কোটা সংস্কারের আন্দোলনের প্রথম পর্বে যা দেখেছি ও বুঝেছি –
শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলন ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান হয়ে ওঠার পর্যায়ের কিছু কথা
রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস যত বেড়েছে ছাত্রদের আন্দোলন তত উত্তাল হয়েছে। তবে ১৬ই জুলাই পুলিশের গুলিতে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের মৃত্যু যেন আগুনে ঘি ঢালে। ফলে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনও সেই পর্যায়ে সহিংস হয়ে ওঠে। পুলিশের উপর পালটা আক্রমণ, মেট্র রেল, বাংলাদেশ টিভি স্টেশন, প্রভৃতি বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানে আগ্নি সংযোগের ঘটনাসহ লুটপাটের ঘটনা ঘটে। আন্দোলন যেমন যেমন তীব্র হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সাথে যোগ দিয়েছে ডান বাম নির্বিশেষে সমস্ত ছাত্র সংগঠনের কর্মী এবং রাজনৈতিক দলের কর্মীরা। যোগ দেয় গর্ত থেকে বেরিয়ে আসা মুসলিম মৌলবাদী ও জঙ্গী সংগঠনের কর্মীরা। সাধারণত তারাই পুলিশকে হত্যাসহ ধ্বংসাত্মক ও হিংসাত্মক কাজে লিপ্ত হয়। সেই পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা কিছুটা কৌশল পরিবর্তন করে শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনকে বাগে আনার চেষ্টা করে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী কার্যক্রম জারি রেখেও আন্দোলনের নেতৃত্বকে তাঁর সরকারী বাসভবনে (গণভবনে) ডেকে আলোচনার প্রস্তাব পাঠান। কোটা পুনঃপ্রবর্তনের আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করবে বলে জানান। আন্দোলনের নেতৃত্বের আস্থা অর্জনের জন্যে সরকারের পক্ষ থেকে আপীলও করেন। আবার তারই পাশাপাশি মুখ্য সংগঠকদের আটক করে, আয়না ঘরে গুম করে রেখে, তাদের উপর নির্মমভাবে মানসিক ও শারিরীক নির্যাতন চালান। সে অবস্থায় তাদের অর্থ ও ক্ষমতার প্রলোভনও দেখানো হয়। তবে একটা পর্যায়ে ব্যাপক গণবিক্ষোভের ফলে তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
গণবিক্ষোভের সেই উত্তাল পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ আদালত হাই কোর্টের কোটা পুনর্বহালের রায় খারিজ করে দেয়। শেখ হাসিনা তখন সর্বোচ্চ আদালতের রায় মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেন এবং ছাত্র আন্দোলন সমাপ্ত করার আহ্বান জানান। শিক্ষার্থীরা সেই আহ্বানকে ফিরিয়ে দিয়ে সরকারের কাছে ন’দফা দাবী পেশ করে এবং সেগুলো সরকার যতক্ষণ না মানছে ততক্ষণ তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সঙ্কল্প ঘোষণা করে। সেই দাবিগুলোর মধ্যে প্রধান কয়টি দাবি ছিল এ রকমঃ ছাত্র-নাগরিকদের হত্যার দায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে, ছাত্র ও জনতা হত্যার দায় নিয়ে পদত্যাগ করতে হবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সড়ক পরিবহন মন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, তথ্য প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ ও এ আরাফাতকে পদত্যাগ করতে হবে, যেখানে যেখানে ছাত্র ও নাগরকদের হত্যা করা হয়েছে সেখানকার ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার ও পুলিশ সুপারদের বরখাস্ত করতে হবে, বাংলাদেশের যে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী সশস্ত্র হামলা করেছে সেই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও প্রক্টরদের পদত্যাগ করতে হবে, যে সব পুলিশ, র্যাব ও সেনা সদস্যরা শিক্ষার্থীদের উপর গুলি করেছে, যে সকল নির্বাহী মেজিস্ট্রেট গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে হবে এবং দ্রুততম সময়ে গ্রেপ্তার করতে হবে, দেশব্যাপী যে সকল ছাত্র ও নাগরিক নিহত ও আহত হয়েছে তাদের পরিবারকে অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
বলা বাহুল্য যে, শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো মানতে অস্বীকার করেন যদিও বলেন যে তিনি যে গুলি চালানোর সকল ঘটনার তদন্ত করে যারা দোষী তাদের বিচার করা হবে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রীর সেই আশ্বাসে ভরসা রাখেনি। আমারও মনে হয়নি যে শেখ হাসিনার কথায় বা আশ্বাসে তখন ভরসা রাখার সামান্যতম কোনো অবশিষ্ট ছিল। কারণ, তখনও হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও নাগরিকদের নিহত ও আহত হওয়ার ঘটনায় তিনি একবার ভুলে করেও দুঃখ প্রকাশ পর্যন্ত করেননি, তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া তো দূরের কথা। ঘুরিয়ে যারা পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে ও গুরুতরভাবে আহত হয়েছে তাদের বিরুদ্ধেই পুলিশ হত্যা ও সরকারী সম্পত্তি ধ্বংসের যথেচ্ছ মামলা দিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সন্তানসম শিক্ষার্থীরা যারা হাসপাতালের বেডে বা মেঝেয় পড়ে থেকে যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে তাদের কাছে আগে না গিয়ে শেখ হাসিনা ছুটে গিয়েছেন কোথায় কোথায় সরকারী সম্পত্তি নষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তা দেখতে এবং তা দেখে ক্যামেরার সামনে লোক দেখানো অশ্রু বিসর্জন করে আহত নিহত শিক্ষার্থীদের জঙ্গী ও সন্ত্রাসী তকমা দিয়ে তাদের কঠোর শাস্তি দিবেন বলে বজ্রকণ্ঠে হুঁঙ্কার ছেড়েছেন। এরূপ পরিস্থিতিতে ছাত্রদের সামনে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য বিকল্প ছিল ন। ফলত তারা ঘোষণা দেয় যে যতক্ষণ না তাদের সকল দাবী মানা হবে ততক্ষণ তারা রাজপথ ছেড়ে যাবে না।
শেখ হাসিনার হুঙ্কারকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে তারা আন্দোলনকে আরও তীব্র করেছে। সেই পর্যায়ে তারা নতুন নতুন আগুন ঝরা শ্লোগান এবং কর্মসূচী দিয়েছে যে কথা ইতিমধ্যেই আলোচনা করেছি। সেই সময়ের শ্লোগানগুলো প্রমাণ করে যে হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ ও ক্রোধ কত তীব্র হয়ে আকার ধারণ করেছিলো এবং সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ না করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য যে কোনো মূল্য চুকাতে তারা প্রস্তুত ছিল।
৩৬ দিনের এই আন্দোলনের শেষ তিন সপ্তাহে তৈরি হয়েছে নতুন নতুন স্লোগান, বদলেছে দাবির ভাষাও। ‘আমি কে তুমি কে, রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’—এর মতো শ্লেষের প্রতিবাদ একপর্যায়ে রূপ নেয় সরকার পতনের এক দফা এক দাবিতে। এক দুই তিন চার, শেখ হাসিনা গদি ছাড় - এর মতন বজ্রকঠিন কিছু স্লোগান ওঠে। মাঝের তিন সপ্তাহে যে সব স্লোগান শোনা গিয়েছিল - ‘চাইলাম অধিকার হয়ে, হয়ে গেলাম রাজাকার’; ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’, দালালি না রাজপথ, রাজপথ ইত্যাদি। ১৬ই জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ। এর পর থেকেই স্লোগান শুরু হয়, ‘আমার খায়, আমার পরে, আমার বুকেই গুলি করে’; ‘তোর কোটা তুই নে, আমার ভাই ফিরিয়ে দে’; ‘বন্দুকের নলের সাথে ঝাঁজালো বুকের সংলাপ হয় না’ এবং ‘লাশের ভেতর জীবন দে, নইলে গদি ছাইড়া দে’—এসব স্লোগান। এই শ্লোগানগুলির শব্দ চয়ন বুঝিয়ে দেয় শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে জড়িয়ে ছিল প্রাণ হারানোর কত যন্ত্রণা। সেই সময় পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছিল দ্রুতলয়ে আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন স্লোগান। ২রা আগষ্ট রাজধানীর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দেয় - 'আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই'; ‘একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে ওঠো আরেকবার’; ‘যে হাত গুলি করে, সে হাত ভেঙে দাও’ এবং ‘অ্যাকশন অ্যাকশন ডাইরেক্ট অ্যাকশন’। ৩রা আগষ্ট ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ থেকে শোনা যায়, ‘আমার ভাই কবরে, খুনিরা কেন বাইরে’; ‘আমার ভাই জেলে কেন’ এবং ‘গুলি করে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না। সায়েন্স ল্যাব মোড়ে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিল থেকে শোনা যায়, ‘জাস্টিস জাস্টিস, উই ওয়ান্ট জাস্টিস’; ‘জ্বালো রে জ্বালো, আগুন জ্বালো’ এবং ‘দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেব রক্ত’;—এর মতো স্লোগানগুলো। রিক্সাওয়ালারাও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে একাত্ম হয়ে ৩রা আগষ্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে শ্লোগান দেয়, ‘গুলি করে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না’; ‘রক্তের বন্যায়, ভেসে যাবে অন্যায়’; ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার’ এবং ‘আমার ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না’ ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে বেশি সাড়া ফেলেছিল এই শ্লোগানটি – ‘বুকের ভিতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’।
শ্লোগান লেখা ছিল প্ল্যাকার্ডেও। ‘অনাস্থা অনাস্থা, স্বৈরতন্ত্রে অনাস্থা’; ‘চেয়ে দেখ এই চোখের আগুন, এই ফাগুনেই হবে দ্বিগুণ’; ‘তবে তাই হোক বেশ, জনগণই দেখে নিক এর শেষ’; ‘আমরা আম-জনতা, কম বুঝি ক্ষমতা’; ‘তোমারে বধিবে যে গোকূলে বাড়িছে সে’; ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’; ‘হাল ছেড় না বন্ধু বরং কণ্ঠ ছাড় জোরে’; ‘ফাইট ফর ইওর রাইটস’; ‘নিউটন বোমা বোঝো মানুষ বোঝো না’ লেখার মতো শ্লেষাত্মক প্ল্যাকার্ডও ছিল হাতে হাতে।
এমন তীব্র গণবিক্ষোভেও শেখ হাসিনার শুভবুদ্ধির উদয় না হলে শিক্ষার্থীরা ৩রা আগষ্ট ৯ দফা দাবি ছেড়ে এক দফা দাবি তথা হাসিনার পদত্যাগের দাবি তোলে এবং দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন ও ঢাকায় লং মার্চের ডাক দেয়। সে সময় তাদের শ্লোগান ছিল – ‘দফা এক দাবি এক, হাসিনার পদত্যাগ’ এবং ‘এক দফা এক দাবি, হাসিনা তুই কবে যাবি’। প্রথমে ৬ই মার্চ ঢাকায় লং মার্চের ডাক দেয়, পরে একদিন এগিয়ে নিয়ে এসে সেটা ৫ই মার্চ করে। তারপরের যা হয়েছে তাতো ইতিহাস, এক ভয়ংকর স্বৈরাচারী নারী প্রধানমন্ত্রীর পতন হয়েছে, বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে ইতিহাসের এক বিরল অধ্যায়ে প্রবেশ করে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা তাঁর সরকারকে উৎখাত করার জামায়াতি ইসলামী ও মুসলিম জঙ্গি সংগঠনগুলোর একটা গভীর ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ তুলেছিলেন তাকে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় নি। কারণ, প্রথমত কোটা সংস্কারের দাবি ছিল অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত যে দাবি না মেনে শেখ হাসিনা দমন করার চেষ্টা করেছেন তাঁর দলীয় গুণ্ডাবাহিনী ও রাষ্ট্রশক্তির সাহায্যে নির্মমভাবে। দ্বিতীয়ত ৩৬ দিনের রক্তক্ষয়ী গণবিক্ষোভে লক্ষ লক্ষ ছাত্র ও নাগরিক পথে নেমেছিলো স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে ও মাথায় বেঁধে, মুসলিম জঙ্গিদের কলেমা লেখা কালো পতাকা তেমন চোখে পড়েনি বললেই চলে, ‘আল্লাহো আকবর’, ‘নারায়ে তকবির’, এসব ইসলামী শ্লোগান শোনা যায় নি, শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে ছিল বাংলা ভাষার কবিদের লেখা দেশপ্রেমের গান ও কবিতা, একাত্তরকে স্মরণ করে শ্লোগান দিয়েছে ‘একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে ওঠো আরেকবার’, ধর্মীয় বিভেদসহ সকল বিভেদ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় শ্লোগান ‘আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’। ক্রমশ ...
No comments:
Post a Comment