আজ ১০ই মহরম। আজ আশুরা। আজ মহরম। মুসলমানদের কাছে আজকের
দিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই দিনটি তাদের কাছে মহাপবিত্র দিন। এই দিনটি আবার তাদের
কাছে মহাশোকের দিনও। মহাশোকের দিন এজন্যে যেহেতু এই দিনে মুহাম্মদের দোহিত্র ইমাম হুসাইন
(হোসেন) কারবালা নামক বৃক্ষবর্জিত একটি মাঠে ইয়াজিদের (এজিদের) সৈন্যবাহিনীর হাতে
একটি অসম যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। যুদ্ধটি ইতিহাসে কারবালা যুদ্ধ নামে খ্যাত। এ
নিবন্ধটি কারবালা যুদ্ধ নিয়ে। তবে আজ যেহেতু আশুরাও বটে, তাই আশুরা প্রসঙ্গে
সংক্ষেপে কয়েকটা কথা বলে নিয়ে মূল নিবন্ধে প্রবেশ করবো।
আশুরার দিনটি, আগেই বলেছি, মুসলমানদের কাছে মহাপবিত্র
দিন। মহাপবিত্র এজন্যে যে আল্লাহ এদিনে পৃথিবী সৃষ্টি করেন এবং এদিনেই কেয়ামত ঘটাবেন (পৃথিবী ধ্বংসও
করবেন)। এদিন ইব্রাহিম নবী
নমরুদের অগ্নিকুন্ড থেকে রক্ষা এবং ইউনুস নবী মাছের পেট থেকে মুক্তি পান। এরূপ আরো
বহু রূপকথা জুড়ে রয়েছে আশুরাকে কেন্দ্র করে। এ রূপকথাগুলিকে মুসলমানরা সম্পূর্ণ
সত্যি বলে বিশ্বাস করেন। তাই এদিনটি তারা ধর্মীয় ভাবগাম্ভির্যের সাথে পালন করে
থাকেন। অনেকেই এদিনে
রোযা (উপবাস) রাখেন।
আশুরার মহাপবিত্র দিনেই মহানবীর অতি আদরের ছোট নাতি কারবালা
যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। কী অবাক কাণ্ড! এদিনটিকেই আল্লাহ তার শ্রেষ্ঠ হাবিব
(অভিন্নহৃদয় বন্ধু) মুহাম্মদের নাতি হোসেনের মৃত্যুদিবস হিসেবে বেছে নিয়েছিলো! আর
তার জন্যে হোসেনকে অকালে প্রাণ দিতে হয় একটি অসম যুদ্ধে! অনেক অসম যুদ্ধেই তো
আল্লাহ তার পিয়ারা দোস্ত মুহাম্মদকে ফেরেস্তা পাঠিয়ে সাহায্য করেছিলো যার ফলে মুহাম্মদ
সে সব যুদ্ধে হয় বিজয়ী হয়েছিলেন, না হয় পরাজয় ও নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা
পেয়েছিলেন। অনুরূপভাবে কারবালা প্রান্তরে আল্লাহ হোসেনকে ফেরেস্তা পাঠিয়ে সাহায্য
করলে কারবালা যুদ্ধের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো। আল্লাহ কিন্তু হোসেনকে ফেরেস্তা
পাঠিয়ে সাহায্য করেনি। ফলে আশুরার মহাপবিত্র দিনটিই মহাশোকে পরিণত হয়। কেনো
আল্লাহ হোসেনকে সাহায্য করে নি তার উত্তর মুসলমান সম্প্রদায় আজো খুঁজে পায়নি। মুসলমান সমাজ সে উত্তর খুঁজে ফিরুক, আমি এই মহাপবিত্র ও মহাশোকের দিনটিতে আর একবার
খুঁজে দেখবো কেনো কারবালা যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিলো।
১৩৩৭ বছর আগে ৫৯ হিজরীতে ৬৮০ সালে আজকের দিনটিতে ফোরাত
(ইউফ্রেটাস) নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে এজিদের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে হোসেনের যুদ্ধ
বেধেছিলো এবং হোসেন সদলবলে নিহত হয়েছিলেন। এজিদ ছিলেন ইসলামি বিশাল সাম্রাজ্যের
৬ষ্ঠ খলিফা। তাঁকে তাঁর পিতা ৫ম খলিফা মুয়াবিয়া (মাবিয়া) খলিফা মনোনীত করেছিলেন।
মাবিয়ার মৃত্যুর পর এজিদ খলিফা পদে আরোহণ করলে হোসেন
তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। হোসেন নিজেই খলিফা পদের দাবিদার ছিলেন। হোসেনের দাবী ছিলো যে, যেহেতু তিনি মহানবীর
বংশধর, তাই খলিফা পদের ন্যায্য উত্তরাধিকার একমাত্র
তিনিই। এজিদকে তাই তিনি অবৈধ ও অপ্রকৃত
খলিফা ঘোষণা করে তাঁর বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দেন। তিনি এটাকে মিথ্যার বিরুদ্ধে
সত্যের, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, ধর্মদ্রোহীর বিরুদ্ধে বিশ্বাসীর এবং কুফরির
বিরুদ্ধে ঈমানের জিহাদ আখ্যা দেন। সেই জিহাদে অংশ নিতে তিনি সমস্ত মুসলমানদের কাছে
আহ্বান জানান। এবং জিহাদের জন্যে সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে একটি ক্ষুদ্র
সৈন্যদল নিয়ে তিনি কুফা নগরের পথে রওনা দেন। কুফায় পৌঁছানোর আগেই কারবালা
প্রান্তরে এজিদের সৈন্যবাহিনী তাঁর পথরোধ করে এবং সেখানেই দু’পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ
সংঘটিত হয়। সেই যুদ্ধে হোসেন সসৈন্য
মৃত্যুবরণ করেন।
মুসলিম সমাজের ধর্মগুরু ও ঐতিহাসিকগণ কারবালা
যুদ্ধকে আল্লাহর পথে একটি পবিত্র জিহাদ বলেই সীলমোহর দিয়েছেন। তারা বলেন যে ঈমাম
হুসাইন কারবালা প্রান্তরে শাহাদাত বরণ করেছিলেন ইসলামের শত্রু ইয়াজিদের
সৈন্যবাহিনীর হাতে। তারা কারবালা যুদ্ধের জন্যে অভিযুক্ত করেন এজিদ ও তার পিতা
মাবিয়াকে। মাবিয়ার বিরুদ্ধে তাদের প্রধান অভিযোগ হলো এই যে তিনি পুত্র এজিদকে
খলিফা করার জন্যে ইসলামি গণতান্ত্রিক নীতি লঙ্ঘন করে ইসলামি খেলাফতে পরিবারতন্ত্র/রাজতন্ত্র
প্রতিষ্ঠা করেন যার পরিণতিতে
কারবালা যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই ধর্মগুরু ও ঐতিহাসিকগণই আলির
মৃত্যুর পর তার জ্যৈষ্ঠ পুত্র ইমাম হাসান (হাসেন) যখন খলিফা হন তখন তার
মধ্যে পরিবারতন্ত্র/রাজতন্ত্র দেখতে পান নি। এবং ঈমাম হুসাইন (হোসেন) যখন মুহাম্মদের বংশধর হিসেবে উত্তরাধিকার সূত্রে
খলিফা হওয়ার দাবী পেশ করেন তখনও এদের চোখে সেটাকে পরিবারতন্ত্র বলে মনে হয় নি। মুসলিম
সমাজের ধর্মগুরু ও ঐতিহাসিকদের এরূপ দ্বিচারিতা আরো অনেক পরিলক্ষিত হয় তাদের লেখা
কারবালা যুদ্ধের ইতিহাসে।
ইসলামি নীতি লংঘন করে ৫ম খলিফা মাবিয়া এজিদকে ৬ষ্ঠ খলিফা
মনোনীত করার জন্যেই কারবালা যুদ্ধ হয়েছিলো বলে যে অভিযোগ করা হয় তার ঐতিহাসিক
ভিত্তি নেই। কারণ, খলিফা মনোনয়ন বা নির্বাচন নিয়ে ইসলামে আসলে কোনো নীতিই নেই। ফলে
মুহাম্মদের মৃত্যুর পর খলিফা পদে নিয়ে তিন দিন ধরে তাঁর সাহাবিদের মধ্যে প্রবল ঝগড়া
ও বাদানুবাদ হয়। সেই তিন দিন মুহাম্মদের লাশ অসমাধিস্থ
অবস্থায় পড়েছিলো। তিন দিন পর অবশেষে কোনোরকমে
আবু বকর ১ম খলিফা মনোনীত হন। মুহাম্মদের কন্যা ফতেমা তখন জীবিত ছিলেন। তিনি ও তাঁর
বর আলি এবং তাদের অনুগামীরা আবু বকরকে খলিফা হিসেবে মেনে নেন নি। কারণ, তাঁরা আশা
করেছিলেন যে মুহাম্মদের তৈরী করা সাম্রাজ্যের খলিফা হিসেবে তাঁর উত্তর পুরুষ আলিই সর্বসম্মতিক্রমে
মনোনীত হবেন। কিন্তু তা না হওয়ায় তিনি অতিশয় হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে
ওঠেন এবং সংযম ও শালীনতা হারিয়ে আবু বকরকে বিশ্বাসঘাতক বলে গালাগাল দিয়ে বাড়ির
দরজা থেকে তাড়িয়ে দেন। ২য়, ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম খলিফা মনোনীত হয়েছিলেন ভিন্ন ভিন্ন
পদ্ধতিতে। এটা প্রমাণ করে যে খলিফা মনোনয়ন বা নির্বাচন নিয়ে ইসলামের কোনো নীতি
নেই। সুতরাং মাবিয়ার বিরুদ্ধে খলিফা মনোনীত করার
প্রশ্নে ইসলামি নীতি লংঘনের অভিযোগ ধোপে টেকে না।
আসলে কারবালা যুদ্ধের বীজ পোঁতা হয়ে গিয়েছিলো সেদিন
যেদিন আবু বকর প্রথম খলিফা মনোনীত হয়েছিলেন। আবু বকরের প্রথম খলিফা হওয়াটা ঠিক ছিল
না ভুল ছিলো তা নিয়ে মুসলিমরা আজো দ্বিধাবিভক্ত। সুন্নি মুসলমানরা বলেন যে
সম্পূর্ণ সঠিক ছিল আর শিয়া মুসলমানরা বলেন ভুল ছিলো। আবু বকরের প্রথম খলিফা হওয়াটা
ঠিক বা ভুল যাই হোক না কেনো, আলি যদি সংকীর্ণতা পরিহার করে তাঁকে মেনে নিতেন তা হলে ইসলামের ইতিহাস
তৈরী হতো অন্যভাবে এবং তাহলে কারবালা যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরী হতো
না। আলি একে তো প্রথমে আবু বকরকে খলিফা হিসেবে স্বীকারই করেন নি, তারপর তিনি তাকে
আম জনতার সামনেই প্রচণ্ড অপমানও করেছিলেন। এর ফল ভালো হয় নি তাঁর (আলির) পক্ষে। আবু
বকর তাঁর নেক নজর থেকে আলির নাম সম্পূর্ণই মুছে দিয়েছিলেন এবং তিনি মৃত্যুর পূর্বে
২য় খলিফা মনোনীত করে যান ওমর ফারুককে। আবু বকরকে আম জনতার সামনে যখন ফতেমা ও আলি
অপমান করেন তখন আবু বকরের সঙ্গে ওমর ফারুকও ছিলেন। তাঁরা উভয়মিলে দু’জনকেই
ক্ষমতালোভী ও বেইমান বলে অপমান করেছিলেন। স্বভাবতই ওমর ফারুকও আলির প্রতি পচণ্ড
বিরূপ ও রুষ্ট হয়েছিলেন। ফলে তিনিও তাই আলিকে তৃতীয় খলিফা মনোনীত করার কথা ভাবেন
নি। মুহাম্মদের আর এক জামাতা ওসমান গণিকে তিনি খলিফা মনোনীত করেন। এতে আলির
গাত্রদাহ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। আলি যেহেতু নিজেকে মুহাম্মদের উত্তরাধিকার মনে করতেন
তাই প্রতিবারই তিনি খলিফা হবেন এমন আশা পোষণ করতেন। ফলে
খলিফা হতে না পেরে প্রতিবারই তিনি আশাহত হন এবং তার হতাশা ও ক্ষোভও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি
পায়। তার সঙ্গে তার মনে খলিফা হওয়ার
আকাংখা ও জেদও প্রবলভাবে বাড়তে থাকে। ওসমানের খেলাফতকালে তাই তিনি তার পাশে
দাঁড়ানোর ন্যূনতম সৌজন্যটুকুও প্রদর্শন করতে পারেন নি। উল্টে নানা তুচ্ছাতিতুচ্ছ
বিষয়গুলি নিয়ে খলিফার বিরুদ্ধে সাহাবি ও তাবেয়ীদের* অসন্তোষগুলিকে গোপনে উস্কে দেয়ার চেষ্টা
করতেন। যারা ব্যক্তিগত স্বার্থ পূরণ না হওয়ায় খলিফার (ওসমানের) প্রতি অতিশয়
ক্ষুব্ধ ছিলো তারা আলির ভূমিকায় উৎসাহিত হয়ে খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংগঠিত করার
সাহস পেয়ে যায়। বিদ্রোহীদের লক্ষ্য ছিলো ওসমানকে ক্ষমতাচ্যুত করে আলির হাতে খেলাফত
তুলে দেয়া। আলি এ বিষয়ে যে অবহিত ছিলেন তা বিদ্রোহের সময় এবং বিদ্রোহের পরের নানা
ঘটনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। অতি সারল্য এবং অদুরদর্শিতার
জন্যে ওসমান অবশেষে বিদ্রোহীদের হাতে নিহত
হন। তারপর দ্রুতই পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে বিদ্রোহীদের হাত ধরে আলি চতুর্থ
খলিফার সিংহাসনে
আরোহণ করেন।
ওসমানের হত্যাকাণ্ড এবং তারপর আলির খলিফা হওয়াটা সাহাবী,
তাবেয়ী এবং বিভিন্ন প্রদেশে গভর্নরগণ
অধিকাংশই মেনে নিতে পারেন নি এবং তাঁরা খলিফা আলির হাতে বয়াতও নেন নি। উল্টে তারা আলিকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্যে তাঁর
বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে সংকল্পবদ্ধ হন এবং অচিরেই গোটা সাম্রাজ্য জুড়ে গৃহযুদ্ধ
বেধে যায়। প্রধানতঃ দু’টি ফ্রণ্টে সে যুদ্ধ চলে কয়েক বছর ধরে। একটি ফ্রণ্টে ছিলেন
মুহাম্মদের কনিষ্ঠতম বৌ আয়েষার নেতৃত্বে মক্কা ও মদিনার সাহাবীগণ এবং অন্য
ফ্রণ্টের নেতৃত্বে ছিলেন একটি বৃহৎ প্রদেশের গভর্নর মাবিয়া। গৃহযুদ্ধ চলাকালীনই
আলি গুপ্তঘাতকের হাতে গুরুতর আহত হয়ে মারা যান। আলির অকাল মৃত্যুতে ইসলামি
সাম্রাজ্য দু’টুকরো হয়ে যায়। আলির অধিকারে থাকা সাম্রাজ্যে খলিফা মনোনীত হন তার
জ্যৈষ্ঠ পুত্র ঈমাম হাসান (হাসেন) আর মাবিয়ার অধিকারে থাকা সাম্রাজ্যে তিনিই খলিফা নিযুক্ত হন। খলিফা পদে হাসানের
কোনোদিন আগ্রহ ছিলো না। বস্তুতঃ নারী ছাড়া আর অন্য কিছুতেই বিশেষ আগ্রহ তাঁর ছিলো
না। জামা-কাপড়ের মতো তিনি বৌ পাল্টাতেন। নতুন কোনো সুন্দরী ও যুবতী নারীকে
পছন্দ হলে আগের বৌকে তালাক দিয়ে তাকেই বিয়ে করতেন। একদিনে চার বৌকে তালাক দিয়ে
সেদিনই চারজন নারীকে বিয়ে করার বিশ্বনজিরও তিনি তৈরী করে গিয়েছেন। এতে যার পর নাই
ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর এক বৌ তাঁকে খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে হত্যা করেছিলেন। মৃত্যুর
আগে হাসেন মোট ১০০টি বিয়ে করেছিলেন। এহেন নারীবিলাসী মানুষের কাছে যুদ্ধবিধ্বস্ত
খেলাফত গলার কাঁটা হয়ে উঠেছিলো। তাছাড়া রণনিপুণ বিচক্ষণ মাবিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে এঁটে
ওঠা যে যাবে না তা তিনি বিলক্ষণ জানতেন। তাই হাসেন কালবিলম্ব না করে মাবিয়ার সঙ্গে
সন্ধি করে নিয়ে তাঁর হাতে থাকা খেলাফতের ভার মাবিয়ার
হাতে তুলে দেন। ফলে সমগ্র সাম্রাজ্যের খলিফার গুরুদায়িত্ব মাবিয়ার কাঁধে ন্যস্ত
হয়। হাসেন যখন মাবিয়ার হাতে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা হস্তান্তর করেন তখন তাদের মধ্যে একটি
চুক্তি হয়েছিলো। চুক্তিটি ছিলো –
·
এক). হাসেন ও তার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা হবে।
·
দুই). রাজকোষ থেকে তাদের সকলের ভরণ-পোষণ
নির্বাহ করা হবে।
·
এর সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট ক্ষুদ্র ভূখণ্ডও হাসেন দাবী করেছিলেন। মাবিয়া সহর্ষ
চিত্তে তা মেনে নিয়েছিলেন।
মাবিয়া মোট কুড়ি বছর (৬৬১-৬৮০) খলিফা ছিলেন। লম্বা
গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত ইসলামি সাম্রাজ্যটিকে নিপুণ দক্ষতায় নতুন করে তাঁকে নির্মাণ
করতে হয়েছিলো। গৃহযুদ্ধের সুযোগ নিয়ে অনেক
রাজ্যই ইসলামি খেলাফত থেকে বিদ্রোহ করে বেরিয়া গিয়েছিলো। সেগুলিকে মাবিয়া পুনরায় দখল করে খেলাফতের অধীনে নিয়ে আসেন।
শুধু তাই নয়, সাম্রাজ্যের
বিপুল বিস্তারও তিনি ঘটিয়েছিলেন। শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান প্রভৃতি
সর্বক্ষেত্রে তিনি প্রভূত উন্নতি সাধন করেন। প্রশাসন-সহ সর্বত্রই তিনি
ধর্মনিরপেক্ষ নীতি প্রবর্তন করেন। নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে যোগ্য ও দক্ষ লোককদেরই নিয়োগ দিতেন।
তিনিই প্রথম মুসলমান, খৃস্টান ও ইহুদী প্রভৃতি বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের নিয়ে একটি
ধর্মনিরপেক্ষ সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। এমনকি মজলিসে শুরায়ও (খলিফার
উপদেষ্টামণ্ডলীতে) তিনি বিদ্বান ও জ্ঞানতাপস ব্যক্তিত্বদের নিয়োগ দিতেন যেখানে
ধর্মের পরিচয় থাকতো গৌণ। এসব কারণে আলীর
সময়ে চারিদিকে যেখানে কেবল অরাজকতা ও বিশৃংখলা বিরাজ করতো সেখানে তাঁর আমলে গোটা
সাম্রাজ্যে তিনি সর্বত্র শৃংখলা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
চুরি,ছিনতাই, ডাকাতি, রাহাজানি, ধর্ষণ এসব সামাজিক অপরাধকে নির্মূল করে তিনি এক
স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মাবিয়ার খেলাফত সম্পর্কে এসব কথা বলেছেন বহু
ঐতিহাসিকই যাঁদের মধ্যে মাবিয়ার জাতশত্রু মুসলিমরা ঐতিহাসিকরাও রয়েছেন।
ঐতিহাসিকদের বিচারে মাবিয়া ছিলেন আরবের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নৃপতি।
মাবিয়ার দু’দশকের গৌরবময় খেলাফত কালে হোসেনের ভূমিকা
ছিলো খুবই হতাশাব্যঞ্জক ও নেতিবাচক। তিনি কখনোই খলিফা মাবিয়াকে সহযোগিতার হাত
প্রসারিত করেন নি। উল্টে সর্বদায় তার সমালোচনা করতেন এবং প্রজাদের মাঝে তাঁর
বিরুদ্ধে অসন্তোষ তৈরী করার চেষ্টা করতেন। তথাপি তাঁর প্রতি আইনি পদক্ষেপ করা তো
দূরের কথা, মাবিয়া কোনদিন অসৌজন্যমূলক ব্যবহার পর্যন্ত করেন নি। বরঞ্চ তাঁর
পরিবারের সদস্যদের যথাযথ নিরাপত্তা ও ভরণ-পোষণ দেয়ার ক্ষেত্রে যাতে কোনো শিথিলতা
তৈরী না হয় সেদিকে বিশেষ নজর রাখতেন।
মুসলিম সমাজের ধর্মগুরু ও ঐতিহাসিক দাবী করেন যে হোসেন
যেহেতু মুহাম্মদের বংশধর ছিলেন তাই মাবিয়ার উচিৎ ছিলো তাঁকেই (হোসেনকেই) পরবর্তী
খলিফা মনোনীত করা। হোসেনও অনুরূপ দাবী করেছিলেন। মুহাম্মদের বংশধর হলেই যে তাকে
খলিফা করতে হবে এমন নীতি ইসলামের বিধানে নেই সে কথা পূর্বেই আলোচিত হয়েছে। মুহাম্মদের
বংশধর থেকেই কাউকে খলিফা করতে হবে এমন বিধান থাকলে ইসলামের প্রথম তিন খলিফাকে (আবু
বকর, ওমর ফারুক ও ওসমান গণীকে) অবৈধ খলিফা বলতে হয়। কিন্তু সুন্নি মুসলমান সমাজ,
তাদের ধর্মগুরু ও ঐতিহাসিকগণ তাঁদেরকে অবৈধ খলিফা মানতে রাজী নন। তাদের চোখে ঐ তিন
জন ছিলেন বৈধ এবং সৎ ও মহৎ খলিফা। সুতরাং
হোসেনকে খলিফা মনোনীত করার দাবীটি যে অযৌক্তিক তা বলা বাহুল্য। প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার দিক দিয়েও হোসেনের ভাঁড়ারটিও ছিলো
একেবারেই শূন্য। অর্থাৎ সেদিক দিয়েও তাঁকে খলিফা করার প্রশ্ন ওঠে না। সুতরাং
মাবিয়া খলিফা পদ থেকে হোসেনকে বঞ্চিত করেছিলেন এ অভিযোগটি দেখা যাচ্ছে একেবারেই
অবান্তর ও ভিত্তিহীন।
এখন বিবেচ্য বিষয় থাকছে, মাবিয়া কি এজিদকে খলিফা
মনোনীত করেছিলেন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্যেই?
এ অভিযোগটি মূলতঃ মুসলিমদের। পাশ্চাত্যের অমুসলিম ঐতিহাসিকরা কিন্তু অন্য কথা বলেছেন যাদের কাছে
হোসেন ও মাবিয়া দু’জনেই সমান। তারা বলেছেন এজিদ ব্যতীত অন্য কাউকে খলিফা মনোনীত
করলে গৃহযুদ্ধ অনিবার্য ছিলো। কারণ, খলিফা পদের দাবিদার ছিলো অনেকেই এবং তাদের
মধ্যে কোনো একজনকে খলিফা মনোনীত করলে বাকিরা বিদ্রোহ করতো এবং ইসলামি সাম্রাজ্য
ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেতো। গৃহযুদ্ধ এড়ানো এবং ইসলামি খেলাফতকে অটুট রাখার জন্যে
মাবিয়ার সামনে এজিদকে খলিফা মনোনীত করা ছাড়া অন্য বিকল্প ছিলো না। তাছাড়া অমুসলিম
ঐতিহাসিকদের অনেকেই বলেছেন যে এজিদ খলিফা পদের জন্যে মোটেই অযোগ্য বা অনুপযুক্ত
ছিলেন না, তিনি ঐ পদের জন্যে যথেষ্ট যোগ্য ও উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
হোসেন ছিলেন তার মাতা ও পিতার মতোই প্রচণ্ড
ক্ষমতালোভী। এবং তিনিও তার পিতা
ও মাতার মতোই এরূপ
ভুল ধারণার শিকার হয়েছিলেন যে মুহাম্মদের বংশধররাই কেবল ইসলামি সাম্রাজ্যের খলিফা
হতে পারবেন। সে কারণেই যেমন আলী আবু বকরকে খলিফা মেনে নিতে পারেন নি, তেমনি হোসেনও
এজিদকে খলিফা মেনে নিতে পারেন নি। তাই তিনি নিজে খলিফা হবার বাসনায় এজিদকে উৎখাত
করার পরিকল্পনা করে কুফা যাত্রা করেছিলেন একটি শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী গঠন করার
জন্যে। সেক্ষেত্রে বিদ্রোহ দমন করার জন্যে একজন খলিফার যা করণীয় তাই করেছিলেন
এজিদ। তিনি কুফার গভর্ণরকে আদেশ দিয়েছিলেন হোসেনের বাহিনীকে প্রতিহত করার জন্যে।
ফলে কারবালা প্রান্তরে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয় এবং হোসেন নিহত হন।
হোসেন যদি তার পিতার ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পারতেন
তারা দাদা হাসেনের মতো এবং অহেতুক খলিফা হওয়ার দাবিতে উন্মাদের মতো জিদ না ধরতেন
তবে কারবালা যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরী হতো না এবং অকালে তাকে জীবন বিসর্জন দিতে হতো
না। তাহলে শিয়া ও সুন্নি দু’ভাগে মুসলিম জামাত ভাগও হতো না।
(তাবেয়ী* - মুহাম্মদের মৃত্যুর পর সাহাবীদের
সহকর্মী হয়ে যারা ইসলাম বিস্তারে জিহাদ করেছিলেন তাদের তাবেয়ী বলা হয়)
১/১০/১৭ (১০ই মহরম)
No comments:
Post a Comment