যে কথাগুলি বলা একান্ত জরুরী, কিন্তু কেউ বলে
না, আমরা বলতে চাই । আমরা কিছু করতে চাই ।
একটি আবেদন
বন্ধুগণ,
আমরা কাজ করছি মুর্শিদাবাদ জেলার একটি মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে যেখানে পশ্চাদপদতার
শ্রীহীন ছাপ চোখে পড়ে সর্বত্র । মুসলিম সমাজের
পশ্চাদপদতা সারা পৃথিবী ও সারা দেশজুড়েই , কিন্তু মুর্শিদাবাদে পশ্চাদপদতা তুলনামূলকভাবে অনেক
বেশী প্রকট । এ অঞ্চলে যে হিন্দুরা বাস করেন তাঁদের সিংহভাগই তফশীলি সম্প্রদায়ের
অন্তর্ভুক্ত । বলা বাহুল্য, তাঁরাও পশ্চাদপদ
। ফলতঃ সামগ্রিকভাবে এ অঞ্চলটি পশ্চাদপদতম অঞ্চলগুলির একটি ।
পশ্চাদপদ অঞ্চলের সমাজ
আষ্ঠেপৃষ্ঠে শৃঙ্খলিত থাকে নানা পশ্চাদপদ
চিন্তা, কুপ্রথা ও কুসংস্কারের শিকলে । ফলে জন্ম নেয় নানারকম সামাজিক ব্যাধি যা সেখানকার
মানুষের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রন করে । ফলে উন্নতি, অগ্রগতি ও বিকাশের
পথ প্রবলভাবে ব্যাহত হয় । আমরা যে অঞ্চলে কাজ
করছি সেখানে এর অন্যথা হবার কোনো কারণ নেই, হয়ও নি ।
এ অঞ্চলে যে সামাজিক
ব্যধিগুলি এখানকার জনজীবনকে প্রতিদিন কুঁড়ে কুঁড়ে খায় ও তার প্রাণশক্তিকে ক্রমাগত শুঁষে
নেয় সেগুলি হলো বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ (তালাক), অনিয়ন্ত্রিত
পরিবার, অনিয়ন্ত্রিত জন্মহার, ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় গোঁড়ামি ইত্যাদি । এছাড়াও জুয়া, মদ ও মাতলামির মত ভয়ঙ্কর সামাজিক
ব্যাধিগুলিও রয়েছে । জুয়া ও মদ যে এক
সর্বনাশা সামাজিক ব্যাধি তা বলা বাহুল্য ।
জুয়া ও মদের কবলে পড়ে কত পরিবার যে
সর্বস্বান্ত হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই । জুয়া ও মদের কারণে মাঝেমধ্যে সামাজিক শৃঙ্খলা
ব্যাহত হয়, কখনো কখনো বিশৃঙ্খলা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে ।
ধর্মান্ধতা মানুষের চিন্তাভাবনাকে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ ও পশ্চাদমুখী করে । মানুষকে করে তোলে প্রবলভাবে অদৃষ্টবাদী ।
অদৃষ্টবাদ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতি প্রভৃতি
বিষয়ে মানুষের সচেতনতা অর্জনের পথে বাধা
সৃষ্টি করে এবং সমাজজীবনের
প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষকে অজ্ঞতার
অন্ধকারে ডুবিয়ে রাখে । উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া দারিদ্রের সঙ্গে এই অজ্ঞতা যুক্ত হওয়ার ফলে দারিদ্রকেই মানুষ জীবনের ভবিতব্য বলে
ভেবে নিয়ে নিজেদের ভবিষ্যতকে অদৃষ্টের উপর
সঁপে দেয় । তাঁদের উপলব্ধির মধ্যে এটা থাকে না যে নিজেদের
প্রচেষ্টাতেও আর্থিক দৈন্যতা অনেকটা লাঘব
করা যায় । পরিবার ছোট হলে
ও শিক্ষার্জন করতে পারলে যে দারিদ্রতাকে
অনেকাংশে জয় করতে পারে এটা তাঁদের জ্ঞান ও
বোধের মধ্যে নেই ।
অকাল মৃত্যুর করুণ ছবি
এখানকার সমাজ জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ
। এ ছবি অবশ্য
শুধু এখানকারই নয়, গোটা দেশেরই । অকাল মৃত্যুর বড়ো কারণ নিশ্চয় দারিদ্রতা । সরকারের জনস্বার্থের বিপরীত ভাবনা ও পরিকল্পনাও
একটা বড়ো কারণ । কিন্তু আরো কারণ আছে । একটি অন্যতম প্রধান কারণ মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনার প্রচন্ড অভাব । এখনও ঝাড়-ফুঁক, মাদুলি-কবজ, ইমাম-পুরোহিত এবং কালি-পীরের উপর মানুষের আস্থা এত প্রবলভাবে ক্রীয়াশীল যা না
দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত । (অপ)চিকিৎসার এই প্রাচীন পন্থাগুলি আসলে এক একটা মরণফাঁদ ছাড়া কিছু নয় যা
বহুমানুষের অকাল মৃত্যুকে অনিবার্য করে তোলে । আত্মীয়-স্বজনের অকাল মৃত্যুর ব্যাথা ও যন্ত্রণা কত দুঃসহ হতে পারে তা কল্পনাতীত । সেই যন্ত্রণা
ও কষ্ট ভুলতে মানুষ অদৃষ্টের কোলে আশ্রয় নেয় । এটা বিধিলিপি, ঈশ্বরের ধন ঈশ্বর তুলে নিয়েছে বলে মৃতের
আত্মীয়-স্বজন শান্তি ও সান্ত্বনা খোঁজেন এবং তারপর অতি দ্রুত মৃতের আত্মার শান্তির জন্যে ধর্মীয়
পারলৌকিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন । এসব কাজে মানুষ যে অর্থ অনর্থক ব্যয় বা অপচয় করে
থাকেন তা সঠিক চিকিৎসায় ব্যয় করলে
নিশ্চিতভাবেই অকাল মৃত্যু অনেকটাই রোধ করা সম্ভব ।
দেশ স্বাধীন হয়েছে প্রায় সাত দশক, কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন বিশেষ হয় নি ।
দারিদ্রতা কমার চিহ্ন নেই, অপরদিকে সমাজের গুণগত অবস্থার অবনতি ক্রমবর্ধমান ।
জাতিগত,ধর্মীয় সম্প্রদায়গত ও ভাষাগত
পারষ্পরিক শ্রদ্ধা, সৌহার্দ ও ভালোবাসার জায়গাগুলি ক্রমশঃ সঙ্কীর্ণ থেকে
সঙ্কীর্ণতর হচ্ছে । এসব ক্ষেত্রে, বিশেষভাবে ধর্মীয় সম্প্রদায়গতভাবে ক্রমশঃ
বৃদ্ধিলাভ করছে পারষ্পরিক অবিশ্বাস, অনৈক্য, বিদ্বেষ, ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা ও হানাহানি
। মুখে আমরা নারীর স্বাধীনতা ও
সমানাধিকারের কথা বলছি, কিন্তু প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে লিঙ্গবৈষম্য । কী ঘরে কী বাইরে নারীর প্রতি
অবিচার, বঞ্চনা ও বৈষম্য এবং অপমান,
অত্যাচার, নির্যাতন ও ধর্ষণ বেড়েই চলেছে ।
দারিদ্রতা বিমোচনে সরকার কিছুই করছেনা তা নয় । কিন্তু যা করছে তা নগণ্য ।
একাজে শুধু আর্থিক পরিকল্পনা ও কর্মসূচী গ্রহণ
করাই যথেষ্ট নয় । সর্বাগ্রে ও সর্বাধিক প্রয়োজন মানুষের চিন্তাভাবনার জগতের সকল
বন্ধ জানালা-দরজাগুলি খুলে দেওয়া । সহস্র বছর ধরে মানুষের চিন্তাজগতে যে অজ্ঞতা ও পশ্চাদপদ চিন্তা এবং সামাজিক কুসংস্কার ও কুপ্রথাগুলি জগদ্দল
পাথরের মতো চেপে বসে রয়েছে সেই পাথরটার অপসারণ সব আগে জরুরী । এই কাজটি করাই সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব । কিন্তু কোনো সরকারই সেটা করতে চায় না, বরং
উল্টে ধর্মাশ্রিত পশ্চাদপদ চিন্তা ও
প্রথাগুলিকেই উৎসাহ দেয় । শুধু সরকার নয়,
এ কথা প্রযোজ্য শাসকদল ও বিরোধী রাজনৈতিক
দলগুলির ক্ষেত্রেও । রাজনৈতিক দলগুলি
সর্বদা সর্বক্ষেত্রেই নিজের দলের স্বার্থকে জনগণের স্বার্থের উপরে প্রাধান্য দেয় । এ দেশে অসংখ্য বেসরকারী সমাজসেবী
স্বেচ্ছাসেবা সংগঠন কাজ করে চলেছে , কিন্তু
তাদের ভূমিকাও তদ্রূপ ।
দারিদ্রতার অবসান করতে হলে আগে মানুষের চিন্তার দৈন্যতার অবসান ঘটানো জরুরী । অথচ সেই কাজটি হচ্ছে অবহেলিত । সরকার বা রাজনৈতিক
দলগুলি কেউ এ কাজটি করছে না, আর করবে বলে মনে হয় না । ওঁরা যদি না করে, আমরা, অরাজনীতিক
মানুষরা, শুধু সরকারের সমালোচনা করে চুপ করে বসে থাকতে পারি না । আমরা আমাদের দায়বদ্ধতাকে অস্বীকার করতে পারি না বা
এড়িয়ে যেতে পারি না । এ বোধের দ্বারা চালিত হয়ে আমরা পশ্চাদপদ মানুষদের পাশে দাঁড়াতে চাই । এ কাজ আমরা
অতীতেও করেছি ‘মিঠিপুরের স্পন্দন’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন
গড়ে তুলে । সেই কাজের ধারাবাহিকতায় আমরা এবার নতুন করে গড়ে তুলেছি একটি নতুন মঞ্চ –
‘ভিন্ন স্বর ভিন্ন মঞ্চ’ ।
পশ্চাদপদ মানুষদের পাশে কেন দাঁড়াতে চাই তা অতি সংক্ষেপে আলোচনা করেছি । সে কাজে সাফল্য পেতে সব চেয়ে বেশী প্রয়োজন শিক্ষার
প্রসার । শিক্ষার আলো ব্যতীত মানুষের অজ্ঞতা, ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের অন্ধকার
দূর করার কথা ভাবা বাতুলতা মাত্র । সেই শিক্ষাই
স্বাধীনতার প্রায় সাত দশক পরে আজো রয়ে গেছে গরীব মানুষের কাছে কার্যতঃ অধরা, কারণ
শিক্ষাও একটি পণ্য । সব চেয়ে মহার্ঘ্য পণ্য । ফলে শিক্ষা আজো বিত্তহীন ও
নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষদের নাগালের
বাইরেই রয়ে গেছে । আর অতি দ্রুত লয়ে উচ্চ শিক্ষাও চলে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর
নাগালের বাইরে চলে গেছে ।
আমরা তাই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে উচ্চ শিক্ষা প্রসারের জন্যে দরিদ্র পরিবারের
পাশে তাদের বন্ধু হয়ে দাঁড়াবো বলে স্থির করেছি । শিক্ষার ক্ষেত্রে আবার মেয়েদের প্রতি বৈষম্য ও বঞ্চনা অপরিসীম । অথচ
পরিবার ও সমাজ গঠনে মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার অধিক জরুরী । আমরা তাই প্রথম
পর্যায়ে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষালাভের পথে যে আর্থিক ও মানসিক বাধা রয়েছে তা দূর করতে
সর্বাধিক প্রয়াস চালাতে চাই । মাধ্যমিক পাশ করার আগেই বহু ছাত্রীর বিয়ে দিয়ে তাদের
শিক্ষাজীবনের ইতি করে দেওয়া হয় । যারা মাধ্যমিক পাশ করে তাদের ক্ষেত্রে এ ঘটনার
হার আরো বেশী । তার উপরে এ হার আরো অনেক বেশী । ফলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম
মেয়েদের প্রায় চোখেই পড়ে না । তফশীলি হিন্দু সমাজের ক্ষেত্রেও অবস্থাটা হতাশাজনক ।
আমরা এ অবস্থাটার উন্নতির লক্ষ্যে নারীশিক্ষায় অভিবাবকদের অনীহা ও অর্থাভাবের
কারণে সাধারণ পরিবারের মেয়েদের যাতে
পড়াশোনা বন্ধ না হয় তারজন্যে আর্থিক সাহায্যের ক্ষুদ্র ডালি নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ
মাধ্যমিক উত্তীর্ণ মেয়েদের পাশে দাঁড়াতে চাই ।
এখানকার সমাজে আর্থিক ক্ষেত্রে দৈন্যাবস্থা এত প্রকট যে সবাই আধুনিক
চিকিৎসা নিতে সক্ষম নয় । তার উপরে আছে চিন্তা-ভাবনার জগতেপ্রবল বন্ধ্যা দশা । তাই মানুষকে
হয় ঝাড়-ফুঁক-কবিরাজী-পীড়ান-ওঝা, না হয় হাতুড়ে ডাক্তারের উপর নির্ভরশীল থাকতে বাধ্য হয়
। আমরা তাই বছরে তিন-চারটি মেডিকেল
ক্যাম্পের ব্যবস্থা করে তাঁদের কাছে বিনামুল্যে চিকিৎসা পরিষেবা কিছুটা হলেও পৌঁছে
দিতে চাই । এ উপলক্ষে পাড়ায় পাড়ায় সভা করে স্বাস্থ্য চেতনাও গড়ে তুলতে চাই ।
ইতিমধ্যেই আমরা দুটি মেডিকেল ক্যাম্প করে এ কাজটি শুরু করেছি ।
আমাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হলো – একদিকে, এক). বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গঠন, দুই).
ধর্মনিরিপেক্ষ সমাজ গঠন এবং তিন).
লিঙ্গনিরপেক্ষ সমাজ গঠন । অপরদিকে আমরা চাই, এক). নারীর স্বাধীনতা, দুই). নারীশিক্ষা, তিন). নারীর সমানাধিকার।
আমরা যে কাজ করছি তা রূপায়ণে বিস্তর বাধা । ধর্মীয় গোঁড়ামি ও মতান্ধতার
বাধাতো আছেই, তার থেকেও বড় বাধা অর্থের বাধা
। এ কাজে অনেক অর্থ প্রয়োজন । যেখানে ও
যাঁদের জন্যে কাজ করছি সেখান থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করা অসম্ভব । দূরের
বন্ধুদেরও সহযোগীতা তাই আমাদের একান্ত প্রয়োজন । আশা করি আমাদের নিকট ও দূরের শুভাকাঙ্খী
বন্ধুদের কাছ থেকে আর্থিক ও নৈতিক - সমস্ত প্রকার সহযোগিতা পাবো ।
[বিঃদ্রঃ সরকারী রেজিষ্ট্রেশন আইনে আটকে যাওয়ায় আমাদের সংগঠনের নামের পরিবর্তন করতে হয়েছে। এখন নাম হয়েছে - 'মিঠিপুরের ভিন্ন স্বর ভিন্ন সমিতি']
[বিঃদ্রঃ সরকারী রেজিষ্ট্রেশন আইনে আটকে যাওয়ায় আমাদের সংগঠনের নামের পরিবর্তন করতে হয়েছে। এখন নাম হয়েছে - 'মিঠিপুরের ভিন্ন স্বর ভিন্ন সমিতি']