Wednesday, June 2, 2021

আব্বাস সিদ্দিকীর দলের সঙ্গে জোট করে সিপিএম ধর্মনিরপেক্ষ নীতির লঙ্ঘন করে নি

 

এবারের (২০২১) বিধানসভা নির্বাচনে কং-বাম-আইএসএফ জোট নিয়ে সর্বত্র ব্যাপক চর্চা হচ্ছে। এটা শুরু হয় জোট গড়ার প্রস্তুতি পর্বে। জোট তথা সংযুক্ত মোর্চা গঠন করার পর চর্চার তীব্রতা অনেকটা বাড়ে। সেটা আকাশচুম্বী হয় নির্বাচনে সংযুক্ত মোর্চার ভরাডুবি হলে। 

চর্চা বা সমালোচনার অভিমুখ মূলত একটিই 

জোট গঠনের প্রস্তুতি পর্বেই চর্চা বা আলোচনার একটা নির্দিষ্ট অভিমুখ পরিলক্ষিত হয়। অভিমুখটি মূলত ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র বিরুদ্ধে। তাদের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ হলো তারা কম্যুনিস্ট পার্টির ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বিসর্জন দিয়ে একটি ইসলামী মৌলবাদী দলের সঙ্গে জোট করেছে। নীতিগত এই সমালোচনা যদি সঠিক বল ধরা হয় তবে এটা প্রাপ্য ছিলো কংগ্রেস দলেরও। কিন্তু সমালোচনায় বিদ্ধ করা হচ্ছে শুধু সিপিআই (এম)-কেই। এই সমালোচনার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। তা হলো, সমালোচকদের মধ্যে মূলত প্রাধান্য রয়েছে তাদেরই যারা সিপিআই (এম)-এর ঘোরতর বিরোধী। এই গোত্রের সমালোচকরা মনে করে যে কম্যুনিস্ট পার্টি হিসেবে সিপিআই (এম)-এর  কোনো বিশ্বাসযোগ্যতাই আর অবশিষ্ট নেই। তাদের একপেশে ও নেতিবাচক সমালোচনায় আমার মনে যুগপৎ বিষ্ময় ও একটা প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। প্রশ্নটি হলো, যারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে সিপিআই (এম) আদৌ আর কম্যুনিস্ট পার্টি নেই, তারা সিপিআই (এম)-এর ‘নীতিচ্যুত’ হওয়া নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছে কেন? অথচ তারা শুধু মাথাই ঘামাচ্ছে না, দলটাকে তারা লাগাতার ছিঁড়ে খাচ্ছে। তাদের সিপিআই (এম) – এর পেছনে জোঁকের মতন এই লেগে থাকা বিষ্ময়কর বৈকি! এই গোত্রের সমালোচকরা সবাই যে কম্যুনিস্টবিদ্বেষী তা কিন্তু নয়, তাদের মধ্যে একদল আছে যারা বামপন্থায় বিশ্বাসী। যারা মনে করে সিপিআই (এম) আদৌ আর কম্যুনিস্ট পার্টি নেই তাদের এই দলের ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে এত কথা বলার অর্থ কী তা আমাদের বোধগম্য হয় না।   

আইএসএফের সঙ্গে জোট নিয়ে সিপিআই (এম)-এর ভিতরেও অনেকেরই প্রশ্ন ও অসন্তোষ আছে। প্রশ্ন আছে দলের সমর্থক ও শুভান্যুধায়ীদের মধ্যেও। ফলে ঘরে ও বাইরে সর্বত্রই তাই দলের নেতৃত্বকে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে। এর আগে জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী না করা, সোমনাথ চ্যাটার্জীকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করা এবং পরমাণু চুক্তির প্রশ্নে ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করার প্রশ্নেও দলের ভিতরে ও বাইরে প্রবল সমালোচনা সামাল দিতে হয়েছিলো সিপিএমকে। সেই ইস্যুগুলি ছিলো সবটাই জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। আর এবার দলের রাজ্য নেতৃত্বকে ঘরে ও বাইরে নীতিগত প্রশ্নে যেভাবে কঠোর সমালোচনায় বিদ্ধ হতে হচ্ছে। এটা বোধ হয় অতীতে কখনো হয় নি, একেবারেই নজিরবিহীন ঘটনা।

  যত জ্বালা সব পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকীকে নিয়ে

দলের ভিতরে ও বাইরে সিপিআই (এম)-কে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করা নিয়েও এর আগে কম প্রশ্ন ও সমালোচনার মুখে পড়তে হয়নি। সে প্রশ্ন ও সমালোচনা এবারও রয়েছে। কিন্তু এটা এবার পেছনে চলে গেছে, বরং বলা যায় যে চাপা পড়ে গেছে। সবকিছু ছাপিয়ে সামনে উঠে এসেছে আব্বাস সিদ্দিকী ও তাঁর দল আইএসএফ ইস্যুটি। ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচন থেকেই সিপিআই (এম)-এর জনসমর্থন হ্রাস পাচ্ছে। এবারও সেটারই হয়েছে পুনরাবৃত্তি। কিন্তু এবার এর জন্যে মূলত দায়ী করা হচ্ছে সিপিআই (এম)-কে আইএসএফকে জোটে অন্তর্ভুক্ত করার নীতি ও পদক্ষেপকে। শুধু ভোটই কমে নি, বামফ্রণ্ট ও কংগ্রেসও যে নির্বাচনে এবার একটি আসনও পায় নি। তারজন্যেও মূলত দায়ী করা হচ্ছে সিপিআই (এম)-কে এবং সেই জোট নীতিকে। দায় চাপানোর ভঙ্গিটি এমনই যে আইএসএফকে জোটে না নিলে কংগ্রেস ও বামফ্রণ্টের ফল যেন ভালো হতো। কোন যুক্তিতে বা কোন তথ্যের ভিত্তিতে এমনটা বলা হচ্ছে ওরা জানায় নি। বামফ্রণ্টের শরীক দলগুলিও নির্বাচনে ভরাডুবির জন্যে দায়ী করছে আইএসএফের সঙ্গে জোটকে। তাদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে যে আইএসএফকে নিয়ে সংযুক্ত মোর্চা গঠনে যেন তাদের সম্মতি ছিলো না এবং তাদের উপর জোটটা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ বাস্তব সত্যিটা হলো আইএসএফকে জোটে নেওয়ার প্রশ্নে ফ্রণ্টের মধ্যে বেশ কয়েক দফা আলাপ আলোচনা হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত ঐক্যমতের ভিত্তিতেই আইএসএফকে জোটে নিয়ে সংযুক্ত মোর্চা গঠন করা হয়েছে।

নির্বাচনের প্রাক্কালে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক দল আইএসএফ এর নাম ও পতাকা কিন্তু যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।  আব্বাস যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে আসেন নি, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ মেনেই তিনি রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করতে চান তার স্বাক্ষর তিনি রেখেছেন দলের নামকরণ ও পতাকার রঙ নির্বাচনে।   রাজনৈতিক দল তৈরি করে ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবেন এ ঘোষণা যখন তিনি দেন তখনই গোটা রাজ্যে তোলপাড় শুরু হয়েছিলো। তাঁর সভা সমাবেশগুলিতে ব্যাপক জনসমাগম হতে দেখা গেছে। তা দেখে শাসকদল স্বাভাবিকভাবেই ভীষণ চিন্তায় ও চাপে পড়ে যায়। তারা চিন্তিত হয়ে পড়ে মুসলিম ভোট ব্যাংকের দখল রাখা নিয়ে। ফলে তারা শুরু করে সংগঠিত ও পরিকল্পিত অভিযান আব্বাসকে জনগণ থেকে, বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের কাছ থেকে, বিচ্ছিন্ন করার জন্যে। সে কাজে ফুরফুরা শরীফের প্রধান পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকী এবং সিপিএম বিরোধী বামেরাও নগ্নভাবে শাসকদলকে সঙ্গ দেয়। তারা একযোগে আব্বাসের বিরুদ্ধে তিনটি মারাত্মক অভিযোগ উত্থাপন করে। অভিযোগ তিনটি হলো,

·         আব্বাস সিদ্দিকী একজন গোঁড়া ধর্মীয় নেতা

·         তাঁর উদ্দেশ্য সাম্প্রদায়িক দল তৈরি করে বিজেপিকে ক্ষমতায় আসতে  সহায়তা  করা 

·         বিজেপি তাঁর পেছনে প্রচুর অর্থ ঢালছে মুসলিম ভোট ভাগ করার জন্যে

আব্বাস সিদ্দিকী দলের নাম ও পতাকার রঙ ঠিক করার সময় তাঁর বিরুদ্ধে তোলা এই মারাত্মক অভিযোগগুলি সম্পর্কে নিশ্চয়ই সজাগ ও সতর্ক ছিলেন। তাই সেইসব পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগসমূহ খণ্ডন করেন দলের নাম ইণ্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রণ্ট রেখে এবং পতাকায় মুসলিমদের ধর্মীয় পতাকার রঙ (সবুজ) ও চিহ্ন (চাঁদ) পরিহার করে। বলা বাহুল্য যে দলের নাম ও পতাকার রঙ নির্বাচন করার মাধ্যমেই তিনি বলিষ্ঠ বার্তা দেন যে তাঁর বিরুদ্ধে তোলা গুরুতর অভিযোগগুলি সর্বৈব মিথ্যে ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। শুধু দলের নাম ও পতাকায় শুধু জবাব দেন নি, তাঁর ধর্ম ও বংশ পরিচয়কে কটাক্ষ করে তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত রুচিহীন কুৎসার জবাবে বারবার তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা দিয়েছেন যে তিনি সব আগে একজন ভারতীয় এবং ভারতীয় হিসেবে তিনি গর্বিত। সর্বোপরি দলের সাংগঠনিক কমিটিতে হিন্দু, মুসলিম, আদিবাসী, জঙ্গলবাসী ও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া সমাজের প্রতিনিধি রাখার মাধ্যমেও তিনি বার্তা দিয়েছেন যে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের প্রতি তিনি সম্পূর্ণ আস্থাশীল এবং ধর্ম-বর্ণ জাত-পাত নির্বিশেষে সমস্ত বঞ্চিত ও পশ্চাদপদ মানুষের জন্যেই লড়াই করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। তাঁর এই ঘোষণা যে কোনো ফাঁকা বুলি ছিলো না তা প্রত্যেকটি নির্বাচনী জনসভায় তার প্রমাণ রেখেছেন। প্রতিটি জনসভায় তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ও সংযুক্ত মোর্চার পক্ষে এবং ধর্মীয় মেরুকরণ ও তৃণমূল সরকারের মোল্লাতোষণ নীতির বিরুদ্ধে তীক্ষ্ণ, তথ্যবহুল ও যুক্তিপূর্ণ ভাষণ রেখেছেন। তথাপি তাঁর কোনো কথাতেই ভরসা না রেখে তাঁর বিরুদ্ধে অবিরাম কুৎসা প্রচার করে যাওয়া হয়েছে। কেন তাঁর কথা, দলের কর্মসূচী ও নির্বাচনী ইস্তেহার সব কিছুকেই ছেঁড়া কাগজের মতন মূল্যহীন মনে করে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে? সেটা কি তিনি পীর বংশের সন্তান এবং মুসলমান বলে? নাকি সিপিএম তাঁর দলকে জোটে নিয়েছে বলে? নাকি বিজেপিকে আটকানোর অছিলায় সিপিএমের বিরোধিতা করার জন্যে?  

আব্বাসকে যেভাবে দেগে দেওয়া হলো তা তাঁর প্রাপ্য ছিল না

 


 পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী

ভারতীয় রাজনীতিতে কয়েকটি শব্দবন্ধ খুবই প্রচলিত। যেমন ভোটব্যাংক, তোষণ নীতি, আইডেন্টিটি পলিটিক্স ইত্যাদি। তোষণনীতির নানা প্রকারের থাকলেও এ দেশে তার মূলটা হচ্ছে মুসলিম তোষণ। মুসলিম তোষণ কথাটা বিজেপি প্রচার করে। তাদের সৌজন্যেই ‘মুসলিম তোষণ’ শব্দবন্ধটি মানুষের মুখে  মুখে শোনা যায়। মুসলিম তোষণ কথাটা কিন্তু অর্ধ সত্য এবং অবশ্যই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সঠিকটা হলো মোল্লা তোষণ বা মোল্লাতন্ত্র তোষণ। বিজেপি সচেতনভাবেই ‘মুসলিম তোষণ’ শব্দবন্ধটি প্রচার করে। কারণ, তাদের মেরুকরণ রাজনীতির জন্যে এই শব্দবন্ধটাই ভীষণ কার্যকরী। এখন আবার আমাদের দেশের ভোট রাজনীতি হয়ে উঠেছে আইডেন্টিটি পলিটিক্স নির্ভর। আইডেন্টিটি পলিটিক্সটাও এসেছে তোষণের রাজনীতি থেকে। জনগণকে যেমন ধর্মের নামে ভাগ করা হয় ভোট ব্যাংক রাজনীতির সুবিধা পাওয়ার জন্যে ঠিক একই কারণে আইডেন্টিটি পলিটিক্সটাও করা হয় ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, জাত-পাত ও জাতি-উপজাতির ভিত্তিতে মানুষকে ভাগ করার জন্যে। নানা ধরণের ভোটব্যাংক আছে ভারতীয় রাজনীতিতে। যেমন মুসলিম ভোটব্যাংক, হিন্দু ভোট ব্যাংক, যাদব ভোটব্যাংক, রাজবংশী ভোটব্যাংক, আদিবাসী ভোটব্যাংক, দলিত ভোটব্যাংক, গোর্খা ভোটব্যাংক, লেপচা ভোটব্যাংক, চাঁই ভোট ব্যাংক, মতুয়া ভোট ব্যাংক ইত্যাদি। রাজনৈতিক দলগুলি এই হরেক রকমের ভোটব্যাংকে ভাগ বসাতে নানা কৌশল অবলম্বন করে। এতে এটা স্পষ্ট প্রতিভাত হয় যে রাজনৈতিক দলগুলো গরীব ও মেহনতী মানুষদের মানুষ হিসেবে ভাবে না, ভাবে শুধু ভোটার বা ভোট ব্যাংক হিসেবে। তাই তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কথা চিন্তা করার আগ্রহ ও ইচ্ছা কোনোটাই থাকে না। তারা শুধু চিন্তাভাবনা করে  কী করলে তারা সন্তুষ্ট হবে এবং তাদের ভোট পাওয়া যাবে। তারজন্যে তারা দেখে কোন সমাজ বা গোষ্ঠীর কী কী চাহিদা আছে। ভারতের গ্রামীণ সমাজকে আজও শাসন করে মোড়ল, মাতব্বর ও গোষ্ঠীপতিরা কিংবা ধর্মীয় নেতারা। সমাজের পক্ষ থেকে যা বলার বলে সমাজের এইসব মাথারাই। রাজনৈতিক দলগুলো ভোট বাংকে দখল/ভাগ নিতে নানা রকম কৌশল গ্রহণ করে সমাজের এই মাথাদের মন-মানসিকতা ও চাহিদা অনুযায়ী। মুসলিম সমাজ যেহেতু কঠোর ধর্মীয় অনুশাসনের অক্টোপাশে আজও  বন্দি এবং মুসলিম সমাজে ধর্মগুরুদের নিদানই শেষ কথা। তাই রাজনৈতিক দলগুলো সর্বদা চেষ্টা করে মুসলিম ধর্মগুরুদের দাবি পূরণ করতে। মুসলিম ধর্মগুরুদের একমাত্র লক্ষ্য ও কাজ হলো মুসলিম সমাজে মোল্লাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। তাই তাদের প্রধান চাওয়া হলো শরিয়া আইন ও মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সুরক্ষা ও তার আরও সম্প্রসারণ, এর পাশাপাশি তাদের চায় যারা শরিয়া আইন ও ইসলামের সমালোচনা করে তাদের কঠোর শাস্তি। অন্যদিকে মুসলিম ধর্মগুরুরা মোটেই চায় না মুসলিমদের জন্যে আধুনিক শিক্ষার স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যদি, নারী ও পুরুষের সমান অধিকার এবং সর্বোপরি মুসলিম সমাজের বিকাশ। এসব হলে তো মোল্লাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। তাই মুসলিম ধর্মগুরুদের তোষণ করা মানেই হলো মোল্লাতন্ত্র তোষণ করা। এ প্রবন্ধে শুধু মোল্লাতন্ত্র তোষণ নিয়েই কিছু কথা বলতে চাই। তবে সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে একটা কথা উল্লেখ করা দরকার যে স্বাধীনত্তোর কালে ডানপন্থী ও বামপন্থী সকল অবিজেপি পার্টির সরকারই যে যার মতন করে মোল্লাতন্ত্র তোষণের রাজনীতি করে আসছে।  এখানে কংগ্রেস সরকারের মোল্লাতন্ত্র তোষণের কয়েকটা নমুনা দেওয়া যাক।

·         কংগ্রেস সরকার হিন্দু বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করেছে, কিন্তু মুসলিম বহুবিবাহ বহাল রেখেছে।

·         হিন্দুদের ধর্মীয় সম্পত্তি উত্তরাধিকার আইন বাতিল করে নতুন আইন প্রণয়ন করে নারী ও পুরুষকে সমানাধিকার দিয়েছে, কিন্তু মুসলিমদের সেই ধর্মীয় আইন (ফারাইজ আইন) বহাল রেখেছে।

·         হিন্দুদের প্রাচীন ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র টোল কবেই বিদায় নিয়েছে। সেটা সম্ভব হয়েছে কংগ্রেস সরকার তাতে উৎসাহ দেয় নি বলে। মুসলিমদের ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা আজও টিকে রয়েছে। শুধু তাই নয়, দিন দিন এর শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে। এটা সম্ভব হচ্ছে কারণ কংগ্রেস সরকার সহ সমস্ত অবিজেপি সরকার এই শিক্ষাব্যবস্থায় উৎসাহ দেয় এবং এর পেছনে অঢেল অর্থ খরচ করে বলে।

·         দেশে ধর্মনিরপেক্ষ অভিন্ন দেওয়ানি আইন প্রবর্তন করা যায় নি কারণ মোল্লাতন্ত্র চায় না বলে।

·       মোল্লাতন্ত্র তোষণের সবচেয় নিকৃষ্ট নমুনা রেখে গেছেন রাজীব গান্ধী। খোরপোষ সংক্রান্ত সর্বোচ্চ আদালতের ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী রায়কে খারিজ করে দেন তিনি সংসদে একটি কালা আইন প্রণয়ন করে মুসলিম নারীর সুরক্ষার নামে। কিন্তু বস্তুত সেই আইনে মুসলিম নারীদের খোরপোষ চাওয়ার অধিকারকেই নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে।      

আগেই বলেছি যে অবিজেপি সব দলের সরকারই কমবেশি মোল্লাতন্ত্র তোষণ ও ভোটব্যাংকের রাজনীতি করে। তবে এক্ষেত্রে একেবারে নগ্নভাবে মোল্লাতন্ত্র তোষণ করা বলতে যা বোঝায় তা করে চলেছে মমতা ব্যানার্জীর টিএমসি সরকার। মমতা ব্যানার্জীর সরকারের সেই নগ্ন মোল্লাতন্ত্র তোষণের রাজনীতির কয়েকটা নমুনা এরূপঃ 

·         মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় দু’ ধরণের মাদ্রাসা আছে – সরকার নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসা এবং মোল্লাতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত কওমি বা খারিজি মাদ্রাসা। দ্বিতীয় প্রকারের মাদ্রাসায় জিহাদের শিক্ষা দেওয়া হয় এবং তৈরি করা হয় জিহাদি ও সন্ত্রাসী। একমাত্র মমতা ব্যানার্জীর সরকারই খারিজি মাদ্রাসাকে উৎসাহ দেওয়ার নজির তৈরি করেছে।

·         ইমাম ভাতা ও মুয়াজ্জিন ভাতার প্রবর্তন।

·         হজ হাউসের সম্প্রসারণ এবং ঝাঁ চকচকে রাজকীয় নতুন হজ হাউস নির্মাণ।

·         মুসলিমদের ধর্মীয় জমায়েতে গিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে ভুলভাল উচ্চারণে মুসলিমদের ধর্মীয় ভাষায় ও কায়দায় সম্বোধন করা ও বিদায় জানানো। যেমন সালেমালেকুম, ইনসাল্লাহ, আল্লা হাফেজ, খোদা হাফেজ ইত্যাদি ইত্যাদি। 

·         রোযার মাসে উপবাস ভাঙ্গা পার্টিতে অংশ নিয়ে মাথায় আঁচল টেনে মুসলিম নারীর বেশ ধারণ করে দু’হাত তুলে আল্লাহর কাছে মোনাজাত করা।

·         অনুরূপ বেশ ধারণ করে ঈদের জামাতে অংশ নিয়ে ভাষণ দেওয়া ও মোনাজাত করা।

 

মোল্লাতন্ত্র তোষণের বিরুদ্ধে মুসলিম সমাজের পক্ষ থেকে কেউ কখনো প্রতিবাদ করে নি, এমনকি সামান্য সমালোচনাও করে নি। কংগ্রেস নেতা আরিফ মহম্মদ খাঁন শুধু একবার প্রতিবাদ করেছিলেন যখন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী সংসদে মুসলিম নারীর খোরপোষ বিরোধী আইন প্রণয়ন করেন। প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা ও দল থেকেও পদত্যাগ করেন। সেই তিনি এখন কেরালার গভর্নর। এটা বোধ হয় বিজেপির দেওয়া পুরষ্কার। তাই মনে হয় অন্য কোনো কারণে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন, আইনটা ছিলো একটা বাহানা মাত্র।        

শরিয়তি আইন এতই কুৎসিত যে সৌদি আরব, ইরাক, ইরান সহ অধিকাংশ মুসলিম দেশই সেই আইনের ব্যাপক সংস্কার করেছে। বাতিল করে দিয়েছে বহুবিবাহ ও তিন তালাক আইন। এ দেশে সম্ভবত ৯০/৯৫% মুসলিমই মাদ্রাসার ছায়া মাড়ায় না। এতদসত্ত্বেও মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা শরিয়তি আইন এবং মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা তুলে দেবার দাবি জানায় না। তাদের এই কাপুরুষসুলভ নীরবতা হেতু মোল্লাতন্ত্রের প্রতিনিধিদেরই (মাওলানা, ইমাম ও মুফতিরা) দাসত্ব করে চলেছে সমগ্র মুসলিম সমাজ। মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের নীরবতার জন্যেই রাজনৈতিক দলগুলি মুসলিম ধর্মগুরুদের তোষণ করে তথা মোল্লাতন্ত্র তোষণ করে পার পেয়ে যায়। আর অবিজেপি সরকারগুলোর এই মোল্লাতন্ত্র তোষণকারী নীতি ও ভূমিকায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয় মুসলিম সমাজ।

অবশেষে বহু যুগের সুদীর্ঘ লজ্জাজনক নীরবতা ভাঙলেন পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী। ভাঙলেন সশব্দে, সজোরে। রাজ্য সরকার ও মুখ্যমন্ত্রীর চোখে চোখ রেখে বলিষ্ঠ কণ্ঠে প্রতিবাদ করলেন মোল্লাতন্ত্রের তোষণের। সরকার ও মুখ্যমন্ত্রীর যে কাজগুলির প্রতিবাদ করেছেন সেগুলি হলোঃ 

·         ইমাম ভাতা ও মুয়াজ্জিন ভাতা প্রদান

·         মহরমের দিন দূর্গা প্রতিমা বিসর্জন স্থগিত রাখা

·         মুসলিমদের রোযা এফতার পার্টিতে অংশ নিয়ে রোজা এফতারের ভাণ করা

·         ঈদের জামাতে গিয়ে ইমামদের পাশাপাশি খুতবা (ভাষণ) দেওয়া

·         মুসলমানদের জন্যে দেওয়া প্রতিশ্রুতির ১০০% পূরণ করে দেওয়ার অসত্য ঘোষণা করা

ইমাম ভাতা ও মুয়াজ্জিন ভাতা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন যে ওতে মুসলিম সমাজের কল্যাণ হয় নি। বলেছেন রিলিফ বা ভিক্ষা নয়, প্রাপ্য অধিকার চাই। প্রতিমা বিসর্জন স্থগিত রাখা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, ওটা করে মুখ্যমন্ত্রী একটা বার্তা দিয়েছেন যে একই দিনে মহরম ও প্রতিমা বিসর্জন হলে দাঙ্গা বাধতে পারতো। এই বার্তা দিয়ে মুসলমানদের হেয় করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর রোযা এফতার পার্টি ও ঈদের জামাতে অংশ নেওয়াকে বলেছেন নাটকবাজী এবং মুসলিমদের প্রতি কপট দরদ প্রদর্শন।

যে কাজটা অনেকদিন আগেই করা দরকার ছিলো প্রগতিশীল মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের, তারা করে নি। সেটা করলেন আব্বাস সিদ্দিকী। তার জন্যে তাঁকে পীর বংশের কত বাধার যে মোকাবেলা করতে হয়েছিলো তা একমাত্র তিনিই জানেন। এটা করার জন্যে যাদের তাঁকে ছিঁড়ে খাওয়ার কথা ছিলো তারা তো খেয়েছেই, কিন্তু যাদের কাছ থেকে বাহবা পাওয়ার কথা ছিলো তারাও ছিঁড়ে খেয়েছে। অর্থাৎ বাম মনস্ক মানুষরাও তাঁকে সমানে ছিঁড়ে খেয়েছে। বামপন্থী এই ‘পণ্ডিত’ মানুষগুলো বঙ্গ রাজনীতিতে আব্বাসকে ভয়ংকর এক মুসলিম মৌলবাদী দৈত্য বলে অভিহিত করেছে। এটা কিন্তু তাঁর প্রাপ্য ছিলো না।

প্রসঙ্গঃ কং-বাম-আইএসএফ জোট  

 

Congress-Left-ISF hold mega rally in Kolkata but cracks visible for all to see

Left, Cong & ISF leadership in Brigade ground

 

শুধু আব্বাসকেই নয়, আব্বাসের সঙ্গে জোট করার জন্যে চারদিক থেকে ছিঁড়ে খাওয়া হয়েছে সিপিএমকেও। আব্বাসকে যারা মনে করে মুসলিম মৌলবাদী শক্তির প্রতিনিধি তাদের কাছে অন্য কিছু আশা করা যায় না। ওরা আব্বাসের অতীতকেই শুধু কাঁটাছেঁড়া করেছে। সমাজে যেমন ভাঙাগড়া হয় তেমনি ভাঙাগড়া হয় মানুষেরও। আব্বাসের মধ্যে সেই ভাঙাগড়া আমরা দেখেছি। একজন ইমানদার মুসলিমের অবস্থান থেকে নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির উপযুক্ত করে তোলার জন্যে তাঁর নিরন্তর  চেষ্টা দেখেছি। সেই চেষ্টায় খাদ বা কপটতা ছিলো না। তিনি যা বলেছেন তা অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের মতন শুধু কথার কথা ছিলো না। যা বলেছেন তার মধ্যে যে কপটতা ছিলো না তার প্রমাণ তিনি রেখেছেন কথায় ও কাজে। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছেন যে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের তিনি একজন নাগরিক এবং তারজন্যে তিনি গর্বিত। তিনি যে ধর্মনিরপেক্ষ তার প্রমাণ রেখেছেন দল গঠনে। তাঁর দলে প্রতিনিধিত্ব রয়েছে বিভিন্ন ধর্ম, জাতি, উপজাতি ও জনজাতির। দলের পতাকায় ইসলামের গন্ধ রাখেন নি। শাসক দল ও সরকারের মোল্লাতন্ত্র তোষণের বিরুদ্ধে অকুতোভয়ে গলা ফাটিয়েছেন যা বামপন্থীরাও পারে নি। প্রত্যেকটা জনসভায় গলা ফাটিয়েছেন ধর্মনিরপেক্ষতার জন্যে এবং ধর্মীয় মেরুকরণের বিরুদ্ধে। সুতরাং এ কথা বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে, সেক্যুলার ফ্রণ্টের সঙ্গে জোট করে সিপিএম ধর্মনিরপেক্ষ নীতি থেকে বিচ্যুত হয় নি।    

  বামফ্রণ্টের ভোট কমার দায় প্রসঙ্গে 

বামফ্রণ্টের ভোট কমা ও একটিও আসন না পাওয়ার জন্যে দায়ী করা হচ্ছে মূলত আব্বাসের সঙ্গে জোট করাকে। এটার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ নিহিত রয়েছে। প্রধান কারণ অবশ্যই বামফ্রণ্ট ও কংগ্রেসের বহু অনুগামী ও সমর্থকের বিজেপির জয় আটকাতে তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দেওয়া। এছাড়া যে কারণগুলি রয়েছে তার কয়েকটি হলোঃ

·         এটা ভুললে চলবে না যে ২০১১ এর পর প্রতিটি নির্বাচনে ভোট কমেছে সিপিএম ও বামফ্রণ্টের

·         বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোটটাই আদতে হয় নি। সেটা মূলত প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির অনীহার জন্যে। তিনি জোট করতে বাধ্য হয়েছিলেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশে। ফলে জোটটা ছিলো বাস্তবে অন্তঃসারশূণ্য।

·         অনেক আসনেই মোর্চার একাধিক প্রার্থী ছিলো।

·         কংগ্রেস ও আইএসএফের মধ্যে বস্তুত জোটই হয় নি। 

·         বামফ্রণ্ট ও কংগ্রেসের মধ্যে জোটটাও নীচুতলায় কাজ করেনি। দুই শিবিরের নীচুতলার নেতা-কর্মীরা বহুলাংশেই জোটের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করে নি।  

·         সবচেয়ে বড়ো কারণ হলো, বহু কর্মী ও সমর্থক হয় বিজেপিকে হারাতে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছে না হয় তৃণমূলকে হারাতে বিজেপিকে ভোট দিয়েছে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় এই পরিসংখ্যান থেকে। ২০১৬ এর বিধানসভা নির্বাচনে বাম+কংগ্রেস পেয়েছিলো ৭৬টি আসন যার ৫২টি পেয়েছে তৃণমূল ও ২৪ট পেয়েছে বিজেপি।

·         আর একটি পরিসংখ্যান বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মতন। বামের লড়েছিলো যার ৯৪টি আসনেই তাদের ভোট বেড়েছে ২০১৯ এর লোকসভার তুলনায়।

সুতরাং উপসংহারে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে এটা নিছকই ভ্রান্ত ধারণা যে কংগ্রেস ও বামেদের ভোট কমেছে আব্বাস সিদ্দিকীর সঙ্গে জোট করার জন্যে।

 

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...