Wednesday, December 11, 2019

মুসলিম-মুক্ত হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্যেই CAA ও NRC


নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (CAB) রাজ্যসভায় পাস হয়ে গেলো আজ। বিলটি লোকসভায় পাস হয়েছে গত সোমবারই (৯ই ডিসেম্বর)। আর কয়েক ঘণ্টা পরই এটা রাষ্ট্রপতির অনুমোদন প্রাপ্ত হয়ে আইনে (নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ তথা CAA 2019 - এ) রূপান্তরিত হয়ে যাবে। এটি বিজেপি সরকারের বহুদিনের আকাঙ্ক্ষিত মূল লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্যে একটি প্রবল ক্ষমতাশালী মোক্ষম অস্ত্র। আর একটি মোক্ষম অস্ত্র এনআরসি তো আগে থেকেই মজুত রয়েছে। NRC (National Register of Cityzenship) তথা জাতীয় নাগরিক নিবন্ধগ্রন্থ তৈরি করার জন্যে একটা চুক্তি হয় ১৯৮৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকার এবং আসু (All Asam Students Union) ও অল আসাম গণসংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে (AAGSP)। NRC তৈরি করার সেই চুক্তিটি হয়েছিল শুধু আসামের জন্যে যার উদ্দেশ্য ছিল আসাম থেকে সমস্ত অনুপ্রবশকারীদের চিহ্নিত করে তাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করা। সেই চুক্তি অনুসারে সুপ্রিম কোর্ট NRC তৈরি করার জন্যে আসাম সরকারকে নির্দেশ প্রদান করলে ২০১৩ সালে তার কাজ শুরু হয়। তার এক বছর পরেই অর্থাৎ ২০১৪ সালে বিজেপি কেন্দ্রের ক্ষমতায় চলে আসে এবং RSS - এর পছন্দের লোক নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তার দু'বছর পরে ১৯১৬ সালে আসামেও বিজেপি সরকার তৈরি করে। NRC তৈরি করার জন্যে যখন চুক্তি হয় তখন তার লক্ষ্য ছিল জাতপাত-ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত অনুপ্রবেশকারীকে বহিষ্কার করা। কিন্তু বিজেপি সেই লক্ষ্য বদলে দেয় এবং তারা নিশানা করে শুধু মুসলিম অনুপ্রবশকারীদের প্রতি। মুখে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের কথা বললেও আসলে তারা নিশানা করেছে সমস্ত মুসলিমদেরকেই। NRC তৈরি করার কাজ শুরু করার বহু আগে থেকেই তারা প্রচার করা শুরু যে আসামে ৫০ লক্ষ বাংলাদেশী মুসলিম অনুপ্রবেশকারী রয়েছে। এদিকে পশ্চিমবঙ্গে দু'কোটি বাংলাদেশী মুসলিম অনুপ্রবেশকারী বাস করছে বলে বিজিপির নেতৃবৃন্দ তারস্বরে চিৎকার করার ঢঙে লাগাতার প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এসব প্রচার থেকে তাদের লক্ষ্য যে শুধু বাংলাদেশী মুসলিমরাই নয়, লক্ষ্য এ দেশের মুসলিমরাও তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। এটা সর্বজন বিদিত যে মুসলিমরা সবচেয়ে গরীব এবং সবদিক থেকেই পশ্চাৎপদ। তাই তাদের ধারণা ছিল যে মুসলিমদের বিশাল সংখ্যক মানুষের হাতে ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণ করার কাগজপত্র নেই এবং তাদের সহজেই অনুপ্রবেশকারী তকমা দিয়ে ভারত থেকে তাড়িয়ে দেওয়া যাবে। ধারণাটি যে মস্ত বড়ো ভুল ছিলো তা নয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকার কারণে হিন্দুরাও যে ব্যাপক সংখ্যায় NRC-র বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়ে যেতে পারে তা হয়তো তাদের ধারণার মধ্যে ছিলো না। ফলে তাদের এ ছবিটিও দেখতে হলো শুধু মুসলিমরাই নয়, লক্ষ লক্ষ হিন্দুর নামও জাতীয় নাগরিক পঞ্জিতে নেই। ৩১শে আগষ্ট NRC-র যে চূড়ান্ত তালিকা বের হয়েছে তাতে যে ১৯ লক্ষ মানুষের নাম নেই তাদের মধ্যে ১২ লক্ষই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। যে অস্ত্রটি বিজেপি সরকার প্রয়োগ করতে চেয়েছিলো জাতশত্রু মুসলমানদের উপর সেটা বুমেরাং হয়ে তাদেরকেও বিঁধেছে। এর শাস্তিও তারা পেয়ে যায় ক'দিন যেতে না যেতেই। রায়গঞ্জ ও খড়্গপুর বিধানসভার উপনির্বাচনে পরাস্ত হয় তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে যে দু'টি সেগমেন্টে (বিধানসভা নির্বাচন ক্ষেত্রে) কিছুদিন আগে হয়ে যাওয়া লোকসভা সাধারণ নির্বাচনে বড়ো ব্যবধানে এগিয়েছিলো। এই পরাজয়টা তাদের বরণ করতে হয়, কারণ রাাজবংশী সহ অন্যান্য বর্গের ব্যাপক সংখ্যক হিন্দু যারা লোকসভায় বিজেপিকে ঢেলে ভোট দিয়েছিলো তারাই NRC আতঙ্কে ঢেলে ভোট দিয়েছে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ তৃণমূল কংগ্রেসকে। তারপরই পশ্চিমবঙ্গ সহ সারাদেশে NRC প্রয়োগ করার পরিকল্পনা সাময়িক ভাবে স্থগিত রাখে এবং ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনটি সংশোধন করতে তৎপর হয়। ইতিমধ্যেই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনটি যে সংসদের দু'কক্ষেই পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছে তা শুরুতেই বলা হয়েছে। এই আইনের সাহায্যে আসামের নাগরিক পঞ্জি থেকে বাদ পড়া অহিন্দুদের ভারতের নাগরিকত্ব প্রদান করে হিন্দুদের হারানো আস্থা ফিরে পেতে চায়। মোদি সরকার এখন প্রতিবেশী তিনটি দেশ (আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ) থেকে এসে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের (মুসলমান বাদে) শরণার্থী তকমা দিয়ে অতি দ্রুত ভারতের নাগরিকত্ব দিয়ে তাদের কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্ত করতে তৎপর হবে। বলা বাহুুল্য যে ঐ একই কারণে উক্ত কারাগারে বন্দি মুসলমানদের অনন্ত কাল কারাগরেই পচতে হবে।

সঙ্ঘপরিবারের মূল লক্ষ্য

সঙ্ঘপরিবারের কর্তা হলো আরএসএস তথা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ (RSS) এবং তার রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান হলো ভারতীয় জনতা পার্টি। এছাড়াও আরএসএসের রয়েছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, দুর্গাবাহিনী ইত্যাদি আরো কয়েকটি উগ্র জাতীয়তাবাদী সাম্প্রদায়িক শাখা সংগঠন। বিরোধী দলগুলো বলছে বিজেপির নতুন নাগরিকত্ব আইন করার মূল লক্ষ্য হলো ভোটব্যাংক স্ফীত করা এবং বেকারি, আকাশ ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, দেশজুড়ে ক্রমবর্ধমান নারীর শ্লীলতাহানি ও তাদের উপর বলাৎকার ইত্যাদি জ্বলন্ত সমস্যাগুলি থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘোরানো। নতুন নাগরিকত্ব আইনে তাদের হিন্দু ভোট হয়তো বাড়বে, কিন্তু ভোট বৃদ্ধি করা কিংবা জ্বলন্ত সমস্যাগুলি থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্যেই তারা নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে গোটা দেশে এনআরসি তৈরি করতে উদ্যোগী ও তৎপর হয়েছে তা কিন্তু নয়। তারা এটা করেছে তাদের মূল লক্ষ্যে দ্রুত পৌঁছনোর জন্যে।
সঙ্ঘপরিবারের মূল লক্ষ্য হলো বিশুদ্ধ হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণ করা যে রাষ্ট্র থেকে যতদূর সম্ভব অহিন্দুদের বিতাড়িত করা। সবাইকে তাড়ানো যদি সম্ভব না হয় তবে যারা অবিতাড়িত থেকে যাবে তাদের উপর হিন্দুদের একচেটিয়া কতৃত্ব, নেতৃত্ব ও আধিপত্য চাপানো। এটা আইন করে যদি করা সম্ভবও না হয় তবে সামাজিক ভাবে বলপ্রয়োগ করে তা সম্ভব। তাদের চিন্তাধারা অনেকটা ইসলামী রাষ্ট্রের মতন। এই রাষ্ট্রগুলো কোথাও কোথাও আইন করেই অমুসলিমদের নাগরিকত্ব না দিয়ে জিম্মি (hostage) করে রেখেছে, আর কোথাও রাষ্ট্রশক্তির মদতে অমুসলিমদের উপর মুসলমানদের কতৃত্ব, নেতৃত্ব ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে।

হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের কাজ আগে থেকেই চলছে

অটলবিহারী বাজপেয়ী ছিলেন নরম হিন্দুত্বের প্রবক্তা। লালকৃষ্ণ আদবানি ছিলেন তাঁর অনুসারী। বাজপেয়ী ছিলেন প্রবল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। তাই তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন তাঁঁর সরকারের উপর আরএসএস তাদের হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের পরিকল্পনা রূপায়নের জন্যে জোর খাটাতে পারে নি। আদবানিরও ব্যক্তিত্বের জোরও ছিলো যথেষ্ট। তিনি প্রধানমন্ত্রী হলে তাই একই সমস্যার উদ্ভব হবে ভেবে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে আরএসএস আদবানির পরিবর্তে নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী করে। কারণ, তিনি ছিলেন আরএসএসের পোস্টার বয় ও বিশ্বস্ত সৈনিক।
মোদির নেতৃত্বে সেই নির্বাচনে বিজেপি লোকসভায় একাই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ফলে বিজেপি, আরএসএস ও তার শাখা সংগঠনগুলিতে মরা গাঙে জোয়ার আসার মতন পরিস্থিতি তৈরি হয়। তারা মোদি সরকার এবং বিজেপির রাজ্য সরকারগুলির মদতে ও প্রশ্রয়ে বিজেপি প্রভাবিত অঞ্চলগুলিতে পরিকল্পনা মাফিক হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের কাজ শুরু করে দেয়। শুরু করে গো-হত্যা বন্ধ ও গোরক্ষা আন্দোলন, ঘরওয়াপসি, লাভ জিহাদ, ধর্মান্তরকরণ ইত্যাদি কর্মসূচি রূপায়নের কাজ। গোরক্ষা আন্দোলনের নামে সঙ্ঘপরিবারের বাহিনী গো-বলয়ে তাণ্ডবে মত্ত হয় মুসলিমদের উপর। সেই তাণ্ডবে তারা শুধু অত্যাচার নির্যাতনের শিকারই হয় নি, কয়েকজন নিহতও হয়েছে। ঘরওয়াপসি আন্দোলন ও লাভ জিহাদের নিশানাতেও মুসলিমরাই। হিন্দুত্ববাদীদের দাবি হলো সকল ভারতীয়ই হিন্দু, কারণ যারা ভারতের মুসলিমরা ধর্মান্তরিত মুসলিম, তাদের পূর্ব পুরুষরা ছিলো হিন্দু। তাদের মুসলিম শাসকরা ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিলো। তাই তারা ঘরওয়াপসির মাধ্যমে মুসলমানদের তাদের ঘরে (হিন্দু ধর্মে) ফিরিয়ে আনতে তৎপর হয়েছে। লাভ জিহাদের কর্মসূচির নিশানা হলো মূলত মুসলিম নারী। ওদের অভিযোগ হলো মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি এই যে, তাদের ছেলের দল নানা প্রলোভনে ফুসলিয়ে হিন্দু মেয়েদের বিয়ে করে তাদের ধর্মান্তরিত করে মুসলিম বানাচ্ছে এবং তাদের দিয়ে গণ্ডায় গণ্ডায় সন্তান পয়দা করিয়ে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি করছে। এটা মুসলিমরা করে পরিকল্পনা মাফিক যার উদ্দেশ্য হলো মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে ভারতে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা করা। তাই তারা হিন্দু ছেলেদের বলছে যে তাদেরও মুসলিম মেয়েদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত করে তাদের দিয়ে গণ্ডায় গণ্ডায় সন্তান পয়দা করিয়ে হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। সেজন্যই তাদের লাভ জিহাদের কর্মসূচি। ধর্মান্তরকরণের (conversions) কর্মসূচি আর লাভ জিহাদের কর্মসূচি কিন্তু এক নয়। ধর্মান্তরকরণের কর্মসূচি অনেক বড়ো ও ব্যাপক। এই কর্মসূচির নিশানায় রয়েছে কিন্তু সকল অহিন্দুরাই, বিশেষ করে আদিবাসী ও ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টানরা। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি কেন্দ্রের ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরপরই আরএসএস ও বিজেপি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষ করে তারা যেখানে শক্তিশালী, সেসব অঞ্চলে হিন্দুত্বের অভিযান শুরু করে যার মধ্যে রয়েছে উপরোক্ত কর্মসূচিগুলি। এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি "ভাগবত-মোদি জুটির নেতৃত্বে ভারতে হিন্দুত্বের অভিযান চলছে" শিরোনামে আমার একটি লেখায়। ওটা লিখেছি ২০১৫ সালে (https://giasuddinonline.blogspot.com/2015/04/blog-post.html?m=1)  লেখাটি পরে দু'বার হালনাগাদ (update) করা হয়েছে।

সিএএ হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদী আইনই
   

বিরোধী দলগুলি এবং অরাজনৈতিক বহু ব্যক্তিত্ব প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ধর্মীয় বিভাজনের অভিযোগ এনেছেন। এই অভিযোগ যে ভিত্তিহীন বা অবাস্তব নয় তার স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে উক্ত আইনের মধ্যেই। আইনটির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও   থেকে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে যারা ভারতে এসেছে তারা শরণার্থী এবং তাদেরই শুধু ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। সেই শরণার্থীদের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজন করা হয়েছে নগ্ন ভাবেই। তার প্রমাণ হলো এই যে, তাতে মাত্র ছ'টি (হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, শিখ, জৈন ও পার্সি) ধর্ম সম্প্রদায়ের নাম রয়েছে। উল্লেখিত তিনটি প্রতিবেশী মুসলিম সমাজের প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ মানুষরাও মুসলিম মৌলবাদীদের দ্বারা অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হয়। সেই অত্যাচারে তারা কতজন নিহত হয়েছে এবং তাদের কতো জন যে হামলা ও মামলার শিকার তার ইয়ত্তা নেই। তাদের কতজন যে প্রাণ রক্ষার্থে দেশ ত্যাগ করেছে তারও ইয়ত্তা নেই। তারা যদি ভারতে এসে আশ্রয় নিয়ে থাকে তবে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যবস্থা এই আইনে নেই। শুধু আমাদের প্রতিবেশী তিনটি রাষ্ট্রেই নয়, মুসলিম সম্প্রদায়ের অসংখ্য প্রগতিশীল ও যুক্তিবাদী মানুষ রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার হয় মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী রাষ্ট্রগুলিতেও। এই দেশগুলোর মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য হলো সৌদি আরব ও ইরান। ফলে মুসলিম সম্প্রদায়ের বহু মানুষ আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলিতে আশ্রয় নিয়ে প্রাণ রক্ষা করেছে। মুসলিম সন্ত্রাসবাদীদের নৃশংস ও বর্বর অত্যাচারে ইরাক, ইরান ও নাইজেরিয়া থেকে কতো লক্ষ মানুষ ইউরোপের দেশগুলিতে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে তারও তোো ইয়ত্তা নেই। তাদের সিংহভাগই মুসলমান। মায়ানমার থেকেও লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমানও রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশত্যাগ করে বিভিন্ন দেশে গিয়ে শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এই বিপুল সংখ্যক মুসলিম শরণার্থীদের সিএএ-তে ভারতের নাগরিকত্ব প্রদান করার কথা বিবেচনা করা হয় নি। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা থেকেও ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের ফলে অসংখ্য মানুষ  ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যে এসে বসবাস করছে বহুদিন যাবৎ। তারাও তো শরণার্থী।  কিন্তু তাদের কথাও বিবেচনা করা হয় নি। কৌশলগত কারণে নাগরিকত্ব সংশোধিত আইনে হিন্দু ছাড়া আরো পাঁঁচটি ধর্ম সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করা হলেও বিজেপির আসল লক্ষ্য হিন্দুদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করা যাতে হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে হিন্দুরাষ্ট্র কায়েম করার পথ মসৃণ হয়। তারজন্যই সিএএ। সুতরাং আইনটি যে হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদী আইনই তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই।

সিএএ, এনআরসি-র নিশানা মুসলিমরাই

প্রধানমন্ত্রী বরাবরই মনে পোষেন এক কথা, আর বলেন আর এক কথা। তাঁর মনের কথা একরকম, আর মুখের কথা আরেক রকম।পরিকল্পনা করেন এক রকম আর মানুষকে বলেন আরেক রকম। এটা তাঁর এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ২০১৪ সালের নির্বাচনে শ্লোগান দেন, "সবকা সাথ, সবকা বিকাশ"। কিন্তু পুরো পাঁচ বছর সকলের সাথে ও সকলের উন্নয়নের শ্লোগান শিকেয় তুলে রেখে নি:শব্দে শনৈ শনৈ গতিতে কাজ করে গেলেন হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণ করার লক্ষ্যে। গত (২০১৯) লোকসভা নির্বাচনে আরো বড়ো বিজয় পাওয়ার পর জুড়ে দেন সবকা বিশ্বাসকেও সবকা সাথ ও সবকা বিকাশের সঙ্গে। অর্থাৎ তিনি মুসলিমদের বোঝাতে চাইলেন যে এবার তিনি তাদেরও বিশ্বাস অর্জন করার লক্ষ্যে কাজ করবেন। কিন্তু দ্বিতীয় বার অর্থাৎ গত বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েই তড়িঘড়ি দু'টি দানবীয় পদক্ষেপ নিয়ে তিনি দেশবাসীকে বুঝিয়ে দিলেন যে সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস, এসব ফালতু কথা, তাঁর আসল এজেণ্ডা হলো হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণ করাই। দানবীয় পদক্ষেপ দুটির একটি হলো জম্মু-কাশ্মীরকে ভেঙে দু'টুকরো করে তার রাজ্যের মর্যাদা হরণ করা, এবং তার বিশেষ অধিকার ও ক্ষমতা সম্বলিত ৩৭০ নং ধারা ও ৩৫এ উপধারাটি বিলোপ করা। আর দ্বিতীয় দানবীয় স্বৈরাচারী পদক্ষেপটি হলো ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনটি সংশোধন করে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন' ২০১৯ তথা সিএএ' ২০১৯ প্রণয়ন করা যেটি সম্পূর্ণ ধর্মীয় বিভেদমূলক। জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে যে পদক্ষেপটি নেওয়া হয়েছে সেটা শুধু স্বৈরাচারীই নয়, পদক্ষেপটি নেওয়ার পেছনে রয়েছে সরকারের ধর্মীয়বিদ্বেষ মূলক নিকৃষ্ট মানসিকতাও। প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুখে যাই বলুন না কেন, তাঁরা চান জম্মু-কাশ্মীরের মুসলিমদের শক্তি খর্ব করে তাদের হীনবল করে তাদের রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও নিপীড়নে নিষ্পেষিত করতে। সেই মতলবেই গতবছর ৫ই আগষ্ট মোদি-শাহ জুটি জম্মু-কাশ্মীরকে দ্বিখণ্ডিত করে তার বিশেষ অধিকার ও ক্ষমতা (৩৭০ নং ধারা ও ৩৫এ উপধারা) হরণ করা হয়েছে এবং ঠিক তার আগেই সেখানকার তিন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সমস্ত নেতা ও কর্মীদের হয় গৃহবন্দি, না হয় কারাবন্দি করা হয়েছে। আর ঠিক সেই কালা দিন ৫ই আগষ্ট থেকেই টেলিফোন সংযোগ ও ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, এবং গোটা রাজ্যটিকে মুুড়ে ফেলা হয়েছে ১৪৪ নং ধারা ও বহু জায়গায় কারফিউ জারি করে। এ সব পদক্ষেপ জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের উপর রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন, নির্যাতন ও নিষ্পেষণ চালানো ছাড়া আর কী বলা যায়?
এ প্রসঙ্গে এ কথাটাও বিশেষভাবে স্মরণীয় যে ৩৭০ নং ধারা ও তার উপধারা ৩৫এ বাতিল করা হলেও কিন্তু ৩৭১ নং ধারা ও তার উপধারাগুলোয় (৩৭১-এর ৩৭১এ থেকে ৩৭৩জে নং উপধারায়) হাত দেওয়া হয় নি, উল্টে সে ধারা-উপধারাগুলি অক্ষত রাখার ঘোষণাই দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এই ৩৭১ নং ধারার বিশেষ সাংবিধানিক ক্ষমতা ও অধিকার ভোগ করে মহারাষ্ট্র, গুজরাট সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছ'টি রাজ্য। এটা কী প্রমাণ করে যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য বলেই জম্মু-কাশ্মীরকে দ্বিখণ্ডিত করে, এবং তাকে দুটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলছেন যে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে মুসলিমদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কারণ, এই আইনে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে ভারতে আসা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার সংস্থান রয়েছে শুধু, কারো নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার কথা বলা হয় নি। হ্যাঁ, সিএএ-তে সত্যিই কারো নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার ব্যবস্থা নেই। তবুও প্রধানমন্ত্রীর এই ব্যাখ্যা ও আশ্বাসবাণী অসত্য ও প্রতারণা বৈ নয়।  এটা কেন অসত্য ও প্রতারণা তা বুঝতে হলে চোখ রাখতে হবে এনআরসি-র  উপর এবং সিএএ ও এনআরসি-কে পাশাপাশি রেখে বিচার করতে হবে। কেননা এ দুটি হলো পরষ্পরের প‍রিপূরক, একটাকে বাদ দিলে আরেকটা অসম্পূর্ণ। সিএএ ও এনআরসি পরষ্পরের পরিপূরক বলেই আসামে এনআরসি করার পর গোটা দেশে এনআরসি তৈরি করা স্থগিত রেখে মোদি সরকার তাড়াহুড়ো করে সিএএ প্রণয়ন করা হলো। আইনটি প্রণয়ন করার আগে এবং প্রণয়ন করার  সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুন:পুন ঘোষণা দেন যে আইনটি প্রণীত হলেই গোটা দেশেই এনআরসি তৈরি করা হবে এবং ২০২৪ সালের মধ্যেই তার কাজ শেষ করা হবে। আসামে এনআরসি চূড়ান্ত তালিকা বের করার পর কী পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তা আমরা সবাই জানি। ৩.২৯ কোটি লোক তালিকায় নাম নথিভুক্ত করার আবেদন করেছিল। তাদের মধ্যে ঊনিশ লক্ষ মানুষের আবেদন বাতিল হয়েছেে যাদের মধ্যে ষোলো লক্ষ মানুষই অমুসলিম। তাদের বারো লক্ষই আবার হিন্দু যা বিজেপিকে  বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে নিক্ষেপ করে। সে অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমুসলিমদের, বিশেষ করে হিন্দুদের, অভয় দেন যে তাদের কোনো ভয় বা উদ্বেগের কারণ নেই। কারণ, অনতিবিলম্বে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হবে।  তারপর নজিরবিহীন দ্রুততায় সিএএ প্রণয়ন করে প্রধানমন্ত্রী তাঁর কথা রাখেন। সুতরাং সিএএ ও এনআরসি যে পরষ্পরের পরিপূরক তা স্পষ্ট। এনআরসি অস্ত্র দিয়ে মুসলমানদের অনুুুপ্রবেশকারী তকমায় বিদ্ধ করতে গিয়ে সেই অস্ত্রে যে হিন্দুরা ঘায়েল হবে তাদের উদ্ধার করতে প্রয়োগ করা হবে সিএএ। কিন্তু সিএএ-এর সহায়তা পাবে না মুসলমানরা। সুুতরাং এটা প্রমাণ করে যে, মুসলমানদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই কারণ তাদের নাগরিকত্ব যাবে না এই ব্যাখ্যা ও আশ্বাসবাণী অসত্য ও প্রতারণাই। এগুলো আরো প্রমাণ করে যে সিএএ ও এনআরসি-র নিশানা মুুুসলিমরাই।

আশু লক্ষ্য মুসলিম-মুক্ত ভারত নির্মাণই


সিএএ ও এনআরসি-র লক্ষ্য হলো ভারতকে মুসলিম-মুক্ত রাষ্ট্রে পরিণত করা। মুসলিম-মুক্ত রাষ্ট্র মানে ভারতে একজনও মুসলমান থাকবে না তা নয়। মুসলমানরা থাকলে থাকবে এমন অল্প সংখ্যায় যাতে তাদের দরকষাকষির শক্তি না থাকে এবং তাদের রাখা হবে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে। এটা অবশ্য বিজেপির আশু লক্ষ্য। ওদের মূল লক্ষ্য হলো ভারতকে একটি বিশুদ্ধ হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র বানানো। সে রাষ্ট্রে সকল অহিন্দুদের বিতাড়িত করা সম্ভব না হলে (সম্ভব নয়ও) তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখা হবে। যারা ফ্যাসিস্ট সরকারের সমালোচনা করবে তাদের নির্মমভাবে দমন করা হবে। কীভাবে সে লক্ষ্যে তারা পৌঁছতে চায় তা আলোচনা করার জায়গা এটা নয়। সুতরাং সিএএ ও এনআরসি নিয়ে তারা যে আশু লক্ষ্য রেখেছে সে আলোচনায় ফিরে আসা যাক
আসামের এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকায় যে ঊনিশ লক্ষ মানুষের নাম ওঠে নি তাদের মধ্যে কয়েক লক্ষ যে ভারতের বৈধ নাগরিক রয়েছে তা বলা বাহুল্য। ঐ তালিকায় এরকম বহু উদাহরণ রয়েছে - স্বামীর নাম আছে কিন্তু স্ত্রীর নাম নেই, স্ত্রীর নাম আছে স্বামীর নাম নেই, ছেলের নাম আছে বাবার নাম নেই, বাবার নাম আছে ছেলের নাম নেই, বাবা-মায়ের নাম আছে তাদের সন্তানদের নাম নেই। এগুলো ছাড়াও অনেক অসঙ্গতি রয়েছে। যারা দশকের পর দশক সেনাবাহিনী, পুলিশবাহিনী, সরকারি প্রশাসন, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি ক্ষেত্রে কর্মরত থেকে দেশের সেবা করেছে তাদের বহুজনের নাম নেই। নাম নেই এমনকি দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আমেদের পরিবারের সদস্যদেরও। এটা প্রমাণ করে যে অসংখ্য বৈধ ভারতীয় নাগরিক আসামের নাগরিক পঞ্জি থেকে বাদ পড়েছে। সেই সংখ্যাটা যে কয়েক লক্ষাধিক হবে না তা কেউ হলফ করে বলতে পারবে না। কেন ভারতের বৈধ নাগরিকদের নাম ঐ তালিকায় ঠাঁই পায় নি তা বোঝার চেষ্টা করা যাক।
আসামের নাগরিক পঞ্জিতে তাদেরই নাম নথিভুক্ত করার নির্দেশ ছিল যারা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের আগে থেকেই আসামে বসবাস করছে। সেই তালিকায় নাম তোলার জন্যে যারা আবেদন করেছিল তাদের মধ্যে ঊনিশ লক্ষের আবেদন গ্রাহ্য হয় নি। এর অর্থ হলো তারা প্রামাণ্য নথিপত্র পেশ করতে পারে নি। এই না পারাদের দলে যে ভারতের বৈধ নাগরিকরাও রয়েছে সে কথা আগেই বলেছি। রয়েছে প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা অসংখ্য মানুষও যারা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের মধ্যে এসেছে। বৈধ ভারতীয় নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও, কিংবা যারা প্রতিবেশ দেশ থেকে উক্ত বেঁধে দেওয়া সময়ের আগে থেকেই ভারতে বসবাস করছে তারা এতো বিশাল সংখ্যায় কেন তাদের সপক্ষে প্রামাণ্য কাগজপত্র দেখাতে পারে নি? এই না পারাটা আমাকে অবাক করে নি।
তাদের পক্ষে প্রামাণ্য কাগজপত্র দেখাতে না পারার পেছনে রয়েছে বহুবিধ কারণ। তার মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলো দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, স্বল্প শিক্ষা ও অসচেতনতা। দারিদ্র্যের চেহারাটা ফুটে বেরিয়েছ  ভারত  সরকারের উন্ননয়ন দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীর রাজ্যসভায় পেশ করা এই রিপোর্ট যেখানে বলা হয়েছে যে আসামে দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ৩২%। আর শিক্ষার দৈনতাটি এ রকম: ২০১১ সালের আদমশুমারি রিপোর্ট অনুযায়ী স্বাক্ষরতার হার ৭৩%। এই স্বাক্ষর সম্পন্ন মানুষদের মধ্যে রয়েছে বড়ো সংখ্যক অষ্টম শ্রেণী উত্তীর্ণ বা অনুত্তীর্ণ লোকজনও। এই পরিসংখ্যান স্পষ্ট করে সেখানকার মানুষের সচেতনতার অভাব কতো প্রকট‍। আসামের জনসংখ্যা (২০১১ সালের আদমশুমারি থেকে) তিন কোটি কয়েক লক্ষ। বর্তমানে সেটা কিছু কমবেশি সাড়ে তিন কোটি। অর্থাৎ দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করা মানুষের সংখ্যা এক কোটি বারো লক্ষ। তাদের মধ্যেই রয়েছে রয়েছে লক্ষ লক্ষ গৃৃহহীন ও বাস্তুহীন। তাছাড়া লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজের সন্ধানে ভারতের এক প্রদেশ থেকে আরেক প্রদেশে গিয়ে বাস করে। আসামেও বাস করে এ রকম অসংখ্য মানুষ। উপরোক্ত দরিদ্র, বাস্তুহীন, ভিটিহীন, ভিন্ন রাজ্য থেকে কিংবা ভিন্ন দেশ থেকে ছিন্নমুল মানুষগুলো কোথায় পাবে প্রামাণ্য কাগজপত্র? সুতরাং পঞ্জি থেকে বাদ বৈধ ভারতীয় নাগরিকের সংখ্যা ঊনিশ লক্ষ হওয়াটা চমকানোর মতন সংখ্যা মোটেই নয়।
ঊনিশ লক্ষের মধ্যে যে ষোলো লক্ষ অমুসলিম রয়েছে তাদের জন্যেই প্রণীত হলো সিএএ। এই আইনের সাহায্যে যে ভারতীয়রা নাগরিকত্ব হারিয়েছে তাদের সেটা ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে যারা ২০১৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতে এসেছে তাদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে। কিন্তু জাতীয় নাগরিক পঞ্জিতে (এনআরসিতে) মুসলমানদের নাম (তারা বৈধ ভারতীয় হওয়া সত্ত্বেও)  না থাকে তারা নিশ্চিতভাবেই হবে রাষ্ট্রহীন।
আসামের নাগরিক পঞ্জি বাতিল করে নতুন করে আবার পঞ্জি তৈরি করা হবে সে কথা ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে আসাম সরকার। পঞ্জিটি বাতিল করতে চায় দুটি কারণে। প্রথমত পঞ্জি থেকে যাদের নাম বাদ গেছে তাদের ৮৪% অহিন্দু। দ্বিতীয়ত পঞ্জিছুট মাত্র মুসলিমদের সংখ্যা মাত্র তিন লক্ষ যা পঞ্জিছুটদের মোট  সংখ্যার ১৬% এর নীচে। কিন্তু ওরা চেয়েছিল ৫০ (লক্ষ) মুসলমানকে অনুপ্রবেশকারী দেখাতে। ৫০ লক্ষ লক্ষ হলো আসামের মুসলিম জনসংখ্যার ১৫/১৬%। বলা বাহুল্য যে  আসামের নাগরিক পঞ্জি ওদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে পারে নি, বরং রুষ্টই করেছে। তাই ওটা বাতিল করে আসাম সরকার নতুন একটা পঞ্জি বানাতে চায়। এটা চায় প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর স‍রকারও।
আসামে এটা যদি তারা করতে পারে তাহলে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপাবে বাকি ভারতে। তখন তাদের মুসলিম বিতাড়নের লক্ষ্যমাত্রা হবে আরও অনেক বড়ো। লক্ষ্যমাত্রাটা যদি ভারতের মুসলিমদের মোট জনসংখ্যার পঞ্চাশ/ষাট শতাংশও হয় তবুও তাতে বিষ্ময়ের কিছু থাকবে না। কারণ ভারতকে মুসলিম-মুক্ত করার স্বপ্ন পূরণে আসাম ছিল মোদি সরকারের এ্যাসিড টেস্টের প্রথম পরীক্ষাগার (Laboratory)। প্রথম প্রচেষ্টা তাদের পুরোপুরি সফলতা পায় নি। কিন্তু তাতে তারা হতোদ্যম হয় নি। বরং আরও অধিক উদ্যমী হয়েছে। তাই একদিকে আসাম সরকার নতুন জাতীয় নাগরিক পঞ্জি তৈরি করার দাবি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, অপরদিকে কেন্দ্রীয় সরকার সিএএ প্রণয়ন করেছে। এমতাবস্থায় আসামে তারা যদি নতুন পঞ্জি তৈরি করার পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের অনুমতি পেয়ে যায় (পাওয়ার সম্ভাবনাই উজ্জ্বল দেখাচ্ছে) তাহলে আসামে তাদের লক্ষ্যের  (১৬/১৭% মুসলিমকে বিতাড়ন করা)  কাছাকাছি তাদের পক্ষে পৌঁছে যাওয়া খুব কঠিন নাও হতে পারে। আর তখন তো সমগ্ৰ ভারত থেকে তাদের মুসলিম বিতাড়নের লক্ষ্যমাত্রা আসামের লক্ষ্যমাত্রা ১৬/১৭% থেকে বেড়ে ৫০/৬০% হ ওয়াটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার হবে না। গোটা দেশে এনআরসি কার্যকর করার ক্ষেত্রে বিজেপি সরকারকে আটকানো না যায় তবে কয়েক কোটি মুসলমানকে অনুপ্রবেশকারী তকমায় বিদ্ধ হয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে ঢুকতে হবে, নতুুুবা তাদের দেশের সীমানার বাইরে কোথাও নিয়ে গিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। আর তখন বাকি মুসলমানদের জিম্মি বা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রাখতে বিজেপি সরকারকে মোটেই বেগ পেতে  হবে না। আর আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ ভারত তখন তো কার্যত মুসলিম-মুক্ত ভারত হয়ে উঠবে।

                    সমাপ্ত

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...