Saturday, December 18, 2021

পত্নীকে পেটানোর অধিকার শরিয়ত সম্মত

‘পত্নীকে প্রহার করা পুরুষের আইন সম্মত অধিকার, ওতে কোনো দোষ নেই’। না, এটা কোনো নাটক বা সিনেমার সংলাপ নয়। এটা আরব আমীর শাহীর সর্বোচ্চ আদালতের একটি রায়। এই নিন্দার্হ ও ঘৃণার্হ রায়টি প্রদান করা হয়েছে একজন প্রহৃতা পত্নীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে। উক্ত মুসলিম নারী ও তার মেয়েকে নির্মমভাবে প্রহার করেছিল তার স্বামী। সর্বোচ্চ আদালত পত্নীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তার পতিকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং কারাদন্ডের আদেশ দেয়। সেই আদেশের মধ্যেই রয়েছে ঐ কুখ্যাত রায়টিও। আদালত একদম স্পষ্ট ভাষায় জানায় যে স্ত্রী ও কন্যাকে প্রহার করার জন্যে অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় নি, এবং কারাদন্ড দেওয়া হয় নি। কেননা পত্নী প্রহার করায় কোনো অন্যায় নেই, ওটাতো একজন মুসলমান পুরুষের শরিয়তসম্মত অধিকার। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করে কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে কারণ, সে সে তার স্ত্রীকে প্রহার করার সময় শরিয়ত প্রদত্ত সীমা লঙ্ঘন করেছে। কীভাবে শরিয়তি সীমা লঙ্ঘিত হয়েছে সে প্রসঙ্গে আদালত বলেছে যে, স্বামী প্রয়োজনে তার স্ত্রীকে প্রহার করতে পারবে, কিন্তু প্রহার এমন হবে না যাতে স্ত্রীর দেহে প্রহারের চিহ্ন ফুটে ওঠে। 
 Husband Beating And Smothering Wife During Argument Stock Photo, Picture  And Royalty Free Image. Image 41848908.
 
কোনো ইসলামি রাষ্ট্রের আদালত কিংবা মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ এরূপ কুৎসিত, অসভ্য ও অমানবিক রায় বা ফতোয়া যখন প্রদান করে তখন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলিম সমাজে এর প্রবল প্রতিক্রিয়া হয়। সাধারণত তাঁরা বিশ্বাস করতেই চান না যে ইসলাম ধর্মে এরূপ কুৎসিত আইন আছে বা থাকতে পারে। তাঁদের বক্তব্য হলো, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ কোরানের অপব্যাখ্যা করে এরূপ শরিয়ত-বিরুদ্ধ রায় বা ফতোয়া দেন যার ফলে ইসলামের ভাবমূর্তি অবিরাম ক্ষুণ্ণ হয়। মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা এ ধরণের রায় বা ফতোয়াকে অনৈস্লামিক ফতোয়া বলে উড়িয়ে দেন। বলা বাহুল্য যে, এই রায়টিকেও তাঁরা অনৈশ্লামিক ও শরিয়তবিরুদ্ধ বলে বিবৃতি দিতে কালক্ষেপ করেন নি। তথাকথিত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলিম সমাজ যাই ভাবুন এবং মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা যতই বিবৃতি দিন না কেন, কিন্তু বাস্তবটা হলো এই যে, আরব আমীর শাহীর সর্বোচ্চ আদালতের রায়টি শরিয়তসম্মতই। এর প্রমাণ রয়েছে কোরানে। কোরান পুরুষদের নির্দেশ দিয়েছে তারা যেন তাদের অবাধ্য পত্নীকে প্রহার করতে দ্বিধা না করে। হ্যা, আল্লাহর স্পষ্ট নির্দেশ তাই, পত্নীর অবাধ্যতা আশঙ্কা করলে তাকে প্রহার করবে। দেখা যাক আল্লাহ ঠিক কী বলেছে -   
“পুরুষগণ নারীর কর্তা; কারণ এককে অন্যের উপর মর্যাদা দিয়েছেন; আর তাহারাই তো সম্পদ ব্যয় করে; সতী নারী অনুগত, আল্লাহর হিফাযতে স্বামীর অবর্তমানে সংসার রক্ষা করে; যখন তাহাদের অবাধ্যতার ভয় কর; তখন উপদেশ দাও, শয্যা বর্জন কর, প্রহার কর; যদি অনুগত হয়ে যায় তবে বাহানা খোঁজ করিও না।” ( কোরান- ৪/৩৪)    
এই বাণীতে অবশ্য উল্লেখ নেই যে, স্ত্রী যদি কোনোমতেই শেষ পর্যন্ত অনুগত না হয় তখন কী হবে? তার উত্তর দিয়েছেন ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ। সেই উত্তরটি কী তা উল্লেখ করা হয়েছে আর একটু পরে।    
এ যুগে পত্নীকে প্রহার করা কোনো পরিস্থিতেই গ্রহণযোগ্য বা সমর্থনযোগ্য নয়। এটা আইনের চোখেও জামিন অযোগ্য ও দন্ডনীয় অপরাধ। কোরানে এ রকম আরও অনেক অগণতান্ত্রিক, অমানবিক ও বর্বরোচিত আয়াত আছে যেগুলো সম্পর্কে অধিকাংশ মুসলিমরাই অজ্ঞ। এই অজ্ঞতা হেতু এ সব কুৎসিত, জঘন্য ও অমানবিক ফতোয়ার জন্যে তারা সব দোষ চাপিয়ে থাকেন ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের উপর। অবশ্য একদল উচ্চ শিক্ষিত মুসলিম আছেন যারা কোরান ও হাদিস সম্পর্কে যথেষ্টই বিজ্ঞ। তারা সচেতনভাবে কোরান-সম্মত রায় বা ফতোয়াকে অনৈশ্লামিক বলে ইসলামের মহিমা প্রচার করেন যা সর্বৈব মিথ্যা। এসব বুদ্ধিজীবী্রা এই ধরণের রায় বা ফতোয়াকে কেন ইসলাম সম্মত নয় তা বোঝাতে গিয়ে নানারূপ মনগড়া ব্যাখ্যা উপস্থাপিত করেন। আবার কখনো বলেন যে, কোরানের আয়াতের মানে সব সময় আক্ষরিক অর্থে ধরা উচিত নয়, বুঝতে হবে তার ভিতরের আসল কথাটা। ভিতরের সেই কথাটার তারা যা বর্ণনা দেয় তা তাদের সম্পূর্ণ মমগড়া। এ জাতীয় মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা একদম ভণ্ড। স্ত্রীকে প্রহার করা প্রসঙ্গে ভন্ড বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্য হলো, কোরানের ‘প্রহার কর’ শব্দবন্ধটিকে আক্ষরিক অর্থে নয়, বিচার করতে হবে প্রতিকী অর্থে। তাদের অভিমত হলো, আলেম সমাজ কোরানের অনেক আয়াতের অন্তর্নিহিত অর্থ সঠিকভাবে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্যে শরিয়তি আইনে অনেক ত্রুটি রয়েছে যা ইসলামের ভাবমূর্তিকে মলিন করছে এবং ইসলাম সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা তৈরী করছে। আরব আমীর শাহীর সংবিধানের এই আইনটি সে রকমই একটি ত্রুটি।  
 
মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ ‘পত্নীকে প্রহার’ করার কোরানের নির্দেশটিকে প্রতিকী অর্থে দেখার দাবী করেছেন। কিন্তু এই দাবীটি যে মোটেই সঠিক বা যুক্তিগ্রাহ্য নয় তা আয়াতটি ভালোভাবে অধ্যয়ন করলেই বোঝা যায়। এই আয়াতে যেটা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় তা হলো এই যে, পত্নী অবাধ্য হলে সঙ্গে সঙ্গেই যে তাকে প্রহার করতে হবে এমন নির্দেশ কোরান দেয় নি। প্রহার করার পূর্বে তাকে বোঝানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তাতে কাজ না হলে তার শয্যা বর্জন করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, তারপরেও পত্নী যদি অবাধ্য থাকে তবে সর্বশেষ উপায় হিসেবে তবে তাকে প্রহার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে পত্নীকে প্রহার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পুরুষকে একেবারে আক্ষরিক অর্থেই, মোটেই প্রতিকী অর্থে নয়।   
 
এ রকম আইন মুসলিম সমাজের বুদ্ধিজীবীদের কাছে খুবই অস্বস্তিকর ও বিব্রতকর। কারণ, আধুনিকে সমাজে এই আইনগুলি খুবই নিন্দার্হ, ঘৃণার্হ ও মানবাধিকারবিরোধী বলে চিহ্নিত। তারা যেহেতু নিজেদের প্রগতিশীল বলে দাবী করেন তাই এই কুৎসিত আইন-কানুনগুলির পক্ষে তারা দাঁড়াতে পারেন না। আবার মুসলমান সমাজে থাকতে হলে কোরানের সমালোচনাও করা যায় না। তারা মুসলমানও থাকতে চান, আবার প্রগতিশীলও সাজতে চান। কিন্তু এটা তো একেবারেই সম্ভব নয়। তাই তাদের ভন্ডামির আশ্রয় নিতেই হয়। কিন্তু আলেম সমাজ ভন্ডামির আশ্রয় নেয় না এবং এসব আইনের জন্যে তাঁরা লজ্জাবোধও করেন না। বরং কোরানের সমস্ত আইন ও নীতিমালাকে অভ্রান্ত ও চিরিন্তন বলে অকপটে বিশ্বাস করেন। শুধু যে বিশ্বাস করেন তাই নয়, আল্লাহর তৈরি সমস্ত আইন মেনে চলে বলে আত্মশ্লাঘা বোধও করেন। এবং কোরানের আইনগুলির পক্ষে তারা প্রতিনিয়ত নানা ব্যাখ্যা ও যুক্তিও তারা দিয়ে চলেছেন অক্লান্তভাবে। তাঁদের যুক্তি যে অপযুক্তি সে কথা বলা বাহুল্য। পত্নীকে প্রহার করার ইসলামি বিধির পক্ষে আলেম সমাজের যুক্তি হলো – পতির প্রতি পত্নীর আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই, কারণ আল্লাহ পুরুষকে নারীর কর্তা করে পাঠিয়েছেন এবং পুরুষ তথা পতিরাই তো তাদের পত্নীদের ভরণ-পোষণ করে। সুতরাং পতির প্রতি পত্নীর অবাধ্যতা বা অনানুগত্যতা প্রদর্শন করার কোনো অধিকার নেই। তাদের মতে, পত্নী অবাধ্য হলে তাকে বাধ্য করার জন্যে প্রয়োজনে প্রহার করাটাই তো স্বাভাবিক। সারা বিশ্বের মুসলিম সমাজের সমস্ত ধর্মগুরুগণ এই প্রশ্নে সহমত যে অবাধ্য পত্নীকে প্রয়োজনে প্রহার করতে হবে। এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানের প্রখ্যাত ধর্মগুরু মাওলানা মুহাম্মদ আলী কী বলেছে তা শোনা যাক। তিনি তাঁর বিখ্যাত পুস্তকে (The Religion of Islam: A Comprehensive Discussion of the Sources, Principles and Practices of Islam - Lahore, 1938 , p-652-653) লিখেছেন,  
              “It appears that confining (women) to the house is the first step, and it is when they repeat their evil deeds in the house, or do not submit to the authority of the husband and desert him, that permission is given to inflict corporal punishment, which is the last resort, and even if this last step does not make them mend their ways, matrimonial relations may be ended.”(দেখা যাচ্ছে যে ঘরের ভিতর নারীদের আটকে রাখা হচ্ছে প্রথম পদক্ষেপ, এবং এর পরেও যদি তারা তাদের মন্দ কাজগুলি অব্যাহত রাখে বা তাদের স্বামীর কর্তৃত্বের প্রতি তারা তাদের নত না করে ও স্বামীকে ছেড়ে চলে যায় তবে তাদের দৈহিক শাস্তি দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে যেটা হলো সর্বশেষ ধাপ, এবং এমন কি এর পরেও এই শেষ পদক্ষেপেও যদি তারা তাদের সংশোধন না করে তবে তাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক রদ করা যেতে পারে।) ( Vide: Women and the Koran, Anwar Hekmat, p-216)   
 
কোরানের ৪/৩৪ নং আয়াতে এ বিষয়ে স্পষ্ট উল্লেখ নেই যে প্রহৃত হওয়া সত্বেও যদি স্ত্রী পতির কাছে সমর্পণ না করে তা হলে কী হবে? তার উত্তরে মাওলানা মুহাম্মদ আলি তাঁর পুস্তকে লিখেছেন যে পতি তখন সেই অবাধ্য স্ত্রীকে তালাক দিয়ে তার সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কের ছেদ টেনে দেবে।  
 
স্ত্রীকে প্রহার করা নিয়ে উলামার (মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের) মধ্যে অবশ্য মতভেদ আছে , সে মতভেদ প্রহার করার মাত্রা ও ধরণ নিয়ে। এই প্রশ্নে বহু মত থাকলেও প্রধান মত হচ্ছে দুটি। প্রথম মতটি হলো - কড়া বা কঠিন প্রহার নয়, হাল্কা ধরণের প্রহার করতে হবে। দ্বিতীয় মতটি হলো – কড়া প্রহার করতে হবে, হাল্কা বা আলতো প্রহার নয়। যাঁরা প্রথম দলভুক্ত তাঁদের অভিমত হলো – হয় চড় বা থাপ্পড় মারবে , অথবা কিল বা ঘুষি মারবে; তবে সে আঘাত যেন খুব জোরের সঙ্গে না হয়। এক্ষেত্রে যেটা লক্ষ্যণীয় তা হলো, কেবল হাত দিয়ে প্রহার করার কথা বলা হয়েছে। যারা দ্বিতীয় দলভুক্ত অর্থাৎ যারা কড়া প্রহারের পক্ষে তারা প্রহার করার জন্যে লাঠি, রড ও চাবুক ব্যবহার করার বিধান দিয়েছেন। যারা হাল্কাভাবে প্রহার করা সমীচীন বলেছেন তারা কি ধরণের ‘হাল্কা প্রহার’ হবে সেটাও নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘স্ত্রীকে যতখুশী, যতক্ষণ খুশি প্রহার করা যাবে, কিন্তু প্রহারের ফলে যেন শরীরে কোনো চিহ্ন ফুটে না উঠে’। আরও বলা হয়েছে যে, প্রহারের ফলে স্ত্রীর শরীরে যদি চিহ্ন ফুটে ওঠে তবে তা সীমা লঙ্ঘন হয়েছে বলে গণ্য করা হবে এবং সেটা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আরব আমীর শাহীর শরিয়তি আইন বা সংবিধান বলা বাহুল্য যে এই মতটিকে অনুসরণ করেছে। 
 
পাঠকদের মনে প্রশ্ন বা সংশয় তৈরী হতে পারে যে ‘স্ত্রীকে প্রহার’ করা নিয়ে কোরান বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কি সত্যি এরূপ নানা মত আছে? নাকি, ইসলামকে হেয় করার জন্যে ইসলাম বিদ্বেষীদের এটা মনগড়া ও মুখরোচক অপপ্রচার? না, মোটেই এটা কারও মনগড়া অপপ্রচার নয়। এটা যে সত্য ঘটনা তার প্রমাণ কোরানের তফসীরে রয়েছে । গিরিশ চন্দ্র সেন, যিনি সর্ব প্রথম বাংলা ভাষায় কোরান অনুবাদ করে মুসলিম সমাজে খুবই খ্যাতি, সম্মান ও কৃতজ্ঞতা কুড়িয়েছিলেন, তাঁর অনুবাদ গ্রন্থে অনেকগুলি তফসীর উদ্ধৃত করেছেন পারস্য ভাষ্য-পুস্তক থেকে। সেই পুস্তকে ‘স্ত্রীকে প্রহার’ করা প্রসঙ্গে তফসীরে তিনি লিখেছেন, 
 
        “ ... নারীদিগকে এরূপ প্রহার করিবে না যাহাতে তাহাদের কোন অঙ্গ আহত ও ইন্দ্রিয় বিকৃত হয় । যাহাতে তাহাদের অন্তর কোমল হয়, তাহারা দাম্পত্যস্বত্বের সম্মান রক্ষা করিতে পারে ,প্রথমতঃ তাহাদিগকেএরূপ উপদেশ ও শিক্ষা দিবে । অবাধ্যতার আশঙ্কা হইলে উপদেশ, অবাধ্যতা প্রকাশ পাইলে ভিন্ন শয্যায় শয়ন করিতে দেওয়া,পুনঃ পুনঃ অবাধ্যতাচরণ হইলে সামান্য প্রহার বিধি ।(ত, হো,) (দ্রঃ কুরআন শারীফ/ ভাই গিরিশচন্দ্র সেন, পৃ-৮৪) ‘ত,হো’ মানে পারস্য ভাষ্য-পুস্তক “তফসীর হোসেনী”। 
 
এরপর যে প্রশ্নটা আসে তা হলো, পত্নীর কোন কোন আচরণ অবাধ্যতা বলে গণ্য হবে? এটা অনেক বড়ো বিষয় যা আলোচনার জন্যে বৃহৎ পরিসর আবশ্যক যার সুযোগ নেই, তাই সংক্ষেপে যতটা সম্ভব এটা আলোচনা করার চেষ্টা করা যাক। এটা বোঝার জন্যে সবচেয়ে বেশী সহায়ক হবে এ বিষয়ে মুহাম্মদ স্বয়ং কী বলেছেন সে কথাটা জানা। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেনঃ 
 
     “ইবনে আবু ওমর (রাঃ) রেওয়ায়েত করেছেন, আবু হোরায়রাহ (রাঃ) বলেন, রাসুলে পাক (সাঃ) এরশাদ করেছেন, কসম সে সত্তার! যাঁর হাতের মুঠোয় আমার প্রাণ। কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে নিজের শয্যায় আহ্বান করলে সে যদি আসতে অস্বীকার করে, তবে নিঃসন্দেহে যে পর্যন্ত না সে স্ত্রীর প্রতি সন্তুষ্ট হয়, সে পর্যন্ত আসমানবাসী ( ফিরিশতাগণ) তার উপর নাখোশ থাকে।” (মুসলিম শরীফ, হাঃ নং- ৩৪০৭) 
 
এরূপ হাদিস আরও বহু আছে। অর্থাৎ মুহাম্মদ যে এ কথাগুলি বলেছেন তা প্রশ্নাতীত। এ হাদিস থেকে এটা স্পষ্ট যে, পতি যখন যে মূহুর্তে স্ত্রীকে যৌন সম্ভোগের জন্যে আহ্বান করবে, স্ত্রীকে তৎক্ষণাত সাড়া দিতে হবে এবং পতির যৌন সেবায় নিয়োজিত হয়ে তাকে তুষ্ট ও তৃপ্ত করতে হবে। শারিরীক কিংবা মানসিক কিংবা অন্য কোনো অনিবার্য কারণেও পতির আহ্বানে পত্নী অসম্মতি বা আপত্তি জানাতে পারবে না। পতির যৌন আবেদন বা কামনা যতই অযৌক্তিক বা অন্যায় হোক, মুসলিম নারীকে তাতেই সাড়া দিতে হবে, কোনো অবস্থাতেই পতি অপ্রসন্ন হয় এমন কাজ সে করতে পারবে না। কেননা, আল্লাহ নারীকে তো পুরুষের সেবা করার জন্যেই সৃস্টি করেছে। স্ত্রীর কর্তব্য কী সে কথা অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ইসলামি চিন্তাবিদ ইমাম গাজ্জালি তাঁর বিখ্যাত ‘ইয়াহ্ইয়া উলুমেদ্দিন’গ্রন্থে ৯২৩৫ পৃষ্ঠায় লিখেছছেন, 
 
       “স্ত্রীর উচিৎ স্বামীকে তার নিজ সত্ত্বার চেয়েও উপরে স্থান দেয়া, এমনকি তার সকল আত্মীয়স্বজনের উপর স্থান দেয়া। সে স্বামীর জন্যে নিজেকে সদা-সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখবে যেন স্বামী তাকে যখন ইচ্ছা ভোগ করতে পারে।” ( দ্রঃ পুরুষ রচিত ধর্মে বিকলাঙ্গ নারী/ নন্দিনি হোসেন, মুক্তমনা ওয়েব সাইট)  উক্ত হাদিস এবং ইমাম গাজ্জালির উক্তি থেকে এটা স্পষ্ট যে পতির যৌন আবেদনে সাড়া না দিলে তা স্ত্রীর অবাধ্যতা বলে গণ্য হবে। 
 
এর পরেও প্রশ্ন থেকে যায়, পত্নী যদি মানসিক দিক বা শারিরীক দিক থেকে বা অন্য অনিবার্য কোনো কারণে পতির যৌনসেবা করার মত অবস্থায় না থাকে এবং তজ্জনিত কারণে যদি সে পতির আহ্বানে সাড়া দিতে অসম্মত হয় এবং পতির শয্যায় না যায় তা হলে কী হবে? আল্লাহ ও তার নবী তারজন্যে কিন্তু তাকে ছাড় দেওয়ার কথা কোথাও বলে নি। অর্থাৎ কোনো অবস্থাতেই পতির শয্যায় না গিয়ে তাকে অসন্তুষ্ট করা যাবে না। সুতরাং স্ত্রী সাড়া না দিলে বা দিতে না পারলে – ঘটনা যাই হোক না কেন, তা তার অবাধ্যতা বলে গণ্য হবে। আর এই অবাধ্যতার শাস্তি হিসাবে পতিকে অধিকার (নির্দেশ ) প্রদান করা হয়েছে তার পত্নীকে প্রহার করার। এরপরেও প্রশ্ন থেকে যায় - প্রহৃত হওয়া সত্বেও যদি স্ত্রী পতির শয্যায় না যায় তা হলে কী হবে? সেক্ষেত্রে বিধান হলো পতি তখন পত্নীকে তালাক (ডিভোর্স) দেওয়ার ভীতি প্রদর্শন করবে। ভীতি প্রদর্শন করার পরেও যদি পত্নী পদতলে গিয়ে না পড়ে তা হলে কী হবে? পতি তখন তাকে বর্জন (তালাক)করবে। হ্যাঁ ,এটাই ইসলামের নির্দেশ। মাওলানা মুহাম্মদ আলী তাঁর পুস্তকে সে কথাটি স্পষ্ট করে লিখেছন যার উল্লেখ উপর করা হয়েছে। ইসলাম ধর্ম পুরুষকে নারীর উপর এই যে অসীম ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রদান করেছে তা যে ভীষণই একপেশে ও একচেটিয়া তা বলা বাহুল্য। মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ এরূপ সমস্ত শরিয়তি আইনকেই মুসলিম ধর্মগুরুদের মনগড়া এবং অনৈশ্লামিক বলে প্রচার করেন। কিন্তু প্রকৃত ও নির্মম সত্যটি হলো মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের এই অভিমতটাই মনগড়া ও অনৈশ্লামিক। এর প্রমান মেলে যেমন কোরানে , তেমনি হাদিসেও। এ প্রসঙ্গে একটা কথা উল্লেখ করা ভীষণ প্রাসঙ্গিক ও জরুরী তা হলো, স্বয়ং হযরত মুহাম্মদও তাঁর দাম্পত্য জীবনে এই একচেটিয়া ক্ষমতা, অধিকার ও কর্তৃত্ব প্রয়োগ করেছেন ও ভোগ করেছেন। তিনি তাঁর পত্নীদের তালাকের ভীতি প্রদর্শন করে বারবার তাঁর পদতলে সমর্পণ করতে বাধ্য করেছেন। না, এটা মনগড়া মিথ্যা অভিযোগ বা অপপ্রচার নয়, এর সপক্ষে ভুরি ভুরি প্রমাণ জ্বলজ্বল করছে কোরান ও হাদিসে এবং এমন কি মুহাম্মদের জীবন-চরিতেও। মুহাম্মদের দাম্পত্যজীবন সদা সুখশান্তিতে ভরপুর ছিল না, বহু অশান্তি ও কলহের ঘটনা ঘটেছিল তাঁর দাম্পত্যজীবনে। সরল ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে এটা অবিশ্বাস্য ও বেদনাদায়ক হলেও এটাই নির্মম বাস্তব ও সত্যি ঘটনা। বিভিন্ন সময়ে মুহাম্মদের স্ত্রীগণ তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন এবং তার ফলে মুহাম্মদের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীদের বহুবার কলহ-বিবাদ হয়েছে। স্ত্রীদের অসন্তোষ বা ক্ষোভগুলি প্রশমন করতে যখন ব্যর্থ হয়েছেন মুহাম্মদ তখন আল্লাহর ওহির অবতারণা করেছেন যেসব ওহিতে তাঁর স্ত্রীদের তালাক দেবার হুমকির উল্লেখ রয়েছে। এই হুমকির উল্লেখ রয়েছে কোরানের ৩৩/২৮ নং আয়াতে। আয়াতটির বঙ্গানুবাদ হলো- 
 
          “হে সংবাদবাহক, তুমি স্বীয় ভার্যাদিগকে বল, যদি তোমরা পার্থিব জীবন ও তাহার শোভা অভিলাষ করিয়া থাক তবে এস, তোমাদিগকে (তাহার) ফল ভোগ করাইব, এবং তোমাদিগকে উত্তম বিদায়ে বিদায় দান করিব।” 
 
‘উত্তম বিদায়ে বিদায় দান করিব’ – এই কথাগুলির অর্থ হলো ‘তোমাদের তালাক দিয়ে বিদায় করে দেব’। অর্থাৎ একজন স্ত্রী নয়, একাধিক স্ত্রী মুহাম্মদের প্রতি অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাঁরা এতটাই ক্ষুব্ধ ছিলেন যে মুহাম্মদের পক্ষে তা প্রশমন করা সম্ভব হয় নি এবং সে জন্যে তিনি এক মাস গৃহত্যাগ করে মসজিদে অবস্থান করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তারপরেও স্ত্রীদের ক্ষোভ প্রশমিত না হওয়ায় তিনি আল্লাহর ওহি নামিয়ে এনে তালাকের ভয় দেখিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। হ্যাঁ, ঐ আয়াতের তফসিরে এই ঘটনার বর্ণনাটি আছে। তফসীরটি এরূপঃ 
 
           “মদীনা প্রস্থানের নবম বৎসরে হজরত স্বীয় পত্নীগণ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়াছিলেন ও শপথ করিয়াছিলেন যে, এক মাস কাল তাঁহাদের সঙ্গ করিবেন না, কারণ এই যে, তাঁহারা তাঁহার সাধ্যাতীত বস্ত্রাদি প্রার্থনা করিতেছিলেন। এয়মনের বিচিত্র বসন ও মেসরের পট্ট-বস্ত্র, এবং এইরূপ অন্যান্য সামগ্রীর প্রতি তাঁহাদের লোভ হইয়াছিল। এই সকল হজরতের হস্তায়ত্ত ছিল না। তিনি তাঁহাদের কত্তৃক উত্তক্ত হইয়া তাঁহাদের সঙ্গ পরিত্যাগ করেন, এবং এক মসজ্বেদে যাইয়া বসিয়া থাকেন, ঊনত্রিশ দিবসের পর তিনি এই আয়াত প্রাপ্ত হন।” (দ্রঃ কুরআন শরীফ/গিরিশ্চন্দ্র সেন, পৃ-৪৭৬)
 
         ...   ঠিক কি কী কারণে মুহাম্মদের প্রতি এত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তা নিয়ে বিতর্ক আছে। সে কথা থাক। আমরা এখন অন্য আরও তিনটি আয়াতের প্রতি দৃষ্টিপাত করব যেখানে মুহাম্মদের দাম্পত্যজীবনে তীব্র অশান্তি ও কলহ এবং তা দমনে সেই তালাকের দাওয়াইয়েরই উল্লেখ রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো – 
 
          “হে সংবাদবাহক, ঈশ্বর তোমার জন্য যাহা বৈধ করিয়াছেন স্বীয় ভার্যাদিগের সন্তোষ প্রয়াস করতঃ তাহা কেন অবৈধ করিতেছ ?” (আয়াত নং ৬৬/১)  
 
অন্য আয়াত দুটি এরূপঃ 
 
         “তোমরা দুই জনে (হে পয়গম্বরের দুই ভার্যা ) যদি ঈশ্বরের দিকে ফিরিয়া আইস, (ভাল হয়,) অনন্তর নিশ্চয় তোমাদের অন্তর কুটিল হইয়াছে, এবং যদি তাহার প্রতি (তাহাকে ক্লেশ দানে) তোমরা পরষ্পর অনুকূল হও তবে নিশ্চয় (জানিও) সেই ঈশ্বর ও জেব্রিল এবং সাধু বিশ্বাসীগণ তাঁহার বন্ধু আছেন, অতঃপর দেবগণ সাহায্যকারী হয়। যদি সে তোমাদিগকে বর্জন করে তবে তাহার প্রতিপালক তোমাদিগ অপেক্ষা উত্তম মোসলমান বিশ্বাসিনী সাধনপরায়ণা পাপ হইতে প্রতিনিবৃত্তা অর্চনাকারিণী উপবাসব্রতিধারিণী বিবাহিতা ও কুমারী নারীদিগকে তাহাকে বিনিময় দান করিতে সমুদ্যত।” (আয়াত দুটির নম্বর হলো – ৬৬/৩, ৪) 
 
 প্রথম আয়াতটির প্রেক্ষাপট নিয়ে দুটি মত শোনা যায়। তার মধ্যে যেটি অধিক গ্রহণযোগ্য সেটা হলো এটা – 
 
        “... পরন্তু এরূপ প্রসিদ্ধ যে, হজরত হফসার বারের দিন তাঁহার গৃহে যাইতেন, একদা তিনি হজরতের আজ্ঞাক্রমে পিত্রালয়ে গিয়াছিলেন, হজরত কেবতা কুলোদ্ভবা দাসীপত্নী মারিয়াকে ডাকাইয়া নিজ সেবায় নিযুক্ত করেন। হফসা তাহা অবগত হইয়া অসন্তোষ প্রকাশ করেন। হজরত বলেন, ‘হে হফসা, যদি আমি তোমাকে নিজের সম্বন্ধে অবৈধ করি তাহাতে তুমি কি সম্মত নও’। তিনি বলিলেন ‘হ্যাঁ সম্মত’। হজরত কহিলেন, ‘এ কথা কাহারও নিকটে ব্যক্ত করিবে না, তোমার নিকট গুপ্ত রহিল’। হফসা সম্মত হইলেন। কিন্তু যখন হজরত তাঁহার গৃহ হইতে চলিয়া গেলেন, তৎক্ষণাৎ হফসা আয়েশাকে যাইয়া এই সুসংবাদ দান করিয়া বলিলেন, ‘আমরা কেবত নারীর হস্ত হইতে মুক্তি পাইয়াছি’। পরে হযরত আয়েশার গৃহে আগমন করিলে তখন আয়েষা ইঙ্গিতে এই বৃত্তান্ত বলেন। এতদুপলক্ষে এই সুরা অবতীর্ণ হয়। অর্থাৎ মারিয়াকে ঈশ্বর তোমার প্রতি বৈধ করিয়াছেন, তাহাকে কেন আপনার সম্বন্ধে অবৈধ করিয়া তুলিলে ও শপথ করিলে? ” ( দ্রঃ – প্রাগুক্ত, পৃ-৬২৮, ৬২৯) 
 
প্রকৃত ঘটনাটির অতি ক্ষুদ্র অংশ এই তফসিরে বর্ণিত হয়েছে। তাতেই এটা স্পষ্ট যে, স্বয়ং মুহাম্মদও তাঁর স্ত্রীদের বাধ্য করার জন্যে তালাকের ভয় দেখাতে দ্বিধা করেন নি। মুহাম্মদ তাঁর স্ত্রীদের বাধ্য করার জন্যে প্রহার করেছিলেন কী না জানা নেই, কিন্তু তিনি যে বারবার তালাক, আল্লাহর গজব ও ফেরেস্তাদের অভিশাপের ভয় দেখিয়েছিলেন তা নিয়ে সংশয়ের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। সুতরাং মুসলিম বুদ্দিজীবীরা যতই ভন্ডামি করুন না কেন, আরব আমির শাহীর আদালত যে শরিয়ত তথা ইসলামি আইন মেনেই রায় দিয়েছে তা সন্দেহাতীতভাবে সত্যি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, অন্যান্য ধর্মেও স্ত্রীকে প্রহার করার নির্দেশ বা বিধান রয়েছে। হিন্দু ধর্মও ব্যতিক্রম নয়। শতপথ ব্রাহ্মণের একটি শ্লোক এরূপঃ ‘তেমনি স্বামীও স্ত্রীকে পেটাবে, যাতে তার নিজের শরীর বা সম্পত্তির ওপর কোনো অধিকার না থাকে।’ ( দ্রঃ সুকুমারী ভট্টাচার্যের ‘প্রাচীন ভারতে নারী সমাজ’, পৃ-৫০) হিন্দু সমাজের বুদ্ধিজীবীগণ সাধারণভাবে এই অরুচিকর, নিকৃষ্ট ও ঘৃণ্য ধর্মীয় বিধি-বিধানগুলি আড়াল করার অপচেষ্টা না করে অকপটে তুলে ধরেন এবং এগুলি বর্জন করার নির্ভীক আহ্বান জানিয়ে হিন্দু সমাজের সংস্কার ও উন্নতি করার প্রয়াস করেন। অন্যান্য সমস্ত ধর্মীয় সমাজেও অনুরূপ ধারাবাহিক সাধু প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। ব্যতিক্রম কেবলই মুসলিম সমাজ। এ সমাজের বুদ্ধিজীবীরা এসব কুৎসিত, জঘন্য ও মানবতাবিরোধী বিধি-বিধানগুলি অস্বীকার ও আড়াল করে ইসলাম, কোরান ও মুহাম্মদকে নিয়ে অকারণ মিথ্যা বড়াই করেন। তাঁরা বোঝেন না বা বোঝার চেষ্টা করেন না যে তারফলে মুসলিম সমাজের অকল্যাণ বৈ কল্যাণ হয় না ।  
          ( প্রবন্ধটি ‘বোধোদয়’ পত্রিকায় ৭ই ডিসেম্বর’২০১০ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় )

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...