২৬শে জানুয়ারী অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা ‘কালা দিবস’ উদযাপন করলো । এ দিন উত্তরপ্রদেশের
মিরাটে কালা দিবস পালন করার সাথে সাথে তারা ভারতকে
হিন্দুরাষ্ট্র বানাবার শপথ নিয়েছে । এটা অবাক করার মতো খবর নয়, কারণ স্বাধীনতার জন্ম লগ্নেই অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা চেয়েছিলো ভারত
হিন্দুরাষ্ট্র হবে, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র নয় । তাই ভারতের
সংবিধানের প্রতি প্রথম দিন থেকেই তারা আস্থাশীল ও শ্রদ্ধাশীল নয় । তাদের এই অভিমত
তারা সর্বদা সোচ্চারেই ঘোষণা করে এবং ২৬শে জানুয়ারী গোটা দেশ যখন
এই দিনটি সাড়ম্বরে উদযাপন করে তখন তারা এতে অংশ নেয় না, উল্টে ‘কালা দিবস’
পালন করে। এই দিনটিতে ‘কালা দিবস’ পালন করার উদ্দেশ্য শুধু
ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরোধিতা করা নয়, তারা এ দিনটাকেই বেছে নিয়েছে
ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানাবার ‘পবিত্র’ সংগ্রাম জারি রাখার জন্যে পুনরায় শপথ
নেওয়ার দিন হিসেবেও । তাঁদের বিশ্বাস ভারত একদিন সত্যি সত্যিই হিন্দুরাষ্ট্র
হবে । এটা অন্ধবিশ্বাস
। এরূপ অন্ধবিশ্বাস পোষণ করেন মুসলিম মৌলবাদীরাও
। তাঁদের বিশ্বাস একদিন গোটা বিশ্বেই আল্লাহ্র
শাসন কায়েম (প্রতিষ্ঠা) হবে । এই
অন্ধবিশ্বাস দ্বারা প্রাণিত ও চালিত হয়েই হিন্দু মহাসভার লোকেরা এবারো ২৬শে জানুয়ারী কালা
দিবস পালন করলেন ।
‘কালা দিবস’ পালন করার জন্যে মিরাটের রাস্তায় অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার
মাত্র কয়েকশো কর্মী কালো পতাকা হাতে নিয়ে
বিক্ষোভ দেখিয়েছেন । এ দিন তাঁরা প্রতিবারের ন্যায়
এবারো ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানাবার শপথ নিয়েছেন । প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন হিন্দুরাষ্ট্র বানাবার শপথের
অনুষ্ঠানে হিন্দু মহাসভার সহ-সভাপতি অশোক শর্মা বলেন,
দেশের লক্ষ লক্ষ হিন্দুর মতো আমারো উদ্দেশ্য হলো ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা । শর্মা তাঁর তীব্র ক্ষোভ উগরে দিয়ে বলেন যে ভারতের সংবিধানের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র আস্থা ও বিশ্বাস নেই । তিনি যে ভাষায় এ কথা বলেছেন তা
হলো, “এই নিয়ে ৫১ বছর হলো আমি হিন্দু মহাসভার একজন একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে ভারতের যে
ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি রয়েছে এবং যে সংবিধান ভারতকে ধর্মমনিরপেক্ষ বলে ঘোষণা করেছে
তার বিরুদ্ধে কালো পতাকা দেখিয়ে আসছি ।” প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে হিন্দু মহাসভার এই নেতাই
গত বছর গান্ধিজীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসকে জাতীয় বীর
আখ্যা দিয়ে তার নেমে মন্দির নির্মাণ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন । তাঁর এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ ঘোষণায় সে দিন সারা দেশ তোলপাড়
হয়েছিলো । মিরাটের কালা দিবসের অনুষ্ঠানে
হিন্দু মহাসভার আর এক নেতা ভারত রাজপুত প্রশ্ন তোলেন যে, “দেশ ভাগের পর পাকিস্তান ইসলামিস্তান হয়ে গেছে,
তাহলে ভারতকে কেনো হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষণা করা হবে না ?” রাজপুত গান্ধিজী ও নেহেরুর গায়ে হিন্দু-বিরোধী তকমা সেঁটে দিয়ে আরো বলেন যে, “এই দুই নেতা ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ
হিসেবে ঘোষণা দিয়ে যান । তাঁরা আমাদের উপর যা চাপিয়ে দিয়েছিলেন সেই ঐতিহাসিক ভুলকে
আমরা সংশোধন করতে চাই।”
আমি বা আমরা সংবিধান মানি না – এ কথা বলা তো ভয়ঙ্কর ব্যাপার । এ তো শাস্তিযোগ্য ফৌজদারী অপরাধ । কিন্তু কী অবাক
কাণ্ড যে পুলিশের নাকের ডগায় কয়েকশো মানুষ এভাবে সংবিধানের
অবমাননা করে চলে গেলো তবু পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করলো না ! অথচ ক্ষুধার তাড়নায় এ দেশে একজন নাবালক ছেলে একটু
খাবার চুরি করে খেলে সে রেহাই পায় না । তাকে বেদম মার খেতে হয়, জেল খাটতেও হয় । কী বিচিত্র এ দেশ!
শুধু হিন্দু মহাসভা নয়, সঙ্ঘপরিবার ও তাদের নেতা ও সদস্যরাও সংবিধানের উপর আস্থা পোষণ করেন না । কিন্তু সংবিধান মানেন না সে কথা মুখে বলেন না, কাজের মধ্যে দিয়ে তাঁরা তা বুঝিয়ে দেন । তাই বাবরি মসজিদ
ভাঙতে কিংবা গীর্জার উপর হামলা করতে তাঁদের দ্বিধা হয় না । গুজরাটে ২০০২-এর মতো মুসলিম
নিধন-যজ্ঞ সংগঠিত করতে কিংবা ঠাণ্ডা মাথায় গো মাংস খাওয়ার মিথ্যা
অভিযোগে আখলাকদের হত্যা করতে তাঁদের হাত
কাঁপে না । হাত কাঁপে না কুলবার্গী, দাভোলকার, পানেসর প্রমুখ যুক্তিবাদী ও দেশের উজ্জ্বল মেধাব্যক্তিত্বদের
হত্যা করতেও । এমনকি গান্ধিজীর হত্যাকারীকেও দেশের বীর সন্তান বলে
আখ্যা দিতে ঠোঁট কাঁপে না । বুক কাঁপেনা
অস্ট্রেলিয়ান খৃস্টান যাজক ও ডাক্তারকে সপুত্র পুড়িয়ে মারতে যিনি ভারতে এসে
কুষ্ঠরোগীদের চিকিৎসায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন ।
অনুরূপভাবে ভারতের সংবিধান মানেন না মুসলিম মৌলবাদীরাও । তাঁরাও মুখে সে কথা বলেন না, কিন্তু
তাঁরা যে সংবিধান মানেন না তা বোঝা যায় তাঁদের কথা-বার্তায় ও কাজকর্মে । ভারতের সংবিধান নয়, হিন্দুত্ববাদীরা যেমন
সংবিধান মানে কেবল বেদ ও গীতাকে, তেমনি মুসলিম মৌলবাদীরা সংবিধান মানে শুধু
‘ফিকাহ্’কে (কোরান ও হাদিসের ভিত্তিতে রচিত
শরিয়তি আইনশাস্ত্র) । হিন্দুত্ববাদীরা
যেমন মনে করেন আগে তাঁরা হিন্দু পরে ভারতীয়, মুসলিম মৌলবাদীরাও অনুরূপভাবে মনে
করেন আগে তাঁরা মুসলমান পরে ভারতীয় । তাই তাঁরা ২৬শে জানুয়ারী
প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন করেন না, প্রজাতন্ত্রের দিবসের অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করেন
না, নিজেদের বাড়িতে বা দলীয় সংগঠনের
অফিসে জাতীয় পতাকা তোলেন না । কোনো খারিজি
মাদ্রাসাতেই ২৬শে জানুয়ারী পতাকা ওঠে না । ওঠার কথাও নয় । বরং দেখা যায় যে বহু মাদ্রাসাতে জিহাদের পাঠ দেওয়া হয় । এটা যে নির্মম সত্যি তা গত বছরের ভয়ঙ্কর
খাগড়াগড়-বিষ্ফোরণ কাণ্ডে প্রমাণিত । সরকারি সাহায্য প্রাপ্ত হাই মাদ্রাসা ও সিনিয়র
মাদ্রাসাতেও প্রজাতন্ত্র দিবস পালিত হয় না । পালন করা যে হয় না সে কথা জানিয়েছেন সম্প্রতি
মেটিয়াবুরুজের তালপুকুর হাই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক কাজি মাসুম আক্তার । তাঁর উপর কিছুদিন আগে হামলা চালিয়েছে মুসলিম মৌলবাদীরা । তিনি প্রানের ভয়ে এখন মাদ্রাসা যেতে পারেন না । সরকারও তাঁকে নিরাপত্তা
দিচ্ছে না । তাঁর উপর হামলা হয়েছে এজন্যে
যে, তিনি ২৬শে জানুয়ারী মাদ্রাসায় জাতীয় পতাকা
তুলতেন, মাদ্রাসা শিক্ষার পরিবর্তে আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির কথা বলতেন, নারী
শিক্ষার কথা বলতেন, বাল্যবিবাহ ও বোরখার বিরোধিতা
করতেন । আরো বহু দৃষ্টান্ত সহযোগে প্রমাণ করা যায় যে মুসলিম মৌলবাদীরা ভারতের সংবিধান মানেন না । এটা মনে রাখতে হবে
যে, মুসলিম মৌলবাদীরা তাঁদের ব্যক্তিগত
অনুদার ও সংকীর্ণ ভাবনা-চিন্তার কারণে ভারতের সংবিধানের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে
পারেন না এমনটা নয় । না পারার পেছনে রয়েছে
তাঁদের মতাদর্শগত কারণ । ইসলামি
মতাদর্শানুসারে ভারতের সংবিধান মানলে
তাঁদের ঈমান (আল্লাহ্ ও মুহাম্মদের প্রতি
বিশ্বাস) নষ্ট হবে, তাই মানেন না । একজন মুসলমানের কাছে ‘ঈমান’ হলো তার প্রধান
পরিচয়। ঈমানদার মুসলমানকে মুমিন বলা হয়, আর যে সত্যিকারের মুমিন সে প্রাণ ত্যাগ করতে পারে কিন্তু ‘ঈমান’ ত্যাগ
করতে পারে না । ঈমানদার মুসলমানের কাছে ইসলামের আদেশ হলো, তাকে আল্লাহর সংবিধানই
মানতে হবে, তাগুতি সংবিধান (মানুষের তৈরী
করা সংবিধান) নয় । আল্লাহর সংবিধান হলো কোরান । সুতরাং তাকে কোরানের প্রতিই আস্থা
ও আনুগত্য রাখতে হবে, মানুষের তৈরী ভারতীয় সংবিধান নয় ।
যারা সংবিধান মানে না তারাই
রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পদ । কারণ তাদের কাছে সংবিধান ও মানুষের জীবন নয়, ক্ষমতা দখল
বা রক্ষা করাই প্রধান কর্তব্য । তাই উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিন্দুভোটের কথা
ভেবে হিন্দু মহাসভার নেতাদের বিরুদ্ধে এবং
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খারিজি
মাদ্রসাকে যারা জিহাদের আখড়া বানায় তাদের বিরুদ্ধে নীরব থাকেন ।