Monday, May 24, 2021

করোনা ডায়রি (সাত)ঃ ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতি, আংশিক লকডাউন প্রসঙ্গে কিছু দাবি ও কিছু প্রশ্ন

white and red heart shaped decor

আজ ১৬ই মে থেকে রাজ্যে শুরু হলো কার্যত লকডাউন। দেশ জুড়ে করোনা পরিস্থিতির ক্রমশ ভয়ানক থেকে ভয়ানকতর হয়ে উঠছে। প্রতিদিন নতুন সংক্রমণের সংখ্যা লাফ দিয়ে যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে পাল্লা দিয়ে করোনা রোগীর দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যাও। সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা যা সামনে আসছে বাস্তবে সংখ্যাটা তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি। কারণ, করোনা সংক্রমণ যাদের দেহে হচ্ছে তাদের একটা ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র করোনা পরীক্ষা করাচ্ছে। এর প্রধান কারণ হলো, করোনা পরীক্ষা কেন্দ্রের লজ্জাজনক অপ্রতুলতা ও সচেতনতার অভাব। তাছাড়া সিগম্যাটাইজড হয়ে যাওয়ার ভয়ও কাজ করে, জানাজানি হয়ে গেলে সামাজিক বয়কটের মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে যা গোটা পরিবারকে অনাহারের দিকে ঠেলে দেবে। হাসপাতালে বেড নেই, বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা নেওয়ার সামর্থ নেই, ফলে করোনা রোগীরা ঘরেই যে যার সাধ্য মতন চিকিৎসা করাচ্ছেন, গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশ মানুষই সে সুযোগটুকুও নিতে পারে না। ফলে বাডিতেই বহু করোনা রুগীর মৃত্যু হচ্ছে যে খবর সরকার রাখে না। গোটা দেশের সঙ্গে আমাদের রাজ্যেও করোনা পরিস্থিতি ক্রমশ ভয়ংকর থেকে ভয়ংকরতর হয়ে উঠছে। দৈনিক সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিনই রেকর্ড ভাঙছে আর নতুন রেকর্ড গড়ছে। দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা কয়েকদিন থেকেই চার হাজারের গণ্ডী টপকাচ্ছে, আর মৃত্যুর সংখ্যা একশোর উপরেই থাকছে। এই পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকার করোনা মোকাবিলায় ১৫ দিনের জন্যে (১৬ই মে থেকে ৩০শে মে পর্যন্ত) কিছু কঠোর অনুশাসন ও বিধিনিষেধ জারি করলো ‘যাকে কার্যত লকডাউন’ বলা হচ্ছে।

পরিস্থিতি যা তাতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার বিকল্প নেই

চিকিৎসকমণ্ডলী এতে খুশি নন, তাঁরা চান পূর্ণ লকডাউন। পরিস্থিতি এতই সঙ্গিন হয়ে উঠেছে যে জনগণের জন্যে মরাকান্না করা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও না পারছে চিকিৎসকদের মতামতের বিরুদ্ধাচারণ করতে, না পারছে সরকারের গৃহীত কড়া পদক্ষেপের বিরোধিতা করছে। আমি গ্রামের মানুষ, আমার বাস প্রান্তিক ও নিম্নবিত্ত মানুষজনের মধ্যে। আমি জানি আংশিক লকডাউন হোক আর পূর্ণ লকডাউনই হোক, তাতে এই সব মানুষরা কাজ হারিয়ে কতটা বিপদে পড়বে। সেজন্যেই চিকিৎসক বন্ধুদের অভিমত অত্যন্ত বাস্তব বুঝেও তাঁদের অভিমতকে সমর্থন দিতে মন সায় দিচ্ছে না। আবার পূর্ণ লকডাউন না চাইলেও সরকার যে আংশিক লকডাউন জারি করেছে যা কার্যত পূর্ণ লকডাউনের মতনই,  তারও বিরোধিতা করতে পারছি না। কারণ, করোনার ভয়াল করাল গ্রাস থেকে দেশ ও মানুষকে বাঁচাতে এরূপ কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া অন্য বিকল্প নেই।   

সরকারের জারি করা আংশিক লকডাউন যা প্রায় পূর্ণ লকডাউনের সমতুল্য তাকে সমর্থন জানিয়ে সরকারের উদেশ্যে ও প্রতি কিছু প্রশ্ন ও দাবি রাখতে চাই।    

সরকার ঘোষিত অত্যাবশ্যকীয় কর্মক্ষেত্র ও দ্রব্যের তালিকা নিয়ে প্রশ্ন

অত্যাবশ্যকীয় কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দিয়ে রাত্রিবেলা রাস্তায় চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অত্যাবশ্যকীয় নয় এমন সব দোকান ও প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বন্ধের তালিকায় যে সব দোকানপাট ও প্রতিষ্ঠান রাখা রয়েছে সেগুলি বন্ধ রাখা নিশ্চয়ই জরুরী ছিলো। অন্যদিকে অত্যাবশ্যকীয় কিছু ক্ষেত্রকে আংশিক বা সম্পূর্ণ ছাড় দেওয়া অত্যন্ত জরুরী ছিলো। সরকার সেটা করেছেও। এ রকম ছাড় দেওয়া নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে না। কিন্তু প্রশ্ন রয়েছে অন্যত্র। যেমন প্রশ্ন রয়েছে অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের তালিকা এবং ছাড় দেওয়ার সময়ের ব্যাপ্তি নিয়ে।    

অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের তালিকায় রয়েছে এমন কয়েকটি দ্রব্যের দোকান যা অনেককেই অবাক করেছে। সেগুলি হলো মিষ্টি, শাড়ি ও গয়নার দোকান। মিষ্টির দোকান খোলা থাকবে সাত ঘণ্টা (সকাল দশটা থেকে পাঁচটা) এবং গয়না ও শাড়ীর দোকান তিন ঘণ্টা (দুপুর বারোটা থেকে তিনটা)। মিষ্টি বা মিষ্টি জাতীয় দ্রব্য, শাড়ি ও গয়না কি অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য? না, হ্যাঁ বলা যাচ্ছে না। কোন মাপকাঠিতে, কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে, কার বুদ্ধিতে এগুলোকে অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বোধগম্য হচ্ছে না। গতবছর পূর্ণ লকডাউনের সময় দেশ জুড়ে কিছু গোয়ালা বন্ধু এবং দুধ ব্যবসায়ী প্রবল বিক্ষোভ দেখিয়েছিলো। বহু জায়গায় তারা বড়ো বড়ো দুধপাত্র রাস্তায় উল্টে দিয়ে প্রচুর দুধ নষ্ট করে লকডাউনের প্রতিবাদ করেছিলো। তাদের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ প্রদর্শনে সরকার মাথা নত করে আংশিক সময়ের জন্যে মিষ্ঠির দোকান খোলার অনুমতি প্রদানও করেছিলো। আমার মনে হয় সেজন্যেই এবারও মিষ্টির দোকানকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। মিষ্টির দোকান বন্ধ থাকলে গোয়ালা, দুধ ব্যবসায়ী এ মিষ্টান্ন বিক্রেতাদের প্রচুর আর্থিক ক্ষতি যে হবে তা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করার অবকাশ নেই। কিন্তু দুগ্ধজাত শিল্পের সঙ্গে যত শ্রমজীবী মানুষ যুক্ত তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি শ্রমজীবী মানুষ যুক্ত রয়েছে অন্য অনেক ক্ষেত্র ও ব্যবস্যায়। রেল, বাস, নৌকা, লঞ্চ, স্টীমার ইত্যাদি পরিবহণ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত লক্ষ লক্ষ সংগঠিত ও অসংগঠিত কর্মচারী ও শ্রমজীবী মানুষ। চটশিল্পে ৩০% শতাংশ ও চা শিল্পে ৫০% লোক কাজ করতে পারবে। ফলে এই দুটি শিল্পে কাজ হারাবে বহু লক্ষ শ্রমিক। এ ছাড়া রয়েছে আরও অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা এবং শিল্প যেখানে লকডাউনে অসংখ্য মানুষ কাজ হারাবে। দুগ্ধজাত শিল্পের শ্রমজীবী ও ব্যবসায়ীদের কথা ভাবলে তো ভাবতে হয় অন্যদের কথাও। আর তাহলে তো লকডাউন (আংশিক বা পূর্ণ) করাই যাবে না।        

প্রশ্ন আছে ছাড় দেওয়ার সময়সীমা নিয়েও। চশমার দোকানকে সম্পূর্ণ ছাড় দেওয়া হয়েছে। ডাক্তারখানা ও ঔষধের দোকানের সমগোত্রীয় হতে পারে না চশমার দোকান। চশমার দোকানকে আংশিক সময়ের জন্যে ছাড় দিলেও মানুষের খুব বেশি অসুবিধা হবে না। মিষ্টির দোকানকে যেখানে ছাড় দেওয়াই ঠিক হয় নি সেখানে সেগুলি সাত ঘণ্টা খুলে রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অথচ মুদিখানার দোকান ও বাজার হাট খুলে রাখার জন্যে সময় দেওয়া হয়েছে সারাদিনে মাত্র তিন ঘণ্টা – সকাল সাতটা থেকে দশটা। এই তিন ঘণ্টা সময় খুবই কম। এর ফলে মুদিখানার দোকানে ও বাজার-হাটে ভিড় অনেক বেশি হবে যার ফলে দুরত্ববিধি মানা শিকেয় উঠবে।

কয়েকটি দাবি সরকারের কাছে

রেশন দোকান খোলা থাকবে রবিবার বাদে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সপ্তাহে ছ’দিন। মানুষের সচেতনার অভাব এবং তীব্র দারিদ্রতা হেতু সপ্তাহের প্রথম দু/তিন দিনেই মানুষ রেশনের দোকানে ভিড় করে যেখানে দুরত্ববিধি মেনে চলা অসম্ভব হয়ে ওঠে। প্রশাসনও এক্ষেত্রে থাকে সম্পূর্ণ উদাসীন ও নিষ্ক্রিয়। ফলে লকডাউনের (তা আংশিক হোক কিংবা পূর্ণই হোক) উদ্দেশ্য অনেকটাই ব্যর্থ হয়ে যায়। রেশনের দোকান তাই সপ্তাহে ছ’দিন দিনভোর খোলা রাখলেই হবে না। সেখানে দুরত্ববিধি কার্যকর করার জন্যে সরকারকে বিশেষ নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে সরকারকে ভোটের আগে দেওয়া দুয়ারে দুয়ারে রেশন পৌঁছে দেবার প্রতিশ্রুতি। সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার এটাই তো উপযুক্ত সময়। সরকারকে সেই প্রতিশ্রুতি কার্যকর করার জন্যে এখনই উদ্যোগী হতে হবে। এ বিষয়ে জরুরী ভিত্তিতে এখনই দুটি কাজ করার পরামর্শ সরকারে কাছে রাখতে চাই। প্রথমত, সরকারকে রেশন ডিলারদের নির্দেশ দিতে হবে রেশন গ্রহীতাদের ছ’টা তালিকা করে কাদের কবে রেশন দেওয়া হবে তা জানিয়ে দিতে। দ্বিতীয়ত, রেশনের দোকানে দুরত্ববিধি কার্যকর করার জন্যে প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করার নির্দেশ দিতে হবে। ৩০শে মে আংশিক লকডাউনের মেয়াদ শেষ হলে, যদি হয়, করোনার আরো অনেক বেশি শক্তিশালী তৃতীয় প্রজাতি প্রস্তুত হচ্ছে তৃতীয় ঢেউ নিয়ে আমাদের ওপর আছড়ে পরার জন্যে। অর্থাৎ করোনা সৃষ্ট অতিমারি থেকে অন্তত ২০২১ সালে রেহাই পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এ কথাটা মনে রেখে রেশন দোকানের ভিড় পাতলা করার জন্যে সরকারকে আর একটি কাজ করতে হবে। তৃতীয় সেই কাজটি হলো খুব শীঘ্রয় রেশনের দোকানের সংখ্যা বৃদ্ধি করার উদ্যোগ গ্রহণ করা।

আংশিক হোক আর পূর্ণ লকডাউনই হোক কাজ হারাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ যাদের অধিকাংশই দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ। তাদের শুধু বিনামূল্যে চাল গম দিলেই হবে না। তাদের হাতে নগদ টাকাও দিতে হবে বাজার হাট করা সহ অন্যান্য জরুরী কাজ করার জন্যে। আর এর জন্যে কেন্দ্রীয় সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে রাজ্য সরকার বসে থাকতে পারে না বা এর দায় কেন্দ্রীয় সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে বসে থাকতে পারে না। কেন্দ্রীয় সরকার যদি এগিয়ে না আসে তবে যেখান থেকেই হোক রাজ্য সরকারকেই টাকার ব্যবস্থা করতে হবে। রাজ্য সরকার বিগত দশ বছর ধরে অহেতুক ক্লাবের পেছনে, মাটি উৎসবে, মুখ্যমন্ত্রীর ছবি সম্বলিত বিজ্ঞাপন প্রচারে এবং আরো অনেক ফালতু কাজে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ব্যয় করে ঋণের বোঝা বাড়িয়েছে। এবার মানুষের জীবন বাঁচাতে দরকার হলে সরকারকে ঋণ করেও টাকার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারকে আর একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। সদ্য সমাপ্ত বিধানসভা ভোটে মুখ্যমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রত্যেকটি গরীব পরিবারের গৃহকর্ত্রীর ব্যাংক একাউণ্টে টাকা (কাউকে ৫০০ টাকা, কাউকে ১০০০ টাকা) দেওয়া হবে। মুখ্যমন্ত্রীকে এই সময়েই সেই প্রতিশ্রুতিটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করা জরুরী হয়ে উঠেছে।                  

আরো দু’টি দাবি আছে রাজ্য সরকারের কাছে। গত বছর দেশ জুড়ে পূর্ণ লকডাউন চলাকালীন প্রথম দিকে পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা ছিলো খুবই প্রশংসনীয়। ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে জনগণের একটা সাধারণ প্রবণতা ছিলো লকডাউনকে উপেক্ষা করে। সে সময় লকডাউন সফল ও সার্থক করতে পুলিশকে ভীষণ তৎপর ও সক্রিয় দেখা গিয়েছিলো। অবশ্য কিছু পুলিশকে কোথাও কোথাও একটু বাড়াবাড়ি করতেও দেখাও গিয়েছিলো। তারজন্য সংশ্লিষ্ট অভিযুক্ত পুলিশকর্মীকে ডেকে প্রশাসনের অভ্যন্তরে কড়া ভাষায় সতর্ক করলেই কাজ হতো বলে মনে হয়। কিন্তু অভিযুক্ত পুলিশকর্মীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিলো এবং সে খবর জনগণের মাঝে ছড়িয়েও দেওয়া হয়েছিলো। তারপরেই দেখা যায় পুলিশকে প্রায় দর্শকের ভূমিকায় চলে যেতে, লকডাউন সফল করতে পুলিশের মধ্যে আগ্রহ ও উৎসাহ অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছিলো। তাই সরকার ও প্রশাসনের কাছে সবিনয়ে বলতে চাই যে, তাঁরা যেন বিশেষভাবে সতর্ক থাকেন যাতে গতবারের পুনরাবৃত্তি এবার আর না হয়।    

সব শেষে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই যে বিষয়ে সেটাও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও দরকারি। সর্বদ্রাসী করোনা ভাইরাসের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে একান্ত প্রয়োজন হলো সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। সকল রাজনৈতিক দল, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, সামাজিক সংগঠন, সরকারি-ব্বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিবিশেষ যার যা শক্তি ও সামর্থ আছে তাদের সবাইকে একজোট হয়ে সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে করোনাকে হারানোর লড়াইয়ে সামিল হতে হবে, ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। করোনা অতিমারির বিরুদ্ধে সবাই মিলে জোট বেঁধে সার্বিক শক্তির সমাবেশ না ঘটিয়ে লড়তে না পারলে করোনাকে হারানো যাবে না। আর এটা সবচেয়ে আগে, সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করা দরকার সরকারের। প্রধানত সরকারেকেই উদ্যোগী হতে হবে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে করোনার বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব কঠিন লড়াইয়ে সামিল করার। এ প্রসঙ্গে বিনম্রতার ও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে সবাইকে নিয়ে করোনা-যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে গত বছরের আমাদের অভিজ্ঞতা মোটেই আশানুরূপ ছিলো না। এবারে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই আরও কঠিন। তাই আশা করবো যে, সরকার এবার বিরোধী দল সহ অন্যান্য সকল শক্তি ও সংগঠনকে পাশে নিয়ে করোনা-যুদ্ধে পরিচালনা করতে সদর্থক ভূমিকা পালন করবে।

১৬.০৫.২১

 

Wednesday, May 19, 2021

করোনা ডায়রি (ছয়) - করোনার উপসর্গ না থাকা মানেই করোনা সংক্রমিত নয় – এটা ধ্রুব সত্য নয়

আমাদের দেহে করোনার কোনো উপসর্গ নেই এবং আমরা কোনো প্রকার অসুস্থতার প্রকাশ নেই বলে আমরা কেউ নিশ্চিত হতে পারি না যে আমরা করোনা আক্রান্ত নয়। করোনা ভাইরাসের এটা একটা অন্যতম বৈশিষ্ট। এই ভাইরাসটি অনবরত রূপ বদল করছে, ফলে এর উপসর্গ ও বৈশিষ্ট্যগুলিরও অনবরত পরিবর্তন ঘটছে। কিন্তু গত বছরের প্রথম প্রজাতির করোনা ভাইরাসটির উপসর্গহীনতার বৈশিষ্ট্যটা এখনও থেকে গেছে। ফলে আমরা যারা আপাতত সুস্থ আছি এবং করোনা উপসর্গের কোনো চিহ্ন আমাদের দেহে দেখছি না তারা জোর দিয়ে বলতে পারব না যে আমরা করোনা সংক্রমিত হই নি। করোনা যেহেতু বায়ুবাহিত ভাইরাস এবং আমরা সবাই পারিবারিক ও সামাজিক জীব তাই আমাদের প্রতি মুহূর্তেই করোনা সংক্রমিত হবার আশংকা থেকেই যায়। কিন্তু না, তারজন্যে আমি বলছি না যে, করোনার উপসর্গ থাক বা না থাক আমাদের সকলকেই করোনা টেস্ট করতে ছুটতে হবে। তবে যাদের পরিবারে করোনা থাবা বসিয়েছে তাদের কথাটা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।

শরীরে করোনার কোনো উপসর্গ না থাকলে আমরা সাধারণত ধরে নিই যে আমরা করোনা সংক্রমিত নই। এটা কিন্তু ভ্রান্ত ধারণা। এই ভ্রান্ত ধারণার শিকার হচ্ছে কিন্তু করোনা আক্রান্ত পরিবারের মানুষজনও। এমন ঘটনাও দেখা যাচ্ছে যে, করোনা রোগীর সেবাযত্ন করার পর সেই পরিবারের কারও দেহে করোনার উপসর্গ দেখা না দিলে তারা ধরে নিচ্ছে যে তারা করোনা সংক্রমিত হয় নি। এমনকি এও দেখা যাচ্ছে যে, যে ব্যক্তি করোনা রোগীর সেবাযত্ন করেছে মাস্ক না পরেই তার দেহে করোনার উপসর্গের প্রকাশ না থাকায় সেও নিশ্চিতরূপেই ধরে নিচ্ছে যে সে করোনা সংক্রমিত হয় নি। 

এক্ষেত্রে আমার বলার কথা এই যে, করোনা রোগীর সেবাযত্ন করা উপসর্গহীন কোনো ব্যক্তিরই   করোনা টেস্ট (পিসিআর টেস্ট) না করিয়ে নিশ্চিত হওয়া উচিৎ নয় যে সে করোনা সংক্রমিত হয় নি। এ প্রসঙ্গে আর একটা জরুরী কথা বলি। করোনা সংক্রমিত ব্যক্তির দেহে কোনো উপসর্গ দেখা না দিলেও সে কিন্তু করানো স্প্রেডার এবং সে অন্য মানুষের দেহে করোনা ছড়াতে সক্ষম। তাই যে ব্যক্তি করোনা রোগীর সেবাযত্ন করেছে তার অবশ্যই করোনা টেস্ট করা উচিৎ। সেটা প্রয়োজন তার পরিবার সদস্যদের ও সমাজের অন্য মানুষের স্বার্থে। কোনো কারণে যদি তার পক্ষে করোনা টেস্ট করা সম্ভব না হয় তবে তাকে অবশ্যই হোম আইসোলেশনে থাকা উচিৎ।

আমি যা বললাম তা অবশ্যই চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের কথা যা গবেষণাগারে পরীক্ষিত ও প্রমাণিত সত্য এবং অসংখ্য পর্যবেক্ষণে সমর্থিত। আমি কিন্তু শুধু চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের কথার উপর ভরসা করেই (তাদের কথায় আমাদের অবশ্যই ভরসা রাখতে হবে) বলছি না, বলছি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ কয়েকটি প্রমাণের ভিত্তিতে। তার মধ্যে দু’টি প্রমাণ রাখি এখানে। আমার প্রতিবেশী এবং আমার একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় রাজস্থানের কোটা গিয়েছিলো তার পুত্রকে আনতে যে সেখানে মেডিকেলের পরীক্ষায় বসার জন্যে কোচিং নিচ্ছিল। আমার আত্মীয়টির কোনো উপসর্গ না থাকলেও সে করোনা টেস্ট করলে দেখা যায় যে সে করোনা সংক্রমিত হয়েছে। দ্বিতীয় প্রমাণটি হলো এই রকম, আমার মেয়ের শ্বশুর, দেওর দু’জনেই করোনাক্রান্ত হয়। আমার মেয়ে তখন আমার কাছে থাকায় আমার জামাইকেই তার বাবার যাবতীয় সেবাযত্ন করতে হয়। বাবার সেবাযত্ন করার সময় যাতে সেও সংক্রমিত না হয় তারজন্যে মাস্ক পরা, স্যানিটাইজ করা সহ যাবতীয় সতর্কতা সে অবলম্বন করেছিলো। ধীরে ধীরে তার বাবা ও ভাই সুস্থ হয়ে ওঠে। তারপর আমার জামাই করোনা টেস্ট করায় যদিও তার শরীরে করোনা উপসর্গ দেখা যায় নি। টেস্টে তারও করোনা পজিটিভ ধরা পড়ে।  

২০.০৫.২১    

 

স্বাধীনোত্তর কালের একটি অভূতপূর্ব নির্বাচন আমরা দেখলাম পশ্চিমবঙ্গে

 Representational Image

প্রথমেই বলি যে স্বাধীনোত্তর ভারতে এবারের (২০২১) পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনটি ছিলো সব দিক থেকেই অভূতপূর্ব ও সম্পূর্ণই ভিন্ন প্রকৃতির। নির্বাচনের ফলাফলও হয়েছে অনুরূপ প্রকৃতির – অভূতপূর্ব ও একেবারেই ভিন্ন ধারার।

এই নির্বাচনের আগে ও পরে এবার অনেকগুলি বিশেষ উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য আমাদের নজরে এসেছে যা অতীতে কখনো পরিলক্ষিত হয় নি। তার মধ্যে প্রধান কয়েকটি বৈশিষ্ট্য এ রকমঃ

·         এক).  এবারে ভোট হয়েছে সামগ্রিকভাবে কার্যত ধর্মীয় মেরুকরণের ভিত্তিতে। আরও স্পষ্ট করে বললে হিন্দু ও মুসলমান বিভাজনের ভিত্তিতে।

·         দুই). নির্বাচনের একেবারে প্রাক্কালে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব ঘটে এবং দলটি অতি দ্রুত বঙ্গ রাজনীতিতে চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে। এটা একটা অভূতপূর্ব ঘটনা।  

·         তিন). এই প্রথম একজন মুসলিম ধর্মগুরুকে (পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকী) শাসকদলের মোল্লাতোষণের বিরুদ্ধে এবং ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে রাজনীতির ময়দানে অবতীর্ণ হতে দেখা গেলো।  

·         চার). পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় আগামী পাঁচ বছরের জন্যে এই প্রথম একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হলো যেখানে বাম ও কংগ্রেস সহ তৃতীয় কোনো ধর্মনিরপেক্ষ দলের কণ্ঠস্বর (দু’জন বিধায়কের ব্যতিক্রমী উপস্থিতি বাদ দিলে) ধ্বনিত হবে না।    

·         পাঁচ). পশ্চিমবঙ্গ এই প্রথম দ্বিদলীয় শাসনব্যবস্থায় ঢুকে পড়লো যা পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে লজ্জা ও গণতন্ত্রের পক্ষে অশনি সংকেতও বটে।

  এবার কোনো রাডার যন্ত্রেই বাঙালির মনের হদিস ধরা পড়ে নি

নির্বাচনের আগে বহু সমীক্ষা হয়েছে যাতে অনেক সংস্থায় সামিল ছিলো। প্রতিবারের মতন বুথ ফেরৎ সমীক্ষাতেও মেতে উঠেছিল সেই সংস্থাগুলি। সমীক্ষার প্রতিযোগিতায় এবার সামিল হতে দেখা গিয়েছে মূল ধারার সংবাদ মাধ্যম ছাড়াও অনেক ছোট ছোট অনামী সোশ্যল মিডিয়াকেও। রাজনৈতিক দলগুলোও যথারীতি যে যার মতন তাদের নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আগাম আভাস দিয়েছিলো। কিন্তু কারো কোনো সমীক্ষার (নির্বাচনের আগের ও পরের দুটোরই) পূর্বাভাষই নির্বাচনী ফলাফলের ধারে কাছে পৈঁছোতে পারে নি। নির্বাচনের প্রাক্কালে কয়েক দফার সমীক্ষায় শাসক দলের প্রত্যাবর্তনের পূর্বাভাষ ছিলো বটে, কিন্তু তাতে শাসকদল কোনো রকমে টেনেটুনে পাশ মার্ক দিয়েছিলো মাত্র। বুথ ফেরৎ সমীক্ষাগুলিতে ছিলো তিন রকমের পূর্বাভাষ। একদল বলেছিলো যে শাসকদল অল্প ব্যবধানে আবার ক্ষমতায় ফিরবে, একদল বলেছিলো বিজেপি ক্ষমতায় আসতে চলেছে এবং কিছু সংস্থা বলেছিলো যে কোনো দলই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। কিন্তু দেখা গেলো যে একটা পূর্বাভাসও মেলে নি। শাসকদল পুনরায় ক্ষমতায় ফিরেছে, কিন্তু ফিরেছে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে, সামান্য মার্জিনে নয়।     

শাসকদলের নেতা-নেত্রীরা নির্বাচনের আগে মুখে যাই বলুক না কেন, তাদের মধ্যেও ক্ষমতা হারানোর আশংকা ছিলো। ছিলো বলেই দলনেত্রী নির্বাচনী প্রচারে এক সময় বাম ও কংগ্রেসের ভোটারদের কাছেও সমর্থন চেয়েছিলেন, বলেছিলেন, বিজেপিকে আটকাতে চাইলে আপনারা আমাকে সমর্থন করুন। বিজেপি ডাক দিয়েছিলো পরিবর্তনের। তাদের গভীর বিশ্বাস ছিলো যে তারাই ক্ষমতায় আসছে, সরকার তৈরি করাটা শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। সংযুক্ত মোর্চাও (বামফ্রণ্ট, জাতীয় কংগ্রেস ও আব্বাস সিদ্দিকীর আইএসএফ) ত্রিমুখী লড়াইয়ের আশা করেছিলো।  

নির্বাচনী ফলাফল কিন্তু একটা জিনিষ স্পষ্ট করে দিয়েছে যে বাংলার মানুষ যা ভেবেছিলো তা রাজনৈতিক দলগুলো টের পায় নি। টের পায় নি দেশ বিদেশের নামিদামি ও অনামী কোনো সংবাদ মাধ্যমই। যেমন সংযুক্ত মোর্চার নেতৃবৃন্দ ঘূণাক্ষরেও আঁচ করতে পারেন নি যে তারা বিধানসভা থেকে একেবারেই মুছে যাবে। এটা সংবাদ মাধ্যমগুলোও আঁচ করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিজেপিও বিন্দুমাত্র টের পায় নি যে বাংলা জয়ের স্বপ্ন তাদের মুখ থুবড়ে পড়বে। দু’শো আসন পাওয়া দূরের কথা তাদের জয়শ্রী রামের রথ আটকে গেছে একশোরও অনেক নীচে, মাত্র সাতাত্তরেই। এ রকম লজ্জাজনক হার হতে পারে তা তারা দুঃস্বপ্নেও ভাবে নি। মমতা ব্যানার্জীই কি ভাবতে পেরেছিলেন যে ২১৩টা আসনে জয়লাভ করে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা তিনি পুনরায় ক্ষমতায় ফিরবেন?  বাংলা কিন্তু তাঁকে এতই ঢেলে ভোট দিয়েছে বিজেপি বিধায়ক কিনে পেছনের দরজা দিয়ে নবান্ন দখল করার ভাবনা স্বপ্পেও ভাবতে পারবে না। সুতরাং এটা বলাই যায় যে, বঙ্গ সমাজ তার মনোভাব ও পরিকল্পনা এতটাই সংগোপনে সংরক্ষণ রেখেছিলো যে কোনো রাজনৈতিক দল ও মিডিয়ার রাডার তার এতটুকু হদিস পর্যন্ত  পায় নি।

তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়া সব দলেরই ভোট কমেছে

২০১১ সাল থেকে বামভূমিতে ধ্বস নামার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো তা এবারেও তা অব্যাহত থেকেছে। জাতীয় কংগ্রেসের অবস্থাও প্রায় তাই। এই বিধানসভার নির্বাচন ছাড়া প্রত্যেকটা নির্বাচনেই বিজেপির ভোটের হার বেড়েছে। অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটের হার ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচন ছাড়া প্রত্যেকবারই বৃদ্ধি পেয়েছে। কার কতটা বৃদ্ধি বা হার হয়েছে তা দেখানো হয়েছে নীচের সারণিতে।

·         নির্বাচনের বছর  -  তৃণমূল কংগ্রেস  -  বিজেপি  - জাতীয় কংগ্রেস -  বামফ্রণ্ট 

·         ২০১১ বিধানসভা –    ৩৮.৯%    -   ৪.১%  -    ৯.১%   -   ৪১.১%

·         ২০১৪ লোকসভা  -   ৩৯.৮%    -   ১০.২%  -   ১২.৩%   -   ৩০.১%

·         ২০১৬ বিধানসভা –   ৪৪.৯%     -   ১৭%   -   ৯.৭%    -   ২৫.৬%

·         ২০১৯ লোকসভা –   ৪৩.৬৯%     -  ৪০.৬৪%  -  ৪.৯%    -  ৬.৪%

·         ২০২১ বিধানসভা –   ৪৭.৯%      -  ৩৮.০৯%  - ২.৯৪%   -   ৫.৬৬%

 

২০০৬ সালে বামেদের প্রাপ্ত ভোট ছিলো ৫০.৬ শতাংশ। ২০১১ এর নির্বাচনে যেবার বামফ্রণ্ট পরাস্ত হয় সেবার এক ধাক্কায় বামভূমিতে ধ্বস নামে ৯.৫ শতাংশ ভোট। তারপর ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ধ্বস নামে আরও বেশী, ১০%। এভাবে ক্রমাগত ধ্বস নামতে নামতে এই বিধানসভা নির্বাচনে নেমে এসেছে ৬% এরও নীচে। কংগ্রেসের ভূমিধ্বসও ধারাবাহিকভাবে হয়েছে (ব্যতিক্রম ২০১৪ এর লোকসভা নির্বাচন)। এই নির্বাচনেও ভোটক্ষয়ের ধারা অব্যাহত রইলো। শুধু তাইই নয়, বাম ও কংগ্রেস দল  এবার একটা আসনেও জয়লাভ করতে পারে নি। অবস্থাটা এতটাই শোচনীয় যে, শুধু বিধানসভা থেকে নয় বাংলার মাটিতে তাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে উঠেছে। এটা কিন্তু শুধু তাদের পক্ষেই চিন্তাজনক নয়, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষেও বেশ চিন্তাজনক। বিজেপির ভোটও এবার কমেছে ২.৫৯%। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পর থেকে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত প্রতিবারই বিজেপির ভোট বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ২০১১ সালের বিধানসভায় তাদের প্রাপ্ত ভোট ছিলো ৪.১%, সেটা দশগুণ বেড়ে ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে ৪০.৬৪% এ পৌঁছে যায়। তার ফলশ্রুতিতে তারা ৪২টি আসনের মধ্যে ১৮টি জয়লাভ করে তৃণমূলের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করে। স্বভাবতই এই বিধানসভা নির্বাচনে নবান্ন দখলের জন্যে সর্বশক্তি নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো।  

বিধানসভা ভোট এবার কার্যত গণভোটের চেহারা নিয়েছে

এবারের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল বঙ্গবাসীর সামনে অনেকগুলি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে। সব প্রশ্নের উত্তর এ নিবন্ধে দেওয়ার পরিসর নেই। প্রশ্নগুলি তবু রাখা যেতে পারে। প্রশ্নগুলি এ রকমঃ

·         এক). উল্কার মতন আবির্ভাব হওয়া এবং আবির্ভাবেই সাড়া ফেলে দেওয়া পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকীর ইণ্ডিয়ান সেকুলার ফ্রণ্ট আগামী দিনেও প্রাসঙ্গিক থাকবে?   

·         দুই). বামেদের ধর্মগুরু আব্বাস সিদ্দিকীর আইএসএফ দলের সঙ্গে জোট কী বাম আদর্শের পরিপন্থী? এবং আইএসএফ দলকে বাম-কংগ্রেস জোটে নিয়ে বামেরা ভুল করেছে?

·         তিন). কংগ্রেস ও বামেরা কি ভবিষ্যতে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, নাকি বঙ্গ রাজনীতি থেকে মুছে যাবে?

·         চার). ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর প্রত্যেকটা নির্বাচনে বিজেপির ভোটের হার বাড়তে বাড়তে এবার কমে গেলো কেন?

·         পাঁচ). গতো লোকসভা নির্বাচনে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট কমেছিলো। প্রায় দশ বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে শাসকদলের ভোট কিছুটা কমাই তো স্বাভাবিক। এবারেও যদি ভোট কমতো তবে সেটাই তো স্বাভাবিক ঘটনা হতো। কিন্ত অন্য সব দলের ভোটের হার যখন কমলো তখন শাসকদলের ভোট বাড়লো কেনো? কোন যাদুমন্ত্রে এমনটা হলো যেটা নিঃসন্দেহে একটি চমকপ্রদ ঘটনা?   

শেষের প্রশ্নটা নিয়েই আলোচনা শুরু করা যাক। বিজেপি দিয়েছিলো পরিবর্তনের ডাক এবং সংযুক্ত মোর্চা বিকল্প নীতি ও কর্মসূচীর। এ কথা বলা যাবে না যে বিজেপির পরিবর্তনের ডাক কিংবা সংযুক্ত মোর্চার বিকল্প নীতি ও কর্মসূচীর ইস্তেহার অপ্রাসঙ্গিক ছিলো। কারণ, বিগত দশ বছরের তৃণমূল কংগ্রেসে শাসনে আমফান ও টেট দুর্নীতি সর্বোচ্চ শিখর স্পর্শ করেছিলো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভেঙে পড়া দশা, সারদা-নারদা কেলেঙ্কারী, গরু পাচার এবং বালি ও কয়লা লুট, পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট লুট, কাটমানি ও সিণ্ডিকেট রাজ, পরিযায়ী শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনতে টালবাহানা, কলকারখানা একের পর বন্ধ হয়ে যাওয়া, কোনো নতুন শিল্প না আসা, সরকারি শূন্য পদ এবং স্কুল-কলেজে নিয়োগ বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং সর্বোপরি শিক্ষিত বেকার যুবদের ভবিষ্যৎ ডুবে গেছে এক রাশ চাপা ঘন অন্ধকারে। এ সকল পাহাড় প্রমাণ ব্যর্থতা ও নিরাশা ছাড়াও ছিলো রাজ্য জুড়ে সুশাসনের বদলে প্রশাসনের সর্বস্তরে অপশাসনের চূড়ান্ত। প্রতিশ্রুতি ছিলো প্রশাসনে দলতন্ত্রের বদলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রকে রাজনীতি মুক্ত করার। কিন্তু সেসব কিছুই হয় নি, উল্টে সর্বক্ষেত্রেই হয়েছে আরও অবনতি। এসব নিয়ে সর্বস্তরে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ ও ক্ষোভও ছিলো প্রচুর, ছিলো দলের অভ্যন্তরে আদি-নব, চাওয়া-পাওয়া এবং পাওয়া-না পাওয়ার প্রবল দ্বন্দ। মোদ্দা কথা দশ বছরেরে শাসনে জনগণের অভিজ্ঞতা সামগ্রিকভাবে মোটেই সুখকর ছিলো না যাতে শাসকদলের ভোট বাড়তে পারে। প্রশ্ন হলো তাহলে ভোট বাড়লো কেন? এর আগে প্রতিটি নির্বাচনে বিজেপির ভোট বেড়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে, এবারে একেবারে মোক্ষম সময়েই ভোট কমলো, কিন্তু কেন ?  ভোট বাড়ানোর জন্যে বিজেপির অনুকূলে যাবতীয় উপাদানই তো মজুত ছিলো, যেমন ছিলো জনগণের ব্যাপক অসন্তোষ ও ক্ষোভ, ছিলো দলের বিপুল অর্থবল, ছিলো শাসকদলের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের বুকে কাঁপন ধরানোর জন্যে ইডি ও সিবিআই এর মতন পরাক্রমশালী রাজনৈতিক-প্রশাসনিক হাতিয়ার, এতদসত্ত্বেও বিজেপি ভোট বাড়িয়ে নিয়ে ক্ষমতার দখল নিতে পারলো না কেন? এই প্রশ্ন দুটিই সবচেয়ে বেশি চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে।

সাধারণভাবে যে কোনো ভোটে সরকারের পাঁচ বছরের কাজের সাফল্য-ব্যর্থতার ভিত্তিতেই জনগণ ভোট দিয়ে থাকে। এবার নিশ্চয় করেই বলা যায় যে, বাঙালি ভোটার এবার ভোট দেবার আগে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের পাঁচ বা দশ বছরের কাজের বিচার করে নি। তারা এবার আড়া-আড়ি দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে ইভিএমে ছাপ মেরেছে। একদল চেয়েছে বিজেপিকে ক্ষমতায় দেখতে, আর একদল চেয়েছে বিজেপির ক্ষমতা দখলকে ঠেকাতে। সংযুক্ত মোর্চার সমর্থক সহ অন্যান্য বিরোধী দলের লোকেরা দলীয় স্বার্থের উর্ধে উঠে বিজেপিকে ঠেকানো অধিক জরুরী বলে মনে করেছে। তারা তাই চাঁদ সদাগর যেমন বাঁ হাতে মনসার পূজা দিয়েছিলো সে রকম প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছে। এর আগে বিগত দশ বছরে বল্গাহীন সন্ত্রাসের জন্যে বামেদের বহু সমর্থক ও অনুগামী তৃণমূল কংগ্রেসকে হারাতে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলো। তারজন্যে বাম নেতৃত্বকে ‘বামের ভোট রামে গেছে’ বলে কটাক্ষ শুনিতে হয়েছে। বাম ও কংগ্রেসের বহু অনুগামী এবার বিজেপিকে ঠেকাতে তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছে বলেই এবার বিজেপির ক্রমাগত ভোট বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ধাক্কা খেয়েছে এবং ২০১৯ এর লোকসভা ভোটের তুলনায় ২.৫% (আড়াই শতাংশ) ভোট কমেছে। এবং উল্টোদিকে বাম ও কংগ্রেসের জন্যে বিধানসভার দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। আমার বিশ্বাস বঙ্গবাসীর দেওয়া বাম ও কংগ্রেসের জন্যে এই কঠিন শাস্তি সাময়িক। পাঁচ বছর পর এই শাস্তি তারা ফিরিয়ে নেবে।   

তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট বৃদ্ধি এবং বিজেপির ভোট হ্রাস পাওয়ার আর একটি উল্লেখযোগ্য কারণ রয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে প্রবল ক্ষোভ-বিক্ষোভ এবং তার ফলশ্রুতিতে দল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়ার হিড়িক আমরা দেখেছি। এটা আরও তীব্রতা পায় পূর্ণাঙ্গ প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর। ফলে দলের কয়েকজন নির্দল প্রার্থী হয়ে ভোটে দাঁড়িয়ে যায় এবং, একাংশ পরিকল্পনা করে অন্তর্ঘাত করে নিজ নিজ কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থীকে হারানোর। কিন্তু তারাও শেষ পর্যন্ত বিজেপির বিপদটাকেই বড়ো করে দেখে এবং তাদের দলের পক্ষেই ভোট করে।

পরিশেষে শাসকদলের উদ্দেশ্য সবিনয়ে দুটি কথা বলি যে, প্রথমতঃ তারা যেন এটা উপলব্ধির মধ্যে রাখেন যে বাঙালি বিপুল সংখ্যায় নিজেদের যাবতীয় অসন্তোষ ও ক্ষোভ বুকে চাপা দিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে ঢেলে দিয়েছে তাদের জন্যে নবান্নে প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে। ফলে বিধানসভা ভোট কার্যত গণভোটের চেহারা নিয়েছে। আর গণভোটের বিচার্য বিষয় ছিলো – বিজেপির পক্ষে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট। প্রসঙ্গত স্মরণ করিয়ে দিই যে, রাজ্য জুড়ে স্লোগান উঠেছিলো - ‘নো ভোট টু বিজেপি’ (No Vote to BJP)। সেই ‘না’ ভোটের সৌজন্যেই তৃণমূল কংগ্রেস তৃতীয় বার ক্ষমতায় এসেছে, তৃণমূল কংগ্রেসকে পুনর্বার ক্ষমতায় চাই বলে সবাই কিন্তু ভোট দেয় নি। দ্বিতীয়তঃ এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, ‘নো ভোট টু বিজেপি’-র মতন ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি বারবার আসবে না।  

 

 

Wednesday, February 17, 2021

সংযুক্ত আরব আমিরাতে ঘোষিত নতুন নাগরিকত্ব আইনটি ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী

অতি সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত তাদের পুরনো নাগরিকত্ব আইনটি সংশোধন করেছে। সংশোধিত নতুন আইন অনুযায়ী সেখানে এখন থেকে বিদেশী মেধাবীদের দ্বৈত নাগরিকত্ব প্রদান করা যাবে। অর্থাৎ কোনো বিদেশী নাগরিক যদি নিজ দেশের নাগরিকত্ব বহাল রেখেও সংযুক্ত আরব আমিরাতের নাগরিকত্ব পেতে চায় তবে নতুন আইনে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সে আবেদনে সাড়া দিতে আইনত যে বাধা ছিল তা রদ করা হয়েছে। ‘বিদেশী’ মানে বিদেশীই, সেক্ষত্রে ধর্মের কোনো বাছ-বিচার থাকবে না, অর্থাৎ বিদেশী নাগরিক যদি অমুসলিম হন তবুও। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে পুরনো নাগরিকত্ব আইনে দ্বৈত নাগরিকত্ব দেওয়া তো দূরের কথা, কোনো বিদেশীকেই আরব আমিরাতের নাগরিকত্ব দেওয়া হতো না। আইনেই সে বাধা ছিলো। শুধু তাই-ই নয়, আমিরাতি পুরুষদের স্ত্রী এবং আমিরাতি বাবার সন্তান ব্যতীত এমনকি উপসাগরীয় দেশগুলোর কাউকেই সে দেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হতো না। বিশ্বের সমস্ত অমুসলিম দেশেই মুসলিমরা নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকারী, এবং পায়ও। ইউরোপ তো মুসলিমদের জন্যে তাদের দরজা হাট করে খুলেই রেখেছে। ইদানিং অবশ্য এই ঐতিহ্যে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। 
 
কিন্তু মুসলিম দেশগুলিতে অমুসলিমরা ব্রাত্য, ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ছাড়া অমুসলিম বিদেশীদের নাগরিকত্ব বা দ্বৈত নাগরিকত্ব কোনোটাই দেয়া হয় না। কিছু মুসলিম দেশ আছে যেখানে অমুসলিমরা জন্মসূত্রেই সে দেশের নাগরিক তাদেরও অত্যাচার করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। কিছু মুসলিম দেশ আছে যেখানে তাদের সংবিধানে অমুসলিমদের ধর্মাচারণের অধিকারটুকু পর্যন্ত দেওয়া হয় নি। অপরদিকে মুসলিমরা কিন্ত বিশ্বের সমস্ত দেশেরই নাগরিকত্ব ভোগ করার অধিকার চায়। শুধু তাই-ই নয়, তারা শরীয়া আইন ভোগ করার পরিসর ও অধিকারও চায়। তারা এটা বিশ্বাস করে যে বিশ্বের সর্বত্র শরীয়া আইনের অধিকার সহ জীবন যাপন করা তাদের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। তারা এও বিশ্বাস করে যে, মুসলিম দেশে অমুসলিমদের তাদের নিজস্ব ধারার জীবন যাপন করতে চাওয়ার অধিকার নেই। মৌলিক অধিকার ভোগ করার ক্ষেত্রে এই যে ভয়ঙ্কর বৈষম্য তাতে মুসলিমরা কোনো ত্রুটি বা ভুল দেখে না। কারণ তারা মনে করে যে আল্লাহ্র তৈরি আইনে কোনো ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে না। নাগরিকত্ব সহ নিজ নিজ ধর্মাচারণ ভোগ করার ক্ষেত্রে শরীয়া আইনের এই যে একদেশদর্শীতা তার বিরুদ্ধে মুসলিম সমাজ থেকে কোনো সমালোচনা শোনা যায় না। আরব উপদ্বীপের দেশগুলির নাগরিকত্ব আইনের একটি ধর্মীয় প্রেক্ষিত রয়েছে উপসাগরীয় অঞ্চলের উক্ত শরিয়া আইনগুলি প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে প্রচলিত রয়েছে। সমাজ পরিবর্তনশীল, পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থাও। ফলে বিশ্বব্যাপী দেশের সংবিধান, সমাজের নিয়ম-নীতি ও ঐতিহ্যে অবিরাম ঘটে চলেছে। এমনকি আমূল পাল্টে গেছে অনেক দেশের সমস্ত আইনকানুন এবং সমগ্র সমাজব্যবস্থাটাও। কিন্তু মুসলিম দেশগুলি, বিশেষ করে উপসাগরীয় দেশগুলি কার্যত প্রায় অপরিবর্তিতই থেকে গেছে। আরব উপদ্বীপের দেশগুলি প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে চূড়ান্ত বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব আইন নিয়ে আজও তালগাছের মতন এক পায়ে স্থবির দাঁড়িয়ে রয়েছে। এতে যে জাতি ধর্ম ভাষা সংস্কৃতির বৈচিত্রে ভরপুর বিশ্বে শান্তি, সম্প্রীতি সহবস্থান এবং বিকাশ ব্যহত হচ্ছে সে বিষয়ে তারা নির্বিকার। এর কারণ হলো, উপসাগরীয় অঞ্চলের শাসকদের তাদের নবীর প্রতি অন্ধ বিশ্বাস, আনুগত্য ও আবেগ। হ্যাঁ, তারা তাদের নবীর তৈরি নাগরিকত্ব আইনই অনুসরণ করে চলেছেন ধর্মান্ধতা বশতই। তিনি এই নাগরিকত্ব আইন শুধু তৈরিই করেন নি, স্বহস্তে সেটা প্রয়োগও করে গেছেন। তিনিই প্রথম আরব উপদ্বীপ থেকে প্রথমে ইহুদীদের বানু নাজির গোষ্ঠী এবং তারপর বানু কানুইকা গোষ্ঠীকে মদিনা থেকে বিতাড়িত করেন। তারপর বানু কুরাইজা গোষ্ঠীর ইহুদীদের বিচারের নামে সমস্ত পুরুষদের গলা কেটে হত্যা করেন এবং নারী ও শিশুদের বন্দি করে দাস-দাসীতে পরিণত করেন। তিনি মৃত্যুশয্যায় আরবকে সম্পূর্ণ অমুসলিম মুক্ত করার নির্দেশ দিয়ে যান তাঁর উত্তরাধিকারীদের। দ্বিতীয় খলিফা ওমর বিন খাত্তাব সে নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। তারপর থেকেই আরব উপদ্বীপে সেই আইন ও ঐতিহ্য আজও বহাল রয়েছে। আরব থেকে অমুসলমানদের তাড়ানোর ব্যাপারে ইসলামের প্রবর্তক ঠিক কী বলে যান তা দেখা যাক। হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি রাসূল (স)-কে বলতে শুনেছেন, আমি আরব উপদ্বীপ থেকে অবশ্যই ইহূদী ও নাসারাদের বের করে দেব। সেখানে মুসলমান ছাড়া আর কাউকে থাকতে দিব না। আবু ঈশা বলেন এ হাদীসটি হাসান ও সহীহ। (দ্রঃ তিরমিযি শরীফ ১-৬ খণ্ড একত্রে, সোলেমানিয়া বুক হাউস, ঢাকা, হাদিস নং ১৫৫২, ১৫৫৩) উক্ত হাদসটি বোখারী শরিফ এবং মুসলিম শরীফেও রয়েছে, রয়েছে কোরানের তফসিরেও। নবীর তৈরি করা আইন যা তিনি হাতে-কলমে প্রয়োগ করে গেছেন তার প্রতি বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর (সম্রদায়ের) বিশ্বাস ও আবেগ কল্পনাতীত। মুসলিমদেশগুলির শাসকদের জন সমর্থনের প্রধান ভিত্তি হলো মুসলিমদের তাদের ধর্ম ও নবীর প্রতি অন্ধ আবেগ ও বিশ্বাস। উপসাগরীয় দেশগুলির ক্ষেত্রে একথা আরও বেশী প্রযোজ্য। শিক্ষা স্বাস্থ্য পরিবহণ পরিবেশ নির্মাণ প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে অমুসলিমদের সহযোগিতা ছাড়া, বিশেষ করে ইহুদী-নাসারাদের (খ্রিষ্টানদের) সহযোগিতা ব্যতীত ঐ দেশগুলির এক পাও চলার ক্ষমতা নেই। ফলে সমগ্র উপসাগরীয় উপতক্যা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে লক্ষ লক্ষ খ্রিষ্টান হিন্দু প্রভৃতি অমুসলিম ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ। নবীর জন্মভূমি ও কর্মভূমি সৌদি আরবে মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশই বিদেশী যাদের সিংহভাগই অমুসলিম, যদিও অমুসলিম নাগরিক একজনও নেই সেখানে। অর্থাৎ নীতিটা হলো অমুসলিমদের সহযোগিতা নেওয়া হবে কিন্তু বিনিময়ে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না। এই অন্যায় ও অযৌক্তিক নীতি অনুসরণ করার পেছনে যেমন ধর্মীয় কারণ রয়েছে, তেমনি রয়েছে রাষ্ট্র ক্ষমতা ধরে রাখার স্বার্থও। নবীর আইন ও আদর্শের অবমাননা মুসলিম সমাজ সহজে মেনে নেবে না, তারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ পর্যন্ত করেছে। এ রকম দৃষ্টান্ত অনেক রয়েছে। আরবের বিভিন্ন রাষ্ট্রের শাসকরা তাই নবীর কোনো আইনে পরিবর্তন বা সংস্কার করতে চায় না। সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী সেখ মহম্মদ বিন কাসেম অল-মকতুম তাই নাগরিকত্ব আইনটি সংস্কার করে একটি ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। যে কারণে সংযুক্ত আরব আমিরশাহী নাগরিকত্ব আইনের সংস্কার করলো স্বল্প আয়ের শ্রমিক ও কর্মীরা সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থনীতি গড়ে তুলতে, নির্মাণ ক্ষেত্রে, হোটেল ব্যবসা এবং ভ্রমণ খাতে জনবল সরবরাহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা কিন্তু নতুন নাগরিকত্ব আইনের সুযোগ পাবে না। বিনিয়োগকারী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী (ইঞ্জিনিয়র), গবেষক, উদ্ভাবক, শিল্প-সংস্কৃতি ও লেখার জগতে সৃজনশীল ব্যক্তিদেরই কেবল দ্বৈত নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে। নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু শর্ত রাখা হয়েছে। যেমন বিনিয়োগকারী হলে তাকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিজস্ব সম্পত্তি থাকতে হবে, চিকিৎসক হলে সে দেশে চাহিদা আছে এমন ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ হতে হবে, গবেষক ও উদ্ভাবক হলে সংযুক্ত আরব আমিরাতে অথবা বিশ্বের নামী উপযুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে অনুমোদিত পেটেন্ট গ্রহণ করতে হবে, সৃজনশীল ব্যক্তিদের তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা থাকতে হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ তাদেরই নাগরিকত্ব দেওয়া হবে যারা সে দেশটির সার্বিক বিকাশে এবং অর্থনীতিতে কিছু অবদান রাখতে পারবে। নবীর তৈরি আইনে হস্তক্ষেপ করা বিশ্বের মুসলিম উম্মাহর কাছে একটি গুরুতর ইসলামিক বিচ্যুতি যা যে কোনো মুসলিম শাসকের শাসন ক্ষমতায় টিকে থাকার ক্ষেত্রে প্রচণ্ড ঝুঁকিপূর্ণ। সে ঝুঁকি নিয়েও সংযুক্ত আরব আমিরাত কেন নাগরিকত্ব আইনের সংস্কার করলো তা শোনা যাক তার প্রধানমন্ত্রীর মুখেই। তিনি তাঁর টুইটার হ্যাণ্ডেলে লিখেছেন, “We adopted law amendments that allow granting the UAE citizenship to investors, specialized talents & professionals including scientists, doctors, engineers, artists, authors and their families. The new directives aim to attract talents that contribute to our development journey,” মধ্যযুগীয় নাগরিকত্ব আইন ত্যাগ করতে হবে একদিন সমগ্র আরব উপদ্বীপকেই যে সময় ও পরিস্থিতিতে সংযুক্ত আরব আমিরাত নাগরিকপ্ত্ব আইনটি আমূল বদলে ফেললো সেটি বিশেষভাবে বিবেচনাযোগ্য। একদিকে করোনা ভাইরাসের অতিমারি জনিত বিশ্বজুড়ে অভূতপূর্ব আর্থিক সংকট, অপরদিকে আন্তজার্তিক বাজারে পেট্রলিয়াম তেলের দামের হ্রাস। আরব উপদ্বীপের দেশগুলির অর্থনীতি নির্ভরশীল প্রধানত তেল ও পর্যটন শিল্পের ওপর। সৌদি আরবের অর্থনীতিকে সামাল দেবার জন্যে তেল ও পর্যটন শিল্প ছাড়াও রয়েছে মক্কার কাবা মসজিদ ও মদীনার মসজিদে নববী যেখান থেকে হজ ও উমরা খাতে তারা বিশাল অংকের বিদেশী মূদ্রা আয় করতে পারে। কিন্তু সংযুক্ত আরব আমিরাতের সে সুযোগ নেই। বিশ্বব্যাপী করোনা অতিমারির কারণে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পর্যটন শিল্প। একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে খনিজ তেলের মূল্য হ্রাস, অপরদিকে পর্যটন শিল্পে গভীর মন্দা, এই দুটি ঘটনা উপসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনীতিতে তৈরি করেছে গভীর সংকট। এই সংকট হয়তো ইসলামি নাগরিকত্ব আইন সংস্কারে প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ বিন রশিদ অল-মকতুমকে প্ররোচিত করে থাকতে পারে। কিন্তু সেটাই নিশ্চয়ই একমাত্র কারণ নয়। নবীর তৈরি আজন্ম লালিত নাগরিকত্ব আইনটি ত্যাগ করার একটি আলাদা ও বৃহত্তর অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রলিয়াম পণ্যের দাম হ্রাস পাওয়ার কতকগুলি কারণ রয়েছে যেখানে উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর কোনো হাত নেই। তার মধ্যে প্রধান কারণগুলি হলো - গোটা বিশ্বেই পেট্রলিয়াম তেল ও গ্যাস উৎপাদনের লেখচিত্র ঊর্দ্ধমুখী, পেট্রলিয়াম তেল ও গ্যাসের বিকল্প শক্তির ক্রমাগত উৎপাদন বৃদ্ধি, অতিমারির কারণে উড়ান শিল্পে সংকট এবং পৃথিবীতে যুদ্ধ/গৃহযুদ্ধ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাওয়া। করোনাজনিত অতিমারির সংকট একদিন যাবে, পর্যটন শিল্পও কিছুটা চাঙ্গা হবে, কিন্তু অন্য কারণগুলি তো থেকেই যাবে। এই বিষয়টি উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলির শাসকদের চোখের নির্ভাবনার ঘুম কেড়ে নিয়েছে। এটা হলো নাগরিকত্ব আইন সংস্কার করার বৃহত্তর অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের একটা দিক। এছাড়া আর একটা দিক রয়েছে যেটা আরো বৃহৎ ও আরো বেশি গুরুত্ব্বপূর্ণ। সেটা হলো পেট্রলিয়াম তেল ও গ্যাসের ভবিষ্যৎ। পেট্রলিয়াম তেল ও গ্যাসের প্রাকৃতিক ভাণ্ডার দ্রূত শেষ হয়ে আসছে। সেদিন আর খুব বেশি দূরে নেই যেদিন এই ভাণ্ডার একেবারেই নিঃশেষ হয়ে যাবে। শুধু পর্যটন শিল্পের ওপর নির্ভর করে কোনো দেশ বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। তাই উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলিকে সময় থাকতেই খনিজ তেল ও গ্যাসের নির্ভরশীলতা বের করতেই হবে। নচেৎ তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে এক নিশ্ছিদ্র তমসাচ্ছন্ন ভবিষ্যৎ। আর তা করতে হলে তাদের সম্ভাব্য সমস্ত ক্ষেত্রে শিল্প এবং কলকারখানা গড়ে তুলতে হবে এবং তৎসহ গড়ে তুলতে হবে বিদেশী বিনিয়োগের জন্যে উপযুক্ত পরিবেশ, পরিস্থিতি ও পরিকাঠামো। শিল্প এবং কলকারখানা গড়ে তোলা এবং বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিন্তু অন্যতম প্রধান বাধা হলো তাদের নাগরিকত্ব আইনটি। সংযুক্ত আরব আমিরাতকে একটি আধুনিক এবং শিল্পোন্নত রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্যে এই আইনটিকে সংস্কার ও যুগোপযোগী করা একান্ত অপরিহার্য ছিলো। অপরিহার্য গোটা আরব উপদ্বীপের জন্যেই। সমগ্র উপদ্বীপকেই তাই অদূর ভবিষ্যতে একদিন না একদিন সংযুক্ত আরব আমিরাতের পথে হাঁটতে হবে। ৫.২.২১

বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাইনি – পাঁচ

  দ্বিতীয় অধ্যায় শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবের প্রতি তীব্র গণরোষের নেপথ্যে ২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে ৩৬ দিন পর (৫ই ...