Tuesday, May 26, 2020

করোনা ডায়রি - (তিন)ঃ করোনাকে কেনো ভয়

এক 

হিস হিস করে এ পাশ ও পাশ দিয়ে 

ছুটে গেছে কতো বুলেট 

ডানে বামে সামনে সমানে নাগাড়ে 

পড়েছে বোমা, 

বিকট শব্দে ফেটেছে একটার পর একটা 

কেউ কেউ হয়তো থেকেছে পাশে জীবন বাজি রেখে 

বাকিরা সবাই সরে গেছে 

কমরেডরা শুভান্যুধায়ীরা চিৎকার করেছে – 

গিয়াসদা পালান পালান পালান, 

আমি নির্বিকার গুটি গুটি পায়ে পিছিয়ে এসেছি 

কিন্তু পালাইনি কখনো, 

মৃত্যু-ভয় আমাকে ছুঁতে পারেনি কোনোদিন। 

দুই 

না কোনো গল্পকথা নয় তা - 

 তখন আগুন ঝরানো সাতের দশক 

নক্সাল নিধন যজ্ঞ শেষে 

সিদ্ধার্থ মেতেছে সিপিএম নিধন যজ্ঞে 

আর আমরা লাল ঝাণ্ডা হাতে 

মেতেছি তেরঙ্গার দূর্গগুলি ভাঙতে 

দখল নিতে 

জেলা জুড়ে মুর্শিদাবাদে, 

জোতদার-জমিদারদের চোখে চোখ 

রেখেছি আমরা, 

চোখ রাখতে শুরু করেছে 

গ্রামের ক্ষেতমজুর ভাগচাষী প্রান্তিক কৃষকও 

যাদের আজন্ম ঠাঁয় ছিলো জমিদারের পায় 

ভৃত্যরা পদসেবা ছেড়ে লালঝাণ্ডা ধরে 

হুঙ্কার ছেড়ে কয় 

আর বঞ্চনা নয় 

ফসলের ন্যায্য ভাগ চায় 

ক্ষেতের মালিকানাও চায় - 

এ সব চোখ রাঙানি 

সহ্য হবে কেনো ওদের 

যারা সামন্ত প্রভুদের গোলাম আর তাদের সেবাদাস, 

তারা গুণ্ডা আর পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছে 

নিরস্ত্র গণ মানুষদের উপর 

মুছে দিতে লাল পার্টি আর তার নিশান 

গোটা বাংলায়। 

তিন 

ঊনিশ শো তিয়াত্তর সাল 

গণতন্ত্রের গভীর সংকট কাল - 

হাতে মারার পাশাপাশি ভাতে মারার অভিযানে 

মেতেছে বুর্জোয়া-জমিদারদের তাঁবেদার 

তেরঙ্গা ঝাণ্ডাওয়ালা সিদ্ধার্থ রায়ের সরকার, 

পাইকারী হারে চাকরিচ্যুত করেছে তাদের যারা 

মাথা নত করেনি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কাছে -

নির্মমভাবে, 

চাকরিচ্যুতদের দলে একদিন নাম তুলে দিয়েছিলো 

আমারও অকস্মাৎ - 

১ লা ডিসেম্বর ঊনিশ শ’ তিয়াত্তর 

স্কুলে ঢুকতে গিয়ে বাধা পেলাম - 

স্কুলের গেট ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা 

একদল চেনা অচেনা যুবকের একজন গম্ভীর কণ্ঠে 

যেন ফাঁসীর রায় ঘোষণা করলো, বললো – 

যান ইনকিলাব জিন্দাবাদ আর ধর্মঘট করুন 

স্কুলে আসতে হবেনা। 

স্কুলে আর ঢুকতে দেয়নি কোনোদিন 

সিদ্ধার্থ জমানায়। 

চার 

পঁচিশে জুন ঊনিশ শ’ পঁচাত্তর ঘোষিত হলো 

অভ্যন্তরীণ জরুরী অবস্থা - 

গোটা দেশটাকেই মিসা (কালা কানুন) দিয়ে 

জেলখানায় আটক করলেন ইন্দিরা গান্ধী, 

বেকার জীবনে নিত্য সঙ্গী তখন আমার 

অভাব অনটন আর অনিশ্চয়তা - 

ঠিক তখনই আমার সঙ্গীরা অনেকে মিসার ভয়ে 

সই করলো দল বেঁধে একে একে, 

সই করলো ইন্দিরার বিশ দফা আর সঞ্জয়ের পাঁচ দফায় - 

চরম সেই দুর্দিনেও প্রায় নিঃসঙ্গ একা আমি একদিকে 

যুঝেছি প্রাণপণে প্রবল দারিদ্রের সঙ্গে 

আর অন্যদিকে 

হয় জেল না হয় বুলেট আর বোমার ভ্রূকুটি 

তখনও লালঝাণ্ডা ছাড়িনি ভয়ে 

বরং ধরেছি আরো শক্ত করে মুষ্টিবদ্ধ হাতে 

ভয়ের কাছে আমি নতো হইনি 

ভয়ই নতো হয়েছে আমার কাছে। 

পাঁচ 

দু হাজার পাঁচ কি ছয় - 

তখন হাতে লালঝাণ্ডা আর নেই 

হাতে তুলে নিয়েছি তখন 

একটা কলম। 

জানো করোনা, সেটাও ছিলো বড়ো অপরাধ 

লাল ঝাণ্ডা ধরার চেয়েও বড়ো - 

ইসলাম আর নবী-নিযুক্ত মোল্লারা বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করলো 

আমার মৃত্যুদণ্ড, 

আমার মাথার দাম ধার্য করলো পাঁচ লাখ। 

জানো করোনা, 

মৃত্যু-ভয়ে মোল্লাদের কাছে তখনও 

মুচলেকা লিখে দিয়ে কলম তুলে রাখিনি। 

 ছয় 

জানো করোনা, 

লজ্জা সরম দূরে সরিয়ে বলি - 

ভয় কিন্তু এখন পাচ্ছি আমি 

ভয় ঢুকেছে বুকে মস্তিষ্কে ও মনে 

ভয় পাচ্ছি দিনে রাতে শয়নে স্বপনে। 

এখন কী মনে হয় জানো - 

ব্যাঙ্গালোর থেকে আমার বাড়ি 

দু’ হাজার কিমি পথ জুড়ে সর্বত্র 

ওৎ পেতে রয়েছো তুমি, 

যেদিকে তাকাই সেদিকেই দেখি যেন 

তুমি পেতে রেখেছো ফাঁদ 

বাড়ির দরজার চৌকাঠ পের হলে 

কোথাও না কোথাও নাগাল পাবে আমার 

খপ করে ধরে তখন গপ 

করে গিলবে আমায়  -

মনে হয় কী জানো – 

করোনা রূপী মৃত্যুটা ছায়ার মত যেন 

ঘুর ঘুর করছে আমাকে ঘিরে 

আমি হাঁটি সেও হাঁটে 

আমি বসি সেও বসে 

আমি উঠি সেও ওঠে 

আমি ঘুমায় সেও ঘুমায় 

ও যেন সর্বক্ষণ আমার সঙ্গে লেপ্টে রয় 

নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারিনা 

মাঝরাতে যখন ঘুম ভাঙে 

তারও ঘুম ভাঙে 

যখন বাথরুমে যাই সেও যায়। 

সাত 

আগে পাইনি কিন্তু 

এখন ভয় পাচ্ছি কেন জানো করোনা? 

শোনো করোনা তবে অকপটে বলি – 

বুলেট বোমা ছুরিতে ভয় পাইনি কোনোদিন 

কারণ মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত ছিলাম তখন 

ভয় পাইনি কারণ জানতাম 

এক গিয়াস মরলে 

হাজার গিয়াস জন্ম নিবে, 

ইসলামের তলোয়ারকেও ভয় পাইনি 

যদিও জানতাম মোরতাদের শাস্তি তো মৃত্যুদণ্ডই। 

এখন মৃত্যুকে ভয় পাচ্ছি থুড়ি, 

ভয় পাচ্ছি তোমাকে করোনা – 

কেনো পাচ্ছি শোনো তার কারণ, 

এক - বয়স আমার সত্তরের কাছাকাছি 

ডায়াবিটিস উচ্চ রক্তচাপ থায়রডের 

সঙ্গে আমার বাস আজ এক যুগ 

আমরা তো তোমার উপাদেয় খাবার। 

দুই – আমি এখন মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত নই 

আমি যে বাঁচতে চাই আরও দশ বছর, 

নিদেন পক্ষে বছর পাঁচ 

আমার যে বাঁচা ভীষণ দরকার 

সে বাঁচা শুধু নিছক বাঁচা নয় 

কিংবা নিছক আমার কারণে নয় 

আমি বাঁচতে চাই কারণ, 

আমি বাঁচলে আমার কলমটা বাঁচবে তাই। 

তিন - ইসলাম, জিহাদ আর নবীর স্বরূপ উন্মোচনে 

এখনও যে অনেক কাজ বাকি 

সে কাজ ফেলে রেখে মরতে চাই না 

একদম, 

তারপরেও করোনা, তোমার থাবায় 

যদি অকালে মৃত্যু ঘনায় 

কলমটা আমার চিরতরে থেমে যায় 

তবে তুমি নিশ্চিত জেনো 

দ্বিতীয় গিয়াস জন্ম নেবে না আর 

ভণ্ড সেক্যুলারদের এ দেশে 

যে আমার কলমটা তুলে নেবে নির্ভয়ে 

আমার বাকি কাজ এগিয়ে নিতে। 

২৭ শে মে ২০২০

Saturday, May 9, 2020

করোনা ডায়রি (দুই) - জান থেকে মান বড়ো

   
        জান থেকে মান বড়ো



    এক 

২৩শে মার্চের ট্রেনে
ঘরে ফেরার টিকিট কাটা ছিলো
কিন্তু ঊনিশ থেকেই
চাইছিলাম মন থেকে যেন
যাত্রীবাহী সব ট্রেন যেন স্তব্ধ হয়ে যায়
করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে।
করোনা বাসা বেঁধেছে তখন
বড় জোর দেড় হাজার মানব দেহে
তাতেই দেশজুড়ে কাঁপন ধরেছে মানব মনে
দূরপাল্লার ট্রেনের টিকিট বাতিল করার
ধূম পড়ে গেছে তাই দিকে দিকে।
কাঁপন ধরেছে ভয়ে আমার মনেও -
কিন্তু মেয়ের কাছে ব্যাঙ্গালোরে আছি অনেক দিন
চক্ষু লজ্জায় তাই বলি কী করে
যাবোনা এখন,  
অন্তর থেকে চাইছিলাম তাই
যাত্রীবাহী ট্রেনগুলো সব স্তব্ধ হয়ে যায়
যেনো তেইশের আগেই। 

           দুই 

রেলভ্রমণ বিমানভ্রমণ মনে হতো  
যেনো একটা মস্ত বড়ো মরণফাঁদ
করোনা ওৎ পেতে রয়েছে যেনো
রেল আর বিমানের প্রকাণ্ড দেহজুড়ে -  
প্রতিটি কামরায় প্রতিটি আসনে শৌচালয়ে
প্রতিটি দরজায় আর কোনায় কোনায়     
ভয়ে তাই কাঁটা হয়ে থাকতাম সর্বক্ষণ
ঠিক মতো ঘুম হয়না রাত্রে
করোনা তো নয় যেনো যমদূত
ফোঁস ফোঁস করে
নিঃশ্বাস ফেলছে ঘাড়ের উপর  
অবশেষে বহু আকাঙ্ক্ষিত ঘোষণাটি হলো
করোনা ঠেকাতে -
২৩শে মার্চ থেকে বন্ধ থাকবে
যাত্রীবাহী সব প্লেন ও ট্রেন,  
ক’দিন পর রাতে ঘুমালাম সেদিন
পরম স্বস্তিতে নিশ্চিন্তে নির্ভয়ে।

       তিন

লকডাউনের আজ ৪৭তম দিন
তৃতীয় দফার লকডাউন চলছে দেশজুড়ে
আড়াই লক্ষ প্রাণ সংহার করে এ গ্রহের
আক্ষরিক অর্থেই করোনা
আজ প্রকটিত ভয়াল করাল রূপে,
ভীত-সন্ত্রস্ত জবুথবু গোটা বিশ্ব
পরাক্রমশালী ট্রাম্প থেকে মোদি  
সবার কণ্ঠে পরাজিত সেনা নায়কের করুণ আর্তনাদ -  
বাঁচতে হবে আমাদের করোনাকে সঙ্গে নিয়েই।

            চার

ভারতেও করোনা সংহারের বলি ইতিমধ্যেই দুই সহস্রাধিক
সংক্রমণ ছুঁলো বলে লক্ষ শরীর
নিয়ন্ত্রণ শব্দটিকে দলে পিষে মাড়িয়ে
করোনা ছুটছে পাগলা ঘোড়ার মতন
ভারতকেও নিয়ে যেতে মৃত্যুপুরীর দিকে।
ঘরে বাইরে দরজার মুখেই দাঁড়িয়ে আছে যেনো
করোনা-রূপী মৃত্যুর সাক্ষাৎ যমদূত,
সত্তর ছুঁই ছুঁই আমি বহন
করে চলেছি দেহে তিন তিনটি মারণ রোগ –
বহুমূত্র রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, থায়রয়েড
করোনা তো খুঁজছে হন্যে হয়ে আমাদেরই  
খাঁচাবন্দী পাখির মতন
তাই যাপন করছি বন্দীজীবন
ভয়ে ঘরের চৌকাঠ মাড়াইনি দেড় মাস।

           পাঁচ

সেই আমি দিন রাত জপছি   
ট্রেন প্লেন চলতে শুরু করুক এখনই 
লকডাউন থাকুক
কিন্তু ট্রেন চলুক প্লেন চলুক,  
করোনা তাণ্ডবে কাঁটা ভীত ত্রস্ত আজও
তবু আমার চাই এখনই
একটা ট্রেন কিংবা প্লেনের টিকিট,  
করোনা হানায় যদি জান যায় যাক
কিন্তু মন বড়োই উদগ্রীব উতলা আজ
যেভাবেই হোক ঘরে ফিরতে

        ছয় 

মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চাওয়া
কি শুধু ঘরে ফেরার তাগিদে?
এমন মরিয়া মনোভাব কি হতোই
মেয়ের বদলে ছেলের কাছে এসে থাকলে,   
কিংবা মেয়ে আমার গৃহবধূ না হয়ে  
উপার্জনশীল স্বাবলম্বী ব্যক্তিত্ব হলে?
মেয়ের কাছে এসেছিলাম মেয়ে-জামায়েরই কাজে
তাদেরই একান্ত অনুরোধে   
কিন্তু সে প্রয়োজন ফুরিইয়েছে অনেক দিন
এখন তাই নিজেকে কেবলই মনে হয়
বোঝা জামাইয়ের সংসারে,  
যত দিন যায়
এ অনুভূতি তত তীক্ষ্ণ হয় -
নিষ্কৃতি চাই তাই এ জীবন থেকে।

         সাত 

জীবন আজ এক নির্মম উপলব্ধির সাক্ষী -
শুধু দিন বদলায় না দ্রুত
দ্রূত বদলায় পরিবেশ পরিস্থিতি
আর বদলায় দ্রুত মানুষের মনও -
জীবন তখন তুচ্ছ ক্ষুদ্র মনে হয় 
আর মনে হয়
আত্মসম্মান আত্মমর্যাদাই সব থেকে বড়ো
তার চেয় কিছু নয়।
আত্মসম্মান তখন বড়ো হয়ে ওঠে জীবনের চেয়েও।

১০ই মার্চ ২০২০ ব্যাঙ্গালোর  









Thursday, May 7, 2020

করোনা ডায়রি (এক)ঃ কখনো কি এতো মৃত্যুভয় পেয়েছি?


কখনো কি এতো মৃত্যুভয় পেয়েছি?

আমি এখন সত্তর ছুঁই ছুইঁ করছি
জীবনের চৌত্রিশটা বসন্ত কেটেছে রাজনৈতিক প্রাঙ্গণে
সাড়ে তিন দশকের দীর্ঘ জীবনটা ছিল না
মসৃণ, ফুল বিছানো
মৃত্যু ছিলো নিত্যসঙ্গী, ছায়াসঙ্গী,
পায়ে পায়ে মৃত্যু যেনো বেড়ি পরিয়ে রাখতো
কানের কাছে হিশহিশ শব্দের ঢেউ তুলতো,
একবার একটা বুলেট তো কানের পাশ দিয়ে হুশ হুশ
শব্দ তুলে বেরিয়ে গেলো,
তার আগেই একদিন প্রতিপক্ষের লোকজন
পেয়ে গেলো একেবারে হাতের মুঠোয়,
অদূরেই ফিসফিস করে ফন্দি আঁটা হচ্ছে
কুচি কুচি করে কেটে বস্তাবন্দি দেহটা
কীভাবে পাচার করা হবে তার,
ফন্দিটা অবশেষ ব্যর্থ করে দিলো একজন কনস্টেবল এসে।
মৃত্যু আমার পায়ে পায়ে হেঁটেছে সদা যখন
তখন কি মৃত্যুর চোখ রাঙানিকে
ভয় পেয়েছিলাম আদৌ?
যখন কানের পাশ দিয়ে হুশ হুশ করে
বুলেটটা বেরিয়ে যায় লাস্ট ওয়ার্নিংগ দিয়ে
তখন কি ভয় পেয়েছিলাম?
যখন নিশ্চিত মৃত্যর কোলে শুয়ে ছিলাম
প্রতিপক্ষের বেষ্টনীর মধ্যে
তখন কি খুবই ভয় পেয়েছিলাম?
ভয় পেলে তো রাজনীতির প্রাঙ্গণটা আরও
বেশী করে আঁকড়ে পড়ে থাকতাম না,
পারতাম না ডিজির আমার জন্যে বরাদ্দ করা
সিকিউরিটি হেলায় ফিরিয়ে দিতে।
আজ ভাবছি কেউ যদি
একজন সিকিউরিটি দিতো করোনার থাবা থেকে বাঁচতে।

৮ই মার্চ, ২০২০ (১৫৯তম রবীন্দ্র জয়ন্তী), ব্যাঙ্গালোর 





Friday, February 14, 2020

সিএএ শুধু ধর্মীয় বিভেদমূলক আইনই নয়, এটা একটি মুসলিম-বিদ্বেষ প্রসূত আইনও

সিএএ এবং এনআরসি-র বিরুদ্ধে নজিরবিহীন অরাজনৈতিক গণআন্দোলন

গোটা দেশে সিএএ, এনআরসি ও এনপিআরের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে। যতদিন যাচ্ছে আন্দোলনটি ততো তীব্র হচ্ছে। আন্দোলনটি অতি অল্প সময়েই আক্ষরিক অর্থেই জন-আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। আন্দোলনের পুরোভাগে রয়েছে ছাত্র-যুব, নারী ও নাগরিক সমাজ, পরে নেমেছে কয়েকটি রাজনৈতক দল। স্বাধীনোত্তর ভারত অনেক বড়ো বড়ো গণআন্দোলন দেখেছে, কিন্তু সিএএ, এনআরসি ও এনপিআর বিরোধী গণআন্দোলনে যে কয়েকটি বিশেষ চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হচ্ছে তা অতীতে কোনো আন্দোলনে পরিলক্ষিত হয় নি। এই গণআন্দোলনের বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো হলো এরকমঃ ১). আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষ অংশ গ্রহণ করেছে দলীয় পতাকাকে দূরে সরিয়ে রেখেই। ২). আন্দোলনটি শুরু করে প্রথম জনগণই, পরে নামে রাজনৈতিক দলগুলো। ৩). আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেছে বিপুল সংখ্যক নারী যাদের মধ্যে চির পর্দানসীন গৃহবন্দি মুসলিম নারীর সংখ্যাই অধিক। তারা শুধু অংশ গ্রহণই করেই নি, আন্দোলনের একেবারে পুরোভাগে রয়েছে। ৪). আন্দোলনে মুসলিম সমাজের  মানুষ অংশ নিয়েছে ব্যাপক সংখায়, কিন্তু তারা তাদের ধর্মীয় পতাকা ও ধর্মীয় নেতাদের কাছে ঘেঁষতে দেয় নি। ৫). মুসলিম নারীরা গৃহবধূ ও ছাত্রী নির্বিশেষে বিরাট সংখ্যায় গোটা দেশ জুড়ে ডিসেম্বর-জানুয়ারির হাড় কাঁপানো কনকনে হিমশীতল ঠাণ্ডার মধ্যেও বিভিন্ন রাস্তায় বসে অবস্থান আন্দোলন শুরু করেছে এবং অদ্যাবধি চালিয়ে যাচ্ছে (দিল্লীর শাহিনবাগের অবস্থান বা ধর্ণা ইতিমধ্যেই দু'মাস পূরণ হতে চলেছে)। হাতে রয়েছে তাদের ধর্মীয় পতাকার পরিবর্তে জাতীয় পতাকা ও দেশের সংবিধান এবং মুখে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সংবিধান রক্ষা করার মুহুর্মুহু শ্লোগান। অমুসলিম সমাজের ব্যাপক মানুষ নারী পুরুষ নির্বিশেষে তৈরি করা খাবার, শুকনো খাবার, বাচ্চাদের দুধ, পানীয় জল, ঔষধ, ইত্যাদি প্রয়োজনীয় সব রকম জিনিসপত্র নিয়ে অবস্থানরত এই নারীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এগিয়ে এসেছেন বহু ডাক্তার ও ফার্মাসিস্টরাও এবং স্থাপন করেছেন অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্পও। ৬). সরকারের জনস্বার্থবিরোধী কিংবা রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন হোক কিংবা হিংসাত্মক আন্দোলনই হোক সব আন্দোলনই করে থাকে মূলত পুরুষরা, আর নারী তাদের সর্বপ্রকারের সহযোগিতা করে থাকে, এটাই এ দেশের সর্ব কালের দস্তুর। সিএএ ও এনআরসি বিরোধী আন্দোলন সর্বকালের সেই নিয়ম উল্টে দিয়েছে। এই আন্দোলনে মুসলিম নারী পথে নেমেছে, তারা রয়েছে আন্দোলনের পুরোভাগেই আর পুরুষগণ তাদের সর্বপ্রকার সাহায্য করছে। ৭). গোটা দেশজুড়ে ইতিহাসবিদ, অভিনেতা, অভিনেত্রী, নাট্যব্যক্তিত্ব, শিল্পী, লেখক - অধ্যাপক, গায়ক-গায়িকা রাজনৈতিক পতাকা ছাড়াই শ'য়ে শ'য়ে এই আন্দোলনে পথে নেমেছে। অতীতে নাগরিক সমাজ সরকারের বিরুদ্ধে কখনো  এভাবে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র পরিচয় নিয়ে এত বিপুল সংখ্যায় আন্দোলনে শামিল হয় নি। তারা কেন্দ্রীয় সরকারকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে যে সিএএ ও এনআরসিকে তারা প্রত্যাখ্যান করছেন এবং নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্যে সরকারের কাছে কোনো প্রমাণ পত্র জমা দেবে না এবং তার পরিণতিতে ডিটেনশন ক্যাম্প তথা কারাগারে যেতে প্রস্তুত। এবং এটাই হয়ে গেছে এখন সর্বস্তরের আন্দোলনকারীদের মুখের ভাষা।  স্বাধীন ভারতে নাগরিক সমাজকে কোনো সরকারকে এমন সংঘবদ্ধভাবে এ রকম চ্যালেঞ্জ জানাতে দেখা যায় নি। ৮). আন্দোলনের শুরুতে আন্দোলনকারীরা হিংসাত্মক হয়ে উঠলেও পরে তারা  নাগরিক সমাজ ও মুসলিম  সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপে হিংসাত্মক পথ পরিহার করে এবং সবার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ  আন্দোলনে শামিল হয়।
এ কথা বলা বাহুল্য যে,  নাগরিকত্ব হারানোর ভয় ও আতঙ্কই মুসলিম সমাজের তরুণ ও যুবাদের হিংসার পথে নিয়ে গিয়েছিল। হিংসাশ্রয়ী ছেলেরা হিংসার পথ পরিহার করে শান্তিপূর্ণ  বিশ্বের ইতিহাসে এমন উদাহরণ থাকলেও তা বিরল। ৯). আন্দোলনটি গোটা দেশ ও দুনিয়ায় এমন আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে যার সারা বিশ্বে বোধ হয় বেনজির। এমনকি মোদিজীর বিশেষ বন্ধু ট্রাম্পের দেশ থেকেও সিএএ ও এনআরসি বাতিল করার দাবি উঠেছে। আমেরিকার দুটি নামকরা শহরের (সিটল ও কেমব্রিজ সিটির) স্থানীয় সরকার সিএএ ও এআসির বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করে সেই প্রস্তাবে ভারত সরকারকে সিএএ ও এনআরসি প্রত্যাহার করতে অনুরোধ করা হয়েছে। সিএএ ও এনআরসির জন্যেই ভারত সরকার এখন কার্যত আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় একঘরে হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এদিকে ভারতের অভ্যন্তরে একের এক রাজ্যের বিধানসভা সিএএ-এর বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাশ করেছে যার মধ্যে কেরালা, পাঞ্জাব, রাজস্থান, পশ্চিমবঙ্গ, মধ্যপ্রদেশ, পণ্ডিচেরি প্রভৃতি রাজ্যগুলো রয়েছে।
এক কথায় স্বাধীনোত্তর ভারত এমন আলোড়ন সৃষ্টি করা আন্দোলন কখনো দেখে নি। দেশে বিদেশে সিএএ ও এনআরসি  বিরোধী আন্দোলনের প্রতি এই অভাবনীয় বিপুল সমর্থন দেখে মোদি সরকার ও শাসকদলের সব হিসাবনিকাশ গুলিয়ে যাচ্ছে। সিএএ পাশ করানোর সময় বিজেপি সরকারের দুই স্তম্ভ প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও শাসকদলের নেতৃবৃন্দের শরীরী ভাষায় ফুটে উঠেছিল বহুদিনের ঈপ্সিত লক্ষ্য (হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণ) স্পর্শ করার অপার আনন্দ ও উচ্ছ্বাস। তার সঙ্গে ছিল বেলাগাম অহংকার ও ঔদ্ধত্যও। সিএএ ও এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের প্রতি সর্বস্তরের জনগণের অংশ গ্রহণ, সমর্থন ও সহানুভূতির ব্যাপকতা ও তীব্রতা দিন দিন যতো বেড়েছে তাদের শরীরি ভাষা ততো ফ্যাকাসে ও বিবর্ণ হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে যাবতীয় অহংকার ও ঔদ্ধত্যৈর আস্ফালন অন্তর্হিত হতে শুরু করেছে। তাদের মুখের বচনও পাল্টাতে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী, তাঁর মন্ত্রী পারিষদ ও শাসকদলের নেতারা মিউ মিউ করে আত্মরক্ষার ঢঙে কথা বলা শুরু করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলছেন, না না, এনআরসি নিয়ে সরকারি স্তরে কোথাও কোনো আলোচনা হয় নি। সিএএ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পারিষদ বলছেন এই আইন তো নাগরিকত্ব দেবার জন্যে, কারো নাগরিকত্ব কেড়ে নেবার জন্যে নয়। বিরোধী দলগুলো ও আন্দোলনকারীরা অযথা মানুষকে বিভ্রান্ত ও মুসলিমদের ভয় দেখাচ্ছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পারিষদ যে মিথ্যাচার করছেন ও মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে প্রতারণা করছেন তা বুঝতে কারো অসুবিধা হচ্ছে না।অবশ্য মাঝে মাঝে হুমকিও শোনা যাচ্ছে তাঁদের কন্ঠে। বলছেন যে আন্দলনের চাপ যতোই হোক না কেন সিএএ ও এনআরসি প্রত্যাহার করা হবে না।

কারো নাগরিকত্ব যাবে না,  মোদি সরকারেরে এই আশ্বাস বাণী একটা ভয়ংকর মিথ্যাচার

সিএএ-এর গোটা কথাটা হলো সিটিজেনশিপ এ্যামেণ্ডমেন্ট এ্যাক্ট ২০১৯। হ্যাঁ, এই আইনে কারো নাগরিকত্ব কেড়ে নেবার কথা বলা হয় নি, বলা হয়েছে নাগরিকত্ব দেবারই কথা। আপাতদৃষ্টিতে এ কথা সত্যি বটে, কিন্তু বাস্তবে আদৌ নয়। বাস্তবে এটা অর্ধ সত্য যা মিথ্যা্র চেয়েও ভয়ংকর। এই সত্যটা অবশ্যই অর্ধ সত্য, কারণ এটা স্বয়ং সম্পূর্ণ আইন নয়, এনআরসি-র সঙ্গে এর অবিচ্ছ্বেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। আসামে এনআরসি-র ব্যর্থতা ঢাকতে তড়িঘড়ি সিএএ প্রণয়ন করা হয়েছে। এখানে এনআরসি-র ব্যর্থতার একটি বিশেষ অর্থ রয়েছে। তাহলো, বিজেপি চেয়েছিল এনআরসি-র সাহায্যে ব্যাপক সংখ্যক (লক্ষ্যমাত্রা ছিলো পঞ্চাশ হাজার) মুসলিমদের অনুপ্রবেশকারী প্রমাণ করে  ভারত থেকে গলা ধাক্কা দিয়ে বার করে দেওয়া। কিন্তু তাদের সে সাধ পূরণ হয় নি। কারণ, এনআরসির চূড়ান্ত তালিকায় যাদের নাম ওঠে নি তাদের মধ্যে ১২ লক্ষই হিন্দু। সেই ১২ লক্ষ হিন্দুদের জন্যেই মূলত সিএএ প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই আইনে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, পার্সি, জৈন ও শিখ ধর্মের মানুষকে নাগরিকত্ব দেবার কথা রয়েছে। সুতরাং এটা  স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে সিএএ ও এনআরসি পরষ্পরের পরিপূরক বা সম্পূরক এবং অবিচ্ছেদ্য। কথাটা এভাবেও বলা যায়, সিএএ হলো এনআরসির গর্ভজাত সন্তান। এনআরসির কাজ হলো নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া, আর সিএএ-এর কাজ হলো  যাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হবে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আসা মানুষের মধ্যে  মুসলমান বাদে হিন্দু সহ উপরে উল্লেখিত পাঁচটি ধর্মের মানুষদের তথা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া। এর অর্থ হলো, এনআরসি যদি মুসলিমদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়, তবে তারা ভারতীয় নাগরিক হলেও, নাগরিকত্ব ফিরে পাবে না। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে, হিন্দু ধর্ম সহ ৬টি ধর্মের মানুষদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেবে, কিন্তু মুসলমানদের ফেরত দেবে না। সুতরাং সিএএ-তে কারো নাগরিকত্ব যাবে না এ কথাটা অর্ধ সত্য। যেহেতু সিএএ নাগরিকত্ব দেবার বা ফিরিয়ে দেবার প্রশ্নে মুসলমানদের জন্যে সব দরজা বন্ধ করে দিয়েছে, তাই আসামের এনআরসি তালিকায় যে মুসলিমদের (তিন লক্ষ, মতান্তরে পাঁচ লক্ষ) নাম নেই তাদের দেশ ছাড়া  হতে হবে, না হয় কারাগারে পচে মরতে হবে। এ ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা থাকলো না।

আসামের এনআরসি ধর্মীয় বিভেদকামী ও মুসলিম-বিদ্বেষী ছিলো না 


আসামে ১৯৮৫ সালে এনআরসি তৈরী করার জন্যে যে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হয়েছিল সেটা মোটেই ধর্মীয় বিভেদমূলক ও সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্ট ছিলো না। এনআরসি তথা জাতীয় নাগরিক  পঞ্জী তৈরী করার উদ্দেশ্য ছিলো জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অবৈধ ভাবে প্রবেশ করা অভিবাসীদের খুঁজে বার করে তাদের দেশ থেকে বার করে দেওয়া। চুক্তিটি সম্পাদিত হয়েছিল আসু ও সারা আসাম গণসংগ্রাম পরিষদের প্রবল গণআন্দোলনের চাপে। সেই চুক্তির সম্পাদনের মধ্য দিয়েই দীর্ঘ ৬ বছরের আসু ও সারা আসাম গণসংগ্রাম পরিষদের গণআন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে। তাদের আন্দোলনের দাবি ছিল অবৈধ অভিবাসীদের চিহ্নিত করে ফেরত পাঠাতে হবে। সেই দাবি মেনে নিয়েই রাজীব গান্ধীর কেন্দ্রীয় সরকার ও তৎকালীন কংগ্রেসের আসাম সরকার আসু ও সারা আসাম গণসংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী ছিল আসু ও সারা আসাম গণসংগ্রাম পরিষদও। আসু ও আসাম গণসংগ্রাম পরিষদ তখন ১৯৬৬ সালের ১লা জানুয়ারীর আগে যারা আসামে এসেছে তাদের গ্রহণ করে নিতে এবং নিয়মিতকরণ করতে সম্মত হয়েছিল। পরে কেন্দ্রীয় সরকার তাতে একটি সংশোধনী নিয়ে আসে। সেই সংশোধনীতে বলা হয় যে, ১৯৭১ সালের ২৪ শে মার্চের মধ্যে যারা আসামে এসেছে তাদেরও ভারতীয় নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করে নিয়মিতকরণ করা হবে। তারপরে যারা ভারতে এসেছে তাদের চিহ্নিত করে ফেরত পাঠানো হবে। এই ছিল ১৯৮৫ সালের আসাম চুক্তির মূল কথা। অর্থাৎ আসু ও সারা আসাম গণসংগ্রাম পরিষদ আসামে অবৈধ উপায়ে প্রবেশকারী অভিবাসীদের চিহ্নিত করে বহিষ্কার করার দাবিতে যে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলে তার মধ্যে কোনোরূপ জাতি-বিদ্বেষ, বর্ণ-বিদ্বেষ বা ধর্ম-বিদ্বেষ  ছিল না। বিপুল সংখ্যক অবৈধ অভিবাসীদের চাপে আসামের ভাষা, নিজস্ব সংস্কৃতি ও অর্থনীতি বিপন্ন হয়ে উঠেছে - এটা ছিল তাদের আন্দোলনের মূল কথা। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর অবৈধ অভিবাসী কথাটির উপর ধর্মীয় লেবেল সেঁটে দেয়। অবৈধ অভিবাসীদের মধ্যে বিভাজন করে একটা জঘন্য সাম্প্রদায়িক মনোভাব থেকে। সরাসরি মুসলিম ও অমুসলিম এই দু ভাগে তাদের বিভাজিত করে। যারা মুসলমান তারা অনুপ্রবেশকারী, আর যারা অমুসলমান তারা শরণার্থী। এই হীন মনোভাব থেকেই তারা আসামের এনআরসির অভিমুখটাই ঘুরিয়ে দেয় মুসলমানদের দিকে। বিজেপির কেন্দ্রীয় সরকার এবং আসামের রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত করে এনআরসিকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে একটি মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই আসামের রাজ্য সরকার এনআরসির কাজ শুরু করে জোর কদমে। অবশ্য আসামে এন আরসির কাজ শুরু করার নির্দেশও ছিল সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এনআরসি যে তাদের কাছে বুমেরাং হয়ে প্রত্যাঘাত করতে পারে সে আন্দাজ তাদের ছিলো না।

বিজেপি সরকারেরে শরণার্থী নীতিটি ধর্মীয়-বিদ্বেষী মনোভাবাপন্ন

এনআরসি তথা জাতীয় নাগরিক পঞ্জী তৈরি করায় কোনো আপত্তি নেই। হওয়াটা যে খুব জরুরী তাও নয়।  আর আসামের এনআরসি হোক কিংবা মোদি সরকার সারা ভারতে যে এনআরসি তৈরি করতে চায় সেটাই হোক, এগুলো মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোনোভাবেই সমর্থন যোগ্য নয়। কারণ, বিজেপি সরকার যে মতলবে গোটা দেশে এনআরসি তৈরি করতে তার উদ্দেশ্য দুরভিসন্ধিমূলক। সেটা হলো, ভারত থেকে ব্যাপক সংখ্যক মুসলিমদের তাড়ানো। সারা পৃথিবীতেই অনুপ্রবেশ সমস্যা রয়েছে, ভারতেও আছে। বিশ্বে যতদিন ধনী ও গরীবের বৈষম্য থাকবে, ধনী দেশ ও গরীব দেশ থাকবে, রাষ্ট্রীয় অত্যাচার ও নিপীড়ন থাকবে, বর্ণবৈষম্য থাকবে, ধর্মীয় মৌলবাদ ও ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ থাকবে ততদিন অনুপ্রবেশের সমস্যা থাকবে। যে দেশে যত বেশি অনুপ্রবেশ ঘটে তাদের অনুপ্রবেশজনিত সমস্যা তত বেশি। যারা রাষ্ট্রীয় নির্যাতন কিংবা ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে কিংবা যুদ্ধের কারণে প্রাণ রক্ষার্থে স্বদেশ পরিত্যাগ করে এবং ভিন্ন দেশে অবৈধ ভাবে প্রবেশ করে তাদের শরণার্থী বলে। মানবিক কারণেই এই সব শরণার্থীদের আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসা সহ প্রয়োজনীয় সব রকমের সাহায্য দেওয়া হয়। এটা একটা সর্বজন গ্রাহ্য আন্তর্জাতিক নীতি। কিন্তু যারা অন্য কারণে, এবং যথেষ্ট যুক্তি সঙ্গত কারণেই, স্বদেশ পরিত্যাগ করে ভিন দেশে যায় বৈধ অনুমিতি ছাড়াই তাদের প্রতি রাষ্ট্রের, দেশের ও  সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী কীরূপ হওয়া বাঞ্ছনীয়? তাদের ক্ষেত্রে কি অমানবিক হওয়াই কি রাষ্ট্রীয় নীতি বা সমাজের নীতি হওয়া বাঞ্ছনীয় ? গোটা বিশ্বেই তো কাজের সন্ধানে মানুষ দেশান্তরী হয়তে হয় নিরুপায় হয়ে। এই নিরুপায় দরিদ্র কর্মচ্যুত মানুষ কিংবা বেকার ছেলেমেয়েরা কি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী ও সহানুভূতি পেতে পারে না? শ্রমিক রপ্তানি করা বহু দেশের একটা বিধি সম্মত বৈদেশিক নীতি। এরূপ ব্যবসা করে যেমন বহু বেসরকারি কোম্পানী, তেমনি করে বহু সরকারও। আমাদের ভারত থেকেও  মধ্যপ্রাচ্যে অসংখ্য মানুষ যায় বেসরকারি সংস্থার হাত ধরে কাজের জন্যে। বাংলাদেশ থেকে তো যায় হাজারে হাজারে। ভিন দেশে মানুষ বা শ্রমিক রপ্তানি করার পশ্চাতে কি শুধুই ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গীই থাকে, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী একেবারেই থাকে না?  নিশ্চয়ই থাকে। কিন্তু যারা সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার হাত ধরে ভিন দেশে যেতে পারে না, বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ ভাবে দেশান্তরি হয় তাদের প্রতি কি রাষ্ট্র কিংবা রাজনৈতিক দলগুলো মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী দেখাতে পারে না? ইউরোপের দেশগুলি ও সেখানকার নাগরিক সমাজ তো সেই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী প্রদর্শনে কার্পণ্য করে না। ট্রাম্প পূর্ববর্তী  আমেরিকাও তো কখনো করে নি। ইউরোপের দেশগুলো তো সেই সব অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কড়া মনোভাব করে তাদের দেশ থেকে তাড়ানোর কথা বলে না। আমাদের দেশ ভারতের সংস্কৃতিও অনুরূপ। অতীতে সব সরকারই তো অবৈধ অভিবাসীদের উদারনৈতিক দৃষ্টিভিঙ্গী ও মনোভাব প্রদর্শন করেছে চিরদিন, কাউকে তো তাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে নি। এমনকি বিজেপির নেতা অটলবিহারি বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারও তো একই নীতি প্রদর্শন করেছে। গুজরাটে মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের মদতে ও প্রশ্রয়ে যে মুসলিম নিধন যজ্ঞ হয়েছিল তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অটলবিহারি বাজপেয়ী। গুজরাটের সেই বীভৎস গণহত্যাকান্ডে বাজপেয়ী মোদিকে তখন যা বলেছিলেন তাতো আমাদের স্মরণে আজও সমান সমুজ্জ্বল। তিনি মুখ্যমন্ত্রী মোদিকে রাজধর্ম পালন করতে বলেছিলেন। বলা বাহুল্য যে, মোদি তা করেন নি। মুসলমানদের প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মোদির দৃষ্টিভঙ্গী ও মনোভাব প্রধানমন্ত্রী মোদির দৃষ্টিভঙ্গী ও মনোভাব একই রয়ে গেছে। বরং তিনি মুসলমানদের প্রতি আরও বেশী বিরূপ মনোভাব নিয়ে রাজধর্ম পালন করা বিরত রয়েছেন।
মোদি সরকারের শরণার্থী নীতিটি মুসলমানদের প্রতি তাঁর ঐ মনোভাব থেকেই তৈরি। অবৈধ অভিবাসীদের ধর্মীয় বিভাজনও ঐ মনোভাব থেকেই জাত। একদল অবৈধ অভিবাসী (হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, শিখ, জৈন ও পারসিক) হলো শরণার্থী, আর একদল অভিবাসী (মুসলমান) হলো অনুপ্রবেশকারী। মোদি সরকার শরণার্থীদের জন্যে অর্থাৎ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, শিখ, জৈন, ও পার্সিদের জন্যে প্রণয়ন করেছে সিএএ। সুতরাং মোদি সরকার কী সাফাই দিল তাতে কিছু যায় আসে না, সিএএ যে একটি ধর্মীয় বিভেদমূলক এবং মুসলিম-বিদ্বেষ প্রসূত আইন তা দিনের আলোর মতন স্বচ্ছ ও পরিষ্কার।
বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসীদের শুধু অনুপ্রবেশকারী হিসেবেই বিজেপি ও আরএসএস দেখে না। তাদের সকলকেই তারা মুসলিম মৌলবাদী ও মুসলিম সন্ত্রাসবাদী বলে মনে করে। এ কথা অনস্বীকার্য্য যে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে অনেক মুসলিম সন্ত্রাসবাদী ভারতে প্রবেশ করে এবং সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ করে। এমনকি তারা এদেশে কিছু মুসলিম জিহাদি অন্তর্জাল (নেট ওয়ার্ক/Net work) তৈরি করেও ফেলেছে। বলা বাহুল্য যে তাদের বিরুদ্ধে আমি সর্বদা সোচ্চার এ কথা সর্বজন বিদিত। তাদের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা (Zero tolerance) নীতি নিয়ে তাদের মূলোচ্ছেদ করুক আমি সর্বাগ্রে চাই। কিন্তু অবৈধ অভিবাসী সব মুসলমানই জঙ্গী ও সন্ত্রাসী এ কথা মানা যায় না। মানা যায় না, কারণ, তা একটা অতি নিম্নরুচির জঘন্য মিথ্যাচার যা এসেছে মুসলিম-বিদ্বেষ থেকে। শুধু ঐ অভিবাসী মুসলমানদের সম্পর্কে নয়, আরএসএস ও বিজেপির কট্টর লোকজন সমস্ত মুসলিমদের সম্পর্কেই ঐ একই ধারণা পোষণ করে। এটা আমার নিছক অনুমান কিংবা অমূলক সন্দেহ নয়, এ বিষয়ে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও রয়েছে। একজন অনামী লেখক হলেও হিন্দু সমাজের বহু মানুষের সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয় আছে যাদের অনেকেই আরএসএস ও বিজেপির মতাদর্শে বিস্বাসী। তাদের সঙ্গে আলাপ কালে তাদের সেই অমূলক ভ্রান্ত ধারণার প্রকাশ পেয়েছি। আমার মনে হয় বর্তমান বিজেপি সরকার সেই ভ্রান্ত ধারণার শিকার এবং তার দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে।
পরিশেষে আর একটা সমান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এ লেখাটি শেষ করতে চাই। তা হলো,  রাষ্ট্রের প্রশ্রয়ে মুসলিম মৌলবাদীদের হাতে অত্যাচারিত হয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে উপরে উল্লেখিত ছ'টি ধর্মাবলম্বী মানুষই শুধু ভারতে অবৈধভাবে প্রবেশ করে নি, মুসলিম সমাজের অসংখ্য ধর্মনিরপেক্ষ মানুষও ঐ একই কারণে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেছে। প্রতিবেশী তিনটি মুসলিম দেশ থেকেই নির্যাতিত মানুষরা ভারতে আসে নি। রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও ধর্মীয় নির্যাতন হাজার হাজার তামিলরাও শ্রীলংকা থেকে ভারতে এসেছে এবং বহুদিন যাবত তারা তামিলনাড়ু সহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বসবাস করছে। সিএএ উক্ত তিনটি দেশ থেকে আসা মুসলিম সমাজের ধর্মনিরপেক্ষ ছিন্নমূল মানুষগুলো ও শ্রীলংকা থেকে আসা ছিন্নমূল তামিল জনগণের প্রতিও চরম বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে।
                               শেষ

Friday, January 24, 2020

৭১তম প্রজাতন্ত্র দিবসে আমাদের সংবিধানটাই ধ্বংসের মুখে

"আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র রুপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠাার সঙ্গে শপথ গ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে: সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা, মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদ, আজ, ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।"
আমাদের (ভারতের) সংবিধান গৃহীত হয় ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারি। ২৬শে জানুয়ারি তাই ভারতবাসীর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। তাই ভারতে প্রতি বছর প্রজাতন্ত্র দিবস হিসাবে মহাসমারোহে উদযাপিত হয়। আগামীকালও হবে। কাল আমাদের ৭১তম প্রজাতন্ত্র  দিবস। এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন (ভয়ংকর ও বীভৎস) চেহারা নিয়ে দিনটি আমাদের সামনে উপস্থিত হচ্ছে। তা নিয়েই এই লেখার অবতারণা।

লেখার শুরুতেই যে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে সেটা আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনা (preamble)। সংবিধানটি গৃহীত হবার পর সত্তরটি বছর অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে কোনো সরকারই প্রস্তাবনায় উচ্চারিত শপথ ও অঙ্গীকার অনুযায়ী কাজ করে নি। ফলে সকল নাগরিক সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার পায় নি; চিন্তা, মতপ্রকাশ, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা পায় নি; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা কোথাও হয় নি; সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে ওঠে নি। বরং তার বিপরীতটাই হয়েছে। ফলে সমাজের সর্বস্তরে স্থান করে নিয়েছে স্থায়ীভাবে ন্যায়বিচারের বদলে অবিচার, অন্যায় বিচার; দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার; সমতার স্থলে বৈষম্য ও বঞ্চনা ইত্যাদি ইত্যাদি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বদলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ এবং গণতন্ত্রের সম্প্রসারণের বদলে উত্তরোত্তর সংকোচন ও রাষ্ট্রের দমনপীড়নের বৃদ্ধি সমাজ ও রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকলের কাজের বদলে কর্মহীনতা ও বেকারি বৃদ্ধি, ধনী-গরীবের বৈষম্য কমার বদলে ক্রমাগত বৈষম্য বৃদ্ধি, দারিদ্র্য দূরীকরণের বদলে দারিদ্র্য বৃদ্ধি, এগুলো আমাদের অঙ্গের ভূষণে পরিণত হয়েছে। এ রকম আরো কতো বৈপরিত্য রয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। তাই প্রজাতন্ত্র দিবসটিকে আমার প্রজাতন্ত্র দিবস মনে হয় না। কী মনে হয় তা এর আগে ২০১৫ সালে ব্যক্ত করেছি আমার ব্লগে। তার লিংক হলো www.giasuddinonline.blogspot.in.

এই বৈপরিত্য আমাকে চমকায় না। বুর্জোয়া সরকারগুলোর শাসনে এগুলোই স্বাভাবিক পরিণতি। ওরা মুখে যা বলে এবং সংবিধানে যা লেখে তার বিপরীতেই কাজ করে। এতেও কোনো অস্বাভাবিকতা আমি দেখি না। বুর্জোয়াদের সরকার তো তাদের নিজেদের (বুর্জোয়াদের) জন্যেই কাজ করবে। এমন কোনো যাদু (অর্থনীতি) নেই ওদের কাছে যা দিয়ে ওদের পক্ষে একই সঙ্গে তারা বুর্জোয়া শ্রেণী ও খেটে খাওয়া শ্রেণী তথা শোষিত শ্রেণীর স্বার্থে কাজ করা সম্ভব। কারণ, এই শ্রেণীদুটি তো পরষ্পর বিপরীত মেরুর। দ্বিতীয় শ্রেণীর জন্যে কিছু পদক্ষেপ তারা করে বটে, তবে তা তাদের চোখে ধূলো দেওয়ার জন্যে, তাদের আন্দোলনকে প্রশমিত করার জন্যে। তাদের এই মিথটা খাওয়ানোর জন্যে যে সরকারের (রাষ্ট্রের) শ্রেণী চরিত্র হয় না। রাষ্ট্র হয় নিরপেক্ষ এবং সবার।  বুর্জোয়া শ্রেণীর দলগুলো তাদের সরকারকে শ্রেণীনিরপেক্ষ দেখানোর জন্যে তাদের পরিচালিত সরকার তথা রাষ্ট্রের নামের আগে গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ইত্যাদি গালভরা শব্দগুলো বসিয়ে দেয়। যেমন আমাদের দেশের রাষ্ট্রের নাম দেওয়া হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। ব্যাস! তাতেই কেল্লা ফতে। আমরা বুঝে গিয়েছি যে আমাদের রাষ্ট্র শ্রেণীনিরপেক্ষ, রাষ্ট্রের চোখে আমরা সবাই সমান, সবার সমান অধিকার, বহু হাজার কোটি টাকার মালিক বৃহত পুঁজিপতি আম্বানির যেমন একটা ভোট আছে তেমনি নি:স্ব একজন ক্ষেতমজুরেরও আছে একটা ভোট। এটা যে স্রেফ ধাপ্পাবাজি, মানুষকে বোকা বানানোর জন্যে বানানো বুলি তা আজও আমরা বুঝে উঠতে পারি নি। ফলে বুর্জোয়া দলগুলি পাল্টাপাল্টি করে আরামসে তাদের সরকার তথা রাষ্ট্র পরিচালনা করে যাচ্ছে। তারই ফলশ্রুতিতে ধনী আরও ধনী হচ্ছে, ধনী-গরীবের ব্যবধান ক্রমশ বাড়ছে, বেড়ে চলেছে দ্রব্যমূল্য, বেকারি, কর্মহীনতা, ইত্যাদি ইত্যাদি। স্বভাবতই দেশের অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক সংকট, সাংস্কৃতিক সংকট, সামাজিক সংকট দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে।
বিজেপির সরকারের শাসনে গত ছ'বছরে এগুলো আরো বেড়েছে। সর্বস্তরে দ্বন্দ্ব ও সংকটও সমানে বাড়ছে, ঘনীভূত হচ্ছে, বেসামাল হয়ে উঠছে। এর মধ্যেও অস্বাভাবিকতা অনুসন্ধান করার কিছু নেই। কারণ বিজেপির শ্রেণী চরিত্র অন্য রকম নয়। এই দলটাও বুর্জোয়া শ্রেণীর দাসানুদাস। গণতান্ত্রিক যুগে বুর্জোয়ারা অনেক রাজনৈতিক দলকে লালনপালন করে। তাদের কোনো দলের প্রতি জনগণ যখন ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, তার প্রতি আস্থা হারায় তখন তাদের অন্য একটা দলকে তারা সামনে এগিয়ে দেয়। কংগ্রেসের দীর্ঘ শাসনে মানুষ ক্রমাগত যখন ক্ষোভ বেড়েছে তখন তারা জনগণের সামনে কংগ্রেসের বিকল্প হিসাবে বিজেপিকে এগিয়ে দিয়েছে। শ্রেণী অসচেতন মানুষ তাকেই ভোট দিয়ে সরকারে বসিয়েছে। ফলে সরকারের বদল হলেও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মৌলিক নীতির কোনো বদল হয় নি। ফলে কোনো ক্ষেত্রেই সংকট কমে নি, বরং আরও বেড়েছে, তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও শ্রীলঙ্কারও পেছনে নেমে গেছে। নেমে গেছে গণতন্ত্রের পরিসরের ক্ষেত্রে দশ ধাপ নীচে।
আমাদের স্বাধীনতার বয়স ৭২ পেরিয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে রাষ্ট্রের ক্ষমতায় মোদি সরকারের আগে ৩/৪টি রাজনৈতিক দলের সরকার, তাদের দলীয় জোটের সরকার আমরা দেখেছি। এমনকি বিজেপির নেতৃত্বাধীন দলীয় জোটেরও সরকারও দেখেছি যার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বিজেপির নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ী। বলা বাহুল্য যে সবগুলো সরকারই ছিল বুর্জোয়া সরকার। বাজপেয়ীর সরকার সহ আগের সেই সরকারগুলোকে আমরা কিন্তু কখনো এখনকার মোদি সরকারের মতন দৈত্য দানবের চেহারায় দেখি নি। আমাদের সংবিধান সম্পর্কে যা কিছুই প্রচার হোক না কেন, সংবিধানটি কিন্তু মোটেই শ্রেণীনিরপেক্ষ নয়, প্রধানত এটা বুর্জোয়াদের স্বার্থ রক্ষাকারী সংবিধান। তৎসত্ত্বেও এই সংবিধানে অন্যান্য সকল শ্রেণীর জন্যেও কিছু না কিছু সুযোগ সুবিধা রাখা হয়েছে। পূর্বতন সরকারগুলো মাঝে মাঝেই স্বৈরতান্ত্রিক পদক্ষেপ করেছে, কিন্তু তাই বলে তারা কখনোই চরিত্রগতভাবে স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ছিল না, ছিল বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক সরকার। আমাদের দেশের রাষ্ট্র সম্পর্কে যতই ভালো ভালো কথা শুনি না কেন, রাষ্ট্রটি হলো বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ফলে আমাদের দেশের গণতন্ত্রও বুর্জোয়া গণতন্ত্র যে গণতন্ত্র সকলের জন্যে উন্মুক্ত নয়। তাই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণকে দেওয়া হয় খুবই সীমিত ও খণ্ডিত গণতন্ত্র। আমাদের জন্যে অর্থাৎ জনগণের জন্যে আমাদের সংবিধানেও তাই সীমিত ও খণ্ডিত গণতন্ত্রটুকুই দেওয়া হয়েছে। প্রাক-মোদি জমানায় মাঝে মাঝেই সংবিধান প্রদত্ত সীমিত ও খণ্ডিত গণতন্ত্রটুকুকেও খর্ব করা হয়েছে, মতপ্রকাশের খণ্ডিত স্বাধীনতা ও সুযোগকে খর্ব করা হয়েছে। কিন্তু কোনো সরকার কখনও গণতন্ত্রকে হত্যা করে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে নি। মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপির সরকারের কাজকর্মে সেটা করার ঝোঁক প্রকটিত হচ্ছে। আমাদের দেশ বহু ভাষা, বহু ধর্ম, বহু জাতি-উপজাতি ও বহু সংস্কৃতির দেশ। তাই এ দেশ পরিচালিত হয় যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতিতে। এই নীতি ও কাঠামো অতীতে শক্তিশালী কেন্দ্র তৈরি করার অজুহাতে বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে, অঙ্গরাজ্যগুলোর ক্ষমতা খর্বিত হয়েছে। কিন্তু কখনও যুুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি ও কাঠামো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার প্রবণতা প্রকটিত হয় নি যা পরিলক্ষিত হচ্ছে মোদি সরকাররের মধ্যে। এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি বিশেষ ক্ষমতা ও অধিকার প্রাপ্ত অঙ্গরাজ্য জম্মু-কাশ্মীরকে দ্বিখণ্ডিত করে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে রূপান্তরিত করার নজিরবিহীন পদক্ষেপে।
আমাদের দেশটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ বলে পরিচিত। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ভারত একটি 'সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র' ('Socialist Secular Democratic Republic')। কিন্তু আমাদের দেশ ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকৃত অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ নয়। সেটাই প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র যে রাষ্ট্র বা সরকার ধর্ম বিষয়ে সদা নিরপেক্ষ থাকবে এবং সকল ধর্ম থেকে সমান দুরত্ব বজায় রাখবে। সরকার কোনো ধর্মের প্রতি কোনোরূপ পক্ষপাতিত্ব করবে না, এবং কোনো ধর্মের প্রতি বৈষম্যও করবে না। ধর্মবিশ্বাসীদের প্রত্যেকের ধর্মাচরণ করার সমান অধিকার সুনিশ্চিত করবে, কিন্তু ধর্মাচরণের অধিকারের নামে কাউকে সংবিধানের পরিপন্থী যে কোনো কাজ কঠোর হাতে দমন করবে। ধর্মীয় কোনো বিধান বা রীতিনীতি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে তাকে নিষিদ্ধ করে দেশের নিজস্ব সংবিধানকেই রক্ষা করবে। রাষ্ট্র কারো ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচরণে হস্তক্ষেপ করবে না, তবে কেউ তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস রাষ্ট্রের উপর চাপাতে চেষ্টা করলে সেটাও কঠোরভাবে দমন করবে। যারা নাস্তিক কিংবা সংশয়বাদী, রাষ্ট্র তাদের ধর্ম বিশ্বাস না করা ও ধর্মাচরণ না করার সম্পূর্ণ অধিকার প্রদান করবে, এবং সমাজ যদি তাদের সেই অধিকার খর্ব বা হরণ করার চেষ্টা করে তবে রাষ্ট্র অধিকার হরণকারীদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করবে। আমাদের দেশে কোনো সরকারই এই নীতিমালা অনুসরণ করে না, আমাদের সংবিধানও রাষ্ট্রকে এগুলো অনুসরণ করার নির্দেশ দেয় নি। বরং উল্টে আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ধর্মনিরপেক্ষ বলতে ধর্ম সমন্বয় মনে করেন। সেজন্য আমি এই অনুচ্ছেদর শুরুতেই বলেছি যে আমাদের দেশটি প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ নয়।
আমাদের সংবিধানে শিক্ষা, চাকরি, শিল্প, ব্যবসা প্রভৃতি ক্ষেত্রগুলিতে সব ধর্মের মানুষেরই সুযোগ ও অধিকার রয়েছে। সব ধর্মের মানুষেরই নিজ নিজ ধর্ম পালন করার স্বাধীনতা রয়েছে। সংবিধানে সবারই নিজ নিজ ধর্ম প্রচার করার অধিকার রয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংখালঘুদের ধর্মাচরণে বাধা দেওয়া বা হস্তক্ষেপ করাও বেআইনী করেছে। সংবিধানে নাগরিকদের ধর্ম বিশ্বাস না করা কিংবা ধর্ম পালন না করার অধিকারও রয়েছে।
সম্ভবত এজন্যেই আমাদের দেশে বিশ্বের দরবারে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। দেশের ভিতরেও সেই পরিচিত রয়েছে।  কিন্তু কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলো সর্বদা এই নীতিগুলো কখনোই সঠিকভাবে অনুসরণ করে না। কিন্তু তাই বলে কোনো সরকারই (মোদি সরকারের আগে পর্যন্ত) আমাদের সংবিধানে সীমিত আকারে হলেও যেটুকু ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ, নীতি ও বিধান রয়েছে তাকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে নি বা করতে উদ্যত হয় নি।  আমাদের দেশের এই আবহমান ঐতিহ্য (Tradition) এবার কিন্তু বিপন্নতার মুখে পড়েছে মোদি সরকারের হাতে।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে কেন্দ্রের ক্ষমতায় বিজেপি আসার পর থেকেই সংখ্যালঘুদের উপর, বিশেষ করে মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের উপর, হামলা করা শুরু হয়েছে। পরে অবশ্য কৌশলগত কারণে হামলা কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে শুধু মুসলমানদের উপর। এ হামলা কিন্তু শুধু আক্রোশ বশত স্বত:স্ফুর্ত হামলা নয়। এর পেছনে রয়েছে সুনির্দিষ্ট ও সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য ও পরিকল্পনা। তা হলো ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানো যেখানে  সংখ্যালঘুরা কেউ থাকবে না, স্বল্প সংখ্যক থাকলেও তারা হিন্দুদের অধীনতা স্বীকার করে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকবে। এর প্রতিবাদ করে আমি একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখি ২০১৫ সালে 'ভারতে ভাগবত-মোদির নেতৃত্বে হিন্দুত্বের অভিযান চলছে' শিরোনামে। প্রবন্ধটি হালনাগাদ (updated) করি ২০১৮ সালে (https://giasuddinonline.blogspot.com/2018/05/blog-post_29.html?m=1) প্রবন্ধটি অনেকেই পড়েছেন, তবু লিংকটি দিলাম যারা পড়েন নি তাদের জন্যে। ভারত থেকে মূলত মুসলমানদের তাড়ানোর জন্যে বিজেপি এনআরসিকে (জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকে) হাতিয়ার করে। আসামে যখন এনআরসি তৈরি করার জন্যে চুক্তি হয় তার পেছনে কোনো ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক দুরভিসন্ধি ছিল না। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সমস্ত অনুপ্রবেশকারীকে চিহ্নিত করে আসাম ও ভারত থেকে তাড়িয়ে দেওয়া তার উদ্দেশ্য ছিল।
কিন্তু বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরই এনআরসিকে তাক করে মুসলমানদের দিকে।তারা আসামে বসবাসকারী মুসলমানদের অনুপ্রবেশকারী তকমা দিয়ে এ দেশ থেকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার জন্যে এনআরসিকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫০ লক্ষ (পঞ্চাশ লক্ষ) মুসলমানকে বাংলাদেশী তকমা দিয়ে ভারত থেকে বিতাড়িত করা। কিন্তু গতবছর ৩১শে আগষ্ট প্রকাশিত এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা দেখে তারা ঘাবড়ে যায়। কারণ, তাতে বাদ পড়া ঊনিশ লক্ষ মানুষের মধ্যে ১৬ (ষোল) লক্ষই অমুসলিম এবং অধিকাংশই হিন্দু, আর মুসলমান মাত্র তিন লক্ষ। তখন আসাামের বিজেপি সরকার ও তাদের দল দুটি দাবি উত্থাপন করে - এক). এনআরসি তালিকাটি বাতিল করতে হবে, কারণ ওটা ভুলে ভর্তি। এবং দুই). পুনরায় একটি নতুন তালিকা তৈরি করতে হবে। সেই দাবিকে সমর্থন জানিয়ে বিজেপির তৎকালীন সভাপতি ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঘোষণা দেন যে ভারতের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে নাগরিকহীন হয়ে যাওয়া হিন্দুদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং যতদিন না ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনটির সংশোধন হচ্ছে ততদিন কোথাও এনআরসি তৈরি করা হবে না।
তারপর তড়িঘড়ি কেন্দ্রীয় সরকার তার ঘোষণা মত সেই আইনটি সংশোধন করে নতুন নাগরিকত্ব আইন তৈরি করে (নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯, CAA 2019)। এই আইনের কাজ হল জাতীয় নাগরিক পঞ্জি থেকে যে সকল অমুসলমানদের নাম, বিশেষ করে হিন্দুদের নাম, বাদ যাবে তাদের পুনরায় ভারতের নাগরিকত্ব প্রদান করা। সুতরাং এনআরসি ও সিএএ-র মূল উদ্দেশ্য পরিষ্কার। উদ্দেশ্যটি হল কোটি কোটি ভারতীয় মুসলমানকে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী তকমা দিয়ে ভারত থেকে তাড়ানো। এই সিএএ ও এনআরসির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে আমার একটি লেখা আছে যার লিংকটি হলো  https://giasuddinonline.blogspot.com/2019/12/blog-post.html?m=1

সিএএ ও এনআরসি-র জন্যে স্বভাবতই এ দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাহীন ভয় ও আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। হবারই তো কথা। কারণ, বিজেপি সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যে মুসলিমরা এই দেশে (ভারতে) স্বাধীনতার বহু আগে থেকেই বসবাস করছে তাদেরও নির্বাসিত করতে। হ্যাঁ, বিজেপি সরকার যে সেটাই চায় তা সংশয়াতীত। ভারত ভাগের সময় ওদের পূর্বসূরীদের (আরএসএস ও হিন্দু মহাসভা) দাবি ছিল পাকিস্তান যদি মুসলমানদের জন্যে তৈরি হয় তবে ভারত হবে শুধু হিন্দুদের দেশ। তারই ভিত্তিতে ভারত ভাগের পর ওরা দাবি করেছিল যে হিন্দু ও মুসলমানদের যথাক্রমে ভারতে ও পাকিস্তানে বিনিময় করতে হবে। অর্থাৎ ভারতের ভাগে যে মুসলমানরা পড়েছে তারা যদি পাকিস্তান না যায় তবে তাদের জোর করে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিতে হবে এবং পাকিস্তানের ভাগে পড়া হিন্দুদের ভারতে নিয়ে আসতে হবে। বিজেপি তো আরএসএস ও হিন্দু মহাসভার উত্তরসূরী। স্বভাবতই তারাও সেই তত্ত্বেরই অনুসারী। আরএসএস ও হিন্দু মহাসভার দাবি সেদিন প্রত্যাখ্যাত হলেও সেই দাবি বা তত্ত্ব তারা কখনোই ত্যাগ করে নি। সেই তত্ত্ব তো মনে প্রাণে লালনপালন করে বিজেপিও। মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার এখন সেই তত্ত্বই বাস্তবায়িত করতে তৎপর হয়ে উঠেছে। স্বভাবতই এবারের প্রজাতন্ত্র দিবসেও মুসলিমরা ভয় ও আতঙ্ক থেকে বেরোতে পারছে না।

আতঙ্ক ঢুকেছে হিন্দুদের মধ্যেও। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র হিন্দুরা ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। আসামের এনআরসি তালিকা থেকে তারা বুঝেছে যে তাদেরও নিস্তার নেই। তাদের নাম যদি ঐ তালিকায় না ওঠে তবে তারা নাগরিকত্ব পুনরায় পাবে কিনা তা নিয়ে তাদের ঘোর সংশয় রয়েছে। আর নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়ার বিষয়টা তো পরের কথা, তার আগে তো তাদের তুলে নিয়ে গিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দি করা হবে।
আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে এ দেশের প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের মনেও। কারণ, আইনটি তো শুধু সাম্প্রদায়িক আইনই নয়, আইনটি যে সংবিধানবিরুদ্ধও। বিজেপির সরকারের অভিসন্ধি তো স্পষ্ট।  তাদের লক্ষ্য হলো ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র ধ্বংস করে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানিয়ে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করা।
তাই এবারের প্রজাতন্ত্র দিবসে আরএসএস, বিজেপি ও সঙ্ঘপরিবারের অন্যান্য সদস্যরা ছাড়া আর কেউ স্বস্তিতে নেই, আনন্দে ও উচ্ছ্বাসে নেই।
              -----      --------        ------- 

(বি:দ্র: ব্লগটি লিখেছি ২৫শে জানুয়ারি। কিন্তু ব্লগের শিরোনামের নীচে দেখাচ্ছে ২৪শে জানুয়ারি। এটা কেন দেখাচ্ছে জানি না)

Wednesday, December 11, 2019

মুসলিম-মুক্ত হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্যেই CAA ও NRC


নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (CAB) রাজ্যসভায় পাস হয়ে গেলো আজ। বিলটি লোকসভায় পাস হয়েছে গত সোমবারই (৯ই ডিসেম্বর)। আর কয়েক ঘণ্টা পরই এটা রাষ্ট্রপতির অনুমোদন প্রাপ্ত হয়ে আইনে (নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯ তথা CAA 2019 - এ) রূপান্তরিত হয়ে যাবে। এটি বিজেপি সরকারের বহুদিনের আকাঙ্ক্ষিত মূল লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্যে একটি প্রবল ক্ষমতাশালী মোক্ষম অস্ত্র। আর একটি মোক্ষম অস্ত্র এনআরসি তো আগে থেকেই মজুত রয়েছে। NRC (National Register of Cityzenship) তথা জাতীয় নাগরিক নিবন্ধগ্রন্থ তৈরি করার জন্যে একটা চুক্তি হয় ১৯৮৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকার এবং আসু (All Asam Students Union) ও অল আসাম গণসংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে (AAGSP)। NRC তৈরি করার সেই চুক্তিটি হয়েছিল শুধু আসামের জন্যে যার উদ্দেশ্য ছিল আসাম থেকে সমস্ত অনুপ্রবশকারীদের চিহ্নিত করে তাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করা। সেই চুক্তি অনুসারে সুপ্রিম কোর্ট NRC তৈরি করার জন্যে আসাম সরকারকে নির্দেশ প্রদান করলে ২০১৩ সালে তার কাজ শুরু হয়। তার এক বছর পরেই অর্থাৎ ২০১৪ সালে বিজেপি কেন্দ্রের ক্ষমতায় চলে আসে এবং RSS - এর পছন্দের লোক নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তার দু'বছর পরে ১৯১৬ সালে আসামেও বিজেপি সরকার তৈরি করে। NRC তৈরি করার জন্যে যখন চুক্তি হয় তখন তার লক্ষ্য ছিল জাতপাত-ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত অনুপ্রবেশকারীকে বহিষ্কার করা। কিন্তু বিজেপি সেই লক্ষ্য বদলে দেয় এবং তারা নিশানা করে শুধু মুসলিম অনুপ্রবশকারীদের প্রতি। মুখে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের কথা বললেও আসলে তারা নিশানা করেছে সমস্ত মুসলিমদেরকেই। NRC তৈরি করার কাজ শুরু করার বহু আগে থেকেই তারা প্রচার করা শুরু যে আসামে ৫০ লক্ষ বাংলাদেশী মুসলিম অনুপ্রবেশকারী রয়েছে। এদিকে পশ্চিমবঙ্গে দু'কোটি বাংলাদেশী মুসলিম অনুপ্রবেশকারী বাস করছে বলে বিজিপির নেতৃবৃন্দ তারস্বরে চিৎকার করার ঢঙে লাগাতার প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এসব প্রচার থেকে তাদের লক্ষ্য যে শুধু বাংলাদেশী মুসলিমরাই নয়, লক্ষ্য এ দেশের মুসলিমরাও তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। এটা সর্বজন বিদিত যে মুসলিমরা সবচেয়ে গরীব এবং সবদিক থেকেই পশ্চাৎপদ। তাই তাদের ধারণা ছিল যে মুসলিমদের বিশাল সংখ্যক মানুষের হাতে ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণ করার কাগজপত্র নেই এবং তাদের সহজেই অনুপ্রবেশকারী তকমা দিয়ে ভারত থেকে তাড়িয়ে দেওয়া যাবে। ধারণাটি যে মস্ত বড়ো ভুল ছিলো তা নয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকার কারণে হিন্দুরাও যে ব্যাপক সংখ্যায় NRC-র বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়ে যেতে পারে তা হয়তো তাদের ধারণার মধ্যে ছিলো না। ফলে তাদের এ ছবিটিও দেখতে হলো শুধু মুসলিমরাই নয়, লক্ষ লক্ষ হিন্দুর নামও জাতীয় নাগরিক পঞ্জিতে নেই। ৩১শে আগষ্ট NRC-র যে চূড়ান্ত তালিকা বের হয়েছে তাতে যে ১৯ লক্ষ মানুষের নাম নেই তাদের মধ্যে ১২ লক্ষই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। যে অস্ত্রটি বিজেপি সরকার প্রয়োগ করতে চেয়েছিলো জাতশত্রু মুসলমানদের উপর সেটা বুমেরাং হয়ে তাদেরকেও বিঁধেছে। এর শাস্তিও তারা পেয়ে যায় ক'দিন যেতে না যেতেই। রায়গঞ্জ ও খড়্গপুর বিধানসভার উপনির্বাচনে পরাস্ত হয় তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে যে দু'টি সেগমেন্টে (বিধানসভা নির্বাচন ক্ষেত্রে) কিছুদিন আগে হয়ে যাওয়া লোকসভা সাধারণ নির্বাচনে বড়ো ব্যবধানে এগিয়েছিলো। এই পরাজয়টা তাদের বরণ করতে হয়, কারণ রাাজবংশী সহ অন্যান্য বর্গের ব্যাপক সংখ্যক হিন্দু যারা লোকসভায় বিজেপিকে ঢেলে ভোট দিয়েছিলো তারাই NRC আতঙ্কে ঢেলে ভোট দিয়েছে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ তৃণমূল কংগ্রেসকে। তারপরই পশ্চিমবঙ্গ সহ সারাদেশে NRC প্রয়োগ করার পরিকল্পনা সাময়িক ভাবে স্থগিত রাখে এবং ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনটি সংশোধন করতে তৎপর হয়। ইতিমধ্যেই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনটি যে সংসদের দু'কক্ষেই পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছে তা শুরুতেই বলা হয়েছে। এই আইনের সাহায্যে আসামের নাগরিক পঞ্জি থেকে বাদ পড়া অহিন্দুদের ভারতের নাগরিকত্ব প্রদান করে হিন্দুদের হারানো আস্থা ফিরে পেতে চায়। মোদি সরকার এখন প্রতিবেশী তিনটি দেশ (আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ) থেকে এসে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের (মুসলমান বাদে) শরণার্থী তকমা দিয়ে অতি দ্রুত ভারতের নাগরিকত্ব দিয়ে তাদের কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্ত করতে তৎপর হবে। বলা বাহুুল্য যে ঐ একই কারণে উক্ত কারাগারে বন্দি মুসলমানদের অনন্ত কাল কারাগরেই পচতে হবে।

সঙ্ঘপরিবারের মূল লক্ষ্য

সঙ্ঘপরিবারের কর্তা হলো আরএসএস তথা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ (RSS) এবং তার রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান হলো ভারতীয় জনতা পার্টি। এছাড়াও আরএসএসের রয়েছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, দুর্গাবাহিনী ইত্যাদি আরো কয়েকটি উগ্র জাতীয়তাবাদী সাম্প্রদায়িক শাখা সংগঠন। বিরোধী দলগুলো বলছে বিজেপির নতুন নাগরিকত্ব আইন করার মূল লক্ষ্য হলো ভোটব্যাংক স্ফীত করা এবং বেকারি, আকাশ ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, দেশজুড়ে ক্রমবর্ধমান নারীর শ্লীলতাহানি ও তাদের উপর বলাৎকার ইত্যাদি জ্বলন্ত সমস্যাগুলি থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘোরানো। নতুন নাগরিকত্ব আইনে তাদের হিন্দু ভোট হয়তো বাড়বে, কিন্তু ভোট বৃদ্ধি করা কিংবা জ্বলন্ত সমস্যাগুলি থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্যেই তারা নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে গোটা দেশে এনআরসি তৈরি করতে উদ্যোগী ও তৎপর হয়েছে তা কিন্তু নয়। তারা এটা করেছে তাদের মূল লক্ষ্যে দ্রুত পৌঁছনোর জন্যে।
সঙ্ঘপরিবারের মূল লক্ষ্য হলো বিশুদ্ধ হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণ করা যে রাষ্ট্র থেকে যতদূর সম্ভব অহিন্দুদের বিতাড়িত করা। সবাইকে তাড়ানো যদি সম্ভব না হয় তবে যারা অবিতাড়িত থেকে যাবে তাদের উপর হিন্দুদের একচেটিয়া কতৃত্ব, নেতৃত্ব ও আধিপত্য চাপানো। এটা আইন করে যদি করা সম্ভবও না হয় তবে সামাজিক ভাবে বলপ্রয়োগ করে তা সম্ভব। তাদের চিন্তাধারা অনেকটা ইসলামী রাষ্ট্রের মতন। এই রাষ্ট্রগুলো কোথাও কোথাও আইন করেই অমুসলিমদের নাগরিকত্ব না দিয়ে জিম্মি (hostage) করে রেখেছে, আর কোথাও রাষ্ট্রশক্তির মদতে অমুসলিমদের উপর মুসলমানদের কতৃত্ব, নেতৃত্ব ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে।

হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের কাজ আগে থেকেই চলছে

অটলবিহারী বাজপেয়ী ছিলেন নরম হিন্দুত্বের প্রবক্তা। লালকৃষ্ণ আদবানি ছিলেন তাঁর অনুসারী। বাজপেয়ী ছিলেন প্রবল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। তাই তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন তাঁঁর সরকারের উপর আরএসএস তাদের হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের পরিকল্পনা রূপায়নের জন্যে জোর খাটাতে পারে নি। আদবানিরও ব্যক্তিত্বের জোরও ছিলো যথেষ্ট। তিনি প্রধানমন্ত্রী হলে তাই একই সমস্যার উদ্ভব হবে ভেবে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে আরএসএস আদবানির পরিবর্তে নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী করে। কারণ, তিনি ছিলেন আরএসএসের পোস্টার বয় ও বিশ্বস্ত সৈনিক।
মোদির নেতৃত্বে সেই নির্বাচনে বিজেপি লোকসভায় একাই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ফলে বিজেপি, আরএসএস ও তার শাখা সংগঠনগুলিতে মরা গাঙে জোয়ার আসার মতন পরিস্থিতি তৈরি হয়। তারা মোদি সরকার এবং বিজেপির রাজ্য সরকারগুলির মদতে ও প্রশ্রয়ে বিজেপি প্রভাবিত অঞ্চলগুলিতে পরিকল্পনা মাফিক হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণের কাজ শুরু করে দেয়। শুরু করে গো-হত্যা বন্ধ ও গোরক্ষা আন্দোলন, ঘরওয়াপসি, লাভ জিহাদ, ধর্মান্তরকরণ ইত্যাদি কর্মসূচি রূপায়নের কাজ। গোরক্ষা আন্দোলনের নামে সঙ্ঘপরিবারের বাহিনী গো-বলয়ে তাণ্ডবে মত্ত হয় মুসলিমদের উপর। সেই তাণ্ডবে তারা শুধু অত্যাচার নির্যাতনের শিকারই হয় নি, কয়েকজন নিহতও হয়েছে। ঘরওয়াপসি আন্দোলন ও লাভ জিহাদের নিশানাতেও মুসলিমরাই। হিন্দুত্ববাদীদের দাবি হলো সকল ভারতীয়ই হিন্দু, কারণ যারা ভারতের মুসলিমরা ধর্মান্তরিত মুসলিম, তাদের পূর্ব পুরুষরা ছিলো হিন্দু। তাদের মুসলিম শাসকরা ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিলো। তাই তারা ঘরওয়াপসির মাধ্যমে মুসলমানদের তাদের ঘরে (হিন্দু ধর্মে) ফিরিয়ে আনতে তৎপর হয়েছে। লাভ জিহাদের কর্মসূচির নিশানা হলো মূলত মুসলিম নারী। ওদের অভিযোগ হলো মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি এই যে, তাদের ছেলের দল নানা প্রলোভনে ফুসলিয়ে হিন্দু মেয়েদের বিয়ে করে তাদের ধর্মান্তরিত করে মুসলিম বানাচ্ছে এবং তাদের দিয়ে গণ্ডায় গণ্ডায় সন্তান পয়দা করিয়ে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি করছে। এটা মুসলিমরা করে পরিকল্পনা মাফিক যার উদ্দেশ্য হলো মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে ভারতে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা করা। তাই তারা হিন্দু ছেলেদের বলছে যে তাদেরও মুসলিম মেয়েদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত করে তাদের দিয়ে গণ্ডায় গণ্ডায় সন্তান পয়দা করিয়ে হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। সেজন্যই তাদের লাভ জিহাদের কর্মসূচি। ধর্মান্তরকরণের (conversions) কর্মসূচি আর লাভ জিহাদের কর্মসূচি কিন্তু এক নয়। ধর্মান্তরকরণের কর্মসূচি অনেক বড়ো ও ব্যাপক। এই কর্মসূচির নিশানায় রয়েছে কিন্তু সকল অহিন্দুরাই, বিশেষ করে আদিবাসী ও ধর্মান্তরিত খ্রিষ্টানরা। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি কেন্দ্রের ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরপরই আরএসএস ও বিজেপি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষ করে তারা যেখানে শক্তিশালী, সেসব অঞ্চলে হিন্দুত্বের অভিযান শুরু করে যার মধ্যে রয়েছে উপরোক্ত কর্মসূচিগুলি। এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি "ভাগবত-মোদি জুটির নেতৃত্বে ভারতে হিন্দুত্বের অভিযান চলছে" শিরোনামে আমার একটি লেখায়। ওটা লিখেছি ২০১৫ সালে (https://giasuddinonline.blogspot.com/2015/04/blog-post.html?m=1)  লেখাটি পরে দু'বার হালনাগাদ (update) করা হয়েছে।

সিএএ হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদী আইনই
   

বিরোধী দলগুলি এবং অরাজনৈতিক বহু ব্যক্তিত্ব প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ধর্মীয় বিভাজনের অভিযোগ এনেছেন। এই অভিযোগ যে ভিত্তিহীন বা অবাস্তব নয় তার স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে উক্ত আইনের মধ্যেই। আইনটির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও   থেকে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে যারা ভারতে এসেছে তারা শরণার্থী এবং তাদেরই শুধু ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। সেই শরণার্থীদের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজন করা হয়েছে নগ্ন ভাবেই। তার প্রমাণ হলো এই যে, তাতে মাত্র ছ'টি (হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, শিখ, জৈন ও পার্সি) ধর্ম সম্প্রদায়ের নাম রয়েছে। উল্লেখিত তিনটি প্রতিবেশী মুসলিম সমাজের প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ মানুষরাও মুসলিম মৌলবাদীদের দ্বারা অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হয়। সেই অত্যাচারে তারা কতজন নিহত হয়েছে এবং তাদের কতো জন যে হামলা ও মামলার শিকার তার ইয়ত্তা নেই। তাদের কতজন যে প্রাণ রক্ষার্থে দেশ ত্যাগ করেছে তারও ইয়ত্তা নেই। তারা যদি ভারতে এসে আশ্রয় নিয়ে থাকে তবে তাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যবস্থা এই আইনে নেই। শুধু আমাদের প্রতিবেশী তিনটি রাষ্ট্রেই নয়, মুসলিম সম্প্রদায়ের অসংখ্য প্রগতিশীল ও যুক্তিবাদী মানুষ রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার হয় মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী রাষ্ট্রগুলিতেও। এই দেশগুলোর মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য হলো সৌদি আরব ও ইরান। ফলে মুসলিম সম্প্রদায়ের বহু মানুষ আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলিতে আশ্রয় নিয়ে প্রাণ রক্ষা করেছে। মুসলিম সন্ত্রাসবাদীদের নৃশংস ও বর্বর অত্যাচারে ইরাক, ইরান ও নাইজেরিয়া থেকে কতো লক্ষ মানুষ ইউরোপের দেশগুলিতে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে তারও তোো ইয়ত্তা নেই। তাদের সিংহভাগই মুসলমান। মায়ানমার থেকেও লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমানও রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশত্যাগ করে বিভিন্ন দেশে গিয়ে শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এই বিপুল সংখ্যক মুসলিম শরণার্থীদের সিএএ-তে ভারতের নাগরিকত্ব প্রদান করার কথা বিবেচনা করা হয় নি। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা থেকেও ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের ফলে অসংখ্য মানুষ  ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যে এসে বসবাস করছে বহুদিন যাবৎ। তারাও তো শরণার্থী।  কিন্তু তাদের কথাও বিবেচনা করা হয় নি। কৌশলগত কারণে নাগরিকত্ব সংশোধিত আইনে হিন্দু ছাড়া আরো পাঁঁচটি ধর্ম সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করা হলেও বিজেপির আসল লক্ষ্য হিন্দুদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করা যাতে হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে হিন্দুরাষ্ট্র কায়েম করার পথ মসৃণ হয়। তারজন্যই সিএএ। সুতরাং আইনটি যে হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদী আইনই তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই।

সিএএ, এনআরসি-র নিশানা মুসলিমরাই

প্রধানমন্ত্রী বরাবরই মনে পোষেন এক কথা, আর বলেন আর এক কথা। তাঁর মনের কথা একরকম, আর মুখের কথা আরেক রকম।পরিকল্পনা করেন এক রকম আর মানুষকে বলেন আরেক রকম। এটা তাঁর এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ২০১৪ সালের নির্বাচনে শ্লোগান দেন, "সবকা সাথ, সবকা বিকাশ"। কিন্তু পুরো পাঁচ বছর সকলের সাথে ও সকলের উন্নয়নের শ্লোগান শিকেয় তুলে রেখে নি:শব্দে শনৈ শনৈ গতিতে কাজ করে গেলেন হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাণ করার লক্ষ্যে। গত (২০১৯) লোকসভা নির্বাচনে আরো বড়ো বিজয় পাওয়ার পর জুড়ে দেন সবকা বিশ্বাসকেও সবকা সাথ ও সবকা বিকাশের সঙ্গে। অর্থাৎ তিনি মুসলিমদের বোঝাতে চাইলেন যে এবার তিনি তাদেরও বিশ্বাস অর্জন করার লক্ষ্যে কাজ করবেন। কিন্তু দ্বিতীয় বার অর্থাৎ গত বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েই তড়িঘড়ি দু'টি দানবীয় পদক্ষেপ নিয়ে তিনি দেশবাসীকে বুঝিয়ে দিলেন যে সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস, এসব ফালতু কথা, তাঁর আসল এজেণ্ডা হলো হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণ করাই। দানবীয় পদক্ষেপ দুটির একটি হলো জম্মু-কাশ্মীরকে ভেঙে দু'টুকরো করে তার রাজ্যের মর্যাদা হরণ করা, এবং তার বিশেষ অধিকার ও ক্ষমতা সম্বলিত ৩৭০ নং ধারা ও ৩৫এ উপধারাটি বিলোপ করা। আর দ্বিতীয় দানবীয় স্বৈরাচারী পদক্ষেপটি হলো ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনটি সংশোধন করে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন' ২০১৯ তথা সিএএ' ২০১৯ প্রণয়ন করা যেটি সম্পূর্ণ ধর্মীয় বিভেদমূলক। জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে যে পদক্ষেপটি নেওয়া হয়েছে সেটা শুধু স্বৈরাচারীই নয়, পদক্ষেপটি নেওয়ার পেছনে রয়েছে সরকারের ধর্মীয়বিদ্বেষ মূলক নিকৃষ্ট মানসিকতাও। প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুখে যাই বলুন না কেন, তাঁরা চান জম্মু-কাশ্মীরের মুসলিমদের শক্তি খর্ব করে তাদের হীনবল করে তাদের রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও নিপীড়নে নিষ্পেষিত করতে। সেই মতলবেই গতবছর ৫ই আগষ্ট মোদি-শাহ জুটি জম্মু-কাশ্মীরকে দ্বিখণ্ডিত করে তার বিশেষ অধিকার ও ক্ষমতা (৩৭০ নং ধারা ও ৩৫এ উপধারা) হরণ করা হয়েছে এবং ঠিক তার আগেই সেখানকার তিন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সমস্ত নেতা ও কর্মীদের হয় গৃহবন্দি, না হয় কারাবন্দি করা হয়েছে। আর ঠিক সেই কালা দিন ৫ই আগষ্ট থেকেই টেলিফোন সংযোগ ও ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, এবং গোটা রাজ্যটিকে মুুড়ে ফেলা হয়েছে ১৪৪ নং ধারা ও বহু জায়গায় কারফিউ জারি করে। এ সব পদক্ষেপ জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের উপর রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন, নির্যাতন ও নিষ্পেষণ চালানো ছাড়া আর কী বলা যায়?
এ প্রসঙ্গে এ কথাটাও বিশেষভাবে স্মরণীয় যে ৩৭০ নং ধারা ও তার উপধারা ৩৫এ বাতিল করা হলেও কিন্তু ৩৭১ নং ধারা ও তার উপধারাগুলোয় (৩৭১-এর ৩৭১এ থেকে ৩৭৩জে নং উপধারায়) হাত দেওয়া হয় নি, উল্টে সে ধারা-উপধারাগুলি অক্ষত রাখার ঘোষণাই দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এই ৩৭১ নং ধারার বিশেষ সাংবিধানিক ক্ষমতা ও অধিকার ভোগ করে মহারাষ্ট্র, গুজরাট সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছ'টি রাজ্য। এটা কী প্রমাণ করে যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য বলেই জম্মু-কাশ্মীরকে দ্বিখণ্ডিত করে, এবং তাকে দুটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলছেন যে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে মুসলিমদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কারণ, এই আইনে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে ভারতে আসা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার সংস্থান রয়েছে শুধু, কারো নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার কথা বলা হয় নি। হ্যাঁ, সিএএ-তে সত্যিই কারো নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার ব্যবস্থা নেই। তবুও প্রধানমন্ত্রীর এই ব্যাখ্যা ও আশ্বাসবাণী অসত্য ও প্রতারণা বৈ নয়।  এটা কেন অসত্য ও প্রতারণা তা বুঝতে হলে চোখ রাখতে হবে এনআরসি-র  উপর এবং সিএএ ও এনআরসি-কে পাশাপাশি রেখে বিচার করতে হবে। কেননা এ দুটি হলো পরষ্পরের প‍রিপূরক, একটাকে বাদ দিলে আরেকটা অসম্পূর্ণ। সিএএ ও এনআরসি পরষ্পরের পরিপূরক বলেই আসামে এনআরসি করার পর গোটা দেশে এনআরসি তৈরি করা স্থগিত রেখে মোদি সরকার তাড়াহুড়ো করে সিএএ প্রণয়ন করা হলো। আইনটি প্রণয়ন করার আগে এবং প্রণয়ন করার  সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুন:পুন ঘোষণা দেন যে আইনটি প্রণীত হলেই গোটা দেশেই এনআরসি তৈরি করা হবে এবং ২০২৪ সালের মধ্যেই তার কাজ শেষ করা হবে। আসামে এনআরসি চূড়ান্ত তালিকা বের করার পর কী পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তা আমরা সবাই জানি। ৩.২৯ কোটি লোক তালিকায় নাম নথিভুক্ত করার আবেদন করেছিল। তাদের মধ্যে ঊনিশ লক্ষ মানুষের আবেদন বাতিল হয়েছেে যাদের মধ্যে ষোলো লক্ষ মানুষই অমুসলিম। তাদের বারো লক্ষই আবার হিন্দু যা বিজেপিকে  বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে নিক্ষেপ করে। সে অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমুসলিমদের, বিশেষ করে হিন্দুদের, অভয় দেন যে তাদের কোনো ভয় বা উদ্বেগের কারণ নেই। কারণ, অনতিবিলম্বে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হবে।  তারপর নজিরবিহীন দ্রুততায় সিএএ প্রণয়ন করে প্রধানমন্ত্রী তাঁর কথা রাখেন। সুতরাং সিএএ ও এনআরসি যে পরষ্পরের পরিপূরক তা স্পষ্ট। এনআরসি অস্ত্র দিয়ে মুসলমানদের অনুুুপ্রবেশকারী তকমায় বিদ্ধ করতে গিয়ে সেই অস্ত্রে যে হিন্দুরা ঘায়েল হবে তাদের উদ্ধার করতে প্রয়োগ করা হবে সিএএ। কিন্তু সিএএ-এর সহায়তা পাবে না মুসলমানরা। সুুতরাং এটা প্রমাণ করে যে, মুসলমানদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই কারণ তাদের নাগরিকত্ব যাবে না এই ব্যাখ্যা ও আশ্বাসবাণী অসত্য ও প্রতারণাই। এগুলো আরো প্রমাণ করে যে সিএএ ও এনআরসি-র নিশানা মুুুসলিমরাই।

আশু লক্ষ্য মুসলিম-মুক্ত ভারত নির্মাণই


সিএএ ও এনআরসি-র লক্ষ্য হলো ভারতকে মুসলিম-মুক্ত রাষ্ট্রে পরিণত করা। মুসলিম-মুক্ত রাষ্ট্র মানে ভারতে একজনও মুসলমান থাকবে না তা নয়। মুসলমানরা থাকলে থাকবে এমন অল্প সংখ্যায় যাতে তাদের দরকষাকষির শক্তি না থাকে এবং তাদের রাখা হবে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে। এটা অবশ্য বিজেপির আশু লক্ষ্য। ওদের মূল লক্ষ্য হলো ভারতকে একটি বিশুদ্ধ হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র বানানো। সে রাষ্ট্রে সকল অহিন্দুদের বিতাড়িত করা সম্ভব না হলে (সম্ভব নয়ও) তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখা হবে। যারা ফ্যাসিস্ট সরকারের সমালোচনা করবে তাদের নির্মমভাবে দমন করা হবে। কীভাবে সে লক্ষ্যে তারা পৌঁছতে চায় তা আলোচনা করার জায়গা এটা নয়। সুতরাং সিএএ ও এনআরসি নিয়ে তারা যে আশু লক্ষ্য রেখেছে সে আলোচনায় ফিরে আসা যাক
আসামের এনআরসি-র চূড়ান্ত তালিকায় যে ঊনিশ লক্ষ মানুষের নাম ওঠে নি তাদের মধ্যে কয়েক লক্ষ যে ভারতের বৈধ নাগরিক রয়েছে তা বলা বাহুল্য। ঐ তালিকায় এরকম বহু উদাহরণ রয়েছে - স্বামীর নাম আছে কিন্তু স্ত্রীর নাম নেই, স্ত্রীর নাম আছে স্বামীর নাম নেই, ছেলের নাম আছে বাবার নাম নেই, বাবার নাম আছে ছেলের নাম নেই, বাবা-মায়ের নাম আছে তাদের সন্তানদের নাম নেই। এগুলো ছাড়াও অনেক অসঙ্গতি রয়েছে। যারা দশকের পর দশক সেনাবাহিনী, পুলিশবাহিনী, সরকারি প্রশাসন, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি ক্ষেত্রে কর্মরত থেকে দেশের সেবা করেছে তাদের বহুজনের নাম নেই। নাম নেই এমনকি দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আমেদের পরিবারের সদস্যদেরও। এটা প্রমাণ করে যে অসংখ্য বৈধ ভারতীয় নাগরিক আসামের নাগরিক পঞ্জি থেকে বাদ পড়েছে। সেই সংখ্যাটা যে কয়েক লক্ষাধিক হবে না তা কেউ হলফ করে বলতে পারবে না। কেন ভারতের বৈধ নাগরিকদের নাম ঐ তালিকায় ঠাঁই পায় নি তা বোঝার চেষ্টা করা যাক।
আসামের নাগরিক পঞ্জিতে তাদেরই নাম নথিভুক্ত করার নির্দেশ ছিল যারা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের আগে থেকেই আসামে বসবাস করছে। সেই তালিকায় নাম তোলার জন্যে যারা আবেদন করেছিল তাদের মধ্যে ঊনিশ লক্ষের আবেদন গ্রাহ্য হয় নি। এর অর্থ হলো তারা প্রামাণ্য নথিপত্র পেশ করতে পারে নি। এই না পারাদের দলে যে ভারতের বৈধ নাগরিকরাও রয়েছে সে কথা আগেই বলেছি। রয়েছে প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা অসংখ্য মানুষও যারা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের মধ্যে এসেছে। বৈধ ভারতীয় নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও, কিংবা যারা প্রতিবেশ দেশ থেকে উক্ত বেঁধে দেওয়া সময়ের আগে থেকেই ভারতে বসবাস করছে তারা এতো বিশাল সংখ্যায় কেন তাদের সপক্ষে প্রামাণ্য কাগজপত্র দেখাতে পারে নি? এই না পারাটা আমাকে অবাক করে নি।
তাদের পক্ষে প্রামাণ্য কাগজপত্র দেখাতে না পারার পেছনে রয়েছে বহুবিধ কারণ। তার মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলো দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, স্বল্প শিক্ষা ও অসচেতনতা। দারিদ্র্যের চেহারাটা ফুটে বেরিয়েছ  ভারত  সরকারের উন্ননয়ন দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীর রাজ্যসভায় পেশ করা এই রিপোর্ট যেখানে বলা হয়েছে যে আসামে দারিদ্র্য সীমার নীচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ৩২%। আর শিক্ষার দৈনতাটি এ রকম: ২০১১ সালের আদমশুমারি রিপোর্ট অনুযায়ী স্বাক্ষরতার হার ৭৩%। এই স্বাক্ষর সম্পন্ন মানুষদের মধ্যে রয়েছে বড়ো সংখ্যক অষ্টম শ্রেণী উত্তীর্ণ বা অনুত্তীর্ণ লোকজনও। এই পরিসংখ্যান স্পষ্ট করে সেখানকার মানুষের সচেতনতার অভাব কতো প্রকট‍। আসামের জনসংখ্যা (২০১১ সালের আদমশুমারি থেকে) তিন কোটি কয়েক লক্ষ। বর্তমানে সেটা কিছু কমবেশি সাড়ে তিন কোটি। অর্থাৎ দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করা মানুষের সংখ্যা এক কোটি বারো লক্ষ। তাদের মধ্যেই রয়েছে রয়েছে লক্ষ লক্ষ গৃৃহহীন ও বাস্তুহীন। তাছাড়া লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজের সন্ধানে ভারতের এক প্রদেশ থেকে আরেক প্রদেশে গিয়ে বাস করে। আসামেও বাস করে এ রকম অসংখ্য মানুষ। উপরোক্ত দরিদ্র, বাস্তুহীন, ভিটিহীন, ভিন্ন রাজ্য থেকে কিংবা ভিন্ন দেশ থেকে ছিন্নমুল মানুষগুলো কোথায় পাবে প্রামাণ্য কাগজপত্র? সুতরাং পঞ্জি থেকে বাদ বৈধ ভারতীয় নাগরিকের সংখ্যা ঊনিশ লক্ষ হওয়াটা চমকানোর মতন সংখ্যা মোটেই নয়।
ঊনিশ লক্ষের মধ্যে যে ষোলো লক্ষ অমুসলিম রয়েছে তাদের জন্যেই প্রণীত হলো সিএএ। এই আইনের সাহায্যে যে ভারতীয়রা নাগরিকত্ব হারিয়েছে তাদের সেটা ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে যারা ২০১৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতে এসেছে তাদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে। কিন্তু জাতীয় নাগরিক পঞ্জিতে (এনআরসিতে) মুসলমানদের নাম (তারা বৈধ ভারতীয় হওয়া সত্ত্বেও)  না থাকে তারা নিশ্চিতভাবেই হবে রাষ্ট্রহীন।
আসামের নাগরিক পঞ্জি বাতিল করে নতুন করে আবার পঞ্জি তৈরি করা হবে সে কথা ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে আসাম সরকার। পঞ্জিটি বাতিল করতে চায় দুটি কারণে। প্রথমত পঞ্জি থেকে যাদের নাম বাদ গেছে তাদের ৮৪% অহিন্দু। দ্বিতীয়ত পঞ্জিছুট মাত্র মুসলিমদের সংখ্যা মাত্র তিন লক্ষ যা পঞ্জিছুটদের মোট  সংখ্যার ১৬% এর নীচে। কিন্তু ওরা চেয়েছিল ৫০ (লক্ষ) মুসলমানকে অনুপ্রবেশকারী দেখাতে। ৫০ লক্ষ লক্ষ হলো আসামের মুসলিম জনসংখ্যার ১৫/১৬%। বলা বাহুল্য যে  আসামের নাগরিক পঞ্জি ওদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে পারে নি, বরং রুষ্টই করেছে। তাই ওটা বাতিল করে আসাম সরকার নতুন একটা পঞ্জি বানাতে চায়। এটা চায় প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর স‍রকারও।
আসামে এটা যদি তারা করতে পারে তাহলে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপাবে বাকি ভারতে। তখন তাদের মুসলিম বিতাড়নের লক্ষ্যমাত্রা হবে আরও অনেক বড়ো। লক্ষ্যমাত্রাটা যদি ভারতের মুসলিমদের মোট জনসংখ্যার পঞ্চাশ/ষাট শতাংশও হয় তবুও তাতে বিষ্ময়ের কিছু থাকবে না। কারণ ভারতকে মুসলিম-মুক্ত করার স্বপ্ন পূরণে আসাম ছিল মোদি সরকারের এ্যাসিড টেস্টের প্রথম পরীক্ষাগার (Laboratory)। প্রথম প্রচেষ্টা তাদের পুরোপুরি সফলতা পায় নি। কিন্তু তাতে তারা হতোদ্যম হয় নি। বরং আরও অধিক উদ্যমী হয়েছে। তাই একদিকে আসাম সরকার নতুন জাতীয় নাগরিক পঞ্জি তৈরি করার দাবি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, অপরদিকে কেন্দ্রীয় সরকার সিএএ প্রণয়ন করেছে। এমতাবস্থায় আসামে তারা যদি নতুন পঞ্জি তৈরি করার পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের অনুমতি পেয়ে যায় (পাওয়ার সম্ভাবনাই উজ্জ্বল দেখাচ্ছে) তাহলে আসামে তাদের লক্ষ্যের  (১৬/১৭% মুসলিমকে বিতাড়ন করা)  কাছাকাছি তাদের পক্ষে পৌঁছে যাওয়া খুব কঠিন নাও হতে পারে। আর তখন তো সমগ্ৰ ভারত থেকে তাদের মুসলিম বিতাড়নের লক্ষ্যমাত্রা আসামের লক্ষ্যমাত্রা ১৬/১৭% থেকে বেড়ে ৫০/৬০% হ ওয়াটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার হবে না। গোটা দেশে এনআরসি কার্যকর করার ক্ষেত্রে বিজেপি সরকারকে আটকানো না যায় তবে কয়েক কোটি মুসলমানকে অনুপ্রবেশকারী তকমায় বিদ্ধ হয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে ঢুকতে হবে, নতুুুবা তাদের দেশের সীমানার বাইরে কোথাও নিয়ে গিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। আর তখন বাকি মুসলমানদের জিম্মি বা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রাখতে বিজেপি সরকারকে মোটেই বেগ পেতে  হবে না। আর আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ ভারত তখন তো কার্যত মুসলিম-মুক্ত ভারত হয়ে উঠবে।

                    সমাপ্ত

বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাইনি – পাঁচ

  দ্বিতীয় অধ্যায় শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবের প্রতি তীব্র গণরোষের নেপথ্যে ২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে ৩৬ দিন পর (৫ই ...