প্রথমেই
বলি যে স্বাধীনোত্তর ভারতে এবারের (২০২১) পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনটি ছিলো সব
দিক থেকেই অভূতপূর্ব ও সম্পূর্ণই ভিন্ন প্রকৃতির। নির্বাচনের ফলাফলও হয়েছে অনুরূপ প্রকৃতির
– অভূতপূর্ব ও একেবারেই ভিন্ন ধারার।
এই
নির্বাচনের আগে ও পরে এবার অনেকগুলি বিশেষ উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য আমাদের নজরে এসেছে
যা অতীতে কখনো পরিলক্ষিত হয় নি। তার মধ্যে প্রধান কয়েকটি বৈশিষ্ট্য এ রকমঃ
·
এক). এবারে ভোট হয়েছে সামগ্রিকভাবে কার্যত ধর্মীয় মেরুকরণের
ভিত্তিতে। আরও স্পষ্ট করে বললে হিন্দু ও মুসলমান বিভাজনের ভিত্তিতে।
·
দুই). নির্বাচনের
একেবারে প্রাক্কালে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব ঘটে এবং দলটি অতি দ্রুত বঙ্গ
রাজনীতিতে চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে। এটা একটা অভূতপূর্ব ঘটনা।
·
তিন). এই প্রথম
একজন মুসলিম ধর্মগুরুকে (পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী) শাসকদলের মোল্লাতোষণের বিরুদ্ধে
এবং ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে রাজনীতির ময়দানে অবতীর্ণ হতে দেখা গেলো।
·
চার). পশ্চিমবঙ্গ
বিধানসভায় আগামী পাঁচ বছরের জন্যে এই প্রথম একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হলো যেখানে বাম ও
কংগ্রেস সহ তৃতীয় কোনো ধর্মনিরপেক্ষ দলের কণ্ঠস্বর (দু’জন বিধায়কের ব্যতিক্রমী উপস্থিতি
বাদ দিলে) ধ্বনিত হবে না।
·
পাঁচ). পশ্চিমবঙ্গ
এই প্রথম দ্বিদলীয় শাসনব্যবস্থায় ঢুকে পড়লো যা পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে লজ্জা ও গণতন্ত্রের
পক্ষে অশনি সংকেতও বটে।
এবার কোনো রাডার যন্ত্রেই বাঙালির মনের হদিস
ধরা পড়ে নি
নির্বাচনের
আগে বহু সমীক্ষা হয়েছে যাতে অনেক সংস্থায় সামিল ছিলো। প্রতিবারের মতন বুথ ফেরৎ সমীক্ষাতেও
মেতে উঠেছিল সেই সংস্থাগুলি। সমীক্ষার প্রতিযোগিতায় এবার সামিল হতে দেখা গিয়েছে মূল
ধারার সংবাদ মাধ্যম ছাড়াও অনেক ছোট ছোট অনামী সোশ্যল মিডিয়াকেও। রাজনৈতিক দলগুলোও যথারীতি
যে যার মতন তাদের নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আগাম আভাস দিয়েছিলো। কিন্তু কারো কোনো সমীক্ষার
(নির্বাচনের আগের ও পরের দুটোরই) পূর্বাভাষই নির্বাচনী ফলাফলের ধারে কাছে পৈঁছোতে পারে
নি। নির্বাচনের প্রাক্কালে কয়েক দফার সমীক্ষায় শাসক দলের প্রত্যাবর্তনের পূর্বাভাষ
ছিলো বটে, কিন্তু তাতে শাসকদল কোনো রকমে টেনেটুনে পাশ মার্ক দিয়েছিলো মাত্র। বুথ ফেরৎ
সমীক্ষাগুলিতে ছিলো তিন রকমের পূর্বাভাষ। একদল বলেছিলো যে শাসকদল অল্প ব্যবধানে আবার
ক্ষমতায় ফিরবে, একদল বলেছিলো বিজেপি ক্ষমতায় আসতে চলেছে এবং কিছু সংস্থা বলেছিলো যে
কোনো দলই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। কিন্তু দেখা গেলো যে একটা পূর্বাভাসও মেলে
নি। শাসকদল পুনরায় ক্ষমতায় ফিরেছে, কিন্তু ফিরেছে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে, সামান্য
মার্জিনে নয়।
শাসকদলের
নেতা-নেত্রীরা নির্বাচনের আগে মুখে যাই বলুক না কেন, তাদের মধ্যেও ক্ষমতা হারানোর আশংকা
ছিলো। ছিলো বলেই দলনেত্রী নির্বাচনী প্রচারে এক সময় বাম ও কংগ্রেসের ভোটারদের কাছেও
সমর্থন চেয়েছিলেন, বলেছিলেন, বিজেপিকে আটকাতে চাইলে আপনারা আমাকে সমর্থন করুন। বিজেপি
ডাক দিয়েছিলো পরিবর্তনের। তাদের গভীর বিশ্বাস ছিলো যে তারাই ক্ষমতায় আসছে, সরকার তৈরি
করাটা শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। সংযুক্ত মোর্চাও (বামফ্রণ্ট, জাতীয় কংগ্রেস ও আব্বাস
সিদ্দিকীর আইএসএফ) ত্রিমুখী লড়াইয়ের আশা করেছিলো।
নির্বাচনী
ফলাফল কিন্তু একটা জিনিষ স্পষ্ট করে দিয়েছে যে বাংলার মানুষ যা ভেবেছিলো তা রাজনৈতিক
দলগুলো টের পায় নি। টের পায় নি দেশ বিদেশের নামিদামি ও অনামী কোনো সংবাদ মাধ্যমই। যেমন
সংযুক্ত মোর্চার নেতৃবৃন্দ ঘূণাক্ষরেও আঁচ করতে পারেন নি যে তারা বিধানসভা থেকে একেবারেই
মুছে যাবে। এটা সংবাদ মাধ্যমগুলোও আঁচ করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিজেপিও বিন্দুমাত্র টের
পায় নি যে বাংলা জয়ের স্বপ্ন তাদের মুখ থুবড়ে পড়বে। দু’শো আসন পাওয়া দূরের কথা তাদের
জয়শ্রী রামের রথ আটকে গেছে একশোরও অনেক নীচে, মাত্র সাতাত্তরেই। এ রকম লজ্জাজনক হার
হতে পারে তা তারা দুঃস্বপ্নেও ভাবে নি। মমতা ব্যানার্জীই কি ভাবতে পেরেছিলেন যে ২১৩টা
আসনে জয়লাভ করে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা তিনি পুনরায় ক্ষমতায় ফিরবেন? বাংলা কিন্তু তাঁকে এতই ঢেলে ভোট দিয়েছে বিজেপি বিধায়ক
কিনে পেছনের দরজা দিয়ে নবান্ন দখল করার ভাবনা স্বপ্পেও ভাবতে পারবে না। সুতরাং এটা
বলাই যায় যে, বঙ্গ সমাজ তার মনোভাব ও পরিকল্পনা এতটাই সংগোপনে সংরক্ষণ রেখেছিলো যে
কোনো রাজনৈতিক দল ও মিডিয়ার রাডার তার এতটুকু হদিস পর্যন্ত পায় নি।
তৃণমূল
কংগ্রেস ছাড়া সব দলেরই ভোট কমেছে
২০১১
সাল থেকে বামভূমিতে ধ্বস নামার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো তা এবারেও তা অব্যাহত থেকেছে।
জাতীয় কংগ্রেসের অবস্থাও প্রায় তাই। এই বিধানসভার নির্বাচন ছাড়া প্রত্যেকটা নির্বাচনেই
বিজেপির ভোটের হার বেড়েছে। অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটের হার ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচন
ছাড়া প্রত্যেকবারই বৃদ্ধি পেয়েছে। কার কতটা বৃদ্ধি বা হার হয়েছে তা দেখানো হয়েছে নীচের
সারণিতে।
·
নির্বাচনের
বছর -
তৃণমূল কংগ্রেস - বিজেপি
- জাতীয় কংগ্রেস - বামফ্রণ্ট
·
২০১১
বিধানসভা – ৩৮.৯% - ৪.১% - ৯.১%
-
৪১.১%
·
২০১৪
লোকসভা - ৩৯.৮% - ১০.২% - ১২.৩%
-
৩০.১%
·
২০১৬
বিধানসভা – ৪৪.৯% - ১৭% - ৯.৭%
-
২৫.৬%
·
২০১৯
লোকসভা – ৪৩.৬৯% - ৪০.৬৪% - ৪.৯%
-
৬.৪%
·
২০২১
বিধানসভা – ৪৭.৯% - ৩৮.০৯%
- ২.৯৪% - ৫.৬৬%
২০০৬
সালে বামেদের প্রাপ্ত ভোট ছিলো ৫০.৬ শতাংশ। ২০১১ এর নির্বাচনে যেবার বামফ্রণ্ট পরাস্ত
হয় সেবার এক ধাক্কায় বামভূমিতে ধ্বস নামে ৯.৫ শতাংশ ভোট। তারপর ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে
ধ্বস নামে আরও বেশী, ১০%। এভাবে ক্রমাগত ধ্বস নামতে নামতে এই বিধানসভা নির্বাচনে নেমে
এসেছে ৬% এরও নীচে। কংগ্রেসের ভূমিধ্বসও ধারাবাহিকভাবে হয়েছে (ব্যতিক্রম ২০১৪ এর লোকসভা
নির্বাচন)। এই নির্বাচনেও ভোটক্ষয়ের ধারা অব্যাহত রইলো। শুধু তাইই নয়, বাম ও কংগ্রেস
দল এবার একটা আসনেও জয়লাভ করতে পারে নি। অবস্থাটা
এতটাই শোচনীয় যে, শুধু বিধানসভা থেকে নয় বাংলার মাটিতে তাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে
উঠেছে। এটা কিন্তু শুধু তাদের পক্ষেই চিন্তাজনক নয়, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষেও
বেশ চিন্তাজনক। বিজেপির ভোটও এবার কমেছে ২.৫৯%। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পর থেকে
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত প্রতিবারই বিজেপির ভোট বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ২০১১
সালের বিধানসভায় তাদের প্রাপ্ত ভোট ছিলো ৪.১%, সেটা দশগুণ বেড়ে ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে
৪০.৬৪% এ পৌঁছে যায়। তার ফলশ্রুতিতে তারা ৪২টি আসনের মধ্যে ১৮টি জয়লাভ করে তৃণমূলের
ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করে। স্বভাবতই এই বিধানসভা নির্বাচনে নবান্ন দখলের জন্যে
সর্বশক্তি নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো।
বিধানসভা
ভোট এবার কার্যত গণভোটের চেহারা নিয়েছে
এবারের
বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল বঙ্গবাসীর সামনে অনেকগুলি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে। সব প্রশ্নের
উত্তর এ নিবন্ধে দেওয়ার পরিসর নেই। প্রশ্নগুলি তবু রাখা যেতে পারে। প্রশ্নগুলি এ রকমঃ
·
এক). উল্কার মতন
আবির্ভাব হওয়া এবং আবির্ভাবেই সাড়া ফেলে দেওয়া পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকীর ইণ্ডিয়ান সেকুলার
ফ্রণ্ট আগামী দিনেও প্রাসঙ্গিক থাকবে?
·
দুই). বামেদের
ধর্মগুরু আব্বাস সিদ্দিকীর আইএসএফ দলের সঙ্গে জোট কী বাম আদর্শের পরিপন্থী? এবং আইএসএফ
দলকে বাম-কংগ্রেস জোটে নিয়ে বামেরা ভুল করেছে?
·
তিন). কংগ্রেস
ও বামেরা কি ভবিষ্যতে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, নাকি বঙ্গ রাজনীতি থেকে মুছে যাবে?
·
চার). ২০১১ সালের
বিধানসভা নির্বাচনের পর প্রত্যেকটা নির্বাচনে বিজেপির ভোটের হার বাড়তে বাড়তে এবার কমে
গেলো কেন?
·
পাঁচ). গতো লোকসভা
নির্বাচনে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট কমেছিলো। প্রায় দশ বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে শাসকদলের
ভোট কিছুটা কমাই তো স্বাভাবিক। এবারেও যদি ভোট কমতো তবে সেটাই তো স্বাভাবিক ঘটনা হতো।
কিন্ত অন্য সব দলের ভোটের হার যখন কমলো তখন শাসকদলের ভোট বাড়লো কেনো? কোন যাদুমন্ত্রে
এমনটা হলো যেটা নিঃসন্দেহে একটি চমকপ্রদ ঘটনা?
শেষের
প্রশ্নটা নিয়েই আলোচনা শুরু করা যাক। বিজেপি দিয়েছিলো পরিবর্তনের ডাক এবং সংযুক্ত মোর্চা
বিকল্প নীতি ও কর্মসূচীর। এ কথা বলা যাবে না যে বিজেপির পরিবর্তনের ডাক কিংবা সংযুক্ত
মোর্চার বিকল্প নীতি ও কর্মসূচীর ইস্তেহার অপ্রাসঙ্গিক ছিলো। কারণ, বিগত দশ বছরের তৃণমূল
কংগ্রেসে শাসনে আমফান ও টেট দুর্নীতি সর্বোচ্চ শিখর স্পর্শ করেছিলো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য
ব্যবস্থার ভেঙে পড়া দশা, সারদা-নারদা কেলেঙ্কারী, গরু পাচার এবং বালি ও কয়লা লুট, পঞ্চায়েত
নির্বাচনে ভোট লুট, কাটমানি ও সিণ্ডিকেট রাজ, পরিযায়ী শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনতে টালবাহানা,
কলকারখানা একের পর বন্ধ হয়ে যাওয়া, কোনো নতুন শিল্প না আসা, সরকারি শূন্য পদ এবং স্কুল-কলেজে
নিয়োগ বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং সর্বোপরি শিক্ষিত বেকার যুবদের ভবিষ্যৎ ডুবে গেছে এক রাশ
চাপা ঘন অন্ধকারে। এ সকল পাহাড় প্রমাণ ব্যর্থতা ও নিরাশা ছাড়াও ছিলো রাজ্য জুড়ে সুশাসনের
বদলে প্রশাসনের সর্বস্তরে অপশাসনের চূড়ান্ত। প্রতিশ্রুতি ছিলো প্রশাসনে দলতন্ত্রের
বদলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রকে রাজনীতি মুক্ত করার। কিন্তু
সেসব কিছুই হয় নি, উল্টে সর্বক্ষেত্রেই হয়েছে আরও অবনতি। এসব নিয়ে সর্বস্তরে মানুষের
মধ্যে অসন্তোষ ও ক্ষোভও ছিলো প্রচুর, ছিলো দলের অভ্যন্তরে আদি-নব, চাওয়া-পাওয়া এবং
পাওয়া-না পাওয়ার প্রবল দ্বন্দ। মোদ্দা কথা দশ বছরেরে শাসনে জনগণের অভিজ্ঞতা সামগ্রিকভাবে
মোটেই সুখকর ছিলো না যাতে শাসকদলের ভোট বাড়তে পারে। প্রশ্ন হলো তাহলে ভোট বাড়লো কেন?
এর আগে প্রতিটি নির্বাচনে বিজেপির ভোট বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে, এবারে একেবারে মোক্ষম
সময়েই ভোট কমলো, কিন্তু কেন ? ভোট বাড়ানোর
জন্যে বিজেপির অনুকূলে যাবতীয় উপাদানই তো মজুত ছিলো, যেমন ছিলো জনগণের ব্যাপক অসন্তোষ
ও ক্ষোভ, ছিলো দলের বিপুল অর্থবল, ছিলো শাসকদলের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের বুকে কাঁপন
ধরানোর জন্যে ইডি ও সিবিআই এর মতন পরাক্রমশালী রাজনৈতিক-প্রশাসনিক হাতিয়ার, এতদসত্ত্বেও
বিজেপি ভোট বাড়িয়ে নিয়ে ক্ষমতার দখল নিতে পারলো না কেন? এই প্রশ্ন দুটিই সবচেয়ে বেশি
চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে।
সাধারণভাবে
যে কোনো ভোটে সরকারের পাঁচ বছরের কাজের সাফল্য-ব্যর্থতার ভিত্তিতেই জনগণ ভোট দিয়ে থাকে।
এবার নিশ্চয় করেই বলা যায় যে, বাঙালি ভোটার এবার ভোট দেবার আগে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের
পাঁচ বা দশ বছরের কাজের বিচার করে নি। তারা এবার আড়া-আড়ি দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে ইভিএমে
ছাপ মেরেছে। একদল চেয়েছে বিজেপিকে ক্ষমতায় দেখতে, আর একদল চেয়েছে বিজেপির ক্ষমতা দখলকে
ঠেকাতে। সংযুক্ত মোর্চার সমর্থক সহ অন্যান্য বিরোধী দলের লোকেরা দলীয় স্বার্থের উর্ধে
উঠে বিজেপিকে ঠেকানো অধিক জরুরী বলে মনে করেছে। তারা তাই চাঁদ সদাগর যেমন বাঁ হাতে
মনসার পূজা দিয়েছিলো সে রকম প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছে। এর
আগে বিগত দশ বছরে বল্গাহীন সন্ত্রাসের জন্যে বামেদের বহু সমর্থক ও অনুগামী তৃণমূল কংগ্রেসকে
হারাতে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলো। তারজন্যে বাম নেতৃত্বকে ‘বামের ভোট রামে গেছে’ বলে কটাক্ষ
শুনিতে হয়েছে। বাম ও কংগ্রেসের বহু অনুগামী এবার বিজেপিকে ঠেকাতে তৃণমূল কংগ্রেসকে
ভোট দিয়েছে বলেই এবার বিজেপির ক্রমাগত ভোট বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ধাক্কা খেয়েছে এবং ২০১৯
এর লোকসভা ভোটের তুলনায় ২.৫% (আড়াই শতাংশ) ভোট কমেছে। এবং উল্টোদিকে বাম ও কংগ্রেসের
জন্যে বিধানসভার দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। আমার বিশ্বাস বঙ্গবাসীর দেওয়া বাম ও কংগ্রেসের
জন্যে এই কঠিন শাস্তি সাময়িক। পাঁচ বছর পর এই শাস্তি তারা ফিরিয়ে নেবে।
তৃণমূল
কংগ্রেসের ভোট বৃদ্ধি এবং বিজেপির ভোট হ্রাস পাওয়ার আর একটি উল্লেখযোগ্য কারণ রয়েছে।
তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে প্রবল ক্ষোভ-বিক্ষোভ এবং তার ফলশ্রুতিতে দল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়ার
হিড়িক আমরা দেখেছি। এটা আরও তীব্রতা পায় পূর্ণাঙ্গ প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর। ফলে
দলের কয়েকজন নির্দল প্রার্থী হয়ে ভোটে দাঁড়িয়ে যায় এবং, একাংশ পরিকল্পনা করে অন্তর্ঘাত
করে নিজ নিজ কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থীকে হারানোর। কিন্তু তারাও শেষ পর্যন্ত বিজেপির
বিপদটাকেই বড়ো করে দেখে এবং তাদের দলের পক্ষেই ভোট করে।
পরিশেষে
শাসকদলের উদ্দেশ্য সবিনয়ে দুটি কথা বলি যে, প্রথমতঃ তারা যেন এটা উপলব্ধির মধ্যে রাখেন
যে বাঙালি বিপুল সংখ্যায় নিজেদের যাবতীয় অসন্তোষ ও ক্ষোভ বুকে চাপা দিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে
ঢেলে দিয়েছে তাদের জন্যে নবান্নে প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে। ফলে বিধানসভা ভোট কার্যত গণভোটের
চেহারা নিয়েছে। আর গণভোটের বিচার্য বিষয় ছিলো – বিজেপির পক্ষে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট।
প্রসঙ্গত স্মরণ করিয়ে দিই যে, রাজ্য জুড়ে স্লোগান উঠেছিলো - ‘নো ভোট টু বিজেপি’ (No Vote to BJP)। সেই ‘না’ ভোটের সৌজন্যেই তৃণমূল
কংগ্রেস তৃতীয় বার ক্ষমতায় এসেছে, তৃণমূল কংগ্রেসকে পুনর্বার ক্ষমতায় চাই বলে সবাই
কিন্তু ভোট দেয় নি। দ্বিতীয়তঃ এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, ‘নো ভোট টু বিজেপি’-র মতন
ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি বারবার আসবে না।