Friday, January 24, 2020

৭১তম প্রজাতন্ত্র দিবসে আমাদের সংবিধানটাই ধ্বংসের মুখে

"আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র রুপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠাার সঙ্গে শপথ গ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে: সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা, মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদ, আজ, ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।"
আমাদের (ভারতের) সংবিধান গৃহীত হয় ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারি। ২৬শে জানুয়ারি তাই ভারতবাসীর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। তাই ভারতে প্রতি বছর প্রজাতন্ত্র দিবস হিসাবে মহাসমারোহে উদযাপিত হয়। আগামীকালও হবে। কাল আমাদের ৭১তম প্রজাতন্ত্র  দিবস। এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন (ভয়ংকর ও বীভৎস) চেহারা নিয়ে দিনটি আমাদের সামনে উপস্থিত হচ্ছে। তা নিয়েই এই লেখার অবতারণা।

লেখার শুরুতেই যে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে সেটা আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনা (preamble)। সংবিধানটি গৃহীত হবার পর সত্তরটি বছর অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে কোনো সরকারই প্রস্তাবনায় উচ্চারিত শপথ ও অঙ্গীকার অনুযায়ী কাজ করে নি। ফলে সকল নাগরিক সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার পায় নি; চিন্তা, মতপ্রকাশ, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা পায় নি; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা কোথাও হয় নি; সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে ওঠে নি। বরং তার বিপরীতটাই হয়েছে। ফলে সমাজের সর্বস্তরে স্থান করে নিয়েছে স্থায়ীভাবে ন্যায়বিচারের বদলে অবিচার, অন্যায় বিচার; দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার; সমতার স্থলে বৈষম্য ও বঞ্চনা ইত্যাদি ইত্যাদি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বদলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ এবং গণতন্ত্রের সম্প্রসারণের বদলে উত্তরোত্তর সংকোচন ও রাষ্ট্রের দমনপীড়নের বৃদ্ধি সমাজ ও রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকলের কাজের বদলে কর্মহীনতা ও বেকারি বৃদ্ধি, ধনী-গরীবের বৈষম্য কমার বদলে ক্রমাগত বৈষম্য বৃদ্ধি, দারিদ্র্য দূরীকরণের বদলে দারিদ্র্য বৃদ্ধি, এগুলো আমাদের অঙ্গের ভূষণে পরিণত হয়েছে। এ রকম আরো কতো বৈপরিত্য রয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। তাই প্রজাতন্ত্র দিবসটিকে আমার প্রজাতন্ত্র দিবস মনে হয় না। কী মনে হয় তা এর আগে ২০১৫ সালে ব্যক্ত করেছি আমার ব্লগে। তার লিংক হলো www.giasuddinonline.blogspot.in.

এই বৈপরিত্য আমাকে চমকায় না। বুর্জোয়া সরকারগুলোর শাসনে এগুলোই স্বাভাবিক পরিণতি। ওরা মুখে যা বলে এবং সংবিধানে যা লেখে তার বিপরীতেই কাজ করে। এতেও কোনো অস্বাভাবিকতা আমি দেখি না। বুর্জোয়াদের সরকার তো তাদের নিজেদের (বুর্জোয়াদের) জন্যেই কাজ করবে। এমন কোনো যাদু (অর্থনীতি) নেই ওদের কাছে যা দিয়ে ওদের পক্ষে একই সঙ্গে তারা বুর্জোয়া শ্রেণী ও খেটে খাওয়া শ্রেণী তথা শোষিত শ্রেণীর স্বার্থে কাজ করা সম্ভব। কারণ, এই শ্রেণীদুটি তো পরষ্পর বিপরীত মেরুর। দ্বিতীয় শ্রেণীর জন্যে কিছু পদক্ষেপ তারা করে বটে, তবে তা তাদের চোখে ধূলো দেওয়ার জন্যে, তাদের আন্দোলনকে প্রশমিত করার জন্যে। তাদের এই মিথটা খাওয়ানোর জন্যে যে সরকারের (রাষ্ট্রের) শ্রেণী চরিত্র হয় না। রাষ্ট্র হয় নিরপেক্ষ এবং সবার।  বুর্জোয়া শ্রেণীর দলগুলো তাদের সরকারকে শ্রেণীনিরপেক্ষ দেখানোর জন্যে তাদের পরিচালিত সরকার তথা রাষ্ট্রের নামের আগে গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ইত্যাদি গালভরা শব্দগুলো বসিয়ে দেয়। যেমন আমাদের দেশের রাষ্ট্রের নাম দেওয়া হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। ব্যাস! তাতেই কেল্লা ফতে। আমরা বুঝে গিয়েছি যে আমাদের রাষ্ট্র শ্রেণীনিরপেক্ষ, রাষ্ট্রের চোখে আমরা সবাই সমান, সবার সমান অধিকার, বহু হাজার কোটি টাকার মালিক বৃহত পুঁজিপতি আম্বানির যেমন একটা ভোট আছে তেমনি নি:স্ব একজন ক্ষেতমজুরেরও আছে একটা ভোট। এটা যে স্রেফ ধাপ্পাবাজি, মানুষকে বোকা বানানোর জন্যে বানানো বুলি তা আজও আমরা বুঝে উঠতে পারি নি। ফলে বুর্জোয়া দলগুলি পাল্টাপাল্টি করে আরামসে তাদের সরকার তথা রাষ্ট্র পরিচালনা করে যাচ্ছে। তারই ফলশ্রুতিতে ধনী আরও ধনী হচ্ছে, ধনী-গরীবের ব্যবধান ক্রমশ বাড়ছে, বেড়ে চলেছে দ্রব্যমূল্য, বেকারি, কর্মহীনতা, ইত্যাদি ইত্যাদি। স্বভাবতই দেশের অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক সংকট, সাংস্কৃতিক সংকট, সামাজিক সংকট দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে।
বিজেপির সরকারের শাসনে গত ছ'বছরে এগুলো আরো বেড়েছে। সর্বস্তরে দ্বন্দ্ব ও সংকটও সমানে বাড়ছে, ঘনীভূত হচ্ছে, বেসামাল হয়ে উঠছে। এর মধ্যেও অস্বাভাবিকতা অনুসন্ধান করার কিছু নেই। কারণ বিজেপির শ্রেণী চরিত্র অন্য রকম নয়। এই দলটাও বুর্জোয়া শ্রেণীর দাসানুদাস। গণতান্ত্রিক যুগে বুর্জোয়ারা অনেক রাজনৈতিক দলকে লালনপালন করে। তাদের কোনো দলের প্রতি জনগণ যখন ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, তার প্রতি আস্থা হারায় তখন তাদের অন্য একটা দলকে তারা সামনে এগিয়ে দেয়। কংগ্রেসের দীর্ঘ শাসনে মানুষ ক্রমাগত যখন ক্ষোভ বেড়েছে তখন তারা জনগণের সামনে কংগ্রেসের বিকল্প হিসাবে বিজেপিকে এগিয়ে দিয়েছে। শ্রেণী অসচেতন মানুষ তাকেই ভোট দিয়ে সরকারে বসিয়েছে। ফলে সরকারের বদল হলেও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মৌলিক নীতির কোনো বদল হয় নি। ফলে কোনো ক্ষেত্রেই সংকট কমে নি, বরং আরও বেড়েছে, তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও শ্রীলঙ্কারও পেছনে নেমে গেছে। নেমে গেছে গণতন্ত্রের পরিসরের ক্ষেত্রে দশ ধাপ নীচে।
আমাদের স্বাধীনতার বয়স ৭২ পেরিয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে রাষ্ট্রের ক্ষমতায় মোদি সরকারের আগে ৩/৪টি রাজনৈতিক দলের সরকার, তাদের দলীয় জোটের সরকার আমরা দেখেছি। এমনকি বিজেপির নেতৃত্বাধীন দলীয় জোটেরও সরকারও দেখেছি যার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বিজেপির নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী। বলা বাহুল্য যে সবগুলো সরকারই ছিল বুর্জোয়া সরকার। বাজপেয়ীর সরকার সহ আগের সেই সরকারগুলোকে আমরা কিন্তু কখনো এখনকার মোদি সরকারের মতন দৈত্য দানবের চেহারায় দেখি নি। আমাদের সংবিধান সম্পর্কে যা কিছুই প্রচার হোক না কেন, সংবিধানটি কিন্তু মোটেই শ্রেণীনিরপেক্ষ নয়, প্রধানত এটা বুর্জোয়াদের স্বার্থ রক্ষাকারী সংবিধান। তৎসত্ত্বেও এই সংবিধানে অন্যান্য সকল শ্রেণীর জন্যেও কিছু না কিছু সুযোগ সুবিধা রাখা হয়েছে। পূর্বতন সরকারগুলো মাঝে মাঝেই স্বৈরতান্ত্রিক পদক্ষেপ করেছে, কিন্তু তাই বলে তারা কখনোই চরিত্রগতভাবে স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ছিল না, ছিল বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সরকার। আমাদের দেশের রাষ্ট্র সম্পর্কে যতই ভালো ভালো কথা শুনি না কেন, রাষ্ট্রটি হলো বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ফলে আমাদের দেশের গণতন্ত্রও বুর্জোয়া গণতন্ত্র যে গণতন্ত্র সকলের জন্যে উন্মুক্ত নয়। তাই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণকে দেওয়া হয় খুবই সীমিত ও খণ্ডিত গণতন্ত্র। আমাদের জন্যে অর্থাৎ জনগণের জন্যে আমাদের সংবিধানেও তাই সীমিত ও খণ্ডিত গণতন্ত্রটুকুই দেওয়া হয়েছে। প্রাক-মোদি জমানায় মাঝে মাঝেই সংবিধান প্রদত্ত সীমিত ও খণ্ডিত গণতন্ত্রটুকুকেও খর্ব করা হয়েছে, মতপ্রকাশের খণ্ডিত স্বাধীনতা ও সুযোগকে খর্ব করা হয়েছে। কিন্তু কোনো সরকার কখনও গণতন্ত্রকে হত্যা করে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে নি। মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপির সরকারের কাজকর্মে সেটা করার ঝোঁক প্রকটিত হচ্ছে। আমাদের দেশ বহু ভাষা, বহু ধর্ম, বহু জাতি-উপজাতি ও বহু সংস্কৃতির দেশ। তাই এ দেশ পরিচালিত হয় যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতিতে। এই নীতি ও কাঠামো অতীতে শক্তিশালী কেন্দ্র তৈরি করার অজুহাতে বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে, অঙ্গরাজ্যগুলোর ক্ষমতা খর্বিত হয়েছে। কিন্তু কখনও যুুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি ও কাঠামো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার প্রবণতা প্রকটিত হয় নি যা পরিলক্ষিত হচ্ছে মোদি সরকাররের মধ্যে। এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি বিশেষ ক্ষমতা ও অধিকার প্রাপ্ত অঙ্গরাজ্য জম্মু-কাশ্মীরকে দ্বিখণ্ডিত করে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে রূপান্তরিত করার নজিরবিহীন পদক্ষেপে।
আমাদের দেশটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ বলে পরিচিত। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ভারত একটি 'সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র' ('Socialist Secular Democratic Republic')। কিন্তু আমাদের দেশ ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকৃত অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ নয়। সেটাই প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র যে রাষ্ট্র বা সরকার ধর্ম বিষয়ে সদা নিরপেক্ষ থাকবে এবং সকল ধর্ম থেকে সমান দুরত্ব বজায় রাখবে। সরকার কোনো ধর্মের প্রতি কোনোরূপ পক্ষপাতিত্ব করবে না, এবং কোনো ধর্মের প্রতি বৈষম্যও করবে না। ধর্মবিশ্বাসীদের প্রত্যেকের ধর্মাচরণ করার সমান অধিকার সুনিশ্চিত করবে, কিন্তু ধর্মাচরণের অধিকারের নামে কাউকে সংবিধানের পরিপন্থী যে কোনো কাজ কঠোর হাতে দমন করবে। ধর্মীয় কোনো বিধান বা রীতিনীতি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে তাকে নিষিদ্ধ করে দেশের নিজস্ব সংবিধানকেই রক্ষা করবে। রাষ্ট্র কারো ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচরণে হস্তক্ষেপ করবে না, তবে কেউ তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস রাষ্ট্রের উপর চাপাতে চেষ্টা করলে সেটাও কঠোরভাবে দমন করবে। যারা নাস্তিক কিংবা সংশয়বাদী, রাষ্ট্র তাদের ধর্ম বিশ্বাস না করা ও ধর্মাচরণ না করার সম্পূর্ণ অধিকার প্রদান করবে, এবং সমাজ যদি তাদের সেই অধিকার খর্ব বা হরণ করার চেষ্টা করে তবে রাষ্ট্র অধিকার হরণকারীদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করবে। আমাদের দেশে কোনো সরকারই এই নীতিমালা অনুসরণ করে না, আমাদের সংবিধানও রাষ্ট্রকে এগুলো অনুসরণ করার নির্দেশ দেয় নি। বরং উল্টে আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ধর্মনিরপেক্ষ বলতে ধর্ম সমন্বয় মনে করেন। সেজন্য আমি এই অনুচ্ছেদর শুরুতেই বলেছি যে আমাদের দেশটি প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ নয়।
আমাদের সংবিধানে শিক্ষা, চাকরি, শিল্প, ব্যবসা প্রভৃতি ক্ষেত্রগুলিতে সব ধর্মের মানুষেরই সুযোগ ও অধিকার রয়েছে। সব ধর্মের মানুষেরই নিজ নিজ ধর্ম পালন করার স্বাধীনতা রয়েছে। সংবিধানে সবারই নিজ নিজ ধর্ম প্রচার করার অধিকার রয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংখালঘুদের ধর্মাচরণে বাধা দেওয়া বা হস্তক্ষেপ করাও বেআইনী করেছে। সংবিধানে নাগরিকদের ধর্ম বিশ্বাস না করা কিংবা ধর্ম পালন না করার অধিকারও রয়েছে।
সম্ভবত এজন্যেই আমাদের দেশে বিশ্বের দরবারে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। দেশের ভিতরেও সেই পরিচিত রয়েছে।  কিন্তু কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলো সর্বদা এই নীতিগুলো কখনোই সঠিকভাবে অনুসরণ করে না। কিন্তু তাই বলে কোনো সরকারই (মোদি সরকারের আগে পর্যন্ত) আমাদের সংবিধানে সীমিত আকারে হলেও যেটুকু ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ, নীতি ও বিধান রয়েছে তাকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে নি বা করতে উদ্যত হয় নি।  আমাদের দেশের এই আবহমান ঐতিহ্য (Tradition) এবার কিন্তু বিপন্নতার মুখে পড়েছে মোদি সরকারের হাতে।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে কেন্দ্রের ক্ষমতায় বিজেপি আসার পর থেকেই সংখ্যালঘুদের উপর, বিশেষ করে মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের উপর, হামলা করা শুরু হয়েছে। পরে অবশ্য কৌশলগত কারণে হামলা কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে শুধু মুসলমানদের উপর। এ হামলা কিন্তু শুধু আক্রোশ বশত স্বত:স্ফুর্ত হামলা নয়। এর পেছনে রয়েছে সুনির্দিষ্ট ও সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য ও পরিকল্পনা। তা হলো ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানো যেখানে  সংখ্যালঘুরা কেউ থাকবে না, স্বল্প সংখ্যক থাকলেও তারা হিন্দুদের অধীনতা স্বীকার করে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকবে। এর প্রতিবাদ করে আমি একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখি ২০১৫ সালে 'ভারতে ভাগবত-মোদির নেতৃত্বে হিন্দুত্বের অভিযান চলছে' শিরোনামে। প্রবন্ধটি হালনাগাদ (updated) করি ২০১৮ সালে (https://giasuddinonline.blogspot.com/2018/05/blog-post_29.html?m=1) প্রবন্ধটি অনেকেই পড়েছেন, তবু লিংকটি দিলাম যারা পড়েন নি তাদের জন্যে। ভারত থেকে মূলত মুসলমানদের তাড়ানোর জন্যে বিজেপি এনআরসিকে (জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকে) হাতিয়ার করে। আসামে যখন এনআরসি তৈরি করার জন্যে চুক্তি হয় তার পেছনে কোনো ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক দুরভিসন্ধি ছিল না। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সমস্ত অনুপ্রবেশকারীকে চিহ্নিত করে আসাম ও ভারত থেকে তাড়িয়ে দেওয়া তার উদ্দেশ্য ছিল।
কিন্তু বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরই এনআরসিকে তাক করে মুসলমানদের দিকে।তারা আসামে বসবাসকারী মুসলমানদের অনুপ্রবেশকারী তকমা দিয়ে এ দেশ থেকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার জন্যে এনআরসিকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫০ লক্ষ (পঞ্চাশ লক্ষ) মুসলমানকে বাংলাদেশী তকমা দিয়ে ভারত থেকে বিতাড়িত করা। কিন্তু গতবছর ৩১শে আগষ্ট প্রকাশিত এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা দেখে তারা ঘাবড়ে যায়। কারণ, তাতে বাদ পড়া ঊনিশ লক্ষ মানুষের মধ্যে ১৬ (ষোল) লক্ষই অমুসলিম এবং অধিকাংশই হিন্দু, আর মুসলমান মাত্র তিন লক্ষ। তখন আসাামের বিজেপি সরকার ও তাদের দল দুটি দাবি উত্থাপন করে - এক). এনআরসি তালিকাটি বাতিল করতে হবে, কারণ ওটা ভুলে ভর্তি। এবং দুই). পুনরায় একটি নতুন তালিকা তৈরি করতে হবে। সেই দাবিকে সমর্থন জানিয়ে বিজেপির তৎকালীন সভাপতি ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঘোষণা দেন যে ভারতের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে নাগরিকহীন হয়ে যাওয়া হিন্দুদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং যতদিন না ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনটির সংশোধন হচ্ছে ততদিন কোথাও এনআরসি তৈরি করা হবে না।
তারপর তড়িঘড়ি কেন্দ্রীয় সরকার তার ঘোষণা মত সেই আইনটি সংশোধন করে নতুন নাগরিকত্ব আইন তৈরি করে (নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯, CAA 2019)। এই আইনের কাজ হল জাতীয় নাগরিক পঞ্জি থেকে যে সকল অমুসলমানদের নাম, বিশেষ করে হিন্দুদের নাম, বাদ যাবে তাদের পুনরায় ভারতের নাগরিকত্ব প্রদান করা। সুতরাং এনআরসি ও সিএএ-র মূল উদ্দেশ্য পরিষ্কার। উদ্দেশ্যটি হল কোটি কোটি ভারতীয় মুসলমানকে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী তকমা দিয়ে ভারত থেকে তাড়ানো। এই সিএএ ও এনআরসির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে আমার একটি লেখা আছে যার লিংকটি হলো  https://giasuddinonline.blogspot.com/2019/12/blog-post.html?m=1

সিএএ ও এনআরসি-র জন্যে স্বভাবতই এ দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাহীন ভয় ও আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। হবারই তো কথা। কারণ, বিজেপি সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যে মুসলিমরা এই দেশে (ভারতে) স্বাধীনতার বহু আগে থেকেই বসবাস করছে তাদেরও নির্বাসিত করতে। হ্যাঁ, বিজেপি সরকার যে সেটাই চায় তা সংশয়াতীত। ভারত ভাগের সময় ওদের পূর্বসূরীদের (আরএসএস ও হিন্দু মহাসভা) দাবি ছিল পাকিস্তান যদি মুসলমানদের জন্যে তৈরি হয় তবে ভারত হবে শুধু হিন্দুদের দেশ। তারই ভিত্তিতে ভারত ভাগের পর ওরা দাবি করেছিল যে হিন্দু ও মুসলমানদের যথাক্রমে ভারতে ও পাকিস্তানে বিনিময় করতে হবে। অর্থাৎ ভারতের ভাগে যে মুসলমানরা পড়েছে তারা যদি পাকিস্তান না যায় তবে তাদের জোর করে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিতে হবে এবং পাকিস্তানের ভাগে পড়া হিন্দুদের ভারতে নিয়ে আসতে হবে। বিজেপি তো আরএসএস ও হিন্দু মহাসভার উত্তরসূরী। স্বভাবতই তারাও সেই তত্ত্বেরই অনুসারী। আরএসএস ও হিন্দু মহাসভার দাবি সেদিন প্রত্যাখ্যাত হলেও সেই দাবি বা তত্ত্ব তারা কখনোই ত্যাগ করে নি। সেই তত্ত্ব তো মনে প্রাণে লালনপালন করে বিজেপিও। মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার এখন সেই তত্ত্বই বাস্তবায়িত করতে তৎপর হয়ে উঠেছে। স্বভাবতই এবারের প্রজাতন্ত্র দিবসেও মুসলিমরা ভয় ও আতঙ্ক থেকে বেরোতে পারছে না।

আতঙ্ক ঢুকেছে হিন্দুদের মধ্যেও। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র হিন্দুরা ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। আসামের এনআরসি তালিকা থেকে তারা বুঝেছে যে তাদেরও নিস্তার নেই। তাদের নাম যদি ঐ তালিকায় না ওঠে তবে তারা নাগরিকত্ব পুনরায় পাবে কিনা তা নিয়ে তাদের ঘোর সংশয় রয়েছে। আর নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়ার বিষয়টা তো পরের কথা, তার আগে তো তাদের তুলে নিয়ে গিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি করা হবে।
আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে এ দেশের প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের মনেও। কারণ, আইনটি তো শুধু সাম্প্রদায়িক আইনই নয়, আইনটি যে সংবিধানবিরুদ্ধও। বিজেপির সরকারের অভিসন্ধি তো স্পষ্ট।  তাদের লক্ষ্য হলো ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র ধ্বংস করে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানিয়ে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করা।
তাই এবারের প্রজাতন্ত্র দিবসে আরএসএস, বিজেপি ও সঙ্ঘপরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ছাড়া আর কেউ স্বস্তিতে নেই, আনন্দে ও উচ্ছ্বাসে নেই।
              -----      --------        ------- 

(বি:দ্র: ব্লগটি লিখেছি ২৫শে জানুয়ারি। কিন্তু ব্লগের শিরোনামের নীচে দেখাচ্ছে ২৪শে জানুয়ারি। এটা কেন দেখাচ্ছে জানি না)

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...