Wednesday, July 30, 2014

ভিন্ন স্বর ভিন্ন মঞ্চ


 যে কথাগুলি বলা একান্ত জরুরী, কিন্তু কেউ বলে না, আমরা বলতে চাইআমরা কিছু করতে চাই
একটি আবেদন
বন্ধুগণ,
আমরা কাজ করছি  মুর্শিদাবাদ জেলার  একটি মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে যেখানে পশ্চাদপদতার শ্রীহীন ছাপ  চোখে পড়ে সর্বত্রমুসলিম সমাজের পশ্চাদপদতা সারা পৃথিবী ও সারা দেশজুড়েই , কিন্তু  মুর্শিদাবাদে পশ্চাদপদতা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী প্রকট । এ অঞ্চলে যে হিন্দুরা বাস করেন তাঁদের সিংহভাগই তফশীলি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত । বলা বাহুল্য, তাঁরাও  পশ্চাদপদ ।  ফলতঃ সামগ্রিকভাবে এ অঞ্চলটি  পশ্চাদপদতম অঞ্চলগুলির একটি 
পশ্চাদপদ অঞ্চলের সমাজ  আষ্ঠেপৃষ্ঠে শৃঙ্খলিত থাকে নানা পশ্চাদপদ চিন্তা, কুপ্রথা ও কুসংস্কারের শিকলে  ফলে জন্ম নেয় নানারকম সামাজিক ব্যাধি যা সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রন করে ফলে  উন্নতি, অগ্রগতি ও বিকাশের পথ প্রবলভাবে ব্যাহত হয়আমরা যে অঞ্চলে  কাজ করছি   সেখানে এর অন্যথা হবার কোনো কারণ নেই,  হয়ও নি ।
এ অঞ্চলে যে সামাজিক ব্যধিগুলি এখানকার জনজীবনকে প্রতিদিন কুঁড়ে কুঁড়ে খায় ও তার প্রাণশক্তিকে ক্রমাগত শুঁষে নেয়  সেগুলি হলো বহুবিবাহ,  বাল্যবিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ (তালাক), অনিয়ন্ত্রিত পরিবার, অনিয়ন্ত্রিত জন্মহার, ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় গোঁড়ামি  ইত্যাদি ।  এছাড়াও জুয়া, মদ ও মাতলামির মত ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধিগুলিও রয়েছে জুয়া ও মদ যে  এক সর্বনাশা সামাজিক ব্যাধি তা  বলা বাহুল্য । জুয়া ও  মদের কবলে পড়ে কত পরিবার যে সর্বস্বান্ত হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই । জুয়া ও মদের কারণে মাঝেমধ্যে সামাজিক শৃঙ্খলা ব্যাহত হয়, কখনো কখনো বিশৃঙ্খলা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে ।   
ধর্মান্ধতা মানুষের  চিন্তাভাবনাকে  যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ ও  পশ্চাদমুখী করে   মানুষকে করে তোলে প্রবলভাবে   অদৃষ্টবাদী । অদৃষ্টবাদ  শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয়ে মানুষের সচেতনতা  অর্জনের পথে বাধা সৃষ্টি করে       এবং  সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই  মানুষকে অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবিয়ে রাখে । উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া  দারিদ্রের সঙ্গে এই অজ্ঞতা যুক্ত  হওয়ার ফলে দারিদ্রকেই মানুষ জীবনের ভবিতব্য বলে ভেবে নিয়ে নিজেদের  ভবিষ্যতকে অদৃষ্টের উপর সঁপে  দেয় তাঁদের উপলব্ধির মধ্যে এটা থাকে না যে নিজেদের প্রচেষ্টাতেও  আর্থিক দৈন্যতা অনেকটা লাঘব করা যায়  পরিবার ছোট হলে ও  শিক্ষার্জন করতে পারলে যে দারিদ্রতাকে অনেকাংশে জয় করতে পারে এটা  তাঁদের জ্ঞান ও বোধের মধ্যে নেই
অকাল মৃত্যুর করুণ ছবি  এখানকার সমাজ জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এ ছবি অবশ্য শুধু এখানকারই নয়, গোটা দেশেরই । অকাল মৃত্যুর বড়ো কারণ নিশ্চয় দারিদ্রতা  সরকারের জনস্বার্থের বিপরীত ভাবনা ও পরিকল্পনাও একটা বড়ো কারণ কিন্তু আরো কারণ  আছে  একটি অন্যতম প্রধান কারণ মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনার প্রচন্ড অভাবএখনও  ঝাড়-ফুঁক, মাদুলি-কবজ, ইমাম-পুরোহিত  এবং কালি-পীরের উপর মানুষের আস্থা  এত প্রবলভাবে ক্রীয়াশীল  যা  না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত (অপ)চিকিৎসার এই প্রাচীন পন্থাগুলি  আসলে এক একটা মরণফাঁদ ছাড়া কিছু নয় যা বহুমানুষের অকাল মৃত্যুকে অনিবার্য করে তোলে আত্মীয়-স্বজনের অকাল মৃত্যুর  ব্যাথা ও যন্ত্রণা  কত দুঃসহ হতে পারে তা কল্পনাতীত । সেই যন্ত্রণা ও কষ্ট ভুলতে মানুষ অদৃষ্টের কোলে আশ্রয় নেয়এটা বিধিলিপি,  ঈশ্বরের ধন ঈশ্বর তুলে নিয়েছে বলে মৃতের আত্মীয়-স্বজন শান্তি ও সান্ত্বনা খোঁজেন এবং  তারপর অতি দ্রুত মৃতের আত্মার শান্তির জন্যে ধর্মীয় পারলৌকিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েনএসব কাজে মানুষ যে অর্থ অনর্থক ব্যয় বা অপচয় করে থাকেন তা  সঠিক চিকিৎসায় ব্যয় করলে নিশ্চিতভাবেই অকাল মৃত্যু অনেকটাই রোধ করা সম্ভব
দেশ স্বাধীন হয়েছে প্রায় সাত দশক, কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন বিশেষ হয় নি । দারিদ্রতা কমার চিহ্ন নেই, অপরদিকে সমাজের গুণগত অবস্থার অবনতি ক্রমবর্ধমান । জাতিগত,ধর্মীয় সম্প্রদায়গত ও  ভাষাগত পারষ্পরিক শ্রদ্ধা, সৌহার্দ ও ভালোবাসার জায়গাগুলি ক্রমশঃ সঙ্কীর্ণ থেকে সঙ্কীর্ণতর হচ্ছে । এসব ক্ষেত্রে, বিশেষভাবে ধর্মীয় সম্প্রদায়গতভাবে ক্রমশঃ বৃদ্ধিলাভ করছে পারষ্পরিক অবিশ্বাস, অনৈক্য, বিদ্বেষ, ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা ও হানাহানি ।  মুখে আমরা নারীর স্বাধীনতা ও সমানাধিকারের কথা বলছি, কিন্তু প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে  লিঙ্গবৈষম্য । কী ঘরে কী বাইরে নারীর প্রতি অবিচার, বঞ্চনা ও বৈষম্য এবং  অপমান, অত্যাচার, নির্যাতন ও ধর্ষণ বেড়েই চলেছে ।
দারিদ্রতা বিমোচনে সরকার কিছুই করছেনা তা নয় । কিন্তু যা করছে তা নগণ্য । একাজে শুধু আর্থিক পরিকল্পনা ও কর্মসূচী  গ্রহণ করাই যথেষ্ট নয় । সর্বাগ্রে ও সর্বাধিক প্রয়োজন মানুষের চিন্তাভাবনার জগতের সকল বন্ধ জানালা-দরজাগুলি খুলে দেওয়া । সহস্র বছর ধরে মানুষের চিন্তাজগতে  যে অজ্ঞতা ও পশ্চাদপদ চিন্তা  এবং সামাজিক কুসংস্কার ও কুপ্রথাগুলি জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে রয়েছে সেই পাথরটার অপসারণ সব আগে জরুরী  এই কাজটি করাই সরকারের প্রাথমিক দায়িত্বকিন্তু কোনো সরকারই  সেটা করতে চায় না, বরং উল্টে ধর্মাশ্রিত  পশ্চাদপদ চিন্তা ও প্রথাগুলিকেই উৎসাহ দেয় ।  শুধু সরকার নয়, এ কথা প্রযোজ্য শাসকদল ও বিরোধী  রাজনৈতিক দলগুলির ক্ষেত্রেও ।  রাজনৈতিক দলগুলি সর্বদা সর্বক্ষেত্রেই নিজের দলের স্বার্থকে জনগণের  স্বার্থের উপরে প্রাধান্য দেয় এ দেশে অসংখ্য বেসরকারী সমাজসেবী স্বেচ্ছাসেবা  সংগঠন কাজ করে চলেছে , কিন্তু তাদের ভূমিকাও তদ্রূপ ।  
 দারিদ্রতার অবসান  করতে হলে আগে  মানুষের চিন্তার দৈন্যতার অবসান ঘটানো জরুরী অথচ সেই কাজটি  হচ্ছে অবহেলিত । সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলি কেউ এ কাজটি করছে না, আর করবে বলে মনে হয় নাওঁরা যদি না করে, আমরা, অরাজনীতিক মানুষরা, শুধু সরকারের সমালোচনা করে চুপ করে বসে থাকতে পারি না আমরা আমাদের দায়বদ্ধতাকে অস্বীকার করতে পারি না বা এড়িয়ে যেতে পারি না । এ বোধের দ্বারা চালিত হয়ে  আমরা পশ্চাদপদ মানুষদের পাশে দাঁড়াতে চাই  কাজ আমরা অতীতেও করেছি ‘মিঠিপুরের স্পন্দন’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তুলে । সেই কাজের ধারাবাহিকতায় আমরা এবার নতুন করে গড়ে তুলেছি একটি নতুন মঞ্চ – ‘ভিন্ন স্বর ভিন্ন মঞ্চ’
পশ্চাদপদ মানুষদের পাশে কেন দাঁড়াতে চাই তা অতি সংক্ষেপে আলোচনা করেছি সে কাজে সাফল্য পেতে সব চেয়ে বেশী প্রয়োজন শিক্ষার প্রসার । শিক্ষার আলো ব্যতীত মানুষের অজ্ঞতা, ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের অন্ধকার দূর করার কথা ভাবা বাতুলতা মাত্র । সেই  শিক্ষাই স্বাধীনতার প্রায় সাত দশক পরে আজো রয়ে গেছে গরীব মানুষের কাছে কার্যতঃ অধরা, কারণ শিক্ষাও একটি পণ্য । সব চেয়ে মহার্ঘ্য পণ্য । ফলে শিক্ষা আজো বিত্তহীন ও নিম্নবিত্ত  শ্রেণীর মানুষদের নাগালের বাইরেই রয়ে গেছে । আর অতি দ্রুত লয়ে উচ্চ শিক্ষাও চলে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নাগালের বাইরে চলে গেছে । 
আমরা তাই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে উচ্চ শিক্ষা প্রসারের জন্যে দরিদ্র পরিবারের পাশে তাদের বন্ধু হয়ে দাঁড়াবো বলে স্থির করেছি শিক্ষার ক্ষেত্রে আবার মেয়েদের প্রতি বৈষম্য ও বঞ্চনা অপরিসীম ।  অথচ পরিবার ও সমাজ গঠনে মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার অধিক জরুরী । আমরা তাই প্রথম পর্যায়ে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষালাভের পথে যে আর্থিক ও মানসিক বাধা রয়েছে তা দূর করতে সর্বাধিক প্রয়াস চালাতে চাই । মাধ্যমিক পাশ করার আগেই বহু ছাত্রীর বিয়ে দিয়ে তাদের শিক্ষাজীবনের ইতি করে দেওয়া হয় । যারা মাধ্যমিক পাশ করে তাদের ক্ষেত্রে এ ঘটনার হার আরো বেশী । তার উপরে এ হার আরো অনেক বেশী । ফলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম মেয়েদের প্রায় চোখেই পড়ে না । তফশীলি হিন্দু সমাজের ক্ষেত্রেও অবস্থাটা হতাশাজনক । আমরা এ অবস্থাটার উন্নতির লক্ষ্যে নারীশিক্ষায় অভিবাবকদের অনীহা ও অর্থাভাবের কারণে  সাধারণ পরিবারের মেয়েদের যাতে পড়াশোনা বন্ধ না হয় তারজন্যে আর্থিক সাহায্যের ক্ষুদ্র ডালি নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ মেয়েদের পাশে দাঁড়াতে চাই ।
এখানকার সমাজে আর্থিক ক্ষেত্রে দৈন্যাবস্থা এত প্রকট যে সবাই আধুনিক চিকিৎসা নিতে সক্ষম নয় । তার উপরে আছে চিন্তা-ভাবনার জগতেপ্রবল বন্ধ্যা দশা । তাই মানুষকে হয় ঝাড়-ফুঁক-কবিরাজী-পীড়ান-ওঝা, না হয়  হাতুড়ে ডাক্তারের উপর নির্ভরশীল থাকতে বাধ্য হয় ।  আমরা তাই বছরে তিন-চারটি মেডিকেল ক্যাম্পের ব্যবস্থা করে তাঁদের কাছে বিনামুল্যে চিকিৎসা পরিষেবা কিছুটা হলেও পৌঁছে দিতে চাই । এ উপলক্ষে পাড়ায় পাড়ায় সভা করে স্বাস্থ্য চেতনাও গড়ে তুলতে চাই । ইতিমধ্যেই আমরা দুটি মেডিকেল ক্যাম্প করে এ কাজটি শুরু করেছি ।  
আমাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হলো – একদিকে, এক). বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গঠন, দুই). ধর্মনিরিপেক্ষ সমাজ গঠন এবং  তিন). লিঙ্গনিরপেক্ষ সমাজ গঠন । অপরদিকে আমরা চাই, এক). নারীর স্বাধীনতা, দুই). নারীশিক্ষা, তিন). নারীর সমানাধিকার
আমরা যে কাজ করছি তা রূপায়ণে বিস্তর বাধা । ধর্মীয় গোঁড়ামি ও মতান্ধতার বাধাতো আছেই, তার থেকেও  বড় বাধা অর্থের বাধা ।  এ কাজে অনেক অর্থ প্রয়োজন । যেখানে ও যাঁদের জন্যে কাজ করছি সেখান থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করা অসম্ভব । দূরের বন্ধুদেরও সহযোগীতা তাই আমাদের একান্ত প্রয়োজন ।  আশা করি আমাদের নিকট ও দূরের  শুভাকাঙ্খী  বন্ধুদের কাছ থেকে আর্থিক ও নৈতিক - সমস্ত প্রকার সহযোগিতা পাবো ।   

[বিঃদ্রঃ  সরকারী রেজিষ্ট্রেশন আইনে আটকে যাওয়ায় আমাদের সংগঠনের নামের পরিবর্তন করতে হয়েছে। এখন নাম হয়েছে - 'মিঠিপুরের ভিন্ন স্বর ভিন্ন সমিতি']  







বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাইনি – পাঁচ

  দ্বিতীয় অধ্যায় শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবের প্রতি তীব্র গণরোষের নেপথ্যে ২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে ৩৬ দিন পর (৫ই ...