Sunday, July 7, 2013

সেক্যুলার তুরস্কের ইসলামায়ন প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে তরুণ তুর্কিদের বিক্ষোভে সমগ্র তুরস্ক উত্তাল


মাত্র ৭.৬ কোটি মানুষের একটি ছোট্ট দেশ তুরস্ক ।  এক যুগের কিছু অধিক সময় ধরে ক্ষমতায় আসীন রয়েছে ইসলামপন্থী দল Justice and Development Party(AKP) মুসলিম মোল্লা সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের অন্তহীন গর্ব এই দেশটিকে নিয়ে । তুরস্ক নাকি প্রকৃতই একটি ধর্মনিরপেক্ষ ইসলামিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে উঠেছে । ইসলামিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ ? ইসলামিক এবং গণতান্ত্রিক ? এ রকম আবার হয় নাকি ? কী হাস্যকর ! তা যাই হোক,  সেই তুরস্কের  মানুষ এখন প্রধান মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবীতে উত্তাল আন্দোলন শুরু হয়েছিল একটা নিরীহ ইস্যুতে । দাবী ছিল একটি পার্ক বাঁচানোর  সেই আন্দোলন দমন করতে পুলিশ অমানবিক ও হিংস্র পদক্ষেপ নেয়   তার বিরুদ্ধে মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে । বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশেপুলিশ দমন-পীড়নের মাত্রা বাড়াতে থাকে । পুলিশের আক্রমণে ( ১৩জুন পর্যন্ত) মারা গেছে  ৪(চার) জন এবং আহত হয়েছে কমপক্ষে পাঁচ হাজার মানুষ বিক্ষুব্ধ  মানুষ তাই এখন  প্রধান মন্ত্রী রিসেপ তায়িপ এরদোগানের পদত্যাগ চায়ছে
তথাকথিত ইসলামি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের  শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের উপর দমন-পীড়নের সে কি বীভৎস রূপ ! তা দেখলে হিটলার-মুসোলিনিরাও লজ্জা পেত । কয়েক শ’ নিরীহ পরিবেশবিদ ও পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা ইস্তানবুলের বিখ্যাত গেজী পার্কটি বাঁচানোর জন্যে গত ২৯শে মে সন্ধ্যায় জড়ো হয়েছিলেন সেখানেকারণ পরের দিন শুরু হবে পার্কের সমস্ত গাছপালা নিধন করার কর্মকাণ্ড । বিশাল সে পার্কে আছে ৬০০টি বৃক্ষ যার মধ্যে অসংখ্য শতাব্দী প্রাচীন । স্বভাবতঃই প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার প্রশ্নে পার্কটির গুরুত্ত্ব অপরিসীম । সেটা ধ্বংস করে  নির্মাণ করা হবে ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের সেনা ছাওনির আদলে একটা স্থাপনা, এবং এক বিশাল শপিং মল সেই পার্কটিকে বাঁচাতে সেদিন সেখানে জড়ো হয়েছিলেন । তাঁরা এসেছিলেন  পতি-পত্নীপুত্র-কন্যা  সহ সপরিবারে ভেবেছিলেন হয়তো , সঙ্গে শিশু ও নারীরা থাকলে অন্ততঃ মানবতার খাতিরেও প্রশাসন কঠোর মনোভাব নেওয়া থেকে বিরত থাকবে । কিন্তু সরকার তাঁদের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করতে একটু দ্বিধা করে নি । পর দিন ভোরবেলা তাঁরা  সবকটা বুলডোজারের সামনে দাঁড়িয়ে গিয়ে মানব প্রাচীর তৈরী করেছিলেন । সেই মানব প্রাচীরগুলো নির্মমভাবে ভেঙে দিয়েছিল পুলিশ  নির্দয়ভাবে জল-কামান, রবার বুলেট , টিয়ার গ্যাসে সেল এবং লঙ্কার গুড়ো স্প্রে করার মেসিন চালিয়েবলা বাহুল্য যে নারী-শিশু সহ আন্দোলনকারীদের ঐ নিরীহ জমায়েতকে ওখান থেকে সরানোর জন্যে এত নৃশংসভাবে বলপ্রয়োগ করা আবশ্যক ছিল না । কিন্তু সরকার বোধহয় একটা বার্তা দিতে চেয়েছিল সমগ্র দেশবাশীকে যে সরকারের কোনো কর্মসূচী ও সিদ্ধান্তের সমালোচনা বিরোধিতা বরদাস্ত করা হবে না ।  
     এত বড় একটা খবর সংগ্রহ করার জন্যে সেদিন কোনো সংবাদ মাধ্যম সেখানে উপস্থিত ছিল না  কোনও  মাধ্যমকে ঢুকতে দেয় নি   আদর্শ ইসলামিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এই হলো নমুনা !  তবুও নৃশংস পুলিশি অভিযানের দৃশ্য ও খবর চাপা থাকে নি । স্থানীয় মানুষ দেখেছেন, মোবাইলে ছবি তুলেছেন –  মুখে মুখে, মোবাইলে মোবাইলে এবং ইন্টারনেটে খবর রাষ্ট্র হয়েছে হাওয়ার বেগে । পরের দিন,  ৩১শে মে তাই সন্ধ্যাবেলায় হাজার হাজাড় মানুষ ওই ঘটনার প্রতিবাদে জড়ো হয়ে যায়  ট্যাক্সিম স্কোয়ারে যেখানে গেজী পার্ক অবস্থিত । মানুষকে আটকানোর জন্য ট্যাক্সিম স্কোয়ার অভিমুখে ইস্তানবুলের সব কটা রাস্তা এবং মেট্রো ও ফেরী সার্ভিসও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলতবুও বিক্ষুব্ধ মানুষদের আসা বন্ধ করা যায় নি । তাঁরা ইস্তানবুলের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হেঁটে এসে জড়ো হন এবং শুরু করেন বিক্ষোভ অবস্থানে । মানুষের প্রতিবাদের এই স্বাভাবিক প্রবণতাকে কোনো স্বৈরশাসকই উপলব্ধি করতে পারে না । পারেনি তুরস্কের  আদর্শ গণতান্ত্রিক সরকারও । বরং সরকার আরও অধিক শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উচিত(!) শিক্ষা দিতে প্রশাসনকে নির্দেশ প্রদান করে । এবার লেলিয়ে দেয় দাঙ্গা পুলিশকে । গভীর রাতে অতর্কিতে তারা উন্মাদের ন্যায় জল-কামান, রবার বুলেট, টিয়ার গ্যাসের সেল ও লঙ্কার গুড়ো স্প্রে করা মেসিন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ অবস্থানের উপর । মানুষের মাথা লক্ষ্য করে ছোঁড়া হয় টিয়ার গ্যাসের সেল, ফলে বহু মানুষের মাথা ফেটে যায় । লঙ্কার গুঁড়ো এত এত স্প্রে করা হয় যার ফলে অনেকের চোখের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা আছে এবং কয়েকটা রাস্তার কুকুর ও বিড়াল মারা গেছেদুজন যুবকের উপর দিয়ে পুলিশ গাড়ি চালিয়ে তাদের পিষে দেয় ও তাঁরা ঘটনাস্থলেই মারা যান । এই বর্বরোচিত পুলিশি অভিযানে অসংখ্য মানুষ আহত হন ।
সরকারের এই নিষ্ঠুর দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন তারপর ছড়িয়ে যায় অন্যান্য শহরেও । রাজধানী শহরে আঙ্কারাতেওতথাপি সরকার নমনীয় না হয়ে দমন-পীড়নের মাত্রা আরও বৃদ্ধি করে আন্দোলনকে দমন করার জন্যেতখন বিক্ষোভকারীরা আত্মরক্ষার জন্যে রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে ও নানা উপায়ে মারমুখী পুলিশের আক্রমণ প্রতিহত করতে শুরু করেন । ফলে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিসের সংঘর্ষের ক্রমশঃ বাড়তে থাকে । বাড়তে থাকে ক্রমাগত আহত মানুষের সংখ্যাও । এই অবস্থায়  ৯ই জুন রবিবার প্রধান মন্ত্রী আন্দোলন তুলে নেওয়ার জন্যে আরও কঠোর মনোভাব নেন । অত্যন্ত কড়া ভাষায় হুমকি দেন । বলেন - পার্ক বাঁচানোর নামে তুরস্কের ভাবমূর্তি কলুষিত করার চেষ্টা হচ্ছে । এই আন্দোলনের পেছনে বিদেশী শক্তির হাত আছে । এটা বরদাস্ত করা হবে না । ইসলামিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে । আপনারা ঘরে ফিরে যান , না হলে আরও অনেক চড়া মাশুল দিতে হবে ।
প্রধান মন্ত্রীর এ হেন মিথ্যা দোষারোপ ও হুমকি মানুষের অনেকদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের আগুনে যেন ঘি ঢেলে দিল । তাঁরা ভয় পাওয়ার পরিবর্তে আরও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন । ফলে বিক্ষোভ-আন্দোলনে মানুষের অংশগ্রহণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকলো । ইস্তানবুল শহরের ট্যাক্সিম স্কোয়ারে প্রতিদিন সন্ধ্যা বেলা দশ হাজার মানুষ জড়ো হচ্ছেন এখন । সেখানে রাতভোর অবস্থান করছেন, বিক্ষোভ করছেন । তাঁদের এখন একটাই দাবী -  প্রধান মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে । সমাজের সর্বস্তরের মানুষে এই আন্দোলনে  সামিল হয়েছেনসংখ্য মানুষ এগিয়ে এসেছেন অবস্থানকারীদের জন্যে পানীয় জল ও খাবার নিয়ে । আহত মানুষদের চিকিৎসার জন্যে এগিয়ে এসেছেন ডাক্তার ,উকিল,  ব্যবসায়ী , হোটেল মালিক , শ্রমিক-কর্মচারী, প্রভৃতি সব শ্রেণি , পেশা ও ধর্মের মানুষ । আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে গড়ে তোলা হয়েছে সমস্ত সংগঠন ও ব্যক্তি বিশেষদের নিয়ে ‘ ট্যাক্সিম স্কোয়ার সংহতি পরিষদ’ । এ যেন শাহবাগ আন্দোলনের প্রতিচ্ছবি । এদিকে আবার  অনেক পুলিশ অফিসার ও সাধারণ পুলিশ নিরীহ জনতার উপর টিয়ারগ্যাসের সেল ফাটাতে, রবার বুলেট দিয়ে আঘাত করতে এবং লঙ্কার গুঁড়ো স্প্রে করতে রাজী নয় তাঁরা চাকরী ছেড়ে দিয়ে আন্দোলনে সামিল হয়ে গেছেন ।
 অবস্থা এমনই যেন গোটা দেশ প্রধান মন্ত্রী এবং তাঁর দল ও সরকারের বিরুদ্ধে ক্রোধে ও ক্ষোভে ফুঁসছে । শাহবাগীদের মতই আন্দোলনকারীরা বলছেন – প্রধান মন্ত্রী পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আমরা কেউ আন্দোলন ছেড়ে যাবো না । ‘ ট্যাক্সিম স্কোয়ার সংহতি পরিষদ’ – এর মুখপত্র জানিয়েছেন যতদিন না তাঁদের দাবী আদায় হয় ততদিন এই স্কোয়ার ছাড়বেন না । তিনি বলেছেন – "We will stay in Gezi Park with all our demands and sleeping bags," একজন মার্কেটিং ম্যানেজারের দৃপ্ত ঘোষণা - - We will come here every day after work until he goes,"   আমরা সারাদিন কাজ করে প্রতিদিন সন্ধ্যায়  এখানে আসবো    যতদিন না এই প্রধান মন্ত্রী বিদায় নিচ্ছেন ।  
অবস্থা বেগতিক বুঝে মি. এরদোগান সুর নরম করেছেন । সে কথায় পরে আসছি । এখন প্রশ্ন হলো প্রধান মন্ত্রি এবং তাঁর দল ও সরকারের উপর গোটা দেশ এভাবে ক্ষোভে ফেটে পড়লো কেন ? সে কি শুধু একটা পার্কের জন্য ? নাকি শুধু নিষ্ঠুর পুলিশি দমন-পীড়নের জন্যে ? না, ব্যাপারটা মোটেই তা নয় । মানুষের মনে নানা ঘটনায় অনেক অসন্তোষ ও ক্ষোভ জমে ছিল । পার্ক ধ্বংস করে সৌধ ও শপিং মল নির্মাণ করা এবং পুলিশের নৃশংস  দমন-পীড়নের ঘটনা অনুঘটকের কাজ করেছে মাত্র ।  গেজী পার্কে পুলিশের নৃশংস আক্রমণের ঘটনা যে স্ফুলিঙ্গের জন্ম দিয়েছিল তা দাবানলের মত গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে
কেন এই দাবানলের সৃষ্টি হলো ? উত্তর শোনা যাক ওদের মুখেই । একজন ফেসবুকে লিখেছেন-  all gathered to prevent the demolition of something bigger than the park: পার্কের থেকেও বড়ো কিছু ধ্বংস হওয়া প্রতিহত করতে সকলে জড়ো হয়েছে । কী বড়ো কিছু ? The right to live as honorable citizens of this countryএই কথার বাখ্যা দিতে গিয়ে আন্দোলনকারীরা বলছেন, গোটা দেশটাই বিক্রী করে দেওয়া হচ্ছে কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে শপিং মল, বিলাসবহুল বহুতল আবাসন, পাঁচতারা হোটেল, বিনোদন কেন্দ্র, নিউক্লিয়ার প্লান্ট প্রভৃতি নির্মাণ করার জন্যে । আর এসব করা হচ্ছে তথাকথিত উন্নয়নের নামে । আমরা এ দেশের সম্মানীয় নাগরিক, কিন্তু আমাদের কোন কথা শোনা হয় না । আমাদের দেশ, আমাদের শহরের উন্নয়ন পরিকল্পনায় যুক্ত হওয়ার কোনও অধিকার নেই । এভাবে চলতে পারে না । গোটা দেশ চলে যাবে মুনাফাখোর বহুজাতিক পুঁজিপতিদের হাতে, এটা আমরা দর্শকের মতো চুপচাপ বসে বসে দেখতে পারি না । সরকার গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করেছে , সরকারের জনবিরোধী কর্মকান্ডের প্রতিবাদ তো দূরের কথা, সমালোচনা করার অধিকারও নেই । সমস্ত মিডিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ  আরোপ করেছে । সরকারের সমালোচনা করার জন্যে নানা অজুহাতে বহু কবি,লেখক, শিল্পী-সাহিত্যক, প্রভৃতি বিশিষ্টজনদের সরকার গ্রেপ্তার করে জেলে বন্দী করে রেখেছে ।
এ সবের চেয়েও অনেক তীব্র জ্বালা বুকে তাঁদের জমে রয়েছে । ভয়ঙ্কর অভিযোগ হল সরকারের বিরুদ্ধে যে, সরকার জনগণের ব্যক্তিগত জীবন-যাপনের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে শুরু করেছে । পরিস্থিত এমন পর্যায়ে গিয়েছে যা সহ্যের অতীত । মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলছে, গণতন্ত্রের কথা বলছে , আর ধীরে ধীরে শরিয়তি আইন ও বিধি-নিষেধ চাপিয়ে দিচ্ছে । গর্ভপাত করা, সিজার করে সন্তান প্রসব করা, বিমান সেবিকাদের ঠোঁটে লিপস্টিক দেওয়া, অ্যালকহল পান করা, অ্যালকহল বিক্রী করা প্রভৃতির উপর ইতিমধ্যেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে । নারী কী পোশাক পরবে তা বলে দেওয়া হচ্ছে এবং তাঁদের  আবার বোরকা-বন্দী করার চেষ্টা হচ্ছে । নারীর স্বাধীনতা ও অধিকারের উপর মাত্রাহীন হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে । এভাবেই  দেশটাকে ধীরে ধীরে মধ্যযুগীয় পশ্চাদপদ ও অন্ধকার যুগের শরিয়ত শাসনের   দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ।
আধুনিক তুরস্কের জনক কামাল আতাতুর্কের দেশের মানুষ তাঁদের উপর এসব অন্ধকার যুগের পশ্চাদপদ আইন সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠার জোরে চাপিয়ে দিলে তা মানবে কেন ? প্রায় এক’শ বছর পূর্বে কামাল আতাতুর্ক তুরস্কের বুক থেকে প্রথম খলিফাতন্ত্রের জগদ্দল পাথরটাকে তুলে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে গঠন করেন একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ।  তিনিই প্রথম নারীকে রক্ষণশীল শরিয়তি কারাগার থেকে মুক্ত করে তাঁদের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করেন । তুরস্কে আরবী অক্ষর তুলে দিয়ে ল্যাটিন অক্ষরের উপর ভিত্তি করে তুর্কি অক্ষর প্রবর্তন করেন । শরিয়তি আইন ও  আদালতের অবসান ঘটিয়ে আধুনিক আইন নির্ভর আদালত গঠন ও স্থাপন করেন । আরবীয় পোশাক ও আরবীয় সংস্কৃতির অবসান ঘটিয়ে ইউরোপীয়ান পোশাক ও সংস্কৃতি প্রবর্তন করেন । এবং সর্বোপরি তুরস্ককে মধ্য প্রাচ্য সংস্কৃতির অন্ধকার গুহা থেকে বের করে ইউরোপিয়ান উন্নত ও উজ্জ্বল সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত করেন । ফলে তুরস্ক ধীরে ধীরে পশ্চাদপদ ও সংরক্ষণশীল ধ্যান-ধারণা বর্জন করে ইউরোপিয় উন্নত, উদার, প্রগতিশীল ও আধুনিক সাংস্কৃতিক জীবনধারায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে । সেই তুরস্কের বুকে পুনরায় শরিয়তি শাসন প্রবর্তন করলে মানুষ তা মানবে কেন ?
ফলে, তুরস্কের মাটিতে ৩০শে মে গেজি পার্ক বাঁচানোর যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার অভিমুখ অতি দ্রুতই প্রধান মন্ত্রী তথা একেপি পার্টির সরকারের দিকে ঘুরে যায় । গেজি পার্কে যে স্ফুলিঙ্গ তৈরী হয়েছিল তা প্রধান মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দাবানলে পরিণত হয় । তাই অগত্যা তিনি সুর নরম করেন । ১৩ই জুন বুধবার গেজি পার্কের প্রকল্প নিয়ে গণভোট নেওয়ার প্রস্তাব দেন । আন্দোলনকারীরা তা তৎক্ষণাৎ প্রত্যাখান করেন । পরের দিন আরও একটু পশ্চাদপসারণ করেন । প্রকল্পটির রূপায়ণ স্থগিত রাখার ঘোষণা দিয়ে বলেন আদালতের রায় না আসা পর্যন্ত তিনি কাজ শুরু করবেন না । এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে তিনি সরকার বিরোধী আন্দোলন প্রত্যাহার করার আবেদন জানান । আন্দোলনকারীরা সরকারের এই ঘোষণাকে তাঁদের আংশিক জয় বলে মনে করেন । কিন্তু তাঁরা তাঁদের আন্দোলন প্রত্যাহার করেন নি ।
এর্দোয়ানের একেপি ( জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ) পার্টি তুরস্কের মানুষকে ধোঁকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলতারা বলেছিল কামাল আতাতুর্ক প্রবর্তিত ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর কোনো পরিবর্তন না করেই তারা তুরস্কের উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় । তাদের আসল কর্মসূচী গোপণ করে রেখেছিল । এখন ধীরে ধীরে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে তুরস্কের ইসলামায়ন ঘটানোর কাজ শুরু করেছে । তারই বিরুদ্ধে আধুনিক সংস্কৃতিমনা ও বিজ্ঞানমনস্ক তরুণ তুর্কিরা পথে নেমে উত্তাল গণআন্দোলন গড়ে তুলেছেন । এই আন্দোলন কোথায় এবং কীভাবে শেষ হয় তা বলা মুস্কিল । তবে এ কথা নিশ্চয়ই বলা যায় যে, সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আর যাই হোক তুরস্ককে আর কোনোদিন আধুনিক ও প্রগতিশীল জীবন-সংস্কৃতির আলোকোজ্জ্বল জগৎ থেকে মধ্যযুগীয় শরিয়তি জীবন-সংস্কৃতির গাঢ় অন্ধকার গুহায় নিয়ে যাওয়া অসম্ভব   । 
written on 16.06.2013

No comments:

Post a Comment

KARBALA: Truth and Lies

  KARBALA : Truth and Lies           GIASUDDIN                 Translated by SRIJIB BISWAS        ...