নারী কী করবে কী করবে না, কী পরবে ও কীভাবে পরবে
এবং কী পরবে না, কীভাবে চলবে কীভাবে চলবে না, কীভাবে কথা বলবে কীভাবে বলবে না, এ
সব নানাবিধ নিয়ম-কানুন বা বিধান যা সমাজে চালু আছে তা সবই পুরুষেরদের রচিত। নারীকে ঘরের মধ্যে আবদ্ধ জীবন যাপন করতে হয় সেই
বিধান মেনেই। এ সব বিধানের সামান্য উল্লঙ্ঘন করলে বা এদিক ওদিক করলে নারীকে পেতে
হয় শাস্তি ও নানারূপ ভর্ৎসনা। অসতী, কুলটা, বেহায়া, চরিত্রহীন, বেশ্যা এরূপ
পুরুষ রচিত কুৎসিত ভাষা ও নোংরা গালাগাল শুনতে হয় তাদের। পাছে নারী এসব গালাগাল ও অপবাদ অগ্রাহ্য করে সেজন্যে তাদের পরকালের শাস্তির ভয়ও দেখানো হয়। নারীকে পুরুষ শিখিয়েছে, তার
প্রধান ধর্ম হলো পতিসেবা করা। নারী যদি পতিসেবায় সামান্য ত্রুটি করে তবে মৃত্যুর
পর তার জন্যে রয়েছে ভয়ংকর শাস্তি, এ কথা তাকে পুরুষ বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়।
নারীর ‘মুক্তিদাতা’ মুহাম্মদ পুরুষ রচিত সেই কুৎসিত বিধানগুলি শুধু অনুমোদনই করেন
নি, আপন ভঙ্গিমায় সেগুলিকে আরো নবরূপে এবং আরো কঠোর ও নিবিড় করে আল্লাহর নামে
আইনরূপে প্রবর্তন করেছেন। তিনি জানিয়েছেন অবলীলায় যে, পতিসেবায় সামান্য ত্রুটি
হলে পরকালে নারীকে কঠোর শাস্তি পেতে হবে তা তিনি নিজের চোখে দেখে এসেছেন আল্লাহর নিকট
গিয়ে। কী দেখেছেন তা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, “তিনি বললেন আমি তো জান্নাত দেখেছিলাম এবং একগুচ্ছ আঙ্গুরের
প্রতি হাত বাড়িয়েছিলাম, আমি তা পেয়ে গেলে, দুনিয়া কায়েম থাকা পর্যন্ত তোমরা তা খেতে পারতে। তার পর আমি জাহান্নামে দেখলাম, আজকের মতো ভয়াবহ দৃশ্য আর কখনও দেখিনি। আর দেখলাম জাহান্নামের অধিকাংশ অধিবাসী স্ত্রীলোক। লোকেরা জিজ্ঞাসা করল, ইয়া রাসুলুল্লাহ! কী কারণে? তিনি বললেন, তাদের কুফুরীর কারণে। জিজ্ঞাসা করা
হলো, তারা কি আল্লাহর সাথে কুফুরী করেছে? তিনি উত্তর দিলেন, স্বামীর অবাধ্য থেকে এবং তাদের এহসান অস্বীকার করে।” (বোখারী
শরিফ, ১ম-৭ম খণ্ডে একত্রে, মল্লিক ব্রাদার্স, কলকাতা, হাদিস নং ৩৬৪) নারীকে কীভাবে পতিসেবা করতে হবে তার খুঁটিনাটি
বিবরণ দিয়ে গেছেন মুহাম্মদ। তিনি যা বলেছেন তার মধ্যে রয়েছে এ হাদিসটি, “হযরত আবু
হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন - স্বামী
যদি স্ত্রীকে বিছানার প্রতি আহ্বান করে এবং তাতে স্ত্রী অসম্মতি প্রকাশ করে,
যদ্দরুণ স্বামী অসন্তুষ্টির সহিত রাত্রি যাপন করে তবে সেই স্ত্রীর রাত্রি এই
অবস্থায় অতিবাহিত হয় যে, ফিরিস্তাগণ রাত ভোর পর্যন্ত তার প্রতি লানত (অভিশাপ)
বর্ষণ করে ।” (সূত্র – ঐ, হাদিস নং ১১১৫) এ হাদিস অনুযায়ী এটা স্পষ্ট হয় যে, পতির
যৌন কামনা ও যৌন-ক্ষুধা পূরণে পত্নীর কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি বাধা হতে পারে না।
পতির যৌন আবেদনে সাড়া দেওয়াই যে নারীর প্রাথমিক ও প্রধান কর্তব্য সেটা মুহাম্মদ
স্পষ্ট করে দিয়েছেন আর একটি হাদিসে। হাদিসটি হলো – “যদি কোন ব্যক্তি সঙ্গম করার
ইচ্ছায় স্ত্রীকে আহ্বান করে তবে সে যেন তৎক্ষণাৎ তার নিকট উপস্থিত হয় যদি সে
উনানের উপর রন্ধনের কাজে লিপ্তও থাকে।” (মুসলিম শরীফ) নারীর ধর্মের নামে নারীর
প্রতি এ সব নির্দেশ হলো নারী দাসত্বের এক একটি ঘৃণ্য বিধান। নারী দাসত্বের অনেক
বিধান আছে যা নারীকে সর্বদা স্বীয় অঙ্গে বহন করতে হয়। যেমন হিন্দু নারীর হাতের
শাখা, সিঁথির সিঁদুর, পতির পদবী ধারণ ইত্যাদি। তবে স্বীয় অঙ্গে বহন করার সবচেয়ে
ঘৃণ্য দৃষ্টান্তটি হলো ‘হিযাব’। নারী দাসত্বের এই ঘৃণ্যতম ও অসভ্যতম প্রতীকটি বহন
করতে হয় কেবল মুসলিম নারীদেরকেই।
হিযাবের পক্ষে মুসলিম পণ্ডিতগণ অনেক যুক্তি (আসলে
অপযুক্তি বা কুযুক্তি) দেখালেও মুসলিম নারীরা কিন্তু হিযাবকে তাদের স্বাধীনতার উপর
নগ্ন হস্তক্ষেপ বলেই মনে করে। ইসলামি রাষ্ট্রগুলিতে মুসলিম নারীরা সবাই বোরখা পরে। তা এ জন্যে নয় যে, তারা সকলেই বোরখা
পরিধান করাকে সমর্থন করে। খুব কম মেয়েই আছে যারা বোরখা পরার আল্লাহর নির্দেশকে
নীতিগতভাবে সমর্থন করে এবং স্বেচ্ছায় বোরখা পরে। অধিকাংশ নারীই ভয়ে বোরখা পরে
যেহেতু সে সব দেশের আইনে বোরখা পরা বাধ্যতামূলক এবং বোরখা না পরে রাস্তায় বের হওয়া
শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যে সব মুসলিম দেশে সাংবিধানিক আইনে বোরখা পরা
বাধ্যতামূলক নয় এবং বোরখা না পরলে শাস্তির মুখে পরতে হয় না সেখানে ৮০-৯০% মুসলিম
নারীই বোরখা বর্জন করেছে। ভারতের
সংবিধানেও মুসলিম নারীদের বোরখা পরা বাধ্যতামূলক নয় বলে ভারতের মুসলিম নারীরাও
৮০-৯০ শতাংশই বোরখা পরে না। এটাই সত্যি যে মুসলিম নারীরা বোরখা বা হিযাব পরতে চায় না। না, এটা কারো মনগড়া কথা নয়, ইতিহাসে
এর ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে। মুসলিম নারী যুগে যুগে দেশে দেশে হিযাবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম
করেছে। সে সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। হিযাব সম্পর্কে মুসলিম নারীদের মনোভাব
জানবার জন্যে সে ইতিহাস আমাদের জানা আবশ্যক। সেই ইতিহাসের পাতায়
একটু চোখ বুলানো যাক। ইরানের
আমেরিকা প্রবাসী একজন খ্যাতনামা ঐতিহাসিক ও লেখক এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “In the struggle for the
liberation for the Muslim woman the veil has become a symbol of her servitude.
Thus in 1923 the president of the Egyptian Feminist Union Mr. Houda Cha’araoui, and her colleagues defiantly threw their veils into the sea.
Similarly in 1927 there was a campaign of “de-hijabization” in communist
Turkestan. Not less than 87,000 Uzbek women publicly repudiated their “black
cowls”, though not less than 300 of
their sisters had been killed by the male heads of the Muslim families for
betraying Islam. In 1928, at the independence celebrations, the Shah of
Afghanistan ordered his wife to “unveil” herself in public. Following the
public scandal, the shah was obliged to backtrack and cancel his projects for
the emancipation of women. He himself was obliged to abdicate. In 1936 Reza
Shah of Iran forbade the tchador by a special decree. Obviously the people were
not ready to break with tradition and so after mass protests in 1941 he also
had to retreat and abrogate law. (Why I am not a Muslim, Ibn Warraq, p. 315,
Prometheus Books, New York) মুসলিম
নারীদের মুক্তির সংগ্রামে হিযাব একটি দাসত্বের প্রতীক হয়ে উঠে। তাই ১৯২৩ সালে ইজিপ্টের নারীবাদী সঙ্ঘের সভানেত্রী ও
তাঁর সহকর্মীরা সমুদ্রের জলে হিযাব ছুঁড়ে
ফেলে দিয়েছিলেন। অনুরূপভাবে ১৯২৭ সালে কম্যুনিস্ট শাসিত তুর্কিস্তানে
হিযাব-বিরোধী প্রচার আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছিলো। সে সময় কম পক্ষে ৮৭০০০ (সাতাশি হাজার) মুসলিম নারী একযোগে তাদের “কালো
মস্তকাবরণ” প্রকাশ্যেই বর্জন করেছিলেন যদিও তার জন্যে কম পক্ষে ৩০০ জন মুসলিম
নারীকে ইসলাম বর্জন করার অভিযোগে তাদের পরিবারের
পুরুষ অভিভাবকরা হত্যা করেছিলো। ১৯২৮ সালে আফগানিস্তানের শাহ তাঁর পত্নীকে প্রকাশ্যে স্বাধীনতা উদযাপনের একটি অনুষ্ঠানে
‘হিযাব’ বর্জন করতে বলেছিলেন। পরে প্রবল লোক নিন্দার কারণে তিনি পিছু হটতে বাধ্য হন এবং নারী মুক্তির কর্মসূচী বাতিল করেন। ১৯৩৬
সালে ইরানের শাহ চাদর (হিযাব) বর্জনের জন্যে একটি বিশেষ অধ্যাদেশ জারি করেন।
কিন্তু ইরানের জনগণ সে ঐতিহ্য বর্জনের জন্যে প্রস্তুত ছিলো না, ফলে মানুষের তীব্র
প্রতিবাদের মুখে ১৯৪১ সালে শাহ পিছু হটতে
বাধ্য হন এবং আইনটি (অধ্যাদেশটি)
প্রত্যাহার করেন। ‘হিযাব’
শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ হাযাবা থেকে। ‘হাযাবা’র মানে হলো আড়াল করা বা গোপন
করা। শরিয়তি আইনে হিযাবের উপর একটি অধ্যায় বিদ্যমান। হিযাব-আইনটি থেকে বোঝা যায় যে, প্রাক ইসলাম যুগে আরবে নারী ও পুরুষ স্বচ্ছন্দে
এক সঙ্গে চলাফেরা ও মেলামেশা করতো। আধুনিক
সমাজেও মুসলিম মেয়েদের কাছে হিযাবের গ্রহণযোগ্যতা নেই তা চারিদিকে চোখ রাখলেই বোঝা
যায়, এবং হয় তো কোনো কালেই ছিলো না। আধুনিক
মুসলিম সমাজ যেহেতু হিযাব পরতে সম্মত নই, তাই ইসলামি আইনের সংস্কারপন্থীরা অনেকেই
হিযাবকে সংশোধিত রূপে উপস্থাপিত করার চেষ্টায় মগ্ন রয়েছেন। তাদের কেউ কেউ বলেন
যে, হিযাব শুধু মুহাম্মদের পত্নীদের জন্যে প্রযোয্য, সমস্ত মুসলিম নারীদের জন্যে
নয়। আবার হিযাবকে আধুনিক সমাজের মুসলিম নারীদের কাছে গ্রহণযোগ্য করার উদ্দেশ্যে
সংস্কারপন্থীরা হিযাবের আকার, আকৃতি ও আয়তন নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত ও মশলা ব্যক্ত
করেছেন। তাদের একটা অভিমত হলো, নারীর কিয়দংশ চোখ, নাক, হাত ও পায়ের অগ্রভাগ খোলা
রেখে শরীরের বাকি অংশ কাপড় দিয়ে ঢাকতে হবে। কিন্তু কোরানের উপরে উল্লেখিত আয়াত
দু’টি সংস্কারপন্থীদের এই মতকে নস্যাত করে দেয়। সংস্কারপন্থীদের অভিমত ও
বাখ্যা-বিশ্লেষণ কোরান দ্বারা সমর্থিত ও স্বীকৃত না হলেও তার প্রভাব পড়েছে মুসলিম সমাজে। তৈরী হয়েছে হিযাবের খুঁটিনাটি
নিয়ে মতভেদ। ফলে হিযাবের ভিন্ন পোশাক ও ভিন্ন ভিন্ন অনুবাদের প্রচলন দেখা যায় বিভিন্ন
দেশে ও ভাষায়। বাংলায় হিযাব বলতে বোঝানো
হয় পর্দা, বোরখা, চাদর ইত্যাদি। ইংরাজীতে ব্যবহার করা হয় Veil, Cloak,
Outer Garment, Shawl ইত্যাদি শব্দ। মুসলিম দেশগুলিতে হিযাবকে কী বলে
সে প্রসঙ্গে ইবন ওয়ারাক তাঁর উক্ত গ্রন্থে একটি বর্ণনা দিয়েছেন । তিনি লিখেছেন –
In Morocco, Algeria, and Tunisia we find haik, safsari, akhnif, and adjar. In
Egypt, Israel, Syria, Iraq, and among the Bedouins, we find abaya, tarna, izar,
milhafa, khabara, chambar, niquab, litham, and bourqou; in Iran, bourda,
tchadar, pitcha, and rouband; in Turkey, yatchmek, yalek, harmaniya, and
entari; in India and Pakistan, burka.
নারী গৃহবন্দী
বিভিন্ন দেশে এবং একই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে
হিযাবের পোশাকেও বিভিন্নতা দেখা যায়। আগেই বলেছি যে হিযাব শব্দের মানে হলো কোনো বস্তুকে লুকানো
বা আড়াল করা। কিন্তু নারীকে এক টুকরো কাপড়ে সম্পূর্ণ লুকানো সম্ভব নয়। তাই
হিযাবের মধ্যেই রয়েছে কিছু কিছু উপধারা যাতে নারীকে সম্পূর্ণই লুকিয়ে রাখা সম্ভব
হয়। কোরানে দু’টি আয়াত আছে যেখানে নারীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তারা যাতে ঘরের
মধ্যে লুকিয়ে থাকে। আয়াতদ্বয়ের একটি হলো – “এবং তোমরা স্বগৃহে অবস্থান করবে; প্রাচীন জাহিলী যুগের মতো নিজেদের
প্রদর্শন করে বেড়াবে না। তোমরা নামায কায়েম করবে ও যাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সঃ) - এর প্রতি অনুগত থাকবে; হে নবীর পরিবার। আল্লাহতো
চান তোমাদের হতে শুধু অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।” (৩৩/৩৩) আর একটি আয়াত আছে যাতে নারীদের পরপুরুষের সাথে
কার্যতঃ কথা বলতে বারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ পুরুষদের নিকট থেকে নারীকে পৃথক রাখা বা
লুকিয়ে রাখার জন্যেই এই নির্দেশ। সেই আয়াতটি হলো - “হে নবী পত্নীরা!
তোমরা অন্য নারীদের মত নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় করো তবে পর পুরুষের সঙ্গে কোমল
কণ্ঠে এমনভাবে কথা বলো না যাতে অন্তরে যার
ব্যাধি আছে সে প্রলুব্ধ হয়, এবং তোমরা ন্যায়সঙ্গতভাবে কথা বলবে।” (৩৩/৩২) অজুহাত অন্বেষণকারীরা বলতেই পারেন যে, এ আয়াতটি তো নবী পত্নীদের উদ্দেশ্যে
এসেছে। তাদের জবাব দিয়েছেন স্বয়ং মুহাম্মদ আয়াতটির উদ্দেশ্য বাখ্যা করার সময়। সেটা এ
রকমঃ “আল্লাহ তা’আলা স্বীয় প্রিয় নবী (সঃ) – এর
সহধর্মিণীদেরকে আদব-কায়দা ও ভদ্রতা শিক্ষা দিচ্ছেন। সমস্ত স্ত্রীলোক তাদের
অধীনস্থ। সুতরাং এই নির্দেশাবলী সমস্ত
মুসলিম নারীর জন্যেই প্রযোজ্য।” (দ্রঃ-
ইবনে কাথিরের তফসির, পঞ্চদশ খণ্ড, পৃ – ৮৭৩ সূত্রঃ http://.IslamiBoi.wordpress.com) ইসলামি পণ্ডিত প্রখ্যাত তফসিরকার ইবনে কাথিরের এই বিবরণ থেকে এটা স্পষ্ট যে হিযাবের বিধান সমস্ত মুসলিম
নারীদের জন্যেই। হিযাবের উদ্দেশ্য কী তা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। সেই উদ্দেশ্য
পূরণের জন্যেই এ আয়াত দু’টিতে নারীকে একেবারে গৃহবন্দি করে পুরুষ সমাজ থেকে পৃথক করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি ঘরের ভিতরেও নারীকে তার স্বাভাবিক, স্বাধীন ও
স্বচ্ছন্দ জীবন-যাপনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। স্বগৃহেও (অবশ্য নারীর নিজের সত্যিকারের গৃহ
বলতে কিছু নেই) নারীকে কাপড়ে অবগুণ্ঠিত হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নারীকে অবগুণ্ঠিত হওয়া থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে কেবল পিতা, পুত্র, ভাইপো, ভাগ্নে, এবং
নারীদের সামনে। বাকি সকলের সামনে নারীকে পর্দায় অবগুণ্ঠিত থাকতে হবে । কোরান এ
প্রসঙ্গে বলছে – “নবী-পত্নিগণের জন্য তাদের পিতৃগণ, পুত্রগণ, ভ্রাতৃগণ,
ভ্রাতুষ্পুত্রগণ, ভগ্নিপুত্রগণ, সেবিকাগণ এবং তাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীগণের
ব্যাপারে পর্দা পালন না করা অপরাধ নয়।” (৩৩/৩৫)
যা নবীপত্নীদের জন্যে আদেশ তা যে সকল মুসলিম নারীর জন্যেই প্রযোয্য, এ কথা
যে মুহাম্মদ বলেছেন তা আগেই উল্লেখ করেছি। মুসলিম নারীকে অবগুণ্ঠনের মধ্যে থাকতে
হবে ঘরের বাইরে এবং ঘরের মধ্যেও – এই হলো হিযাবের মূল নির্দেশ। পুরুষের কারণে
যাতে নারীর হিযাববন্দি জীবনের শৃঙ্খলায় (শিকলে) কোনো ব্যত্যয় না ঘটে তার জন্যে
পুরুষের উপরেও হিযাবের একটি ধারা আরোপ করা হয়েছে। মুসলমান পুরুষদের বলা হয়েছে
পরের ঘরে ঢুকে পরনারীদের কাছে কিছু না চাইতে। অবশ্য এক্ষেত্রেও নবীপত্নীদের দোহাই
দেওয়া হয়েছে। আল্লাহকে দিয়ে মুহাম্মদ তাঁর শিষ্যদের উদ্দেশ্যে বলিয়েছেন, “হে
বিশ্বাসীগণ! তোমাদের অনুমতি দেওয়া না হলে তোমরা আহার্য প্রস্তুতির জন্য অপেক্ষা না
করে ভোজনের জন্য নবী-গৃহে প্রবেশ করো না। তবে তোমাদের ডাকলে – তোমরা প্রবেশ করো,
এবং আহার শেষ হলে চলে যেয়ো। তোমরা কথা-বার্তায় মশগুল হয়ে পড়ো না, কারণ এ নবীর
জন্য কষ্ঠদায়ক; সে তোমাকে উঠে যাবার জন্য বলতে সংকোচ বোধ করে। কিন্তু আল্লাহ সত্য
বলতে সংকোচ করে না। তোমরা তার পত্নীদের নিকট হতে কিছু চাইলে পর্দার আড়াল হতে
চাইবে, এ বিধান তোমাদের ও তাদের হৃদয়ের জন্য অধিকতর পবিত্র। তোমাদের কারও পক্ষে
রসুলকে কষ্ট দেওয়া অথবা তার মৃত্যুর পর তার পত্নীদের বিবাহ করা কখনও সঙ্গত নয়।” (৩৩/৫৩) নিজের পত্নীদের
মানুষের বৃহত্তর সমাজ থেকে
বিচ্ছিন্ন করে গৃহবন্দি ও কাপড়বন্দি করে সম্পূর্ণ তালুবন্দি করতে মুহাম্মদ
তাঁর শিষ্যদের তাঁর গৃহে প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে দ্বিধা করেন নি। যা
যা তাঁর পত্নীদের উপর আরোপ করেছেন সেগুলি পরে সমস্ত মুসলিম নারীদের উপরেও আরোপ
করেছেন। এভাবে হিযাবের নামে নারীকে ঘরে বাইরে সর্বত্রই সম্পূর্ণ বন্দি, অবরুদ্ধ, সম্পূর্ণ পরাধীন ও শৃঙ্খলিত করা
হয়েছে। আর এসবই করা হয়েছে আল্লাহর ওহির দোহাই দিয়ে। প্রত্যেকটি ওহি বা
আয়াতের উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপট (তফসির বা
শানে নুযুল) রয়েছে যা পাওয়া যায় হাদিসে ও কোরানের তফসিরে। অবশ্য হাদিস ও তফসির
নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতও রয়েছে। হিযাবের প্রেক্ষাপট
নিয়েও মতভেদ রয়েছে।
হিযাবের প্রেক্ষাপট নিয়ে যে কথাগুলি শোনা যায় তার
মধ্যে একটি এ রকমঃ - দ্বিতীয় খলিফা ওমর ফারুক যিনি ছিলেম মুহাম্মদের
অতি ঘনিষ্ঠ সাহাবী এবং একজন শ্বশুরও, একদিন মুহাম্মদকে বলেন তাঁর (মুহাম্মদের) ঘরে
যে সব মুসলমানরা ঢোকেন তাদের মধ্যে মন্দ চরিত্রের লোকও থাকতে পারে, তাদের হাত থেকে
নবী-পত্নীদের মান-মর্যাদা রক্ষা করার স্বার্থে তিনি কেনো তাঁদের (নবী-পত্নীদের)
আড়ালে থাকার নির্দেশ প্রদান করছেন না। তারপরই
২৪/৩১ নং আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। অন্য একটি মত হলো – ওমর ফারুকের একদিন মুহাম্মদের
কনিষ্ঠতম ও প্রিয়তম পত্নী আয়েশার সঙ্গে আকষ্মিকভাবে দৈহিক সংস্পর্শ ঘটে এবং
তারজন্যে তিনি ভীষণ লজ্জিত ও বিব্রত বোধ করেন। তারপরেই তিনি মুহাম্মদকে বলেন কেনো
তিনি তাঁর পত্নীদের আড়ালে থাকার নির্দেশ প্রদান করছেন না। এর প্রেক্ষাপটেই হিযাব সংক্রান্ত ওহিগুলো অবতীর্ণ হয়।
হিযাবের আদেশ (তথাকথিত ওহি বা প্রত্যাদেশ) মুসলিম নারীদের উপর চাপানো হয় চতুর্থ হিজরীতে
(৬২৫ খৃস্টাব্দে) অর্থাৎ মুহাম্মদের মদিনায় হিযরত করার চতুর্থ বছরে। মুহাম্মদ ৬১০ খ্রিস্টাব্দে দাবি করেন যে তিনি নবুয়ত
প্রাপ্ত হয়েছেন অর্থাৎ আল্লাহ তাঁকে নবী করে পাঠিয়েছেন। স্বভাবতঃই এ প্রশ্নটি ওঠে যে, মন্দ চরিত্রের লোকদের হাত থেকে নবী-পত্নীদের শ্লীলতা, সতীত্ব ও
মর্যাদার হেফাজত (রক্ষা) করার জন্যে
হিযাবের ওহিগুলি পাঠাতে আল্লাহ এতো বিলম্ব করেছিলো কেনো? তাঁর প্রথম পত্নী
খাদিজার জীবদ্দশায় হিযাবের আদেশ আল্লাহ পাক কেন পাঠায় নি? সে কি এজন্যে যে খাদিজা
ছিলেন একজন মক্কার সবচেয়ে ধনী বণিক, প্রবল প্রভাবশালী ও প্রতাপশালী এবং প্রখর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মহিলা? ইসলামি পণ্ডিত কিংবা মুসলিম
ঐতিহাসিকদের নিকট থেকে এ প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া যায় না। সুতরাং এটা প্রতীয়মান হয়
যে মুসলিম নারীদের উপর হিযাব আরোপ করার অন্য কোনো প্রেক্ষাপট আছে।
ইতিহাস বলে যে মুহাম্মদই প্রথম আল্লাহর কাছ থেকে
প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত হয়ে নারীদের উপর হিযাব চাপিয়েছেন তা নয়। ইসলামের আবির্ভাবের
বহু কাল আগে থেকেই পার্সিয়ানদের সমাজে হিযাবের প্রচলন ছিলো। হিযাবের বিধানটি
মুহাম্মদ পার্সীদের কাছ থেকেই নিয়েছিলেন। আবার নারীদের ঘরের অভ্যন্তরে আবদ্ধ
থাকার কুপ্রথাটিও বাইজান্টাইন সমাজে বিদ্যমান ছিলো প্রাক ইসলাম যুগে।
বাইজান্টাইনের মানুষ সেটা গ্রহণ করেছিলো গ্রীকদের কাছ থেকে। মদিনায় হিযরত করার পর
কয়েক বছরের মধ্যে মুহাম্মদের আরবের বাইরের
জগতের সংস্পর্শে আসার ব্যাপক সুযোগ ঘটে।
তার আগেও অবশ্য বাণিজ্য করার সুবাদে মুহাম্মদকে বেশ কয়েকবার আরবের বাইরে যেতে
হয়েছিলো। এর ফলে আরবের বাইরের বিভিন্ন দেশের মানুষদের সামাজিক ও ধর্মীয়
রীতি-নীতি, আচার-ব্যবহার ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে তিনি আসেন এবং বহু ক্ষেত্রেই
সেগুলির দ্বারা প্রভাবিত হন। যে গুলির দ্বারা তিনি প্রভাবিত হন সেগুলির তিনি
ইসলামিকরণ করেন আল্লাহর দোহাই দিয়ে। হিযাবের সংস্কৃতিও তিনি পার্সী ও
বাইজান্টাইনের থেকে নেন এবং তার ইসলামিকরণ করে মুসলিম সমাজে প্রবর্তন করেন। হিযাব
বাদে আর যে সব পশ্চাদপদ প্রথা ও নিয়ম-কানুন
অন্যদের কাছ থেকে নিয়ে আল্লাহর ওহির নামে মুসলমানদের উপর চাপিয়ে ছিলেন তার
মধ্যে নামাজ, রোজা, হজ, যাকাতও আছে। এগুলির কোনোটাই ইসলামের তথা মুহাম্মদের
আবিষ্কার নয়। খাতনাও (মুসলমানী) সে রকম
একটি ভয়ংকর কুপ্রথা যা মুহাম্মদ গ্রহণ করেন ইহুদিদের নিকট থেকে। খাতনা সম্পর্কে
কয়েকটি কথা বলে এ নিবন্ধটি শেষ করবো। মুসলমানরা মনে করে ছেলেদের খাতনা করার আদেশ
মুহাম্মদ আল্লাহর কাছ থেকে পেয়েছিলেন। তাই তা নিয়ে তাদের গর্বের অন্ত নেই। খাতনা বা ৪/৫ বছরের পুং শিশুদের লিঙ্গের
ত্বকের অগ্রভাগ কেটে ফেলাকে শিশুকে কষ্ট দেওয়া তারা বিজ্ঞানসম্মত বলে বিশ্বাস করে। এর পরিপ্রেক্ষতে তারা বলে আল্লাহ যে একজন মহাবিজ্ঞানী তার একটা বড়ো প্রমাণ নিহিত আছে এই খাতনার মধ্যে। খাতনা প্রথাটা মুসলমানদের কাছে একটা গর্ব ও
অহঙ্কারের বিষয়ও বটে। খাতনা উপলক্ষে তারা জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান করে যার মধ্যে বিশাল ভোজের আয়োজনও থাকে। মুসলমানরা
দাবি করে যে কোরান শুধু একটি ধর্মগ্রন্থই নয়, এটা একটি মহাবিজ্ঞান গ্রন্থও। আর কোরান যে একটি মহাবিজ্ঞান গ্রন্থ তার প্রমাণ
হিসেবে মুসলিমরা এই খাতনার দৃষ্টন্তটির উল্লেখ করে থাকেন। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো খাতনা একটি অবৈজ্ঞানিক ও বর্বর প্রথা যাতে সর্বদায় বিপদের ঝুঁকি থাকে। খাতনার পর কোনো কোনো ক্ষেত্রে
শিশুদের বিপদে পড়তে হয়েছে এমন দৃষ্টান্তও আছে। খাতনা নিয়ে গর্ব ও অহঙ্কার করার
মত হিযাব নিয়েও গোঁড়া মুসলমানরা গর্ব করে। হায় রে! তারা যদি জানতো
যে, হিযাবের পশ্চাদপদ ও কুৎসিত বিধানগুলি
আসমান থেকে আসা কোনো প্রত্যাদেশ নয়, মুহাম্মদ এই বিধানগুলি নিয়েছিলেন পারস্য ও
বাইজান্টাইন থেকে !