(১)
বেড়া উৎসব আলোর
উৎসব
‘বেড়া ভাসান উৎসব’ যেটা সেটাই সংক্ষেপে ‘বেড়া উৎসব’ নামে পরিচিত । মুর্শিদাবাদ
জেলার হাজার দুয়ারীর নিকট ভাগিরথী নদীতে এই
উৎসব ধূমধাম সহকারে অনুষ্ঠিত হয় প্রতি বছর বাংলা ক্যালেণ্ডারের ভাদ্র মাসের শেষ বৃহষ্পতিবার
। ‘বেড়া’ মানে আমরা সাধারণতঃ যা বুঝি
(বাঁশের বেড়া বা কাঠের বেড়া ইংরেজী প্রতিশব্দে fence) এ বেড়া সে বেড়া নয়, এ ‘বেড়া’ হলো আসলে কলার ভেলা যে ভেলা চেপে পৌরাণিক গল্পের রূপকথার
নায়িকা বেহুলা সমুদ্র পাড়ি দিয়েছিলো মৃত লখিন্দরকে নিয়ে । ‘ভেলা’কে
আবার মুর্শিদাবাদের বাঘড়ি অঞ্চলে ‘ভুঁড়’ও বলে । আট/দশটি কলার গাছ জোড়া লাগিয়ে এটা তৈরী করা হয় । বন্যা প্লাবিত অঞ্চলে যেখানে নৌকা পাওয়া যায় না সেখানে এই ভেলা বা ভুঁড়ে
চেপেই মানুষ যাতায়াত করে । বেড়া উৎসবে যে ভেলাটি ভাসানো হয় সে ভেলাটি বিশাল আয়তনের
। আনুমানিক শতাধিক কলাগাছ দিয়ে তৈরী এই ভেলাটি । বিশাল আয়তনের এই ভেলায় থাকে বাঁশের তৈরী চারখানা নৌকা এবং অসংখ্য
প্রদীপ (প্রদীপের সংখ্যা আনুমানিক ৪০০/৫০০) । বাশের বাতা বা বাত্তি দিয়ে তৈরি করা হয় নৌকাগুলির কাঠমো । তারপর কাগজ দিয়ে মুড়ে কালো রঙ লাগিয়ে এমনভাবে তৈরী করা হয় যা দেখে কাঠের তৈরী আসল নৌকা বলে ভ্রম হবে । নৌকাগুলি বিশেষ বৈশিষ্ট সম্পন্ন যা সকলেরই
নজর কাড়তে সক্ষম । তাহলো, নৌকার এক প্রান্তটা
দেখতে হাতির মুখের মতো এবং অপর প্রান্তটি কুমিরের মুখের মতো । প্রদীপগুলি মাটির পাত্রে বসানো থাকে সারিবদ্ধভাবে । প্রদীপগুলি যাতে বাতাসে নিভে না যায় তারজন্যে সাদা
পলিথিনের ঘেরাটোপে রাখা হয় । ভেলার চারদিকে চারটি খুঁটি বসিয়
সেই খুঁটিগুলির সঙ্গে চারদিকে উপর-নীচে ৪/৫ সারি বাঁশ বা কাঠের তৈরি বাতা সেট করা থাকে ।
বাতাগুলির সঙ্গে সুতো বেঁধে প্রদীপগুলি ঝোলানো থাকে । এ ছাড়া চারটা বড়ো আকৃতির গম্বুজের খাঁচা
থাকে ভেলার চারকোনায় প্রদীপ রাখার জন্যে ।
দুটি বিশেষ প্রদীপ থাকে যার একটি সোনার এবং অপরটি চাঁদির । প্রদীপ ছাড়াও ভেলার উপরে থাকে অনেক আতসবাজি
। আতশবাজিগুলি সেট করা থাকে চারটি
খাঁচায় যেগুলি দেখতে অনেকটা কলাগাছের মতো ।
রাত্রি এগারোটা নাগাদ বেড়া ভাসান শুরু হয় । তার আগে সমস্ত প্রদীপগুলি
জ্বালিয়ে দেয়া হয় । বেড়া ভাসানো শুরু হলে অবশ্য সোনা ও চাঁদির প্রদীপ দুটি তুলে
নেয়া হয় ভেলা থেকে । ভেলার সঙ্গে ৪/৫ খানা নৌকা থাকে যেগুলির একটিতে থাকে প্রচুর
বাজি-পটকা ও আতশবাজি । বেড়া ভাসানোর অনেক আগে থেকেই ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ে একটি
সুসজ্জিত ক্যাম্প থেকে বাজি-পটকা ও আতস-বাজি ফাটানো শরু হয়ে যায় । বেড়া ভাসানো
শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ার সহযাত্রী একটি নৌকা থেকে শুরু হয় বাজি-পটকা ফাটানো । স্রোতের ভেসে যেতে থাকে আপন মনে । বেড়াটি তখন আর
শুধু কলা গাছের তৈরী একটা সাধারণ আটপৌরে ভেলা থাকে না । কয়েকশ’ প্রদীপের আলোক-সজ্জায় আর আকাশের
বুকে অসংখ্য আতসবাজির রং-বেরঙের সুদৃশ্য আলোর হরেক রকমের ফুল-মালায় ভেলাটি হয়ে উঠে যেনো আলোর একটি সুরম্য
অট্টালিকা । নদীর পার থেকে মনে হয় যেন
একটি আলোর তৈরী রাজপ্রাসাদ ভাগিরথীর বুক
চিরে ভেসে যাচ্ছে আপন আনন্দে । স্বর্গে বিশ্বাস করলে বলতাম, সে এক নয়ন জুড়ানো মন মাতানো, ভুবন ভোলানো স্বর্গীয় দৃশ্য যা বর্ণনা করা মানুষের সাধ্যের অতীত । আলোর এই রঙমহলটির যাত্রা পথ হলো হাজার দুয়ারী সংলগ্ন ইমামবারা ঘাট থেকে লালবাগ কোর্ট
ঘাট পর্যন্ত । এবারে [২০১৫] ইমামবারা ঘাটে বিখ্যাত সেই ভেলার নোঙর খুলে দেয়া হয়েছিলো রাত পৌনে এগারোটায়, ভেলাটি লালবাগ কোর্ট ঘাটের সামনে যখন পৌঁছালো তখন রাত
সোওয়া এগারোটা । আমরা ভেলার সহযাত্রী একটা নৌকায় ছিলাম, আমাদের নৌকাটি লালবাগ কোর্ট ঘাটের সামনে থেকে তাকে বিদায় জানালো । আমরা
নৌকার মটর এবার চালিত ইঞ্জিন সক্রিয় হলো, আমরা ফিরিতে শুরু করলাম যেখান থেকে ভাসান
শুরু হয়েছিলো সেখানে । আমরা পিছন ফিরে দাঁড়ালাম এবার আলোর সেই নয়নাভিরাম আলোর
তাজমহলটি পুনরায় অবলোকন করার জন্যে । ধীরে ধীরে দূর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, কিন্তু
চোখ তবু আমরা সরাতে পারছিনা । বেড়া উৎসব
দেখে যা মনে হলো, এটা আসলে আলোর উৎসব । সে উৎসব এক সার্বজনীন উৎসব । ইমামবারা ঘাট
থেকে থেকে লালবাগ কোর্ট ঘাট (দেড় থেকে দু’
কিলো মিটার) ব্যাপী ভাগিরথীর দুই তীরে লোকে লোকারণ্য, শুধু লোক আর লোক । সবাই মেতে
উঠেছে আলোর উৎসবে ।
(২)
পটভূমিঃ ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার
বাড়ি থেকে মাত্র চল্লিশ কি.মি.
দূরের আলোর এই সার্বজনীন বেড়া উৎসবটি এর আগে দেখা হয়ে ওঠে নি । এবার যখন যাবো ঠিক
করলাম তখন যতোটা না দেখার আগ্রহ ছিলো তার চেয়ে বেশী কৌতূহল ছিলো জানার এর ইতিহাস ।
তাই যাওয়ার আগে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা
করেছিলাম সে ইতিহাস । খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেলো,
বেড়া উৎসব নিয়ে প্রামাণ্য ইতিহাস বলতে যা বোঝায় তা পাওয়া
দুষ্কর, তবে এর উপর অনেক লোককথা প্রচলিত আছে । সে রকম দু’টো লোককথা শোনালো আমার হাই
স্কুলের একজন সহপাঠী যে সরকারি নবাব বাহাদুর হাই স্কুলে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছিলো
। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে এই
স্কুলটি হাজার দুয়ারী ও ইমামবারার গায়েই অবস্থিত । প্রথম লোককথাটি এ রকমঃ কোনো এক নবাব কোনো এক
সময় গুরুতর পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে মরতে
বসেছিলেন । তাঁর স্ত্রী বেগম সাহেবা তখন আল্লাহর দরবারে দোয়া করে তাঁর স্বামীর
আরোগ্য কামনা করেছিলেন । সে সময় আল্লাহর কাছে একটি মানতও করেছিলেন । বলেছিলেন যে
তার স্বামীর রোগমুক্তি ঘটলে আল্লাহর ওয়াস্তে হাজার প্রদীপের ভেলা ভাগিরথী নদীতে
ভাসাবেন । কিছুদিনের মধ্যেই নবাব সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং তাঁর স্ত্রী তখন তাঁকে সেই
মানতের বিষয়ে অবগত করান । নবাব ও বেগম উভয়েই বিশ্বাস করেন যে আল্লাহই তার অশেষ
রহমতে (দয়ায়) নবাবকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে বেগমের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে । নবাব বাহাদুর তাই সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার পর
আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে হাজার প্রদীপের একটি ভেলা অত্যন্ত জাঁকজমক সহকারে
ভাগিরথী নদীর বুকে ভাসিয়ে দেন । সেটা ছিলো ভাদ্র মাসের শেষ বৃহষ্পতিবার । তারপর
থেকেই প্রতি বছর এই দিনে একই ভাবে ভেলা
ভাসানো হয় । দ্বিতীয় লোককথাটি এরূপঃ নবাব
মুর্শিদকুলি খাঁ এই উৎসবটির প্রচলন করেছিলেন । তিনি এটা প্রবর্তন করেছিলেন
হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতি রক্ষা করার জন্যে। তাই অনেকে বিশ্বাস করে যে বেড়া উৎসব হলো সম্প্রীতির
উৎসব । দ্বিতীয় লোককথাটি খুব কম লোকই বিশ্বাস করে । কারণ, মুর্শিদকুলি খাঁ ছিলেন ধর্মান্তরিত মুসলমান এবং তীব্র
হিন্দু-বিদ্বেষী। তিনি জন্ম সূত্রে ছিলেন একজন উচ্চবর্ণের হিন্দু । ইতিহাস বলে যে ক্ষমতার লোভে স্বধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান হওয়ার পর মুর্শিদকুলি
খাঁ অসংখ্য হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছিলেন ।
হাজার দুয়ারী তথা লালবাগ গিয়ে
এবার ঘটনা চক্রে যোগাযোগ হয় মীরজাফরের আলির এক বংশধর মীর্জা আব্বাস আলির সঙ্গে যাঁকে ছোটে নবাব বলে সবাই জানে ও চেনে ।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে লালবাগে এখন যাঁরা নবাবের বংশধর আছেন তাঁরা সবাই মিরজাফর
আলির বংশধর, নবাব সিরাজের বংশধর কেউ নেই এখানে এবং নবাবের এই বংশধরগণ শিয়া সম্প্রদায় ভুক্ত । নবাব বংশের আর এক প্রতিনধির সঙ্গে যোগাযোগ ও
আলাপ হয় যিনি মুর্শিদাবাদ পৌরসভার একজন নির্বাচিত কাউন্সিলারও বটেন । তাঁদের সঙ্গে
দীর্ঘক্ষণ আলাপচারিতা হয় এবং তাঁদের কাছ থেকে আমরা জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি বেড়া ভাসান
উৎসবের ইতিহাস । তাঁদের সৌজন্যে আলাপ হয়
ইমামবারার জন্যে সরকারিভাবে নিযুক্ত ইমামের সঙ্গে যাঁর কাছ থেকেও ইতিহাসের
পরম্পরার কিছু কথা বা ঘটনা জানতে পারি । আমরা গিয়েছিলেম মীরজাফরের সমাধিস্থলে ।
সেই সমাধিস্থলে এগারো শো সমাধি আছে । সেখানে যিনি রক্ষণাবেক্ষণের মূল দায়িত্বে আছেন তিনি বেড়া উৎসবের ইতিহাস ও
প্রাসঙ্গিক অন্য কিছু বিষয়েও আলোকপাত করেন । তাঁদের মুখ থেকে যা শুনেছি তা সম্পূর্ণ অন্য কথা যার সঙ্গে পূর্ব কথিত
লোককথার কোনো মিল নেই । ছোটে নবাব আমাদের জানালেন যে বেড়া উৎসব প্রবর্তনের পশ্চাতে
দু’টি প্রধান কারণ ছিলো । সেই কারণ দু’টি বর্ণনা করার প্রাক্কালে
দু’টি ঐতিহাসিক তথ্য নিবেদন করি যেটা শুনিয়েছেন ছোটে নবাব এবং আরো অনেকেই । ঐতিহাসিক তথ্য দু’টি হলো - এক). বেড়া উৎসবের সূচনা করেছিলেন মুর্শিদকুলিখাঁ
। দুই). এ উৎসব প্রথমে শুরু হয়েছিলো ঢাকায়
১৬৯০ খৃস্টাব্দে, তার সতেরো বছর পর ১৭০৭ খৃস্টাব্দে এ উৎসব স্থানান্তরিত হয়
মুর্শিদাবাদের রাজধানী শহর লালবাগে হাজার দুয়ারীর ঘাটে। বেড়া ভাসানের পটভূমি সম্পর্কে যা যা জানা গেলো তাঁদের
জবানিতে তার কতোটা ঐতিহাসিক মূল্য আছে তা গবেষকরা বলতে পারবেন, তবে তা আমার বিচার-বুদ্ধি মতে বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে হয় ।
কারণ, বেড়া ভাসান শুরু হয়েছিলো দু’টি ভয়ঙ্কর বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেতে অলৌকিক বা
দৈব শক্তির উপর বিশ্বাস ও ভরসা রেখে । এ
যুগেও তো আমরা লক্ষ্য করছি রাজনৈতিক
নেতাদের মাচান বাবার পদতলে মাঠা ঠেকিয়ে
আশীর্বাদ নিতে, কালীঘাটে-তারাপীঠে-তিরুপতি মন্দিরে পূজো দিতে কিংবা খাজা মঈনুদ্দিন
চিস্তির দরগায় চাদর চড়াতে তাদের মনের অভিলাষ পূরণ করার জন্যে । সুতরাং আজ থেকে তিন শ’ বছরে আগে কোনো একজন নবাব দৈব শক্তির উপর ভরসা রেখে এবং তাদের
উদ্দেশ্যে নতজানু হয়ে তাদের কৃপা ভিক্ষা করার জন্যে কোনো অনুষ্ঠান বা
উৎসব প্রবর্তন করেছেন বলে যদি শোনা যায় তা অবিশ্বাস করবো কেমন করে ? এ সব কথা ছেড়ে এবার বলি কোন দু’টি বিশ্বাসের উপর
ভর করে মুর্শিদকুলি খাঁ বেড়া ভাসানের প্রবর্তন করেছিলেন । ছোটে নবাব আমাদের যা জানালেন তা সংক্ষেপে এ
রকমঃ সে সময় নদীপথে নৌকাযোগে রাজস্ব
পাঠানো হতো দিল্লির দরবারে । কিন্তু মাঝে মধ্যে সে নৌকা জলদস্যুদের কাছে লুন্ঠিত
হয়ে যেতো । নবাবকে আরো দু’টি বিপদ ভয়ানক দুশ্চিন্তায় ফেলেছিলো, তাহলো নদীর ভাঙন ও
বন্যা । এই বিপদগুলির হাত থেকে কীভাবে
রক্ষা পাওয়া যায় সেটাই ছিলো নবাবদের কাছে সব চেয়ে বড়ো প্রশ্ন । নবাব এবং তাঁর
পারিষদবর্গের মনের মধ্যে এ বিশ্বাস প্রতীত হয় যে জলের দেবতা খোয়াজ খিজির , যে কোনো কারণেই
হোক না কেনো, নবাবের প্রতি অসন্তুষ্ট হওয়ার কারণেই তাঁর উপর এ সব বড়ো বড়ো বিপর্যয় নেমে আসছে । কে এই জলের
দেবতা খোয়াজ খিজির ? এ নিয়ে দু’টো মত শোনা
গেলো । ছোটে নবাব বললেন যে ইনি হলেন পৃথিবীতে
আল্লাহর
প্রেরিত এক লাখ চব্বিশ হাজার
পয়গম্বরের একজন । মীরজাফরের সমাধিস্থলের
কেয়ারটেকার বললেন যে ইনি হলেন আল্লাহর একজন ফেরেস্তা (স্বর্গীয় দূত যে আলো বা আগুন দিয়ে
তৈরী) । খোয়াজ খিজিরকে আবার খাজা খিজির নামেও ডাকা হয় । খোয়াজ খিজিরের উপর ন্যস্ত দায়িত্ব
সম্পর্কে অবশ্য দু’জনেই একমত পোষণ করেন । তাঁদের বিশ্বাস মতে, জলের মধ্যে বা জলের
কারণে সৃষ্ট যে কোনো বিপদ থেকে মানুষকে রক্ষা করা তার দায়িত্ব ও কাজ । নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ সেই বিশ্বাসে ভর করেই খোয়াজ খিজিরকে তুষ্ট করার
জন্যে বেড়া ভাসান উৎসবের সূচনা করেছিলেন ঢাকায় ।
বেড়া ভাসানোর আগে দেবতাদের পূজা করার ঢঙে কিছু অনুষ্ঠান পালন করা হতো । সেগুলি
আজোও পালন করা হয় । ইসলামে মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ । তাই ছোটে নবাব আমাদের বারবার
স্মরণ করিয়ে দিতে ভোলেন নি যে, অনুষ্ঠানগুলো মোটেই পূজা করা নয়, সমগ্র
অনুষ্ঠানটাকে বলা হয় ‘নওয়াজ’ । অনুষ্ঠানের
মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নৌকায় সেহারা পরানো (ফুলের মালা পরানো), হালুয়া-পায়েস
রান্না করে এবং পান-খিলি বানিয়ে খোয়াজ খিজিরের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা । নবাব প্যালেস থেকে ঢাক-ঢোল ও ব্যাণ্ড বাজিয়ে বিরাট
আড়ম্বরের সঙ্গে শোভাযাত্রা বের করা হতো । শোভাযাত্রা শেষ হতো যেখানে ভেলাটি
নোঙর করা থাকতো । শোভাযাত্রায় সবার আগে হাতির পিঠে থাকতেন নবাব, তাঁর পেছনে
চারজন কর্মচারী চারটি প্রতিকী নৌকা মাথায় নিয়ে হাঁটতো, তাদের পেছনে ব্যাণ্ড
পার্টি, ব্যাণ্ড পার্টির পরে থাকতো শ’য়ে শ’য়ে প্রজা সাধারণ । এখনও বেড়া ভাসানের আগে শোভাযাত্রা
বের হয়, চারজন মানুষ চারটি নৌকা মাথায় নিয়ে শোভাযাত্রার আগে আগে ধীর পায়ে হাঁটে, তাদের অনুসরণ করে ব্যাণ্ডের
দল, তাদের পেছনে থাকে মানুষের ঢল । এখনও
হালুয়া-পায়েস রান্না করা হয় এবং পানের খিলি বানানো হয়, সেগুলো নবাবের বংশধর যারা
আছেন তাদের মধ্যে বন্টন করা হয়, তারপর শেহারা পরানো শুরু হয় নিউ প্যালেসে যেখান
থেকে শোভাযাত্রা বের করা হয় । এখন বেড়া উৎসব হয় রাজ্য রাজ্য সরকারের পরিচালনায়, তবুও নবাবি আমলের ঐতিহ্য মেনে
আনুষ্ঠানিক ‘নওয়াজ’-এর সূচনা করা হয় নবাবের বংশধরদের হাত দিয়েই । এখন সেহারা পরানোর সূচনা করেন
ছোটে নবাব মির্জা আব্বাস আলি । এবারও তিনিই সুচনা করলেন । তারপর শেহারা পরালেন আরো তিন নবাব । তারপর নবাবের অন্যান্য বংশধর ও অতিথিবর্গ । ‘নওয়াজ’ অনুষ্ঠানের শুরুতে অতিথি বরণ পর্বেও ছোটে নবাবকেই
সবার আগে বরণ করা হয় এখন, এবারেও তাই হলো । সেহেরা পরানো শেষ অতিথিদের
সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখার পর শুরু হয় শোভাযাত্রা । শোভাযাত্রাটি শেষ হয় ইমামবারা
ঘাটে যেখানে বেড়া ভাসান উৎসবের মূল আকর্ষণ বিশাল আয়তনের ভেলাটি নোঙর করে অপেক্ষমাণ
থাকে । বেড়া ভাসান শুরু হওয়ার পূর্বে ইমামবারা ঘাটে একটি সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় । সেই অনুষ্ঠানেও অতিথিদের মধ্যে ছোটে নবাবই থাকেন মধ্যমণি
। প্রতিকী নৌকা চারটি ভেলায় তুলে দেওয়ার
পর সেই অনুষ্ঠানটি শুরু করা হয় । অনুষ্ঠান শেষে ভেলাটি ভাসানোর তৎপরতা শুরু হয় এবং
সব কটা প্রদীপ জ্বালানো সম্পন্ন হলে নোঙর
খুলে দিয়ে ভেলাটি ভাসিয়ে দেওয়া হয় স্রোতের অনুকূলে, সঙ্গে সঙ্গে বাজি-পটকা ফাটতে থাকে আর আকাশে শুরু
হয়ে যায় আতসবাজির আলোর উৎসব । নদীর তীর ছাড়িয়ে যখন কলা গাছের তৈরী ভেলাটি ধীরে
ধীরে একটু একটু করে দূরে সরে যায় তখন শুরু হয় আলোর মায়াবি খেলা । তখন মানুষের
চোখে ও মনে আর ভেলাটির অস্তিত্ব থাকে না, সেটি রূপান্তরিত হয়ে যায় একটি আলোর
রাজপ্রাসাদে, রঙমহলে, স্বপ্নপুরীতে বা স্বর্গপুরীতে । আলোর স্বপ্নপুরীর সেই অসাধারণ রূপ হাজার হাজার মানুষ নদীর দুই তীরে
মন্ত্রমুগ্ধ দাঁড়িয়ে অবলোকন করতে থাকে আর
স্বপ্নপুরীটি ও তার মাথায় যে আতসবাজীর আলোর
রঙ-বেরঙের খেলা চলে তা অপার বিষ্ময়ে উপভোগ করে ।
(৩)
খোয়াজ খিজিরের গল্প
ছোটে নবাব গর্বিত কণ্ঠে আমাদের
জানালেন যে, জলের পয়গম্বর খোয়াজ খিজির নবাব মুর্শিদকুলি খাঁকে হতাশ করে নি । তাঁর
ঐকান্তিক আবেদন, নিবেদনে ও প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে খোয়াজ ফিজির নবাবকে ও তাঁর
প্রজাদের জলের বিপদ থেকে রক্ষা করেছিল এবং
আজো রক্ষা করে চলেছে । ছোটে নবাব বললেন
যে, যে বছর বেড়া ভাসানো হয়েছিলো তারপর আর
নবাবের রাজস্ব বহনকারী নৌকাকে জলদস্যুদের কবলে পড়তে হয় নি, খোয়াজ খিজির স্বয়ং
নবাবের সেই নৌকাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে গিয়ে
গন্তব্যে নিরাপদে পৌঁছে দিয়েছে । আর সেই
থেকে ভাগিরথীর দুই পাড় ভেঙে অসংখ্য জনপদ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলেও নবাবের রাজধানী
শহর লালবাগের দুই পাড় কোনোদিন ভাঙনের কবলে পড়ে নি এবং ভাগিরথীর প্লাবনে শতো শতো
গ্রাম ও লক্ষ লক্ষ একর একর আবাদি জমি প্লাবিত
হলেও লালবাগে কখনও প্লাবন হয় নি । খোয়াজ খিজির ও বেড়া ভাসানের এই মহিমার কথা শুধু
ছোটে নবাব ও নবাবের বংশধরেরা বিশ্বাস করে তাই নয়, এ বিশ্বাস বোধ হয় লালবাগ বাসীর
মনেও দৃঢ়ভাবে গেথে রয়েছে । এই একই সুর আমরা প্রতিধ্বনিত হতে শুনেছি নবাব মীরজাফরের
সমাধির কেয়ারটেকারের কণ্ঠেও । তিনিও দৃঢ়কন্ঠে আমাদের সামনে এই বিশ্বাস ব্যক্ত
করেছেন যে, জলের ফেরেস্তা খোয়াজ খিজিরই তাদের জলের যাবতীয় বিপদ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে, আর তাই লালবাগে কোনোদিন বন্যা হয় না এবং নদীর ভাঙনও
হয় না । ফেরেস্তা বা পয়গম্বর যে নামেই হোক, অলৌকিক শক্তির উপর তাঁদের এই অগাধ
বিশ্বাস আমাকে বিষ্মিত করেছে । অবাক হয়েছি এ কথা ভেবে যে, বিজ্ঞানের বিস্ময়কর
অগ্রগতির যুগেও এই শিক্ষিত মানুষেরা আজো
জানে না কেনো বন্যা হয় ও কেনো নদীর পাড় ভাঙে এবং বন্যা ও ভাঙনরোধ করা মানুষের সাধ্যের বাইরে নয় ।
খোয়াজ খিজিরের গল্পটি নেহাতই
পৌরাণিক গল্প । কিন্তু আর পাঁচটা রূপকথার গল্পের মতো এটা খুব প্রচলিত বা পরিচিত
গল্প নয় । আমি নিজেও খোয়াজ খিজিরের গল্প সম্পর্কে আগে পরিচিত ছিলাম না ।
কোরান-হাদিস ও ইসলামের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করি যথাসাধ্য, কিন্তু কোথাও খোয়াজ খিজিরের কথা পড়েছি বলে মনে পড়ে না । আমার চোখে না পড়লেও নিশ্চয় মুসলিমদের পৌরাণিক কাহিনীতে খোয়াজ খিজিরের অস্তিত্ব আছে ধরে নিয়ে বাড়ি ফিরে তার সম্পর্কে খোঁজ নেয়া
শুরু করি । খোয়াজ খিজিরের সন্ধানও পেয়ে যাই । যাদের কাছ থেকে সন্ধান পায় তাদের জিজ্ঞাসা করে জানতে পারি যে, তারা যা শুনেছে তা
মুসলিমদের ধর্মীয় জালসায় (সভায়) মাওলানাদের ওয়াজ (বক্তৃতা) থেকে । খোয়াজ খিজির সম্পর্কে মুসলিম ধর্মগুরুদের মধ্যে
দু’টি মত রয়েছে । একটি মত হলো, আল্লাহ তার
বান্দাদের অর্থাৎ মুসলমানদের রক্ষা করার জন্যে খোয়াজ খিজির নামের একজন ফেরেস্তাকে জলের
মধ্যে (নদী ও সমুদ্রে) সব সময়ের জন্যে মোতায়েন (পাহারায়) রেখেছে । মুসলমানরা জলে
কোনো বিপদে পড়লে তাকে বা আল্লাহকে স্মরণ করলে সে এসে তাদের রক্ষা করবে। দ্বিতীয়
মতে খোয়াজ খিজির একজন অসামান্য পণ্ডিত ব্যক্তি যার জ্ঞান নবীদের (আল্লাহর প্রেরিত
দূত) চেয়েও বেশী । একবার মুসা নবীকে (ইহুদি ধর্মের প্রবর্তক কাল্পনিক চরিত্র
মোসেজকে মুহাম্মদ সচেতনভাবে বিকৃত করে মুসা নবী বলে আখ্যায়িত করেন) তার
শিষ্যরা জিজ্ঞেস করছিলো যে, পৃথিবীতে সব চেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি কে ? মুসা তার
জ্ঞানের অহঙ্কার করে বলেছিলো, আমিই সব
থেকে জ্ঞানী । আল্লাহ এ কথা শুনে মুসার উপর
রুষ্ট হয়ে বলেছিলো যে, এই মুসা, তুমি সবচেয়ে জ্ঞানী নও । তোমার চেয়েও জ্ঞানী
ব্যক্তি আছে, তুমি ওমুক জায়গায় যাও, তার দেখা পাবে । সেই ব্যক্তিটির নাম খোয়াজ খিজির । মুসা নবী তখন তার কাছে গেলো এবং বললো যে, আল্লাহ বলেছে তুমি এ পৃথিবীতে
সবচেয়ে জ্ঞানী, আমি তোমার কাছ থেকে জ্ঞান আহরণ করতে এসেছি । খোয়াজ খিজির বলল যে,
ঠিক আছে, চলো আমার সাথে, কিন্তু কোনো প্রশ্ন করতে পারবে না । যদি প্রশ্ন করো তবে
তোমাকে বিদায় করে দেবো । ওরা দু’জন একটা নতুন নৌকা ভাড়া করে নদীপথে যেতে শুরু করলো ।
কিছুদূর গিয়ে খোয়াজ খিজির নৌকাটা ফুটো করে নৌকা থেকে নেমে পড়লো । তা দেখে মুসার
খুব রাগ হলো, মনে মনে ভাবলো একটা গরীব মানুষের নৌকা এভাবে বিনা কারণে ফুটো করে
দিয়ে খোয়াজ খিজির খুব অন্যায় করেছে । মুসা অতিশয় রাগবশতঃ শর্তের কথা ভুলে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তুমি নতুন নৌকাটা
ফুটো করলে কেনো ? খোয়াজ খিজির তার উত্তর না দিয়ে ক্রুদ্ধভাবে বললো, তুমি শর্ত ভাঙলে কেনো ? মুসা ভুল স্বীকার করে ক্ষমা
চেয়ে নিলো । কিছুদূর গিয়ে ওরা দেখতে পেলো একটা বাড়ির দেয়াল কাত হয়ে রয়েছে, যে কোনো সময়
পড়ে যেতে পারে । খোয়াজ খিজির তখন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দেয়ালটাকে খাড়া করে দিলো ।
বিপরীত এই কর্মটি দেখে মুসা এবার আশ্চর্য হয়ে আবারো শর্তের কথা ভুলে গিয়ে জিজ্ঞেস
করলো, একটু আগে একটা গরীব লোকের নতুন নৌকা ফুটো করে তার সর্বনাশ করলে, আর এবার একজনের
দয়াবানের রূপ দেখালে, এর মাহাত্ম কী ? খোয়াজ খিজির এবার তাকে পুনরায় প্রশ্ন করায়
আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো এবং বললো, আর একটা প্রশ্ন করলে তোমাকে বিদায় করে দেবো । মুসা
কিন্তু তৃতীয় একটি ঘটনায় আবারও কৌতূহল বশে খোয়াজ খিজিরকে প্রশ্ন করে বসে । খোয়াজ ফিজির
তখন মুসাকে বিদায় করে দেয় । বিদায় করার
আগে অবশ্য প্রশ্নগুলির উত্তর জানিয়ে দিয়েছিলো । প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলো,
এখানকার সম্রাট (সম্ভবত ফেরাউন) খুবই স্বৈরাচারী । নতুন নৌকা দেখলে তার সৈন্যরা নৌকাটা নিয়ে নিতো বলে
নৌকাটা ফুটো করে দিয়েছি । যার নৌকা সে পরে ফুটোটা মেরামত করে নিতে পারবে । দ্বিতীয়
ঘটনা প্রসঙ্গে জানায় যে, ঐ বাড়িতে একটা নাবালক ছেলে বাস করে যার পক্ষে
বাড়িটা মেরামত করা সম্ভব নয়, তাই আমি মেরামত করে দিয়েছি । তৃতীয় ঘটনাটি কী তা আমি
জানতে পারি নি ।
এই হলো খোয়াজ খিজিরের গল্প যা
পৌরাণিক গল্প বৈ নয় । কিন্তু এই গল্পকেই আজো মুসলমানদের ব্যাপক অংশই সত্য বলে বিশ্বাস করে এবং বিশ্বাস করে যে, যদি বেড়া ভাসান কোনোদিন বন্ধ
হয়ে যায় তবে লালবাগ নদী ভাঙনের কবলে পড়বে এবং হাজার দুয়ারী, ইমামবারা প্রভৃতি
ঐতিহাসিক সৌধগুলি ভাগিরথীর গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে । এই বিশ্বাস পোষণ করে বোধ হয় ঐ
অঞ্চলের অমুসলিমরাও অনেকেই ।