লেখক ও প্রাবন্ধিক – আমার এখন এ রকম একটা পরিচয় তৈরী হয়েছে শুনতে পাই । জানি না, আমি এ রকম পরিচয়ের উপযুক্ত কী না । এই
পরিচয়ের পক্ষে আমি অনুপযুক্ত যদি হইও, তবুও আমার আর এর ওপরে হাত নেই, যেহেতু বহু মানুষ আমাকে তাই-ই ভাবেন । আমার
পরিচয়টা কিন্তু এমনটা
হওয়ার কথা মোটেই ছিলো না । কারণ, আমি ছিলাম একজন রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী ও সংগঠক ।
দলীয় রাজনৈতিক জীবনের ছেদ যখন ২০০০ সালে ঘটে তখন
আমার বয়স ৫০বছর ছুঁই ছুঁই । কেনো দলীয় রাজনীতি ত্যাগ করে লেখালেখির জগতে
প্রবেশ করি তার ইতিহাস খুব ছোটো নয় । এ বিষয়ে কয়েকটি কথা বলেছি আমার প্রথম প্রবন্ধ গ্রন্থের [মুসলিম সমাজ বনাম ফতোয়া সন্ত্রাস] ভূমিকায় । তার অংশ বিশেষ এ রকম – “জীবনের
সেরা সময়গুলো - প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর ফেলে এসেছি রাজনীতির অঙ্গনে । তখন স্বপ্ন
দেখতাম জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণের
। বিশ্বাস ছিলো সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে মহাকরনের লালবড়িটির আগে দখল নেওয়া আবশ্যক ।
লালবাড়িটি জয় করে সামনে আরো কঠিন ও বন্ধুর পথ ভেঙে অগ্রসর হতে হবে । কিন্তু হায়রে
! সব দৌড় থমকে গেলো ঐ লালবাড়িতেই । লালবাড়িটিই শেষ অবধি জয় করে নিলো নেতাদের ।
বিপ্লব থেকে সাম্যবাদ – সব স্বপ্ন আর লক্ষ্যগুলো বলি চড়ানো হলো অম্লান বদনে ঐ
ক্ষমতার বাড়িটির বেদীমূলে । অগত্যা ধীরে ধীরে রাজনীতি থেক গাত্রোত্থান এবং অবশেষে
নিরুপায় প্রস্থান ।
অতঃপর হাতে কলম তুলে নেওয়া । সচেতন ছিলাম আমার
সার্বিক জ্ঞান ও ভাষাজ্ঞানের ক্ষুদ্রতা, অপ্রতুলতা ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে । কিন্তু
বাকি জীবন গৃহকোণে অলস ও নিস্তরঙ্গ যাপন ? ভেতর থেকে তীব্র প্রতিবাদ উঠে এলো । তাই
দুর্বল হাতে অবশেষে কলমটিই তুলে নিলাম ।
কলম তো শক্তিশালী হাতিয়ার । এটা ধারণ করলে
পক্ষালম্বন অতি আবশ্যক, এবং আবশ্যক প্রতিপক্ষ স্থির করাও । আজীবন লড়েছি সকল শোষিত
শ্রেণির পক্ষে, তখন প্রতিপক্ষ ছিলো জনগণের তিন প্রধান শত্রু – সামন্তবাদ, একচেটিয়া
পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ । এবার দাঁড়ালাম শোষিত শ্রেণিরই অংশ সবচেয়ে পশ্চাদপদ
মুসললমান সম্প্রদায়ের পক্ষে, এবং প্রতিপক্ষ বাছলাম মোল্লাতন্ত্র ও রাজনৈতিক ইসলামকে । এই দুই
শক্তি হলো ঐ তিন শত্রুর নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য মিত্রশক্তি । ঐ তিন শত্রুর
মিত্রশক্তি হিন্দুত্ববাদীরাও । তাই হিন্দুমৌলবাদও আমার কলমের অন্যতম প্রতিপক্ষ ।”
আমার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন শুরু
বামফ্রন্ট সরকার গঠন করার বহু পূর্ব থেকে । রাজনীতি করার জন্যে ১৯৭৩ সালে আমাকে
স্কুলের চাকরি (শিক্ষক) থেকে ছাঁটাই করা হয় । বামফ্রন্ট সরকার তৈরী হলে ১৯৭৮ সালে
সেই স্কুলে সেই পদে পুনরায় সরকারি আদেশে
যোগদান করি । আমার উপর বারবার আক্রমণ নেমে আসে তৎকালীন শাসক দলের পক্ষ থেকে । আমি
অন্ততঃ তিনবার মৃতুর মুখ থেকে ফিরে আসি । আমি
যুক্ত ছিলাম বামফ্রন্টের প্রধান রাজনৈতিক দল সিপিআই[এম] - এর সঙ্গে । আমি যখন
পার্টি থেকে পদত্যাগ করি তখন পার্টির জেলা [মুর্শিদাবাদ] কমিটির সদস্য ছিলাম । সেই
দলের বিভিন্ন গণসংগঠনে নেতৃত্ব করেছি জেলাস্তরে ।
বিভিন্ন সময়ে সংগঠনের যে
পদগুলিতে নির্বাচিত হয়েছিলাম
সেগুলি হলো, ডি.ওয়াই.এফ.আই [DYFI] – এর মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ও রাজ্য কমিটির সদস্য, এবং
সি.আই.টি.ইউ – এর মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ও অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল
সদস্য । দল ছাড়ার সময় পশ্চিম বাংলার সব চেয়ে বড়ো শিক্ষক সংগঠন এ.বি.ট.এ – এর
মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট
পদে বৃত ছিলাম । পার্টির ও গণসংগঠনে নেতৃত্ব করার পাশাপাশি প্রশাসনের দায়িত্বও
পালন করেছি প্রত্যক্ষভাবে দশ বছর [১৯৮৮ – ১৯৯৮ সাল] । প্রথম পাঁচ বছর [রঘুনাথ ২ নং পঞ্চায়েত সমিতি ]
পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির গুরু দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে । জেলার সবচেয়ে
সফল ও দক্ষ সভাপতির পুরস্কার আমার ঝুলিতে জমা পড়েছিলো । পরের পাঁচ বছর
[১৯৯৩-৯৮] জেলা পরিষদের সদস্য ছিলাম । জেলা পরিষদের সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী সমতি ‘অর্থ, উন্নোয়ন ও পরিকল্পনা স্থায়ী সমতি’র
সদস্য ছিলাম । ছিলাম বিধান সভার পাবলিক
এ্যাকাউন্ট কমিটি ধাঁচের জেলা
পরিষদের একটি কমিটির উপাধক্ষ পদেও বৃত
ছিলাম যে পদটি যেমন বিশেষ গুরুত্বপূর্ন তেমনি মর্যাদাপূর্ণও । মূল কথা হলো জেলার মধ্যে
দীর্ঘ দশ বছর সরাসরি প্রশাসনিক পদে অর্থাৎ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলাম । ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে তথা
প্রশাসনে বসে কাজ করলে অনেক খ্যাতি
ও কদর পাওয়া যায়, তবু প্রশাসনে কাজ করার চেয়ে দলের সংগঠনে কাজ করতেই বেশী পছন্দ করতাম
। তাই পার্টি ছাড়ার আগের পঞ্চায়েত নির্বাচনে [১৯৯৮] প্রশাসনে যাবো না বলে
নির্বাচনে প্রার্থী হয় নি, যদিও পার্টি
চেয়েছিলো আমার দক্ষতাকে প্রশাসনে কাজে লাগাতে ভোটে আবার দাঁড়াই । তারপর তো
পার্টিটাই ছেড়ে দিলাম, এবং তরপর দলীয় রাজনীতিটাই । তারপর তো লেখালেখির জগতে প্রবেশ ।
প্রথম লেখালেখি শুরু স্থানীয় সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক
ক্ষুদ্র সংবাদ পত্রগুলিতে । তবে প্রথম দিকে কলমের অভিমুখ ছিল অবশ্যই কিছুটা ভিন্ন ও দ্বিমুখি ।
একটা অভিমুখ ছিলো বামফ্রন্ট সরকার ও বামফ্রন্ট তথা সিপিআই[এম] - এর জনস্বার্থবিরোধী
ও অগণতান্ত্রিক কর্মকান্ড এবং তীব্র বামপন্থীবিচ্যুতির বিরুদ্ধে । দ্বিতীয় অভিমুখটি ছিলো মুসলিম
সমাজের পশ্চাদপদ দৃষ্টিভঙ্গী,
সংস্কৃতি ও মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ তথা উলামার [মুসলিম সমাজের ধর্মী
নেতৃবৃন্দ] বিরুদ্ধে ।
তখন ধারণা ছিলো এই উলামাই প্রধানতঃ দায়ী মুসলিম সমাজের পশ্চাদপদতার জন্যে । কারণ, ইসলাম ধর্ম ততোটা মন্দ নয়, যতটা তারা ইসলামের নামে কুৎসিত ও বর্বরোচিত
ফতোয়া দেয় । প্রথম দিকে আমার ধারণা ছিলো যে তারা ইসলামের অপবাখ্যা করে এবং মনগড়া ফতোয়া দিয়ে
মুসলমান সমাজকে ভ্রান্তপথে ও পশ্চাদদিকে টেনে
নিয়ে যাচ্ছে । ওরা যে সব ফতোয়া তার মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হলো জিহাদের ফতোয়া যার প্রধান কথা হলো সমগ্র পৃথিবীতে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যে
জিহাদ [বিধর্মীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ] করতে হবে । এই ফতোয়ায় আকৃষ্ট ও বিভ্রান্ত হয়ে হাজার হাজার
মুসলমান আত্মঘাতী জিহাদে অংশ নিয়ে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাস চালাচ্ছে । অন্যান্য
ফতোয়াগুলি সামাজিক, কিন্তু ভয়ানক রকমের
পশ্চাদপদ । ফলে মুসলিম সমাজ ক্রমশঃ পিছিয়ে যাচ্ছে । মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের দাবী - এ সব ফতোয়া অনৈসলামিক । আমার ধারণাও তাই ছিলো ।
কিন্তু ক্রমে ক্রমে আমার ভুল ভাঙতে থাকে । অবশেষে বুঝতে পারি উলামার দেওয়া ফতোয়াগুলিতে কোনো ভুল নেই এবং তারা ইসলামের পথেই মুসলমানদের টানছে । বরং মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা যে সব করে
সেগুলিই মনগড়া এবং ইসলামবিরোধী ।
মুসলিম মহিলাদের উপর মুসলিম সমাজে যে ধর্মীয়
অত্যাচার ও শোষণ চলে তা এতো ভয়ঙ্কর যে বর্ণনার অতীতই বলা যায় । মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা নারীর উপর নারকীয় অত্যাচার ও শোষণের জন্যে দায়ী করেন মোল্লা-মুফতিদের । আমিও
তাই-ই ভাবতাম । কিন্তু না, শীঘ্রয় আমার ভুল ভাঙে । নিঃশংসয়ে বুঝতে পারি যে মুসলিম নারীর উপর অত্যাচার ও শোষণ সংগঠিত হয় শরিয়তি আইন অনুসারেই । তখন বুঝতে পারি শুধু উলামার বিরুদ্ধে লড়াই
করলে হবে না, আসল লড়াইটা শরিয়তি আইনের বিরুদ্ধে করতে হবে । শরিয়তি আইনের প্রধান
ধারক-বাহক হচ্ছে উলামা তথা মোল্লা-মুফতি সমাজ । সুতরাং লড়াইটা করতে হবে শরিয়তি আইন
তথা ইসলামি আইন ও তার ধারক-বাহক উলামার বিরুদ্ধে । এসব কথা সংক্ষেপে আমার প্রথম গ্রন্থের ভূমিকাতে উল্লেখ করেছিলাম । সে কথাগুলির কিছু অংশ এ রকম – “ প্যান
ইসলামিজমের জন্ম রাজনৈতিক ইসলামের গর্ভে । এটা একটা ভয়ঙ্কর ইসলামি তত্ত্ব ।
এই তত্ত্বের লক্ষ্য সমগ্র বিশ্বকে কোরাণের শাসনের পদানত করা । এই অলীক ও অবাস্তব
লক্ষ্য পূরণে রাজনৈতিক মোল্লা-মুফতি ও তাদের শিষ্যরা অবলীলায় হত্যালীলা ও
ধ্বংসকান্ড চালাচ্ছে বিশ্বজুড়ে । ...
মুসলিম সমাজ শরিয়তি শৃঙ্খলে আজও
শৃঙ্খলিত । শৃঙ্খলটি যাতে আলগা না হয় সেজন্যে ফতোয়া বর্ষণ চলে বিরামহীন ।
জন্ম-নিয়ন্ত্রণে, জীবন-বীমায়, ভিন্নধর্মে বিয়েতে, নাটক-থিয়েটারে, আধুনিক শিক্ষায়,
জীবনের প্রতি পদে ফতোয়া । নারীর উপর ফতোয়া অধিক বেশী এবং বর্বর । ইমরানা, গুঁড়িয়া, লুৎফন্নিশারা তার
দৃষ্টান্ত । মুসলমানদের কেউ যুক্তিবাদী হলেও তাকে কোতল করার ফতোয়া । এভাবেই চলছে
ফতোয়া সন্ত্রাস ।” আরো লিখেছিলাম – “ মুসলিম সমাজকে লড়তে হচ্ছে এই ফতোয়া সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেই । এই লড়াই এখনও
মোল্লাতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ জানাবার শক্তি অর্জন করতে সক্ষম হয় নি । তবে তারজন্যে মুসলমানরা একা দায়ী
নয় । রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক দলগুলি মোল্লাতন্ত্রের প্রধান
পৃষ্ঠপোষক ।”
মোল্লাতন্ত্র মানে কী ? যে সব
মুসলিম বুদ্ধিজীবী মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে মুসলমানদের কাছে লড়াই করার ডাক দিচ্ছে
তাঁরা নিজেরা হয় জানে না মোল্লাতন্ত্র মানে কী, অথবা মোল্লাতন্ত্রের ভয়ঙ্কর
চরিত্রটি সচেতনভাবে আড়াল করছেন ।
মোল্লা-মুফতিগণ একদিকে মুসলিম সমাজকে শরিয়তি শাসন ও সংস্কৃতির শৃঙ্খলে বাঁধতে চায়,
অপরদিকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে দেশে দেশে
ইসলামি রাষ্ট্র স্থাপন করতে চায় । যারা সে কাজে বাধা দেবে তারা আল্লাহর শত্রু ।
সেই শত্রুর [অমুসলমানদের] বিরুদ্ধে
সশস্ত্র ও হিংসাত্মক জিহাদ [পবিত্র যুদ্ধ] করতে হবে । এই হলো মোলাতন্ত্র
। মোল্লাতন্ত্র হলো একটি ভয়ঙ্কর তত্ত্ব,
যা কেবল মুসলিম সমাজের মানুষদের জন্যে প্রযোজ্য ও বিপদের কারণ নয় । মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই তাই মামুলি কোনো
লড়াই নয়, যেমনটা মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা বলে থাকেন । মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই
তাই শুধু মোল্লা-মুফতি ও মুসলমান সমাজের ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লড়াই নয়,
মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই হলো আসলে কোরান-হাদিসের আইন ও অনুশাসনের বিরুদ্ধেও
লড়াই । এ লড়াই স্বভাবতই ভীষণ কঠিন লড়াই । রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক দলগুলি মোল্লাতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতা
মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইকে আরো কঠিন করে তুলেছে । তবে এ লড়াইকে সব থেকে বেশী কঠিন করে তুলছে
মুসলিম সমাজের পাহাড় প্রমাণ অজ্ঞতা এবং মুহাম্মদ ও কোরান-হাদিসের প্রতি অসীম অন্ধ
বিশ্বাস, আবেগ, শ্রদ্ধা ও আনুগত্য । মুহাম্মদ ও কোরান-হাদিসের সামান্য সমালোচনাতেও
মুসলিম সমাজ হিংস্র পশু বা দৈত্যের
মতো সবেগে তেড়ে আসে । কিন্তু লড়াইটা যতই কঠিন হোক না কেন, লড়াইটা করতেই হবে । মুশকিল
হলো মুসলিম সমাজে এই লড়াইটা প্রকৃত অর্থে আজো শুরু হয় নি ।
উলামার বিরুদ্ধে তথা
মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইটা যে হচ্ছে না তা নয় । এ লড়াই জারি রেখেছে মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা । কীভাবে
তা উপরে উল্লেখ করেছি । মুফতিগণ যখনই ফতয়া দেয় তখনই ঐ বুদ্ধিজীবীরা সেই ফতোয়াকে
অনৈসলামিক বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং ইসলাম ধর্ম ও শরিয়ত আইনের স্তুতিতে মেতে ওঠে । প্রগতিশীলতা, উদারতা ও সহিষ্ণুতার মিথ্যা আবরণ
দিয়ে ইসলামের ভিতরের কদর্য, কুৎসিত বীভৎস রূপগুলিকে ঢেকে রেখে ইসলামকে একটি
প্রগতিশীল, উদার ও যুগোপযোগী একটি সর্বশ্রেষ্ঠ মানবধর্ম হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা
করে থাকেন । তাঁদের এই নির্লজ্জ মিথ্যাচার
ও প্রতারণাও মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পথে একটা বড়ো অন্তরায় ।
হাতে কলম নেওয়ার দু/তিন বছরের
মধ্যে লেখক হিসেবে আমার উত্তরণ ঘটে । বুঝতে পারি মুসলিম সমাজের বিকাশের পথে প্রধান
বাধা ইসলাম এবং তার প্রধান ধর্মগ্রন্থ কোরান ও হাদিস । মুসলমানদের অপরিসীম মোহ এগুলির প্রতিই । ইসলামের ধারক-বাহক মোল্লা-মুফতি এবং মোল্লাতন্ত্রের তত্ত্বের প্রধান শক্তি নিহিত
রয়েছে মুসলামানদের সেই অগাধ বিশ্বাস ও মোহের মধ্যে । মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে
মুসলিমদের মধ্যে সে যে মোহ রয়েছে তাকে আগে
ভাঙতে হবে । তাই মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে
লড়াই মানে শুধু মোল্লা-মুফতি তথা উলামার বিরুদ্ধে লড়াই নয়, লড়াইটা একই সঙ্গে
অবশ্যই কোরান-হাদিসের আইন ও অনুশাসনের
বিরুদ্ধে নির্ভীক ও আপোষহীন লড়াই । একদা মোল্লা-মুফতিদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে হাতে
কলম তুলে নিয়েছিলাম, সেই লড়াইটা কিছুদিন পরে ঘুরে যায় মোল্লা-মুফতিদের ছাড়িয়ে একদম
ইসলাম ও কোরান-হাদিসের বিরুদ্ধে । এ লড়াই শুধু ভীষণ কঠিনই নয়, এক দীর্ঘস্থাইয়ী লড়াইও । জানতাম এ
লড়াইয়ে শুধু বিস্তর বাধা-বিঘ্নই আসবে না, পদে পদে জীবনের ঝুঁকিও আছে এ লড়াইয়ে ।
তবুও নিজের কাছে নিজে অঙ্গীকার করি – এ লড়াইটা লড়তে হবে । লড়াইটা যে খু-উ-উ—উ-ব
কঠিন তা নিশ্চয়ই জানতাম, কিন্তু তার সম্যক উপলব্ধি ছিলো তা বলা যায় না । সেটাও টের পেলাম খুব অচিরেই । সে কথা বলবো, কিন্তু তার আগে
কিছু অন্য কথা বলতে চাই । সে কথা আমার জীবনের আর একটা দিক নিয়ে ।
রাজনৈতিক দল ছাড়বার সময় যেমন স্থির
করেছিলাম কলম ধরবো, তেমনি এটাও স্থির করেছিলাম যে আর্থিক দিক থেকে ভীষণ পশ্চাদপদ
দরিদ্র পরিবারগুলিরও পাশে যথাসাধ্য পাশে দাঁড়াবো । তৈরী করেছিলাম স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘মিঠিপুরের স্পন্দন’ যার লক্ষ্য ছিলো দরিদ্র অথচ মেধাবী
ছাত্র-ছাত্রীদের সহায়তা প্রদান করা । সে কাজে পেয়েছিলাম আমার পাশে আমারই প্রাক্তন
ছাত্রদের অনেককেই । প্রায় এক দশক সে কাজ অব্যাহত ছিলো, অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীদের
পাঠ্যপুস্তক দিয়েছিলাম । কিছু
ছাত্র-ছাত্রীকে কলেজে পড়াশোনার ক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলাম । সে প্রয়াস
ব্যর্থ হয় নি । স্পন্দনের প্রচেষ্টায়
অন্ততঃ চারজন [তারমধ্যে একজন মেয়ে] এখন
হাইস্কুলে শিক্ষকতা করছে, একজন সরকারি অফিসে চাকরি করছে । তাছাড়া একজন ছাত্রী
ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে যার পেছনেও
স্পন্দনের একটা আর্থিক সহায়তা ছিলো । স্পন্দনের
ধারাবাহিকতায়ই এখন তৈরী করেছি আরো বৃহৎ একটি সংগঠন – ভিন্ন স্বর ভিন্ন মঞ্চ- যার
উদ্দেশ্য আরো বড় ও আরো ব্যাপক । নারীর উচ্চ শিক্ষা, নারীর সমানাধিকার ও নারীর
স্বাধীনতার জন্যে লড়াই করা যার প্রধান উদ্দেশ্য । আর একট প্রধান উদ্দেশ্য হলো সমাজ
সংস্কার করা । এ বিষয়ে বিশদ জানা যাবে এখান থেকে – www.giasuddinonline.blogspot.in/2014_07_30_archive.html
ফিরে আসি মোল্লাতন্ত্র বিরোধী লড়াইয়ের কথায় । সেটা
২০০৫ সাল । আমার কলমের অভিমুখ তখন সরাসরি উন্মোচন করতে শুরু করেছে ইসলাম,
কোরান-হাদিস ও মুহাম্মদের আসল চেহারা । চারিদিকে আমার বিরুদ্ধে গুঞ্জন শুরু হয়েছে
। তসলিমার আত্মজীবনীর একট খণ্ড ‘দ্বিখন্ডিত’ নিষিদ্ধ করেছিলো বামফ্রন্ট সরকার ।
কলকাতা হাইকোর্ট সে নিষেধাজ্ঞাকে বেআইনী বলেছে । হাইকোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়ে
লিখলাম একটা প্রবন্ধ ‘বুদ্ধবাবু কলকাতাকে কলঙ্কিত করেছিলেন, হাইকোর্ট সে কলঙ্ক
মুছে দিলো’ । ‘দৈনিক স্টেটসম্যান’ সেটা
ছাপে ০৬.১০.২০০৫ তারিখ । ঐ প্রবন্ধে শুধু বামফ্রন্ট সরকারের সমালোচনা ছিলো না,
সমালোচনা ছিলো ইসলাম, কোরান ও মুহাম্মদেরও । সে সমালোচনায় ছিলো নিশ্চয় কয়েকটা কঠিন
শব্দ ও কথা, কিন্তু সব সমালোচনাই ছিলো নিবন্ধের বিষয়বস্তুর সঙ্গে সামঞ্জস্য পূর্ণ
ও প্রাসঙ্গিক । ঐ নিবন্ধটি বের হওয়ার ২/৩ দিন আগে বা পরে আর একটি প্রবন্ধ বেরিয়াছিল
‘জঙ্গিপুরের চিঠি’ নামের একটি স্থানীয় সাপ্তাহিক পত্রিকায় । সেখানে আমি লিখেছিলাম
কোরান আল্লাহর গ্রন্থ নয়, ওতে যা আছে তার সবই মুহাম্মদের কথা, তিনি মানুষের কাছে
বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে আল্লাহর নামে প্রচার করেছেন । এ রকম আরো কিছু কঠিন কঠিন কথা ছিলো
। ঐ প্রবন্ধ দুটির তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় মোল্লা-মুফতিদের মধ্যে । তারা প্রবন্ধ
দুটি শয়ে শয়ে ফটকপি করে মুসলমানদের মধ্য প্রচার করে, মসজিদে মসজিদে গিয়ে মানুষকে
আমার বিরুদ্ধে প্ররোচিত করা শুরু করে । তারা আওয়াজ তোলে আমাকে এর জন্যে ক্ষমা
চাইতে হবে, না হলে আমাকে কঠি শাস্তি পেতে হবে । আমি জানি, শরিয়ত মতে আমার শাস্তি
কী । আমি সব শুনেও নীরব থাকি। ওরা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে । আমাকে শাস্তি দিতেই হবে,
তারজন্যে তৈরী করে মোল্লা-মুফতি ও শিক্ষিত মুসলিম যুবদের নিয়ে একটি কমিটি –
‘তাহাফফুজে ইসলাম কমিটি’ । সেই কমিটি ১৮.১০.২০০৫ তারিখ লিখিতভাবে বিবৃতি দিয়ে
আমাকে সমগ্র মুসলিম সমাজের কাছে ক্ষমা চাইতে নির্দেশ দেয় । এবং নির্দেশ জারি করে
বলে যে আমার কথাগুলি প্রত্যাহার করতে হবে ।
লিফলেট দিয়ে আমাকে ক্ষমা চাইবার নির্দেশ দেওয়ার আগেই আমার বিরুদ্ধে ১১.১০.০৫ তারিখ সমাবেশ ডেকে আমার উপর ফতোয়া জারি করে । কয়েকহাজার মানুষের সমাবেশে সেই ফতোয়ায় তারা ঘোষণা দেয় - ক). গিয়াসুদ্দিন কাফের ও মুরতাদ, খ). মুসলিম সমাজ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হলো, এবং মুরতাদের যে শাস্তি মৃত্যুদন্ড সেটাই তাকে দেওয়া হলো । একজন হাজী সাহেব ঘোষণা করলো, যে গিয়াসের মুন্ডু কাটতে পারবে তাকে পাঁচ লাখ টাকা ইনাম [পুরস্কার] দেবে এবং তার যদি জেল হয় তবে তার পরিবারের ভরনপোষণের দায়িত্ব নেবে । মুফতি ঘোষণা দিলো, গিয়াসকে মুসলিম সমাজ থেকে বহিষ্কার করা হলো, কেউ গিয়াসের সাথে কথা বলতে পারবে না, যে কথা বলবে সেই কাফের বলে গণ্য হবে । ফতোয়া দেওয়ার পরের দিন ১২.১০.০৫ তারিখ মোল্লা-মুফতিরা এবং বেশকিছু গোঁড়া যুবক সভায় বসে এটা আলোচনা করার জন্যে কীভেবে সেই ফতোয়া কার্যকর করা হবে । সেদিনই তৈরী করা হয় সেই কুখ্যাত কমিটিটি - ‘তাহাফফুজে ইসলাম কমিটি’ । ওই কমিটির নির্দেশে আমার গ্রামে ১৪.১০.০৫ তারিখ সমাজের মাতব্বররা সভা ডাকে আমার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে । সেখানেও আলোচনা করে আমাকে অমার্জনীয় অপরাধ করেছি বলে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় । তারা আমমার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করে । সেই ফতোয়ার বয়ান এ রকম - "ক). গিয়াসকে গ্রামের সমাজ থেকে বহিষ্কার করা হলো, খ). গ্রামের মানুষ গিয়াসের কথা বলতে ও সম্পর্ক রাখতে পারবে না, এবং গ). ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা যদি গিয়াসের উপর আক্রমণ করে, কিংবা তার বাড়িতে হামলা করে তবে গ্রামের কোনো মানুষ তার পাশে দাঁরাতে পারবে না বা তাকে রক্ষা করার চেষ্ঠা করতে পারবে না ।"
আমাকে যে ক্ষমার চাওয়ার নির্দেশ দিয়ে হ্যান্ডবিল প্রচার করেছিলো সেই নির্দেশ মানার প্রশ্নই নেই । আমি আমার অবস্থানে অনড় আছি । আমার উপর এই যে ফ্যাসিবাদী আক্রমণ নেমে এলো, তা যে আসছেই তার পূর্বাভাষ পেয়েছিলাম দু' বছর পূর্বেই । এই পূর্বাভাষ কীভাবে এসেছিলা সে প্রসঙ্গে 'মোল্লা-মুফতি সমাজ ও এবং একই মূদ্রার এপিঠ ও ওপিঠ' প্রবন্ধে (দ্রঃ মুসলিম সমাজ বনাম ফতোয়া সন্ত্রাস, পৃ - ১৬৮,১৬৯) কয়েকটি কথা বলা আছে । সে কথাগুলির কিছু অংশ এ রকমঃ "এই সমাজের জন্যে প্রকৃত কলয়াণ করতে হলে যেখানে মূল গলদ নিহিত আছে আঘাত করতে হবে । ... বলতে হবে স্পষ্ট করে যে, ১৪০০ বছর পূর্বের শরিয়তি আইন-কানুন এবং মূল্যবোধগুলি অভ্রান্ত, চূড়ান্ত ও শাশ্বত এমন অন্ধবিশ্বাসই হলো চরম সর্বনাশের মূল এবং এই পথ অনুসরণ করার জন্যেই তারা আজো এত পশ্চাদপদ । বলতে হবে এসব আইন ও শিক্ষা-সংস্কৃতি বর্জন করে আধুনিক আইন ওশিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে আধুনিক সমাজ গঠন করতে হবে । এ ছাড়া মুসলমানদের উন্নতি ও অগ্রগতির অন্যঙ্কোনো পথ খোলা নেই । এসব কথা বলা নিশ্চিতভাবেই খুব কঠিন ও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু মুশকিল হলো ঠিক এই কথাগুলিই বলতে হবে,কারণ মুসলিম সমাজের জন্যে প্রকৃতপক্ষে কল্যাণকর কিছু করার জন্যে অন্য কোনো মসৃণ বিকল্প নেই ।
... ... ...
আমি এই কাজটাই করবো বলে দৃঢ়ভাবে মনযস্থির করি তখন দুটো উপায় ভেবে রেখেছিলাম । এক খবরের কাগজে লেখালেখির মাধ্যমে এবনহ দুই বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে পাঠ্যবিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে নিয়ে নিয়ে ধর্মের স্বরূপ তুলে ধরা এবং দেশের ভবিষ্যত নাগরিওদের বিজ্ঞানমনষ্ক করে তৈরী করা । ... .... কাজ শুরু করলাম । বাংলা দৈনিকে চিঠি লেখা এবং স্থানীয় সাপ্তাহিক কাগজে প্রবন্ধ লেখার মধ্য দিয়ে এক মস্ত কঠিন কাজের এবং আমার জীবনে দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনা করবো বলে স্থির করলাম ।
ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লিখব, কিন্তু ধর্মের বিরুদ্ধে লিখব না - তা হয় না । কিন্তু প্রশ্ন হলো কোথায় লিখবো, কটা কাগজ এসব ভাবে ? সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন করে কটা কাগজ ? অনেক ভেবেচিন্তে 'আজকালে' চিঠি পাঠালাম এবং প্রবন্ধ পাঠালাম 'জঙ্গিপুরের চিঠি' নামক জেলার একটি সাপ্তাহিক কাগজে । ওরা ছাপল । (অবশ্য তার আগেই পাক্ষিক রঙধনু পত্রিকা লেখা শুরু, তখনও অভিমুখ মোল্লাতন্ত্রের দিকে সুনির্দিষ্ট হয় নি ) শুরু হলো মুসলিম সমাজে প্রতিক্রিয়া । প্রবল গুঞ্জনও । একটা বড়ো প্রতিক্রিয়া এলো ২০০৩ সালের আগষ্ট মাসে । অভিন্ন দেওয়ানি আইনের দাবিতে লেখা একটা চিঠি ১৭ই আগষ্ট আজকা;ল পত্রিকার রবিবারের চিঠির পাতায় । (সপ্তাহের সেরা চিঠিগুলি ছাপা হয় এই পাতায়) সেই চিঠিতে ছিলো মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের তীব্র সমালোচনা । এক জায়গায় লিখেছিলাম, 'একজন পুরুষ একটার পর একটা তালাক আর একটার পর বিয়ে করার অধিকারের সুযোগ নিয়ে অসংখ্য নারীকে ইচ্ছা মতো ভোগ করতে ও ত্যাগ করতে পারবে । এতো নারীদের উপর পুরুষদের বিধিসম্মত বলাৎকারের চমৎকার ব্যস্থা । এই আইন সভ্য সমাজ এখনও বহন করবে ? তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় সারা রাজ্যজুড়ে । বহু চিঠি আসে আমার নামে । প্রত্যেক চিঠিতে হুমিকি ও ভীত প্রদর্শন । আমার অঞ্চলে ও অন্যান্য গ্রামে গ্রামে এবং মসজিদে মসজিদে মোল্লারা এই চিঠির ফটকপি বিলি করে এবং আমার বিরুদ্ধে উত্তেজনা ছড়াতে চেষ্টা করে । আমাকে সামাজিক বয়কট করার প্রয়াস নেওয়া হয় । ফলপ্রসূ সেবার হয় নি, তবে তখনি দেখেছিলাম একটি বড়ো ঝড়ের পূর্বাভাষ ।"
আবার ফিরে আসি আগের কথায় । আমার উপর দেওয়া ফতোয়াকে কংগ্রেস সমর্থন করে মোল্লা-মুফতির পাশে তারা দাঁড়ালো, সিপিএম নেতারা কোনো অবশ্য প্রতিক্রিয়া দেয় নি, অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি ফতোয়ার পক্ষেই । আমার আত্মীয়-স্বজন ও হিতাকাঙ্খীরা আমাকে কিছুদিনের জন্যে কোথাও গিয়ে গা-ঢাকা দিতে পরামর্শ দেয়, তাঁরা সবাই আমাকে নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন । পুলিশের কাছে সশরীরে যাওয়ার পথ নেই, রাস্তায় পেলেই আল্লাহর সৈনিকরা ঝাঁপিয়ে পড়বে । তাই লিখিত অভিযোগ পাঠালাম, তৎসহ নিরাপত্তা চেয়েও আবেদন জানালাম । পুলিশ অভিযোগ নিল না । আরো চাপ বাড়লো স্নায়ুর উপর আমার আত্মীয়স্বজনদের, আমারও । আবার সবাই বলছে, এ অবস্থায় বাড়িতে থাকা নিরাপদ নয় । আমি স্থির করলাম, বাড়ি ছেড়ে যাবো না, গেলে আর ফিরিতে দেবে না, তখন ফিরতে হলে ওদের শর্তে ফিরতে হবে । সে তো মৃত্যুর শামিল । এও স্থির করলাম লেখা চালিয়ে যাব । সমাজ থেকে বহিষ্কার এবং মৃত্যুদন্ডের ফতোয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে প্রবন্ধ লিখলাম । সেখানে আমি লিখলামঃ “যখন এই প্রবন্ধ লিখছি তখনও আমার জীবনের নিরাপত্তার অভাব আছে । আমার ওপর মৃত্যুর ফতোয়া, তথাপি আমি বলতে চাই, মৌলবাদীদের ভয়ে কিছুতেই আমার কলম থামবে না । ধর্মান্ধতা, মুসলিম ধর্মের গোঁড়ামি ও যাবতীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আমার লড়াই আমৃত্যু জারি থাকবে ।” এই লেখাটা দৈনিক স্টেটসম্যানে ছাপা হয় ২১.১০.২০০৫ তারিখ । দৈনিক স্টেটসম্যান ছাড়া আর কোনো কাগজ এই সংবাদটা পর্যন্ত ছাপে নি ।
লিফলেট দিয়ে আমাকে ক্ষমা চাইবার নির্দেশ দেওয়ার আগেই আমার বিরুদ্ধে ১১.১০.০৫ তারিখ সমাবেশ ডেকে আমার উপর ফতোয়া জারি করে । কয়েকহাজার মানুষের সমাবেশে সেই ফতোয়ায় তারা ঘোষণা দেয় - ক). গিয়াসুদ্দিন কাফের ও মুরতাদ, খ). মুসলিম সমাজ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হলো, এবং মুরতাদের যে শাস্তি মৃত্যুদন্ড সেটাই তাকে দেওয়া হলো । একজন হাজী সাহেব ঘোষণা করলো, যে গিয়াসের মুন্ডু কাটতে পারবে তাকে পাঁচ লাখ টাকা ইনাম [পুরস্কার] দেবে এবং তার যদি জেল হয় তবে তার পরিবারের ভরনপোষণের দায়িত্ব নেবে । মুফতি ঘোষণা দিলো, গিয়াসকে মুসলিম সমাজ থেকে বহিষ্কার করা হলো, কেউ গিয়াসের সাথে কথা বলতে পারবে না, যে কথা বলবে সেই কাফের বলে গণ্য হবে । ফতোয়া দেওয়ার পরের দিন ১২.১০.০৫ তারিখ মোল্লা-মুফতিরা এবং বেশকিছু গোঁড়া যুবক সভায় বসে এটা আলোচনা করার জন্যে কীভেবে সেই ফতোয়া কার্যকর করা হবে । সেদিনই তৈরী করা হয় সেই কুখ্যাত কমিটিটি - ‘তাহাফফুজে ইসলাম কমিটি’ । ওই কমিটির নির্দেশে আমার গ্রামে ১৪.১০.০৫ তারিখ সমাজের মাতব্বররা সভা ডাকে আমার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে । সেখানেও আলোচনা করে আমাকে অমার্জনীয় অপরাধ করেছি বলে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় । তারা আমমার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করে । সেই ফতোয়ার বয়ান এ রকম - "ক). গিয়াসকে গ্রামের সমাজ থেকে বহিষ্কার করা হলো, খ). গ্রামের মানুষ গিয়াসের কথা বলতে ও সম্পর্ক রাখতে পারবে না, এবং গ). ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা যদি গিয়াসের উপর আক্রমণ করে, কিংবা তার বাড়িতে হামলা করে তবে গ্রামের কোনো মানুষ তার পাশে দাঁরাতে পারবে না বা তাকে রক্ষা করার চেষ্ঠা করতে পারবে না ।"
আমাকে যে ক্ষমার চাওয়ার নির্দেশ দিয়ে হ্যান্ডবিল প্রচার করেছিলো সেই নির্দেশ মানার প্রশ্নই নেই । আমি আমার অবস্থানে অনড় আছি । আমার উপর এই যে ফ্যাসিবাদী আক্রমণ নেমে এলো, তা যে আসছেই তার পূর্বাভাষ পেয়েছিলাম দু' বছর পূর্বেই । এই পূর্বাভাষ কীভাবে এসেছিলা সে প্রসঙ্গে 'মোল্লা-মুফতি সমাজ ও এবং একই মূদ্রার এপিঠ ও ওপিঠ' প্রবন্ধে (দ্রঃ মুসলিম সমাজ বনাম ফতোয়া সন্ত্রাস, পৃ - ১৬৮,১৬৯) কয়েকটি কথা বলা আছে । সে কথাগুলির কিছু অংশ এ রকমঃ "এই সমাজের জন্যে প্রকৃত কলয়াণ করতে হলে যেখানে মূল গলদ নিহিত আছে আঘাত করতে হবে । ... বলতে হবে স্পষ্ট করে যে, ১৪০০ বছর পূর্বের শরিয়তি আইন-কানুন এবং মূল্যবোধগুলি অভ্রান্ত, চূড়ান্ত ও শাশ্বত এমন অন্ধবিশ্বাসই হলো চরম সর্বনাশের মূল এবং এই পথ অনুসরণ করার জন্যেই তারা আজো এত পশ্চাদপদ । বলতে হবে এসব আইন ও শিক্ষা-সংস্কৃতি বর্জন করে আধুনিক আইন ওশিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে আধুনিক সমাজ গঠন করতে হবে । এ ছাড়া মুসলমানদের উন্নতি ও অগ্রগতির অন্যঙ্কোনো পথ খোলা নেই । এসব কথা বলা নিশ্চিতভাবেই খুব কঠিন ও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু মুশকিল হলো ঠিক এই কথাগুলিই বলতে হবে,কারণ মুসলিম সমাজের জন্যে প্রকৃতপক্ষে কল্যাণকর কিছু করার জন্যে অন্য কোনো মসৃণ বিকল্প নেই ।
... ... ...
আমি এই কাজটাই করবো বলে দৃঢ়ভাবে মনযস্থির করি তখন দুটো উপায় ভেবে রেখেছিলাম । এক খবরের কাগজে লেখালেখির মাধ্যমে এবনহ দুই বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে পাঠ্যবিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে নিয়ে নিয়ে ধর্মের স্বরূপ তুলে ধরা এবং দেশের ভবিষ্যত নাগরিওদের বিজ্ঞানমনষ্ক করে তৈরী করা । ... .... কাজ শুরু করলাম । বাংলা দৈনিকে চিঠি লেখা এবং স্থানীয় সাপ্তাহিক কাগজে প্রবন্ধ লেখার মধ্য দিয়ে এক মস্ত কঠিন কাজের এবং আমার জীবনে দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনা করবো বলে স্থির করলাম ।
ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লিখব, কিন্তু ধর্মের বিরুদ্ধে লিখব না - তা হয় না । কিন্তু প্রশ্ন হলো কোথায় লিখবো, কটা কাগজ এসব ভাবে ? সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন করে কটা কাগজ ? অনেক ভেবেচিন্তে 'আজকালে' চিঠি পাঠালাম এবং প্রবন্ধ পাঠালাম 'জঙ্গিপুরের চিঠি' নামক জেলার একটি সাপ্তাহিক কাগজে । ওরা ছাপল । (অবশ্য তার আগেই পাক্ষিক রঙধনু পত্রিকা লেখা শুরু, তখনও অভিমুখ মোল্লাতন্ত্রের দিকে সুনির্দিষ্ট হয় নি ) শুরু হলো মুসলিম সমাজে প্রতিক্রিয়া । প্রবল গুঞ্জনও । একটা বড়ো প্রতিক্রিয়া এলো ২০০৩ সালের আগষ্ট মাসে । অভিন্ন দেওয়ানি আইনের দাবিতে লেখা একটা চিঠি ১৭ই আগষ্ট আজকা;ল পত্রিকার রবিবারের চিঠির পাতায় । (সপ্তাহের সেরা চিঠিগুলি ছাপা হয় এই পাতায়) সেই চিঠিতে ছিলো মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের তীব্র সমালোচনা । এক জায়গায় লিখেছিলাম, 'একজন পুরুষ একটার পর একটা তালাক আর একটার পর বিয়ে করার অধিকারের সুযোগ নিয়ে অসংখ্য নারীকে ইচ্ছা মতো ভোগ করতে ও ত্যাগ করতে পারবে । এতো নারীদের উপর পুরুষদের বিধিসম্মত বলাৎকারের চমৎকার ব্যস্থা । এই আইন সভ্য সমাজ এখনও বহন করবে ? তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় সারা রাজ্যজুড়ে । বহু চিঠি আসে আমার নামে । প্রত্যেক চিঠিতে হুমিকি ও ভীত প্রদর্শন । আমার অঞ্চলে ও অন্যান্য গ্রামে গ্রামে এবং মসজিদে মসজিদে মোল্লারা এই চিঠির ফটকপি বিলি করে এবং আমার বিরুদ্ধে উত্তেজনা ছড়াতে চেষ্টা করে । আমাকে সামাজিক বয়কট করার প্রয়াস নেওয়া হয় । ফলপ্রসূ সেবার হয় নি, তবে তখনি দেখেছিলাম একটি বড়ো ঝড়ের পূর্বাভাষ ।"
আবার ফিরে আসি আগের কথায় । আমার উপর দেওয়া ফতোয়াকে কংগ্রেস সমর্থন করে মোল্লা-মুফতির পাশে তারা দাঁড়ালো, সিপিএম নেতারা কোনো অবশ্য প্রতিক্রিয়া দেয় নি, অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি ফতোয়ার পক্ষেই । আমার আত্মীয়-স্বজন ও হিতাকাঙ্খীরা আমাকে কিছুদিনের জন্যে কোথাও গিয়ে গা-ঢাকা দিতে পরামর্শ দেয়, তাঁরা সবাই আমাকে নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন । পুলিশের কাছে সশরীরে যাওয়ার পথ নেই, রাস্তায় পেলেই আল্লাহর সৈনিকরা ঝাঁপিয়ে পড়বে । তাই লিখিত অভিযোগ পাঠালাম, তৎসহ নিরাপত্তা চেয়েও আবেদন জানালাম । পুলিশ অভিযোগ নিল না । আরো চাপ বাড়লো স্নায়ুর উপর আমার আত্মীয়স্বজনদের, আমারও । আবার সবাই বলছে, এ অবস্থায় বাড়িতে থাকা নিরাপদ নয় । আমি স্থির করলাম, বাড়ি ছেড়ে যাবো না, গেলে আর ফিরিতে দেবে না, তখন ফিরতে হলে ওদের শর্তে ফিরতে হবে । সে তো মৃত্যুর শামিল । এও স্থির করলাম লেখা চালিয়ে যাব । সমাজ থেকে বহিষ্কার এবং মৃত্যুদন্ডের ফতোয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে প্রবন্ধ লিখলাম । সেখানে আমি লিখলামঃ “যখন এই প্রবন্ধ লিখছি তখনও আমার জীবনের নিরাপত্তার অভাব আছে । আমার ওপর মৃত্যুর ফতোয়া, তথাপি আমি বলতে চাই, মৌলবাদীদের ভয়ে কিছুতেই আমার কলম থামবে না । ধর্মান্ধতা, মুসলিম ধর্মের গোঁড়ামি ও যাবতীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আমার লড়াই আমৃত্যু জারি থাকবে ।” এই লেখাটা দৈনিক স্টেটসম্যানে ছাপা হয় ২১.১০.২০০৫ তারিখ । দৈনিক স্টেটসম্যান ছাড়া আর কোনো কাগজ এই সংবাদটা পর্যন্ত ছাপে নি ।
তারপর কীভাবে ঐ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে এসেছি সে এক লম্বা
ইতিহাস । শুধু এটুকু বলতে পারি যে ফতোয়া দেওয়ার আগে ও পরে ‘মার মার কাট কাট’ বলে আমার বিরুদ্ধে যে ঝড় তৈরী হয়েছিলো এবং সে ঝড়
যতদিন স্থায়ী ছিল তা একজন মানুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে মাথা নত করার পক্ষে যথেষ্ট ।
সেই প্রবল ঝড়ের মুখে আমি কীভাবে অটল পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম সে কথা এখন যখন ভাবি তখন আমার নিজেরই অবাক লাগে
।
আমার ওপর আমার গ্রামের সমাজের সেই ফতোয়া এখনও
সমাজের মাতব্বররা প্রত্যাহার করে নি । আমি এখনও তাদের সমাজ থেকে বহিষ্কৃত । তবে
অধিকাংশ মানুষের সঙ্গে আমার সামাজিক
সম্পর্ক আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছে । তারা
সেই ফতোয়া উপেক্ষা করেই আমার সঙ্গে
সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে । তবে আমি মুরতাদ
ও আমার গ্রামের সমাজ থেকে বহিষ্কৃত – এটা কিন্তু মোটেই হালকা ব্যাপার নয় । নানাভাবে এর প্রভাব পড়ে আমার পরিবারের উপর, ফলে
নানা সমস্যায় পড়তে হয় । ফতোয়া উপেক্ষা করে কিছু মানুষ ও তাদের পরিবার সে সময় আমার
সঙ্গে ছিলো বলে এক কঠিন সংকটে পড়তে হয়েছিলো ।
সংকট হয়েছিলো একটি মেয়ের বিয়ের সময় ।
বিয়ে পড়ানোর জন্যে মৌলভি দরকার । গ্রামের মৌলভিকে আসতে দেয় নি, অন্যগ্রামেও
খবর পাঠিয়ে বলেছিলো নাস্তিকের মেয়ের বিয়ে হচ্ছে, কোনো গ্রাম যেন মৌলভি না দেয় । সে
এক কঠিন পরিস্থিতি, বিয়ে প্রায় ভাঙে আর কী । শেষ পর্যন্ত বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে
অন্য গোত্রের মৌলভি এনে বিয়ে পড়ানো সম্ভব হয়েছিল, না হলে আমার জন্যে মেয়েটির জীবনটাই বরবাদ হয়ে যাচ্ছিলো । আমার নিজের মেয়ের বিয়ের সময়ও পড়েছিলাম গভীর
সংকটে ।
সে সংকট থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসা
সম্ভব হয়েছিলো সে আর একটা কঠিন লড়াইয়ের ইতিহাস । আমি নাস্তিক এবং এখনও আমি
মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লিখে যাচ্ছি বলে তার খেসারত আজো আমাকে ও আমার পরিবারকে
দিতে হয় । আমি আমার জন্যে ভাবিনা, তবে আমার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আমাকে
দুশ্চিন্তার বোঝা বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয় । চিন্তা
হয় আমার পরিবারের কারো মৃত্যু হলে কী হবে ? আমার তো মরণোত্তর দেহ দান করার অঙ্গিকার করা
আছে, কিন্ত আমার স্ত্রী কিংবা আমার ছেলের মৃত্যু হলে তাদের কী হবে ? আমার গ্রামের
গ্রস্থানে তো তাদের সৎকার করতে দেবে না, অন্য গ্রামের মানুষ কী দেবে ? জানি না কী
হবে ?
মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই
করবো বলে কলকাতায় বসে একটি মঞ্চ তৈরী করেছিলাম । তসলিমা নাসরিন এ কাজে সাহায্য
করেছিলেন, তাঁর কলকাতার ফ্লাটে বসে এ বিষয়ে আমরা মুসলিম সমাজের কয়েকজন যুক্তিবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ আলাপ-আলোচনা
করে গড়ে তুলেছিলাম একটি মঞ্চ, যার নাম ‘ধর্মমুক্ত মানববাদী মঞ্চ’ । মঞ্চের প্রধান লক্ষ্য
ছিলো যেহেতু মুসলিম সমাজের উন্নতি ও বিকাশ
জন্যে কাজ করা এবং মোলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করা তাই মঞ্চের
সিদ্ধান্ত ছিল যে শুধু মুসলিম সমাজের যুক্তিবাদী মানুষরাই এই মঞ্চের সদস্য হতে
পারবে । আমি ও মুজাফফর হোসেন – আমরা এই দুজন ছিলাম মঞ্চের প্রধান সংগঠক এবং আমাদের
পাশে ছিলেন অবশ্যই তসলিমা নাসরিন । সে মঞ্চের একটি মুখপত্রও বের করতাম যার নাম
ছিলো ‘মুক্ত মন মুক্ত কন্ঠ’ । কিন্তু আগেই
বলেছি মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করা ভীষণই কঠিন । যে মোল্লা-মুফতি নিয়ন্ত্রিত মুসলিম সমাজে ইসলাম ও কোরানের কুৎসিত আইনগুলির সমালোচনা করবে তার ওপর নেমে আসবে গলা কাটার ফতোয়া, তার বাড়িতে হামলা
হবে, সমাজ থেকে তাকে বহিষ্কার করে দেওয়া হবে, তার ছেলে-মেয়ের বিয়েতে বাধা দেওয়া
হবে, তার জন্যে মুদি- মনোহারী প্রভৃতি সব দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে দেওয়া হবে । এতো বড়ো বিপদ ও ক্ষতি মোকাবিলা করার মানুষ
পাওয়া সহজ কথা নয় । তাই মোল্লাতন্ত্রের আমাদের
মঞ্চটি শেষ পর্যন্ত সেভাবে দানা বাঁধে নি । অনেকেই এসেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত
অধিকাংশই নানা অজুহাত দেখিয়ে সরে পড়েছে ।