হাওড়া জেলার নিশ্চিন্দা থানার নিম্নবিত্ত একটি কর্মকার পরিবারের গৃহবধু অনন্যা ও রিয়া ভালোবেসে ছিলো মুর্শিদাবাদ জেলার সুতি থানার দু’জন রাজমিস্ত্রীকে যাদের নাম শেখর রায় ও শুভ্রজিত দাস। শেখর ও শুভ্রজিত ঐ কর্মকার বাড়িতে কাজ করতো। সেই সূত্রেই তাদের পরষ্পরের সঙ্গে পরিচয় হয়, তারপর ধীরে ধীরে হয় ঘনিষ্ঠতা ও অবশেষে প্রণয়। প্রণয় হয় অনন্যা ও শেখরের মধ্যে এবং রিয়া ও শুভ্রজিতের মধ্যে। প্রেমের টানে অনন্যা ও রিয়া ঘর ছেড়ে চলে যায় তাদের প্রেমিকের কাছে। ঘটনাটি ঘটে অতি সম্প্রতি, ১৬ই ডিসেম্বর। স্বপ্ন ছিল তাদের ভালোবাসার দুটি নতুন সংসার। অনন্যার সাত বছরের একটি ছেলে (আয়ুষ) আছে, তাকেও সে সঙ্গে নিয়েছিলো। কিন্তু তাদের স্বপ্ন অধরা থেকে গেছে পুলিশের আজব ভূমিকা ও নিম্ন আদালতের আজব রায়ে।
পুলিশের আজব ভূমিকা
নিঁখোজ অনন্যা ও রিয়ার অনুসন্ধান করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে যে তারা অপহৃত হয় নি, স্বেচ্ছায় তাদের প্রেমিক যথাক্রমে শেখর ও শুভ্রজিতের সঙ্গে তাদের বাড়ি গিয়েছে। শেখর ও শুভ্রজিতের বাড়ি মুর্শিদাবাদ জেলার সুতি থানায়। তাদের বাড়ি গিয়ে পুলিশ নিশ্চিত হয় সে বিষয়ে।সেখানে তারা আরও জানতে পারে যে শেখর ও শুভ্রজিতের পরিবার অনন্যা ও রিয়া বিবাহিত বলে তাদের আশ্রয় দেয় নি। ফলে শেখর ও শুভ্রজিত অনন্যা ও রিয়াকে নিয়ে মুম্বাই পারি দিয়েছে। পুলিশ তখন তাদের গ্রেপ্তার করতে মুম্বাই ধাওয়া করে। ওদিকে শেখর ও শুভ্রজিতরা দিন কয়েক মধ্যেই অর্থকষ্টে পড়ে মুম্বাই থেকে তারা বাড়ি ফিরে আসছিলো ট্রেনে। পুলিশ আসানসোল স্টেশনে ওৎ পেতে ছিলো, সেখানে নামার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের গ্রেপ্তার করে এবং পরে তাদের আদালতে সোপর্দ করে। অনন্যা ও রিয়ার নিঁখোজ হওয়ার ডায়েরির পরিপ্রেক্ষিতে তাদের খঁজার জন্যে পুলিশের তৎপর হওয়াই দোষ ছিলো না। তাদের সন্ধানে শেখর ও শুভ্রজিতের বাড়ি গিয়ে খোঁজখবর করাতেও দোষের কিছু ছিলো না যেহেতু তাদের কাছে খবর ছিলো যে অনন্যা ও রিয়া তাদের সঙ্গেই গেছে। কিন্তু পুলিশ যখন জানলো যে তারা অনন্যা ও রিয়া স্বেচ্ছায় ঘর ছেড়েছে শেখর ও শুভ্রজিতকে ভালোবেসে তখন পুলিশের উচিৎ ছিলো তখনই সঙ্গে সঙ্গে তাদের তৎপরতা বন্ধ করে দেওয়া। সেই সঙ্গে পুলিশ যদি কর্মকার বাড়ির লোককে বলে দিতে পারত যে যেহেতু অনন্যা ও রিয়া প্রাপ্তবয়স্ক তাই তাদের আর করণীয় কিছু নেই। হ্যাঁ, পুলিশের সত্যি সত্যি করার কিছু নেই। কারণ, অনন্যা ও রিয়া যা করেছে তাতে আইনের লঙ্ঘন হয় নি। বিবাহিত হলেও অন্য পুরুষকে তাদের ভালোবাসার অধিকার আছে, এটা আইনে স্বীকৃতি। এ ধরণের ভালোবাসাকে আমাদের সমাজ পরকীয়া বলে নিন্দা করে পশ্চাদগামী ধ্যান-ধারণা ও মানসিকাতার জন্যে। এই মানসিকতার লোকেরা বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক বা ভালোবাসাকে মেনে নিতে পারে না কারণ, তারা মনে করে যে বর-বধূর সম্পর্ক হলো অচ্ছেদ্য ও জন্ম-জন্মান্তরের। কিন্তু কোনো সম্পর্কই অচ্ছেদ্য বা জন্ম-জন্মান্তরের হয় না, হতে পারে না। দাম্পত্যজীবনে নানা কারণে দ্বন্দ দেখা দিতে পারে। এমনকি এক সময়ে তা দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে। সেক্ষেত্রে সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কারের বশে বা অন্য কারণে দাম্পত্যজীবন টিকিয়ে রাখার ফল ভালো হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে বর কিংবা বধূ, কিংবা উভয়েই বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে। এমন পরিণতিটাই স্বাভাবিক। কারণ এটাই জীবনের নিয়ম। বাতাস যেমন শূন্যস্থানের দিকে ছুটে যায়, জল যেমন সদা নীচের দিকে প্রবাহিত হয় ঠিক তেমনই মানুষও সদা আকর্ষিত হয় ভালোবাসার প্রতি, ভালোবাসার মানুষের প্রতি। তখন সমাজের কোনো নিয়মকানুন, রীতিনীতি ও প্রথা তাদের পথ আটকাতে পারে না। এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক তথা পরকীয়াকে২০১৮ সালে আইন সিদ্ধ ঘোষণা করেছে সর্বোচ্চ আদালত। একইভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে লিভ-ইন-টুগেদারকেও (বিয়ে ছাড়াই বিপরীত লিঙ্গের বা সমলিঙ্গের দুজন মানুষের একত্রে বাস করাকে)। তার মানে স্বীকৃতি পেয়েছে সমকামিতাও। লিঙ্গ পরিবর্তনের অধিকারকেও সর্বোচ্চ আদালত বৈধ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। সুতরাং সংশয় নেই যে অনন্যা ও শেখর এবং রিয়া ও শুভ্রজিতদের ভালোবাসায় কোনো ভুল বা অন্যায় নেই এবং তারা আইনও লঙ্ঘন করে নি। বরং তারাই আইন লঙ্ঘন করেছে যারা অনন্যা ও রিয়াদের ব্যক্তিজীবনের অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছে।
নিম্ন আদালতের ভূমিকাও হতাশাজনক
নিম্ন আদালতে অনন্যা ও শেখর, অনন্যা ও তার পুত্র আয়ুষ এবং রিয়া ও শুভ্রজিতের মামলায় যে রায় দিয়েছে তা বিষ্ময়কর। তিনটি রায় দিয়েছেন বিচারক। শেখর ও শুভ্রজিতকে চৌদ্দদিনের জন্যে জেলে পাঠানো হয়েছে, অনন্যা ও রিয়াকে মুক্তি দিয়েছে এবং সাত বছরের শিশু আয়ুষকে তার মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে তার বাবার হাতে তুলে দিয়েছে। সামগ্রিকভাবে এ রায়ে ২০১৮ সালের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের কতটা প্রতিফলন ঘটেছে তা নিয়ে প্রশ্ন করার অবকাশ রয়েছে। নিম্ন আদালত অনন্যা ও রিয়াকে জামিন দিলেও শেখর ও শুভ্রজিতের জেল হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে। ২০১৮ সালের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের সকলের বেকসুর মুক্তি পাওয়ার কথা। কিন্তু শেখর ও শুভ্রজিতের যেহেতু জেল হেফাজত হয়েছে তাই মনে হচ্ছে অনন্যা ও রিয়াকে জামিন দেওয়া হয়েছে। অনন্যা ও রিয়া এজাহার দিয়েছে যে তারা যথাক্রমে শেখর ও শুভ্রজিতকে ভালোবাসে এবং স্বেচ্ছায় তাদের সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে। তাই ২০১৮ সালের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে তারা নির্দোষ। সুতরাং অনন্যা ও রিয়ার মতন তাদেরও কেস থেকে অব্যাহতি পাওয়া, নিদেন পক্ষে জামিন পাওয়াটা প্রাপ্য ছিলো। বিষ্ময়কর ঠেকেছে সাত বছরের নাবালক সন্তান আয়ুষকে তার মায়ের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে বাবাকে হস্তান্তর করা। সন্তান সাবালক না হওয়া পর্যন্ত মায়ের কাছেই থাকবে, এটাই তো যতদূর জানি আইনের নির্দেশ। আর নাবালক সন্তানকে তার মা যতটা আদর-যত্ন দিয়ে প্রতিপালন করতে পারবে সেটা কখখনই সম্ভব নয় তার পিতার পক্ষে করা। সুতরাং আয়ুষকে তার মায়ের কাছে পাঠাবার নির্দেশ দেওয়াটাই ছিলো প্রত্যাশিত। অনন্যা যদি তার পুত্র আয়ুষকে নিতে অস্বীকার করে থাকে তবে আলাদা কথা। অনন্যা তার পুত্রকে তার সঙ্গে রাখতে চায় নি এমন খবর কিন্তু শোনা যায় নি। অনন্যা, রিয়া, শেখর ও শুভ্রজিতদের মূল অপরাধ হলো তারা বিত্তহীন পুরাণ জুড়ে দেখা যায় পরকীয়ার ছড়াছড়ি। ভগবান কৃষ্ণ ও রাধার পরকীয়ার সর্বজন বিদিত। এটাও সর্বজন সুবিদিত যে রাধা ছিলেন বিবাহিত। শুধু এক রাধা নয়, কৃষ্ণ পরকীয়া করতো বহু রমণীর সঙ্গে। তাদেরকে নষ্ট মেয়ে নয়, বলা হয়। ইসলামও পরোক্ষভাবে বিভিন্ন পথে পরকীয়াকে অনুমোদন করেছে। ইসলামি আইনে বহুবিবাহ সিদ্ধ। একজন মুসলিম পুরুষ চারটি বউ নিয়ে সংসার করতে পারে। প্রথম বিয়ের ক্ষেত্রে বউ নির্বাচন করে থাকে সাধারণত অভিভাবকরা। কিন্তু বউ থাকা সত্ত্বেও কেউ যখন দ্বিতীয় বা তৃতীয় বা চতুর্থ বিয়ে করে তখন বউ নির্বাচন সে নিজেই করে। সেই বউদের তারা সাধারণত নির্বাচন করে থাকে বিবাহ বহির্ভূত প্রেমে পড়েই। অর্থাৎ মুসলিম সমাজে দ্বিতীয় বা তার পরের বিয়েগুলো সম্পন্ন হয় কিছুদিন বিবাহ বহির্ভূত প্রেমালাপ চলার পর। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে বহুবিবাহের মধ্যেই পরকীয়ার বীজ নিহিত রয়েছে। ইসলাম অনুমোদিত মুতা বিয়েও কার্যত এক প্রকার পরকীয়া। একজন বিবাহিত পুরুষ কিছু দিনের জন্যে বাড়ির বাইরে অবস্থান করলে চুক্তির ভিত্তিতে কয়েকদিনের জন্যে একটা মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে। তারপর চুক্তি অনুসারে মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে তাকে ইস্তফা দিয়ে দেবে। এতো পরকীয়াই। বর্তমান সময়েও পরকীয়ার ঘটনা কম ঘটছে? বলিউড ও টলিউডের তারকাদের মধ্যে তো পরকীয়া একটা সংস্কৃতি বা ফ্যাসান হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই জগতে সবচেয় চর্চিত পরকিয়ার তারকারা হলেন নুসরত ও যশ। চলচিত্র জগতের বাইরে পরকিয়ার জন্যে যারা সবচেয়ে সাড়া জাগিয়েছে তারা হলো শোভন ও বৈশাখী। তারা দুজনেই বিবাহিত এবং তাদের কারোরই বিবাহবিচ্ছেদ হয় নি। কৃষ্ণ ও রাধা পরকীয়া করলে দোষ নেই। মহাভারতের চরিত্র কর্ণের জন্ম তার পিতা পাণ্ডূর ঔরসে হয় নি। তবু তাকে জারজ বলে গালাগাল দেওয়ার পরিবর্তে বীর যোদ্ধা বলে সম্মান জানানো হয়। শোভন ও বৈশাখী এবং যশ ও নুসরত প্রকাশ্যে পরকীয়া করতে পারবে। তাতে হিন্দু ও মুসলিম সমাজের যায় আসে না কিছুই। পুলিশও তাদের বিরুদ্ধে কোনো তৎপরতা দেখাবার কথা ভাবতেই পারে না। শোভন ও বৈশাখী এবং যশ ও নুসরত বিবাহ বন্ধন ছাড়াই একসঙ্গে থাকতে পারে ও বসবাস করতে পারে, পুলিশ কিন্তু সে সব দেখেও নীরব থাকে। পুলিশের নীরব থাকার কারণ শুধু এটাই নয় যে পরকীয়া আইনত সিদ্ধ। নীরব থাকার পেছনে আর একটা কারণ আছে সেটা হলো, তারা বিত্তশীল ও প্রভাবশালী। আইনের চোখে অনন্যা,, শেখর, রিয়া ও শুভ্রজিতরাও নির্দোষ। তবু সমাজ ও পুলিশ উভয় মিলে তাদের ইচ্ছামতো অপবাদ দিলো, হেনস্থা করলো, জেলেও পুরলো কারণ, তারা বিত্তহীন ও প্রভাব-প্রতিপত্তিহীন। এ দেশে নিম্নবর্ণ ও নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়াই সবচেয়ে বড়ো অপরাধ।
যে পরিণতি
প্রত্যাশিত ছিলো
অনন্যা ও রিয়া আদালত থেকে জামিন বা ছাড়া পাওয়ার পর
তাদের শ্বশুর বাড়ি তাদের নেয় নি। ফলে তারা তাদের বাবা-মায়ের আশ্রয়েই চলে যায়।
আমাদের সমাজ এখনও যেভাবে ধর্মীয় কুসংস্কারে আকণ্ঠ ডুবে আছে তাতে এটা অনুমান করা
যায় যে অনন্যা ও রিয়া আশ্রয় পেলেও ভালো নেই। ভালো নেই তাদের বাবা-মা এবং পরিবারের
অন্য সদস্যরাও। ভাগাড়ে মরা পড়লে শকুনের দল যেমন মরাটাকে ছিঁড়ে খুবলে খায় তেমনি করে
সমাজের মাতব্বররা তাদের নিরন্তর ছিঁড়ে খাবে। অনন্যা ও রিয়ার বাবা-মা যদি ধর্মীয়
কুসংস্কারের বশে কিংবা লোকলজ্জার ভয়ে তাদের সন্তানকে নিতে অস্বীকৃতি জানাতো তবে
সমাজ তাদের ধন্য ধন্য করতো। আমাদের সমাজে পরকীয়ার ক্ষেত্রে এরূপ মর্মান্তিক ও
দুঃষহ পরিণতি যে ঘটতে পারে তা অনুমান করা মোটেই কঠিন কিছু নয়। তথাপি নিম্ন আদালত কেন যে তাদের এরূপ ভয়ানক পরিণতির
মধ্যে নিক্ষেপ করলো তা আমাদের এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ঢুকছে না।
পরকীয়াকে বৈধ বলে সর্বোচ্চ আদালত যেহেতু তিন বছর আগেই
স্বীকৃতি দিয়েছে সেহেতু অনন্যা ও রিয়ার মতন শেখর ও শুভ্রজিতেরও ভিত্তিহীন অভিযোগ
থেকে মুক্তি বা জামিন পাওয়ার ক্ষেত্রে আইনি কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিলো না। তারা মুক্তি বা জামিন
পেলে অনন্যা ও রিয়া এবং তাদের বাবা-মাকেও সমাজের দ্বারা হেনস্থা হওয়ার মতন
বিড়ম্বনায় পড়তে হতো না। আর এই পরিণতিই তো আমাদের কাম্য ও প্রত্যাশিত ছিলো।
২৮.১২.২০২১
No comments:
Post a Comment