অমর একুশে বই মেলার বাইরে পুলিশের নাকের
ডগায় খুন হয়ে গেলেন মুক্তমনা লেখক অভিজিত
রায় । তাঁকে হত্যা করার পর বিশ্বজুড়ে যে প্রতিক্রিয়া দেখতে পাওয়া যাচ্ছে তা প্রমান
করে তাঁর কাজ আন্তর্কজাতিক স্তরেও যথেষ্ট
প্রশংসা ও খ্যাতি অর্জন করেছিলো । এমন একজন তরুণ প্রতিভাবান লেখককে হত্যা করলো মুসলিমদের জঙ্গিরা । তিনি আন্তর্জাতিক
দুনিয়ায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন কারণ,
তিনি যে স্বাধীন ও মুক্ত সমাজ নির্মাণের জন্যে অক্লান্তভাবে কাজ করছিলেন তা শুধু তাঁর
দেশ বাংলাদেশের মানুষদের জন্যেই নয়, কাজ
করছিলেন সমস্ত বিশ্ববাসীর জন্যে । এ কথাটা বুঝেছে তাঁর ছোট মেয়ে তৃষা আহমেদও, কিন্তু কথাটা বুঝতে অক্ষম বিশ্বের তাবৎ মুসলমানরা । তৃষা যা বলেছে – “বিশ্বকে আরও উন্নত করার জন্য আওয়াজ ওঠানোয়
তিনি [বাবা] প্রবলভাবে বিশ্বাসী ছিলেন ।” [বনন্ধনীভুক্ত শব্দটি লেখকের] হ্যাঁ,
সারা বিশ্বের মানুষের স্বার্থে ও পক্ষে
কাজ করার জন্যে যে বুদ্ধি, মেধা, প্রতিভা, প্রজ্ঞা, ভাবনা ও বোধ থাকা দরকার তা অভিজিতের ছিলো । অভিজিত সম্পর্কে তসলিমা লিখেছেন, “অভিজিৎ রায় বয়সে আমার চেয়ে প্রায় আট-ন’ বছরের ছোট। কিন্তু স্নেহ নয়, ওঁকে আমি সবসময় শ্রদ্ধা করেছি। বিজ্ঞানের এবং দর্শনের যে সব কঠিন জটিল খুঁটিনাটি সাধারণের পাঠযোগ্য করে অভিজিৎ একের পর এক বই লিখে গেছেন, আমার পক্ষে সেসব লেখা কখনই সম্ভব হতো না। অভিজিৎ রায়ের মতো ধৈর্য আর ধীশক্তি আমার নেই।” তসলিমা আরো লিখেছেন, “ যে কথা আমি কোথাও বলতে পারিনি, সবসময় জানতাম সে কথা বলার জন্য একটি মাত্র জায়গা যদি কোথাও থাকে, সে মুক্তমনা। ... বিভিন্ন বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের বিভিন্ন মত প্রকাশ, আর একই সঙ্গে বিভিন্ন মত নিয়ে আলোচনা চলতে লাগলো মুক্তমনায়। ... একটা অশিক্ষিত মৌলবাদী মানুষের দেশ আমার দেশ—এই ভাবনাটি আমাকে মাথা নত করিয়েছিলো, অভিজিৎ এর ‘মুক্তমনা’ আমার নতমস্তক উঁচু করিয়েছে।”
অভিজিত খুন হলেন কেনো ? তিনি ছিলেন বাক-স্বাধীনতা এবং অবাধ মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী । সেই বিশ্বাস তিনি শুধু অন্তরে পোষণই
করতেন না, ছড়িয়ে দিতেন অকুতোভয়ে ।
তিনি জানতেন ধর্ম প্রভাবিত রাষ্ট্র ও সমাজ
সে অধিকার দেবে না, তা সংগ্রাম করে অর্জন করতে হবে । সেই সংগ্রামে তিনি নিজেকে যেমন
উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন মৃত্যুর ভ্রুকূটিকে উপেক্ষা করে, তেমনি সঙ্ঘবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে
তোলার জন্যে খুলেছিলেন ‘মুক্তমনা’ ব্লগও । এই ব্লগটি
সারা বিশ্বে, বিশেষ করে বাংলাদেশে ও এপার
বাংলায় মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার আন্দোলন গড়ে তুলতে একটি মশাল হয়ে পথ দেখিয়েছে । অভিজিত ও তাঁর সহযোদ্ধারা এই ব্লগে প্রাতিষ্ঠানিক
ধর্মগুলি যে অন্ধবিশ্বাস, অপবিজ্ঞান ও কুসংস্কার, হিংসা-বিদ্বেষ ও ঘৃণার বাতাবরণ
তৈরী করে মানবসমাজের সর্বনাশ করে চলেছে তার বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন ও সঙ্ঘবদ্ধ
করার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন । শুধু ইসলামের নয়, মুক্তমনা সব ধর্মেরই মুখোশ খুলেছে নির্মমভাবে যুক্তিপূর্ণ
সমালোচনায় বিদ্ধ করে । এই মহান কাজটি অন্য কোনো ধর্মের মানুষের কাছে অসহ্য ঠেকে নি, কেবল সহ্য
হয় নি ইসলামের পতাকা বহনকারী অন্ধকারের কীটগুলোর ।
তারা অভিজিতকে শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর বুক থেকে সরিয়েই
দিলো । অভিজিতকে হত্যা করে তারা একজন ব্যক্তিকেই
কেবল হত্যা করে নি, কিংবা কারো সন্তান, বা কারো বাবা, বা কারো স্বামী, বা কারো আত্মীয়কেই শুধু হত্যা করে নি । তারা হত্যা করেছে মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির আন্দোলনের একজন
সেনাপতিকেও । এবং তারা হত্যা
করতে চেয়েছে একটা আদর্শকে, একটা আন্দোলনকে, একটা
প্রতিষ্ঠানকে এবং একটা মশালকে । এর আগেও বাংলাদেশের মাটিতে তারা হত্যা করেছে মুক্তচিন্তার বহু মানুষকে যাঁদের মধ্যে
আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও লেখক
হুমায়ুন আযাদ, শাহবাগ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ব্লগার রাজীব হায়দার শোভোন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকও । এটা শুধু বাংলাদেশের সমস্যা
নয় । সারা বিশ্বেই ধর্মান্ধ মুসলমানরা অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে মুক্তচিন্তা ও
মুক্তবুদ্ধির মানুষদের উপর তাঁদের কণ্ঠ স্তব্ধ
করার জন্যে । স্বভাবতই বিশ্বের মুক্তমনা মানুষরা অভিজিত হত্যার বিরুদ্ধে
রাস্তায় নেমেছে হত্যাকারীদের শাস্তির দাবিতে
এবং ইসলামি সন্ত্রাসকে প্রতিহত ও প্রতিরোধ এবং পরাস্ত করার অঙ্গিকারবদ্ধ হতে ।
অভিজিত হত্যার ঘটনায় বিশ্বব্যাপী উল্টো
প্রতিক্রিয়াও আছে । সে প্রতিক্রিয়া উল্লাসের । উল্লাসে মেতে উঠেছে বিশ্বের
ধর্মান্ধ মুসলিমানরা যাদের মধ্যে আছে যেমন মাওলানা-ইমাম-মুফতি ও মাদ্রাসার
ছাত্র-ছাত্রীরা, তেমনি আছে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতি মুসলিম শিক্ষক-অধ্যাপক,
বুদ্ধিজীবী, কলাকুশলী, লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকদের বিপুল অংশও । প্রথম দল উল্লাস ব্যক্ত করছে
সোচ্চারে, পরের দলভুক্ত লোকেরা তাদের উল্লাস ভাগাভাগি করে নিচ্ছে আড়ালে
একান্তে নিজেদের মধ্যে ।
শেষোক্ত দলভুক্ত লোকেরাও মোল্লা-মুফতিদের মতোই মনে করেন তাঁরা
আগে মুসলিম পরে অন্য কিছু । আর মুসলমানদের পক্ষে তো
ইসলাম এবং নবির সমালোচনা একেবারেই অসহনীয় । তাঁরা যে অভিজিত হত্যায় মনে মনে আহ্লাদিত হবেই । কিন্তু যেহেতু তাদের
আর একটা সত্তা আছে, তাই তারা মুক্তমনা
মানুষদের হত্যা করার ঘটনায় প্রকাশ্যে আনন্দ প্রকাশ করতে পারেন না । তাদেরই
একাংশ আবার এ
রকম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কলম ধরতে
দ্বিধা করেন না । এই কলমচিরা
মুসলিম জঙ্গিদের [কপট] নিন্দা করার জন্যেই যে শুধু কলম ধরেন তা মোটেই নয়, , তাঁদের
প্রধান উদ্দেশ্যই হলো ইসলাম ও ইসলামের নবির নামে জয়গান করা । এঁরা জঙ্গিদেরযত নিন্দা করেন তার চেয়্ব বেশী নিন্দা করেন যাঁরা সন্ত্রাসের শিকার হন তাঁদের ।
তাঁদের বক্তব্য,
বাক-স্বাধীনতার সীমা থাকতে হবে,
বাক-স্বাধীনতার নামে মুসলমানদের ধর্মীয়
বিশ্বাসে আঘাত করা যাবে না । তাঁরা বলেন যে, বাক-স্বাধীনতার নামে ইসলামের
সমালোচনা করে প্ররোচনা সৃষ্টি করার কারণে মুসলিম জঙ্গিরা বিভ্রান্ত হয়েই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে থাকে । গত ৭ই
জানুয়ারী প্যারিসে ব্যাঙ্গ পত্রিকা শার্লু হেব্দুর ব্যাঙ্গশিল্পীদের হত্যার দায় পত্রিকাটির কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে তাঁরা
বলছেন যে মুহাম্মদের ব্যঙ্গচিত্র আঁকাটা মত প্রকাশের স্বাধীনতার
অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না, ওটা মারাত্মক অপরাধ যা মুসলমানদের
সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে
। তাই পত্রিকাটি মুহাম্মদকে ব্যাঙ্গ করে যে প্ররোচনা সৃষ্টি
করেছিলো তারই পরিণামে আইএস জঙ্গিরা ঐ কার্টুনিস্টদের হত্যা করেছে ।
এই কলমচিরা ইসলামি সন্ত্রাসের জন্যে মার্কিন
সাম্রাজ্যবাদ ও পশ্চিমি দেশগুলিকে বলির পাঁঠা হিসেবে ব্যবহার করতে সিদ্ধহস্ত । আর এ কাজে অতি বিশ্বস্ততার সঙ্গে তাঁদের দোসর ও দোহারের ভূমিকা পালন করে থাকে সকল রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বামপন্থী দলগুলি ।
পুঁজিবাদের সংকট দেখিয়ে এরা সর্বদা কোরাস গায় যে বিশ্বজুড়ে ইসলামি সন্ত্রাসের জন্মদাতা হলো পশ্চিমি দেশগুলি, বিশেষ করে আমেরিকা । তারা নাকি তাদের সংকট লাঘব করার জন্যে ইসলামি
সন্ত্রাসবাদীদের সৃষ্টি করেছে । বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নাকি তার
যুদ্ধশিল্প টিকিয়ে রাখতে এ সব করছে ।
তারাই নাকি মধ্যপ্রাচ্যে আল-কায়দা ও
তালিবানকে সৃষ্টি করেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি
। বিশ্বের নানা প্রান্তে যে সব ইসলামি
সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে সেগুলো তাঁদের মতে মুসলমানদের মুক্তি সংগ্রাম । তাঁদের
অভিযোগ হলো সেই মুক্তি সংগ্রামকেই
সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে ইজরায়েল
ও পশ্চিমি দেশগুলো ।
পশ্চিমি দেশগুলো নাকি রুশদি, তসলিমা, আলি সিনা, এম.এ খান, আনোয়ার
হেকমত, ইবন ওয়ারাক প্রমুখ বিশ্বের নাম করা
যুক্তিবাদি লেখক এবং ফরাসি ও ডেনিস কার্টুনিস্টদের
পেছনে ঢালাও টাকা খরচ করছে সেই অপপ্রচারকে বিশ্বের বুকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে ।
মুসলিম কলমচিদের সুবিধা হলো এই যে তাঁরা যা বলেন
তা বলেই খালাস, কোনো বাখ্যা বা অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ দেওয়ার দায় নেন না । পশ্চিমি দেশগুলি কেবল মুসলিমদেরই সন্ত্রাসবাদী বানাতে পারে, অন্যদের কেনো পারে
না ? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায় নেই তাঁদের । মুহাম্মদ এবং তাঁর শিষ্য খলিফাগণ তরবারি দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে,
লক্ষ লক্ষ নরনারীকে ক্রীতদাস বানিয়ে
অর্ধেক বিশ্বকে পদানত করে যে বিভীষিকা সৃষ্টি করেছিলো তার পেছনে কোন
সাম্রাজ্যবাদের হাত ছিলো ? উত্তর পাওয়া যায় না । লিবিয়া, ইরাক, সিরিয়া, নাইজিরিয়া,
মিশর, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া প্রভৃতি মুসলিম
দেশগুলিতে ইসলামি সন্ত্রাসবাদীরা হাজার
হাজার নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করছে দিনের পর
দিন - এগুলো মুসলিমদের কোন মুক্তি সংগ্রাম
? কার বিরুদ্ধে এই মুক্তি সংগ্রাম ? এই কলমচিরা বলেন, আমরাও বাক-স্বাধীনতার পক্ষে, কিন্তু মুসলমানদের
ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দেওয়ার বিপক্ষে । সে আবার কেমন বাক-স্বাধীনতা ? কলমচিদের কথা মানলে তো বিজ্ঞানের পরিক্ষীত সত্যগুলো বলা যাবে না । যেমন – সূর্যের চারিদিকে পৃথিবি ঘোরে, পৃথিবীর আহ্নিক গতির জন্যে
দিন-রাত্রি হয়, পৃথিবীর বার্ষিক গতির জন্যে ঋতু পরিবর্তন হয়, পৃথিবী ও চন্দ্র
ঘুরতে ঘুরতে সূর্যের সঙ্গে এক সরল রেখায় আসে বলে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ হয়,
সূর্য ও চন্দ্রের আকর্ষণে জোয়ার-ভাটা হয়, প্রাকৃতিক নিয়মেই ঝড়-বৃষ্টি হয়, ভিটামিনের অভাব ও জীবাণুর কারণে
অসুখ-বিসুখ হয় । এই সত্যি ঘটনাগুলো তো বলা যাবে না, কারণ এগুলো বললে মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসে
আঘাত লাগবে । পৃথিবীর গতি আছে এ কথা বলার জন্যে তো ব্রুনোকে ক্যাথলিক যাজকরা
পুড়িয়ে হত্যা করেছিলো । ৪/৫ বছর আগে সৌদি আরবের গ্রাণ্ড মুফতি ফতোয়া দিয়েছেন যে
পৃথিবী গোলাকার যে বলবে তাকে শরিয়তি আইনে শাস্তি দেওয়া হবে । এবার দয়া করে একতা লিস্ট বানিয়ে দিন মুসলিম কলমচিরা,
আমরা কোনটা বলতে পারবো, কোনটা পারবো না । এটা বলা যাবে না, ওটা বলা যাবে না – এ সব শর্ত আরোপ করলে বাক-স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের
স্বাধীনতার কিছু থাকে না কি ? মুসলমানরা ছাড়া আর কোনো ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষ তো ধর্মের সমালোচনা করলে আজকাল রুষ্ট
হয় না । আমার বিশ্বাস, আমার ভাবনা, আমার
কথা আমি প্রকাশ করতে পারবো না
? তা হলে বাক-স্বাধীনতার কি থাকে ? বাক স্বাধিনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা হতে হবে
চূড়ান্ত, অবাধ । আমার উপর কেউ কারো ধর্ম বিশ্বাস জোর করে চাপিয়ে দিতে পারবে না এবং
আমিও আমার নাস্তিকতা কারো উপর চাপিয়ে দিবো
না – এটা হতে হবে বাক স্বাধিনতা ও মত প্রকাশের স্বাধিনতার নীতি ।
আবার ফিরে
আসি অভিজিৎ হত্যা প্রসঙ্গে । অভিজিত হত্যায় মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের একাংশ একটু বেশী বিব্রত বলে মনে হচ্ছে । কারণ, অভিজিত ছিলেন হিন্দু পরিবারের সন্তান এবং তিনি কোনো পশ্চিমি দেশের নাগরিক ঞ্ছিলেন না । মুসলিম পরিবারের
লোক হলে তাকে বিধর্মীদের চর বলে সহজেই দেগে
দেওয়া যায় এবং তাতে মুসলিমদের সন্তুষ্ট
করাও যায় আবার তার জন্যে বিধর্মীরাও
অসন্তুষ্ট হয় না । আর কোনো পশ্চিমি বিধর্মী হলে তো ইসলামবিদ্বেষী বলে দিলেই কেল্লা ফতে । কিন্তু ভারত ও
বাংলাদেশের মাটিতে অভিজিতের বিরুদ্ধে এই সস্তা বস্তাপচা অভিযোগ উত্থাপন করা একটু
অসুবিধা বৈকি । করলে মুসলমানদের কাছে জনপ্রিয়তা বাড়ে ঠিকই, কিন্তু
প্রতিবেশী হিন্দুদের কাছে
প্রগতিশীলতার অপ্রিয় হওয়ার ঝুঁকি থাকে ।
তাই অভিজিত হত্যাকাণ্ডে নতুন
তত্ত্ব আমদানি করতে হলো । তাঁরা বলছেন যে শার্লু হেব্দুর ব্যাঙ্গচিত্র শিল্পীদের হত্যা ও
অভিজিতকে হত্যা এক জিনিষ নয় । আর অভিজিতকে
হত্যার ঘটনাকে মুক্তচিন্তার উপর আঘাত বলা যায় না । অভিজিত তো শার্লু এব্দু
পত্রিকার মতো ইসলাম ও আল্লহর নবীকে ব্যাঙ্গ করেন নি । আর অভিজিত ধর্ম নিয়ে যা লিখেছেন তা বিতর্কিত
বটে, কিন্তু তিনি নবীকে নিয়ে হাসিমস্করা
করেন নি । সুতরাং তাঁকে হত্যা করা
নিন্দনীয় এবং তা ইসলামবিরোধী কাজ । এই তত্ত্বে হিন্দু সমাজের কাছে প্রগতিশীলতার লেবাশটাও থাকলো আবার ইসলামের জয়গান গেয়ে মুসলমানদের কাছে
প্রিয় থেকে যাওয়াও গেলো । বাঃ! কি চমৎকার দ্বিচারিতা ! বহুচারিতা ! এঁরা কাকের
কোকিল সাজার গল্পকেও হার মানায় ।
অভিজিতের
লেখা নিয়ে উল্লেখিত কলমচিরা যে
কথাগুলি বলছেন তা মোটেই সত্যি নয় । হয়
তাঁরা মিথ্যাচার করছেন, না হয় অভিজিতের লেখা সম্পর্কে অবহিত না হয়েই
নিজের হাস্যকর মতের পক্ষে প্রমাণ না পেয়ে মনগড়া কথা বলছেন । একজন যুক্তিবাদী লেখক যতই
প্রাজ্ঞ ও বিদগ্ধ হোন, তিনি ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে শব্দ চয়নে যতই মার্জিত ও
পরিশীলিত থাকার চেষ্টা করুন না কেন, এবং তিনি
যত নম্রভাবেই ইসলামের সমালোচনা
করুন না কেন, তাঁর লেখাগুলি ইমুসলিমদের কাছে সলাম ও নবির অবমাননা ও ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত বলে মনে হবেই । আর তা ছাড়া অভিজিত তাঁর লেখায় নবিকে কোথাও একদম ব্যঙ্গ করেন নি এ কথা মোটেই ঠিক নয় । করেছেন তো কী হলো ? সবাইকে
ব্যঙ্গ করা যাবে, কিন্তু নবিকে ব্যঙ্গ করা
যাবে না - এটা কোন যুক্তি ? বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কিংবা প্রতিষ্ঠানের কাজের বা মতের প্রতিবাদ করার নানা পন্থা ও
নানা কৌশলের মধ্যে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা তো
একটা অন্যতম স্বীকৃত পন্থা বা কৌশল । অভিজিতের লেখায় সে রকম কিছু
থাকলে তা অপরাধ হতে যাবে কেন
? এবার অভিজিতের লেখা থেকে কিছু উদ্ধৃত করা যাক যা মুসলিম কলমচিরা কত মিথ্যাচারের মুখোশ খুলে
দেবে । ‘মহাবিশ্ব এবং ঈশ্বর – একটি দার্শনিক আলোচনা’ নিবন্ধে অভিজিত আল্লাহ
তথা ঈশ্বরকে ‘বড় বাবু’ বলে ব্যঙ্গ করে লিখেছেন – “মহাবিশ্বের কোন নিয়ন্ত্রক কোন ‘ঈশ্বর’ নামক কোন ‘বড় বাবু’
নন, বরং পদার্থ বিজ্ঞানের কিছু সহজ সূত্রাবলী [Laws of Physics]।” আল্লাহর বৃষ্টিতত্ত্ব খণ্ডন করতে গিয়ে
মুহাম্মদ গোঁজামিল দিয়েছেন বলে অভিজিত তাঁকে তীব্র কটাক্ষ করে লিখেছেন
– “স্কুলের ছোট ছেলেটিও জানে মিকাইল ফেরেস্তা বা ইন্দ্রের হাতের কারসাজিতে
নয়, বৃষ্টি হয় পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম মেনে ।
... এটা অনেকটা প্রাচীনকালে বৃষ্টি কিভাবে হয় তা বুঝতে না পেরে এর পেছনে ‘মেকাইল ফেরেস্তাকে’
কল্পনা করে গোঁজামিল গুঁজে দেওয়ার মত ব্যাপার ।” আল্লাহকে যে অস্বীকার করবে তাকে হত্যা
করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে । সেই আল্লাহ তথা ঈস্বরকে অগ্রাহ্য ও অবজ্ঞা করেছেন তিনি লিখেছেন – “অজ্ঞতার অপর নামই হল ঈশ্বর ।” অভিজিত একজন
বিজ্ঞানীকে উদ্ধৃত করেছেন যেখানে আল্লাহকে সরাসরি মূর্খ বলে হেয় করা হয়েছে – “... তেমন একটা বিশ্বকে মূর্খের সৃষ্ট বলে ধরে
নেওয়া যেতে পারে ।” আর দৃষ্টান্ত বাড়িয়ে লাভ নেই, এই কয়টি দৃষ্টান্তই যথেষ্ট এটা
বুঝতে যে অভিজিত সম্পর্কে মুসলিম
কলমচিরা যা বলছেন তা এক মস্তবড়ো গোঁজামিল বই
নয় ।
ধরা যাক, অভিজিত ইসলাম
ও নবিকে ব্যঙ্গ করেন নি, তা হলেই কি মুসলিম কলমচিদের ম্বাখ্যা অনুযায়ী তাঁকে হত্যা
করা অনৈসলামিক হয় ? মোটেই নয় । ইসলামি আইনে অভিজিত যেহেতু হিন্দু পরিবারের সন্তান
সেই কারণেই তাঁর বাঁচার অধিকার নেই এই
পৃথিবীতে, বিশেষ করে কোনো একটি মুসলিম দেশে, কারণ তিনি বিধর্মী । কোরান বলছে – “হে রব! পৃথিবীতে কোনো কাফেরকে
রাখবেন না । রাখলে আপনার বান্দাকে বিভ্রান্ত করবে ।” [৭১/২৬-২৭] কোরান তো মিথ্যে
বলে নি, কারণ যুক্তিবাদীরা তো সব সময় আল্লাহার বান্দাদের বিভ্রান্ত [!] করেই । কোরানের
এই নির্দেশ পালন করছে বিশ্বজুড়ে ইসলামি সন্ত্রাসবাদীরা । বাংলাদেশেও । সেখানে প্রতিনিয়ত হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃস্টান নিধন
চলে ।
১৯৫১ সালে বাংলাদেশে [তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে] হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ২২%,
২০১১ সালে সেটা কমে হয়েছে ৮% । বাংলাদেশে বিধর্মীদের কত যে হত্যা করা হয়েছে ও
হচ্ছে , কত নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে ও হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই । ফলে দলে দলে তারা এ দেশে
চলে এসেছে । বিধর্মীদের উপর এই অত্যাচারও কি পশ্চিমি দেশগুলোর
চক্রান্ত ? সাধারণ হিন্দুদের যেখানে ঠাঁই নেই সেখানে অভিজিতের যে
ঠাঁই হওয়া সম্ভব ? তিনি যে ছিলেন ঈশ্বর ও ঈশ্বরের ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধের একজন
সেনাপতি । অভিজিতদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা,
তাঁদেরকে হত্যা করার স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে ইসলামে । কোরানে বলছে – “যারা
আল্লাহ ও তার নবির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদেরকে হত্যা করা হবে বা শুলিতে দেওয়া হবে
।” [৫/৩৩] “যারা ধর্মদ্রোহী তাদের গলদেশে আঘাত করো, তাদের আঙুলের গিটে গিটে আঘাত
করো । এটা এজন্যে যে তারা আল্লাহ ও নবির বিরোধী । [৮/১২,১৩] “হে নবি ! কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো, ওদের বিরুদ্ধে কঠোর হও ।” [৯/৭৩] এ রকম অসংখ্য বাণী/নির্দেশ আছে কোরান ও হাদিসে
যার শিকার হয়েছেন অভিজিত । যে কলমচিরা বলছেন অভিজিতকে হত্যা করা ইসলামবিরোধী কাজ
তাঁরা মিথ্যাচার করছেন ।
পরিশেষে বলতে চাই যে
অভিজিত নিহিত হওয়ায় আমরা বেদনাহত, কিন্তু হতাশ নই । এর আগে অনেক অভিজিতকে ধর্মীয়
সন্ত্রাসবাদীরা হত্যা করেছে কিন্তু তাতে মুক্তচিন্তা থেমে যায় নি, থেমে যায় নি
মুক্তবুদ্ধি ও বাক-স্বাধীনতার আন্দোলন । ভবিষ্যতেও আমাদের অনেক অভিজিতকে হারাতে
হবে, কিন্তু মুক্তচিন্তার আন্দোলন কোনোদিনই স্তব্ধ হবে না । কারণ, একজন বিজ্ঞানীকে
হত্যা করা যায়, কিন্তু বিজ্ঞানসাধনাকে স্তব্ধ করা যায় না । একজন লেখককে হত্যা করা
যায় কিন্তু কলমকে স্তব্ধ করা যায় না । একজন গায়ককে হত্যা করা যায় কিন্তু সঙ্গীতকে
স্তব্ধ করা য্য না । একজন শিল্পীকে হত্যা করা যায় কিন্তু শিল্পির তুলি ও
ক্যানভাসকে স্তব্ধ করা যায় না । একজন দার্শনিককে হত্যা করা যায় কিন্তু দর্শনকে
হত্যা করা যায় না ।
সব শেষে যে প্রশ্নটা
আমাকে ক্ষত-বিক্ষত করে তা নিবেদন করতে
চাই, বর্বর ইসলামি শক্তির বিরুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ বাঙালি প্রাণ দিয়ে দেশটাকে স্বাধীন
করেছিল । সেই আত্মবলিদান কি ব্যর্থ হয়ে
যাবে ? আর কতকাল ঐ বর্বর ইসলামি শক্তির হাতে
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উত্তরাধিকার যারা বহন করছে তারা প্রাণ দেবে ?
No comments:
Post a Comment