Saturday, December 26, 2020

পুরুষতন্ত্রের বৈষম্য ও রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার ঐতিহ্যের বলি হয়েছেন সুজাতা খাঁন

 

Sujata Mondal khan - Photos | Facebook

সুজাতা খাঁ যেমনই বিজেপি ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিলেন তেমনই তাঁর জীবনসঙ্গী সৌমিত্র খাঁন বৈদ্যুতিন চ্যানেলে বসে ঘোষণা দিলেন যে, তিনি অতি শীঘ্রয় সুজাতার সঙ্গে বৈবাহিক ছিন্ন করার আইনি পদক্ষেপ করবেন। তাঁরা দুজনেই একদা তৃণমূল কংগ্রেস করতেন এবং দুজনেই একসঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন। তখন দল বদল করার সিদ্ধান্তটি ছিলো সৌমিত্রর, সুজাতা তাঁর অনুগামী হয়ে সহধর্মিণীর পবিত্র (!) কর্তব্য পালন করেছিলেন মাত্র। এবার সুজাতা যখন দল বদল করার সিদ্ধান্ত নিলেন তখন সৌমিত্র তাঁকে শোনালেন চরম শাস্তি প্রদানের ঘোষণা। ওঁরা ঘর বেঁধেছিলেন ভালবেসে। স্বভাবতই তাঁদের দাম্পত্য জীবনে সাত পাকের বন্ধনের জোর যতোটা ছিলো তার চেয়ে জোর বেশী ছিলো ভালবাসার বন্ধনের। তাঁদের দুজনের কথাতেই সেটা স্পষ্ট হয়েছে। সৌমিত্র চোখের জল ধরে রাখতে পারেন নি বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘোষণা যখন দেন। অর্থাৎ ভালবাসার বন্ধন ছিন্ন করতে তাঁর মন চায় নি তাঁর, যা করেছেন চাপে করেছেন – এমনটা দাবি করেছেন সুজাতা। সৌমিত্র ও সুজাতা যখন তৃণমূল  কংগ্রেস ছাড়েন, তখন তার খেসারত দিতে হয়েছিলো মূলত সুজাতাকেই। সুজাতা অবশ্য এখন যে শাস্তি পেলেন সৌমিত্রের কাছ থেকে তার তুলনায় আগের শাস্তিটা ছিলো নগণ্য।   

সুজাতাকে ডিভোর্স দেবার ঘটনাটি আমাদের অচেনা কিছু নয়

অদূরেই বিধানসভা নির্বাচন, তারপর দুজনই দুই যুযুধান রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, তাই বৈদ্যুতিন মাধ্যমগুলির নিকট এই ঘটনাটি তাদের টিআরপি বাড়ানোর জন্যে অত্যন্ত উপাদেয় খাদ্য। তাই স্থানীয় থেকে সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলি হামলে পড়েছে সুজাতা ও সৌমিত্রর উপর। ফলে ঘটনাটা একটা বিশেষ মাত্রা পেয়েছে। যেন চিত্রনাট্যের একটা মুচমুচে গল্প কিংবা নতুন কোনো উপাখ্যান, বাস্তব জীবনের কোনো ঘটনাই যেন নয়। না, মোটেই তা নয়, মোটেই অচেনা বা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। সুপ্রাচীন কালের আমল থেকে হাল আমলের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে এই ঘটনাগুলি হরদমই ঘটে যার কিছু খবর হয়, বেশীরভাগেরই খবর হয় না। এক লহমায় সুজাতাকে তাঁর স্বামীর ত্যাগ করার ঘটনাটি পুরুষতন্ত্রের বহু প্রাচীন সংস্কৃতি এবং আধুনিক যুগের রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতির অংশ ও অঙ্গ মাত্র, এর বেশী কিছু নয়।         

রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতায় প্রতিনিয়ত নষ্ট হচ্ছে সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কগুলি  

আমাদের দেশের গণতন্ত্র নাকি খুব বিকশিত হয়েছে, এবং এখন বেশ পরিণত। এমন দাবির বাস্তবতা আমার চোখে পড়ে না। বরং যতদিন যাচ্ছে আমাদের গণতন্ত্র হিংসা ও অসহিষ্ণুতার খঞ্জরে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। গণতন্ত্রের গা বেয়ে অবিরাম রক্ত ঝড়ছে। হিংসার কথা থাক, ওটা এ নিবন্ধের বিষয় নয়। আমাদের স্বাধীনতার অব্যবহিত কাল থেকেই রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা আমাদের গণতন্ত্রকে বিদ্ধ করে চলেছে। ভিন্ন মত ও বিরোধী দলের প্রতি সহিষ্ণুতার অভাব পরিলক্ষিত হয় প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুর আমল থেকেই। দেশ স্বাধীন হতে না হতেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করে নেহেরু সরকার। সেই কমিউনিস্ট পার্টিকেই ১৯৫৭ সালে ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন কেরালার জনগণ। সেটা কংগ্রেস সয়তে পারে নি, সরকারটা ভেঙে দিয়েছিলো। একই কারণে, ৩৫৬ নং ধারা প্রয়োগ করে একের পর রাজ্য সরকার ভেঙেছে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় সরকার।      

ভিন্ন মত, বিরোধী কণ্ঠস্বর তো একেবারেই সয় না বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেসে দলের সরকারেরও। মোদিজির সহিষ্ণুতার এত অভাব যে প্রধান বিরোধী দলকে পর্যন্ত ও সয়তে পারে না, কংগ্রেস মুক্ত ভারত গড়ার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছেন। সরকারের সমালোচনা করলেই দেশবিরোধী, পাকিস্তানের দালাল, মাওবাদী, শহুরে নক্সাল বলে দেগে দিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। মমতা ব্যানার্জীও অনুরূপ কাজই করছেন।  

কম্যুনিস্ট পার্টিতেও ভিন্ন মত, মতাদর্শগত সয় না। মতাদর্শগত কারণে সিপিআই (এম) থেকে বেরিয়ে গিয়ে যখন নক্সাল দল তৈরি হয় দেখা গেছে দুটি দলের মধ্যেই ভয়ঙ্কর রকমের অসহিষ্ণুতা। এক দশক জুড়ে চলেছিলো দুই দলের মধ্যে প্রবল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। সিপিআই থেকে বেরিয়ে গিয়ে যখন সিপিআই (এম) তৈরি হয়েছিলো তখনও দেখা গিয়েছিলো দুই দলের নেতাদের মধ্যে অসহিষ্ণুতা। অসহিষ্ণুতা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে স্বামী-স্ত্রীর বাড়ির মধ্যে পাঁচিল ঊঠে গিয়েছিলো। ঘটনাটি ঘটেছিলো কেরালায়।    কে.আর.গৌরী ও টিভি টমাস ছিলেন কেরালার শীর্ষস্থানীয় দুই কম্যুনিস্ট নেতা এবং পরষ্পরের জীবনসঙ্গীও। ১৯৬৪ সালে সিপিআই মতাদর্শগত কারণে দুটুকরো হয়ে যায়। গৌরী আম্মা সিপিআই (এম)-এ চলে যান, টমাস থেকে যান সিপিআই-এ। গৌরী আম্মা পার্টি থেকে ছুটি নেন, টমাস তাঁর দলের কাজ চালিয়ে যান। তাঁরা ঠিক করেন যে, কেউই দলের লোককে বাড়িতে আনবেন না যাতে দাম্পত্যে জীবনে দলীয় রাজনীতির প্রভাব না পড়ে। এভাবে কিছুদিন চললেও শেষ রক্ষা হয় নি। মন্ত্রীসভার সদস্য হবার কারণে তাঁদের দুজনকেই সরকারের বরাদ্দ করা আলাদা আলাদা বাড়িতে ঊঠে যেতে হয় এক সময়। বাড়ি দুটো ছিলো পাশাপাশি। তাঁরা দুটি বাড়ির মধ্যেকার পাঁচিল ভেঙে একটা দরজা বসিয়েছিলেন। কিন্তু সেই দরজা বন্ধ করে দিতে হয়েছিলো পার্টির নির্দেশে। সেটা নাকি সিপিআই দলের সিদ্ধান্ত ছিলো।

রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতার বলি হচ্ছে অসংখ্য পরিবার, নষ্ট হচ্ছে আত্মীয়তার সুন্দর সম্পর্কগুলি। কত পরিবার যে প্রতিনিয়ত ভেঙে তছনছ হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। দ্বন্দ হচ্ছে ভাইয়ে ভাইয়ে, ভাই-বোনে, পিতা-পুত্রে্ ও পতি-পত্নীতে। দ্বন্দ গড়াচ্ছে থানা ও আদালত পর্যন্ত। অসহিষ্ণুতা প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার চেহারা নিচ্ছে। জান যাচ্ছে, ধন যাচ্ছে, মানও যাচ্ছে। অসহিষ্ণুতার কারণে প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার পীঠস্থান হয়ে উঠেছে এ রাজ্য। সুজাতা যাঁকে নিয়ে এই নিবন্ধের অবতারণার তিনিই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে গেলে তাঁর পরিবারের উপর নেমে এসেছিলো ভয়ঙ্কর অত্যাচার, এমনকি তাঁর চাকরিটাও চলে গিয়েছিলো। সেই সুজাতা বিজেপি ত্যাগ করে তৃণমূল কংগ্রেসে যাওয়ায়  আবারও বলি হয়েছেন অসহিষ্ণু রাজনীতির। তাঁর স্বামী তাঁকে ডিভোর্স করবেন জানিয়ে দিয়েছেন।      

সুজাতার উপর ডিভোর্সের যে খাঁড়া নেমে এসেছে তা পুরুষতন্ত্রের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি

কেবল দলের অসহিষ্ণুতাজনিত চাপ নয়, স্ত্রীকে ত্যাগ করার মতন চরম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সৌমিত্র আর একটা কারণে। সেটা তার স্বামীত্বের অহংবোধ। সুজাতা খাঁন তাঁর সঙ্গে আলোচনা না করে, তাঁর অনুমতি ব্যতীতই বিজেপি ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান করেছেন, এটা সৌমিত্রর স্বামীত্বের অহংবোধকে প্রবল আঘাত করেছে। স্ত্রী তাঁর দলকে ত্যাগ করে চলে যাওয়ায় তাঁর সামনে একটা কঠিন প্রশ্ন এসে উপস্থিত হয়। সেটা হলো তাঁর কাছে কে বড়ো – দল না স্ত্রী? সুজাতা বিজেপির বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তুলে বিজেপিকে ত্যাগ করে তৃণমূল কংগ্রেসে যাওয়ায় বিজেপির মুখ যে পুড়েছে, তা বুঝতে সৌমিত্রর বিলম্ব করে নি। বুঝতে তার বিলম্ব হয় নি এটাও যে সুজাতাকে মুখের উপর জুতসই জবাব দিয়ে বিজেপির মুখ রক্ষা করতে হবে তাকেই সেটাও। সেই জুতসই জবাবটা হলো স্ত্রীকে ত্যাগ করা। এছাড়া আর কীইবা ছিলো যা বিজেপিকে সন্তুষ্ট করতে পারতো? এটা তো একটা দিক, রাজনৈতিক দিক। এ ছাড়াও আর একটি দিক রয়েছে যা সৌমিত্রকে ঐ কঠোর পদক্ষেপ করতে প্ররোচিত করেছে। সেটা হলো তাঁর স্বামীত্বের অহংকার। দলে এবং ঘরে ও বাইরে সৌমিত্র কী জবাব দিতেন এ খোঁটার – কীরে কি রকম স্বামী তুই যে তোর বৌ তোর দল ছেড়ে পালিয়ে গেলো? আর গেল তো গেল তোদের প্রধান শত্রুর শিবিরে ? স্ত্রীকে ডিভোর্স দেওয়া ছাড়া এ প্রশ্নটার অন্য কোনো জবাব ছিলো না সৌমিত্রর কাছে। পুরুষতন্ত্র পুরুষজাতিক একটাই জবাব শিখিয়েছে, সেটা হলো - অবাধ্য স্ত্রীকে ত্যাগ করা। তাই বিজেপির কাছে বিশ্বাসযোগ্য থাকা এবং স্বামীত্ব ও পুরুষত্বের অহংবোধকে অটুট রাখার জন্যে স্ত্রীকে ডিভোর্স দেওয়া ছাড়া সৌমিত্রর সামনে আর কোনো উপায় ছিলো না।

সৌমিত্র যা করেছেন তা ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্য মেনেই করেছেন। ভারতীয় সংস্কৃতি বলতে বিজেপি বোঝে হিন্দু সংস্কৃতি যা দাঁড়িয়ে আছে প্রধান দুটি স্তম্ভের উপর - পুরুষতন্ত্র এবং বর্ণবৈষম্য তথা জাতিভেদ প্রথা। আর পুরুষতন্ত্রের প্রধান স্তম্ভ হলো লিঙ্গবৈষম্য। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নিরঙ্কুশ আধিপত্য ও কর্তৃত্ব পুরুষজাতির, স্ত্রীজাতি ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের সেখানে মানুষ হিসাবে কোনো মর্যাদা নেই, নেই কোনো স্বাধীনতা ও অধিকারও। পুরুষজাতির ইচ্ছাই স্ত্রীজাতির কর্ম। পুরুষতন্ত্রের দুটো শাখা – পিতৃতন্ত্র ও স্বামীতন্ত্র। পিতৃতন্ত্র মানে সন্তানদের উপর পিতার নিরঙ্কুশ আধিপত্য ও কর্তৃত্ব। পিতা হলো পরিবারের একমাত্র কর্তা ও শাসক। সন্তানরা কী পরবে, কী খাবে, কোন স্কুলে/কলেজে পড়বে, কোন শাখায় পড়বে, কাকে ও কোথায় বিয়ে করবে সব ঠিক করবে পিতা, সেখানে সন্তানের মায়ের মতামত মূল্যহীন। স্বামীতন্ত্র মানে অনুরূপভাবে স্বামীর নিরঙ্কুশ আধিপত্য ও কর্তৃত্ব। স্বামী ও স্ত্রীর সম্পর্ক হলো আসলে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্কের মতন। স্বামী যা নির্দেশ করবে স্ত্রী তা অম্লান বদনে পালন করবে। পুরুষতন্ত্রের এই সামাজিক বিধানই হিন্দু সমাজের বিধান, হিন্দু সংস্কৃতির অঙ্গও। বিজেপির বিরুদ্ধে তাই সৌমিত্রকে তাঁর স্ত্রীকে ইস্তফা দেবার জন্যে চাপ দেবার যে অভিযোগ উঠেছে তাকে অবিশ্বাস করার কারণ নেই। 

পুরুষতান্ত্রিক হিন্দু সংস্কৃতির ঐতিহ্য অনুযায়ী হিন্দু নারী হবে সীতা ও বেহুলার মতন সতীস্বাধ্বী পতিব্রতা নারী। সীতার মতন বিনা প্রতিবাদে স্বামীর কথায় আগুনে ঝাঁপ দেবে, পাতালে প্রবেশ করবে। বেহুলার মতন মৃত স্বামীর দেহ নিয়ে স্বর্গে গিয়ে দেবতাদের নাচ দেখিয়ে মন গলাবে। হিন্দু সংস্কৃতি মতে বিয়ে হলো জন্ম-জন্মান্তরের বন্ধন। স্বামী অজস্র বিয়ে করতে পারবে, স্ত্রীকে ত্যাগ করে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে পারবে, কিন্তু উল্টোদিকে স্ত্রী স্বামীর মৃত্যু হোক বা না হোক, স্ত্রীকে খেতে দিক বা না দিক, স্ত্রী তাকে ত্যাগ করে দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবে না। কারণ,  স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর বন্ধন যে ইহকাল ও পরকালেরও। হিন্দু রমণী বিধবা হলে তাই হয় চিতায় উঠবে, না হয় আজীবন বিধবাই থাকবে। মূল কথা হলো হিন্দু নারী কোনো পরিস্থিতিতেই স্বামীকে ছেড়ে যাবে না সে জীবিতই হোক কিংবা মৃতই হোক। কোনো হিন্দু নারী এসব বিধি-বিধান লঙ্ঘন করলে তাকে কঠোর শাস্তি পেতে হবে। বিজেপি ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সুজাতার একান্ত নিজস্ব – এটাতো স্পষ্টত পুরুষতান্ত্রিক হিন্দু কোডের লঙ্ঘন এবং কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সৌমিত্র সেই কোড ও বিজেপির অনুশাসন মেনেই সুজাতাকে কঠোরতম শাস্তির ঘোষণা শুনিয়েছেন।                         

সুজাতা যদি সুজাতা খাঁন না হয়ে শাহনাজ পারভীন হতেন তা হলেও তাঁর জন্যে ওই একই শাস্তি বরাদ্দ ছিলো। কারণ, কারণ, ইসলামও পুরুষতন্ত্রের ধ্বজাধারী একটি ধর্ম যেথানে রয়েছে  নারীর উপর পুরুষের নিরঙ্কুশ আধিপত্য ও কর্তৃত্ব। ইসলামি সংবিধানের পোশাকি নাম শরিয়ত। শরিয়ত অনুযায়ী সেই নারীই আদর্শ মুসলিম নারী যে স্বামীকে প্রভু মেনে তার ভৃত্যগিরি করবে, সদাই স্বামীর নির্দেশ তামিল করবে, কোনো পরিস্থিতিতেই স্বামীর অবাধ্য হবে না, স্বামী অসন্তুষ্ট হয় এমন কাজ করবে না, স্বামীকে ত্যাগ করার কথা মনেও ঠাঁই দেবে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। মুসলিম নারী যদি স্বামীর অবাধ্য হয় তবে শরিয়তে তার জন্যেও রয়েছে চরম শাস্তি তথা তালাকের বিধান। (দ্রঃ কোরানের ৪/৩৪ নং আয়াত)              

সুজাতার দলত্যাগে নীতি-নৈতিকতা নেই, আছে শুধুই সুবিধাবাদ

ভারতীয় রাজনীতি থেকে দ্রুত গতিতে অপসৃত হচ্ছে নীতি ও আদর্শ এবং ত্যাগ, শৃঙ্খলা, মানবতা, উদারতা, নিঃস্বার্থপরতা, দল ও দশের প্রতি দায়বদ্ধতা ও নিষ্ঠা ইত্যাদি মূল্যবোধগুলি। ফলে ভারতীয় রাজনীতির জগৎটা পরিণত হয়েছে পশুহাটের মতন নেতা-নেত্রী এবং জনপ্রতিনিধি কেনাবেচার হাটে। যতদূর মনে পড়ে, কংগ্রেসী জামানায় প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও-এর আমলে এর সূত্রপাত হয়েছিলো। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হবার পর জনপ্রতিনিধি কেনাবেচাটা প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নিয়েছে। জনগণের রায় তিনি মানতে চাইছেন না। জনগণ তাঁর দলকে মোটা অর্থ ও মন্ত্রীত্বের বিনিময়ে ঘোড়া কেনার মতন বিধায়ক ও সাংসদ কেনার খেলায় মত্ত হয়ে উঠেছেন। বিধায়ক কিনেই তিনি ব্যাঙ্গালোর ও মধ্যপ্রদেশের মতন দুটি বড় রাজ্য দখল করেছেন। গোয়া, মণিপুরও ও হরিয়ানাও দখল করেছেন অনৈতিকভাবে। পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু ব্যাপকহারে জনপ্রতিনিধি কেনা শুরু হয়ে আরও আগে, ২০১১ সালে মমতা ব্যানার্জী ক্ষমতায় আসার পর থেকে। সেই কেনাবেচার রাজনীতিতে শুধু বিরোধী দলের বিধায়ক ও সাংসদ বিক্রী হয় নি, বিক্রি হয়ে গেছে আস্ত দুটো জেলা পরিষদ (মুর্শিবাদ ও মালদহ জেলা পরিষদ) এবং অনেকগুলি পৌরসাভাও। বিশাল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে যে বিধায়ক কেনাবেচা হয়েছে তা ফাঁস করে দিয়ে গেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রভাবশালী নেতা ও মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী বিজেপিতে যাবার আগে। ক্যামেরার সামনে বলেছেন যে মুর্শিদাবাদের খড়গ্রাম বিধানসভার কংগ্রেসের বিধায়ককে কেনা হয়েছে পঞ্চাশ লক্ষ টাকায় এবং একই জেলার নবগ্রাম বিধানসভার সিপিআই (এম)-এর বিধায়ককে কেনা হয়েছে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা ও একটা স্করপিয় গাড়ির বিনিময়ে।

পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন জনপ্রতিনিধি কেনাবেচার বাজারে ক্রেতা ছিল একজনই। কিছুদিন হলো বাজারে নেমেছেন আর একজন যিনি আরও বড় ক্রেতা। ফলে বিধায়ক কেনাবেচার বাজার এখন আরও জমজমাট। বাজারটা আরও বেশী জমে উঠেছে শুভেন্দু মালিক বিজেপিতে যাওয়ায়। ফলে পশ্চিমবঙ্গে শাসকদলে এখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। বিধায়ক ও সাংসদ এবং অন্যান্য জনপ্রতিনিধিদের দল বদলানোটা ব্যাপক চেহারা নিয়েছে। সকালে বিকালে দল বদল হচ্ছে। দল বদলের খবরে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে সম্প্রতি সুজাতা খাঁনের দল বদলেও।    

সুজাতার দল বদলের সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। তবুও তাঁর দল বদলে অনৈতিকতা ও সুবিধাবাদের ছাপ ভীষণভাবেই স্পষ্ট। তিনি তো নিজেই জানিয়েছেন যে তার দল বদলের পেছনে রয়েছে তাঁর আশা ও মোহভঙ্গের ক্ষোভ। তিনি অভিযোগ করেছেন যে তার যা প্রাপ্য (নেতৃস্থানীয় পদ) বিজেপি তা দেয় নি। বিজেপি তাঁর প্রতি অবিচার করেছে, তাঁকে ঠকিয়েছে যে ক্ষোভে তিনি বিজেপি ত্যাগ করেছেন। তাঁর অভিযোগ যুক্তিসঙ্গত হলে তিনি দলে থেকেই প্রতিবাদ করতে পারতেন, কিংবা নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারতেন। তা হলে কেউ তাঁর বিরুদ্ধে আঙুল তুলতে পারতো না। তাঁর দিকে আঙুল উঠছে আর একটা কারণে। তা হলো, দল বদল করে প্রত্যাবর্তন করেছেন সেই দলেই যে দল তিনি ছেড়ে গিয়েছিলেন, যে দল প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে তাঁর উপর অত্যাচারের স্টীম রোলার চালিয়েছে, তাঁকে চাকরিচ্যুত পর্যন্ত করেছে। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে তাঁর দল বদলে নীতি-নৈতিকতা নেই, যা আছে তা অনৈতিকতা ও সুবিধাবাদ।         

তবুও সুজাতার পদক্ষেপকে স্বাগত

সুজাতা খাঁনের দলত্যাগ ও অন্য দলে যোগদানের দুটো দিক আছে। একটা দিক কেবলই  নীতিহীনতা ও ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা যা উপরে বর্ণিত হয়েছে। আর একটি দিক হলো, একজন নারীর নারী থেকে মানুষ হয়ে ওঠার দুঃসাহসিক চেষ্টা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ও সমাজব্যবস্থায় নারী শিশু ভূমিষ্ঠ হয় একজন মানব সন্তান হিসেবে। কিন্তু তাকে ধীরে ধীরে মানব সন্তান থেকে নারী করে গড়ে তোলা হয়। তার মানসিক গড়ন, চিন্তন ও দর্শন এমনভাবে গড়ে তোলা হয় যে, সে এটা মেনে নেয় যে, তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা, পছন্দ-অপছন্দ, আশা-আকাঙ্খা ও ব্যক্তিগত মতামত থাকতে নেই, থাকাটা অন্যায় ও অনৈতিক; তার নিজস্ব কোনো স্বাধীনতা ও অধিকার থাকতে নেই, তা চাওয়াটা তার এক্তিয়ার বহির্ভূত; সেই হলো আদর্শ নারী যে বিয়ের আগে থাকবে পিতার বাধ্য ও অনুগত এবং বিয়ের পর থাকবে স্বামীর অনুগত ও বাধ্য; সেই হলো আদর্শ স্ত্রী যে হবে সীতা ও বেহুলার মতন পতিভক্ত এবং পুরুষের এঁকে দেওয়া লক্ষণ রেখা অতিক্রম করবে না; সেই নারীই প্রকৃত অর্থে আদর্শ নারী যার নিজস্ব সত্ত্বা ও পরিচয় থাকবে না; একজন আদর্শ স্ত্রী হবে সেই নারী যে আক্ষরিক অর্থেই হবে সহধর্মিণী ও সহগামিণী ইত্যাদি ইত্যাদি। নারীর মস্তিষ্ক ধোলাই করার জন্যে পুরুষ অনেক নির্মাণ করেছে নারীর জন্যে। সহধর্মিণী ও সহগামিণী হলো সে রকম দুটো শব্দ যা লেপটে দেওয়া হয়েছে নারীর উপর। সহধর্মিণী মানে নারীর নিজের কোনো ধর্ম থাকতে নেই, স্বামীর ধর্মই তার ধর্ম এবং সহগামিণী মানে নারীর নিজস্ব কোনো গমন থাকতে নেই, স্বামীর অনুগামিণী হওয়াই তার একমাত্র ধর্ম।  

পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পুরুষজাতি নারীর হাতে পায়ে মনে মননে ও মস্তিষ্কে অজস্র বেড়ি পরিয়ে রেখেছে, নারী আপাদমস্তক পুরুষের তৈরি নিয়ম-কানুনের লৌহশৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত। এই শৃঙ্খল যে নারী ভাঙার একটু চেষ্টা করেছে তখনই তার উপর নেমে এসেছে কঠোর শাস্তি, সঙ্গে সঙ্গে তাকে বেজাত, ব্যভিচারী, পতিতা, ইত্যাদি কুৎসিত তকমা দিয়ে পরিবার ও সমাজের কাছে অচ্ছুত করে তার জীবন দুর্বিষহ করে তোলা হয়। তা দেখে অন্য নারীদের হৃদয় কম্পন শুরু হয়ে যায়, ফলে যে নারী প্রতিবাদী হতে চায় সেও ভয়ে সেঁটিয়ে যায়। এই বাস্তবতার কথা একজন পুরুষের চেয়ে অনেক বেশী বোঝে একজন নারী। সুজাতা খাঁনের পদক্ষেপকে বিচার করা দরকার এই বাস্তবতার কথা মাথায় রেখে। তিনি শুধু একটা দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন নি, বিদ্রোহ করেছেন হাজার হাজার বছর ধরে জগদ্দল পাথরের মতন পুরুষতান্ত্রিক যে ব্যবস্থা সমাজের বুকে চেপে বসে রয়েছে তার বিরুদ্ধে। স্বামীর পরিচয়ের ঘেরাটোপের বাইরে বেরিয়ে এসেছেন নিজস্ব সত্ত্বা ও পরিচয় অর্জনের জন্যে। সহধর্মিণী ও সহগামিনীর তকমা ছিন্ন করে নিজের পছন্দের রাস্তায় পদক্ষেপ করেছেন। স্বামীর স্বার্থ ও ইচ্ছার বেড়া ভেঙে নিজের ইচ্ছা ও স্বার্থকে রূপায়িত করার জন্যে পদক্ষেপ করেছেন। সেই পদক্ষেপকে আমি আন্তরিকভাবেই কুর্ণিশ জানাই, স্বাগত জানাই।        

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...