কোটা সংস্কারের আন্দোলনের প্রথম পর্বে যা দেখেছি ও বুঝেছি –
বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়েছিলো সরকারী চাকুরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত বছর জুলাই মাসে। এই আন্দোলনের একটা অতীত রয়েছে। এটা প্রথম শুরু হয় ২০১৮ সালে। সেই আন্দোলন এতই তীব্র রূপ নিয়েছিলো যে শেখ হাসিনা, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, মাথা নত করতে বাধ্য হন আন্দোলনের কাছে। সমস্ত কোটা বাতিল করে দেন। কিন্তু সেটা তার নিছকই একটা কৌশল ছিলো মাত্র। পরে তিনি তাঁর কুক্ষিগত আদালতের রায়ের সাহায্যে গত বছর জুলাই মাসে পুরনো কোটা (৫৪% সংরক্ষিত) ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন করেন। এর বিরুদ্ধেই এবং কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে। সেই আন্দোলনে পথে নেমে আসে প্রায় গোটা ছাত্র সমাজ নিজেদের মত পথ ও দর্শনের ভিন্নতা ভুলে বা পাশে সরিয়ে রেখে কারণ, মেধার ভিত্তিতে চাকরির দাবি ছিলো সমগ্র ছাত্র সমাজের প্রাণের দাবি, মনের দাবি। ফলে আন্দোলনে হাজারে হাজারে শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে আসে এবং আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। বলা বাহুল্য যে সেই আন্দোলনে শামিল হয় জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ‘ছাত্র শিবির’ এর শিক্ষার্থীরাও। সেটাই তো স্বাভাবিক ছিলো, কারণ চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার বলি ছিলো তারাও সমানভাবে ও শোচনীয়ভাবেই। এ রকম একটা ছাত্র আন্দোলনে যার মূল দাবি ছিলো সরকারী চাকরিতে চলতে থাকা দীর্ঘদিনের ভয়ংকর রকমের বৈষম্যের অবসান ঘটানো তার মধ্যে বা পেছনে কট্টর ইসলামী দলগুলোর ষড়যন্ত্র থাকতে পারে এমন প্রশ্ন সত্যি কথা বলতে কী আমার মগজেই আসেনি।
হাসিনা সরকারের উপেক্ষা ও অনমনীয়নতার কারণে কোটা সংস্কার আন্দোলন ক্রমশ তীব্রতর ও দীর্ঘতর হয়েছে। আন্দোলনে সামিল হয়েছে দলে দলে সমানে নারী শিক্ষার্থীরাও। স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা মাথায় বেঁধে দেশাত্মবোধক বাংলা কবিতা ও গান গেয়ে তারা রাজপথ কাঁপিয়েছে। গেয়েছে সমস্বরে ‘মরা গাঙে বান এসেছে জয় মা বলে ভাসা তরী’, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙে ফেল কররে লোপাট’, এ রকম অসংখ্য বিদ্রোহের কবিতা ও গান। আন্দোলনের সর্বাঙ্গে ছিলো চোখে পড়ার মতন স্বতঃস্ফূর্ততার ছাপ। মুসলিম জঙ্গি সংগঠনগুলোর দ্বারা তৈরি করা কোনো পরিকল্পনা বা ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের আন্দোলন হলে আন্দোলনের মধ্যে এমন স্বতঃস্ফূর্ততা তৈরি হওয়া সম্ভব ছিলো না। এটাও সম্ভব হতো না যে সবাই মুখে মুখে বাংলা ভাষায় লেখা দেশপ্রেম ও বিদ্রোহের গান গাইবে। মুসলিম জঙ্গি সংগঠনগুলো আন্দোলনের পেছন থেকে কলকাঠি নাড়বে সেটা কেউই বুঝতে না পেরে হিন্দু বৌদ্ধ পাহাড়ি আদিবাসী ও অগোঁড়া মুসলিম ছাত্রছাত্রীরা সবাই দলে দলে অংশ নেবে তাই বা কী করে সম্ভব? এটাও বা কি করে সম্ভব যে গোটা আন্দোলনে গোঁড়া কট্ট্রপন্থী ছাত্ররা পরিকল্পনামাফিক ‘বিসমিল্লাহের রহামানের রাহিম’ লেখা ও জোড়া তরবারি খচিত কালো ইসলামি পতাকাগুলো প্রদর্শন করবে না?
এক পর্যায়ে শেখ হাসিনা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে জামায়াতে ইসলামীপন্থী ছাত্রদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শবিরোধী বলে দেগে দেন। এমনকি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের গায়ে রাজাকার তকমাও অবলীলায় সেঁটে দেন। সঙ্গে সঙ্গে হাসিনার তল্পিবাহক মিডিয়াগুলো এবং চটিচাটা বুদ্ধিজীবীরাও দলবদ্ধভাবে তাদের রাজাকার বলে কটাক্ষ করতে ও তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতে শুরু করে। উদ্দেশ্য ছিলো আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করে আন্দোলনকে ছত্রভঙ্গ করা। সে সময় ভারতের মিডিয়া ও সমাজমাধ্যমও সমানে গলা চড়িয়েছিলো একই সুরে। হাসিনার সুরে সুর মিলিয়ে তারাও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পেছনে জামায়াতে ইসলামির ষড়যন্ত্র দেখেছিলো। হাসিনার সরকার ও হাসিনাপন্থী মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীকূল তখন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একটা শ্লোগানের খণ্ডিতাংশকে পরিকল্পিতভাবে ব্যাপক হারে ব্যবহার করেছিলো। হাসিনা যখন শিক্ষার্থীদের রাজাকারের নাতিপুঁতি বলে কটাক্ষ করেন এবং তাদের আন্দোলনের যৌক্তিকতা ও ন্যায্যতাকে অস্বীকার করেন তখন শিক্ষার্থীরা সাথে সাথেই সেই কটাক্ষকে ফিরিয়ে দেন তীব্র শ্লেষ ও ব্যাঙ্গাত্মকভাবে পাল্টা শ্লোগান দিয়ে। তারা কণ্ঠস্বরকে আরও বহুগুণ তীব্র ও তীক্ষ করে আওয়াজ তোলে ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার; কে বলেছে কে বলেছে, হাসিনা সরকার; তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার; কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বোরাচার। ইত্যাদি। তাদের এই শ্লোগানের পটভূমি চেপে গিয়ে এবং গোটা শ্লোগানের একটা অংশ কেটে নিয়ে হাসিনা সরকারের মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবীরা প্রচার করে শুধু ‘...তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’। ভারতের মিডিয়া ও সমাজমাধ্যমও সেই প্রচারে সামিল হয় সমান তালে।
সেই প্রচারের প্রাবল্যে আমার মনেও খটকা লেগেছিলো প্রথমে। সেটা স্থায়ী হয় নি। বাংলাদেশের সমাজমাধ্যম পুরো শ্লোগানটি এবং শ্লোগানের পটভূমি সামনে নিয়ে এসেছিলো তড়িৎ গতিতে। ফলে খটকা কেটে গিয়েছিলো অচিরেই। (ক্রমশ .... )
No comments:
Post a Comment