Tuesday, December 28, 2021

অনন্যা,রিয়া,শেখর ও শুভ্রজিতের মূল অপরাধ তারা বিত্তহীন

হাওড়া জেলার নিশ্চিন্দা থানার নিম্নবিত্ত একটি কর্মকার পরিবারের গৃহবধু অনন্যা ও রিয়া ভালোবেসে ছিলো মুর্শিদাবাদ জেলার সুতি থানার দু’জন রাজমিস্ত্রীকে যাদের নাম শেখর রায় ও শুভ্রজিত দাস। শেখর ও শুভ্রজিত ঐ কর্মকার বাড়িতে কাজ করতো। সেই সূত্রেই তাদের পরষ্পরের সঙ্গে পরিচয় হয়, তারপর ধীরে ধীরে হয় ঘনিষ্ঠতা ও অবশেষে প্রণয়। প্রণয় হয় অনন্যা ও শেখরের মধ্যে এবং রিয়া ও শুভ্রজিতের মধ্যে। প্রেমের টানে অনন্যা ও রিয়া ঘর ছেড়ে চলে যায় তাদের প্রেমিকের কাছে। ঘটনাটি ঘটে অতি সম্প্রতি, ১৬ই ডিসেম্বর। স্বপ্ন ছিল তাদের ভালোবাসার দুটি নতুন সংসার। অনন্যার সাত বছরের একটি ছেলে (আয়ুষ) আছে, তাকেও সে সঙ্গে নিয়েছিলো। কিন্তু তাদের স্বপ্ন অধরা থেকে গেছে পুলিশের আজব ভূমিকা ও নিম্ন আদালতের আজব রায়ে। 

                                                                    পুলিশের আজব ভূমিকা 

 নিঁখোজ অনন্যা ও রিয়ার অনুসন্ধান করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে যে তারা অপহৃত হয় নি, স্বেচ্ছায় তাদের প্রেমিক যথাক্রমে শেখর ও শুভ্রজিতের সঙ্গে তাদের বাড়ি গিয়েছে। শেখর ও শুভ্রজিতের বাড়ি মুর্শিদাবাদ জেলার সুতি থানায়। তাদের বাড়ি গিয়ে পুলিশ নিশ্চিত হয় সে বিষয়ে।সেখানে তারা আরও জানতে পারে যে শেখর ও শুভ্রজিতের পরিবার অনন্যা ও রিয়া বিবাহিত বলে তাদের আশ্রয় দেয় নি। ফলে শেখর ও শুভ্রজিত অনন্যা ও রিয়াকে নিয়ে মুম্বাই পারি দিয়েছে। পুলিশ তখন তাদের গ্রেপ্তার করতে মুম্বাই ধাওয়া করে। ওদিকে শেখর ও শুভ্রজিতরা দিন কয়েক মধ্যেই অর্থকষ্টে পড়ে মুম্বাই থেকে তারা বাড়ি ফিরে আসছিলো ট্রেনে। পুলিশ আসানসোল স্টেশনে ওৎ পেতে ছিলো, সেখানে নামার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের গ্রেপ্তার করে এবং পরে তাদের আদালতে সোপর্দ করে। অনন্যা ও রিয়ার নিঁখোজ হওয়ার ডায়েরির পরিপ্রেক্ষিতে তাদের খঁজার জন্যে পুলিশের তৎপর হওয়াই দোষ ছিলো না। তাদের সন্ধানে শেখর ও শুভ্রজিতের বাড়ি গিয়ে খোঁজখবর করাতেও দোষের কিছু ছিলো না যেহেতু তাদের কাছে খবর ছিলো যে অনন্যা ও রিয়া তাদের সঙ্গেই গেছে। কিন্তু পুলিশ যখন জানলো যে তারা অনন্যা ও রিয়া স্বেচ্ছায় ঘর ছেড়েছে শেখর ও শুভ্রজিতকে ভালোবেসে তখন পুলিশের উচিৎ ছিলো তখনই সঙ্গে সঙ্গে তাদের তৎপরতা বন্ধ করে দেওয়া। সেই সঙ্গে পুলিশ যদি কর্মকার বাড়ির লোককে বলে দিতে পারত যে যেহেতু অনন্যা ও রিয়া প্রাপ্তবয়স্ক তাই তাদের আর করণীয় কিছু নেই। হ্যাঁ, পুলিশের সত্যি সত্যি করার কিছু নেই। কারণ, অনন্যা ও রিয়া যা করেছে তাতে আইনের লঙ্ঘন হয় নি। বিবাহিত হলেও অন্য পুরুষকে তাদের ভালোবাসার অধিকার আছে, এটা আইনে স্বীকৃতি। এ ধরণের ভালোবাসাকে আমাদের সমাজ পরকীয়া বলে নিন্দা করে পশ্চাদগামী ধ্যান-ধারণা ও মানসিকাতার জন্যে। এই মানসিকতার লোকেরা বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক বা ভালোবাসাকে মেনে নিতে পারে না কারণ, তারা মনে করে যে বর-বধূর সম্পর্ক হলো অচ্ছেদ্য ও জন্ম-জন্মান্তরের। কিন্তু কোনো সম্পর্কই অচ্ছেদ্য বা জন্ম-জন্মান্তরের হয় না, হতে পারে না। দাম্পত্যজীবনে নানা কারণে দ্বন্দ দেখা দিতে পারে। এমনকি এক সময়ে তা দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে। সেক্ষেত্রে সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারের বশে বা অন্য কারণে দাম্পত্যজীবন টিকিয়ে রাখার ফল ভালো হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে বর কিংবা বধূ, কিংবা উভয়েই বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। এমন পরিণতিটাই স্বাভাবিক। কারণ এটাই জীবনের নিয়ম। বাতাস যেমন শূন্যস্থানের দিকে ছুটে যায়, জল যেমন সদা নীচের দিকে প্রবাহিত হয় ঠিক তেমনই মানুষও সদা আকর্ষিত হয় ভালোবাসার প্রতি, ভালোবাসার মানুষের প্রতি। তখন সমাজের কোনো নিয়মকানুন, রীতিনীতি ও প্রথা তাদের পথ আটকাতে পারে না। এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক তথা পরকীয়াকে২০১৮ সালে আইন সিদ্ধ ঘোষণা করেছে সর্বোচ্চ আদালত। একইভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে লিভ-ইন-টুগেদারকেও (বিয়ে ছাড়াই বিপরীত লিঙ্গের বা সমলিঙ্গের দুজন মানুষের একত্রে বাস করাকে)। তার মানে স্বীকৃতি পেয়েছে সমকামিতাও। লিঙ্গ পরিবর্তনের অধিকারকেও সর্বোচ্চ আদালত বৈধ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। সুতরাং সংশয় নেই যে অনন্যা ও শেখর এবং রিয়া ও শুভ্রজিতদের ভালোবাসায় কোনো ভুল বা অন্যায় নেই এবং তারা আইনও লঙ্ঘন করে নি। বরং তারাই আইন লঙ্ঘন করেছে যারা অনন্যা ও রিয়াদের ব্যক্তিজীবনের অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছে।    

নিম্ন আদালতের ভূমিকাও  হতাশাজনক    

নিম্ন আদালতে অনন্যা ও শেখর, অনন্যা ও তার পুত্র আয়ুষ এবং রিয়া ও শুভ্রজিতের মামলায় যে রায় দিয়েছে তা বিষ্ময়কর। তিনটি রায় দিয়েছেন বিচারক। শেখর ও শুভ্রজিতকে চৌদ্দদিনের জন্যে জেলে পাঠানো হয়েছে, অনন্যা ও রিয়াকে মুক্তি দিয়েছে এবং সাত বছরের শিশু আয়ুষকে তার মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে তার বাবার হাতে তুলে দিয়েছে। সামগ্রিকভাবে এ রায়ে ২০১৮ সালের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের কতটা প্রতিফলন ঘটেছে তা নিয়ে প্রশ্ন করার অবকাশ রয়েছে। নিম্ন আদালত অনন্যা ও রিয়াকে জামিন দিলেও শেখর ও শুভ্রজিতের জেল হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে। ২০১৮ সালের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের সকলের বেকসুর মুক্তি পাওয়ার কথা। কিন্তু শেখর ও শুভ্রজিতের যেহেতু জেল হেফাজত হয়েছে তাই মনে হচ্ছে অনন্যা ও রিয়াকে জামিন দেওয়া হয়েছে। অনন্যা ও রিয়া এজাহার দিয়েছে যে তারা যথাক্রমে শেখর ও শুভ্রজিতকে ভালোবাসে এবং স্বেচ্ছায় তাদের সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে। তাই ২০১৮ সালের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে তারা নির্দোষ। সুতরাং অনন্যা ও রিয়ার মতন তাদেরও কেস থেকে অব্যাহতি পাওয়া, নিদেন পক্ষে জামিন পাওয়াটা প্রাপ্য ছিলো। বিষ্ময়কর ঠেকেছে সাত বছরের নাবালক সন্তান আয়ুষকে তার মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে বাবাকে হস্তান্তর করা। সন্তান সাবালক না হওয়া পর্যন্ত মায়ের কাছেই থাকবে, এটাই তো যতদূর জানি আইনের নির্দেশ। আর নাবালক সন্তানকে তার মা যতটা আদর-যত্ন দিয়ে প্রতিপালন করতে পারবে সেটা কখখনই সম্ভব নয় তার পিতার পক্ষে করা। সুতরাং আয়ুষকে তার মায়ের কাছে পাঠাবার নির্দেশ দেওয়াটাই ছিলো প্রত্যাশিত। অনন্যা যদি তার পুত্র আয়ুষকে নিতে অস্বীকার করে থাকে তবে আলাদা কথা। অনন্যা তার পুত্রকে তার সঙ্গে রাখতে চায় নি এমন খবর কিন্তু শোনা যায় নি। অনন্যা, রিয়া, শেখর ও শুভ্রজিতদের মূল অপরাধ হলো তারা বিত্তহীন পুরাণ জুড়ে দেখা যায় পরকীয়ার ছড়াছড়ি। ভগবান কৃষ্ণ ও রাধার পরকীয়ার সর্বজন বিদিত। এটাও সর্বজন সুবিদিত যে রাধা ছিলেন বিবাহিত। শুধু এক রাধা নয়, কৃষ্ণ পরকীয়া করতো বহু রমণীর সঙ্গে। তাদেরকে নষ্ট মেয়ে নয়, বলা হয়। ইসলামও পরোক্ষভাবে বিভিন্ন পথে পরকীয়াকে অনুমোদন করেছে। ইসলামি আইনে বহুবিবাহ সিদ্ধ। একজন মুসলিম পুরুষ চারটি বউ নিয়ে সংসার করতে পারে। প্রথম বিয়ের ক্ষেত্রে বউ নির্বাচন করে থাকে সাধারণত অভিভাবকরা। কিন্তু বউ থাকা সত্ত্বেও কেউ যখন দ্বিতীয় বা তৃতীয় বা চতুর্থ বিয়ে করে তখন বউ নির্বাচন সে নিজেই করে। সেই বউদের তারা সাধারণত নির্বাচন করে থাকে বিবাহ বহির্ভূত প্রেমে পড়েই। অর্থাৎ মুসলিম সমাজে দ্বিতীয় বা তার পরের বিয়েগুলো সম্পন্ন হয় কিছুদিন বিবাহ বহির্ভূত প্রেমালাপ চলার পর। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে বহুবিবাহের মধ্যেই পরকীয়ার বীজ নিহিত রয়েছে। ইসলাম অনুমোদিত মুতা বিয়েও কার্যত এক প্রকার পরকীয়া। একজন বিবাহিত পুরুষ কিছু দিনের জন্যে বাড়ির বাইরে অবস্থান করলে চুক্তির ভিত্তিতে কয়েকদিনের জন্যে একটা মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে। তারপর চুক্তি অনুসারে মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে তাকে ইস্তফা দিয়ে দেবে। এতো পরকীয়াই। বর্তমান সময়েও পরকীয়ার ঘটনা কম ঘটছে? বলিউড ও টলিউডের তারকাদের মধ্যে তো পরকীয়া একটা সংস্কৃতি বা ফ্যাসান হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই জগতে সবচেয় চর্চিত পরকিয়ার তারকারা হলেন নুসরত ও যশ। চলচিত্র জগতের বাইরে পরকিয়ার জন্যে যারা সবচেয়ে সাড়া জাগিয়েছে তারা হলো শোভন ও বৈশাখী। তারা দুজনেই বিবাহিত এবং তাদের কারোরই বিবাহবিচ্ছেদ হয় নি। কৃষ্ণ ও রাধা পরকীয়া করলে দোষ নেই। মহাভারতের চরিত্র কর্ণের জন্ম তার পিতা পাণ্ডূর ঔরসে হয় নি। তবু তাকে জারজ বলে গালাগাল দেওয়ার পরিবর্তে বীর যোদ্ধা বলে সম্মান জানানো হয়। শোভন ও বৈশাখী এবং যশ ও নুসরত প্রকাশ্যে পরকীয়া করতে পারবে। তাতে হিন্দু ও মুসলিম সমাজের যায় আসে না কিছুই। পুলিশও তাদের বিরুদ্ধে কোনো তৎপরতা দেখাবার কথা ভাবতেই পারে না। শোভন ও বৈশাখী এবং যশ ও নুসরত বিবাহ বন্ধন ছাড়াই একসঙ্গে থাকতে পারে ও বসবাস করতে পারে, পুলিশ কিন্তু সে সব দেখেও নীরব থাকে। পুলিশের নীরব থাকার কারণ শুধু এটাই নয় যে পরকীয়া আইনত সিদ্ধ। নীরব থাকার পেছনে আর একটা কারণ আছে সেটা হলো, তারা বিত্তশীল ও প্রভাবশালী। আইনের চোখে অনন্যা,, শেখর, রিয়া ও শুভ্রজিতরাও নির্দোষ। তবু সমাজ ও পুলিশ উভয় মিলে তাদের ইচ্ছামতো অপবাদ দিলো, হেনস্থা করলো, জেলেও পুরলো কারণ, তারা বিত্তহীন ও প্রভাব-প্রতিপত্তিহীন। এ দেশে নিম্নবর্ণ ও নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়াই সবচেয়ে বড়ো অপরাধ। 

যে পরিণতি  প্রত্যাশিত ছিলো

অনন্যা ও রিয়া আদালত থেকে জামিন বা ছাড়া পাওয়ার পর তাদের শ্বশুর বাড়ি তাদের নেয় নি। ফলে তারা তাদের বাবা-মায়ের আশ্রয়েই চলে যায়। আমাদের সমাজ এখনও যেভাবে ধর্মীয় কুসংস্কারে আকণ্ঠ ডুবে আছে তাতে এটা অনুমান করা যায় যে অনন্যা ও রিয়া আশ্রয় পেলেও ভালো নেই। ভালো নেই তাদের বাবা-মা এবং পরিবারের অন্য সদস্যরাও। ভাগাড়ে মরা পড়লে শকুনের দল যেমন মরাটাকে ছিঁড়ে খুবলে খায় তেমনি করে সমাজের মাতব্বররা তাদের নিরন্তর ছিঁড়ে খাবে। অনন্যা ও রিয়ার বাবা-মা যদি ধর্মীয় কুসংস্কারের বশে কিংবা লোকলজ্জার ভয়ে তাদের সন্তানকে নিতে অস্বীকৃতি জানাতো তবে সমাজ তাদের ধন্য ধন্য করতো। আমাদের সমাজে পরকীয়ার ক্ষেত্রে এরূপ মর্মান্তিক ও দুঃষহ পরিণতি যে ঘটতে পারে তা অনুমান করা মোটেই কঠিন কিছু নয়। তথাপি  নিম্ন আদালত কেন যে তাদের এরূপ ভয়ানক পরিণতির মধ্যে নিক্ষেপ করলো তা আমাদের এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ঢুকছে না।  

পরকীয়াকে বৈধ বলে সর্বোচ্চ আদালত যেহেতু তিন বছর আগেই স্বীকৃতি দিয়েছে সেহেতু অনন্যা ও রিয়ার মতন শেখর ও শুভ্রজিতেরও ভিত্তিহীন অভিযোগ থেকে মুক্তি বা জামিন পাওয়ার ক্ষেত্রে আইনি কোনো  প্রতিবন্ধকতা ছিলো না। তারা মুক্তি বা জামিন পেলে অনন্যা ও রিয়া এবং তাদের বাবা-মাকেও সমাজের দ্বারা হেনস্থা হওয়ার মতন বিড়ম্বনায় পড়তে হতো না। আর এই পরিণতিই তো আমাদের কাম্য ও প্রত্যাশিত ছিলো।  

২৮.১২.২০২১

Saturday, December 18, 2021

পত্নীকে পেটানোর অধিকার শরিয়ত সম্মত

‘পত্নীকে প্রহার করা পুরুষের আইন সম্মত অধিকার, ওতে কোনো দোষ নেই’। না, এটা কোনো নাটক বা সিনেমার সংলাপ নয়। এটা আরব আমীর শাহীর সর্বোচ্চ আদালতের একটি রায়। এই নিন্দার্হ ও ঘৃণার্হ রায়টি প্রদান করা হয়েছে একজন প্রহৃতা পত্নীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে। উক্ত মুসলিম নারী ও তার মেয়েকে নির্মমভাবে প্রহার করেছিল তার স্বামী। সর্বোচ্চ আদালত পত্নীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তার পতিকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং কারাদন্ডের আদেশ দেয়। সেই আদেশের মধ্যেই রয়েছে ঐ কুখ্যাত রায়টিও। আদালত একদম স্পষ্ট ভাষায় জানায় যে স্ত্রী ও কন্যাকে প্রহার করার জন্যে অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় নি, এবং কারাদন্ড দেওয়া হয় নি। কেননা পত্নী প্রহার করায় কোনো অন্যায় নেই, ওটাতো একজন মুসলমান পুরুষের শরিয়তসম্মত অধিকার। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করে কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে কারণ, সে সে তার স্ত্রীকে প্রহার করার সময় শরিয়ত প্রদত্ত সীমা লঙ্ঘন করেছে। কীভাবে শরিয়তি সীমা লঙ্ঘিত হয়েছে সে প্রসঙ্গে আদালত বলেছে যে, স্বামী প্রয়োজনে তার স্ত্রীকে প্রহার করতে পারবে, কিন্তু প্রহার এমন হবে না যাতে স্ত্রীর দেহে প্রহারের চিহ্ন ফুটে ওঠে। 
 Husband Beating And Smothering Wife During Argument Stock Photo, Picture  And Royalty Free Image. Image 41848908.
 
কোনো ইসলামি রাষ্ট্রের আদালত কিংবা মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ এরূপ কুৎসিত, অসভ্য ও অমানবিক রায় বা ফতোয়া যখন প্রদান করে তখন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলিম সমাজে এর প্রবল প্রতিক্রিয়া হয়। সাধারণত তাঁরা বিশ্বাস করতেই চান না যে ইসলাম ধর্মে এরূপ কুৎসিত আইন আছে বা থাকতে পারে। তাঁদের বক্তব্য হলো, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ কোরানের অপব্যাখ্যা করে এরূপ শরিয়ত-বিরুদ্ধ রায় বা ফতোয়া দেন যার ফলে ইসলামের ভাবমূর্তি অবিরাম ক্ষুণ্ণ হয়। মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা এ ধরণের রায় বা ফতোয়াকে অনৈস্লামিক ফতোয়া বলে উড়িয়ে দেন। বলা বাহুল্য যে, এই রায়টিকেও তাঁরা অনৈশ্লামিক ও শরিয়তবিরুদ্ধ বলে বিবৃতি দিতে কালক্ষেপ করেন নি। তথাকথিত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলিম সমাজ যাই ভাবুন এবং মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা যতই বিবৃতি দিন না কেন, কিন্তু বাস্তবটা হলো এই যে, আরব আমীর শাহীর সর্বোচ্চ আদালতের রায়টি শরিয়তসম্মতই। এর প্রমাণ রয়েছে কোরানে। কোরান পুরুষদের নির্দেশ দিয়েছে তারা যেন তাদের অবাধ্য পত্নীকে প্রহার করতে দ্বিধা না করে। হ্যা, আল্লাহর স্পষ্ট নির্দেশ তাই, পত্নীর অবাধ্যতা আশঙ্কা করলে তাকে প্রহার করবে। দেখা যাক আল্লাহ ঠিক কী বলেছে -   
“পুরুষগণ নারীর কর্তা; কারণ এককে অন্যের উপর মর্যাদা দিয়েছেন; আর তাহারাই তো সম্পদ ব্যয় করে; সতী নারী অনুগত, আল্লাহর হিফাযতে স্বামীর অবর্তমানে সংসার রক্ষা করে; যখন তাহাদের অবাধ্যতার ভয় কর; তখন উপদেশ দাও, শয্যা বর্জন কর, প্রহার কর; যদি অনুগত হয়ে যায় তবে বাহানা খোঁজ করিও না।” ( কোরান- ৪/৩৪)    
এই বাণীতে অবশ্য উল্লেখ নেই যে, স্ত্রী যদি কোনোমতেই শেষ পর্যন্ত অনুগত না হয় তখন কী হবে? তার উত্তর দিয়েছেন ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ। সেই উত্তরটি কী তা উল্লেখ করা হয়েছে আর একটু পরে।    
এ যুগে পত্নীকে প্রহার করা কোনো পরিস্থিতেই গ্রহণযোগ্য বা সমর্থনযোগ্য নয়। এটা আইনের চোখেও জামিন অযোগ্য ও দন্ডনীয় অপরাধ। কোরানে এ রকম আরও অনেক অগণতান্ত্রিক, অমানবিক ও বর্বরোচিত আয়াত আছে যেগুলো সম্পর্কে অধিকাংশ মুসলিমরাই অজ্ঞ। এই অজ্ঞতা হেতু এ সব কুৎসিত, জঘন্য ও অমানবিক ফতোয়ার জন্যে তারা সব দোষ চাপিয়ে থাকেন ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের উপর। অবশ্য একদল উচ্চ শিক্ষিত মুসলিম আছেন যারা কোরান ও হাদিস সম্পর্কে যথেষ্টই বিজ্ঞ। তারা সচেতনভাবে কোরান-সম্মত রায় বা ফতোয়াকে অনৈশ্লামিক বলে ইসলামের মহিমা প্রচার করেন যা সর্বৈব মিথ্যা। এসব বুদ্ধিজীবী্রা এই ধরণের রায় বা ফতোয়াকে কেন ইসলাম সম্মত নয় তা বোঝাতে গিয়ে নানারূপ মনগড়া ব্যাখ্যা উপস্থাপিত করেন। আবার কখনো বলেন যে, কোরানের আয়াতের মানে সব সময় আক্ষরিক অর্থে ধরা উচিত নয়, বুঝতে হবে তার ভিতরের আসল কথাটা। ভিতরের সেই কথাটার তারা যা বর্ণনা দেয় তা তাদের সম্পূর্ণ মমগড়া। এ জাতীয় মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা একদম ভণ্ড। স্ত্রীকে প্রহার করা প্রসঙ্গে ভন্ড বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্য হলো, কোরানের ‘প্রহার কর’ শব্দবন্ধটিকে আক্ষরিক অর্থে নয়, বিচার করতে হবে প্রতিকী অর্থে। তাদের অভিমত হলো, আলেম সমাজ কোরানের অনেক আয়াতের অন্তর্নিহিত অর্থ সঠিকভাবে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্যে শরিয়তি আইনে অনেক ত্রুটি রয়েছে যা ইসলামের ভাবমূর্তিকে মলিন করছে এবং ইসলাম সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা তৈরী করছে। আরব আমীর শাহীর সংবিধানের এই আইনটি সে রকমই একটি ত্রুটি।  
 
মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ ‘পত্নীকে প্রহার’ করার কোরানের নির্দেশটিকে প্রতিকী অর্থে দেখার দাবী করেছেন। কিন্তু এই দাবীটি যে মোটেই সঠিক বা যুক্তিগ্রাহ্য নয় তা আয়াতটি ভালোভাবে অধ্যয়ন করলেই বোঝা যায়। এই আয়াতে যেটা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় তা হলো এই যে, পত্নী অবাধ্য হলে সঙ্গে সঙ্গেই যে তাকে প্রহার করতে হবে এমন নির্দেশ কোরান দেয় নি। প্রহার করার পূর্বে তাকে বোঝানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তাতে কাজ না হলে তার শয্যা বর্জন করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, তারপরেও পত্নী যদি অবাধ্য থাকে তবে সর্বশেষ উপায় হিসেবে তবে তাকে প্রহার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে পত্নীকে প্রহার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পুরুষকে একেবারে আক্ষরিক অর্থেই, মোটেই প্রতিকী অর্থে নয়।   
 
এ রকম আইন মুসলিম সমাজের বুদ্ধিজীবীদের কাছে খুবই অস্বস্তিকর ও বিব্রতকর। কারণ, আধুনিকে সমাজে এই আইনগুলি খুবই নিন্দার্হ, ঘৃণার্হ ও মানবাধিকারবিরোধী বলে চিহ্নিত। তারা যেহেতু নিজেদের প্রগতিশীল বলে দাবী করেন তাই এই কুৎসিত আইন-কানুনগুলির পক্ষে তারা দাঁড়াতে পারেন না। আবার মুসলমান সমাজে থাকতে হলে কোরানের সমালোচনাও করা যায় না। তারা মুসলমানও থাকতে চান, আবার প্রগতিশীলও সাজতে চান। কিন্তু এটা তো একেবারেই সম্ভব নয়। তাই তাদের ভন্ডামির আশ্রয় নিতেই হয়। কিন্তু আলেম সমাজ ভন্ডামির আশ্রয় নেয় না এবং এসব আইনের জন্যে তাঁরা লজ্জাবোধও করেন না। বরং কোরানের সমস্ত আইন ও নীতিমালাকে অভ্রান্ত ও চিরিন্তন বলে অকপটে বিশ্বাস করেন। শুধু যে বিশ্বাস করেন তাই নয়, আল্লাহর তৈরি সমস্ত আইন মেনে চলে বলে আত্মশ্লাঘা বোধও করেন। এবং কোরানের আইনগুলির পক্ষে তারা প্রতিনিয়ত নানা ব্যাখ্যা ও যুক্তিও তারা দিয়ে চলেছেন অক্লান্তভাবে। তাঁদের যুক্তি যে অপযুক্তি সে কথা বলা বাহুল্য। পত্নীকে প্রহার করার ইসলামি বিধির পক্ষে আলেম সমাজের যুক্তি হলো – পতির প্রতি পত্নীর আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই, কারণ আল্লাহ পুরুষকে নারীর কর্তা করে পাঠিয়েছেন এবং পুরুষ তথা পতিরাই তো তাদের পত্নীদের ভরণ-পোষণ করে। সুতরাং পতির প্রতি পত্নীর অবাধ্যতা বা অনানুগত্যতা প্রদর্শন করার কোনো অধিকার নেই। তাদের মতে, পত্নী অবাধ্য হলে তাকে বাধ্য করার জন্যে প্রয়োজনে প্রহার করাটাই তো স্বাভাবিক। সারা বিশ্বের মুসলিম সমাজের সমস্ত ধর্মগুরুগণ এই প্রশ্নে সহমত যে অবাধ্য পত্নীকে প্রয়োজনে প্রহার করতে হবে। এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানের প্রখ্যাত ধর্মগুরু মাওলানা মুহাম্মদ আলী কী বলেছে তা শোনা যাক। তিনি তাঁর বিখ্যাত পুস্তকে (The Religion of Islam: A Comprehensive Discussion of the Sources, Principles and Practices of Islam - Lahore, 1938 , p-652-653) লিখেছেন,  
              “It appears that confining (women) to the house is the first step, and it is when they repeat their evil deeds in the house, or do not submit to the authority of the husband and desert him, that permission is given to inflict corporal punishment, which is the last resort, and even if this last step does not make them mend their ways, matrimonial relations may be ended.”(দেখা যাচ্ছে যে ঘরের ভিতর নারীদের আটকে রাখা হচ্ছে প্রথম পদক্ষেপ, এবং এর পরেও যদি তারা তাদের মন্দ কাজগুলি অব্যাহত রাখে বা তাদের স্বামীর কর্তৃত্বের প্রতি তারা তাদের নত না করে ও স্বামীকে ছেড়ে চলে যায় তবে তাদের দৈহিক শাস্তি দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে যেটা হলো সর্বশেষ ধাপ, এবং এমন কি এর পরেও এই শেষ পদক্ষেপেও যদি তারা তাদের সংশোধন না করে তবে তাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক রদ করা যেতে পারে।) ( Vide: Women and the Koran, Anwar Hekmat, p-216)   
 
কোরানের ৪/৩৪ নং আয়াতে এ বিষয়ে স্পষ্ট উল্লেখ নেই যে প্রহৃত হওয়া সত্বেও যদি স্ত্রী পতির কাছে সমর্পণ না করে তা হলে কী হবে? তার উত্তরে মাওলানা মুহাম্মদ আলি তাঁর পুস্তকে লিখেছেন যে পতি তখন সেই অবাধ্য স্ত্রীকে তালাক দিয়ে তার সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কের ছেদ টেনে দেবে।  
 
স্ত্রীকে প্রহার করা নিয়ে উলামার (মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের) মধ্যে অবশ্য মতভেদ আছে , সে মতভেদ প্রহার করার মাত্রা ও ধরণ নিয়ে। এই প্রশ্নে বহু মত থাকলেও প্রধান মত হচ্ছে দুটি। প্রথম মতটি হলো - কড়া বা কঠিন প্রহার নয়, হাল্কা ধরণের প্রহার করতে হবে। দ্বিতীয় মতটি হলো – কড়া প্রহার করতে হবে, হাল্কা বা আলতো প্রহার নয়। যাঁরা প্রথম দলভুক্ত তাঁদের অভিমত হলো – হয় চড় বা থাপ্পড় মারবে , অথবা কিল বা ঘুষি মারবে; তবে সে আঘাত যেন খুব জোরের সঙ্গে না হয়। এক্ষেত্রে যেটা লক্ষ্যণীয় তা হলো, কেবল হাত দিয়ে প্রহার করার কথা বলা হয়েছে। যারা দ্বিতীয় দলভুক্ত অর্থাৎ যারা কড়া প্রহারের পক্ষে তারা প্রহার করার জন্যে লাঠি, রড ও চাবুক ব্যবহার করার বিধান দিয়েছেন। যারা হাল্কাভাবে প্রহার করা সমীচীন বলেছেন তারা কি ধরণের ‘হাল্কা প্রহার’ হবে সেটাও নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘স্ত্রীকে যতখুশী, যতক্ষণ খুশি প্রহার করা যাবে, কিন্তু প্রহারের ফলে যেন শরীরে কোনো চিহ্ন ফুটে না উঠে’। আরও বলা হয়েছে যে, প্রহারের ফলে স্ত্রীর শরীরে যদি চিহ্ন ফুটে ওঠে তবে তা সীমা লঙ্ঘন হয়েছে বলে গণ্য করা হবে এবং সেটা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আরব আমীর শাহীর শরিয়তি আইন বা সংবিধান বলা বাহুল্য যে এই মতটিকে অনুসরণ করেছে। 
 
পাঠকদের মনে প্রশ্ন বা সংশয় তৈরী হতে পারে যে ‘স্ত্রীকে প্রহার’ করা নিয়ে কোরান বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কি সত্যি এরূপ নানা মত আছে? নাকি, ইসলামকে হেয় করার জন্যে ইসলাম বিদ্বেষীদের এটা মনগড়া ও মুখরোচক অপপ্রচার? না, মোটেই এটা কারও মনগড়া অপপ্রচার নয়। এটা যে সত্য ঘটনা তার প্রমাণ কোরানের তফসীরে রয়েছে । গিরিশ চন্দ্র সেন, যিনি সর্ব প্রথম বাংলা ভাষায় কোরান অনুবাদ করে মুসলিম সমাজে খুবই খ্যাতি, সম্মান ও কৃতজ্ঞতা কুড়িয়েছিলেন, তাঁর অনুবাদ গ্রন্থে অনেকগুলি তফসীর উদ্ধৃত করেছেন পারস্য ভাষ্য-পুস্তক থেকে। সেই পুস্তকে ‘স্ত্রীকে প্রহার’ করা প্রসঙ্গে তফসীরে তিনি লিখেছেন, 
 
        “ ... নারীদিগকে এরূপ প্রহার করিবে না যাহাতে তাহাদের কোন অঙ্গ আহত ও ইন্দ্রিয় বিকৃত হয় । যাহাতে তাহাদের অন্তর কোমল হয়, তাহারা দাম্পত্যস্বত্বের সম্মান রক্ষা করিতে পারে ,প্রথমতঃ তাহাদিগকেএরূপ উপদেশ ও শিক্ষা দিবে । অবাধ্যতার আশঙ্কা হইলে উপদেশ, অবাধ্যতা প্রকাশ পাইলে ভিন্ন শয্যায় শয়ন করিতে দেওয়া,পুনঃ পুনঃ অবাধ্যতাচরণ হইলে সামান্য প্রহার বিধি ।(ত, হো,) (দ্রঃ কুরআন শারীফ/ ভাই গিরিশচন্দ্র সেন, পৃ-৮৪) ‘ত,হো’ মানে পারস্য ভাষ্য-পুস্তক “তফসীর হোসেনী”। 
 
এরপর যে প্রশ্নটা আসে তা হলো, পত্নীর কোন কোন আচরণ অবাধ্যতা বলে গণ্য হবে? এটা অনেক বড়ো বিষয় যা আলোচনার জন্যে বৃহৎ পরিসর আবশ্যক যার সুযোগ নেই, তাই সংক্ষেপে যতটা সম্ভব এটা আলোচনা করার চেষ্টা করা যাক। এটা বোঝার জন্যে সবচেয়ে বেশী সহায়ক হবে এ বিষয়ে মুহাম্মদ স্বয়ং কী বলেছেন সে কথাটা জানা। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেনঃ 
 
     “ইবনে আবু ওমর (রাঃ) রেওয়ায়েত করেছেন, আবু হোরায়রাহ (রাঃ) বলেন, রাসুলে পাক (সাঃ) এরশাদ করেছেন, কসম সে সত্তার! যাঁর হাতের মুঠোয় আমার প্রাণ। কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে নিজের শয্যায় আহ্বান করলে সে যদি আসতে অস্বীকার করে, তবে নিঃসন্দেহে যে পর্যন্ত না সে স্ত্রীর প্রতি সন্তুষ্ট হয়, সে পর্যন্ত আসমানবাসী ( ফিরিশতাগণ) তার উপর নাখোশ থাকে।” (মুসলিম শরীফ, হাঃ নং- ৩৪০৭) 
 
এরূপ হাদিস আরও বহু আছে। অর্থাৎ মুহাম্মদ যে এ কথাগুলি বলেছেন তা প্রশ্নাতীত। এ হাদিস থেকে এটা স্পষ্ট যে, পতি যখন যে মূহুর্তে স্ত্রীকে যৌন সম্ভোগের জন্যে আহ্বান করবে, স্ত্রীকে তৎক্ষণাত সাড়া দিতে হবে এবং পতির যৌন সেবায় নিয়োজিত হয়ে তাকে তুষ্ট ও তৃপ্ত করতে হবে। শারিরীক কিংবা মানসিক কিংবা অন্য কোনো অনিবার্য কারণেও পতির আহ্বানে পত্নী অসম্মতি বা আপত্তি জানাতে পারবে না। পতির যৌন আবেদন বা কামনা যতই অযৌক্তিক বা অন্যায় হোক, মুসলিম নারীকে তাতেই সাড়া দিতে হবে, কোনো অবস্থাতেই পতি অপ্রসন্ন হয় এমন কাজ সে করতে পারবে না। কেননা, আল্লাহ নারীকে তো পুরুষের সেবা করার জন্যেই সৃস্টি করেছে। স্ত্রীর কর্তব্য কী সে কথা অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ইসলামি চিন্তাবিদ ইমাম গাজ্জালি তাঁর বিখ্যাত ‘ইয়াহ্ইয়া উলুমেদ্দিন’গ্রন্থে ৯২৩৫ পৃষ্ঠায় লিখেছছেন, 
 
       “স্ত্রীর উচিৎ স্বামীকে তার নিজ সত্ত্বার চেয়েও উপরে স্থান দেয়া, এমনকি তার সকল আত্মীয়স্বজনের উপর স্থান দেয়া। সে স্বামীর জন্যে নিজেকে সদা-সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখবে যেন স্বামী তাকে যখন ইচ্ছা ভোগ করতে পারে।” ( দ্রঃ পুরুষ রচিত ধর্মে বিকলাঙ্গ নারী/ নন্দিনি হোসেন, মুক্তমনা ওয়েব সাইট)  উক্ত হাদিস এবং ইমাম গাজ্জালির উক্তি থেকে এটা স্পষ্ট যে পতির যৌন আবেদনে সাড়া না দিলে তা স্ত্রীর অবাধ্যতা বলে গণ্য হবে। 
 
এর পরেও প্রশ্ন থেকে যায়, পত্নী যদি মানসিক দিক বা শারিরীক দিক থেকে বা অন্য অনিবার্য কোনো কারণে পতির যৌনসেবা করার মত অবস্থায় না থাকে এবং তজ্জনিত কারণে যদি সে পতির আহ্বানে সাড়া দিতে অসম্মত হয় এবং পতির শয্যায় না যায় তা হলে কী হবে? আল্লাহ ও তার নবী তারজন্যে কিন্তু তাকে ছাড় দেওয়ার কথা কোথাও বলে নি। অর্থাৎ কোনো অবস্থাতেই পতির শয্যায় না গিয়ে তাকে অসন্তুষ্ট করা যাবে না। সুতরাং স্ত্রী সাড়া না দিলে বা দিতে না পারলে – ঘটনা যাই হোক না কেন, তা তার অবাধ্যতা বলে গণ্য হবে। আর এই অবাধ্যতার শাস্তি হিসাবে পতিকে অধিকার (নির্দেশ ) প্রদান করা হয়েছে তার পত্নীকে প্রহার করার। এরপরেও প্রশ্ন থেকে যায় - প্রহৃত হওয়া সত্বেও যদি স্ত্রী পতির শয্যায় না যায় তা হলে কী হবে? সেক্ষেত্রে বিধান হলো পতি তখন পত্নীকে তালাক (ডিভোর্স) দেওয়ার ভীতি প্রদর্শন করবে। ভীতি প্রদর্শন করার পরেও যদি পত্নী পদতলে গিয়ে না পড়ে তা হলে কী হবে? পতি তখন তাকে বর্জন (তালাক)করবে। হ্যাঁ ,এটাই ইসলামের নির্দেশ। মাওলানা মুহাম্মদ আলী তাঁর পুস্তকে সে কথাটি স্পষ্ট করে লিখেছন যার উল্লেখ উপর করা হয়েছে। ইসলাম ধর্ম পুরুষকে নারীর উপর এই যে অসীম ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রদান করেছে তা যে ভীষণই একপেশে ও একচেটিয়া তা বলা বাহুল্য। মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ এরূপ সমস্ত শরিয়তি আইনকেই মুসলিম ধর্মগুরুদের মনগড়া এবং অনৈশ্লামিক বলে প্রচার করেন। কিন্তু প্রকৃত ও নির্মম সত্যটি হলো মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের এই অভিমতটাই মনগড়া ও অনৈশ্লামিক। এর প্রমান মেলে যেমন কোরানে , তেমনি হাদিসেও। এ প্রসঙ্গে একটা কথা উল্লেখ করা ভীষণ প্রাসঙ্গিক ও জরুরী তা হলো, স্বয়ং হযরত মুহাম্মদও তাঁর দাম্পত্য জীবনে এই একচেটিয়া ক্ষমতা, অধিকার ও কর্তৃত্ব প্রয়োগ করেছেন ও ভোগ করেছেন। তিনি তাঁর পত্নীদের তালাকের ভীতি প্রদর্শন করে বারবার তাঁর পদতলে সমর্পণ করতে বাধ্য করেছেন। না, এটা মনগড়া মিথ্যা অভিযোগ বা অপপ্রচার নয়, এর সপক্ষে ভুরি ভুরি প্রমাণ জ্বলজ্বল করছে কোরান ও হাদিসে এবং এমন কি মুহাম্মদের জীবন-চরিতেও। মুহাম্মদের দাম্পত্যজীবন সদা সুখশান্তিতে ভরপুর ছিল না, বহু অশান্তি ও কলহের ঘটনা ঘটেছিল তাঁর দাম্পত্যজীবনে। সরল ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে এটা অবিশ্বাস্য ও বেদনাদায়ক হলেও এটাই নির্মম বাস্তব ও সত্যি ঘটনা। বিভিন্ন সময়ে মুহাম্মদের স্ত্রীগণ তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন এবং তার ফলে মুহাম্মদের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীদের বহুবার কলহ-বিবাদ হয়েছে। স্ত্রীদের অসন্তোষ বা ক্ষোভগুলি প্রশমন করতে যখন ব্যর্থ হয়েছেন মুহাম্মদ তখন আল্লাহর ওহির অবতারণা করেছেন যেসব ওহিতে তাঁর স্ত্রীদের তালাক দেবার হুমকির উল্লেখ রয়েছে। এই হুমকির উল্লেখ রয়েছে কোরানের ৩৩/২৮ নং আয়াতে। আয়াতটির বঙ্গানুবাদ হলো- 
 
          “হে সংবাদবাহক, তুমি স্বীয় ভার্যাদিগকে বল, যদি তোমরা পার্থিব জীবন ও তাহার শোভা অভিলাষ করিয়া থাক তবে এস, তোমাদিগকে (তাহার) ফল ভোগ করাইব, এবং তোমাদিগকে উত্তম বিদায়ে বিদায় দান করিব।” 
 
‘উত্তম বিদায়ে বিদায় দান করিব’ – এই কথাগুলির অর্থ হলো ‘তোমাদের তালাক দিয়ে বিদায় করে দেব’। অর্থাৎ একজন স্ত্রী নয়, একাধিক স্ত্রী মুহাম্মদের প্রতি অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাঁরা এতটাই ক্ষুব্ধ ছিলেন যে মুহাম্মদের পক্ষে তা প্রশমন করা সম্ভব হয় নি এবং সে জন্যে তিনি এক মাস গৃহত্যাগ করে মসজিদে অবস্থান করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তারপরেও স্ত্রীদের ক্ষোভ প্রশমিত না হওয়ায় তিনি আল্লাহর ওহি নামিয়ে এনে তালাকের ভয় দেখিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। হ্যাঁ, ঐ আয়াতের তফসিরে এই ঘটনার বর্ণনাটি আছে। তফসীরটি এরূপঃ 
 
           “মদীনা প্রস্থানের নবম বৎসরে হজরত স্বীয় পত্নীগণ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়াছিলেন ও শপথ করিয়াছিলেন যে, এক মাস কাল তাঁহাদের সঙ্গ করিবেন না, কারণ এই যে, তাঁহারা তাঁহার সাধ্যাতীত বস্ত্রাদি প্রার্থনা করিতেছিলেন। এয়মনের বিচিত্র বসন ও মেসরের পট্ট-বস্ত্র, এবং এইরূপ অন্যান্য সামগ্রীর প্রতি তাঁহাদের লোভ হইয়াছিল। এই সকল হজরতের হস্তায়ত্ত ছিল না। তিনি তাঁহাদের কত্তৃক উত্তক্ত হইয়া তাঁহাদের সঙ্গ পরিত্যাগ করেন, এবং এক মসজ্বেদে যাইয়া বসিয়া থাকেন, ঊনত্রিশ দিবসের পর তিনি এই আয়াত প্রাপ্ত হন।” (দ্রঃ কুরআন শরীফ/গিরিশ্চন্দ্র সেন, পৃ-৪৭৬)
 
         ...   ঠিক কি কী কারণে মুহাম্মদের প্রতি এত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তা নিয়ে বিতর্ক আছে। সে কথা থাক। আমরা এখন অন্য আরও তিনটি আয়াতের প্রতি দৃষ্টিপাত করব যেখানে মুহাম্মদের দাম্পত্যজীবনে তীব্র অশান্তি ও কলহ এবং তা দমনে সেই তালাকের দাওয়াইয়েরই উল্লেখ রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো – 
 
          “হে সংবাদবাহক, ঈশ্বর তোমার জন্য যাহা বৈধ করিয়াছেন স্বীয় ভার্যাদিগের সন্তোষ প্রয়াস করতঃ তাহা কেন অবৈধ করিতেছ ?” (আয়াত নং ৬৬/১)  
 
অন্য আয়াত দুটি এরূপঃ 
 
         “তোমরা দুই জনে (হে পয়গম্বরের দুই ভার্যা ) যদি ঈশ্বরের দিকে ফিরিয়া আইস, (ভাল হয়,) অনন্তর নিশ্চয় তোমাদের অন্তর কুটিল হইয়াছে, এবং যদি তাহার প্রতি (তাহাকে ক্লেশ দানে) তোমরা পরষ্পর অনুকূল হও তবে নিশ্চয় (জানিও) সেই ঈশ্বর ও জেব্রিল এবং সাধু বিশ্বাসীগণ তাঁহার বন্ধু আছেন, অতঃপর দেবগণ সাহায্যকারী হয়। যদি সে তোমাদিগকে বর্জন করে তবে তাহার প্রতিপালক তোমাদিগ অপেক্ষা উত্তম মোসলমান বিশ্বাসিনী সাধনপরায়ণা পাপ হইতে প্রতিনিবৃত্তা অর্চনাকারিণী উপবাসব্রতিধারিণী বিবাহিতা ও কুমারী নারীদিগকে তাহাকে বিনিময় দান করিতে সমুদ্যত।” (আয়াত দুটির নম্বর হলো – ৬৬/৩, ৪) 
 
 প্রথম আয়াতটির প্রেক্ষাপট নিয়ে দুটি মত শোনা যায়। তার মধ্যে যেটি অধিক গ্রহণযোগ্য সেটা হলো এটা – 
 
        “... পরন্তু এরূপ প্রসিদ্ধ যে, হজরত হফসার বারের দিন তাঁহার গৃহে যাইতেন, একদা তিনি হজরতের আজ্ঞাক্রমে পিত্রালয়ে গিয়াছিলেন, হজরত কেবতা কুলোদ্ভবা দাসীপত্নী মারিয়াকে ডাকাইয়া নিজ সেবায় নিযুক্ত করেন। হফসা তাহা অবগত হইয়া অসন্তোষ প্রকাশ করেন। হজরত বলেন, ‘হে হফসা, যদি আমি তোমাকে নিজের সম্বন্ধে অবৈধ করি তাহাতে তুমি কি সম্মত নও’। তিনি বলিলেন ‘হ্যাঁ সম্মত’। হজরত কহিলেন, ‘এ কথা কাহারও নিকটে ব্যক্ত করিবে না, তোমার নিকট গুপ্ত রহিল’। হফসা সম্মত হইলেন। কিন্তু যখন হজরত তাঁহার গৃহ হইতে চলিয়া গেলেন, তৎক্ষণাৎ হফসা আয়েশাকে যাইয়া এই সুসংবাদ দান করিয়া বলিলেন, ‘আমরা কেবত নারীর হস্ত হইতে মুক্তি পাইয়াছি’। পরে হযরত আয়েশার গৃহে আগমন করিলে তখন আয়েষা ইঙ্গিতে এই বৃত্তান্ত বলেন। এতদুপলক্ষে এই সুরা অবতীর্ণ হয়। অর্থাৎ মারিয়াকে ঈশ্বর তোমার প্রতি বৈধ করিয়াছেন, তাহাকে কেন আপনার সম্বন্ধে অবৈধ করিয়া তুলিলে ও শপথ করিলে? ” ( দ্রঃ – প্রাগুক্ত, পৃ-৬২৮, ৬২৯) 
 
প্রকৃত ঘটনাটির অতি ক্ষুদ্র অংশ এই তফসিরে বর্ণিত হয়েছে। তাতেই এটা স্পষ্ট যে, স্বয়ং মুহাম্মদও তাঁর স্ত্রীদের বাধ্য করার জন্যে তালাকের ভয় দেখাতে দ্বিধা করেন নি। মুহাম্মদ তাঁর স্ত্রীদের বাধ্য করার জন্যে প্রহার করেছিলেন কী না জানা নেই, কিন্তু তিনি যে বারবার তালাক, আল্লাহর গজব ও ফেরেস্তাদের অভিশাপের ভয় দেখিয়েছিলেন তা নিয়ে সংশয়ের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। সুতরাং মুসলিম বুদ্দিজীবীরা যতই ভন্ডামি করুন না কেন, আরব আমির শাহীর আদালত যে শরিয়ত তথা ইসলামি আইন মেনেই রায় দিয়েছে তা সন্দেহাতীতভাবে সত্যি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, অন্যান্য ধর্মেও স্ত্রীকে প্রহার করার নির্দেশ বা বিধান রয়েছে। হিন্দু ধর্মও ব্যতিক্রম নয়। শতপথ ব্রাহ্মণের একটি শ্লোক এরূপঃ ‘তেমনি স্বামীও স্ত্রীকে পেটাবে, যাতে তার নিজের শরীর বা সম্পত্তির ওপর কোনো অধিকার না থাকে।’ ( দ্রঃ সুকুমারী ভট্টাচার্যের ‘প্রাচীন ভারতে নারী সমাজ’, পৃ-৫০) হিন্দু সমাজের বুদ্ধিজীবীগণ সাধারণভাবে এই অরুচিকর, নিকৃষ্ট ও ঘৃণ্য ধর্মীয় বিধি-বিধানগুলি আড়াল করার অপচেষ্টা না করে অকপটে তুলে ধরেন এবং এগুলি বর্জন করার নির্ভীক আহ্বান জানিয়ে হিন্দু সমাজের সংস্কার ও উন্নতি করার প্রয়াস করেন। অন্যান্য সমস্ত ধর্মীয় সমাজেও অনুরূপ ধারাবাহিক সাধু প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। ব্যতিক্রম কেবলই মুসলিম সমাজ। এ সমাজের বুদ্ধিজীবীরা এসব কুৎসিত, জঘন্য ও মানবতাবিরোধী বিধি-বিধানগুলি অস্বীকার ও আড়াল করে ইসলাম, কোরান ও মুহাম্মদকে নিয়ে অকারণ মিথ্যা বড়াই করেন। তাঁরা বোঝেন না বা বোঝার চেষ্টা করেন না যে তারফলে মুসলিম সমাজের অকল্যাণ বৈ কল্যাণ হয় না ।  
          ( প্রবন্ধটি ‘বোধোদয়’ পত্রিকায় ৭ই ডিসেম্বর’২০১০ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় )

Wednesday, November 17, 2021

নবীর দৃষ্টিকটু পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ

 

আখেরী নবী ছিলে প্রচণ্ড বিতর্কি পুরুষ আজও তিনি সমান বিতর্কিত। তিনি যে সব জন্যে বিতর্কিত চর্চিত তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো তিনি ব্যক্তিবিশেষ, জনগোষ্ঠী এবং বৃহত্তর মানবসমাজকে নানা সময় নানা উপাধি তকমা দিয়ে গেছেন উপাধিগুলো ছিলো তাঁর দিক থেকে দেওয়া পুরষ্কার যারা তাঁকে বিশ্বাস করতেন, তাঁর আনুগত্য স্বীকার করতেন এবং বিনা প্রশ্নে তাঁর নির্দেশ পালন করতেন তাদের তিনি অকাতরে বিলি করে গেছেন নানা রকম উপাধি উপাধিগুলো ছিলো প্রশংসামূলক যারা তাকে বিশ্বাস করত না, তাঁকে নবী বলে স্বীকার করতো না, তাঁর কাজকর্মের সমালোচনা বিরোধিতা করতো তাদের মন ভরে দিতেন নানা রকম তকমা যাতে থাকতো নিন্দা, অশ্রাব্য কুৎসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা, অভিশাপ ইত্যাদি  

সাহাবী আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি নবীর পক্ষপাতিত্ব

 

আখেরী নবী নানান ধরণের উপাধি যা বিলিয়েছেন তা শুধু তাঁর সাহাবী এবং আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে আমরা প্রথমে লক্ষ্য রাখবো তিনি দুহাত খুলে কাদের মধ্যে কী কী উপাধি বিতরণ করে গেছেন যারা তাঁর কাছ থেকে নানান ধরণের উপাধি বা পুরষ্কার পেয়েছেন তাদের মধ্যে কয়েকজন বিশেষ উল্লেখযোগ্যরা ছিলেন ১ম খলিফা আবু বকর, ২য় খলিফা ওমর, ৪র্থ খলিফা আলি, খালিদ, নবীর কনিষ্ঠ কন্যা বিবি ফতেমা, নবীর দুই নাতি হাসান হোসেন প্রমুখ  

১ম খলিফা আবু বকরঃ আবু বকরের পুরো নাম আবু বকর বিন আবি কুহাফা তিনি ছিলেন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি যিনি আখেরি নবীর ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন তিনি ছিলেন আখেরী নবীর শ্বশুরও তাঁকে আখেরী নবী সিদ্দিকী উপাধি দিয়েছিলেনসিদ্দিকীমানে বিশ্বাসী আখেরী নবীর মিরাজ সফরের দাবিকে কোরেশগণ ভণ্ডামি বলে প্রত্যাখান করেছিলো এমনকি নবীর অনুগামী বিশ্বাসী মুসলিমরাও মিরাজ সফর নিয়ে সন্দিহান ছিলো তখন নবীর সেই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি বলেছিলেন, আমি আল্লাহ্ নামে শপথ নিয়ে বলছি নবীর মিরাজ সফর একশভাগ  সত্যি সন্দেহাতীত তারপর একে একে অন্যান্য মুসলিমরা মিরাজ সফরকে সত্যি বলে সাক্ষ্য দিয়েছিলো এই ঘটনার পরেই নবী আবু বকরকেসিদ্দিকউপাধিতে ভূষিত করেন তখন থেকে তাঁর নাম হয় আবু বকর সিদ্দিকী

২য় খলিফা ওমরঃ ওমরের পুরো নাম ওমর বিন খাত্তাব তিনি ছিলেন ভীষণ গোঁয়ার, অসম সাহসী প্রভাবশালী একজন ব্যক্তিত্ব তিনিও ছিলেন নবীর শ্বশুর তিনি মুসলিম হওয়ার আগে পর্যন্ত নবী তাঁর অনুগামীরা প্রকাশ্যে নামাজ পড়তো না তিনি মুসলিম হওয়ার পরেই নবীকে প্রকাশ্যে নামাজ পড়ার জন্যে সাহস দেন এবং তখন থেকেই মুসলিমরা প্রকাশ্যে নামাজ পড়া শুরু করে ওমরের ইসলাম ধর্মে অন্তর্ভুক্তি এভাবে ইসলামের অগ্রগতি উত্তরণের ইতিহাসের ক্ষেত্রে একটি নতুন যুগ বা অধ্যায়ের সূচনা করে আখেরী নবী সেজন্যে তাঁকে ফারুক; উপাধিতে ভূষিত করেনফারুকশব্দের অর্থ হলো সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী  

৪র্থ খলিফা আলিঃ আলির পুরো নাম আলি বিন আবু তালিব তিনি ছিলেন নবীর আপন চাচাতো ভাই পরে হয়েছিলেন নবীর জামাতা তিনি নবীর কাছেই প্রতিপালিত হন নবী যখন তাঁর নবুয়ত প্রাপ্তির দাবি করেন তখন আলি ছিলেন একজন অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালক সেই অপ্রাপ্ত বয়সেই তিনি ইসলামে দীক্ষা নিয়ে মুসলমান হন সেই সুবাদে তিনিই হলেন প্রথম মুসলমান অপ্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে তাঁকে আখেরী নবী ব্যতিক্রম হিসাবে দুদুটি উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন একটা উপাধি হলো আসাদ আল্লাহ্‌’ তথা শের--খোদা (আল্লাহ্ সিংহ) এবং আর একটি হলো জ্ঞানের দরজা আখেরী নবী বলেছিলেন, আমি জ্ঞানের নগরী হলে আলি তার দরজা অর্থাৎ এভাবেই আখেরী নবী আলিকেজ্ঞানের দরজাউপাধি দেন শিয়াদের মতে আলিকে উক্ত মহামূল্যবান উপাধির চেয়েও অনেক বড়ো পুরষ্কারে ভূষিত করে গেছেন আখেরী নবী নবী বলেছেন, আলিই হচ্ছে ভুবনে আমার পরে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ

খালিদঃ খালিদের পুরো নাম খালিদ বিন ওয়ালিদ তিনিও ছিলেন একজন সাহাবী ইসলামি রণকৌশলের দিক থেকে তিনি ছিলেন একজন বিশেষজ্ঞ সেনাপতি হিসাবেও ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ পারদর্শী অনেক কঠিন জিহাদে তিনি ইসলামকে অবিশ্বাস্য জয় এনে দিয়ে ইসলামের ইতিহাসে প্রাতঃ-স্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁর এই স্মরণীয় কৃতিত্বের জন্যে তিনিও নবীর কাছে মহামূল্যবান উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন সেটা হলো সাইফুল্লাহ তথা আল্লাহ্ তরবারি

বিবি ফাতেমাঃ ফাতেমা ছিলেন নবীর কনিষ্ঠ কন্যা তিনি ছিলেন নবীর প্রিয়তম কন্যাও বটে প্রত্যেক পিতামাতার কাছে, বিশেষ করে আল্লাহ্ নবীর কাছে, সকল সন্তানই সমান প্রিয় হওয়া বাঞ্ছনীয় একজন নবী তাঁর কোনো একজন সন্তানকে যদি অন্য সন্তানদের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন তবে সেটা তাঁর নবীত্বের সঙ্গে বেমানান আখেরী নবী কিন্তু বিষয়ে ছিলেন বেপরোয়া তিনি অকপটেই ফতেমাকে দিয়ে গেছেন তাঁর প্রিয়তম কন্যার মহা মর্যাদা এটাই শেষ কথা নয় আখেরী নবী ফাতেমাকে এক অতুলনীয় দুর্লভ মর্যাদা সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করে যান তাঁর মরণোত্তর জীবনে নবী বলেছেন ফাতেমা হবেন বেহেস্তের নারীদের সর্দার    

আল হাসান আল হোসেনঃ আল হাসান আল হোসেন ছিলেন বিবি ফাতেমার গর্ভজাত দুই সহদোর ভাই ইসলামের ইতিহাসে এই দুই ভাই আখেরী নবীর নয়নের মণি বলে খ্যাত আল হোসেন কারবালা যুদ্ধে ইসলামের ৬ষ্ঠ খলিফা ইয়াজিদের সৈন্যবাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়েছিলেন শান্তিপ্রিয় ভোগবিলাসী আল হাসান একান্ত ব্যক্তিস্বার্থে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত খেলাফত ৫ম খলিফা মুয়াবিয়াকে হস্তান্তর করেছিলেন এই দুই ভাইকেও তাদের নানা আখেরী নবী এক অতুলনীয় মর্যাদার আসনে বসিয়ে দিয়ে গেছেন নবী বলেছেন, তাঁরা দুই ভাই হবেন বেহেস্তের যুবদলের সর্দার 

 অমুসলিমদের প্রতি বৈরিতা

আখেরী নবী অমুসলিমদের সারা জীবন নানা কটু বিশেষণে বিদ্ধ করেছেন তাদের অকারণ দোষারোপও করেছেন তাদের ভালো কাজের মূল্য এক কানাকড়িও তাঁর কাছে ছিলো না তাদের সকলকেই জাহান্নামের আগুনে পুড়ে কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি ভোগ করার ব্যবস্থা করে গেছেন অবশ্য সবকিছুই করেছেন আল্লাহর নামে 

অমুসলিমদের মধ্যে মক্কায় অনেকেই ছিলেন তাঁর পরম হিতাকাঙ্ক্ষী হিতৈষী যারা মক্কায় নিরাপদে ধর্ম প্রচার করতে তাঁকে নানাভাবে সাহায্য করেছেন নবী তাদের প্রতিও বিরূপ মনোভাব লালন করতেন তাদের দোষ ছিল একটাই, তারা স্বধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হয় নি এক্ষেত্রে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো তাঁর আপন চাচা আবু তালিব যিনি অনাথ নবীকে পুত্র স্নেহে যেমন প্রতিপালনই করেছেন তেমনি ইসলামের প্রচারেও তাঁকে সকল আপদবিপদ থেকে সযত্নে আগলেও রেখেছেন সেই চাচাকেও জাহান্নামের আগুনে অনন্তকাল পুড়তে হবে বলে নিদান দিয়ে গেছেন এই হলো তাঁর অকৃতজ্ঞতার নমুনা নবী তাঁর মায়ের প্রতিও অনুরূপ বিশ্রী আচরণ করেছেন মায়ের কবর জিয়ারত (প্রদক্ষিণ) করার সময় মৃত মাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন যে, মা, তুমি পৌত্তলিক ছিলে বলে জাহান্নামের আগুন থেকে তোমাকে অব্যাহতি দিতে আল্লাহ্ কাছে প্রার্থনা করতে পারলাম না

শিষ্যকূল উম্মতদের প্রতি নবীর আচরণ

আখেরী নবী নিজেকে আল্লাহর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী বলে দাবি করেছেন নবীদের আগমনের হেতু সম্পর্কে যা শোনা যায় তাতে এটা স্পষ্ট যে তারা আসে সমস্ত মানুষ প্রাণীকূলের জন্যে সুতরাং নবীদের কাছে এটাই সবার প্রত্যাশা থাকবে যে তিনি হবেন একজন সত্যিকারের নিরপেক্ষ মানুষ যিনি থাকবেন স্বজনপ্রীতি, বংশপ্রীতি, গোষ্ঠীপ্রীতি ইত্যাকার যাবতীয় সংকীর্ণ বিচারধারার অনেক ঊর্ধে কিন্তু আখেরী নবীর যে পরিচয় আমরা পেয়েছি তা ভীষণ হতাশাব্যঞ্জক এবং মোটেই নবীসুলভ নয় নবুয়ত প্রাপ্তির সময় তিনি দাবি করেছিলেন যে তিনি সকলের জন্যেই এসেছেন, অর্থাৎ তিনি সবার নবী কিন্তু শেষমেশ তিনি সবার নবী থাকতে পারেন নি, তিনি ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিলেন শুধু মুসলমানদের নবী আর অমুসলমানদের শুনিয়েছেন যে তাঁর কাছে তাদের ভালো কাজের মূল্য এক কানাকড়িও নেই এবং  সবাইকে ভোগ করতে হবে জাহান্নামের কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি এভাবে প্রথমেই তিনি বিচ্যুত হয়েছেন নিরপেক্ষ ন্যায়বিচার থেকে 

যতদিন গেছে নিরপেক্ষতা ন্যায়বিচার থেকে নবীর বিচ্যুতি তত বেড়েছে সাহাবীদের (যারা প্রথম থেকেই জীবনকে বাজি রেখে তাঁর সহযোদ্ধা ছিলেন) প্রতিও এক নজরে বিচার করার নিরপেক্ষতা প্রদর্শন করার উদারতা দেখাতে পারেন নি তাদের মধ্যে ভেদাভেদ করেছেন নানা দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি তাঁর বংশ হাসেমি বংশের সাহাবীদের প্রতি যে দরদ, ভালবাসা অনুকম্পা দেখিয়েছেন তা থেকে বঞ্চিত করেছেন উমাইয়া বংশের সাহাবীদের হাসেমি বংশের সাহাবী আবু বকর, ওমর আলিকে এবং বনু মাখজুম গোত্রের সাহাবী খালিদকে নবীর পক্ষ থেকে নানা সম্মানজনক উপাধিতে ভূষিত করা হলেও উমাইয়া বংশের প্রতিনিধি সাহাবী ওসমান গণিকে তা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিলো এর কারণ একটাই, তা হলো, উমাইয়া বংশের প্রতি বংশগত বহু যুগের পুঞ্জিভূত রাগ শত্রুতাকে ত্যাগ করার ক্ষেত্রে নবীর চূড়ান্ত ব্যর্থতা  

হাসেমি বংশের সাহাবিদের মধ্যেও নিজ পর ভাগ করেছেন আখেরী নবী তিনি যখন সবে নবুয়ত লাভের দাবি করেন তখন তাঁর চাচাতো ভাই (পরে জামাতা) আলি ছিলেন নিতান্ত বালক ফলত ইসলামের একেবারে গোড়ায় ইসলামের প্রচারে বিস্তারে আলির কোনো অবদানই ছিলেন না সেই পর্বে বিরাট অবদান রেখেছিলেন আবু বকর, ওমর ওসমান গণি অথচ নবী সেই আলিকেই দেন সবচেয়ে বড়ো সম্মাননা (মানবজাতির সর্বকালের দ্বিতীয় সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বের সম্মান) অথচ গোড়া থেকেই যে দুজন (আবু বকর ওমর) ছিলেন ইসলামের প্রধান স্তম্ভ তাদেরকে নবী দেনসিদ্দিকীফারুকনামক দুটি মামুলি সম্মাননা যা আলিকে দেওয়া সম্মাননার তুলনায় বাচ্চাদের লজেঞ্চুসের ন্যায় অতিশয় তুচ্ছ, আর বেচারা ওসমানকে তো সেটাও দেন নি আলির প্রতি নবীর এই পক্ষপাতিত্ব যুগের রাজনৈতিক নেতাদের স্বজনপোষণ স্বজনপ্রীতির নিকৃষ্ট রাজনীতির সঙ্গেই কেবল তুলনীয়

না, এখানেই শেষ নয় নবী ক্ষমতার অপব্যবহার স্বজনপোষণের ক্ষেত্রে আরও এমন কিছু নজির তৈরি করে গেছেন যেগুলি আরও বেশি নিকৃষ্ট যার মধ্যে একটি নজির হলো নিম্নরূপঃ  

নবী তাঁর আপন কন্যা বিবি ফাতেমা হাতে তুলে দেন বেহেস্তের নারীদের সর্দারের সিংহাসনটি  এক্ষেত্রে তিনি একদিকে বঞ্চিত করেছেন তাঁর অন্য কন্যাদের এবং তাঁর প্রথম পত্নী খাদিজাকে এই ঘটনা প্রমাণ করে যে তিনি তাঁর সকল কন্যাদের প্রতিও সমান স্নেহ ভালবাসা প্রদর্শন করে যেতে পারেন নি না, এটা কোনো ঘটনা নয় যে ফাতেমা ইসলামের প্রচার প্রসারের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো অবদান রেখেছেন যা অন্য কন্যারা রাখতে পারেন নি আর যদি অবদানের প্রসঙ্গ ওঠে তাহলে তো খাদিজার সঙ্গে ফাতেমার তুলনা করাই যায় না তুলনা করলে সেটা হবে খাদিজাকে হেয় অপদস্থ করার শামিল কারণ, ইসলামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে নবীকে সহযোগিতা দেওয়ার প্রশ্নে ফাতেমার অবদান কার্যত ছিলো শূন্য, আর খাদিজার যা অবদান ছিলো তা এক কথায় অপরিমেয় প্রথমত, খাদিজাই ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি নবীর ধর্ম ইসলাম তাঁর নবীত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে প্রথম মুসলমান হয়েছিলেন দ্বিতীয়ত, খাদিজা একদা দীনদরিদ্র নবীকে কর্মচারী নিযুক্ত করে প্রথমে তাঁকে দয়া করুণা করেছিলেন, তারপর তাঁকে স্বামীত্বে বরণ করে তাঁকে ঈর্ষণীয় সামাজিক মর্যাদা দিয়েছিলেন তৃতীয়ত, তিনি তাঁকে বাণিজ্যিক কাজের বিশাল গুরুদায়িত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে নবুয়ত প্রাপ্তির জন্যে মাসের পর মাস ব্যাপী গুহায় বসে ধ্যান করার সুযোগ দিয়েছিলেন চতুর্থত, আর্থিক প্রাচুর্য সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তি দিয়ে একদিকে তিনি নবীকে ইসলামের প্রচার প্রতিষ্ঠায় প্রভূত সাহায্য করেছিলেন এবং অপরদিকে প্রতিপক্ষের দিক থেকে আসা বাধাবিপত্তি থেকে রক্ষা করতে বিশেষ কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিলেন এটা সর্বজন স্বীকৃত যে নবী তাঁর চাচা আবু তালেব এবং পত্নী খাদিজার সক্রিয় সমর্থন ছাড়া নবীর পক্ষে মক্কায় ইসলামের প্রচার করা একদম অসম্ভব ছিলো নিরপেক্ষভাবে বিচার বিবেচনা করলে কোনো সংশয় থাকেন যে খাদিজার সেই সম্মান মর্যাদা পাওয়া উচিত ছিলো যেটা নবী তাঁর কন্যা ফাতেমাকে দেন হ্যাঁ, বেহেস্ত বলে কিছু যদি থেকে থাকে এবং সেখানে নারীদের সর্দারের কোনো পদ বা সিংহাসন থাকে তবে তার একমাত্র উপযুক্ত নারী ছিলেন খাদিজা, অন্য কেউ নয়, ফাতেমা তো নয়ই হায়রে নবীর বিচার! সেই অযোগ্য অনুপযুক্ত ফাতেমাই বেহেস্তে নারীদের নেতৃত্ব করবে এবং তার অধীনে মাথা নত করে থাকতে হবে নবী-পত্নী খাদিজাকেও যিনি ছিলেন ইসলামের প্রথম পর্বে নবীর ডান হাত প্রধান স্তম্ভ এবং ছিলেন তাঁর সময়ের মক্কার সবচেয়ে বিত্তশালী, উচ্চ মর্যাদাশীল প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী  

আরও বেশি নিকৃষ্ট দ্বিতীয় নজিরটি নিম্নরূপঃ   

নবী বেহেস্তে যুবাদের সর্দার নামে একটি পদ বা সিংহাসন সৃস্টি করেন এবং সেখানে বসিয়ে দিয়ে যান তাঁর পরম আদরের দুই নাতি - ইমাম হাসান ইমাম হোসাইন - যারা ছিলেন সেই ফাতেমারই সন্তান এই দুই ভাইয়ের ইসলামের জন্যে এক কানাকড়িও অবদান নেই ফলত বিশেষ কোনো সম্মাননা তো দূরস্থান, সামান্য কোনো সম্মাননাই পাওয়ার যোগ্যতা তাদের ছিলো না তথাপি বেহেস্তের সর্দারের মতন বিরল সম্মানে ভূষিত হয়েছেন কারণ, তারা ছিলেন নবীর নাতি নিরপেক্ষভাবে বিচার করা হলে হাসান হোসাইনের পাওয়া সম্মাননাটা পাওয়ার ক্ষেত্রে জায়েদ ছিলো অনেক বেশি যোগ্য জায়েদ ছিলেন একদা নবীর গোলাম (ক্রীতদাস) তিনিই গোলামদের মধ্যে সবার আগে নবীর ধর্মে দীক্ষিত হয়ে মুসলমান হয়েছিলেন তাঁর সেবায় অতিশয় মুগ্ধ হয়ে নবী তাকে গোলামি থেকে মুক্ত করে দেন তথাপি তিনি নবীকে ছেড়ে তার বাবা-মার কাছে যান নি তার এরূপ ত্যাগ সেবায় মুগ্ধ হয়ে নবী তাকে এক সময় দত্তক নেন জায়েদ নবীর কামনা পূরণের জন্যে তার প্রিয় পত্নীকে (জয়নব) তালাক দেন যাকে নবী পরে বিয়ে করে তাঁর হারেমে তুলে নেন জায়েদ তার জীবনে ইসলামের বহু জিহাদে অংশ নিয়েছিলেন এবং জিহাদের ময়দানেই শত্রুপক্ষের হাতে মৃত্যু বরণ করেন এহেন জায়েদকে বাদ দিয়ে নবী তাঁর সম্পূর্ণ অযোগ্য দুই নাতিকে বেছে নিয়েছিলেন বেহেস্তের যুবদের সর্দার করার জন্যে             

   নবীর পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ এক নজরে

আল্লাহর প্রেরিত দূতের কাছে সবার এটাই প্রত্যাশা যে তিনি আল্লাহর সৃষ্টিকূলের প্রতি দরদি মরমি আচরণ করবেন কিন্তু আখেরি নবী সেই আচরণ করতে যে সম্পূর্ণ তার প্রমাণ পাওয়া গেছে উপরের আলোচনায় সেই ব্যর্থতাগুলো এক নজরে দেখার বা বোঝার জন্যে এভাবে সাজানো যেতে পারে

·         এক) নবী মুসলমানদের প্রতি চরম পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করেছেন, আর চরম শত্রুতা করেছেন অমুসলমানদের প্রতি

·         দুই) মুসলমানদের মধ্যে তাঁর নিজের বংশের (হাসেমি বংশ) সাহাবিদের প্রতি আচরণ করেছেন নিজের সন্তানের মতন, আর উমাইয়া বংশের সাহাবিদের সঙ্গে আচরণ করেছেন বৈমাত্রেয়সুলভ

·         তিন) নবী তাঁর বংশের (হাসেমি বংশের) সাহাবিদের ন্যায্য প্রাপ্য সম্মান মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করে সেগুলি বণ্টন করেছেন তাঁর পরিবারের অযোগ্য সদস্যদের মধ্যে।

·         চার) সারা বিশ্বে নিজেকে নবী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে নবী তাঁর পত্নীদের মধ্যে যার কাছে সবচেয়ে বেশি ঋণী সেই খাদিজাকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করে সেটা প্রদান করেছেন তাঁর নিজের কন্যা ফাতেমাকে ইসলামের জন্যে যার অবদান ছিলো শূন্য

·         পাঁচ) নবী তাঁর সকল কন্যার প্রতিও সমান ন্যায় বিচার দিতে পারেন নি

·         ছয়) জায়েদের মতন অনেক যুবক ছিলো যারা ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করতে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে গেছেন তাদের উপেক্ষা বঞ্চিত করে বেহেস্তের অন্যতম সেরা পুরষ্কারে ভূষিত করেছেন তাঁর নিজের দুই নাতিকে

 

 

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...