বাংলাদেশকে
স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে যে মূল্য দিতে হয়েছে তা বিশ্বের ইতিহাসে খুব কম দেখা গেছে
। শুধু শহীদের মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে ত্রিশ লক্ষ মানুষকে এবং তিন লক্ষাধিক নারীকে
বিসর্জন দিতে হয়েছে তাঁদের সম্ভ্রম । এর বাইরে আরও কত যে ক্ষতি ও ত্যাগ স্বীকার
করতে হয়েছে তার হিসাব পরমাপ করা মানুষের সাধ্যের অতীত । এত মৃত্যু, এত রক্তপাত, এত
বলাৎকার ও এত ক্ষয়ক্ষতি করার শক্তি পাক সেনাদের ছিল না । এটা সম্ভব করে তুলেছিল
স্থানীয় ধর্মান্ধ হিংস্র ও বর্বর মুসলিম মৌলবাদীরা । স্থানীয় এই বর্বর পশুগুলো ছিল
রাজাকার, আল- বদর ও আল –শামস এর সদস্যরা । এই তিনটি হিংস্র সংগঠন তৈরী করেছিল জামাতি
ইসলাম । বর্তামান বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধী অধ্যাপক গোলাম আযম ছিল তখন তৎকালীন পুড়ড়বো
পাকিস্তানের জামাতি ইসলামের আমির তথা প্রধান নেতা । জামাতের নেতারা মুক্তিযোদ্ধা ও
মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের আল্লাহ ও মুসলমানদের চরম শত্রু আখ্যা দিয়ে নৃশংস গণহত্যা
ও ধ্বংসযজ্ঞ সংগঠিত এক হাতে কোরান ও আর এক হাতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ।
স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের আশু প্রধান কর্তব্য
ছিল এই সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার করে চরম শাস্তি প্রদান করা । বিচার প্রক্রিয়া শুরুও
হয়েছিল । কিন্তু ঐ মৌলবাদীরাই সে প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়েছিল মুজিবর রহমানকে হত্যা
করে । সেই জঘন্য ও নৃশংস হত্যাকান্ডের সঙ্গে ছিল প্রাক্তন সামরিক রাষ্ট্রপতি
জিয়াউর রহমানও । তিনিই পরে ক্ষমতা দখল করে
আইন প্রণয়ন করে যুদ্ধ প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়ে প্রায় ৬৫ হাজার রাজাকারকে জেল থেকে
মুক্ত করে দিয়েছিলেন । সে সময় জামাতের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের আঁতাত ছিল গোপনে ।
মানবতার শত্রু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে চরম
শাস্তি দিতে না পারাটা ছিল বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে এক জাতীয় লজ্জা ও কলঙ্ক । সেই
লজ্জা ও কলঙ্ক থেকে সমগ্র জাতি ও দেশকে মুক্ত করার জন্যে বর্তমান সরকার বিচার
প্রক্রিয়া শুরু করেছে । ইতিমধ্যেই ট্রাইবুনাল তিন জনের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন
করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক রায়ও প্রদান করেছে ।
সাবেক জামাত নেতা বাচ্চু রাজাকারের মৃত্যুদন্ড,
জামাতের শীর্ষনেতা কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং জামাতের আমির মাওলানা
দেলওয়ার হোসেন সাইদির মৃত্যুদন্ড প্রদান করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল ।
কাদের মোল্লার শাস্তির রায় দেশের মানুষ মেনে নিতে পারে নি । তরুণ প্রজন্ম কাদের
মোল্লা সহ সমস্ত রাজাকারের ফাঁসীর দাবীতে আন্দোলনে রাস্তায় নামে যে আন্দোলনে গোটা
দেশ সামিল হয়েছে । এদিকে জামাতি ইসলাম প্রথম থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের
বিরুদ্ধে সরব হয়ে নানাভাবে বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে আসছিল । সেই বাধাদান
হিংস্র ও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে ক্রমশঃ দেলওয়ার হোসেনের মৃত্যুদন্ড হওয়ার পর । দেলওয়ার
হোসেন সহ সমস্ত যুদ্ধাপরাধীদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবীতে গুলি, বোমা ও অগ্নি সংযোগের
মাধ্যমে শুরু করে গোটা দেশ জুড়ে তান্ডব । জামাতের দাবীকে সমর্থন জানিয়ে বিএনপিও
যোগ দেয় এই তান্ডবে । বিএনপি-জামাত জোট হিংসাতাত্মক আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে
উৎখাত করার কর্মসূচী ঘোষণা করে । গোটা দেশ জুড়ে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরী করে
নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটিয়ে তারা
যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করতে চায়ছে ।
যুদ্ধাপরাধীদের
রক্ষা করতে জামাত-বিএনপি জোট একদিকে যেমন সহিংস ও হিংস্র আক্রমণের পথকে হাতিয়ার
করেছে, তারই পাশাপাশি তারা অপপ্রচার ও মিথ্যাচারকেও হাতিয়ার করেছে । এই অপপ্রচার ও
মিথ্যাচারের তাদের প্রধান হাতিয়ার হলো ধর্ম । তারা বলছে যে হাসিনা সরকার
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে দেশ থেকে ইসলাম ধর্মকেই মুছে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে
। মাওলানা দেলওয়ার হোসেন সাইদি সহ মুসলিম সমাজের যে সব ধর্মীয় নেতাদের বিরুদ্ধে
যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রক্রিয়ায় নিয়ে এসেছে তারা সবাই নির্দোষ । বিচারের নামে
প্রহসন করে তাদের ফাঁসী দিয়ে এই সরকার বাংলাদেশ থেকে চিরদিনের জন্যে মুছে দিতে চায়
ইসলাম ধর্ম ও আল্লাহর নামটাই ।
মিথ্যাচারের
তীর শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের দেশপ্রেমিক তরুণ যোদ্ধাদের বিরুদ্ধেও নিক্ষেপিত
হচ্ছে প্রবল বেগে । এমনকি শাহবাগের আন্দোলনকে যাঁরা সমর্থন করছেন তাঁদের দিকেও ।
ওঁরা সবাই নাস্তিক এবং ইসলাম ও মুসলমানের শত্রু । শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ আসলে ইসলাম
খতমের মঞ্চ । শাহবাগের আন্দোলন যদি সফল হয়, তবে বাংলাদেশের ইমাম- মাওলানা-মুফতিদের
সবাইকে একে একে ফাঁসীতে ঝোলানো হবে যাতে মুসলি সমাজ ধর্মীয় নেতৃত্ব শুন্য হয়ে পড়ে
। ফলে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে মুসলমানদের বসবাসের অযোগ্য ,সমস্ত মসজিদ ও মাদ্রাসা ভেঙে
গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে এবং মুসলমানদের ওপর হিন্দুদের আধিপত্য কায়েম হবে ।
মুসলিম
মৌলবাদীরা ঠিক এ রকমই আগাপাশতালা জঘন্য মিথ্যাচার চালিয়েছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ
ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধেও । ঐ একই হীন কৌশল অবলম্বন করেছে এবারেও । হাসিনা,
তাঁর দলের লোকেরা এবং যাঁরা রাজাকারদের ফাঁসী ও জামাতি ইসলামকে নিষিদ্ধ করার
দাবীতে আন্দোলন করছেন তাঁরা সবাই নাস্তিক এবং ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রু , এবং
তাঁরা সকলেই ইসলাম ধর্মকে মুছে দেবার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ও মত্ত - এই অভিযোগগুলি
যে সর্বৈব মিথ্যা তা বলা বাহুল্য । বাংলাদেশের মানুষরা অধিকাংশই ইসলামবিরোধী ও
বিদ্বেষী হয়ে গেছেন – এর চেয়ে অবিশ্বাসযোগ্য আর কিছু হতে পার না । এখন প্রশ্ন হলো
এত জঘন্য ও অবিশ্বাসযোগ্য মিথ্যাচার করে কী লাভ ? এত স্থূল মিথ্যাচারেও কেউ বিভ্রান্ত হয় ?
হয়
। বহু মুসলমান আজও বিভ্রান্ত হয় । কারণ মাওলানা,ইমাম, মুফতি প্রভৃতি ধর্মীয় নেতাদের
প্রতি মুসলি সমাজের রয়েছে গভীর শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস । এই ধর্মীয় নেতারা কাউকে হত্যা
বা কোনো নারীকে ধর্ষণ করতে পারে কিংবা এরূপ কাজের নির্দেশ দিতে পারে তা সাধারণভাবে
তাদের কাছে অবিশ্বাসযোগ্য । বলা বাহুল্য যে এই অগাধ আস্থা অন্ধবিশ্বাস প্রসূত ।
ইসলামে মুসলমানদের প্রতি অমুসলিমদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা এবং তাদের হত্যা করার
বিধান রয়েছে তা খারিজি মাদ্রাসা শিক্ষালাভ করা মাওলানা- মুফতি এবং মাদ্রাসার পড়ুয়া
ব্যতীত খুব কম সংখ্যক মুসলমানই জানে । তাই চার দশক আগে বাংলাদেশে ব্যাপক
হত্যাকান্ড ও ধর্ষণকান্ড সহ যে নৃশংস ও ভয়াবহ অত্যাচার সংগঠিত হয়েছিল তাতে পাক
সেনাদের সঙ্গে মাওলানা-মুফতিরাও ছিল তা বিশ্বাস করা তাদের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন । ঠিক এ জন্যেই আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন
মাওলানা দেলওয়ার হোসেন সাইদি সহ অন্যান্য ধর্মীয় নেতাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা কিংবা
গণধর্ষণকান্ডের অভিযোগকে হাসিনা সরকারের ষড়যন্ত্র বলে বহু মুসলমানকে বিভ্রান্ত করা আজও
সম্ভব ।
সাধারণ
মুসলমানদের কাছে বিশ্বাস করা যতই কঠিন হোক, কিংবা তাদের কাছে এটা যতই পীড়াদায়ক হোক
না কেন , কিন্তু যুদ্ধাপরাধী হিসাবে অভিযুক্ত ও ধৃত মাওলানাদের বিরুদ্ধে আনীত
অভিযোগগুলি যে নির্মম সত্য তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই । কারণ তাদের বিরুদ্ধে
উত্থাপিত প্রায় সকল অভিযোগই আদালতে সত্য প্রমাণিত হয়েছে । সংশ্লিষ্ট বিচারপতিগণ
তাঁদের রায়ের কপিতে সে সব পর্যবেক্ষণ ও প্রমাণাদি যথাযথভাবে নথিভুক্ত করে রেখেছেন
। যে কেউ চায়লেই সে কপিগুলি দেখে নিতে পারেন ।
এই
প্রবন্ধে তিন জন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে প্রদত্ত রায়ে কি কি আছে তা উল্লেখ করার
পরিসর নেই । তাই শুধু কিছুটা আলোকপাত করা হবে দেলওয়ার হোসেন সাইদির রায়ের ওপরেই ।
সেই রায় ঘোষণা করতে গিয়ে বিচারকগণ প্রথমেই বলেন যে তাঁরা মাওলানা দেলওয়ার হোসেন
সাইদির বিচারের রায় ঘোষণা করতে বসেন নি । যার বিচারের রায় ঘোষণা করা হচ্ছে তিনি ৪২
বছর আগে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে গিয়ে যে গণহত্যা সহ বহু মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত
করেছিলেন যাকে মানুষ তখন দেলু রাজাকার বা দ্যেইলা রাজাকার বলে জানত । ঠিক কি
বলেছেন বিচারকগণ তা শোনা যাক, আসন গ্রহণ করার পর বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর
বলেন, বলেন, ‘আমরা আজ (বৃহস্পতিবার) যে রায় দিতে যাচ্ছি, তার আগে দুটো কথা বলতে চাই। ... প্রশ্ন আসতে
পারে, আমরা কি জামায়াতের নায়েবে আমির
বা সাংসদ হিসেবে তাঁর বিচার করছি?
উত্তর, না। আসুন, আমরা ফিরে যাই ৪০ বছর আগে। তখন সাঈদী ৩০ বছরের যুবক ছিলেন। পিরোজপুরের সাউথখালি গ্রামে তাঁর বাড়ি, বিবাহিত ও এক সন্তানের জনক। তখন তিনি
ধর্মীয় বা রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না, সাধারণ মানুষ ছিলেন। গ্রামের লোকেরা তাঁকে
দেলু বলে ডাকত। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি পিরোজপুরের শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি আলিম পাস,
উর্দুতে ভালো কথা বলতে পারতেন। তাই পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে
তাঁর ভালো যোগাযোগ তৈরি হয়।’ বিচারপতি বলেন, ‘তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ,
ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। আমরা সেই ৩০ বছরের যুবকের বিচার করছি, বর্তমানের সাঈদীর বিচার করছি
না। তাঁর বিরুদ্ধে যাঁরা সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাঁরা গ্রামের নিরীহ
লোক, সাধারণ মানুষ। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন ২৮ জন, তাঁর পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন ১৭ জন। এসব সাক্ষ্য পর্যালোচনা করে শুধুমাত্র সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে রায় দেওয়া হচ্ছে।’
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে সাইদির বিরুদ্ধে
২০টি অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল যার মধ্যে ৮টি সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে । এর মধ্যে
দুটি অভিযোগ ( ৮ ও ৯ নং ) হত্যার, দুটি ( ১৪ ও ১৬ নং ) ধর্ষণ এবং একটি ( ১৯ নং )
অভিযোগ ধর্মান্তরকরণের ।
হত্যার
অভিযোগ প্রসঙ্গে ট্রাইবুনাল বলেছে, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের নয়জন
সাক্ষীর (২, ৪, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১ ও ১২ নম্বর)
সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ওই দিন পাকিস্তানি সেনা ও স্থানীয় রাজাকাররা পারেরহাট বন্দরের বাদুরিয়া ও চিথোলিয়া গ্রামের অনেক
বাড়ি লুণ্ঠনের পর আগুন দেয়। সাঈদী ও অন্য রাজাকাররা ঘটনাস্থলে ইব্রাহিম কুট্টি ও মফিজউদ্দিন পসারিকে ধরে রাজাকার ক্যাম্পের দিকে রওনা হন। কিন্তু পথে কুট্টিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আর মফিজউদ্দিনকে ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। তবে রাতে
মফিজউদ্দিন ক্যাম্প থেকে
পালাতে সক্ষম হন। তিনি কুট্টি হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ও রাষ্ট্রপক্ষের সপ্তম সাক্ষী। তাঁর
পুঙ্খানুপুঙ্খ বক্তব্য অবিশ্বাস করার কোনো কারণ
ট্রাইব্যুনাল পাননি। দশম অভিযোগ হলো,
একাত্তরের ২ জুন বিসাবালিকে হত্যা এবং উমেদপুর হিন্দুপাড়ার ২৪টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ। এই অভিযোগের পক্ষে রাষ্ট্রপক্ষে তিন সাক্ষী (১, ৫ ও ৯ নম্বর)
সাক্ষ্য দিয়েছেন। সাক্ষ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, ওই দিন পাকিস্তানি সেনা ও স্থানীয় রাজাকারদের নিয়ে সাঈদী উমেদপুর হিন্দুপাড়ায় লুণ্ঠনের পর প্রায় ২৪টি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন। রাজাকাররা বিসাবালিকে নারকেলগাছের সঙ্গে
বেঁধে নির্যাতন করে, সাঈদীর উসকানিতে পরে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষের পঞ্চম সাক্ষী মাহতাবউদ্দিন হাওলাদার এবং নবম সাক্ষী আলতাব
হোসেন হাওলাদার ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তাঁদের বর্ণনা স্পষ্টতই প্রমাণ করে,
হত্যাকাণ্ড সংঘটনে আসামির সংশ্লিষ্টতা ছিল। অগ্নিসংযোগের ধরনে
বোঝা যায়, এ হামলা ছিল পূর্বপরিকল্পিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে প্রথম হত্যাকান্ডটি
সংঘটিত হয়েছিল একাত্তরের ৮ই মে ।
ধর্ষণের অভিযোগ প্রসঙ্গে ট্রাইবুনাল যা বলেছে, ১৪ নম্বর
অভিযোগ অনুসারে, মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে সাঈদী হোগলাবুনিয়ার হিন্দুপাড়ায় এক নারীকে ধর্ষণ
ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করেন। এ অভিযোগে রাষ্ট্রপক্ষে ১, ৩, ৪ ও ২৩ নম্বর সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। ২৩তম সাক্ষীর সাক্ষ্য ছিল খুবই
গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তাঁর
স্ত্রীকে ধর্ষণের বিষয়ে
দেওয়া সাক্ষ্যে বলেছেন, সাঈদীসহ অন্য রাজাকাররা যখন তাঁর বাড়িতে হামলা চালায়, তখন তিনি বাড়িতে ছিলেন
না। বাড়ি ফিরলে
স্ত্রী জানান, তিনি
ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। কে করেছে জানতে চাইলে
স্ত্রী বলেন, যিনি
তাঁকে (স্বামীকে) ধর্মান্তরিত করেছিল, তিনিই ধর্ষণ করেছেন। সাঈদীর বিরুদ্ধে ১৬ নম্বর
অভিযোগ ছিল—তিন নারীকে অপহরণ করে আটকে রেখে ধর্ষণ। এ অভিযোগের পক্ষে পাওয়া সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ওই তিন নারীকে অপহরণ করার পর যৌন নির্যাতনের ঘটনায় আসামি অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা করেছেন, যা একটি মানবতাবিরোধী অপরাধ।
ধর্মান্তরকরণের
ভয়ঙ্কর অভিযোগ প্রসঙ্গে বিচারপতিরা বলেন, ধর্মান্তরিত করার ১৯তম অভিযোগ অনুসারে, সাঈদী প্রভাব খাটিয়ে পারেরহাটসহ অন্য গ্রামের ১০০-১৫০ হিন্দুকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করেন। এঁরা হলেন: মধুসূদন ঘরামী,
কৃষ্ট সাহা, গণেশ
সাহা, অজিত কুমার
শীল, বিপদ সাহা,
নারায়ণ সাহা, গৌরাঙ্গ পাল, সুনীল পাল,
নারায়ণ পাল, অমূল্য হাওলাদার, হরি রায়,
শান্তি রায় গুরণ,
ফকির দাস, তনা দাস, গৌরাঙ্গ সাহা
ও তাঁর বাবা
হরিদাস, মাসহ তিন বোন প্রমুখ। এই অভিযোগের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের পাঁচ
সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। ১৩তম
সাক্ষী গৌরাঙ্গ চন্দ্র সাহা ও ২৩তম
সাক্ষী মধুসূদন ঘরামী
এ ঘটনার শিকার
হন। বাকিদের সাক্ষ্য এ অভিযোগকে সমর্থন করে।
হত্যা,
ধর্ষণ ও ধর্মান্তরকরণের উক্ত ৫টি অভিযোগ ছাড়া সাইদির বিরুদ্ধে বাকি তিনটি প্রমাণিত
অভিযোগগুলির মধ্যে রয়েছে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মত জঘন্য অপরাধের ঘটনা ।
ট্রাইব্যুনালের বিচারকগণ জানিয়েছেন যে সাইদির বিরুদ্ধে ৮টি অপরাধ প্রমাণিত হলেও তাকে দুটি অপরাধের
জন্যে ফাঁসীর সাজা দেওয়া হয়েছে ।
আমি
নিজে ব্যক্তিগতভাবে মৃত্যুদন্ডের পক্ষে নয় । বিচারের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে কারও মৃত্যুদন্ড
কার্যকর করা হলে সেটাও হত্যা বৈ নয় । কোনো হত্যাই সমর্থনযোগ্য নয় । সাধারণভাবে এমন
নীতিই হওয়া উচিত ও বাঞ্ছনীয় । কিন্তু কোনো নীতি বা আইনকে যান্ত্রিকভাবে গ্রহণ করলে
তার ব্যাপক কুফলের আশঙ্কা থেকে যায় । তাই ব্যতিক্রমের সংস্থান রাখা জরুরী এ সব
ক্ষেত্রে । বাংলাদেশের বুকে একাত্তরে হত্যা করা হয়েছে ৩০লক্ষ মানুষকে এবং ধর্ষণ
করা হয়েছে ৩লক্ষাধিক নারীকে । এত ভয়ঙ্কর পৈশাচিক মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনা ইতিহাসে
বিরল । তাই এ ক্ষেত্রে অপরাধীদের চরম শাস্তিই প্রাপ্য ।
(written on 28.04.2013)