মেয়েদের ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করে দিলো জেলা প্রশাসন
মুসলিম মৌলবীদের চাপে ।
মৌলবিদের সঙ্গে থাকা স্থানীয় মানুষজনের
মধ্যে ছিল তৃণমূল কংগ্রেসের পঞ্চায়েত সদস্য ও দলীয় কর্মীরাও । মালদহ জেলার হরিশচন্দ্র
পুরের চণ্ডীপুরে ‘প্রগ্রেসিভ ইয়ুথ ক্লাব’ পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি মহিলা
ফুটবল খেলার আয়োজন করেছিলো । জাতীয় মহিলা দলে খেলা কিছু খেলোয়ার নিয়ে গড়া কলকাতা
একাদশ ও উত্তরবঙ্গ একাদশের মধ্যে খেলা হওয়ার কথা ছিলো । মৌলবিদের বক্তব্য হলো যে আঁটোসাঁটো স্বল্প পোশাক পরে মেয়েদের যে কোনো খেলা এবং পুরুষদের সেই খেলা দেখা দুটোই
শরিয়তবিরোধী , কারণ ঐ পোশাকে মেয়েদের শরীরের অনেক অঙ্গই দৃশ্যমান হয় ।
ক্লাবের সদস্যদের অধিকাংশই মুসলিম
সম্প্রদায়ের যারা মহিলাদের মধ্যে ফুটবল খেলায় আগ্রহ বাড়ানোর জন্যে মহিলা তারকা
ফুটবলারদের নিয়ে এই প্রদর্শনী খেলাটির আয়োজন করেছিলো । ক্লাবের সভাপতি রেজা রাজী
আক্ষেপ করে বলেছেন, প্রশাসন এভাবে অশুভ
শক্তির কাছে মাথা নত করলো, ভাবতেই পারছি না । তবে ক্লাবের সদস্যরা
মোল্লাদের ফতোয়াদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের রাস্তায় যায় নি বলে খবরে প্রকাশ ।
মুসলিম ধর্মগুরুদের
ফতোয়ার কাছে এ দেশের জাতীয় সরকার এবং এ রাজ্যের সরকারগুলির আত্মসমর্পণ করার ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটে চলেছে । তাই এসব খবর
আমাকে ব্যথিত করে ঠিকই, কিন্তু আর অবাক করে না । ১৯৮৫ সালে ধর্মগুরুরা
তালাকপ্রাপ্তা মুসলিম মেয়েদের খোরপোষের অনুকূলে দেওয়া সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে শরিয়তবিরোধী বলে ফতোয়া দিয়ে তা বাতিল করার দাবীতে যখন পথে নেমেছিলো, তখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী তাদের
দাবি মেনে একটি খোরপোষবিরোধী আইন প্রণয়ন করেছিলেন । কেন্দ্রীয়
সরকার দত্তক আইন প্রণয়ন করলে মুসলিম ধর্মিয় নেতারা তা শরিয়তবিরোধী বলে ফতোয়া দিয়ে
দাবি জানিয়েছিল যে মুসলমানদের এই আইনের বাইরে রাখতে হবে । কেন্দ্রীয় সরকার সে দাবি
পূরণ করতে বিলম্ব করে নি । মেদিনীপুর শহরে তসলিমার একটি কবিতা পড়ার অনুষ্ঠান
বাতিলের দাবি জানিয়েছিলো এই ধর্মগুরুরা । বলেছিল তসলিমা মেদিনীপুর শহরে ঢুকলে
রক্তগঙ্গা বইবে । একবার শিলিগুড়ি বইমেলা উদ্বোধনের কথা ছিলো
তসলিমার । সেবারও তসলিমা শিলিগুড়ি শহরে প্রবেশ করলে রক্তগঙ্গা বইবে বলে
হুমকি দিয়েছিলো । দুটো ঘটনার ক্ষেত্রেই তৎকালীন বাম সরকার মোল্লাদের কাছে হাঁটু
গেড়ে আত্মসমর্পণ করেছিলো । আর ফতোয়াবাজদের দাবিতেই তো শেষ পর্যন্ত বামফ্রণ্ট সরকার
তসলিমাকে কলকাতা থেকে নির্বাসিত করতেও দ্বিধা করে নি । আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে মুসলিম ছাত্র সংগঠন ফতোয়া দিয়েছিলো যে প্রত্যেক ছাত্রী ও মহিলা শিক্ষককে বোরখা পরতে
হবে । এই ফতোয়ার প্রতিবাদ যারা করেছিলে
তাঁদের পাশে না দাঁড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্ত্তৃপক্ষ ও বাম সরকার ফতোয়াবাজদের পাশেই দাঁড়িয়েছিলো । কাশ্মীরের মুসলিম ধর্মগুরুরা সেখানকার দু’জন
মুসলিম তরুণী গায়িকার উপর ফতোয়া জারি করে বলেছিলো যে তারা যদি গান বন্ধ
না করে তবে তাদের প্রকাশ্যেই হত্যা করা হবে । সরকার মেয়ে দুটির নিরাপত্তা না দিয়ে ঘুরিয়ে তাদেরকেই গান করবে না বলে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিতে বাধ্য
করেছিলো । এমন ঘটনা যে কতো ঘটেছে তার ইয়ত্তা নেই । এ দেশে এটাই দস্তুর যে মুসলিম মৌলবাদিরা ফতোয়া
দেবে আর সরকার সেটাই পালন করবে । তাই
উলামার র কাছে সরকারের নতজানু হওয়ার
ঘটনাগুলো আমাকে উদ্বিগ্ন করলেও
বিস্মিত করে না । কিন্তু মালদহ জেলার চণ্ডিপুরের ঘটনা আমাকে চরম বিস্মিত করেছে ।
শুধু বিস্মিতই নয়, আমাকে স্তম্ভিতও করেছে
।
এতদিন পর্যন্ত উলামা
প্রদত্ত সমস্ত ফতোয়ার একটা সাধারণ বৈশিষ্ট
ছিল । তাদের ফতোয়ার শিকার হয়েছে হয়
মুসলিমরা, নয়তো মুসলিম সমাজের যুক্তিবাদী
মানুষরা । কিন্তু মোল্লা-মুফতিরা এবার
তাদের লক্ষণরেখা অতিক্রম করার দুঃসাহস দেখিয়েছে । তারা শুধু মুসলিম মেয়েদের ফুটবল
খেলার উপর কিংবা শুধু মুসলিম সমাজের উপরেই মেয়েদের ফুটবল খেলা দেখার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার ফতোয়া জারি করে নি, ফতোয়া জারি করেছে গোটা সমাজের উপরেই । তাদের এই দুঃসাহসটাই আমাকে স্তম্ভিত করেছে ।
এবার আমার জানতে ইচ্ছা করে অমুসলিম সমাজের বুদ্ধিজীবী ও বিদ্বজনেরা কী বলেন । তাঁরা তো বলেন যে মুসলিম সমাজে ধর্মগুরুদের ফতোয়া সন্ত্রাসের
বিষয়টি মুসলমানদের নিজেদের সমস্যা এবং সেক্ষেত্রে
তাঁদের কোনো দায়-দায়িত্ব নেই, মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা মুসলমানদেরই মোকাবিলা করতে হবে ।
চণ্ডিপুরের উক্ত ফতোয়া
আফগানিস্তানের তালিবানি যুগের কথা আমাদের স্মরণ করাচ্ছে । তালিবানরা শুধু মেয়েদের খেলাধূলা নয়, পুরুষদেরও খেলাধুলা বন্ধ করে
দিয়েছিলো । বন্ধ করে দিয়েছিলো গান-বাজনা, সিনেমা-থিয়েটার, চিত্র অঙ্কনও । সমস্ত স্টেডিয়াম, সাংস্কৃতিক
কেন্দ্র ও বিনোদনের জায়গুলিতে তালা মেরে দিয়েছিলো । বন্ধ করে দিয়েছিল টিভি সেণ্টারও । মেয়েদের
পুরুষদের সঙ্গ ছাড়া ঘরের বাইরে পা ফেলা এবং পুরুষ ডাক্তারের কাছে নারীর চিকিৎসা
নেয়া নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলো । পুরুষসঙ্গহীন নারীকে রাস্তায় দেখলে
প্রকাশ্যেই চাবুক মারতো । কোনো নারী পুরুষ ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিয়েছে খবর পেলে
তার হাত-পা’র রগ কেটে তাকে হত্যা করতো । মালদহের মুসলিম ধর্মগুরুরা দেখছি তালিবানদের মতোই শরিয়তি শাসন প্রতিষ্ঠা করতে
চায়ছে । ভারতের মতো রাষ্ট্রে যেখানে মুসলিমরা অতিশয় সংখ্যালঘু সেখানে এ ধৃষ্টতা
দেখাবার দুঃসাহস তাদের হলো কি কীভাবে ? এটা কি নেহাতই
কতিপয় মূর্খ ধর্মগুরুর আগুনে হাত দেওয়ার মতো শিশুসুলভ দুঃসাহসিক অভিযান ? না কি এটা
একটা পরিকল্পিত দুঃসাহসিক মহড়ার ইঙ্গিত ?
নজিরবিহীন এই ফতোয়া দেখে এরূপ ধারণা যদি হয় যে, যেখানে যেখানে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানে
সেখানে তারা শরিয়িতি শাসন বলবৎ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে , তা হলে কী তা খুবই
অমূলক হবে ? এর উত্তর এখনই পাওয়া যাবে না,
তবে এটাকে হাল্কা করে দেখাও ঠিক হবে না । যদি তারা মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে শরিয়তি
শাসন চাপিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে তবে নিশ্চয় তারা মূর্খ । ধর্মান্ধদের
পক্ষে মূর্খের মতো পদক্ষেপ করা মোটেই অস্বাভাবিক ব্যাপার নয় । কিন্তু আমাদের এটাও
ভেবে দেখা দরকার যে তাদের মূর্খের স্বর্গে বিচরণ করার কারণ কি শুধুই ধর্মান্ধতা,
না কি অন্য কোনো কারণও আছে ?
স্বাধীনোত্তর যুগে ডান-বাম সমস্ত দলের সরকারগুলি সীমাহীন ভাবে মোল্লাতোষণ
[মুসলিম তোষণ নয়] করে চলেছে । ফলে মোল্লা-মুফতিরা নেতা-মন্ত্রীদের নাকে দড়ি বেঁধে যেদিকে ঘুরতে বলেছে সেদিকেই তাঁরা দাসানুদাসের মতো
ঘুরেছেন । নেতা-মন্ত্রীদের এই নির্লজ্জ
ভুমিকা তাদের আশ্বস্ত করেছে যে তারা যাই-ই করুক তাদেরকে অন্ততঃ আইনের আওতায় আনা
হবে না । মোল্লাতোষণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী নগ্ন ও ন্যক্কারজনক ভূমিকা পালন করে
চলেছেন তৃণমূলের সরকার ও তার সুপ্রীমো মমতা ব্যানার্জি । তিনি মোল্লাদের হুকুম
মেনে আদালতের রায়কে নস্যাত করে অসাংবিধানিক ভাবেই ইমাম-ভাতা ও মোয়াজ্জিন-ভাতা দিয়ে
যাচ্ছেন । এক হাজার খারিজি মাদ্রাসার অনুমোদন দিয়েছেন । নতুন হজ হাউস নির্মাণ করেছেন
। ভারতের নিষিদ্ধ সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি সংগঠন সিমির প্রতিষ্ঠাতা আহমেদ হাসান ইমরানকে
রাজ্যসভার সাংসদ করেছেন । ভারত ও বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার জলবণ্টন চুক্তি রূপায়ণ
আটকে দিয়েছেন । বাংলাদেশের জঙ্গিরা এ রাজ্যের মাটিতে নিশ্চিন্তে ঘাঁটি তৈরী করতে
পেরেছে । খাগড়াগড় বিষ্ফোরণ কাণ্ডের পর অনায়াসে
বাংলাদেশের জঙ্গিরা ঘটনাস্থল থেকে
পালিয়ে যেতে পেরেছিলো । খাগড়াগড় বিষ্ফোরণ কাণ্ডকে মোল্লা-মুফত-ইমামরা বিজেপির
সাজান ঘটনা বলে একদিকে বিনা বাধায় তারস্বরে চিৎকার করেছে যখন তখন মুখ্যমন্ত্রী
তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলছেন যে খাগড়াগড়ের পেছনে মুসলিম জঙ্গিরা নয়, ‘র’-এর হাত
আছে । তাঁর এই ভূমিকা মুসলিম ধর্মগুরুদের মুসলিম অধ্যুষিত
অঞ্চলে শরিয়তি শাসন চাপিয়ে দেয়ার অলীক স্বপ্ন দেখতে
ও মূর্খের স্বর্গে বিচরণ করতে অনেকটাই
উৎসাহ জুগিয়েছে ও প্ররোচিত করেছে ।
তালিবানি ফতোয়ার কাছে
জেলা প্রশাসনের নতজানু হওয়ার ঘটনার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে । প্রথমতঃ মুসলিম
ধর্মগুরু ও ধর্মান্ধ মুসলিমদের দুঃসাহস অনেকটাই বাড়বে এবং এর পর অন্যান্য মুসলিম
অধ্যুষিত অঞ্চলেও এরূপ তালিবানি ফতোয়া জারি হতে পারে । এর ফলে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সম্প্রীতির যে
আবহ আছে তা প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে ।
দ্বিতীয়তঃ এরূপ ঘটনা ঘটতে থাকলে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হবে মুসলিমরা ।
কারণ, তাদের উপর ফতোয়া-সন্ত্রাসের মাত্রা বহুগুণ বাড়বে । তৃতীয়তঃ মুসলিম সমাজের
বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী মানুষ যাঁরা মুসলিম সমাজের সংস্কারের কথা বলেন ও সেই
উদ্দেশ্যে লেখালেখি করেন তাঁদের উপর হুমকি ও আক্রমণ আরো তীব্র হবে । এবং চতুর্থতঃ হিন্দু
সম্প্রদায়ের মধ্যে অসন্তোষ ও ক্ষোভের সঞ্চার করবে যা হিন্দুত্ববাদীদের হাতকে শক্তিশালি করতে
ভীষণভাবেই সাহায্য করবে ।
ইসলামি ফতোয়ায় একটা
রাজ্য স্তরের ফুটবল খেলা বন্ধ হয়ে গেল – এটা তো একটা অশনি সংকেত আমাদের গণতন্ত্র ও
ধর্মনিরপেক্ষতার উপর । তথাপি কোনো দিক
থেকে কোনো প্রতিবাদ চোখে পড়ছে না ।
হিন্দুত্ববাদীরা ছাড়া সবাই নিশ্চুপ ও নির্বিকার । না মোল্লা-মুফতিদের
বিরুদ্ধে নিন্দা ও প্রতিবাদ শোনা যাচ্ছে, না শোনা যাচ্ছে প্রশাসন ও সরকারের
বিরুদ্ধে । একদা প্রতিবাদী রাজ্যটা এখন একটা কাপুরুষোচিত নির্বিবাদী ডরফুক রাজ্যে পরিণত
হয়েছে । নজরুল, সুকান্ত, বিনয়, বাদল, দীনেশ, ক্ষুদিরাম ও সুভাষের বিদ্রোহী বাংলার
এই পরিণতি আমাকে যতটা বিস্মিত করে তার চেয়ে বেশী লজ্জিত করে ।
ধর্মীয় মৌলবাদের
বিরুদ্ধে সবাইকে জোটবদ্ধ হতে হবে তা সে যে ধর্মের মৌলবাদই হোক । তবে এ কথা
অনস্বীকার্য যে ইসলামি মৌলবাদ ক্রমশঃ বিপজ্জনক হয়ে উঠছে সারা বিশ্বে, এবং আমাদের
দেশেও । কিন্তু তাই বলে এর বিরুদ্ধে শুধু মুসলমানরাই প্রতিবাদ করবে এটা কোনো সৎ
যুক্তি হতে পারে না । তবে এটাও অনস্বীকার্য যে ইসলামি মৌলবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে
প্রধান ভূমিকা নিতে হবে মুসলিম সমাজের লোকদেরই । কিন্তু এখানেও সেই একই হতাশার চিত্র, কিছু কপট
প্রতিবাদ দেখা যায় ঠিকই, সত্যিকারের প্রতিবাদ একেবারেই চোখে পড়ে না । মুসলিম
বুদ্ধজিজীবিদের কপট প্রতিবাদের সেই ভাষা
বা কৈফিয়ত থাকে একই গতে বাঁধা – ইসলামি মৌলবাদীদের ফতোয়া বা সন্ত্রাসী কাজকর্মগুলো
অনৈসলামিক । এ ক্ষেত্রেও তাঁরা বলবেন
যে ইসলাম মহিলাদের খেলাধূলার বিরোধী নয়, বরং ইসলামই একমাত্র ধর্ম যে নারীকে
পুরুষের সমান অধিকার দিয়েছে এবং পুরুষের দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছে । তবে কেউ কেউ
আবার পাশ কাটিয়ে যাবেন এ কথা বলে যে শরিয়তে এমন ফতোয়ার বিধান আছে কি না জানা নেই ।
মেয়েদের ফুটবল খেলা ও সেই খেলা পুরুষদের দেখা শরিয়তবিরোধী বলে যে ফতোয়া জারি হয়েছে তার উপর মীরাতুন নাহার সে রকমই
কৌশলী একটি প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন ।
মুসলিম বুদ্ধিজীবী ও লেখক বলে যাঁদের পরিচিতি ও খ্যাতি আছে তাঁদের মধ্যে
মীরাতুন নাহার একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব । তিনি বলেছেন, “শরিয়তি আইনে এমন ফতোয়া আছে কি না, জানা নেই । শরিয়ত আইন কতটা শাস্ত্র সম্মত তা-ও
জানা নেই ।” তিনিই আবার পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন ধর্মগুরুদের উদ্দেশ্যে,
“কোরান তো বলছে যে নারী ও পুরুষ উভয়কে এমন পোশাক পরতে হবে যাতে ঔদ্ধত্য প্রকাশ না পায়
। কই, সে ফতোয়া তো তাঁরা মানেন না ।” মেয়েদের খোলা ময়দানে যে কোনো খেলাধূলাই যে
শরিয়তবিরোধী তা জানে না এমন অজ্ঞ মুসলমান খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না । অথচ মীরাতুন
নাহার বললেন যে মেয়েদের ফুটবেলা খেলা শরিয়তবিরোধী কী না জানেন না । তিনিই আবার শরিয়তের এই বিধানটা ভাল করেই জানেন
যে নারী ও পুরুষকে কীরূপ পোশাক পরতে হবে । এটা যে স্পষ্টতঃই দ্বিচারিতা তা পাগলেও
বোঝে । তিনি ধর্মগুরুদের দেওয়া
ফতোয়া নিয়ে অজ্ঞ সাজলেন এজন্যে যাতে
ইসলামের মুখ না পুড়ে, আর পোশাক নিয়ে যেচে শরিয়তি বিধানের বিষয়ে বিজ্ঞ সাজলেন
যাতে ইসলামের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল দেখায়। এটাই হলো প্রগতিশীল [!] মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ বৈশিষ্ট ।
এবার একটু চোখ বুলানো
যাক মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে শরিয়তি আইন কী বলছে । শরিয়তি আইনের প্রধান ভিত্তি হলো
কোরান । কোরানে এমন কোনো আয়াত পাওয়া যাবে না যাতে মেয়েদের ফুটবল খেলা নিয়ে সরাসরি কোনো
বিধান রয়েছে । এ সব ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে এই বিষয়গুলিতে কোরান ও হাদিসের আলোকে
ইসলামি বিধান প্রণয়ন করতে হবে যার ভার দেওয়া হয়েছে ধর্মগুরুদের উপর । কোরান ও
হাদিসের আলোকে যে ইসলামি বিধান প্রনণয়ন করা হয় তাকে ইসলামের পরিভাষায় ‘ইজমা’ বলে ।
শরিয়তি বিধানের চারটি উৎসের মধ্যে একটি হলো ‘ইজমা’ যা নিয়ে মুসলিম সমাজে মতান্তর
নেই । মেয়েদের ফুটবল খেলা, ক্রিকেট খেলা, টেনিস খেলা, ব্যাডমিন্টন খেলা প্রভৃতি
ময়দানের খেলাগুলি [outdoor game] ইজমার ভিত্তিতে সর্বসম্মতিতে শরিয়তবিরোধি বলে স্বীকৃত
হয়েছে ।
মেয়েদের ঘরের বাইরে খেলাগুলি যে ইসলামের পরিপন্থী তার স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে এমন
অনেক আয়াত আছে কোরানে । সেই আয়াতগুলির কয়েকটা এ রকম – “তোমরা [নারী] গৃহকোণে
স্থিতি করবে । পূর্বতন মূর্খতার সাজসজ্জার
ন্যায় সাজসজ্জা করবে না ।” [৩৩/৩৩]
“যখন তোমরা নবিপত্নীদের নিকট কিছু চাইবে তখন আড়াল থেকে চাইবে ।” [৩৩/৫৩] “হে নবি ! তুমি স্বীয় পত্নীদের, কন্যাদের এবং
মুমিনদের পত্নিদের বলো, তারা যেন তাদের মাথার
উপর চাদরের কিয়দংশ টেনে দেয় ।” [৩৩/৫৯] চাদর
দিয়ে মাথা ঢাকা পোশাককে ইসলামের পরিভাষায় বলে বোরখা । কোন কোন ক্ষেত্রে নারীর
বোরখা পরা শিথিল করা হয়েছে সে কথাও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে কোরান । কোরানের সেই ভাষ্যটি
এরূপঃ “পিতৃগণ, পুত্রগণ, ভ্রাতুষ্পুত্রগণ,
ভগ্নিপুত্রগণ, সেবিকাগণ এবং তাদের অধিকারভুক্ত দাসীগণের পর্দা পালন না করলে অপরাধ
নেই ।” [৩৩/৫৫] অর্থাৎ ঐরূপ নিকটাত্মীয় পুরুষ এবং দাসদাসী ব্যতীত যে কোনো পুরুষের
সামনে নারীর বোরখা পরা বাধ্যতামূলক ।
নারীর ফুটবল খেলা নিয়ে
প্রদত্ত ফতোয়াটিতে দুটি অংশ আছে । একটি অংশে নারীর ফুটবল খেলাকে শরিয়তবিরোধী বলা হয়েছে । আর একটা অংশে বলা
হয়েছে পুরুষদের সেই খেলা দেখা শরিয়তবিরোধী । ফতোয়ার এই দুটি অংশই যে শরিয়ত সম্মত
তা উপরের আয়াতগুলি থেকে অত্যন্ত স্পষ্ট । সুতরাং ফতোয়াটি যে সম্পূর্ণ শরিয়তসম্মত
তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই । এর পরেও প্রশ্ন উঠতে পারে যে, কোরানের উক্ত
আয়াতগুলিতো মুসলিমদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, তাহলে অমুসলিমদের উপর ফতোয়া দেয়া কি
অনৈসলামিক নয় ? না, অনৈসলামিক নয় । কারণ, ইসলাম
অন্যত্র বলেছে যে এ পৃথিবী আল্লাহর সৃষ্টি, তাই এই পৃথিবীতে বাস করতে হলে সবাইকে
আল্লাহর বিধান মানতে হবে ।
মুসলিম সমাজ এখনও
সবচেয়ে অনগ্রসর ও পশ্চাদপদ হয়ে রয়েছে এই শরিয়তি ফাঁসে আটকে থাকার জন্যে । এই ফাঁস
থেকে না বেরোতে পারলে মুসলিম সমাজ কোনোদিনই পশ্চাদপদতা কাটিয়ে প্রগতি, উন্নতি ও
অগ্রগতির পথে পা রাখতে পারবে না । আর তা করতে হলে মুসলিম সমাজের সংস্কার সাধন করা
একান্তই আবশ্যক । সমাজ সংস্কারের কাজে মুসলিমরা তখনই এগিয়ে আসবে যখন শরিয়তি আইনের
প্রতি তাদের অন্ধ মোহ কাটবে । সেই মোহ কাটানোর জন্যে শরিয়তি আইনের অন্ধকার ও
কুৎসিত দিকগুলো নির্মমভাবে উন্মোচন করতেই হবে । খুবই দুঃখজনক ঘটনা হলো এ কাজে
মুখ্য ভূমিকা নেয়ার দায়িত্ব যাদের সেই মুসলিম বুদ্ধজিজীবীগণ মুসলমানদের আরো বেশী
বেশি করে শরিয়ত আইনের প্রতি মোহগ্রস্ত করে তুলছেন ।