Saturday, October 23, 2021

কোরান মনুষ্য রচিত গ্রন্থ - এক

 আল্লাহ স্বয়ং (Allah himself) প্রার্থনাকারী এবং কথা বলে তৃতীয় পুরুষের ভাষায় 

ইসলাম ধর্মের মূল ধর্ম গ্রন্থ হলো কোরান। অন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলি হলো হদিস। অনেকগুলি হাদিস আছে। তার মধ্যে মাত্র ছ’টি হাদিসকে সঠিক হাদিস বলে গণ্য করা হয় সুন্নী সমাজে। সেগুলি হলো বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযি, নাসায়ী ও ইবনে মাজাহ। মুহাম্মদের ঘোষণা মতে কোরান হলো আল্লাহ্‌র বাণী। আর মুসলিম ধর্মগুরুদের বয়ান অনুযায়ী হাদিস তৈরি হয়েছে মুহাম্মদের বাণী, ব্যক্তিজীবন ও কর্মজীবন নিয়ে। এ লেখা কোরান সম্পর্কে মুহাম্মদের ঘোষণা নিয়ে। অর্থাৎ কোরানে যা কিছু তার সমুদয় হলো আল্লাহ্‌র প্রেরিত বাণীর সমাহার, এই দাবিটি নিয়ে। কোরানে আছে ১১৪টি অধ্যায় যাকে ইসলামি পরিভাষায় সুরা বলা হয়। সেই সুরাগুলির মধ্যে এমন অনেক সুরা আছে যেগুলির বক্তব্য যদি নিরপেক্ষ ও খোলা মন নিয়ে পড়া হয় তাহলে সবার মনেই গভীর সন্দেহ বা সংশয় তৈরি না হয়ে পারে না। সংশয়টি হলো কোরানের কথাগুলি আল্লাহ্‌র কিনা তা নিয়ে। যুক্তিবাদী চেতনা ও কৌতূহল নিয়ে কয়েকবার পড়লে অবশ্যই বোঝা যায় যে সংশয়টি যথার্থই।

কোরানের কয়েকটি সুরা এবার বিশ্লেষণ করা যাক। প্রথমেই দৃষ্টিপাত করা যাক প্রথম সুরা ফাতেহা-র উপর। ফাতেহা সুরার অনুবাদ বাংলা ও ইংরাজী ভাষায় নীচে দেওয়া হলো।

 

 

95 Quran ideas | quran, holy quran, quran pak

“সকল প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই,

যিনি দয়াময়, পরম দয়ালু,

কর্মফল দিবসের মালিক।

আমরা শুধু তোমারই ‘ইবাদত করি, শুধু তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি,

আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন কর,

তাহাদের পথ, যাহাদেরকে তুমি অনুগ্রহ দান করিয়াছ,

তাহাদের পথ নহে, যাহারা ক্রোধ নিপতিত, পথভ্রষ্ট।”

ফাতেহা সুরার ইংরাজী অনুবাদ হলো নিম্নরূপঃ  

“All praise to Allah, Lord of

all the worlds,

The Gracious, the Merciful,

master of the Day of Judgement.

Thee alone do we worship and

Thee alone do we implore for help.

Guide us in the right path –

The path of those on whom Thou

Hast bestowed Thy blessings, those

who have not incurred Thy displeasure,

and those who have not gone astray.”

উপরে উদ্ধৃত লাইনগুলি আরবীতে লেখা একটি কবিতার অনুবাদ। কবিতাটি হলো কোরানের প্রথম সুরা যার নাম ফাতেহা। মুসলিমদের কাছে কোরানের প্রত্যেকটি কথাই মহা পবিত্র ও সওয়াবপূর্ণ। সওয়াব (নেকি বা পূণ্য) হলো মুসলিমদের আখেরাতের (পরকালের) সঞ্চয় যার দ্বারা মেলে জাহান্নামের আগুন থেকে চিরমুক্তি এবং বেহেস্তে (স্বর্গে) একটি সুরম্য কুঠুরি।  সেখানে প্রত্যেক বেহেস্তিকে অপার আনন্দ ও সুখ দেবার জন্যে অপেক্ষায় থাকে বাহাত্তর জন হুরি (উর্বশী)। কোরান তেলায়ত করলে (পাঠ করলে) কিংবা কোরানের কিছু অংশ আবৃত্তি করলে, এমনকি কোরান তেলায়ত শুনলেও প্রচুর সওয়াব হয়। নামাজের প্রত্যেক রাকাতেই ফাতেহা সুরাটি আবৃত্তি করা বাধ্যতামূলক। দিনে ও রাতে (পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে) ফরজ ও সুন্নত মিলিয়ে মোট ৩৬ রাকাত নামাজ পড়ার নির্দেশ রয়েছে মুসলমানদের প্রতি। এটা মুসলমানদের হানাফি মোজাহাবের নিয়মানুসারে। সাফি মোজাহাবের মুসলমানরা অবশ্য হানাফিদের তুলনায় কম রাকাত নামাজ পড়ে। সুতারাং  হানাফিদের প্রতিদিন ফাতেহা সুরাটি কমপক্ষে ৩৬ বার আবৃত্তি করতে হয়। যেহেতু কোরান যত বেশি আবৃত্তি বা পড়া হয় তত বেশি নেকি পাওয়া যায় সেহেতু কোরানের এই সুরাটি (ফাতেহা সুরা) মনে হয় সবচেয়ে বেশি সওয়াবপূর্ণ।

কোরান পাঠ করা বা কোরান পাঠ শোনা প্রচুর সওয়াবের কাজ। কেন? কারণ, কোরানের লেখক স্বয়ং আল্লাহ্‌। কোরান আরবী ভাষায় লেখা একটি গ্রন্থ। সেজন্যে নামাজ পড়ার সময় কোরানের সুরাগুলো আবৃত্তি করতে হয় হুবহু কোরানের ভাষাতেই অর্থাৎ আরবীতেই। ফলত অনারব মুসলমানদের ৯৫ শতাংশই নামায পড়ার সময় ভুলভাল উচ্চারণে আবৃত্তি করে এবং যা আবৃত্তি করে তার মানে কিছুই বোঝে না। কিন্তু তবু তারা এই বিশ্বাসে দৃঢ় থাকে যে, নামাজে যে সুরাগুলি তারা আবৃত্তি করে তাতে আখেরাতের জন্যে তাদের অঢেল নেকি হয়। এই কথাটি একইভাবে প্রযোয্য যারা কোরান তেলায়ত করে তাদের জন্যেও।

কোরান আল্লাহ্‌র লিখিত একটা কেতাব, এই বিশ্বাসে মুসলমানরা আসমুদ্রহিমাচল পাহাড়ের মতন দৃঢ়ভাবে স্থির ও অটল। বলা বাহুল্য যে, এই বিশ্বাস তারা পোষণ করে কোরানের কথাগুলোর অর্থ না বুঝেই এবং বোঝার কোনো চেষ্টা না করেই। কিন্তু ফাতেহা সুরাটির যা অর্থ তা কিন্তু মুসলমানদের সেই বিশ্বাসের মূলেই আঘাত করার জন্যে যথেষ্ট। কারণ, আল্লাহ্‌র যে ভাষায় কথা বলার কথা ফাতেহা সুরার কথাগুলি তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফাতেহা সুরাটি যেভাবে ছন্দ মিলিয়ে রচিত হয়েছে তাতে সুরাটিকে একটি কবিতা হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে। সুরাটির অনুবাদও করা হয়েছে চমৎকারভাবে অত্যন্ত সহজ ও সরল ভাষায় এবং কবিতার ঢঙেই। ফলে বাংলা ও ইংরাজী ভাষাতে অনূদিত কবিতাতেও ফাতেহা সুরার অর্থগুলো সহজবোধ্য হয়ে উঠেছে। তথাপি আরও সহজ করে তোলার জন্যে সুরাটি গদ্যাকারে লেখা যেতে পারে। কবিতার গদ্যরূপটি আমাদের আরও বেশী সহায়ক হয়ে উঠবে এটা বোঝার জন্যে যে সুরাটি আসলে কার লেখা – আল্লাহ্‌র না মানুষের ? গদ্যরূপটি নিম্নরূপঃ

“হে পরম দয়ালু আল্লাহ্‌! তুমি জগৎ সংসার ও শেষ বিচারদিনের মালিক, সব প্রশংসা শুধু তোমারই প্রাপ্য। আমি/আমরা শুধু তোমারই ইবাদত (উপাসনা) করি ও তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি, অনুগ্রহ করে আমাদের সরল পথ দেখাও যাতে পথভ্রষ্ট হয়ে তোমার ক্রোধে না পড়ি।” (‘হে’ শব্দটি ফাতেহা সুরায় নেই। শব্দটি যোগ করা হয়েছে কবিতাটির গদ্যরূপকে শ্রুতিমধুর ও আরও সহজবোধ্য করে তোলার জন্যে। ‘হে’ শব্দটি আরোপিত হলেও তার ফলে সুরাটির অর্থ এতটুকু বিকৃত হয় নি।) 

ফাতেহা সুরাটির গদ্যরূপ থেকে এটা আরও স্পষ্ট হয় যে সুরাটি আর যার কারো লেখা বা বাণীই হোক না কেন, আল্লাহ্‌র নিশ্চয় নয়। সেটা এজন্যে যে আল্লাহ্‌ তার নিজের প্রশংসা নিজেই করবে এটা অবিশ্বসযোগ্য ও অযৌক্তিক। আবার এটাও অবিশ্বাস্য ও অবাস্তব যে আল্লাহ্‌ স্বয়ং পথভ্রষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করে তাকে সঠিক ও সরল পথ দেখানোর জন্যে অন্য কারও কাছে প্রার্থনা করবে। আল্লাহ্‌ কারো কাছে কিছু পাওয়ার জন্যে প্রার্থনা করছে এমনটা যদি হয় তাহলে তো আল্লাহ্‌র অদ্বিতীয়ত্ব ও সর্বময় কর্তৃত্বের দাবিটি সম্পূর্ণ নস্যাৎ বা খারিজ হয়ে যায়।  সুতরাং তৎক্ষণাৎ এটাও খারিজ হয়ে যায় যে ফাতেহা সুরাটি আল্লাহ্‌র লেখা বা তার প্রেরিত একটি বাণী। তাহলে প্রশ্ন হলো, ফাতেহা সুরাটি তবে কার লেখা? সুরাটি যেহেতু প্রমাণিত হয় যে আল্লাহ্‌র লেখা নয়, সুতরাং এটাই প্রতীয়মান হয় যে এর রচিয়তা কোনো একজন মানুষ। আর সেই মানুষটি কে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

মুসলমানদের ইসলামের প্রতি অগাধ বিশ্বাসের প্রধান ভিত্তি হলো আল্লাহ্‌র নবী তথা মুহাম্মদ এবং তাঁর কাছে প্রেরিত আল্লাহ্‌র গ্রন্থ কোরান। কিন্তু এটা যদি প্রতীয়মান হয় যে কোরান আল্লাহ্‌র প্রেরিত কোনো গ্রন্থ নয়, ওটার স্রষ্টা বা রচিয়তা হলেন মুহাম্মদ নিজেই, তাহলে মুসলমানদের অগাধ বিশ্বাসের ভিতটাই তো নড়-বড়ে ও ভঙ্গুর হয়ে যায়। আর তেমনটা হলে তো ইসলামের আকাশচুম্বী ইমারতের ভবিষ্যতটাও বিপন্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু সেটা তো হতে দেওয়া যায় না। তাই ইসলাম ধর্মের পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ  চাতুরী ও মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বেসামাল পরিস্থিতিটা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তারা বলেন যে, ফাতেহা সুরাটি শুরু হয়েছে 'কুল' শব্দ দিয়ে যেটা কোরানে উহ্য রয়েছে। 'কুল' শব্দটির বাংলা ও ইংরাজী প্রতিশব্দ হলো যথাক্রমে 'বলো' ও 'say'। 

 'কুল' শব্দটি নিয়ে ঐ ধর্মীয় গুরুদের দাবিটি যে সম্পূর্ণ মনগড়া তা প্রমাণ করা খুব কঠিন নয়। দুটো উদাহরণ দেওয়া যাক। প্রথমত, আরবি 'কুল' শব্দটি উহ্য আছে এই দাবির সপক্ষে তারা বিশ্বাসযোগ্য ও যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ দিতে দিতে পারেন নি। দ্বিতীয়ত, কোরানে কিছু সুরা আছে যেগুলি শুরুই হয়েছে 'কুল' শব্দটি দিয়ে। সেই সুরাগুলোয় উক্ত শব্দটি উহ্য রাখা হয় নি, কেবল ফাতেহা সুরাতেই উহ্য রাখা হয়েছে, এটা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। সুতরাং এটা প্রমাণ করে যে, ফাতেহা সুরা 'কুল' শব্দ দিয়ে শুরু হয় নি। কোরানের কিছু সুরা যে 'কুল' শব্দ দিয়ে শুরু হয়েছে তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। সেই সুরাগুলি হলো, সুরা নম্বর ১১২ ও ১১৩। ১১২ নং সুরা ইখলাস শুরু হয়েছে এভাবে - "বলুন, তিনি আল্লাহ্‌, এক, ...।" (আরবি ভাষায় কথাটি হলো - "কুল হু আল্লাহো আহাদ")  আর ১১৩ নং সুরা ফালাক শুরু হয়েছে এভাবে - "বলুন, আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি প্রভাতের পালনকর্তার,"। (আরবিতে কথাটি হলো - কুল আউজো বেরাব্বিল ফালাকে)

শুধু ফাতেহা সুরাই নয়, আসলে সমগ্র কোরান গ্রন্থটিই মুহাম্মদের নিজের সৃষ্টি। এর প্রমাণ আমরা পাই কোরানের মধ্যেই। কোরানে ফাতেহা সুরার মতন আরও বহু সুরা আছে যেগুলি বিশ্লেষণ করলেও আমরা দেখতে পাবো যে সেগুলিরও স্রষ্টা মানুষ, তথাকথিত মহান সৃষ্টিকর্তা নয়।  তার কয়েকটা নমুনা দেওয়া যাক।    

দেখা যাক কোরানের ১১১ নং অধ্যায়ে তথা সুরা আবু লাহাবে কী লেখা আছে। এই সুরাটির বঙ্গানুবাদ হলো এরূপঃ

ধ্বংস হোক আবু লাহাবের হস্তদ্বয় এবং ধ্বংস হোক সে নিজেও।

তার ধন সম্পদ ও তার উপার্জন তার কোন উপকারে আসেনি।

অচিরেই সে শিখা বিশিষ্ট নরকানলে প্রবেশ করবে

এবং তার স্ত্রীও যে ইন্ধন বহন করে,

তার গলদেশে খর্জুর বল্কলের রজ্জু রয়েছে।

সুরাটির ইংরাজী অনুবাদ নিম্নরূপঃ

Perished be the two hands of Abu Lahab, and he will perish. 

His wealth and what he has

earned shall avail him not.

Soon shall he enter into a blazing fire;

And his wife too, who goes about

slandering.

Round her neck shall be a halter

of twisted palm-fibre.

আবু লাহাব সুরায় ‘আবু লাহাব’ নামে জনৈক ব্যক্তি ও তার স্ত্রীর ধ্বংস ও কঠোর শাস্তি কামনা করা হয়েছে। আল্লাহ্‌কে যদি মানা হয় তার নির্দেশেই সকল প্রাণীর সৃষ্টি ও মৃত্যু হয় তবে তিনি তো কারও ধ্বংস ও শাস্তি কামনা করবেন না, তিনি তার শাস্তি ও ধ্বংসের (মৃত্যুর) নিদান দেবেন। সুতরাং যিনি আবু লাহাব ও তার স্ত্রীর শাস্তি ও ধ্বংস কামনা করেছেন তিনি নিশ্চয়ই একজন মানুষ, আল্লাহ্‌ নন। বলা বাহুল্য যে তিনি ছিলেন মুহাম্মদ। 

‘আবু লাহাব’ সুরাটির কথাগুলো যে মুহাম্মদের নিজের কথা তা প্রমাণ করা যায় অন্য পথেও। সেটা এরূপঃ

আবু লাহাব ছিলেন মুহাম্মদের আপন চাচা। মুহাম্মদের পিতারা ছিলেন ১০ ভাই, মতান্তর ১৪ ভাই। তাঁদের মধ্যে শুধু হামজা মুহাম্মদের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। সেটা একটি বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, মুহাম্মদ নবী এমন বিশ্বাস থেকে নয়। দু’জন চাচা আবু তালেব ও আব্বাস ছিলেন মুহাম্মদের প্রতি খুবই স্নেহশীল ও সহানুভূতিশীল ছিলেন। কিন্তু আবু তালেব মুহাম্মদকে তাঁর ধর্ম প্রচারে নানাভাবে সহযোগিতা করলেও আমৃত্যু ইসলাম গ্রহণ করেন নি। আর আব্বাস ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন মুহাম্মদের মক্কা বিজয়ের পর। আবু লাহাব কিন্তু মুহাম্মদকে আল্লাহ্‌র নবী বলে বিশ্বাস করতেন না এবং ইসলাম ধর্মের ছিলেন ঘোরতর বিরোধী। বাকি চাচাদের কথা ইসলামের ইতিহাসে তেমন শোনা যায় না। যতদূর শোনা যায়, তাঁরা ইসলামের প্রতি অনুরাগী ছিলেন না, কিন্তু ইসলামের বিরুদ্ধেও যান নি।

মুহাম্মদ ১২ বছর ধরে মক্কায় ইসলাম ধর্মের প্রচার করেছিলেন। কিন্তু মক্কার মানুষরা (কোরেশগণ) মুহাম্মদ ও তাঁর ধর্ম ইসলামকে প্রত্যাখান করেন এবং ইসলাম ধর্মের প্রচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ফলে মুহাম্মদ এক সময় মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় চলে যেতে বাধ্য যান। তাঁর শিষ্যরা পাছে আবার ইসলাম ত্যাগ করে স্বধর্মে ফিরে যায় এই ভয়ে তাদের তিনি আগেভাগেই মক্কা থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। 

মুহাম্মদের বংশ বাদে মক্কার কোরেশদের সমস্ত বংশ ও গোত্রের প্রভাবশালী মানুষরা মুহাম্মদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনের পুরভাগে ছিলেন। একমাত্র আবু লাহাবই ছিলেন ব্যতিক্রম যিনি মুহাম্মদের চাচা হয়েও প্রতিরোধ আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কোরেশদের মধ্যে মুহাম্মদ ও তাঁর ধর্মকে প্রতিহত করতে যাঁরা বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে যেমন আবু লাহাব ছিলেন, তেমনি ছিলেন আবু সুফিয়ান, আবু জেহেল প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ। আবু লাহাব অপেক্ষা আবু সুফিয়ান ও আবু জেহেলকেই মুহাম্মদ আল্লাহ্‌র ধর্ম ইসলামের বড়ো শত্রু বলে চিহ্নিত করেছিলেন। মুহাম্মদ বলেছেন যে মক্কায় তাঁকে হত্যা করার যে পরিকল্পনা ছক কষা হয়েছিলো তার হোতা ছিলেন আবু জেহেলই। আবু সুফিয়ানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন যে তিনি মদিনায় গিয়ে মুহাম্মদ ও মুসলমানদের সমূলে বিনাশ করার পরিকল্পনা করেছিলেন। সেই উদ্দেশ্যে তিনি বাণিজ্যের নামে সিরিয়া গিয়েছিলেন অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করতে।

কোরানে কিন্তু শুধু আবু লাহাবের নামেই সুরা আছে যেখানে তাঁর ধ্বংস ও কঠোর শাস্তি চাওয়া হয়েছে। আবু জেহেল ও আবু সুফিয়ান সহ অন্য কোরেশ নেতা বা দলপতিদের বিরুদ্ধে তাঁদের নাম ধরে কোনো সুরা কিন্তু নেই। এখানেই ঘোরতর সন্দেহ আমাদের মনে উঁকি দেয় যে, যারা ইসলামের সবচেয়ে বড়ো শত্রু তাদের বাদ দিয়ে আল্লাহ্‌ শুধু আবু লাহাবের বিরুদ্ধেই তাঁর নাম ধরে সুরা নাযিল করবে কেন? ‘আবু লাহাব’ সুরার প্রেরক বা রচয়িতা আল্লাহ্‌ হলে তিনি ইসলামের শত্রু কোরেশদের অন্য প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নামেও সুরা নাযিল করতেন, বিশেষ করে আবু সুফিয়ান ও আবু জেহেলের নামে তো বটেই। সুতরাং এটা স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে ‘আবু লাহাব’ সুরার রচয়িতা স্বয়ং মুহাম্মদই, আল্লাহ্‌ বা অন্য কেউ নয়।  

এখন প্রশ্নটি হলো মুহাম্মদ কোন উদ্দেশ্যে এবং কেন আবু লাহাবের নাম ধরেই আল্লাহ্‌র ওহির নামে ‘আবু লাহাব’ সুরাটি আবৃত্তি করেন? উদ্দেশ্য যে ভয় দেখিয়ে আবু লাহাবকে পক্ষে টানার চেষ্টা করা, নিদেন পক্ষে চুপ করিয়ে দেওয়া, তা তো সুরাটির বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট। এর পর যে প্রশ্নটির উৎপত্তি হয় সেটা হলো, ইসলাম ও মুহাম্মদের শত্রুপক্ষের শুধু আবু লাহাবকেই ভয় দেখাতে ওহির অবতারণা কেন করা হয়েছিলো? এর উত্তর রয়েছে তৎকালীন সময়ে মক্কার পরিস্থিতির গর্ভে। সেই পরিস্থিতিটি কেমন ছিলো তার উপর চোখ রাখা যাক। পরিস্থিতিটি ছিলো নিম্নরূপঃ

‘আবু লাহাব’ সুরাটির আদি ক্রমিক নম্বর হলো ছয়, যদিও কোরানে রয়েছে শেষের দিকে, ১১১ নম্বর স্থানে। অর্থাৎ সুরাটি ইসলামের একেবারের গোঁড়ার দিকের। ইসলামের একেবারে গোড়ায় মুহাম্মদ সংগোপনে তাঁর ধর্মের প্রচার করতেন। যবে থেকে তিনি প্রকাশ্যে প্রচারণা শুরু করেন তখন থেকেই মক্কার লোকেরা পদে পদে নানারূপ বাধা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতো। কোরেশরা মুহাম্মদের ধর্ম ও নবীত্ব নিয়ে হাসি-ঠাট্টা ও মস্করা করলেও তিনি তাঁর প্রতিবাদ করতেন না, নীরবে সবই সহ্য করতেন। সেই পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টায় হামজা ওমর বিন খাত্তাব ইসলাম গ্রহণ করার পর। আবু জেহেল নামে একজন কোরেশ দলপতি একদিন পথিমধ্যে মুহাম্মদকে তাঁর মুখের সামনে ভণ্ড, প্রতারক, মিথ্যাবাদী, ক্ষমতালোভী ইত্যাদি বিশেষণে বিদ্ধ করে যাচ্ছেতাই অপমান করেন। তখনও হামজা মুসলমান হন নি। কিন্তু তাঁর ভাতিজা মুহাম্মদের অপদস্থ হওয়ার কথা শোনা মাত্রই আবু জেহেলের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এবং সমস্ত কোরেশদের উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বলেন, আমি এই এখন থেকেই নিজেকে মুসলমান বলে ঘোষণা করলাম। আয়, আমাকে এসে অপমান কর, কার হিম্মত আছে দেখি। তারপর তিনি আবু জেহেলকে খুঁজে বের করে শক্ত একটা ডাণ্ডা দিয়ে মেরে তাঁর মাথা ফাটিয়ে দেন। এই ঘটনায় স্বভাবতই মুহাম্মদ ও তাঁর শিষ্যদের মনোবল কিছুটা বৃদ্ধি পায়। তার কিছুদিন পর ওমর মুসলমান হন। তারপরই মুহাম্মদ তাঁর শিষ্যদের প্রকাশ্যে নামাজ পড়ার নির্দেশ দেন। হামজা ও ওমর মুসলমান হওয়ার ফলে মুহাম্মদ তাঁর ধর্মের প্রচারে কিছুটা যে সুবিধা পেয়েছিলেন তা সন্দেহাতীত। কিন্তু তাতেও বিশেষ লাভ হয় নি। কারণ, উল্টোদিকে কোরেশরা  আরও এককাট্টা হয়ে মুহাম্মদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সেই প্রতিরোধের মুখে মুহাম্মদ ও তাঁর শিষ্যরা একেবারে কোনঠাসা হয়ে পড়ে।     

এহেন পরিস্থিতিতে মুহাম্মদ উপলব্ধি করেন যে, কোনঠাসা অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে হামজা ও ওমরের মতন অন্তত আর একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে দলে টানতে হবে। কিন্তু তখন তো তাঁর বংশ ও গোত্রের বাইরে কোরেশদের কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তিকে দলে টানার মতন পরিস্থিতি ছিলো না। তাই তিনি তাঁর চাচা আবু লাহাবকেই যে কোনো মূল্যে তাঁর শিকার বানানোর বিষয়ে মনস্থির করেন। তারজন্যে কোনো চেষ্টা করতেই তিনি বাকি রাখেন নি। কখনও ভাতিজা হিসাবে তাঁর কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করার জন্যে কাকুতিমিনতি করেছেন, কখনও বংশের লোকদের দিয়ে তাঁর উপর একটা সম্মিলিত চাপ সৃষ্টি করেছেন। সে সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে জাহান্নামের ভয় ও বেহেস্তের লোভও দেখিয়েছেন। কিন্তু তাঁর কোনো প্রচেষ্টাই কাজে আসে নি। যখন তিনি বুঝতে পারলেন যে আবু লাহাব তাঁর শত অনুরোধ ও হুমকিতেও দমবার পাত্র নয়, তখন তিনি আল্লাহকে দিয়ে ভয় দেখানোর কৌশল নেন। আর তারই ফলশ্রুতি হলো সুরা ‘আবু লাহাব’। হ্যাঁ, মুহাম্মদ সুরাটি নিজেই তৈরি করে আল্লাহ্‌র ওহি বলে আবৃত্তি করেন এবং বাইরে ছড়িয়ে দেন।

আল্লাহ্‌র ভয় দেখিয়ে কাজ হাসিল করার চাতুরি মুহাম্মদ তাঁর সমগ্র জীবনে বারবার করেছেন। সেটা শুধু যে অবিশ্বাসীদের সঙ্গেই করেছেন তা নয়, তাঁর শিষ্য ও স্ত্রীদের সঙ্গেও করেছেন। তার বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় কোরানের বিভিন্ন সুরায় বা আয়াতে (বাক্যে)। এমন দৃষ্টান্তও আছে যে মুহাম্মদ তাঁর স্ত্রীদের মুখ বন্ধ করার জন্যে তালাকের ভয় দেখিয়েছেন ওহির মাধ্যমে। অনুরূপ বহু ঘটনা (ভয় দেখানো) দেখতে পাওয়া তাঁর শিষ্যদেরও বেলাতেও। জিহাদের অভিযানে মুসলমানরা যখন কোনো কারণে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দেয় নি তখন তাদেরও ভয় দেখাতে তিনি বহু ওহির অবতারণা করেছেন। ওহির মাধ্যমে স্ত্রীদের ভয় দেখানোর ঘটনাটা প্রথমে আলোচনা করা যাক।

স্ত্রীদের তালাক দেওয়া সহ কঠোর শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে বহু আয়াতে। তার মধ্যে দুটি আয়াত হলো আহযাব সুরার ২৮ ও ৩০ নম্বর আয়াত। আয়াত দু’টি উদ্ধৃত করার আগে অতি সংক্ষেপে কয়েকটা কথা বলা দরকার। কথাগুলি মুহাম্মদের দাম্পত্য জীবন নিয়ে। কোরান থেকে জানা যায়, মাঝেমধ্যেই মুহাম্মদের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীদের ঝগড়াঝাঁটি হতো। কোরানের তাহরিম সুরার বহু আয়াতেই তার স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। আহযাব সুরাতেও রয়েছে। এই সুরাতেই রয়েছে স্ত্রীদের তালাক দেওয়া ও কঠিন শাস্তির ভয় দেখানো বিশ্রী আয়াত দু’টি। তফসির সহ আয়াত দু’টির বাংলা তর্জমা নীচে দেওয়া হলো – 

·            হে নবী (সঃ)! তুমি তোমার স্ত্রীদের বলঃ তোমরা যদি পার্থিব জীবন ও তার ভূষণ কামনা কর, তবে এসো, আমি তোমাদের ভোগ-সামগ্রীর ব্যবস্থা করে দিই এবং সৌজন্যের সাথে তোমাদেরকে বিদায় দিই।    (৩৩/২৮)

·          হে নবী-পত্নীরা! যে কাজ স্পষ্টত অশ্লীল, তোমাদের মধ্যে কেউ তা করলে, তাকে দ্বিগুণ শাস্তি দেয়া হবে এবং এটা আল্লাহ্‌র জন্য সহজ। (৩৩/৩০) 

৩৩/২৮ নম্বর আয়াতের তফসিরঃ

·         এ আয়াতে আল্লাহ্‌ তা’আলা স্বীয় নবী (সাঃ)-কে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তিনি যেন তাঁর সহধর্মিণীদের দু’টো জিনিসের একটি বেছে নেয়ার স্বাধীনতা প্রদান করেন। যদি তারা পার্থিব জগতের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, সৌন্দর্য ও জাঁক-জমক পছন্দ করে তবে তিনি যেন তাদেরকে তাঁর বিবাহ-সম্পর্ক হতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেন।  (দ্রঃ ইবনে কাসিরের তফসির, পঞ্চদশ অধ্যায়, পৃ – ৭৭৭)  

৩৩/৩০ নম্বর আয়াতের তফসিরঃ

·         ... যদি তোমরা নবী (সঃ)-এর অবাধ্যাচরণ কর কিংবা তোমাদের দ্বারা কোন নির্লজ্জতাপূর্ণ কাজ সংঘটিত হয়ে যায় তবে জেনে রেখো যে, দুনিয়া ও আখিরাতে তোমাদের দ্বিগুণ শাস্তি হবে। (দ্রঃ – ঐ, পৃ – ৭৮০)

আয়াত দু’টির ভাষ্য থেকে বোঝা যাচ্ছে যে মুহাম্মদের স্ত্রীরা তাঁর প্রতি বেজায় অসন্তুষ্ট ছিলেন যা মুহাম্মদের দাম্পত্য জীবনের সুখ ও শান্তিকে যথেষ্ট বিঘ্নিত করে তুলেছিলো। যিনি আল্লাহর নবী তাঁর প্রতি তাঁর পত্নীদের অসন্তুষ্ট থাকার ঘটনা সাধারণভাবে বিষ্ময়কর এবং অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য বলে মনে হবে। কিন্তু ঘটনাটা একশ’ শতাংশ সত্যি ও বাস্তব। কারণ, মুহাম্মদ এমন অনেক কাজই করেছেন যার ফলে তাঁর স্ত্রীদের তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিলো। সে রকম কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাক। এক. একজন নবী হয়েও স্ত্রীদের অনুমতি না নিয়েই তিনি একের পর এক বিয়ে করেছেন। দুই. নিজের দত্তক পুত্রের তালাকপ্রাপ্তা বধূ জয়নাবকে বিয়ে করেছেন। তিন. মিথ্যা অজুহাতে জয়নাবের ঘরে অনেক বেশি সময় কাটাতেন। চার. পত্নী হাফসার অনুপস্থিতিতে তাঁর ঘরে উপপত্নী মারিয়ার সঙ্গে যৌন-মিলন করেছেন, ইত্যাদ।

আল্লাহ্‌ সকল মানুষের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা এবং ন্যায়বিচারক বলে কোরানে অসংখ্যবার দাবি করা হয়েছে। আল্লাহ্‌ বলে কেউ থাকলে তার তো সে রকমই হওয়ার কথা। কিন্তু উপরের দু’টি আয়াতে দেখা যাচ্ছে যে, যে একটার পর একটা দোষ করেছে আল্লাহ্‌ তাকেই পুরষ্কৃত করেছে, এবং উল্টোদিকে যারা উপেক্ষা, বঞ্চনা, অবহেলা ও অপমানের শিকার তাদেরই শাস্তি দেওয়া হয়েছে। সাধারণ জ্ঞান ও যুক্তি থেকেই বোঝা যায় যে এমন বিচার আল্লাহ্‌ করতে পারে না যদি সে সত্যিই কোথাও থেকে থাকে। অন্যায় ও অবিচার করার ত্রুটি একমাত্র মানুষই করতে পারে। সুতরাং এটা সংশয়াতীত যে আয়াত দু’টির কথা মুহাম্মদের নিজেরই, আল্লাহ্‌র নয়।   

এবার একটি আয়াত নিয়ে আলোচনা করা হবে যেখানে জিহাদে যেতে গড়ি-মসি করা শিষ্যদের ওহির মাধ্যমে ভয় দেখানো হয়েছে। সে রকম একটি আয়াত হলো ৯/৩৯ নম্বর আয়াত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে এ রকম বহু আয়াত আছে কোরানে যে সব আয়াতের কোনোটাই জাহান্নামের ভয় দেখানো হয়েছে, আবার কোনোটাই বেহেস্তের লোভ দেখানো হয়েছে। ৯/৩৯ নম্বর আয়াতের বাংলা অনুবাদ ও তফসির হলো –

·         যদি বের না হও তবে আল্লাহ্‌ তোমাদের মর্মন্তুদ আযাব দেবেন এবং অপর জাতিকে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন। তোমরা তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না, আর আল্লাহ্‌ সর্ববিষয়ে শক্তিমান। (৯/৩৯)

আয়াতটির তফসির হলো -

·     প্রচণ্ড গরমের সময় মুহাম্মদ তাঁর বাহিনী নিয়ে তাবুক অভিযানে বেরিয়েছিলেন। সে সময় মুসলমানরা অনেকেই তাদের নবীর ডাকে সাড়া দেন নি। তখন তাদের ভয় দেখাতে উক্ত ওহিটির অবতারণা করা হয়েছিলো।  (দ্রঃ ইবনে কাশিরের তাফসির, অষ্টম-একাদশ খণ্ড, পৃ-৭০৫)  

এ লেখাটি লেখা হয়েছে একজন আস্তিক তথা ঈশ্বরের দৃষ্টিকোণ থেকে, নাস্তিকের দৃষ্টিকোণ থেকে একদমই নয়। নাস্তিকের চিন্তাভাবনা থেকে লিখলে এ ধরণের কোনো লেখার প্রয়োজনই হয় না। কারণ, তারা আল্লাহ তথা ঈশ্বরের অস্তিত্বকেই স্বীকার করে না।    

আস্তিক মুসলিমদের মধ্যে যেমন ব্যাপক অংশের একেবারে নিরেট গোঁড়া বা ধর্মান্ধ রয়েছে তেমনি রয়েছে বহু মানুষও যারা সম্পূর্ণ গোঁড়া নয়। এই দ্বিতীয় শ্রেণির মুসলমানদের মধ্যে অল্পবিস্তর হলেও যুক্তি, বুদ্ধি ও বিচার বোধ প্রয়োগের ইচ্ছা, আগ্রহ ও ভাবনা রয়েছে। আমার এ লেখাটি মূলত এদের উদ্দেশ্যেই। সেজন্যেই লেখাটি সাজানো হয়েছে চারটি সম্পূর্ণ সুরা (সুরা ফাতেহা, আবু লাহাব, ইখলাস ও ফালাক) এবং ৩৩ নম্বর সুরা আহযাব৯ নম্বর সুরা তওবার তিনটি আয়াত দিয়ে। এই সুরা ও আয়াতগুলি বিশ্লেষণ করা হয়েছে বিভিন্ন নিরিখ থেকে। বিচার ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে তফসির সহ সুরা ও আয়াতগুলির বক্তব্য, উদ্দেশ্য, পরিপ্রেক্ষিত এবং সমকালীক পরিবেশ ও পরিস্থিতি। সমস্ত দিক বিচার ও বিশ্লেষণ করার পরই এ বিষয়ে নিঃসংশয় হওয়া গেছে কোরান হলো মানুষের লেখা একটি গ্রন্থ, আল্লাহ্‌ নামক তথাকথিত কোনো সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার লেখা নয়।

 

 

 

 

 

 

 

Friday, June 25, 2021

নবীর অশেষ যন্ত্রণাময় মৃত্যু ও তাঁর শবদেহের অশেষ লাঞ্ছনা

মসজিদে নববী: মহানবী (সা.)-এর সব কাজ-কর্মের প্রাণকেন্দ্র

মসজিদে নববী, ২০১২ সালের ছবি

মুহাম্মদ নিজেই বলেছিলেন তিনিই আল্লাহর প্রেরিত সর্বশ্রেষ্ঠ ও শেষ নবী, আল্লাহ পৃথিবীতে আর কখনও কোনো নবী পাঠাবে না। অথচ সর্বশ্রেষ্ঠ ও শেষ নবীকেই কিনা মৃত্যুর আগে পনেরো দিন ধরে ভোগ করতে হয়েছিলো সীমাহীন যন্ত্রণা ও কষ্ট যা অন্য কোনো নবীকে ভোগ করতে হয় নি!  আল্লাহর শেষ নবীরে মৃত্যু কীভাবে হয়েছিলো তাও নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। শুধু এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় যে কোনো যুদ্ধে কিংবা গুপ্তঘাতকের আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয় নি। অর্থাৎ তাঁর মৃত্যু ছিলো একটা স্বাভাবিক ঘটনা। সুতরাং এটাও সন্দেহাতীত যে তাঁর মৃত্যু হয়েছিলো হয় কোনো অসুখে কিংবা অন্য কোনো কারণে। এ বিষয়ে তিনটি মত শোনা যায় বিভিন্ন সূত্র থেকে থেকে। একটি মত হলো বিষক্রিয়ায় তাঁর মৃত্যু হয়। দ্বিতীয় মতটি হলো সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। এবং তৃতীয় মতটি হলো ম্যানেনজাইটিস রোগে তিনি মারা যান।

নবীর অশেষ মৃত্যুযন্ত্রণা

প্রথম অভিমতঃ  বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর  প্রসঙ্গে -

বিষক্রিয়ায় মৃত্যু নিয়ে দু’টি ঘটনার কথা শোনা যায়। প্রথম ঘটনাটি হলো এ রকম – ৬২৮ খৃস্টাব্দে মৃত্যুর চার বছর আগে খায়বার যুদ্ধ শেষে মদিনায় ফিরে আসার আগে সেখানকার একজন সম্ভ্রান্ত ইহুদী নারী, সাললাম বিন মিশকান এর স্ত্রী যয়নাব বিনতে আল-হারিথ, তাঁর বাড়িতে নবীকে খাবার দাওয়াত (নিমন্ত্রণ) দেন। সেই দাওয়াত তিনি কবুল (স্বীকার) করেন এবং তাঁর বাড়ি যান। তাঁর সঙ্গে ছিলো বিশর বিন আল-বারা নামের জনৈক একজন সাহাবী। সেই নারী তাঁদের খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দেন। মুহাম্মদ এক গ্রাস খাবার মুখে দিয়েই বুঝতে পারেন যে খাবার বিষ মিশানো আছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই মুখের খাবারটুকু ফেলে দেন এবং বিশর বিন আল-বারাকে বলেন, থাম, খাওয়া থামাও, খাবারে বিষ আছে। কিন্তু বিশর তৎক্ষণে এক গ্রাস খাবার খেয়ে ফেলেছে। ফলে বিশর তৎক্ষণাৎ মারা যায়। মুহাম্মদের শরীরেও ততক্ষণে বিষক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু যেহেতু খাদ্যটুকু গলাধঃকরণ করেন নি তাই সে যাত্রা তিনি মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। মুসলিম ঐতিহাসিকরা অনেকেই বিশ্বাস করে সেই বিষক্রিয়ার জেরেই চার বছর পর তাঁর মৃত্যু হয়েছিলো। এ প্রসঙ্গে ড. ওসমান গণী লিখেছেন,

·         “খায়বারে তাঁকে এক ইহুদিনী নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানোর সময় খাদ্যে বিষ মিশিয়ে দেন। খাদ্যবস্তু মুখে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তা বুঝে ফেলে দিয়েছিলেন তবুও সামান্য জের তাঁর শরীরে থেকে গিয়েছিল। প্রথমে জ্বর ও মাথাব্যথা আরম্ভ হয়েছিল। তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর কাজ ঠিক নিয়মমাফিক করে যেতে থাকেন। তিনি আজ নিজেও অনুমান করে নিয়েছেন – তাঁর শেষ সময় আগত-প্রায়।” (মহানবী, পৃঃ-৩৮০)

যদি ধরে নেওয়া যায় খায়বারে  নবীর খাবারে বিষ মেশানোর  ঘটনাটা সত্যি তবে, এটাও সত্যি যে তাঁর শরীরে যে বিষক্রিয়া হয়েছিলো তা ছিলো অতিশয় নগণ্য। কারণ, সেই বিষক্রিয়ায় তখন তাঁর মৃত্যু হয় নি। সেই ঘটনাটি ঘটেছিলো ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু তাঁর মৃত্যু হয় ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে। অর্থাৎ খায়বারে বিষযুক্ত খাবার মুখে দেওয়া এবং মৃত্যুর মধ্যে ব্যবধান ছিলো চার বছর। বিজ্ঞানের আলোকে মুহাম্মদের মৃত্যুর কারণ বিচার করলে এটা কখনই যুক্তিগ্রাহ্য ও বিশ্বাসযোগ্য হয় না যে খায়বারে মুহাম্মদের শরীরে অতিশয় নগণ্য যে বিষক্রিয়া হয়েছিলো তাতেই নবীর মৃত্যু হয়েছিলো।

দ্বিতীয় ঘটনাটি হলো, নবী  যখন মৃত্যুর আগে কয়েকদিনের জ্বরে অসুস্থ হয়ে তীব্র মাথা যন্ত্রণায় অসহ্য কষ্ট পাচ্ছেন তখন তাঁর স্ত্রী মাইমুনা তাঁকে জ্বর ও মাথা যন্ত্রণার উপশম করার জন্যে একটি ওষুধ তৈরি করে খাওয়ান। ওষুধ তৈরি করা সময় তিনি তাতে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিলেন। সেই ওষুধ খেয়েই তাঁর মৃত্যু হয়েছিলো। কিন্তু অধিকাংশ ঐতিহাসিক এই অভিমতটিকে মনগড়া বলে নস্যাৎ করে দেন। তবে ইতিহাসকাররা স্বীকার করেছেন যে মুহাম্মদের জন্যে মাইমুনার নিজের হাতে ওষুধ তৈরি করে দিয়েছিলেন এবং সেই ওষুধ মুহাম্মদকে খাওয়ানোও হয়েছিলো। এ প্রসঙ্গে ইতিহাসে যে ঘটনার কথা শোনা যায় তা নিম্নরূপঃ 

·         প্রবল জ্বরে ও অসহ্য মাথা যন্ত্রণায় মুহাম্মদ খুবই কষ্ট পাচ্ছিলেন। সেই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে মাঝে মাঝেই তিনি মাগো বাবাগো, আর সহ্য হচ্ছে না বলে চিৎকার করতেন। মাঝে মাঝেই আবার কখনও মোটা সুতা দিয়ে কখনো কাপড় দিয়ে মাথা কষে বাঁধতেন। মাঝে মাঝেই তিনি  জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন, আবার কিছুক্ষণ পরই তাঁর জ্ঞান ফিরে আসতো।  জ্ঞান ফিরলে আবার তীব্র মাথা যন্ত্রণায় চিৎকার ও ছটফট করতেন। মৃত্যুর সময় এ রকম  অসহ্য তীব্র কষ্টের মধ্যে তাঁর পনেরো দিন অতিবাহিত হয়েছিলো। সে সময় সাহাবীরা সব সময়েই কেউ না কেউ তাঁর পাশে থাকতেন। একদিন আয়েশার ঘরে (সেখানেই মুহাম্মদের শেষ পনেরো দিন্ অতিবাহিত হয়েছিলো) তাঁর স্ত্রীরা সবাই উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন বেশ কয়েকজন সাহাবীও যাদের মধ্যে তাঁর চাচা আব্বাস বিন মোত্তালেবও ছিলেন। মুহাম্মদের স্ত্রী মাইমুনা তখন মুহাম্মদের অন্যান্য স্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করার সময় বলেন যে তিনি একটি ওষুধ তৈরি করতে জানেন যেটা খাওয়ালে জ্বর ও মাথাব্যথা সেরে যাবে। মুহাম্মদের স্ত্রীদের মধ্যে এটা নিয়ে যে আলোচনাটা হচ্ছিল সেটা আব্বাস শুনতে পান। তিনি মাইমুনাকে বলেন ওষুধটা তৈরি করতে। মাইমুনা তখন বলেন যে ওষুধটা খুবই তেতো তাই তিনি খেতে চান না। আব্বাস বলেন তুমি তৈরি করো আমি খাইয়ে দেবো। মাইমুনা ওষুধটা তৈরি করে আব্বাসের হাতে তুলে দেন। সে সময় নবীর জ্ঞান ছিলো না। আব্বাস সহজেই ওষুধটা নবীর মুখে ঢেলে দেন। নবীর জ্ঞান ফিরলে বুঝতে পারেন যে তাঁকে ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে। তখন ভীষণ রাগান্বিত হয়ে চিৎকার করে জানতে চান কে তাঁকে ওষুধ খাইয়েছে। আব্বাস তৎক্ষণাৎ তার দায় নেন। তাতেও তিনি শান্ত হন না। ঐ ওষুধটা আবার তৈরি করে তাঁর স্ত্রীদের তাঁর সামনেই পান করার নির্দেশ দেন। মাইমুনা ওষুধটা তৈরি করেন এবং নবীর স্ত্রীরা নবীর সামনে সেটা পান করেন। কিন্তু ওষুধ খাওয়ার পর সকল স্ত্রীরাই সুস্থ ছিলেন। মুহাম্মদ বুঝতে পারেন যে তাঁর ওষুধে বিষ মেশানো হয়েছিলো বলে তাঁর যে সন্দেহ হয়েছিলো সেটা অমূলক।               

দ্বিতীয় অভিমতঃ  সিফিলিস অসুখে মৃত্যু প্রসঙ্গে -

যারা বলে সিফিলিস রোগে নবীর মৃত্যু হয় তাদের যুক্তি হলো এ রকম। এটি ছোঁয়াচে রোগ এবং মূলত যৌন রোগ যেটা মানুষের দেহে বাসা বাঁধে প্রধানত যৌন সংসর্গের কারণে। সিফিলিস রোগে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির সঙ্গে মুখের ভিতর জিহ্বা সঞ্চালনের মাধ্যমে শারিরীক সম্পর্ক স্থাপন করলেও রোগটা ছড়িয়ে থাকে। সমকামীদের মধ্যেও তাই রোগটি ছড়াতে পারে। ফলে নারী ও পুরুষ উভয়েই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

যারা বলেন যে নবী সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তাদের বক্তব্য হলো এরূপঃ নবী বহুগামী ছিলেন এবং বিবাহ বহির্ভূত বহু নারীর সঙ্গে যৌন সংসর্গ করতেন। আরবে সেই সময় যতখুশী উপপত্নী ও দাসী রাখা এবং তাদের সঙ্গে অবাধে সঙ্গম করা ছিলো প্রচলিত বৈধ রীতি। নবী  নিজেকে আল্লাহর রসুল বলে দাবি করলেও সেই কুৎসিত সংস্কৃতি ও প্রথা বাতিল করেন নি। বরং সেই  সেগুলিকে আল্লাহর দোহাই দিয়ে বহাল রেখে তার ভিতকে আরও দৃঢ় করেছিলেন। তাই তাঁর শরীরে সিফিলিস রোগের বাসা বাঁধার যথেষ্ট আশঙ্কা ছিলো। তখন আরবে সিফিলিস ছিলো একটি দূরারোগ্য ব্যাধি এবং তাই অবশেষে ঐ রোগেই তাঁর জীবনাসান ঘটে। কিন্তু সিফিলিস রোগ হলে শরীরে তার নানা উপসর্গ প্রকাশ পায় যা নবীর মধ্যে পরিলক্ষিত হয় নি। সিফিলিসে আক্রান্ত মানুষের মধ্যে দুর্বলতা দেখা দেয়, শরীরের কিছু অঙ্গ-প্রতঙ্গ অবশ বা অসাড় হতে থাকে। ফলে একটা সময় সিফিলিস রোগীর কর্মক্ষমতা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু নবীর মধ্যে এগুলোর কোনোটারই প্রকাশ পরিলক্ষিত হয় নি। মৃত্যুর কিছুদিন আগে পর্যন্তও তিনি শারিরীকভাবে সক্ষম ছিলেন। সুতরাং সিফিলিসে নবীর মৃত্যু হওয়াটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।   

 প্রিয় নবীজির বাড়ি (ভিডিও) | Home of Prophet Muhammad in Mecca | Islamic  Light - YouTube

তৃতীয় অভিমতঃ  ম্যানেনজাইটিসে মৃত্যু প্রসঙ্গে -  

ম্যানেনজাইটিস রোগে নবী মারা যান বলে একদল ঐতিহাসিকের অভিমত। মানব শরীরের নানা অঙ্গে ইনফেকশন বা সংক্রমণ হয়। ইনফেকশন হয় যেমন লিভার, ফুসফুস, কিডনি ইত্যাদি শরীরে, তেমনি হয় মস্তিষ্কেও। মস্তিষ্কে ইনফেকশন হলে যে রোগটা হয় সেটা ম্যানেনজাইটিস রোগ যেটা একটা অন্যতম মারণ রোগ। মুহাম্মদের সময়ে আরবে এই রোগের ওষুধ ছিলো না। মৃত্যুর আগে ম্যানেনজাইটিস রোগের উপসর্গগুলি মুহাম্মদের শরীরে ফুটে উঠেছিল। যেমন তাঁর প্রবল জ্বর হয়েছিলো এবং তার সঙ্গে ছিলো সহ্য মাথা যন্ত্রণা। প্রবল জ্বর ও মাথা যন্ত্রণা হেতু মাঝে মাঝেই তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলেন। কিছুক্ষণ পরপর জ্ঞান হারাচ্ছিলেন এবং জ্ঞান ফিরে আসছিলো। তীব্র মাথা যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন, মাগো বাবাগো বলে চিৎকার করছিলেন মাঝে মধ্যে, কখনও মাথায় কষে কাপড়ের ফেটি বাঁধছিলেন। মাঝে মধ্যে প্রলাপও বকছিলেন। এগুলো ম্যানেনজাইটিস রোগের উপসর্গ। আরবে এই রোগটার মাঝে মধ্যেই প্রদুর্ভাবও হয়। আরবে এই রোগের মহামারীও হয়েছে বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। সুতরাং ম্যানেনজাইটিস রোগেই মুহাম্মদের মৃত্যু হয়েছে বলে যে কথাটি শোনা যায় সেটাই বিজ্ঞান সম্মত ও সঠিক বলে মনে হয়।

নবীর মৃতদেহের অশেষ লাঞ্ছণা ও দুর্ভোগ

শুধু অশেষ শারিরীক মৃত্যুযন্ত্রণাই নয় নবীকে ভোগ করতে হয়েছে তাঁর মৃত্যুশয্যায় অশেষ মানসিক যন্ত্রণাও। নবী যখন বুঝেছিলেন যে মৃত্যু তাঁর শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছে এবং কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁর শেষ নিশ্বাস বেরিয়ে যাবে তখন তাঁর সাহাবীদের কিছু অছিয়ত করে যেতে চেয়েছিলেন বা কিছু নির্দেশ দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সেজন্যে তাঁর সাহাবিদের কাগজ ও কলম নিয়ে তাঁর পাশে এসে বসতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি কল্পনাও করতে পারেন নি যে তাঁর জীবদ্দশাতেই তাঁর সাহাবিরা তাঁর নির্দেশ অমান্য বা অগ্রাহ্য করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে সেটাই ঘটেছিলো। তিনি যখন কাগজ ও কলম নিয়ে তাঁর পাশে কোনো একজনকে বসার নির্দেশ দেন তখন তাঁর আজ্ঞা পালনের ব্যাপারে তীব্র মতভেদ দেখা দেয়। উপস্থিত সাহাবিদের মধ্যে একদল দ্রুত সেই নির্দেশ পালনে তৎপর হয়ে ওঠেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই প্রবল আপত্তি করে অন্য একটা দল। দ্বিতীয় পক্ষের নেতা ছিলেন দ্বিতীয় খলিফা ওমর বিন খাত্তাব। তিনি যুক্তি প্রদর্শন করেন যে নবী প্রলাপ বকছেন মাঝে মধ্যে, এ রকম পরিস্থিতিতে যা বলবেন তা তাঁর হয়তো মস্তিষ্ক-প্রসূত ও যথেষ্ট বিবেচনা-প্রসূত হবে না। তেমন কোনো অছিয়ত দিয়ে যদি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তবে ইসলাম ও সমগ্র মানবমণ্ডলী দিকভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট হবে। আপাতদৃষ্টিতে ওমরের কথাগুলি উপেক্ষণীয় নয়। কিন্তু নবী তখন সজ্ঞানেই ছিলেন এবং প্রলাপ বকছিলেন না। ফলে ওমরের কথার প্রতিবাদ করে প্রথম দল। কিন্তু দুই দলের মধ্যে প্রবল বাদানুবাদ শুরু হয়ে যায় নবীর সামনেই। নবী তা দেখে যারপরনাই বিরক্তি ও ক্রোধে ফেটে পড়ে সবাইকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে নির্দেশ দেন। নবী যে তখন অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছিলেন না এবং সম্পূর্ণ সজ্ঞানেই ছিলেন সেটা ওমর বোঝেন নি তা নয়। নবীর তবুও সর্বশেষ অছিয়ত দেওয়া আটকে দেন সচেতনভাবেই যার পশ্চাতে গভীর পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্য নিহিত ছিলো যা স্পষ্ট হয়ে যায় নবীর মৃত্যুর পরের ঘটনাবলীতে। 


Real and inside tomb of Prophet Muhammad - YouTube

You Tube

Uploaded by: Hassi S Thanongsak # HBM, Nov 23, 2018

 

অবশেষে দিন পনেরো পর ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ৮ই জুন সোমবার নবীর অশেষ মৃত্যু যন্ত্রণার অবসান হয়। সঙ্গে সঙ্গেই সাহাবিদের মধ্যে ক্ষমতা দখলের ন্যক্কারজনক রাজনীতি শুরু হয়। এটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার অবকাশ এখানে নেই। নবীর চাচা ও চাচাতো ভাই তথা জামাতা আলি ও কতিপয় সাহাবি নবীর শবদেহ আগলে বসে থাকেন একদিকে, অপরদিকে ক্ষমতা দখলের কুৎসিত খেলায় মত্ত হয়ে ওঠে অন্যান্য সাহাবিরা। নবীর শবদেহ ফেলে রেখে এই কুৎসিত খেলায় মেতে উঠেছিলেন নবীর যে প্রিয় সাহাবিরা তাদের মধ্যে ছিলেন আবুবকর ও ওমর এবং অপর পক্ষে ছিলেন মদিনার সেই সাহাবিরা যাঁরা মুহাম্মদকে আশ্রয় ও নিরাপত্তা দিয়ে নবী হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিলেন। দুই পক্ষই বাকবিতণ্ডা ও বচসায় জড়িয়ে পড়েছিলো নবীর উত্তরাধিকারি তথা প্রথম খলিফা হওয়ার জন্যে। তিন দিন ধরে সাহাবিদের মধ্যে সেই ঝগড়া অব্যাহত চলার পর অবশেষে আবুবকর প্রথম খলিফা নির্বাচিত হন। তারপর নবীকে সমাধিস্থ করা হয়। সাহাবিদের ঝগড়া গড়িয়েছিলো নবীর মৃতদেহের জানাযা নামাজ পর্যন্ত। ফলে নবীকে কবরস্থ করা হয় জানাযা নামায ব্যতিরকেই। ঝগড়া গড়িয়েছিলো নবীকে কবর কোথায় হবে তা নিয়েও। খুবই দুঃখজনক ঘটনা হলো নবীকে সমাধিস্থ করার আগে তাঁর শবদেহে পচন শুরু হয়ে গিয়েছিলো এবং দেহ থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল।নবীর মৃতদেহের এহেন অপমান ও লাঞ্ছনা বোধ হয় সারা বিশ্বে নজিরবিহীন।

 

উপসংহার

উপসংহারে রয়েছে পর্যবেক্ষণ, প্রধ্ন ও মন্তব্য এই তিনটি জিনিষ। পর্যবেক্ষণ মূলত ওমর ও আবুবকরের ভূমিকা নিয়ে। আগেই আলোচনা করা হয়েছে যে তিন দিন ধরে তীব্র কলহ, বাক-বিতণ্ডা ও বচসার শেষে আবুবকর প্রথম খলিফা নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে আবুবকরের নাম প্রথম খলিফা হিসাবে প্রস্তাব করেছিলেন ওমর। আবার আবুবকর খলিফার ক্ষমতা ও প্রভাবকে ব্যবহার করে ওমরকে দ্বিতীয় খলিফা মনোনীত করে যান। এই ঘটনার সঙ্গে পরবর্তীকালের দুটি ঘটনার যোগসূত্র থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ঘটনা দুটি হলো - এক) মৃত্যুর আগে নবী সাহাবীদের উদ্দেশ্যে যে অছিয়ত করে যেতে চেয়েছিলেন সেটা ওমরের ভেস্তে দেওয়া। দুই) নবীর মৃতদেহের সৎকার না করেই খলিফা পদটি কব্জা করার জন্যে দৃষ্টিকটূভাবে আবুবকর ও ওমরের অন্যান্য সাহাবিদের সঙ্গে তীব্র কলহে লিপ্ত হয়ে পড়া। প্রথম ঘটনটি প্রমাণ করে যে প্রথম খলিফা হবার জন্যে আবুবকরের তীব্র লালসা ছিলো। আবুবকরের হাত ধরে দ্বিতীয় খলিফা হয়েছিলেন ওমর। দ্বিতীয় এই ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে খলিফা হবার জন্যে ওমরেরও তীব্র লালসা ছিলো। ওমরের ধারণা ছিলো যে নবী মৃত্যুকালীন অছিয়তে কাউকে তাঁর উত্তরাধিকারি ঠিক করে দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে নবী যদি তাঁর বংশধর বলে আলিকে উত্তরাধিকারি ঠিক করে দিতেন যার সম্ভাবনা ছিলো প্রবল তবে, আবুবকর ও ওমর দুজনের কারোরই খলিফা হওয়ার লালসা ও সাধ জীবনে পূর্ণ হতো না। কারণ, আলি তাঁদের দুজনের থেকেই ছিলেন অনেক ছোট। তাই তাঁদের নিজেদের খলিফা হওয়ার পথ খোলা রাখার জন্যে নবীর অছিয়ত দেওয়া বাঞ্চাল করে  দেওয়াটা তাঁদের কাছে একান্তই অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলো। সেজন্যেই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা মাফিকই অজুহাত খাড়া করে নবীর অছিয়ত দেওয়াটা আটকে দিয়েছিলেন ওমর এবং নীরব থেকে তাঁর পক্ষ নিয়েছিলেন আবুবকর। একই উদ্দেশ্যে নবীর মৃতদেহ সৎকার করার আগেই তাঁরা দু’জন প্রথম খলিফা ঠিক করার জন্যে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়ে পড়েন। আগে নবীর মৃতদেহ সৎকার করে পরে যদি আলোচনার মাধ্যমে নবীর উত্তরাধিকার ও প্রথম খলিফা নির্বাচন করা হতো তবে সেক্ষেত্রে তাঁদের খলিফা হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো খুবই ক্ষীণ। সেজন্যেই আবুবকর ও ওমর নবীর মৃতদেহ আয়েশার ঘরে ফেলে রেখেই তড়ি-ঘড়ি প্রথম খলিফা নির্বাচনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।  

মুহাম্মদ নিজেই জানিয়েছেন যে আল্লাহ অগুণতি নবী পাঠিয়েছে যাদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ এবং শেষ নবী। তিনি আরও জানিয়ে গেছেন যে তিনিই ছিলেন আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় এবং আল্লাহও তাঁর প্রতি ছিলো অতিশয় সহানুভূতিশীল, দয়ালু ও স্নেহশীল। তাঁর এ সব দাবিগুলি আপাতদৃষ্টিতে অতিরঞ্জিত বলে মনে হয় না। কারণ, কোরানে এরূপ বহু ঘটনা দেখতে পাওয়য়া যায় যে নবী যখন যা চেয়েছেন বা কামনা করেছেন আল্লাহ তৎক্ষণাৎ তা পূরণ করে দিয়েছে অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে। দুটো উদাহরণ দেওয়া যাক। নবী তাঁর পালক পুত্র জায়েদের স্ত্রী অসামান্য সুন্দরী জয়নবকে কামনা করেছিলেন। আল্লাহ সেটা বুঝতে পেরে জয়নবের সঙ্গে তাঁর (নবীর) বিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিলেন বেহেশতে। নবী আবুবকরের ছ’বছরের শিশু কন্যা আয়েশাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। আবুবকর তাতে সঙ্গত কারণেই রাজী হন নি। কিন্তু স্বয়ং আল্লাহুই উদ্যোগী হয়ে আয়েশার সঙ্গে নবীর বিয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কোরানে এ রকম আরও বহু উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায় যা বিশ্বাসীদেরকেও যুগপৎ বিষ্মিত করে ও ভাবিয়ে তোলে।  তারা মন থেকে মেনে নিতে পারে না তাদের নবীর এই হীন কাজগুলি। এবং তাদের বিশ্বাস হয় না যে নবীর এহেন অন্যায় কামনাগুলি আল্লাহর ইচ্ছায় সম্পন্ন হয়েছে। তাদের এই অবিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়  নবীর মৃত্যুশয্যায় অসহ্য যন্ত্রণা  ও কষ্টের কথা জানার পর। তাদের সন্দেহ ও সংশয় তাই দানা বাঁধতে শুরু করে নবীর নবীত্ব নিয়েও। কারণ তারা বিশ্বাস করতে পারে না যে আল্লাহ তার কোনো নবীকে এতো  যন্ত্রণাময় মৃত্যু উপহার দিতে পারে যা একটা অত্যন্ত কঠিন শাস্তির সমতুল্য। আর তারা এটাও বিশ্বাস করতে পারে না যে আল্লাহ নীরব থাকতে পারে কোনো নবীর লাশ তিন দিন ধরে অপমানিত ও লাঞ্চিত হচ্ছে দেখেও। তাই তাদের মনে এই ধারণাও প্রবল হয় যে হয় নবী বোধ হয় আল্লাহর দোহাই দিয়ে আবুবকর ও জায়েদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।  

তথ্য সূত্রঃ ড. ওসমান গণীর মুহাম্মদের জীবনী - মহানবী, মুহাম্মদের মৃত্যুর পর আরবের রাজনীতি - ১, আলোচনায় অমিয় হাসান, মুফতি আল-মাসুদ ও রিক্তা,  সঞ্চালক - রুমি, ইউ টিউব, নবী জীবনের শেষ দু'সপ্তাহের গল্প, নিসিক্ত, ইউ টিউব

বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাইনি – পাঁচ

  দ্বিতীয় অধ্যায় শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবের প্রতি তীব্র গণরোষের নেপথ্যে ২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে ৩৬ দিন পর (৫ই ...