Thursday, July 14, 2022

তিউনিসিয়ার সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিদায় আসন্ন

 Create Custom Tunisia Map Chart with Online, Free Map Maker.

আগামী ২৫শে জুলাই তিউনিসিয়ায় অনুষ্ঠিত হতে চলেছে গণভোট। গণভোট হবে নতুন একটি সংবিধান গ্রহণ করার জন্যে। সংবিধান প্রণয়ন কমিটি ইতিমধ্যেই নতুন সংবিধানের খসড়া তিউনিসিয়ার রাষ্ট্রপতি কায়েস সায়েদের হাতে তুলে দিয়েছে। সে কথা নিশ্চিত করেছেন রাষ্ট্রপতি স্বয়ংনতুন সংবিধানটি ২০১৪ সালে  প্রণীত সংবিধানটির স্থান নেবে।  

রাষ্ট্রপতি কায়েস সায়েদ জানিয়েছেন যে নতুন সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকবে না। তিউনিসিয়া রাষ্ট্রের মালিক হবে তিউনিসিয়ার জনগণ যাদের ধর্ম ইসলাম। কেন সংবিধান থেকে রাষ্ট্রের ধর্ম পরিচয়কে মুছে দেওয়া হচ্ছে সে প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন যে, জাতি ও রাষ্ট্র দুটো ভিন্ন জিনিষ। অর্থাৎ মানুষের ধর্ম থাকতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম হয় না। এ কথাগুলি তিনি বলেছেন গত একুশে জুন টিউনিস বিমানবন্দরে সংবাদ সংস্থা এএফপিকে। তিনি ঠিক কী বলেছেন তা ‘দি হিন্দু’ পত্রিকা উদ্ধৃত করে লিখেছে,   

·         Tunisian President Kais Saied confirmed that "The next constitution of Tunisia won't mention a state with Islam as its religion, but of belonging to an umma (community) which has Islam as its religion," he told journalists at Tunis airport. ... "The umma and the state are two different things."  

(সূত্রঃ - https://www.thehindu.com/news/international/tunisias-saied-confirms-no-state-religion-in-new-charter/article65549523.ece)

 

সংবিধান প্রণয়ন কমিটির (ন্যাশনাল কনসালটিভে কমিশন) সমন্বায়ক সাদেক বিলায়েত নিউজ এজেন্সি এএফপিকে এ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন যে, সংবিধানে ইসলাম ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়ে যা যা আছে তার সব কিছুই মুছে ফেলা হবে। সাদেক বিলায়েতকে উদ্ধৃত করে এ প্রসঙ্গে  ‘দি হিন্দু’ লিখেছে, –

·         Sadeq Belaid, the legal expert who headed the drafting committee, had told AFP in an interview this month that he would remove all reference to Islam from the new document in a challenge to Islamist parties.  (সূত্রঃঐ)

তিউনিসিয়া হলো সেই রাষ্ট্র যেখানে ২০১১ সালে আরব বসন্তের (আরব ভূখণ্ডের বিভিন্ন প্রান্তে স্বৈরতান্ত্রিক শাসকদের বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহ) সূত্রপাত হয়েছিলো এবং পরে তা বিভিন্ন রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়েছিলো। আরব বসন্তের ধাক্কায় শাসন ক্ষমতায় পট পরিবর্তন হয়েছিলো আরবের কয়েকটি রাষ্ট্রে। পট পরিবর্তন হয়েছিলো তিউনিসিয়াতেও। দীর্ঘদিনের স্বৈরতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট জাইন আল আবিদিন বেন আলি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তারপর তিউনিসিয়াতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো একটা সীমিত স্তর পর্যন্ত গণতন্ত্র তাই তিউনিসিয়াকেই একমাত্র আরব বসন্তের সাফল্য হিসাবে দেখা হয়। কারণ, আরব বসন্তের মূল দাবি ছিলো স্বৈরতান্ত্রিক শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। আরব বসন্তের পর তিউনিসিয়ায় যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হয় তা হলো রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রাধীন সংসদীয় ব্যবস্থা। সেই ব্যবস্থায় সরাসরি রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচিত হয় জনগণের ভোটে। শুধু অবাধে ভোট দিয়ে রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচন করার অধিকারই সংবিধানে স্বীকৃত হয় নি, স্বীকৃতি পেয়েছিলো সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ-বিক্ষোভ দেখানোর অধিকারকেও।    

সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও তিউনিসিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতা তিউনিসিয়ার ছায়াসঙ্গী হয়ে ওঠে। এর জন্যে নব্য চালু হওয়া সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে দায়ী করা যায় না। অস্থিরতার মূল কারণ হলো, আরব বিপ্লবের পর যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলো তারা জনগণকে দেওয়া  প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছিলো। সেই অস্থিরতা একটা সময় এমন পর্যায়ে চলে যায় যে স্বৈরাচারী শাসক জাইন আল আবিদিন বেন আলি উৎখাত হবার পর থেকে তিউনিসিয়ায় নয়টি সরকারের পরিবর্তন হয়েছে। কোনো দলই স্থায়ী সরকার দিতে পারে নি। তার মধ্যে কোনো কোনো সরকারের আয়ু ছিল মাত্র কয়েক মাস।

২০১৯ সালের নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে সাংবিধানিক আইনের অধ্যাপক কায়েস সায়েদ যিনি ছিলেন একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি ৭২% ভোট পেয়ে নির্বাচিত হলেও সংসদে কোনো দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় নি। ফলে একটা কোয়ালিশন সরকার তৈরি হয় যার নেতৃতে ছিলো মুসলিম মৌলবাদী দল আননাহদা। সেই সরকারে যোগ দিয়েছিলো কয়েকটি গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ দলও। সেই দলগুলির সমর্থন নেওয়ার জন্যে আননাহদা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো যে তারা তিউনিসিয়ায় শরিয়ত আইন প্রবর্তন করা থেকে বিরত থাকবে এবং জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করবে। কিন্তু ক্ষমতায় বসার পর আননাহদা যথারীতি কথার খেলাপ করে ইসলামি সন্ত্রাসবাদী দল মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে সম্পর্ক অব্যাহত রাখে এবং একের পর এক জনস্বার্থবিরোধী কাজ চালিয়ে যায়। ফলে তারা তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থা হয়। জনগণ তাই সরকারের বিরুদ্ধে আবার আন্দোলন করতে পথে নামতে বাধ্য হয়। গণ-আন্দোলন এত তীব্র হয়ে ওঠে যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এলিয়েস ফাখফাখ মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় (২০২০ সালের জুলাই মাসে) পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। রাষ্ট্রপতি সায়েদ তখন আননাহদা পার্টির আর এক নেতা মি. মেচিচিকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন।

মি. মেচিচির সরকারের শাসনেও পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত থাকে। দেশের আর্থিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ আরও গভীর সংকটে ডুবে যেতে থাকে।  ২০২০ সালে দেখা যায় যে অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে ন’ শতাংশ (৯%)। বেকারি পৌঁছে যায় আঠারো শতাংশে (১৮%)। আর সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২০ এর শেষে যুবদের মধ্যে বেকারত্বের হার পৌঁছে যায় ছত্রিশ শতাংশে (৩৬%)। অন্য দিকে কোভিড পরিস্থিতি গোটা দেশ জুড়ে ভয়ংকর চেহারা নেয়। গভীর অর্থনৈতিক সংকট, তীব্র বেকারি ও ভয়াবহ কোভিড পরিস্থিতি – ত্রিবিধ এই ভয়াবহ সংকট মোকাবিলায় মেচিচি সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। ফলে ব্যাপক সংখ্যায় জনগণ আবার রাস্তায় নামে এবং বিক্ষোভে সামিল। বিক্ষোভ বহু শহরে সহিংস হয়ে ওঠে। পুলিশ ও বিক্ষুব্ধ মানুষের সঙ্গে দিকে দিকে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে থাকে। ক্ষুব্ধ জনতা ক্ষমতাসীন আননাহদা পার্টির অফিসে হামলা চালিয়ে কম্পিউটার ভেঙে ফেলে এবং তুজেউর শহরে দলটির স্থানীয় সদর দফতরে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরিস্থিতি ক্রমশ হাতের বাইরে চলে যেতে থাকে। রাষ্ট্রপতি তখন (২০২১ সালের ২৫শে জুলাই) প্রধানমন্ত্রী মেচিচিকে বরখাস্ত এবং সংসদ স্থগিত করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।

রাষ্ট্রপতির কড়া পদক্ষেপকে (প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত ও সংসদ স্থগিত করা) বিরোধী পক্ষ, বিশেষ করে মুসলিম মৌলবাদী দল আননাহদা বিপজ্জনক অভ্যুত্থান বলে অভিহিত করে। তারা তীব্র বিরোধিতা শুরু করে রাষ্ট্রপতির প্রস্তাবিত সংবিধানের। একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করার পদক্ষেপকে তারা আরব বসন্ত এবং সংবিধানের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা বলে অভিহিত করেছে। তারা জনগণকে এ কথা বলে বিভ্রান্ত করতে চায়ছে যে, রাষ্ট্রপতি কায়েস সায়েদ নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্যে ২০১৪ সালের সংবিধান বাতিল করার উদ্যোগ নিয়েছেন যার ফলে তিউনিসিয়ার গণতান্ত্র ভূলুণ্ঠিত হবে।

রাষ্ট্রপতি কায়েস সায়েদ বিরোধিদের সমস্ত অভিযোগ খণ্ডন করেছেন। সংবিধান উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন যে, দেশ জুড়ে যে ব্যাপক হিংসাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিলো সেটা নিয়ন্ত্রণে আনতে তাকে কিছু ব্যবস্থা নিতে হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করা সহ সংসদ স্থগিত করা তারই অংশ বিশেষ। তিনি তিউনিসিয়ার জনগণকে এই বলে আশ্বস্ত করেছেন যে, প্রস্তাবিত সংবিধান তিউনিসিয়ার মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার একটু খর্ব করবে না, বরং তা আরও সম্প্রসারিত ও সুরক্ষিত করবে এবং তিউনিসিয়াকে উদ্ভূত অর্থনৈতিক সংকট থেকে মুক্ত করবে।

প্রস্তাবিত সংবিধানকে আটকাতে ২৫শে জুলাইয়ের গণভোটকে বাঞ্চাল করতে হিংসাত্মক আন্দোলনের পথে যেতে পারে এমন আশঙ্কা রয়েছে। রাষ্ট্রপতি এ বিষয়ে কড়া বার্তা দিয়েছেন বিরোধিদের উদ্দেশ্যে। তিনি বলেছেন, "আমি সতর্ক করে দিতে চাই কেউ যদি অস্ত্র হাতে নেওয়ার কথা চিন্তা করে..কেউ যদি একটা বুলেটও ছোঁড়ে..তাহলে সশস্ত্র বাহিনী গুলি করেই তার জবাব দেবে,"  (সূত্রঃ https://www.bbc.com/bengali/news-57966333 )

প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত এবং সংসদ স্থগিত করার ঘটনা ঘটেছে হয়েছে প্রায় এক বছর আগে। তারপর  এই এক বছরে মুসলিম মৌলবাদী দল আননাহদা সহ সমস্ত বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো কখনো ধর্মের নামে, কখনো গণতন্ত্রের নামে রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টার ত্রুটি কম করে নি। তথাপি তিউনসিয়ার পরিস্থিতি এখনও শান্তিপূর্ণ রয়েছে। এটা প্রমাণ করে যে তিউনিসিয়ার জনগণ রাষ্ট্রপতির পক্ষেই রয়েছে এবং বিরোধিদের প্রত্যাখান করেছে। এর অর্থ দাঁড়ায় যে জনগণও প্রস্তাবিত সংবিধানকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত।  তারা বুঝেছে কোভিডের অতিমারি, বিপর্যস্ত অর্থনীতি ও ভয়ঙ্কর বেকারত্বের হাত থেকে তিউনিসিয়াকে বাঁচাতে যদি হয় তাহলে একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দেশ নির্মাণ করতে হবে, ইসলামি আইন ও আবেগ দিয়ে তা কখনই সম্ভব নয়।  

আরবের ছোট একটি দেশ তিউনিসিয়া যার জনসংখ্যা বারো মিলিয়ন (এক কোটি কুড়ি লক্ষ) মাত্র। জনসংখ্যার নিরানব্বই শতাইংশই (৯৯%) মুসলমান। সেই তিউনিসিয়ার বর্তমান সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে মনে হচ্ছে যে, মুসলিম অধ্যুষিত এই দেশটি অচিরেই (আগামী ২৫শে জুলাই) গ্রহণ করতে যাচ্ছে ধর্মীয় প্রভাব মুক্ত একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক সংবিধান। তা যদি হয় তাহলে সেটা হবে একটি সুদূরপ্রসারী ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী ঘটনা যা আরবের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে খোদিত হয়ে থাকবে এবং একই সঙ্গে সূচনা করবে দ্বিতীয় আরব বসন্তের যা মুসলিম বিশ্বের ধর্মাশ্রিত ভিতকে নাড়িয়ে দেবে প্রবলভাবে।

Wednesday, April 13, 2022

কুরাইশদের হাত থেকে প্রাণে বাঁচতে নয়, মুহাম্মদ মক্কা ত্যাগ করেছিলে অন্য কারণে

 

আখেরি নবীর হিজরত প্রসঙ্গে কথিত অভিযোগ

বাইশ বছর মক্কা নগরীতে ইসলাম প্রচার কার্য পরিচালনা করার পর ৬২২ খৃষ্টাব্দে আখেরি নবী মক্কা ছেড়ে মদিনায় চলে যান। তাঁর মক্কা ত্যাগ করার পেছনে কারণ হিসেবে বলা হয় যে, মক্কার অধিবাসী তথা কুরাইশগণ যারা ইসলাম ধর্মের বিরোধিতা করতো তাঁকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেযেদিন তাঁকে হত্যা করার কথা ছিলো তার আগের দিন তিনি সেটা জেনে যান তাই তিনি প্রাণ রক্ষার্থে সে দিন রাতেই তাঁর প্রিয় শিষ্য ও বন্ধু আবুবকরকে সঙ্গে নিয়ে মক্কা ত্যাগ করেন। কুরাইশরা কেন তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিলো? এ প্রসঙ্গে বলা হয় যে, কুরাইশরা এটা উপলব্ধি করতে পারে যে মুহাম্মদ বাঁচিয়ে রাখলে সে অচিরেই তাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী হয়ে উঠবে তখন হয় তাকে আল্লাহর নবী বলে মেনে নিতে হবে নচেৎ মক্কা থেকে নির্বাসিত হতে হবে। 

আখেরি নবীর হিজরত নিয়ে কোরানে একটি আয়াত আছে। সেটা হলো আনফাল সুরার তিরিশ নম্বর আয়াত। আয়াতটির ভাষ্য হলো -    

·         ৮/৩০ – এবং (স্মরণ কর,) যখন (হে মহম্মদ,) কাফেরগণ তোমার সঙ্গে ছলনা করিতেছিল যেন তোমাকে বন্দি করিয়া রাখে, অথবা তোমাকে বধ করে, কিংবা তোমাকে নির্বাসিত করে, এবং তাহারা ছলনা করিতেছিল এবং ঈস্বরও ছলনা করিতেছিলেন, ঈশ্বর ছলনাকারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। (গিরিশচন্দ্রের বাংলা কোরান শরীফ)             6,007 Kaaba Stock Photos, Pictures & Royalty-Free Images - iStock

·         And remember the time when disbelievers plotted against thee that they might imprison thee or kill thee or expel thee. And they planned and Allah also planned, and Allah also is the best of the planners.

গিরিশচন্দ্র সেন তাঁর তর্জমায় যেখানে ‘ছলনা’ বসিয়েছেন সেখানে অন্যান্য বাংলা তর্জমাকারীরা ‘ষড়যন্ত্র’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ইংরাজীতেও অনুবাদ করা হয়েছে ‘ছলনা’-র পরিবর্তে ষড়যন্ত্র (plot)আবার ইবনে কাথিরও তাঁর তর্জমা ও তফসিরে ষড়যন্ত্র  শব্দটিই ব্যবহার করেছেনসুতরাং এটা বোঝা যাচ্ছে স্পষ্টতই যে ‘ছলনা’ শব্দটি ভুল তর্জমা, ‘ষড়যন্ত্র’ই সঠিক তর্জমা বা বঙ্গানুবাদ। 

মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে একটা বিষয়ের প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারছি না যদিও এটা এই বইয়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক নয়। তবুও পাঠকদের কাছে উপস্থাপনা করা হচ্ছে কারণ, বিষয়টি যেমন অতিশয় বিষ্ময়কর তেমনি কৌতূহলোদ্দিপকও বটে। বিষয়টি হলো এই যে, উক্ত আয়াতটি আমাদের যারপরনাই বিস্মিত করে। কারণ, এই আয়াতটিতে যে দুটি বাক্য রয়েছে তার বক্তা দু’জন। প্রথম বাক্যটি হলো, ‘কুরাইশরা তোমার সঙ্গে ছলনা করেছিলো যার উদ্দেশ্য ছিলো তোমাকে বন্দি করা, অথবা তোমাকে বধ করা, অথবা তোমাকে নির্বাসিত করা।’ ধরা যাক এই বাক্যটি বা উক্তিটি আল্লাহর। কিন্তু দ্বিতীয় বাক্যটি বা শেষের বাক্যটি তো আল্লাহর হতে পারে না। কারণ, আল্লাহ নিশ্চয়ই বলতে পারে না যে, ‘তাহারা ষড়যন্ত্র করিতেছিল এবং ঈশ্বরও ষড়যন্ত্র করিতেছিলেন, ঈশ্বর ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ’ (‘they planned and Allah also planned, and Allah also is the best of the planners.’)  কথাটা আল্লাহ্‌র হলে হতো এ রকম, ‘তারা ছলনা করেছিলো, আমিও ছলনা করেছিলাম এবং সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ছলনাকারী।’ বিস্ময়ের বিষয় হলো এই যে, কোরান যদি আল্লাহর সৃষ্টি, তাহলে মানতে হয় যে আল্লাহ গুলিয়ে ফেলছেন আয়াতটি তার নবীকে পাঠাবার সময়। তিনি প্রথমে তার নিজের ভাষায় কথা বলেছেন, আবার পরক্ষণেই বলেছেন তার নবীর ভাষায়। আর তা যদি না হয় তাহলে যুক্তিবাদী ও কৌতূহলী পাঠকদের মনকে এই প্রশ্নটি বিদ্ধ না করে পারে না যে, আয়াতটির স্রষ্টা কি তবে স্বয়ং নবীই? নিজের কথাটি আল্লাহর মুখে বসাতে গিয়ে কি গুলিয়ে ফেলেছেন? এ বিষয়টা এখানেই শেষ করা যাক। কারণ, কোরানের স্রষ্টা কে - আল্লাহ না নবী, সেটা এই পুস্তকের আলোচনার বিষয় নয়। সুতরাং বিষয়ে ফেরা যাক, এখন দৃষ্টি নিবদ্ধ করা যাক আয়াতটির মধ্যেই 

এখন আমাদের দেখা দরকার যে, কখন, কেন এবং কোন প্রেক্ষিতে আয়াতটির অবতারণা করা হয়েছে। কোরানের তফসিরের মধ্যে এগুলির উত্তর পাওয়া যেতে পারে। তফসির শব্দের অর্থ হলো কোরানের আয়াতগুলির অর্থ ব্যাখ্যা করা, বিস্তৃত করা ও খোলসা করা। তাই কোরানের তফসির গ্রন্থই অনেক বড়ো একটি গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন কোরানের আয়াতসমূহের পটভূমি, পরিপ্রেক্ষিত ও ব্যাখ্যা পাওয়ার ক্ষেত্রে। তবে এ প্রসঙ্গে একটা কথা অবশ্যই বিবেচনায় রাখা জরুরী যে, তফসির সব সময়েই যে সঠিক ঘটনার বিবরণ দিতে পারে তা কিন্তু নয়। কারণ, নবীর মৃত্যুর কয়েক শতাব্দী পর তফসির লেখার কাজ শুরু হয়েছে। প্রাচীন তফসির গ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো তফসির আল-তাবারিআল-তাবারির জন্ম ৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে এবং মৃত্যু ৯২৩ খৃষ্টাব্দে। অর্থাৎ অনুমান করা যায় যে কোরানের তফসির লেখা শুরু হয় আখেরি নবীর মৃত্যুর (৬৩২ খ্রিঃ) তিনশত বছর পর। ফলে কোরানের আয়াতসমূহের অর্থ, ব্যাখ্যা ও পরিপ্রেক্ষিত বর্ণনায় বহুক্ষেত্রেই তফসিরকারদের মধ্যে মতানৈক্য হওয়া স্বাভাবিক এবং সেটা পরিলক্ষিত হয়ও বহুল সংখ্যায়। তবে তফসিরের ভুল-ভ্রান্তি বা দোষ-ত্রুটি যাই থাকুক না কেন, কোরানকে বুঝতে হলে আমাদের প্রধান ভরসার যায়গাটাই হলো কোরানের তফসির। সুতরাং ৮/৩০ নম্বর আয়াতটি বুঝবার জন্যে তার তফসিরের প্রতিই আমাদের চোখ রাখতে হবে। দেখা যাক আয়াতটির বিষয়ে তফসিরকারগণ কী বলেছেন। 

গিরিশচন্দ্র বর্ণিত তফসিরটি হলোঃ

·         যখন মক্কা পরিত্যাগের আদেশ হইল, তখন পূর্বেই হজরতের সহচরগণ মদিনায় প্রস্থান করিলেন, আবুবকর ও আলী ব্যতীত অন্য কেহই তাঁহার নিকট ছিলেন না। কোরেশ লোকেরা ইহা জানিতে পারিয়া দারোন্নদওয়া নামক স্থানে ষড়যন্ত্র করিবার জন্য মিলিত হইল, পাপপুরুষও মনুষ্যের আকারে সেই সভায় আগমন করিল। হজরতের সম্বন্ধে এক ব্যক্তি বলিল যে, “তাহাকে গৃহে আবদ্ধ করিয়া রাখা আবশ্যক, গৃহের দ্বার দৃঢ়রূপে বন্ধ করিয়া যে পর্যন্ত না তাহার মৃত্যু হয়, গবাক্ষ দ্বারা অন্নজল তাহাকে জোগাইতে হইবে” পাপাসুর এই যুক্তি অগ্রাহ্য করিয়া বলিল যে, “মদিনাবাসী অধিকাংশ লোক এসলাম ধর্ম গ্রহণ করিয়াছে এবং মহম্মদের বহু সংখ্যক বন্ধু সেখানে আছে, এবং হাশেম বংশীয় বহু লোক এ নগরে বাস করে, সকলে দলবদ্ধ হইয়া আসিয়া তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করিবে ও তাহাকে মুক্ত করিয়া লইয়া যাইবে” অন্য একজন বলিল, “তাহাকে নগর হইতে বাহির করিয়া দেওয়া আবশ্যক, যথা ইচ্ছা সে চলিয়া যাউক।” এই কথা শুনিয়া পাপাসুর বলিল, সে যেখানেই যাইবে, সেইখানেই লোক সকল তাহা দ্বারা প্রতারিত হইবে, পরে বহু সংখ্যক লোককে প্রাতারিত করিয়া দল বাঁধিয়া আসিয়া তোমাদের সঙ্গে সংগ্রাম করিবে”। তখন হজরতের পিতৃব্য আবু জ্বহল বলিল, “আমার মত এই যে, আমরা সকলে মিলে তাহাকে বধ করিব, মোহম্মদ বন্ধু হাশেম বংশীয় লোকেরা আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে সমর্থ হইবে না”। শয়তান বলল যে, “আমারও এই মত”। দুরাত্মা আবু জ্বহল প্রত্যেক পরিবারের একজনকে ডাকিয়া আনিয়া সেই দিন রাত্রেই হজরতকে হত্যা করা স্থির করিল। হজরত এই বৃত্তান্ত জানিতে পাইলেন, তিনি আপন প্রচারবন্ধু আলীকে স্বীয় শয্যায় শয়ান রাখিয়া প্রিয় সহচর আবুবকরের সঙ্গে গর্তের ভিতর লুকাইয়া রহিলেন। এক্ষণ পরমেশ্বর সেই কথা স্মরণ করিয়া দিলেন। (ত, হো,) 

  ইবনে কাথির উক্ত আয়াতের তফসিরে একাধিক ঘটনার কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেনঃ    

·         আতা (র) বলেনঃ “আমি উবায়েদ উমায়েরকে বলতে শুনেছি যে, যখন কাফিররা নবী (সঃ)-কে বন্দি করার বা হত্যা করার অথবা দেশান্তরিত করার ষড়যন্ত্র করে তখন তাঁকে তাঁর চাচা আবূ তালিব জিজ্ঞাসা করেন, কাফিররা তোমার বিরুদ্ধে কি ষড়যন্ত্র করেছে তা তুমি জান কি?” তিনি উত্তরে বলেন, তারা আমাকে বন্দী করতে বা হত্যা করতে অথবা নির্বাসিত করতে চায়।” আবূ তালিব আবার জিজ্ঞাসা করেন, এ সংবাদ তোমাকে কে জানিয়েছে? তিনি উত্তর দেন, “আমার প্রতিপালক আমাকে এ সংবাদ জানিয়েছেন।” আবূ তালিব তখন বলেন, তোমার প্রতিপালক খুবই উত্তম প্রতিপালক। তাঁর কাছে উত্তম উপদেশ প্রার্থনা কর। তখন নবী (সঃ) বলেনঃ “আমি তাঁর কাছে উত্তম উপদেশই চাচ্ছি এবং তিনি আমাকে সদা উত্তম উপদেশই প্রদান করবেন।” সত্য কথা এই যে, এখানে আবূ তালিবের আলোচনা বড়ই বিষ্ময়কর ব্যাপার এবং প্রত্যাখ্যান যোগ্য। কারণ, এটা হচ্ছে মাদানি আয়াত। আর এই ঘটনা এবং এইভাবে কুরায়েশদের পরামর্শকরণ হয়েছিল হিজরতের রাত্রে। অথচ আবূ বকরের মৃত্যু হয়েছিলো এর তিন বছর পূর্বে। আবূ তালিবের মৃত্যুর কারণেই তো কাফিররা এতোটা দুঃসাহস দেখাতে পেরেছিলকেননা, আবূ তালিব সদা সর্বদা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাজে সাহায্য ও সহযোগিতা করতেন এবং তাঁকে রক্ষা করতে গিয়ে কুরায়েশদের সাথে মুকাবিলা করতেন।  

·         হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, কুরায়েশ নেতৃবর্গের একটা দল রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য একটি পরামর্শ সভায় মিলিত হয়। ঐ সভায় ইবলিসও একজন মর্যাদা সম্পন্ন মানুষের বেশে উপস্থিত হয়। জনগণ তাকে জিজ্ঞাসা করে, “আপনি কে?” সে উত্তরে বলেঃ “আমি নাজদবাসী একজন শায়েখ। আপনারা পরামর্শ সভা আহ্বান করেছেন জেনে আমিও উপস্থিত হয়েছি, যেন আপনারা আমার উপদেশ ও সৎ পরামর্শ থেকে বঞ্চিত না হন।“ তখন কুরায়েশ নেতৃবর্গ তাকে অভিনন্দন জানালো। সে তাদেরকে বললোঃ “আপনারা এই লোকটার (মুহাম্মদ সঃ-এর) ব্যাপারে অত্যন্ত চিন্তাভাবনা ও তদবীরের সাথে কাজ করুন। নতুবা খুব সম্ভব সে আপনাদের উপর প্রভাব বিস্তার করে বসবে।” সুতরাং একজন মত প্রকাশ করলোঃ “তাকে বন্দী করা হোক, শেষ পর্যন্ত সে বন্দী অবস্থাতেই শেষ হয়ে যাবে। যেমন ইতিপূর্বে কবি যুহায়ের ও নাবেগাকে বন্দী করা হয়েছিল এবং ঐ অবস্থাতেই তারা ধ্বংস হয়ে গেছে। এও তো একজন কবি।” এ কথা শুনে ঐ নাজদী বৃদ্ধ চিৎকার করে বলে উঠলোঃ “আমি এতে কখনই একমত নই। আল্লাহর শপথ! তার প্রভু তাকে সেখান থেকে বের করে দেবে। ফলে সে তার সঙ্গীদের কাছে ফিরে যাবে। অতঃপর সে তোমাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে তোমাদের সবকিছু ছিনিয়ে নেবে এবং তোমাদেরকে তোমাদের শহর থেকে বের করে দেবে।” লোকেরা তার এ কথা শুনে বললোঃ “শায়েখ সত্য কথা বলেছেন। অন্যমত পেশ করা হোক।“ অন্য একজন তখন বললোঃ “তাকে দেশ থেকে বের করে দেয়া হোক, তাহলেই তোমরা শান্তি পাবে। সে যখন এখানে থাকবেই না তখন তোমাদের আর ভয় কিসের? তার সম্পর্ক তোমাদের ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে থাকবেএতে তোমাদের কি হবে?” তার ঐ কথা শুনে ঐ বৃদ্ধ বললোঃ “আল্লাহর কসম! এ মতও সঠিক নয়। সে যে মিষ্টভাষী সে তা কি তোমাদের জানা নেই। সে মধু মাখা কথা দ্বারা মানুষের মন জয় করে নেবে। তোমরা যদি এই কাজ কর তাহলে সে আরবের বাইরে গিয়ে সারা আরববাসীকে একত্রিত করবে। তারা সবাই মিলে তোমাদের উপর সম্মিলিতভাবে আক্রমণ করে বসবে এবং তোমাদেরকে তোমাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে। আর তোমাদের সম্ভ্রান্ত লোকদের হত্যা করে ফেলবে।” লোকেরা বললোঃ “শায়েখ সাহেব ঠিক কথাই বলেছেন। অন্য একটি মত প্রকাশ করা হোক।” তখন আবূ জেহেল বললোঃ “আমি একটা পরামর্শ দিচ্ছি। তোমরা চিন্তা করে দেখলে বুঝতে পারবে যে, এর চেয়ে উত্তম মত আর হতে পারে না। প্রত্যেক গোত্র থেকে তোমরা একজন করে যুবক বেছে নাও যারা হবে বীর পুরুষ ও সম্ভ্রান্ত। সবারই কাছে তরবারী থাকবে। সবাই সম্মিলিতভাবে হঠাৎ করে তাকে তরবারীর আঘাত করবে। যখন সে নিহত হয়ে যাবে তখন তার রক্ত সকল গোত্রের মধ্যে বণ্টিত হয়ে যাবে। এটা কখনও সম্ভব নয় যে, বানু হাশিমের একটি গোত্র সকল গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। বাধ্য হয়ে বানু হাশিমকে রক্তপণ গ্রহণ করতে হবে। আমরা তাদেরকে রক্তপণ দিয়ে দেবো এবং শান্তিলাভ করবো।” তার এ কথা শুনে নাজদী বৃদ্ধ বললোঃ “আল্লাহর কসম! এটাই হচ্ছে সঠিকতম মত। এর চেয়ে উত্তম মত আর হতে পারে না।” সুতরাং সর্বসম্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে গেল এবং এরপর সভা ভঙ্গ হলো। অতঃপর হযরত জিব্রাঈল (আঃ) আসলেন এবং রাসূলুলাহ (সঃ)-কে বললেন, “আজকে রাত্রে আপনি বিছানায় শয়ন করবেন না।” এ কথা বলে তিনি তাঁকে কাফিরদের ষড়যন্ত্রের কথা অবহিত করলেন। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সঃ) ঐ রাত্রে নিজের বিছানায় শয়ন করলেন না এবং তখনই আল্লাহ তা’আয়ালা তাঁকে হিজরতের নির্দেশ দিলেন।

·         মদিনায় আগমনের পর আল্লাহ পাক তাঁর উপর সুরায়ে আনফাল অবতীর্ণ করলেন। স্বীয় নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেনঃ ওয়া ইয়ামকোরুনা ওয়য়া ইয়ামকোরুল্লাহ ওয়া খায়রুল মাকেরিন। অর্থাৎ “তারা ষড়যন্ত্র করতে থাকে এবং আল্লাহ তা’আলাও (স্বীয় নবীকে সঃ রক্ষা করার) তদবীর ও ফিকির করতে থাকেন, আল্লাহ হচ্ছেন সর্বোত্তম তদবীরকারক।” তাদের উক্তি ছিলঃ ইয়া রাব্বাসুবেহি ওয়া ইয়াবালমানুনে হাত্তা ইহোলেকা অর্থাৎ “তার ব্যাপারে তোমরা মৃত্যু ঘটবার অপেক্ষা কর, শেষ পর্যন্ত সে ধ্বংস হয়ে যাবে।” ঐ দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, আম ইয়া কুলুনা সায়েরুন্নাতারাব্বাসো বেহি রাআবায়ালমানুন অর্থাৎ “তারা কি বলে – এ ব্যক্তি কবি, আমরা তার ব্যাপারে মৃত্যু ঘটারই অপেক্ষা করছি। (৫২/৩০) তাই ঐ দিনের নামই রেখে দেয়া হয় “দুঃখ-বেদনার দিন।” কেননা ঐ দিন রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। তাদের ঐ দুরভিসন্ধির আলোচনা নিম্নের আয়াতে আছে – “তারা এই ভূমি থেকে তোমাকে উৎখাত করতে উদ্যত হয়েছিল, যেন তোমাকে তথা হতে বের করে দেয়, আর যদি এরূপ ঘটে যেতো তবে তারাও তোমার পর (এখানে) অল্প সময় টিকে থাকতে পারতো।” (১৭/৭৬)  (দ্রঃ ইবনে কাথিরের তফসির, ৮ম খণ্ড, পৃ: ৫৫৩ - ৫৫৬)   

তফসিরে বর্ণিত ঘটনাগুলির পর্যালোচনা

গিরিশচন্দ্র লিখেছেন যে, কুরাইশরা যখন জানতে পারে যে আল্লাহ নবীকে মক্কা ত্যাগ করার নির্দেশ পাঠিয়েছে তখন তারা ‘দারোন্নদওয়া’ নামক স্থানে ষড়যন্ত্র করিবার জন্য মিলিত হয় এবং সেখানেই নবীকে হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়। নবীকে হত্যা করার কুরাইশদের ষড়যন্ত্র প্রসঙ্গে এখানে যে কথাটি বলা হয়েছে তার সত্যতা মোটেই প্রশ্নাতীত নয়। কারণ,

                                এক. নবীকে মক্কা ত্যাগ করার আল্লাহর নির্দেশের কথা কুরাইশগণ জানবে কীভাবে? ওই নির্দেশ তো একান্তই গোপনীয় যা নবী ছাড়া আর কারও পক্ষে জানা সম্ভব নয়।  

             দুই.এবার লক্ষ্য করা যাক তফসিরকার ইবনে কাথির কী বলেছেন তার প্রতি। তিনি ঠিক এর বিপরীত কথাটাই বলেছেন। বলেছেন যে, কুরাইশরা নবীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার কথা জানার পরপরই আল্লাহ নবীকে সেটা জানিয়ে দেয় এবং মক্কা ত্যাগ করার আদেশ দেয়। 

              তিন একটা বিশেষ লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, ৮/৩০ আয়াতে কোথাও বলা হয় নি যে, আল্লাহ তার নবীকে মক্কা ত্যাগ করার আদেশ দিয়েছিল। 

          চার. তফসির দু’টোতে তথ্যের মধ্যে অসামঞ্জস্যও রয়েছে। ইবনে কাথির জানিয়েছেন যে, কুরাইশরা যে নবীকে হত্যা করার ছক কষেছে সে কথা আল্লাহ নবীকে জানিয়েছিলো জিব্রাইল মারফত। অপরদিকে কুরাইশদের ষড়যন্ত্রের কথাটি আল্লাহই যে নবীকে জানিয়েছিলো তার উল্লেখ গিরিশচন্দ্রের তফসিরে নেই। এই বিষয়গুলি বিবেচনায় রাখলে এ কথাটি বিশ্বাসযোগ্য বা গ্রহণযোগ্য মনে হয় না যে কুরাইশরা নবীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিলো যার দরুণ নবী মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।  

কু তাছাড়া কুরাইশদের বিরুদ্ধে নবীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র বা হত্যা করার পরিকল্পনা করার  গুরুতর অভিযোগটির সত্যতা সম্পর্কে গভীর সংশয় জাগে উপরে বর্ণিত তফসির দু’টির বিবরণ থেকে অন্য কারণেও। 

সেটা এ রকম -  তফসির দু’টোর বর্ণনায় দু’টো সাধারণ মিল রয়েছে। তাহলো -  

·                            প্রথমত, নবী স্বেচ্ছায় মক্কা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন নি। আল্লাহর নির্দেশ পেয়েই তিনি মক্কা ত্যাগ করেছিলেন। 

·                        দ্বিতীয়ত, আল্লাহ কুরাইশদের ভয়েই নবীকে মক্কা ত্যাগ করার আদেশ দিয়েছিলো এখানেই সাধারণভাবে কিছু প্রশ্নের উদ্রেক হয় যে, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে যে সর্বশক্তিমান আল্লাহ কুরাইশদের ভয়ে তার নবীকে মক্কা ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছিলো? যদি তাই হয় তবে তার পরিপ্রেক্ষিতে আরও দু’টো প্রশ্ন অনিবার্যভাবে সামনে চলে আসে। তাহলো, প্রশ্ন এক. স্রষ্টা আল্লাহ তার সৃষ্টি কুরাইশদের ভয় পাবে কেন? আল্লাহর ভয় পাওয়াটা কি কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে? প্রশ্ন দুই. ধরা যাক, কুরাইশরা সত্যিই নবীকে হত্যা করার ছক কষেছিলো। সেক্ষেত্রে আল্লাহর তো কুরাইশদের ছক বাঞ্চাল করে তার নবীকে রক্ষা করার কথা। আল্লাহ তার নবীকে মক্কা ত্যাগ করতে বলবে কেন?

মোটের উপর কথা হলো এই যে, যে আল্লাহ কোরানে পুনঃপুন ঘোষণা করেছে যে, সে সর্বশক্তিমান ও সর্বময় ক্ষমতার মালিক। সেই আল্লাহ কুরাইশদের ভয় পেয়েছিল এবং ভয় পেয়েই তার নবীকে নির্বাসনে যেতে বলেছিলো, এটা মোটেই যুক্তিগ্রাহ্য ও বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। সুতরাং এটা স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, কুরাইশরা যে নবীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা করেছিলো তার বিশ্বাসযোগ্য ও যুক্তিগ্রাহ্য কোনো প্রমাণ কোরানের তফসির থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। সুতরাং নবীর মক্কা ত্যাগ করার নেপথ্যে অন্য কোনো কারণ আছে, কুরাইশদের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে তিনি মক্কা ত্যাগ করে মদিনা যান নি।     

 

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...