কলকাতার টিপু সুলতান মসজিদ কলকাতার একটি পর্যটন কেন্দ্র। কারণ, এটা একটি
ইতিহাস প্রসিদ্ধ মসজিদ। এ মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন মহিশুরের নবাব টিপু সুলতানের
কনিষ্ঠ পুত্র প্রিন্স গোলাম মহম্মদ ১৮৪২ খৃষ্টাব্দে। এ মসজিদের দরজা
মুসলিম-অমুসলিম সবার জন্যে খোলা যা ইসলাম-সম্মত নয়। ঐতিহাসিক এই মসজিদের ইমাম
হিসেবে মাওলানা সৈয়দ নুরুর রহমান বরকতি পূর্ব থেকেই বিশেষ খ্যাতি ও মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। তাঁর সে খ্যাতি
ও মর্যাদা এবং তার সঙ্গে পরিচিতিটাও ব্যাপক বৃদ্ধি লাভ করে তৃনমূল কংগ্রেস সরকারের শাসন কালে।
এমনিতেই এ রাজ্যের আলেম সমাজ এবং তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের মধ্যে সম্পর্কটা মধুর।
বরকতি কিন্তু সকলকে ছাপিয়ে খুব দ্রুতই এই সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর কাছের লোক হয়ে
ওঠেন। মাঝেমাঝেই তাঁকে দেখা যায় সরকারি ও শাসক দলের দলীয় অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীর
পাশের আসনে। বিনিময়ে তিনিও মুখ্যমন্ত্রীকে আরো বেশী তুষ্ট ও তোয়াজ করতে থাকেন।
মুখ্যমন্ত্রীর অনুকূলে ধর্মীয় ফতোয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক ফতোয়াও দিতে থাকেন অনর্গল।
তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি বলেন যে,
ভারতের মানুষ মোদিকে আর প্রধানমন্ত্রী দেখতে আর চান না, তারা মমতা ব্যানার্জীকে
প্রধানমন্ত্রী দেখতে চায়। পারষ্পরিক এই লেনদেনে বরকতি ও মুখ্যমন্ত্রীর সম্পর্কের
রসায়নটা ক্রমশঃ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকে। ফলে
খ্যাতি, মর্যাদা ও পরিচিতির পাশাপাশি তাঁর প্রভাব, প্রতিপত্তি ও ক্ষমতাও চড় চড় করে
বাড়তে থাকে। ক্রমে তিনি নিজেকে একজন ধর্মীয় নেতার পাশাপাশি মুসলমানদের রাজনৈতিক নেতাও
ভাবতে শুরু করেন। এমনকি নিজেকে মুসলমানদের মসিহাও
ভাবতে শুরু করেন।
কিন্তু বরকতির জনপ্রিয়তা, খ্যাতি ও প্রভাব-প্রতিপত্তির লেখচিত্রের
ঊর্ধগতিহঠাৎই মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম। তার বিরুদ্ধে
চারিদিকে প্রবল সমালোচনা ও প্রতিবাদের ঝড় বইতে দেখা যাচ্ছে । এমনকি কিছু মানুষ
রাস্তায় নেমে বিক্ষোভও দেখাচ্ছে। সমালোচনা, প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ যা
হচ্ছে তা কিন্তু মূলতঃ মুসলমান সমাজ থেকেই। জামায়াত-ই-ইসলামী
হিন্দের সভাপতি বলেছেন যে বরকতির মন্তব্য ভয়ঙ্কর এবং মেরুকরণের রাজনীতিকেই উৎসাহ
যোগাবে। তিনি বরকতিকে উদ্দেশ্য করে আরো বলেছেন যে একজন ইমামের ভারসাম্য বজায় রেখে কথা
বলা উচিৎ। সর্বভারতীয় সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মোহম্মদ
কামারুজ্জামানও বরকতির ফতোয়ার তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন যে বরকতির মন্তব্য ও ফতোয়া সমস্ত ইমাম ও আলেম সমাজের মনে প্রবল আঘাত দিয়েছে। সারা
রাজ্য থেকে ইমামরা ফোন করে বরকতির ফতোয়ায়
তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বরকতির
রাজনৈতিক বক্তব্য ও ফতোয়ার বিরুদ্ধে শুধু সমালোচনা ও প্রতিবাদেই থেমে থাকেনি টিপু
সুলতান মসজিদের দেখভাল করার কাজে নিযুক্ত তদারকি কমিটি। মসজিদের মোতোয়াল্লি আনোয়ার
আলি শাহ সংবাদ মাধ্যমকে বলছেন, "আমরা উনাকে জানিয়েছি, যে মসজদিটা ধর্মীয় স্থান। সেখানে রাজনীতি আনবেন না। ইমামতির জায়গায় সেটাই করুন। আর রাজনীতির কথা নিশ্চয়ই তাঁর বলার অধিকার আছে, সেটা তিনি বাইরে বলুন, মসজিদে নয়। উনি বার বার মসজিদ চত্বর থেকে রাজনৈতিক কথা বললে সমাজের মধ্যে একটা ভুল বার্তা যাচ্ছে, যে উনি মসজিদে বসে যা বলছেন, সেটা সমস্ত মুসলমানদের কথা। কিন্তু তা তো নয়।" আনোয়ার
আলি শাহ আরো অভিযোগ করেছেন যে, গত শুক্রবারও (১৭.২.১৭) একটি সংবাদ সম্মেলন করতে বাধা দিলে, তাঁকে শারীরিকভাবে নিগ্রহ করা হয়।
চারিদিকে এতো সমালোচনা ও প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভ
সত্ত্বেও বরকতি তার অবস্থানে অনড় রয়েছেন। তিনি বলেছেন যে রাজনৈতিক ইস্যুতে ফতোয়া
দিয়ে কিছু ভুল করেন নি, এবং ভবিষ্যতেও এ রকম
ফতোয়া তিনি দিয়ে যাবেন।
মসজিদের
জায়গায় যে সব দোকান রয়েছে তাদের মালিকরা তো বরকতির
বিরুদ্ধে পথে নেমে বিক্ষোভও দেখাচ্ছে। বরকতির উদ্দেশ্যে দোকানদেরদের সংগঠন (‘সপকিপার ওয়েলফেয়ার এ্যাসোসিয়েশন’) পোস্টার
সেঁটে বলেছে যে মসজিদে বসে রাজনীতি করা চলবে না। দোকানদাররা অভিযোগ করেছেন যে
বরকতির গুণ্ডাবাহিনী দিয়ে তাদের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে এবং তাদেরকে হুমকি দেওয়া
দিচ্ছে। এর বিরুদ্ধে তারা গত বুধবার (১৫.২.১৭) ১২ ঘণ্টার বনধও পালন করেছে -
PROTEST
SHOP CLOSED 15.02.17
TO PROTEST AGAINST THREAT AND
ATROCITIES UNLEASHED BY THE
GOONS OF THE IMAM
OF TIPU SULTAN MASJID,
DHARMATALA
মসজিদের সম্পত্তি দেখভাল করা কমিটি এবং ‘সপকিপার
ওয়েলফেয়ার এ্যাসোসিয়েশন’ বরকতিকে অত্যন্ত
কড়া ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে যে মসজিদ ইমামতি করার জায়গা, ইমামতিই করতে হবে, মসজিদে
বসে রাজনীতি করা চলবে না। মসজিদকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে হবে। এ কথাগুলো মসজিদের
ভিতরেই শুধু নয়, পোস্টার লিখে প্রকাশ্যেই তারা এগুলি ঘোষণা করেছে। তাদের কয়েকটি
পোস্টার নীচে দেওয়া হলো -
OUR DEMAND
NO SYASAT
ONLY
IMAMAT
SHOPKEEPER’S WELFARE ASSOCIATION
(TIPU SULTAN MOSQUE)
185, LENIN SARANI KOLKATA –
700013
OUR DEMAND
KEEP MASJID FREE
FROM POLITICS
SHOPKEEPER’S WELFARE ASSOCIATION
(TIPU SULTAN MOSQUE)
185, LENIN SARANI KOLKATA –
700013
OUR DEMAND
NO POLITICS
IN MASJID
SHOPKEEPER’S WELFARE ASSOCIATION
(TIPU SULTAN MOSQUE)
185, LENIN SARANI KOLKATA –
700013
বরকতির
বিরুদ্ধে মুসলিম সমাজে ক্ষোভের সূত্রপাত ঘটে মূলতঃ বিজেপির নেতাদের বিরুদ্ধে
ফতোয়া দেওয়ার পর থেকে। সেই ক্ষোভের
বিষ্ফোরণ ঘটে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে ফতোয়া দেওয়ার পর। গতো ৭ই জানুয়ারী তিনি তৃণমূলের দুই সাংসদ ও বিধায়ককে পাশে নিয়েই প্রধানপমন্ত্রীকে ন্যাড়া করার ফতোয়া দেন। সর্বভারতীয় মজলিশ-ই-শুরা ও সর্বভারতীয় সংখ্যালঘু ফোরামের সভায় নোট বাতিলের
প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন যে নোট বাতিল করে মোদি যে পাপ করেছেন তার জন্যে তার দাড়ি
কেটে মাথা ন্যাড়া করে মুখে চুনকালি লাগিয়ে তাকে শাস্তি দিতে হবে। তিনি আরো বলেন, এই কাজটি যে করবে তাকে ২৫ লক্ষ টাকা
পুরষ্কার দেওয়া হবে। দেখুন সেই ভিডিওটি - https://youtu.be/Ddv9aPwFrJc। প্রধানমন্ত্রীর পদটি অত্যন্ত সম্মানের। তাঁর বিরুদ্ধে এহেন উস্কানিমূলক ও অসভ্য ফতোয়া
আইনের চোখেও গুরুতর অপরাধ। বরকতি এ রকম ফতোয়া দেওয়ার সাহস পেলেন কোথায়?
গতো
ডিসেম্বরে বরকতি আর একটি প্ররোচনামূলক ফতোয়া দিয়েছিলেন। সেটা ছিলো বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের বিরুদ্ধে। বলেছিলেন, দিলীপ ঘোষকে পাথর ছুঁড়ে মেরে বাংলার থেকে বের করে দিতে হবে।
তিনি এর আগে তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে তিন তিনটে ফতোয়া দিয়েছিলেন। সেটা ছিলো বাম জামানা।. তিনবারই ঘোষণা করেছিলেন তাঁর মাথার দাম। শেষ ফতোয়াটা তো ছিলো সাংঘাতিক। বলেছিলেন, যে তসলিমার মুন্ডুটা কাটতে পারবে তাকে এক লক্ষ নয়, পাঁচ লক্ষ নয়, আনলিমিটেড টাকা দেওয়া হবে। দেখুন সেই ভিডিওটি - http://youtu.be/AOAAcLxNIBQ। এ রকম প্ররোচনামূলক ও হিংসাত্মক ফতোয়া বারবার দেওয়া সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে কোনো সরকারই কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে বরকতি বুঝে গিয়েছেন যে,
যে ফতোয়াই তিনি দেন না কেনো পুলিশ তার কেশাগ্র পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারবে না। ফলে
সরকারের প্রশ্রয় ও মদতে তিনি ক্রমে ক্রমে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। তাই প্রধানমন্ত্রীর পদে
সমাসীন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী নরেন্দ্র মোদির দাড়ি
কেটে মাথা মুড়িয়ে মুখে চুনকালি মাখিয়ে দেওয়ার ফতোয়া দিতে ভয়ে তার বুক মোটেই কাঁপে নি।
প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বরকতির ফতোয়ায় তাই আমাকে বিষ্মিত
করেনি। আমাকে বরং যার পর নাই বিষ্মিত
করেছে বরকতির বিরুদ্ধে আলেম সমাজের সরব প্রতিবাদ এবং সাধারণ মুসলিমদের রাস্তায় নেমে
বিক্ষোভ প্রদর্শনের ঘটনা। বিষ্মিত তো হবারই কথা। কারণ বরকতি ইসলামের অবমাননা হয়
এমন কোনো ফতোয়া দেননি। সেজন্যেই তো বরকতি যখনই যে ফতোয়া দিয়েছেন আলেম সমাজ ও
মুসলিমরা তাকে করতালি দিয়ে সমর্থন
জানিয়েছে। তা হলে প্রশ্ন ওঠে – আলেম সমাজ এবং মুসলমানরা হঠাৎ তার বিরুদ্ধে
প্রতিবাদে সরব হলো কেনো? মুসলমান এবং
আলেমদের কি তাহলে বোধদয় হয়েছে? ইসলামিক মূল্যবোধের কট্টর অবস্থান থেকে তারা বেরিয়ে
আসতে চায়? কিন্তু এও কি সম্ভব? যারা
বহুবিবাহ ও তালাকের মতো অসভ্য আইনের পক্ষে আজো পাহাড়ের মতো অনড়, লাখো মানুষের হত্যাকারী ওপার বাংলার
যুদ্ধাপরাধিদের বাঁচাতে কলকাতার রাজপথে নামে, জেহাদি কর্মকাণ্ডে সংস্লিষ্ট মাদ্রাসার বিরুদ্ধে
ব্যবস্থা নিলে প্রতিবাদ করে, মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসারের জন্যে আন্দোলন করে, লাদেন
এবং মোল্লা ওমরের মতো পিলে চমকানো বিশ্বসন্ত্রাসীদের প্রতি শ্রদ্ধায় গদগদ থাকে, তাদের এমন আমূল পালটে যাওয়া কি সম্ভব? না, তা মনে
হয় না। বরং মনে হয় এর পেছনে রয়েছে নিশ্চয়
রাজনীতির খেলা।
একটা বিষয় আমাদের ভেবে দেখা দরকার। প্রধানমন্ত্রীর
বিরুদ্ধে বরকতি যে ফতোয়াটি দিয়েছেন তাতে
কার লাভ বা ক্ষতি হয়েছে? না, লাভ কারো
হয়নি। বরকতি যদিও স্পষ্টতই শাসক দলকে
তুষ্ট করার জন্যেই ফতোয়া দিয়েছেন, কিন্তু বাস্তবে তাতে তাদের ক্ষতি বৈ লাভ কিছু হয়নি। কারণ এই ফতোয়ায় শাসক দলের
দু’ধরণের ক্ষতি হওয়ার প্রবল আশংকা রয়েছে। গোটা দেশ জানে মোদি ভাই ও দিদি ভাই এর
গল্প ও রসায়নটা। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ফতোয়াটি সেই রসায়নে নিশ্চিতভাবেই বিরূপ
প্রভাব ফেলবে। কারণ, বরকতি যে
মুখ্যমন্ত্রীর খাস লোক সে কথা
প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলের লোকেরা বেশ ভালো করেই জানেন। দ্বিতীয় প্রকার ক্ষতির
আশংকা রয়েছে সরাসরি ভোটের বাক্সে। কারণ, দিলীপ ঘোষ এবং নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে
উস্কানিমূলক এই অসভ্য ফতোয়াটি শাসক দলের সঙ্গে থাকা অমুসলিম ভোটারদের মধ্যে যথেষ্ট
বিরূপ প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা প্রবল এবং ভোট বাক্সে তার প্রতিফলন ঘটার যথেষ্ট আশংকা
রয়েছে। এটা যে শাসক দল সব চেয়ে বেশী
উপলব্ধি করছে তা বলা বাহুল্য। শাসক দল কি তাই ড্যামেজ কণ্ট্রোল করার জন্যে আলেম
সমাজের একাংশ এবং টিপু সুলতান মসজিদের মোতোয়াল্লি ও দোকানদের বরকতির বিরুদ্ধে মাঠে নামিয়েছে? না, এটা অমূলক বলে উড়িয়ে দেওয়া
যাচ্ছে না।