Friday, January 7, 2022

কোরান মনুষ্য রচিত গ্রন্থ - দুই

                                                  কোরানের আইনকানুনের পর্যালোচনা - এক

মুসলিমদের দাবী যে কোরান হলো একটি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সংবিধানযার মধ্যে রয়েছে মানুষের জন্যে সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত পরিপূর্ণ একটা জীবনব্যবস্থা তথা একটি সুসংহত আইনকানুন তাদের আরো দাবি করে যে কোরানের আইনগুলো শাশ্বত ও চিরন্তন। অর্থাৎ কোরান হলো একটি চির অপরিবর্তনশীল সংবিধান যেটা সর্বকালে ও সর্বযুগে সমান প্রযোজ্য। সদা পরিবর্তনশীল সমাজে এটা কিভাবে সম্ভব? এর উত্তরে তাদের জবাব হলো, এটা সম্ভব কারণ, আল্লাহ হলো ত্রিকালজ্ঞ এবং পরিপূর্ণ জ্ঞান ও বুদ্ধির অধিকারী। এ বিষয়টি সীমিত ও খণ্ডিত জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেচনাবোধদূরদর্শিতার অধিকারী মানুষের পক্ষে এটা বোঝা সম্ভব নয়। মুসলমানদের দাবি কতটা বাস্তবসম্মত সে কথা বা বিতর্ক এখন থাক। এখন আলোচনা শুরু করা যাক লেখার যেটা মূল বিষয় সেখানেই, অর্থাৎ কোরানের আইনকানুনের আলোচনা ও পর্যালোচনায়।       

কোরানের লিপিবদ্ধ আইনকানুনের নানা দিক রয়েছে। সবগুলি দিক নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা করা এ লেখায় সম্ভব নয়। তাই কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আইনকানুনের মধ্যে আলোচনাটা সীমাবদ্ধ রাখা হবে। সেই সীমিত আলোচনাটার জন্যেও অনেক বড়ো পরিসর প্রয়োজন। তাই এ লেখাটাও সম্পন্ন করা হবে কয়েকটি ভাগে। এই আলোচনা ও পর্যালোচনাটা সীমাবদ্ধ থাকবে কোরানের বিচারে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ একটি ফৌজদারী আইন (criminal law) নিয়ে।   

ব্যাভিচার সংক্রান্ত আইন 

ব্যভিচার বিষয়টি ফৌজদারি নাকি দেওয়ানি আইনের অন্তর্ভুক্ত তার সম্পূর্ণ মীমাংসা আজও অধরা। পরাধীন ভারতে বৃটিশদের তৈরি করা সংবিধানে এটা ফৌজদারী আইনের (ধারা নং ৪৯৭) অন্তর্ভুক্ত ছিলো। ঐ আইনে বলা হয়েছিলো যে কোনো পুরুষ যদি বিবাহিত কোনো নারীর সঙ্গে তার স্বামীর অনুমতি ছাড়াই যৌন সম্পর্ক করে সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ (punishable crime for men)২০১৮ সালে সর্বোচ্চ আদালত এটাকে অসাংবিধানিক বলে আখ্যায়িত করে ফৌজদারী আইনের তালিকা থেকে নামিয়ে দেয়। এ প্রসঙ্গে রায় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, বিবাহ-বিচ্ছেদ সহ নাগরিক সমস্যাগুলি বিবেচনার জন্যে ভিত্তি হতে পারে, কিন্তু এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হতে পারে না। সর্বোচ্চ আদালতের ভাষায় কথাটি হলো - Adultery can be ground for civil issues including dissolution of marriage but it cannot be a criminal offence,” সর্বোচ্চ আদালতের এই ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী রায় বৃহত্তর ভারতীয় সমাজ আজও বুকে ধারণ করতে নারাজ। ব্যভিচারকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বিবেচনা করে এবং অভিযুক্তদের নানা প্রকার আদিম প্রকৃতির বর্বরোচিত শাস্তি দেয়। হিন্দু সমাজে ব্যাভিচার সম্পর্কে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পক্ষে কিছুটা পরিবর্তন পরিলক্ষিত হলেও মুসলিম সমাজ এই প্রশ্নে যে তিমিরে ছিলো সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। ফলে মুসলিম সমাজে আজও ব্যভিচার সম্পর্কে সমান স্পর্শকাতর। ইসলামের চোখে ব্যাভিচার একটি গুরুতর অপরাধ যার সর্বোচ্চ শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড। মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পদ্ধতিটিও অত্যন্ত আদিম প্রকৃতির। ব্যাভিচার দোষী সাব্যস্ত নারীকে বুক পর্যন্ত পুঁতে অবিরাম পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হয়। ব্যাভিচার নিয়ে মুসলিম সমাজে অতি বিষ্ময়কর বৈপরিত্য রয়েছে। এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে সংক্ষিপ্তাকারে একদম শেষে।  

EU Slams Iran Stoning as Report Shows Spike in Executions | Europe | News  and current affairs from around the continent | DW | 24.07.2008

প্রথমে ব্যভিচার সম্পর্কে কোরানের কোন কোন আয়াতে কী কী বলা হয়েছে এবং কিরূপ শাস্তির সংস্থান রয়েছে সেগুলি আগে দেখে নেওয়া যাক। আয়াতগুলি নীচে একসঙ্গে উদ্ধৃত করা হলো -   

  • ব্যভিচারিণী ও ব্যাভিচারী তাদের প্রত্যেককে একশ’ কশাঘাত করবে, আল্লাহ্‌র বিধান কার্যকরীকরণে তাদের প্রতি দয়া যেন তোমাদের প্রভাবিত না করে। যদি তোমরা আল্লাহ্‌ ও পরকালে বিশ্বাসী হও, মুমিনদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে। ২৪/২ (সুরা নুর) 

    ·    ব্যাভিচারী কেবল ব্যাভিচারিণী অথবা মুশরিক নারীকে ছাড়া বিয়ে করবে না এবং ব্যভিচারিণীকে কেবল ব্যভিচারী অথবা মুশরিক ছাড়া বিয়ে করবে না। আর মুমিনদের উপর এটা হারাম করা হয়েছে। ২৪/ (সুরা নুর)

    যাহারা সাধ্বী রমণীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে এবং চারজন সাক্ষী উপস্থিত করে না, তাদেরকে আশিটি কশাঘাত করিবে এবং কখনও তাহাদের সাক্ষী গ্রহণ করিবে না; ইহারাই তো সত্যত্যাগী। ২৪/৪ (সুরা নুর) 


 

  • তবে যদি ইহার পর উহারা তওবা করে এবং নিজেকে সংশোধন করে, আল্লাহ্‌ তো অতিশয় ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। ২৪/৫ (সুরা নুর) 

 

  • এবং যাহারা নিজেদের স্ত্রীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে অথচ নিজেরা ব্যতীত তাহাদের কোন সাক্ষী নাই, তাহাদের প্রত্যেকের সাক্ষ্য হবে এই যে, সে আল্লাহ্‌র নামে চারবার শপথ করিয়ে বলিবে যে, সে অবশ্যই সত্যবাদী, ২৪/৬ (সুরা নুর) 

 

  • এবং পঞ্চমবারে বলিবে যে, সে মিথ্যাবাদী হইলে তাহার উপর নামিয়া আসিবে আল্লাহ্‌র লা’নত। ২৪/৭ (সুরা নুর) 

 

  • তবে স্ত্রীর শাস্তি রহিত হইবে যদি সে চারবার আল্লাহ্‌র নামে শপথ করিয়া সাক্ষ্য দেয় যে, তাহার স্বামীই মিথ্যাবাদী, ২৪/৮ (সুরা নুর) 

 

  • এবং পঞ্চমবার বলে যে, তাহার স্বামী সত্যবাদী হইলে তাহার উপর নামিয়া আসিবে আল্লাহর গযব। ২৪/৯ (সুরা নুর) 

 

  • তোমাদের প্রতি আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ ও দয়া না থাকিলে তোমাদের কেই অব্যাহতি পাইতে না; এবং আল্লাহ্‌ তওবা গ্রহণকারী ও প্রজ্ঞাময়। ২৪/১০ (সুরা নুর) 

 

  • তোমাদের নারীদের মধ্যে যারা ব্যাভিচার করে তাহাদের বিরুদ্ধে তোমাদের মধ্য হইতে চারজন সাক্ষী তলব করিবে। যদি তাহারা সাক্ষ্য দেয় তবে তাহাদেরকে গৃহে অবরুদ্ধ করিবে, যে পর্যন্ত না তাহাদের মৃত্যু হয় অথবা আল্লাহ তাহাদের জন্যে অন্য কোন ব্যবস্থা না করেন। [সুরা নিশা, :] 

  • আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি স্বাধীন (الْمُحْصَنَاتِ) মুসলমান নারীকে বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে না, সে তোমাদের অধিকারভুক্ত মুসলিম ক্রীতদাসীদেরকে বিয়ে করবে। আল্লাহ তোমাদের ঈমান সম্পর্কে ভালোভাবে জ্ঞাত রয়েছেন। তোমরা পরস্পর এক, অতএব, তাদেরকে তাদের মালিকের অনুমতিক্রমে বিয়ে কর এবং নিয়ম অনুযায়ী তাদেরকে মোহরানা প্রদান কর এমতাবস্থায় যে, তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে-ব্যভিচারিণী কিংবা উপ-পতি গ্রহণকারিণী হবে না। অতঃপর যখন তারা বিবাহ বন্ধনে এসে যায়, তখন যদি কোন অশ্লীল কাজ করে, তবে তাদেরকে স্বাধীন নারীদের (الْمُحْصَنَاتِ) অর্ধেক শাস্তি ভোগ করতে হবে। ব্যবস্থা তাদের জন্যে, তোমাদের মধ্যে যারা ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে ভয় করে। আর যদি সবর কর, তবে তা তোমাদের জন্যে উত্তম। আল্লাহ ক্ষমাশীল, করুণাময়। [সুরা নিশা, :২৫] 

 

ব্যভিচারের শাস্তির বিধান নিয়ে প্রচুর হাদিস দেখয়া যায়। সেই সব হাদিসেও দেখা যায় দু’রকমের শাস্তির বিধান রয়েছে। অর্থাৎ ব্যভিচারী যদি অবিবাহিত হয় তারজন্যে এক রকম শাস্তি, আর যদি বিহাবিত হয়ে তারজন্য অন্য রকম শাস্তি। প্রথমটির ক্ষেত্রে ব্যভিচারীকে একশ’টি চাবুক মারা এবং এক বছরের জন্যে দেশত্যাগী করা, আর দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে ব্যভিচারীকে পাথর মেরে হত্যা করা। দেখা যাক সেই রকম দু’টি হাদিস দু’টি হাদিস গ্রন্থ থেকে। মুসলিম শরীফের একটি হাদিস হলো এরূপঃ   

·         ... রাসূলে পাক এরশাদ করেছেন, তোমরা আমার নিকট হতে গ্রহণ কর, তোমরা আমার নিকট হতে গ্রহণ কর, তোমরা আমার নিকট হতে গ্রহণ কর ওর্থাৎ জেনে নাও) যে, নিশ্চয়ই আলাহ পাক নারীদের জন্য একটি পথ বের করে দিয়েছেন। কোন অবিবাহিত পুরুষ কোনা অবিবাহিতা নারীর সাথে ব্যভিচার করলে একশ’ করে বেত্রাঘাত (চাবুক) মার এবং এক বছরের জন্য দেশত্যাগী কর। আর বিবাহিত পুরুষ কোন বিবাহিত নারীর সাথে ব্যভিচার করলে তাদেরকে প্রথমে একশত করে চাবুক মার, তারপর প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যা কর।  (মুসলিম শরীফ, হাদিস নং ৪২৬৯, দ্রঃ (মুসলিম শরীফ ১-৮ খণ্ড একত্রে, সোলেমানিয়া বুক হাউস, বাংলাবাজার, ঢাকা) প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে অনুরূপ শাস্তির বিধান রয়েছে  ৪২৭০ থেকে ৪২৭৪ নং হাদিসেও।

অনুরূপ কয়েকটি হাদিস রয়েছে তিরমিযি হাদিসেও। তার মধ্যে একটি হাদিস হলো এরূপঃ

·          উবাদা ইবনুস সামিত (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমার নিকট হতে তোমরা জেনে নাও। তাদের (যিনাকারীদের) জন্য আল্লাহ তা’আলা একটা রাস্তা (ব্যবস্থা) করে দিয়েছেন। বিবাহিত পুরুষ ও স্ত্রীলোক যিনা করলে তাদের প্রত্যেককে একশত ঘা চাবুক মারতে হবে, তারপর পাথর মেরে হত্যা করতে হবে। অবিবাহিত পুরুষ বা স্ত্রীলোক যিনা করলে তাদের প্রত্যেককে একশত ঘা চাবুক মারতে হবে এবং এক বছরের জন্য নির্বাসনে পাঠাতে হবে।  (তিরমিযি, হাদিস নং – ১৪৩৪)     

ইসলামের চোখে সমকামিতাও ব্যাভিচার। এ বিষয়েও কোরানে অনেকগুলি আয়াত আছে। সেগুলি নিয়ে এর পরে আলোচনা করা হবে, তখন আয়াতগুলিও উদ্ধৃত করা হবে। এখন ব্যাভিচার নিয়ে উপরে উদ্ধৃত আয়াতগুলি পর্যালোচনা করা যাক।  (ক্রমশঃ)

 

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...