Monday, May 20, 2013

গভীর সঙ্কটে বাংলাদেশ- হেফাজতে ইসলাম কিংবা হেফাজতে বাংলাদেশের মধ্যে যে কোনও একটাকে বাছতে হবে হাসিনাকে


সাংবাদিক সহ সংবাদ মাধ্যমের কর্মীদের মারধর, পুলিশের ওপর আক্রমণ, ঘাতক নির্মূল কমিটির মঞ্চ ভাঙচুর ও কর্মীদের মারধর, গণজাগরণ মঞ্চের ওপর হামলার চেষ্টা এবং একমহিলা জন আওয়ামি লিগের নেতাকে পিটিয়ে হত্যা করার মধ্য দিয়ে ‘হেফাজতে ইসলামের’ তথাকথিত শান্তিপূর্ণ লং মার্চ শেষ হয়েছে গত ৬ই এপ্রিল । সারাদিনে ঢাকার বুকে দাদাগিরি প্রদর্শন শেষে তারা সরকারকে হুমকি দিয়ে গেছে  যে ১৩ দফা দাবী পূরণ না হলে ৭ ই এপ্রিল সারা দেশে হরতাল সহ আগামি ৫ ই মে ঢাকা অবরোধ করবে  । আরও জানিয়ে দিয়ে গেছে আওয়ামি লিগ ও বিএনপিকে  ক্ষমতায় থাকতে হলে বা ক্ষমতায় ফিরতে হলে ঐ ১৩ দফা মানতে হবে । ভাবখানা এমন যে বাংলাদেশে কে ক্ষমতায় থাকবে , কে থাকবে না তা স্থির করার মালিক তারাই, জনগণ নয় । কিন্তু যাঁরা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসী , জামাতি ইসলামকে নিষিদ্ধ করা এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার দাবীতে সংগ্রাম করছে সেই গণজাগরণ মঞ্চ , ঘাতক নির্মুল কমিটি, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম ,  সম্মিলিত সাংস্কৃতিক ঐক্য জোট সহ ২৭ টি সংগঠন হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবী এবং হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচীর ঘোষণাকে প্রত্যাখান করে জানিয়ে দিয়েছে যে তারা কোনও শক্তির কাছে মাথা নত করবে না এবং তাদের দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাদের সংগ্রাম  বন্ধ হবে না 
দুটো  পরষ্পরবিরোধী শক্তি একেবারে মুখোমুখি সম্মুখ সমরে   একদিকে রয়েছে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি, অন্যদিকে স্বাধীনতার শত্রুরা ; একদিকে গণতন্ত্র ও শান্তি-সম্প্রীতির পক্ষের শক্তি , অপরদিকে এর শত্রুরা ; একদিকে সহিষ্ণুতা, উদারতা ও মানবতার পক্ষের শক্তি, অপরদিকে এর বিরোধী শক্তি ; একদিকে মানব সভ্যতার বিকাশের পক্ষের শক্তি, অপরদিকে মানব সভ্যতার শত্রুরা । অন্যভাবে দেখতে গেলে বাংলাদেশ এখন দুটো রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে  । একটা রাস্তা গেছে সোজা মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নলালিত গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের ঠিকানায়, আর একটা রাস্তা গেছে ঠিক এর উল্টো দিকে তালিবানি ইসলামি রাষ্ট্রের ঠিকানায় । এর বাইরে তৃতীয় কোনও রাস্তা দেখা যাচ্ছে না । পরিস্থিতি একাত্তরের যুদ্ধের মত , গোটা দেশ ভাগ হয়ে গেছে দুটো শিবিরে , আর রাস্তাও দুটো । এই যুদ্ধে জিতবে হয় গণতন্ত্র, শান্তি, সম্প্রীতি ও মানবতার শক্তি , না হয় স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবতার শত্রুরা । যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ হয় পৌঁছাবে হয়
বিকাশমান একটা গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ঠিকানায় , না হয় হারিয়ে যাবে মধ্যযুগীয় অন্ধকার ও অসভ্য এক জগতে ।
বাংলাদেশের ভবিতব্য কী ? দেশটা আলোর পথে অগ্রসর হবে , না কি শরিয়তি অন্ধকারের কানাগলিতে পথ হারাবে ? এই প্রশ্ন, উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা এখন সমস্ত শুভবুদ্ধি মানুষের ঘুম কেড়ে নিয়েছে । দেশের ভবিষ্যত কিন্তু সম্পূর্ণ নির্ভর করছে সরকার ও প্রধান শাসক দলের ওপর । বর্তমানে যে দল সরকারে নেতৃত্ব প্রদান করছে তাদের কাছে মানুষের  প্রত্যাশা অনেক । কারণ এই দল তথা আওয়ামি লিগই মুক্তিযুদ্ধ নেতৃত্ব প্রদান করেছে । তাছাড়া এরাই যুদ্ধাপরাধীদের কঠোর শাস্তি প্রদান ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়বার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে । সুতরাং দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ থাকার কথা নয় । কিন্তু নিরুদ্বেগ থাকা যাচ্ছে না ।  এটাই এখন নিষ্ঠুর বাস্তব যে দেশের ভবিষ্যত এখন সম্পূর্ণই অনিশ্চয়তায় ঢাকা । কারণ সরকারের মনোভাব ও ভূমিকা ক্রমশঃ অস্পষ্ট ও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে । কারণ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বিবৃতি দিয়ে ধন্যবাদ জানিয়েছেন হেফাজতে ইসলামের নেতাদের, তারা নাকি  লং মার্চ ও সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করেছে । মন্ত্রী আরও জানিয়েছেন যে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবী সরকার গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবে । কিন্তু হেফাজতে ইসলামের কর্মী-সমর্থকরা কতটা উগ্র ও হিংস্র ভূমিকা নিয়েছিল তা তো বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছেন । শাসক দলেরই একজন নেতাকে তারা পিটিয়ে হত্যা করেছে , শাহরিয়ার কবির এবং মুনতাসির মামুন এর মতো স্বনামধন্য মানবাধিকার কর্মী ও অধ্যাপককে হত্যা জন্যে ঘাতক নির্মুল কমিটির মঞ্চ ভাঙচুর করেছে , হামলা চালিয়েছে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের উপরে তাদের নেতাদের হত্যা করার জন্যে । আক্রমণ ও মারধর করেছে সংবাদ মাধ্যমের কর্মীদের ওপর , নারী হয়ে কেন পুরুষের সমাবেশে এই অভিযোগে পিটিয়েছে একজন নারী সাংবাদিককেও । হেফাজতের উগ্র ও হিংস্র কর্মীদের হাতে আক্রান্ত হয়েছে পুলিশ বাহিনীও ।  এই সব হামলা ও হত্যার ঘটনার জন্যে দুষ্কৃতিদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া কর্তব্য ছিল সরকারের,  কিন্তু তা না করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হেফাজতে ইসলামের নেতাদের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তাদের  ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন ।  
 যে ১৩ দফা দাবীগুলি বিবেচনা করার  আশ্বাস দিয়েছে সরকার তার প্রত্যেকটিই  অগণতান্ত্রিক, বেআইনি ও অসাংবিধানিক । দাবীগুলির কয়েকটি হলো - ১) সংবিধানের মূল নীতিতেআল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা বিশ্বাসকথাটি পুনঃপ্স্থাপন করতে হবে । ২) ইসলাম ধর্মের অবমাননাকারীদের  বিরুদ্ধে মৃত্যদন্ডের বিধান সম্বলিত আইন তৈরী করতে হবে ৩) সাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের নেতা নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসী দিতে হবে  । ৪) শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ বন্ধ করে দিতে হবে , ৫)  প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ বন্ধ করতে হবে ৬)  ইসলাম বিরোধী নারীনীতি ধর্মহীন শিক্ষানীতি  বাতিল  করতে হবে । এই সব কুৎসিত ও কদাকার দাবী কোনো সভ্য সরকার বিবেচনা করার আশ্বাস প্রদান করতে পারে তা অবিশ্বাসযোগ্য । সুতরাং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর এ হেন ন্যক্কারজনক বিবৃতি থেকে এটা স্পষ্ট যে সরকার মুসলিম মৌলবাদীদের তুষ্ট করার নীতি গ্রহণ করেছে ।
সরকারে এই তোষণ নীতি নতুন নয় , তবে এটা আরও বেড়েছে হেফাজতে ইসলাম যখন গণজাগরণ মঞ্চের চট্টগ্রামের সমাবেশ বেআইনীভাবে বাঞ্চাল করার হুমকি দিয়েছিল তখন থেকে । তখন সরকার হেফাজতে ইসলামের কাছে নতি স্বীকার করে এবং গণজাগরণ মঞ্চের পূর্বঘোষিত সমাবেশের কর্মসূচী করার অনুমতি বাতিল করে দেয় । হেফাজতে ইসলাম তারপর যখন ঢাকায় লং মার্চের কর্মসূচীর ঘোষণা দেয়  তখন দূত পাঠিয়ে মাওলানাদের হাত-পা ধরে  লং মার্চের কর্মসূচী থেকে নিরস্ত করার ব্যর্থ প্রয়াস করে । এই পর্যায়ে আলাপ কালে হেফাজতে ইসলাম সরকারকে বলে যে সকল নাস্তিক এবং গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্লগারদের গ্রেপ্তার করে ফাঁসীর সাজা দিতে হবে এবং তারজন্যে প্রয়োজনীয় আইন তৈরী করতে হবে। সরকার ঠিক তারপরেই শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েকজন ব্লগারকে গ্রেপ্তার করে এবং তাঁদের কয়েকজনের ব্লগ বন্ধ করে দেয় । এই ব্লগগুলিই শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা পালন করছিল । ব্লগারদের ধরপাকড় করার অব্যবহিত পরেই স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রী  জানান যে যারা মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত করছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যে একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠন করা হয়েছে । এই সময়  গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষের ব্লগারদের গ্রেপ্তার ও তাদের ব্লগ বন্ধ করা হলেও অমুসলমানদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত করার জন্যে কোনো ধর্মান্ধ মুসলমান ব্লগারকে গ্রেপ্তার করা  বা তাদের কোনো ব্লগ বন্ধ করা হয় নি । বরং এই নিবন্ধ লেখার সময়েও খবর পেলাম যে আরও দুজন সংখ্যালঘু সমাজের যুবককে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে ফেস বুকে মুসলমানদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত করার তথাকথিত অপরাধে ।
গণজাগরণ মঞ্চ বন্ধ করে দেওয়ার জন্যে চাপ দেওয়া, বাছাই করে কিছু ব্লগ বন্ধ করা, বাছাই করে কিছু ব্লগারদের গ্রেপ্তার করা , হেফাজতে ইসলামের  হিংসাপূর্ণ লং মার্চকে শান্তিপূর্ণ আখ্যা দেওয়া, তাদের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক দাবীগুলির প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন ও বিবেচনার আশ্বাস প্রদান –এ সব নেতিবাচক ও নির্লজ্জ নগ্ন পদক্ষেপগুলি বাংলাদেশের বর্তমান সঙ্কটকে আরও ঘনিভূত করে তুলছে এবং দেশটাকে নিয়ে যাচ্ছে এক ভয়ঙ্কর পরিণামের দিকে । শুধু সরকারেরই নয়, এর সাথে সাথে সরকার , শাসক-জোট ও শাসক দলেরও  সঙ্কট আরও গভীর হচ্ছে । সরকারের এই পদক্ষেপগুলি কেউই মেনে নিতে পারছে না । সরকারি এই পদক্ষেপগুলির  বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হচ্ছে সর্বস্তরে । গণজাগরণ মঞ্চ বন্ধ করার অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চের নেতৃবৃন্দ ।  তাঁরা বলেছেন কারও দয়ায় মঞ্চ গড়ে ওঠেনি এবং কারও কথায় এটা বন্ধ হবে না । কিছু ব্লগার বন্ধ ও কতিপয় ব্লগারকে গ্রেপ্তার করার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে মঞ্চের  মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার জানতে চেয়েছেন - যখন জাতীয় মসজিদে ভাঙচুর করে, অগ্নিসংযোগ করে জামায়াত- শিবিরের হিংস্র হায়েনারা, তখন কি রাষ্ট্রের ধর্মানুভূতি শীতনিদ্রায় থাকে ? যখন জামাত শিবিরের হায়েনারা আমাদের পুলিশ ভাইদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালায়, তাদের হত্যা করে, চিকিৎসককে আগুনে পুড়িয়ে মারে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধের হুমকি দেয়; রাষ্ট্র তখন তদন্ত কমিশন বানায় না কেন? তখন কি রাষ্ট্র আঘাতপ্রাপ্ত হয় না? যখন অনলাইনে ব্লগে জামাত-শিবিরচক্রের হায়েনারা বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অপপ্রচার চালায়, তখন তো মহাজোট সরকার তার বিরুদ্ধে কোনো উদ্যোগ নেয় না। আজ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকারীদের বিরুদ্ধে সরকার কী কোনো উদ্যোগ নিয়েছে?
এর বাইরেও আরও অনেকে অনেক প্রশ্ন তুলেছেন । শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ বারবার ঘোষণা দিয়েছে যে তারা কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে নয়, তারা যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের ফাঁসী ও জামাতি ইসলামকে নিষিদ্ধ করার দাবীতে আন্দোলনে নেমেছেন । তা হলে তাঁদের পক্ষের  ব্লগগুলিই কেবল বন্ধ করা হলো কেন ? যাঁরা শাহবাগের আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত তাঁদের কয়েকজনকেই কেবল কেন গেপ্তার করা হলো ? ব্লগে ধর্মের সমালোচনা করার ঘটনা তো বাংলাদেশে নতুন কিছু নয় ।  এতদিন কেন কাউকে গ্রেপ্তার করা হয় নি ? ধর্মানুভূতিতে আঘাতকারীদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যে সরকার এর আগে কেন তদন্ত কমিশন গঠন করে নি ? ধর্মান্ধ মুসলিমদেরও
 অসংখ্য ব্লগ রয়েছে যারা প্রতি নিয়ত অমুসলিমদের ধর্মানুভূতিকে আক্রমণ করছে প্রতনিয়ত । শুধু তাঁদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত করাই নয়, তাঁদের উপর চড়াও হয়ে হত্যা করা,  বাড়ি-ঘর লুঠ করা, মন্দির-গীর্জা ধ্বংস করা ,ব্যবসা-বাণিজ্য ও জমি-জায়গা বলপূর্বক দখল করা ইত্যাদি অমানবিক কাজেও তারা অবিরাম প্ররোরচনা ও উৎসাহ দেয় তাদের ব্লগে । সরকার এই ব্লগগুলির একটিও কেন বন্ধ করে নি এবং এই ব্লগারদের কাউকেই গ্রেপ্তার করে নি কেন ? সরকার কেন এই সব ব্লগ ও ব্লগারদের ক্ষেত্রে নীরব রয়েছেন ?
 ব্লগ বন্ধ করা ও ব্লগারদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশের ২০ জন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীও । তাঁদের মধ্যে রয়েছেন অধ্যাপক সালাউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, আকবর আলি খান, অজয় রায়,   রামেন্দু মজুমদার,   সুলতানা কামাল, রাশেদা কে চৌধূরী,  জাফর ইকবাল, এম এম আকাশ, ইয়াসমিন হক,  সুপ্রিয় চক্রবর্তী ও রোবায়েত ফেরদৌস প্রমুখ ।  বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, ‘সম্প্রতি ধর্মানুভূতিতে আঘাত করে সামাজিক আলাপচারিতার তথ্য প্রযুক্তিকে ব্যবহার করার অভিযোগে চারজন তরুণকে গ্রেপ্তার করার ঘটনায় আমরা মর্মাহত। এই তরুণেরা শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের প্রচারে যুক্ত ছিল। ... সরকারের কাছে আবেদন জানাই, সর্বজনের ধর্মানুভূতি রক্ষা করুন, তবে মুক্তচিন্তার পথ রুদ্ধ করবেন না। এর ফলে দেশে-বিদেশে ভুল বার্তা পৌঁছাবে। তাঁরা ঐ তরুণদের মুক্তির দাবীও জানিয়েছেন ।
  হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আপোষ , তাদের তুষ্ট করার জন্যে তরুণ ব্লগারদের গ্রেপ্তার ও গণজাগরণ মঞ্চ ভেঙে দেওয়ার পরামর্শে আওয়ামী লীগ দল ও তার সরকারের অভ্যন্তরেও তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে । সরকারের এ মনোভাবকে অনেকে ২০০৭ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারীতে খেলাফত মজলিস ও আওয়ামী লীগের করা নির্বাচনী সমঝোতা চুক্তির তুলনা করছেন । ওয়ারকার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, “ আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছি , আবার হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আলোচনা করছি । এ অবস্থান নিলে আমও যাবে ছালাও যাবে ।”  রাশেদ খান মেননের সঙ্গে সহমত পোষণ করে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন , “দুই নৌকায় পা দিলে কোনো কিছুই হবে না । আমরা লক্ষ্য ঠিক রাখতে পারছি না । একটি আদর্শের জন্য নির্দ্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এগোতে হবে আমাদের ।” হেফাজতে ইসলামের নেতাদের ধন্যবাদ জানানোর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে আওয়ামি লিগের মহিলা সংগঠনও । যাঁরা প্রতিবাদ করেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন আইন মন্ত্রী ব্যারিষ্টার শফিকের স্ত্রীও ,যিনি ঐ সংগঠনের একজন অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নেত্রী ।

   হেফাজতে ইসলাম লং -মার্চ কর্মসূচীর মাধ্যমে সরকার ও গোটা দেশকে আতঙ্কগ্রস্ত করার পরিকল্পনা করেছিল । তাদের বিশাল সমাবেশ ও তান্ডব দেখে সরকার ভয় পেলেও বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা আতঙ্কগ্রস্ত ও ভয় পেয়েছে বলা যাবে না ।  হেফাজতের ওই ভয়ঙ্কর রূপ ও ১৩ দফা দাবী বরং বাংলাদেশের পক্ষে শাপে বরই হয়েছে । সংগ্রামী সংগঠনপগুলি আরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত আরও কঠিন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্যে আরও দৃঢ় অঙ্গীকার ঘোষণা করেছে । এবং যাঁদের কণ্ঠস্বর এতদিন সেভাবে শোনা যায় নি, তাঁরাও, বিশেষ করে সর্বস্তরের নারী সংগঠনগুলিও পথে নেমে এসেছে হেফাজতকে ঠেকানোর জন্যে । গণজাগরণ মঞ্চ আরও কঠোর অবস্থান নিয়েছে । তারা বিশাল একটা লাঠি মিছিল করে বার্তা দিয়েছে যে মুসলিম মৌলবাদীদের সহিংস আক্রমণ প্রতিরোধ করতে প্রয়োজনে তারাও অস্ত্র তুলে নিতে দ্বিধা করবে না । 
 সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের বিরুদ্ধে দল ও জোটের মধ্যে এই যে অসন্তোষ ও প্রতিবাদ এবং দেশ জুড়ে প্রবল সমালোচনা ও প্রতিবাদের ঝড় তৈরী হয়েছে তার ফলে সরকারের মনোভাবে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে । সরকার যে ভাবে একতরফা হেফাজতের কাছে সমর্পণ করছিল সেটা অনেকটা কমেছে । প্রধান মন্ত্রী বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে  জানিয়েছেন যে তাঁর সরকার হেফাজতে ইসলামের যে দাবীগুলি সংবিধানের সঙ্গে সাঙ্ঘর্ষিক সে গুলি বিবেচনা করবে না । তিনি এও জানিয়েছেন যে ধর্মুনুভূতিতে আঘাতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যে যে আইন আছে তাই যথেষ্ট, এই আইন পরিবর্তন করে আরও কঠোর কোনো আইন তথা ব্লাসফেমি আইনও তৈরী করবেনা । তাঁর সরকার আর একটি কঠিন পদক্ষেপ করার সাহস দেখিয়েছে  ‘আমার দেশ’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে । এই লোকটাকে বহু আগেই গ্রেপ্তার করা দরকার ছিল, কারণ আমার দেশ কাগজটি প্রথম থেকেই পরিকল্পনা মাফিক ধর্মীয় উস্কানিমূলক ও মিথ্যা খবর প্রচার করে আসছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ব্যবস্থা ভন্ডুল ও দেশ জুড়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধানোর জন্যে । অনেক বিলম্বে হলেও সরকার এতদিনে দেশে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা সৃষ্টির জন্যে বিএনপি ও জামাত নেতাদের বিরুদ্ধে কড়া আইনি পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে এবং খালেদা জিয়া ছাড়া সকল শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেপ্তার করে আইনের অধীনে নিয়েছে ।
সরকার একদিকে এইসব ইতিবাচক পদক্ষেপ নিচ্ছে ,আবার অপরদিকে প্রধান শাসক দলে আওয়ামি লিগের কন্ঠেও শোনা যাচ্ছে মুসলিম মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কিছুটা কড়া সুর । বিএনপি-জামাতের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে হেফাজতে ইসলাম লং মার্চের কর্মসূচী দিয়েছিল - এই তথ্যটি ফাঁস হয়ে গেছে । এই খবরের সূত্র ধরে আওয়ামি লিগও অবশেষে হেফাজতে ইসলামকে তোষামোদ করার অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসে তাদের বিরুদ্ধে প্রচারে মাঠে নেমেছে । হেফাজতে ইসলামের সশস্ত্র আক্রমণ প্রতিহত করতে আওয়ামি লিগ পথে নেমেছে এমন দৃশ্যও কোথাও কোথাও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে । 
সরকার কিছু ইতিবাচক ও সাহসী পদক্ষেপ নিলেও তা মোটেই যথেষ্ট নয় । সরকার মনে হচ্ছে যাঁরা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসী ও জামাতি ইসলামকে নিষিদ্ধ করার দাবীতে সংগ্রাম করেছেন তাঁদের এবং যারা ইসলাম ধর্মের দোহায় দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে সহিংস আন্দোলন করছে তাদের উভয়কে সন্তুষ্ট করার নীতি গ্রহণ করেছে । এই নীতি ত্যাগ করে সরকারকে মুসলিম মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে আরও শক্ত এবং স্পষ্ট অবস্থান ও ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে । কারণ হেফাজতে ইসলাম যতই তাদের অরাজনৈতিক সংগঠন বলে দাবী করুক তারা যে আসলে জামাতি ইসলামের রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা করতেই মাঠে নেমেছে তা সংশয়াতীত এবং ইতিমধ্যেই সে তথ্য উঠেও এসেছে । তারা একদিকে গণজাগরণ মঞ্চের নেতাদের ফাঁসীর দাবীতে আর একদিকে যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের মুক্তির দাবীতে সহিংস আক্রমণ শুরু করেছে । তারা দাবী করেছে বর্তমান সংবিধান বাতিল করে শরিয়তি সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে যেখানে নারীর অবাধ পদচারণা , সহ শিক্ষা, আধুনিক শিক্ষা, ভাস্কর্য নির্মাণ ও স্থাপন, ইসলামি সংস্কৃতির পরিপন্থী সিনেমা-নাটক-গান-বাজনা , ধর্মনিরপেক্ষতা প্রভৃতি নিষিদ্ধ থাকবে । এই দাবীগুলি প্রমাণ করে যে জামাতি ইসলাম ও হেফাজতে ইসলাম – এরা নামে ভিন্ন হলেও এদের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এক ও অভিন্ন । ‘আমার দেশ’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করার পর এটা আরও স্পষ্ট হয়ে গেছে । মাহমদুরের গ্রেপ্তারের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে  হেফাজতে ইসলাম বলেছে যে সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ।  সুতরাং সরকার যদি মনে করে তোষামোদ করলে হেফাজতে ইসলাম শান্ত হবে এবং জামাত-বিএনপি জোট থেকে বেরিয়ে আসবে তবে তা হবে মহাভুল এবং তার কঠিন মাশুল গুণতে হবে আওয়ামি লিগ সহ গোটা দেশকে । হেফাজতে ইসলাম কোনদিনই আওয়ামি লিগ ভোট দিবে না । অপরদিকে ওদের তোষণ করার জন্যে যাঁরা আওয়ামি লিগকে ভোট দেয় তাঁরা অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নেবে । ফলে রাশেদ মেনন খাঁন যা বলেছেন – আমও যাবে ছালাও যাবে – তাই হবে ।
দেশ এখন গভীর সঙ্কটে । হাসিনার সরকারের হাতেই এই দেশটার ভাগ্য এখন অনেকখানি নির্ভর করছে । হাসিনা দুকূল বজায় রেখে সঙ্কট নিরসনের যে চেষ্টা করছেন । এটা ভুল নীতি ও ভুল পথ । দু পক্ষকে তুষ্ট করা অসম্ভব । তাঁকে বেছে নিতে হবে একটা স্পষ্ট নীতি ও পথ ।  হেফাজতে ইসলাম কিংবা হেফাজতে বাংলাদেশ - এর  মধ্যে তাঁকে যে কোনও একটাকে বাছতে হবে  । 
 
পুনশ্চঃ  প্রধান মন্ত্রী কী করবেন তা নিয়ে যে তিনি ভীষণ দ্বিধাগ্রস্ত তা বোঝা যায় তাঁর দেওয়া অতি সাম্প্রতিক দুটি ভাষণে । তিনি একবার বলেছেন তাঁর সরকার ‘মদিনা সনদ’ ও শেষ নবীর ‘বিদায় হজের ভাষণ’ অনুসরণ করে চলবে । আর একটি ভাষণে বলেছেন , যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করা হবেই ,কেউ তাদের রক্ষা করতে পারবে না । প্রথম ভাষণটি স্পষ্টতঃ ইসলামি রাষ্ট্র নির্মাণ করার ঘোষণা যা স্পষ্টতঃ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সঙ্গে সাঙ্ঘর্ষিক । যুদ্ধাপরাধী রাজাকাররা যে সব গণহত্যা, গণধর্ষণ ও লুটপাটের মত ঘৃণ্য ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে , তা করেছে শেষ নবীর নির্দেশনা মেনেই । ইসলামি রাষ্ট্র তাদের তো বিচার করে না, তাদের পুরস্কৃত করে । ইসলামি রাষ্ট্র স্থাপন করবো , আবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও করবো – এটা হয় না ।
(written on 20.04

No comments:

Post a Comment

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...