Friday, June 25, 2021

নবীর অশেষ যন্ত্রণাময় মৃত্যু ও তাঁর শবদেহের অশেষ লাঞ্ছনা

মসজিদে নববী: মহানবী (সা.)-এর সব কাজ-কর্মের প্রাণকেন্দ্র

মসজিদে নববী, ২০১২ সালের ছবি

মুহাম্মদ নিজেই বলেছিলেন তিনিই আল্লাহর প্রেরিত সর্বশ্রেষ্ঠ ও শেষ নবী, আল্লাহ পৃথিবীতে আর কখনও কোনো নবী পাঠাবে না। অথচ সর্বশ্রেষ্ঠ ও শেষ নবীকেই কিনা মৃত্যুর আগে পনেরো দিন ধরে ভোগ করতে হয়েছিলো সীমাহীন যন্ত্রণা ও কষ্ট যা অন্য কোনো নবীকে ভোগ করতে হয় নি!  আল্লাহর শেষ নবীরে মৃত্যু কীভাবে হয়েছিলো তাও নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। শুধু এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় যে কোনো যুদ্ধে কিংবা গুপ্তঘাতকের আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয় নি। অর্থাৎ তাঁর মৃত্যু ছিলো একটা স্বাভাবিক ঘটনা। সুতরাং এটাও সন্দেহাতীত যে তাঁর মৃত্যু হয়েছিলো হয় কোনো অসুখে কিংবা অন্য কোনো কারণে। এ বিষয়ে তিনটি মত শোনা যায় বিভিন্ন সূত্র থেকে থেকে। একটি মত হলো বিষক্রিয়ায় তাঁর মৃত্যু হয়। দ্বিতীয় মতটি হলো সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। এবং তৃতীয় মতটি হলো ম্যানেনজাইটিস রোগে তিনি মারা যান।

নবীর অশেষ মৃত্যুযন্ত্রণা

প্রথম অভিমতঃ  বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর  প্রসঙ্গে -

বিষক্রিয়ায় মৃত্যু নিয়ে দু’টি ঘটনার কথা শোনা যায়। প্রথম ঘটনাটি হলো এ রকম – ৬২৮ খৃস্টাব্দে মৃত্যুর চার বছর আগে খায়বার যুদ্ধ শেষে মদিনায় ফিরে আসার আগে সেখানকার একজন সম্ভ্রান্ত ইহুদী নারী, সাললাম বিন মিশকান এর স্ত্রী যয়নাব বিনতে আল-হারিথ, তাঁর বাড়িতে নবীকে খাবার দাওয়াত (নিমন্ত্রণ) দেন। সেই দাওয়াত তিনি কবুল (স্বীকার) করেন এবং তাঁর বাড়ি যান। তাঁর সঙ্গে ছিলো বিশর বিন আল-বারা নামের জনৈক একজন সাহাবী। সেই নারী তাঁদের খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দেন। মুহাম্মদ এক গ্রাস খাবার মুখে দিয়েই বুঝতে পারেন যে খাবার বিষ মিশানো আছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই মুখের খাবারটুকু ফেলে দেন এবং বিশর বিন আল-বারাকে বলেন, থাম, খাওয়া থামাও, খাবারে বিষ আছে। কিন্তু বিশর তৎক্ষণে এক গ্রাস খাবার খেয়ে ফেলেছে। ফলে বিশর তৎক্ষণাৎ মারা যায়। মুহাম্মদের শরীরেও ততক্ষণে বিষক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু যেহেতু খাদ্যটুকু গলাধঃকরণ করেন নি তাই সে যাত্রা তিনি মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। মুসলিম ঐতিহাসিকরা অনেকেই বিশ্বাস করে সেই বিষক্রিয়ার জেরেই চার বছর পর তাঁর মৃত্যু হয়েছিলো। এ প্রসঙ্গে ড. ওসমান গণী লিখেছেন,

·         “খায়বারে তাঁকে এক ইহুদিনী নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানোর সময় খাদ্যে বিষ মিশিয়ে দেন। খাদ্যবস্তু মুখে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তা বুঝে ফেলে দিয়েছিলেন তবুও সামান্য জের তাঁর শরীরে থেকে গিয়েছিল। প্রথমে জ্বর ও মাথাব্যথা আরম্ভ হয়েছিল। তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর কাজ ঠিক নিয়মমাফিক করে যেতে থাকেন। তিনি আজ নিজেও অনুমান করে নিয়েছেন – তাঁর শেষ সময় আগত-প্রায়।” (মহানবী, পৃঃ-৩৮০)

যদি ধরে নেওয়া যায় খায়বারে  নবীর খাবারে বিষ মেশানোর  ঘটনাটা সত্যি তবে, এটাও সত্যি যে তাঁর শরীরে যে বিষক্রিয়া হয়েছিলো তা ছিলো অতিশয় নগণ্য। কারণ, সেই বিষক্রিয়ায় তখন তাঁর মৃত্যু হয় নি। সেই ঘটনাটি ঘটেছিলো ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু তাঁর মৃত্যু হয় ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে। অর্থাৎ খায়বারে বিষযুক্ত খাবার মুখে দেওয়া এবং মৃত্যুর মধ্যে ব্যবধান ছিলো চার বছর। বিজ্ঞানের আলোকে মুহাম্মদের মৃত্যুর কারণ বিচার করলে এটা কখনই যুক্তিগ্রাহ্য ও বিশ্বাসযোগ্য হয় না যে খায়বারে মুহাম্মদের শরীরে অতিশয় নগণ্য যে বিষক্রিয়া হয়েছিলো তাতেই নবীর মৃত্যু হয়েছিলো।

দ্বিতীয় ঘটনাটি হলো, নবী  যখন মৃত্যুর আগে কয়েকদিনের জ্বরে অসুস্থ হয়ে তীব্র মাথা যন্ত্রণায় অসহ্য কষ্ট পাচ্ছেন তখন তাঁর স্ত্রী মাইমুনা তাঁকে জ্বর ও মাথা যন্ত্রণার উপশম করার জন্যে একটি ওষুধ তৈরি করে খাওয়ান। ওষুধ তৈরি করা সময় তিনি তাতে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিলেন। সেই ওষুধ খেয়েই তাঁর মৃত্যু হয়েছিলো। কিন্তু অধিকাংশ ঐতিহাসিক এই অভিমতটিকে মনগড়া বলে নস্যাৎ করে দেন। তবে ইতিহাসকাররা স্বীকার করেছেন যে মুহাম্মদের জন্যে মাইমুনার নিজের হাতে ওষুধ তৈরি করে দিয়েছিলেন এবং সেই ওষুধ মুহাম্মদকে খাওয়ানোও হয়েছিলো। এ প্রসঙ্গে ইতিহাসে যে ঘটনার কথা শোনা যায় তা নিম্নরূপঃ 

·         প্রবল জ্বরে ও অসহ্য মাথা যন্ত্রণায় মুহাম্মদ খুবই কষ্ট পাচ্ছিলেন। সেই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে মাঝে মাঝেই তিনি মাগো বাবাগো, আর সহ্য হচ্ছে না বলে চিৎকার করতেন। মাঝে মাঝেই আবার কখনও মোটা সুতা দিয়ে কখনো কাপড় দিয়ে মাথা কষে বাঁধতেন। মাঝে মাঝেই তিনি  জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন, আবার কিছুক্ষণ পরই তাঁর জ্ঞান ফিরে আসতো।  জ্ঞান ফিরলে আবার তীব্র মাথা যন্ত্রণায় চিৎকার ও ছটফট করতেন। মৃত্যুর সময় এ রকম  অসহ্য তীব্র কষ্টের মধ্যে তাঁর পনেরো দিন অতিবাহিত হয়েছিলো। সে সময় সাহাবীরা সব সময়েই কেউ না কেউ তাঁর পাশে থাকতেন। একদিন আয়েশার ঘরে (সেখানেই মুহাম্মদের শেষ পনেরো দিন্ অতিবাহিত হয়েছিলো) তাঁর স্ত্রীরা সবাই উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন বেশ কয়েকজন সাহাবীও যাদের মধ্যে তাঁর চাচা আব্বাস বিন মোত্তালেবও ছিলেন। মুহাম্মদের স্ত্রী মাইমুনা তখন মুহাম্মদের অন্যান্য স্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করার সময় বলেন যে তিনি একটি ওষুধ তৈরি করতে জানেন যেটা খাওয়ালে জ্বর ও মাথাব্যথা সেরে যাবে। মুহাম্মদের স্ত্রীদের মধ্যে এটা নিয়ে যে আলোচনাটা হচ্ছিল সেটা আব্বাস শুনতে পান। তিনি মাইমুনাকে বলেন ওষুধটা তৈরি করতে। মাইমুনা তখন বলেন যে ওষুধটা খুবই তেতো তাই তিনি খেতে চান না। আব্বাস বলেন তুমি তৈরি করো আমি খাইয়ে দেবো। মাইমুনা ওষুধটা তৈরি করে আব্বাসের হাতে তুলে দেন। সে সময় নবীর জ্ঞান ছিলো না। আব্বাস সহজেই ওষুধটা নবীর মুখে ঢেলে দেন। নবীর জ্ঞান ফিরলে বুঝতে পারেন যে তাঁকে ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। তখন ভীষণ রাগান্বিত হয়ে চিৎকার করে জানতে চান কে তাঁকে ওষুধ খাইয়েছে। আব্বাস তৎক্ষণাৎ তার দায় নেন। তাতেও তিনি শান্ত হন না। ঐ ওষুধটা আবার তৈরি করে তাঁর স্ত্রীদের তাঁর সামনেই পান করার নির্দেশ দেন। মাইমুনা ওষুধটা তৈরি করেন এবং নবীর স্ত্রীরা নবীর সামনে সেটা পান করেন। কিন্তু ওষুধ খাওয়ার পর সকল স্ত্রীরাই সুস্থ ছিলেন। মুহাম্মদ বুঝতে পারেন যে তাঁর ওষুধে বিষ মেশানো হয়েছিলো বলে তাঁর যে সন্দেহ হয়েছিলো সেটা অমূলক।               

দ্বিতীয় অভিমতঃ  সিফিলিস অসুখে মৃত্যু প্রসঙ্গে -

যারা বলে সিফিলিস রোগে নবীর মৃত্যু হয় তাদের যুক্তি হলো এ রকম। এটি ছোঁয়াচে রোগ এবং মূলত যৌন রোগ যেটা মানুষের দেহে বাসা বাঁধে প্রধানত যৌন সংসর্গের কারণে। সিফিলিস রোগে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির সঙ্গে মুখের ভিতর জিহ্বা সঞ্চালনের মাধ্যমে শারিরীক সম্পর্ক স্থাপন করলেও রোগটা ছড়িয়ে থাকে। সমকামীদের মধ্যেও তাই রোগটি ছড়াতে পারে। ফলে নারী ও পুরুষ উভয়েই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

যারা বলেন যে নবী সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তাদের বক্তব্য হলো এরূপঃ নবী বহুগামী ছিলেন এবং বিবাহ বহির্ভূত বহু নারীর সঙ্গে যৌন সংসর্গ করতেন। আরবে সেই সময় যতখুশী উপপত্নী ও দাসী রাখা এবং তাদের সঙ্গে অবাধে সঙ্গম করা ছিলো প্রচলিত বৈধ রীতি। নবী  নিজেকে আল্লাহর রসুল বলে দাবি করলেও সেই কুৎসিত সংস্কৃতি ও প্রথা বাতিল করেন নি। বরং সেই  সেগুলিকে আল্লাহর দোহাই দিয়ে বহাল রেখে তার ভিতকে আরও দৃঢ় করেছিলেন। তাই তাঁর শরীরে সিফিলিস রোগের বাসা বাঁধার যথেষ্ট আশঙ্কা ছিলো। তখন আরবে সিফিলিস ছিলো একটি দূরারোগ্য ব্যাধি এবং তাই অবশেষে ঐ রোগেই তাঁর জীবনাসান ঘটে। কিন্তু সিফিলিস রোগ হলে শরীরে তার নানা উপসর্গ প্রকাশ পায় যা নবীর মধ্যে পরিলক্ষিত হয় নি। সিফিলিসে আক্রান্ত মানুষের মধ্যে দুর্বলতা দেখা দেয়, শরীরের কিছু অঙ্গ-প্রতঙ্গ অবশ বা অসাড় হতে থাকে। ফলে একটা সময় সিফিলিস রোগীর কর্মক্ষমতা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু নবীর মধ্যে এগুলোর কোনোটারই প্রকাশ পরিলক্ষিত হয় নি। মৃত্যুর কিছুদিন আগে পর্যন্তও তিনি শারিরীকভাবে সক্ষম ছিলেন। সুতরাং সিফিলিসে নবীর মৃত্যু হওয়াটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।   

 প্রিয় নবীজির বাড়ি (ভিডিও) | Home of Prophet Muhammad in Mecca | Islamic  Light - YouTube

তৃতীয় অভিমতঃ  ম্যানেনজাইটিসে মৃত্যু প্রসঙ্গে -  

ম্যানেনজাইটিস রোগে নবী মারা যান বলে একদল ঐতিহাসিকের অভিমত। মানব শরীরের নানা অঙ্গে ইনফেকশন বা সংক্রমণ হয়। ইনফেকশন হয় যেমন লিভার, ফুসফুস, কিডনি ইত্যাদি শরীরে, তেমনি হয় মস্তিষ্কেও। মস্তিষ্কে ইনফেকশন হলে যে রোগটা হয় সেটা ম্যানেনজাইটিস রোগ যেটা একটা অন্যতম মারণ রোগ। মুহাম্মদের সময়ে আরবে এই রোগের ওষুধ ছিলো না। মৃত্যুর আগে ম্যানেনজাইটিস রোগের উপসর্গগুলি মুহাম্মদের শরীরে ফুটে উঠেছিল। যেমন তাঁর প্রবল জ্বর হয়েছিলো এবং তার সঙ্গে ছিলো সহ্য মাথা যন্ত্রণা। প্রবল জ্বর ও মাথা যন্ত্রণা হেতু মাঝে মাঝেই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলেন। কিছুক্ষণ পরপর জ্ঞান হারাচ্ছিলেন এবং জ্ঞান ফিরে আসছিলো। তীব্র মাথা যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন, মাগো বাবাগো বলে চিৎকার করছিলেন মাঝে মধ্যে, কখনও মাথায় কষে কাপড়ের ফেটি বাঁধছিলেন। মাঝে মধ্যে প্রলাপও বকছিলেন। এগুলো ম্যানেনজাইটিস রোগের উপসর্গ। আরবে এই রোগটার মাঝে মধ্যেই প্রদুর্ভাবও হয়। আরবে এই রোগের মহামারীও হয়েছে বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। সুতরাং ম্যানেনজাইটিস রোগেই মুহাম্মদের মৃত্যু হয়েছে বলে যে কথাটি শোনা যায় সেটাই বিজ্ঞান সম্মত ও সঠিক বলে মনে হয়।

নবীর মৃতদেহের অশেষ লাঞ্ছণা ও দুর্ভোগ

শুধু অশেষ শারিরীক মৃত্যুযন্ত্রণাই নয় নবীকে ভোগ করতে হয়েছে তাঁর মৃত্যুশয্যায় অশেষ মানসিক যন্ত্রণাও। নবী যখন বুঝেছিলেন যে মৃত্যু তাঁর শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছে এবং কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁর শেষ নিশ্বাস বেরিয়ে যাবে তখন তাঁর সাহাবীদের কিছু অছিয়ত করে যেতে চেয়েছিলেন বা কিছু নির্দেশ দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সেজন্যে তাঁর সাহাবিদের কাগজ ও কলম নিয়ে তাঁর পাশে এসে বসতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি কল্পনাও করতে পারেন নি যে তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর সাহাবিরা তাঁর নির্দেশ অমান্য বা অগ্রাহ্য করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে সেটাই ঘটেছিলো। তিনি যখন কাগজ ও কলম নিয়ে তাঁর পাশে কোনো একজনকে বসার নির্দেশ দেন তখন তাঁর আজ্ঞা পালনের ব্যাপারে তীব্র মতভেদ দেখা দেয়। উপস্থিত সাহাবিদের মধ্যে একদল দ্রুত সেই নির্দেশ পালনে তৎপর হয়ে ওঠেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই প্রবল আপত্তি করে অন্য একটা দল। দ্বিতীয় পক্ষের নেতা ছিলেন দ্বিতীয় খলিফা ওমর বিন খাত্তাব। তিনি যুক্তি প্রদর্শন করেন যে নবী প্রলাপ বকছেন মাঝে মধ্যে, এ রকম পরিস্থিতিতে যা বলবেন তা তাঁর হয়তো মস্তিষ্ক-প্রসূত ও যথেষ্ট বিবেচনা-প্রসূত হবে না। তেমন কোনো অছিয়ত দিয়ে যদি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তবে ইসলাম ও সমগ্র মানবমণ্ডলী দিকভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট হবে। আপাতদৃষ্টিতে ওমরের কথাগুলি উপেক্ষণীয় নয়। কিন্তু নবী তখন সজ্ঞানেই ছিলেন এবং প্রলাপ বকছিলেন না। ফলে ওমরের কথার প্রতিবাদ করে প্রথম দল। কিন্তু দুই দলের মধ্যে প্রবল বাদানুবাদ শুরু হয়ে যায় নবীর সামনেই। নবী তা দেখে যারপরনাই বিরক্তি ও ক্রোধে ফেটে পড়ে সবাইকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে নির্দেশ দেন। নবী যে তখন অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছিলেন না এবং সম্পূর্ণ সজ্ঞানেই ছিলেন সেটা ওমর বোঝেন নি তা নয়। নবীর তবুও সর্বশেষ অছিয়ত দেওয়া আটকে দেন সচেতনভাবেই যার পশ্চাতে গভীর পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্য নিহিত ছিলো যা স্পষ্ট হয়ে যায় নবীর মৃত্যুর পরের ঘটনাবলীতে। 


Real and inside tomb of Prophet Muhammad - YouTube

You Tube

Uploaded by: Hassi S Thanongsak # HBM, Nov 23, 2018

 

অবশেষে দিন পনেরো পর ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ৮ই জুন সোমবার নবীর অশেষ মৃত্যু যন্ত্রণার অবসান হয়। সঙ্গে সঙ্গেই সাহাবিদের মধ্যে ক্ষমতা দখলের ন্যক্কারজনক রাজনীতি শুরু হয়। এটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার অবকাশ এখানে নেই। নবীর চাচা ও চাচাতো ভাই তথা জামাতা আলি ও কতিপয় সাহাবি নবীর শবদেহ আগলে বসে থাকেন একদিকে, অপরদিকে ক্ষমতা দখলের কুৎসিত খেলায় মত্ত হয়ে ওঠে অন্যান্য সাহাবিরা। নবীর শবদেহ ফেলে রেখে এই কুৎসিত খেলায় মেতে উঠেছিলেন নবীর যে প্রিয় সাহাবিরা তাদের মধ্যে ছিলেন আবুবকর ও ওমর এবং অপর পক্ষে ছিলেন মদিনার সেই সাহাবিরা যাঁরা মুহাম্মদকে আশ্রয় ও নিরাপত্তা দিয়ে নবী হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিলেন। দুই পক্ষই বাকবিতণ্ডা ও বচসায় জড়িয়ে পড়েছিলো নবীর উত্তরাধিকারি তথা প্রথম খলিফা হওয়ার জন্যে। তিন দিন ধরে সাহাবিদের মধ্যে সেই ঝগড়া অব্যাহত চলার পর অবশেষে আবুবকর প্রথম খলিফা নির্বাচিত হন। তারপর নবীকে সমাধিস্থ করা হয়। সাহাবিদের ঝগড়া গড়িয়েছিলো নবীর মৃতদেহের জানাযা নামাজ পর্যন্ত। ফলে নবীকে কবরস্থ করা হয় জানাযা নামায ব্যতিরকেই। ঝগড়া গড়িয়েছিলো নবীকে কবর কোথায় হবে তা নিয়েও। খুবই দুঃখজনক ঘটনা হলো নবীকে সমাধিস্থ করার আগে তাঁর শবদেহে পচন শুরু হয়ে গিয়েছিলো এবং দেহ থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল।নবীর মৃতদেহের এহেন অপমান ও লাঞ্ছনা বোধ হয় সারা বিশ্বে নজিরবিহীন।

 

উপসংহার

উপসংহারে রয়েছে পর্যবেক্ষণ, প্রধ্ন ও মন্তব্য এই তিনটি জিনিষ। পর্যবেক্ষণ মূলত ওমর ও আবুবকরের ভূমিকা নিয়ে। আগেই আলোচনা করা হয়েছে যে তিন দিন ধরে তীব্র কলহ, বাক-বিতণ্ডা ও বচসার শেষে আবুবকর প্রথম খলিফা নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে আবুবকরের নাম প্রথম খলিফা হিসাবে প্রস্তাব করেছিলেন ওমর। আবার আবুবকর খলিফার ক্ষমতা ও প্রভাবকে ব্যবহার করে ওমরকে দ্বিতীয় খলিফা মনোনীত করে যান। এই ঘটনার সঙ্গে পরবর্তীকালের দুটি ঘটনার যোগসূত্র থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ঘটনা দুটি হলো - এক) মৃত্যুর আগে নবী সাহাবীদের উদ্দেশ্যে যে অছিয়ত করে যেতে চেয়েছিলেন সেটা ওমরের ভেস্তে দেওয়া। দুই) নবীর মৃতদেহের সৎকার না করেই খলিফা পদটি কব্জা করার জন্যে দৃষ্টিকটূভাবে আবুবকর ও ওমরের অন্যান্য সাহাবিদের সঙ্গে তীব্র কলহে লিপ্ত হয়ে পড়া। প্রথম ঘটনটি প্রমাণ করে যে প্রথম খলিফা হবার জন্যে আবুবকরের তীব্র লালসা ছিলো। আবুবকরের হাত ধরে দ্বিতীয় খলিফা হয়েছিলেন ওমর। দ্বিতীয় এই ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে খলিফা হবার জন্যে ওমরেরও তীব্র লালসা ছিলো। ওমরের ধারণা ছিলো যে নবী মৃত্যুকালীন অছিয়তে কাউকে তাঁর উত্তরাধিকারি ঠিক করে দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে নবী যদি তাঁর বংশধর বলে আলিকে উত্তরাধিকারি ঠিক করে দিতেন যার সম্ভাবনা ছিলো প্রবল তবে, আবুবকর ও ওমর দুজনের কারোরই খলিফা হওয়ার লালসা ও সাধ জীবনে পূর্ণ হতো না। কারণ, আলি তাঁদের দুজনের থেকেই ছিলেন অনেক ছোট। তাই তাঁদের নিজেদের খলিফা হওয়ার পথ খোলা রাখার জন্যে নবীর অছিয়ত দেওয়া বাঞ্চাল করে  দেওয়াটা তাঁদের কাছে একান্তই অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলো। সেজন্যেই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা মাফিকই অজুহাত খাড়া করে নবীর অছিয়ত দেওয়াটা আটকে দিয়েছিলেন ওমর এবং নীরব থেকে তাঁর পক্ষ নিয়েছিলেন আবুবকর। একই উদ্দেশ্যে নবীর মৃতদেহ সৎকার করার আগেই তাঁরা দু’জন প্রথম খলিফা ঠিক করার জন্যে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ে পড়েন। আগে নবীর মৃতদেহ সৎকার করে পরে যদি আলোচনার মাধ্যমে নবীর উত্তরাধিকার ও প্রথম খলিফা নির্বাচন করা হতো তবে সেক্ষেত্রে তাঁদের খলিফা হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো খুবই ক্ষীণ। সেজন্যেই আবুবকর ও ওমর নবীর মৃতদেহ আয়েশার ঘরে ফেলে রেখেই তড়ি-ঘড়ি প্রথম খলিফা নির্বাচনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।  

মুহাম্মদ নিজেই জানিয়েছেন যে আল্লাহ অগুণতি নবী পাঠিয়েছে যাদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ এবং শেষ নবী। তিনি আরও জানিয়ে গেছেন যে তিনিই ছিলেন আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় এবং আল্লাহও তাঁর প্রতি ছিলো অতিশয় সহানুভূতিশীল, দয়ালু ও স্নেহশীল। তাঁর এ সব দাবিগুলি আপাতদৃষ্টিতে অতিরঞ্জিত বলে মনে হয় না। কারণ, কোরানে এরূপ বহু ঘটনা দেখতে পাওয়য়া যায় যে নবী যখন যা চেয়েছেন বা কামনা করেছেন আল্লাহ তৎক্ষণাৎ তা পূরণ করে দিয়েছে অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে। দুটো উদাহরণ দেওয়া যাক। নবী তাঁর পালক পুত্র জায়েদের স্ত্রী অসামান্য সুন্দরী জয়নবকে কামনা করেছিলেন। আল্লাহ সেটা বুঝতে পেরে জয়নবের সঙ্গে তাঁর (নবীর) বিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিলেন বেহেশতে। নবী আবুবকরের ছ’বছরের শিশু কন্যা আয়েশাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। আবুবকর তাতে সঙ্গত কারণেই রাজী হন নি। কিন্তু স্বয়ং আল্লাহুই উদ্যোগী হয়ে আয়েশার সঙ্গে নবীর বিয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কোরানে এ রকম আরও বহু উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায় যা বিশ্বাসীদেরকেও যুগপৎ বিষ্মিত করে ও ভাবিয়ে তোলে।  তারা মন থেকে মেনে নিতে পারে না তাদের নবীর এই হীন কাজগুলি। এবং তাদের বিশ্বাস হয় না যে নবীর এহেন অন্যায় কামনাগুলি আল্লাহর ইচ্ছায় সম্পন্ন হয়েছে। তাদের এই অবিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়  নবীর মৃত্যুশয্যায় অসহ্য যন্ত্রণা  ও কষ্টের কথা জানার পর। তাদের সন্দেহ ও সংশয় তাই দানা বাঁধতে শুরু করে নবীর নবীত্ব নিয়েও। কারণ তারা বিশ্বাস করতে পারে না যে আল্লাহ তার কোনো নবীকে এতো  যন্ত্রণাময় মৃত্যু উপহার দিতে পারে যা একটা অত্যন্ত কঠিন শাস্তির সমতুল্য। আর তারা এটাও বিশ্বাস করতে পারে না যে আল্লাহ নীরব থাকতে পারে কোনো নবীর লাশ তিন দিন ধরে অপমানিত ও লাঞ্চিত হচ্ছে দেখেও। তাই তাদের মনে এই ধারণাও প্রবল হয় যে হয় নবী বোধ হয় আল্লাহর দোহাই দিয়ে আবুবকর ও জায়েদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।  

তথ্য সূত্রঃ ড. ওসমান গণীর মুহাম্মদের জীবনী - মহানবী, মুহাম্মদের মৃত্যুর পর আরবের রাজনীতি - ১, আলোচনায় অমিয় হাসান, মুফতি আল-মাসুদ ও রিক্তা,  সঞ্চালক - রুমি, ইউ টিউব, নবী জীবনের শেষ দু'সপ্তাহের গল্প, নিসিক্ত, ইউ টিউব

Friday, June 18, 2021

২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনে বাংলার রায় কি সত্যিই সুচিন্তিত?

এবারের (২০২১) বিধানসভা নির্বাচনে বাংলার রায় সবার সব হিসাব, আন্দাজ, সমীক্ষাকে ভুল প্রমাণ করেছে। শাসকদলের ক্ষমতায় নিয়ে সংশয়ে ছিলো। বিজেপি ২০০-র বেশী আসন নিয়ে সরকার তৈরি করবে আশা ভেবেছিলো। বাম ও কংগ্রেস নেতারা টিএমসি ও বিজেপির বিকল্প হতে পারবে আশা করেছিলো। কিন্তু শাসকদল পেয়েছে বিপুল সাফল্য। দু’শোর বেশী দূর অস্ত বিজেপির আটকে গেছে মাত্র সাতাত্তরে। বাম-কংগ্রেস একটিও আসন পায় নি তাদের অস্তিত্বের সংকটকে গভীরতর করেছে। অকল্পনীয় এই রায়ে সংবাদ মাধ্যমগুলি বাংলার রায়ের বন্দনায় মেতে উঠেছে। সমস্বরে বলছে, বাংলার মানুষ এবার  দারুণ একটা সুচিন্তিত রায় দিয়েছে। বাংলার জনগণ রায়  কতটা সুচিন্তিত সেটাই এই নিবন্ধের মূল আলোচনা।       

বিজেপি আপাতত পরাস্ত বটে, কিন্তু হিন্দুত্বের রাজনীতি নয়

এবারের নির্বাচনী ফলাফলের একটাই ইতিবাচক দিক চোখে পড়ছে। সেটা হলো বিজেপিকে হারানো গেছে। কিন্তু এর বাইরে যা আছে তার সবই নেতিবাচক যা অন্তত বাংলার পক্ষে যথেষ্ট চিন্তার। ফলে এই রায়ে উল্লসিত হওয়ার মতন কিছু দেখছি না। প্রথমে ধরা যাক বিজেপির ব্যাপারটা। 

 After 9 years, Modi-Shah together in running govt | Deccan Herald

বিজেপি ৭৭টি আসন পেয়েছে যা মোট আসনের প্রায় একচতুর্থাংশ। গত লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় তো ভীষণই কম। কারণ গত লোকসভা নির্বাচনে ১২১টি বিধানসভা কেন্দ্রে তারা এগিয়েছিলো। স্বভাবতই এই ফল বিজেপির জন্যে খুব খারাপ। বলা বাহুল্য যে ওদের পক্ষে যেটা খারাপ ধর্মনিরপেক্ষ বাংলার পক্ষে সেটা অবশ্যই ভাল। কিন্তু এই ফলাফল যে বিজেপির বিপদ থেকে আমাদের চিন্তামুক্ত করেছে তা বলা যাচ্ছে না। বরং এটাই বাস্তব যে বিপদটা আমাদের ঘাড়ে চেপে বসেই রয়েছে। কারণ, প্রথমত, ওরা সংখ্যায় অনেক আসন (বিধায়ক) কম পেলেও জনসমর্থন ওদের তেমন কমে নি। ভোট পেয়েছে ৩৮.০৯% যা গত লোকসভা ভোটের চেয়ে মাত্র ২.৫% কম। দ্বিতীয়ত, গত বিধানসভা ভোটের চেয়ে প্রাপ্ত ভোট বেড়েছে ২৭% (৩৮.০৯%-১১%) এবং আসন (বিধায়ক) সংখ্যা বেড়েছে ৭৪টি (৭৭-৩) যা ২৮ গুণ বেশী। তৃতীয়ত, তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির প্রাপ্ত মোট ভোট ৮৬% (৪৭.৯% + ৩৮.০৯%) যা প্রমাণ করে বিজেপির ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি বিশাল সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এবং চতুর্থত, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে যাদের উপর কিছুটা হলেও আমরা ভরসা করি সেই বাম ও কংগ্রেসের এবারের বিধানসভায় অনুপস্থিতি। শাসকদল যে বিজেপির বিপদ থেকে বাংলাকে বাঁচাতে পারবে না তা পরিক্ষীত সত্য। সুতরাং এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, শাসকদল বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরলেও বিজেপির বিপদ একটুও কমে নি, বরং বেড়েছে বাম ও কংগ্রেস একটা আসনও না পাওয়ায়।      

তোমাকে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে – এই প্রবাদকে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যখন দেখি যে, আমাদের চোখের আড়ালে গোটা রাজ্যব্যাপী সঙ্ঘপরিবার হিন্দুত্বের আদর্শ প্রচারের কাজ ক্রমশ বাড়িয়ে যাচ্ছে তাদের নানা সংগঠন, সেবামূলক সংগঠন ও স্কুলের মাধ্যমে। তাদের সেই কাজ ভবিষ্যতেও অবাধে চলতে থাকবে বিজেপি ভোটে হারলেও। কারণ, ওদের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত লড়াই চালানোর প্রধান দায়িত্ব যে শাসকদলের তারা তা অতীতে করে নি, ভবিষ্যতেও করবে না। কারণ, শাসকদল তো এটা প্রমাণ করতেই ব্যস্ত যে হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষায় বিজেপির চেয়ে তারা কিছু কম যায় না। এভাবেই শাসকদল বিজেপির উগ্র হিন্দুত্বকে পাল্টা নরম হিন্দুত্ব দিয়ে মোকাবেলা করতে চায়। উগ্র হিন্দুত্বকে যে নরম হিন্দুত্ব দিয়ে মোকাবেলা করা যায় না তা গত দশ বছরে প্রমাণিত। তার ফল হয়েছে এই যে, দীর্ঘ বামফ্রণ্ট জামানায় বিজেপি এ রাজ্যে বিধানসভায় ঢুকতেই পারে নি, আর তাদের প্রাপ্ত ভোট ছিলো মাত্র ৪% (চার শতাংশ)। সেই বিজেপি এখন বিধানসভায় ৭৭টি বিধায়ক নিয়ে একমাত্র বিরোধী দল এবং প্রাপ্ত ভোট ৩৮%। অর্থাৎ তৃণমূল কংগ্রেসের জমানায় তাদের জনসমর্থন, সংগঠন ও শক্তি বৃদ্ধিলাভ করেছে ঝড়ের গতিতে। এই শক্তির জোরেই বিজেপি সভাপতি বিধানসভায় তৃণমূল কংগেস সরকারের চোখের ঘুম কেড়ে নেবার হুমকি দিতে পারছে। 

বাংলার রায়ে পশ্চিমবঙ্গে বহুদলীয় ব্যবস্থা বিপন্ন

বিজেপিকে বাড়তে সাহায্য করেছে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের নগ্ন মোল্লাতন্ত্র তোষণ নীতি এবং   বিজেপির উগ্র হিন্দুত্বের রাজনীতির মোকাবেলায় তাদের নরম হিন্দুত্বের রাজনীতি। অন্যদিকে বিজেপি  যেমন নগ্নভাবে ধর্মের নামে হিন্দুদের সংগঠিত করার চেষ্টা করেছে, তৃণমূল কংগ্রেসও তেমনি তার পাল্টা ধর্মের তাস খেলেছে মুসলিমদের সংগঠিত করার জন্যে। তারই ফলশ্রুতিতে বাংলার মানুষ এবার ধর্মের ভিত্তিতে দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। একদিকে হিন্দুদের ব্যাপক অংশ হিন্দু হিসেবেই বিজেপিকে ভোট দিয়েছে, অন্যদিকে মুসলিমরা প্রায় সবাই মুসলিম হিসেবেই ভোট দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসকে। ফলশ্রুতিতে কংগ্রেস ও বামেদের অনুগামীরাও ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে গিয়ে একদল ছাপ মেরেছে পদ্মফুলে এবং আর একদল ঘাসফুলে। তারই নিট ফল বাম ও কংগ্রেস শূন্যতে নেমে গিয়েছে। ফলে আপাতত হলেও এ রাজ্যে বহুদলীয় সংসদীয় শাসনব্যবস্থার অপমৃত্যু ঘটেছে এবং তার জায়গা নিয়েছে দ্বিদলীয় সংসদীয় শাসনব্যবস্থা। এ যে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার জন্যে ঘোর অশনি সংকেত তা বলা বাহুল্য।

বিধানসভায় কংগ্রেস ও বামফ্রণ্টের শূন্যতায় তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ও বিজেপি উভয়েই খুশি। খুশি  কম্যুনিস্ট বিরোধী মূল ধারার সংবাদ মাধ্যমগুলিও। কারণ, তারা তো এটাই চেয়েছিলো। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে শাসকদল ও বিজেপি ছাড়া তারা সংযুক্ত মোর্চাকে তারা তো খুঁজেই পায় নি। তবে শাসকদলের চেয়ে বেশি খুশি হয়েছে বিজেপি। কারণ তারা তো বিলক্ষণ জানে যে এ রাজ্যে তাদের প্রধান  শত্রু বামপন্থী ও কংগ্রেসই।   

  বাংলার অন্ধকার দিকগুলো অন্ধকারেই থেকে গেল

তৃণমূল সুপ্রিমো বদলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে সরকার তৈরি করেছিলো। কিন্তু বিগত দশ বছরে সেই প্রতিশ্রুতি পালন করার কোনো প্রয়াসই চোখে পড়ে নি। ফলে বাম জমানায় স্বচ্ছ ও ন্যায় প্রশাসন দেওয়ার ক্ষেত্রে যে অবক্ষয় শুরু হয়েছিলো তার বৃত্তটা সম্পূর্ণ হয়েছে তৃণমূল জমানায়। প্রশাসনে দলতন্ত্র, দুর্নীতি, স্বজনপোষণ জাঁকিয়ে বসেছে। পুলিশ ও আমলারা পরিণত হয়েছে দলদাসে। তারা জনগণকে  নিরাপত্তা দেবে কি নিজেরাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ফলে দুর্নীতির জাল ও চক্র সর্বত্র ডালপালা ছড়িয়েছে। এরই পরিণতি হলো নারদা কেলেঙ্কারি, শারদা কেলেঙ্কারি, আমফান কেলেঙ্কারি, গরু পাচার, কয়লা পাচার, বালি পাচার, কাটমানি, সিণ্ডিকেট রাজ ইত্যাদি দুর্গন্ধযুক্ত শব্দবন্ধগুলি শাসকদলের অঙ্গের ভূষণে পরিণত হয়েছে। 

দলতন্ত্র ও দুর্নীতির অভিঘাতে বিপর্যস্ত শিক্ষাব্যবস্থা। কার্যত বেহালাবস্থা স্বাস্থ্যব্যবস্থাতেও। এসব নিয়ে বিশদে বলার পরিসর নেই। যেটুকু বলতেই হয় তা হলো, প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল শিক্ষাকেন্দ্র রক্তাল্পতায় ভুগছে। হবেই তো, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ যে প্রায় বন্ধ। সামান্য যেটুকু নিয়োগের চেষ্টা হয়েছে তাতে স্বচ্ছতার লেশ মাত্র নেই। ফলে আদালতে কয়েকটি মেধা তালিকা ঝুলে রয়েছে। সরকারি হাসপাতালে দালাল চক্র বাম জমানার চেয়েও বেশি জাঁকিয়ে বসেছে। জনগণ যেখানে বহুক্ষেত্রে বেডের অভাবে চিকিৎসা পাচ্ছে না কিছু স্বাস্থ্যকর্তা সেখানে কুকুরের ডায়ালিসিস করার দুঃসাহস দেখিয়েও পার পেয়ে যায়। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে টিএমসি সরকারের কিছু ইতিবাচক কাজ নিশ্চয় আছে, কিন্তু দুর্নীতি ও দলতন্ত্রের দাপটে সেগুলো ঢাকা পড়ে গিয়েছে।

এ রাজ্যে পশু কেনাবেচার মতন মানুষ কেনাবেচার ব্যবসা চলছে। বিধায়ক/সাংসদরা অবলীলায় বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। বিক্রি হচ্ছে জেলা পরিষদ ও পৌরসভার আস্ত বোর্ডটাই। কিনছে শাসকদল, বিক্রি হচ্ছে বিরোধী দলের জনপ্রতিনিধিরা। বিধানসভা ভোটের আগে বিধায়ক/সাংসদ কেনার বাজারে টিএমসিকে টেক্কা দিয়েছে তার চেয়েও বড় সওদাগর, বিজেপি। আগেও বিধায়ক/সাংসদরা দল বদলাতো। তবে দল বদলালে বিধায়ক/সাংসদ পদ থেকে পদত্যাগ করতো। এই নৈতিকতাটুকুও এখন আর নেই। যে জনপ্রতিনিধিরা তাদের বিক্রি করে তারা একদিকে বিশ্বাসঘাতকতা করে জনগণের সঙ্গে, আর অন্যদিকে করে যে দলের টিকিটে নির্বাচিত হয়েছিল সেই দলের সঙ্গে। জনপ্রতিনিধি কেনাবেচার এই জঘন্য কুসংস্কৃতি বাংলাকে কলঙ্কিত করেছে যার স্রষ্টা টিএমসি।   

তৃণমূল জমানায় সবচেয়ে বেশি শোচনীয় অবস্থা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে। সরকারি/আধা সরকারি অফিসে শূন্য পদে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রায় বন্ধ। এদিকে বন্ধ হয়েছে বিগত দশ বছরে বহু কলকারখানা,  শিল্পক্ষেত্রেও বিনিয়োগ নেই। ফলে কাজের সন্ধানে অন্য রাজ্যে ছুটছে বাংলার শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা, ছুটছে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা। বাংলার যুব সমাজের ভবিষ্যত ক্রমশ অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে।   

উপরে আলোচিত গুরুতর অভিযোগ ও সমস্যাগুলি বাংলার জ্বলন্ত সমস্যা। কিন্তু বাংলার মানুষ সেগুলি পেছনে ঠেলে দিয়ে বেছে নিল দু’টি শ্লোগান – ‘ফ্যাসিবাদী বিজেপিকে আটকাও’ আর ‘মুসলিম তোষণকারী দিদিকে পাল্টাও’। ব্যাস, মানুষ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল – ৪৮% মানুষ ভোট দিল বিজেপিকে আটকাতে, আর ৩৯% মানুষ ভোট দিল দিদিকে পাল্টাতে। ফলে বিজেপি আটকে গেল আর টিএমসি আবার নবান্নের দখল নিল।

 প্রশ্ন হলো,  বাংলার মেয়ের হাতে বাংলা কি সুরক্ষিত?


বিজেপির ক্ষমতায় যাওয়া আটকে দেওয়াটা কিন্তু আসল কথা নয়, আসল কথা হলো বিজেপির বিপদ থেকে বাংলাকে রক্ষা করা। এটা শোনা যাচ্ছে যে তৃণমূল কংগেসই সে কাজটা পারবে। কারণ তারাই বিজেপিকে হারিয়েছে। কিন্তু একটি গভীরে গিয়ে দেখলে এটা স্পষ্টতই বোঝা যায় যে বিজেপিকে হারিয়েছে বাংলার জনগণ, তৃণমূল কংগেস নয়। উপরে আলোচনায় আমরা দেখিয়েছি যে তৃণমূল কংগ্রেস কেন বিজেপির বিপদ থেকে বাংলাকে রক্ষা করতে পারবে না।

বিজেপির বিপদ ছাড়া আরও অনেক বিপদ নিয়ে আমরা ঘর করছি। তার মধ্যে রয়েছে পাহাড় প্রমাণ সর্বগ্রাসী দুর্নীতি। রেশনে, ত্রাণে, নিয়োগে, একশ’ দিনের কাজে, সরকারি অর্থে গৃহ নির্মাণ ইত্যাদি সমস্ত প্রকল্পই দুর্নীতির কবলে পর্যুসস্ত। তার সঙ্গে রয়েছে প্রশাসনে নগ্ন দলতন্ত্র, গরু পাচার, কয়লা পাচার, তোলাবাজি, সিণ্ডিকেটের সীমাহীন দাপট। এগুলির হাত থেকে কি বাংলা যে সুরক্ষিত নয় তা নিয়ে তর্কের জায়গা নেই। তাছাড়া রয়েছে শিল্পক্ষত্রে বন্ধ্যাদশা, শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য, হাসপাতালের বেহাল অবস্থা, আকাশ ছোঁয়া বেকারত্ব প্রভৃতি অসংখ্য ইস্যু। নারদা-শারদা কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত যারা, এবং শিক্ষায়-স্বাস্থ্যে-শিল্পে-বাণিজ্যে চূড়ান্ত ব্যর্থ যারা তাদের নিয়েই তো নতুন সরকার পথ চলা শুরু করেছে। তাই ভরসা পায় না যে নতুন সরকার বাংলা যে তিমিরে ছিল সেখান থেকে টেনে তুলতে পারবে।   

বাংলার রায় আপাতত হলেও বহুদলীয় সংসদীয় ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করে ভয়ংকর আঘাত করেছে বাংলার গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার উপর। বাংলার রায় কষে সিলমোহর লাগিয়ে দিল শাসকদলের গোয়েবলসীয় সেই দাবিকেই যে দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, দলতন্ত্র, অনুয়ন্নয়ন, বেকারত্ব প্রভৃতি জ্বলন্ত সমস্যাগুলি বিরোধিদের তোলা অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও সর্বৈব মিথ্যা। উল্টে বাংলার রায় তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের সেই দাবিতেই সিলমোহর বসিয়ে দিলো যে বাংলায় উন্নয়ন চলছে তরতরিয়ে যা আগে কোথাও, কখনও হয় নি।         

সুতরাং বাংলার এবার কতটা সুচিন্তিত সে প্রশ্ন কিন্তু রয়েই গেল। এর উত্তর নিহিত রয়েছে অনাগত ভবিষ্যতের গর্ভে। সেটা জানার জন্যে আমাদের এখন অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।

 

১০.০৬.২১

Wednesday, June 2, 2021

আব্বাস সিদ্দিকীর দলের সঙ্গে জোট করে সিপিএম ধর্মনিরপেক্ষ নীতির লঙ্ঘন করে নি

 

এবারের (২০২১) বিধানসভা নির্বাচনে কং-বাম-আইএসএফ জোট নিয়ে সর্বত্র ব্যাপক চর্চা হচ্ছে। এটা শুরু হয় জোট গড়ার প্রস্তুতি পর্বে। জোট তথা সংযুক্ত মোর্চা গঠন করার পর চর্চার তীব্রতা অনেকটা বাড়ে। সেটা আকাশচুম্বী হয় নির্বাচনে সংযুক্ত মোর্চার ভরাডুবি হলে। 

চর্চা বা সমালোচনার অভিমুখ মূলত একটিই 

জোট গঠনের প্রস্তুতি পর্বেই চর্চা বা আলোচনার একটা নির্দিষ্ট অভিমুখ পরিলক্ষিত হয়। অভিমুখটি মূলত ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র বিরুদ্ধে। তাদের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ হলো তারা কম্যুনিস্ট পার্টির ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বিসর্জন দিয়ে একটি ইসলামী মৌলবাদী দলের সঙ্গে জোট করেছে। নীতিগত এই সমালোচনা যদি সঠিক বল ধরা হয় তবে এটা প্রাপ্য ছিলো কংগ্রেস দলেরও। কিন্তু সমালোচনায় বিদ্ধ করা হচ্ছে শুধু সিপিআই (এম)-কেই। এই সমালোচনার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। তা হলো, সমালোচকদের মধ্যে মূলত প্রাধান্য রয়েছে তাদেরই যারা সিপিআই (এম)-এর ঘোরতর বিরোধী। এই গোত্রের সমালোচকরা মনে করে যে কম্যুনিস্ট পার্টি হিসেবে সিপিআই (এম)-এর  কোনো বিশ্বাসযোগ্যতাই আর অবশিষ্ট নেই। তাদের একপেশে ও নেতিবাচক সমালোচনায় আমার মনে যুগপৎ বিষ্ময় ও একটা প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রশ্নটি হলো, যারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে সিপিআই (এম) আদৌ আর কম্যুনিস্ট পার্টি নেই, তারা সিপিআই (এম)-এর ‘নীতিচ্যুত’ হওয়া নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছে কেন? অথচ তারা শুধু মাথাই ঘামাচ্ছে না, দলটাকে তারা লাগাতার ছিঁড়ে খাচ্ছে। তাদের সিপিআই (এম) – এর পেছনে জোঁকের মতন এই লেগে থাকা বিষ্ময়কর বৈকি! এই গোত্রের সমালোচকরা সবাই যে কম্যুনিস্টবিদ্বেষী তা কিন্তু নয়, তাদের মধ্যে একদল আছে যারা বামপন্থায় বিশ্বাসী। যারা মনে করে সিপিআই (এম) আদৌ আর কম্যুনিস্ট পার্টি নেই তাদের এই দলের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে এত কথা বলার অর্থ কী তা আমাদের বোধগম্য হয় না।   

আইএসএফের সঙ্গে জোট নিয়ে সিপিআই (এম)-এর ভিতরেও অনেকেরই প্রশ্ন ও অসন্তোষ আছে। প্রশ্ন আছে দলের সমর্থক ও শুভান্যুধায়ীদের মধ্যেও। ফলে ঘরে ও বাইরে সর্বত্রই তাই দলের নেতৃত্বকে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে। এর আগে জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী না করা, সোমনাথ চ্যাটার্জীকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করা এবং পরমাণু চুক্তির প্রশ্নে ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করার প্রশ্নেও দলের ভিতরে ও বাইরে প্রবল সমালোচনা সামাল দিতে হয়েছিলো সিপিএমকে। সেই ইস্যুগুলি ছিলো সবটাই জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। আর এবার দলের রাজ্য নেতৃত্বকে ঘরে ও বাইরে নীতিগত প্রশ্নে যেভাবে কঠোর সমালোচনায় বিদ্ধ হতে হচ্ছে। এটা বোধ হয় অতীতে কখনো হয় নি, একেবারেই নজিরবিহীন ঘটনা।

  যত জ্বালা সব পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকীকে নিয়ে

দলের ভিতরে ও বাইরে সিপিআই (এম)-কে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করা নিয়েও এর আগে কম প্রশ্ন ও সমালোচনার মুখে পড়তে হয়নি। সে প্রশ্ন ও সমালোচনা এবারও রয়েছে। কিন্তু এটা এবার পেছনে চলে গেছে, বরং বলা যায় যে চাপা পড়ে গেছে। সবকিছু ছাপিয়ে সামনে উঠে এসেছে আব্বাস সিদ্দিকী ও তাঁর দল আইএসএফ ইস্যুটি। ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচন থেকেই সিপিআই (এম)-এর জনসমর্থন হ্রাস পাচ্ছে। এবারও সেটারই হয়েছে পুনরাবৃত্তি। কিন্তু এবার এর জন্যে মূলত দায়ী করা হচ্ছে সিপিআই (এম)-কে আইএসএফকে জোটে অন্তর্ভুক্ত করার নীতি ও পদক্ষেপকে। শুধু ভোটই কমে নি, বামফ্রণ্ট ও কংগ্রেসও যে নির্বাচনে এবার একটি আসনও পায় নি। তারজন্যেও মূলত দায়ী করা হচ্ছে সিপিআই (এম)-কে এবং সেই জোট নীতিকে। দায় চাপানোর ভঙ্গিটি এমনই যে আইএসএফকে জোটে না নিলে কংগ্রেস ও বামফ্রণ্টের ফল যেন ভালো হতো। কোন যুক্তিতে বা কোন তথ্যের ভিত্তিতে এমনটা বলা হচ্ছে ওরা জানায় নি। বামফ্রণ্টের শরীক দলগুলিও নির্বাচনে ভরাডুবির জন্যে দায়ী করছে আইএসএফের সঙ্গে জোটকে। তাদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে যে আইএসএফকে নিয়ে সংযুক্ত মোর্চা গঠনে যেন তাদের সম্মতি ছিলো না এবং তাদের উপর জোটটা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ বাস্তব সত্যিটা হলো আইএসএফকে জোটে নেওয়ার প্রশ্নে ফ্রণ্টের মধ্যে বেশ কয়েক দফা আলাপ আলোচনা হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত ঐক্যমতের ভিত্তিতেই আইএসএফকে জোটে নিয়ে সংযুক্ত মোর্চা গঠন করা হয়েছে।

নির্বাচনের প্রাক্কালে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক দল আইএসএফ এর নাম ও পতাকা কিন্তু যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।  আব্বাস যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে আসেন নি, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ মেনেই তিনি রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করতে চান তার স্বাক্ষর তিনি রেখেছেন দলের নামকরণ ও পতাকার রঙ নির্বাচনে।   রাজনৈতিক দল তৈরি করে ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবেন এ ঘোষণা যখন তিনি দেন তখনই গোটা রাজ্যে তোলপাড় শুরু হয়েছিলো। তাঁর সভা সমাবেশগুলিতে ব্যাপক জনসমাগম হতে দেখা গেছে। তা দেখে শাসকদল স্বাভাবিকভাবেই ভীষণ চিন্তায় ও চাপে পড়ে যায়। তারা চিন্তিত হয়ে পড়ে মুসলিম ভোট ব্যাংকের দখল রাখা নিয়ে। ফলে তারা শুরু করে সংগঠিত ও পরিকল্পিত অভিযান আব্বাসকে জনগণ থেকে, বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের কাছ থেকে, বিচ্ছিন্ন করার জন্যে। সে কাজে ফুরফুরা শরীফের প্রধান পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকী এবং সিপিএম বিরোধী বামেরাও নগ্নভাবে শাসকদলকে সঙ্গ দেয়। তারা একযোগে আব্বাসের বিরুদ্ধে তিনটি মারাত্মক অভিযোগ উত্থাপন করে। অভিযোগ তিনটি হলো,

·         আব্বাস সিদ্দিকী একজন গোঁড়া ধর্মীয় নেতা

·         তাঁর উদ্দেশ্য সাম্প্রদায়িক দল তৈরি করে বিজেপিকে ক্ষমতায় আসতে  সহায়তা  করা 

·         বিজেপি তাঁর পেছনে প্রচুর অর্থ ঢালছে মুসলিম ভোট ভাগ করার জন্যে

আব্বাস সিদ্দিকী দলের নাম ও পতাকার রঙ ঠিক করার সময় তাঁর বিরুদ্ধে তোলা এই মারাত্মক অভিযোগগুলি সম্পর্কে নিশ্চয়ই সজাগ ও সতর্ক ছিলেন। তাই সেইসব পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগসমূহ খণ্ডন করেন দলের নাম ইণ্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রণ্ট রেখে এবং পতাকায় মুসলিমদের ধর্মীয় পতাকার রঙ (সবুজ) ও চিহ্ন (চাঁদ) পরিহার করে। বলা বাহুল্য যে দলের নাম ও পতাকার রঙ নির্বাচন করার মাধ্যমেই তিনি বলিষ্ঠ বার্তা দেন যে তাঁর বিরুদ্ধে তোলা গুরুতর অভিযোগগুলি সর্বৈব মিথ্যে ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। শুধু দলের নাম ও পতাকায় শুধু জবাব দেন নি, তাঁর ধর্ম ও বংশ পরিচয়কে কটাক্ষ করে তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত রুচিহীন কুৎসার জবাবে বারবার তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা দিয়েছেন যে তিনি সব আগে একজন ভারতীয় এবং ভারতীয় হিসেবে তিনি গর্বিত। সর্বোপরি দলের সাংগঠনিক কমিটিতে হিন্দু, মুসলিম, আদিবাসী, জঙ্গলবাসী ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া সমাজের প্রতিনিধি রাখার মাধ্যমেও তিনি বার্তা দিয়েছেন যে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের প্রতি তিনি সম্পূর্ণ আস্থাশীল এবং ধর্ম-বর্ণ জাত-পাত নির্বিশেষে সমস্ত বঞ্চিত ও পশ্চাদপদ মানুষের জন্যেই লড়াই করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। তাঁর এই ঘোষণা যে কোনো ফাঁকা বুলি ছিলো না তা প্রত্যেকটি নির্বাচনী জনসভায় তার প্রমাণ রেখেছেন। প্রতিটি জনসভায় তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ও সংযুক্ত মোর্চার পক্ষে এবং ধর্মীয় মেরুকরণ ও তৃণমূল সরকারের মোল্লাতোষণ নীতির বিরুদ্ধে তীক্ষ্ণ, তথ্যবহুল ও যুক্তিপূর্ণ ভাষণ রেখেছেন। তথাপি তাঁর কোনো কথাতেই ভরসা না রেখে তাঁর বিরুদ্ধে অবিরাম কুৎসা প্রচার করে যাওয়া হয়েছে। কেন তাঁর কথা, দলের কর্মসূচী ও নির্বাচনী ইস্তেহার সব কিছুকেই ছেঁড়া কাগজের মতন মূল্যহীন মনে করে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে? সেটা কি তিনি পীর বংশের সন্তান এবং মুসলমান বলে? নাকি সিপিএম তাঁর দলকে জোটে নিয়েছে বলে? নাকি বিজেপিকে আটকানোর অছিলায় সিপিএমের বিরোধিতা করার জন্যে?  

আব্বাসকে যেভাবে দেগে দেওয়া হলো তা তাঁর প্রাপ্য ছিল না

 


 পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী

ভারতীয় রাজনীতিতে কয়েকটি শব্দবন্ধ খুবই প্রচলিত। যেমন ভোটব্যাংক, তোষণ নীতি, আইডেন্টিটি পলিটিক্স ইত্যাদি। তোষণনীতির নানা প্রকারের থাকলেও এ দেশে তার মূলটা হচ্ছে মুসলিম তোষণ। মুসলিম তোষণ কথাটা বিজেপি প্রচার করে। তাদের সৌজন্যেই ‘মুসলিম তোষণ’ শব্দবন্ধটি মানুষের মুখে  মুখে শোনা যায়। মুসলিম তোষণ কথাটা কিন্তু অর্ধ সত্য এবং অবশ্যই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সঠিকটা হলো মোল্লা তোষণ বা মোল্লাতন্ত্র তোষণ। বিজেপি সচেতনভাবেই ‘মুসলিম তোষণ’ শব্দবন্ধটি প্রচার করে। কারণ, তাদের মেরুকরণ রাজনীতির জন্যে এই শব্দবন্ধটাই ভীষণ কার্যকরী। এখন আবার আমাদের দেশের ভোট রাজনীতি হয়ে উঠেছে আইডেন্টিটি পলিটিক্স নির্ভর। আইডেন্টিটি পলিটিক্সটাও এসেছে তোষণের রাজনীতি থেকে। জনগণকে যেমন ধর্মের নামে ভাগ করা হয় ভোট ব্যাংক রাজনীতির সুবিধা পাওয়ার জন্যে ঠিক একই কারণে আইডেন্টিটি পলিটিক্সটাও করা হয় ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, জাত-পাত ও জাতি-উপজাতির ভিত্তিতে মানুষকে ভাগ করার জন্যে। নানা ধরণের ভোটব্যাংক আছে ভারতীয় রাজনীতিতে। যেমন মুসলিম ভোটব্যাংক, হিন্দু ভোট ব্যাংক, যাদব ভোটব্যাংক, রাজবংশী ভোটব্যাংক, আদিবাসী ভোটব্যাংক, দলিত ভোটব্যাংক, গোর্খা ভোটব্যাংক, লেপচা ভোটব্যাংক, চাঁই ভোট ব্যাংক, মতুয়া ভোট ব্যাংক ইত্যাদি। রাজনৈতিক দলগুলি এই হরেক রকমের ভোটব্যাংকে ভাগ বসাতে নানা কৌশল অবলম্বন করে। এতে এটা স্পষ্ট প্রতিভাত হয় যে রাজনৈতিক দলগুলো গরীব ও মেহনতী মানুষদের মানুষ হিসেবে ভাবে না, ভাবে শুধু ভোটার বা ভোট ব্যাংক হিসেবে। তাই তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কথা চিন্তা করার আগ্রহ ও ইচ্ছা কোনোটাই থাকে না। তারা শুধু চিন্তাভাবনা করে  কী করলে তারা সন্তুষ্ট হবে এবং তাদের ভোট পাওয়া যাবে। তারজন্যে তারা দেখে কোন সমাজ বা গোষ্ঠীর কী কী চাহিদা আছে। ভারতের গ্রামীণ সমাজকে আজও শাসন করে মোড়ল, মাতব্বর ও গোষ্ঠীপতিরা কিংবা ধর্মীয় নেতারা। সমাজের পক্ষ থেকে যা বলার বলে সমাজের এইসব মাথারাই। রাজনৈতিক দলগুলো ভোট বাংকে দখল/ভাগ নিতে নানা রকম কৌশল গ্রহণ করে সমাজের এই মাথাদের মন-মানসিকতা ও চাহিদা অনুযায়ী। মুসলিম সমাজ যেহেতু কঠোর ধর্মীয় অনুশাসনের অক্টোপাশে আজও  বন্দি এবং মুসলিম সমাজে ধর্মগুরুদের নিদানই শেষ কথা। তাই রাজনৈতিক দলগুলো সর্বদা চেষ্টা করে মুসলিম ধর্মগুরুদের দাবি পূরণ করতে। মুসলিম ধর্মগুরুদের একমাত্র লক্ষ্য ও কাজ হলো মুসলিম সমাজে মোল্লাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। তাই তাদের প্রধান চাওয়া হলো শরিয়া আইন ও মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সুরক্ষা ও তার আরও সম্প্রসারণ, এর পাশাপাশি তাদের চায় যারা শরিয়া আইন ও ইসলামের সমালোচনা করে তাদের কঠোর শাস্তি। অন্যদিকে মুসলিম ধর্মগুরুরা মোটেই চায় না মুসলিমদের জন্যে আধুনিক শিক্ষার স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যদি, নারী ও পুরুষের সমান অধিকার এবং সর্বোপরি মুসলিম সমাজের বিকাশ। এসব হলে তো মোল্লাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। তাই মুসলিম ধর্মগুরুদের তোষণ করা মানেই হলো মোল্লাতন্ত্র তোষণ করা। এ প্রবন্ধে শুধু মোল্লাতন্ত্র তোষণ নিয়েই কিছু কথা বলতে চাই। তবে সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে একটা কথা উল্লেখ করা দরকার যে স্বাধীনত্তোর কালে ডানপন্থী ও বামপন্থী সকল অবিজেপি পার্টির সরকারই যে যার মতন করে মোল্লাতন্ত্র তোষণের রাজনীতি করে আসছে।  এখানে কংগ্রেস সরকারের মোল্লাতন্ত্র তোষণের কয়েকটা নমুনা দেওয়া যাক।

·         কংগ্রেস সরকার হিন্দু বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করেছে, কিন্তু মুসলিম বহুবিবাহ বহাল রেখেছে।

·         হিন্দুদের ধর্মীয় সম্পত্তি উত্তরাধিকার আইন বাতিল করে নতুন আইন প্রণয়ন করে নারী ও পুরুষকে সমানাধিকার দিয়েছে, কিন্তু মুসলিমদের সেই ধর্মীয় আইন (ফারাইজ আইন) বহাল রেখেছে।

·         হিন্দুদের প্রাচীন ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র টোল কবেই বিদায় নিয়েছে। সেটা সম্ভব হয়েছে কংগ্রেস সরকার তাতে উৎসাহ দেয় নি বলে। মুসলিমদের ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা আজও টিকে রয়েছে। শুধু তাই নয়, দিন দিন এর শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে। এটা সম্ভব হচ্ছে কারণ কংগ্রেস সরকার সহ সমস্ত অবিজেপি সরকার এই শিক্ষাব্যবস্থায় উৎসাহ দেয় এবং এর পেছনে অঢেল অর্থ খরচ করে বলে।

·         দেশে ধর্মনিরপেক্ষ অভিন্ন দেওয়ানি আইন প্রবর্তন করা যায় নি কারণ মোল্লাতন্ত্র চায় না বলে।

·       মোল্লাতন্ত্র তোষণের সবচেয় নিকৃষ্ট নমুনা রেখে গেছেন রাজীব গান্ধী। খোরপোষ সংক্রান্ত সর্বোচ্চ আদালতের ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী রায়কে খারিজ করে দেন তিনি সংসদে একটি কালা আইন প্রণয়ন করে মুসলিম নারীর সুরক্ষার নামে। কিন্তু বস্তুত সেই আইনে মুসলিম নারীদের খোরপোষ চাওয়ার অধিকারকেই নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে।      

আগেই বলেছি যে অবিজেপি সব দলের সরকারই কমবেশি মোল্লাতন্ত্র তোষণ ও ভোটব্যাংকের রাজনীতি করে। তবে এক্ষেত্রে একেবারে নগ্নভাবে মোল্লাতন্ত্র তোষণ করা বলতে যা বোঝায় তা করে চলেছে মমতা ব্যানার্জীর টিএমসি সরকার। মমতা ব্যানার্জীর সরকারের সেই নগ্ন মোল্লাতন্ত্র তোষণের রাজনীতির কয়েকটা নমুনা এরূপঃ 

·         মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় দু’ ধরণের মাদ্রাসা আছে – সরকার নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসা এবং মোল্লাতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত কওমি বা খারিজি মাদ্রাসা। দ্বিতীয় প্রকারের মাদ্রাসায় জিহাদের শিক্ষা দেওয়া হয় এবং তৈরি করা হয় জিহাদি ও সন্ত্রাসী। একমাত্র মমতা ব্যানার্জীর সরকারই খারিজি মাদ্রাসাকে উৎসাহ দেওয়ার নজির তৈরি করেছে।

·         ইমাম ভাতা ও মুয়াজ্জিন ভাতার প্রবর্তন।

·         হজ হাউসের সম্প্রসারণ এবং ঝাঁ চকচকে রাজকীয় নতুন হজ হাউস নির্মাণ।

·         মুসলিমদের ধর্মীয় জমায়েতে গিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে ভুলভাল উচ্চারণে মুসলিমদের ধর্মীয় ভাষায় ও কায়দায় সম্বোধন করা ও বিদায় জানানো। যেমন সালেমালেকুম, ইনসাল্লাহ, আল্লা হাফেজ, খোদা হাফেজ ইত্যাদি ইত্যাদি। 

·         রোযার মাসে উপবাস ভাঙ্গা পার্টিতে অংশ নিয়ে মাথায় আঁচল টেনে মুসলিম নারীর বেশ ধারণ করে দু’হাত তুলে আল্লাহর কাছে মোনাজাত করা।

·         অনুরূপ বেশ ধারণ করে ঈদের জামাতে অংশ নিয়ে ভাষণ দেওয়া ও মোনাজাত করা।

 

মোল্লাতন্ত্র তোষণের বিরুদ্ধে মুসলিম সমাজের পক্ষ থেকে কেউ কখনো প্রতিবাদ করে নি, এমনকি সামান্য সমালোচনাও করে নি। কংগ্রেস নেতা আরিফ মহম্মদ খাঁন শুধু একবার প্রতিবাদ করেছিলেন যখন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী সংসদে মুসলিম নারীর খোরপোষ বিরোধী আইন প্রণয়ন করেন। প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা ও দল থেকেও পদত্যাগ করেন। সেই তিনি এখন কেরালার গভর্নর। এটা বোধ হয় বিজেপির দেওয়া পুরষ্কার। তাই মনে হয় অন্য কোনো কারণে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন, আইনটা ছিলো একটা বাহানা মাত্র।        

শরিয়তি আইন এতই কুৎসিত যে সৌদি আরব, ইরাক, ইরান সহ অধিকাংশ মুসলিম দেশই সেই আইনের ব্যাপক সংস্কার করেছে। বাতিল করে দিয়েছে বহুবিবাহ ও তিন তালাক আইন। এ দেশে সম্ভবত ৯০/৯৫% মুসলিমই মাদ্রাসার ছায়া মাড়ায় না। এতদসত্ত্বেও মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা শরিয়তি আইন এবং মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা তুলে দেবার দাবি জানায় না। তাদের এই কাপুরুষসুলভ নীরবতা হেতু মোল্লাতন্ত্রের প্রতিনিধিদেরই (মাওলানা, ইমাম ও মুফতিরা) দাসত্ব করে চলেছে সমগ্র মুসলিম সমাজ। মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের নীরবতার জন্যেই রাজনৈতিক দলগুলি মুসলিম ধর্মগুরুদের তোষণ করে তথা মোল্লাতন্ত্র তোষণ করে পার পেয়ে যায়। আর অবিজেপি সরকারগুলোর এই মোল্লাতন্ত্র তোষণকারী নীতি ও ভূমিকায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয় মুসলিম সমাজ।

অবশেষে বহু যুগের সুদীর্ঘ লজ্জাজনক নীরবতা ভাঙলেন পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী। ভাঙলেন সশব্দে, সজোরে। রাজ্য সরকার ও মুখ্যমন্ত্রীর চোখে চোখ রেখে বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রতিবাদ করলেন মোল্লাতন্ত্রের তোষণের। সরকার ও মুখ্যমন্ত্রীর যে কাজগুলির প্রতিবাদ করেছেন সেগুলি হলোঃ 

·         ইমাম ভাতা ও মুয়াজ্জিন ভাতা প্রদান

·         মহরমের দিন দূর্গা প্রতিমা বিসর্জন স্থগিত রাখা

·         মুসলিমদের রোযা এফতার পার্টিতে অংশ নিয়ে রোজা এফতারের ভাণ করা

·         ঈদের জামাতে গিয়ে ইমামদের পাশাপাশি খুতবা (ভাষণ) দেওয়া

·         মুসলমানদের জন্যে দেওয়া প্রতিশ্রুতির ১০০% পূরণ করে দেওয়ার অসত্য ঘোষণা করা

ইমাম ভাতা ও মুয়াজ্জিন ভাতা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন যে ওতে মুসলিম সমাজের কল্যাণ হয় নি। বলেছেন রিলিফ বা ভিক্ষা নয়, প্রাপ্য অধিকার চাই। প্রতিমা বিসর্জন স্থগিত রাখা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, ওটা করে মুখ্যমন্ত্রী একটা বার্তা দিয়েছেন যে একই দিনে মহরম ও প্রতিমা বিসর্জন হলে দাঙ্গা বাধতে পারতো। এই বার্তা দিয়ে মুসলমানদের হেয় করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর রোযা এফতার পার্টি ও ঈদের জামাতে অংশ নেওয়াকে বলেছেন নাটকবাজী এবং মুসলিমদের প্রতি কপট দরদ প্রদর্শন।

যে কাজটা অনেকদিন আগেই করা দরকার ছিলো প্রগতিশীল মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের, তারা করে নি। সেটা করলেন আব্বাস সিদ্দিকী। তার জন্যে তাঁকে পীর বংশের কত বাধার যে মোকাবেলা করতে হয়েছিলো তা একমাত্র তিনিই জানেন। এটা করার জন্যে যাদের তাঁকে ছিঁড়ে খাওয়ার কথা ছিলো তারা তো খেয়েছেই, কিন্তু যাদের কাছ থেকে বাহবা পাওয়ার কথা ছিলো তারাও ছিঁড়ে খেয়েছে। অর্থাৎ বাম মনস্ক মানুষরাও তাঁকে সমানে ছিঁড়ে খেয়েছে। বামপন্থী এই ‘পণ্ডিত’ মানুষগুলো বঙ্গ রাজনীতিতে আব্বাসকে ভয়ংকর এক মুসলিম মৌলবাদী দৈত্য বলে অভিহিত করেছে। এটা কিন্তু তাঁর প্রাপ্য ছিলো না।

প্রসঙ্গঃ কং-বাম-আইএসএফ জোট  

 

Congress-Left-ISF hold mega rally in Kolkata but cracks visible for all to see

Left, Cong & ISF leadership in Brigade ground

 

শুধু আব্বাসকেই নয়, আব্বাসের সঙ্গে জোট করার জন্যে চারদিক থেকে ছিঁড়ে খাওয়া হয়েছে সিপিএমকেও। আব্বাসকে যারা মনে করে মুসলিম মৌলবাদী শক্তির প্রতিনিধি তাদের কাছে অন্য কিছু আশা করা যায় না। ওরা আব্বাসের অতীতকেই শুধু কাঁটাছেঁড়া করেছে। সমাজে যেমন ভাঙাগড়া হয় তেমনি ভাঙাগড়া হয় মানুষেরও। আব্বাসের মধ্যে সেই ভাঙাগড়া আমরা দেখেছি। একজন ইমানদার মুসলিমের অবস্থান থেকে নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির উপযুক্ত করে তোলার জন্যে তাঁর নিরন্তর  চেষ্টা দেখেছি। সেই চেষ্টায় খাদ বা কপটতা ছিলো না। তিনি যা বলেছেন তা অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের মতন শুধু কথার কথা ছিলো না। যা বলেছেন তার মধ্যে যে কপটতা ছিলো না তার প্রমাণ তিনি রেখেছেন কথায় ও কাজে। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছেন যে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের তিনি একজন নাগরিক এবং তারজন্যে তিনি গর্বিত। তিনি যে ধর্মনিরপেক্ষ তার প্রমাণ রেখেছেন দল গঠনে। তাঁর দলে প্রতিনিধিত্ব রয়েছে বিভিন্ন ধর্ম, জাতি, উপজাতি ও জনজাতির। দলের পতাকায় ইসলামের গন্ধ রাখেন নি। শাসক দল ও সরকারের মোল্লাতন্ত্র তোষণের বিরুদ্ধে অকুতোভয়ে গলা ফাটিয়েছেন যা বামপন্থীরাও পারে নি। প্রত্যেকটা জনসভায় গলা ফাটিয়েছেন ধর্মনিরপেক্ষতার জন্যে এবং ধর্মীয় মেরুকরণের বিরুদ্ধে। সুতরাং এ কথা বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে, সেক্যুলার ফ্রণ্টের সঙ্গে জোট করে সিপিএম ধর্মনিরপেক্ষ নীতি থেকে বিচ্যুত হয় নি।    

  বামফ্রণ্টের ভোট কমার দায় প্রসঙ্গে 

বামফ্রণ্টের ভোট কমা ও একটিও আসন না পাওয়ার জন্যে দায়ী করা হচ্ছে মূলত আব্বাসের সঙ্গে জোট করাকে। এটার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ নিহিত রয়েছে। প্রধান কারণ অবশ্যই বামফ্রণ্ট ও কংগ্রেসের বহু অনুগামী ও সমর্থকের বিজেপির জয় আটকাতে তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দেওয়া। এছাড়া যে কারণগুলি রয়েছে তার কয়েকটি হলোঃ

·         এটা ভুললে চলবে না যে ২০১১ এর পর প্রতিটি নির্বাচনে ভোট কমেছে সিপিএম ও বামফ্রণ্টের

·         বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোটটাই আদতে হয় নি। সেটা মূলত প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির অনীহার জন্যে। তিনি জোট করতে বাধ্য হয়েছিলেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশে। ফলে জোটটা ছিলো বাস্তবে অন্তঃসারশূণ্য।

·         অনেক আসনেই মোর্চার একাধিক প্রার্থী ছিলো।

·         কংগ্রেস ও আইএসএফের মধ্যে বস্তুত জোটই হয় নি। 

·         বামফ্রণ্ট ও কংগ্রেসের মধ্যে জোটটাও নীচুতলায় কাজ করেনি। দুই শিবিরের নীচুতলার নেতা-কর্মীরা বহুলাংশেই জোটের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করে নি।  

·         সবচেয়ে বড়ো কারণ হলো, বহু কর্মী ও সমর্থক হয় বিজেপিকে হারাতে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে না হয় তৃণমূলকে হারাতে বিজেপিকে ভোট দিয়েছে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় এই পরিসংখ্যান থেকে। ২০১৬ এর বিধানসভা নির্বাচনে বাম+কংগ্রেস পেয়েছিলো ৭৬টি আসন যার ৫২টি পেয়েছে তৃণমূল ও ২৪ট পেয়েছে বিজেপি।

·         আর একটি পরিসংখ্যান বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মতন। বামের লড়েছিলো যার ৯৪টি আসনেই তাদের ভোট বেড়েছে ২০১৯ এর লোকসভার তুলনায়।

সুতরাং উপসংহারে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে এটা নিছকই ভ্রান্ত ধারণা যে কংগ্রেস ও বামেদের ভোট কমেছে আব্বাস সিদ্দিকীর সঙ্গে জোট করার জন্যে।

 

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...