মুর্শিদাবাদ জেলায়
লোসভার তিনটি কেন্দ্র, তিনটিই কংগ্রেসের দখলে । এবার এই তিনটি
কেন্দ্রের মধ্যে একমাত্র বহরমপুর কেন্দ্রটিতে কংগ্রেসের জেতা শুধু সময়ের অপেক্ষা
বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা । এই কেন্দ্রটি থেকে গত লোকসভা নির্বাচনে বহু
ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন কংগ্রেসের বর্তমান রাজ্য-সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সরকারের
রেল দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরি । তৃণমূল
কংগ্রেস এই কেন্দ্রের অধীন রেজিনগর বিধান সভা কেন্দ্রের কংগ্রেসের বিধায়ককে ভাঙিয়ে নিয়ে
গিয়েও অধীরের দূর্গে যে বিশেষ ফাটল ধরাতে পারে নি তার প্রমাণ ইতিমধ্যেই দু দুবার
হয়ে গেছে । রেজিনগর বিধানসভা কেন্দ্রের
উপনির্বাচনে এবং গতবছর পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস পরাস্ত হয়েছে অধীরের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের কাছে
। জাতীয় কংগ্রেস এই দুটো নির্বাচনে তৃণমূল
কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট উভয় শক্তিকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছে । একজন বিধায়ককে ভাঙাতে পারলেও তৃণমূল কংগ্রেস পারেনি
বড়ো কোনো ধ্বস নামাতে জাতীয় কংগ্রেসের শিবিরে । তৃণমূল কংগ্রেস অবশ্য রেজিনগরে
অনেকটাই বামফ্রন্টের ঘর ভাঙতে সক্ষম হয়েছে । সুতরাং অধীরই যে পুনরায় এবার লোকসভার
ভোটে জিতবেন এমন কথা প্রায় সর্বস্তরে শোনা
যাচ্ছে ।
বাকি দুটি লোকসভার
আসনে – মুর্শিদাবাদ ও জঙ্গীপুর - এবার
কংগ্রেসের পক্ষে পুনরায় জয়লাভ করা খুবই শক্ত হবে । মুর্শিদাবাদ লোকসভা আসনে
কংগ্রেস অপেক্ষা ফ্রন্ট অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থানে রয়েছে বলে অনেকেরই ধারণা । এ ধারণাটি মানুষের মধ্যে তৈরী হয়েছে তার কারণ
হলো, মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রের অধীন
নদিয়া জেলার করিমপুর বিধানসভা আসনে কংগ্রেসের অবস্থা অতিশোয় শোচনীয়, সেখানে লড়াই
হবে ফ্রন্টের সঙ্গে তৃণমূলের । বাকি ৬টি বিধানসভার
আসনে লড়াই ফ্রন্ট ও কংগ্রেসের মধ্যে । করিমপুরে যে বড়ো ব্যবধানে কগ্রেস পিছিয়ে
পড়বে তা মেক আপ করে জেতা কংগ্রেসের পক্ষে ভীষণ কঠিন হবে বলে মনে হয় ।
এবার বোধহয় সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক লড়াইয়ের
সাক্ষী হতে যাচ্ছে জঙ্গীপুর লোকসভা
কেন্দ্রের মানুষ । গত লোকসভা ভোটে এই কেন্দ্র থেকে বড়ো ব্যবধানে (লক্ষাধিক )
কংগ্রেসের টিকিটে জয়লাভ করেছিলেন প্রণব
মুখার্জী যিনি এখন ভারতের রাষ্ট্রপতি । তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ায় তাঁকে লোকসভার সদস্য পদ
থেকে ইস্তফা দিতে হয়, এবং সে জন্যে ২০১২ সালে জঙ্গীপুর লোকসভা কেন্দ্রে
উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় । সেই উপ-নির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী করেছিল প্রণব
মুখার্জী তথা রাষ্ট্রপতির পুত্র অভিজিত মুখার্জীকে । তাঁর বিরুদ্ধে সিপিএম
প্রার্থী করেছিলো যাঁকে ( মুজাফফর হোসেন ) তিনি ছিলেন একেবারে নতুন লোক । তা নিয়ে
একটা প্রচার ছিলো তখন যে, সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্ব প্রণব বাবুর সঙ্গে একটা
বোঝাপাড়ার ভিত্তিতে (এই প্রচার এখনও শোনা যায় )
একজন অখ্যাত ব্যক্তিকে প্রার্থী করেছে প্রণব বাবুকে সিটটা উপহার দেওয়ার
জন্যে । এই প্রচারটাকে আরো খানিকটা
বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছিলো একটা জিনিষ, তা হলো, সিপিএম সেই উপনির্বাচনে প্রচারে
কোনো রাজ্যস্তরের নেতাকে পাঠায় নি । এই প্রচারের সত্যি কোনো ভিত্তি আছে, নাকি
শুধুই অপপ্রচার তা নিশ্চয় করে বলা প্রায়
অসম্ভব । সেই উপনির্বাচনের ফলাফল কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়েছিলো, প্রণব পুত্র অভিজিত
জয়লাভ করেছিলেন বহু কষ্টে, মাত্র ২৫৩৬ ভোটের ব্যবধানে । অভিজিত পেয়েছিলেন ৩৬৭৩৭২ টি ভোট আর মুজাফফার পেয়েছিলেন ৩৩০৩৮৩ টি
ভোট । কং ও বামফ্রন্ট ভোটের ব্যবধান ছিলো
শতাংশের নিরিখে যৎসামান্য । কংগ্রেস ভোট পেয়েছিলো ৩৯.০১% এবং বামফ্রন্ট পেয়েছিলো ৩৮.৭১%, ব্যবধান এক
শতাংশেরও কম, মাত্র ০.৩০% । এত সামান্য
ব্যবধানে হারা সিপিএম নেতা-কর্মীদের মধ্যে যতটা হতাশা তৈরী হয়েছিলো তার চেয়ে বেশী
তাঁদের মনে আশার সঞ্চার করেছিলো । সেই ফলাফলে জঙ্গীপুর সিটটা যে কংগ্রসের হাত থেকে
পুনরুদ্ধার করা সম্ভব সে বিশ্বাস দলের মধ্যে তৈরী হতে সাহায্য করেছে । তাই জয়ের লক্ষ্য নিয়েই এবার সিপিএম নির্বাচনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে, যা কংগ্রেসকে ভীষণ শক্ত প্রতিদ্বন্দিতার মুখে দাঁড় করিয়ে
দিয়েছে ।
এবারের নির্বাচনে সার্বিকভাবে কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট উভয়েই প্রতিকূল অবস্থায়
রয়েছে । কেন্দ্রে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের
সীমা-পরিসীমা নেই । অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও পাহাড় প্রমাণ কয়েকটি বিশাল
দুর্নীতির জেরে জাতীয় স্তরে কংগ্রেসের
অবস্থা খুবই শোচনীয় । অপরদিকে সাড়ে তিন দশক পর এই প্রথম লোকসভা নির্বাচন করতে
হচ্ছে বামফ্রন্টকে ক্ষমতার বাইরে থেকে এবং ক্ষমতা হাত ছাড়া হওয়ার পর বামফ্রন্টে,
বিশেষ করে সিপিএম দলে যে ভাঙন শুরু হয়েছিলো তা এখনও সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয় নি ।
কোনো দলই তাই জাতীয় বা রাজ্য পরিস্থিতির কারণে
কোনো সুবিধা পাচ্ছে না, বরং তাদের অসুবিধারই মুখোমুখি হতে হচ্ছে । জঙ্গীপুর কেন্দ্রে একটা ছবি খুবই স্পষ্ট তা
হলো, কংগ্রেস বা বামফ্রন্ট কেউই সরাসরি জিততে পারবে না, কারণ তাদের পক্ষে জনসমর্থন
৪০% -এরও কম । আর যেহেতু খুবই মার্জিনাল তাই
এবারে কে জিতবে – কংগ্রেস না সিপিএম - তা শুধু তাদের দলের প্রভাব ও সাংগঠনিক
শক্তির উপরেই নির্ভর করবে না । ভোটের ফলাফলকে প্রভাবিত করবে আরো অনেকগুলি ফ্যাক্টর
যা অতিশয় জটিল । বিজেপি উপ-নির্বাচনে পেয়েছিলো ৮৫৮৬৭ (১০.০৬%) টি ভোট, এবার কতটা
ভোট পাবে, তাদের ভোট কি বাড়বে না কমবে ? বিজেপির
ভোট বাড়া-কমা ফলাফলকে প্রভাবিত করবে । অনুরূপ একটি ফ্যাক্টর হলো WPI ও SDPI – এর
দুজন প্রার্থীদের তাঁদের ভোট বাড়বে না কমবে ?
ওঁদের মিলিত ভোট ছিলো ৬৬৩৬১টি যা মোট ভোটের ০৭.৭৭% । তাদের ভোট বাড়া-কমাটাও
একটা ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে এই কেন্দ্রে ফলাফলের উপর । আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হচ্ছে শাসক দল তৃণমূল
কংগ্রেস । গত উপ নির্বাচনে ওরা প্রার্থী দেয় নি কংগ্রেসের প্রার্থীর জয় ত্বরাণ্বিত
করার জন্যে, এবার প্রার্থী দিয়েছে । তৃণমূল কংগ্রেস ও কংগ্রেস গত বছর(২০১৩) পঞ্চায়েত নির্বাচনে
পৃথকভাবে লড়াই করে এবং তৃণমূল কংগ্রেস
জঙ্গীপুর লোকসভা কেন্দ্রের অধীন জেলা পরিষদের আসনগুলিতে মোট ভোট পায় ১৭৩০৭৫ টি যা
মোট ভোটের ১৭.৬৯% । এবার তৃণমূল কংগ্রেস কি
আরো বেশী ভোট পাবে, না কি তারা তাদের ভোট কমবে – এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন
এবারে কংগ্রেস ও বামফ্রন্টকে ভাবাচ্ছে । তৃণমূল কংগ্রেস তো মুর্শিদাবাদে উদীয়মান শক্তি,
তাই মনে হতে পারে যে তারা গত পঞ্চায়েতের প্রাপ্ত
ভোট কি ধরে রাখতে পারবে কি না এ প্রশ্ন অবান্তর । কিন্তু তবুও প্রশ্নটা
উঠেছে এবং ওঠার ভিত্তিও আছে । সে প্রশ্নে পরে আসছি । আর একটা বিষয় অনেকেই ভাবছেন
যে জাত-পাতের মানসিকতাও এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে । বামফ্রন্ট ও তৃণমূলের প্রার্থী দু’জনেই মুসলিম, এসিউসির প্রার্থীও মুসলিম,
তারপর রয়েছে মুসলিম সমাজে একাংশের দ্বারা জাত-পাত ভিত্তিক গড়ে ওঠা
দুটি সাম্প্রদায়িক দল WPI ও SDPI – এর দুজন প্রার্থী । ফলে এমন
আশঙ্কা কোনো মহল করছে যে মুসলিম ভোট বহুধা বিভক্ত হওয়য়ার সম্ভাবনা আছে । অপরদিকে
কংগ্রেসের প্রার্থী হিন্দু বলে বিজেপি, বামফ্রন্ট ও তৃণমূলের বহু হিন্দু ভোট
কংগ্রেসের পক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে । এমনটা হতে পারে বলে একটা চাপা আলোচনা সর্বত্রই
শোনা যাচ্ছে এবং তারফলে এবার জঙ্গীপুর কেন্দ্রটি আবারও কংগ্রেসের ঝুলিতে যেতে পারে
বলে মনে করছেন অনেকেই । এমনটা শোনা যাচ্ছে যে কংগ্রেস তাদের প্রচারে হিন্দুদের
মধ্যে সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি দিচ্ছে, বলছে, যদি অভিজিত মুখার্জী ফেল করে তবে
চিরদিনের জন্যে জঙ্গীপুর কেন্দ্রটি মুসলমানদের হাতে চলে যাবে, তাই হিন্দুদের উচিত
অভিজিত মুখার্জীকে ভোট দিয়ে জেতানো । সিপিএমের একাধিক নেতার মুখে শুনেছি তাঁরা নাকি
কিন্তু কংগ্রেসের এই ধরণের প্রচারে রীতিমত ভয় পাচ্ছে ।
শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস দাবী করছে
যে তাদের সঙ্গে লড়াই হবে বামফ্রন্টের । এ দাবীর কোনো ভিত্তি নেই । আগেই বলেছি লড়াই
হবে কংগ্রেস ও বামফন্টের মধ্যে । তৃণমূল
কংগ্রেস থাকবে তৃতীয় স্থানে, এবং তারা লড়াইয়ের জায়গায় নেই । । ফলে এখানে কার্যতঃ ত্রিমুখী নয়, লড়াই হবে দ্বিমুখী । তবে তৃণমূল কংগ্রেস এখানে জয়-পরাজয় নির্ধারণের
ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর
অবশ্যই । তৃণমূল কংগ্রেসের উপস্থিতি এখানে
সাহায্য করবে খানিকটা বামফ্রন্টকেই । অবশ্য তৃণমূল কংগ্রেস যা ভোট কাটবে তা মূলতঃ
কংগ্রেসের এবং তাই সিপিএম ড্যাং ড্যাং করে বেরিয়ে যাবে এমনটা হবে না ।
গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফল সে কথা বলছে না । গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে জঙ্গীপুর লোকসভা
কেন্দ্রের অধীনস্থ জেলা পরিষদের আসনগুলিতে
তৃণমূল কংগ্রেস যদিও ১৭.৬৯% ভোট পেয়েছিল,
তবুও কংগ্রেস দল কি ভোটের অঙ্কে,
কি সিটের অঙ্কে, সব দিক থেকেই বামফ্রন্টের চেয়ে এগিয়েছিলো । জেলা পরিষদের মোট ২২টি
আসনের মধ্যে কংগ্রেস জয় পায় ১২টি আসনে, ফ্রন্ট পায় ৯টি আর তৃণমূল পায় মাত্র একটি আসনে । বামফ্রন্টের চেয়ে কংগ্রেস ৯৩৫২টি বেশী ভোট পায় । ভোটের শতাংশের হারেও কংগ্রেস এগিয়ে ছিলো
। কংগ্রেস পেয়েছে ৩৭.৫৬% যা লোকসভা উপ-নির্বাচনের চেয়ে মাত্র ১.৪৫% কম, আর ফ্রন্ট
পেয়েছে ৩৬.৬১% যা লোকসভা উপ-নির্বাচনের চেয়ে ২.১% কম । অর্থাৎ চিত্রটি যা বলছে তা
হলো, তৃণমূল তেমন বিশেষ ভাঙন ধরাতে পারে
নি কংগ্রেস ও ফ্রন্টের ভূমিতে । তাহলে
প্রশ্ন, তৃণমূল কংগ্রেস তবে ১৭.৬৯% ভোট কোথা
থেকে পেয়েছিলো ? পঞ্চায়েত নির্বাচনে অধিকাংশ আসনেই বিজেপি এবং WPI
ও SDPI প্রার্থী দিতে পারে নি, তাদের নিজস্ব ভোটাররা তাই ভোট দিয়েছিলো তৃণমূল
কংগ্রেসের প্রার্থীদের । দেখা যাচ্ছে সর্ব সাকুল্যে বিজেপি পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট
পেয়েছিল মাত্র ০২.৪২% এবং WPI ও SDPI পেয়েছিলো সম্মিলিতভাবে ০.৫৩% । তাদের ভোট
কমেছিলো যথাক্রমে ০৭.৬৪% ও ০৭.২৪% । অর্থাৎ তৃণমূল কংগ্রেস যে ১৭.৬৯% ভোট পেয়েছিলো
তার মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন দলগুলির ভোট ছিলো ১৪.৮৮%, আর কংগ্রেস ও
বামফ্রন্টের ভোট ছিলো সর্বাধিক ২.৮১% । তাই তো প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তৃণমূল কংগ্রেস কি পঞ্চায়েতের প্রাপ্ত ভোট ধরে
রাখতে পারবে ? এবার তো সাম্প্রদায়িক
মনোভাবাপন্ন ভোটাররা তো তাদের নিজেদের প্রার্থীদেরই ভোট দেবে ।
এতদসত্ত্বেও ভোটের ময়দানে তৃণমূল কংগ্রেসের উপস্থিতি খানিকটা হলেও এই
কেন্দ্রে সিপিএমকে কিছুটা সুবিধা করে দেবে
। কারণ পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর তৃণমূল কংগ্রেস কিছুটা হলেও কংগ্রেসের ঘর ভাঙতে
সমর্থ হয়েছে । এই লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সুতী বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়ক ইমানি
বিশ্বাস তার দলবল নিয়ে ইতিমধ্যেই তৃণমূল কংগ্রেস দলে যোগদান করেছে এবং এখনও কংগ্রেস শিবিরে ভাঙনের সেই ধারা
অল্পবিস্তর হলেও অব্যাহত আছে বলে শোনা যাচ্ছে । তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা ভালোভাবেই
জানে যে এই কেন্দ্রে লড়াই হবে কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের মধ্যে, তবু তারা সর্বোচ্চ
শক্তি নিয়োগ করবে তাদের নিজেদের ভোট বাড়াতে এবং সে ক্ষেত্রে তাদের প্রধান লক্ষ্য
হলো কংগ্রেস যেন কিছুতেই জিতিতে না পারে ।
তৃণমূল কংগ্রেসের এ রকম ভাবনার পশ্চাতে যে
কারণগুলি আছে তার মধ্যে প্রধান করণটি হলো মুর্শিদাবাদে কংগ্রেস তথা অধীরের দূর্গে
ফাটল সৃষ্টি করা যাতে আগামী ২০১৬ সালের
বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসকে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের বিকল্প শক্তি হিসেবে
তুলে ধরা যায় ।
বিজেপির ভাবনাও তৃণমূল কংগ্রেসের মতোই, তারাও চায় যেন কংগ্রেস কিছুতেই
জিতিতে না পারে । কারণ, জাতীয় স্তরে তাদের প্রধান শত্রু । বিজেপি জানে কংগ্রেস যে ধরণের প্রচার করছে তার
ফলে তাদের ভোট ব্যাঙ্ক অক্ষত রাখা কঠিন । শোনা যাচ্ছে যে বিজেপির ভোটারদের কাছে
গিয়ে কংগ্রেস বলছে, ‘তোমরা বিধানসভার ভোটে তোমাদের দলকে ভোট দিও, কিন্তু এবার যাতে
একজন হিন্দুকে জেতানো যায় তারজন্যে অভিজিত মুখার্জীকে ভোটটা দাও, কারণ বিজেপি তো
জিততে পারবে না । এ ধরণের প্রচার সম্পর্কে
বিজেপিও সচেতন ও সতর্ক আছে বলে শোনা
যাচ্ছে । বিজেপি জানে কংগ্রেসের একটা এম.পি বেশী হওয়া মানে কেন্দ্রে তাদের পক্ষে
ক্ষমতায় আসার পথটা আর একটু কন্টকিত হওয়া, তাই তারা যে কোনোভাবেই হোক একদিকে তাদেরে
ভোট ধরে রাখতে চায়বে অপরদিকে কংগ্রেসের শিবিরকে আঘাত করতে মরিয়া প্রয়াস চালাবে ।
ফলে সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি দিয়ে বাড়তি হিন্দু ভোট ঝুলিতে টানা কংগ্রেসের পক্ষে খুবই
কঠিন হবে ।
আসরে রয়েছে এবারো WPI ও SDPI । এই দুটি দল সম্মিমিলিতভাবে ভোট পেয়েছিলো এই কেন্দ্রে গত উপ-নির্বাচনে ৬৬৩৬১
টি যা মোট প্রদত্ত ভোটের ০৭.৭৭% । মুর্শিদাবাদ জেলা মুসলিম অধ্যুষিত জেলা কিন্তু
এই জেলার মুসলমান জনগণ সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন নয় । মুসলিমরা পারিবারিক ও
সামাজিক জীবনে প্রধানতঃ ধর্মীয় আইন-কানুনই মেনে চলে, কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষেত্র তাদের প্রধান বৈশিষ্ট হলো
তারা অসাম্প্রদায়িক । ফলে তাই মুসলিম ভোট ইমাম ও মাওলানা-মুফতিদের কথায় বিশেষ প্রভাবিত হয় না । সে জন্যেই মুসলিম একদা মুসলিম লীগের
প্রভাব থাকলেও তা ধীরে ধীরে প্রায় মুছে গেছে । মুসলিম লীগ উঠে গেলে জামাত-ই-ইসলাম
চেষ্টা করেছিল সংগঠন বাড়াবার, তারাও শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে । জামাতের
লোকেরাই এখন মূলতঃ WPI – এর পতাকায় জড়ো হয়েছে বলে শোনা যায় । এই দুটি দল জাত-পাতের
দোহায় দিয়ে এখন পর্যন্ত মুসলমান সমাজে দাগ কাটতে পেরেছে এমন কথা বলা যাবে না । ফলে
গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে অধিকাংশ গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির আসনে প্রার্থীই
দিতে পারে নি । মুসলিমরা সাধারণতঃ ভাগ হয়ে রাজনৈতিক শিবিরে হয় কংগ্রেস, না হয় বাম
দল, না হয় তৃণমূলের সঙ্গে । তাই তারা
তাদের ভোট বাড়িয়ে কংগ্রেস বা সিপিএমের বিশেষ ক্ষতি করতে পারবে মনে হয় না । আর সে
কারণেই সমস্ত মুসলিম ভোট মুসলিম প্রার্থীদের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে আর কংগ্রেসের
প্রার্থী হিন্দু হওয়ার সুযোগে ড্যাং ড্যাং করে বিপুল ভোতে জিতে যাবে এমনটা হওয়ার
সুযোগ বিশেষ নেই ।
তূলনা মূলকভাবে বরং হিন্দু সমাজে সাম্প্রদায়িক ভাবনা মুসলিমদের থেকে বেশী,
যা থেকে অতি সুপ্ত অবস্থায় । এর ফলে বাম মনোভাবাপন্ন হিন্দু ভোট এবং বিজেপির
হিন্দু ভোট থেকে কিছু ভোট কেটে নেওয়ার চেষ্টা কংগ্রেস দল করছে বলে যা শোনা যাচ্ছে
তা থেকে তারা কিছুটা লাভবান হতেও পারে যা সিপিএম প্রার্থী ও নেতাদের কপালে দুশ্চিন্তার
ভাঁজ কিছুটা ফেলেছে তা তাঁরা অস্বীকার করতে পারছেন না ।
তবে কংগ্রেসের পক্ষে আর একটা
দুশ্চিন্তার কারণ আছে যা সিপিএমের পক্ষে একটু আশার আলো হয়ে দেখা দিয়েছে । এটা হলো জঙ্গীপুর
লোকসভা কেন্দ্রের গত উপ নির্বাচনে(২০১২) এবং গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে(২০১৩) ঐ লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত রঘুনাগঞ্জ বিধানসভা
কেন্দ্রের দুটি গ্রাম পঞ্চায়েতে ( গিরিয়া ও সেকেন্দ্রা ) সিপিএম অধিকাংশ বুথেই কংগ্রেসের
সন্ত্রাসের সামনে ভোট করতে পারে নি । এবার সে পরিস্থিতি নেই । যেহেতু জঙ্গীপুর
লোকসভা কেন্দ্রটি খুবই মার্জিনাল কেন্দ্র তাই এই দুটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় প্রায়
৩০টি বুথে শান্তিপূর্নভাবে ভোট হলে তা এই কেন্দ্রের নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত
করে দিতে পারে যা কংগ্রেসের জয়কে প্রতিহত করে দিতে পারে ।
সামগ্রিকভাবে জঙ্গীপুর লোকসভা কেন্দ্রের অবস্থা এক নজরে এ রকমঃ এখানে
প্রধান দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী হলো কংগ্রেস এবং বামফ্রন্ট যারা শক্তির বিচারে প্রায় একেবারেই
সমান সমান । ২০১২-এর উপ নির্বাচনে বামফ্রন্ট
অপেক্ষা কংগ্রেস বেশী ভোট পেয়েছিলো মাত্র ০.৩%
অর্থাৎ এক শতাংশের চেয়েও কম । আর পঞ্চায়েত ভোটেও ব্যবধান ছিলো কংগ্রেসের পক্ষে যৎসামান্যই, মাত্র ০.৯৫% । দলের শক্তি হ্রাসের প্রশ্নেও অবস্থাটা প্রায়
একই রকম । ২০১২ সালে উপ নির্বাচনের পর গত
পঞ্চায়েত নির্বাচন (২০১৩) কংগ্রেসের শক্তি হ্রাস পেয়েছে যেখানে ১.৪৫%, সেখানে ফ্রন্টের শক্তি হ্রাস পেয়েছে ২.১% । অবশ্য খুব
সম্প্রতি কংগ্রেসের বিধায়ক ইমানি বিশ্বাস (সুতি বিধানসভা) কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে
চলে যাওয়ায় একটা বড়ো ধাক্কা খেয়েছে । অন্যদিকে অন্যদলগুলি, বিশেষ করে হিন্দু ও
মুসলিম সাম্প্রদায়িকদলগুলি আপ্রাণ চেষ্টা
চালাচ্ছে যার যা শক্তি তা ধরে রাখার জন্যে । তাই জঙ্গীপুর লোকসভা কেন্দ্রে এবার কংগ্রেস
ও বামফ্রন্টের মধ্যে লড়াই হচ্ছে একেবারে যাকে বলে হাড্ডাহাড্ডি ঠিক তাই, কে জিতবে
বলা খুব মুশকিল ।
No comments:
Post a Comment