মাত্র ৭.৬ কোটি
মানুষের একটি ছোট্ট দেশ তুরস্ক । এক যুগের কিছু অধিক সময় ধরে ক্ষমতায় আসীন রয়েছে ইসলামপন্থী দল Justice
and Development Party(AKP) । মুসলিম মোল্লা সমাজ
ও বুদ্ধিজীবীদের অন্তহীন গর্ব এই দেশটিকে নিয়ে । তুরস্ক নাকি প্রকৃতই একটি ধর্মনিরপেক্ষ
ইসলামিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে উঠেছে । ইসলামিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ ?
ইসলামিক এবং গণতান্ত্রিক ? এ রকম আবার হয় নাকি ? কী হাস্যকর ! তা যাই হোক, সেই
তুরস্কের মানুষ এখন প্রধান মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবীতে উত্তাল । আন্দোলন শুরু হয়েছিল একটা নিরীহ
ইস্যুতে । দাবী ছিল একটি পার্ক
বাঁচানোর । সেই আন্দোলন দমন করতে পুলিশ অমানবিক ও হিংস্র পদক্ষেপ নেয় । তার বিরুদ্ধে মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে । বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারা
দেশে । পুলিশও দমন-পীড়নের মাত্রা বাড়াতে থাকে । পুলিশের আক্রমণে ( ১৩জুন পর্যন্ত) মারা গেছে
৪(চার) জন এবং আহত হয়েছে কমপক্ষে পাঁচ হাজার মানুষ । বিক্ষুব্ধ মানুষ
তাই এখন প্রধান মন্ত্রী রিসেপ তায়িপ এরদোগানের পদত্যাগ চায়ছে ।
তথাকথিত
ইসলামি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শান্তিপূর্ণ
আন্দোলনের উপর দমন-পীড়নের সে কি বীভৎস রূপ ! তা
দেখলে হিটলার-মুসোলিনিরাও লজ্জা পেত । কয়েক শ’ নিরীহ পরিবেশবিদ ও পরিবেশ আন্দোলনের
কর্মীরা ইস্তানবুলের বিখ্যাত গেজী পার্কটি বাঁচানোর জন্যে গত ২৯শে মে সন্ধ্যায় জড়ো
হয়েছিলেন সেখানে । কারণ পরের দিন শুরু হবে পার্কের সমস্ত গাছপালা
নিধন করার কর্মকাণ্ড ।
বিশাল সে পার্কে আছে ৬০০টি বৃক্ষ যার মধ্যে অসংখ্য শতাব্দী প্রাচীন । স্বভাবতঃই
প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার প্রশ্নে পার্কটির গুরুত্ত্ব অপরিসীম । সেটা ধ্বংস করে নির্মাণ করা হবে ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের সেনা ছাওনির
আদলে একটা স্থাপনা, এবং এক বিশাল শপিং মল । সেই পার্কটিকে বাঁচাতে সেদিন সেখানে
জড়ো হয়েছিলেন । তাঁরা এসেছিলেন পতি-পত্নী ও পুত্র-কন্যা সহ সপরিবারে । ভেবেছিলেন হয়তো , সঙ্গে শিশু ও নারীরা থাকলে অন্ততঃ মানবতার
খাতিরেও প্রশাসন কঠোর মনোভাব নেওয়া থেকে বিরত থাকবে । কিন্তু সরকার তাঁদের ধারণাকে
ভুল প্রমাণ করতে একটু দ্বিধা করে নি । পর দিন ভোরবেলা তাঁরা সবকটা
বুলডোজারের সামনে দাঁড়িয়ে গিয়ে মানব প্রাচীর তৈরী করেছিলেন । সেই মানব প্রাচীরগুলো
নির্মমভাবে ভেঙে দিয়েছিল পুলিশ নির্দয়ভাবে
জল-কামান, রবার বুলেট , টিয়ার গ্যাসে সেল এবং লঙ্কার গুড়ো স্প্রে করার মেসিন
চালিয়ে । বলা বাহুল্য যে নারী-শিশু সহ আন্দোলনকারীদের ঐ নিরীহ
জমায়েতকে ওখান থেকে সরানোর জন্যে এত নৃশংসভাবে বলপ্রয়োগ করা আবশ্যক ছিল না ।
কিন্তু সরকার বোধহয় একটা বার্তা দিতে চেয়েছিল সমগ্র দেশবাশীকে যে সরকারের কোনো
কর্মসূচী ও সিদ্ধান্তের সমালোচনা বিরোধিতা বরদাস্ত করা হবে না ।
এত বড়
একটা খবর সংগ্রহ করার জন্যে সেদিন কোনো সংবাদ মাধ্যম সেখানে উপস্থিত ছিল না । কোনও মাধ্যমকে ঢুকতে দেয় নি আদর্শ ইসলামিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এই হলো নমুনা ! তবুও নৃশংস পুলিশি অভিযানের দৃশ্য ও খবর চাপা
থাকে নি । স্থানীয় মানুষ দেখেছেন, মোবাইলে ছবি তুলেছেন – মুখে মুখে, মোবাইলে মোবাইলে এবং ইন্টারনেটে খবর
রাষ্ট্র হয়েছে হাওয়ার বেগে । পরের দিন, ৩১শে মে তাই সন্ধ্যাবেলায় হাজার হাজাড় মানুষ ওই ঘটনার প্রতিবাদে জড়ো হয়ে
যায় ট্যাক্সিম স্কোয়ারে যেখানে গেজী পার্ক
অবস্থিত । মানুষকে আটকানোর জন্য ট্যাক্সিম স্কোয়ার অভিমুখে ইস্তানবুলের সব কটা
রাস্তা এবং মেট্রো ও ফেরী সার্ভিসও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল । তবুও বিক্ষুব্ধ মানুষদের আসা বন্ধ করা যায় নি । তাঁরা
ইস্তানবুলের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হেঁটে এসে জড়ো হন এবং শুরু করেন বিক্ষোভ
অবস্থানে । মানুষের প্রতিবাদের এই স্বাভাবিক প্রবণতাকে কোনো স্বৈরশাসকই উপলব্ধি
করতে পারে না । পারেনি তুরস্কের আদর্শ
গণতান্ত্রিক সরকারও । বরং সরকার আরও অধিক শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উচিত(!) শিক্ষা দিতে
প্রশাসনকে নির্দেশ প্রদান করে । এবার লেলিয়ে দেয় দাঙ্গা পুলিশকে । গভীর রাতে
অতর্কিতে তারা উন্মাদের ন্যায় জল-কামান, রবার বুলেট, টিয়ার গ্যাসের সেল ও লঙ্কার
গুড়ো স্প্রে করা মেসিন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ অবস্থানের উপর ।
মানুষের মাথা লক্ষ্য করে ছোঁড়া হয় টিয়ার গ্যাসের সেল, ফলে বহু মানুষের মাথা ফেটে
যায় । লঙ্কার গুঁড়ো এত এত স্প্রে করা হয় যার ফলে অনেকের চোখের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হওয়ার
আশঙ্কা আছে এবং কয়েকটা রাস্তার কুকুর ও বিড়াল মারা গেছে । দুজন যুবকের উপর
দিয়ে পুলিশ গাড়ি
চালিয়ে তাদের পিষে দেয় ও তাঁরা ঘটনাস্থলেই মারা যান । এই বর্বরোচিত পুলিশি অভিযানে
অসংখ্য মানুষ আহত হন ।
সরকারের
এই নিষ্ঠুর দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন তারপর ছড়িয়ে যায় অন্যান্য শহরেও । রাজধানী
শহরে আঙ্কারাতেও । তথাপি সরকার নমনীয় না হয়ে দমন-পীড়নের মাত্রা আরও
বৃদ্ধি করে আন্দোলনকে দমন করার জন্যে । তখন বিক্ষোভকারীরা আত্মরক্ষার জন্যে
রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে ও নানা উপায়ে মারমুখী পুলিশের আক্রমণ প্রতিহত করতে শুরু
করেন । ফলে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিসের সংঘর্ষের ক্রমশঃ বাড়তে থাকে । বাড়তে থাকে
ক্রমাগত আহত মানুষের সংখ্যাও । এই অবস্থায় ৯ই জুন রবিবার প্রধান মন্ত্রী আন্দোলন তুলে
নেওয়ার জন্যে আরও কঠোর মনোভাব নেন । অত্যন্ত কড়া ভাষায় হুমকি দেন । বলেন - পার্ক
বাঁচানোর নামে তুরস্কের ভাবমূর্তি কলুষিত করার চেষ্টা হচ্ছে । এই আন্দোলনের পেছনে
বিদেশী শক্তির হাত আছে । এটা বরদাস্ত করা হবে না । ইসলামিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের
প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে । আপনারা ঘরে ফিরে যান , না হলে আরও অনেক চড়া
মাশুল দিতে হবে ।
প্রধান
মন্ত্রীর এ হেন মিথ্যা দোষারোপ ও হুমকি মানুষের
অনেকদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের আগুনে যেন ঘি ঢেলে দিল । তাঁরা
ভয় পাওয়ার পরিবর্তে আরও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন । ফলে
বিক্ষোভ-আন্দোলনে মানুষের অংশগ্রহণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকলো । ইস্তানবুল শহরের
ট্যাক্সিম স্কোয়ারে প্রতিদিন সন্ধ্যা বেলা দশ হাজার মানুষ জড়ো হচ্ছেন এখন । সেখানে
রাতভোর অবস্থান করছেন, বিক্ষোভ করছেন । তাঁদের এখন একটাই দাবী - প্রধান মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে । সমাজের
সর্বস্তরের মানুষে এই আন্দোলনে
সামিল হয়েছেন । অসংখ্য মানুষ এগিয়ে এসেছেন
অবস্থানকারীদের জন্যে পানীয় জল ও খাবার নিয়ে । আহত মানুষদের চিকিৎসার জন্যে এগিয়ে
এসেছেন ডাক্তার ,উকিল, ব্যবসায়ী , হোটেল
মালিক , শ্রমিক-কর্মচারী, প্রভৃতি সব শ্রেণি , পেশা ও ধর্মের মানুষ । আন্দোলনকে
এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে গড়ে তোলা হয়েছে সমস্ত সংগঠন ও ব্যক্তি বিশেষদের নিয়ে ‘
ট্যাক্সিম স্কোয়ার সংহতি পরিষদ’ । এ যেন শাহবাগ আন্দোলনের প্রতিচ্ছবি । এদিকে আবার অনেক
পুলিশ অফিসার ও
সাধারণ পুলিশ নিরীহ জনতার উপর
টিয়ারগ্যাসের সেল ফাটাতে, রবার বুলেট দিয়ে আঘাত করতে এবং লঙ্কার গুঁড়ো স্প্রে করতে
রাজী নয় । তাঁরা চাকরী ছেড়ে
দিয়ে আন্দোলনে সামিল হয়ে গেছেন ।
অবস্থা এমনই যেন গোটা দেশ প্রধান মন্ত্রী এবং
তাঁর দল ও সরকারের বিরুদ্ধে ক্রোধে ও ক্ষোভে ফুঁসছে । শাহবাগীদের মতই আন্দোলনকারীরা
বলছেন – প্রধান মন্ত্রী পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আমরা কেউ আন্দোলন ছেড়ে যাবো না । ‘ ট্যাক্সিম স্কোয়ার সংহতি পরিষদ’ – এর মুখপত্র
জানিয়েছেন যতদিন না তাঁদের দাবী আদায় হয় ততদিন এই স্কোয়ার ছাড়বেন না । তিনি বলেছেন
– "We will
stay in Gezi Park with all our demands and sleeping bags,"। একজন মার্কেটিং ম্যানেজারের দৃপ্ত ঘোষণা - - We will come here every day after work until he goes," আমরা সারাদিন কাজ করে প্রতিদিন সন্ধ্যায় এখানে আসবো যতদিন না এই প্রধান মন্ত্রী বিদায় নিচ্ছেন ।
অবস্থা বেগতিক বুঝে
মি. এরদোগান সুর নরম করেছেন । সে কথায় পরে আসছি । এখন প্রশ্ন হলো প্রধান মন্ত্রি
এবং তাঁর দল ও সরকারের উপর গোটা দেশ এভাবে ক্ষোভে ফেটে পড়লো কেন ? সে কি শুধু একটা
পার্কের জন্য ? নাকি শুধু নিষ্ঠুর পুলিশি দমন-পীড়নের জন্যে ? না, ব্যাপারটা মোটেই তা
নয় । মানুষের মনে নানা ঘটনায় অনেক অসন্তোষ ও ক্ষোভ জমে ছিল । পার্ক ধ্বংস করে সৌধ ও শপিং মল নির্মাণ করা এবং পুলিশের নৃশংস দমন-পীড়নের ঘটনা অনুঘটকের কাজ করেছে মাত্র । গেজী পার্কে পুলিশের নৃশংস আক্রমণের ঘটনা যে
স্ফুলিঙ্গের জন্ম দিয়েছিল তা দাবানলের মত গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ।
কেন এই দাবানলের
সৃষ্টি হলো ? উত্তর শোনা যাক ওদের মুখেই । একজন ফেসবুকে লিখেছেন- all gathered to prevent the demolition of
something bigger than the park: পার্কের থেকেও বড়ো
কিছু ধ্বংস হওয়া প্রতিহত করতে সকলে জড়ো হয়েছে । কী বড়ো কিছু ? The right to live as honorable
citizens of this country । এই কথার বাখ্যা দিতে
গিয়ে আন্দোলনকারীরা বলছেন, গোটা দেশটাই বিক্রী করে দেওয়া হচ্ছে কর্পোরেট
সংস্থাগুলিকে শপিং মল, বিলাসবহুল বহুতল আবাসন, পাঁচতারা হোটেল, বিনোদন কেন্দ্র,
নিউক্লিয়ার প্লান্ট প্রভৃতি নির্মাণ করার জন্যে । আর এসব করা হচ্ছে তথাকথিত
উন্নয়নের নামে । আমরা এ দেশের সম্মানীয় নাগরিক, কিন্তু আমাদের কোন কথা শোনা হয় না
। আমাদের দেশ, আমাদের শহরের উন্নয়ন পরিকল্পনায় যুক্ত হওয়ার কোনও অধিকার নেই ।
এভাবে চলতে পারে না । গোটা দেশ চলে যাবে মুনাফাখোর বহুজাতিক পুঁজিপতিদের হাতে, এটা
আমরা দর্শকের মতো চুপচাপ বসে বসে দেখতে পারি না । সরকার গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর
হস্তক্ষেপ করেছে , সরকারের জনবিরোধী কর্মকান্ডের প্রতিবাদ তো দূরের কথা, সমালোচনা
করার অধিকারও নেই । সমস্ত মিডিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ
আরোপ করেছে । সরকারের সমালোচনা করার জন্যে নানা অজুহাতে বহু কবি,লেখক,
শিল্পী-সাহিত্যক, প্রভৃতি বিশিষ্টজনদের সরকার গ্রেপ্তার করে জেলে বন্দী করে রেখেছে
।
এ সবের চেয়েও অনেক
তীব্র জ্বালা বুকে তাঁদের জমে রয়েছে । ভয়ঙ্কর অভিযোগ হল সরকারের বিরুদ্ধে যে,
সরকার জনগণের ব্যক্তিগত জীবন-যাপনের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে শুরু করেছে ।
পরিস্থিত এমন পর্যায়ে গিয়েছে যা সহ্যের অতীত । মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলছে,
গণতন্ত্রের কথা বলছে , আর ধীরে ধীরে শরিয়তি আইন ও বিধি-নিষেধ চাপিয়ে দিচ্ছে ।
গর্ভপাত করা, সিজার করে সন্তান প্রসব করা, বিমান সেবিকাদের ঠোঁটে লিপস্টিক দেওয়া, অ্যালকহল
পান করা, অ্যালকহল বিক্রী করা প্রভৃতির উপর ইতিমধ্যেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে ।
নারী কী পোশাক পরবে তা বলে দেওয়া হচ্ছে এবং তাঁদের আবার বোরকা-বন্দী করার চেষ্টা হচ্ছে । নারীর
স্বাধীনতা ও অধিকারের উপর মাত্রাহীন হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে । এভাবেই দেশটাকে ধীরে ধীরে মধ্যযুগীয় পশ্চাদপদ ও অন্ধকার
যুগের শরিয়ত শাসনের দিকে টেনে নিয়ে
যাচ্ছে ।
আধুনিক তুরস্কের জনক
কামাল আতাতুর্কের দেশের মানুষ তাঁদের উপর এসব অন্ধকার যুগের পশ্চাদপদ আইন সংসদে
সংখ্যাগরিষ্ঠার জোরে চাপিয়ে দিলে তা মানবে কেন ? প্রায় এক’শ বছর পূর্বে কামাল
আতাতুর্ক তুরস্কের বুক থেকে প্রথম খলিফাতন্ত্রের জগদ্দল পাথরটাকে তুলে ইতিহাসের
আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে গঠন করেন একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র
। তিনিই প্রথম নারীকে রক্ষণশীল শরিয়তি
কারাগার থেকে মুক্ত করে তাঁদের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করেন । তুরস্কে আরবী
অক্ষর তুলে দিয়ে ল্যাটিন অক্ষরের উপর ভিত্তি করে তুর্কি অক্ষর প্রবর্তন করেন ।
শরিয়তি আইন ও আদালতের অবসান ঘটিয়ে আধুনিক
আইন নির্ভর আদালত গঠন ও স্থাপন করেন । আরবীয় পোশাক ও আরবীয় সংস্কৃতির অবসান ঘটিয়ে
ইউরোপীয়ান পোশাক ও সংস্কৃতি প্রবর্তন করেন । এবং সর্বোপরি তুরস্ককে মধ্য প্রাচ্য সংস্কৃতির
অন্ধকার গুহা থেকে বের করে ইউরোপিয়ান উন্নত ও উজ্জ্বল সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত করেন
। ফলে তুরস্ক ধীরে ধীরে পশ্চাদপদ ও সংরক্ষণশীল ধ্যান-ধারণা বর্জন করে ইউরোপিয়
উন্নত, উদার, প্রগতিশীল ও আধুনিক সাংস্কৃতিক জীবনধারায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে । সেই
তুরস্কের বুকে পুনরায় শরিয়তি শাসন প্রবর্তন করলে মানুষ তা মানবে কেন ?
ফলে, তুরস্কের মাটিতে
৩০শে মে গেজি পার্ক বাঁচানোর যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার অভিমুখ অতি দ্রুতই প্রধান
মন্ত্রী তথা একেপি পার্টির সরকারের দিকে ঘুরে যায় । গেজি পার্কে যে স্ফুলিঙ্গ তৈরী
হয়েছিল তা প্রধান মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দাবানলে পরিণত হয় । তাই অগত্যা তিনি সুর নরম
করেন । ১৩ই জুন বুধবার গেজি পার্কের প্রকল্প নিয়ে গণভোট নেওয়ার প্রস্তাব দেন ।
আন্দোলনকারীরা তা তৎক্ষণাৎ প্রত্যাখান করেন । পরের দিন আরও একটু পশ্চাদপসারণ করেন
। প্রকল্পটির রূপায়ণ স্থগিত রাখার ঘোষণা দিয়ে বলেন আদালতের রায় না আসা পর্যন্ত
তিনি কাজ শুরু করবেন না । এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে তিনি সরকার বিরোধী আন্দোলন
প্রত্যাহার করার আবেদন জানান । আন্দোলনকারীরা সরকারের এই ঘোষণাকে তাঁদের আংশিক জয়
বলে মনে করেন । কিন্তু তাঁরা তাঁদের আন্দোলন প্রত্যাহার করেন নি ।
এর্দোয়ানের একেপি ( জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট
পার্টি ) পার্টি তুরস্কের মানুষকে ধোঁকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল । তারা বলেছিল কামাল আতাতুর্ক প্রবর্তিত ধর্মনিরপেক্ষতা ও
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর কোনো পরিবর্তন না
করেই তারা তুরস্কের উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় । তাদের আসল কর্মসূচী গোপণ করে রেখেছিল
। এখন ধীরে ধীরে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে তুরস্কের ইসলামায়ন ঘটানোর কাজ শুরু করেছে ।
তারই বিরুদ্ধে আধুনিক সংস্কৃতিমনা ও বিজ্ঞানমনস্ক তরুণ তুর্কিরা পথে নেমে উত্তাল
গণআন্দোলন গড়ে তুলেছেন । এই আন্দোলন কোথায় এবং কীভাবে শেষ হয় তা বলা মুস্কিল । তবে
এ কথা নিশ্চয়ই বলা যায় যে, সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আর যাই হোক তুরস্ককে আর
কোনোদিন আধুনিক ও প্রগতিশীল জীবন-সংস্কৃতির আলোকোজ্জ্বল জগৎ থেকে মধ্যযুগীয় শরিয়তি
জীবন-সংস্কৃতির গাঢ় অন্ধকার গুহায় নিয়ে যাওয়া অসম্ভব ।
written on 16.06.2013
No comments:
Post a Comment