Wednesday, March 5, 2025

বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাইনি – চার

 

দ্বিতীয় অধ্যায়

শেখ হাসিনার পতন ও পলায়ন পরবর্তী মুহূর্তগুলো  

৫ই আগষ্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঢাকা লং মার্চের ডাকে গোটা দেশ থেকে লাখো লাখো ছাত্র ও জনতার ঢল নেমেছিল ঢাকার রাস্তায়। গোটা দেশের সকল রাস্তা সেদিন আকশরিক অর্থেই যেন ঢাকায় এসে  মিলে গিয়েছিল। ঢাকা শহরের লাখো মানুষের মাথায় বাঁধা বাংলাদেশের লাল সবুজের জাতীয় পতাকা ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না, রাস্তার কালো পিচ ঢাকা পড়ে গিয়েছিল জনসমুদ্রের একের পর এক উত্তাল ঢেউয়ে। তার সঙ্গে লক্ষ লক্ষ জনতার সমবেত কণ্ঠের গগনবিদীর্ণ করা ‘দফা এক, দাবি এক, হাসিনার পদত্যাগ’; ‘এক দফা এক দাবি, হাসিনা তুই কবে যাবি’; ইত্যাদি শ্লোগানে ঢাকা মহানগরীতে যেন শেষ যুদ্ধের দামামা বাজছে চারিদিকে লক্ষ লক্ষ মানুষের পদভারে কম্পিত ঢাকার সমস্ত রাজপথের গন্তব্য তখন একটাই, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবন, গণভবন। বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ওয়াকার উজ্জামান প্রধানমন্ত্রীকে যত দ্রূত সম্ভব পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার   পরামর্শ দেন। তিনি তাঁকে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তাঁর সেনাবাহিনী সন্তানসম শিক্ষার্থীদের উপর আর গুলি না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উপায়ান্তর না দেখে অগত্যা ক্ষমতার মোহ ত্যাগ করে শেখ হাসিনা তখন বিকালের পড়ন্ত বেলায় বোন রেহানাকে সঙ্গে সেনাপ্রধানের বদান্যতায় হেলিকপ্টারে চেপে দেশ ছাড়েন ভারতের  উদ্দেশ্যে।

শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই উত্তেজনা জনসমুদ্রের উত্তাল ঢেউ একের পর এক আছড়ে পড়ে পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবন তথা গণভবনে। শুরু হয় বাসভবনে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট। জনসমুদ্রের একটা অংশ ঝাঁপায় শেখ মুজিবের মূর্তির উপর লাঠি, শাবল, কোদাল, হাতুড়ি, দা প্রভৃতি যন্ত্রপাতি যা হাতের কাছে পেয়েছে তা দিয়েই মুজিবের মূর্তি ধ্বংস করার যজ্ঞে মেতে ওঠে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই তাণ্ডবলীলা চলে।   

  Following her resignation on Monday, former Bangladeshi Prime Minister Sheikh Hasina's official residence, Ganabhaban, in Dhaka was stormed by thousands of protesters who engaged in vandalism and looting.

বলা বাহুল্য যে ভয়ংকর রকমের সেই তাণ্ডবলীলা ও ধ্বংস যজ্ঞের দৃশ্য দেখেছে গোটা দুনিয়া। কারণ, বিশ্বের প্রায় সমস্ত সংবাদ চ্যানেলে সেই ঘটনাবলী সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে। ভারত সরকার, ভারতের সকল মিডিয়া, প্রচারমাধ্যম ও ভারতের মানুষ সমস্বরে তখন নিন্দার ঝড় তুলেছে সেই তাণ্ডব, লুটপাট ও ধ্বংসকাণ্ডের বিরুদ্ধে। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। মানুষের যতই ক্ষোভ ও ঘৃণা থাকুক না কেন কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না জনগণের ঐ রকম হিংসাত্মক ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড। ভারতের প্রচার মাধ্যম ও জনগণ কিন্তু শুধু নিন্দা করেই তাদের কাজ সারে নি। তীব্র নিন্দাজনক ঐ তাণ্ডব ও ধ্বংসলীলাকে তারা হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছে বাংলাদেশের আওয়ামীপন্থী মানুষ ছাড়া বাকি তাবত মানুষ এবং ৩৬ জুলাই অভ্যুত্থানকে কালিমালিপ্ত করার কাজে। ৩৬ জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে জঙ্গিবাদের উত্থান বলে টানা প্রচার চালিয়েছে। বিক্ষুব্ধ জনগণের ঐ তাণ্ডবে অংশ নেওয়াকেই তারা মুসলিম জঙ্গিবাদের জ্বলন্ত অকাট্য প্রমাণ বলে চালানোর চেষ্টা করেছে। আমাদের ভারতের সরকারী বেসরকারী ব্যাপক শক্তিধর প্রচার মাধ্যমগুলি  শুধু নিজের দেশবাসীকেই নয়, সমগ্র দুনিয়াকেই বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকে মুসলিমদের জঙ্গিঅভ্যুত্থান বলে বিভ্রান্ত ও প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে।

কথায় আছে দশচক্রে ভগবান ভূত। হ্যাঁ, সমস্বরে ভারতের গদি মিডিয়া, অন্যান্য মেইন স্ট্রীম মিডিয়া, সমস্ত সমাজ মাধ্যমের একযোগে বাংলাদেশের ছাত্র ও জনতার সফল ও ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানকে জঙ্গি-অভ্যুত্থান বলে প্রচারের তীব্র প্রাবল্যে ও জোয়ারে আমার উপরেও কিছুটা প্রভাব ফেলেছিল। ঐ যে ‘দশচক্রে ভগবান ভূত’ এর মতন অবস্থা আর কী। তবে ঐ প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। শেখ হাসিনার সরকারী বাসভবন ভাঙচুর ও লুটপাট করা এবং শেখ মুজিবের মূর্তি ভাঙার ঘটনায় যারা অংশ গ্রহণ করেছিলো তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই একটা ভালো অংশ যে উগ্রপন্থী মুসলিম তথা বর্বর দুষ্কৃতিকারী ছিল তা সংশয়াতীত। কিন্তু এটাও সংশয়াতীতভাবে সর্বৈব মিথ্যাচার যে তাণ্ডবে অংশ নেওয়া সকল মানুষগুলো ছিলো জঙ্গি বা জঙ্গিবাদের সমর্থক। প্রকৃত ঘটনা হলো ঐ তাণ্ডব ও ধ্বংসলীলা ছিল আসলে তীব্র জনরোষের ফল। দেড় দশক ধরে ভোটের নামে প্রহসন করে ক্ষমতা আঁকড়ে থেকে বিরোধী দলসহ সমগ্র জনগণের উপর তিনি চালিয়েছিলেন বর্বর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, তার সাথে তিনি ও তাঁর দলের নেতা-মন্ত্রীরা ঐ দীর্ঘ সময় জুড়ে দেশটাকে কার্যত লুট করেছেন, বিপুল অর্থ পাচার করে বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। এ সবেরই পরিণতিতে একটা নিরীহ কোটা সংস্কারের দাবির আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয় এবং গণরোষ আছড়ে পড়ে তাঁর বাসভবনে।  

নিকট অতীতেই (২০২২ সালে) তো আমরা দেখেছি কী ভয়ঙ্কর গণরোষের শিকার হয়েছিল শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি গোঠাভয় রাজাপক্ষে ও তাঁর সরকারী বাসভবন। সেদিনও তো শ্রীলঙ্কার বিক্ষুব্ধ জনগণ রাষ্ট্রপতির সরকারী বাসভবনে চালিয়েছিল ব্যাপক তাণ্ডব, চালিয়েছিল তারসঙ্গে ব্যাপক লুটপাটও। যে ঘটনা শ্রীলঙ্কার মানুষ ঘটালে গণরোষ বলে গণ্য হয় বা মান্যতা পায় সে ঘটনা বাংলাদেশে ঘটলে হয়ে যায় জঙ্গি কার্যকলাপ। এতো সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ বৈ নয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর গোটা দেশ জুড়ে লেনিন, স্ট্যালিন ও মার্কসের মূর্তি ভাঙা হয়েছিল, সাদ্দাম শাসন খতম হওয়ার পর তাঁর মূর্তি ভাঙার তাণ্ডব হয়েছিল, এরূপ ঘটনার ভুরিভুরি দৃষ্টান্ত রয়েছে বিশ্ব ইতিহাসে। সে সব ঘটনা গণরোষ বলে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছে। তাহলে বাংলাদেশে শেখ মুজিবের মূর্তি ভাঙার ঘটনা গণরোষ বলে গণ্য হবে না কেন? কেন জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের তাণ্ডব বলে ধ্বিকৃত হবে?    

শেখ হাসিনার প্রতি গণরোষের সঞ্চার হওয়ার যেমন অজস্র কারণ রয়েছে, অনুরূপভাবে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের মনে গণরোষ তৈরি হওয়ারও যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এসব নিয়ে আলোচনা হবে পরের লেখায়। ক্রমশ ....  

 

 

     

   

       

 

No comments:

Post a Comment

বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাইনি – পাঁচ

  দ্বিতীয় অধ্যায় শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবের প্রতি তীব্র গণরোষের নেপথ্যে ২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে ৩৬ দিন পর (৫ই ...