সবেই
(২৯.১২.১৭) তাৎক্ষণাৎ তিন তালাকের খাঁড়া থেকে মুসলিম নারীদের বাঁচাতে লোকসভায় একটি
বিল পাস করিয়ে নিয়েছেন। রাজ্যসভায় এখনো পেশ করা বাকি (পেস করার কথা আগামী
মঙ্গলবার, ০২.০১.২০১৮)। এর মধ্যেই আবার গতকাল
(১লা জানুয়ারী) তিনি মুসলিম নারীদের জন্যে আর একটি মস্ত বড়ো পদক্ষেপ করার
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী
নরেন্দ্র মোদি। পদক্ষেপটি
হলো হজে যাওয়ার ক্ষেত্রে
মুসলিম নারীদের প্রতি বহু যুগ ধরে চলে আসা
বৈষম্যের অবসান ঘটানো। নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে হজে যাওয়া বাধ্যতামূলক সকল
সামর্থবান (আর্থিক ও শারিরীক দিক থেকে) মুসলমানদের জন্যে। হজে যাওয়া বাধ্যতামূলক হলেও মুসলিম
নারীদের একাকী হজে যাওয়ার অনুমতি নেই। হজে যেতে পারবে যদি সঙ্গে তাদের বর কিংবা
রক্তের সম্পর্ক আছে এমন পুরুষ অভিভাবক থাকে। বর (স্বামী) ছাড়া যে পুরুষ মুসলিম
নারী হজযাত্রীর সঙ্গী হতে পারবে তাকে ইসলামের পরিভাষায় ‘মেহরাম’ বলে। হজের বিধানে স্পষ্ট
করে বলা হয়েছে যে, ‘মেহরাম’ ছাড়া মুসলিম নারী হজে যেতে পারবে না।
হজে যেতে
প্রবল ইচ্ছুক কোনো অবিবাহিত মুসলিম নারী, কিংবা কোনো বিধবা নারীর যদি মেহরাম হওয়ার উপযুক্ত কোনো পুরুষ না থাকে তাহলে তিনি কী করবেন? কিংবা কোনো সধবা নারীর বর যদি পঙ্গু হয় এবং তার যদি
মেহরাম হবার উপযুক্ত অন্য কোনো পুরুষ
অভিভাবক না থাকে, কিংবা থাকলেও তাকে সঙ্গে নেওয়ার আর্থিক সামর্থ যদি তার না থাকে
তবে সেই নারী কী করবেন? এর উত্তর একটাই, এ
রকম মুসলিম নারী হজ করা থেকে বঞ্চিত হবেন। হজ করা থেকে বঞ্চিত মানে, হজ করার নেকী
(পূণ্য) থেকে তারা বঞ্চিত হবেন। এটা যে নারীর প্রতি একটা বড়ো বৈষম্য তা বলা বাহুল্য। প্রধানমন্ত্রী
বৈষম্যমূলক এই নিয়মটির অবসান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং তারজন্যে সংশ্লিষ্ট
দপ্তরের মন্ত্রীকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করার
নির্দেশও প্রদান করেছেন।
সৌদি
আরবের বেঁধে দেওয়া কোটা অনুযায়ী ভারত থেকে নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে সর্বাধিক এক
লক্ষ সত্তর হাজার মুসলমান হজে যেতে পারেন। কিন্তু যেহেতু
হজে যাওয়ার জন্যে মুসলমানদের ব্যাকুলতার অন্তহীন, তাই হজযাত্রার জন্যে আবেদন পত্র
জমা পড়ে তার চেয়ে অনেক অনেক বেশী। ফলে কেন্দ্রীয় সরকার আবেদনকারীদের মধ্যে লটারী
করে হজযাত্রীদের তালিকা তৈরী করে থাকে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, এবার যে ১৩০০ জন নারী ‘মেহরাম’
ছাড়া একাকীই হজে যাওয়ার আবেদন করেছেন তাঁদের সকলকে লটারীর নিয়মের বাইরে রেখে বিশেষ
শ্রেণীর মর্যাদা দিয়ে হজে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে।
মক্কা ও
মদীনা মুহাম্মদের জন্মভূমি ও কর্মভূমি। জিহাদেরও পবিত্র(!)
ভূমি। স্বভাবতই মুসলমান মাত্রই সকলের মনের মধ্যেই হজ করতে যাওয়ার প্রবল আগ্রহ ও
আকাঙ্খা থাকে। থাকে প্রবল বাসনাও। বাসনা
থাকে তাদের প্রিয় নবী এবং তাঁর সাহাবী সহযোদ্ধাদের সমাধিগুলো এবং তাঁদের স্মৃতিবিজড়িত দ্রষ্টব্য স্থানগুলি স্বচক্ষে
ঘুরে ঘুরে দেখার ও স্পর্শ করার। সেই আকাঙ্খা ও বাসনা বহুগুণ তীব্রতা লাভ করে
বেহেস্তের মহালোভ ও দোযখের (নরকের) মহাভয়ের কারণে। কারণ,
তাদের মহানবী বলে গিয়েছেন যে হজ করলে সব পাপ মুছে যাবে এবং বেহেস্তবাসী হবে, আর
সামর্থবানরা যদি হজ না করে তবে মৃত্যুর পর তাদের দোযখের আগুনে অনন্তকাল পুড়ে মরতে
হবে। তাই অসামর্থবানরাও যাদের হজ করতে যাওয়া ফরজ (বাধ্যতামূলক) নয় - অবশ্য হজে
যেতে তাদের মানাও নেই - বিপুল সংখ্যায় হজ করতে যেতে চায়। যায়ও। তাই
নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে সকল মুসলমানই জীবনে অন্ততঃ একবার হজ করতে যাওয়ার বাসনা
যাতে পূরণ হয় তার জন্যে তারা আল্লাহ্র কাছে জীবনভোর প্রার্থনা করে। যারা একবার হজ
করে আসে তারা আর একবার, বারবার, হজে যেতে
চায়। হজে যাওয়ার এই তীব্র বাসনা পূরণ করার অধিকার আছে চোর, ডাকাত, দস্যু, বাটপার,
লম্পট, সুদখোর, চাঁদাবাজ, ধোঁকাবাজ, জুলুমবাজ, ইত্যাদি সকল শ্রেণীর পুরুষ মুসলমানেরই।
অধিকার আছে সকল মুনাফেক পুরুষ মুসলমানেরও,
কিংবা যারা মক্কা ও মদীনাকে স্রেফ ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্য স্থান বলে মনে করে সেই শুধু
নামধারী মুসলিম পুরুষদেরও। এমনকি আল্লাহ্র শত্রু ইহুদি, খৃস্টান ও মুশরিকদেরও
(অংশীবাদীদেরও) কর্মসূত্রে মক্কা ও মদীনা যাওয়ার অনুমতি ও অধিকার আছে। কিন্তু মুসলিম নারীদের একাকী হজ করতে যাওয়ার অধিকার নেই। এ যে
মুসলিম নারীর প্রতি কতো বড়ো বঞ্চনা, বৈষম্য ও অবিচার তা
ভাষায় প্রকাশ মানুষের সাধ্যের অতীত।
প্রধানমন্ত্রী
নরেন্দ্র মোদির এই পদক্ষেপটিকে নারীর
প্রতি বৈষম্য ঘটানোর শুধু একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে শুধু দেখলে ভুল হবে। এটা তার চেয়ে
অনেক বড়ো বিষয়। এর মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভারতের মুসলিম নারীর একটি মস্ত বড়ো অধিকারও। এই
ন্যায্য অধিকার থেকে তারা এতদিন বঞ্চিত ছিলো। সৌদি আরব তিন বছর
আগেই এই বৈষম্যটির অবসান করেছে। সৌদি আরবের পথ ধরে অনেক মুসলিম দেশও তাই করেছে।
কিন্তু ভারতে মুসলিম নারীদের প্রতি সেই বৈষম্যমূলক নীতি বহালই ছিলো। ভারতের বুকে
কেউ এটা তুলে দেওয়ার দাবি জানায় নি। প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব উদ্যোগেই হজে যাওয়ার
ক্ষেত্রে এই বৈষম্যমূলক আইনটির অবসান ঘটালেন। হজে যাওয়ার ক্ষেত্রে মুসলিম নারীদেরকে
এই যে পুরুষদের সমান অধিকার প্রদান করা
হলো, মুসলিম সমাজে এর সুদূর প্রসারী প্রভাব পড়বে। এর ফলে মুসলিম
নারীদের হাত অনেক শক্ত হবে, তাদের
মনোবল আরো দৃঢ় হবে, তারা তাদের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ও সমানাধিকার অর্জন করার
লড়াইকে আরো শক্তিশালী ও বেগবান করতে পারবে।
মুসলিম
সমাজের পক্ষে এটা বিশ্বাস করা অসম্ভব ব্যাপার ছিলো যে নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর সরকার
মুসলিম সমাজের পক্ষে কল্যাণকর কোনো কাজ করতে পারে। অনুরূপ ধারণা বদ্ধমূল ছিলো এবং এখনও বিদ্যমান রয়েছে অমুসলিমদের
মধ্যেও। এতে কাউকে দোষ দেওয়া যায় না। কারণ, আরএসএস ও বিজেপির যা
দর্শন তাতে এমন ধারণা হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু
তিন তালাক আইন বাতিল করতে চেয়ে লোকসভায় বিল পাশ করার ঠিক পরপরই মেহরাম ছাড়াই মুসলিম
নারীগণ হজে যেতে পারবেন এমন আইন প্রণয়ন করায় নরেন্দ্র মোদি সম্পর্কে সেই ‘অসম্ভব
ব্যাপার’টিতে কিছুটা পরিবর্তনের আভাষ পরিলক্ষিত হচ্ছে। মুসলিমদের মধ্যে একটা অংশ,
বিশেষ করে নারী সমাজ, ইতিমধ্যেই মনে করতে শুরু করেছে যে, নরেন্দ্র মোদি সত্যি
সত্যিই মুসলিম মহিলাদের দুঃখ-কষ্ট ও নিরাপত্তাহীনতা লাঘব করতে, তাদের প্রতি বৈষম্য
দূর করতে এবং তাদের কিছুটা হলেও ন্যায্য অধিকার ও স্বাধীনতা প্রদান করতে আগ্রহী।
মুসলিম মহিলাদের দুঃখ, কষ্ট ও যন্ত্রণা লাঘব করতে চান বলে তিনি যা প্রায়শঃই বলেন
তা নেহাতই কথার কথা নয়। মুসলিম নারী সমাজ যে সত্যিই এরূপ ধারণা পোষণ করেন তা কারো কোনো
কষ্ট-কল্পনা নয়। তাঁরা (মুসলিম মহিলারা) রাস্তায় নেমে প্রকাশ্যেই তাদের মতামত এখন
ব্যক্ত করছেন। তিন তালাক আইন নিষিদ্ধ করার আইনই হোক, কিংবা ‘মেহরাম’ বাতিলের আইনই
হোক, উভয় ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে মুসলিম নারীরা শয়ে শয়ে রাস্তায় নেমে
প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ও সাধুবাদ জানিয়েছেন, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। এই নারীদের মধ্যে যেমন অন্যায় ও অবিচারের
বিরুদ্ধে সোচ্চার নির্ভিক প্রতিবাদী নারীরা রয়েছেন, তেমনি সাধারণ নারীরাও রয়েছেন। খোলা
মনে এবং শোনার আগ্রহ নিয়ে বাতাসে কান পাতলেই শোনা যায় মুসলিম নারীদের মনে আজ কী
খুশীর লহর বইছে। দক্ষিণ
২৪ পরগণা জেলার বজবজের সন্তোষপুরের ষাটোর্ধ মুসলিম রমণী সামশুন্নেহার মহানন্দে
হজযাত্রার প্রস্তুতি সারছেন। যারা তাঁর একা যাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন তাদের
উদ্দেশ্যে বলেছেন, “বয়স ছাড়া তাদের আর কী আছে যা আমার নেই? বিপদ যদি ঘটে তারা
থাকলেও আটকাবে না।” একা যেতে সত্যি ভয় করছে না? তিনি বলেছেন, “ একদমই না। আমি যে
পারি সেটা প্রমাণ করার সুযোগই পাইনি এতদিন।” সামসুন্নেহারের মতো একই আনন্দঘন অনুভূতি নির্দ্বিধায়
ব্যক্ত করেছেন মুর্শিদাবাদ জেলার লালগোলা থানার আর
এক মহিলা হজযাত্রী, খাদিজা বেওয়া। তাঁর বয়সও এখন
৬৫, স্বামী মারা গেছে এক যুগ আগে ২০০৫ সালে।
তিনি একই সঙ্গে খেদ ও খুশী প্রকাশ করেছেন এভাবে, “এর আগে মেয়েদের দলে দিল্লি ও আজমের গিয়েছি ধর্মের
টানে। কিন্তু দেশের বাইরে? ভাবতেই পারতাম না। এবারও হজে যাচ্ছি ধর্মের টানেই,
কিন্তু বাড়ির বাইরে সব দায়িত্ব আমার নিজের, এটা কম বড় কথা? একটাই আফশোস, বয়স এখন ৬৫,
সুযোগটা আরো আগে পেলে ভাল হতো।” নিজের মতো
করে ভাববো এটা ভেবে ভীষণ উত্তেজিত আর এক হজযাত্রী মরজিনা
বিবিও। মুর্শিদাবাদ জেলার রাধাকান্তপুরের
এই রমণীর কণ্ঠেও আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি ঝরে পড়তে দেখা যায় প্রচণ্ড খেদ ও
ক্ষোভও । তিনি জানান, “মনে পড়ে যাচ্ছে
মেহরাম পাওয়া যায়নি বলে কত মহিলার যে হজে যাওয়ার ইচ্ছাটা পুরণ হয়নি। মারাও গিয়েছেন
অনেকেই।”
মোল্লা-মুফতি ও মুসলিম সমাজের মাতব্বররা মোদিজির এই সিদ্ধান্তে যে
বেজায় ক্ষুব্ধ তা বলা বাহুল্য। মোল্লা-মুফতিগণ তৎক্ষণাৎ হুঙ্কার দিয়ে বলছেন, আল্লাহর আইনে
হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করবো না। পরক্ষণেই অবশ্য একটু গলা নামিয়ে বলেছেন যে এটা অসাংবিধানিক
সিদ্ধান্ত এবং এর বিরুদ্ধে তাঁরা আদালতে যাবেন। অন্যদিকে মুসলিম সমাজের বুদ্ধিজীবী
ও মাতব্বরগণ নানা অপযুক্তি খাড়া করে মুসলিম সমাজকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা
চালাচ্ছেন। বলছেন যে নরেন্দ্র মোদি মুসলিম নারীদের বিপাকে ফেলার জন্যে একটি ভালো
আইনে পরিবর্তন এনেছেন। কী রকম বিপাক? যেমন এ কে এম ফারহাদ, রাজ্য হজ কমিটির সদস্য,
বলেছেন, “ধরুন, আমার মা কিংবা স্ত্রী একা হজে যাবেন। সব
ঠিকঠাক থাকলে অসুবিধা নাই। কিন্তু যদি তাঁরা অসুস্থ হয়ে পড়েন তা হলে কী হবে?”
এটা যে স্রেফ অজুহাত তা মুখের উপরেই বলে
দিয়ে তাদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছেন মুসলিম নারীরাই। মুর্শিদাবাদ জেলার গোকর্ণের নাজমা বিবি কিংবা দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার মেটিয়াবুরুজের ফতেমা বিবির
পাল্টা প্রশ্ন, “মেহরাম কি অসুস্থ হতে পারে না?” নাজমা ও ফতেমারা একা যাচ্ছেন না।
পাড়া বা আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে থেকে তাঁরা তিন/চার জন মহিলাকে সঙ্গী করে নিয়ে দল
বেঁধে হজে যাচ্ছেন। সেটা আইনের গ্যাঁড়াকল মানার জন্যে, ভয়ে মোটেই নয়। এই মহিলারাই
প্রশ্ন তুলেছেন, ৪৫ বছরের কম বয়সী মহিলারা কেন এ সুযোগ পাবে না। মহিলাদের এই উৎসাহ
ও উচ্ছ্বাস দেখে রহিমা খাতুন, যিনি মুসলিম নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করছেন দীর্ঘদিন,
বলেছেন, নিজের মতো করে বাঁচতে চাওয়ার প্রশ্নে আমরা আর এক ধাপ এগোলাম।
উপরের
নারী চরিত্রগুলি কাল্পনিক চরিত্র একদমই নয়, এবং তাঁদের সংলাপগুলিও এই লেখকের মনগড়া নয়। তাঁরা প্রত্যেকেই
বাস্তব ও জীবন্ত চরিত্র। মেহরাম ছাড়াই কবে হজের উদ্দেশ্যে বাড়ির বাইরে পা রাখবেন সেদিনটির
জন্যে প্রহর গুণছেন। হঠাৎই পুরুষের লেজুড় না হয়ে একাকী হজে যাওয়ার সুযোগ উপলব্ধ
হওয়ায় মুসলিম নারীদের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে তার সন্ধান করতে বেরিয়ে পড়েছিলো
কোনো কোনো সংবাদ মাধ্যম। বাংলার সে রকম একটি বহুল প্রচারিত সংবাদ পত্র মুসলিম
নারীদের এই ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ও অভিব্যক্তিগুলি তুলে ধরেছে সংক্ষেপে। (সূত্রঃ http://www.anandabazar.com/state/they-found-proper-freedom-in-travelling-alone-for-hajj-pilgrimage-1.740363?ref=hm-ft-stry-4) সামশুনেহার, খাদিজা, মরজিনা, নাজমা, ফতেমা, রহিমা খাতুন প্রমুখ
নারীগণ কিন্তু কোনো বিচ্ছিন্ন চরিত্র নয়। এঁরাই মুসলিম নারীসমাজের আসল প্রতিনিধি
যাঁদের কাছে শরিয়া আইন কী বলছে সেটা বড়ো কথা নয়, বড়ো কথা হলো তাঁদের কাছে তাঁদের
নিজস্ব অধিকার ও স্বাধীনতা। এই নারীগণই যে মুসলিম সমাজের আসল মুখপত্র তার প্রমাণ মেলে
এই দুটি তথ্য থেকে। এক). মেহরাম
ছাড়া হজে যাওয়ার বিধান ছিলো না জেনেও ১৩০০ জন মুসলিম নারী হজে যাওয়ার আবেদন
জানিয়েছিলেন। এই আবেদনের মাধ্যমেই তাঁরা দুটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন। ক).
হজ্জ্বে যাওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি যে বঞ্চনা ও অবিচার রয়েছে তার অবসান তাঁরা
চান। খ). শরিয়তি বিধানের অনুশাসন ও নারী
স্বাধীনতার মধ্যে দ্বিতীয়টাই তাঁদের পছন্দ। দুই). মেহরাম
ছাড়াই মহিলারা হজে যেতে পারবেন প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার পর ইতিমধ্যেই কলকাতা-সহ
সারা রাজ্য থেকে মুসলিম নারীদের হজে যাওয়ার বহু আবেদন জমা পড়েছে। রাজ্য হজ কমিটির
একজন মুখপত্র জানিয়েছেন যে মুসলিম নারীদের কাছ থেকে এতো সাড়া আসবে তা তাঁরা
কল্পনাও করতে পারেন নি। (সূত্রঃ ঐ) যা কল্পনাতীত ছিলো তা বাস্তবে পরিণত হয়েছে এ জন্যে যে,
মুসলিম নারী মেহরাম ছাড়া হজযাত্রার অধিকারকে
তাঁদের মুক্তিযাত্রা বলে
মনে করছেন। যারা মানুষের মনের কথা সোচ্চারে বলতে পারে তারাই তো
মানুষের প্রতিনিধি। সুতরাং যে নারীরা প্রথম হজ্জ্বে যাওয়ার আবেদন করেছিলেন এবং
যাঁরা সর্বপ্রথম হজ্জ্বে যাচ্ছেন তারাই তো মুসলিম নারীদের আসল প্রতিনিধি।
মুসলিম নারীদের এই আনন্দ ও উচ্ছ্বাসকে কটাক্ষ করছেন
মুসলিম সমাজের অনেকেই। তারা বলছেন যে, এরা মুর্খ নারী, নারীদের মেহরাম ছাড়াই হজে
পাঠাবার অনুমতি দেওয়ার পেছনে মোদির যে নিশ্চয়ই কোনো গভীর দূরভিসন্ধি আছে তা বোঝার
ক্ষমতা এদের নেই। এই মহাপণ্ডিতদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র
মোদি ‘মেহরাম’ ছাড়াই মুসলিম নারীদের হজ ও উমরা (ছোট হজ) করার অধিকার দেওয়ার আগে ও
পরে যথাক্রমে ‘তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রদান’কে একটি দণ্ডনীয় অপরাধ বলে
চিহ্নিত করে বিল প্রণয়ন করেছেন ও সংসদে পাশ করিয়েছেন এবং হজে ভর্তুকি তুলে দিয়ে
সুপ্রীম কোর্টের রায়ের মর্যাদা দিয়েছেন। অন্যদিকে উত্তর প্রদেশের বিজেপি সরকারের
মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ যোগী জানিয়েছেন যে মাদ্রাসা বোর্ড তুলে দেওয়া হবে এবং
মাদ্রাসা পাঠ্যক্রমের আধুনিকীকরণ করা হবে। হিন্দু সাম্প্রদায়িক দলের দুই নেতা মোদি
ও যোগী কর্তৃক গৃহীত এই পদক্ষেপগুলির প্রত্যেকটিই যুগান্তকারী ও ঐতিহাসিক। তাঁদের এই কাজগুলি যে পিছিয়ে পড়া মুসলিম
সমাজের পক্ষে প্রভূত মঙ্গলময় ও কল্যাণকর হবে
তা নিয়ে তর্ক করার কোনো অবকাশ নেই। এটা ঠিক যে নরেন্দ্র মোদি ও আদিত্যনাথ যোগি
সরকারে আসার পর এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে ও ঘটছে যেগুলি মুসলিমদের নিরাপত্তার কাছে
হুমকির কারণ হয়ে উঠেছে। বিপদের এই দিকটাকে খেয়ালে রেখেও একথা বলতে চাই যে, তাঁদের শাসনকালে মুসলিম সমাজের
যতোটা অমঙ্গল ও ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা তৈরী হয়েছিলো পরিস্থিতি ততোটা খারাপ হয়নি।
বরং বলা যায় যে, তাঁদের ক্ষমতার যুগলবন্দি মুসলমানদের পক্ষে শাপে বরই হয়েছে।
আর দু’টি
বিষয় উল্লেখ করে নিবন্ধটির যবনিকা টানবো।
এক).
তথাকথিত ডান বা বাম ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির সরকার ক্ষমতায়
থাকলে কি মুসলিম নারীগণ একাকী ও স্বাধীনভাবে হজে যাওয়ার অধিকার পেত? ডান অর্থে
কংগ্রেস, আরজেডি, সপা, বহুজন সমাজ পার্টি এবং বাম অর্থে মূলতঃ সিপিআই(এম) ও সিপিআই এই দুটি কম্যুনিস্ট পার্টকে বোঝানো হয়েছে। এই দলগুলিই বরাবর
নিজেদের ভারতের সংখ্যালঘুদের (মুসলমানদের) একমাত্র স্বার্থরক্ষাকারী স্বঘোষিত
ঠিকাদার বলে দাবী করে আসছে। কিন্তু এরা ক্ষমতায় থাকলে মুসলিম নারী যে সে অধিকার
পেতো না তা দুধের শিশুও জানে। দুই). মুসলিম সমাজ
যারপরনাই বিভ্রান্ত এই প্রশ্নে যে মুসলিম নারীদের হজে যাওয়ার কোন বিধানটা (আগেরটা
না পরেরটা) ইসলাম সম্মত? ইসলামের পশ্চাদপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল বিধানগুলিকে
মোল্লা-মুফতিদের মনগড়া বিধান বলে প্রচার করার একটা সংস্কৃতি চালু আছে মডারেট
মুসলিম সমাজে। এটা নিঃসন্দেহে একটা কুৎসিৎ সংস্কৃতি।
কারণ, মোল্লা-মুফতিরা কখনোই জ্ঞানতঃ মনগড়া ফতোয়া বা বিধি তৈরী করেন না। যারা
মডারেট মুসলিম সমাজের কলমেই আস্থাশীল এবং ইসলাম হলো শ্রেষ্ঠ ও চির আধুনিক ধর্ম বলে
অহংকার বোধ করেন তাদের উদ্দ্যেশ্যে বলতে চাই যে, ‘মেহরাম’ ছাড়া নারী হজে যেতে
পারবে না এই নারীবিরোধী বিধানটি সম্পূর্ণ কোরান সম্মত বিধান। কোরানের
আহযাব সুরার তেত্রিশ নম্বর (৩৩/৩৩) আয়াতে স্পষ্ট বিধান হলো মুসলিম নারীদের ঘরের কোণেই আবদ্ধ থাকতে হবে। সেই
আয়াতটি হলো –
·
তোমরা সকলে আপন আপন গৃহকোণে স্থিতি করিতে থাক ও পূর্বতন
মূর্খতার বেশ-বিন্যাসের ন্যায় বেশ-বিন্যাস করিও না।’
এই আয়াতের
ভিত্তিতেই শরিয়তি বিশেষজ্ঞদের প্রণয়ন করা বিধিটি হলো,
·
“মুসলিম নারী একাকী একদিক্রমে তিন দিনের বেশী বাড়ির
বাইরে থাকতে, কিংবা ৭৮ কিমির বেশী পথ যেতে পারবে না, এমনকি তা হজের জন্যে হলেও।
(বিঃদ্রঃ- নিবন্ধটি প্রথমে ০২/০১/২০১৮ তারিখে
লেখা হয় বিতর্ক ডট কম ওয়েব ম্যাগাজিন (www.bitarka.com) - এর জন্যে। তখন শিরোনাম ছিল - ‘মেহরাম’ ছাড়াই নারীকে হজযাত্রার অনুমতি প্রদান একটি ঐতিহাসিক
পদক্ষেপ
২৬/০১/২০১৮
তারিখে নিবন্ধটি সম্পাদনা ও হালনাগাদ (update) করা হয়েছে।)
গিয়াসুদ্দিন
No comments:
Post a Comment