু শহরে সহিংস হয়ে ওঠে। পুলিশ ও বিক্ষুব্ধ মানুষের সঙ্গে দিকে দিকে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে থাকে। ক্ষুব্ধ জনতা ক্ষমতাসীন আননাহদা পার্টির অফিসে হামলা চালিয়ে কম্পিউটার ভেঙে ফেলে এবং তুজেউর শহরে দলটির স্থানীয় সদর দফতরে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরিস্থিতি ক্রমশ হাতের বাইরে চলে যেতে থাকে। রাষ্ট্রপতি তখন (২০২১ সালের ২৫শে জুলাই) প্রধানমন্ত্রী মেচিচিকে বরখাস্ত এবং সংসদ স্থগিত করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।

রাষ্ট্রপতির কড়া পদক্ষেপকে (প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত ও সংসদ স্থগিত করা) বিরোধী পক্ষ, বিশেষ করে মুসলিম মৌলবাদী দল আননাহদা বিপজ্জনক অভ্যুত্থান বলে অভিহিত করে। তারা তীব্র বিরোধিতা শুরু করে রাষ্ট্রপতির প্রস্তাবিত সংবিধানের। একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করার পদক্ষেপকে তারা আরব বসন্ত এবং সংবিধানের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা বলে অভিহিত করেছে। তারা জনগণকে এ কথা বলে বিভ্রান্ত করতে চায়ছে যে, রাষ্ট্রপতি কায়েস সায়েদ নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্যে ২০১৪ সালের সংবিধান বাতিল করার উদ্যোগ নিয়েছেন যার ফলে তিউনিসিয়ার গণতান্ত্র ভূলুণ্ঠিত হবে।

রাষ্ট্রপতি কায়েস সায়েদ বিরোধিদের সমস্ত অভিযোগ খণ্ডন করেছেন। সংবিধান উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন যে, দেশ জুড়ে যে ব্যাপক হিংসাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিলো সেটা নিয়ন্ত্রণে আনতে তাকে কিছু ব্যবস্থা নিতে হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করা সহ সংসদ স্থগিত করা তারই অংশ বিশেষ। তিনি তিউনিসিয়ার জনগণকে এই বলে আশ্বস্ত করেছেন যে, প্রস্তাবিত সংবিধান তিউনিসিয়ার মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার একটু খর্ব করবে না, বরং তা আরও সম্প্রসারিত ও সুরক্ষিত করবে এবং তিউনিসিয়াকে উদ্ভূত অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্ত করবে।

প্রস্তাবিত সংবিধানকে আটকাতে ২৫শে জুলাইয়ের গণভোটকে বাঞ্চাল করতে হিংসাত্মক আন্দোলনের পথে যেতে পারে এমন আশঙ্কা রয়েছে। রাষ্ট্রপতি এ বিষয়ে কড়া বার্তা দিয়েছেন বিরোধিদের উদ্দেশ্যে। তিনি বলেছেন, "আমি সতর্ক করে দিতে চাই কেউ যদি অস্ত্র হাতে নেওয়ার কথা চিন্তা করে..কেউ যদি একটা বুলেটও ছোঁড়ে..তাহলে সশস্ত্র বাহিনী গুলি করেই তার জবাব দেবে,"  (সূত্রঃ https://www.bbc.com/bengali/news-57966333 )

প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত এবং সংসদ স্থগিত করার ঘটনা ঘটেছে হয়েছে প্রায় এক বছর আগে। তারপর  এই এক বছরে মুসলিম মৌলবাদী দল আননাহদা সহ সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো কখনো ধর্মের নামে, কখনো গণতন্ত্রের নামে রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টার ত্রুটি কম করে নি। তথাপি তিউনসিয়ার পরিস্থিতি এখনও শান্তিপূর্ণ রয়েছে। এটা প্রমাণ করে যে তিউনিসিয়ার জনগণ রাষ্ট্রপতির পক্ষেই রয়েছে এবং বিরোধিদের প্রত্যাখান করেছে। এর অর্থ দাঁড়ায় যে জনগণও প্রস্তাবিত সংবিধানকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত।  তারা বুঝেছে কোভিডের অতিমারি, বিপর্যস্ত অর্থনীতি ও ভয়ঙ্কর বেকারত্বের হাত থেকে তিউনিসিয়াকে বাঁচাতে যদি হয় তাহলে একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দেশ নির্মাণ করতে হবে, ইসলামি আইন ও আবেগ দিয়ে তা কখনই সম্ভব নয়।  

আরবের ছোট একটি দেশ তিউনিসিয়া যার জনসংখ্যা বারো মিলিয়ন (এক কোটি কুড়ি লক্ষ) মাত্র। জনসংখ্যার নিরানব্বই শতাইংশই (৯৯%) মুসলমান। সেই তিউনিসিয়ার বর্তমান সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে মনে হচ্ছে যে, মুসলিম অধ্যুষিত এই দেশটি অচিরেই (আগামী ২৫শে জুলাই) গ্রহণ করতে যাচ্ছে ধর্মীয় প্রভাব মুক্ত একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক সংবিধান। তা যদি হয় তাহলে সেটা হবে একটি সুদূরপ্রসারী ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী ঘটনা যা আরবের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে খোদিত হয়ে থাকবে এবং একই সঙ্গে সূচনা করবে দ্বিতীয় আরব বসন্তের যা মুসলিম বিশ্বের ধর্মাশ্রিত ভিতকে নাড়িয়ে দেবে প্রবলভাবে।

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...