Wednesday, December 11, 2019

মুসলিম-মুক্ত হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্যেই CAA ও NRC


নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (CAB) রাজ্যসভায় পাস হয়ে গেলো আজ। বিলটি লোকসভায় পাস হয়েছে গত সোমবারই (৯ই ডিসেম্বর)। আর কয়েক ঘণ্টা পরই এটা রাষ্ট্রপতির অনুমোদন প্রাপ্ত হয়ে আইনে (নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ তথা CAA 2019 - এ) রূপান্তরিত হয়ে যাবে। এটি বিজেপি সরকারের বহুদিনের আকাঙ্ক্ষিত মূল লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্যে একটি প্রবল ক্ষমতাশালী মোক্ষম অস্ত্র। আর একটি মোক্ষম অস্ত্র এনআরসি তো আগে থেকেই মজুত রয়েছে। NRC (National Register of Cityzenship) তথা জাতীয় নাগরিক নিবন্ধগ্রন্থ তৈরি করার জন্যে একটা চুক্তি হয় ১৯৮৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকার এবং আসু (All Asam Students Union) ও অল আসাম গণসংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে (AAGSP)। NRC তৈরি করার সেই চুক্তিটি হয়েছিল শুধু আসামের জন্যে যার উদ্দেশ্য ছিল আসাম থেকে সমস্ত অনুপ্রবশকারীদের চিহ্নিত করে তাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করা। সেই চুক্তি অনুসারে সুপ্রিম কোর্ট NRC তৈরি করার জন্যে আসাম সরকারকে নির্দেশ প্রদান করলে ২০১৩ সালে তার কাজ শুরু হয়। তার এক বছর পরেই অর্থাৎ ২০১৪ সালে বিজেপি কেন্দ্রের ক্ষমতায় চলে আসে এবং RSS - এর পছন্দের লোক নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তার দু'বছর পরে ১৯১৬ সালে আসামেও বিজেপি সরকার তৈরি করে। NRC তৈরি করার জন্যে যখন চুক্তি হয় তখন তার লক্ষ্য ছিল জাতপাত-ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত অনুপ্রবেশকারীকে বহিষ্কার করা। কিন্তু বিজেপি সেই লক্ষ্য বদলে দেয় এবং তারা নিশানা করে শুধু মুসলিম অনুপ্রবশকারীদের প্রতি। মুখে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের কথা বললেও আসলে তারা নিশানা করেছে সমস্ত মুসলিমদেরকেই। NRC তৈরি করার কাজ শুরু করার বহু আগে থেকেই তারা প্রচার করা শুরু যে আসামে ৫০ লক্ষ বাংলাদেশী মুসলিম অনুপ্রবেশকারী রয়েছে। এদিকে পশ্চিমবঙ্গে দু'কোটি বাংলাদেশী মুসলিম অনুপ্রবেশকারী বাস করছে বলে বিজিপির নেতৃবৃন্দ তারস্বরে চিৎকার করার ঢঙে লাগাতার প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এসব প্রচার থেকে তাদের লক্ষ্য যে শুধু বাংলাদেশী মুসলিমরাই নয়, লক্ষ্য এ দেশের মুসলিমরাও তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। এটা সর্বজন বিদিত যে মুসলিমরা সবচেয়ে গরীব এবং সবদিক থেকেই পশ্চাৎপদ। তাই তাদের ধারণা ছিল যে মুসলিমদের বিশাল সংখ্যক মানুষের হাতে ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণ করার কাগজপত্র নেই এবং তাদের সহজেই অনুপ্রবেশকারী তকমা দিয়ে ভারত থেকে তাড়িয়ে দেওয়া যাবে। ধারণাটি যে মস্ত বড়ো ভুল ছিলো তা নয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকার কারণে হিন্দুরাও যে ব্যাপক সংখ্যায় NRC-র বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়ে যেতে পারে তা হয়তো তাদের ধারণার মধ্যে ছিলো না। ফলে তাদের এ ছবিটিও দেখতে হলো শুধু মুসলিমরাই নয়, লক্ষ লক্ষ হিন্দুর নামও জাতীয় নাগরিক পঞ্জিতে নেই। ৩১শে আগষ্ট NRC-র যে চূড়ান্ত তালিকা বের হয়েছে তাতে যে ১৯ লক্ষ মানুষের নাম নেই তাদের মধ্যে ১২ লক্ষই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। যে অস্ত্রটি বিজেপি সরকার প্রয়োগ করতে চেয়েছিলো জাতশত্রু মুসলমানদের উপর সেটা বুমেরাং হয়ে তাদেরকেও বিঁধেছে। এর শাস্তিও তারা পেয়ে যায় ক'দিন যেতে না যেতেই। রায়গঞ্জ ও খড়্গপুর বিধানসভার উপনির্বাচনে পরাস্ত হয় তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে যে দু'টি সেগমেন্টে (বিধানসভা নির্বাচন ক্ষেত্রে) কিছুদিন আগে হয়ে যাওয়া লোকসভা সাধারণ নির্বাচনে বড়ো ব্যবধানে এগিয়েছিলো। এই পরাজয়টা তাদের বরণ করতে হয়, কারণ রাাজবংশী সহ অন্যান্য বর্গের ব্যাপক সংখ্যক হিন্দু যারা লোকসভায় বিজেপিকে ঢেলে ভোট দিয়েছিলো তারাই NRC আতঙ্কে ঢেলে ভোট দিয়েছে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ তৃণমূল কংগ্রেসকে। তারপরই পশ্চিমবঙ্গ সহ সারাদেশে NRC প্রয়োগ করার পরিকল্পনা সাময়িক ভাবে স্থগিত রাখে এবং ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনটি সংশোধন করতে তৎপর হয়। ইতিমধ্যেই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনটি যে সংসদের দু'কক্ষেই পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছে তা শুরুতেই বলা হয়েছে। এই আইনের সাহায্যে আসামের নাগরিক পঞ্জি থেকে বাদ পড়া অহিন্দুদের ভারতের নাগরিকত্ব প্রদান করে হিন্দুদের হারানো আস্থা ফিরে পেতে চায়। মোদি সরকার এখন প্রতিবেশী তিনটি দেশ (আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ) থেকে এসে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের (মুসলমান বাদে) শরণার্থী তকমা দিয়ে অতি দ্রুত ভারতের নাগরিকত্ব দিয়ে তাদের কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্ত করতে তৎপর হবে। বলা বাহুুল্য যে ঐ একই কারণে উক্ত কারাগারে বন্দি মুসলমানদের অনন্ত কাল কারাগরেই পচতে হবে।

সঙ্ঘপরিবারের মূল লক্ষ্য

সঙ্ঘপরিবারের কর্তা হলো আরএসএস তথা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ (RSS) এবং তার রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান হলো ভারতীয় জনতা পার্টি। এছাড়াও আরএসএসের রয়েছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, দুর্গাবাহিনী ইত্যাদি আরো কয়েকটি উগ্র জাতীয়তাবাদী সাম্প্রদায়িক শাখা সংগঠন। বিরোধী দলগুলো বলছে বিজেপির নতুন নাগরিকত্ব আইন করার মূল লক্ষ্য হলো ভোটব্যাংক স্ফীত করা এবং বেকারি, আকাশ ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, দেশজুড়ে ক্রমবর্ধমান নারীর শ্লীলতাহানি ও তাদের উপর বলাৎকার ইত্যাদি জ্বলন্ত সমস্যাগুলি থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘোরানো। নতুন নাগরিকত্ব আইনে তাদের হিন্দু ভোট হয়তো বাড়বে, কিন্তু ভোট বৃদ্ধি করা কিংবা জ্বলন্ত সমস্যাগুলি থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্যেই তারা নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে গোটা দেশে এনআরসি তৈরি করতে উদ্যোগী ও তৎপর হয়েছে তা কিন্তু নয়। তারা এটা করেছে তাদের মূল লক্ষ্যে দ্রুত পৌঁছনোর জন্যে।
সঙ্ঘপরিবারের মূল লক্ষ্য হলো বিশুদ্ধ হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণ করা যে রাষ্ট্র থেকে যতদূর সম্ভব অহিন্দুদের বিতাড়িত করা। সবাইকে তাড়ানো যদি সম্ভব না হয় তবে যারা অবিতাড়িত থেকে যাবে তাদের উপর হিন্দুদের একচেটিয়া কতৃত্ব, নেতৃত্ব ও আধিপত্য চাপানো। এটা আইন করে যদি করা সম্ভবও না হয় তবে সামাজিক ভাবে বলপ্রয়োগ করে তা সম্ভব। তাদের চিন্তাধারা অনেকটা ইসলামী রাষ্ট্রের মতন। এই রাষ্ট্রগুলো কোথাও কোথাও আইন করেই অমুসলিমদের নাগরিকত্ব না দিয়ে জিম্মি (hostage) করে রেখেছে, আর কোথাও রাষ্ট্রশক্তির মদতে অমুসলিমদের উপর মুসলমানদের কতৃত্ব, নেতৃত্ব ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে।

হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের কাজ আগে থেকেই চলছে

অটলবিহারী বাজপেয়ী ছিলেন নরম হিন্দুত্বের প্রবক্তা। লালকৃষ্ণ আদবানি ছিলেন তাঁর অনুসারী। বাজপেয়ী ছিলেন প্রবল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। তাই তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন তাঁঁর সরকারের উপর আরএসএস তাদের হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের পরিকল্পনা রূপায়নের জন্যে জোর খাটাতে পারে নি। আদবানিরও ব্যক্তিত্বের জোরও ছিলো যথেষ্ট। তিনি প্রধানমন্ত্রী হলে তাই একই সমস্যার উদ্ভব হবে ভেবে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে আরএসএস আদবানির পরিবর্তে নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী করে। কারণ, তিনি ছিলেন আরএসএসের পোস্টার বয় ও বিশ্বস্ত সৈনিক।
মোদির নেতৃত্বে সেই নির্বাচনে বিজেপি লোকসভায় একাই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ফলে বিজেপি, আরএসএস ও তার শাখা সংগঠনগুলিতে মরা গাঙে জোয়ার আসার মতন পরিস্থিতি তৈরি হয়। তারা মোদি সরকার এবং বিজেপির রাজ্য সরকারগুলির মদতে ও প্রশ্রয়ে বিজেপি প্রভাবিত অঞ্চলগুলিতে পরিকল্পনা মাফিক হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের কাজ শুরু করে দেয়। শুরু করে গো-হত্যা বন্ধ ও গোরক্ষা আন্দোলন, ঘরওয়াপসি, লাভ জিহাদ, ধর্মান্তরকরণ ইত্যাদি কর্মসূচি রূপায়নের কাজ। গোরক্ষা আন্দোলনের নামে সঙ্ঘপরিবারের বাহিনী গো-বলয়ে তাণ্ডবে মত্ত হয় মুসলিমদের উপর। সেই তাণ্ডবে তারা শুধু অত্যাচার নির্যাতনের শিকারই হয় নি, কয়েকজন নিহতও হয়েছে। ঘরওয়াপসি আন্দোলন ও লাভ জিহাদের নিশানাতেও মুসলিমরাই। হিন্দুত্ববাদীদের দাবি হলো সকল ভারতীয়ই হিন্দু, কারণ যারা ভারতের মুসলিমরা ধর্মান্তরিত মুসলিম, তাদের পূর্ব পুরুষরা ছিলো হিন্দু। তাদের মুসলিম শাসকরা ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিলো। তাই তারা ঘরওয়াপসির মাধ্যমে মুসলমানদের তাদের ঘরে (হিন্দু ধর্মে) ফিরিয়ে আনতে তৎপর হয়েছে। লাভ জিহাদের কর্মসূচির নিশানা হলো মূলত মুসলিম নারী। ওদের অভিযোগ হলো মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি এই যে, তাদের ছেলের দল নানা প্রলোভনে ফুসলিয়ে হিন্দু মেয়েদের বিয়ে করে তাদের ধর্মান্তরিত করে মুসলিম বানাচ্ছে এবং তাদের দিয়ে গণ্ডায় গণ্ডায় সন্তান পয়দা করিয়ে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি করছে। এটা মুসলিমরা করে পরিকল্পনা মাফিক যার উদ্দেশ্য হলো মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে ভারতে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা করা। তাই তারা হিন্দু ছেলেদের বলছে যে তাদেরও মুসলিম মেয়েদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত করে তাদের দিয়ে গণ্ডায় গণ্ডায় সন্তান পয়দা করিয়ে হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। সেজন্যই তাদের লাভ জিহাদের কর্মসূচি। ধর্মান্তরকরণের (conversions) কর্মসূচি আর লাভ জিহাদের কর্মসূচি কিন্তু এক নয়। ধর্মান্তরকরণের কর্মসূচি অনেক বড়ো ও ব্যাপক। এই কর্মসূচির নিশানায় রয়েছে কিন্তু সকল অহিন্দুরাই, বিশেষ করে আদিবাসী ও ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টানরা। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি কেন্দ্রের ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরপরই আরএসএস ও বিজেপি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষ করে তারা যেখানে শক্তিশালী, সেসব অঞ্চলে হিন্দুত্বের অভিযান শুরু করে যার মধ্যে রয়েছে উপরোক্ত কর্মসূচিগুলি। এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি "ভাগবত-মোদি জুটির নেতৃত্বে ভারতে হিন্দুত্বের অভিযান চলছে" শিরোনামে আমার একটি লেখায়। ওটা লিখেছি ২০১৫ সালে (https://giasuddinonline.blogspot.com/2015/04/blog-post.html?m=1)  লেখাটি পরে দু'বার হালনাগাদ (update) করা হয়েছে।

সিএএ হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদী আইনই
   

বিরোধী দলগুলি এবং অরাজনৈতিক বহু ব্যক্তিত্ব প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ধর্মীয় বিভাজনের অভিযোগ এনেছেন। এই অভিযোগ যে ভিত্তিহীন বা অবাস্তব নয় তার স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে উক্ত আইনের মধ্যেই। আইনটির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও   থেকে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে যারা ভারতে এসেছে তারা শরণার্থী এবং তাদেরই শুধু ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। সেই শরণার্থীদের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজন করা হয়েছে নগ্ন ভাবেই। তার প্রমাণ হলো এই যে, তাতে মাত্র ছ'টি (হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, শিখ, জৈন ও পার্সি) ধর্ম সম্প্রদায়ের নাম রয়েছে। উল্লেখিত তিনটি প্রতিবেশী মুসলিম সমাজের প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ মানুষরাও মুসলিম মৌলবাদীদের দ্বারা অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হয়। সেই অত্যাচারে তারা কতজন নিহত হয়েছে এবং তাদের কতো জন যে হামলা ও মামলার শিকার তার ইয়ত্তা নেই। তাদের কতজন যে প্রাণ রক্ষার্থে দেশ ত্যাগ করেছে তারও ইয়ত্তা নেই। তারা যদি ভারতে এসে আশ্রয় নিয়ে থাকে তবে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যবস্থা এই আইনে নেই। শুধু আমাদের প্রতিবেশী তিনটি রাষ্ট্রেই নয়, মুসলিম সম্প্রদায়ের অসংখ্য প্রগতিশীল ও যুক্তিবাদী মানুষ রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার হয় মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী রাষ্ট্রগুলিতেও। এই দেশগুলোর মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য হলো সৌদি আরব ও ইরান। ফলে মুসলিম সম্প্রদায়ের বহু মানুষ আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলিতে আশ্রয় নিয়ে প্রাণ রক্ষা করেছে। মুসলিম সন্ত্রাসবাদীদের নৃশংস ও বর্বর অত্যাচারে ইরাক, ইরান ও নাইজেরিয়া থেকে কতো লক্ষ মানুষ ইউরোপের দেশগুলিতে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে তারও তোো ইয়ত্তা নেই। তাদের সিংহভাগই মুসলমান। মায়ানমার থেকেও লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমানও রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশত্যাগ করে বিভিন্ন দেশে গিয়ে শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এই বিপুল সংখ্যক মুসলিম শরণার্থীদের সিএএ-তে ভারতের নাগরিকত্ব প্রদান করার কথা বিবেচনা করা হয় নি। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা থেকেও ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের ফলে অসংখ্য মানুষ  ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যে এসে বসবাস করছে বহুদিন যাবৎ। তারাও তো শরণার্থী।  কিন্তু তাদের কথাও বিবেচনা করা হয় নি। কৌশলগত কারণে নাগরিকত্ব সংশোধিত আইনে হিন্দু ছাড়া আরো পাঁঁচটি ধর্ম সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করা হলেও বিজেপির আসল লক্ষ্য হিন্দুদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করা যাতে হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে হিন্দুরাষ্ট্র কায়েম করার পথ মসৃণ হয়। তারজন্যই সিএএ। সুতরাং আইনটি যে হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদী আইনই তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই।

সিএএ, এনআরসি-র নিশানা মুসলিমরাই

প্রধানমন্ত্রী বরাবরই মনে পোষেন এক কথা, আর বলেন আর এক কথা। তাঁর মনের কথা একরকম, আর মুখের কথা আরেক রকম।পরিকল্পনা করেন এক রকম আর মানুষকে বলেন আরেক রকম। এটা তাঁর এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ২০১৪ সালের নির্বাচনে শ্লোগান দেন, "সবকা সাথ, সবকা বিকাশ"। কিন্তু পুরো পাঁচ বছর সকলের সাথে ও সকলের উন্নয়নের শ্লোগান শিকেয় তুলে রেখে নি:শব্দে শনৈ শনৈ গতিতে কাজ করে গেলেন হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণ করার লক্ষ্যে। গত (২০১৯) লোকসভা নির্বাচনে আরো বড়ো বিজয় পাওয়ার পর জুড়ে দেন সবকা বিশ্বাসকেও সবকা সাথ ও সবকা বিকাশের সঙ্গে। অর্থাৎ তিনি মুসলিমদের বোঝাতে চাইলেন যে এবার তিনি তাদেরও বিশ্বাস অর্জন করার লক্ষ্যে কাজ করবেন। কিন্তু দ্বিতীয় বার অর্থাৎ গত বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েই তড়িঘড়ি দু'টি দানবীয় পদক্ষেপ নিয়ে তিনি দেশবাসীকে বুঝিয়ে দিলেন যে সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস, এসব ফালতু কথা, তাঁর আসল এজেণ্ডা হলো হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণ করাই। দানবীয় পদক্ষেপ দুটির একটি হলো জম্মু-কাশ্মীরকে ভেঙে দু'টুকরো করে তার রাজ্যের মর্যাদা হরণ করা, এবং তার বিশেষ অধিকার ও ক্ষমতা সম্বলিত ৩৭০ নং ধারা ও ৩৫এ উপধারাটি বিলোপ করা। আর দ্বিতীয় দানবীয় স্বৈরাচারী পদক্ষেপটি হলো ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনটি সংশোধন করে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন' ২০১৯ তথা সিএএ' ২০১৯ প্রণয়ন করা যেটি সম্পূর্ণ ধর্মীয় বিভেদমূলক। জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে যে পদক্ষেপটি নেওয়া হয়েছে সেটা শুধু স্বৈরাচারীই নয়, পদক্ষেপটি নেওয়ার পেছনে রয়েছে সরকারের ধর্মীয়বিদ্বেষ মূলক নিকৃষ্ট মানসিকতাও। প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুখে যাই বলুন না কেন, তাঁরা চান জম্মু-কাশ্মীরের মুসলিমদের শক্তি খর্ব করে তাদের হীনবল করে তাদের রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও নিপীড়নে নিষ্পেষিত করতে। সেই মতলবেই গতবছর ৫ই আগষ্ট মোদি-শাহ জুটি জম্মু-কাশ্মীরকে দ্বিখণ্ডিত করে তার বিশেষ অধিকার ও ক্ষমতা (৩৭০ নং ধারা ও ৩৫এ উপধারা) হরণ করা হয়েছে এবং ঠিক তার আগেই সেখানকার তিন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সমস্ত নেতা ও কর্মীদের হয় গৃহবন্দি, না হয় কারাবন্দি করা হয়েছে। আর ঠিক সেই কালা দিন ৫ই আগষ্ট থেকেই টেলিফোন সংযোগ ও ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, এবং গোটা রাজ্যটিকে মুুড়ে ফেলা হয়েছে ১৪৪ নং ধারা ও বহু জায়গায় কারফিউ জারি করে। এ সব পদক্ষেপ জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের উপর রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন, নির্যাতন ও নিষ্পেষণ চালানো ছাড়া আর কী বলা যায়?
এ প্রসঙ্গে এ কথাটাও বিশেষভাবে স্মরণীয় যে ৩৭০ নং ধারা ও তার উপধারা ৩৫এ বাতিল করা হলেও কিন্তু ৩৭১ নং ধারা ও তার উপধারাগুলোয় (৩৭১-এর ৩৭১এ থেকে ৩৭৩জে নং উপধারায়) হাত দেওয়া হয় নি, উল্টে সে ধারা-উপধারাগুলি অক্ষত রাখার ঘোষণাই দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এই ৩৭১ নং ধারার বিশেষ সাংবিধানিক ক্ষমতা ও অধিকার ভোগ করে মহারাষ্ট্র, গুজরাট সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছ'টি রাজ্য। এটা কী প্রমাণ করে যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য বলেই জম্মু-কাশ্মীরকে দ্বিখণ্ডিত করে, এবং তাকে দুটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলছেন যে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে মুসলিমদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কারণ, এই আইনে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে ভারতে আসা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার সংস্থান রয়েছে শুধু, কারো নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার কথা বলা হয় নি। হ্যাঁ, সিএএ-তে সত্যিই কারো নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার ব্যবস্থা নেই। তবুও প্রধানমন্ত্রীর এই ব্যাখ্যা ও আশ্বাসবাণী অসত্য ও প্রতারণা বৈ নয়।  এটা কেন অসত্য ও প্রতারণা তা বুঝতে হলে চোখ রাখতে হবে এনআরসি-র  উপর এবং সিএএ ও এনআরসি-কে পাশাপাশি রেখে বিচার করতে হবে। কেননা এ দুটি হলো পরষ্পরের প‍রিপূরক, একটাকে বাদ দিলে আরেকটা অসম্পূর্ণ। সিএএ ও এনআরসি পরষ্পরের পরিপূরক বলেই আসামে এনআরসি করার পর গোটা দেশে এনআরসি তৈরি করা স্থগিত রেখে মোদি সরকার তাড়াহুড়ো করে সিএএ প্রণয়ন করা হলো। আইনটি প্রণয়ন করার আগে এবং প্রণয়ন করার  সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুন:পুন ঘোষণা দেন যে আইনটি প্রণীত হলেই গোটা দেশেই এনআরসি তৈরি করা হবে এবং ২০২৪ সালের মধ্যেই তার কাজ শেষ করা হবে। আসামে এনআরসি চূড়ান্ত তালিকা বের করার পর কী পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তা আমরা সবাই জানি। ৩.২৯ কোটি লোক তালিকায় নাম নথিভুক্ত করার আবেদন করেছিল। তাদের মধ্যে ঊনিশ লক্ষ মানুষের আবেদন বাতিল হয়েছেে যাদের মধ্যে ষোলো লক্ষ মানুষই অমুসলিম। তাদের বারো লক্ষই আবার হিন্দু যা বিজেপিকে  বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে নিক্ষেপ করে। সে অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমুসলিমদের, বিশেষ করে হিন্দুদের, অভয় দেন যে তাদের কোনো ভয় বা উদ্বেগের কারণ নেই। কারণ, অনতিবিলম্বে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হবে।  তারপর নজিরবিহীন দ্রুততায় সিএএ প্রণয়ন করে প্রধানমন্ত্রী তাঁর কথা রাখেন। সুতরাং সিএএ ও এনআরসি যে পরষ্পরের পরিপূরক তা স্পষ্ট। এনআরসি অস্ত্র দিয়ে মুসলমানদের অনুুুপ্রবেশকারী তকমায় বিদ্ধ করতে গিয়ে সেই অস্ত্রে যে হিন্দুরা ঘায়েল হবে তাদের উদ্ধার করতে প্রয়োগ করা হবে সিএএ। কিন্তু সিএএ-এর সহায়তা পাবে না মুসলমানরা। সুুতরাং এটা প্রমাণ করে যে, মুসলমানদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই কারণ তাদের নাগরিকত্ব যাবে না এই ব্যাখ্যা ও আশ্বাসবাণী অসত্য ও প্রতারণাই। এগুলো আরো প্রমাণ করে যে সিএএ ও এনআরসি-র নিশানা মুুুসলিমরাই।

আশু লক্ষ্য মুসলিম-মুক্ত ভারত নির্মাণই


সিএএ ও এনআরসি-র লক্ষ্য হলো ভারতকে মুসলিম-মুক্ত রাষ্ট্রে পরিণত করা। মুসলিম-মুক্ত রাষ্ট্র মানে ভারতে একজনও মুসলমান থাকবে না তা নয়। মুসলমানরা থাকলে থাকবে এমন অল্প সংখ্যায় যাতে তাদের দরকষাকষির শক্তি না থাকে এবং তাদের রাখা হবে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে। এটা অবশ্য বিজেপির আশু লক্ষ্য। ওদের মূল লক্ষ্য হলো ভারতকে একটি বিশুদ্ধ হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র বানানো। সে রাষ্ট্রে সকল অহিন্দুদের বিতাড়িত করা সম্ভব না হলে (সম্ভব নয়ও) তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখা হবে। যারা ফ্যাসিস্ট সরকারের সমালোচনা করবে তাদের নির্মমভাবে দমন করা হবে। কীভাবে সে লক্ষ্যে তারা পৌঁছতে চায় তা আলোচনা করার জায়গা এটা নয়। সুতরাং সিএএ ও এনআরসি নিয়ে তারা যে আশু লক্ষ্য রেখেছে সে আলোচনায় ফিরে আসা যাক
আসামের এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকায় যে ঊনিশ লক্ষ মানুষের নাম ওঠে নি তাদের মধ্যে কয়েক লক্ষ যে ভারতের বৈধ নাগরিক রয়েছে তা বলা বাহুল্য। ঐ তালিকায় এরকম বহু উদাহরণ রয়েছে - স্বামীর নাম আছে কিন্তু স্ত্রীর নাম নেই, স্ত্রীর নাম আছে স্বামীর নাম নেই, ছেলের নাম আছে বাবার নাম নেই, বাবার নাম আছে ছেলের নাম নেই, বাবা-মায়ের নাম আছে তাদের সন্তানদের নাম নেই। এগুলো ছাড়াও অনেক অসঙ্গতি রয়েছে। যারা দশকের পর দশক সেনাবাহিনী, পুলিশবাহিনী, সরকারি প্রশাসন, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি ক্ষেত্রে কর্মরত থেকে দেশের সেবা করেছে তাদের বহুজনের নাম নেই। নাম নেই এমনকি দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আমেদের পরিবারের সদস্যদেরও। এটা প্রমাণ করে যে অসংখ্য বৈধ ভারতীয় নাগরিক আসামের নাগরিক পঞ্জি থেকে বাদ পড়েছে। সেই সংখ্যাটা যে কয়েক লক্ষাধিক হবে না তা কেউ হলফ করে বলতে পারবে না। কেন ভারতের বৈধ নাগরিকদের নাম ঐ তালিকায় ঠাঁই পায় নি তা বোঝার চেষ্টা করা যাক।
আসামের নাগরিক পঞ্জিতে তাদেরই নাম নথিভুক্ত করার নির্দেশ ছিল যারা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের আগে থেকেই আসামে বসবাস করছে। সেই তালিকায় নাম তোলার জন্যে যারা আবেদন করেছিল তাদের মধ্যে ঊনিশ লক্ষের আবেদন গ্রাহ্য হয় নি। এর অর্থ হলো তারা প্রামাণ্য নথিপত্র পেশ করতে পারে নি। এই না পারাদের দলে যে ভারতের বৈধ নাগরিকরাও রয়েছে সে কথা আগেই বলেছি। রয়েছে প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা অসংখ্য মানুষও যারা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের মধ্যে এসেছে। বৈধ ভারতীয় নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও, কিংবা যারা প্রতিবেশ দেশ থেকে উক্ত বেঁধে দেওয়া সময়ের আগে থেকেই ভারতে বসবাস করছে তারা এতো বিশাল সংখ্যায় কেন তাদের সপক্ষে প্রামাণ্য কাগজপত্র দেখাতে পারে নি? এই না পারাটা আমাকে অবাক করে নি।
তাদের পক্ষে প্রামাণ্য কাগজপত্র দেখাতে না পারার পেছনে রয়েছে বহুবিধ কারণ। তার মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলো দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, স্বল্প শিক্ষা ও অসচেতনতা। দারিদ্র্যের চেহারাটা ফুটে বেরিয়েছ  ভারত  সরকারের উন্ননয়ন দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীর রাজ্যসভায় পেশ করা এই রিপোর্ট যেখানে বলা হয়েছে যে আসামে দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ৩২%। আর শিক্ষার দৈনতাটি এ রকম: ২০১১ সালের আদমশুমারি রিপোর্ট অনুযায়ী স্বাক্ষরতার হার ৭৩%। এই স্বাক্ষর সম্পন্ন মানুষদের মধ্যে রয়েছে বড়ো সংখ্যক অষ্টম শ্রেণী উত্তীর্ণ বা অনুত্তীর্ণ লোকজনও। এই পরিসংখ্যান স্পষ্ট করে সেখানকার মানুষের সচেতনতার অভাব কতো প্রকট‍। আসামের জনসংখ্যা (২০১১ সালের আদমশুমারি থেকে) তিন কোটি কয়েক লক্ষ। বর্তমানে সেটা কিছু কমবেশি সাড়ে তিন কোটি। অর্থাৎ দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করা মানুষের সংখ্যা এক কোটি বারো লক্ষ। তাদের মধ্যেই রয়েছে রয়েছে লক্ষ লক্ষ গৃৃহহীন ও বাস্তুহীন। তাছাড়া লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজের সন্ধানে ভারতের এক প্রদেশ থেকে আরেক প্রদেশে গিয়ে বাস করে। আসামেও বাস করে এ রকম অসংখ্য মানুষ। উপরোক্ত দরিদ্র, বাস্তুহীন, ভিটিহীন, ভিন্ন রাজ্য থেকে কিংবা ভিন্ন দেশ থেকে ছিন্নমুল মানুষগুলো কোথায় পাবে প্রামাণ্য কাগজপত্র? সুতরাং পঞ্জি থেকে বাদ বৈধ ভারতীয় নাগরিকের সংখ্যা ঊনিশ লক্ষ হওয়াটা চমকানোর মতন সংখ্যা মোটেই নয়।
ঊনিশ লক্ষের মধ্যে যে ষোলো লক্ষ অমুসলিম রয়েছে তাদের জন্যেই প্রণীত হলো সিএএ। এই আইনের সাহায্যে যে ভারতীয়রা নাগরিকত্ব হারিয়েছে তাদের সেটা ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে যারা ২০১৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতে এসেছে তাদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে। কিন্তু জাতীয় নাগরিক পঞ্জিতে (এনআরসিতে) মুসলমানদের নাম (তারা বৈধ ভারতীয় হওয়া সত্ত্বেও)  না থাকে তারা নিশ্চিতভাবেই হবে রাষ্ট্রহীন।
আসামের নাগরিক পঞ্জি বাতিল করে নতুন করে আবার পঞ্জি তৈরি করা হবে সে কথা ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে আসাম সরকার। পঞ্জিটি বাতিল করতে চায় দুটি কারণে। প্রথমত পঞ্জি থেকে যাদের নাম বাদ গেছে তাদের ৮৪% অহিন্দু। দ্বিতীয়ত পঞ্জিছুট মাত্র মুসলিমদের সংখ্যা মাত্র তিন লক্ষ যা পঞ্জিছুটদের মোট  সংখ্যার ১৬% এর নীচে। কিন্তু ওরা চেয়েছিল ৫০ (লক্ষ) মুসলমানকে অনুপ্রবেশকারী দেখাতে। ৫০ লক্ষ লক্ষ হলো আসামের মুসলিম জনসংখ্যার ১৫/১৬%। বলা বাহুল্য যে  আসামের নাগরিক পঞ্জি ওদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে পারে নি, বরং রুষ্টই করেছে। তাই ওটা বাতিল করে আসাম সরকার নতুন একটা পঞ্জি বানাতে চায়। এটা চায় প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর স‍রকারও।
আসামে এটা যদি তারা করতে পারে তাহলে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপাবে বাকি ভারতে। তখন তাদের মুসলিম বিতাড়নের লক্ষ্যমাত্রা হবে আরও অনেক বড়ো। লক্ষ্যমাত্রাটা যদি ভারতের মুসলিমদের মোট জনসংখ্যার পঞ্চাশ/ষাট শতাংশও হয় তবুও তাতে বিষ্ময়ের কিছু থাকবে না। কারণ ভারতকে মুসলিম-মুক্ত করার স্বপ্ন পূরণে আসাম ছিল মোদি সরকারের এ্যাসিড টেস্টের প্রথম পরীক্ষাগার (Laboratory)। প্রথম প্রচেষ্টা তাদের পুরোপুরি সফলতা পায় নি। কিন্তু তাতে তারা হতোদ্যম হয় নি। বরং আরও অধিক উদ্যমী হয়েছে। তাই একদিকে আসাম সরকার নতুন জাতীয় নাগরিক পঞ্জি তৈরি করার দাবি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, অপরদিকে কেন্দ্রীয় সরকার সিএএ প্রণয়ন করেছে। এমতাবস্থায় আসামে তারা যদি নতুন পঞ্জি তৈরি করার পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের অনুমতি পেয়ে যায় (পাওয়ার সম্ভাবনাই উজ্জ্বল দেখাচ্ছে) তাহলে আসামে তাদের লক্ষ্যের  (১৬/১৭% মুসলিমকে বিতাড়ন করা)  কাছাকাছি তাদের পক্ষে পৌঁছে যাওয়া খুব কঠিন নাও হতে পারে। আর তখন তো সমগ্ৰ ভারত থেকে তাদের মুসলিম বিতাড়নের লক্ষ্যমাত্রা আসামের লক্ষ্যমাত্রা ১৬/১৭% থেকে বেড়ে ৫০/৬০% হ ওয়াটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার হবে না। গোটা দেশে এনআরসি কার্যকর করার ক্ষেত্রে বিজেপি সরকারকে আটকানো না যায় তবে কয়েক কোটি মুসলমানকে অনুপ্রবেশকারী তকমায় বিদ্ধ হয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে ঢুকতে হবে, নতুুুবা তাদের দেশের সীমানার বাইরে কোথাও নিয়ে গিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। আর তখন বাকি মুসলমানদের জিম্মি বা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রাখতে বিজেপি সরকারকে মোটেই বেগ পেতে  হবে না। আর আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ ভারত তখন তো কার্যত মুসলিম-মুক্ত ভারত হয়ে উঠবে।

                    সমাপ্ত

Thursday, October 31, 2019

বিশ্বের এক নম্বর কুখ্যাত সন্ত্রাসী বাগদাদী বিশ্বজয়ের স্বপ্ন ত্যাগ করে অবশেষে আত্মহননই করলেন

নিকাশ হয়ে গেল বিশ্বের এক নম্বর কুখ্যাত সন্ত্রাসী আবুবকর আল-বাগদাদী। সম্প্রতি (২৭.১০.১৯) মার্কিন সেনার 'কায়লা মুয়েলার' অভিযানে সেনারা বাগদাদীকে নাগালের মধ্যে পেয়ে যায়। পালাবার সমস্ত পথ ছিল রুদ্ধ। ফলে 'সুইসাইড ভেস্ট' (বোমা বাঁধা পোশাক) - এর বোতাম টিপে আত্মহত্যা করেন। সুইসাইড ভেস্টের বিষ্ফোরণে তাঁঁর তিন সন্তানও নিহত হয়।

 কে বেশি বিপজ্জনক ও ক্ষমতাশালী সন্ত্রাসী ছিল - লাদেন না বাগদাদী? 

ওসামা বিন লাদেনকেও নিকাশ করেছিল মার্কিন সেনা আট বছর আগে (২.৫.১১)। লাদেন ছিলেন সে সময়ের বিশ্বের এক নম্বর কুখ্যাত সন্ত্রাসী, বিশ্বের এক নম্বর ত্রাস সৃষ্টিকারীও। আর বাগদাদী ছিলেন এ সময়ের এক নম্বর কুখ্যাত সন্ত্রাসী, এক নম্বর বিশ্বত্রাস। এই দু'জনের মধ্যেই বাগদাদীই ছিলেন অনেক বেশি বিপজ্জনক ও  ত্রাস সৃষ্টিকারী বিশ্বের ভয়ংকরতম সন্ত্রাসী। লাদেনের সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত থাকলেও তাঁঁর জঙ্গি সংগঠন আল-কায়দার জিহাদি কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ ছিল মূলত আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে। এর বাইরে তাঁঁর প্রধান নিশানা ছিল আমেরিকা। বিশ্ব জয় করে পৃথিবীর বুকে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য ও কর্মসূচি তাঁঁর ছিল না। অন্তত শোনা যায় নি সে কথা। পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম কোনো ভূখণ্ডেও তিনি ইসলামি রাষ্ট্র স্থাপন করতে পারেন নি। ৯/১১/২০০১ - এর (আমেরিকার জোড়া টাওয়ারে বিমান হানার) ঘটনায় তাঁঁর মাথায় বিশ্বের এক নম্বর ভয়ংকর সন্ত্রাসীর মুকুট ওঠে। জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম ও বিশ্বব্যাপী ত্রাস সৃষ্টিতে আবুবকর আল-বাগদাদী কিন্তু লাদেন অপেক্ষা বেশ কয়েক কদম এগিয়ে যান। তিনি ইরাক ও ইরানের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে ইসলামী রাষ্ট্র (Islamic State, তথা IS) স্থাপন করেন। তিনি সেখানে নতুন করে খেলাফত পুন:স্থাপনের ঘোষণা দেন এবং নিজেকেই তার খলিফা হিসাবে ঘোষণা করেন। ইসলামে প্রথম খেলাফত যুগের শুরু হয় ৬৩২ খৃস্টাব্দে। মুহাম্মদের মৃত্যুর পর মদিনায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন আবুবকর যাঁকে বলা হয় ইসলামের প্রথম খলিফা। তারপর ১২৫৮ খৃ: খেলাফত যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে। বাগদাদী সেই খেলাফতি জামানা ফিরিয়ে আনেন ইরাক-সিরিয়ায়। অত:পর তিনি ঘোষণা দেন যে তাঁঁর খেলাফত শুধু ইরাক-ইরানে সীমাবদ্ধ থাকবে না, গোটা বিশ্বকে তার খেলাফতের অধীনে নিয়ে আনবেন। তিনি ডিক্রি জারি করেন তাঁঁর শেষ নবীর কায়দায় যে, তার খেলাফতে শুধু সুন্নি মুসলমান থাকবে, আর যারা ইসলাম কবুল করে বাগদাদীর কাছে বয়াত (আনুগত্যের শপথ) নেবে না তাদের হয় জিজিয়া কর দিয়ে জিম্মি হয়ে বসবাস করতে হবে, নতুবা ইসলামিক স্টেট পরিত্যাগ করে চলে যেতে হবে, যারা দু'টোর কোনোটাই পালন করবে না তাদের হত্যা করা হবে। অত:পর তাঁঁর নির্দেশে আইএস জঙ্গিরা নৃশংস গণহত্যা, ধ্বংসকাণ্ড, অপহরণ, ধর্ষণ, লুটপাট শুরু করে। বীভৎসতার দিক থেকে এর নজির সারা বিশ্বে খুব কমই আছে। বাগদাদীর জল্লাদ বাহিনী যারা খেলাফতের নির্দেশে সাড়া দেয় নি তাদের বহু সংখ্যায় নৃশংসভাবে হত্যা করে। হাজার হাজার ইয়াহুদী, খৃষ্টান, শিয়া মুসলিম, ইয়াজিদি প্রাণ বাঁচাতে তাদের ভিটিমাটি ও সমস্ত সম্পত্তি ত্যাগ করে দেশান্তরী হয়। গোটা বিশ্বকে তার খেলাফতে নিয়ে আসার যে ঘোষণা দেন তাতে প্রভাবিত হয় সমগ্র বিশ্ব। কয়েক হাজার সুন্নি মুসলিম যুবক, এমনকি কিছু যুবতীও, বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে দলে দলে পঙ্গপালের মত বিশ্বজয়ের তথাকথিত পবিত্র জিহাদে সামিল হতে ইরাক ও সিরিয়ায় ছুটে যায়। বিশ্বের অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের  অসংখ্য জঙ্গিও তাদের নিজেদের সংগঠন ছেড়ে বাগদাদীর ডাকে সাড়া দিয়ে আইএসের পতাকা হাতে তুলে নেয়। এভাবে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি অতি দ্রুত বিশ্বের সমস্ত মুসলিম জঙ্গিদের এক নম্বর নেতা হয়ে ওঠেন। হয়ে ওঠেন এক নম্বর বিশ্বত্রাসী সন্ত্রাসীও এবং অচিরেই সহিংসতা, হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতায় ছাপিয়ে যায় লাদেনের আলকায়েদা ও মোল্লা ওমরের তালিবানিদের। এমনকি সাংগঠনিক শক্তি, সংগঠনের সংহতি ও বিস্তারেও তিনি বহুগুণ ছাপিয়ে যান লাদেনকে। লোকটা আমেরিকা, রাশিয়া সহ বিশ্বের সমস্ত অমিত শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির বুকে কাঁপুনি ধরিয়ে দিতে সক্ষম হয়। একসময় আমেরিকা তো তাঁঁর মাথার দাম বাড়াতে বাড়াতে ১৭৭ কোটি টাকা করে দেয় যা বোধ হয় সর্বকালের রেকর্ড।

      মেধাবী ছাত্র থেকে ভয়ংকর জিহাদি হয়ে ওঠার গল্প

মেধাবী ছাত্র ছিলেন আবুবকর আল-বাগদাদী। জন্ম গ্রহণ করেছিলেন ইরাকে ১৯৭১ সালের ৮ই আগষ্ট। ইরাকের বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। বিষয় ছিল ইসলামিক স্টাডিজ। ফুটবল ছিল তাঁঁর প্রিয় খেলা। খেলতেনও খুব ভালো। দক্ষ ফুটবলার হয়ে উঠেছিলেন। সবাই ডাকতো তাঁঁকে ইরাকের মারাদোনা বলে। সেই মেধাবী ছাত্র ও দক্ষ ফুটবল খেলোয়াড় বাগদাদী এক সময় ঝুঁকতে থাকেন ইসলামি কট্টর মতাদর্শ ও জিহাদি সন্ত্রাসের দিকে। ধীরে ধীরে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী হয়ে ওঠেন। এটাই তাঁঁদের স্বাভাবিক পরিণতি। কারণ, তার লেখাপড়ার বিষয় ছিল ইসলামিক স্টাডিজ। এই বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করলে যুক্তি, বুদ্ধি ও বিবেকহীন ব্যক্তিদের পক্ষে ধীরে ধীরে বর্বর জিহাদি হয়ে ওঠাটাই স্বাভাবিক। জিহাদি হয়ে ওঠা বাগদাদী যোগ দেন লাদেনের হাতে গড়ে তোলা জঙ্গি সংগঠন আল-কায়দার শাখা আই.এস.আই (ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক) এর সঙ্গে। ক্ষুরধার মস্তিষ্ক সম্পন্ন বাগদাদী একজন সাধারণ জঙ্গি থেকে অতি দ্রুতই আই.এস.আই এর নেতা হয়ে ওঠেন।নেতৃত্বের পদে অধিষ্ঠিত হন ২০১০ সালে। ছিলেন ইসলামি আদর্শ ও জিহাদের প্রতি যারপরনাই নিষ্ঠাবান এবং কঠোর শৃঙ্খলাপরায়ন।  সেই মতাদর্শ, নিষ্ঠা ও শৃঙ্খলার জোরে সংগঠনের মধ্যে তাঁঁর নিরঙ্কুশ কতৃত্ব ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হতে বিলম্ব হয়নি। 
আল-কায়দার প্রতি তাঁঁর অনুরাগ ও আনুগত্য বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তার মনে হয় আল-কায়দা ইসলামি বিপ্লব সম্পন্ন করার উপযুক্ত সংগঠন নয় এবং আল-কায়দার সঙ্গে থাকলে ইরাক ও ইরানের রাষ্ট্র উচ্ছেদ করে ইসলামি রাষ্ট্র স্থাপন করা কখনোই সম্ভব নয়। তিনি তাই আই.এস.থেকে বেরিয়ে গিয়ে ২০১৩ সালে আইএসআইএল (ISIL) নামে পৃথক একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। লেভান্ট হলো মধ্যপ্রাচ্যের একটি বৃহৎ ভূখণ্ড যার মধ্যে পড়ে ইরাক ও সিরিয়া ছাড়াও মিশর, লেবানন ও জর্ডান। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি জিহাদি কার্যকলাপের ভৌগোলিক সীমানা কাটছাঁট করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আশু লক্ষ্য হিসাবে স্থির করেন যে, প্রাথমিক পর্যায়ে শুধু ইরাক ও ইরানে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করে সেখানে একটি সত্যিকারের ইসলামি রাষ্ট্র তৈরি করেবেন। তাই তিনি তার সংগঠনের নামে বদল আনেন। আইএসআইলের বদলে নতুন নাম দেন আইএসআইএস অর্থাৎ ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এণ্ড ইরান (ISIS)। রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী এবং শিয়া মুসলমান সহ সমস্ত মুশরিক ও কাফের জনতার বিরুদ্ধে একের পর এক নৃশংস সন্ত্রাসী হামলা সংগঠিত করা শুরু করেন। এইসব হামলায় বহু সেনা ও অসামরিক মানুষ হতাহত হয়। হামলাগুলি মোকাবিলা করতে চূড়ান্ত ব্যর্থ হয় ইরাক ও ইরানের সরকার। ফলে ইরাক ও ইরানের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সাধারণ জনজীবন ক্রমশ বিপর্যস্ত হতে থাকে। ISIS জঙ্গি হানায় দু'ই রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ক্রমশও পিছু হটতে থাকে। এর প্রভাব পড়ে অন্যান্য সংগঠনের জঙ্গিদের উপর। আল-কায়দার সংগঠন আই.এস.আই এর সমস্ত জঙ্গি  বাগদাদীর সঙ্গে যোগ দেয়। তার পতাকা তলে যোগ জড়ো হয় অন্যান্য সংগঠনের বহু জঙ্গিও। ফলে বাগদাদীর ISIS ব্যাপক শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং সন্ত্রাসী অভিযান আরো জোরদার করে তোলে। অচিরেই পৃথিবীর সবচেয়ে পরাক্রমশালী জিহাদি সংগঠনে পরিণত হয়। বাগদাদীর ক্রমবর্ধমান তীব্র জঙ্গি আক্রমণে সেনাবাহিনী আরো বেশি বেশি কোনঠাসা হতে থাকে, আরো বেশি পিছু হটতে থাকে। তাঁঁর পরাক্রম ও একের পর এক সফল জিহাদি অভিযানের খবর বাতাসের গতিতে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে যা গোঁড়া মুসলিম যুব সমাজকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। তারা বিশ্বের নানাপ্রান্ত থেকে শ'য়ে শ'য়ে পঙ্গপালের মত ইরাক ও ইরানে গিয়ে ISIS এর জঙ্গিবাহিনীতে যোগদান করে।
বাগদাদী ইরাক ও ইরানে তাঁঁর দখলিকৃত ভূখণ্ডে ২০১৪ সালে ইসলমি রাষ্ট্র গঠন করার ঘোষণা দেন যার নাম দেন আইএস (IS) তথা ইসলামিক স্টেট। সে সময়েই তার সংগঠন ISIS-এর নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দেন আইএস তথা IS। ইসলামী রাষ্ট্র স্থাপনের ঘোষণা দেওয়ার অব্যবহিত পরই (২৯শে জুন, ২০১৪) সেখানে খেলাফত গঠনের ঘোষণা দেন এবং নিজেকে তাঁঁর খলিফা হিসেবে নিযুক্ত করার ঘোষণাও দেন। খলিফা হয়েই ফতোয়া জারি করেন -  বিশ্বের সমস্ত মুসলমান এবং সমস্ত মুসলিম রাষ্ট্রের তিনি খলিফা, সবাইকে তার খেলাফতের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করতে হবে এবং তার কাছে বয়াত (আনুগত্যের শপথ) নিতে হবে। যারা তার আনুগত্য স্বীকার করবে না, তার খেলাফতকে অস্বীকার করবে, তারা সবাই ইসলামের শত্রু। একটা বিশেষ লক্ষণীয় বিষয় হলো খেলাফতের ঘোষণা দেওয়ার নির্বাচনের দিনটি। খেলাফত স্থাপনের ঘোষণার দিনটি ছিল আরবি রমজান মাসের ১লা তারিখ যে দিনটি মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে একটি বিশেষ পবিত্র দিন।
বাগদাদীর খেলাফত স্থাপনের ঘোষণা শুধু নামেই ছিলো না, কাজেও তা করে দেখিয়ে গিয়েছেন। তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত হলো এগুলো:
দৃষ্টান্ত এক. মুহাম্মদ এবং তাঁর পরম বিশ্বস্ত সাহাবী (অনুচর) প্রথম চার খলিফা যে উদ্দেশ্য ও কঠোর মনোভাবে নিয়ে খেলাফত পরিচালনা করতেন ঠিক সেই উদ্দেশ্য ও তাঁঁদের মতোই  কঠোর মনোভাবে নিয়েই বাগদাদীও তাঁঁর খেলাফত পরিচালনা করে গেছেন। তাঁঁর নবী ও পূর্বসূরি খলিফাদের মূল লক্ষ্য ছিল গোটা বিশ্বে খেলাফতি শাসন প্রতিষ্ঠা করা। মুহাম্মদ কিন্তু প্রথমেই বিশ্বকে জয় করার লক্ষ্য স্থির করেন নি। প্রথমে নিশানা করেন মদিনার প্রতি। তারপর মক্কা জয় করার প্রতি। এভাবে ধাপে ধাপে লক্ষ্যমাত্রার (target area) বিস্তার ঘটান এবং পর পর সাফল্য আসার পর গোটা বিশ্বে খেলাফত প্রতিষ্ঠা করার লক্ষমাত্রা স্থির করেন। মুহাম্মদের সাহাবী খলিফাগণও সে পথটাই অনুসরণ করে ধাপে ধাপে ইসলামী সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটিয়ে ছিলেন। বাগদাদীও তাঁঁদের মতো ধাপে ধাপে তার খেলাফত বিস্তারের লক্ষমাত্রা সম্প্রসারিত করেছেন। যেমন প্রথম লক্ষ্য ছিল ইরাক ও ইরানে খেলাফত স্থাপন করা। সেটা পূরণ হবার পর পরবর্তী লক্ষমাত্রার বিস্তার ঘটান। স্থির করেন যে ২০২০ সালের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া মহাদেশের বৃহৎ অঞ্চল, উত্তর আফ্রিকা, স্পেন, আফ্রিকা ও বাল্কান অঞ্চলগুলিকে তাঁঁর খেলাফতের অধীনে নিয়ে আনবেন। তারপর দখল করবেন সৌদি আরব ও ইরান। তাঁর চোখ ছিল কাবা মসজিদের প্রতি। দৃষ্টান্ত দুই. খেলাফতের অন্তর্গত শিয়াদের সমস্ত মসজিদ ও সৌধ, খৃষ্টানদের সমস্ত গীর্জা ও সমস্ত ভাস্কর্য শিল্প ধ্বংস করেন।
দৃষ্টান্ত তিন. ফতোয়া জারি করেন যে তাঁঁর খেলাফতে শুধু সুন্নি মুসলিমরাই প্রথম শ্রেণীর নাগরিকের অধিকার ও মর্যাদা পাবে। অন্যদের হয় খেলাফত ত্যাগ করতে হবে, নচেৎ জিম্মি হয়ে থাকতে হবে।
দৃষ্টান্ত চার. তিনি মেয়েদের হিযাব পরা বাধ্যতামূলক করেন। সমস্ত পানশালা ও কফি হাউস বন্ধ করেন। ধূমপান নিষিদ্ধ করেন।
দৃষ্টান্ত পাঁচ. নামাজ পড়া ও রোজা রাখা বাধ্যতামূলক করেন। নামাজের সময় সমস্ত দোকান, বাজার ও অফিস-আদালত বন্ধ রাখার ফতোয়া জারি করেন।
দৃষ্টান্ত ছয়. সুদ লেনদেন নিষিদ্ধ করেন। সমস্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে তাদের সমস্ত অর্থ বাজেয়াপ্ত (লুঠ) করেন।
দৃষ্টান্ত সাত. বিনা বাধায় লুঠ করা সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পদকে গণিমতের মাল তথা বৈধ সম্পদ বলে ঘোষণা দেন এবং সেগুলো রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করেন।
দৃষ্টান্ত আট. অপহৃত সকল অসুন্নি মুসলিম নারী সহ সকল মুশরিক ও অবিশ্বাসী নারী কে আইএস জঙ্গিদের জন্য ভোগ করা তথা ধর্ষণ করা বৈধ বলে ঘোষণা করেন।
দৃষ্টান্ত নয়. অপহৃত নারীদের ভোগ করার ক্ষেত্রে জঙ্গিদের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া ব্যাপক বিশৃঙ্খলা রোধে কোরানের আলোকে একটি নতুন বিধিমালা তৈরি করেন।
দৃষ্টান্ত দশ. সকল মুসলিম দেশগুলোর প্রতি ঘোষণা দেন যে পাশ্চাত্য দেশগুলোর অনুকরণে তৈরি করা সমস্ত আইন-কানুন বাতিল করতে হবে এবং গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবাধিকার ইত্যাদি সমস্ত অইসলামি নীতি ও ধ্যানধারণা বর্জন করতে হবে।
বাগদাদী ছিলেন আদর্শ খলিফা
নৃশংসতা, নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, পৈশাচিকতা হিংস্রতা, হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, মানব পাচার ইত্যাদি সমস্ত আদিম, অমানবিক ও ভয়ংকর অপগুণগুলির দিক দিয়ে বাগদাদী ছিলেন একজন আদর্শ খলিফা। ছিলেন এ যুগের ইসলামের নবীর আদর্শ অনুসারী। মুহাম্মদ তাঁকে আল্লাহর নবী বলে স্বীকার না করার জন্যে কাফের ও মুশরিকদের উপর যে নৃশংস নির্যাতন ও নিপীড়ন চালিয়েছিলেন তার বর্ণনা শুনলে আজও গা শিউরে ওঠে। তাঁকে নবী মানতে অস্বীকার করার অপরাধে মদিনার বানু কুরাইজা গোষ্ঠীর ইহুদিদের ৮০০/৯০০ জন পুরুষের শিরচ্ছেদ করেন। সেই ভয়ংকর হত্যাকাণ্ডের তিনি নিজেই তত্বাবধান করেন। বাদদাদীও ইরাকের মসুল শহরে ৫০০ জন ইয়াজিদিকে জীবন্ত পুঁতে দেন। তাদের অপরাধ ছিল তারা তাঁঁকে খলিফা বলে স্বীকার করতে এবং জিজিয়া কর দিতে সম্মত হয় নি। মুহাম্মদ যেমন অবিশ্বাসীদের যাবতীয় স্থাবর ও  অস্থাবর সম্পদ লুট করে ফকির থেকে বাদশা হয়ে উঠেছিলেন রকেটের গতিতে, বাগদাদীও মাত্র কয়েক বছরে আইএসকে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী জিহাদি ও সন্ত্রাবাদী সংগঠনে পরিণত করে তুলে ছিলেন। আইএস এই বিপুল সম্পদ অর্জন করে তাদের নবীর অনুসৃত পথেই যার মধ্যে ছিল ব্যাপক লুটতরাজ, চোরাচালান, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, মানব পাচার ইত্যাদি। যে সমস্ত শিয়া, ইয়াজিদি, ইহুদী, খৃষ্টান ও অন্যান্য কাফের সম্প্রদায়ের মানুষ খেলাফত ত্যাগ করে দেশান্তরী হয় তাদের সমস্ত সম্পত্তি বাগদাদী লুট করেছিলেন। লুট করেন খেলাফতের অধীনস্থ সমস্ত ব্যাংক। অতি মূল্যবান সমস্ত ভাস্কর্য পাচার করে বহু অর্থ উপার্জন করেন। তৈলক্ষেত্রগুলি থেকে তেল পাচার, গুরুত্বপূর্ণ অপহৃত ব্যক্তিদের কাছ থেকে মোটা মুক্তিপণ আদায় ও অপহৃতদের বিক্রি করেও বিপুল অর্থ উপার্জন করেন।
বিশ্বের সমস্ত মুসলিম জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদী গ্রুপের নেতারা তাদের সংগঠনর শাখা বিশ্বব্যাপী  ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে এবং সাধ্যমত তারা পেরেছে। এ ব্যাপারে ওসামা বিন লাদেনের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এক্ষেত্রেও বাগদাদীর নাম থাকবে সবার উপরেই। গ্রুপের প্রধান নেতা  হিসাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন মাত্র ছ' বছর। ২০১৩ সালে নিজের দেশ ইরাকে তিনি তার নিজের গ্রুপ বা সংগঠন ISIL এর জন্ম দেন, তারপর মাত্র সাত বছরের মাথায় এ বছর (২০১৯) ২৭শে অক্টোবর নিহত হন। অর্থাৎ  তাঁঁর কার্যকালের মেয়াদ অতি সামান্যই। তবুও এই স্বল্প সময়ের মধ্যে বহু দেশে তার সংগঠন আইএসের শাখা ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন যেগুলো এখনো জীবিত ও সক্রিয়। নিজের সংগঠনের বাইরেও সমমনোভাবাপন্ন বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম জিহাদি গ্রুপকে সহায়তা দেন। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য ও পরিসংখ্যান অনুযায়ী তিনি ২৯টি দেশে ১৪০টি জঙ্গি ও জিহাদি হামলায় উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন। এ ছিল তার সারা বিশ্বে শরিয়তি রাজ কায়েম করার মূল লক্ষ্য ও পরিকল্পনার অঙ্গ।
ইসলামী সাম্রাজ্যের প্রথম চার খলিফাকে (আবুবকর, ওমর ফারুক, ওসমান গণি ও আলীকে) সুন্নি মুসলিমরা খোলাফায়ে রাশিদিনের (সৎপথে পরিচালিত খলিফা) উপাধিতে ভূষিত করেন। অর্থাৎ তাঁঁরা মুহাম্মদ ও আল্লাহর আদর্শ ও নির্দেশ মেনে খেলাফত পরিচালনা করেছেন। অবশ্য তাঁঁরাও কোরানের বাইরে গিয়ে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। সেগুলি অবশ্য কোরানের আদেশ ও আদর্শের পরিপন্থী ছিল না। মুহাম্মদ ও কোরানের নির্দেশ ও নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু কিছু পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয় মূলত পঞ্চম খলিফা আমির মুয়াবিয়ার (৬৬১-৬৮০ খৃ:) খেলাফতের সময় থেকে। তাঁঁর নেওয়া ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও ইসলামের পরিপন্থি পদক্ষেপগুলির মধ্যে প্রধান তিনটি পদক্ষেপ হলো - ১). তিনি সর্বপ্রথম একটি ধর্মনিরপেক্ষ সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। ২). খলিফার উপদেষ্টা পরিষদেও (মজলিসে সুরায়) ধর্মনিরপেক্ষ নীতি চালু করেন। উক্ত পরিষদে তিনিই সর্বপ্রথম অমুসলিম সম্প্রদায় থেকে নানা বিষয়ে জ্ঞানী, পণ্ডিত, বুদ্ধিদীপ্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সদস্য করেছিলেন যাঁদের মধ্যে ইহুদি ও খৃষ্টান সম্প্রদায়ের লোকও ছিল। ৩). একজন ইহুদি চিকিৎসককে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক নিয়োগ করেন। তিনি কিন্তু তাঁর নবী ও আল্লাহর প্রতি আস্থাবান ও আনুগত্যশীল ছিলেন না এমন নয়। তিনি তাঁর পৃর্বসূরি খলিফাদের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধি ও বাস্তব জ্ঞান সম্পন্ন দূরদর্শী খলিফা ছিলেন। তাই তিনি ইসলাম ও খেলাফতের সংহতি, উন্নতি বিস্তারের প্রয়োজনে এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করার ঝুঁকি নিতে সক্ষম হয়েছিলেন যেগুলি ছিলো ইসলামের সঙ্গে স্পষ্টতই সাংঘর্ষিক।
মুয়াবিয়া ইসলামের পরিপন্থি পদক্ষেপ করার যে সাহস ও পথ দেখান তাকে তাঁর উত্তরসূরি খলিফাগণ সামনের দিকে আরও অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যান। বিশেষ করে আব্বাসি যুগের মাঝামাঝি কয়েকজন খলিফা আরবের উন্নতি ও বিকাশের ক্ষেত্রে কোরানকে সবচেয়ে বড়ো প্রতিবন্ধক বলে মনে করতেন, খেলাফত তথা সাম্রাজ্য পরিচালনায় তাঁরা কোরানকে সম্পূর্ণ ব্রাত্য করে দেন। শুধু ব্রাত্যই করা হয় নি, কোরানের সমর্থনে সর্বপ্রকার লেখালেখি ও আলোচনা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করা হয়েছিল যে কোরান হলো ব্যক্তির সৃষ্টি, আল্লাহর নয়। সেই খলিফাদের শাসন কালে এক সময় রাষ্ট্রীয় নীতি থেকে শরিয়তকে সম্পূর্ণ বর্জন করে একটি বিকল্প নীতি গ্রহণ করা হয়। সেই নীতিটি 'মুতাজিলা' নীতি নামে ইতিহাসে খ্যাত। খলিফা হারুণ রশিদ সর্বত্র মুতাজিলা নীতি কার্যকর করার জন্য একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন। সেই নীতিটির একটি অন্যতম প্রধান ঘোষণা ছিল, সত্যের অনুসন্ধানে অন্ধবিশ্বাস ও অন্ধানুগত্য বর্জন করে চিন্তাকে সর্বপ্রকার বাধা থেকে মুক্ত করতে হবে। মুতাজিলা যুগের খলিফা আল-মামুন একটি আইন প্রণয়ন করেন যে আইনে নির্দেশ দেওয়া হয় যে, সবাইকে মানতে হবে এ কথা যে, কোরান মানুষের দ্বারা রচিত একটি গ্রন্থ, আল্লাহর নয়। যারা তা মানবে না তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হবে। খুবই বেদনার বিষয় হলো এই যে আরবের ইতিহাসের এই স্বর্ণযুগের স্থায়িত্ব কাল ছিল মাত্র একশ' বছর (৭৫৪ - ৮৪৩)। খলিফা আল মুতাওয়াক্কিল  অব মুতাজিলা নীতিকে বর্জন করে খেলাফত পরিচালনায় ইসলাম ও কোরানকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। 

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, মক্কায় বাস করত মূলত দু'টি গোত্র বা বংশের লোকজন  - হাসেম বংশ বা আব্বাস বংশ, উমাইয়া বংশের লোক। এই দু'ই বংশের মধ্যে গোড়া থেকেই ছিল পারষ্পরিক বৈরি মনোভাব। মুহাম্মদ হাসেমি বংশের লোক বলে তাঁর ধর্ম প্রচারে মক্কায় সবচাইতে বেশি বাধা এসেছিল উমাইয়া বংশ থেকে। মুয়াবিয়া ছিলেন উমাইয়া বংশের লোক। তাই তাঁর খলিফা হওয়াটা হাসেমি বংশের লোকজন মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারে নি। সে অন্য কথা। সুতরাং সে কথা থাক। মূল আলোচনায় ফেরা যাক। মুয়াবিয়ার পর উমাইয়া বংশের আরও কয়েক জন খলিফার আসন অলঙ্কৃত করেছিলেন। সেজন্যই তাঁদের শাসন কাল ইতিহাসে উমাইয়া যুগ বলা হয়। তারপর এক সময় আব্বাস বংশের লোকেরা এক সময় উমাইয়াদের কাছ থেকে খেলাফত ছিনিয়ে নেয় এবং সেখানেই  উমাইয়া যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে। অত:পর শেষ পর্যন্ত আব্বাস বংশের লোকেরাই খেলাফতের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। এই শাসন কালটাকে বলা হয় আব্বাসি যুগ। আব্বাসি যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে ১২৫৮ খৃষ্টাব্দে। সে বছর আব্বাস বংশের শেষ খলিফা বহি:শত্রুর হানা রুখতে ব্যর্থ হলে খেলাফতের ক্ষমতা চলে যায় আরবের বাইরে। সেজন্যেই বলা হয় যে খেলাফতি যুগের পরিসমাপ্তি হয় ১২৫৮ খৃস্টাব্দে। তারপর অনারব মুসলিমদের হাতে বিচ্ছিন্নভাবে নানা জাতি নানা বংশের হাতে বিশ্বের নানা প্রান্তে খেলাফতি শাসন টিকেছিল বিংশ শতাব্দীর সিকিভাগ পর্যন্ত। সর্বশেষ ওসমানিয়া খেলাফতের পরাজয় ঘটে ১৯২৪ খৃস্টাব্দে কামাল আতাতুর্কের কাছে এবং পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে খেলাফত মুছে যায়। 
৬৬০ সনে পঞ্চম খলিফা আমির মুয়াবিয়া সর্বপ্রথম শরিয়া নীতি থেকে সরে আসা শুরু করেন। এটা আগেই আলোচনা করা হয়েছে। তিনি এ রকম পদক্ষেপ নেওয়া অবশ্য শুরু করেন ইসলামি খেলাফত তথা ইসলামি সাম্রাজ্যের উন্নতি, বিকাশ ও সুরক্ষার প্রয়োজনে। মুয়াবিয়া যে কাজ শুরু করেন তাকে তাঁঁর উত্তরসূরিরা আরো এগিয়ে নিয়ে যান। সে কাজ পূর্ণতা পায় আব্বাসী যুগে যে যুগটি আরবের ইতিহাসে মুতাজিলা যুগ নামে খ্যাত। আব্বাস বংশের খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিল মুতাজিলা মতবাদকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে বাতিল করে দেন এবং ৮৪৩ সনে পুনরায় শরিয়া শাসনকে ফিরিয়ে আনেন। 
খলিফা আল মুতাওয়াক্কিল শরিয়া শাসনের পুন:প্রবর্তন ঘটালেও তা সত্যিকারের শরিয়া শাসন ছিল না যে শরিয়া শাসন প্রবর্তন করেছিলেন মুহাম্মদ ও তাঁর প্রথম চার খলিফা (প্রতিনিধি)। সেজন্যই মুসলিমরা প্রথম চার খলিফা ছাড়া আর কোনো খলিফাকে আদর্শ খলিফা বা সৎপথে (ইসলামের পথে) পরিচালিত খলিফা বলে মানে না।
আইএস (IS) সুপ্রিমো আবুবকর আল বাগদাদী ১৯১৪ সনে ইরাকের মসুল শহরে ঘোষণা দেন যে তিনিই সত্যিকারের ইসলামী খেলাফত তথা শরিয়া শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন পৃথিবীর বুকে পুন‍রায় নতুন করে। তাঁর ঘোষণা যে অতীতের অন্যান্য খলিফা ও বর্তমান মুসলিম বিশ্বের ধর্মীয় ও রাষ্ট্র নেতাদের মতন ফাঁকা আওয়াজ ছিল না তার নিখুঁত প্রমাণ তিনি রেখে গিয়েছেন তাঁর অতি স্বল্পকালীন খেলাফতকালে (২০১৪-২০১৯)। 
তাই যারা আজও মূর্খের মতন বিশ্বাস করে যে সমগ্র পৃথিবী জুড়ে একদিন না একদিন সত্যিকারের খেলাফত তথা আল্লাহর শরিয়া শাসনের প্রতিষ্ঠা হবেই তারা আইএস খলিফা আলবাগদাদীর মৃত্যুতে চরম হতাশ হবে। কারণ, তাদের মনে গভীর বিশ্বাস ও প্রত্যাশার জন্ম হয়েছিল যে বাগদাদী হলো সেই বহু কাঙ্খিত নেতা যাঁঁকে  আল্লাহ স্বয়ং প্রেরণ করেছে পৃথিবীকে শরিয়া শাসনের অধীনে নিয়ে আনার জন্যে। 
সুতরাং বাগদাদীর নিকাশ হয়ে যাওয়ার ঘটনা আর পাঁচটা কট্টর মুসলিম জঙ্গিনেতার মৃত্যু বা নিকাশ হওয়ার মতন কোনো মামুলি ঘটনা নয়।
যৌথবাহিনীর প্রতিরোধ ও পাল্টা হানায় সম্পূর্ণ কোণঠাসা হয়ে গোপন জায়গায় লুকিয়ে থাকা বগদাদীর নিকাশ হওয়াটা ছিল সময়ের অপেক্ষা মাত্র। বাগদাদীর বিনাশে মুসলিম জঙ্গি আন্দোলন শেষ হয়ে যাবে না ঠিকই, তবে তাঁর বিনাশের ফলে মুসলিম জঙ্গি আন্দোলনে অপূরণীয় ক্ষতি হবে যা ওসামা বিন লাদেনের নিকাশের ফলে যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছিল তাকেও ছাপিয়ে যাবে। 
                     শেষ
(বি:দ্র:- লেখাটি শুরু করি ৩১ শে অক্টোবর, শেষ করলাম আজ ৮ই ডিসেম্বর। আমার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কারণে সীমাতিরিক্ত এই বিলম্ব। এই বিলম্ব কিন্তু আমার সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত। তবুও সকলের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।)

Saturday, August 17, 2019

জম্মু-কাশ্মীরে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত

জম্মু-কাশ্মীর যেভাবে ৩৭০ ধারা রদ করে রাজ্যটিকে দ্বিখন্ডিত করা হয়েছে তা স্বাধীনোত্তর ভারতে একটি বেনজির ঘটনা। ঘটনাটা কি অভিপ্রেত ছিলো? কয়েকটি রাজ্য বাদে গোটা দেশের অধিকাংশ হিন্দুদের চোখে এটি একটি চমৎকার ঘটনা। তাদের কাছে এটি বহুদিনের একটি বহু প্রতিক্ষিত ঘটনা। আরএসএস ও বিজেপির অনুগামীরা তাই এই ঘটনায় মেতেছে বাঁধনহারা উল্লাসে। ভারত পাকিস্তানের ভুখণ্ডে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ও এয়ার স্ট্রাইক করার পর যে আনন্দ ও উচ্ছ্বাস দেখা গিয়েছিল তাদের চোখেমুখে তার চেয়ে ঢের বেশি উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে এক্ষেত্রে। এবার উচ্ছ্বাস যেন আক্ষরিক অর্থেই বাঁধনহারা।
শুধু বিজেপি ও তার জোটসঙ্গীরাই নয়, কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন দিয়েছে এনডিএ-এর বাইরের কয়েকটি দলও। এমনকি যারা গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে আদর্শ হিসেবে ধারণ করেন বলে জাহির করতেন এবং আপাদমস্তক বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদবিরোধী তারাও কেউ কেউ এই পদক্ষেপকে সমর্থন জানিয়েছেন। উদ্বাহু হয়ে স্বাগত জানিয়েছেন। এখানেই ছেদ পড়ে নি‌। কেন্দ্রের এই পদক্ষেপের অভিঘাতে ইউপিএ-এর ঘর পর্যন্ত ভেঙেছে। ভেঙেছে এমনকি কংগ্রেসের ঘরও। কংগ্রেসের কিছু নেতা ও সাংসদ দলের অবস্থানের বাইরে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারসরকারের পক্ষে সোচ্চারে সমর্থন প্রদান করেছেন। দলের আদর্শ, ঐতিহ্য ও শৃঙ্খলাকে পদদলিত করেছেন অক্লেশে। অকপটে। কী করে সম্ভব হলো এটা? আরএসএস ও বিজেপির ধর্মীয় মৌলবাদবিরোধী অবস্থানে থেকেও যারা জম্মু-কাশ্মীর অপারেশনে বিজেপির পাশে দাঁড়িয়েছেন তারা কোন চোখে দেখছেন এই অপারেশনটিকে? তারাও কি সাধারণ হিন্দু ও হিন্দুত্ববাদীদের চোখে দেখছে? তারা যে এই ঘটনাটিকে ওদের চোখে দেখছেন না তা বুঝবো কী করে? কই, তারা তো ৩৭০ ধারার মতনই প্রায় অন্য ধারাগুলো - ৩৭১এ থেকে ৩৭১জে - রয়েছে সেগুলো রদ করার কথা বলছেন না? জম্মু-কাশ্মীরের ৩৫এ ধারার প্রায় সমগোত্রীয় অন্য যে ধারাগুলো রয়েছে জম্মু-কাশ্মীর ছাড়া অন্য কয়েকটি রাজ্যে সেগুলো তো রদ করার দাবি জানাচ্ছেন না?
সরকার যখন কোনো পদক্ষেপ নেয় সেটা হিন্দু বা মুসলমান বা খ্রিস্টান, কোন পক্ষের পক্ষে কতটা ভালো বা মন্দ সেটা বড়ো বিবেচ্য হওয়া কাম্য নয় এদেশে। কারণ, এ দেশটা যে একটা ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দেশ। সরকারের প্রতিটি কাজের বিচার হওয়া উচিত গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি ও আদর্শের মানদণ্ডে। সরকারের সমস্ত কাজের মূল্যায়ন করা উচিত সংবিধানের নিক্তিতে। কিন্তু ভারত সরকারের এই পদক্ষেপটি কি আমাদের দেশের নীতি ও আদর্শ এবং আমাদের সংবিধানের মানদণ্ডে মূল্যায়ন করা সম্ভব? এ কথা ঠিক যে, পদক্ষেপটি সংসদের দু' কক্ষেই গৃহীত হয়েছে, এ কথাও ঠিক যে, হয়তো বা সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এই পদক্ষেপটির পেছনে রয়েছে, তার অর্থ কি এই যে, পদক্ষেপটি নি:সংশয়ে সাংবিধানিক দিক থেকে সঠিক ও শুভ পদক্ষেপ? পদক্ষেপটি কি আদৌ আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের সঙ্গে খাপ খায়?
এই পদক্ষেপটি কতটা গণতন্ত্রসম্মত, কিংবা কতটা ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, কিংবা আদৌ সংবিধানসম্মত হয়েছে কী না তা নিয়ে আলোচনা চলছে দেশজুড়ে। এই পদক্ষেপটিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে অনেকেই সর্বোচ্চ আদালতে যাবেন তা শোনা যাচ্ছে। সংবিধান মেনে কেন্দ্রীয় সরকার পদক্ষেপটি গ্রহণ করেছে কী না সে বিষয়ে শেষ কথা বলবে সর্বোচ্চ আদালতই। তবু প্রত্যেক নাগরিকেরই অধিকার আছে এ বিষয়ে আলোচনা করার, নিজস্ব মতামত জ্ঞাপন করার। তাই আমিও এর উপর আমার মতামত ব্যক্ত করতে চাই। কিন্তু তার আগে ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা রদ করা প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলে নিতে চাই।
প্রথমেই সরাসরি ও অকপটে বলি যে এই ধারা দু'টি রদ করার বিরুদ্ধে আমি নই। ধারা দু'টি রদ করা হয়েছে বলে আমার কোনো খেদ বা ক্ষোভ নেই। ৩৭০ প্রসঙ্গে পরে আসছি। প্রথমেই বলি যে, ৩৫এ ধারাটি সব সময়ের জন্যেই রদযোগ্য। কারণ, আইনটি তো আপাদমস্তক অগণতান্ত্রিক, নারীবিদ্বেষী ও নারীবিরোধী। জম্মু-কাশ্মীরের কোনো নারী সে রাজ্যের বাইরের কাউকে বিয়ে করলে সে তার উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে, সে তার পূর্ব পুরুষের সম্পত্তির কিছুই পাবেনা। এমনকি তার উত্তরাধিকারগণও বঞ্চিত হবে, এমন আইন যে কোনো সভ্য দেশ ও সমাজের ক্ষেত্রে যে অনুপযুক্ত ও বেমানান তা বলা বাহুল্য। কাশ্মীরের পুরুষ গোটা দেশের যে কোনো প্রান্তে যেখানে খুশী ব্যবসা বা চাকরি করতে পারবে, সেখানকার সম্পত্তি কিনতে পারবে, সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হতে পারবে, সেখানে স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে, কিন্তু দেশের অন্য প্রান্তের মানুষ জম্মু-কাশ্মীরে সে অধিকারগুলি ভোগ করতে পারবে না, এমন তীব্র বৈষম্যমূলক আইন কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে বড় জোর অতি স্বল্প সময়ের জন্য প্রবর্তন করা যেতে পারে। কিন্তু এমন আইন যা সংবিধানের মূল ধারার সঙ্গে অসামন্জস্যপূর্ণ এবং সাংঘর্ষিক তা চিরকাল বলবৎ থাকা সমীচীন নয়। তাই এই ধারাটি (৩৫এ) রদ করা অনেক আগেই উচিত ছিল। এবং ৩৫এ ধারার প্রায় অনুরূপ অন্য যে ধারাগুলো রয়েছে অন্যান্য রাজ্যে বা অঞ্চলে সেগুলিও রদ করা সমান কর্তব্য।
৩৭০ নং ধারা সম্পর্কে সংবিধানের একবিংশ অংশের প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, এটা একটা সাময়িক, পরিবর্তনসাপেক্ষ ও বিশেষ আইন (Temporary, transitional and special Act)। এই ধারায় জম্মু-কাশ্মীরকে তিনটি ক্ষেত্র (পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ) ছাড়া তাদের নিজস্ব সংবিধান তৈরি করার বিশেষ ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। এই ধারাটি সংবিধানে সংযুক্ত করার পেছনে তিনটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল - জম্মু-কাশ্মীরের জনগণকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান, সে রাজ্যের মানুষদের নিজস্ব জীবনধারা (কাশ্মীরিয়াত) অটুট ও অক্ষুন্ন রাখা এবং ধীরে ধীরে ভারতের বাকি অংশের মানুষের সাথে জম্মু-কাশ্মীরের জনগণের সম্প্রীতি ও সংহতি নির্মাণ করা। এই ধারাটি সংবিধানে সংযুক্ত করা সাত দশক হয়ে গেছে। এটা নি:সন্দেহে দীর্ঘ সময়। এতদিনে এবার আমাদের এটা পর্যালোচনা করার সময় নিশ্চয়ই হয়েছে। জম্মু-কাশ্মীরকে উক্ত বিশেষ সুবিধা ও অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদান করার পরিণাম বা পরিণতি কী হয়েছে তা আমাদের এবার অবশ্যই পর্যালোচনা করে দেখা দরকার। আত্মনিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে জম্মু-কাশ্মীরের জনগণকে স্বশাসনের যে অধিকার দেওয়া হয়েছিল তার কতটা সুফল পেয়েছে সে রাজ্যের মানুষ? সে রাজ্যের জনগণের নিজস্ব জীবনধারা তথা কাশ্মীরিয়াত কি অক্ষুন্ন রয়েছে? ভারতের বাকি অংশের জনগণের সঙ্গে সে রাজ্যের জনগণের সম্প্রীতি ও সংহতি গড়ে উঠেছে? তিনটি প্রশ্নের একটাই উত্তর - না, না, না। বরং হয়েছে উল্টোটাই। জম্মু-কাশ্মীরকে দেওয়া আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বশাসনের ফলে প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেখানকার অমুসলিম সমাজের মানুষ। তাদের অপরিসীম বৈষম্য, বঞ্চনা ও অবিচার করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, তারা দিনের পর দিন অত্যাচারিত ও নিপীড়িতও হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কাশ্মীরি ব্রাক্ষণদের নৃশংস অত্যাচার ও নির্যাতনের মাধ্যমে তাদের কাশ্মীর ত্যাগ করে জম্মুতে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য করার বর্বর ঘটনাটি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তবুও জম্মু-কাশ্মীরের কোনো সরকার এগুলিকে কোনো সমস্যা মনে করার সঙ্গত কারণ খুঁজে পায় নি। কোনো সরকারই তাদের প্রতি ধারাবাহিকভাবে হতে থাকা বৈষম্য ও বঞ্চনার অবসান করতে এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে নি। স্বশাসনের ফায়দা কিন্তু সাধারণ মুসলিমরাও পাই নি। তা ভোগ করেছে মূলতঃ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা, মুসলিম সম্প্রদায়ের অভিজাত শ্রেণী, বিচ্ছিন্নতাকামী শক্তি ও মুসলিম মৌলবাদীরা। কাশ্মীরের সাধারণ মেহনতি মুসলিমদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার কতটুকু উন্নতি হয়েছে? বিগত সাত দশকের শাসনে কখনও কি এগুলোর পর্যালোচনা হয়েছে? পর্যালোচনা করলে এ ছবিটিই স্পষ্ট হয় যে, জম্মু-কাশ্মীরের সেই মেহনতি মানুষগুলো যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই পড়ে রয়েছে। অর্থাৎ সাত দশক ধরে জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ নং ধারার শুধু অপপ্রয়োগই হয়েছে। এই ধারাটি কি কাশ্মীরিদের কাশ্মীরিয়াত অটুট ও অক্ষুন্ন রাখতেও সফল হয় নি যে কথা আগেই বলেছি। তাদের কাশ্মীরিয়াত ধীরে ধীরে ইসলামিয়াতে রূপান্তরিত হয়েছে। ইসলামী মৌলবাদী ও ইসলামী সন্ত্রাসবাদী চিন্তাধারা ও নেটওয়ার্ক ক্রমশ বিস্তারলাভ করেছে, এবং মুসলিম সন্ত্রাসবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের শক্তি বৃদ্ধি হয়েছে যার অভিঘাতে কাশ্মীরিয়াতি মূল্যবোধ ব্যাপক বিচ্যুতির কবলে পড়েছে। কাশ্মীরিয়াতি মূল্যবোধকে সরিয়ে সেখানে ক্রমশ জাঁকিয়ে বসছে  ইসলামিয়াতি সর্বনাশা মূল্যবোধ। জম্মু-কাশ্মীর ও ভারতের বাকি অংশের মধ্যে সম্প্রীতি ও সংহতি কি গড়ে উঠেছে? বলা বাহুল্য যে, গড়ে ওঠেনি। বরং দিনে দিনে বেড়েছে দুরত্ব, অবিশ্বাস ও অসংহতি। না, বলছি না যে, এই ভয়ংকর ব্যর্থতা এবং নেতিবাচক ও হতাশাব্যঞ্জক পরিণতির দায় বর্তায় এককভাবে জম্মু-কাশ্মীরের সরকারগুলির উপরেই। এর দায় রয়েছে ভারত সরকারেরও। কিন্তু প্রধানত ও প্রথমত দায় বর্তায় তো জম্মু-কাশ্মীরের সরকারগুলোর উপরেই। কারণ, সংখ্যালঘু তথা অমুসলিমদের প্রতি ন্যায় বিচার প্রদান করা ও তাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার প্রধাান দায়িত্ব ছিল তো তাদের কাঁধেই। এবং ইসলামিয়াত তথা ইসলামাইজেশনের হাত থেকে কাশ্মীরিয়াতকে রক্ষা করার দায়িত্বটিও ছিল তাদের উপরেই। জম্মু-কাশ্মীরের জন্য সংবিধানে ৩৭০ নং ধারা সংযুক্ত ক‍রার মূল উদ্দেশ্যগুলিই যে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে এবং উন্নতির প‍রবর্তে রাজ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতির ক্রমাবনতি ঘটেছে তা নিয়ে তো সংশয়ের কোনো অবকাশই নেই।  এহেন পরিস্থিতিতে ৩৭০ নং ধারা রদ করার জন্যে ক্ষোভ বা বিলাপ করার কোনো কারণ থাকতে পারে বলে আমার হয় না।
৩৭০ ও ৩৭১ নং ধারার নানা উপধারাগুলো সংবিধানে সংযুক্ত করা হয়েছিল কয়েকটি রাজ্যে বিশেষ পরিস্থিতিতে সাময়িক কালের জন্যেই। না, আমি এটাও সমীচীন মনে করিনা যে, বিশেষ কয়েকটি রাজ্য আজীবন সেই বিশেষ ক্ষমতা ও সুযোগগুলি অনন্তকাল ভোগ করতে থাকবে। কারণ, এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো দুর্বল বৈ সবল হতেই পারেনা। জম্মু-কাশ্মীরকে ৩৭০ নং দেওয়ার ফল যে ভালো হয় নি তা তো দিবালোকের মতন স্পষ্ট। অন্যান্য যে সব জায়গায় ঐ রকম বিশেষ ক্ষমতা ও সুযোগ দিয়েও যে কাজের কাজ কিছু হয় নি তা ঐ জায়গাগুলির দিকে চোখ ঘোরালেই বোঝা যায়। তাই ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা রদ করার জন্যে যারা গেল গেল রব তুলেছে তাদের সঙ্গে কন্ঠ মেলানোর প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। এবং এর পাশাপাশি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাদেরও তীব্র নিন্দা করছি যারা ৩৭১ নং ধারা ও তার উপধারাগুলি নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে বসে রয়েছে।
৩৭০ ও ৩৫এ নং ধারা দু'টি বিলোপে আমার আপত্তি নেই তো বটেই, বরং বিলোপই চাই। কিন্তু ভারত সরকার যে উদ্দেশ্যে ও যে পদ্ধতিতে ধারা দু'টা বিলোপ করেছে তার তীব্র প্রতিবাদ করছি। কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না জম্মু-কাশ্মীরকে দ্বিখন্ডিত করে তার রাজ্যের মর্যাদা (status of state) হরণ করার পদক্ষেপকে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একই সঙ্গে ঘোষণা দিয়েছেন যে ৩৭১ নং ধারাগুলো (৩৭১এ থেকে ৩৭১জে ধারাগুলো) রদ ক‍রা হবে না। তাঁর এই ঘোষণায় কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশ্য ও মনোভাব নিয়ে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী মানুষদের মনে গভীর সন্দেহ তৈরি হয়েছে। সন্দেহ - এক. জম্মু-কাশ্মীর ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য বলেই কি ৩৭০ নং ধারা বাতিল করা হলো? সন্দেহ - দুই. রাজ্যটিকে দু'টুকরো করা হলো কি একমাত্র বৌদ্ধ অধ্যুষিত ক্ষুদ্র ভুখন্ড লাদাখকে হিন্দুত্ববাদীদের হাতে তুলে দেবার জন্যে? যা করা হয়েছে তা নাকি জম্মু-কাশ্মীরকে সন্ত্রাসমুক্ত করার জন্যে আর জম্মু-কাশ্মীরের বিকাশের জন্যে! এসব ভালো ভালো সুন্দর সুন্দর কথা বলে কি কেন্দ্রীয় সরকার ও বিজেপি যদি মনে করে যে তাদের উদ্দেশ্য ও মনোভাব সম্পর্কে মানুষকে ধোঁকা দিতে পারবে তবে বলবো যে তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছে।
যেভাবে আচমকা কেন্দ্রীয় সরকার ৩৭০ ও ৩৫এ নং ধারা রদ করে জম্মু-কাশ্মীরকে দ্বিখন্ডিত করেছে তাতে গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই। কার্যত সংসদের দু'টি কক্ষকে ফাঁকি দিয়েই ঐ ধারা দুটি রদ এবং রাজ্যটিকে দুটি অংশে বিভাজিত করার বিলটি পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছে। এবং অস্বাভাবিক তৎপরতায় ও দ্রুততায় বিলটিতে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে বিলটিকে আইনে পরিণত করা হয়েছে। সংবিধানের দু দুটো ধারা বাতিল করা, এবং একই সঙ্গে কোনো একটি রাজ্যকে দ্বিখন্ডিত করে তার রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নেওয়া একটা মস্তবড় পদক্ষেপ। এটা আমাদের দেশে একটি বেনজির ঘটনাও বটে। বস্তুত কোনো গণতান্ত্রিক দেশে এমনটা যে হতে পারে তা ভাবাই যায় না।  সংবিধান থেকে কোনো ধারা বাতিল করতে হলে সংসদকে তা অনেক আগেই অবহিত করা  এবং সেখানে দীর্ঘ সময় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা একান্ত আবশ্যক যাতে সাংসদগণ তাদের মূল্যবান মতামত সংসদ কক্ষে রাখতে পারেন। এমনকি এ রকম বিষয়ে সংসদের বাইরেও আলোচনা করা দরকার যাতে সংসদে যাদের প্রতিনিধি নেই তারাও সরকারের কাছে তাদের মতামত জ্ঞাপন করতে পারে। আর কোনো রাজ্যকে ভেঙে দু'টুকরো করতে হলে শুধু সংসদের নয় সে রাজ্যের আইনসভাতেও ব্যাপক আলোচনা করা, সে রাজ্যের জনগণের মতামত জানা জরুরী। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এর বিকল্প নেই। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এতো বড়ো একটি কর্মকান্ড সম্পন্ন করে মাত্র দুদিনে‌। একদিন নামমাত্র আলোচনা করা হয়েছে লোকসভায় এবং একদিন রাজ্যসভায়। এভাবেই বিলটি তড়িঘড়ি সংসদে পাস করিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিলটি সংসদে উত্থাপন করাও হয়েছে প্রায় অকস্মাৎই। কোনো বিল সংসদে আনার যথেষ্ট আগে সংসদদের আগাম নোটিশ দেওয়ার যে রীতি চালু আছে সে রীতিটি সচেতনভাবেই লঙ্ঘন করা হয়েছে। ফলে অনেক সদস্যই সেদিন সংসদে উপস্থিত থাকতে পারেন নি। আসলে সরকার তো চেয়েই ছিল সাংসদদের কম উপস্থিতি যা সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর।
এর আগে ভারতের অনেক রাজ্যকেই ভাঙা হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের বিধানসভায় দিনের পর দিন ব্যাপক আলোচনা করা হয়েছে, বিধানসভার বাইরেও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মতামত নেওয়া হয়েছে, সংসদেও দীর্ঘ সময় ধরে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। রাজ্য পুনর্গঠনের এটাই তো সংসদীয় গণতান্ত্রিক রীতি ও পদ্ধতি। কেন্দ্রীয় সরকার সেই রীতি ও পদ্ধতিকে নস্যাৎ করেছে, পদদলিত করেছে। এটা আমাদের দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষ অশনিসংকেত।
৩৭০ নং ধারা গ্রহণ বা বর্জন করার জন্য কি কি করণীয় সে বিষয়ে ভারত সরকার এবং জম্মু-কাশ্মীরের প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। সে চুক্তিটিও ভঙ্গ করেছে সরকার। উক্ত চুক্তিতে ৩৭০ নং ধারা গ্রহণ কিংবা বর্জন করার সমস্ত ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছিল জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভা এবং সে রাজ্যের বিশিষ্ট মানুষদের নিয়ে তৈরি গণপরিষদের উপর। বলা বাহুল্য যে বিধানসভা ও গণপরিষদে গৃহীত হবার পরই ৩৭০ ধারাটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ভারত সরকার ও জম্মু-কাশ্মীরের প্রতিনিধিদলের মধ্যে সম্পাদিত হওয়া চুক্তি অনুসারে ঐ রাজ্যের বিধানসভা ও গণপরিষদ সেটি গ্রহণ না করে বর্জন ক‍রতেও পারতো। অথচ এমন একটা সময়ে আচমকা এই ধারাটি বাতিল করা হলো যখন সেখানে বিধানসভা ভেঙে দেওয়ার পর রাজ্যপালের শাসন তথা রাষ্ট্রপতির শাসন তথা বকলমে কেন্দ্রীয় সরকারের শাসন জারি রয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে কোনো রাজ্যের জন্যে চালু করা বিশেষ আইন রদ করা অসমীচীন। অসমীচীন দুদিক থেকেই। কী ভারত সরকার ও জম্মু-কাশ্মীরের প্রতিনিধিদের মধ্যে হওয়া সম্পাদিত চুক্তি অনুসারে, কী ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতি ও নীতি অনুসারে, উভয় দিক থেকেই রাজ্যের জনপ্রতিনিধি ও জনগণকে অন্ধকারে রেখে রাজ্যের পুনর্গঠন করা হয়েছে যা সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক। কেন্দ্রীয় সরকার তথাপি এই বিতর্কিত কাজটিই সম্পন্ন করে বসলো। এ কাজ করে কেন্দ্রীয় সরকার শুধু গণতন্ত্রের রীতিনীতিকেই নগ্নভাবে লঙ্ঘন করে নি, প্রশ্ন উঠেছে সংবিধানকেও লঙ্ঘন করেছে কী না তা নিয়েও। অবশ্য এ বিষয়ে চূড়ান্ত কথা বলবে সর্বোচ্চ আদালত।
৫ই আগষ্ট জম্মু-কাশ্মীরকে কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। তার ২-৩ দিন আগে থেকেই কেন্দ্রীয় সরকার গোটা রাজ্যটিকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। ১৪৪ ধারা ও কারফিউ দিয়ে গোটা রাজ্যটিকে মুড়ে ফেলা হয়েছে। রাস্তাঘাট সব ফাঁকা, চারিদিক সুনসান। সেনা-আধাসেনার বুটের শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। মানুষের রুটিরুজি, শিক্ষা, চিকিৎসা ও স্বাভাবিক জীবন স্তব্ধ। শত প্রয়োজনেও মানুষ ঘরের বাইরে বের হতে সাহস করছে না, রাজ্যের বাইরে যেতে পারছে না, যারা বাইরে আছে তারা ঘরে ফিরতে পারছে না। গোটা রাজ্যে ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবস্থাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার গোটা উপত্যকাটিকে কার্যত  কারাগার বানিয়ে ফেলেছে। এসব করা হচ্ছে নাকি জম্মু-কাশ্মীরকে সন্ত্রাসমুক্ত করার জন্যে, রাজ্যের মানুষের বিকাশ ও উন্নতি করার জন্যে! বটে!
সন্ত্রাস মুছে দেওয়া হবে মানুষকে সঙ্গে না নিয়েই? সন্ত্রাস মুছে দেওয়াটা আসলে বাহানা, আসল উদ্দেশ্য হলো গণতন্ত্র মুছে দেওয়া এবং মুসলিমদের হীনবল করা ও কোনঠাসা করা।
                            শেষ


[বি:দ্র:- ৫ই আগষ্ট যেদিন ৩৭০ নং ধারা রদ এবং জম্মু-কাশ্মীরকে দু'টুকরো করা হয় সেদিন খুব সম্ভবত ওড়িশার বেরহামপুর শহরে ছিলাম। খবরটি জানার সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকে আমার প্রতিক্রিয়া পোস্ট করি। সেই পোস্ট দেখে একটি বাংলা অনলাইন পোর্টালের (যে কাগজে মাঝে মাঝে লিখি) কর্ণধার ঐ  বিষয়ে একটি লেখা পাঠাতে বলেন। ওড়িশা থেকে বাড়ি ফিরে দ্রুত এই লেখাটি লিখে ফেলি। লিখতে লিখতেই মনে হয়েছিল লেখাটি সম্পাদকের পছন্দ হয়তো হবে না। সেটা তাঁকে জানিয়েছিলামও। তবু তিনি লেখাটা পাঠাতে বলেন। যথারীতি পাঠিয়েও দি। কিন্তু আমার আশঙ্কাটাই সত্যি প্রমাণিত হয়। তিনি লেখাটা ছাপান নি। এটা হতেই পারে, সব লেখা ছাপানো নানা কারণে সম্পাদকের হয় না। কিন্তু আশা করেছিলাম যে আমাকে জানিয়ে দেওয়া হবে যে লেখাটা ছাপানো হবে না। লেখাটা ছাপানো হচ্ছে না যখন বুঝলাম তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তারপর আমি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে কাহিল হয়ে পড়ি। এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে পারিনি। তবুও কষ্ট করে লেখাটি আমার ব্লগে আপলোড করবার সিদ্ধান্ত নি‌। তাই এত গুরুত্বপূর্ণ লেখাটি ব্লগে আপলোড করতে দু'মাস বিলম্ব হলো।]




Wednesday, January 16, 2019

বিজেপি সরকারের তিন তালাক বিরোধী বিল মুসলিম স্বার্থ বিরোধী যারা বলছে তারা মিথ্যাচার করছে

সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ সহ অর্ধেক মুসলিম বিশ্ব তিন তালাক আইনটি কবেই তালাক দিয়ে বসে আছে। ‌তারা তার পরিবর্তে প্রণয়ন করেছে ভিন্ন তালাক আইন। তাদের প্রণীত তালাক আইনগুলি আলাদা হলেও তাতে দুটি বিষয়ে অভিন্নতা রয়েছে। তা হলো এ রকম, স্বামী ও স্ত্রী উভয়কেই তালাক দেবার অধিকার দেওয়া হয়েছে এবং আদালতের বাইরে সবরকমের তালাককে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সৌদি আরব তো খুব সম্প্রতি তালাক আইনে নারীর অনুকূলে আর একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী অনুমোদন করেছে। এর ফলে স্ত্রীকে তালাক দেবার পূর্বে তাকে সে কথা মেসেজ করে জানাতে হবে। এটা এ জন্য করা হয়েছে যাতে স্ত্রী আদালতে তালাক প‍রবর্তী সুযোগ-সুবিধার দাবি জানাতে পারে। প্রধান প্রধান মুসলিম দেশগুলো সহ অর্ধেক মুসলিম বিশ্বই এটা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে যে নারীর প্রতি অন্যায়, অবিচার ও বঞ্চনার অবসান এবং নারীর ক্ষমতায়নকে বাস্তবায়িত করতে হলে তিন তালাক আইনটি আমূল পাল্টানো কিংবা সম্পূর্ণ বর্জন করা আবশ্যক। তাদের এই উপলব্ধি ও তদনুযায়ী পদক্ষেপ করা কুর্ণিশ করার মতো কাজ।
মুসলিম দেশগুলো তাদের ধর্মীয় আবেগের উপর নারী ও দেশের স্বার্থকে স্থাপন করে শরিয়া তালাক অইনকে তালাক দিতে পেরেছে। এটা মোটেও সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু আমাদের পক্ষে কাজটা ক‍রা অনেক সহজ ছিল। তবু স্বাধীনতার সাত দশক পার হওয়ার পরেও আমরা এ কাজটি আজও করতে পারলাম না। কংগ্রেস দল দাবি করে যে তারা ধর্মনিরপেক্ষ দল এবং ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। এরাই দীর্ঘ সময় দেশ শাসন করেছে। তথাপি তারা তিন তালাক আইনটি ব‍র্জন বা সংশোধন করার কোনো উদ‍্যোগই গ্রহণ করেনি। উল্টে বিজেপির মোদি সরকার যখন সেই কাজটি করতে উদ্যোগী হয়েছে ও পদক্ষেপ করছে তখনই তারা সেই পদক্ষেপকে ব্যর্থ করতে মরিয়া ভূমিকা পালন করছে। গত বছর মোদি সরকার সংসদে তিন তালাক বিরোধী বিল সংসদে পাশ করিয়েছে, কিন্তু রাজ্যসভায় সেটি আটকে যায়। কারণ রাজ্যসভায় বিরোধী পক্ষ সংখ্যাগরিষ্ঠ। সেখানে এই বিলটি আটকে দিতে প্রধান ভূমিকা পালন করে কংগ্রেস দল। ফলে ঐতিহাসিক এই বিলটি শেষ পর্যন্ত আইনের স্বীকৃতি পায়নি। মোদি সরকার গত বছরেই একেবারে অন্তিম লগ্নে আরেকবার এই বিলটিই লোকসভায় পাশ করিয়ে রাজ্যসভায় পেশ করতে উদ্যোগী হয়। কিন্তু গোটা বিরোধী পক্ষ পুনরায় চীনের প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। এক্ষেত্রেও কংগ্রেস দলই বিলের বিরুদ্ধে গোটা বিরোধী পক্ষকে ঐক্যবদ্ধ করতে প্রধান ভূমিকা পালন করে। কংগ্রেসের এই ন্যাক্কারজনক ভূমিকায় নগ্নভাবে সঙ্গত দিয়েছে দুই কম্যুনিস্ট পার্টি এবং অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি। কী আশ্চর্য! এই দলগুলো নাকি ধর্মনিরপেক্ষ দল! এরা নাকি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ও ধর্মনিরপেক্ষ দেশ গড়তে অঙ্গীকারবদ্ধ! এরা নাকি নারী-পুরুষের সমানাধিকারে বিশ্বাসী!
কংগ্রেস দল ও দুই কম্যুনিস্ট পার্টি সহ বিরোধী দলগুলো তিন তালাক বিরোধী বিল আটকাতে যা যা বলছে সেগুলো সবই হয় অজুহাত, না হয় মিথ্যা। সেই সমস্ত অজুহাত ও মিথ্যাচারগুলো ধরে ধরে আলোচনা করার অবকাশ এখানে নেই। এখানে মাত্র একটি অজুহাত ও একটি মিথ্যাচার নিয়ে আলোচনা করতে চেষ্টা করবো। ওরা যে অজুহাতগুলি খাড়া করার চেষ্টা করছে তার মধ্যে একটি হলো, তিন তালাককে নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ করতে চাওয়ার পেছনে বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদীর নিশ্চয় কোনো দূরভিসন্ধি রয়েছে। আর যে মিথ্যাচারগুলি করছে তার মধ্যে একটি হলো এই যে,  তিন তালাক বিরোধী বিলটি আইনে রূপান্তরিত হলে মুসলিম নারীর স্বার্থ বিপন্ন হবে।
প্রথমে আলোচনা করা যাক অজুহাত প্রসঙ্গে। তিন তালাক বেআইনি করার পশ্চাতে বিজেপির কী দূরভিসন্ধি আছে তা তারা কেউই খোলসা করছেন না। অপরদিকে বিজেপি কিন্তু দাবি করছে যে মুসলিম নারীদের ন্যায় বিচার পাইয়ে দিতেই তারা তিন তালাক বাতিল করতে চায়। এটা কারো কাছে অজানা নয় যে বিজেপি একটি হিন্দু সাম্প্রদায়িক দল। সুতরাং এই দলটি নারীদের ন্যায় বিচার দিতে চায় এ দাবি বিশ্বাস করা সত্যিই কঠিন। সেজন্য কংগ্রেস ও বিরোধী পক্ষের দলগুলো যখন বলে যে তিন তালাক নিষিদ্ধ করার পেছনে বিজেপির কোনো দূরভিসন্ধি আছে তখন সে কথাটাই আপাত দৃষ্টিতে সত্যি ও সঠিক বলে মনে হয়। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে আপাত দৃষ্টিতে যেটা সত্যি বলে মনে হয় সেটা সব সময় সত্যি হয় না। যেমন আপাত দৃষ্টিতে সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে বলে মনে হলেও প্রকৃত সত্যটি ঠিক তার বিপরীত। বিজেপির তিন তালাক আইন নিষিদ্ধ করতে চাওয়া নিয়ে বিরোধী পক্ষের তোলা অভিযোগটি ঠিক সে রকমই। কোনো দূরভিসন্ধির বশবর্তী হয়ে বিজেপি তিন তালাক নিষিদ্ধ করতে চায়ছে এ অভিযোগটা একেবারেই সত্যি নয়। এ অভিযোগটি যে মোটেও সত্যি নয় তার বড় প্রমাণ হলো প্রধান প্রধান মুসলিম দেশগুলো যারা তিন তালাক আইনটি হয় বাতিল করেছে, না হয় আইনটি আমূল সংশোধন করেছে। তিন তালাক আইনটি বাতিল করতে চাওয়ার পেছনে বিজেপির দূরভিসন্ধির অভিযোগ তোলা যে স্রেফ বাহানা তার আর একটি বড়ো প্রমাণ হলো এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের রায়। প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে, সুপ্রিম কোর্ট তালাকপ্রাপ্ত কয়েকজন মুসলিম নারীর আবেদনের ভিত্তিতে তাৎক্ষণিক তিন তালাককে সম্পূর্ণ অসাংবিধনিক আখ্যা দেয় এবং নিষিদ্ধ করে। সেই রায়েই সুপ্রিম কোর্ট ভারত সরকারকে উক্ত রায়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ একটি আইন প্রণয়ন করারও নির্দেশ প্রদান করে।
এবার আসা যাক উপরে উল্লেখিত বিরোধী পক্ষের মিথ্যাচার প্রসঙ্গে। বিরোধীরা বলছে যে বিজেপি সরকারের আনা তিন তালাক বিরোধী বিলটি আইনে পরিণত হলে মুসলিম নারীর স্বার্থ বিপন্ন হবে। বিরোধীদের এই অভিযোগটি নগ্ন মিথ্যাচার ও প্রতারণার জঘন্য নিদর্শন বৈ নয়। এটি যে একটি মিথ্যাচার ও প্রতারণা ছাড়া কিছু নয় তা শরিয়া তিন তালাক আইনে চোখ রাখলে স্পষ্ট বোঝা যায়। তাই এবার শরিয়া তিন তালাক আইন কী বলছে তার প্রতি একটু কান পাতা যাক। এই আইনের প্রধান প্রধান কথাগুলি হলো, এক). স্পষ্ট বাক্যে অথবা পরোক্ষ বাক্যে অথবা ইশারা - ইঙ্গিতে অথবা লিখিতভাবে তালাক দিলে তা তৎক্ষণাৎ কার্যকর হবে। দুই). মত্ত অবস্থায় তালাক দিলেও তা তৎক্ষণাৎ কার্যকর হবে। তিন). তালাক কার্যকর হবার সঙ্গে সঙ্গে বিবাহ - বন্ধন ছিন্ন হবে এবং স্বামী তাকে ফিরিয়ে নিতে পারবে না। চার). স্ত্রীকে তালাক দিলে খোরপোষ পাবার অধিকার রোহিত হয়ে যাবে। পাঁঁচ). স্ত্রী স্বামীকে তালাক দিতে পারবে না। ছয়). স্ত্রী তালাক শরিয়া আদালতে তালাক চায়তে পারবে যদি ক). স্বামী সহবাসে অক্ষম হয়, অথবা খ). স্বামী উন্মাদ হয়, অথবা গ). চার বছর নিরুদ্দেশ থাকে। এসব ক্ষেত্রে স্ত্রী শরিয়া আদালতে তালাকের আবেদন করতে পারে মাত্র যা আদালতে নামঞ্জুরও (অননুমোদিতও) হতে পারে।
এই হলো অতি সংক্ষেপে শরিয়া তালাক আইন যার মতো ক্ষতিকর নারীবিরোধী আইন খুবই কমই আছে সারা বিশ্বে। এই আইনটিকে একট অসভ্য ও বর্বর কালা আইন বললেও কম বলা হয়। আর এই আইনটিকে রদ করলেই নাকি মুসলিম নারীর অকল্যাণ বৈ কল্যাণ হবে না! এই কথা যারা বলছে বলছে তারা প্রথম শ্রেণির ভণ্ড, প্রতারক ও মিথ্যেবাদী। এই মিথ্যেবাদীর দল প্রশ্ন তুলছে যে, তিন তালাক দেওয়ায় স্বামীর যদি কারাবাস হয় তবে স্ত্রীকে ভরণপোষণ কে দেবে? তাই তারা এই ধূয়া তুলে বলছে যে, মোদি সরকারের তিন তালাকবিরোধী বিলটি আইনে পরিণত হলে মুসলিম নারীদের সর্বনাশ হবে। 
বিরোধী পক্ষের এই কথাটি আপাত দৃষ্টিতে বিশ্বাসযোগ্য ও যুক্তিপূর্ণ মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এটা একটা জঘন্য মিথ্যাচার বৈ নয়। কারণ, শরিয়তি তিন তালাক আইনে তালাকপ্রাপ্ত আইনে স্ত্রীদের ভরণপোষণ পাবার কোনো অধিকারই নেই। এই আইন অনুযায়ী একজন স্বামী যদি তার স্রীকে তালাক প্রদান করে তবে সে স্ত্রীকে খোরপোষ দিতে বাধ্য নয়, এমনকি সে বিত্তবানও হলেও নয়। এজন্যেই মুসলিম সমাজে কেউই তার স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার পর ভরণপোষণ প্রদান করে না। এটাই বিশ্বব্যাপী মুসলিম সমাজের একটি সাধারণ সংস্কৃতি। অথচ বিরোধী পক্ষ বলছে যে, তালাক দেবার পর স্বামীকে জেলে পাঠানো চলবে না যাতে তার কাছ থেকে স্ত্রীর খোরপোষ আদায় করা যায়। এ কথা বলে তারা মুসলিম নারীর সাথে ডাহা প্রতারণা করছেন। নির্লজ্জ প্রতারণা। সুতরাং কোনো সংশয় নেই যে, শরিয়তি তাৎক্ষণিক তিন তালাক আইন শুধু বেআইনী বা নিষিদ্ধ করাই যথেষ্ট নয়, তিন তালাক প্রদানকে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য করাও সমান জরুরী। আইনে এরূপ সংস্থান থাকলে তবেই পুরুষরা খেয়ালের বশে কিংবা হীন স্বার্থ পূরণ করার জন্যে স্ত্রীকে তালাক দিতে ভয় পাবে।
মুসলিম ধর্মগুরুদের সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়ে বিরোধী পক্ষ বলছে যে, তিন তালাক আইন নিষিদ্ধ করা জরুরী নয়। কারণ, মুসলিম সমাজে তাৎক্ষণিক তালাক প্রদানের যে ঘটনাগুলি ঘটে সেগুলোর নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রেই আইনের অপব্যবহার ঘটে থাকে। যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেয়া যায় যে, মুসলিম ধর্মগুরুদের বক্তব্য বা দাবি যথার্থ, তাহলে প্রশ্ন, কেনো প্রায় দেড়শ' বছর ধরে এভাবে মুসলিম পুরুষরা আইনের অপব্যবহার করে চলেছে এবং এর প্রতিকারের উপায় কি? না, শরিয়তি আইনে এর প্রতিকার নেই। কারণ, শরিয়ত পুরুষকে তালাক দেওয়ার অবাধ ক্ষমতা প্রদান করেছে। আর ব্যক্তি মানুষ কিংবা সমাজ কিংবা রাষ্ট্র যার হাতেই অবাধ ক্ষমতা থাক না কেনো, সে ক্ষমতার অপব্যবহার হবেই যা রোধ করা কখনোই সম্ভব নয়। বিশ্বের সর্বকালের ইতিহাস এই সাক্ষ্যই দেয়। সুতরাং মুসলিম পুরুষ যাতে শরিয়তি তালাক আইনের অপব্যবহার না করতে পারে তারজন্যেও তাৎক্ষণিক তালাক আইন রদ করা একান্তই জরুরী, এর কোনো বিকল্প নেই।
শরিয়তি তালাক আইন নিষিদ্ধ করা এবং এর বিকল্প একটি আইন প্রণয়ন করা আর একটি কারণে জরুরী। তা হলো এই যে, শরিয়তি আইনে মুসলিম নারীর তালাক দেবার অধিকার নেই। এ কথা মানছেন আলেম সমাজের একাংশও। গোঁড়া মুসলিমরা অবশ্য এ কথা মানতে নারাজ। তাদের বক্তব্য  ইসলামে নারীকে তালাক দেবার অধিকার দিয়েছে, সেটা হলো খুলা তালাক। এই খুলা তালাক প্রদানের অধিকার আসলে নামেই অধিকার, প্রকৃত অধিকার নয়। কারণ, এই আইন অনুসারে স্ত্রী স্বামীর অনুমোদন ব্যতীত খুলা তালাকের অধিকার প্রয়োগ করতে পারে না। সুতরাং আলেম সমাজের একাংশ মানছেন যে, খুলা তালাক নারীর জন্যে যথেষ্ট নয়। খুলা তালাক আসলে তাই নারীর সঙ্গে এক প্রকার তামাশা বৈ নয়। 
শুধু ইসলামই মুসলিম নারীর সঙ্গে তামাশা করে নি, কংগ্রেস ও কম্যুনিস্টরাও মুসিলিম নারীর সঙ্গে সমানে তামাশা করে চলেছে। এ তামাশা তারা যে শুধু মোদি সরকারের আনা তিন তালাক বিরোধী বিলের ক্ষেত্রেই করছে এমনটা নয়, তামাশা করে চলেছে মুসলিম নারীর সঙ্গে তাদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই। ১৯৮৫ সালে সুপ্রীম কোর্ট শাহবানু মামলায় রায় দিয়ে বলেছিলো যে, উপার্জনহীন অসহায় মুসলিম তালাকপ্রাপ্ত নারীর খোরপোষ পাবার অধিকার রয়েছে তার প্রাক্তন স্বামীর নিকট থেকে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সংসদে আইন পাশ করিয়ে সুপ্রীম কোর্টের সেই রায়টি খারিজ করে দেন। সেই আইনটিও প্রণয়ন করা হয় মুসলিম স্বার্থ রক্ষা করার নামে। সেই কুখ্যাত আইনটিকে সমস্ত রাজনৈতিক দলই দু'হাত তুলে সমর্থন জানিয়েছিলো। মুসলিম নারীর সঙ্গে এভাবে বহু তামাশা করেছে কংগ্রেস, কম্যুনিস্ট পার্টি ও অন্যান্য পাতি বুর্জোয়া দলগুলি যারা নিজেদের মুসলিম দরদি ও ধর্মনিরপেক্ষ দল বলে দাবি করে। এ দেশের মুসলিম নারী তাদের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলির এরূপ মেকি দরদ ও তামাশা দেখে দেখে প্রচণ্ড ক্লান্ত, বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ। তাই তারা আর 'খুলা তালাক'-এর তামাশা দেখতে চায় না। তারা চাই তালাক দেবার সত্যিকারের অধিকার ও ক্ষমতা, চাই শরিয়তি তালাক আইনের চির অবসান, এবং চায় সম্পূর্ণ একটি নতুন তালাক আইন যেখানে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার থাকবে। চায় এমন একটা তালাক আইন যার ফলে স্বামী অন্যায়ভাবে তালাক দিলে আদালতে তা খারিজ হয়ে যাবে, অন্যায় তালাক দেবার জন্যে তাকে কারাভোগ করতে হবে এবং স্ত্রীর খোরপোষও তাকে বহন করতে হবে। 
পরিশেষে বলতে চাই নির্দ্বিধায় যে, বিজেপি সরকার যে উদ্দেশ্যেই শরিয়তি তিন তালাক আইনটি বাতিল ও বেআইনি করতে বারবার উদ্যোগি হোক না কেনো, উদ্যোগটি কিন্তু নিঃসন্দেহে অতি শুভ ও ভীষণ প্রয়োজনীয়। এই উদ্যোগটি বাস্তবায়িত হলে শুধু মুসলিম নারীই উপকৃত ও লাভবান হতো না, লাভবান হতো গোটা মুসলিম সমাজই। এটাও স্পষ্ট যে, এই উদ্যোগটি অসফলই থেকে যাবে, কারণ ভোট-ভিখারি বিরোধী পক্ষ এখনও রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। এহেন পরিস্থিতিতে মুসলিম সমাজের, বিশেষ করে মুসলিম নারী সমাজের কর্তব্য হচ্ছে, শরিয়তি তালাক আইন বাতিলের দাবিতে যে আওয়াজ উঠেছে দেশজুড়ে তা ভবিষ্যতে যদি কখনোই থেমে না যায় সে বিষয়ে সতর্ক থাকা এবং নারী-পুরুষের সমানাধাইকারের ভিত্তিতে একটি বিকল্প তালাক আইন প্রণয়নের আন্দোলনকে গণয়ান্দোলনে উন্নীত করতে অবিরাম প্রয়াস চালিয়ে যাওয়া।
(এই লেখা হয় ২০১৮ এর শেষের দিকে না হয় ২০১৯ এর একেবারে প্রথম দিকে মদি সরকারের শেষ শীতকালীন অধিবেশন চলাকালীন সময়ে। লেখাটি লিখি বাংলা পোর্টাল 'বিতর্ক' এর জন্যে। বিতর্ক লেখাটি ছাপে যথেষ্ট দেরিতে। আর তারও অনেক পরে এটা আমার ব্লগে আপলোড করি। ১৫/৩/১৯)  

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...