হিজরির সপ্তম বর্ষে খায়বার যুদ্ধের আগে মুহাম্মদ
বিয়ে করেন আর একজন মুসলিম বিধবাকে যাঁর নাম উম্মে হাবিবা । এই বিয়েটাও মুহাম্মদের
উল্লেখযোগ্য বিয়েগুলির একটি । এ বিয়েটা নিয়েও নানা মতভেদ দেখা যায় । মতভেদ রয়েছে
মুসলিম লেখক ও ইসলামের পণ্ডিতদের মধ্যেও ।
যখন উম্মে হাবিবাকে মুহাম্মদ বিয়ে করেন তখন তাঁর হারেম আলোকিত করছেন কমপক্ষে ৫/৬ জন স্ত্রী । স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে,
আবার কেনো বিয়ে ? এই অপ্রিয় ও অস্বস্তিকর প্রশ্নের উত্তর একেকজন এক এক রকম ভাবে দিয়েছেন । কেউ কেউ বলেছেন সম্পূর্ণ মানবিক
কারণে বা মানবতার জন্যে মুহাম্মদ তাঁকে বিয়ে করেছিলেন । কেউ কেউ বলেছেন কূটনৈতিক কারণে । আবার কেউ বলেছেন
প্রতিশোধ নিতে । ঠিক কী কারণে মুহাম্মদ
উম্মে হাবিবাকে বিয়ে করেছিলেন তা নিশ্চয় করে বলা কঠিন । তবে এটা নিশ্চয় করেই বলা সম্ভব যে মানবতার
কারণে নিশ্চয়ই নয় । এবার বিয়েটা কোন প্রেক্ষাপটে ও কোন পরিস্থিতিতে হয়েছিল তার প্রতি দৃষ্টিপাত করা যাক । তাহলে অন্ততঃ এই
বিয়েটার পশ্চাতে যে রহস্যটি নিহিত রয়েছে সেটা বুঝতে কিছুটা সুবিধা হবে ।
উম্মে হাবিবার নাম উম্মে হাবিবা ছিলো না । তাঁর
আসল নাম ছিলো রমালাহ । তিনি ছিলেন আবু সুফিয়ানের মেয়ে । ইনি সেই আবু সুফিয়ান যিনি ছিলেন ইসলাম ও মুহাম্মদের
সবচেয়ে বড়ো শত্রু, যাকে বলে জাতশত্রু । মুহাম্মদ যখন মক্কায় ইসলাম প্রচার শুরু
করেন তখন সেখানে কুরাইশদের মধ্যে তিন জন ব্যক্তি ছিলেন অত্যন্ত প্রাভাবশালী ও
ক্ষমতাশালী । তাঁরা ছিলেন উৎবা,
আবু জেহেল ও আবু সুফিয়ান । আবু সুফিয়ান ছিলেন শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধের প্রশ্নে বা
যুদ্ধের ময়দানে প্রধান নেতা । মুসলিম
লেখকদের কেউ কেউ বলেছেন যে ফৌজি পতাকা
থাকতো আবু সুফিয়ানের হাতে । কুরাইশ বংশের
মধ্যে দুটি প্রধান গোত্র বা বংশ ছিল –
আব্বাশীয় বংশ ও উমাইয়া বংশ । যার নামে উমাইয়া বংশের পরিচিতি আলাদাভাবে গড়ে ওঠে বা স্বীকৃতি
পায় সেই উমাইয়ার পুত্রের নাম ছিলো হরব, আর
হরবের পুত্র ছিলেন আবু সুফিয়ান । অর্থাৎ
বংশ পরিচয়ে আবু সুফিয়ান ছিলো একজন উঁচুস্তরীয় অভিজাত বংশের উত্তরাধিকার । আবু সুফিয়ান ছিলেন আবার মক্কার বুকে একজন প্রতিষ্ঠিত
ধনী বণিকও । স্বভাবতই
তাঁর মেয়ে রমালাহ-র মধ্যে শিক্ষা, বিদ্যা-বুদ্ধি ও আচার-আচরণে একটা আলাদা
ও বিশেষ বৈশিষ্ট বিদ্যমান ছিলো । আবু
সুফিয়ান তাঁর সেই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন
ওবায়দুল্লাহ বিন জাহাশের [ ওবাইদুল্লাহ/আব্দুল্লাহ] সঙ্গে । পরে ওরা দুজনেই
নিজেদের ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং মুহাম্মদের নির্দেশে আবিসিনিয়া হিজরত করেন ।
আবিসিনিয়া গিয়ে খৃস্টানদের সংস্পর্শে কিছুদিন
থাকার পর উম্মে হাবিবার স্বামী ওবাইদুল্লাহ ইসলাম ত্যাগ করে
পুনরায় খৃস্ট ধর্মে ফিরে যান ।
উম্মে হাবিবা কিন্তু তাঁর নিজের ধর্মে অটল থাকেন । ওবাইদুল্লাহ বিন জাহাশ ইসলাম ত্যাগ করার অল্প
কিছু দিন পরেই অসুখে পড়েন এবং মারা যান । এ
খবর পাওয়ার পর মুহাম্মদ লোক পাঠিয়ে উম্মে হাবিবাকে আবিসিনিয়া থেকে মদিনায় আনিয়ে
তাঁকে বিয়ে করেন । কোনো কোনো মুসলিম লেখক বলেছেন যে আবিসিনিয়াতেই বিয়েটা সম্পন্ন হয়েছিলো । বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন
আবিসিনিয়ার শাসন কর্তা নাজ্জাশী স্বয়ং এবং তিনিই বিয়ের পর খোতবা পড়েছিলেন । মার্টিন লিংস এ প্রসঙ্গে লিখেছেন – ইতিমধ্যেই
তাঁর স্বামীর মৃত্যুর চার মাস পেরিয়ে গেছে
। মহানবী [সাঃ] নাজ্জাশীর নিকট এই মর্মে সংবাদ প্রেরণ করেন যে, তিনি যেন এই
বিধিবার [উম্মে হাবিবার] সঙ্গে মহানবীর বিবাহ সংবাদ দেন এবং এই মহিলা সম্মত হলে
তার [মহানবীর] অবর্তমানেই বিবাহ পড়িয়ে দেন । সরাসরি উম্মে হাবীবার নিকট মহানবী
কোনো বার্তা প্রেরণ করেন নি । কিন্তু এই মহিলা স্বপ্নে দেখেছেন যে, কেউ স্বপ্নে
এসে তাকে উম্মুল মু’মেনীন নামে সম্বোধন করছেন এবং এই স্বপ্নের তিনি এই তাবীর
করেছেন যে, তিনি মহানবী [সাঃ] – এর স্ত্রী হবেন। পরবর্তী দিবসেই তিনি নাজ্জাশীর
নিকট থেকে এই শুভ সংবাদ অবগত এবং নিজের সম্পর্কে নিশ্চিত হতে সমর্থ হন । [দ্রঃ মহানবী [সাঃ] এঁর বিয়ে,পৃ-১১৮] মুহাম্মদের
মুসলিম জীবনীকারদের অধিকাংশই মনে করেন যে বিয়েটা হয়েছিলো আবিসিনিয়াতেই এবং মুহাম্মদের
অনুপস্থিতিতেই ।
মুহাম্মদ ও উম্মে হাবিবার বিয়ে কোথায় হয়েছিলো –
মদিনায় না আবিসিনিয়ায় – তা নিয়ে মতভেদ যেমন আছে তেমনি মতভেদ আছে উম্মে হাবীবার বয়স
এবং তাঁকে বিয়ে করার কারণ নিয়েও । একটা মত হলো মুহাম্মদ উম্মে হাবীবাকে বিয়ে করেছিলেন মানবতার
কারণে, আরেকটি মতো হলো চিরশত্রু আবু
সুফিয়ানকে মানসিকভাবে দূর্বল করে পক্ষে টানার জন্যে, আবার কেউ বলেছেন আবু
সুফিয়ানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে । মুহাম্মদের জীবনীকার ঐতিহাসিক ড.
ওসমান গণির মতে একই সঙ্গে মানবিক কারণে এবং আবু সুফিয়ান ইসলাম-বিরোধিতার মুখ
ঘুরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে মুহাম্মদ উম্মে
হাবীবাকে বিয়ে করেছিলেন । তিনি এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “ আবদুল্লাহ সপরিবারে
আবিসিনিয়াতে হিযরত করেন । সেইখানে তিনি মারা যান । তখন আবু সুফিয়ান চরম
নবী-বিদ্বেষী চূড়ান্ত শত্রু । সুতরাং মহিলার অন্য কোথাও যাওয়ার কোনো পথ ছিলো না ।
তাই মহানবী তাঁকে দাসী নয়, স্ত্রীর মর্যাদা দেন । সঙ্গে সঙ্গে এই বিবাহ দ্বারা
হযরত মুহাম্মদ [সাঃ] আবু সুফিয়ানের মতো দুর্ধর্ষ নেতার কূটনীতিকে মুসলমানের দিকে
মোড় ফেরান । [দ্রঃ মহানবী, পৃ-৩৯২] আরেকজন জীবনীকার মহম্মদ হোসেন হেইকলের লেখা থেকে
এই বিয়েটার অন্য একটা কারণের উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায় । তিনি লিখেছেন – “অপরাপর
ঐতিহাসিকগণ এই বিবাহের মাধ্যমে অন্যরকম
চিত্র খুঁজে পান । তারা উম্মে হাবীবা ও
মুহাম্মদ – এর বিবাহে শেষোক্ত জন কর্তৃক আবু সুফিয়ানকে শাস্তি প্রদান এবং তাকে
ক্ষুব্ধ করার কৌশল হিসাবে চিত্রিত করেন । কেননা আবু সুফিয়ান তখন ছিলো একজন
পৌত্তলিক ।” [দ্রঃ মহানবী [সাঃ] এঁর বিয়ে, পৃ-
১২০]
উম্মে হাবিবাকে মুহাম্মদ কেন বিয়ে করেছিলেন তার
রহস্য উদ্ঘাটন করার জন্যে উম্মে হাবিবার বয়স কত ছিলো তা জানা খুব জরুরী । কারণ,
উম্মে হাবীবার বয়সের সঙ্গে তাঁকে মুহাম্মদের বিয়ে
করার গভীর সম্পর্ক রয়েছে । সাধারণভাবে মুসলিম জীবনীকারগণ মুহাম্মদের স্ত্রীদের
বয়সের বিষয়টি হয় উপেক্ষা করেন, না হয় বেশী
করে দেখিয়ে থাকেন । সেটা এটা প্রমাণ করার জন্যে
যে, মুহাম্মদ যৌন তাড়নার বশে কাউকে
বিয়ে করেন নি । তাঁরা দাবি করে থাকেন যে,
তিনি বহু বিবাহ করেছিলেন হয় মানবতার কারণে, না হয় ইসলামের স্বার্থ রক্ষা করার
তাগিদে । কিন্তু তাঁর প্রত্যেকটি বিয়ের ঘটনার – উম্মে হাবীবার
বিয়ের আগের ও পরের - প্রেক্ষাপট যদি সৎ, নির্ভিক, নির্মোহ ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করা যায় তবে দেখা যাবে যে আসল চিত্রটা ঠিক তার বিপরীত । প্রত্যেকটা বিয়ের পেছনেই অন্যান্য কারণ আর যাই
থাক না কেনো, প্রধান কারণ অবশ্যই ছিল অনিয়ন্ত্রিত প্রবল যৌন-কামনা ।
উম্মে হাবিবার ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছিলো । উম্মে হাবীবা ছিলেন খুবই
সুন্দরি ও তাঁর বয়স ছিলো মাত্র সাতাশ । মুসলিম জীবনীকারগণ অবশ্য বলেন যে তাঁর বয়স
ছিলো আটত্রিশ যা বিশ্বাসযোগ্য নয় । প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে খাদিজা ছাড়া মুহাম্মদের বাকি
সকল স্ত্রীর বয়স ছিলো ত্রিশের নিচে, তবে অধিকাংশ স্ত্রীর বয়সই ছিলো তেরো থেকে ঊনিশের মধ্যে । তাই এটাই স্বাভাবিক যে উম্মে হাবীবার রূপ ও যৌবনই মুহাম্মদকে আকৃষ্ট করেছিলো প্রবলভাবে । ইসলামের
প্রতি তাঁর [উম্মে হাবীবার] প্রগাঢ় ঈমান
বা অসহায়তা কোনোটাই বড়ো কারণ ছিলো না,
যেমন বড়ো কারণ ছিলো না আবু সুফিয়ানের মন জয় করা বা তাকে আঘাত করা । উম্মে হাবীবার বয়স যদি বেশী হত, তিনি যদি যৌবনবতী
না হতেন, তবে মুহাম্মদ তাঁকে বিয়ে করতেন কী না যথেষ্ট সন্দেহ ছিল । যৌবনহীন রূপবতী নারী
তাঁর মোটেই পছন্দ ছিলো না । যখন সওদার বয়স একটু বেশী
হয়ে গিয়েছিলো, এবং তাঁর যৌবন যখন পড়তির
দিকে তখন মুহাম্মদ তাঁকে তালাক দিয়েছিলেন। পরে
এই শর্তে তিনি তালাক প্রত্যাহার করে নেন যে
সওদা মুহাম্মদের সঙ্গে রাত্রি যাপন করার অধিকার আয়েশাকে ছেড়ে দেবেন । মুহাম্মদ যে
বিগত-যৌবনা কোনো রূপবতী নারীকে পছন্দ করতেন না তার আরো প্রমাণ পাওয়া যায় । সে রকম একটি ঘটনাটি সংক্ষেপে এ রকম । একজন নারী বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল তাঁর মাথার চুলের
সৌন্দর্য ও দৈর্ঘের জন্যে । চুল ছিলো মাথা থেকে পা পর্যন্ত
লম্বা । সেই নারীর কথা শুনে বা
তাকে পিছন থেকে দেখে মুহাম্মদ তাঁর প্রতি কামাসক্ত হয়ে পড়েন । তিনি তার ছেলেকে
বলেন যে তার মাকে তাঁর খুব পছন্দ এবং তিনি তাকে বিয়ে করতে চান । ছেলেটির মা ও
ছেলেটি দুজনেই সানন্দে সম্মতি দেন । মুহাম্মদ তখন তাঁর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে
পাঠান নারীটির সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্যে । তারা মুহাম্মদকে খবর দেন যে
নারীটির বয়স বেশী । মুহাম্মদ তখন সেই নারীর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন এবং বিয়েটা
বাতিল করে দেন ।
এই ঘটনাটি আনোয়ার হেকমত বর্ণনা করেছেন ইহুদি
ধর্মের বনি মুস্তালিক গোত্রের কন্যা জুয়াইরিয়াকে মুহাম্মদের বিয়ে করা প্রসঙ্গে । তিনি লিখেছেন -
Would Allah’s messenger have married her if
she was not young and pretty? It is doubtful. Another story about Muhammad
concerns his initial interest in a woman whose hair was reputedly long enough
to cover all her body. Muhammad approached the woman’s son and asked him if he
could marry his mother. The mother and the son both agreed. In the mean time,
Muhammad sent some of his close friends to investigate, but when he learned
that she was ‘aging’ he lost interest and cancelled the wedding. [Vide: Women
and the Koran, page-55]
না, আনোয়ার নিজের মনগড়া কথা লেখেন নি । তিনি
ঘটনাটা উদ্ধৃত করেছেন মাত্র । যেখান থেকে উদ্ধৃত করেছেন সেটা হলো – Ibn Sa’ad, Kitab
al-Tabaqat al-kabir, p.154