Friday, October 6, 2017

রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান করা শুধু মায়ানমার সরকারের দায় নয়, রোহিঙ্গাদেরও দায় নিতে হবে



অন লাইনে চোখ রাখলে চোখের সামনে ভেসে উঠছে রোহিঙ্গাদের ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের হাড় হিম করা একের পর এক দৃশ্য ভেসে উঠছে রোহিঙ্গা স্মরণার্থীদের ক্রন্দনরত বিবর্ণ মুখের মর্মস্পর্শী ছবির মিছিল খবরের কাগজগুলিতেও প্রথম পাতা দখল করে থাকছে রোহিঙ্গাদের খবর। দুরদর্শনেও তাই। রোহিঙ্গা ইস্যু ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। হওয়াটাই যে স্বাভাবিক। কারণ তাদের ওপর মায়ানমার সরকারের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন মানবতা ও মানবাধিকারের সমস্ত সীমা অতিক্রম করে গিয়েছে। তাদের গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। অভিযোগ যে তাদের টার্গেট করে গুলি করা হচ্ছে হত্যা করার জন্যে বাংলাদেশে বিদেশমন্ত্রী দাবী করেছেন যে রাখাইন প্রদেশে অন্ততঃ তিন হাজার রোহিঙ্গা নিধন হয়েছে।  রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন সত্যিই এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে প্রাণ বাঁচাতে প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই বিপজ্জনক পথ ধরে রোহিঙ্গারা দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেফলে রোহিঙ্গারা শয়ে শয়ে মারা যাচ্ছে হয়  জলে ডুবে না হয় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর গুলিতে। এ অভিযোগ রোহিঙ্গারা শুধু করছে তা নয়, অভিযোগ করেছে সংবাদ মাধ্যমগুলিও। এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক অষ্ট্রেলিয় মানবাধিকার সংগঠন বলেছে -  Many people are risking their lives to escape using perilous routes – some are badly injured, and with children.  মানবাধিকার সংগঠনটি আরো বলেছে যে গতো দু সপ্তাহেরও কম সময়ে ৩,৭০,০০০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশের সীমান্তে পৌঁছে গেছেসংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে - In less than two weeks, 370,000 Rohingya people have had to flee Myanmar to nearby Bangladesh. রোহিঙ্গাদের উপর রাষ্ট্রীয় নৃশংস দমন-পীড়নের যে সব বীভৎস খবর আসছে তাতে কিছু অতিরঞ্জন হয় তো আছে, কিন্তু তথাপি পরিস্থিতি যে ভয়াবহ তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ মনে হয় নেই।  সম্প্রতি বৌদ্ধ ধর্মগুরু দালাই লামাও  মায়ানমারে শান্তি ও সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনার জন্যে আং সূচী ও মায়ানমারের অন্যান্য নেতাদের পদক্ষেপ নেবার আহ্বান জানিয়েছেন।  গতো ১১ই সেপ্টেম্বর  তিনি  আং সান সূচি ও মায়ানমার সরকারের উদ্দেশ্যে বলেছেন, “আপনারা শান্তি এবং সৌহার্দ্যের মাধ্যমে জনমানসে সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনুন।” পরিস্থিতি এতোই ভয়াবহ হয়ে উঠেছে যে ১৩ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে অবস্থিত ৪০টি দেশের রাষ্ট্রদূত একসঙ্গে রাষ্ট্রসঙ্ঘকে রোহিঙ্গা সংকটে হস্তক্ষেপ করার আবেদন জানিয়েছেন পরিস্থিতি যে ভীষণ রকম ভয়াবহ তা বোঝা যায় রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার সংক্রান্ত হাইকমিশনার জায়েদ আল হুসেনের মন্তব্যেও  তিনি বলেছেন –
মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপরে যা চলছে তা “জাতি নিধনের আদর্শ উদাহরণ  
হুসেন মায়ানমার সরকারের পাশাপাশি ভারত সরকারেরও তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, “মায়ানমারে যখন রোহিঙ্গারা আক্রমণ ও হিংসার শিকার হচ্ছেন, ঠিক তখনই ভারত নিজেদের এলাকা থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বহিষ্কার করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা অন্যায়।” প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে ভারতে চল্লিশ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রশ্নে ভারত সরকারের ভূমিকা সত্যিই খুবই হতাশাজনকএই ভূমিকায় ভারতবাসী হিসেবে আমি লজ্জিত ভারত সরকার প্রধানতঃ সাম্প্রদায়িক মনোভাব থেকে এমন লজ্জাজনক হীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে বলে আমার ধারণা। আমার এই ধারণা ভ্রান্ত বা অভ্রান্ত যাই হোক না কেনো, এই সিদ্ধান্তের আমি তীব্র প্রতিবাদ করছি। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া যে কোনো দেশের পক্ষেই ঝুঁকির, এটা জেনে ও মেনেও বলছি যে, যারা ইতিমধ্যেই ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে তাদের আশ্রয় দেওয়া আমাদের রাষ্ট্রীয় নৈতিক মানবিক কর্তব্য। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া কেনো ঝুঁকির কারণ সে প্রসঙ্গে পরে আসবো, কিন্তু  ঝুঁকি সত্ত্বেও ছিন্নমূল অসহায় চল্লিশ হাজার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা একটু আশ্রয় ও অন্নের জন্যে যখন দরজায় এসে কড়া নাড়ে তখন তারা শত্রু হলেও তাদের আর্তিতে সাড়া দেওয়াটা সভ্য সমাজের ন্যূনতম রীতি ও কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। উল্টে তাদেরকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেয়াটা চরম নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতা  রূপ অমানবিক সিদ্ধান্ত নিয়ে মোদিজি  বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের মাথা হেঁট করে দিলেন। 
মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের উপর যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও নিপীড়ন চালাচ্ছে তার নিন্দা করার ভাষা নেই কিন্তু তা বলে মায়ামমার সরকারের বিরুদ্ধে মুসলমান নিধনের যে অভিযোগ উঠেছে তার সঙ্গে  আমি সহমত নই। কারণ, রোহিঙ্গা মুসলমান ব্যতীত অন্য গোত্রের মুসলমানরা সেখানে নিরাপদেই আছে। অবশ্য আমার এটা মনে হচ্ছে যে মায়ামমার সরকার তাদের মাটি থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্মূল করতে চাইছে। এ কথা আমি এর আগের নিবন্ধেও লিখেছি। সে লেখায়  আমি অভিযোগ আরও করেছি যে, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের পাশাপাশি মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের পরিকল্পিতভাবে ভয়ঙ্কর মানসিক নিপীড়নও চালাচ্ছে যাতে তারা মায়ানমার ছেড়ে পালিয়ে যায়। সেই উদ্দেশ্যে মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সহ সকল মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে। আমি এও বলেছি যে, শুধু জঙ্গী ও সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারাই নয়, মায়ানমার সরকারের রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের  শিকার হচ্ছে সাধারণ নিরীহ রোহিঙ্গারাও। আগের লেখায় তাই আমি দাবী জানিয়েছি যে, জঙ্গী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মায়ানমার সরকার যতো খুশী কঠোর হোক, কিন্তু নির্দোষ ও নিরীহ রোহিঙ্গাদের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে এবং তাদের নিরাপত্তা দিতে হবে    
আমার সে লেখায় মুসলিম মৌলবাদীরা বেজায় রুষ্ট। রুষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও সেক্যুলার তকমাধারী বন্ধুরাও। তাঁদের রোষের কারণ আমি বলেছি যে –
এক). মায়ানমার সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে ঠিকই, কিন্তু রোহিঙ্গারাও ধোওয়া তুলশী পাতা নয়।
দুই). রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে মায়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে দুনিয়া জুড়ে একপেশে আলোচনা হচ্ছে।
তিন). মুসলমান বলেই রোহিঙ্গাদের উপর রাষ্ট্রীয় নির্যাতন হচ্ছে এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও অবাস্তব অভিযোগএবং
চার). মুসলিম মৌলবাদীরা রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বিশ্বজুড়ে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়াচ্ছে।       
আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আবার জানাতে চাই যে, মায়ানমার সরকারের কাছে রোহিঙ্গাদের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন বন্ধ করা এবং তাদের নাগরিকত্ব-সহ সমস্ত মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার যে দাবী উঠেছে তার প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন আছে। তারপরেও খুবই বেদনার সাথে আমাকে বলতে হচ্ছে যে,  আন্তর্জাতিক মহল ও রাষ্ট্রপুঞ্জ নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ না করে মায়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ একপেশে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই আমি দাবী জানাচ্ছি যে, পূর্বানুমানের ভিত্তিতে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে একপেশে মনোভাব ও অবস্থান থেকেসরে এসে রাষ্ট্রসংঘ ও আন্তর্জাতিক মহলকে একটি  নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে হবে। এবং অনুসন্ধান করে দেখতে হবে কেনো মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গা নিধন-যজ্ঞ শুরু করেছে? সে কি শুধুই ধর্মীয় বিদ্বেষ থেকে, না কি অন্য কোনো কারণ রয়েছে এর পশ্চাতে? তা না হলে রোহিঙ্গা-সংকট নিয়ে যে একপেশে ও একবগ্গা আলোচনা হচ্ছে তা রোহিঙ্গা- সংকটের সমাধানকে ত্বরাণ্বিত করার বদলে আরো জটিল করে তুলবে। একপেশে ও একবগ্গা   আলোচনা ও সমালোচনার ফলে রোহিঙ্গারা মায়ানমারে কী ভূমিকা  পালন করছে সে সম্পর্কে বিশ্ববাসী  বিন্দুবিসর্গও জানতে পারছে না। রোহিঙ্গা-সংকট নিরসনে রাষ্ট্রসংঘকে কার্যকরী উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে  হলে মায়ানমার রাষ্ট্রের ভূমিকার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের ভূমিকা সম্পর্কেও সঠিকভাবে অবহিত হতে হবে। রোহিঙ্গাদের ভূমিকাটাও জানা অবশ্যই দরকার, কারণ মায়ানমার ও  রোহিঙ্গাদের পূর্ব ইতিহাস ঘেঁটে যে তথ্য ও খবর উঠে আসছে তাতে এটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে রোহিঙ্গা-সংকটের জন্যে শুধু মায়ানমার সরকারই দায়ী নয়, দায়ী রোহিঙ্গারাও। রোহিঙ্গাদের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের ঘটনাগুলি পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে যে, মায়ানমার সরকার বিনা প্ররোচনায় রোহিঙ্গাদের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন করেছে এমনটা বলা যাচ্ছে না।  বরং অপ্রিয় ও  নির্মম সত্যিটি হলো এই যে, মৌলবাদি ও জঙ্গী রোহিঙ্গাদের বৌদ্ধ ও রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপই মায়ানমার সরকারকে বাধ্য করেছে বারবার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযানের সিদ্ধান্ত নিতেএ প্রসঙ্গে দুটো টাটকা উদাহরণ হাতের কাছেই দেখা যাচ্ছে।
(এক). গতো বছর (২০১৬) অক্টোবর মাসে মায়ানমার যখন সরকার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযানের নির্দেশ দেয় তার আগে ৯ই অক্টোবর সন্ত্রাসবাদী রোহিঙ্গারা ৩টি সীমান্ত  চৌকিতে হামলা চালিয়ে ৯জন সীমান্তরক্ষীকে হত্যা করে
(দুই). এবারও মায়ানমার সরকারকে সেনাভিযানের নির্দেশ দিতে বাধ্য করেছে জঙ্গী রোহিঙ্গারাই। রোহিঙ্গাদের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন ‘আরসা’ (আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি) গতো আগষ্ট মাসের শেষের দিকে ত্রিশটি পুলিশ চৌকি ও একটি সেনা ছাউনিতে ভয়াবহ সশস্ত্র হামলা চালিয়ে ১৫০ জন পুলিশ ও সেনাকে হত্যা করে এবং সেই হামলায় আহত হয় আরো অনেকে (http://www.anandabazar.com/international/un-raised-their-voice-on-rohingya-crisis-issue-1.673312)
শুধু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই নয়, রোহিঙ্গাদের জিহাদি জঙ্গী হামলার শিকার বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অসামরিক লোকজনও। রোহিঙ্গা মুসলমানরা সবাই মোটেই যে শান্তিপ্রিয় নয় এবং তারা রাষ্ট্র ও বৌদ্ধ সমাজের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী হিংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে সরকারকে সেনা নামাতে বাধ্য করছে এ কথাটা সবাই চেপে যাচ্ছে। সবাই কেবল মায়ানমার সরকার ও আং সান সূচীর  উপর রোহিঙ্গাদের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন বন্ধ করার জন্যে চাপ সৃষ্টি করছে, কিন্তু কেউ রোহিঙ্গাদের উপর তাদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্যে চাপ দেয়া তো দূরের কথা তাদের সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের কথাই মুখে আনছে না। রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের ভূমিকা নতুন কিছু নয়। সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। সে ইতিহাস আলোচনা করার প্রয়োজনীয় পরিসর এই নিবন্ধ নেই। তবুও একান্ত প্রাসঙ্গিক বলে সেই ইতিহাসের পাতায় এক ঝলক চোখ বুলানো যাক।       
১৯৮২ সালে মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়। কোনো অবস্থাতেই কোনো জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার ঘটনা সমর্থনযোগ্য নয়। তথাপি কেনো ও কোন পরিস্থিতিতে মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো তা আমাদের একটু খতিয়ে দেখার দরকার আছে আর সেজন্যে আমাদের একটু পেছনে যেতে হবে। ১৯৪৮ সালে মায়ানমার স্বাধীন হয়। খুবই দুঃখজনক ঘটনা হলো, রোহিঙ্গারা মায়ানমারের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছিলো। ১৯৪৭ সালে মায়ানমারের আকাশে বৃটিশ-সূর্য যখন অস্তমিত প্রায় তখন রাখাইন প্রদেশকে মায়ানমার থেকে বিচ্ছিন্ন করে পাকিস্তানের অঙ্গরাজ্য করার পরিকল্পনা করে রোহিঙ্গারা। সে উদ্দেশ্যে তারা বার্মিজ মুসলিম লীগ গঠন করে মুজাহিদ বাহিনী গড়ে তোলে এবং ভারতের মুসলিম লীগ নেতা মহম্মদ জিন্নার সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিন্তু জিন্নাহ তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। ফলে সেবার তাদের সেই দেশবিরোধী জিহাদি মিশন ব্যর্থ হয়তথাপি স্বাধীন মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে কুণ্ঠিত হয় নি। মায়ানমার সরকার ও মায়ানমারের মানুষদের এই ক্ষমাশীলতা, সহিষ্ণুতা, উদারতা ও মহানুভবতাকে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয় রোহিঙ্গা মুসলমানরা। ওদের ধর্মীয় গোঁড়ামি ও প্রবল রক্ষণোশীলতাই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো মায়ানমারকে তাদের নিজের দেশ ও তার সরকারকে নিজের সরকার বলে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে। উল্টে মায়ানমারকে তারা ভেবেছে দারুল হারব (শত্রু দেশ) এবং তাই মায়ানমারকে দারুল ইসলাম (ইসলামি রাষ্ট্র) বানাবার লক্ষ্যে সন্ত্রাসবাদী জিহাদি কার্যকলাপ তারা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। তার জন্যে বার্মিজ মুসলিম লীগের পরিবর্তে তারা তৈরী করে একটি জিহাদি সংগঠন ‘আরসা’ (আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি)। আরসা-র লক্ষ্য জিহাদের মাধ্যমে মায়ানমারকে বার্মিজদের হাত থেকে মুক্ত করে সেখানে ইসলামি রাষ্ট্র গঠন করা। রোহিঙ্গাদের এই জিহাদি সংগঠন ও হামলা দমন করার জন্যে নে উইন সামরিক সরকার রোহিঙ্গাদের উপর প্রথম রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন শুরু করেছিলো  ১৯৬২ সালে। এই নে উইনের সরকারই রোহিঙ্গাদের প্রথম বাংলাদেশী আখ্যা দিয়ে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মাধ্যমে তাদের বিতাড়নের প্রক্রিয়া শুরু করে সেই রাষ্ট্রী নিপীড়নের ধারাবাহিকতায় ১৯৮২ সালে  মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়। জঙ্গী রোহিঙ্গার জন্যে সমস্ত রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার ঘটনা নিশ্চয় নিন্দাজনক, কিন্তু এ কথাও তো অনস্বীকার্য যে মায়ানমার সরকারকে উক্ত কঠোর পদক্ষেপ নিতে প্ররোচিত করেছে রোহিঙ্গা মুসলমানরাই।      
১৩ হাজার বছর ধরে বৌদ্ধরা মায়ানমারের অধিবাসী। আর মায়ানমারে আরবদের আগমন মাত্র ১৩শো বছর আগে ৮ম কিংবা ৯ম শতাব্দীতেতারা এসেছিলো বাণিজ্য উপলক্ষ্যে। সেদিক থেকে বিচার করলে বৌদ্ধরা মায়ানমারের আদি ও মূল অধিবাসী, এবং মুসলমানরা বহিরাগত। মায়ানমার সরকার তাই রোহিঙ্গারা বহিরাগত বলে তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে চাইছে না। মায়ানমার সরকারের এই দাবী কিন্তু সমর্থনযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নয়। দাবীটি সম্পূর্ণ অবাস্তব ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কারণ হলো,  
এক). যারা বাণিজ্য করার জন্যে এসেছিলো তাদের অনেকেই নিজের দেশে ফিরে না গিয়ে মায়ানমারেই থেকে গিয়েছিলো
দুই). মায়ানমারের অধিকাংশ মুসলমানই ভারত,পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মুসলমানদের মতো ধর্মান্তরিত মুসলমান সুতরাং তারা যে মায়ানমারেরই অধবাসী, এবং বহিরাগত নয় তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
বৌদ্ধদের একটা অংশ কেনো ইসলাম গ্রহণ করেছিলো সেটা একটু দেখা যাক। কারণ আজকে রোহিঙ্গাদের যে সংকট তার সঙ্গে তার কিছুটা হলেও যোগসূত্র রয়েছে।      
১৪৩০ খৃষ্টাব্দে সুলায়মান শাহ ২৫০০০ হাজার সৈন্য নিয়ে অতর্কিতে আরাকানে হামলা চালিয়ে সেখানে ইসলামি রাষ্ট্র স্থাপন করেছিলো এবং সে রাষ্ট্রটি টিকেছিলো ১৪৭৮ সাল পর্যন্ত। সুলায়মান শাহ ছিলেন একদা একজন বৌদ্ধ রাজা যাঁর নাম ছিলো নরমখিলা। ১৪০৪ খৃস্টাব্দে মাত্র ২৪ বছরের আরাকানের যুবরাজ নরমখিলা পিতার সিংহাসনে আরোহণ করেন। এক সামন্তরাজার বোনকে অপহরণ করার জন্যে আরাকানের সমস্ত সামন্তরাজারা জোট বেঁধে তার উপর আক্রমণ চালালে তিনি আরাকান ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে গৌড়ের সুলতানের কাছে আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি ইসলাম গ্রহণ করে সুলায়মান শাহ নাম নেন এবং ২৪ বছর ধরে ইসলাম ধর্ম অনুশীলন ও  চর্চা করে একজন ঈমানদার মুসলমান হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেনতারই পুরস্কার হিসেবে গৌড়ের সুলতান নাসিরুদ্দিন শাহ (মতান্তরে জালালুদ্দিন শাহ) তাঁকে তাঁর রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্যে একজন সেনাপতির নেতৃতে ২৫০০ হাজার সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেন। বলা বাহুল্য যে, সুলায়মান শাহের শাসন কালে বৌদ্ধদের উপর ব্যাপক অকথ্য ও অমানবিক নিপীড়ন চালানো হয়েছিলোমুসলমানরা বৌদ্ধ  হিন্দুদের  ব্যাপকহারে  লুট হত্যা করেফলে প্রাণভয়ে বহু বৌদ্ধ ধর্মান্তরিত হয় এবং অনেকেই অন্য কোথাও পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় সেই নিপীড়নের ইতিহাস বৌদ্ধরা নিশ্চয় ভোলে নি। বৌদ্ধদের উপর রোহিঙ্গাদের সেই নিপীড়নই বৌদ্ধদের একাংশের মধ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও আক্রোশের জন্ম দিয়েছে। আরাকানে মুসলিম শাসন ফিরিয়ে আনার জন্যে রোহিঙ্গারা আজো মায়ানমার সরকার ও অসামরিক বৌদ্ধদের উপর সমানে সন্ত্রাসবাদী হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। যারা আরাকানের মূল জনগোষ্ঠী বৌদ্ধদের উপর ইসলামি শাসন, শিক্ষা ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে রোহিঙ্গারা জিহাদি সন্ত্রাস তথা যুদ্ধাভিযান সংগঠির করে থাকে মায়ানমার রাষ্ট্র ও বৌদ্ধদের উপর। রোহিঙ্গাদের উপর রাষ্ট্রীয় অত্যাচার থেকে বাঁচতে লাখে লাখে রোহিঙ্গারা যখন মায়ানমার ছেড়ে যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে তখনও জঙ্গী রোহিঙ্গারা তাদের জিহাদি কর্মকাণ্ডে অটল রয়েছে। অনলাইনে জঙ্গী নেতারা জিহাদের বার্তা দিয়ে রোহিঙ্গাদের মনোবল ধরে রাখার প্রয়াস জারি রেখেছে। একজন নেতার ভিডিও রেকর্ডিং – এর মাধ্যমে  রোহিঙ্গা মুজাহিদিনদের উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণ ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। তিনি যে ভাষণ দিয়েছেন তার বাংলা অর্থ হলো –
যতোক্ষণ পর্যন্ত একজন কাফির এই দেশে (মায়ানমারে) আছে, ততোক্ষণ পর্যন্ত তাদের এই জিহাদ চলবে। সময় এখন এদের কতল করার  ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার পরেই তাদের এই জিহাদ শেষ হবে মায়ানমারের এটাই হলো সত্যিকারের বাস্তব পরিস্থিতি
রূপ পরিস্থিতিতে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে রোহিঙ্গা-সংকট এর সমাধান শুধু মায়ানমার সরকারের হাতে নেই। রোহিঙ্গারা যতোদিন না জিহাদ ও জিহাদের আদর্শ পরিত্যাগ করে মায়ানমারকে নিজের দেশ মনে করবে, মায়ানমারের উদারতা, সহিষ্ণুতা, ক্ষমাশীলতা ও মহানুভবতার আদর্শ ও সংস্কৃতিকে সম্মান ও মান্য করতে শিখবে এবং সর্বোপরি দেশের সংবিধানকে স্বীকার ও মান্য করবে ততোদিন রোহিঙ্গা-সংকটের সমাধান আশা করা যায় না। মায়ানমারের সরকারের উপর হাজার রকমের চাপ প্রয়োগ করলেও হওয়া সম্ভব নয় বলেই মনে হয়।  
রোহিঙ্গা-সংকটের নেতিবাচক প্রভাব সারা বিশ্বেই পরিলক্ষিত হচ্ছে যা যথেষ্ট উদ্বেগের। রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়ন চালাচ্ছে মায়ানমার সরকার, কিন্তু মুসলিম মৌলবাদীরা ঘৃণা ও হিংসা ছড়াচ্ছে সমগ্র বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যা খুবই উদ্বেগের বিষয়রোহিঙ্গাদের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নকে অস্ত্র করে মুসলিম সংগঠনগুলো নিজ নিজ জায়গায় অমুসলিমদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। ভারতে ও পশ্চিমবঙ্গেও তারা এ কাজ করছে বেপরোয়াভাবে গতো ১২ই সেপ্টেম্বর কলকাতায় মুসলিম সংগঠনগুলো রোহিঙ্গাদের পক্ষে মিছিল করেছে যেখানে  তারা আওয়াজ তুলেছে - ‘নাড়া – এ - তকবির’, আর লক্ষাধিক কণ্ঠ আকাশ ফাটিয়ে মুসলমানরা জবাব দিয়েছে,  ‘আল্লাহু আকবার’। মিছিলে তো কিছু অমুসলিমও ছিলো, তাহলে এই জিহাদি ‘নাড়া’ কেনো? কেন এবং  কাদের বিরুদ্ধে এই ‘নাড়া’?         
ভারত থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর সরকারেরএটা সব হিন্দুরাই সমর্থন করে বলে মনে হয় না। কিন্তু মুসলিম সংগঠনগুলির প্রচারের ধরণ এমনই যেনো রোহিঙ্গা ইস্যুতে গোটা হিন্দু সমাজ রয়েছে মোদির পেছনে। মুসলিম সংগঠগুলির দাবি  করছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবাধে ভারতে আশ্রয় দিতে হবে। এ দাবী কি সুবিবেচনা প্রসূত? কোটি কোটি মানুষ যে দেশে আজো বাস করে খোলা আকাশের নীচে, কোটি কোটি বেকার যে দেশে কাজের অভাবে ধুঁকতে ধুঁকতে এক সময় অসামাজিক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ে, যে দেশে প্রতিদিন কতোশত শিশু অচিকিৎসা ও অপুষ্টিতে মারা যায় তার ইয়ত্তা নেই, যে দেশ জনস্ফীতির ভারে ন্যুব্জ, সে দেশের পক্ষে ভিন দেশের লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়া সম্ভব? একই কারণে বাংলাদেশও তো রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে প্রচণ্ড অনিচ্ছুক। যারা ঢুকেছে তারা লুকিয়ে চুরিয়ে। অথচ বাস্তব সমস্যাকে অস্বীকার করে মুসলিম সংগঠনগুলি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্যে ভারতের দরজা হাট করে খুলে দেবার অবাস্তব দাবী জানাচ্ছে মানবতার দোহাই দিয়েআসলে মানবতার মুখোশ পরে তারা সাম্প্রদায়িক তাস খেলার চেষ্টা করছে। কথায় আছে কারো সর্বনাশ তো কারো পৌষ মাস। রোহিঙ্গাদের সংকটকে তারা হাতিয়ার করে  সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়াচ্ছে। সত্যিই কি রোহিঙ্গারা মুসলিম বলে তাদের দরদ উথলে উঠছে? রাহলে যখন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অন্যায় যুদ্ধ করে ত্রিশ লাখ মুসলমানকে হত্যা করে, তিন লাখ মুসলিম নারীর সম্ভ্রম নষ্ট করে, এক কোটি মানুষ দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয়, তখন তাদের মুসলিম-দরদ কোথায় গিয়েছিলো? বিশ্বজুড়ে সুন্নি মুসলমানরা প্রায় প্রতিদিনই তো শিয়া মুসলমান ও আহমদিয়া মুসলমানদের হত্যা করছে, তখন তাদের মুসলিম-দরদ  দেখতে পাওয়া যায় না কেনো?  
আর একটা কথা বলে শেষ করবো। প্রধানমন্ত্রীর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বহিষ্কার করার সিদ্ধান্তের পেছনে অর্থনৈতিক কারণ ছাড়া আরও দুটি কারণ আছে বলে মনে হয়। তার একটি হলো, মুসলিম-বিদ্বেষ এবং আর একটি হলো রোহিঙ্গাদের ভয়।  প্রধানমন্ত্রীর মুসলিম-বিদ্বেষ নিঃসন্দেহে অতীব ঘৃণ্য ও নিন্দনীয় কিন্তু দ্বিতীয়টি কারণটিকে তো অমূলক বলা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকারও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিতে একদমই চাই না। যারা ঢুকে পড়েছে তাদের নিয়ে তারা রীতিমতো ভয়ে ও আশংকায় রয়েছে। বাংলাদেশের যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কথাতে তা স্পষ্ট। তিনি বলেছেন –
শরণার্থীর সাথে ষড়যন্ত্র, অবৈধ অস্ত্র, মাদক দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র অনুপ্রবেশ করতে পারে।
একাত্তরের টিভি-র বার্তা পরিচালক সৈয়দ ইশতিয়াক রেযা এ কথাটাই আরো স্পষ্ট করে বলেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন –
এসব রোহিঙ্গার একটি বড় অংশ সন্ত্রাসি, মাদক চোরাচালান ও অসামাজিক কাজে জড়িত। এবং বড় ভয়টা হলো কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় থাকা বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে এরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। যেকোন উপায়ে সাম্প্রদায়িক  সম্প্রীতি নষ্ট করার পায়তারা করছে এরা। শুধুমাত্র বাংলাদেশেই নয়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে এরা নানা রকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে এরা জড়িয়ে পড়ছে। রোহিঙ্গারা মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছে বাংলাদেশী পাসপোর্ট ব্যবহার করে। ফলে তাদের এসব অপকর্মের জন্যে আন্তর্জাতিক বিশ্বে ভাবমূর্তি খারাপ হচ্ছে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশী শ্রমিকদের। দেশের একটি গোষ্ঠী, মূলত, ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতি যারা করে, তারা রোহিঙ্গা সমস্যাকে রোহিঙ্গাদের সাথে বিবাদ হিসেবে দেখিয়ে উত্তেজনা তৈরি করতে চাচ্ছে। ফেসবুকে, অনলাইনে তারা ফটোশপ করে উত্তেজনা ছড়াতে ব্যস্ত।      (সূত্রঃ http://www.latestbdnews.com/only-opening-the-gate-is-not-solutions/)
ভারতের ক্ষেত্রেও রোহিঙ্গা স্মরণার্থীরা এখানকার জঙ্গী সংগঠনগুলোর সাথে জোট বাঁধবে না এ কথা হলপ করে কেউ বলতে পারে না। শুধু বাংলাদেশ বা ভারত নয়, আজ গোটা বিশ্বই মুসলমান শরণার্থীদের নিতে ভয়ে কম্পমানএকদিন যে দেশগুলি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইরাক ও সিরিয়ার লক্ষ লক্ষ মুসলিম রণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিল, আজ তারা সবাই ভয়ে প্রকম্পিত কেনো? শুধু মুসলিম-বিদ্বেষ বা ইসলাম-ফোবিয়া বলে চিৎকার করলে হবে না, কেনো মুসলিমদের সম্পর্কে অমুসলিমদের মধ্যে ভীতি তৈরী হয়েছে ও হচ্ছে এবং তা দ্রুতগতিতে বাড়ছে এবং এক দেশ থেকে আর এক দেশে ছড়িয়ে পড়ছে তা খতিয়ে দেখতে হবে মুসলিমদের নিজেদেরই
       
  


 


 

Sunday, October 1, 2017

কেনো কারবালা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো

আজ ১০ই মহরম। আজ আশুরা। আজ মহরম। মুসলমানদের কাছে আজকের দিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই দিনটি তাদের কাছে মহাপবিত্র দিন। এই দিনটি আবার তাদের কাছে মহাশোকের দিনও। মহাশোকের দিন এজন্যে যেহেতু এই দিনে মুহাম্মদের দোহিত্র ইমাম হুসাইন (হোসেন) কারবালা নামক বৃক্ষবর্জিত একটি মাঠে ইয়াজিদের (এজিদের) সৈন্যবাহিনীর হাতে একটি অসম যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। যুদ্ধটি ইতিহাসে কারবালা যুদ্ধ নামে খ্যাত। এ নিবন্ধটি কারবালা যুদ্ধ নিয়ে। তবে আজ যেহেতু আশুরাও বটে, তাই আশুরা প্রসঙ্গে সংক্ষেপে কয়েকটা কথা বলে নিয়ে মূল নিবন্ধে প্রবেশ করবো।
আশুরার দিনটি, আগেই বলেছি, মুসলমানদের কাছে মহাপবিত্র দিন। মহাপবিত্র এজন্যে যে আল্লাহ এদিনে পৃথিবী সৃষ্টি করেন এবং এদিনেই কেয়ামত ঘটাবেন (পৃথিবী ধ্বংসও করবেন) এদিন ইব্রাহিম নবী নমরুদের অগ্নিকুন্ড থেকে রক্ষা এবং ইউনুস নবী মাছের পেট থেকে মুক্তি পান। এরূপ আরো বহু রূপকথা জুড়ে রয়েছে আশুরাকে কেন্দ্র করে। এ রূপকথাগুলিকে মুসলমানরা সম্পূর্ণ সত্যি বলে বিশ্বাস করেন। তাই এদিনটি তারা ধর্মীয় ভাবগাম্ভির্যের সাথে পালন করে থাকেন অনেকেই এদিনে রোযা (উপবাস) রাখেন।
আশুরার মহাপবিত্র দিনেই মহানবীর অতি আদরের ছোট নাতি কারবালা যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। কী অবাক কাণ্ড! এদিনটিকেই আল্লাহ তার শ্রেষ্ঠ হাবিব (অভিন্নহৃদয় বন্ধু) মুহাম্মদের নাতি হোসেনের মৃত্যুদিবস হিসেবে বেছে নিয়েছিলো! আর তার জন্যে হোসেনকে অকালে প্রাণ দিতে হয় একটি অসম যুদ্ধে! অনেক অসম যুদ্ধেই তো আল্লাহ তার পিয়ারা দোস্ত মুহাম্মদকে ফেরেস্তা পাঠিয়ে সাহায্য করেছিলো যার ফলে মুহাম্মদ সে সব যুদ্ধে হয় বিজয়ী হয়েছিলেন, না হয় পরাজয় ও নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। অনুরূপভাবে কারবালা প্রান্তরে আল্লাহ হোসেনকে ফেরেস্তা পাঠিয়ে সাহায্য করলে কারবালা যুদ্ধের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো। আল্লাহ কিন্তু হোসেনকে ফেরেস্তা পাঠিয়ে সাহায্য করেনি ফলে আশুরার মহাপবিত্র দিনটিই মহাশোকে পরিণত হয়। কেনো আল্লাহ হোসেনকে সাহায্য করে নি তার উত্তর মুসলমান সম্প্রদায় আজো খুঁজে পায়নি।  মুসলমান সমাজ সে উত্তর খুঁজে ফিরুক, আমি  এই মহাপবিত্র ও মহাশোকের দিনটিতে আর একবার খুঁজে দেখবো কেনো কারবালা যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিলো।      
১৩৩৭ বছর আগে ৫৯ হিজরীতে ৬৮০ সালে আজকের দিনটিতে ফোরাত (ইউফ্রেটাস) নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে এজিদের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে হোসেনের যুদ্ধ বেধেছিলো এবং হোসেন সদলবলে নিহত হয়েছিলেন। এজিদ ছিলেন ইসলামি বিশাল সাম্রাজ্যের ৬ষ্ঠ খলিফা। তাঁকে তাঁর পিতা ৫ম খলিফা মুয়াবিয়া (মাবিয়া) খলিফা মনোনীত করেছিলেন। মাবিয়ার মৃত্যুর পর এজিদ খলিফা পদে আরোহণ করলে হোসেন তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। হোসেন নিজেই খলিফা পদের দাবিদার ছিলেন।  হোসেনের দাবী ছিলো যে, যেহেতু তিনি মহানবীর বংশধর, তাই খলিফা পদের ন্যায্য উত্তরাধিকার   একমাত্র  তিনিই। এজিদকে তাই তিনি অবৈধ ও অপ্রকৃত খলিফা ঘোষণা করে তাঁর বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দেন। তিনি এটাকে মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, ধর্মদ্রোহীর বিরুদ্ধে বিশ্বাসীর এবং কুফরির বিরুদ্ধে ঈমানের জিহাদ আখ্যা দেন। সেই জিহাদে অংশ নিতে তিনি সমস্ত মুসলমানদের কাছে আহ্বান জানান। এবং জিহাদের জন্যে সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে একটি ক্ষুদ্র সৈন্যদল নিয়ে তিনি কুফা নগরের পথে রওনা দেন। কুফায় পৌঁছানোর আগেই কারবালা প্রান্তরে এজিদের সৈন্যবাহিনী তাঁর পথরোধ করে এবং সেখানেই দু’পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেই যুদ্ধে  হোসেন সসৈন্য মৃত্যুবরণ করেন।   
মুসলিম সমাজের ধর্মগুরু ও ঐতিহাসিকগণ কারবালা যুদ্ধকে আল্লাহর পথে একটি পবিত্র জিহাদ বলেই সীলমোহর দিয়েছেন। তারা বলেন যে ঈমাম হুসাইন কারবালা প্রান্তরে শাহাদাত বরণ করেছিলেন ইসলামের শত্রু ইয়াজিদের সৈন্যবাহিনীর হাতে। তারা কারবালা যুদ্ধের জন্যে অভিযুক্ত করেন এজিদ ও তার পিতা মাবিয়াকে। মাবিয়ার বিরুদ্ধে তাদের প্রধান অভিযোগ হলো এই যে তিনি পুত্র এজিদকে খলিফা করার জন্যে ইসলামি গণতান্ত্রিক নীতি লঙ্ঘন করে ইসলামি খেলাফতে পরিবারতন্ত্র/রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন যার পরিণতিতে কারবালা যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই ধর্মগুরু ও ঐতিহাসিকগণই আলির মৃত্যুর পর তার জ্যৈষ্ঠ পুত্র ইমাম হাসান (হাসেন) যখন খলিফা হন তখন তার মধ্যে পরিবারতন্ত্র/রাজতন্ত্র দেখতে পান নিএবং ঈমাম হুসাইন (হোসেন) যখন মুহাম্মদের বংশধর হিসেবে উত্তরাধিকার সূত্রে খলিফা হওয়ার দাবী পেশ করেন তখনও এদের চোখে সেটাকে পরিবারতন্ত্র বলে মনে হয় নি। মুসলিম সমাজের ধর্মগুরু ও ঐতিহাসিকদের এরূপ দ্বিচারিতা আরো অনেক পরিলক্ষিত হয় তাদের লেখা কারবালা যুদ্ধের ইতিহাসে।
ইসলামি নীতি লংঘন করে ৫ম খলিফা মাবিয়া এজিদকে ৬ষ্ঠ খলিফা মনোনীত করার জন্যেই কারবালা যুদ্ধ হয়েছিলো বলে যে অভিযোগ করা হয় তার ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। কারণ, খলিফা মনোনয়ন বা নির্বাচন নিয়ে ইসলামে আসলে কোনো নীতিই নেই। ফলে মুহাম্মদের মৃত্যুর পর খলিফা পদে নিয়ে তিন দিন ধরে তাঁর সাহাবিদের মধ্যে প্রবল ঝগড়া ও বাদানুবাদ হয়। সেই তিন দিন মুহাম্মদের লাশ অসমাধিস্থ  অবস্থায় পড়েছিলো। তিন দিন পর অবশেষে কোনোরকমে আবু বকর ১ম খলিফা মনোনীত হন। মুহাম্মদের কন্যা ফতেমা তখন জীবিত ছিলেন। তিনি ও তাঁর বর আলি এবং তাদের অনুগামীরা আবু বকরকে খলিফা হিসেবে মেনে নেন নি। কারণ, তাঁরা আশা করেছিলেন যে মুহাম্মদের তৈরী করা সাম্রাজ্যের খলিফা হিসেবে তাঁর উত্তর পুরুষ আলিই সর্বসম্মতিক্রমে মনোনীত হবেনকিন্তু তা না হওয়ায় তিনি অতিশয় হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং সংযম ও শালীনতা হারিয়ে আবু বকরকে বিশ্বাসঘাতক বলে গালাগাল দিয়ে বাড়ির দরজা থেকে তাড়িয়ে দেন। ২য়, ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম খলিফা মনোনীত হয়েছিলেন ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে। এটা প্রমাণ করে যে খলিফা মনোনয়ন বা নির্বাচন নিয়ে ইসলামের কোনো নীতি নেই। সুতরাং মাবিয়ার বিরুদ্ধে খলিফা মনোনীত করার প্রশ্নে ইসলামি নীতি লংঘনের অভিযোগ ধোপে টেকে না।       
আসলে কারবালা যুদ্ধের বীজ পোঁতা হয়ে গিয়েছিলো সেদিন যেদিন আবু বকর প্রথম খলিফা মনোনীত হয়েছিলেন। আবু বকরের প্রথম খলিফা হওয়াটা ঠিক ছিল না ভুল ছিলো তা নিয়ে মুসলিমরা আজো দ্বিধাবিভক্ত। সুন্নি মুসলমানরা বলেন যে সম্পূর্ণ সঠিক ছিল আর শিয়া মুসলমানরা বলেন ভুল ছিলো। আবু বকরের প্রথম খলিফা হওয়াটা ঠিক বা ভুল যাই হোক না কেনো, আলি যদি সংকীর্ণতা পরিহার  করে তাঁকে মেনে নিতেন তা হলে ইসলামের ইতিহাস তৈরী হতো অন্যভাবে এবং তাহলে কারবালা যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরী হতো না। আলি একে তো প্রথমে আবু বকরকে খলিফা হিসেবে স্বীকারই করেন নি, তারপর তিনি তাকে আম জনতার সামনেই প্রচণ্ড অপমানও করেছিলেন। এর ফল ভালো হয় নি তাঁর (আলির) পক্ষে। আবু বকর তাঁর নেক নজর থেকে আলির নাম সম্পূর্ণই মুছে দিয়েছিলেন এবং তিনি মৃত্যুর পূর্বে ২য় খলিফা মনোনীত করে যান ওমর ফারুককে। আবু বকরকে আম জনতার সামনে যখন ফতেমা ও আলি অপমান করেন তখন আবু বকরের সঙ্গে ওমর ফারুকও ছিলেন। তাঁরা উভয়মিলে দু’জনকেই ক্ষমতালোভী ও বেইমান বলে অপমান করেছিলেন। স্বভাবতই ওমর ফারুকও আলির প্রতি পচণ্ড বিরূপ ও রুষ্ট হয়েছিলেন। ফলে তিনিও তাই আলিকে তৃতীয় খলিফা মনোনীত করার কথা ভাবেন নি। মুহাম্মদের আর এক জামাতা ওসমান গণিকে তিনি খলিফা মনোনীত করেন। এতে আলির গাত্রদাহ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। আলি যেহেতু নিজেকে মুহাম্মদের উত্তরাধিকার মনে করতেন তাই প্রতিবারই তিনি খলিফা হবেন এমন আশা পোষণ করতেন। ফলে খলিফা হতে না পেরে প্রতিবারই তিনি আশাহত হন এবং তার হতাশা ও ক্ষোভও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়।  তার সঙ্গে তার মনে খলিফা হওয়ার আকাংখা ও জেদও প্রবলভাবে বাড়তে থাকে। ওসমানের খেলাফতকালে তাই তিনি তার পাশে দাঁড়ানোর ন্যূনতম সৌজন্যটুকুও প্রদর্শন করতে পারেন নি। উল্টে নানা তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়গুলি নিয়ে খলিফার বিরুদ্ধে সাহাবি ও তাবেয়ীদের* অসন্তোষগুলিকে গোপনে উস্কে দেয়ার চেষ্টা করতেন। যারা ব্যক্তিগত স্বার্থ পূরণ না হওয়ায় খলিফার (ওসমানের) প্রতি অতিশয় ক্ষুব্ধ ছিলো তারা আলির ভূমিকায় উৎসাহিত হয়ে খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংগঠিত করার সাহস পেয়ে যায়। বিদ্রোহীদের লক্ষ্য ছিলো ওসমানকে ক্ষমতাচ্যুত করে আলির হাতে খেলাফত তুলে দেয়া। আলি এ বিষয়ে যে অবহিত ছিলেন তা বিদ্রোহের সময় এবং বিদ্রোহের পরের নানা ঘটনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় অতি সারল্য এবং অদুরদর্শিতার জন্যে ওসমান অবশেষে বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন  তারপর দ্রুতই পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে বিদ্রোহীদের হাত ধরে আলি চতুর্থ খলিফার সিংহাসনে আরোহণ করেন।  
ওসমানের হত্যাকাণ্ড এবং তারপর আলির খলিফা হওয়াটা সাহাবী, তাবেয়ী এবং  বিভিন্ন প্রদেশে গভর্নরগণ অধিকাংশই মেনে নিতে পারেন নি এবং তাঁরা খলিফা আলির হাতে বয়াতও নেন নি।  উল্টে তারা আলিকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্যে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে সংকল্পবদ্ধ হন এবং অচিরেই গোটা সাম্রাজ্য জুড়ে গৃহযুদ্ধ বেধে যায়। প্রধানতঃ দু’টি ফ্রণ্টে সে যুদ্ধ চলে কয়েক বছর ধরে। একটি ফ্রণ্টে ছিলেন মুহাম্মদের কনিষ্ঠতম বৌ আয়েষার নেতৃত্বে মক্কা ও মদিনার সাহাবীগণ এবং অন্য ফ্রণ্টের নেতৃত্বে ছিলেন একটি বৃহৎ প্রদেশের গভর্নর মাবিয়া। গৃহযুদ্ধ চলাকালীনই আলি গুপ্তঘাতকের হাতে গুরুতর আহত হয়ে মারা যান। আলির অকাল মৃত্যুতে ইসলামি সাম্রাজ্য দু’টুকরো হয়ে যায়। আলির অধিকারে থাকা সাম্রাজ্যে খলিফা মনোনীত হন তার জ্যৈষ্ঠ পুত্র ঈমাম হাসান (হাসেন) আর মাবিয়ার অধিকারে থাকা  সাম্রাজ্যে তিনিই খলিফা নিযুক্ত হন। খলিফা পদে হাসানের কোনোদিন আগ্রহ ছিলো না। বস্তুতঃ নারী ছাড়া আর অন্য কিছুতেই বিশেষ আগ্রহ তাঁর ছিলো না। জামা-কাপড়ের মতো তিনি   বৌ পাল্টাতেন। নতুন কোনো সুন্দরী ও যুবতী নারীকে পছন্দ হলে আগের বৌকে তালাক দিয়ে তাকেই বিয়ে করতেন। একদিনে চার বৌকে তালাক দিয়ে সেদিনই চারজন নারীকে বিয়ে করার বিশ্বনজিরও তিনি তৈরী করে গিয়েছেন। এতে যার পর নাই ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর এক বৌ তাঁকে খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে হত্যা করেছিলেন। মৃত্যুর আগে হাসেন মোট ১০০টি বিয়ে করেছিলেন। এহেন নারীবিলাসী মানুষের কাছে যুদ্ধবিধ্বস্ত খেলাফত গলার কাঁটা হয়ে উঠেছিলো। তাছাড়া রণনিপুণ বিচক্ষণ মাবিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে এঁটে ওঠা যে যাবে না তা তিনি বিলক্ষণ জানতেন। তাই হাসেন কালবিলম্ব না করে মাবিয়ার সঙ্গে সন্ধি করে নিয়ে তাঁর হাতে থাকা খেলাফতের ভার মাবিয়ার হাতে তুলে দেন। ফলে সমগ্র সাম্রাজ্যের খলিফার গুরুদায়িত্ব মাবিয়ার কাঁধে ন্যস্ত হয়। হাসেন যখন মাবিয়ার হাতে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা হস্তান্তর করেন তখন তাদের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিলো। চুক্তিটি ছিলো  –
·         এক). হাসেন ও তার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা হবে।
·          দুই). রাজকোষ থেকে তাদের সকলের ভরণ-পোষণ নির্বাহ করা হবে।
·         এর সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট ক্ষুদ্র ভূখণ্ডও হাসেন দাবী করেছিলেন। মাবিয়া সহর্ষ চিত্তে তা মেনে নিয়েছিলেন।   
মাবিয়া মোট কুড়ি বছর (৬৬১-৬৮০) খলিফা ছিলেন। লম্বা গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত ইসলামি সাম্রাজ্যটিকে নিপুণ দক্ষতায় নতুন করে তাঁকে নির্মাণ করতে হয়েছিলো।  গৃহযুদ্ধের সুযোগ নিয়ে অনেক রাজ্যই ইসলামি খেলাফত থেকে বিদ্রোহ করে বেরিয়া গিয়েছিলোসেগুলিকে মাবিয়া পুনরায় দখল করে খেলাফতের অধীনে নিয়ে আসেন। শুধু তাই নয়, সাম্রাজ্যের বিপুল বিস্তারও তিনি ঘটিয়েছিলেন। শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান প্রভৃতি সর্বক্ষেত্রে তিনি প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। প্রশাসন-সহ সর্বত্রই তিনি ধর্মনিরপেক্ষ নীতি প্রবর্তন করেন। নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি ধর্ম-বর্ণ-গোত্র  নির্বিশেষে যোগ্য ও দক্ষ লোককদেরই নিয়োগ দিতেন। তিনিই প্রথম মুসলমান, খৃস্টান ও ইহুদী প্রভৃতি বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের নিয়ে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। এমনকি মজলিসে শুরায়ও (খলিফার উপদেষ্টামণ্ডলীতে) তিনি বিদ্বান ও জ্ঞানতাপস ব্যক্তিত্বদের নিয়োগ দিতেন যেখানে ধর্মের পরিচয় থাকতো গৌণ।  এসব কারণে আলীর সময়ে চারিদিকে যেখানে কেবল অরাজকতা ও বিশৃংখলা বিরাজ করতো সেখানে তাঁর আমলে গোটা সাম্রাজ্যে তিনি সর্বত্র শৃংখলা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। চুরি,ছিনতাই, ডাকাতি, রাহাজানি, ধর্ষণ এসব সামাজিক অপরাধকে নির্মূল করে তিনি এক স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মাবিয়ার খেলাফত সম্পর্কে এসব কথা বলেছেন বহু ঐতিহাসিকই যাঁদের মধ্যে মাবিয়ার জাতশত্রু মুসলিমরা ঐতিহাসিকরাও রয়েছেন। ঐতিহাসিকদের বিচারে মাবিয়া ছিলেন আরবের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নৃপতি।
মাবিয়ার দু’দশকের গৌরবময় খেলাফত কালে হোসেনের ভূমিকা ছিলো খুবই হতাশাব্যঞ্জক ও নেতিবাচক। তিনি কখনোই খলিফা মাবিয়াকে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেন নি। উল্টে সর্বদায় তার সমালোচনা করতেন এবং প্রজাদের মাঝে তাঁর বিরুদ্ধে অসন্তোষ তৈরী করার চেষ্টা করতেন। তথাপি তাঁর প্রতি আইনি পদক্ষেপ করা তো দূরের কথা, মাবিয়া কোনদিন অসৌজন্যমূলক ব্যবহার পর্যন্ত করেন নি। বরঞ্চ তাঁর পরিবারের সদস্যদের যথাযথ নিরাপত্তা ও ভরণ-পোষণ দেয়ার ক্ষেত্রে যাতে কোনো শিথিলতা তৈরী না হয় সেদিকে বিশেষ নজর রাখতেন।
মুসলিম সমাজের ধর্মগুরু ও ঐতিহাসিক দাবী করেন যে হোসেন যেহেতু মুহাম্মদের বংশধর ছিলেন তাই মাবিয়ার উচিৎ ছিলো তাঁকেই (হোসেনকেই) পরবর্তী খলিফা মনোনীত করা। হোসেনও অনুরূপ দাবী করেছিলেন। মুহাম্মদের বংশধর হলেই যে তাকে খলিফা করতে হবে এমন নীতি ইসলামের বিধানে নেই সে কথা পূর্বেই আলোচিত হয়েছে। মুহাম্মদের বংশধর থেকেই কাউকে খলিফা করতে হবে এমন বিধান থাকলে ইসলামের প্রথম তিন খলিফাকে (আবু বকর, ওমর ফারুক ও ওসমান গণীকে) অবৈধ খলিফা বলতে হয়। কিন্তু সুন্নি মুসলমান সমাজ, তাদের ধর্মগুরু ও ঐতিহাসিকগণ তাঁদেরকে অবৈধ খলিফা মানতে রাজী নন। তাদের চোখে ঐ তিন জন ছিলেন বৈধ এবং সৎ ও মহৎ খলিফা সুতরাং হোসেনকে খলিফা মনোনীত করার দাবীটি যে অযৌক্তিক তা বলা বাহুল্যপ্রশাসনিক অভিজ্ঞতার দিক দিয়েও হোসেনের ভাঁড়ারটিও ছিলো একেবারেই শূন্য। অর্থাৎ সেদিক দিয়েও তাঁকে খলিফা করার প্রশ্ন ওঠে না। সুতরাং মাবিয়া খলিফা পদ থেকে হোসেনকে বঞ্চিত করেছিলেন এ অভিযোগটি দেখা যাচ্ছে একেবারেই অবান্তর ও ভিত্তিহীন
এখন বিবেচ্য বিষয় থাকছে, মাবিয়া কি এজিদকে খলিফা মনোনীত করেছিলেন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্যেই? এ অভিযোগটি মূলতঃ মুসলিমদের। পাশ্চাত্যের অমুসলিম ঐতিহাসিকরা কিন্তু অন্য কথা  বলেছেন যাদের কাছে হোসেন ও মাবিয়া দু’জনেই সমান। তারা বলেছেন এজিদ ব্যতীত অন্য কাউকে খলিফা মনোনীত করলে গৃহযুদ্ধ অনিবার্য ছিলো। কারণ, খলিফা পদের দাবিদার ছিলো অনেকেই এবং তাদের মধ্যে কোনো একজনকে খলিফা মনোনীত করলে বাকিরা বিদ্রোহ করতো এবং ইসলামি সাম্রাজ্য ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতো। গৃহযুদ্ধ এড়ানো এবং ইসলামি খেলাফতকে অটুট রাখার জন্যে মাবিয়ার সামনে এজিদকে খলিফা মনোনীত করা ছাড়া অন্য বিকল্প ছিলো না। তাছাড়া অমুসলিম ঐতিহাসিকদের অনেকেই বলেছেন যে এজিদ খলিফা পদের জন্যে মোটেই অযোগ্য বা অনুপযুক্ত ছিলেন না, তিনি ঐ পদের জন্যে যথেষ্ট যোগ্য ও উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
হোসেন ছিলেন তার মাতা ও পিতার মতোই প্রচণ্ড ক্ষমতালোভীএবং তিনিও তার পিতা ও মাতার মতোই এরূপ ভুল ধারণার শিকার হয়েছিলেন যে মুহাম্মদের বংশধররাই কেবল ইসলামি সাম্রাজ্যের খলিফা হতে পারবেন। সে কারণেই যেমন আলী আবু বকরকে খলিফা মেনে নিতে পারেন নি, তেমনি হোসেনও এজিদকে খলিফা মেনে নিতে পারেন নি। তাই তিনি নিজে খলিফা হবার বাসনায় এজিদকে উৎখাত করার পরিকল্পনা করে কুফা যাত্রা করেছিলেন একটি শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী গঠন করার জন্যে। সেক্ষেত্রে বিদ্রোহ দমন করার জন্যে একজন খলিফার যা করণীয় তাই করেছিলেন এজিদ। তিনি কুফার গভর্ণরকে আদেশ দিয়েছিলেন হোসেনের বাহিনীকে প্রতিহত করার জন্যে। ফলে কারবালা প্রান্তরে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয় এবং হোসেন নিহত হন।
হোসেন যদি তার পিতার ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পারতেন তারা দাদা হাসেনের মতো  এবং অহেতুক  খলিফা হওয়ার দাবিতে উন্মাদের মতো জিদ না ধরতেন তবে কারবালা যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরী হতো না এবং অকালে তাকে জীবন বিসর্জন দিতে হতো না। তাহলে শিয়া ও সুন্নি দু’ভাগে মুসলিম জামাত ভাগও হতো না।
(তাবেয়ী* - মুহাম্মদের মৃত্যুর পর সাহাবীদের সহকর্মী হয়ে যারা ইসলাম বিস্তারে জিহাদ করেছিলেন তাদের তাবেয়ী বলা হয়)
১/১০/১৭ (১০ই মহরম)   






বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাইনি – পাঁচ

  দ্বিতীয় অধ্যায় শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবের প্রতি তীব্র গণরোষের নেপথ্যে ২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে ৩৬ দিন পর (৫ই ...