Wednesday, August 27, 2014

সামনে দুটো খেলাফত, সত্যিকারের মুসলমানদের যে কোনো একটাকে বেছে নিতে হবে


আইসিস [ISIS] - এর পর এবার নাইজিরিয়ার মুসলিম সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ‘বোকো হারাম’ ইসলামি খেলাফত স্থাপনের ঘোষণা দিলো। বোকো হারামের প্রধান আবুবকর সেকাও সেই ঘোষণায় বলেছেন  যে তাঁরা নাইজিরিয়ার উত্তর-পূর্বে  বোর্নো রাজ্যের গোজা শহরে ‘ইসলামিক খেলাফত’ স্থাপন করেছে। গত ২৪ শে আগষ্ট, রবিবার ৫২ মিনিটের একটি ভিডিও রেকর্ডের মাধ্যমে সেকাও বিশ্ববাসীকে এই সংবাদ  অবহিত করেছেন। গোজা শহরে বিজয় হাসিল ও তথায় ইসলামি খেলাফত স্থাপন করার  সব কৃতিত্ব তিনি দিয়েছেন আল্লাহকে। তিনি বলেছেন, "Thanks be to Allah who gave victory to our brethren in (the town of) Gwoza and made it part of the Islamic caliphate,"  সেকাও আরো জানিয়েছেন যে এখন থেকে গোজা শহর আর নাইজিরিয় সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না। He declared that Gwoza, in Borno state, now has "nothing to do with Nigeria". সেকাও  সদর্পে জানিয়েছেন যে, আল্লাহর অনুগ্রহে আমরা  বোর্নো রাজ্যের গোজা শহরে থাকতে এসেছি, এখান থেকে আমরা  ফিরে যাবো না  -  "By the grace of Allah we will not leave the town. We have come to stay," [সংবাদ সূত্রটি হলো – Islamic Caliphate In Nigeria|Islamic Caliphate|Boko Haram] বোকো হারাম আরো জানিয়েছে যে  গোজা  শহরের উত্তর ও দক্ষিণে বিশাল অঞ্চল  এবং পার্শবর্তী  যোবে রাজ্যের একটি শহরও তারা নিয়ন্ত্রণ করছে। তবুও বোকো হারাম নিয়ে মিডিয়ায় বিশেষ খবর দেখা যায় না।  কিন্তু এটা একটা বিশ্বের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলির একটি। মার্কিন যুক্ত্রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ  বোকো হারামকে অনেক আগেই অন্তর্দেশীয় কুখ্যাত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন বলে চিহ্নিত করেছে।
বোকো হারাম মিডিয়ার নজরে প্রথম আসে সম্ভবতঃ এ বছর ১৬ই এপ্রিল  তারা সে দিন একটা স্কুল থেকে ২৭৬ জন স্কুল ছাত্রীকে অপহরণ করেঅপহরণের পর তাদের জিম্মী  বানিয়ে সরকারকে বলে – হয় আমাদের সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মুক্তি দাও, না হলে আল্লাহর হুকুমে এই মেয়েদের বাজারে বিক্রি করে দেবো। আজ পর্যন্ত নাইজিরিয় সরকার সেই স্কুলছাত্রীদের উদ্ধার করতে পারে নি। ওদের সন্ত্রাসবাদী কাজের ধারা অব্যাহত রয়েছেতাদের সন্ত্রাসবাদী কাজগুলির মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হল -  আরো কুড়িজন নারীকে অপহরণ,  গীর্জায় আক্রমণ ও উপাসনারত খৃষ্টানদের হত্যা, ৩১জন নাইজিরিয় নিরাপত্তা কর্মীকে হত্যা, ২০০ জন অসামরিক নাইজিরিয়কে হত্যা  ইত্যাদি  ইত্যাদিবোকো হারামের এ সব বীভৎস, পৈশাচিক ও নারকীয় সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপগুলি বোধ হয়  চাপা পড়ে যাচ্ছে গাজায় ইজরায়েলের গণহত্যা এবং  ইরাক ও সিরিয়ায় আইসিসের হাড় হিম করা ক্রমাগত চলতে থাকা হত্যালীলার ঘটনায়।
বোকো হারাম নাইজিরিয়ায় ইসলামিক খেলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে ২০০২ সাল থেকে। গত পাঁচ বছরে তারা কমপক্ষে ২০০০ অসামরিক লোকজনকে হত্যা করেছে। এবং প্রাণ রক্ষার্থে সাড়ে সাত লক্ষ নাইজিরিয় মানুষ ঘর ছাড়া হয়েছসামরিক বাহিনী ও প্রশাসনের লোকজন ছাড়াও তারা সাধারণ মানুষকে অপহরণ ও হত্যা করছে তাদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে নিশ্চুপ করিয়ে দিতে বা পক্ষে টানতেসাধারণ মানুষের অবস্থা খুবই সঙ্গীন, সরকার তাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না, এমনকি সামরিক বাহিনীরও বোকো হারামের মোকাবিলা করার শক্তি ও সাহস  কোনোটাই নেই বলে প্রতিভাত হচ্ছে।কয়েকদিন আগে যখন বোকো হারামের সন্ত্রাসীরা গোজা শহরের ২০০ জন মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে তার আগে স্থানীয় সরকার আগে থেকে আক্রমণের খবর পেয়ে সরকারের কাছে আবেদন করেছিলো সেনা পাঠিয়ে তাদের রক্ষা করার জন্যে। কিন্তু নাইজিরিয় সরকার সেনা পাঠাতে পারে নি। কারণ সেনা বাহিনী যেতেই চায় নি। সেনা বাহিনী আরো অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া গোজা শহরে যাবে না বলে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে যে সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে তা এ রকম - Soldiers this week refused to deploy to Gwoza without better weapons in an apparent mutiny. মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর এ বিষয়ে আগেই খবর দিয়েছিলো যে বোকো হারাম তাদের বাহিনীকে যে আধুনিক ও উন্নত মানের প্রশিক্ষণ দেয় তা নাইজিরিয় সরকার তার সামরিক বাহিনীকে দিতে পারে না এবং বোকো হারামের কাছে যে ধরণের উন্নত ও অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র আছে তা  সামরিক বাহিনীর হাতেও নেই।    
আইসিস বা, আইসিএল ইরাক ও সিরিয়ার বেশ কিছু অঞ্চল জুড়ে [সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় এলাক আলেপ্প থেকে পূর্ব ইরাকের দিইয়ালা প্রদেশ পর্যন্ত] ইসলামি খেলাফত ঘোষণা করেছে  গত  ২৯শে জুন,  যে দিন এ বছর মুসলিমদের পবিত্র রমজান মাসের সূচনা  হয়আইসিস তখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ কয়েকটি কথা  ঘোষণা  করে। সেগুলি হলো – এক]. আইসিস [ISIS] এখন থেকে হবে আইএস [IS]  অর্থাৎ ইসলামিক স্টেট। দুই]. তাদের অধিকৃত অঞ্চলে তারা ইসলামি খেলাফত গঠন  করেছে তিন]. আবুবকর আল-বাগদাদি তাদের খলিফা,  চার].  আবুবকর  আল-বাগদাদি এখন থেকে ‘খলিফা ইব্রাহিম’ নামে পরিচিতি পাবেন। পাঁচ]. বিশ্বের সকল  মুসলমানকে আবুবকর আল-বাগদাদির কাছে বায়াত [আনুগত্যের শপথ] নিতে হবেআইসিস কে ‘আইএস’ করে খেলাফত গঠনের মধ্যে দিয়ে তারা যে বার্তা দিয়েছে তা বিরাট তাৎপর্য বহন করে। তাহলো, সমগ্র বিশ্বকে তারা তাদের খেলাফতের অধীনে আনতে চায় এবং গোটা বিশ্ব পরিচালিত হবে তাদের মনোনীত  খলিফার  নির্দেশে ও শাসনে,  যেমন মুহাম্মদ ও তাঁর অনুগামী খলিফাদের অধীনে শাসিত ও পরিচালিত হতো মুসলিম বিশ্ব‘ইব্রাহিম’ একজন নবীর নাম যাঁর বিশেষ মর্যাদা রয়েছে সমস্ত নবীদের মধ্যে। আবুবকর আল-বাগদাদিকে ‘খলিফা ইব্রাহিম’ হিসেবে পরিচিত করার মধ্যে দিয়ে আইএস গোটা বিশ্বের মুসলিমদের কাছে তাদ খেলাফত ও খলিফাকে একটি বিশেষ মর্যাদা ও উচ্চতায় তুলে ধরতে চায়।
খেলাফত গঠনের ঘোষণাকে শুধু কথার কথা হিসেবে  দেখলে চলবে না। কারণ, মুহাম্মদ ও তাঁর উত্তরসূরী প্রথম চারজন খলিফা – আবুবকর, ওমর ফারুক, ওসমান গণি ও আলি - যাঁদেরকে ‘খোলাফায়ে রাশেদিন’ তথা সৎপথে পরিচালিত খলিফা হিসেবে মুসলুমানরা জানে, যে পথে খেলাফত পরিচালনা করতেন সে পথেই তারা খেলাফত পরিচালনা করছে, কোন আপোষ করছে না।  ইহুদি,খৃষ্টান ও ইয়াজেদি সহ অমুসলিম যারা আছে তাদের কাছে তারা এই বিকল্পগুলি দিয়েছিলো – এক]. মুসলমান হও,  দুই]. অথবা জিজিয়া কর দাও, তিন]. অথবা ইসলামি খেলাফত ছেড়ে চলে যাও,  চার]. অথবা মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত থাকো।  কিন্তু  রাষ্ট্রীয় সামরিক বাহিনীর সদস্য, সাধারণ পুলিশ প্রশাসনের সদস্য এবং সাধারন শিয়া মুসলমানদের জন্যে  আইসিস জঙ্গিরা হত্যা করা ছাড়া কোনো বিকল্প রাখে নিতাদের নাগালে পাওয়া মাত্রই নৃশসভাবে হত্যা করছে  শিরচ্ছেদ করে অথবা ক্রশবিদ্ধ করেশিয়ারা তাদের মতে মুসলমানই  নয়, কারণ তারা [সুন্নীরা] যে কোরানকে অনুসরণ করে এবং মনে করে যে সেটাই আসল কোরান যেটা আল্লাহর কাছে গচ্ছিত ও রক্ষিত আছে,  সেই কোরানকে শিয়ারা জাল কোরান বলে প্রত্যাখান করেছে। তাই শিয়ারা ইহুদি, খৃষ্টান ও পৌত্তলিকদের চেয়েও নিকৃষ্ট এবং আল্লাহ ও ইসলামের সব চেয়ে বড়ো শত্রু এদিকে অমুসলিমরা আইসিসের দেওয়া বিকল্পগুলি বেছে নেওয়ার সময়সীমা পার হওয়ার আগে প্রাণ রক্ষার্থে যারা পেরেছে তারা ইসলামিক স্টেট ছেড়ে যে যেখানে পেরেছে চলে গেছে। যেমন  পঁচিশ হাজার খৃষ্টান ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুল ছেড়ে চলে গিয়েছেযাদের নিজের বাড়িঘর  ছেড়ে যাওয়ার সামর্থ নেই তারা জিজিয়া কর দিয়ে জিম্মি হয়ে গোলামের মতো  বাস করছে। ইয়াজিদিরা যারা ইসলাম কবুল করে নি, জিজিয়া কর দিতেও সম্মত হয় নি, এবং বাড়িঘর ও দেশ ত্যাগ করেও যায় নি কিংবা যেতে পারেনি তাদের পাঁচশ জনকে  [ইয়াজিদিরা মুসলমান নয়, আবার ইহুদি ও খৃষ্টানও নয়] আইসিস বাহিনী নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং তাদের অনেককে জীবন্ত কবরে পুঁতে  দিয়েছে। শিয়াদের সমস্ত মসজিদ ও সৌধগুলি তারা ধ্বংস করে উল্লাসে মেতে উঠেছে পিশাচ সদৃশ। গীর্যাগুলির দখল করে সেখান থেকে ‘ক্রশ’ চিহ্নগুলি সরিয়ে দিয়ে কালো পতাকা ঝুলিয়ে দিয়েছে, এবং সেগুলিকে হয় মসজিদ, না হয় ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্রে রূূূপান্তরিত করেছে। নারীদের হিজাব পরিধান করা বাধ্যতামূলক করেছে। ধূমপান নিষিদ্ধ করেছে। সমস্ত পানশালা ও কফি হাউস বন্ধ করে দিয়েছে। নামাজের সময় সমস্ত দোকান-পাট বন্ধ রাখার নির্দেশ জারি করেছে, এই নির্দেশ ঠিকঠাক অনুসরণ করা হচ্ছে কী না তা দেখার জন্যে ইসলামি স্টেটের জঙ্গিবাহিনী তাদের নির্দিষ্ট পোশাক পরে অস্ত্রশস্ত্র সহ শহর জুড়ে  টহল দিচ্ছে।
ইসলামিক স্টেটের পক্ষ থেকে যেমন ঘোষণা করা হয়েছে যে বিশ্বের সব মুসলমানকে তাদের আনুগত্য মানতে হবে, তেমনি তার পাশাপাশি তারা এও ঘোষণা করেছে যে পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবাধিকার, ইত্যাদি সমস্ত আইনি আবর্জনাগুলিও ত্যাগ করতে হবে। ইরাকের ইসলামিক স্টেটের সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের দায়িত্ব প্রাপ্ত প্রধান সামরিক কমান্ডার আকা আবু ওমর আল-শিশানি এক সাক্ষাৎকারে ঘোষণা করেছেন যে তারা পৃথিবীতে ততদিন জিহাদ চালিয়ে যাবে যতদিন না গোটা বিশ্ব তাদের খেলাফতের অধীনে আসবে ও তাদের শাসন মেনে নিবে। আল-শিশানি উক্তিটি হলো এ রকম - ISIS has already declared war on the world and promises to “fight them until they accept our rule” under a new Islamic caliphate. আল-শিশানি একজন চেচেন বিদ্রোহী ও ধর্মান্তরিত মুসলমান। লোকটা অবৈধভাবে অস্ত্র রাখার অপরাধে তিন বছর  জেল খাটা দাগী আসামীসে  ঐ সাক্ষাৎকারে বলেছে যে যারা ইসলামের বিরোধিতা করবে তারাই তাদের শত্রু; আইসিস তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবে, তাদের নারীদের অপহরণ করবে, তাদের শিশুদের অপহরণ করবে; হয় তারা ইসলামের পতাকার নীচে আসবে, না হয়  নিশ্চিহ্ন হবে। তার বলা ইংরাজী ভাষ্যটি  এ রকম - “We will fight them. We will take their women. We will take their children. They have to come to Islam or they will get wiped out.” আল-শিশানিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো সিরিয়া ও ইরাকের সামরিক বাহিনী ও প্রশাসনের সদস্য সহ অসামরিক শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষদের   শিরচ্ছেদ করে হত্যা করা বা ক্রশবিদ্ধ করে হত্যা করার বিষয়ে। শিশানি তার জবাবে বলেছে যে আমাদের লক্ষ্য হলো, সমগ্র বিশ্বকে  ইসলামি স্টেটের খেলাফতের অধীনে  বশীভূত করা,  যারা আমাদের কাজে বাধা সৃষ্টি করবে তারাই শরিয়া [আল্লাহর] আইনে আমাদের শত্রু ও লক্ষ্যবস্তু আকা আবু ওমর আল-শিশানির বিষ্ফোরক সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার টিভি টক শোয়ের একজন নামকরা অ্যাঙ্কার টম ইলিয়ট। তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন আল-শিশানিকে ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’  এই প্রসঙ্গে। এ প্রশ্নে সরাসরি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’  বলে শিশানি উত্তর দেয় - “It is the religion of prophet Muhammad Sallallahu Alaihi Wasallam. It is not the religion of the Western hippie who tries to be accepted by you.”
শিশানি আরো একটা ভয়ঙ্কর বার্তা দিয়েছে। তা হলো, ইরাক ও সিরিয়ার শিয়া সম্প্রদায়ের  মুসলমানরাই শুধু তাদের টার্গেট নয়, তাদের সব থেকে বড়ো  টার্গেট হলো শিয়াদের শক্তির প্রধান কেন্দ্র ইরাক  ইরাক ও সিরিয়ায় তাদের কাজ সমাধা হলে তারা শিয়াদের কেন্দ্রের উপর আক্রমণ চালাবে। এ প্রসঙ্গে টম ইলিয়ট জানিয়েছেন যে কথা তা হলো,  al-Shishani promised to invade Iran when the  ISIS in Iraq finish their goals.
পৃথিবী জুড়ে আজ মুসলিম সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি যে ধরণের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালিয়ে ব্যাপকহারে অপহরণ, লুণ্ঠন ও গণহত্যা সংগঠিত করে চলেছে তা ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চালানো গণহত্যাকান্ড ছাড়া বিনা প্ররোচনায় আর কোথাও ও  কখনও ঘটেছে বলে মনে পড়ছে না। মুসলিম সন্ত্রাসবাদকে আজ আর কোনো কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বা বিপদ বলে ভাবলে ভুল হবে। আইসিসের জঙ্গিরা শুধু ইরাক ও ইরানের মুসলমান নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুসলমানরা গিয়ে সেখানে জিহাদে অংশ নিয়েছে। আল-কায়দা এবং মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডও আইসিস ও বোকো হারামের মতো অন্তর্দেশীয় সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। ফলে নাইজিরিয়া এবং ইরাক ও সিরিয়ায় ‘ইসলামি খেলাফত’ স্থাপন শুধু সেখানকার জনগণের গভীর সঙ্কট ও বিপদের বিষয় নয়। এ বিপদ বিশ্বের মানব সমাজ ও মানব সভ্যতার। এটা যদি থামানো না যায় তবে গোটা বিশ্ব মুসলিম সন্ত্রাসবাদের শিকার হবে; কেউ রেহাই পাবে না, কোনো দেশ রেহাই পাবে না। অথচ এর বিরুদ্ধে  কোনো প্রতিবাদ ধ্বনিত হচ্ছে না। গাজায় ইজ্রায়েলি হানার বিরুদ্ধে লক্ষ্য করছি প্রবল নিন্দা ও প্রতিবাদ, কমবেশী গোটা বিশ্বই মুখর; নিশ্চয় তা বাঞ্ছনীয় ও কাম্য;  কিন্তু ইরাক, সিরিয়া ও নাইজিরিয়ায় মুসলিম সন্ত্রাসবাদীরা যে নজিরবিহীনভাবে নৃশংস নিধনযজ্ঞ চালাচ্ছে মাসের পর মাস, তার বিরুদ্ধে কোথাও কোনো প্রতিবাদ শোনা যাচ্ছে না। এমনকি কোনো আলোচনা-সমালোচনাও শোনা যাচ্ছে না।আইসিস ও বোকো হারাম যত বড়ো বিপদ আমাদের সামনে, আমার মনে হয় নির্বিচারে অমুসলিম ও শিয়াদের যেভাবে তারা শরিয়তি শাস্তি হিসেবে গলা কেটে গণহত্যা চালাচ্ছে তাকে নির্বিবাদে মেনে নেওয়া তার চেয়েও বড়ো বিপদ।  জানি না, বিশ্ববিবেক এভাবে কতদিন ঘুমাবে?
আমি পরিশেষে ভাবছি মুসলমানদের কথা। বিশ্বের মুসলমানদের প্রায় ৯০% হলো সুন্নি মুসলমান। তারা কী ভাবছেন? আমি নিশ্চিত যে সাধারণ মুসলমানদের অধিকাংশই মুসলিম সন্ত্রাসবাদীদের কার্যকলাপ  সমর্থন করে না। অবশ্য তারা নাইজিরিয়া ও ইরাক-সিরিয়ায় কী ঘটছে তার খবরও বিশেষ জানে না।  তারা কোথায় খেলাফত হলো কি না হলো তা নিয়ে মোটেই ভাবিত নয়। কিন্তু বাকিরা যারা উচ্চ শিক্ষিত এবং বিশ্বের খবরা-খবর  রাখেন তারা কী করবেন? তাদের সামনে দুটো খেলাফত, তারা কোনটা নেবেন আর কোনটা নেবেন না? ইসলাম শান্তির ধর্ম এই বস্তাপচা বুলি বললে ওরা ছাড়বে না। কারণ, ইসলাম শান্তির ধর্ম এ কথা মুহাম্মদ মদিনায় আসার পর নিজ মুখে একবারও বলেন নি। মক্কায় শান্তি, সম্প্রীতি ও সহনশীলতার পক্ষে যা বলেছিলেন তা  মদিনায় এসে নির্মমভাবে বর্জন করে কাফেরদের ইসলামের শত্রু বলে নিকেশ করার কথা  বলেছেন। শুধু বলেছেন তাই নয়, তিনি নিজেই অসংখ্য ইহুদি, খৃষ্টান ও পৌত্তলিককে হত্যা করেছেন নৃৃৃশংসভাবে। অসংখ্য নারীকে বন্দি করে দাসী বানিয়ে গণিমতের মাল বলে বাজারে বিক্রি করেছেন,  না হয় অবলীলায় তাদের স্ত্রী রূপে ভোগ করেছেন।মুহাম্মদের উত্তরাধিকারী খলিফারা হাজার হাজার কাফেরদের হত্যা করে, তাদের ধন-সম্পদ লুঠ করে, তাদের নারী ও শিশুদের বন্দি ও দাসী করে, দাসীদের বিক্রি করে  কিংবা ভোগ করে ইসলামি সাম্রাজ্যের ব্যাপক বিস্তার ঘটিয়েছেন। সেই খলিফাদের প্রথম চারজনকে সুন্নি মুসলমানগণ আজো সৎ পথের খলিফা ও ইসলামের সর্বোচ্চ নেতা বলে মানেন ও শ্রদ্ধা করেন। তাদের খেলাফতকে [৬৩২ – ৬৬১ খৃঃ] বিশ্বের সর্বকালের সেরা শাসনকাল বলে তারা আজো গর্ব বোধ করেন। সেই সুন্নি মুসলিমরা কি করবেন এখন? আইসিসের খেলাফত, না বোকো হারামের খেলাফত, কোনটাকে গ্রহণ করবেন? কার কাছে বয়াত [আনুগত্যের শপথ] নেবেন? আবুবকর সেকাও না আবুবকর আল-বাগদাদি – কার কাছে? আবুবকর বাগদাদি  বলেছে যে সমস্ত মুসলমানদের তাকে খলিফা বলে মানতে হবে।  তার দাবি কিন্তু ইসলাম সম্মতই। কারণ, খলিফা একজনই হয়, সেটাই ইসলাম সম্মত। আবুবকর সেকাও এখনও সে রকম দাবি জানায় নি, তবে জানাতেও পারে। সুতরাং সুন্নি মুসলমানদের ঠিক করতে হবে কাকে তারা খলিফা মানবেন।  আইসিস বা বোকো হারাম যা করছে তা ইসলাম সম্মত নয় এ কথা সর্বৈব মিথ্যা। আকা আবু ওমর আল-শিশানি সাক্ষাৎকারে যতদিন  ইসলামের শত্রু থাকবে ততদিন তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবে ও তাদের হত্যা করবে বলে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় যা বলেছে তা তার নিজের কথা নয়, কথাগুলি সবই মুহাম্মদ ও কোরানের কথা। মুহাম্মদের শিক্ষা হলো, কাফেররা যতদিন না নত হয়ে জিজিয়া কর দেয় ততদিন তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে যেতে হবে। এ কথা কোরানের ৯/২৯ নং আয়াতে এভাবে ঘোষণা করা হয়েছে  - “Fight those who believe not in Allah nor the Last Day, nor hold that forbidden which hath been forbidden by Allah and His Messenger, nor acknowledge the religion of Truth, (even if they are) of the People of the Book (that is, Christians and Jews), until they pay the Jizya with willing submission, and feel themselves subdued.” আর কোরানের ২/১৯১-১৯৩ নং আয়াত বলছে কাফেরদের যেখানে পাও সেখানেই হত্যা করবে, তবে যদি তারা বিরত হয় তবে আল্লাহ ক্ষমাশীল এবং যতদিন পৃথিবীতে ফিৎনা [অশান্তি] থাকবে ওদের বিরুদ্ধে জিহাদ জারি রাখবে। কোরানের এই আয়াত তিনটি হলো - “And kill them wherever you find them, and turn them out from where they have turned you out. And Al-Fitnah [disbelief] is worse than killing… but if they desist, then lo! Allah is forgiving and merciful. And fight them until there is no more Fitnah [disbelief and worshipping of others along with Allah] and worship is for Allah alone. But if they cease, let there be no transgression except against Az-Zalimun (the polytheists, and wrong-doers, etc.)”
আইসিস ও বোকো হারাম তো কোরানের এই কথাগুলিই বলছে ও সেগুলি বাস্তবায়িত করছে। সুতরাং তারা যে  ইসলামের সঠিক পথেই আছে তা সংশয়াতীতভাবে সত্যি। তাই ইসলামকে সত্য, সঠিক ও শ্রেষ্ঠ ধর্ম মানতে হলে  মানতে হবে আইসিস বা বোকো হারামকেও এবং তাদের খেলাফতকেও। নচেৎ  তাদের খেলাফতকে অমান্য বা নিন্দা করলে ইসলামেরও নিন্দা করতে হবে। মুহাম্মদকে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ ও মহামানব বলে মানবো, অথচ আল-বাগদাদি কিংবা আবুবকর সেকাওকে নেতা বলে  মানবো না, এটা এক প্রকার নির্লজ্জ দ্বিচারিতা। যারা ইসলামের পক্ষে থাকবেন আবার ইসলামি খেলাফতের বিপক্ষে যাবেন তারা হয় ভন্ড  না হয় কাপুরুষ। সামনে দুটো খেলাফত, সত্যিকারের মুসলমান হলে আপনাকে যে কোনো একটাকে বেছে নিতেই হবে – এটাই বাস্তব, এর কোনো বিকল্প নেই। এ দেশে প্রকাশ্যে তা করা হয়ত যাবে না, কিন্তু মনে মনে বেছে নিতে  তো অসুবিধা নেই।
[বিঃদ্রঃ আকা আবু ওমর আল-শিশানির সাক্ষাৎকার ও তৎসংস্লিষ্ট খবরের সূত্রটির ওয়েব লিঙ্কটি হলো -  http://www.inquisitr.com/1426809/isis-beheading-videos-banned-isil-leader-says-islam-is-not-the- ]religion-of-the-western-hippie/]





Saturday, August 2, 2014

মোদিও কি খালেদা ও বুদ্ধদেবের কাতারে দাঁড়াতে চান ?


গত পোরশু (৩১.০৭.১৪) মোদি সরকার তসলিমা নাসরিনের রেসিডেন্ট পারমিট বাতিল করে দিয়েছে । তার পরিবর্তে দু মাসের ট্যুরিস্ট ভিসা (এক্স ভিসা) দিয়েছে । দু মাস পর সরকার কী করবে তা নিয়ে খোলসা করে কিছু বলে নি । স্বভাবতই আশঙ্কা আমাদের মনে – মোদি কি তসলিমার ভারতে বসবাসের অধিকার কেড়ে নিতে চায় ? ২০০৪ সাল থেকে ভারত সরকার তাঁকে প্রথমে ছ মাস মেয়াদী, পরে এক বছর মেয়াদী ভারতে বসবাসের অনুমতি (রেসিডেন্ট পারমিট)  দিয়ে এসেছে । মুসলিম মৌলবাদীরা তসলিমাকে ভারত থেকে বিতাড়ণের জন্যে কংগ্রেস শাসিত ভারত সরকারের উপর ধারাবাহিকভাবে প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছে এবং তার ফলে কংগ্রেসের সরকারও একসময় তস্লিমার উপর প্রবল মানসিক চাপ তৈরী করেছিলো যাতে তিনি  ভারত ত্যাগ করে চলে যেতে  বাধ্য হন । কিন্তু তিনি যান নি । তখন আন্তর্জাতিক স্তরে ভাবমূর্তি মলিন হবে বলে সরকার অবশেষে তাঁকে রেসিডেন্ট পারমিট দিতে বাধ্য হয়েছিলো   অনেকেরই ধারণা যে, তসলিমা ভারতের নাগরিকত্ব পেতে চান । এটা ভুল ধারণা । তাঁর তো সুইডেনের নাগরিকত্ব আছে,  তিনি চেয়েছিলেন দশ বছর মেয়াদী নবীকরণ যোগ্য রেসিডেন্ট পারমিট । কিন্তু কংগ্রেস সরকার অসন্তুষ্ট মুসলিম মৌলবাদীরা আরো বেশী অসন্তুষ্ট হবে বলে তা মঞ্জুর করে নি, যদিও আর একজন বাংলাদেশের নির্বাসিত লেখক ও মানবাধিকার কর্মী সালাম আজাদকে মঞ্জুর করেছিলো । বিজেপির তো মুসলিম মৌলবাদীদের তোয়াজ করার দায় নেয়, তাই আশা করা গিয়েছিল মোদি তসলিমার দশ বছর মেয়াদী রেসিডেন্ট পারমিটের আবেদন মঞ্জুর করবেন । কিন্তু যা আশা করা গিয়েছিলো ঘটলো ঠিক তার উল্টো ।  খালেদা নির্বাসিত করেছিলেন তসলিমাকে তাঁর স্বদেশ বাংলাদেশ থেকে, বুদ্ধদেব করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে, এবার কি মোদি ভারত থেকে নির্বাসিত করতে চান ? মোদিও কি খালেদা ও বুদ্ধদেবের কাতারে দাঁড়াতে চান ? মনে পড়ে যাচ্ছে খালেদা ও বুদ্ধদেবে কীভাবে তসলিমাকে নির্বাসিত করেছিলেন সে কথাগুলি ।
সেটা ১৯৯৪ সাল । খালেদা জিয়া অতি নিষ্ঠুরভাবে তসলিম নাসরিনকে তাঁর স্বদেশ থেকে চিরদিনের জন্যে নির্বাসিত করেছিলে । তারপর ১৯০৭ সালে একইভাবে  ভারতের কমুনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী শহর কলকাতা থেকে নির্বাসিত করেছিলেন চিরদিনের জন্যে । এই দুজনের কেউই আর তসলিমাকে ঢুকতে দেন নি যইথাক্রমে বাংলাদেশ ও  পশ্চিমবঙ্গে । খালেদার প্রচ্ছন্ন মদতে মুসলিম মৌলবাদীরা বল্গাহীন অপপ্রচার ও কুৎসার বন্যা বইয়ে  তসলিমার বিরুদ্ধে প্রথমে জনমতকে ক্ষুব্ধ করে তোলে । তারপর ‘তসলিমার মুন্ডু চাই’ ধ্বনি তুলে তান্ডব শুরু করে । খালেদা জিয়া, তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী, মৌলবাদীদের তান্ডবে কোনো দোষ দেখেন নি, দেখেছিলেন তসলিমার । এবং তাঁর বিরুদ্ধে ব্লাসফেমি আইনে মামলা  দায়ের করেছিলেন । তখন খুনি মোল্লা-মুফতিদের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে তাঁকে দীর্ঘ দুমাস এ বাড়ি ও বাড়ি করে আন্ডারগ্রাউন্ডে কঠিন কষ্টের জীবন কাটাতে হয়েছিলো ।  সে সময় বাড়ি বাড়ি হন্যে হয়ে খুঁজেছে মোলা-মুফতিদের ঘাতক দল তাঁকে হত্যা করার জন্যে । এই ঘাতকদের বিরুদ্ধে  খালেদা কোনো পদক্ষেপ করেনি, এমন কি সামান্য পদক্ষেপ্ব করেনি এই জল্লাদদের হাত থেকে তসলিমাকে রক্ষা করার জন্যেও  । উল্টে তাঁকেই দেশ থেকে নির্বাসিত করেছিলেন শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করার অজুহাতে । কমবেশী এই একই চিত্রনাট্য দেখেছি পশ্চিমবঙ্গে ।
খালেদা যা করেছিলেন তা অপ্রত্যাশিত ছিলো না , কিন্তু বুদ্ধদেবের সরকারের কাছে এটা ছিলো একেবারেই অপ্রত্যাশিত । কারণ, সিপিএম (ভারতের কমিউনস্ট পার্টি মার্কসবাদী ) আদর্শগতভাবেই ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী ও দীর্ঘ সময় ধরে এই নীতিকে চোখের মণির মতো আগলে রেখেছিলো । তথাপি এই দলের সরকারই ২০০৭ সালের ২২শে নভেম্বর হঠাৎই  তসলিমাকে নিরাপত্তার দোহায় দিয়ে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে একদম জোরকরে একটি বিশেষ বিমানে তুলে দিয়ে রাজস্থানে নামিয়ে দিয়ে চলে আসে । রাজস্থানে নির্বাসিত করার পর সরকার বলেছিলো যে তসলিমা স্বেচ্ছায় কলকাতা ছেড়ে চলে গিয়েছেন ।  তসলিমার সেচ্ছায় কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়ার কথাটা একেবারেই মিথ্যা ছিলো । বুদ্ধবাবুরা মুসলিম মৌলবাদীদের তোয়াজ করতে তসলিমাকে কলকাতায় থাকতে দিতে চান নি তা বহু আগেই কেন্দ্রীয় সরকারকে (১৪/৩/০৫) একটা চিঠি লিখে জানিয়ে দিয়েছিলো । সরকার একটা অজুহাত খুঁজছিলো তাঁকে কলকাতা থকে তাড়ানোর ।  সেই অজুহাত ২১/০৭/১৪ তারিখে কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা হয়েও ছিলো যেদিন তাঁকে তাড়ানো হয় তার আগের দিন ।  আর নির্বাসনে পাঠানোর জন্যে  বুদ্ধবাবু রাজস্থানকেই বেছে নিয়েছিলেন কেন ? বুদ্ধবাবুরা হয়তো তসলিমার ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চেয়েছিলেন, কারণ সে সময় সেখানে বিজেপির  সরকার ছিল নিজের দোষ আড়াল করতে এবং অপরের  ভাবমূর্তি কলঙ্কিত করতে মার্কসবাদী একটা রাজনৈতিক দল এত মিথ্যাচার করতে পারে তা সত্যিই আমার কল্পনার অতীত ছিলো
আমি একজন ভারতীয় হিসেবে এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলির কার্যকলাপ দেখে ভীষণ লজ্জা পাই । এখানে সবাই নির্লজ্জভাবে মুসলিম মৌলবাদীদের পদলেহন করে তারা । ধর্মীয় মৌলবাদীদের মতো সমাজের বড়ো শত্রু কমই আছে জেনেও সবাই করে । করে কারণ, তারা মনে করে মুসলিমরা ঢেলে ভোট দেবে  মোল্লাতন্ত্রকে তোষণ করলে, না করলে দেবে না । এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা, তবুও মোল্লাতন্ত্র তোষণের পরম্পরা চলে আসছে ভারতীয় রাজনীতিতে । আর যেটা আরো অধিক লজ্জা ও বেদনার বিষয় তা হলো,  এই জঘন্য রাজনীতিতে হাত পাকিয়েছে বামপন্থীরাও । ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এম) ক্ষমতায় আসার পর তাদের মধ্যে এই ভয়ানক বিচ্যুতিটির জন্ম হয় । ধীরে ধীরে এই বিচ্যুতিটি এমন ভয়ানক আকার নেয় যে তারা কংগ্রেস সহ অন্যান্য বুর্জোয়া ও পেটি-বুর্জোয়া দলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা  শুরু করে দেয় কে কত মোল্লা-মুফতিদের পদলেহন করতে পারে সে বিষয়ে । ডানপন্থী ও বামপন্থী  সকল রাজনৈতিক দলের এই নোংড়া খেলায় আমি লক্ষ্য করেছি তসলিমা যেন একটা প্যারামিটার কে কতো মোল্লাদরদী তা প্রমাণ করার ক্ষেত্রে । সবাই চেয়েছে বারবার মোল্লাতোষণে তসলিমাকে বলির পাঁঠা করতে । পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম ও বামপন্থীরা কত নগ্নভাবে এই নোংড়া খেলা খেলেছে তার দু একটা দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যাক । 
 ১৯৯২ সাল মোদির দল বিজেপি ও সঙ্ঘপরিবার বিতর্কিত বাবরি মসজিদটি ধ্বংস করে দিলে তার তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো ভারতে ও ভারতের বাইরে  । বাংলাদেশে এর প্রতিক্রিয়া হয়েছিল অত্যন্ত ভয়ঙ্কররূপে । সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর বীভৎস অত্যাচার, উৎপীড়ন ও নির্যাতন চালানো হয়েছিলো এবং অসংখ্য মন্দির ভেঙে ধ্বংস করা হয়েছিলো । তসলিমা সেই ভয়াবহ অত্যাচারের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন ‘লজ্জা’ উপন্যাস লিখে যেখানে সেই বীভৎস অত্যাচারের ছবি এঁকেছিলেন নজিরবিহীন দুঃসাহসিকতায় । এই বইটি লেখার জন্যে আগে থেকেই ক্ষিপ্ত মুসলিম মৌলবাদীরা  তসলিমার উপর আরো সহস্রগুণ ক্ষিপ্ত হয়  ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর শিরচ্ছেদ করতে না পারলেও তাঁকে দেশ থেকে নির্বাসিত করতে সক্ষম হয় । লজ্জা লেখার জন্যে সমস্ত গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ দল ও প্রতিষ্ঠানের কাছে তসলিমার প্রাপ্য ছিল ধন্যবাদ, অন্ততঃ বামপন্থীদের কাছে তো বটেই কিন্তু তখন আমি দেখেছি এ রাজ্যে মৌলবাদিদের সঙ্গে কংগ্রেস ও বামপন্থীরা একই সুরে তসলিমার তীব্র সমালোচনা করেছে  সেই বোধ হয় শুরু, তারপর বামপন্থীরা মোল্লাতন্ত্রকে খুশী করতে তসলিমাকে বারবার বলির পাঁঠা করেছে । ২০০৪ সালে তসলিমার আত্মজীবনীমূলক বইয়ের ৩য় খন্ড ‘দ্বিখন্ডিত’কে নিষিদ্ধ করে বুদ্ধদেব বাবুর সরকার মুসলিম মৌঈলবাদীদের নিষিদ্ধ করতেই । কারণ, তার আগে ২০০৩ সালে মুর্শিদাবাদ ও মালদহ জেলায় ক্ষমতাসীন বামপন্থীরা পঞ্চায়েত নির্বাচনে পরাস্ত হয়েছিলো ।  ২০০৫ সালে ৩০শে এপ্রিল মেদিনীপুরে ‘স্বর ও আবৃত্তি’ নামক একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন তসলিমাকে আমন্ত্রণ করেছিল । মুসলিম মৌলবাদীরা হুঙ্কার দিয়েছিলো তসলিমা গেলে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবে । বুদ্ধদেব বাবু, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী যারা এমন বেআইনী হুঙ্কার দিলো তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে ঐ অনুষ্ঠানটাই বন্ধ করে দিয়েছিলেন । ২০০৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বড়ো শহর শিলিগুড়িতে বইমেলার অনুষ্ঠান । তার শুভ উদ্বোধন করবেন তসলিমা । আবার মুসলিম মৌলবাদীদের তরফ থেকে রক্তগঙ্গা বওয়ানোর হুঙ্কার । বুদ্ধবাবু আবারো নেমে পড়লেন মোল্লাদের তুষ্ট করতে । সরকার আয়োজকদের জানালো, যদি বইমেলা করতে চাও তবে তসলিমার আমন্ত্রন বাতিল  করো বলা বাহুল্য যে আয়োজকরা  তাই করেছিলো । এভাবে সিপিএম ও বামপন্থীরা মুসলিম মৌলবাদীদের সঙ্গে  বারবার আপোষ করেছে । এমন কি ভিতর ভিতর শুভ আঁতাতও গড়ে তুলেছে  । 

এই আঁতাতে যেটুকু গোপনীয়তা ছিল তার সবটুকুই উদাম হয়ে যায় ২০০৭ সালের ২১ শে নভেম্বর । ওই দিন তসলিমা বিতাড়নের দাবীতে মুসলিম মৌলবাদীরা সারাদিন কলকাতার রজপথে তান্ডব চালায় । স্কুলের ছাত্রছাত্রী, পথচারী, দোকানদার, অফিস-কাচারি, যানবাহন কিছুই রেহাই পায় নি ওদের হাত থেকে । পুলিশও রেহায় পায় নি ।  দিনের শেষে বামফ্রন্টের আহ্বায়ক তথা সিপিএমের সম্পাদক বিমান বসুর কন্ঠেও আমরা শুনেছিলান সে একই দাবীর প্রতিধ্বনি – মুসলিমরা যখন চাইছে না তখন তসলিমার  এ রাজ্য ছেড়ে চলে যাওয়াই উচিত । ধর্মীয় আবেগের নামে মুসলিম দুষ্কৃতিরা পুলিশের উপর হামলা চালালো, বাস-ট্রাক-ট্রাম জ্বালালো, দোকান-অফিস ভাঙচুর করলো, এবং গোটা কলকাতাকে জিম্মি করে রাখলো সারাদিন অথচ নির্মমভাবে গণআন্দোলন ভাঙায় সিদ্ধহস্ত পুলিশ কী সংযমই না সেদিন দেখিয়েছিলো ! অন্যদিকে আবার হিংস্র ও উন্মত্ত মৌলবাদী দুষ্কৃতিদের আমরা দেখেছি সেদিনই সন্ধ্যাবেলায় কত শান্ত ভূমিকায় যখন  বিমান বসু তাঁর পার্টির পক্ষ থেকে শান্তিমিছিল করেছিলেন ।   আমরা সেদিন দেখেছি সিপিএম ও মুসলিম মৌলবাদীদের লজ্জাজনক অশুভ বোঝাপাড়া । আর ঠিক সে ঘটনার পরের দিনই তসলিমাকে নিরাপত্তার অজুহাতে বুদ্ধদেব বাবুর পুলিশ জোর করে বিমানে তুলে দিয়ে সাম্প্রদায়িক দল বিজেপি শাসিত রাজস্থানে পাঠিয়ে দেন ।  কী ন্যক্কারজনক (কু)নাট্য চিত্র আর কী নিপুণ তার পরিচালনা ও সঞ্চালনা বুদ্ধবাবু ও বিমান বাবুদের ! তসলিমাকে নির্বাসনে পাঠানোর প্রশ্নে মুসলিম মৌলবাদ ঘেঁষা খালেদা জিয়া ও কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে কী আশ্চর্য চিন্তা ও কাজের মিল দেখেছি আমরা !  
কলকাতা থেকে তসলিমাকে নির্বাসিত করা শুধু অগণতান্ত্রিক, অমানবিক ও বেআইনীই ছিলো না, তা ছিলো কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবিরোধীও । গত শতকের বিশ ও ত্রিশ দশকে  তৎকালীন পূর্ববঙ্গে (অধুনা বাংলাদেশ) মুসলিম সমাজের প্রগতিশীল ও যুক্তিবাদী লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের উপর মুসলিম মৌলবাদীরা কী ভয়ানক অত্যচার ও নির্যাতন চালাতো সে কথা আমাদের কাছে অজানা নয় । কাজী আব্দুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, কবি আব্দুল কাদির, আবুল হোসেন প্রমুখ লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের তারা ইসলামের শত্রু আখ্যা দিয়ে জনসমক্ষে নাক খত দেওয়া করিয়েছিলো ।  শেষ অবধি প্রাণ রক্ষার্থে তাঁরা ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন । ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তৎকালীন  পূর্বপাকিস্তানের (অধুনা বাংলাদেশ) বগুরা কলেজের অধ্যক্ষ  সৈয়দ মুজতুবা আলীকেও কলকাতা পালিয়ে এসে মুসলিম মৌলবাদীদের হাত থেকে প্রাণ রক্ষা করতে হয়েছিলো । তিনি বলেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কাব্য প্রতিভায় কবি ইকবালের চেয়েও বড়ো । তারজন্যে তাঁকে নাস্তিক ও হিন্দুর দালাল বলে তাঁর ওপর হামলা করেছিলো গোঁড়া মোল্লার দল ।  ঢাকায় বা তৎকালীন পূর্ববঙ্গে বা পূর্বপাকিস্তানে মুসলিম সমাজের যাঁরা মুসলিম মৌলবাদীদের হাতে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় এসেছিলেন তাঁদের সবাইকে পরম আদরে বুকে টেনে নিয়েছিলো কলকাতা । ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়েও আমরা দেখেছি একই ছবি । পাক সেনা ও মুসলিম মৌলবাদীদের আক্রমণে  এক কোটি বাঙালি ভারতে এসে আশ্রয় নিয়েছিল যাদের ৯০ শতাংশই ছিলে পশ্চিমবঙ্গে । সবাইকে প্রেম-প্রীতি দিয়ে মায়ের মতো বুকে ঠাঁই দিয়েছিল আমাদের কলকাতা ও পশ্চিমবাংলা ।  অপরদিকে রাজা রামমোহন ও ঈশ্বরচন্দ্র যখন সমাজ সংস্কারের আন্দোলন করেছিলেন তখনও হিন্দু মৌলবাদীরা ও হিন্দু সমাজ তাঁদের ওপর কম খড়্গহস্ত ছিলো না । কিন্তু তারজন্যে তাদের মুন্ডু নিতে কেউ চায় নি বা  তাঁদেরকে কলকাতা ছুঁড়ে ফেলে দেয় নি । এই হলো পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্য ।  বুদ্ধবাবুরা মানব সমাজ ও সভ্যতার শত্রু মুসলিম মৌলবাদীদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে তসলিমাকে কলকাতা থেকে নির্বাসিত করে সেদিন কলকাতার সেই ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে কলঙ্কিত করেছিলো । কিন্তু তিনি ইউরোপ ও আমেরিকায় থাকতে কখনোই স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না ।  অথচ এদিকে যেহেতু তাঁর স্বদেশ ফেরার পথ রুদ্ধ, ফেরার পথ রুদ্ধ কলকাতাতেও, তাই তিনি  বাংলার প্রতি ভালোবাসা ও আবেগের টানে থাকতে চান বাংলার কাছাকাছিই, তথা ভারতেই এবং ভারতের রাজধানী দিল্লীতে । বহু টালবাহানার পর অবশেষে তাঁর আবেদন মঞ্জুর করে ভারত সরকার ২০০৪ সালে । তিনি  ভারত সরকারের কাছে বারবার আবেদন করেছেন দশ বছর মেয়াদি নবীকরোণযোগ্য রেসিডেন্ট পারমিট দেওয়ার জন্যে । কিন্তু মুসলিম মৌলবাদীরা অসন্তুষ্ট হবে বলে তাঁর সে দাবী বারবার প্রত্যাখান করা হয়েছে । বিজেপি সর্বদায় কংগ্রেস ও বামপন্থীদের এই তোয়াজ করার নীতির বিরুদ্ধে সরব থেকেছে । তাই এটাই প্রত্যাশা ছিলো যে মোদির সরকার এবার তসলিমাকে দীর্ঘ মেয়াদী রেসিডেন্ট পারমিট  মঞ্জুর  করবে । কিন্তু একি! রেসিডেন্ট পারমিটের সময়কাল বৃদ্ধি করা তো দূরের কথা, উল্টে তাঁর সেই পারমিটটাই কেড়ে নিলো ।  এ কাজ করে মোদি নিঃসন্দেহে  ভারতের  ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকেই কলঙ্কিত ও পদদলিত  করলেন । তিনি যা করলেন, তা যদি সত্যি হয়, তাহলে  পদদলিত করলেন গণতন্ত্র ও  মত প্রকাশের স্বাধীনতাকেই । হত্যা করলেন মানবাধিকার ও মানবতাকেই ।   
মোদি কেন এ কাজ করলেন তা এক কঠিন রহস্যজনক ঘটনা । লোকসভা ভোটের আগে উগ্র হিন্দুত্ববাদী  মোদির কন্ঠে একটু পরিবর্তনের সুর আমরা লক্ষ্য করেছি । তিনি মুসলিমদের প্রতি একটা নরম বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন । রাজনৈতিক মহলের ধারণা ছিলো  সেটা ছিল তাঁর একটা ছলনা  মাত্র, এবং তিনি শুধু মুসলিম ভোটের আশায় তা করেছিলেন মোটেই তা নয় । সেটা ছিলো ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পন্ন হিন্দু সমাজের ভোটারদের টানতে তাঁর একটা কৌশলী  প্রয়াস মাত্র । কিন্তু তসলিমার  ক্ষেত্রে মোদি যা করলেন তাতে  তাঁর সম্পর্কে  রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের আবার  নতুন করে ভাবনা-চিন্তা শুরু করতে হবে । মোদিও কি সত্যি সত্যিই মুসলিম ভোট পাওয়ার প্রত্যাশী হয়ে উঠেছেন ? তারজন্যে তিনি কি মুসলিম মৌলবাদীদের তোষণ করে মুসলমানদের আস্থাভাজন হওয়ার চেষ্টা করছেন ?  তারজন্যেই কি তসলিমা বিতাড়নে তিনি বুদ্ধ-খালেদার কাতারে দাঁড়িয়ে পড়লেন ?  
পাছে মুসলিম মৌলবাদীরা অসন্তুষ্ট হয় ও মুসলিম ভোট হারাতে হয় ভেবে কোনো রাজনৈতিক দলই  মুখ খুলছে না । সব কটা রাজনৈতিক দল এ দেশে নীতি ও আদর্শহীন এবং দু কান কাটার মতো নির্লজ্জ । এ বাংলার বুদ্ধিজীবীরাও সকলেই হয় ভীতু ও কাপুরুষ,নয়তো  সুবিধাবাদী ও উচ্ছিষ্টভোগী । একটু-আধটু উচ্ছিষ্টের আশায় কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের কাছে টিকি বাঁধা রেখেছেন তাঁরা । মুসলিম মৌলবাদীদের বর্বর কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে এবং  সরকারের মোল্লাতোষণের বিরুদ্ধে একটা শব্দ উচ্চারণ করার মুরোদ নেই তাঁদের ।  বাংলার বাইরে অবস্থা এতো খারাপ নয় । তসলিমার প্রশ্নে কিছু কিছু মানুষকে সরকারের বিরুদ্ধে সরব হতে দেখা যাচ্ছে ।  তসলিমাকে ভারতে থাকার অনুমতি পত্র ফিরিয়ে দিতে, কেউ কেউ  এমন কি তসিলিমাকে ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার দাবিতও  সোচ্চার হয়েছেন   কিন্তু মোদি এ সব দাবীতে কর্ণপাত করবে কী না একমাত্র তিনিই জানেন । বাংলাদেশ ও কলকাতা থেকে নির্বাসিত হয়ে অবশেষে তসলিমা ভারতেই পাকাপাকি থেকে যেতে চেয়েছিলেন । যদি তাঁকে মোদি ও বিজেপির সৌজন্যে ভারত ছেড়ে চলে যেতে হয়, তবে সেটাও হবে তাঁর কাছে আর একদফা স্বদেশ থেকে নির্বাসনের মতোই কষ্টদায়ক ঘটনা । সত্যি কী ঘটে তা দেখার জন্যে আমাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে ।  
পুনশ্চঃ আজ (০৩. ০৮.১৪) ভোরে  সংবাদ পত্রে দেখলাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী রাজনাথ সিং তসিলামাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছেন শীঘ্রয় অন্ধকার কেটে যাবে । তিনি এমন কি দীর্ঘ মেয়াদী রেসিডেন্ট পারমিট দেওয়ারও আশ্বাস দিয়েছেন তসলিমাকে যখন তিনি স্বয়ং তাঁর (রাজনাথ সিং) সঙ্গে দেখা করেন ও ভারতে থাকার আবেদন জানা । সে কথা তসিলিমাও নিজে টুইট করে জানিয়েছেন  ।   আশাকরি সরকার কথা রাখবে এবং তা যদি হয় তবে তা হবে সত্যিই একটা ভালো দৃষ্টান্ত ।      

Wednesday, July 30, 2014

ভিন্ন স্বর ভিন্ন মঞ্চ


 যে কথাগুলি বলা একান্ত জরুরী, কিন্তু কেউ বলে না, আমরা বলতে চাইআমরা কিছু করতে চাই
একটি আবেদন
বন্ধুগণ,
আমরা কাজ করছি  মুর্শিদাবাদ জেলার  একটি মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে যেখানে পশ্চাদপদতার শ্রীহীন ছাপ  চোখে পড়ে সর্বত্রমুসলিম সমাজের পশ্চাদপদতা সারা পৃথিবী ও সারা দেশজুড়েই , কিন্তু  মুর্শিদাবাদে পশ্চাদপদতা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী প্রকট । এ অঞ্চলে যে হিন্দুরা বাস করেন তাঁদের সিংহভাগই তফশীলি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত । বলা বাহুল্য, তাঁরাও  পশ্চাদপদ ।  ফলতঃ সামগ্রিকভাবে এ অঞ্চলটি  পশ্চাদপদতম অঞ্চলগুলির একটি 
পশ্চাদপদ অঞ্চলের সমাজ  আষ্ঠেপৃষ্ঠে শৃঙ্খলিত থাকে নানা পশ্চাদপদ চিন্তা, কুপ্রথা ও কুসংস্কারের শিকলে  ফলে জন্ম নেয় নানারকম সামাজিক ব্যাধি যা সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রন করে ফলে  উন্নতি, অগ্রগতি ও বিকাশের পথ প্রবলভাবে ব্যাহত হয়আমরা যে অঞ্চলে  কাজ করছি   সেখানে এর অন্যথা হবার কোনো কারণ নেই,  হয়ও নি ।
এ অঞ্চলে যে সামাজিক ব্যধিগুলি এখানকার জনজীবনকে প্রতিদিন কুঁড়ে কুঁড়ে খায় ও তার প্রাণশক্তিকে ক্রমাগত শুঁষে নেয়  সেগুলি হলো বহুবিবাহ,  বাল্যবিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ (তালাক), অনিয়ন্ত্রিত পরিবার, অনিয়ন্ত্রিত জন্মহার, ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় গোঁড়ামি  ইত্যাদি ।  এছাড়াও জুয়া, মদ ও মাতলামির মত ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধিগুলিও রয়েছে জুয়া ও মদ যে  এক সর্বনাশা সামাজিক ব্যাধি তা  বলা বাহুল্য । জুয়া ও  মদের কবলে পড়ে কত পরিবার যে সর্বস্বান্ত হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই । জুয়া ও মদের কারণে মাঝেমধ্যে সামাজিক শৃঙ্খলা ব্যাহত হয়, কখনো কখনো বিশৃঙ্খলা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে ।   
ধর্মান্ধতা মানুষের  চিন্তাভাবনাকে  যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ ও  পশ্চাদমুখী করে   মানুষকে করে তোলে প্রবলভাবে   অদৃষ্টবাদী । অদৃষ্টবাদ  শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয়ে মানুষের সচেতনতা  অর্জনের পথে বাধা সৃষ্টি করে       এবং  সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই  মানুষকে অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবিয়ে রাখে । উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া  দারিদ্রের সঙ্গে এই অজ্ঞতা যুক্ত  হওয়ার ফলে দারিদ্রকেই মানুষ জীবনের ভবিতব্য বলে ভেবে নিয়ে নিজেদের  ভবিষ্যতকে অদৃষ্টের উপর সঁপে  দেয় তাঁদের উপলব্ধির মধ্যে এটা থাকে না যে নিজেদের প্রচেষ্টাতেও  আর্থিক দৈন্যতা অনেকটা লাঘব করা যায়  পরিবার ছোট হলে ও  শিক্ষার্জন করতে পারলে যে দারিদ্রতাকে অনেকাংশে জয় করতে পারে এটা  তাঁদের জ্ঞান ও বোধের মধ্যে নেই
অকাল মৃত্যুর করুণ ছবি  এখানকার সমাজ জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এ ছবি অবশ্য শুধু এখানকারই নয়, গোটা দেশেরই । অকাল মৃত্যুর বড়ো কারণ নিশ্চয় দারিদ্রতা  সরকারের জনস্বার্থের বিপরীত ভাবনা ও পরিকল্পনাও একটা বড়ো কারণ কিন্তু আরো কারণ  আছে  একটি অন্যতম প্রধান কারণ মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনার প্রচন্ড অভাবএখনও  ঝাড়-ফুঁক, মাদুলি-কবজ, ইমাম-পুরোহিত  এবং কালি-পীরের উপর মানুষের আস্থা  এত প্রবলভাবে ক্রীয়াশীল  যা  না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত (অপ)চিকিৎসার এই প্রাচীন পন্থাগুলি  আসলে এক একটা মরণফাঁদ ছাড়া কিছু নয় যা বহুমানুষের অকাল মৃত্যুকে অনিবার্য করে তোলে আত্মীয়-স্বজনের অকাল মৃত্যুর  ব্যাথা ও যন্ত্রণা  কত দুঃসহ হতে পারে তা কল্পনাতীত । সেই যন্ত্রণা ও কষ্ট ভুলতে মানুষ অদৃষ্টের কোলে আশ্রয় নেয়এটা বিধিলিপি,  ঈশ্বরের ধন ঈশ্বর তুলে নিয়েছে বলে মৃতের আত্মীয়-স্বজন শান্তি ও সান্ত্বনা খোঁজেন এবং  তারপর অতি দ্রুত মৃতের আত্মার শান্তির জন্যে ধর্মীয় পারলৌকিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েনএসব কাজে মানুষ যে অর্থ অনর্থক ব্যয় বা অপচয় করে থাকেন তা  সঠিক চিকিৎসায় ব্যয় করলে নিশ্চিতভাবেই অকাল মৃত্যু অনেকটাই রোধ করা সম্ভব
দেশ স্বাধীন হয়েছে প্রায় সাত দশক, কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন বিশেষ হয় নি । দারিদ্রতা কমার চিহ্ন নেই, অপরদিকে সমাজের গুণগত অবস্থার অবনতি ক্রমবর্ধমান । জাতিগত,ধর্মীয় সম্প্রদায়গত ও  ভাষাগত পারষ্পরিক শ্রদ্ধা, সৌহার্দ ও ভালোবাসার জায়গাগুলি ক্রমশঃ সঙ্কীর্ণ থেকে সঙ্কীর্ণতর হচ্ছে । এসব ক্ষেত্রে, বিশেষভাবে ধর্মীয় সম্প্রদায়গতভাবে ক্রমশঃ বৃদ্ধিলাভ করছে পারষ্পরিক অবিশ্বাস, অনৈক্য, বিদ্বেষ, ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা ও হানাহানি ।  মুখে আমরা নারীর স্বাধীনতা ও সমানাধিকারের কথা বলছি, কিন্তু প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে  লিঙ্গবৈষম্য । কী ঘরে কী বাইরে নারীর প্রতি অবিচার, বঞ্চনা ও বৈষম্য এবং  অপমান, অত্যাচার, নির্যাতন ও ধর্ষণ বেড়েই চলেছে ।
দারিদ্রতা বিমোচনে সরকার কিছুই করছেনা তা নয় । কিন্তু যা করছে তা নগণ্য । একাজে শুধু আর্থিক পরিকল্পনা ও কর্মসূচী  গ্রহণ করাই যথেষ্ট নয় । সর্বাগ্রে ও সর্বাধিক প্রয়োজন মানুষের চিন্তাভাবনার জগতের সকল বন্ধ জানালা-দরজাগুলি খুলে দেওয়া । সহস্র বছর ধরে মানুষের চিন্তাজগতে  যে অজ্ঞতা ও পশ্চাদপদ চিন্তা  এবং সামাজিক কুসংস্কার ও কুপ্রথাগুলি জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে রয়েছে সেই পাথরটার অপসারণ সব আগে জরুরী  এই কাজটি করাই সরকারের প্রাথমিক দায়িত্বকিন্তু কোনো সরকারই  সেটা করতে চায় না, বরং উল্টে ধর্মাশ্রিত  পশ্চাদপদ চিন্তা ও প্রথাগুলিকেই উৎসাহ দেয় ।  শুধু সরকার নয়, এ কথা প্রযোজ্য শাসকদল ও বিরোধী  রাজনৈতিক দলগুলির ক্ষেত্রেও ।  রাজনৈতিক দলগুলি সর্বদা সর্বক্ষেত্রেই নিজের দলের স্বার্থকে জনগণের  স্বার্থের উপরে প্রাধান্য দেয় এ দেশে অসংখ্য বেসরকারী সমাজসেবী স্বেচ্ছাসেবা  সংগঠন কাজ করে চলেছে , কিন্তু তাদের ভূমিকাও তদ্রূপ ।  
 দারিদ্রতার অবসান  করতে হলে আগে  মানুষের চিন্তার দৈন্যতার অবসান ঘটানো জরুরী অথচ সেই কাজটি  হচ্ছে অবহেলিত । সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলি কেউ এ কাজটি করছে না, আর করবে বলে মনে হয় নাওঁরা যদি না করে, আমরা, অরাজনীতিক মানুষরা, শুধু সরকারের সমালোচনা করে চুপ করে বসে থাকতে পারি না আমরা আমাদের দায়বদ্ধতাকে অস্বীকার করতে পারি না বা এড়িয়ে যেতে পারি না । এ বোধের দ্বারা চালিত হয়ে  আমরা পশ্চাদপদ মানুষদের পাশে দাঁড়াতে চাই  কাজ আমরা অতীতেও করেছি ‘মিঠিপুরের স্পন্দন’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তুলে । সেই কাজের ধারাবাহিকতায় আমরা এবার নতুন করে গড়ে তুলেছি একটি নতুন মঞ্চ – ‘ভিন্ন স্বর ভিন্ন মঞ্চ’
পশ্চাদপদ মানুষদের পাশে কেন দাঁড়াতে চাই তা অতি সংক্ষেপে আলোচনা করেছি সে কাজে সাফল্য পেতে সব চেয়ে বেশী প্রয়োজন শিক্ষার প্রসার । শিক্ষার আলো ব্যতীত মানুষের অজ্ঞতা, ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের অন্ধকার দূর করার কথা ভাবা বাতুলতা মাত্র । সেই  শিক্ষাই স্বাধীনতার প্রায় সাত দশক পরে আজো রয়ে গেছে গরীব মানুষের কাছে কার্যতঃ অধরা, কারণ শিক্ষাও একটি পণ্য । সব চেয়ে মহার্ঘ্য পণ্য । ফলে শিক্ষা আজো বিত্তহীন ও নিম্নবিত্ত  শ্রেণীর মানুষদের নাগালের বাইরেই রয়ে গেছে । আর অতি দ্রুত লয়ে উচ্চ শিক্ষাও চলে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নাগালের বাইরে চলে গেছে । 
আমরা তাই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে উচ্চ শিক্ষা প্রসারের জন্যে দরিদ্র পরিবারের পাশে তাদের বন্ধু হয়ে দাঁড়াবো বলে স্থির করেছি শিক্ষার ক্ষেত্রে আবার মেয়েদের প্রতি বৈষম্য ও বঞ্চনা অপরিসীম ।  অথচ পরিবার ও সমাজ গঠনে মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার অধিক জরুরী । আমরা তাই প্রথম পর্যায়ে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষালাভের পথে যে আর্থিক ও মানসিক বাধা রয়েছে তা দূর করতে সর্বাধিক প্রয়াস চালাতে চাই । মাধ্যমিক পাশ করার আগেই বহু ছাত্রীর বিয়ে দিয়ে তাদের শিক্ষাজীবনের ইতি করে দেওয়া হয় । যারা মাধ্যমিক পাশ করে তাদের ক্ষেত্রে এ ঘটনার হার আরো বেশী । তার উপরে এ হার আরো অনেক বেশী । ফলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম মেয়েদের প্রায় চোখেই পড়ে না । তফশীলি হিন্দু সমাজের ক্ষেত্রেও অবস্থাটা হতাশাজনক । আমরা এ অবস্থাটার উন্নতির লক্ষ্যে নারীশিক্ষায় অভিবাবকদের অনীহা ও অর্থাভাবের কারণে  সাধারণ পরিবারের মেয়েদের যাতে পড়াশোনা বন্ধ না হয় তারজন্যে আর্থিক সাহায্যের ক্ষুদ্র ডালি নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ মেয়েদের পাশে দাঁড়াতে চাই ।
এখানকার সমাজে আর্থিক ক্ষেত্রে দৈন্যাবস্থা এত প্রকট যে সবাই আধুনিক চিকিৎসা নিতে সক্ষম নয় । তার উপরে আছে চিন্তা-ভাবনার জগতেপ্রবল বন্ধ্যা দশা । তাই মানুষকে হয় ঝাড়-ফুঁক-কবিরাজী-পীড়ান-ওঝা, না হয়  হাতুড়ে ডাক্তারের উপর নির্ভরশীল থাকতে বাধ্য হয় ।  আমরা তাই বছরে তিন-চারটি মেডিকেল ক্যাম্পের ব্যবস্থা করে তাঁদের কাছে বিনামুল্যে চিকিৎসা পরিষেবা কিছুটা হলেও পৌঁছে দিতে চাই । এ উপলক্ষে পাড়ায় পাড়ায় সভা করে স্বাস্থ্য চেতনাও গড়ে তুলতে চাই । ইতিমধ্যেই আমরা দুটি মেডিকেল ক্যাম্প করে এ কাজটি শুরু করেছি ।  
আমাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হলো – একদিকে, এক). বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গঠন, দুই). ধর্মনিরিপেক্ষ সমাজ গঠন এবং  তিন). লিঙ্গনিরপেক্ষ সমাজ গঠন । অপরদিকে আমরা চাই, এক). নারীর স্বাধীনতা, দুই). নারীশিক্ষা, তিন). নারীর সমানাধিকার
আমরা যে কাজ করছি তা রূপায়ণে বিস্তর বাধা । ধর্মীয় গোঁড়ামি ও মতান্ধতার বাধাতো আছেই, তার থেকেও  বড় বাধা অর্থের বাধা ।  এ কাজে অনেক অর্থ প্রয়োজন । যেখানে ও যাঁদের জন্যে কাজ করছি সেখান থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করা অসম্ভব । দূরের বন্ধুদেরও সহযোগীতা তাই আমাদের একান্ত প্রয়োজন ।  আশা করি আমাদের নিকট ও দূরের  শুভাকাঙ্খী  বন্ধুদের কাছ থেকে আর্থিক ও নৈতিক - সমস্ত প্রকার সহযোগিতা পাবো ।   

[বিঃদ্রঃ  সরকারী রেজিষ্ট্রেশন আইনে আটকে যাওয়ায় আমাদের সংগঠনের নামের পরিবর্তন করতে হয়েছে। এখন নাম হয়েছে - 'মিঠিপুরের ভিন্ন স্বর ভিন্ন সমিতি']  







Tuesday, July 29, 2014

ঈদের উৎসবে নেই রমজানের তথাকথিত শুদ্ধাচার,আছে অন্য সুর


 গত কাল ঈদ হয়ে গেছে সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, মিশর, সিরিয়া, জর্ডন, ইয়েমেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া প্রভ্রিতি দেশগুলিতে । একই সঙ্গে ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডীয় মুসলমানরাও গতকাল ঈদ উদযপন করেছে । আর আজ (২৯.০৭.২০১৪) যথারীতি পৃথিবীর বহু দেশের সাথা এদেশের মুসলমানরাও  সাড়ম্বরে ও মহা ধূমধামে উদযাপন  করছে  ঈদ-উল-ফিতর ।  উদযাপন করছে  এই বঙ্গের মুসলমানরাও । ঈদের তথাকথিত অন্তর্নিহিত অর্থ যাই হোক, আমরা বুঝে গেছি ঈদ মানে খুশীঈদ মুসলমানদের  সব চেয়ে বড়ো ধর্মীয় উৎসব  । কলকাতার মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি – পার্ক সার্কাস, ,মেটিয়াবুরুজ, গার্ডেনরীচ, রাজাবাজার, চিৎপুর, খিদিরপুর প্রভৃতি – কী সাজে সেজেছে, কতটা সেজেছে এবং কী বিপুল অর্থের অপব্যয় হয়েছে এই সাজসজ্জায়,  কার সাধ্য তার বর্ণনা দেয়, হিসেব দেয় । এ সব অঞ্চলগুলি ঘুরলে কে বলবে যে এ পোড়ার দেশে অন্নহীন, বস্ত্রহীন, বাস্তুহীন, গৃহহীন কোটী কোটী মানুষ  মানবেতর জীবনযাপন করে; লক্ষ লক্ষ শিশু অনাহারে,অপুষ্টিতে, অচিকিৎসায় অকালে ঝরে যায় মায়ের কোল খালি করে;  অন্ধ হয়ে যায় প্রতিদিন শত শত শিশু ভিটামিনের অভাবে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে জীবনের মতো  এবং রক্তাল্পতায় ভুগতে ভুগতে প্রতিদিন শত শত জননী সন্তান প্রসব করতে গিয়ে শেষ শয্যা নেয় ফুটপাতে কিংবা হাসপাতালের বেডে    এ অপরূপ সাজসজ্জা শুধু কলকাতার মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলেই নয়, বাংলার মফঃস্বল শহর ও গ্রামগঞ্জ সর্বত্রই এই ছবি দৃশ্যমান, সবখানেই যে যার সাধ্য মতো সাজিয়েছে নিজ নিজ অঞ্চলকে । হোর্ডিং, ব্যানার, ফ্লেক্স, চেইনফ্লাগ, আলোর বর্ণচ্ছটায় বাংলা জুড়ে সর্বত্রই ঈদের ঘোষণা । চারিদিকে উৎসবমুখর পরিবেশ, উৎসবের মেজাজ ।  বুঝতে অসুবিধা হয় না, ঈদ উপলক্ষ্যে এই যে চারিদিকে খুশীর ফোয়ারা, উৎসবের জয়ধ্বনি – এসব  গরীব-গুর্বা মুসলমানদের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ থেকেই শুধু যে উৎসারিত হয় তা কিন্তু নয় ।   এর পেছনে আছে অবশ্যই  ধর্মীয় সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় স্তর থেকে নেওয়া সুনির্দিষ্ট ও সুগভীর পরিকল্পনা । অন্যান্য সব ধর্মীয় উৎসবে, বিশেষ করে হিন্দুদের দূর্গাপূজা, কালিপূজা ও জগদ্ধাত্রী পূজায় যেমন করে হয় ঠিক তেমন করেই ঈদ উদযাপন করতে হবে – এমন পরিকল্পনা বা নির্দেশ উপর থেকেই আসে । না হলে, ঈদ (রমযানের ঈদ) উপলক্ষ্যে কেন বাজিপটকা ফাটিয়ে, আলোর রোশনায় ছড়িয়ে এতো চোখ ধাঁধানো,  মন রাঙানো খুশীর বন্যা বয়ে যাবে রাজধানী শহরের চওড়া রাজপথ থেকে শুরু করে এঁদো গ্রামের সরুগলি রাস্তায়, মহল্লায় মহল্লায় ?
ঈদ-উল-ফিতর আসে রমজান মাস শেষে শাওয়াল মাসের প্রথম দিন । আর এই রমজান মাসের কঠিনতম উপবাস পর্ব শেষ হয় ঈদ-উল-ফিতরের মাত্র দু রেকাত নামাজের মধ্যে দিয়ে । রমজানের মাসের দুটি দিক আছে বলে শোনা যায় । একটা নাকি কঠোর সংযম তথা আত্মনিয়ন্ত্রণ, আর একটা     কৃচ্ছসাধন । এর পিছনে নাকি এক বিশেষ ও বিশাল তাৎপর্য রয়েছে । এসব নিয়ে বিশোদ আলোচনা করার অবকাশ নেই এ নিবন্ধে । তবু প্রাসঙ্গিকতা হেতু কিছু কথা বলতেই হয় । সংযম মানে বলা হয় চরিত্র গঠন করা, নিজের মনে ও ভাবনায় যে মানুষের সহজাত যে কুপ্রবৃত্তিগুলি রয়েছে সেগুলিকে কঠোরভাবে  দমন করা, পরাস্ত করা এবং এ ভাবে নিজেকে রমজানের আগুনে পুড়িয়ে খাঁটি সোনায় রূপান্তরিত করা । এসব কথার কী অর্থ তা শোনা যাক ।  মিথ্যে বলা যাবে না, চুরি ও দুর্নীতি করা যাবে না, পরনিন্দা-পরচর্চা করা যাবে না, দুর্বলের উপর অত্যাচার করা যাবে না । লোক ঠকানো যাবে না, লোককে শোষণ করা যাবে না, পরনারীর প্রতি কুনজরে দৃষ্টীপাত করা যাবে নাইসলাম এসব কাজে নিষেধাজ্ঞা করেছে এ কথা শুনে ইসলামের ইতিহাসি ও কোরান-হাদিস সম্পর্কে  যাদের সামান্য জ্ঞান আছে সে সব মানুষের হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাবে । সে কথা থাক । ইসলাম নাকি বলছে যে রমজান মাসে মুসলমানদের সম্পূর্ণ সৎভাবে এবং সর্বোচ্চ মূল্যবোধের সঙ্গে জীবিনযাপন করতে হবে । শুধু কি তাই ? ইসলাম না কি বলে যে বছরের পরবর্তী এগারো মাসও সেই সততা ও নিষ্কলুষ মন ও চরিত্র নিয়ে জীবনযাপনের অঙ্গীকারও গ্রহণ করতে হবে রোজার মাসে । ধরে নেওয়া যাক, ইসলাম সত্যি এই শিক্ষাই দেয় । অধিকাংশ মুসলিমই কিন্তু সরল চিত্তে বিশ্বাস করে রমজান মাসের এই বিশেষ গুরুত্বের কথা ।
কিন্তু আমরা বাস্তবে কী দেখি ? আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতাগুলিই বা কী ? কেউ কি দাবী করতে পারেন, যাঁরা রোজা রাখেন, কিংবা প্রবল ইচ্ছা থাকলেও শারীরিক কারণে রোজা রাখেন না, তাঁরা ইসলামের  এই তথাকথিত নির্দেশগুলি পালন করেন ?  কিংবা অন্তত পালন করার চেষ্টা করেন ? না, কেউ করেন না । রমজানের আগুনে পুড়িয়ে নিজের আত্মশুদ্ধি ঘটানোই হলো রোজা রাখার উদ্দেশ্য বলে নিরন্তর  যে প্রচার শুনতে পাওয়া যায় তার ন্যূনতম প্রতিফলন দেখা যায় না মুসলমানদের মধ্যে সমগ্র রমজান মাসে । দেখা যায় বরং উল্টো ছবি । প্রতি পদে উপবাস মুখে সে নির্দেশগুলি নির্বিকার চিত্তে লঙ্ঘন করার হাজারো দৃষ্টান্ত নজরীভূত হয় রমজান মাসে । এই লঙ্ঘন করে মুসলিম সমাজ সজ্ঞানে ও সচেতনভাবে । আর এই যে সজ্ঞানে রোজামুখে রমজানের বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করা হয়,  তারজন্যে কি কোনো মানসিক যন্ত্রণা বা অনুতাপের ছাপ  চোখে পড়ে মুসলমানদের শরীরী ভাষায় ?  মোটেই না ।  তাহলে  ঈদের দিনে বা ঈদের উৎসবে খুশীতে মেতে ওঠার কী  মানে হথাকতে পারে  ?
রমজান মাস না কি কৃচ্ছতা সাধনের মাস । যারা খেতে পায় না, কিংবা আধপেটা খেয়ে দিন যাপন করে তাদের যন্ত্রণাকে উপলব্ধি করা, তাদের ক্ষুধার ভাগীদার হওয়া নাকি  এ মাসের একটা অন্যতম উদ্দেশ্য । সারাদিন উপবাস থেকে অনাহারক্লিষ্ট দরিদ্র মানুষগুলোর সঙ্গে একাত্ম হওয়ার মহান তাৎপর্য ও নির্দেশ নিয়ে নাকি রমজান মাস মুসলমানদের দরবারে এসে হাজির হয় । কিন্ত পবিত্র (!) এই রমজানের  ত্রিশ বা ঊনত্রিশ দিনের  প্রাত্যহিক জীবনের ছবিটা আমরা কীরূপ দেখি ?   কৃচ্ছতা সাধনের লেশ মাত্র আমরা দেখি না কোথাও । বরং  ঠিক এর বিপরীতটাই  দেখা যায় সর্বত্র । সূর্য অস্তমিত হওয়ার সাথে সাথে দৃষ্টীগোচর হয় উপবাস ভাঙার বিশাল আয়োজন । হর কসিমের ফলমূল, উপাদেয় নানা প্রকার তেলের খাবার ও মিষ্টান্ন সহযোগে রোজা ইফতার (উপবাস ভঙ্গ)  করা হয়, আর রাত্রে খাবার মেনুতে থাকে ভুরিভোজের বিপুল ব্যবস্থা । যারা বারোমাস অনাহারে বা অর্ধাহারে থাকে, ক্ষুধার কামড়ে ঠিক মতো ঘুমাতেও পারে না তাদের যন্ত্রণাল্কলিষ্ট মুখের কথা কি একবারও মনে পড়ে   রোজাদার ইমানদার মুসলমানদের ?   রোজা ইফতারের নামে বড়ো বড়ো পার্টি হয়, ইফতার পার্টি যার নাম । সেখানে আমন্ত্রিত হয় রোজা রাখা, না রাখা বিশিষ্ট  মুসলমানরা এমন কি হিন্দু সমাজের  বিশিষ্ট জনেরাও । এই বিশিষ্ট জনেরা সবাই ক্ষমতাবান শ্রেণির থেকে আসা মানুষ – কেউ পলিটিসিয়ান, কেউ শিল্পপতি, কেউ  বড়ো ব্যবসায়ী , কেউ আড়ৎদার, কেউ সুদখোর, কেউ মদখোর, কেউ জোতদার, কেউ প্রমোটার, কেউ খেলোয়ার, কেউ শিল্পী ইত্যাদি ইত্যাদি । কে না আমন্ত্রিত হয় সমাজের বিত্তবান ও  ক্ষমতাবান শ্রেণি থেকে ! শুধু আমন্ত্রিয় হয় না সে মানুষগুলো যারা সারা বছর খেতে পায় না তারা থেকে যায় অবাঞ্ছিত, উপেক্ষিত তবু তারা অনেকেই ছুটে যায় রবাহূত হয়ে । অসম্মানে, অনাদরে ও অবহেলায় তাদের পাতে ছুঁড়ে দেওয়া হয় কিছু খাবার যা বানানো হয় তাদের জন্যেই, কেবল তাদের মতো হতদরিদ্র সর্বহারা শ্রেণির জন্যেই । 
হতদরিদ্র মানুষদের কষ্টগুলি ভাগ করে নেওয়ার, তাদের কষ্টগুলিকে কিছুটা উপলব্ধি করার মহৎ উদ্দেশ্য সাধন করা যদি অন্যতম একটা প্রধান উদেশ্য নিয়ে যদি রমজানের  আগমন ঘটে তবে সেই রমজানের শেষে উৎসবের প্রশ্ন আসে কী করে ? তবু উৎসব হয়, আনন্দ হয় এবং  মহা ধূমধাম করেই হয় । এ বছর আগের বছরের চেয়ে বেশীই ধূমধাম হচ্ছে, সামনে বছর আরো বেশি হবে । ধর্মের কথিত নীতি ও আদর্শগুলো  গৌণই আছে, গৌণই থাকে, আর ক্রমশঃ  গৌণতর হতে থাকে ।   রমজান মাস ও রমজানের শেষে ঈদ-উল-ফিতর যে নিছকই একটা  ধর্মীয় উৎসব, শুধুই উৎসব, এখানে নীতি-আদর্শের কোনো বালাই নেই,  তার ছাপ সর্বত্রই দৃশ্যমান ।   ইসলাম সম্পর্কে যতই বড়ো বড়ো দাবি করা হোক না কেন, এসব দেখে এটা স্পষ্টতঃ প্রতিয়মান হয় যে ইসলাম একটা অনুষ্ঠান সর্বস্ব ধর্ম বৈ নয়আর পাঁচটা ধর্ম যেমন অনুষ্ঠানসর্বস্ব, ইসলামও তাই । কোনো প্রভেদ নেই এ ক্ষেত্রে । কেন  এই  অনুষ্ঠানসর্বস্বতা ? রমজান ও ঈদের কথিত ভালো ভালো গুণাবলি ও আদর্শগুলি কেন ক্রমশঃ ব্রাত্য হয়ে কেবল অনুষ্ঠানটাগুলোই বড়ো হয়ে উঠছে তার উত্তর অন্বেষণ করা যাক ।  প্রথমতঃ  আর পাঁচটা ধর্মের মতোই ইসলামের রীতি-নীতি, আইন-কানুন, ও  বিধিনিষেধগুলি আধুনিক সমাজে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে । প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে এগুলি কতটা প্রাসঙ্গিক ছিলো তা নিয়েও প্রশ্ন ও বিতর্ক থেকে গেছে । বর্তমান সময়ে তো সেগুলি সম্পূর্ণরূপেই অপাঙ্কতেয় ও অচল হয়ে গেছে । মানুষ সুদ নেবে না সুদ দেবে না, মানুষ জন্মনিয়ন্ত্রণ করবে না, কথায় কথায় বৌ পেটাবে, ইচ্ছে হলেই তালাক দেবে, চারটে স্ত্রী রাখবে, মেয়েরা বোরখা পরবে – এসব বিধিবিধান আধুনিক সভ্য সমাজের পরিপন্থী । সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের  কবলে পড়ে যখন শোষণের ক্ষেত্রগুলি  আরো প্রশস্ত ও অবাধ হয়েছে, এবং শিল্পের উদারনীতির কুপ্রভাবে  দেশের অভ্যন্তরে যখন চুরি-দুর্নীতির বাজার আরো হাট হয়ে খুলে গেছে এবং দুর্নীতি যখন এক ভয়ঙ্কর মাত্রায় প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা পেয়েছে তখন মুসলমানেরা নরকের ভয়ে বা বেহেস্তের লোভে রমজান মাসে একমাস উপবাস করে সবাই সৎ ও চরিত্রবান হয়ে উঠবে – এ এক অলীক কল্পনা ব্যতীত নয় । উপদেশ দিয়ে বা পরলোকে বেহেস্তের লোভ বা নরকের ভয় দেখিয়ে মানুষের চরিত্র গঠন করা যায় না । শোষণের বিরুদ্ধে, দারিদ্রতার বিরুদ্ধে, বৈষম্য ও অসাম্যের বিরুদ্ধে  ধারাবাহিক সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই  কেবল সৎ ও সংবেদনশীল মানুষ তৈরী হতে পারে । ইসলামে সেই কর্মসূচী কোথায় ? কোন ধর্মেই বা আছে ? নেই, কোনো ধর্মেই নেই । তাই সকল ধর্মই অনুষ্ঠানসর্বস্ব । দ্বিতীয়তঃ  পবিত্র রমাজান মাসে রমজানের কথিত ইতি-কর্তব্য কোথাও কেউ যে পালন করে না , তা নিয়ে উলামা (যারা ইসলামের ধারক ও বাহক) ও তাদের ধর্মীয় সংগঠনগুলির সামান্যতম মাথা-ব্যাথা দেখতে পাওয়া যায় না । বরং আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠাতেই তাদের আগ্রহ সর্বাধিক ।  কতো আড়ম্বরপূর্ণভাবে মুসলমানরা ঈদ উদযাপন করছে সে বিষয়েই কেবল তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকেযতো বেশী আড়ম্বর ও আতিশয্যের মধ্যে ঈদ উদযাপিত হয় ততো বেশী তারা আনন্দিত হয়, পুলকিত হয় ও উল্লসিত হয় ঈদ যখন আসে তখন তাদের অন্তর যে ভাবনায় মসগুল হয়ে ওঠে তা  এ রকমঃ   ওদের  (অবিশ্বাসীদের) দেখিয়ে দিতে হবে মুসলমানদেরও বিত্ত আছে, বিত্তের প্রাচুর্য আছে । ইসলামের নামে ও  ইসলামের জন্যে ওদের মতো মুসলমানরাও পারে চোখ ধাঁধানো সাজে নিজ নিজ অঞ্চলকে সাজিয়ে তুলতে । ওদের দেখিয়ে দিতে হবে যে ইসলামের আহ্বানে মুসলমানরাও কাঁধে কাঁধ  মেলাতে পারে, সঙ্ঘবদ্ধ হতে পারে, সবদিক দিয়ে সবাইকেই  টেক্কা দিতে পারে । ওদের দেখিয়ে দিতে হবে মুসলমানরাও  তোমাদের চেয়ে কম যায় না । রমজানের কথিত ভালো কাজগুলি নয়, মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে ঈদের উৎসবে এই দেখিয়ে দেওয়ার মানসিকতাটাই কেবল কাজ করে । এই হীন ও বিদ্বেষের মনোভাবটি কাজ করে অবশ্যই সুপ্তভাবে, যা বাহির থেকে দেখা যায় না, বোঝাও যায় না । বোঝা যায় না মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতারা ও গোঁড়া মুসলমানদের সৌজন্যে মুসলিম সমাজের অভ্যন্তরে  কীভাবে সাম্প্রদায়িকতার চোরা স্রোত বয়ে যায় ঈদ তথা খুশীর  উৎসবে     একই স্রোত অবশ্য বয়ে যায় অন্য সকল ধর্মীয় উৎসবেও । তাই রমজান ও ঈদ হয়ে ওঠে অনুষ্ঠানসর্বস্ব ।  তৃতীয়তঃ ঈদের উৎসবের পশ্চাতে কাজ করে আর একটা ভয়ঙ্কর  মানসিকতা যাতে থাকে কেবলই অহঙ্কার ও ঔদ্ধত্যের মনোভাব ।  তাহলো – ইসলামের  শ্রেষ্ঠত্বের মনোভাব ও মানসিকতা  ইসলামই একমাত্র আল্লাহর ধর্ম এবং সব ধর্মের সেরা ধর্ম ; শুধু সেরাই নয়, একমাত্র সত্য ও সঠিক ধর্ম আর সব ধর্মই ভুল ও মানুষের মনগড়া । মুহাম্মদই ঈস্বরের প্রেরিত শ্রেষ্ঠ দূত, ও শেষ দূত (নবী) । এ দাবী কোরানের । মুসলিম সমাজের ধর্মীয় নেতা  ও বুদ্ধিজীবীরা মনে করে কোরান অভ্রান্ত ।   সারা বছর ধরে চলে এই সদম্ভ প্রচারণা ও চলে স্বাভাবিকভাবেই কোরান-হাদিসের প্ররোচনামূলক বাণী বিতরণ । স্বধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের প্রচার শুধু বাণী বিতরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে তা হতে পারে না । তাই দুই ঈদ, নবীর জন্মদিন, মহরম প্রভৃতি পরবকে ঘিরে চেষ্ঠা চলে শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার লড়াই । এ এক অশুভ  লড়াই । তার প্রতিফলন দেখা যায় রমজান মাসে বড়ো বড়ো ইফতার পার্টিতে এলাহি ভুরিভোজের অনুষ্ঠানে এবং ঈদের দিন মুসলিম মহল্লা ও শহরগুলিকে চোখ ধাঁধানো সাজে সাজিয়ে তোলার আয়োজনে । স্বভাবতই রমজান ও ঈদের উৎসবে অন্তর্নিহিত ভালো কিছু থাকলেও তা গৌণ হতে হতে এখন একেবারে চলে যাচ্ছে বাতিলের খাতায় । তাই রমজান ও ঈদের পরব হয়ে উঠেছে শুধুই অনুষ্ঠানসর্বস্ব । তাই ঈদে উৎসবে মুসলমানদের কোনো কল্যাণ হয় না ।  কল্যাণ হয় না সামগ্রিকভাবে মুসলমান সমাজেরও । বরং যা হয় তা সমগ্র মানব সমাজের পক্ষে যথেষ্ট ক্ষতিকর । ঈদের উৎসব আসে, যায়; কিন্তু হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিভেদটাকে আর একটু বাড়িয়েই দিয়ে যায় ।  তাতে  ক্ষতি হয়   ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সদ্ভাব এবং জাতীয় সংহতির । শুধু ঈদের উৎসবেই হয় তা নয়, এমনটা হয় সকল ধর্মীয় উৎসবেই । মুখে আমরা যতই বলি কোনো ধর্মীয় উৎসবই সবার হয়ে ওঠে না, সার্বজনীন হয়ে ওঠে না ।
 রমজান ও ঈদ-উল-ফিতর কেন কেবল অনুষ্ঠানসর্বস্ব তার পেছনে সব চেয়ে বড়ো যে কারণটি নিহিত আছে তা লুকিয়ে আছে এর ইতিহাসের মধ্যে । প্রথমত রমজানের উপবাস আল্লাহর দেওয়া কোনো ধর্মীয় বিধান নয় যেমনটা মুহাম্মদ বলে গেছেন ও মুসলমানরা যা বিশ্বাস করে অন্ধভাবে । রমজানের উপবাস ইহুদিদেরই ধর্মীয় উৎসব যা মুহাম্মদ নিজেই পালন করতেন ইহুদিদের সঙ্গে তাদের সন্তুষ্ট  করতে । কারণ মুহাম্মদ আশাবাদী ছিলেন যে অচিরেই ইহুদিরা তাঁর ধর্মে চলে আসবে । যখন ইহুদিরা স্বধর্ম ত্যাগ না করে মুহাম্মদের  আশায় জল ঢেলে দিলো, তখন তিনি সেই ধর্মীয় আচারের কিছু সংস্কার করে সেটাই আল্লাহর নামে ইসলামে প্রবর্তন করেন । যেমন বলা হয় ‘নতুন বোতলে পুরানো মদ’ - ঠিক সে রকম ।  এ তো হলো রমজানের উপবাসের ইতিহাস । ঈদ-উল-ফিতরের ইতিহাস আরো মজার । সে ইতিহাস তুলে ধরেছেন বিশ্বখ্যাত নারীবাদী লেখক তসলিমা নাসরিন তাঁর ইংরাজী ব্লগে  ‘ঈদ’ শিরোনামে একটি নিবন্ধে । নিবন্ধটি লেখা  হয়েছে ২০১২ সালে সেখানে  তিনি একটি হাদিস উদ্ধৃত করে বলেছেন যে ইহুদিরা  ধর্মীয় উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে প্রচুর আনন্দভোগ করতো যা মুসলমানরা মুগ্ধ হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতো এবং মনে মনে ভাবতো এতো সুন্দর আনন্দোৎসব যদি আমাদেরও থাকতো তা দেখেই মুহাম্মদ ভাবলেন তাঁকেও কিছু উপায় উদ্ভাবন করা দরকার যা মুসলমানদের আনন্দ দিতে পারে এবং মনে না করে যে আল্লাহ তাদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেছে  তিনি তখন  প্রবর্তন করলেন ঈদ-উল-ফিতর এবং  ঈদ-উল-আযহা  ৬২৪ খৃষ্টাব্দে প্রথম পালন করা শুরু হয়েছিল ঈদ-উল-ফিতর । এই ইতিহাসটি খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে তসলিমার নিবন্ধে । সেই নিবন্ধ থেকে  কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যাক । তিনি লিখেছেন - Jews lived in Medina. Most probably Muhammad liked the way Jews celebrated their Yom Kippur or Rosh Hashanah. He wanted to create something for his followers so they would not feel that they were deprived of fun and recreation. Anas bin Malik says, ‘When the Prophet arrived in Medina, he found people celebrating two specific days in which they used to entertain themselves with recreation and merriment. He asked them about the nature of these festivities at which they replied that these days were occasions of fun and recreation. At this, the Prophet remarked that the Almighty has fixed two days [of festivity] instead of these for you which are better than these: Eid al-fitr and Eid al-adha.’ (From Tirmidhi Hadith)
Muhammad celebrated the first Eid in 624 with his friends and followers just after the victory at the battle of Ghazwa -e-Badar. Not many people celebrated Eid when Muhammad was alive.(নিম্নরেখা ও বাঁকানো টাইপ এই নিবন্ধকারের)  
এই হলো ঈদ-উল-ফিতরের পশ্চাতে থাকা প্রকৃত ইতিহাস যেখানে আছে কেবল মুসলমানদের জন্যে আনন্দদানের অভিপ্রায় যাতে তাদের মনে না হয় যে তারা আনন্দলাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে । রমজান ও ঈদ নিয়ে যে সব বড়ো বড়ো আদর্শ ও নীতির কথা বলা হয় তা সবই গল্প ।  তাই গল্পগুলো গল্পই থাকে, বাস্তবায়িত হয় না, বাস্তবায়িত করার গরজও থাকে না ।



বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাইনি – পাঁচ

  দ্বিতীয় অধ্যায় শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবের প্রতি তীব্র গণরোষের নেপথ্যে ২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে ৩৬ দিন পর (৫ই ...