Friday, January 21, 2022

কোরানে বিজ্ঞানের ব-ও নেই

 

মানুষ যখন প্রথম চাঁদে আরোহণ করে, মনে পড়ে তখনকার কথা, মোল্লা-মুফতিরা সে কথা বিশ্বাসই করেনি। বিশ্বাস করবে কেন, কোরানে যে লেখা রয়েছে,

·         “ওদের কি মালিকানা আছে আকাশ, পৃথিবী ও উভয়ের মধ্যবর্তী কিছুর, থাকিলে আরোহণ করুক, অনেক দলের ন্যায় এ দলও সেক্ষেত্রে বিধ্বস্ত হবে।” (৩৮.১১)

কোরানের এই ঘোষণাকে ভুল প্রমাণ করে বিজ্ঞানীরা যখন বারবার চাঁদে যেতে লাগলো, তখন অবশেষে মুসলিম সমাজ সেটা মেনে নিতে বাধ্য হলো। ওর তখনই বিপন্ন ও অসহায় মোল্লাতন্ত্রকে এবং ইসলামকেও রক্ষা করতে ময়দানে অবতীর্ণ হলেন উচ্চশিক্ষিত কিছু মুসলিম। তাদের মধ্যে দেখা গেলো দু’/একজন বিজ্ঞানীও আছেন। তারা বললেন, মানুষের পক্ষে চাঁদে আরোহণ করা সম্ভব এটা প্রমাণ করেছেন আল্লাহর নবী। তিনি তো সাত আসমান পার করে আল্লাহর সাথে দেখা করে এসছেন। আর আজকের বিজ্ঞানীরা তো নবীর সেই আকাশভ্রমণ থেকেই চাঁদের যাওয়ার বৈজ্ঞানিক সূত্র আবিষ্কার করেছেন।  ব্যাস! তারপর থেকেই মোল্লা-মুফতিরা সেই বিখ্যাত(!) ৩৮/১১ নং আয়াতটি চেপে যাওয়া শুরু করেন, ঘুর্ণাক্ষরেও আর এই আয়াতটির কথা মুখেও আনেন না। তারা এখন অন্য কথা বলেন। বলেন, বিজ্ঞানের যত আবিষ্কার তার মূলে রয়েছে কোরানের কোনো কোনো একটা আয়াত।

সমগ্র মুসলিম সমাজে দু’/একজন বিজ্ঞানী খুঁজে পাওয়া বড়োই ভাগ্যের ব্যাপার। সমগ্র বিশ্বে বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও জয়যাত্রায় আধুনিক সমাজে মুসলমানদের অবদান প্রায় শূন্য বললে অত্যুক্তি হয় না। কিন্তু মুসিল্ম দেশগুলিতে বিজ্ঞানের নামে অপবিজ্ঞানের ছড়াছড়ির অন্ত নেই। পাকিস্তানের একজন বিজ্ঞানী নাকি বেহেস্তের গতিবেগ নির্ণয় করে দেখিয়েছেন যে বেহেস্ত আলোর গতিবেগের চেয়ে এক সেন্টিমিটার কম গতিতে পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। পাকিস্তানের আর একজন আণবিক ইঞ্জিনিয়র সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন সমস্ত জিনদের বন্দি করে তাদের মধ্যেকার সমস্ত শক্তি নিংড়ে নেওয়ার। তিনি এই প্রস্তাব দেন কারণ আল্লাহ নাকি বলেছে যে, ফেরেস্তা ও জিন আগুন থেকে তৈরি। পরে ঐ বিজ্ঞানী গোপনে তালিবানদের আণবিক সূত্র পাচার করার জন্যে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। (সূত্রঃ মুসলিম সমাজ ও এই সময়, মইনুল হাসান, পৃঃ ১২৪)

আল্লাহ স্বয়ং বিজ্ঞানী এবং কোরান একটি মহাবিজ্ঞান গ্রন্থ এই প্রচারণায় এবং তা প্রমাণ করার ব্যর্থ ও প্রাণান্তকর চেষ্টায় সবচেয়ে অগ্রণী হলো মুসলিম বাঙালিরা।  তারা এসব নিয়ে গাদাগাদা বই লিখেছেন এবং লিখে চলেছেন। তাদের লেখা কয়েকটি এ রকম কয়েকটি বই হলো,  “বিজ্ঞান ও আল কোরান”,  “মহাকাশ ও কোরানের চ্যালেঞ্জ”, “আল কোরান এক মহাবিজ্ঞান”, “বিজ্ঞান না কোরান” ইত্যাদি। এই বইগুলির চাহিদা মোল্লা-মুফতি ও শিক্ষিত মুসলমানদের  কাছে যথেষ্টই।  এসব বইয়ের লেখকেরা নাকি চৌদ্দশ বছর আগেকার কোরানে আধুনিক বিশ্বের বিজ্ঞানের সব সূত্রই খুঁজে পেয়েছেন।  খুঁজে পেয়েছেন ‘বিগ ব্যাং’, ‘মহাবিশ্বের প্রসারণ’, ‘অণু পরমাণু’, ‘ছায়াপথ’, ‘নক্ষত্ররাজি’, ‘ভ্রূণতত্ত্ব’, আপেক্ষিক তত্ত্ব পভৃতি যতসব তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে তার সবই।

ঈশ্বরকে বিজ্ঞানী প্রমাণ করা, এবং বেদ বাইবেল প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থগুলো সবই ঈশ্বররচিত বিজ্ঞানগ্রন্থ মনে করা এবং তা প্রমাণ করার হাস্যকর চেষ্টাও চলছে পাশাপাশি। বাইবেলে আছে পৃথিবী সমতল এবং পৃথিবীর চারটি প্রান্ত আছে। বাইবেলের এই কথাগুলিকে অভ্রান্ত ভেবে তা প্রমাণ করার জন্যে ‘International Flat Earth Society’ এবং ‘The International Square Earth Society’  নামের কিছু মজার সংগঠন গড়ে উঠেছে। বেদেও বলা আছে পৃথিবী সমতল, তাই গুজরাটে ‘জাম্বুদিপা’ নামে একটি সংগঠন পাগলের মত চেষ্টা করে যাচ্ছে বেদের কথাকে সত্য বলে প্রমাণ করার জন্যে।

এ লেখাটি মূলত কোরানকেন্দ্রিক। কারণ, ধর্মগ্রন্থকে বিজ্ঞান বলে প্রমাণ করার পাগলামি সবচেয়ে বেশি মুসলমদের মধ্যেই। মুসলিম সমাজ এই পাগলামি গিলছেও গোগ্রাসে। কোরান আর পাঁচটা ধর্মগ্রন্থের  মতনই একটা ধর্মগ্রন্থ। মুসলমানরা অন্ধভাবে বিশ্বাস করে যে কোরান হলো আল্লাহর গ্রন্থ যার প্রতিটি আয়াত নির্ভুল ও বিজ্ঞানভিত্তিক। এটা বাস্তবসমত নয় তা তারা মানতে প্রস্তুত নয়। অন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলিতে আমরা যেমন দেখতে পাই  প্রাচীন মনবসমাজের অনগ্রসর ও পশ্চাদপদ জীবনযাত্রার ছবি, তাদের আশা-আকাঙ্খার নানা বর্ণনা এবং নানা রূপকথার গল্প, কোরানে তারচেয়ে আলাদা কিছু দেখতে পাই না। দেখতে পাওয়ার কথাও নয়। কারণ, কোরান এসেছে ১৪৪ বছর আগে যখন বিজ্ঞানেওর প্রায় ভ্রূণাবস্থা। তখন বিজ্ঞানের উপর মানুষের দখল ও জ্ঞান ছিলো অতি সীমিত। পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য প্ররভৃতি সম্পর্কে যাঁরা বিজ্ঞানের নানা দিক আবিষ্কার করেছেন সেই বিজ্ঞানী কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও প্রমুখ পৃথিবীর আলো দেখেছেন মুহাম্মদের জন্মেরও কয়েক শ’ বছর পর। সুতরাং কোরানে পৃথিবী, মহাকাশ, প্রকৃতি, ইত্যাদি সম্পর্কে বিজ্ঞানের তত্ত্ব আশা করা মূর্খামি ও বেকুবি ছাড়া আর কীইবা হতে পারে।  হ্যাঁ, তেমনটা আশা করা যে মূর্খামি ও বেকুবি তার অজস্র প্রমাণ পাওয়া যায় কোরানের কিছু আয়াত বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করলেই।

সূর্য ও পৃথিবীর পরিক্রমা প্রসঙ্গে  

বিজ্ঞানের একটি নির্ভুল আবিষ্কার হলো এই যে, পৃথিবী একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে সূর্যের চারদিকে আবর্তিত হচ্ছে এবং পৃথিবী নিজেও লাট্টুর মতন অবিরাম পাক খাচ্ছে সূর্যকে সম্পূর্ণ প্রদক্ষিণ করতে পৃথিবীর সময় লাগে ৩৬৫ দিন। এই সময়টাকেই বলা হয় এক বছর। তাই সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর আবর্তনকে বলা হয় পৃথিবীর বার্ষিক গতি। আর পৃথিবীর ঘড়ির কাঁটার মতন নিজের চারদিকে এক পাক ঘুরতে সময় লাগে  ২৪ ঘণ্টা। এই সময়টাকে বলা হয় দিন। এই ২৪ ঘণ্টায় হয় দিন-রাত্রি। পৃথিবীর এই ঘুর্ণনকে বলা হয় আহ্নিক গতি যার ফলে হয় দিন ও রাত্রি। পাঠক, আসুন এবার চোখ রাখি কোরানের মধ্যে। দিন ও রাত্রি সম্পর্কে কোরান কি বলছে দেখা যাক। আল্লাহ তার সর্বময় ক্ষমতা জাহির করে এ প্রসঙ্গে বলছে –

·         আল্লাহ দিবাতে রাত্রি স্থাপন করে এবং রাত্রিতে দিবা আনয়ন করে।  এবং সে সূর্য ও চন্দ্রমাকে অধিকৃত করিয়াছে, প্রত্যেকে এক নির্দিষ্ট সময় চলিয়া থাকে।  (সুরা লোকমান, ৩১/২৯)

·         সূর্য নির্দিষ্ট স্থানে ভ্রমণ করে, ইহা পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞের নিয়ন্ত্রণ। (সুরা ইয়াসিন, ৩৬/৩৮)

সূর্য পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে ঘোরে এই ভুল ধারণাটি কোরানে আরও বেশ কয়েকটি আয়াতে আছে। যেমন সুরা যুমার (৩৯/৫), সুরা রা’দ (১৩/২), সুরা আম্বিয়া (২১/৩৩), সুরা ক্বাফ (১৮/৮৬), সুরা ত্বোহা (২০/১৩০) ইত্যাদি। শুধু কোরানেই নয়, একই ভ্রান্ত ধারণার কথা পুনঃপুন উচ্চারিত হয়েছে বেদ, বাইবেল এবং অন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলিতেও। এর কারণ হলো, প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ এটাই বিশ্বাস করতো। সাদা চোখে (আপাত দৃষ্টিতে) সূর্য ও পৃথিবীকে দেখলে তো তাইই মনে হয়। মনে হয় যে, সূর্য ঘুরছে এবং পৃথিবী স্থির রয়েছে।  আর সেটাই স্থান পেয়েছে ধর্মগ্রন্থগুলিতে। এটাই তো স্বাভাবিক। কারণ, সমস্ত ধর্মগ্রন্থই তো মানুষের সৃষ্টি, মানুষ যে বিশ্বাস করতো  সে কথাগুলিই ধর্মগ্রন্থের প্রণেতারা বলেছে আল্লাহ বা ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে।  কোরানও যেহেতু মানুষের সৃষ্টি তাই সেখানেও সেই ভ্রান্ত ধারণাগুলিই ব্যক্ত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সুরায়।      

আজকের জ্যোতির্বিদঃ নিকোলাস কোপার্নিকাস - মহাবিশ্ব           

কোপার্নিকাস

সূর্য ও পৃথিবীর আবর্তন সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক ধারণা প্রথম দেন কোপার্নিকাস ও গ্যালিলিও যাঁদের জন্ম যথাক্রমে ১৪৭৩ ও ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে। আর গতিসূত্র, মহাকর্ষ, অভিকর্ষ, পতনশীল বস্তুর ধর্ম ইত্যাদি বিজ্ঞানের নতুন নতুন তত্ত্বকে আবিষ্কার করে বিজ্ঞানকে এক ধাক্কায় যিনি নেক উপরে তুলে দেন সেই বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন তো জন্মগ্রহণ করেন আরও প্রায় একশ’ বছর পর ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দে। সুতরাং এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে মুহাম্মদ যে সময়ে এসে দাবি করেছেন এই বিশ্ব, আকাশ এবং তাদের অন্তর্ভুক্ত সবকিছুরই স্রষ্টা ও প্রভু হলো আল্লাহ এবং তিনি সেই মহান স্রষ্টার শেষ প্রতিনিধি ও জিগিরি দোস্ত, সে সময় বিজ্ঞানের জ্ঞান ছিলো এতই সীমিত যা না থাকার মতনই। সে যুগে মানুষ খালি চোখে সূর্য ও চন্দ্রকে যা দেখতো তার সঙ্গে মানানসই ধারণাই পোষণ করতো। মানুষ দেখতো প্রতিদিন ভোরবেলা সূর্য পূর্বদিকে আকাশে উঠছে এবং ক্রমে ক্রমে পশ্চিমদিকে হেলে পড়ছে। তাই তারা ভাবতো সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে এবং মুহাম্মদও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। সে সময় মুহাম্মদ জানবেন কি করে যে, সূরয, পৃথিবী ও চন্দ্রের মধ্যে নাড়ির সম্পর্ক রয়েছে এবং ওদের কার্যাবলীর পশ্চাদে রয়েছে পদার্থ বিজ্ঞান ও প্রকৃতি বিজ্ঞানের কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম। সেজন্যে সে যুগের মানুষ বেদ, বাইবেল ও কোরানে বর্ণিত সূর্যের ঘোরার তত্ত্ব বিশ্বাস করেছিলো এবং বিশ্বাস করতো যে সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহরই নির্দেশেই ভ্রমণ করছে স্ব স্ব ক্ষেত্রেমানুষের এই বিশ্বাস এত বদ্ধমূল ছিল যে গ্যালিলিও যেই বলেন যে সূর্য নয় পৃথিবী ঘোরে অমনি খ্রিস্টান যাজকরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে তাঁর বিরুদ্ধে ঈশ্বরদ্রোহিতার  অভিযোগ করে সম্রাটের কাছে। ইতালির সম্রাট সেই অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করে ফাঁসীর আদেশ দেন। গ্যালিলওকে তখন নিজের আবিষ্কারকে ভুল বলে মেনে নিয়ে আত্মরক্ষা করতে হয়েছিলো। আর যাজকতন্ত্রের ভয়ে তো কোপার্নিকাস তাঁর আবিষ্কার (পৃথিবীর আবর্তন সংক্রান্ত) প্রকাশ্যেই আনেন নি। সেটা লিপিবদ্ধ করে যান একটি গ্রন্থে। আরবের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে কোপার্নিকাসেরও বহু পুর্বে  আরব বিজ্ঞানী ইবন-আল-হাইথাম দ্বাদশ শতকেই এই ধারণা পোষণ করতেন যে সূর্য ঘুরছে না, ঘুরছে পৃথিবী তাঁর সব কাজকে আল্লাহদ্রোহিতার অভিযোগে বাতিল করা হয়েছিলো এবং পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো তাঁর সমস্ত বইপত্র 

পৃথিবী নিশ্চল ও স্থির

প্রাচীনকালের মানুষরা মনে করতো পৃথিবী স্থির ও নিশ্চল। বেদ ও বাইবেল সে কথার উল্লেখ আছে। কোরানও তার ব্যতিক্রম নয়। খালি চোখে পৃথিবীর আবর্তন বোঝা যায় না। এখনও ব্যাপক অংশের শিক্ষিত মানুষেরাও তাইই বিশ্বাস করে। পৃথিবী ঘুরছে বললে ওরা প্রশ্ন করে, পৃথিবী ঘুরলে আমরা ছিটকে পড়ছি না কেন? মহাকর্ষের ফলে সূর্য ও পৃথিবীর পরষ্পরের আকর্ষণের জন্যে পৃথিবী শূন্যে পাক খাচ্ছে এবং পৃথিবীর অতি বিশ্বালত্বের কারণে মানুষের পক্ষে সেটা অনুভূত না হওয়ায় পৃথিবীর আবর্তনের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার আজও বহু মানুষ বিশ্বাস করতে চায় না। তাই ১৪০০ বছর পূর্বে জন্ম যার সেই মুহাম্মদের কাছে এটা আশা করা খুবই বাড়াবাড়ি হবে যে তিনি পৃথিবীর আবর্তনের তত্ত্ব তিনি জানবেন। মুহাম্মদ ও তাঁর যুগের মানুষের এ বিষয়ে যে ধারণা ও বিশ্বাস ছিলো সেটাই তিনি ব্যক্ত করেছিলেন নির্দ্বিধায় ও অবলীলায়। কোরানে সেটা দেখতে পাওয়া যায় এই ভাষ্যে –

·         কে ধরাতলকে স্থির রাখিয়াছেন এবং তাহার ভিতর হইতে নির্ঝর সকল উৎপাদন করিয়েছেন? (সুরা নামল, ২৭.৬১)

পৃথিবী স্থির এই ভুল ধারণার কথা রয়েছে সুরা রুম (৩০/২৫), সুরা বাকারা (২/২২) এবং সুরা নাহল-এও ((১৬.১৫)। কোথাও মরুভূমি, কোথাও স্থলভূমি, কোথাও সমুদ্র, আবার কোথাও পাহাড়-পর্বত পৃথিবীর এই বৈচিত্র নিয়ে মানুষের মনে নানা প্রশ্ন ও কৌতূহল ছিলো অনেক আজও আছে মুহাম্মদ দাবি করেছেন তিনি আল্লাহর প্রতিনিধি এবং ফেরেস্তা জিব্রাইলের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর কাছে ওহী প্রেরণ করে সুতরাং মানুষ মুহাম্মদকে সকল প্রশ্ন করবে, তাঁর কাছ থেকে উত্তর জেনে নিয়ে তাদের কৌতূহল নি্রসন করবে তা ছিলো তখন খুবই স্বাভাবিক ঘটনা আর সাহাবি ও শিষ্যদের অজস্র প্রশ্নের উত্তর প্রদানে মুহাম্মদও ছিলেন অক্লান্ত খুবই সপ্রতিভ ও প্রগল্ভ কখনও উত্তর দিয়েছেন আল্লাহ বলেছেন বলে, আব্র কখনও সবজান্তা ঋষিদের মতন নিজেই উত্তর দিয়েছেন পৃথিবীতে পাহাড়-পর্বত কেনএই প্রশ্নের উত্তরে কোরানের ব্যাখ্যা তাই কতই না হাস্যকর কোরান এ প্রসঙ্গে বলছে

·         তিনি খুঁটি ছাড়া আসমানসমূহ সৃষ্টি করেছেন যা তোমরা দেখেছো, আর জমিনে স্ত্রহাপন করেছেন সুদৃঢ় পাহাড়, যাতে তোমাদের নিয়ে হেলে না পড়ে (সুরা লোকমান ৩১/১০)

আচ্ছা আল্লাহর কেন এমন ধারণা হলো যে পৃথিবী ডষলে পড়তে পারে, আর তার জন্যে এরূপ হাস্যকর ব্যাখা দেওয়ারই বা কী প্রয়োজন ছিলো? বিষয়টা হতে পারে এ রকমসাহাবি ও শিষ্যরা প্রশ্ন করলে তো উত্তর দিতেই হবে (উত্তর জানা থাক বা না থাক), না হলে তাঁকে আল্লাহর নবী মানবে কেন? তাই তাঁর এরূপ গোঁজামিল দিয়ে উত্তর দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিলো না

আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে সূর্য সকালে সকালে ওঠে এবং সন্ধ্যায় ডোবে  - তা নিয়ে কোনোকালেই মানুষের কৌতূহলের অন্ত ছিলো না, আজও নেই  তা এসব প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞানী ও প্রাজ্ঞ আল্লাহ  নবীকে জানাবে না তা হয়? নবীও কোরানে সেসব নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করে তাঁর সকল সাহাবি ও জগৎবাসীর সব কৌতূহল নিরসন করে সকলকে কৃতার্থ করে যেতে কার্পণ্য করেন নি মানুষের চিরকালের প্রশ্ন সূর্য কোথায় অস্ত যায়? রাত্রে কোথায় থাকে? সকালে কোথা থেকে ওঠে বা উদয় হয়? এসব প্রশ্নেরই কোরানে আছে এবং সেগুলো শুনলে বিজ্ঞান সচেতন মানুষের হাসতে হাসতে অন্নপ্রাশনের ভাতও উঠে যেতে পারে সূর্যের অস্ত যাওয়া প্রসঙ্গে কোরান বলছে,

·         এমনকি সে (জুলকুরনাইন) চলিতে চলিতে সূর্যাস্তস্থলে উপনীত হইলে সে সূর্যকে দেখিলো একটি পঙ্কিল জলাশয়ে ডুবিতে, আর দেখিলো সেখানে মানুষের একটি সম্প্রদায়কে বলিলাম, হে জুলকুরনাইন! তুমি ওদেরকে সাজা দিতে পারো, অন্যথ্যায় ওদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে পারো (সুরা কহফ, ১৮/৮৬)

কে এই জুলকুরনাইন? সে নাকি দুটো আধখানা শিংওয়ালা বিশাল ক্ষমতাশালী বাদশা ছিলেন সেই বাদশা নাকি সূর্যোদয়ের জায়গাতেও গিয়েছিলেন সে প্রসঙ্গে মহান বিজ্ঞানি আল্লাহ বলছে,

·         এমনকি সূর্যোদয়ের স্থলে পৌঁছলে উহাকে এমন কওমের (মানবজাতি) উপর উদীয়মান দেখিল, যাহাদের জন্যে সূর্যতাপ অন্তরায় করি নাই। ইহাই তো ঘটনা, উহার বৃত্তান্ত আমার আয়ত্তে। (সুরা কহফ, ১৮/৯০)

যারা আল্লাহকে মহাবিজ্ঞানী এবং কোরানকে মহাবিজ্ঞান গ্রন্থ প্রমাণ করতে ব্যস্ত তাদের কাছে প্রশ্ন, বাদশার মাথায় শিং কেন? আর বাদশার কি সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্যে কোনো কাজ ছিলো না যে তিনি নিজে যাবেন দেখতে কোথায় সূর্য ডোবে আর অস্ত যায়? তিনি তো কাউকে দায়িত্ব দিয়ে নির্দেশ দিতে পারতেন, যাও দেখে এসে আমাকে জানাও সূর্য কোথায় অস্ত যায়।  বাদশা কেন সে কাজ করেন নি? আরও প্রশ্ন, সূর্যোদয়ের স্থানে মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে সূর্যাস্তের স্থলের মানুষের সঙ্গে খারাপ ও বৈষম্যমূলক ব্যবহার করা কেন? পঙ্কিল জলাশয়ের পাশে যে মানবজাতি রয়েছে তাদের অপরাধই বা কি যে তাদের শাস্তি দিতে হবে এবং তারা কি এখনও সেই পঙ্কিল জলাশয়ের পাশে দূষিত ও দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশেই বাস করছে? আরও একটি প্রশ্ন, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সেই স্থান (দেশ) পৃথিবীর কোথায় অবস্থিত এবং তার হদিশ কি মুহাম্মদের উম্মত তথা মুসলিম বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন? মানুষ এসব প্রশ্নের উত্তর চায় তাদের কাছে।

একটা জরুরী কথা এই ফাঁকে বলে নেওয়া যাক। কোরান আল্লাহর কেতাব – এটা মুসলিমদের বিশ্বাস। এই নিবন্ধে মাঝে মাঝেই লিখেছি, পরেও লিখবো, কোরানে মুহাম্মদ বলেছেন, তার ফলে মনে হতে পারে যে ভুল করে লেখা হয়েছে। কিন্তু তা নয়, মুসলমানরা যাই বিশ্বাস করুক না কেন আসল ঘটনা হলো, কোরান হলো মুহাম্মদেরই কথা ও বাণীর সংকলন গ্রন্থ। কোরানে অনেক আয়াত আছে যার সাহায্যে সে কথা প্রমাণ করা যায়। পরে সে বিষয়ে প্রবন্ধ বা গ্রন্থ লিখবো। এখন এখনকার নিবন্ধে ফিরে আসি। ফিরে আসি সূর্য রাত্রে কোথায় থাকে সে প্রশ্নে। এ প্রশ্নে মুহাম্মদ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে উত্তর দিয়ে গেছেন,

·         তিনি আবু যা’কে মত বিনিময় কালে জানিয়েছেন, সূর্য যেতে যেতে খোদার আরশের নীচে সিজদায় (হাঁটু ভাঁজ করে ভূমিতে মাথা ঠেকানো) পড়ে যায়। অতঃপর সে পুনঃপুন উদিত হওয়ার অনুমতি চায় এবং তাকে অনুমতি দেওয়া হয়। আর অচিরেই এমন সময় আসবে, সে সিজদা করবে কিন্তু কবুল হবে না এবং সে অনুমতি চায়বে কিন্তু তাকে অনুমতি দেওয়া হবে না। তাকে বলা হবে, যে পথে এসেছো সে পথে চলে যাও। তখন সে পশ্চিম দিকে উদিত হবে – এটাই হলো মহান আল্লাহর বাণী। (বোখারি শরিফ, ১ম থেকে ৭ম খণ্ড একত্রে, মল্লিক ব্রাদার্স, কলকাতা, হাদিস নং -  ১০৯৮)

সূর্য কিভাবে আকাশে ভ্রমণ করে? মুহাম্মদ বলেছেন,

·         চতুর্থ আকাশে ৭০০০০ (সত্তর হাজার) ফেরেস্তা প্রত্যহ একটা বিরাটকায় নৌকায় সূর্যকে বসিয়ে পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে টেনে নিয়ে যায়।

মুসলিম বুদ্ধিজীবী ও বিজ্ঞানীরা যারা মুহাম্মদকে পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ, বিজ্ঞানী ও দার্শনিকের শিরোপা দিয়েছেন, তাদের কাছে উপরোক্ত হাস্যকর বর্ণনার কোনো জবাব আছে? আরও একটা প্রশ্ন, মুহাম্মদ বলেছেন, ‘অচিরেই’ সূর্য পশ্চিম দিকে উদিত হবে, তা চৌদ্দশ বছর পূর্ণ হতে চললো, কই সূর্য এখনও পশ্চিম দিকে উদিত হলো না কেন? ‘অচিরেই’ সময়কালটা কি চৌদ্দ হাজার বছর, নাকি চৌদ্দ লক্ষ, নাকি চৌদ্দ কোটি বছর, নাকি চৌদ্দ হাজার কোটি বছর? যে সব বিজ্ঞানী বেহেস্তের গতিবেগ নিরূপণের হাস্যকর দাবি করেছেন তারা কি এই ‘অচিরেই’ সময়কালটা ঠিক কত বছর তা কি নিরূপণ করতে সক্ষম হয়েছেন? যদি উত্তরটা হয় হ্যাঁ, তবে সেটা কতো এবং তা নিরূপণের সূত্রটা কি দয়া করে আমাদের জানাবেন?

দিন ও রাত্রি

দিন ও রাত্রি কেন হয়? এ বিষয়ে বিজ্ঞানের উত্তর কী তা ইতিমধ্যেই আলোচনা করা হয়েছে। এখন মহান সৃষ্টিকর্তা ও তার প্রতিনিধি কী বলেছেন তা শোনা যাক। কোরান এ প্রসঙ্গে বলছে,

·         নিদ্রাকে বিশ্রাম করিলাম। রাত্রিকে আবরণ করিলাম, দিনকে জীবিকা অর্জনের সময় করিলাম। (সুরা নাবা, ৭৮/৯-১২)

·         তিনি দিবা-রাত্রিকে পরষ্পরের অনুগামী করেরছেন। যে উপদেশ গ্রহণ করতে চায় অথবা কৃতজ্ঞ হতে চায় তার জন্যে। (সুরা ফুরকান, ২৫/৬২)

দিন-রাত্রি সম্পর্কে কোরানের এত ভ্রান্ত ও লঘু ব্যাখ্যা সত্যিই খুবই হাস্যকর। মেরু অঞ্চলে কোনো কোনো স্থানে এক এক সময় দিন এতো দীর্ঘ সময়ের হয় যে সূর্যাস্ত হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্যোদয় হয়। সেই অঞ্চলের মানুষের জন্যে দয়ালু আল্লাহ বিশ্রামের সময় দেন নি কেন? নাকি ওদের বিশ্রামের দরকার নেই? মেরু অঞ্চলের অন্যত্র (গ্রীণল্যাণ্ড) সারা বছরে দিন ও রাত্রি মাত্র একটি করে। অর্থাৎ  সেখানে ছ’মাস কাল একটানা দিন এবং অনুরূপভাবে ছ’মাস কাল ব্যাপী রাত্রি।  সেখানকার মানুষরা কি জীবিকা অর্জনের জন্যে একটানা ছ’মাস কাল পরিশ্রম করে একটানা ছ’মাস কাল বিশ্রাম করে? কোরানকে যারা একটি মহাবিজ্ঞান গ্রন্থ প্রমাণ করতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করছেন তারা কি বলেন? উত্তর চাই।

আকাশ 

প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের বিশ্বাস যে আকাশ হলো পৃথিবীর ছাদ। মানুষের এও বিশ্বাস ছিলো যে বিনা স্তম্ভেই ঈশ্বর সেই ছাদ পৃথিবীর উপর নির্মাণ করেছে।  এ প্রসঙ্গে ঋগ্বেদের একটি ঋক বা শ্লোক হলো,

·         সবিতা নানা যন্ত্রের দ্বারা প্রৃথিবীকে স্থির রেখেছে, সে বিনা খুঁটিতে আকাশকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করেছে। (ঋগ্বেদ, দশম মণ্ডল, ১৪৯/১)

আকাশ সম্পর্কে এমন কাল্পনিক ধারণা বা গোঁজামিল দেওয়ার ব্যাপারে মুহাম্মদও কম মুন্সিয়ানা প্রদর্শন করেন নি। তিনি বলেছেন,

·         স্তম্ভ ছাড়া তিনি গগন তৈরি করলেন, তোমরা দেখিতেছ, যমিনে পাহাড় দিলেন যাতে ঢলিয়া না পড়ে। (সুরা লোকমান, ৩১/১০)

·         তোমাদের উপর সপ্তাকাশ বানাইয়া উজ্জ্বল প্রদীপ দিলাম। (সুরা নাবা, ৭৮/১২, ১৩)

আকাশ সম্পর্কে অজস্র কৌতূহল আজও রয়েছে, তবে সাধারণ বুদ্ধি ও যুক্তিতে স্পষ্টতই প্রতিয়োমাণ হয় যে আকাশ সম্পর্কে বেদ ও কোরানে যা বলা হয়েছে তা আষাঢ়ে গল্পই, অন্য কিছু নয়। আকাশ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হলো, বাস্তবে আকাশ বলতে কিছু নেই, যেটাকে আকাশ বলে ভ্রম হয় তা হলো মহাশূন্য। মোদ্দা কথা হলো মানুষের দৃষ্টির প্রান্তসীমাকেই বলা হয় আকাশ এবং বায়ুমণ্ডলের । অস্তিত্বের কারণে মহাশূন্যকে (আকাশকে) নীল দেখায়। মুহাম্মদকে মহাবিজ্ঞানী বলে কিছু মানুষ যতই লম্ফঝম্প করুক, ১৪০০ বছর পূর্বে আকাশ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ধারণা বা ব্যাখ্যা দেওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব ছিলো না এবং স্বভাবতই মুহাম্মদও দিতে সক্ষম হন নি।

পৃথিবীর আকার

পৃথিবীর আকার কী প্রকার তার সঠিক উত্তর আজকার শিশুশিক্ষার্থীরাও জানে। শিশুরা জানে যে পৃথিবী গোলাকার। মুহাম্মদের যুগের মানুষরা কিন্তু মনে করতো যে পৃথিবী সমতল। সেই ধারণার কথাই কোরানেও বহু জায়গায় ব্যক্ত করা হয়েছে। তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও কোরানে একটি আয়াতও পাওয়া যাবে না যেখানে পৃথিবীর আকার সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত বর্ণনা রয়েছে। কোরানে বলা হয়েছে,

·         ধরাকে বিস্তৃত করিলাম, ওতে পর্বতমালা স্থাপন করিলাম, চোখ জুড়ানো উদ্ভিদ উঠাইলাম। (সুরা ক্বাফ, ৫০/৭)

পৃথিবী সমতল এরূপ বর্ণনা পাওয়া যায় কোরানের আরও অনেক জায়গায়। যেমন, সুরা যুখরুপ, ৪৩/১০, সুরা হিজ্বর ১৫/২৯, সুরা ত্বোহা, ২০/৫৩, সুরা নুহ, ৭১/১৯ ইত্যাদি।

পৃথিবী সমতল এবং সূর্য একই স্থানে ওঠে ও একই স্থানে ডোবে এই ভ্রান্ত, হাস্যকর ও অবৈজ্ঞানিক ধারণা থেকে মুহাম্মদ দিনে পাঁচবার নামাজ (পাঁচ ওয়াক্ত) আদায় করার সময় এবং রোযা রাখা ও ভঙ্গের যে সময় নির্ধারণ করে গেছেন তাতে এ যুগের মুসলিমদের কতকগুলি কঠিন (মজারও বটে) মুখে পড়ে নাজেহাল অবস্থা। নামাজ পড়ার সময় যেমন নির্দিষ্ট করা আছে তেমনি কখন নামাজ পড়া নিষিদ্ধ তারও নির্দিষ্ট বিধান রয়েছে ইসলাম ধর্মে। সূর্যোদয়, মধ্যাহ্ন এবং সূর্যাস্ত – এই তিনটি নির্দিষ্ট সময়ে নামায পড়া নিষিদ্ধ। ফলে যে সমস্যা ও প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে তার প্রতি লক্ষ্য করা যাক। এর জন্যে বাংলাদেশের লেখক ও দার্শনিক আরজ আলি মাতব্বুরের স্মরণাপন্ন হওয়া যাক। তিনি উদাহরণ সহ প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন,

·         বরিশালে যখন সূর্যদয় হইতেছে, তখন কলকাতায় হয় নাই এবং চট্টগ্রামে কিছু পূর্বেই উদয় হইয়া গিয়েছে। অর্থাৎ বরিশালে যখন নামাজ পড়া হারাম তখন কলকাতা বা চট্টগ্রামে হারাম নহে। তাহা হইলে নির্দিষ্ট সময়ে নামাজ নিষিদ্ধ হওয়ার তাৎপর্য আছে কি?

তাঁর আর একটি মজার কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এরূপঃ

·         মনে করা যাক – কোনো ব্যক্তি বেলা দেড়টার সময় জোহরের নামাজ আদায় করিয়া বিমানযোগে প্রতি ঘণ্টায় তিন হাজার মেইল বেগে চট্টগ্রাম হইতে মক্কা যাত্রা করিলেন। সেখানে পৌঁছিয়া তিনি দেখেন যে, ওখানে তখন দুপুর হয় নাই। ওয়াক্ত হইলে ঐ ব্যক্তিকে আবার নামাজ পড়িতে হইবে কি?

বিষুবীয় অঞ্চলে দিন-রাত্রির সময়ে বিস্তর ব্যবধান। আরজ আলী মাতব্বুর তাই প্রশ্ন তুলেছেন,

·         মেরু অঞ্চলের কোন কোন দেশে বৎসরের কোন কোন সময়ে দিন এত বড় যে, ‘সন্ধ্যা’ ও ;ভোর’ এর মাঝখানে কোন রাত্রি নেই। সেখানে এশার নামাজের উপায় কি?

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এশার নামাজের ওয়াক্ত (সময়) হলো রাত্রে এবং সেটা শুরু হয় সন্ধ্যার দু/আড়াই ঘণ্টা পর। আরজ আলি মাতব্বুর আর একটি প্রশ্ন উত্থাপন করে এ বিষয়ের ইতি টানবো। তাঁর প্রশ্নটি হলো –

·         মেরু অঞ্চলে বৎসরে মাত্র একটি দিবা ও একটি রাত্রি হয় অর্থাৎ ছয়মাসকাল একাদিক্রমে থাকে দিন এবং ছয়মাসকাল রাত্রি। ওখানে বৎসরে হয়তো পাঁচবার (পাঁচ ওয়াক্ত) নামাজ পড়া যায়, কিন্তু একমাস রোযা রাখা যায় কি রকমে? (উক্ত উদ্ধৃতিগুলি নেওয়া হয়েছে তাঁর আরজ আলি মাতব্বুর রচনা সমগ্র, পৃঃ ৮২, ৮৩ থেকে)  

যারা মুহাম্মদকে সর্বকালের সরবশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী বলে মানেন ও দাবি করেন তারা আরজ আলী মাতব্বুরের উত্থাপন করা প্রশ্নের উত্তর, এবং মেরু অঞ্চলে রোযা রাখা ও নামাজ পড়ার সমস্যার সমাধান দিতে পারেন কি? না, পারেন না। সুতরাং এটা স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, মুহাম্মদ জানতেনই না যে পৃথিবীর এক গোলার্ধে যখন দিন তখন অন্য গোলার্ধে রাত বা সবে সন্ধ্যা এবং পৃথিবীর ভূগোল এত বৈচিত্রময়। যারা  দৃঢ়কণ্ঠে দাবি করে যে  আল্লাহ এই পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা ও প্রভু তাদের কাছে প্রশ্ন, নামাজ পড়া, রোযা রাখা ও রোযা ভঙ্গ করার সময় নির্ধারণে আল্লাহ এত বড়ো ভুল হয় করে্লো কেন? আপনাদের কথা মতন আল্লাহ সর্বজ্ঞ, তাহলে এত বড়ো ভুলের দায় কি মুহাম্মদের? তা যদি হয়, তবে প্রশ্ন, আল্লাহ কি তাহলে তার সমুদয় জ্ঞান তার সর্বাধিক প্রিয় নবী ও দোস্ত মুহাম্মদের মধ্যে সঞ্চারিত করেনি?

সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ

আলোচনা আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আগে সৌদি আরবের একটি ফতোয়ার প্রতি পাঠক বন্ধুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। সৌদি আরবে চলে রাজার শাসন। ‘রাজা’ শব্দের মানে আরবীয় সংস্কৃতি অনুসারে খলিফা, আর খলিফা হলেন মুহাম্মদের প্রতিনিধি। সৌদি আরব হলো মুহাম্মদের জন্মভূমি যেখান থেকে মুহাম্মদ মৃত্যুর আগে সকল মুশরিকদের উচ্ছেদ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ফলশ্রুতিতে সৌদি আরবে কর্মসূত্রে অমুসলিমরা থাকলেও মুহাম্মদের মৃত্যুর চৌদ্দশ বছর পরেও আজ পর্যন্ত কোনো অমুসলিম সৌদি নাগরিক নেই। এ থেকে বোঝা যায় যে মুহাম্মদের জন্মভূমিতে ইসলামি রক্ষণশীলতা এখনও কত প্রকট। বলা বাহুল্য যে সেখানে চলছে রাজতন্ত্রের পাশাপাশি মোল্লাতন্ত্রের কঠোর স্বৈরতান্ত্রিক শাসন। এই সেদিন – ১৯৯৩ সালে সেখানকার সর্বোচ ধর্মগুরু আব্দেল আজিজ ইবনে বাজ একটি ফতোয়া জারি করেছেন। ফতোয়াটি হলো –

·         এই পৃথিবী সমতল। যারা এই সত্যটা মানে না তারা সকলেই নাস্তিক, শাস্তিই তাদের কাম্য।

সৌদি আরবের রাজা ও জনগণ মুহাম্মদের যোগ্য উত্তরসূরীই বটে!  ভোট-বিপ্লবীরা মুসলমানদের ভোটের জন্যে বলে থাকেন ইসলামের বিশাল সৌধটা নাকি দাঁড়িয়ে আছে গণতান্ত্রিক কাঠামোর উপর। তারা এই ফতোয়া শুনে নীরব কেন? থাক সৌদি আরব, থাক তাদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার কোরান-সম্মত ফতোয়ার কথা, যে আলোচনা চলছিলো সেই আলোচনায় ফেরা যাক।

মহাকাশে মাঝেমধ্যে দুটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটতে দেখা যায় যার একটি হলো সূর্যগ্রহণ এবং অপরটি  চন্দ্রগ্রহণ।  এই দুটি ঘটনা নিয়ে আজও সমানে দেখা যায় নানারূপ ধর্মীয় কুসংস্কার। এই কুসংস্কারের প্রাবল্য অবশ্য হিন্দু সমাজেই বেশি দেখা যায়। সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের মধ্যে তারা নানা অমঙ্গলের আশঙ্কা করে তাই গ্রহণের সময় এবং গ্রহণমুক্তির পর নানা ধর্মীয় আচার পালন করে। কিন্তু বাস্তব হলো এই যে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ হলো সৌরজগতের দুটি স্বাভাবিক ঘটনা যার মধ্যে অলৌকি কোনো কিছু নেই। ঘটিনা দুটি হলো এরূপঃ মহাকাশে সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী পাক খাচ্ছে, আর অনুরূপভাবে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে পাক খাচ্ছে চন্দ্র। পাক খেতে খেতে এক সময় সূর্য, পৃথিবী ও চন্দ্র এক সরলরেখায় চলে আসে। যখন সূর্য ও পৃথিবীর মাঝখানে চাঁদ চলে আসে তখন চন্দ্রের ছায়ায় সূর্য ঢাকা পড়ে যায়। এটাই হলো সূর্যগ্রহণ। অমাবস্যার তিথিতে (সব অমাবস্যায় অবশ্য নয়) এমনটা ঘটে। আর পূর্ণিমায় (সব পূর্ণিমায় নয়) সূর্য ও চন্দ্রের মাঝে পৃথিবী অবস্থান করলে পৃথিবীর ছায়ায় ঢাকা পড়ে চন্দ্র। আর তখনই চন্দ্রগ্রহণের ঘটনাটি ঘটে। জৌতির্বিজ্ঞানীরা সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ কখন কোন স্থানে এবং কতক্ষণ ধরে হবে, কখন গ্রহণমুক্ত হবে তা আগাম যেমন যেমন বলেন কাঁটায় কাঁটায় ঠিক তেমনটাই ঘটে। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ কোনো অলৌকিক ঘটনা নয়। এখন দেখা যাক সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কে মুহাম্মদ কী বলেছেন। তিনি তাঁর একজন প্রিয় শিষ্য ও সাহাবি আবুবকরকে বলেন –

·         সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ আল্লাহ তায়ালার সীম কুদরতের দুটি নিদর্শন। তা কারও মৃত্যুর প্রভাবে গ্রহণযুক্ত হয় না; বরং আল্লাহ তায়ালা স্বীয় বান্দাদের ভয় প্রদর্শনে জন্যে দেখিয়ে থাকেন। (বোখারি শরিফ, ১ম থেকে ৭ম খণ্ড একত্রে, মল্লিক ব্রাদার্স, কলকাতা, হাদিস নং - ৩৬০)

এ প্রসঙ্গে আবুবকর আর একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। সেটা হলো -

·          ... আমরা নবী করিম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম – এর   কাছে উপস্থিত ছিলাম, সেই সময় সূর্যগ্রহণ শুরু হয়ে গেল। রাসূলুল্লাহ  সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন উঠে দাঁড়ালেন এবং তাঁর নিজের চাদর টানতে মসজিদে প্রবেশ করলেন এবং আমরাও প্রবেশ করলাম। তিনি আমাদেরকে সাথে নিয়ে সূর্য প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত দু রাকাত নামাজ আদায় করলেন। অতঃপর তিনি বললেন, .... তোমরা যখন সূর্যগ্রহণ দেখবে তখন সেই অবস্থা কেটে না যাওয়া পর্যন্ত নামাজ আদায় করবে এবং অব্যাহতভাবে দু’য়া করতে থাকবে। থাকেন। (বোখারি শরিফ, ১ম থেকে ৭ম খণ্ড একত্রে, মল্লিক ব্রাদার্স, কলকাতা, হাদিস নং - ৩৬২)

সূর্যগ্রহণ মানেই দিনে অন্ধকার নেমে আসা, সুতরাং মানুষের মধ্যে ভয় সঞ্চারিত হওয়া স্বাভাবিক। চতুর মুহাম্মদ ঠিক সেই মতন ব্যাখ্যা দিয়েই তাঁর নবীত্বকে মুসলমানদের কাছে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যারা দাবি করেন তাঁর মুখনিঃসৃত সব কথাই নির্ভুল, সত্য ও বিজ্ঞানসিদ্ধ, তারা কিভাবে তাঁর এই ব্যাখ্যা ও বর্ণনাকে বিজ্ঞানের ভিত্তির উপর দাঁড় করাবেন? বিজ্ঞানভিত্তিক প্রশ্ন থাক, এরপর যুক্তিভিত্তিক প্রশ্ন তোলা যাক। মুহাম্মদ যখন জেনেই গেছেন সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণে বিপদের কিছু নেই, কেবল মানুষকে ভয় দেখানোর জন্যে তেমনটা করা হচ্ছে, তবে গ্রহণের সময় নামাজ পড়া ও আল্লাহর কাছে দোয়া (প্রার্থনা) করার তাৎপর্য কী? আর আল্লাহ মাঝেমধ্যে অহেতুক তার বান্দাদের ভয়ই বা কেন প্রদর্শন করে? তাতে আল্লাহ ও তার বান্দাদের কোন কল্যাণ সাধিত হয়?

  ঝড় মেঘ বৃষ্টি

ঝড়, মেঘ ও বৃষ্টি  কেন হয় – এই প্রশ্নগুলি এ যুগে বিজ্ঞানের সহজতম প্রশ্নগুলির অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বিজ্ঞান যখন কোলের শিশুর মতন হামাগুড়ি দিচ্ছিল তখন ঝড়, মেঘ ও বৃষ্টি  নিয়ে মানুষের মধ্যে কত যে ভয়-ডর ছিল তার ইয়ত্তা নেই। মুহাম্মদও ভয় পেতেন আকাশে মেঘের সঞ্চার হলে, অস্থির হয়ে উঠতেন মেঘের মধ্যে অজানা কিছু ভয়ের আশঙ্কায়। এর উল্লেখ রয়েছে উক্ত বোখারি শরিফের ১১০১ নং হাদিসে। হাদিসটি বর্ণনা করেছেন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী আয়েশা। আয়েশার বর্ণনায় রয়েছে –

·         আকাশে মেঘ দেখলে ভয়ে মুহাম্মদের মুখ বিবর্ণ হয়ে যেত।

এই হলো বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ এবং আল্লাহর প্রেরিত সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ দূত যিনি আর পাঁচজনের মতনই মেঘ দেখলে ভয়ে কাঁপতেন।  ঝড়, মেঘ ও বৃষ্টির পেছনে প্রকৃতির কতকগুলি সুনির্দিষ্ঠ নিয়ম যে কাজ করে তা মুহাম্মদ কল্পনাও করতে পারেন নি। তাই তাঁর সময়ের আর পাঁচজন মানুষের মতন তিনিও বলেছেন এসবই আল্লাহর অধীন এবং আল্লাহর হুকুমেই ঝড়, মেঘ ও বৃষ্টি হয়। এ প্রসঙ্গে কোরানের ভাষ্য এ রকম –

·         .... আকাশ থেকে আমি পানি পাঠাই। অতঃপর তাতে আমি জোড়ায় জোড়ায় কল্যাণকর উদ্ভিদ জন্মাই। (সুরা লোকমান, ৩১/১০)

·         আর আমি মেঘমালা থেকে প্রচুর পানি বর্ষণ করেছি। (সুরা নাবা, ৭৮/১৪)

মুহাম্মদ তাঁর নিজের ধারণা ও বিশ্বাসকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে এই কথাগুলিকে আল্লাহর ওহী বলে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন আল্লাহ ‘মেকাইল’ নামের এক ফেরেস্তাকে এই দপ্তরটি চালানোর ভার  অর্পণ করেছে। এ প্রসঙ্গে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন –

·         গায়েবের চাবিকাঠি পাঁচটি যা আল্লাহ ছাড়া কেউই জানে না। আগামী কাল কি হবে তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না, বৃষ্টি কখন আসবে তা আল্লাহ ব্যতীত কেউ অবগত নয়; ...।   (বোখারি শরিফ, ১ম থেকে ৭ম খণ্ড একত্রে, মল্লিক ব্রাদার্স, কলকাতা, হাদিস নং - ১৯২৬)

·          

বৃষ্টি কখন হবে তা মানুষ বলতে পারে না – মুহাম্মদের এই ‘জ্ঞানগর্ভ বাণিকে বিজ্ঞানীরা কবেই ভুল ও ফালতু কথা প্রমাণিত করেছেন। তাহলে প্রশ্ন, যারা কোরানকে বিজ্ঞান বলে প্রতিপন্ন করে মোটা মোটা বই লিখেছেন তারা কি কোরানের ঐ আয়াত ও হাদিসগুলির  কথা জানতেন না? তারা এগুলি সম্পর্কে নিশ্চয়ই অজ্ঞ নয়। সব জেনেশুনেই তারা মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে চলেছেন। এটা তাদের ধর্ম ব্যবসা ছাড়া কিছু নয়।  

যারা বেদ, বাইবেল, কোরান প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থকে বিজ্ঞান এবং এই গ্রন্থগুলোর শ্লোক বা আয়াতগুলিতে বিজ্ঞানের তত্ত্ব খুঁজে পেয়েছেন তাদেরকে আহাম্মক প্রতারক ছাড়া আমার অন্য কিছু মনে হয় না। ওই আহাম্মক প্রতারকদের মধ্যে মুসলিমদের সংখ্যা বেশি ঠিকই, কিন্তু হিন্দু, খ্রিস্টান, ইহুদি অন্য ধর্মের মানুষরাও আছে। হিন্দু সমাজে এরূপ প্রতারণা নিয়ে কিছু আলোচনা যদিও ইতিমধ্যেই করা হয়েছে তবুও আরও কিছু আলোচনা করতে চাই। কতিপয় হিন্দু বৈজ্ঞানিক আছে যারা মহাভারতে কৃষ্ণ অর্জুনকে যে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলো তাতে বিজ্ঞানের বিগ-ব্যাং এর তত্ত্ব খুঁজে পেয়েছে!! (কোরানেও নাকি বিগ-ব্যাং এর তত্ত্ব নিহিত রয়েছে) বিজ্ঞানী মৃণাল দাসগুপ্ত দাবি করেছেন যে প্রাচীনকালের মুনি ঋষিরা বিজ্ঞানের যে সব তত্ত্ব বের করেছিলেন, সেগুলোরই পুনরাবৃত্তি হচ্ছে এখন বিজ্ঞানের মধ্যে (!!!) দাসগুপ্ত মহাশয় জানিয়েছেন, বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেন হেইমার নাকি গীতার বিশ্বরূপ দর্শনে এতই মুগ্ধ অভিভূত হয়েছিলেন যে ল্যাবরেটারিতে আণবিক শক্তির তেজ দেখে গীতার একটি শ্লোক তিনি আবৃত্তি করেছিলেন। রামকৃষ্ণ মিশনের মুখপত্রউদ্বোধন’- দাবি করা হয়েছে যে, কৃষ্ণ গহ্বরের ধারণা মোটেই নতুন নয়, হিন্দু ধর্ম নাকি প্রাচীনকালেই আবিষ্কার করেছিলো। মুসলমান সমাজের হাতুড়ে বিজ্ঞানীদের দাবি হলো, বেহেস্তের এক সেকেণ্ড পার্থিব দুনিয়ার হাজার হাজার ঘণ্টার সমান। এই আজগুবি তত্ত্ব তাদের খাড়া করার প্রয়োজন হয় মুহাম্মদের আজগুবিমেরাজযাত্রাকে বাস্তব সত্য প্রমাণ করার জন্যে। ভাববাদী হিন্দু বিজ্ঞানীরাও সেই একই প্রকার আজগুবু তত্ত্ব প্রচার করে বলে, ব্রহ্মার এক মুহূর্ত পৃথিবীর সহস্র বছরের সমান। এই সব ধর্মবাদী হিন্দু বিজ্ঞানীদের আরও দাবি হলো, মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুধ কোনো অলীক কল্পনা নয়, ওটা হলো আসলে পারমাণবিক যুদ্ধ (Atomic war)!! হিন্দু বিজ্ঞানীরা মহেঞ্জোদাড়োর ধ্বংসস্তূপে নাকি মহাভারতের যুদ্ধের নিদর্শনও খুঁজে পাচ্ছেন! বিজ্ঞান লেখক প্রশান্ত প্রামাণিক লিখেছেন, সম্ভবত দুর্যধনেরই কোনো মিত্রশক্তির পারমাণবিক যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে থাকবে মহেঞ্জোদাড়ো।  নলজাতক শিশু’, এবং বিকল্প মাবিজ্ঞানের বিষ্ময় আবিষ্কারও নাকি নতুন কিছু নয়। দ্রোণ-দ্রোণী, কৃপা-কৃপীর জন্মের পৌরাণিক গল্পগুলোই তার সাক্ষ্য বহন করছে। ইরাকে ব্যবহৃত আমেরিকার স্কাড প্যাট্রিয়ট মিসাইলনাকি নতুন কোনো যুদ্ধাস্ত্রই নয়। ঐগুলো হলো পুরাণে বর্ণিত বরুণ বাণ অগ্নিবাণ থাক এখন বেদ-পুরাণে বর্ণিত কাল্পনিক উপাখ্যান নিয়ে হিন্দু বিজ্ঞানী ও লেখকদের যতকিছু আহাম্মকি কাণ্ডকারখানার কথা। ফিরে আসি মুসলিম সমাজের তথাকথিত বিজ্ঞানী ও লেখকদের বিজ্ঞান ও কোরান চর্চা প্রসঙ্গে।

বিগ-ব্যাং

হিন্দু বিজ্ঞানীরা নাকি হিন্দু শাস্ত্রে বিগ-ব্যাং এর তত্ত্ব খুঁজে পেয়েছে এমন উদ্ভট দাবির কথা পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে।  মুসলিম বিজ্ঞানীরাও একই উদ্ভট দাবি করেছেন – কোরানেও নাকি বিগ-ব্যাং এর তত্ত্ব পাওয়া গেছে। বিগ-ব্যাং মানে মহাবিস্ফোরণ। এই তত্ত্বের সূত্রটি নাকি রয়েছে কোরানের আম্বিয়া সুরায়। তো দেখা যাক সেখানে ঠিক কি বলা আছে –

·         অবিশ্বাসীরা কি ভেবে দেখে না, আকাশ ও পৃথিবী এক সঙ্গে মিশেছিল, পরে আমি উভয়কে পৃথক করে দিলাম। (২১/৩০)

মুসলিম বিজ্ঞানীদের কাছে প্রশ্ন, উক্ত আয়াতের কোথায় আছে বিগ-ব্যাং তথা মহাবিস্ফোরণের সংকেত? আয়াতের কথাগুলো যদি আল্লাহর হয় তবে সেখানে আল্লাহ তো বলেছে যে, আকাশ ও পৃথিবী একসঙ্গে মিশেছিলো, তাদেরকে পৃথক করে দেওয়া হয়েছে। একসঙ্গে থাকা দুটো জিনিসকে আলাদা করে দেওয়ার ঘটনাকে কি বিস্ফোরণ বলে? যে সব উর্বর (!!!) মস্তিষ্কের বিজ্ঞানীরা আম্বিয়া সুরার ঐ আয়াতে বিগ-ব্যাং এর তত্ত্ব আবিষ্কার (?) করেছেন তাদের কোরানের আর একটা সুরা হামীমের নয় থেকে এগারো নম্বর আয়াতগুলির প্রতি দৃষ্টি করতে চাই যেখানে আল্লাহ স্বয়ং পৃথিবী থেকে আকাশকে পৃথক করার তত্ত্ব কার্যত খণ্ডন করা হয়েছে।  উক্ত তিনটি আয়ায়ে আল্লাহ মুহাম্মদকে উদ্দেশ্য করে বলছে,

·         বলুন, যিনি দুই দিনে ধরা সৃজিলেন, তাকে কি অস্বীকার করিবেই ও তার সমকক্ষ দাঁড় করাবেই? (৪১/৯)

·         তিনি উহাতে পর্বত রাখিলেন .... চারদিনে খাদ্যের ব্যবস্থা করিলেন। ... পরে তিনি ধূম্রময় আকাশে আরোহণ করিলেন। (৪১/১০, ১১)

উক্ত আয়াতগুলিতে বলা হয়েছে যে পৃথিবী তৈরি করতে চারদিন সময় লেগেছে, পৃথিবী থেকে আকাশকে আলাদা করার কথা সেখানে নেই। কোরানে অন্য জায়গায় আকাশ নির্মাণ করার কথা আছে, পৃথক করার কথা নেই।

·         তোমাদের উপর সপ্তাকাশ বানাইয়া উজ্জ্বল প্রদীপ দিলাম। (৭৮/১৩)

বিগ-ব্যাং এর তত্ত্ব যারা খুঁজে পেয়েছেন তারা উক্ত আয়াতগুলির কী ব্যাখ্যা দেবেন?

বিগ-ব্যাং এর আষাঢ়ে গল্প মুসলিম বিজ্ঞানীরা ফেঁদেছেন তারা কি জানেন যে বিগ-ব্যাং স্থান কাল অদ্বিতীয়ত্বের (space-time-singularity) সাথে জড়িত, পদার্থের সাথে নয়? বিগ ব্যাং এর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো পৃথিবীর জন্মেরও কয়েক কোটি বছর আগে। তাছাড়া কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা থেকে জানা যায় যে বিগ-ব্যাং এর মুহূর্তে প্রকৃতিতে শক্তিশালী নিউক্লীয় বল, দুর্বল নিউক্লীয় বল, তড়িৎ-চুম্বকীয় বল এবং মাধ্যাকর্ষণ বল ‘একীভূত শক্তি’ (Super force) হিসাবে বিদ্যমান ছিলো। ২১/৩০ নং আয়াতে সে সবের গন্ধ কিছু আছে? উক্ত আয়াত থেকে কিভাবে হাবলের ধ্রুবক মিলবে, আর কিভাবেই বা মাপা যাবে ডপলারের বিচ্যুতি? উত্তর নেই কোনো। সুতরাং কোরানের মধ্যে বিগ-ব্যাং এর তত্ত্ব খুঁজে পাওয়া একটা মস্তবড় গাঁজাখুরি গল্প ছাড়া আর কিছু নয়। আর এভাবেই প্রমাণিত হয় যে কোরানের মধ্যে বিজ্ঞানের সব তত্ত্ব খুঁজে পাওয়ার দাবিগুলি সবই নির্ভেজাল মিথ্যা।

আলোচনায় এবার ছেদ টানা যাক। কারণ, কোরানে এত ভুলভাল কথা আর এত গোঁজামিল রয়েছে যার সবটা আলোচনায় আনতে গেলে সে এক মহাকাব্য তৈরি হয়ে যাবে। মূল কথা বা মোদ্দা কথা হলো কোরানে বিজ্ঞানের ব-ও নেই যেমন নেই বেদ-বাইবেল ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থগুলিতে। তবুও ধর্ম নিয়ে যারা ব্যবসা করে তারাই কেবল গ্রন্থগুলিতে বিজ্ঞান খুঁজে পায়। এইসব ধর্ম ব্যবসায়ীরা হিন্দু ও খিস্টান সমাজে বিশেষ পাত্তা পায় না। কিন্তু মুসলিম সমাজে আবার এদের বিশেষ কদর। এই লেখক ধর্ম ব্যবসায়ীরাই মোল্লা-মুফতিদের হাতকে এবং ইসলামি গোঁড়ামিকে আরও পুষ্ট করে চলেছে। ফলে যারা আসলেই মুসলিম সমাজের হিতার্থে মুক্তবুদ্ধির চর্চা করছেন তারাই হচ্ছেন অত্যাচারিত, নির্যাতিত ও নির্বাসিত। তাদের লেখা মূল্যবান গ্রন্থগুলি (দ্বিখণ্ডিত, লজ্জা, নারী ইত্যাদি) নিষিদ্ধ হয়, বাজেয়াপ্ত হয়। অথচ ‘আল কোরান এক মহাবিজ্ঞান’ , ‘বিজ্ঞান ও কোরান’ ‘মহাকাশ ও বিজ্ঞানের চ্যালেঞ্জ’ জাতীয় গোঁজামিলে ভরা বইগুলি অবাধে চলে এবং মানুষকে আলো থেকে অন্ধকারের দিকে টেনে নিয়ে যায়। তাই বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা অন্যদের তুলনায় ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছে। মুসলিম সমাজের উন্নতির জন্যে সর্বাগ্রে তাই এই সত্য তুলে ধরা দরকার যে কোরানে সত্যিকারের জ্ঞানের কোনো আলো নেই, যা আছে তা হলো শুধুই চাপ চাপ অন্ধকার মাত্র। আর এ সত্যটাও বারবার উচ্চারণ করা দরকার যে, মুসলমানরা যতদিন কোরানকে জ্ঞানের উৎস ভাববে ততদিন তাদের বিদ্যা-বুদ্ধি ও চিন্তার জগতে যে বন্ধ্যাত্ব ও স্থবিরতা তৈরি হয়েছে তা থেকে তারা মুক্তি পাবে না এবং আরও পিছিয়ে পড়বে ক্রমাগত।

ঋণ স্বীকারঃ –

১. অভিজিত রায়ের প্রবন্ধ – বিজ্ঞানময় কেতাব

২. বাংলা কোরান

৩. বোখারি শরিফ

৪. আরজ আলী রচনা সমগ্র (১)

৫. মুসলিম সমাজ এবং এই সময় – মইনুল হাসান

(প্রবন্ধটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘পর্বান্তর’ পত্রিকায়, ২৭ এপ্রিল ২০০৮)

 

 

 

 

   

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...