বিজ্ঞান
ও ধর্মের মধ্যে অহিনকুল সম্পর্ক। যেহেতু ধর্মবিশ্বাসের মূল ভিত্তি ঈশ্বরের প্রতি অন্ধবিশ্বাস,
তাই বিজ্ঞানের সঙ্গে অহিনকুল সম্পর্ক ঈশ্বরবিশ্বাসী তথা ধর্মবিশ্বাসীদেরও। এটা সকল
ধর্মের প্রতি আনুগত্যশীল ধর্মবিশ্বাসী তথা
ঈশ্বরবিশ্বাসীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে যেমন অহিনকুল সম্পর্ক
বিদ্যমান ঠিক তেমনই সম্পর্ক দর্শন ও ধর্মের মধ্যেও। যুক্তিবাদী দার্শনিক সক্রেটিস ও
ব্রুনোকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিলো ধর্মবিশ্বাসীরা। বিজ্ঞানীদের মধ্যে যাঁরা ধর্মবিশ্বাসীদের
হাতে অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে গ্যালিলিওর নাম উল্লেখযোগ্য। শুধু
খৃষ্টধর্মবিশ্বাসীদের হাতেই নয়, বিজ্ঞানী ও যুক্তিবাদী দার্শনিকদের ওপর নির্মম ও নৃশংস
নির্যাতন চালিয়েছিল ইসলামী সাম্রাজ্যের অনেক খলিফাও। আজও ইসলামে বিশ্বাসীরা সারা বিশ্বে
যুক্তিবাদীদের উপর নৃশংস নির্যাতন চালাচ্ছে এবং তাদের হত্যা করছে। হিন্দুধর্ম সহ অন্যান্য
ধর্মের ধর্মবিশ্বাসীরাও একই কুকর্ম করেছে ও করে চলেছে। সে সবের দৃষ্টান্ত দিয়ে লেখাটির
কলেবর অহেতুক বাড়াতে চাই না কারণ সেটা আজকের লেখার প্রতিপাদ্য নয়। প্রতিপাদ্য লেখাটির
শিরনামেই উল্লেখ করা হয়েছে। লেখাটির ভূমিকা করার একান্ত প্রয়োজনে উপরের কয়েকটি কথা
বলতে হলো। এবার লেখার মূল প্রতিপাদ্যে যাওয়া যাক।
আমাদের
দেশে (ভারতে) বহু ধর্মের মানুষের বসবাস। তবে এখানে প্রধানত হিন্দুধর্ম ও ইসলাম ধর্মের মানুষরাই বাস করে। বিজ্ঞানের কাঁধে পা রেখে বিজ্ঞানের ওপরেই লাঠি ঘোরানোর
অপকর্মটি করতে হিন্দুধর্মবিশ্বাসিরাও বিশেষ পারদর্শী, তবে আমি এখানে আলোচনা করবো মূলত
ইসলামবিশ্বাসিদের নিয়েই। গতকাল (৮ই জুলাই) ফেসবুকে একজন মুসলিম ডাক্তার বাবুর একটা
বেশ লম্বা পোস্ট পড়লাম। মূলত সেই পোস্টের ওপরেই এই লেখাটি। লেখাটির মূল বিষয় হলো উপবাস
থাকলে ও নিয়ন্ত্রিত খাদ্য গ্রহণ করলে শরীরের কতোটা উপকার হয়। এই নিয়ম অনুসরণ করলে মেদ
ও ওজন দুইই কমে, শরীর নীরোগ হয় ও থাকে, মানুষ দীর্ঘজীবি হয় এবং মানুষের যৌবনও দীর্ঘস্থায়ী
হয়। ডাক্তার বাবু বলেছেন এটা উপলব্ধ হয়েছে বা পাওয়া গেছে বিজ্ঞানের দীর্ঘদিনের গবেষণায়।
পোস্টের তথা ডাক্তার বাবুর মূল বক্তব্য নিয়ে কিছু বলার নেই। আমার বক্তব্য অন্য জায়গায়। উপবাস থাকা নিয়ে। ঠিক কতক্ষণ উপবাস থাকতে হবে সে কথা
তিনি উল্লেখ করেন নি তাঁর দীর্ঘ স্টেটাসে। এটা অনুল্লেখ করেছেন বোধ হয় তাঁর পেশাগত
স্বার্থে। আমার ধারণা উপবাস শব্দটি বারবার উল্লেখ করেছেন একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে। সেটা
স্পষ্ট হয়েছে যেহেতু উপবাসে থাকার আবশ্যকতার কথা বলতে গিয়ে রমজান মাসের রোযার কথাও
বার কয়েক বলেছেন। রোযা রাখলে যে মেদ কমে, ওজন কমে ও শরীর রোগমুক্ত হয় ও থাকে সে কথাও
তিনি জানিয়েছেন।
উপবাস
কতক্ষণ থাকতে হবে সে কথা তাঁর লেখায় নেই, কিন্তু তাঁর বলা উপবাস থাকার অর্থটা কী তা
আমি জেনেছি তাঁর খাদ্যবিধি অনুসরণ করছে এমন একজনের কাছ থেকে। খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে
তাঁর পরামর্শ বা নির্দেশিকা অনুসারে একজন মানুষ
সারা দিনে মাত্র দু’বার খাদ্য গ্রহণ করবে - দুপুর দুটায় ও সন্ধ্যা সাত/সাড়ে সাতটায়,
অবশ্য তার সঙ্গে আছে সকালে এক কাপ র’চা। বলা বাহুল্য যে খাদ্য তালিকায় কী কী থাকবে
এবং কী কী রাখা যাবে না তাও থাকে সবিস্তারে। এই খাদ্যবিধি অনুযায়ী সকালে (ধরা যাক সকাল
ছ’টা) এক কাপ চা খাবার পর আট ঘণ্টা এবং দুপুরে খাবার পর পাঁচ/সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা না খেয়ে
থাকতে হবে। এটাকে নিশ্চয় উপবাস বলা যায় না। তবুও তিনি এটাকেই উপবাসে থাকা বা উপবাস
করা বুঝিয়েছেন। তবু তিনি এটাকে উপবাস বলেছেন। লম্বা কয়েক ঘণ্টা না খেয়ে থাকাকে তাঁকে
উপবাসই বলতে হয়েছে। কারণ ‘উপবাস’ না বললে তো রোযাকে টেনে এনে যায় না, রোযাকে মহান করে
দেখানোও যায় না আর প্রমাণও করা যায় না যে রোযা রাখা অবশ্যই একটি বিজ্ঞানসম্মত প্রথা।
কিন্তু সারা দিন উপবাস থেকে রোযা রাখা তো অবৈনাজ্ঞিক প্রথা এবং শরীরের পক্ষে ভীষণ ক্ষতিকর। কেন
তা স্পষ্ট হবে এর পরের আলোচনায়।
হিন্দুধর্মবিশ্বাসীদের
উপবাসে থাকার রীতিনীতি ও উদ্দেশ্যের মধ্যে ঢুকবো না, আমার আলোচনা সীমাবাদ্ধ রাখবো রোযা
রাখার বিষয়েই। কারণ ডাক্তার বাবু তো কেবল ইসলামের রোযা রাখার কথাই বলেছেন, হিন্দুদের
উপবাসে থাকার কথা বলেন নি। মানুষ সাধারণত দিনের মধ্যে বারবার খায় এবং খাদ্যাভাসে
ও খাদ্য তলিকায় কোনোরূপ নিয়ন্ত্রণ প্রায় রাখেই না বললেই চলে। এর ফলে অবশ্যই মানুষের
মেদ ও ওজন দুইই বাড়ে যা শরীরে নানা অসুখ ডেকে নিয়ে আসে এবং বহু মানুষ অকালেই মারা যায়।
এর হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্যে চিকিৎসক ও ডায়েটিসিয়ানরা মানুষের খাদ্যাভাস ও
খাদ্য তালিকা দু’টোতেই পরিবর্তন আনতে বলেন এবং নিয়ন্ত্রিত খাবার খেতে বলেন। চিকিৎসক
ও ডায়েটিসিয়ানদের এই পরামর্শও যে বিজ্ঞানের গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে সঞ্জাত তা বলা বাহুল্য।
ওপরে উল্লেখিত ফেসবুক পোস্টে মুসলিম ডাক্তার বাবু যা বলেছেন তাও বিজ্ঞানের গবেশণালব্ধ
জ্ঞান বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। তিনি অবশ্য সেটা একটু অন্যভাবে বলেছেন। ডায়েটিসিয়ানগণ
যেভাবে খাদ্যবিধির পরামর্শ বা নির্দেশ দেন তা থেকে অনেকটাই আলাদা তাঁর
দেওয়া খাদ্যবিধি। পার্থক্যটা কোথায় তা নিয়ে শব্দ খরচ করতে চাই না, কারণ সেটা সম্পূর্ণ
অপ্রাসঙ্গিক এ আলোচনায়। তিনি যা বলেছেন তার সঙ্গে যে রমজানের উপবাসকে মেলানো
যায় না আমার আলোচনা মূলত তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
রমজানের
রোযা বা উপবাস সম্পর্কে কিছু কথা বলা এখন অত্যন্ত জরুরী। এ বিষয়ে প্রথমেই একটা কথা জানিয়ে দেওয়া একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, রমজান মাসে
রোযা রাখার প্রচলন শুরু হয় প্রাচীন কালে ইসলামের আগমনের বহুকাল পূর্বেই। ইহুদিরাও রোযা রাখতো। শুধু ইহুদিরাই নয়, রোযা রাখার প্রথা ছিলো আরবে অইহুদি অন্যান্য
উপজাতি গোষ্টীর মধ্যেও। মুহাম্মদও নিজেকে নবী বলে দাবী করার পূর্বে রোযা রাখতেন। অর্থাৎ
এটা ইসলামের সৃষ্টি করা ধর্মীয় প্রথা নয়। মুহাম্মদ পরে রোযা রাখার প্রাচীন প্রথাটির
ইসলামীকরণ করেছেন মাত্র। কিন্তু মুসলিমদের বিশ্বাস (অমুসলিমদের অনেকেরও) যে রমজান মাসে
রোযা রাখার স্বর্গীয় বিধান ঈশ্বর সর্বপ্রথম মুহাম্মদের কাছেই পাঠায়। সেজন্যেই সম্ভবতঃ
রমজানের রোযা নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় অপার গর্ব ও অহংকার। উক্ত ডাক্তার
বাবু শরীর থেকে মেদ ঝরিয়ে শরীরকে মেদহীন ও রোগমুক্ত করার জন্যে উপবাস করতে তথা রোযা রাখতে
(আসলে প্রতিদিনের খাদ্য গ্রহণের ফাঁকে লম্বা লম্বা বিরতি দেওয়ার) যে পরামর্শ দিয়েছেন তার পেছনে একটা বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে। সেটা হলো এই যে, তিনি সম্ভবত প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে বিজ্ঞান এখন যে কথা বলছে ইসলাম তা চৌদ্দশ’ বছর আগেই বলেছে। অর্থাৎ ইসলাম প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে যে কথা বলেছে
বিজ্ঞানীরা এতদিনে সে কথা বলছেন। এ কথা বলে তিনি বোধ হয় এক ঢিলে দু’টো পাখি মারতে চেয়েছেন
– এক). একমাস ধরে রোযা রাখা একটি বিজ্ঞানসম্মত প্রথা এবং দুই. বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে ইসলামকে বিজ্ঞানের উপরে স্থাপন করা। কিন্তু
নির্মম সত্যিটা হলো এই যে, ডাক্তার বাবু বিজ্ঞানের গবেষণালব্ধ জ্ঞান থেকে প্রাপ্ত যে
খাদ্যাভাস ও খাদ্যরীতি অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছেন তার সঙ্গে রমজানের রোযা রাখার তুলনা
টানাই যায় না। কারণ দুটো জিনিষ সম্পূর্ণ আলাদা ও ভিন্ন প্রকৃতির। তা ছাড়া একমাস ধরে
একমাস রোযা রাখা একটা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক প্রথাও বটে। কেন তা বুঝতে হলে রমজান মাসে
রোযা রাখার ধর্মীয় বিধিগুলি ও তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার। তাই এসব বিষয়ে আমদের অবহিত থাকা একান্তই আবশ্যক।
প্রথমে
বলা যাক রোযার বিধিমালা সংক্রান্ত কিছু কথা। সেই বিধিমালায় রয়েছে বছরের সে সময়েই রোযা
আসুক না কেন রোযাদারকে অবস্থায় সূর্যোদয়ের কিছু পূর্ব মুহূর্ত থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত
সম্পূর্ণ নির্জলা উপবাস পালন করতে হবে। তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে গেলেও একফোঁটা জল পান করা
যাবে না। কেউ ভুল করেও তা করলে তার রোযা ভেঙে যাবে। রোযাব্রত অবস্থায় যৌনতা
নিষিদ্ধ। কেউ রাত্রে যৌন সংসর্গ করলে তাকে শেহরি করার (রোযা করার জন্যে খাদ্য গ্রহণ) পূর্বেই গোসল (স্নান) করতে হবে। অর্থাৎ ইসলামী মতে রমজান মাসে যৌনতা একটি অপবিত্র ও
ঘৃণ্য কাজ। অথচ ইসলামই স্বর্গবাসীদের জন্যে যৌনতার এলাহি ব্যবস্থা রেখেছে। রোযাব্রত
অবস্থায় মিথ্যা কথা বলা, অধিক মুনাফা করা, চুরি-দুর্নীতি ও ডাকাতি-রাহাজানি করা, নারীর
প্রতি কুদৃষ্টি নিক্ষেপ করা – এসব সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এগুলির কোনো একটি করলে রোযা ভেঙে যায়। ইসলাম বলেছে রমজান মাসে নারীর ঋতুস্রাব হলে রোযা করা নিষিদ্ধ। অর্থাৎ নারীর ঋতুস্রাব
একটি জঘন্য ও চরম অপবিত্র ব্যবস্থা। ইসলামের চিরকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ও চিন্তাবিদ
ইমাম গাজ্জালী বলেছেন ঋতুস্রাব সহ কিছু অবাঞ্ছিত ও অপবিত্র কাজের জন্য আল্লাহ নারীকে
নানাবিধ শাস্তি প্রদান করেছে। যেমন, নারীকে বিয়ের পর নিজের
সব কিছু পরিত্যাগ করে একটা সম্পূর্ণ অচেনা বাড়িতে (স্বামীর বাড়িতে) যেতে হয়, স্বামীর
অধীনে থেকে তার সর্বপ্রকার সেবা করতে হয়, গর্ভধারণ ও তীব্র প্রসবযন্ত্রণা ভোগ
করতে হয়, ঋতুস্রাবের সময় রোযা রাখা ও নামাজ পড়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকতে হয় ইত্যাদি
ইত্যাদি। যে যে কারণে রোযা ভেঙে যায় তার কোনোটার কারণেই মুসলিম ডাক্তার বাবুর বিজ্ঞানস্মমত
খাদ্যবিধি লঙ্ঘিত হয় না। তাঁর খাদ্যবিধিমালায় তো বারবার জল খেতে এবং দিনে ন্যূনতম দু’বার
প্রধান খাদ্য গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে তিনি যে খাদ্যবিধি অনুসরণ
করতে বলেন তাকে উপবাস বলা যায় না, রোযা রাখা তো কোনো ভাবেই বলা যায় না। মুসলিমদের রোযা
রাখার মূল উদ্দেশ্য কী সেটা এবার দেখা যাক। মুসলিম ধর্মতত্ত্ববিদরা দাবি করেন যে, সততা অনুশীলন করা, অনাহারক্লিষ্ট মানুষের
কষ্ট উপলব্ধি করা, দরিদ্র মানুষকে দান করা ইত্যাদি কিছু ভালো কাজ করার অভ্যাস করা হলো
রমজান মাসে রোযা রাখার উদ্দেশ্য। আর রমজানের রোযা
রাখার প্রধান উদ্দেশ্য হলো নরকের শাস্তি থেকে মুক্তি লাভ ও বেহেস্ত লাভ করা। সুতরাং
উদ্দেশ্যের দিক বিবেচনায় রাখলেও ঐ ডাক্তার বাবুর খাদ্যবিধি অনুসরণ করাকে তথা ডায়েটিং করাকে কোনোভাবেই রোযা রাখার সঙ্গে মেলানো যায়
মা। এবার আলোচনা করা যাক কেন রোযা রাখা শরীরের পক্ষে হানিকর।
ইতিমধ্যেই
উল্লেখ করা হয়েছে যে রোযা যে মাসেই পড়ুক না কেন রোযাব্রতকারীকে সূর্যোদয়ের আগে থেকে
সূর্যাস্ত পর্যন্ত নির্জলা উপবাস করতে হয়। ধরা যাক এই সময়ে অর্থাৎ ইংরাজী ক্যালেণ্ডারের
জুলাই মাসে রমজান মাস শুরু হলো। এই সময়ে দিন যতই দীর্ঘ হোক না কেন সূর্যোদয়ের কিছুক্ষণ
আগে থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পুরো দিনটাই উপবাস উদযাপন করতে হবে, একফোঁটা জল পর্যন্ত
পান করা যাবে না। এবার পৃথিবীর কয়েকটি দেশের দিকে চোখ রেখে দেখা যাক সে সব দেশের রাজধানীতে
জুলাই মাসে দিনের দৈর্ঘ কতটা।দেখা ও বোঝার
সুবিধার্থে নীচে একটা সারণী দেওয়া হলো –
দেশ সূর্যোদয়ের সময় সূর্যাস্তের সময় দিনের দৈর্ঘ
সুইডেন ৩-৪৮ এ.এম ৯-৫৭
পি.এম ১৮ ঘ. ০৯ মি.
নরওয়ে ৪-১১ এ.এম ১০-৩২ পি.এম ১৮ ঘ. ২১ মি.
নেদারল্যাণ্ড
৫-৩০ এ.এম
১০-০১ পি.এম ১৬ ঘ. ৩১ মি.
জার্মানি ৪-৫৫ এ.এম ৯-২৮ পি.এম ১৭ ঘ. ২৭ মি.
গ্রীনল্যাণ্ড ৩-২৪ এ.এম ১১-৪১ পি.এম ২০ ঘ. ১৭ মি.
ফেয়ারব্যাংক ২-৫৭ এ.এম ১২-৪৭ এ.এম ২১ ঘ. ৫০ মি.
(ফেয়ারব্যাংক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় অবস্থিত)
(ফেয়ারব্যাংক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় অবস্থিত)
ওপরের
চিত্র থেকে বোঝা যাচ্ছে যে জুলাই মাসে রোযা যারা রাখবে তাদের সুইডেনে প্রায় সওয়া আঠারো ঘ., নরওয়েতে
সাড়ে আঠারো ঘ., নেদারল্যাণ্ডে সাড়ে ষোলো
ঘ., জার্মানিতে সাড়ে সতেরো ঘ. এবং গ্রিনল্যান্ডে প্রায় সাড়ে কুড়ি ঘ. উপবাস করতে
হবে। একমাস ধরে দিনের মধ্যে এতো লম্বা সময় নির্জলা উপবাস করলে শরীরে কী পরিমাণ জলের
ঘাটতি (কী মারাত্মক ডিহাইড্রেশন) হতে পারে এবং তার ফলে কিডনি কতোটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে
পারে তা সাধারণ মানুষের কল্পনারও বাইরে। তাছাড়া একজন মানুষ ১৮/২০ ঘণ্টা কোনো খাদ্য
গ্রহণ না করলে সেই সময়ে তার শরীরে শক্তি উৎপাদিত হয় না একদম।একমাস রোযা রাখলে একজন
মানুষের শরীর প্রায় জলশূন্য ও শক্তিশূন্য হয়ে পড়বে। এবার ভাবুন ফেয়ারব্যাক অঞ্চলের
মুসলিমদের কথা। তাদের রোযার নির্জলা উপবাস পালন করতে হবে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বাইশ
ঘণ্টা। আমার মনে হয় একমাস তারা রোযা রাখলে তাদের জীবনী শক্তি প্রায় নিঃশেষ হয়ে যাবে। সুতরাং রমজান মাসে রোযাব্রত পালন করা শরীরের পক্ষে
খুবই ক্ষতিকর তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। মুসলিমদের যারা রমজান মাসের রোযার জন্যে নিজেদের ধন্য ও অপরিসীম গর্বিত
মনে করেন তাদের আর একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। ফেয়ারব্যাংকের মুসলিমদের রমজান মাসে রোযা এপ্তার
(রোযা ভঙ্গ) করার পর রাতের যে খাবার খায় (ধরা যাক রাত্রি সাড়ে দশটা) তারপর প্রাক প্রত্যুষে
(বারোটা ত্রিশ মিনিটে) সূর্যোদয়ের পূর্বে খাদ্য গ্রহণ করার আগে হাতে সময় থাকে মাত্র দু’ঘণ্টা।
দু’ঘণ্টায় বড়ো জোর দু’খানা বিস্কুট ও একগ্লাস জল খাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ সেয়ারব্যাংকের
মুসলমানরা রোযা রাখার সময় চব্বিশ ঘণ্টায় মাত্র একবার জল ও খাদ্য খাওয়ার সুযোগ পাবে। সুতরাং রোযা রাখাটা শুধু শরীরের পক্ষে ভীষণ ক্ষতিকরই নয়, খাবার সময় বিন্যাসটাও (সূর্যোদয়ের
পূর্বে এবং সূর্যাস্তের পরে) সম্পূর্ণ অবাস্তব ও অবৈজ্ঞানিক।
প্রবন্ধের গোঁড়াতেই বলা কথাটা আবার বলতে হচ্ছে যে ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাসীদের মহাশত্রু, বলা ভালো, জাতশত্রু হলো বিজ্ঞান ও দর্শন। হবেই না বা কেন। বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীরা এবং যুক্তিবাদী দর্শন ও যুক্তিবাদীরাই তো সমস্ত ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাসীদের সকল অসত্য, অর্ধসত্য, অসততা ও প্রতারণাগুলো উন্মোচন করে দিয়েছে নির্মমভাবে। ধরা যাক ইসলাম ধর্মেরই কথা। ইসলামের প্রধান ধর্মগ্রন্থ কোরান বিশ্ব-মহাবিশ্ব, আকাশ-মহাকাশ, সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, দিন-রাত্রি, বৃষ্টি-বন্যা-খরা, আহ্নিক গতি–বার্ষিক গতি, ঝড়-তুফান, ভূমিকম্প-সুনামি, প্রাণের সৃষ্টি, ইত্যাদি প্রসঙ্গে যা যা বলেছে তার সবটাই যে ভিত্তিহীন, আজগুবি ও মিথ্যেই ঠাসা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বিজ্ঞানী ও যুক্তিবাদীরা। কোরান বলেছে বিশ্ব ও মহাবিশ্ব আল্লাহ সৃষ্টি করেছে সাত দিনে। এই সৃষ্টি তত্ত্ব যে একটা মস্ত বড়ো ধোঁকাবাজি তা মানুষ বুঝেছে বিজ্ঞানের দৌলতে। কোরান বলেছে আল্লাহর কুদরতে আমাদের মাথার উপর সাতটা আকাশ রয়েছে বিনা স্তম্ভেই। এই তত্ত্বটি যে ধর্ম প্রবর্তক ও প্রচারকের বুজরুকি সেটা ফাঁস করে দিয়ে বিজ্ঞান মানুষকে জানিয়েছে, মহাকাশ মানে অন্তহীন মহাশূন্য, মহাকাশের পুরোটাই ফাঁকা। কোরান বলে, সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, দিন-রাত্রি এবং সূর্যোগ্রহণ-চন্দ্রগ্রহণ হয় আল্লাহর হুকুমে (নির্দেশে)। এর রহস্য উন্মোচন করা মানুষের সাধ্যের বাইরে। অথচ সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, দিন-রাত্রি এবং সূর্যোগ্রহণ-চন্দ্রগ্রহণ যে হয় পৃথিবীর আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতির ফলে সেটা বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে অকাট্যভাবে এবং বিজ্ঞানের দৌলতেই মহাকাশ বিজ্ঞানীরা এখন অনায়াসে বলে দিতে পারে পৃথিবীর কোন প্রান্তে কখন (ক’টার সময়) সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত এবং সূর্যোগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ হবে নিঃখুতভাবে যে পৃথিবীর কোন প্রান্তে কখন (ক'টার সময়) সূর্যদয় ও সূর্যাস্ত এবং সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ হবে। বৃষ্টি-বন্যা-খরা ও ঝড়-তুফানও হয় নাকি আল্লাহর হুকুমে। কোরান আরও বলেছে ঝড়-বৃষ্টি-তুফান হবে তা একমাত্র আল্লাহই জানে আর মানুষের পক্ষে এসবের হদিশ পাওয়া সম্ভব নয়। এগুলো সবই যে স্রেফ নির্জলা মিথ্যা দাবি এবং এই প্রাকৃতিক ঘটনাগুলো কেন ও কীভাবে হয় তা নির্ভুলভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়েই আবহাওয়াবিদরা এখন ঝড়-বৃষ্টি-তুফানের আগাম পূর্বাভাষ দিতে পারে। ভূমিকম্প সম্পর্কে কোরানের আজগুবি তত্ত্বকেও নির্মমভাবে নস্যাৎ করে দিয়ে বিজ্ঞান কেন ভূমিকম্প হয় তার রহস্য নিঃখুতভাবে উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছে। সমুদ্রের গভীরে ভূমিকম্প হলে সুনামি হয় সেটাও মানুষ জেনেছে বিজ্ঞানের কাছ থেকেই। আরও অনেক বিষয় আছে সে সব ক্ষেত্রেও কোরান সহ সমস্ত ধর্মগ্রন্থের সকল বুজরুকির ধূম্রজাল ছিন্ন করে বিজ্ঞান মানুষের সামনে আসল সত্যটা তুলে ধরে মানবসমাজের সীমাহীন উপকার করেছে। পৃথিবীর সমস্ত ধর্মের ভিত্তি হলো বিশ্বাস। মানুষের এই সহজ সরল বিশ্বাসকে ধর্মপ্রবর্তক ও ধর্মপ্রচারকরা নির্মমভাবে শোষণ করে মানুষকে করে তুলেছে ধীরে ধীরে অন্ধবিশ্বাসী যা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে মানবসমাজ ও মানবসভ্যতার। ধর্মই মানুষের মধ্যে বর্ণবিভেদ, জাতিবিভেদ ও লিঙ্গবিভেদ সৃষ্টি করেছে। ধর্মের কারণেই মানুষ একে অপরের বিরুদ্ধে অবিশ্বাস ও ঘৃণা করতে শিখেছে, মানুষ হিংসা করতে এবং হিংস্র ও অমানবিক হতে শিখেছে। যুক্তিবাদী দর্শন ও যুক্তিবাদীরা বিশ্বাসের মূলে কঠরভাবে ভাবে আঘাত হেনেছে এবং মানুষকে শিখিয়েছে প্রশ্ন করতে। যুক্তিবাদী দর্শনই ঈশ্বরের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছে এবং বিজ্ঞানের জ্ঞান ও যুক্তির শাণিত তরবারি দিয়ে মানুষকে ঈশ্বরবিশ্বাসের ইস্পাতসম শক্ত বর্মকে (আবরণকে) ফালা ফালা করে কেটে মুক্ত করেছে। কোরান-সহ সমস্ত ধর্মগ্রন্থগুলি যদি তথাকথিত ঈশ্বরের সৃষ্টি হয় তবে একটার সঙ্গে আর একটার অমিল ও বৈপরিত্য থাকে কেমনে – এই বৈধ প্রশ্ন তুলেছে যুক্তিবাদীরা। কোরান যদি আল্লাহর সৃষ্টি হয় তাহলে আল্লাহ কেন সরল ও সৎ পথ দেখানোর জন্যে প্রার্থনা করে (কোরানের ফাতেহা সুরা দেখুন)? আল্লাহ কার কাছে প্রার্থনা করে, আল্লাহরও আল্লাহ আছে নাকি? আল্লাহ নাকি নিরাকার। তাহলে মানুষ কীভাবে সাক্ষ্য দেয় যে মুহাম্মদ আল্লাহর রসুল (এটা আজানের মধ্যে রয়েছে)? আল্লাহর হুকুমে যদি ঝড়-বৃষ্টি, চন্দ্রগ্রহণ-সূর্যগ্রহণ ইত্যাদি হয় তবে মানুষ এগুলি সম্পর্কে আগাম খবর দেয় কেমন করে – এ প্রশ্নগুলি তুলেছে যুক্তিবাদীরা। আল্লাহর নবীর (দূতের) পক্ষে কি বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ ও দত্তক-পুত্রবধূকে বিবাহ ইত্যাদি অশুভ কাজগুলি সম্পন্ন করা শোভা পায় – এ প্রশ্ন তুলে যুক্তিবাদীরা ঈশ্বর ও ঈশ্বরের নবীতত্ত্বকে (theory of prophet-কে) প্রশ্নের মুখে খাড়া করে দিয়েছে। এ রকম হাজারো প্রশ্ন তুলে যুক্তিবাদীরা ঈশ্বররবিশ্বাসী ও ধর্মবিশ্বাসিদের নাস্তানাবুদ করেছে এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব এবং ঈশ্বরের দূত (নবী) ও ঈশ্বরের সৃষ্টি পবিত্র ধর্মগ্রন্থের তত্ত্বকে অবাস্তব ও ভুয়া বলে প্রমাণ করেছে। মানুষের বিশ্বাস ও সংস্কারকে ছিন্নভিন্ন করে মানুষকে যুক্তিবাদী করেছে ও করে যাচ্ছে যুক্তিবাদীরা। তাই তো ঈশ্বরবিশ্বাসী ও ধর্মবিশ্বাসীদের মহাশত্রু ও জাতশত্রু বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীরা এবং দর্শন ও যুক্তিবাদীরা।
ধর্মপ্রবর্তক, ধর্মপ্রচারক ও ধর্মবিশ্বাসীরা যেমন মিথ্যাচারিতায় তুলনাহীন, দ্বিচারিতাতেও তাদের তুলনা কেবল তারাই। ধর্মবিশ্বাসীরা অবশ্য অনেকেই অজ্ঞতাবশে এই অপকর্মগুলি করে। কীরূপ মিথ্যাচারিতা করে অনেকগুলি দৃষ্টান্ত ওপরে আলোচনা করা হয়েছে। এখন দ্বিচারিতার দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। ধর্মপ্রবর্তক ও ধর্মগুরুরা যে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী দর্শনের বিরুদ্ধে গোঁড়া থেকেই খড়্গহস্ত ছিল সে কথা শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সনস্ত ধর্মের ধর্মগুরু ও লেখক-বুদ্ধিজীবীরা এখন দাবি করেন যে তাদের নিজেদের নিজ ধর্মসমূহ ও ধর্মগ্রন্থগুলির ভিত্তিই হলো বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ। যেমন মুসলিম ধর্মগুরু ও লেখক-বুদ্ধিজীবীরা দাবি করে যে ইসলাম হলো একটি বৈজ্ঞানিক ধর্ম, খোদ আল্লাহ একজন বিজ্ঞানী, আল্লাহর নবী হলেন পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী এবং তাদের ধর্মগ্রন্থ কোরান একটা মহা বিজ্ঞানগ্রন্থ। বিজ্ঞান ও যুক্তবাদের সঙ্গে শত্রুতা করবো, তাদের সমস্ত পথ রুদ্ধ করার চেষ্টা করবো, আবার নিজেদের ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের উপই প্রতিষ্ঠিত বলে দাবিও করবো, এগুলো দ্বিচারিতা নয়? এখন প্রশ্ন হলো জীবনভোর বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী দর্শনের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারিতা করে এসে তারা দ্বিচারিতার আশ্রয় নিচ্ছে কেন? এর কারণ হলো বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের প্রতি মানুষের আস্থা, বিশ্বাস ও নির্ভরতা অপ্রতিরোধ্য গতিতে ক্রমবর্ধমান। ইউরোপের অধিকাংশ মানুষ ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থগুলোকে আবর্জনাস্বরূপ বর্জন করেছে। এশিয়া ও অন্যান্য মহাদেশেও ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থ অপেক্ষা বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের প্রতি মানুষের আস্থা, বিশ্বাস ও ভরসা বাড়ছে ও তা ক্রমবর্ধমান। যারা ঈশ্বরবিশ্বাসী তারাও এখন বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদকে সম্পূর্ণ অস্বীকার ও অগ্রাহ্য করতে পারে না, বরং ধর্মগুরু অপেক্ষা চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতিই তাদের বিশ্বাস ও নির্ভরতা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই ধর্মগুরু আর ঈশ্বরবিশ্বাসীরা প্রকাশ্যে বিজ্ঞান ও দর্শনের বিরোধিতা ত্যাগ করেছে। শুধু তাইই নয়, তারা বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী দর্শনকে আশ্রয় করেই তাদের ঈশ্বর ও ধর্মকে রক্ষা করতে চায়ছে। তাই তাদের দ্বিচারিতার আশ্রয় নেওয়া ছাড়া গতি নেই।
প্রবন্ধের গোঁড়াতেই বলা কথাটা আবার বলতে হচ্ছে যে ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাসীদের মহাশত্রু, বলা ভালো, জাতশত্রু হলো বিজ্ঞান ও দর্শন। হবেই না বা কেন। বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীরা এবং যুক্তিবাদী দর্শন ও যুক্তিবাদীরাই তো সমস্ত ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাসীদের সকল অসত্য, অর্ধসত্য, অসততা ও প্রতারণাগুলো উন্মোচন করে দিয়েছে নির্মমভাবে। ধরা যাক ইসলাম ধর্মেরই কথা। ইসলামের প্রধান ধর্মগ্রন্থ কোরান বিশ্ব-মহাবিশ্ব, আকাশ-মহাকাশ, সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, দিন-রাত্রি, বৃষ্টি-বন্যা-খরা, আহ্নিক গতি–বার্ষিক গতি, ঝড়-তুফান, ভূমিকম্প-সুনামি, প্রাণের সৃষ্টি, ইত্যাদি প্রসঙ্গে যা যা বলেছে তার সবটাই যে ভিত্তিহীন, আজগুবি ও মিথ্যেই ঠাসা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বিজ্ঞানী ও যুক্তিবাদীরা। কোরান বলেছে বিশ্ব ও মহাবিশ্ব আল্লাহ সৃষ্টি করেছে সাত দিনে। এই সৃষ্টি তত্ত্ব যে একটা মস্ত বড়ো ধোঁকাবাজি তা মানুষ বুঝেছে বিজ্ঞানের দৌলতে। কোরান বলেছে আল্লাহর কুদরতে আমাদের মাথার উপর সাতটা আকাশ রয়েছে বিনা স্তম্ভেই। এই তত্ত্বটি যে ধর্ম প্রবর্তক ও প্রচারকের বুজরুকি সেটা ফাঁস করে দিয়ে বিজ্ঞান মানুষকে জানিয়েছে, মহাকাশ মানে অন্তহীন মহাশূন্য, মহাকাশের পুরোটাই ফাঁকা। কোরান বলে, সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, দিন-রাত্রি এবং সূর্যোগ্রহণ-চন্দ্রগ্রহণ হয় আল্লাহর হুকুমে (নির্দেশে)। এর রহস্য উন্মোচন করা মানুষের সাধ্যের বাইরে। অথচ সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, দিন-রাত্রি এবং সূর্যোগ্রহণ-চন্দ্রগ্রহণ যে হয় পৃথিবীর আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতির ফলে সেটা বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে অকাট্যভাবে এবং বিজ্ঞানের দৌলতেই মহাকাশ বিজ্ঞানীরা এখন অনায়াসে বলে দিতে পারে পৃথিবীর কোন প্রান্তে কখন (ক’টার সময়) সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত এবং সূর্যোগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ হবে নিঃখুতভাবে যে পৃথিবীর কোন প্রান্তে কখন (ক'টার সময়) সূর্যদয় ও সূর্যাস্ত এবং সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ হবে। বৃষ্টি-বন্যা-খরা ও ঝড়-তুফানও হয় নাকি আল্লাহর হুকুমে। কোরান আরও বলেছে ঝড়-বৃষ্টি-তুফান হবে তা একমাত্র আল্লাহই জানে আর মানুষের পক্ষে এসবের হদিশ পাওয়া সম্ভব নয়। এগুলো সবই যে স্রেফ নির্জলা মিথ্যা দাবি এবং এই প্রাকৃতিক ঘটনাগুলো কেন ও কীভাবে হয় তা নির্ভুলভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়েই আবহাওয়াবিদরা এখন ঝড়-বৃষ্টি-তুফানের আগাম পূর্বাভাষ দিতে পারে। ভূমিকম্প সম্পর্কে কোরানের আজগুবি তত্ত্বকেও নির্মমভাবে নস্যাৎ করে দিয়ে বিজ্ঞান কেন ভূমিকম্প হয় তার রহস্য নিঃখুতভাবে উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছে। সমুদ্রের গভীরে ভূমিকম্প হলে সুনামি হয় সেটাও মানুষ জেনেছে বিজ্ঞানের কাছ থেকেই। আরও অনেক বিষয় আছে সে সব ক্ষেত্রেও কোরান সহ সমস্ত ধর্মগ্রন্থের সকল বুজরুকির ধূম্রজাল ছিন্ন করে বিজ্ঞান মানুষের সামনে আসল সত্যটা তুলে ধরে মানবসমাজের সীমাহীন উপকার করেছে। পৃথিবীর সমস্ত ধর্মের ভিত্তি হলো বিশ্বাস। মানুষের এই সহজ সরল বিশ্বাসকে ধর্মপ্রবর্তক ও ধর্মপ্রচারকরা নির্মমভাবে শোষণ করে মানুষকে করে তুলেছে ধীরে ধীরে অন্ধবিশ্বাসী যা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে মানবসমাজ ও মানবসভ্যতার। ধর্মই মানুষের মধ্যে বর্ণবিভেদ, জাতিবিভেদ ও লিঙ্গবিভেদ সৃষ্টি করেছে। ধর্মের কারণেই মানুষ একে অপরের বিরুদ্ধে অবিশ্বাস ও ঘৃণা করতে শিখেছে, মানুষ হিংসা করতে এবং হিংস্র ও অমানবিক হতে শিখেছে। যুক্তিবাদী দর্শন ও যুক্তিবাদীরা বিশ্বাসের মূলে কঠরভাবে ভাবে আঘাত হেনেছে এবং মানুষকে শিখিয়েছে প্রশ্ন করতে। যুক্তিবাদী দর্শনই ঈশ্বরের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছে এবং বিজ্ঞানের জ্ঞান ও যুক্তির শাণিত তরবারি দিয়ে মানুষকে ঈশ্বরবিশ্বাসের ইস্পাতসম শক্ত বর্মকে (আবরণকে) ফালা ফালা করে কেটে মুক্ত করেছে। কোরান-সহ সমস্ত ধর্মগ্রন্থগুলি যদি তথাকথিত ঈশ্বরের সৃষ্টি হয় তবে একটার সঙ্গে আর একটার অমিল ও বৈপরিত্য থাকে কেমনে – এই বৈধ প্রশ্ন তুলেছে যুক্তিবাদীরা। কোরান যদি আল্লাহর সৃষ্টি হয় তাহলে আল্লাহ কেন সরল ও সৎ পথ দেখানোর জন্যে প্রার্থনা করে (কোরানের ফাতেহা সুরা দেখুন)? আল্লাহ কার কাছে প্রার্থনা করে, আল্লাহরও আল্লাহ আছে নাকি? আল্লাহ নাকি নিরাকার। তাহলে মানুষ কীভাবে সাক্ষ্য দেয় যে মুহাম্মদ আল্লাহর রসুল (এটা আজানের মধ্যে রয়েছে)? আল্লাহর হুকুমে যদি ঝড়-বৃষ্টি, চন্দ্রগ্রহণ-সূর্যগ্রহণ ইত্যাদি হয় তবে মানুষ এগুলি সম্পর্কে আগাম খবর দেয় কেমন করে – এ প্রশ্নগুলি তুলেছে যুক্তিবাদীরা। আল্লাহর নবীর (দূতের) পক্ষে কি বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ ও দত্তক-পুত্রবধূকে বিবাহ ইত্যাদি অশুভ কাজগুলি সম্পন্ন করা শোভা পায় – এ প্রশ্ন তুলে যুক্তিবাদীরা ঈশ্বর ও ঈশ্বরের নবীতত্ত্বকে (theory of prophet-কে) প্রশ্নের মুখে খাড়া করে দিয়েছে। এ রকম হাজারো প্রশ্ন তুলে যুক্তিবাদীরা ঈশ্বররবিশ্বাসী ও ধর্মবিশ্বাসিদের নাস্তানাবুদ করেছে এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব এবং ঈশ্বরের দূত (নবী) ও ঈশ্বরের সৃষ্টি পবিত্র ধর্মগ্রন্থের তত্ত্বকে অবাস্তব ও ভুয়া বলে প্রমাণ করেছে। মানুষের বিশ্বাস ও সংস্কারকে ছিন্নভিন্ন করে মানুষকে যুক্তিবাদী করেছে ও করে যাচ্ছে যুক্তিবাদীরা। তাই তো ঈশ্বরবিশ্বাসী ও ধর্মবিশ্বাসীদের মহাশত্রু ও জাতশত্রু বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীরা এবং দর্শন ও যুক্তিবাদীরা।
ধর্মপ্রবর্তক, ধর্মপ্রচারক ও ধর্মবিশ্বাসীরা যেমন মিথ্যাচারিতায় তুলনাহীন, দ্বিচারিতাতেও তাদের তুলনা কেবল তারাই। ধর্মবিশ্বাসীরা অবশ্য অনেকেই অজ্ঞতাবশে এই অপকর্মগুলি করে। কীরূপ মিথ্যাচারিতা করে অনেকগুলি দৃষ্টান্ত ওপরে আলোচনা করা হয়েছে। এখন দ্বিচারিতার দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। ধর্মপ্রবর্তক ও ধর্মগুরুরা যে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী দর্শনের বিরুদ্ধে গোঁড়া থেকেই খড়্গহস্ত ছিল সে কথা শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সনস্ত ধর্মের ধর্মগুরু ও লেখক-বুদ্ধিজীবীরা এখন দাবি করেন যে তাদের নিজেদের নিজ ধর্মসমূহ ও ধর্মগ্রন্থগুলির ভিত্তিই হলো বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ। যেমন মুসলিম ধর্মগুরু ও লেখক-বুদ্ধিজীবীরা দাবি করে যে ইসলাম হলো একটি বৈজ্ঞানিক ধর্ম, খোদ আল্লাহ একজন বিজ্ঞানী, আল্লাহর নবী হলেন পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী এবং তাদের ধর্মগ্রন্থ কোরান একটা মহা বিজ্ঞানগ্রন্থ। বিজ্ঞান ও যুক্তবাদের সঙ্গে শত্রুতা করবো, তাদের সমস্ত পথ রুদ্ধ করার চেষ্টা করবো, আবার নিজেদের ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের উপই প্রতিষ্ঠিত বলে দাবিও করবো, এগুলো দ্বিচারিতা নয়? এখন প্রশ্ন হলো জীবনভোর বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী দর্শনের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারিতা করে এসে তারা দ্বিচারিতার আশ্রয় নিচ্ছে কেন? এর কারণ হলো বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের প্রতি মানুষের আস্থা, বিশ্বাস ও নির্ভরতা অপ্রতিরোধ্য গতিতে ক্রমবর্ধমান। ইউরোপের অধিকাংশ মানুষ ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থগুলোকে আবর্জনাস্বরূপ বর্জন করেছে। এশিয়া ও অন্যান্য মহাদেশেও ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থ অপেক্ষা বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের প্রতি মানুষের আস্থা, বিশ্বাস ও ভরসা বাড়ছে ও তা ক্রমবর্ধমান। যারা ঈশ্বরবিশ্বাসী তারাও এখন বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদকে সম্পূর্ণ অস্বীকার ও অগ্রাহ্য করতে পারে না, বরং ধর্মগুরু অপেক্ষা চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতিই তাদের বিশ্বাস ও নির্ভরতা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই ধর্মগুরু আর ঈশ্বরবিশ্বাসীরা প্রকাশ্যে বিজ্ঞান ও দর্শনের বিরোধিতা ত্যাগ করেছে। শুধু তাইই নয়, তারা বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী দর্শনকে আশ্রয় করেই তাদের ঈশ্বর ও ধর্মকে রক্ষা করতে চায়ছে। তাই তাদের দ্বিচারিতার আশ্রয় নেওয়া ছাড়া গতি নেই।
পরিশেষে
রমজানের রোযা প্রসঙ্গে ফিরে আসি। একমাস ধরে রোযা রাখা যে মানুষের স্বাস্থ্যের পক্ষে
ক্ষতিকর ও একটি সম্পূর্ণ অবাস্তব ও অবৈজ্ঞানিক প্রথা তা নিয়ে তথ্য ও যুক্তি সহকারে
ওপরে আলোচনা করা হয়েছে। এটা এখন মুসলিমরাও ব্যাপক সংখ্যায় উপলব্ধি করছে। ফলে রোযার
প্রতি তাদের আগ্রহ ক্রমশঃ কমছে। ফলশ্রুতিতে রোযা রাখা মানুষের সংখ্যা ক্রমশঃ হ্রাস
পাচ্ছে। আমি যেখানে বাস করি সেখানে আমার চোখ যতদূর যায় দেখতে পাই যে পুরুষরা ১০/১৫
শতাংশের বেশী রোযা রাখে না। অনেককেই দেখা যায় যে সোৎসাহে ও স্বতস্ফূর্তভাবে রোযা রাখা
শুরু করেও মাঝপথে ছেড়ে দেয়। গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহের মধ্যে ১২/১৪ ঘণ্টা নির্জলা উপবাস
থাকার ফলে শরীরে জলের প্রচণ্ড ঘাটতি ও তীব্র ক্ষুধার ক্লান্তিতে তাদের উৎসাহ ও স্বতস্ফূর্ততা
কর্পূরের মতন উবে যায় এবং হাড়ে হাড়ে টের পায় যে রমজান মাসব্যাপী রোযা রাখা একটা চরম
অবাস্তব ও সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক প্রথা। এই উপলব্ধি আগামী দিনেও বৃদ্ধি পেতে থাকবে। তাই
এখন মুসলিম ধর্মগুরু ও লেখক-বুদ্ধিজীবীদের বিজ্ঞানের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। বলতে হচ্ছে
একমাস রোযা রাখা একটা বিজ্ঞানসম্মত ব্যাপার এবং রোযা রাখলে মানুষ নীরোগ হবে, সুস্বাস্থ্যের
অধিকারী হবে। বিজ্ঞানের দোহায় দিয়েই তারা মুসলমানদের কাছে রমজানের রোযাকে জনপ্রিয় করার
অপচেষ্টা করছে। ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থকে বিজ্ঞানসম্মত বলেই তারা থেমে থাকে না। তারা তাদের
ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থগুলিকে বিজ্ঞানের ওপরে স্থাপন করতেও কম কসুর করে না। তারা এ রকম আজগুবি
করতেও স্বিধা করে না যে বিজ্ঞানের সকল সূত্র লুকিয়ে রয়েছে ধর্মগ্রন্থের মধ্যে এবং বিজ্ঞানীরা
তাদের সমস্ত আবিষ্কারের সূত্র চুরি করেছে ঐ ধর্মগ্রন্থ থেকেই। মুসলিম ধর্মগুরু ও লেখক-বুদ্ধিজীবীরা এগুলো অন্যদের চেয়ে
একটু বেশীই করে। এরই ধারাবাহিকতায় মুসলিম ডাক্তারদেরও বলতে শোনা যাচ্ছে যে শরীরকে মেদহীন
করে রোগমুক্ত রাখতে খাদ্য গ্রহণ করার ফাঁকে ফাঁকে লম্বা লম্বা বিরতি দেওয়ার যে পরামর্শ
আজ বিজ্ঞান দিচ্ছে সেটা কোরান চৌদ্দশ’ বছর আগেই বলেছে। এতো ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থকে বিজ্ঞানের
সমকক্ষ করে তোলার মরিয়া প্রয়াসই শুধু নয়, এতো বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে বিজ্ঞানের কাঁধে
চেপে ছড়ি ঘোরানোর নতো ব্যাপার।
সমাপ্ত