Monday, May 20, 2013

ত্রিশ লাখ মানুষের হত্যাকারীদের শাস্তি ফাঁসীই - আসুন নির্দ্বিধায় শাহবাগের পাশে দাঁড়ায়


যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আদৌ হবে কি না তা নিয়ে সংশয় ছিল। তাই যেদিন প্রথম বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসীর সাজা ঘোষিত হয় সেদিন গোটা বাংলাদেশ আনন্দে মেতে উঠেছিল। সেই রায়ে মানুষের মনের ভিতর যে সংশয় তৈরী হয়েছিল তার অবসানও ঘটেছিল। সংশয় তৈরী হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে শাস্তি প্রদানের কাজ যখন শুরু হয়েছিল তখনই( ১৯৭৫ সালে ) স্বাধীনতার শত্রুরা মুজিবর রহমানকে হত্যা করে বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয় তারপর কেটে গেছে ৩৮ বছর    সেই যুদ্ধাপরাধীরাই দেশের সংবিধান পাল্টে দিয়ে দেশটাকে ইসলামি রাষ্ট্র বানিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজের বুকে মধ্যযুগীয় অত্যাচার-নিপীড়ন চালিয়েছে এতদিনতাদের অত্যাচারের প্রধান লক্ষ্য ছিল একদিকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হিন্দু সমাজ এবং অপরদিকে ধর্মনিরপেক্ষ এবং যুক্তিবাদী বুদ্ধিজীবী, লেখক ও কলা-কুশলীরা এবং আওয়ামী লিগ ও বামপন্থী দলগুলিতারা বারেবারে হিন্দুনিধন যজ্ঞে মেতে উঠেছে, তাদের অসংখ্য গ্রাম-মহল্লা, ব্যবসা-বাণিজ্য লুট করেছে, অসংখ্য মন্দির ও বিগ্রহ ধ্বংস করেছে বাংলাদেশকে কাফেরমুক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে এ সব অত্যাচার সংগঠিত করেছেফলে নিরুপায় হিন্দু জনগণ দলে দলে প্রাণ রক্ষার্থে ভারতে পালিয়ে এসেছেন। এসব বর্বরতা চলেছে চার দশক ব্যাপী ধারাবাহিকভাবে। ফলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আশা মানুষ প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল       প্রথম রায়ে যখন মানুষ ভরসা পেল যে  যুদ্ধাপরাধীরা ছড়া পাবে না, ঠিক তখনই আবার বিশ্বাসের উপর আঘাত নামলো। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল, যে নতুন করে আশা সঞ্চার করেছিল, আঘাত এল সেখান থেকেইসেই ট্রাইবুনালই কাদের মোল্লার সাজা দিল (৫ই ফেব্রুয়ারী) যাবজ্জীবন কারাদন্ড। অবিশ্বাস্য ও অগ্রহণযোগ্য রায়। কারণ বাচ্চু রাজাকার অপেক্ষা কাদের মোল্লার অপরাধের মাত্রা অনেক অনেক বেশী। তার শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড! এই রায় বাংলাদেশের মানুষকে প্রচন্ড আঘাত করে। তাঁদের মধ্যে জন্ম দেয় নানা প্রশ্নের কাদের মোল্লার শরীরি ভাষা সে প্রশ্নকে আরও জোরদার করে এ কিসের ইঙ্গিত? জামাত নেতারা বলেছিল, বিচারের নামে প্রহসন করলে তারা গৃহযুদ্ধ বাধাবে। সরকার কি তাহলে ঐ হুমকিতে ভয় পেয়ে জামাতের সঙ্গে ভিতর ভিতর বোঝাপাড়া করেছে? তাহলে কি আর কারও ফাঁসীর সাজা হবে না? তাহলে কি বিএনপি ক্ষমতায় এলে যুদ্ধাপরাধীরা জেল থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে?   তবে কি বিচারের নামে প্রহসন শুরু হলো?
এই সব প্রশ্ন জন্ম দিয়েছে শাহবাগ আন্দোলনের কতিপয় তরুণ প্রথমে পথে নামলেন কাদের মোল্লার ফাঁসীর দাবীতে। সঙ্গে সঙ্গে সেই দাবীর সমর্থনে এগিয়ে আসল গোটা দেশ সর্বস্তরেরমানুষ ব্যক্তিগতভাবে এবং সংগঠনগতভাবে এই আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে এসে একাত্মতা ঘোষণা করলেনশাহবাগ আন্দোলনের পক্ষে গোটা দেশের স্বতঃস্ফূর্ত ও উত্তাল সমর্থন দেখে ক্ষমতাসীন ১৪ দলের মহাজোটের সব কটি দলও এগিয়ে এলো শাহবাগের পাশে ।  
শাহবাগের আন্দোলনের প্রধান দাবী দুটি - সমস্ত যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদন্ড ও জামাতি ইসলামের নিষিদ্ধকরণের দাবিযুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাবার জন্যে প্রথম থেকেই তৎপর জামাতি ইসলাম। এই দলটাই মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে পাক সেনাবাহিনীর সঙ্গে অস্ত্র ধরেছিল। এরাই তৈরী করেছিল সশস্ত্র রাজাকার, আল-শামস ও আল-বদর বাহিনীএইসব খুনে বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল হাজার হাজার জামাতি ইসলামি নেতা ও কর্মী  সেই নেতাদের কয়েকজন হলো গোলাম আযম,দেলওয়ার হোসেন সাঈদী, কাদের মোল্লা, মতিউর রহমান নিযামি প্রমুখ। তাই শাহবাগ আন্দোলন জামাতি ইসলামকে নিষিদ্ধ করার যে দাবী তুলেছে তা একদম ঠিকআর তাইতো জামাতি ইসলাম প্রথম থেকেই যেমন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত, তেমনি শাহবাগ আন্দোলনের বিরোধিতাতেও সমান সোচ্চার।    
তথাপি শাহবাগ আন্দোলন  ক্রমশঃ শক্তিশালী ও বেগবান হয়েছে। এর ফলে সরকার ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল প্রশাসনে যে  চাপ সৃষ্টি হয়েছিল সে চাপ অনেকটাই সরে যায়সরকারও শাহবাগের দাবী মেনে ট্রাইবুনাল আইনের সংশোধন করে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদন্ডের সাজার পরিবর্তে ফাঁসীর দাবীতে আদালতে আর্জি পেশ করে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল-২ এর বিচারকগণও স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দেলওয়ার হোসেনের বিচার করতে সক্ষম হন।শাহবাগ আন্দোলনে মানুষ যত সামিল হয়েছে জামাতিরা ততই ক্ষিপ্ত হয়েছে ওরা আরও অধিক ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে দেলওয়ার হোসেনকে মৃত্যুদন্ড দন্ডিত করলে পরতার নিঃশর্ত মুক্তির দাবীতে সশস্ত্র আক্রমণ শুরু করে পুলিশ, আওয়ামি লিগ সহ ১৪ দলের শাসক জোটের নেতা-কর্মী, শাহবাগ আন্দোলনের নেতা-কর্মী ও অসামরিক মানুষের উপর বিএনপিও সরাসরি ওদের পাশে দাঁড়িয়ে যায়ফলে এই দুই বর্বর শক্তির মিলিত আক্রমণ যে চেহারা নেয় তাকে তান্ডব বললেও কম বলা হয়। তান্ডব চালিয়ে গোটা দেশে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চায়ছে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করার জন্যে
ওদের হিংসাত্মক কার্যকলাপে ইতিমধ্যেই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।  গোটা দেশে ধ্বংস হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি ও সম্পদ, নিহত হয়েছে শতাধিক মানুষ। সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হিন্দু সমাজের মানুষ ওঁরা তো মুসলিম মৌলবাদীদের রোষানলের লক্ষ্যবস্তু সবসময়ের জন্যেই ( কোরানে এই নির্দেশ রয়েছে মুমিনদের প্রতি) , এবার সেই রোষানল আরও অনেকগুণ তীব্র, কারণ ওঁরাও ঘাতক রাজাকার বাহিনীর অপরাধের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেওয়ার ঔদ্ধত্য দেখিয়েছেন যা যুদ্ধাপরাধী ঐ রাজাকারদের ফাঁসীর রায়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে। হিন্দুদের ওপর আক্রমণ এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’কেও বিবৃতি দিতে হয়েছে। সেই বিবৃতির অংশ বিশেষ হলো এ রকমঃ ‘ ... ৪০টির বেশি হিন্দু মন্দিরে ভাঙচুর আগুন দেওয়া হয় ছাড়া, এই সম্প্রদায়ের বহু বাড়িঘর দোকানপাট জ্বালিয়ে দেওয়া হয় এতে গৃহহীন হয়েছে শত শত মানুষ আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়কে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী চলতে থাকা ব্যাপক সহিংস বিক্ষোভের প্রেক্ষাপটে এসব হামলা অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে ...এটি খুবই বেদনাদায়ক যে দৃশ্যত কেবল ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে এমন হামলার শিকার হচ্ছে তারা কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিতে হবে (প্রথম আলো, ০৮.০৩.১৩)। এই বিবৃতির পরও আক্রমণ অব্যাহত আছে।  ফলে তার বলি হয়েছে সহস্রাধিক মন্দির, শত শত বাড়ি-ঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।       
 জামাত শিবির  জঙ্গী ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপের পাশাপাশি চালাচ্ছে সীমাহীন অপপ্রচারও প্রচার করছে যে,  যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে যাদের গ্রেপ্তার করে বিচার করা হচ্ছে তারা নির্দোষ। হাসিনার সরকার যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল গঠন করেছে সেটা ইসলামকে ফাঁসীতে ঝোলানোর ট্রাইবুনাল। হাসিনা ইসলামবিরোধী আন্তর্জাতিক চক্রান্তের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এই ট্রাইবুনাল গঠন করেছে বাংলাদেশের আলেম সম্প্রদায়কে ফাঁসীতে ঝুলিয়ে ইসলামকে বাংলাদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যে। মাওলানা দেলওয়ার হোসেন সাইদি সেই চক্রান্তের শিকারহাসিনার সরকার তার চক্রান্তকে কার্যকরী করার লক্ষ্যেই নাস্তিকদের নিয়ে তৈরী করেছে শাহবাগে তথাকথিত গণজাগরণ মঞ্চ । এরূপ ভয়ঙ্কর ও মিথ্যা প্রচারণা চালানো হচ্ছে অবিরাম যার উদ্দেশ্য হলো ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করে বাংলাদেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া।
এরূপ পরিস্থিতিতে বিশ্বের সমস্ত গণতন্ত্রিক মানুষের শাহবাগের আন্দোলনকে সমর্থন এবং বিএনপি-জামাত জোটের তান্ডবের প্রতিবাদ করা উচিত। আমাদের( এপারের বাঙালিদের) তো সবার আগে করা উচিত । কারণ আমরা প্রতিবেশী। আর শুধু কি প্রতিবেশী? ঢাকার ঐ শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে যখন ওরা জাতীয় সঙ্গীত গায়, ‘ আমার সোনার বাংলা ...’ , কিংবা নিজেদের আত্মপরিচয়ের ঘোষণা দিয়ে সম্মিলিত কন্ঠে বলে ‘তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা মেঘনা যমুনা’, কিংবা যখন ‘জয় বাংলা’ বলে শ্লোগানে গগণ বিদীর্ণ করে, তখন সেই সুর ও ধ্বনি কি আমাদের  হৃদয় স্পর্শ করে ন? আমাদের শরীরে শিহরণ জাগায় না ?  তখন ঢাকাকে কি সত্যি বিদেশ বলে মনে হয় ?  হয় না।
কিন্তু এটা খুবই দুঃখের যে আমরা সেভাবে শাহবাগের পাশে দাঁড়াতে পারলাম না,  পারলাম না এমন কি  বিএনপি-জামাত জোটের হিংস্র তান্ডবের প্রতিবাদ করতেওআমরা পারলাম না ,কিন্তু মুসলিম এখানকার মৌলবাদীরা চুপচাপ বসে নেই। তারা দেলওয়ার হোসেন সাঈদী সহ ঘাতক রাজাকারদের মুক্তির জন্যে ওপারে মুসলিম মৌলবাদীরা যে তান্ডব ও ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে তার সমর্থনে কলকাতায় পথে নেমে পড়েছেমিছিল করছে। মিছিল থেকে ঘোষণা দিচ্ছে, হাসিনাকে এই বাংলায় তারা ঢুকতে দেবে না। রাজাকারদের মুক্তির দাবীতে ওরা ২৬ শে মার্চ কলকাতায় বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিয়েছে। এ রাজ্যেও ওরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে ওরা এমন কি ওদের কাগজগুলিকে (কলম, মীযান, নতুন গতি প্রভৃতি) বিএনপি-জামাত জোটের মুখপত্রে পরিণত করেছে এবং লাগাতার অপপ্রচার চালাচ্ছে।
মুসলিম মৌলবাদীরা এ রাজ্যে যখন দাপটের সঙ্গে চরম অন্যায়ের পক্ষে গলা ফাটাচ্ছে তখন কলকাতার অধিক বুদ্ধিসম্পন্ন বুদ্ধিজীবীরা শুধু শাহবাগ নিয়ে শুধু নিস্পৃহই থাকছেন না, উল্টে বলছেন – শুধু শাহবাগের পাশে দাঁড়ালেই হবে না, ফাঁসীর দাবী কতটা যৌক্তিক সে প্রশ্নও তুলতে হবে। এ কি শুধু মানবতার জন্যে প্রশ্ন তোলা ? নাকি মানবতার আড়ালে মুসলিম মৌলবাদীদের পদলেহন করা?  ৩০ লক্ষ মানুষের হত্যা ও ৩ লক্ষ নারীর ধর্ষণের অপরাধে যারা অপরাধী তাদেরও ফাঁসীর দাবী করা যাবে না? 

written on 20.03.2013

No comments:

Post a Comment

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...