Thursday, July 23, 2020

জঙ্গি উৎপাদনকেন্দ্র খারিজি মাদ্রাসাগুলি নিষিদ্ধ করতে হবে

ছ’বছরের বিরতির পর জেএমবি-র নাম আবার আন্তর্জাতিক খবরের শিরনামে (বাংলাদেশ ও ভারতের খবরের কাগজে ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমে) ভেসে উঠলো। ২০১৪ সালে বর্ধমান শহরের খাগড়াগড়ে আমরা পরিচয় পায় জেএমবি কতো বড়ো ভয়ংকর একটা সন্ত্রাসবাদী সংগঠন তার। ওই বছরের ২রা অক্টোবর প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন আইইডি (ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) বিস্ফোরণ ঘটে খাগড়াগড়ের একটা বাড়িতে। প্রসঙ্গত বলি যে সাধারণত যুদ্ধক্ষেত্রে যেসব অতিশয় বিস্ফোরক রাসায়নিক মশলা ব্যবহার করা হয় সেসব দিয়ে ওই আইইডিগুলো বানানো হচ্ছিল। বিস্ফোরণস্থলেই দু’জন মারা গেলেও ওদের স্ত্রীরা বেঁচেছিল। তারা ধরা পড়ায় জানা যায় যে বিস্ফোরণের পেছনে জেএমবি রয়েছে। খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণ কাণ্ডের ছ’বছর পর গত ১৬ই জুলাই জেএমবি-র মহিলা শাখার প্রধানের পদে কর্মরত জেএমবি নেত্রী আয়েশা জন্নত মোহনা ধরা পড়ে ঢাকায় বাংলাদেশের পুলিশের সন্ত্রাস দমন শাখার হাতে। ফলে করোনা ভাইরাসকৃত বৈশ্বিক মহামারীর খবরকে পেছনে সরিয়ে দিয়ে জেএমবি পুনরায় খবরের কাগুজের শিরোনাম দখল করে নেয়। প্রসঙ্গত বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে জঙ্গি আয়েশা হলো পশ্চিমবঙ্গর একজন হিন্দু বালা। ওর পিতৃদত্ত নাম প্রজ্ঞা দেবনাথ। জেএমবি-র সংস্পর্শে এসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে তার নাম রাখা হয় আয়েশা জন্নত মোহনা। জেএমবিতে প্রজ্ঞার আর একট নাম রয়েছে - জান্নাতুত তাসনিম। সংক্ষেপে জেএমবি-র পরিচয় দেওয়া যাক। এর পুরো নাম হলো জামাআতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ। ১৯৯৮ সালে এর জন্ম বাংলাদেশে এবং এটি ওসামা বিন লাদেনের আল-কায়দা কতৃক অনুমোদিত। পরে বিশ্বত্রাস আইএস-এর সঙ্গেও এরা সম্পৃক্ত হয়। ভারতের জঙ্গি সংগঠন ইণ্ডিয়ান মুজাহিদ সহ আরও কিছু সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সাথে তাদের গাঁটছড়া রয়েছে। আর্থিক সহায়তা সহ সব রকমের মদত পায় এরা পাকিস্তান সরকার ও আইএসআই-এর কাছ থেকে। এদের মূল কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের মাটিতে হলেও সাংগঠনিক জাল (নেটওয়ার্ক) ও কর্মকাণ্ড দেশের বাইরেও বিস্তৃত। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে এরা খুবই সক্রিয়। পশ্চিমবঙ্গে ওরা ঘাঁটি বানিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা দখল করা ওদের মূল লক্ষ্য। কিন্রু সেখানেই থেমে থাকতে চায় না। পশ্চিমবঙ্গ দখল করে বৃহত্তর বাঙ্গালিস্তান তৈরি করাও ওদের পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ সরকার জেএমবিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তাতে হতোদ্যম না হয়ে এক দিনে গোটা দেশে ১৭ট জেলায় ৩৭৬টি জায়গায় ৫০০টি বোমা ফাটিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানায়। তারা নিজেদের আল্লাহ ও ইসলামের সৈনিক বলে দাবি করে এবং বাংলাদেশে ইসলামি রাষ্ট্র গড়া থেকে কোনো শক্তি তাদের নিরস্ত করতে পারবে না ঘোষণা দেয়। আরও ঘোষণা দেয় যে আল্লাহর সৃষ্ট ভূখণ্ডে আল্লাহর শাসন ছাড়া মানুষের তৈরি করা সংবিধানের শাসন চলতে পারে না। বর্তমানের জঙ্গি জেএমবি সংগঠনটি কিন্তু মূল জেএমবি নয়। এরা নব্য জেএমবি তথা নব্য জামাআতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ। সেখ আব্দুর রহমান এবং সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই সহ জেএমবি-র ছ’জন শীর্ষ নেতা বাংলাদেশের র্যাবের হাতে ধরা পড়ে ২০০৫ সালে। দু’জন সহকারি বিচারক সহ কয়েকজন সরকারি আধিকারিককে খুনের অভিযোগে ২০০৭ সালে তাদের ফাঁসী হয়। তারপর সংগঠনটির ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যায়। ফাঁসীতে নেতাদের মৃত্যু হলে তো আর মন্ত্রের (আদর্শের) মৃত্যু হয় না। তাই জেএমবি-র ছত্রভঙ্গ সদস্যরা পরে সংগঠনটির পুনর্জন্ম দেয় যেটা নব্য জেএমবি বলে পরিচিতি লাভ করে। বর্ধমানের খাগড়াগড়ের হোতা জেএমবি হলো সেই নব্য জেএমবি এবং ঢাকায় ধরা পড়া মহিলা জঙ্গি আয়েশা জন্নত মোহনা সেই নব্য জেএমবি-র একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। শীর্ষ নেতাদের হারিয়ে সাময়িকভাবে জেএমবি দুর্বল হয়ে গেলেও বাকি জঙ্গিরা সংগঠনটিকে পুনর্গঠন করে নব্য জেএমবি নামে আত্মপ্রকাশ করে ২০১৪ সালে। ২০১০ সাল থেকেই জেএমবি-এর অস্তিত্ব ও সক্রিয়তা চোখে পড়ে পশ্চিমবঙ্গে। নব্য জেএমবি যে পশ্চিমবঙ্গে ঘাঁটি তৈরি করে ফেলেছে সেটা টের পায় ২০১৪ সালেই খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণ কাণ্ডে। পশ্চিমবঙ্গরেও অনেক সদস্য রয়েছে জেএমবিতে সেটাও জানা যায় ওই বিস্ফোরণ কাণ্ডে এন.আই.এ (National Investigation Agency)-এর তদন্ত রিপোর্ট থেকে। নব্য জেএমবিতে যে নারী জঙ্গিদের জন্যে আলাদা শাখা রয়েছে সে তথ্যও ছিলো এন.আই.এ)-এর রিপোর্টে। মুসলিম জঙ্গি সংগঠনে নারী সদস্য থাকাটা নতুন কোনো ব্যাপার নয়। ইসলামের নবীর আমল থেকেই এটা হয়ে আসছে। আইএস (Islamic State)-এর যখন রমরমা অবস্থা তখন দেখেছি বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নারীরাও দলে দলে ইরাকে গিয়ে আইএস-এর পতাকা স্বেচ্ছায় হাতে তুলে নিয়েছে। উচ্চশিক্ষিত মুসলিম নারী-পুরুষদের একাংশের মধ্যে এই প্রবণতাটি পরিলক্ষিত হচ্ছে। এটা এ জম্যেই ঘটে যেহেতু ইসলাম ধর্মে নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে সকল মুসলমানের জন্যেই জিহাদ ফরজ (অবশ্যই পালনীয় কর্তব্য)। ইসলাম এও বলেছে যে জিহাদিরা বেহেস্তে (স্বর্গে) যাবে আর জিহাদে অংশ না নিয়েই যারা মারা যাবে তাদের দোজখের (নরকের) আগুনে অনন্তকাল পুড়তে হবে। তাই যুগে যুগে মুসলিম জঙ্গি সংগঠনে নারীদের উপস্থিতি দেখা যায়। স্বভাবতই মূল সংগঠনের অধীনে তাদের জন্যে পৃথক মহিলা শাখা থাকাটাও খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। নব্য জেএমবি কিন্তু আমাকে ভীষণভাবে বিষ্মিত করেছে অন্য দু’টি কারণে। তা হলো, প্রথমতঃ, ২০০৭ সালে শীর্ষ নেতাদের ফাঁসী হবার পর মাত্র সাত বছরের মধ্যেই বিধ্বস্ত ও ছন্নছাড়া সদস্যরা জেএমবিকে পুনর্গঠিত ও পুনরুজ্জীবিত করতে সক্ষম হয়েছে। এবং সক্ষম হয়েছে বিশ্বকে চমকে দেবার মতন বিরল একটি ঘটনা ঘটাতে। সেটা হলো, হিন্দু পরিবার থেকে একজন তরুণিকে সংগঠনের সদস্য করে তাকে সংগঠনের একজন আদর্শ ও যোগ্য নেত্রী হিসাবে গড়ে তুলতে। একজন বিধর্মী মেয়ের মস্তিষ্ক ধোলাই করে সংগঠনে নিয়ে আসা এবং তাকে পুরোদস্তুর জিহাদি আদর্শে গড়ে তুলে আপাদমস্তক জঙ্গি করে তোলার ঘটনা নিঃসন্দেহে বিশ্বকে চমকে দেওয়ার মতন ঘটনা। এটা আমাদেরকে যুগপৎ বিষ্ময়ে হতবাক ও উদ্বিগ্ন করে তোলার মতন ঘটনাও বটে। চাপ সৃষ্টি না করে কিংবা ভয় না দেখিয়ে কোনো কাফের কন্যাকে কট্টর ইসলামি আদর্শে দীক্ষিত করতে পারার ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে বেনজির ঘটনা কিনা জানা নেই, তবে এটা নিশ্চয়ই ইতিহাসের বিরল ঘটনার একটা। সদস্য সংগ্রহ করার জন্যে দরিদ্র হিন্দুরাও এখন ওদের নিশানায় প্রজ্ঞা দেবনাথকে সাফল্যের সাথে একজন জঙ্গিনেত্রী হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নব্য জেএমবি-র বিষ্ময়কর ও চমকপ্রদ সাফল্য আমাদের চিন্তা-ভাবনার জগতে একটা নতুন দিগন্ত খুলে দিলো। আমরা এতদিন পর্যন্ত দেখে এসেছি যে মুসলিম জঙ্গি সংগঠনগুলো মূলত জঙ্গি সদস্য সংগ্রহ করে খারিজি বা কওমি মাদ্রাসা থেকে এবং তাদের নিশানায় থাকে প্রধানত মুসলিম সম্প্রদায়ের দরিদ্র পরিবারগুলি। খারিজি/কওমি মাদ্রাসাগুলি সাধারণত আবাসিক হয় যেখানে পড়ুয়াদের কোনো খরচ লাগে না। সাধারণত দরিদ্র বাবা-মায়েরাই তাই তাদের সন্তানদের এইসব মাদ্রাসায় পাঠিয়ে থাকে। সেটা ততোটা ধর্মের মোহে নয় যতোটা অভাবের তাড়নায়, ছেলেটা অন্তত দু’বেলা দু’মুঠো খেতে তো পাবে। বাস্তবে তাই দেখা যায় যে, খারিজি মাদ্রাসাগুলিই মূলত জঙ্গি সংগঠনগুলিকে জঙ্গি সরবরাহ করে থাকে। এই ধরণের মাদ্রাসাগুলি শুধু জঙ্গি সরবারাহই করে না, মাদ্রাসাগুলিতে জঙ্গিদের জিহাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণও দেয়া হয়। খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কাণ্ডে এন.এই.এ (NIA) – এর তদন্তে রিপোর্টে তার প্রমাণও পাওয়া গেছে। পশ্চিমবঙ্গের কোন কোন খারিজি মাদ্রাসায় নব্য জেএমবি ঘাঁটি তৈরি করে জিহাদের প্রশিক্ষণও দিতো সেটাও জানা যায় উক্ত রিপোর্ট থেকে। খারিজি মাদ্রাসায় যে জিহাদের পাঠ ও প্রশিক্ষণও দেয়া হয় সে কথা অবশ্য সম্পূর্ণ অস্বীকার করে গণতন্ত্রের আলখাল্লা (মুখোশ) পড়া মুসলিম ধর্মগুরু ও বুদ্ধিজীবীরা। জেএমবি ও প্রজ্ঞার কথায় আবার ফিরে আসি। প্রজ্ঞার মুসলিম জঙ্গি হবার ঘটনা আমাদের সামনে এতদিনের যে অজানা দিকটার উন্মোচন করলো তা হলো, জঙ্গি সংগঠনগুলোর নিশানা শুধু আর মুসলিম সমাজের দরিদ্র পরিবারগুলোতেই আটকে নেই, তারা বিধর্মীদের হতদরিদ্র পরিবারগুলিকেও নিশানা করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে প্রজ্ঞা দেবনাথের জন্ম ও মানুষ হওয়া সে রকমই একটি অতি দরিদ্র পরিবারেই। প্রজ্ঞার বাবা দিনমজুরি করেন এবং মা বাড়িতে কাপড় সেলাই করে কোনো রকমে দিন গুজরান করেন। বাংলাদেশ পুলিশের কাছ থেকে আর একটা বিষ্ময়কর তথ্য পাওয়া গেছে। তা হলো, কলেজে পড়তে পড়তে নয়, প্রজ্ঞা জঙ্গি আদর্শে দীক্ষিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে স্কুলে ৯ম শ্রেণিতে পড়ার সময় ২০০৯ সালে। আর সে বাড়ি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে জঙ্গি শিবিরে চলে যায় ২০১৬ সালে। সেই সাত/আট বছর (২০০৯ থেকে ২০১৬) সে তার মুসলিম জঙ্গি পরিচয় গোপন রেখে সবার চোখে ধূলো দিয়ে হিন্দু হয়েই তার পরিবারের সঙ্গে থেকেছে এবং একজন হিন্দু মেয়ের মতনই সমস্ত রকম ধর্মাচারণ করেছে। জেএমবি-র সদস্য হওয়ার পর আর পাঁচজন নারী জঙ্গির মতন সেও একজন প্রবাসী বাংলাদেশি জঙ্গিকে বিয়ে করে। তার স্বামী ওমানে থাকে বিধায় তাদের বিয়ে হয় ফোনের মাধ্যমে। জেএমবির শিবিরে পাকাপাকিভাবে চলে যাবার পরও ফোনে সে তার পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো। ফোনেই তার মাকে সে একদিন জানায় যে সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে এবং একজন মুসলিম যুবককে বিয়েও করেছে। এশিয়া মহাদেশে কোনো পরিবার ও সমাজই কারও ধর্মান্তরিত হবার ঘটনা মেনে নেয় না। এমন ঘটনা চরম অন্যায় ও লজ্জাজনক ঘটনা বলে মনে করা হয়। তাই তার পরিবার তাদের লজ্জার কথা কখনো ফাঁস করে নি। প্রজ্ঞা ওরফে আয়েশা জন্নত মোহনা ওরফে জান্নাতুত তাসমিন বাংলাদেশ পুলিশের হাতে ধরা না পড়লে প্রজ্ঞার জঙ্গি হবার বিরলতম ঘটনা এবং নব্য জেএমবি যে তাদের সংগঠনের জাল বিস্তার করার কাজ পুনরায় পূর্ণ উদ্যমে শুরু করেছে সে খবর অজানাই থেকে যেতো। ২০১৬ থেকে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হবার আগে পর্যন্ত প্রজ্ঞা ওরফে আয়েশা বাংলাদেশ ও ভারতে যাতায়াত করে জঙ্গি ও অর্থ সংগ্রহ করার কাজ করেছে। অনলাইনের মাধ্যমেও সে জঙ্গি সংগ্রহের কাজ করতো। অনলাইনের মাধ্যমেই সেও জেএমবির সংস্পর্শে এসে ইসলামে দীক্ষা নিয়েছে। প্রজ্ঞা ওরফে আয়েশা খারিজি মাদ্রাসাগুলিতে নব্য জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেবার কাজের দায়িত্বও পালন করতো। জেএমবি-র মহিলা শাখার প্রধান আসমানি খাতুন পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর থেকে মহিলা শাখার প্রধানের দায়িত্ব এই প্রজ্ঞাই যোগ্যতা ও দক্ষতার সাথে পালন করেছে। বাংলাদেশ পুলিশ আয়েশাকে (প্রজ্ঞাকে) ধরতে পারলো, পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ পারলো না কেন? উপরের প্রশ্নটি নিঃসংশয়ে বৈধ প্রশ্ন। এক কথায় এর জবাব হলো – বাংলাদেশ সরকার চেয়েছে তাই পেরেছে আর পশ্চিমবঙ্গ সরকার চায় নি তাই পারে নি। বাংলাদেশ সরকার যে আন্তরিকভাবেই মুসলিম জঙ্গি কার্যকলাপ বন্ধ করতে চায় তার অজস্র দৃষ্টান্ত চোখের সামনে রয়েছে। অবশ্য যে দেশে যুক্তিবাদীদের নিরাপত্তা নেই এবং তাদের বেছে বেছে অবাধে হত্যা করা হয় সেই দেশই আবার মুসলিম জঙ্গিদের ঘাঁটিগুলি একটা করে গুঁড়িয়ে দিয়েছে, এটা অবাক করার মতনই ঘটনা। এটা কীভাবে সম্ভব তা আলোচনা করার অবকাশ এখানে নেই। এখানে শুধু একটু সংকেত বা ইঙ্গিত দেওয়া যেতে পারে। মুসলিম মৌলবাদীরা প্রধানত দু’ভাগে বিভক্ত যদিও বাস্তবে তারা বহু শাখা-উপশাখায় বিভক্ত। প্রধান দু’টি ভাগের এক ভাগ জিহাদ ও ইসলামি রাষ্ট্র স্থাপনে বিশ্বাস করে, আর এক দল অজঙ্গি যারা কেবল মুসলিম সমাজের শরিয়তিকরণ চায়। বাংলাদেশের প্রধানমন্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয় ভাগকে তাঁর পক্ষে টানতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে জঙ্গি মৌলবাদীরা ক্রমশ শক্তিহীন হয়ে পড়েছে। জঙ্গি দমনের ক্ষেত্রে এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েছেন হাসিনা এবং জঙ্গিদের দমন সহ তাদের ঘাঁটিগুলি ধ্বংস করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছেন। কিন্তু অজিঙ্গি মুসলিম মৌলবাদীদের কাছে টানার যেমন ইতিবাচক একটা দিক (জঙ্গি দমনে সাফল্য) রয়েছে তেমনি তার একটি নেতিবাচক দিকও রয়েছে। তা হলো, অজঙ্গি মৌলবাদীদের সঙ্গে আপোষ করতে হয়েছে এবং তার জন্যে তাঁকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। এতে তাঁর হয়তো আশু ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক ক্ষতি হয় নি, কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কারণ, হাসিনাকে মুসলিম মৌলবাদীদের কাছে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শকে বন্ধক দিতে হয়েছে। এ প্রসঙ্গ এখানেই থাক, কারণ এটা এই পরিসরে লেখার বিষয় নয়। ফিরে আসি আমাদের ও রাজ্যের প্রশ্নে। আমাদের দেশ ও রাজ্যে জঙ্গি মৌলবাদী ও অজঙ্গি মৌলবাদীদের পারষ্পরিক চমৎকার বোঝাপাড়া রয়েছে। ভয়ংকর কোনো জঙ্গি কার্যকলাপ যখন সামনে চলে আসে এবং প্রশাসন ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করে তখন জঙ্গিদের ত্রাতার ভূমিকায় আসরে অবতীর্ণ হয় অজঙ্গি মৌলবাদীরা। মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ধুয়া তুলে সরকার ও শাসকদলকে ভোটে হারিয়ে দেবার ভয় দেখায়। সরকার তখন সুর সুর করে লেজ গুটিয়ে ঘরে ঢুকে যায় এবং পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকাও আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায়। যদিও মুসলিম মৌলবাদীদের কথায় মুসলিমরা দল বেঁধে ভোট দেয় না, তবুও পাছে মুসলিমরা ক্ষুব্ধ হয় এই ভয়ে সরকার মুসলিম জঙ্গি কার্যকলাপগুলি দেখেও না দেখার ভান করে থাকে। বাম সরকারও এ রকম অন্যায় আপোষও অনেক ক্ষেত্রে করেছে।আর মমতা ব্যানার্জীর সরকারের তো এটাই নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর প্রতিদানও ষোলো আনায় বিশ আনা পায় তৃণমূল কংগ্রেস। প্রত্যেকটা ভোটে মুসলিম মৌলবাদীরা ঝাঁপিয়ে ভোট করে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে। এমনকি বাংলাদেশের মৌলবাদীরাও নির্বাচনের সময় শাসক দলের হয়ে কাজ করে – এ তথ্য দিয়েছিলো সিবিআই সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত করার সময়। খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কাণ্ডে এই সরকার জেএমবি জঙ্গিদের এবং তাদের চিহ্নিত প্রধান আশ্রয়স্থল খারিজি মাদ্রাসাগুলিকে আড়াল করতে কীভাবে নগ্ন প্রয়াস করেছিলো সেটাতো আমাদের সবার জানা। রাজ্য সরকারের এই আত্মঘাতী বিপজ্জনক আপোষকামী নীতির জন্যেই হিন্দু পরিবারের প্রজ্ঞা দেবনাথরা কার্যত বিনা বাধায় মুসলিম জঙ্গি হয়ে উঠতে পারে এবং জঙ্গি আয়েশারাও অবাধে তাদের জঙ্গি কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে পারে। জঙ্গি আয়েশারা বাংলাদেশে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে আর এ রাজ্যে ধরা পড়ে না। জঙ্গি উৎপাদনকারী খারিজি মাদ্রাসাগুলি নিষিদ্ধ করতেই হবে বদর যুদ্ধ (মুসলমান ও মক্কার কোরেশদের মধ্যে যুদ্ধ) ছিল প্রকৃত পক্ষে একটি অসম যুদ্ধ। কারণ প্রথম পক্ষে ছিলো মাত্র ৩১৩ জন সৈন্য, আর অপর পক্ষে ছিলো একহাজার। তবুও আশ্চর্যজনকভাবে প্রথম পক্ষই জিতে গিয়েছিলো। মুসলিমরা বিশ্বাস করে যে এটা সম্ভব হয়েছিলো কারণ আল্লাহ মুসলিমদের পক্ষে হাজার হাজার ফেরেশতা পাঠিয়েছিলো যুদ্ধ করার জন্যে। সে রকম জেএমবিও বিশ্বাস করে যে একদিন তারাও বাংলাদেশে ইসলামি রাষ্ট্র স্থাপন করতে পারবে এবং পারবে পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে বৃহৎ বাঙ্গালিস্তান গড়ে তুলতে পারবে। বিশ্বাস করে কারণ তারা মনে করে আল্লাহ তাদের সঙ্গে আছে। কোনোদিনই ওদের এই অবাস্তব স্বপ্ন পূরণ হবে না ঠিকই, কিন্তু মানুষের জীবনহানি ও ধন-সম্পদ ধ্বংস করার এবং মানবজাতির মধ্যে বিভেদের বিষ ঢুকিয়ে দেবার মতন যথেষ্ট ক্ষমতা ওদের আছে তাতো অনস্বীকার্য। তাই তাদের দিক থেকে কোনো দায়িত্বশীল সরকারই চোখ ঘুরিয়ে রাখতে পারে না। প্রত্যেকটি সরকারেরই প্রধান কর্তব্য হলো দেশ ও নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রদান করাকে দলীয় সংকীর্ণ স্বার্থের উপরে স্থাপন করা। সমগ্র মানবজাতি ও মানবসভ্যতার স্বার্থে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সমস্ত সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো জঙ্গি সংগঠন ও জঙ্গি কার্যকলাপ নির্মূল করা একান্ত আবশ্যক। আর তা করতে হলে সেই সরকারকে যেমন জঙ্গিদের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার মনোভাব নিয়ে কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপ করতে হবে, তেমনি তারই পাশাপাশি একই সঙ্গে জঙ্গি সংগঠনগুলির সাপ্লাই লাইনটাকে সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে অর্থাৎ জঙ্গি উৎপাদনকারী খারিজি মাদ্রাসাগুলিকেও চিরতরে নিষিদ্ধ করতে হবে। তা না হলে কোনোদিনই জঙ্গি কার্যকলাপ বন্ধ করা যাবে না। সমাপ্ত (২১.০৭.২০)

Wednesday, July 8, 2020

ঈশ্বরবিশ্বাসীরা বিজ্ঞানের কাঁধে চেপে বিজ্ঞানের ওপরেই ছড়ি ঘোরাতে চায়


বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে অহিনকুল সম্পর্ক। যেহেতু ধর্মবিশ্বাসের মূল ভিত্তি ঈশ্বরের প্রতি অন্ধবিশ্বাস, তাই বিজ্ঞানের সঙ্গে অহিনকুল সম্পর্ক ঈশ্বরবিশ্বাসী তথা ধর্মবিশ্বাসীদেরও। এটা সকল ধর্মের প্রতি আনুগত্যশীল ধর্মবিশ্বাসী তথা ঈশ্বরবিশ্বাসীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে যেমন অহিনকুল সম্পর্ক বিদ্যমান ঠিক তেমনই সম্পর্ক দর্শন ও ধর্মের মধ্যেও। যুক্তিবাদী দার্শনিক সক্রেটিস ও ব্রুনোকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিলো ধর্মবিশ্বাসীরা। বিজ্ঞানীদের মধ্যে যাঁরা ধর্মবিশ্বাসীদের হাতে অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে গ্যালিলিওর নাম উল্লেখযোগ্য। শুধু খৃষ্টধর্মবিশ্বাসীদের হাতেই নয়, বিজ্ঞানী ও যুক্তিবাদী দার্শনিকদের ওপর নির্মম ও নৃশংস নির্যাতন চালিয়েছিল ইসলামী সাম্রাজ্যের অনেক খলিফাও। আজও ইসলামে বিশ্বাসীরা সারা বিশ্বে যুক্তিবাদীদের উপর নৃশংস নির্যাতন চালাচ্ছে এবং তাদের হত্যা করছে। হিন্দুধর্ম সহ অন্যান্য ধর্মের ধর্মবিশ্বাসীরাও একই কুকর্ম করেছে ও করে চলেছে। সে সবের দৃষ্টান্ত দিয়ে লেখাটির কলেবর অহেতুক বাড়াতে চাই না কারণ সেটা আজকের লেখার প্রতিপাদ্য নয়। প্রতিপাদ্য লেখাটির শিরনামেই উল্লেখ করা হয়েছে। লেখাটির ভূমিকা করার একান্ত প্রয়োজনে উপরের কয়েকটি কথা বলতে হলো। এবার লেখার মূল প্রতিপাদ্যে যাওয়া যাক।
আমাদের দেশে (ভারতে) বহু ধর্মের মানুষের বসবাস। তবে এখানে প্রধানত  হিন্দুধর্ম ও ইসলাম ধর্মের মানুষরাই বাস করে। বিজ্ঞানের কাঁধে পা রেখে বিজ্ঞানের ওপরেই লাঠি ঘোরানোর অপকর্মটি করতে হিন্দুধর্মবিশ্বাসিরাও বিশেষ পারদর্শী, তবে আমি এখানে আলোচনা করবো মূলত ইসলামবিশ্বাসিদের নিয়েই। গতকাল (৮ই জুলাই) ফেসবুকে একজন মুসলিম ডাক্তার বাবুর একটা বেশ লম্বা পোস্ট পড়লাম। মূলত সেই পোস্টের ওপরেই এই লেখাটি। লেখাটির মূল বিষয় হলো উপবাস থাকলে ও নিয়ন্ত্রিত খাদ্য গ্রহণ করলে শরীরের কতোটা উপকার হয়। এই নিয়ম অনুসরণ করলে মেদ ও ওজন দুইই কমে, শরীর নীরোগ হয় ও থাকে, মানুষ দীর্ঘজীবি হয় এবং মানুষের যৌবনও দীর্ঘস্থায়ী হয়। ডাক্তার বাবু বলেছেন এটা উপলব্ধ হয়েছে বা পাওয়া গেছে বিজ্ঞানের দীর্ঘদিনের গবেষণায়। পোস্টের তথা ডাক্তার বাবুর মূল বক্তব্য নিয়ে কিছু বলার নেই। আমার বক্তব্য অন্য জায়গায়।  উপবাস থাকা নিয়ে। ঠিক কতক্ষণ উপবাস থাকতে হবে সে কথা তিনি উল্লেখ করেন নি তাঁর দীর্ঘ স্টেটাসে। এটা অনুল্লেখ করেছেন বোধ হয় তাঁর পেশাগত স্বার্থে। আমার ধারণা উপবাস শব্দটি বারবার উল্লেখ করেছেন একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে। সেটা স্পষ্ট হয়েছে যেহেতু উপবাসে থাকার আবশ্যকতার কথা বলতে গিয়ে রমজান মাসের রোযার কথাও বার কয়েক বলেছেন। রোযা রাখলে যে মেদ কমে, ওজন কমে ও শরীর রোগমুক্ত হয় ও থাকে সে কথাও তিনি জানিয়েছেন। 
উপবাস কতক্ষণ থাকতে হবে সে কথা তাঁর লেখায় নেই, কিন্তু তাঁর বলা উপবাস থাকার অর্থটা কী তা আমি জেনেছি তাঁর খাদ্যবিধি অনুসরণ করছে এমন একজনের কাছ থেকে। খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁর পরামর্শ বা  নির্দেশিকা অনুসারে একজন মানুষ সারা দিনে মাত্র দু’বার খাদ্য গ্রহণ করবে - দুপুর দুটায় ও সন্ধ্যা সাত/সাড়ে সাতটায়, অবশ্য তার সঙ্গে আছে সকালে এক কাপ র’চা। বলা বাহুল্য যে খাদ্য তালিকায় কী কী থাকবে এবং কী কী রাখা যাবে না তাও থাকে সবিস্তারে। এই খাদ্যবিধি অনুযায়ী সকালে (ধরা যাক সকাল ছ’টা) এক কাপ চা খাবার পর আট ঘণ্টা এবং দুপুরে খাবার পর পাঁচ/সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা না খেয়ে থাকতে হবে। এটাকে নিশ্চয় উপবাস বলা যায় না। তবুও তিনি এটাকেই উপবাসে থাকা বা উপবাস করা বুঝিয়েছেন। তবু তিনি এটাকে উপবাস বলেছেন। লম্বা কয়েক ঘণ্টা না খেয়ে থাকাকে তাঁকে উপবাসই বলতে হয়েছে। কারণ ‘উপবাস’ না বললে তো রোযাকে টেনে এনে যায় না, রোযাকে  মহান করে দেখানোও যায় না আর প্রমাণও করা যায় না যে রোযা রাখা অবশ্যই একটি বিজ্ঞানসম্মত প্রথা। কিন্তু সারা দিন উপবাস থেকে রোযা রাখা তো অবৈনাজ্ঞিক প্রথা এবং শরীরের পক্ষে ভীষণ ক্ষতিকর। কেন তা স্পষ্ট হবে এর পরের আলোচনায়। 
হিন্দুধর্মবিশ্বাসীদের উপবাসে থাকার রীতিনীতি ও উদ্দেশ্যের মধ্যে ঢুকবো না, আমার আলোচনা সীমাবাদ্ধ রাখবো রোযা রাখার বিষয়েই। কারণ ডাক্তার বাবু তো কেবল ইসলামের রোযা রাখার কথাই বলেছেন, হিন্দুদের উপবাসে থাকার কথা  বলেন নি। মানুষ সাধারণত দিনের মধ্যে বারবার খায় এবং খাদ্যাভাসে ও খাদ্য তলিকায় কোনোরূপ নিয়ন্ত্রণ প্রায় রাখেই না বললেই চলে। এর ফলে অবশ্যই মানুষের মেদ ও ওজন দুইই বাড়ে যা শরীরে নানা অসুখ ডেকে নিয়ে আসে এবং বহু মানুষ অকালেই মারা যায়। এর হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্যে চিকিৎসক ও ডায়েটিসিয়ানরা মানুষের খাদ্যাভাস ও খাদ্য তালিকা দু’টোতেই পরিবর্তন আনতে বলেন এবং নিয়ন্ত্রিত খাবার খেতে বলেন। চিকিৎসক ও ডায়েটিসিয়ানদের এই পরামর্শও যে বিজ্ঞানের গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে সঞ্জাত তা বলা বাহুল্য। ওপরে উল্লেখিত ফেসবুক পোস্টে মুসলিম ডাক্তার বাবু যা বলেছেন তাও বিজ্ঞানের গবেশণালব্ধ জ্ঞান বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। তিনি অবশ্য সেটা একটু অন্যভাবে বলেছেন। ডায়েটিসিয়ানগণ যেভাবে খাদ্যবিধির পরামর্শ বা নির্দেশ দেন তা থেকে অনেকটাই আলাদা তাঁর দেওয়া খাদ্যবিধি। পার্থক্যটা কোথায় তা নিয়ে শব্দ খরচ করতে চাই না, কারণ সেটা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক এ আলোচনায়। তিনি যা বলেছেন তার সঙ্গে যে রমজানের উপবাসকে মেলানো যায় না আমার আলোচনা মূলত তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
রমজানের রোযা বা উপবাস সম্পর্কে কিছু কথা বলা এখন অত্যন্ত জরুরী। এ বিষয়ে প্রথমেই একটা কথা জানিয়ে দেওয়া একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, রমজান মাসে রোযা রাখার প্রচলন শুরু হয় প্রাচীন কালে ইসলামের আগমনের বহুকাল পূর্বেই। ইহুদিরাও রোযা রাখতো। শুধু ইহুদিরাই নয়, রোযা রাখার প্রথা ছিলো আরবে অইহুদি অন্যান্য উপজাতি গোষ্টীর মধ্যেও। মুহাম্মদও নিজেকে নবী বলে দাবী করার পূর্বে রোযা রাখতেন। অর্থাৎ এটা ইসলামের সৃষ্টি করা ধর্মীয় প্রথা নয়। মুহাম্মদ পরে রোযা রাখার প্রাচীন প্রথাটির ইসলামীকরণ করেছেন মাত্র। কিন্তু মুসলিমদের বিশ্বাস (অমুসলিমদের অনেকেরও) যে রমজান মাসে রোযা রাখার স্বর্গীয় বিধান ঈশ্বর সর্বপ্রথম মুহাম্মদের কাছেই পাঠায়। সেজন্যেই সম্ভবতঃ রমজানের রোযা নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় অপার গর্ব ও অহংকার। উক্ত ডাক্তার বাবু শরীর থেকে মেদ ঝরিয়ে শরীরকে মেদহীন ও রোগমুক্ত করার জন্যে উপবাস করতে তথা রোযা রাখতে (আসলে প্রতিদিনের খাদ্য গ্রহণের ফাঁকে লম্বা লম্বা বিরতি দেওয়ার) যে পরামর্শ দিয়েছেন তার পেছনে একটা বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে। সেটা হলো এই যে, তিনি সম্ভবত প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে বিজ্ঞান এখন যে কথা বলছে ইসলাম তা চৌদ্দশ’ বছর আগেই বলেছে। অর্থাৎ ইসলাম প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে যে কথা বলেছে বিজ্ঞানীরা এতদিনে সে কথা বলছেন। এ কথা বলে তিনি বোধ হয় এক ঢিলে দু’টো পাখি মারতে চেয়েছেন – এক). একমাস ধরে রোযা রাখা একটি বিজ্ঞানসম্মত প্রথা এবং দুই. বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে ইসলামকে বিজ্ঞানের উপরে স্থাপন করা। কিন্তু নির্মম সত্যিটা হলো এই যে, ডাক্তার বাবু বিজ্ঞানের গবেষণালব্ধ জ্ঞান থেকে প্রাপ্ত যে খাদ্যাভাস ও খাদ্যরীতি অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছেন তার সঙ্গে রমজানের রোযা রাখার তুলনা টানাই যায় না। কারণ দুটো জিনিষ সম্পূর্ণ আলাদা ও ভিন্ন প্রকৃতির। তা ছাড়া একমাস ধরে একমাস রোযা রাখা একটা সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক প্রথাও বটে। কেন তা বুঝতে হলে রমজান মাসে রোযা রাখার ধর্মীয় বিধিগুলি ও তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার। তাই এসব বিষয়ে আমদের অবহিত থাকা একান্তই আবশ্যক।    
প্রথমে বলা যাক রোযার বিধিমালা সংক্রান্ত কিছু কথা। সেই বিধিমালায় রয়েছে বছরের সে সময়েই রোযা আসুক না কেন রোযাদারকে অবস্থায় সূর্যোদয়ের কিছু পূর্ব মুহূর্ত থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সম্পূর্ণ নির্জলা উপবাস পালন করতে হবে। তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে গেলেও একফোঁটা জল পান করা যাবে না। কেউ ভুল করেও তা করলে তার রোযা ভেঙে যাবে। রোযাব্রত অবস্থায় যৌনতা নিষিদ্ধ। কেউ রাত্রে যৌন সংসর্গ করলে তাকে শেহরি করার (রোযা করার জন্যে খাদ্য গ্রহণ) পূর্বেই গোসল (স্নান) করতে হবে। অর্থাৎ ইসলামী মতে রমজান মাসে যৌনতা একটি অপবিত্র ও ঘৃণ্য কাজ। অথচ ইসলামই স্বর্গবাসীদের জন্যে যৌনতার এলাহি ব্যবস্থা রেখেছে। রোযাব্রত অবস্থায় মিথ্যা কথা বলা, অধিক মুনাফা করা, চুরি-দুর্নীতি ও ডাকাতি-রাহাজানি করা, নারীর প্রতি কুদৃষ্টি নিক্ষেপ করা – এসব সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এগুলির কোনো একটি করলে রোযা ভেঙে যায়। ইসলাম বলেছে রমজান মাসে নারীর ঋতুস্রাব হলে রোযা করা নিষিদ্ধ। অর্থাৎ নারীর ঋতুস্রাব একটি জঘন্য ও চরম অপবিত্র ব্যবস্থা। ইসলামের চিরকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ও চিন্তাবিদ ইমাম গাজ্জালী বলেছেন ঋতুস্রাব সহ কিছু অবাঞ্ছিত ও অপবিত্র কাজের জন্য আল্লাহ নারীকে নানাবিধ শাস্তি প্রদান করেছে। যেমন, নারীকে বিয়ের পর নিজের সব কিছু পরিত্যাগ করে একটা সম্পূর্ণ অচেনা বাড়িতে (স্বামীর বাড়িতে) যেতে হয়, স্বামীর অধীনে থেকে তার সর্বপ্রকার সেবা করতে হয়, গর্ভধারণ ও তীব্র প্রসবযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়, ঋতুস্রাবের সময় রোযা রাখা ও নামাজ পড়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। যে যে কারণে রোযা ভেঙে যায় তার কোনোটার কারণেই মুসলিম ডাক্তার বাবুর বিজ্ঞানস্মমত খাদ্যবিধি লঙ্ঘিত হয় না। তাঁর খাদ্যবিধিমালায় তো বারবার জল খেতে এবং দিনে ন্যূনতম দু’বার প্রধান খাদ্য গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে তিনি যে খাদ্যবিধি অনুসরণ করতে বলেন তাকে উপবাস বলা যায় না, রোযা রাখা তো কোনো ভাবেই বলা যায় না। মুসলিমদের রোযা রাখার মূল উদ্দেশ্য কী সেটা এবার দেখা যাক। মুসলিম ধর্মতত্ত্ববিদরা দাবি করেন যে, সততা অনুশীলন করা, অনাহারক্লিষ্ট মানুষের কষ্ট উপলব্ধি করা, দরিদ্র মানুষকে দান করা ইত্যাদি কিছু ভালো কাজ করার অভ্যাস করা হলো রমজান মাসে রোযা রাখার উদ্দেশ্য। আর রমজানের রোযা রাখার প্রধান উদ্দেশ্য হলো নরকের শাস্তি থেকে মুক্তি লাভ ও বেহেস্ত লাভ করা। সুতরাং উদ্দেশ্যের দিক বিবেচনায় রাখলেও ঐ ডাক্তার বাবুর খাদ্যবিধি অনুসরণ করাকে তথা ডায়েটিং করাকে কোনোভাবেই রোযা রাখার সঙ্গে মেলানো যায় মা। এবার আলোচনা করা যাক কেন রোযা রাখা শরীরের পক্ষে হানিকর।
ইতিমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে যে রোযা যে মাসেই পড়ুক না কেন রোযাব্রতকারীকে সূর্যোদয়ের আগে থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নির্জলা উপবাস করতে হয়। ধরা যাক এই সময়ে অর্থাৎ ইংরাজী ক্যালেণ্ডারের জুলাই মাসে রমজান মাস শুরু হলো। এই সময়ে দিন যতই দীর্ঘ হোক না কেন সূর্যোদয়ের কিছুক্ষণ আগে থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পুরো দিনটাই উপবাস উদযাপন করতে হবে, একফোঁটা জল পর্যন্ত পান করা যাবে না। এবার পৃথিবীর কয়েকটি দেশের দিকে চোখ রেখে দেখা যাক সে সব দেশের রাজধানীতে জুলাই মাসে দিনের দৈর্ঘ কতটা।দেখা ও বোঝার সুবিধার্থে নীচে একটা সারণী দেওয়া হলো –
দেশ          সূর্যোদয়ের সময়       সূর্যাস্তের সময়      দিনের দৈর্ঘ
সুইডেন         ৩-৪৮ এ.এম        ৯-৫৭ পি.এম      ১৮ ঘ. ০৯ মি. 
নরওয়ে        ৪-১১ এ.এম          ১০-৩২ পি.এম     ১৮ ঘ. ২১ মি. 
নেদারল্যাণ্ড    ৫-৩০ এ.এম       ১০-০১ পি.এম     ১৬ ঘ. ৩১ মি.
জার্মানি        ৪-৫৫ এ.এম          ৯-২৮ পি.এম      ১৭ ঘ. ২৭ মি.
গ্রীনল্যাণ্ড      ৩-২৪ এ.এম          ১১-৪১ পি.এম     ২০ ঘ. ১৭ মি.
ফেয়ারব্যাংক ২-৫৭ এ.এম        ১২-৪৭ এ.এম        ২১ ঘ. ৫০ মি. 
(ফেয়ারব্যাংক  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় অবস্থিত) 

ওপরের চিত্র থেকে বোঝা যাচ্ছে যে জুলাই মাসে রোযা যারা রাখবে তাদের সুইডেনে প্রায় সওয়া আঠারো ঘ., নরওয়েতে সাড়ে আঠারো ঘ., নেদারল্যাণ্ডে সাড়ে ষোলো ঘ., জার্মানিতে সাড়ে সতেরো ঘ. এবং গ্রিনল্যান্ডে প্রায় সাড়ে কুড়ি ঘ. উপবাস করতে হবে। একমাস ধরে দিনের মধ্যে এতো লম্বা সময় নির্জলা উপবাস করলে শরীরে কী পরিমাণ জলের ঘাটতি (কী মারাত্মক ডিহাইড্রেশন) হতে পারে এবং তার ফলে কিডনি কতোটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে তা সাধারণ মানুষের কল্পনারও বাইরে। তাছাড়া একজন মানুষ ১৮/২০ ঘণ্টা কোনো খাদ্য গ্রহণ না করলে সেই সময়ে তার শরীরে শক্তি উৎপাদিত হয়  না একদম।একমাস রোযা রাখলে একজন মানুষের শরীর প্রায় জলশূন্য ও শক্তিশূন্য হয়ে পড়বে। এবার ভাবুন ফেয়ারব্যাক অঞ্চলের মুসলিমদের কথা। তাদের রোযার নির্জলা উপবাস পালন করতে হবে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বাইশ ঘণ্টা। আমার মনে হয় একমাস তারা রোযা রাখলে তাদের জীবনী শক্তি প্রায় নিঃশেষ হয়ে যাবে। সুতরাং রমজান মাসে রোযাব্রত পালন করা শরীরের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। মুসলিমদের যারা রমজান মাসের রোযার জন্যে নিজেদের ধন্য ও অপরিসীম গর্বিত মনে করেন তাদের আর একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। ফেয়ারব্যাংকের মুসলিমদের রমজান মাসে রোযা এপ্তার (রোযা ভঙ্গ) করার পর রাতের যে খাবার খায় (ধরা যাক রাত্রি সাড়ে দশটা) তারপর  প্রাক প্রত্যুষে (বারোটা ত্রিশ মিনিটে) সূর্যোদয়ের পূর্বে খাদ্য গ্রহণ করার আগে হাতে সময় থাকে মাত্র দু’ঘণ্টা। দু’ঘণ্টায় বড়ো জোর দু’খানা বিস্কুট ও একগ্লাস জল খাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ সেয়ারব্যাংকের মুসলমানরা রোযা রাখার সময় চব্বিশ ঘণ্টায় মাত্র একবার জল ও খাদ্য খাওয়ার সুযোগ পাবে। সুতরাং রোযা রাখাটা শুধু শরীরের পক্ষে ভীষণ ক্ষতিকরই নয়, খাবার সময় বিন্যাসটাও (সূর্যোদয়ের পূর্বে এবং সূর্যাস্তের পরে) সম্পূর্ণ অবাস্তব ও অবৈজ্ঞানিক। 
প্রবন্ধের গোঁড়াতেই বলা কথাটা আবার বলতে হচ্ছে যে ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাসীদের মহাশত্রু, বলা ভালো, জাতশত্রু হলো বিজ্ঞান ও দর্শন। হবেই না বা কেন। বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীরা এবং যুক্তিবাদী দর্শন ও যুক্তিবাদীরাই তো সমস্ত ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাসীদের সকল অসত্য, অর্ধসত্য, অসততা ও প্রতারণাগুলো উন্মোচন করে দিয়েছে নির্মমভাবে। ধরা যাক ইসলাম ধর্মেরই কথা। ইসলামের প্রধান ধর্মগ্রন্থ কোরান বিশ্ব-মহাবিশ্ব, আকাশ-মহাকাশ, সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, দিন-রাত্রি, বৃষ্টি-বন্যা-খরা, আহ্নিক গতি–বার্ষিক গতি,  ঝড়-তুফান, ভূমিকম্প-সুনামি, প্রাণের সৃষ্টি, ইত্যাদি প্রসঙ্গে যা যা বলেছে তার সবটাই যে ভিত্তিহীন, আজগুবি ও মিথ্যেই ঠাসা তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বিজ্ঞানী ও যুক্তিবাদীরা। কোরান বলেছে বিশ্ব ও মহাবিশ্ব আল্লাহ সৃষ্টি করেছে সাত দিনে। এই সৃষ্টি তত্ত্ব যে একটা মস্ত বড়ো ধোঁকাবাজি তা মানুষ বুঝেছে বিজ্ঞানের দৌলতে। কোরান বলেছে আল্লাহর কুদরতে আমাদের মাথার উপর সাতটা আকাশ রয়েছে বিনা স্তম্ভেই। এই তত্ত্বটি যে ধর্ম প্রবর্তক ও প্রচারকের বুজরুকি সেটা ফাঁস করে দিয়ে বিজ্ঞান মানুষকে জানিয়েছে, মহাকাশ মানে অন্তহীন মহাশূন্য, মহাকাশের পুরোটাই ফাঁকা। কোরান বলে, সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, দিন-রাত্রি এবং সূর্যোগ্রহণ-চন্দ্রগ্রহণ হয় আল্লাহর হুকুমে (নির্দেশে)। এর রহস্য উন্মোচন করা মানুষের সাধ্যের বাইরে। অথচ সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, দিন-রাত্রি এবং সূর্যোগ্রহণ-চন্দ্রগ্রহণ যে হয় পৃথিবীর আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতির ফলে সেটা বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে অকাট্যভাবে এবং বিজ্ঞানের দৌলতেই মহাকাশ বিজ্ঞানীরা এখন অনায়াসে বলে দিতে পারে পৃথিবীর কোন প্রান্তে কখন (ক’টার সময়) সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত এবং সূর্যোগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ হবে নিঃখুতভাবে যে পৃথিবীর কোন প্রান্তে কখন (ক'টার সময়) সূর্যদয় ও সূর্যাস্ত এবং সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ হবে। বৃষ্টি-বন্যা-খরা ও ঝড়-তুফানও হয় নাকি আল্লাহর হুকুমে। কোরান আরও বলেছে ঝড়-বৃষ্টি-তুফান হবে তা একমাত্র আল্লাহই জানে আর মানুষের পক্ষে এসবের হদিশ পাওয়া সম্ভব নয়। এগুলো সবই যে স্রেফ নির্জলা মিথ্যা দাবি এবং এই প্রাকৃতিক ঘটনাগুলো কেন ও কীভাবে হয় তা নির্ভুলভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়েই আবহাওয়াবিদরা এখন ঝড়-বৃষ্টি-তুফানের  আগাম পূর্বাভাষ দিতে পারে। ভূমিকম্প সম্পর্কে কোরানের আজগুবি তত্ত্বকেও নির্মমভাবে নস্যাৎ করে দিয়ে বিজ্ঞান কেন ভূমিকম্প হয় তার রহস্য নিঃখুতভাবে উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছে। সমুদ্রের গভীরে ভূমিকম্প হলে সুনামি হয় সেটাও মানুষ জেনেছে বিজ্ঞানের কাছ থেকেই। আরও অনেক বিষয় আছে সে সব ক্ষেত্রেও কোরান সহ সমস্ত ধর্মগ্রন্থের সকল বুজরুকির ধূম্রজাল ছিন্ন করে বিজ্ঞান মানুষের সামনে আসল সত্যটা তুলে ধরে মানবসমাজের সীমাহীন উপকার করেছে। পৃথিবীর সমস্ত ধর্মের ভিত্তি হলো বিশ্বাস। মানুষের এই সহজ সরল বিশ্বাসকে ধর্মপ্রবর্তক ও ধর্মপ্রচারকরা নির্মমভাবে শোষণ করে মানুষকে করে তুলেছে ধীরে ধীরে অন্ধবিশ্বাসী যা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে মানবসমাজ ও মানবসভ্যতার। ধর্মই মানুষের মধ্যে বর্ণবিভেদ, জাতিবিভেদ ও লিঙ্গবিভেদ সৃষ্টি করেছে। ধর্মের কারণেই মানুষ একে অপরের বিরুদ্ধে অবিশ্বাস ও ঘৃণা করতে শিখেছে, মানুষ হিংসা করতে এবং হিংস্র ও অমানবিক হতে শিখেছে। যুক্তিবাদী দর্শন ও যুক্তিবাদীরা বিশ্বাসের মূলে কঠরভাবে ভাবে আঘাত হেনেছে এবং মানুষকে শিখিয়েছে প্রশ্ন করতে। যুক্তিবাদী দর্শনই ঈশ্বরের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছে এবং বিজ্ঞানের জ্ঞান ও যুক্তির শাণিত তরবারি দিয়ে মানুষকে ঈশ্বরবিশ্বাসের ইস্পাতসম শক্ত বর্মকে (আবরণকে)  ফালা ফালা করে কেটে মুক্ত করেছে। কোরান-সহ সমস্ত ধর্মগ্রন্থগুলি যদি তথাকথিত ঈশ্বরের সৃষ্টি হয় তবে একটার সঙ্গে আর একটার অমিল ও বৈপরিত্য থাকে কেমনে – এই বৈধ প্রশ্ন তুলেছে যুক্তিবাদীরা। কোরান যদি আল্লাহর সৃষ্টি হয় তাহলে আল্লাহ কেন সরল ও সৎ পথ দেখানোর জন্যে প্রার্থনা করে  (কোরানের ফাতেহা সুরা দেখুন)? আল্লাহ কার কাছে প্রার্থনা করে, আল্লাহরও আল্লাহ আছে নাকি? আল্লাহ নাকি নিরাকার। তাহলে মানুষ কীভাবে সাক্ষ্য দেয় যে মুহাম্মদ আল্লাহর রসুল (এটা আজানের মধ্যে রয়েছে)? আল্লাহর হুকুমে যদি ঝড়-বৃষ্টি, চন্দ্রগ্রহণ-সূর্যগ্রহণ ইত্যাদি হয় তবে মানুষ এগুলি সম্পর্কে আগাম খবর দেয় কেমন করে – এ প্রশ্নগুলি তুলেছে যুক্তিবাদীরা। আল্লাহর নবীর (দূতের) পক্ষে কি বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ ও দত্তক-পুত্রবধূকে বিবাহ ইত্যাদি অশুভ কাজগুলি সম্পন্ন করা শোভা পায় – এ প্রশ্ন তুলে যুক্তিবাদীরা ঈশ্বর ও ঈশ্বরের নবীতত্ত্বকে (theory of prophet-কে) প্রশ্নের মুখে খাড়া করে দিয়েছে। এ রকম হাজারো প্রশ্ন তুলে যুক্তিবাদীরা ঈশ্বররবিশ্বাসী ও ধর্মবিশ্বাসিদের নাস্তানাবুদ করেছে এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব এবং ঈশ্বরের দূত (নবী) ও ঈশ্বরের সৃষ্টি পবিত্র ধর্মগ্রন্থের তত্ত্বকে অবাস্তব ও ভুয়া বলে প্রমাণ করেছে। মানুষের বিশ্বাস ও সংস্কারকে ছিন্নভিন্ন করে মানুষকে যুক্তিবাদী করেছে ও করে যাচ্ছে যুক্তিবাদীরা। তাই তো ঈশ্বরবিশ্বাসী ও ধর্মবিশ্বাসীদের মহাশত্রু ও জাতশত্রু বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীরা এবং দর্শন ও যুক্তিবাদীরা। 
ধর্মপ্রবর্তক, ধর্মপ্রচারক ও ধর্মবিশ্বাসীরা যেমন মিথ্যাচারিতায় তুলনাহীন, দ্বিচারিতাতেও তাদের তুলনা কেবল তারাই। ধর্মবিশ্বাসীরা অবশ্য অনেকেই অজ্ঞতাবশে এই অপকর্মগুলি করে। কীরূপ মিথ্যাচারিতা করে অনেকগুলি দৃষ্টান্ত ওপরে আলোচনা করা হয়েছে। এখন দ্বিচারিতার দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। ধর্মপ্রবর্তক ও ধর্মগুরুরা যে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী দর্শনের বিরুদ্ধে গোঁড়া থেকেই খড়্গহস্ত ছিল সে কথা শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সনস্ত ধর্মের ধর্মগুরু ও লেখক-বুদ্ধিজীবীরা এখন দাবি করেন যে তাদের নিজেদের নিজ ধর্মসমূহ ও ধর্মগ্রন্থগুলির ভিত্তিই হলো বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ। যেমন মুসলিম ধর্মগুরু ও লেখক-বুদ্ধিজীবীরা দাবি করে যে ইসলাম হলো একটি বৈজ্ঞানিক ধর্ম, খোদ আল্লাহ একজন বিজ্ঞানী, আল্লাহর নবী হলেন পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী এবং তাদের ধর্মগ্রন্থ কোরান একটা মহা বিজ্ঞানগ্রন্থ। বিজ্ঞান ও যুক্তবাদের সঙ্গে শত্রুতা করবো, তাদের সমস্ত পথ রুদ্ধ করার চেষ্টা করবো, আবার নিজেদের ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের উপই প্রতিষ্ঠিত বলে দাবিও করবো, এগুলো দ্বিচারিতা নয়? এখন প্রশ্ন হলো জীবনভোর বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী দর্শনের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারিতা করে এসে তারা দ্বিচারিতার আশ্রয় নিচ্ছে কেন? এর কারণ হলো বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের প্রতি মানুষের আস্থা, বিশ্বাস ও নির্ভরতা অপ্রতিরোধ্য গতিতে ক্রমবর্ধমান। ইউরোপের অধিকাংশ মানুষ ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থগুলোকে আবর্জনাস্বরূপ বর্জন করেছে। এশিয়া ও অন্যান্য মহাদেশেও ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থ অপেক্ষা বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের প্রতি মানুষের আস্থা, বিশ্বাস ও ভরসা বাড়ছে ও তা ক্রমবর্ধমান। যারা ঈশ্বরবিশ্বাসী তারাও এখন বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদকে সম্পূর্ণ অস্বীকার ও অগ্রাহ্য করতে পারে না, বরং ধর্মগুরু অপেক্ষা চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রতিই তাদের বিশ্বাস ও নির্ভরতা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই ধর্মগুরু আর ঈশ্বরবিশ্বাসীরা প্রকাশ্যে বিজ্ঞান ও দর্শনের বিরোধিতা ত্যাগ করেছে। শুধু তাইই নয়, তারা বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী দর্শনকে আশ্রয় করেই তাদের ঈশ্বর ও ধর্মকে রক্ষা করতে চায়ছে। তাই তাদের দ্বিচারিতার আশ্রয় নেওয়া ছাড়া গতি নেই।
পরিশেষে রমজানের রোযা প্রসঙ্গে ফিরে আসি। একমাস ধরে রোযা রাখা যে মানুষের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর ও একটি সম্পূর্ণ অবাস্তব ও অবৈজ্ঞানিক প্রথা তা নিয়ে তথ্য ও যুক্তি সহকারে ওপরে আলোচনা করা হয়েছে। এটা এখন মুসলিমরাও ব্যাপক সংখ্যায় উপলব্ধি করছে। ফলে রোযার প্রতি তাদের আগ্রহ ক্রমশঃ কমছে। ফলশ্রুতিতে রোযা রাখা মানুষের সংখ্যা ক্রমশঃ হ্রাস পাচ্ছে। আমি যেখানে বাস করি সেখানে আমার চোখ যতদূর যায় দেখতে পাই যে পুরুষরা ১০/১৫ শতাংশের বেশী রোযা রাখে না। অনেককেই দেখা যায় যে সোৎসাহে ও স্বতস্ফূর্তভাবে রোযা রাখা শুরু করেও মাঝপথে ছেড়ে দেয়। গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহের মধ্যে ১২/১৪ ঘণ্টা নির্জলা উপবাস থাকার ফলে শরীরে জলের প্রচণ্ড ঘাটতি ও তীব্র ক্ষুধার ক্লান্তিতে তাদের উৎসাহ ও স্বতস্ফূর্ততা কর্পূরের মতন উবে যায় এবং হাড়ে হাড়ে টের পায় যে রমজান মাসব্যাপী রোযা রাখা একটা চরম অবাস্তব ও সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক প্রথা। এই উপলব্ধি আগামী দিনেও বৃদ্ধি পেতে থাকবে। তাই এখন মুসলিম ধর্মগুরু ও লেখক-বুদ্ধিজীবীদের বিজ্ঞানের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। বলতে হচ্ছে একমাস রোযা রাখা একটা বিজ্ঞানসম্মত ব্যাপার এবং রোযা রাখলে মানুষ নীরোগ হবে, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হবে। বিজ্ঞানের দোহায় দিয়েই তারা মুসলমানদের কাছে রমজানের রোযাকে জনপ্রিয় করার অপচেষ্টা করছে। ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থকে বিজ্ঞানসম্মত বলেই তারা থেমে থাকে না। তারা তাদের ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থগুলিকে বিজ্ঞানের ওপরে স্থাপন করতেও কম কসুর করে না। তারা এ রকম আজগুবি করতেও স্বিধা করে না যে বিজ্ঞানের সকল সূত্র লুকিয়ে রয়েছে ধর্মগ্রন্থের মধ্যে এবং বিজ্ঞানীরা তাদের সমস্ত আবিষ্কারের সূত্র চুরি করেছে ঐ ধর্মগ্রন্থ থেকেই। মুসলিম  ধর্মগুরু ও লেখক-বুদ্ধিজীবীরা এগুলো অন্যদের চেয়ে একটু বেশীই করে। এরই ধারাবাহিকতায় মুসলিম ডাক্তারদেরও বলতে শোনা যাচ্ছে যে শরীরকে মেদহীন করে রোগমুক্ত রাখতে খাদ্য গ্রহণ করার ফাঁকে ফাঁকে লম্বা লম্বা বিরতি দেওয়ার যে পরামর্শ আজ বিজ্ঞান দিচ্ছে সেটা কোরান চৌদ্দশ’ বছর আগেই বলেছে। এতো ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থকে বিজ্ঞানের সমকক্ষ করে তোলার মরিয়া প্রয়াসই শুধু নয়, এতো বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে বিজ্ঞানের কাঁধে চেপে ছড়ি ঘোরানোর নতো ব্যাপার।
সমাপ্ত
     
               
           
          

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...