মানুষ হলো
প্রাণীজগতের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ প্রাণী। শ্রেষ্ঠ তার মস্তিষ্কের অপরিমিত সর্বপ্রকার ক্ষমতার জন্যে। মানুষের প্রথম আবির্ভাব ২৬ লক্ষ বছর
পূর্বে। আর আধুনিক মানুষের (আকার আকৃতির দিক থেকে) উওরণ ঘটে ১ লক্ষ ১৫ হাজার
বছর পূর্বে। ভারতে আধুনিক মানুষের সন্ধান পাওয়া যায় ৬০-৭০ হাজার বছর পূর্বে।
মানুষের জন্মের আগে ও পরে সৃষ্টি হওয়া হাজার হাজার প্রজাতি কবেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। প্রাকৃতিক পরিবেশে নিরন্তর পরিবর্তন ঘটে থাকে। সেই পরিবর্তনের সঙ্গে যারা
নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারেনা তারা বিলুপ্ত হয়। কিন্তু মানুষ বিলুপ্ত হয়নি।
মানুষ শুধু টিকে নেই, তার অস্তিত্ব ও অবস্থানকে অনেক অনেক উন্নত ও শক্তিশালী করেছে এবং ক্রমাগত করে চলেছে।
মানুষ যেমন একধারে
প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে তার নিরন্তর পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে
সক্ষম হয়েছে, তেমনি বহু ক্ষেত্রে প্রকৃতির প্রতিকূলতাকে জয় করে প্রকৃতিকে নিজের
অনুকূলে নিয়ে এসে নিজেদের
জয়যাত্রা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছে।
বিশ্ব প্রকৃতির ভান্ডার নানা রকম সম্পদে টইটম্বুর যে সম্পদের উপর প্রাণী হিসাবে
কেবল মানুষই তারই আধিপত্য স্থাপন করেছে। সেই সম্পদ ব্যবহার করে মানুষ তার
শারিরীক, জৈবিক, মানসিক, বৌদ্ধিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি চাহিদাগুলি পূরণ করে মানব
সমাজের উন্নতি ও বিকাশের ধারাকে অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছে। প্রকৃতির উপর
সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। কিন্তু মানুষ কিছু কিছু ক্ষেত্রে
প্রকৃতির উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেছে তা অনস্বীকার্য। খরা ও বন্যার উপর মানুষ
নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। স্থাপন করেছে সূর্যালোকের উপরেও অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে পরাস্ত করে
মানুষ মহাকাশে পাড়ি দিয়েছে এবং সেখানে দীর্ঘ সময় ধরে অবস্থান করে গবেষণা কার্য
পরিচালনা করছে। আরও উদাহরন আছে। এভাবেই মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামে ক্রমাগত
সাফল্য অর্জন করে চলেছে। সে জন্যেই পৃথিবীর অস্তিত্ব যতদিন থাকবে মানুষও
থাকবে, এই প্রজাতির প্রাণীটির বিলুপ্তি
ঘটবে না।
পরিবর্তনশীল পরিবেশের
সঙ্গে শুধু খাপ খাওয়ানো নয়, মানুষকে প্রথম
থেকেই পরিবেশকে দূষণ থেকে রক্ষা করার দিকেও
দৃষ্টিপাত করতে হয়েছে। আদিম যুগে যখন মানুষের বিজ্ঞানের কোনো জ্ঞান ছিল না তখন থেকেই, শুধু অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের উপর ভর করেই। মৃত দেহের সৎকার করেছে মানুষ মানব
সমাজের সেই ঊষালগ্ন থেকেই। প্রাণীর মৃত্যুর পর মৃতদেহে যে পচনক্রিয়া হয় তার ফলে পরিবেশ
বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে। আমরা এখন এর কারণ জানি, কিন্তু সে যুগের মানুষ জানত
না। কিন্তু মানুষ এটা জীবনের অভিজ্ঞতায় বুঝেছিল যে মৃতদেহ ঘরে বা পাশে নিয়ে বাঁচা যায় না, সুতরাং এর বিহিত করা আবশ্যক।
মানুষ বাঁচার তাগিদেই পরিবেশকে বসবাসের উপযুক্ত করে রাখতেই মৃতদেহের সৎকার
প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। সেই আদিম যুগে মানুষ ঈশ্বর, ঈশ্বরের ধর্ম এসব কথা শোনেই নি।
তাই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী মানব গোষ্ঠী এক এক যায়গায় এক এক রকম উপায়ে
মৃতদেহের সৎকার করতো। কোথাও সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দিতো, কোথাও পুড়িয়ে দিতো, কোথাও মাটিতে পুঁতে দিতো, আবার
কোথাও পাহাড়ের অনেক উপরে উঠে নিরাপদ দুরত্বে রেখে দিত। সেই প্রক্রিয়াগুলি আজও অব্যাহতো
রয়েছে, পার্থক্য শুধু এক জায়গাতেই, প্রত্যেকটি সৎকার প্রক্রিয়াতে ঈশ্বরকেন্দ্রিক ধর্মের নানারূপ বিধি-বিধান
যুক্ত করা
হয়েছে মাত্র। আর পদ্ধতিগত দিক থেকে অনেকটা ধোপদুরস্ত ও পরিশীলিত করা হয়েছে এই যা। প্রাচ্যের অধিকাংশ মানুষ যদিও এগুলো
ঈশ্বর প্রদত্ত বিধান বলে বিশ্বাস করে এবং অনুসরণ করে, কিন্তু এগুলো যে মানুষের মনগড়া
বিধান তা একটু
গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায়।
এযুগে
বিজ্ঞানের সমস্ত শাখায় অকল্পনীয় অগ্রগতি ঘটেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও
অগ্রগতি ঘটেছে অনুরূপভাবে। এর ফলে প্রাণির মৃতদেহ সম্পর্কে, বিশেষতঃ মানুষের মৃতদেহ
সম্পর্কে অতীতের ধ্যান-ধারণার ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। অনুরূপ
পরিবর্তন এসেছে পরিবেশবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও। মৃতদেহকে মানব সমাজের কল্যাণে
কোনোদিন ব্যবহার করা যেতে পারে এবং মানুষের কাজে আসতে পারে এমন চিন্তাভাবনা অতীতে
মানুষের কল্পনাশক্তিতেও ঠাঁই পায় নি। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অবিশ্বাস্য অগ্রগতি ও উন্নতির ফলে
এটা আজ সর্বজনবিদিত যে মানুষের মৃতদেহকে এখন মানব সমাজের কল্যাণে নানাভাবে কাজে
লাগানো হচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান আজ প্রমাণ করেছে যে মানুষের মৃতদেহ আর নষ্ট করে
দেবার মতন অপ্রয়োজনীয় বা পরিবেশের দূষণ ঘটানোর মত ক্ষতিকর জড় বস্তু নয়। এ ছাড়া
পরিবেশবিজ্ঞান আমাদেরর কাছে আর একটা জিনিষ প্রমাণ করেছে যে, মৃতদেহ সৎকার করার
চালু পদ্ধতিগুলি প্রাচীনকালে পরিবেশ সুরক্ষার প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
রাখলেও বর্তমান যুগে তার উপযোগিতা ও কার্যকারিতে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। মৃতদেহ সৎকারের সর্বাধিক প্রচলিত পদ্ধতি দাহ
করা হোক কিংবা কবরস্থ করা হোক উভয় পদ্ধতিই পরিবেশের কাছে কমবেশী হুমকি হয়ে উঠেছে। সৎকারের এই প্রক্রিয়াগুলি কীভাবে পরিবেশের কাছে হুমকি হয়ে উঠেছে সে বিষয়ে
আলোকপাত করার অবকাশ নেই এই নিবন্ধে যদিও এটা এই নিবন্ধের বিষয়ের সঙ্গে
অঙ্গাঅঙ্গীভাবে যুক্ত। যদি সময় ও সু্যোগ আসে তবে এটা নিয়ে পরে আলোচনা করার প্রয়াস
করা হবে। এখন সেই আলোচনায় ফেরা যাক যেটা এই নিবন্ধের প্রধান আলোচ্য বিষয়। একটু
উপরে উল্লেখ করা হয়েছে যে মানুষের মৃতদেহ এখন পুড়িয়ে বা পুঁতে দিয়ে নষ্ট করে ফেলার
মত অকেজো বা ক্ষতিকর জড় বস্তু নয় । মানবসমাজের কল্যাণে মানুষের মৃতদেহগুলি প্রভূত পরিমাণে
অবদান রাখতে সক্ষম। কিন্তু ধর্মীয় কুসংস্কার বশতঃ মানুষের মৃতদেহগুলি যেহেতু আমরা
নষ্ট করে ফেলি, তাই এই সৎকার পদ্ধতিগুলি মানবসমাজের কল্যাণ ও বিকাশের ক্ষেত্রে
একটা বড়ো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কীভাবে মানুষের মৃতদেহ আমারে মানব সমাজের কল্যাণে
লাগাতে পারি কিংবা মৃতদেহ সৎকারের প্রচলিত পদ্ধতি ও রীতিনীতর পরিবর্তে বিকল্প কি উপায়ে
আমরা সৎকার করতে পারি তা এবার দেখা যাক।
মানুষের
মরণোত্তর দেহ দু রকম উপায়ে মানব সমাজের কল্যাণে কাজে লাগানো সম্ভব। এক). চিকিৎসা
বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্যে এই দেহ একান্তই আবশ্যক। কারো পক্ষে শুধু বই পড়ে
একজন উপযুক্ত চিকিৎসক হওয়া সম্ভব নয়,
চিকিৎসা বিজ্ঞানী হওয়া তো অনেক দূরের কথা। মানুষের চিকৎসক হোক, কিংবা পশু চিকিৎসক, উভয়ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীকে শবদেহের ব্যবচ্ছেদ করেই
শিক্ষা অর্জন করতে হবে। দুই). চিকিৎসাবিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতির ফলে এখন মানুষের মৃতদেহের অঙ্গগুলি জীবিত মানুষের দেহে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে। ফলে প্রতিদিনই বিশ্বের নানাপ্রান্তে অসংখ্য মরণাপন্ন মানুষজন নতুন জীবন লাভ করছে।
এখন
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, মানুষ মারা গেলে তো তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলিরও মৃত্যু
ঘটবে, তাহলে মৃত্যুর পর মানুষের মৃতদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের কথা উঠছে
কেন? না, মানুষের এ ধারণা সঠিক নয়। মানুষের মৃত্যু হলে সঙ্গে সঙ্গে শরীরের সকল
অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মৃত্যু হয় না। এ বিষয়ে আমাদের প্রথমেই যে কথাটা বুঝতে হবে যে
মানুষের মৃত্যু সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত সকল ধারণা ও বিশ্বাসগুলি ঠিক নয়।
মৃত্যু কী এবং কীভাবে হয় সে বিষয়ে মানুষের যে ধারণা ও বিশ্বাস তা ধর্মগ্রন্থসমূহ
থেকে পাওয়া। ধর্মগ্রন্থ ঈশ্বরের রচিত
বিধান বলে প্রাচ্যের অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করলেও প্রকৃত ঘটনা তা নয়।
প্রত্যেকটি ধর্মগ্রন্থই মনুষ্য দ্বারা রচিত এবং তাঁরা কেউই যে বৈজ্ঞানিক ছিলেন না
তা বলা বাহুল্য। তাই মৃত্যু সম্পর্কে মানুষের প্রচলিত ধ্যানধারণা ও বিশ্বাসগুলির
বিন্দুমাত্র বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ও সত্যতা নেই। মৃত্যু সম্পর্কে চিকিৎসা বিজ্ঞানের
পরীক্ষালব্ধ প্রমাণিত আবিষ্কার ও জ্ঞানগুলি না জানার কারণে মানুষ ভ্রান্ত ধারণার
শিকার হন। মানুষের মৃত্যু হওয়া মানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় মস্তিষ্কের মৃত্যু
হওয়া। মস্তিষ্কের মৃত্যু কারো জীবন ফিরিয়ে দেওয়া যায় না সত্য, কিন্তু
চিকিৎসা বিজ্ঞানের একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার হলো – মস্তিষ্কের মৃত্যুর সাথে সাথে
মানব দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলির মৃত্যু হয় না, সেগুলি কয়েকঘণ্টা জীবিত ও সক্রিয় থাকে। অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি সক্রিয় থাকাকালীন শবদেহ
থেকে সফলভাবে বিচ্ছিন্ন করে সংরক্ষণ করা ও অন্য জীবিত মানুষের দেহে প্রতিস্থাপন
করা সম্ভব। এরূপ অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে মূমুর্ষ রোগীকে মৃত্যুর হাত থেকে
বাঁচানো ও তাকে নবজীবন প্রদান করা সম্ভব।এখন
দেখা যাক কোন কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব ও করা হচ্ছে । মানব
দেহের প্রতিস্থাপনযোগ্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি হলো
- ১). কর্ণিয়া, ২). বৃক্ক বা
কিডনি, ৩). হৃৎপিন্ড বা হার্ট, ৪). ফুসফুস, ৫). অগ্ন্যাশয় বা প্যানক্রিয়াস, ৬).
যকৃত বা লিভার, ৭). হাড়, ৮). মজ্জা, ৯). চামড়া, এবং ১০). রক্ত। আমরা প্রায় সকলেই
অবগত যে একজন
মানুষের দেহ থেকে কিডনি নিয়ে অন্য জনের দেহে সাফল্যের সঙ্গে প্রতিস্থাপন করার
কাজকে আমাদের চিকিৎসক বন্ধুরা প্রায় জলভাতের মতো সহজ করে তুলেছেন। আমরা
প্লাস্টিক সার্জারীর কথাও কমবেশী সকলেই অবহিত। প্লাস্টিক সার্জারীর অর্থ হলো শরীরের
এক স্থানের চামড়া অন্যস্থানে প্রতিস্থাপন করা। হৃদযন্ত্রের বাইপাস (bypass) সার্জারীর সময়
দেহের হাত বা পায়ের শিরা থেকে কিছুটা কেটে নিয়ে তা দিয়ে হৃদযন্ত্রে প্রতিস্থাপন
করতে হয়। এ ধরণের সার্জারী বা শল্য চিকিৎসা তো সাফল্যের সঙ্গে এখন আকছার হচ্ছে।
দেহের এক জায়গার হাড় কেটে অন্য জায়গায় প্রতিস্থাপন করা যে হয় এটা জানেনা এমন মানুষ
খুব কমই আছেন। এখন যকৃত স্থাপনেও সাফল্য
এসেছে আমাদের দেশে। প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে মানুষের ফুসফুস ও প্যানক্রিয়াস তথা
অগ্ন্যাশয়ও। ব্লাড ক্যানসার আক্রান্ত রোগী কিংবা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাবজনিত
রোগের শিকার এমন রোগীদের দেহে অস্থিমজ্জা এখন সাফল্যের সঙ্গে প্রতিস্থাপন করে
রোগীকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে। অসংখ্য মানুষ জন্মের পর
নানা কারণে অন্ধ হয়ে যায়। এই সমস্ত মানুষের জীবন তখন পৃথিবীর আলো, রঙ,রূপ ও দৃষ্টিনন্দনসৌন্দর্য
থেকে বঞ্চিত হয়ে এবং কর্মক্ষমতা হারিয়ে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। মৃত্যুর ৬ ঘন্টার মধ্যে দুটি চোখ তুলে নিয়ে তার
অক্ষিপট(রেটিনা) সংরক্ষণ করলে চোখ দুটি নষ্ট হয় না। ঐ চোখ দুটি দু’জন অন্ধ
মানুষের অন্ধত্ব নিরসন করে তাদের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে পারে। এ ভাবে কর্ণিয়া
প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ অন্ধ মানুষকে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব। চিকিৎসা
বিজ্ঞানের এই মহাসাফল্যকে আমরা মানব কল্যাণে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছি না। তার
প্রধান কারণ মানুষের ধর্মীয় কুসংস্কার।
মানুষ ধর্মীয় কুসংস্কারের বশে শবদেহগুলি হয় পুড়িয়ে না হয় মাটিতে পুঁতে নষ্ট
করে ফেলছেন।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের অবিশ্বাস্য উন্নতি ও অগ্রগতি সত্ত্বেও এখনও বহু মানুষ অজানা রোগে মারা
যায়। অজানা রোগগুলির কারণগুলি জানতে না পারলে এই মৃত্যু বন্ধ করা যাবে না। সে
জন্যেই অর্থাৎ অজানা রোগের কারণগুলি অনুসন্ধান করার জন্যে মৃতদেহগুলির উপর
পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো একান্ত জরুরী। এই পরীক্ষাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলে
‘অটোপসি’ (Autopsy ) পরীক্ষা। অজানা রোগে মৃত্যুর পর শবদেহগুলি ধর্মীয় বিধি মেনে নষ্ট
করার ফলে এই জরুরী কাজটি ব্যহত হচ্ছে। ধর্মীয় কুসংস্কারবশতঃ তাই মৃতদেহ নষ্ট না
করে আমাদের একান্ত জরুরী কর্তব্য হলো সেগুলি
মেডিক্যাল কলেজে দান করা। তা করতে পারলে অসংখ্য মানুষের অকাল মৃত্যু
প্রতিরোধ করা সম্ভব। মরণোত্তর দেহ নষ্ট না করে চিকিৎসা বিজ্ঞানকে দান করা তাই
নানা দিক থেকেই একটি মহৎ ও অবশ্য পালনীয়
কর্তব্য। কিন্তু এ কাজে আমরা ভয়ানকভাবে পিছিয়ে, ফলে আমরা বহু মানুষের অকাল
মৃত্যু প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছি শুধু তাই নয়, চিকিৎসা বিজ্ঞানের কাজও বহুল
পরিমাণে ব্যহত হচ্ছে। শুধু মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্যেই যে সংখ্যক
শবদেহ প্রয়োজন তা পাওয়া যায় না। কারণ শবদেহের জন্যে এখনো আমাদের নির্ভর করতে হয়
দুর্ঘটনায় মৃত দাবিদারহীন ব্যক্তির শবদেহের উপর। কিন্তু সেই শবদেহের সংখ্যা, বলা বাহুল্য যে প্রয়োজনের তুলনায় ভীষণই অপ্রতুল ও নগণ্য।
কোনো সংশয় নেই যে এ যুগে মানব সমাজের কল্যাণে
চিকিৎসা বিজ্ঞানকে মরণোত্তর দেহ দান করা সর্বাধিক গুরুত্ত্বপূর্ণ ও অতি আবশ্যক কাজগুলির
অন্যতম। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের
বিষয় হলো, এই কাজটি আমাদের দেশে সবচেয়ে অবহেলিত। অবহেলিত সর্বস্তরে – কী সরকারী, কী বেসরকারী। সরকারী স্তর থেকে এই কাজে মানুষকে সচেতন করার কোনো প্রয়াস
নেওয়া হয় না, প্রয়াস নেয় না বিরোধী ভূমিকায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলিও। এরূপ প্রয়াস
নেওয়া হয়না কারণ, তাতে মানুষের দীর্ঘদিনের ধর্মীয় সংস্কার ও আবেগে আঘাত লাগবে এবং তারা তাদের
প্রতি বিরূপ ও রুষ্ট হবে বিধায় তাদের ভোটব্যাঙ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং অদূর
ভবিষ্যতেও কোনো সরকার বা বিরোধী কোনো রাজনৈতিক দল মরণোত্তর দেহদানের বিষয়ে কোনো
সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করবে এমন আশার ক্ষীণতম রশ্মিটুকুও দেখা যাচ্ছে না।
মানবকল্যাণে নিয়োজিত বেসরকারী সংগঠনগুলিই একমাত্র ইতিবাচক ভূমিকা নিতে
পারে যাদের জনসমর্থন বা ভোট হারাবার ভয় নেয়। কিন্তু সব বেসরকারী সংগঠন এ কাজে এগিয়ে আসবে না। যে সব সংগঠন ধর্মীয় বিশ্বাস ও কুসংস্কারের উর্দ্ধে এবং মুক্ত চিন্তা ও বিজ্ঞান
চিন্তাচেতনায় বিশ্বাসী এবং বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ ও মানব সমাজ নির্মাণের মহান ব্রত
নিয়ে কাজ করে কেবল তারাই এই মহৎ কাজে এগিয়ে আসতে পারে। কিন্তু এই সংগঠনগুলিও এই
কাজে অদ্যাবধি বিশেষভাবে আগ্রাহঈ হয়ে উঠেছে এ কথা বলা যায় না। কয়টি সংগঠন এই কাজ
করছে তার তথ্য হাতের কাছে নেই, কিন্তু সংখ্যাটা যে প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য তা
সংশয়াতীত।
একমাত্র
এই কাজটাই করবার ব্রত নিয়ে যারা বা যে সব সংগঠন আমাদের রাজ্যে কাজ করছেন তাদের
মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি নাম হলো – গণ দর্পণ। কলকাতায় ১৯৮৫ সাল থেকে এই সংগঠনটি স্বনামধন্য
ব্রজ রায়ের নেতৃত্বে কাজ করে চলেছে। তাঁরা এই কাজটিকে গণআন্দোলনে রূপ দেওয়ার
চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমাদের উচিত ওদের পাশে দাঁড়ানো। কেউ মরণোত্তর দেহদান করতে
চাইলে তাঁদের অফিসে গিয়ে অঙ্গীকার পত্রে স্বাক্ষর করে সে কাজটি সম্পন্ন করতে পারেন। এই মহৎ কাজে আগ্রহী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যাঁরা এই বিষয়ে বিশদ তথ্য পেতে চান
তাঁরা তাঁদের সঙ্গে নীচের ঠিকানায় যোগাযোগ করতে পারেন। তাদের
ঠিকানা হলো - গণ দর্পণ, ৩২ ডি, ধীরেন্দ্র নাথ ঘোষ রোড, কলকাতা-৭০০০২৫ । দূরভাষ –
০৩৩২৭০২১৫০৪ , ই-মেলঃ ganadarpan@hotmail.com
২০.০৬.১৩ তারিখে উত্তরণের মুখপত্র 'মানুষ' পত্রিকার জন্যে লেখা বিশেষ নিবন্ধ
যোগাযোগ
করতে পারেন ।