সিএএ এবং এনআরসি-র বিরুদ্ধে নজিরবিহীন অরাজনৈতিক গণআন্দোলন
গোটা দেশে সিএএ, এনআরসি ও এনপিআরের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। যতদিন যাচ্ছে আন্দোলনটি ততো তীব্র হচ্ছে। আন্দোলনটি অতি অল্প সময়েই আক্ষরিক অর্থেই জন-আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। আন্দোলনের পুরোভাগে রয়েছে ছাত্র-যুব, নারী ও নাগরিক সমাজ, পরে নেমেছে কয়েকটি রাজনৈতক দল। স্বাধীনোত্তর ভারত অনেক বড়ো বড়ো গণআন্দোলন দেখেছে, কিন্তু সিএএ, এনআরসি ও এনপিআর বিরোধী গণআন্দোলনে যে কয়েকটি বিশেষ চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হচ্ছে তা অতীতে কোনো আন্দোলনে পরিলক্ষিত হয় নি। এই গণআন্দোলনের বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো হলো এরকমঃ ১). আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষ অংশ গ্রহণ করেছে দলীয় পতাকাকে দূরে সরিয়ে রেখেই। ২). আন্দোলনটি শুরু করে প্রথম জনগণই, পরে নামে রাজনৈতিক দলগুলো। ৩). আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেছে বিপুল সংখ্যক নারী যাদের মধ্যে চির পর্দানসীন গৃহবন্দি মুসলিম নারীর সংখ্যাই অধিক। তারা শুধু অংশ গ্রহণই করেই নি, আন্দোলনের একেবারে পুরোভাগে রয়েছে। ৪). আন্দোলনে মুসলিম সমাজের মানুষ অংশ নিয়েছে ব্যাপক সংখায়, কিন্তু তারা তাদের ধর্মীয় পতাকা ও ধর্মীয় নেতাদের কাছে ঘেঁষতে দেয় নি। ৫). মুসলিম নারীরা গৃহবধূ ও ছাত্রী নির্বিশেষে বিরাট সংখ্যায় গোটা দেশ জুড়ে ডিসেম্বর-জানুয়ারির হাড় কাঁপানো কনকনে হিমশীতল ঠাণ্ডার মধ্যেও বিভিন্ন রাস্তায় বসে অবস্থান আন্দোলন শুরু করেছে এবং অদ্যাবধি চালিয়ে যাচ্ছে (দিল্লীর শাহিনবাগের অবস্থান বা ধর্ণা ইতিমধ্যেই দু'মাস পূরণ হতে চলেছে)। হাতে রয়েছে তাদের ধর্মীয় পতাকার পরিবর্তে জাতীয় পতাকা ও দেশের সংবিধান এবং মুখে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সংবিধান রক্ষা করার মুহুর্মুহু শ্লোগান। অমুসলিম সমাজের ব্যাপক মানুষ নারী পুরুষ নির্বিশেষে তৈরি করা খাবার, শুকনো খাবার, বাচ্চাদের দুধ, পানীয় জল, ঔষধ, ইত্যাদি প্রয়োজনীয় সব রকম জিনিসপত্র নিয়ে অবস্থানরত এই নারীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এগিয়ে এসেছেন বহু ডাক্তার ও ফার্মাসিস্টরাও এবং স্থাপন করেছেন অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্পও। ৬). সরকারের জনস্বার্থবিরোধী কিংবা রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন হোক কিংবা হিংসাত্মক আন্দোলনই হোক সব আন্দোলনই করে থাকে মূলত পুরুষরা, আর নারী তাদের সর্বপ্রকারের সহযোগিতা করে থাকে, এটাই এ দেশের সর্ব কালের দস্তুর। সিএএ ও এনআরসি বিরোধী আন্দোলন সর্বকালের সেই নিয়ম উল্টে দিয়েছে। এই আন্দোলনে মুসলিম নারী পথে নেমেছে, তারা রয়েছে আন্দোলনের পুরোভাগেই আর পুরুষগণ তাদের সর্বপ্রকার সাহায্য করছে। ৭). গোটা দেশজুড়ে ইতিহাসবিদ, অভিনেতা, অভিনেত্রী, নাট্যব্যক্তিত্ব, শিল্পী, লেখক - অধ্যাপক, গায়ক-গায়িকা রাজনৈতিক পতাকা ছাড়াই শ'য়ে শ'য়ে এই আন্দোলনে পথে নেমেছে। অতীতে নাগরিক সমাজ সরকারের বিরুদ্ধে কখনো এভাবে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র পরিচয় নিয়ে এত বিপুল সংখ্যায় আন্দোলনে শামিল হয় নি। তারা কেন্দ্রীয় সরকারকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে যে সিএএ ও এনআরসিকে তারা প্রত্যাখ্যান করছেন এবং নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্যে সরকারের কাছে কোনো প্রমাণ পত্র জমা দেবে না এবং তার পরিণতিতে ডিটেনশন ক্যাম্প তথা কারাগারে যেতে প্রস্তুত। এবং এটাই হয়ে গেছে এখন সর্বস্তরের আন্দোলনকারীদের মুখের ভাষা। স্বাধীন ভারতে নাগরিক সমাজকে কোনো সরকারকে এমন সংঘবদ্ধভাবে এ রকম চ্যালেঞ্জ জানাতে দেখা যায় নি। ৮). আন্দোলনের শুরুতে আন্দোলনকারীরা হিংসাত্মক হয়ে উঠলেও পরে তারা নাগরিক সমাজ ও মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপে হিংসাত্মক পথ পরিহার করে এবং সবার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে শামিল হয়।
এ কথা বলা বাহুল্য যে, নাগরিকত্ব হারানোর ভয় ও আতঙ্কই মুসলিম সমাজের তরুণ ও যুবাদের হিংসার পথে নিয়ে গিয়েছিল। হিংসাশ্রয়ী ছেলেরা হিংসার পথ পরিহার করে শান্তিপূর্ণ বিশ্বের ইতিহাসে এমন উদাহরণ থাকলেও তা বিরল। ৯). আন্দোলনটি গোটা দেশ ও দুনিয়ায় এমন আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে যার সারা বিশ্বে বোধ হয় বেনজির। এমনকি মোদিজীর বিশেষ বন্ধু ট্রাম্পের দেশ থেকেও সিএএ ও এনআরসি বাতিল করার দাবি উঠেছে। আমেরিকার দুটি নামকরা শহরের (সিটল ও কেমব্রিজ সিটির) স্থানীয় সরকার সিএএ ও এআসির বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করে সেই প্রস্তাবে ভারত সরকারকে সিএএ ও এনআরসি প্রত্যাহার করতে অনুরোধ করা হয়েছে। সিএএ ও এনআরসির জন্যেই ভারত সরকার এখন কার্যত আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় একঘরে হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এদিকে ভারতের অভ্যন্তরে একের এক রাজ্যের বিধানসভা সিএএ-এর বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাশ করেছে যার মধ্যে কেরালা, পাঞ্জাব, রাজস্থান, পশ্চিমবঙ্গ, মধ্যপ্রদেশ, পণ্ডিচেরি প্রভৃতি রাজ্যগুলো রয়েছে।
এক কথায় স্বাধীনোত্তর ভারত এমন আলোড়ন সৃষ্টি করা আন্দোলন কখনো দেখে নি। দেশে বিদেশে সিএএ ও এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের প্রতি এই অভাবনীয় বিপুল সমর্থন দেখে মোদি সরকার ও শাসকদলের সব হিসাবনিকাশ গুলিয়ে যাচ্ছে। সিএএ পাশ করানোর সময় বিজেপি সরকারের দুই স্তম্ভ প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও শাসকদলের নেতৃবৃন্দের শরীরী ভাষায় ফুটে উঠেছিল বহুদিনের ঈপ্সিত লক্ষ্য (হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণ) স্পর্শ করার অপার আনন্দ ও উচ্ছ্বাস। তার সঙ্গে ছিল বেলাগাম অহংকার ও ঔদ্ধত্যও। সিএএ ও এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের প্রতি সর্বস্তরের জনগণের অংশ গ্রহণ, সমর্থন ও সহানুভূতির ব্যাপকতা ও তীব্রতা দিন দিন যতো বেড়েছে তাদের শরীরি ভাষা ততো ফ্যাকাসে ও বিবর্ণ হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে যাবতীয় অহংকার ও ঔদ্ধত্যৈর আস্ফালন অন্তর্হিত হতে শুরু করেছে। তাদের মুখের বচনও পাল্টাতে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী, তাঁর মন্ত্রী পারিষদ ও শাসকদলের নেতারা মিউ মিউ করে আত্মরক্ষার ঢঙে কথা বলা শুরু করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, না না, এনআরসি নিয়ে সরকারি স্তরে কোথাও কোনো আলোচনা হয় নি। সিএএ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পারিষদ বলছেন এই আইন তো নাগরিকত্ব দেবার জন্যে, কারো নাগরিকত্ব কেড়ে নেবার জন্যে নয়। বিরোধী দলগুলো ও আন্দোলনকারীরা অযথা মানুষকে বিভ্রান্ত ও মুসলিমদের ভয় দেখাচ্ছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পারিষদ যে মিথ্যাচার করছেন ও মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে প্রতারণা করছেন তা বুঝতে কারো অসুবিধা হচ্ছে না।অবশ্য মাঝে মাঝে হুমকিও শোনা যাচ্ছে তাঁদের কন্ঠে। বলছেন যে আন্দলনের চাপ যতোই হোক না কেন সিএএ ও এনআরসি প্রত্যাহার করা হবে না।
কারো নাগরিকত্ব যাবে না, মোদি সরকারেরে এই আশ্বাস বাণী একটা ভয়ংকর মিথ্যাচার
সিএএ-এর গোটা কথাটা হলো সিটিজেনশিপ এ্যামেণ্ডমেন্ট এ্যাক্ট ২০১৯। হ্যাঁ, এই আইনে কারো নাগরিকত্ব কেড়ে নেবার কথা বলা হয় নি, বলা হয়েছে নাগরিকত্ব দেবারই কথা। আপাতদৃষ্টিতে এ কথা সত্যি বটে, কিন্তু বাস্তবে আদৌ নয়। বাস্তবে এটা অর্ধ সত্য যা মিথ্যা্র চেয়েও ভয়ংকর। এই সত্যটা অবশ্যই অর্ধ সত্য, কারণ এটা স্বয়ং সম্পূর্ণ আইন নয়, এনআরসি-র সঙ্গে এর অবিচ্ছ্বেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। আসামে এনআরসি-র ব্যর্থতা ঢাকতে তড়িঘড়ি সিএএ প্রণয়ন করা হয়েছে। এখানে এনআরসি-র ব্যর্থতার একটি বিশেষ অর্থ রয়েছে। তাহলো, বিজেপি চেয়েছিল এনআরসি-র সাহায্যে ব্যাপক সংখ্যক (লক্ষ্যমাত্রা ছিলো পঞ্চাশ হাজার) মুসলিমদের অনুপ্রবেশকারী প্রমাণ করে ভারত থেকে গলা ধাক্কা দিয়ে বার করে দেওয়া। কিন্তু তাদের সে সাধ পূরণ হয় নি। কারণ, এনআরসির চূড়ান্ত তালিকায় যাদের নাম ওঠে নি তাদের মধ্যে ১২ লক্ষই হিন্দু। সেই ১২ লক্ষ হিন্দুদের জন্যেই মূলত সিএএ প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই আইনে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, পার্সি, জৈন ও শিখ ধর্মের মানুষকে নাগরিকত্ব দেবার কথা রয়েছে। সুতরাং এটা স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে সিএএ ও এনআরসি পরষ্পরের পরিপূরক বা সম্পূরক এবং অবিচ্ছেদ্য। কথাটা এভাবেও বলা যায়, সিএএ হলো এনআরসির গর্ভজাত সন্তান। এনআরসির কাজ হলো নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া, আর সিএএ-এর কাজ হলো যাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হবে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আসা মানুষের মধ্যে মুসলমান বাদে হিন্দু সহ উপরে উল্লেখিত পাঁচটি ধর্মের মানুষদের তথা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া। এর অর্থ হলো, এনআরসি যদি মুসলিমদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়, তবে তারা ভারতীয় নাগরিক হলেও, নাগরিকত্ব ফিরে পাবে না। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে, হিন্দু ধর্ম সহ ৬টি ধর্মের মানুষদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেবে, কিন্তু মুসলমানদের ফেরত দেবে না। সুতরাং সিএএ-তে কারো নাগরিকত্ব যাবে না এ কথাটা অর্ধ সত্য। যেহেতু সিএএ নাগরিকত্ব দেবার বা ফিরিয়ে দেবার প্রশ্নে মুসলমানদের জন্যে সব দরজা বন্ধ করে দিয়েছে, তাই আসামের এনআরসি তালিকায় যে মুসলিমদের (তিন লক্ষ, মতান্তরে পাঁচ লক্ষ) নাম নেই তাদের দেশ ছাড়া হতে হবে, না হয় কারাগারে পচে মরতে হবে। এ ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা থাকলো না।
আসামের এনআরসি ধর্মীয় বিভেদকামী ও মুসলিম-বিদ্বেষী ছিলো না
আসামের এনআরসি ধর্মীয় বিভেদকামী ও মুসলিম-বিদ্বেষী ছিলো না
আসামে ১৯৮৫ সালে এনআরসি তৈরী করার জন্যে যে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হয়েছিল সেটা মোটেই ধর্মীয় বিভেদমূলক ও সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্ট ছিলো না। এনআরসি তথা জাতীয় নাগরিক পঞ্জী তৈরী করার উদ্দেশ্য ছিলো জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অবৈধ ভাবে প্রবেশ করা অভিবাসীদের খুঁজে বার করে তাদের দেশ থেকে বার করে দেওয়া। চুক্তিটি সম্পাদিত হয়েছিল আসু ও সারা আসাম গণসংগ্রাম পরিষদের প্রবল গণআন্দোলনের চাপে। সেই চুক্তির সম্পাদনের মধ্য দিয়েই দীর্ঘ ৬ বছরের আসু ও সারা আসাম গণসংগ্রাম পরিষদের গণআন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে। তাদের আন্দোলনের দাবি ছিল অবৈধ অভিবাসীদের চিহ্নিত করে ফেরত পাঠাতে হবে। সেই দাবি মেনে নিয়েই রাজীব গান্ধীর কেন্দ্রীয় সরকার ও তৎকালীন কংগ্রেসের আসাম সরকার আসু ও সারা আসাম গণসংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী ছিল আসু ও সারা আসাম গণসংগ্রাম পরিষদও। আসু ও আসাম গণসংগ্রাম পরিষদ তখন ১৯৬৬ সালের ১লা জানুয়ারীর আগে যারা আসামে এসেছে তাদের গ্রহণ করে নিতে এবং নিয়মিতকরণ করতে সম্মত হয়েছিল। পরে কেন্দ্রীয় সরকার তাতে একটি সংশোধনী নিয়ে আসে। সেই সংশোধনীতে বলা হয় যে, ১৯৭১ সালের ২৪ শে মার্চের মধ্যে যারা আসামে এসেছে তাদেরও ভারতীয় নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করে নিয়মিতকরণ করা হবে। তারপরে যারা ভারতে এসেছে তাদের চিহ্নিত করে ফেরত পাঠানো হবে। এই ছিল ১৯৮৫ সালের আসাম চুক্তির মূল কথা। অর্থাৎ আসু ও সারা আসাম গণসংগ্রাম পরিষদ আসামে অবৈধ উপায়ে প্রবেশকারী অভিবাসীদের চিহ্নিত করে বহিষ্কার করার দাবিতে যে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলে তার মধ্যে কোনোরূপ জাতি-বিদ্বেষ, বর্ণ-বিদ্বেষ বা ধর্ম-বিদ্বেষ ছিল না। বিপুল সংখ্যক অবৈধ অভিবাসীদের চাপে আসামের ভাষা, নিজস্ব সংস্কৃতি ও অর্থনীতি বিপন্ন হয়ে উঠেছে - এটা ছিল তাদের আন্দোলনের মূল কথা। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর অবৈধ অভিবাসী কথাটির উপর ধর্মীয় লেবেল সেঁটে দেয়। অবৈধ অভিবাসীদের মধ্যে বিভাজন করে একটা জঘন্য সাম্প্রদায়িক মনোভাব থেকে। সরাসরি মুসলিম ও অমুসলিম এই দু ভাগে তাদের বিভাজিত করে। যারা মুসলমান তারা অনুপ্রবেশকারী, আর যারা অমুসলমান তারা শরণার্থী। এই হীন মনোভাব থেকেই তারা আসামের এনআরসির অভিমুখটাই ঘুরিয়ে দেয় মুসলমানদের দিকে। বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকার এবং আসামের রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত করে এনআরসিকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে একটি মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই আসামের রাজ্য সরকার এনআরসির কাজ শুরু করে জোর কদমে। অবশ্য আসামে এন আরসির কাজ শুরু করার নির্দেশও ছিল সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এনআরসি যে তাদের কাছে বুমেরাং হয়ে প্রত্যাঘাত করতে পারে সে আন্দাজ তাদের ছিলো না।
বিজেপি সরকারেরে শরণার্থী নীতিটি ধর্মীয়-বিদ্বেষী মনোভাবাপন্ন
এনআরসি তথা জাতীয় নাগরিক পঞ্জী তৈরি করায় কোনো আপত্তি নেই। হওয়াটা যে খুব জরুরী তাও নয়। আর আসামের এনআরসি হোক কিংবা মোদি সরকার সারা ভারতে যে এনআরসি তৈরি করতে চায় সেটাই হোক, এগুলো মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোনোভাবেই সমর্থন যোগ্য নয়। কারণ, বিজেপি সরকার যে মতলবে গোটা দেশে এনআরসি তৈরি করতে তার উদ্দেশ্য দুরভিসন্ধিমূলক। সেটা হলো, ভারত থেকে ব্যাপক সংখ্যক মুসলিমদের তাড়ানো। সারা পৃথিবীতেই অনুপ্রবেশ সমস্যা রয়েছে, ভারতেও আছে। বিশ্বে যতদিন ধনী ও গরীবের বৈষম্য থাকবে, ধনী দেশ ও গরীব দেশ থাকবে, রাষ্ট্রীয় অত্যাচার ও নিপীড়ন থাকবে, বর্ণবৈষম্য থাকবে, ধর্মীয় মৌলবাদ ও ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ থাকবে ততদিন অনুপ্রবেশের সমস্যা থাকবে। যে দেশে যত বেশি অনুপ্রবেশ ঘটে তাদের অনুপ্রবেশজনিত সমস্যা তত বেশি। যারা রাষ্ট্রীয় নির্যাতন কিংবা ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে কিংবা যুদ্ধের কারণে প্রাণ রক্ষার্থে স্বদেশ পরিত্যাগ করে এবং ভিন্ন দেশে অবৈধ ভাবে প্রবেশ করে তাদের শরণার্থী বলে। মানবিক কারণেই এই সব শরণার্থীদের আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসা সহ প্রয়োজনীয় সব রকমের সাহায্য দেওয়া হয়। এটা একটা সর্বজন গ্রাহ্য আন্তর্জাতিক নীতি। কিন্তু যারা অন্য কারণে, এবং যথেষ্ট যুক্তি সঙ্গত কারণেই, স্বদেশ পরিত্যাগ করে ভিন দেশে যায় বৈধ অনুমিতি ছাড়াই তাদের প্রতি রাষ্ট্রের, দেশের ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী কীরূপ হওয়া বাঞ্ছনীয়? তাদের ক্ষেত্রে কি অমানবিক হওয়াই কি রাষ্ট্রীয় নীতি বা সমাজের নীতি হওয়া বাঞ্ছনীয় ? গোটা বিশ্বেই তো কাজের সন্ধানে মানুষ দেশান্তরী হয়তে হয় নিরুপায় হয়ে। এই নিরুপায় দরিদ্র কর্মচ্যুত মানুষ কিংবা বেকার ছেলেমেয়েরা কি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী ও সহানুভূতি পেতে পারে না? শ্রমিক রপ্তানি করা বহু দেশের একটা বিধি সম্মত বৈদেশিক নীতি। এরূপ ব্যবসা করে যেমন বহু বেসরকারি কোম্পানী, তেমনি করে বহু সরকারও। আমাদের ভারত থেকেও মধ্যপ্রাচ্যে অসংখ্য মানুষ যায় বেসরকারি সংস্থার হাত ধরে কাজের জন্যে। বাংলাদেশ থেকে তো যায় হাজারে হাজারে। ভিন দেশে মানুষ বা শ্রমিক রপ্তানি করার পশ্চাতে কি শুধুই ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গীই থাকে, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী একেবারেই থাকে না? নিশ্চয়ই থাকে। কিন্তু যারা সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার হাত ধরে ভিন দেশে যেতে পারে না, বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ ভাবে দেশান্তরি হয় তাদের প্রতি কি রাষ্ট্র কিংবা রাজনৈতিক দলগুলো মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী দেখাতে পারে না? ইউরোপের দেশগুলি ও সেখানকার নাগরিক সমাজ তো সেই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী প্রদর্শনে কার্পণ্য করে না। ট্রাম্প পূর্ববর্তী আমেরিকাও তো কখনো করে নি। ইউরোপের দেশগুলো তো সেই সব অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কড়া মনোভাব করে তাদের দেশ থেকে তাড়ানোর কথা বলে না। আমাদের দেশ ভারতের সংস্কৃতিও অনুরূপ। অতীতে সব সরকারই তো অবৈধ অভিবাসীদের উদারনৈতিক দৃষ্টিভিঙ্গী ও মনোভাব প্রদর্শন করেছে চিরদিন, কাউকে তো তাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে নি। এমনকি বিজেপির নেতা অটলবিহারি বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারও তো একই নীতি প্রদর্শন করেছে। গুজরাটে মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের মদতে ও প্রশ্রয়ে যে মুসলিম নিধন যজ্ঞ হয়েছিল তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অটলবিহারি বাজপেয়ী। গুজরাটের সেই বীভৎস গণহত্যাকান্ডে বাজপেয়ী মোদিকে তখন যা বলেছিলেন তাতো আমাদের স্মরণে আজও সমান সমুজ্জ্বল। তিনি মুখ্যমন্ত্রী মোদিকে রাজধর্ম পালন করতে বলেছিলেন। বলা বাহুল্য যে, মোদি তা করেন নি। মুসলমানদের প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মোদির দৃষ্টিভঙ্গী ও মনোভাব প্রধানমন্ত্রী মোদির দৃষ্টিভঙ্গী ও মনোভাব একই রয়ে গেছে। বরং তিনি মুসলমানদের প্রতি আরও বেশী বিরূপ মনোভাব নিয়ে রাজধর্ম পালন করা বিরত রয়েছেন।
মোদি সরকারের শরণার্থী নীতিটি মুসলমানদের প্রতি তাঁর ঐ মনোভাব থেকেই তৈরি। অবৈধ অভিবাসীদের ধর্মীয় বিভাজনও ঐ মনোভাব থেকেই জাত। একদল অবৈধ অভিবাসী (হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, শিখ, জৈন ও পারসিক) হলো শরণার্থী, আর একদল অভিবাসী (মুসলমান) হলো অনুপ্রবেশকারী। মোদি সরকার শরণার্থীদের জন্যে অর্থাৎ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, শিখ, জৈন, ও পার্সিদের জন্যে প্রণয়ন করেছে সিএএ। সুতরাং মোদি সরকার কী সাফাই দিল তাতে কিছু যায় আসে না, সিএএ যে একটি ধর্মীয় বিভেদমূলক এবং মুসলিম-বিদ্বেষ প্রসূত আইন তা দিনের আলোর মতন স্বচ্ছ ও পরিষ্কার।
বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসীদের শুধু অনুপ্রবেশকারী হিসেবেই বিজেপি ও আরএসএস দেখে না। তাদের সকলকেই তারা মুসলিম মৌলবাদী ও মুসলিম সন্ত্রাসবাদী বলে মনে করে। এ কথা অনস্বীকার্য্য যে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে অনেক মুসলিম সন্ত্রাসবাদী ভারতে প্রবেশ করে এবং সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ করে। এমনকি তারা এদেশে কিছু মুসলিম জিহাদি অন্তর্জাল (নেট ওয়ার্ক/Net work) তৈরি করেও ফেলেছে। বলা বাহুল্য যে তাদের বিরুদ্ধে আমি সর্বদা সোচ্চার এ কথা সর্বজন বিদিত। তাদের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা (Zero tolerance) নীতি নিয়ে তাদের মূলোচ্ছেদ করুক আমি সর্বাগ্রে চাই। কিন্তু অবৈধ অভিবাসী সব মুসলমানই জঙ্গী ও সন্ত্রাসী এ কথা মানা যায় না। মানা যায় না, কারণ, তা একটা অতি নিম্নরুচির জঘন্য মিথ্যাচার যা এসেছে মুসলিম-বিদ্বেষ থেকে। শুধু ঐ অভিবাসী মুসলমানদের সম্পর্কে নয়, আরএসএস ও বিজেপির কট্টর লোকজন সমস্ত মুসলিমদের সম্পর্কেই ঐ একই ধারণা পোষণ করে। এটা আমার নিছক অনুমান কিংবা অমূলক সন্দেহ নয়, এ বিষয়ে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও রয়েছে। একজন অনামী লেখক হলেও হিন্দু সমাজের বহু মানুষের সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয় আছে যাদের অনেকেই আরএসএস ও বিজেপির মতাদর্শে বিস্বাসী। তাদের সঙ্গে আলাপ কালে তাদের সেই অমূলক ভ্রান্ত ধারণার প্রকাশ পেয়েছি। আমার মনে হয় বর্তমান বিজেপি সরকার সেই ভ্রান্ত ধারণার শিকার এবং তার দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে।
মোদি সরকারের শরণার্থী নীতিটি মুসলমানদের প্রতি তাঁর ঐ মনোভাব থেকেই তৈরি। অবৈধ অভিবাসীদের ধর্মীয় বিভাজনও ঐ মনোভাব থেকেই জাত। একদল অবৈধ অভিবাসী (হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, শিখ, জৈন ও পারসিক) হলো শরণার্থী, আর একদল অভিবাসী (মুসলমান) হলো অনুপ্রবেশকারী। মোদি সরকার শরণার্থীদের জন্যে অর্থাৎ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, শিখ, জৈন, ও পার্সিদের জন্যে প্রণয়ন করেছে সিএএ। সুতরাং মোদি সরকার কী সাফাই দিল তাতে কিছু যায় আসে না, সিএএ যে একটি ধর্মীয় বিভেদমূলক এবং মুসলিম-বিদ্বেষ প্রসূত আইন তা দিনের আলোর মতন স্বচ্ছ ও পরিষ্কার।
বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসীদের শুধু অনুপ্রবেশকারী হিসেবেই বিজেপি ও আরএসএস দেখে না। তাদের সকলকেই তারা মুসলিম মৌলবাদী ও মুসলিম সন্ত্রাসবাদী বলে মনে করে। এ কথা অনস্বীকার্য্য যে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে অনেক মুসলিম সন্ত্রাসবাদী ভারতে প্রবেশ করে এবং সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ করে। এমনকি তারা এদেশে কিছু মুসলিম জিহাদি অন্তর্জাল (নেট ওয়ার্ক/Net work) তৈরি করেও ফেলেছে। বলা বাহুল্য যে তাদের বিরুদ্ধে আমি সর্বদা সোচ্চার এ কথা সর্বজন বিদিত। তাদের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা (Zero tolerance) নীতি নিয়ে তাদের মূলোচ্ছেদ করুক আমি সর্বাগ্রে চাই। কিন্তু অবৈধ অভিবাসী সব মুসলমানই জঙ্গী ও সন্ত্রাসী এ কথা মানা যায় না। মানা যায় না, কারণ, তা একটা অতি নিম্নরুচির জঘন্য মিথ্যাচার যা এসেছে মুসলিম-বিদ্বেষ থেকে। শুধু ঐ অভিবাসী মুসলমানদের সম্পর্কে নয়, আরএসএস ও বিজেপির কট্টর লোকজন সমস্ত মুসলিমদের সম্পর্কেই ঐ একই ধারণা পোষণ করে। এটা আমার নিছক অনুমান কিংবা অমূলক সন্দেহ নয়, এ বিষয়ে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও রয়েছে। একজন অনামী লেখক হলেও হিন্দু সমাজের বহু মানুষের সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয় আছে যাদের অনেকেই আরএসএস ও বিজেপির মতাদর্শে বিস্বাসী। তাদের সঙ্গে আলাপ কালে তাদের সেই অমূলক ভ্রান্ত ধারণার প্রকাশ পেয়েছি। আমার মনে হয় বর্তমান বিজেপি সরকার সেই ভ্রান্ত ধারণার শিকার এবং তার দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে।
পরিশেষে আর একটা সমান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এ লেখাটি শেষ করতে চাই। তা হলো, রাষ্ট্রের প্রশ্রয়ে মুসলিম মৌলবাদীদের হাতে অত্যাচারিত হয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে উপরে উল্লেখিত ছ'টি ধর্মাবলম্বী মানুষই শুধু ভারতে অবৈধভাবে প্রবেশ করে নি, মুসলিম সমাজের অসংখ্য ধর্মনিরপেক্ষ মানুষও ঐ একই কারণে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেছে। প্রতিবেশী তিনটি মুসলিম দেশ থেকেই নির্যাতিত মানুষরা ভারতে আসে নি। রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও ধর্মীয় নির্যাতন হাজার হাজার তামিলরাও শ্রীলংকা থেকে ভারতে এসেছে এবং বহুদিন যাবত তারা তামিলনাড়ু সহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বসবাস করছে। সিএএ উক্ত তিনটি দেশ থেকে আসা মুসলিম সমাজের ধর্মনিরপেক্ষ ছিন্নমূল মানুষগুলো ও শ্রীলংকা থেকে আসা ছিন্নমূল তামিল জনগণের প্রতিও চরম বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে।
শেষ