Monday, November 20, 2017

সৌদি রাজার হাদিস সংস্কারের কর্মসূচী একটি ঐতিহাসিক, যুগান্তকারী ও বৈপ্লবিক পদক্ষেপ



সমগ্র বিশ্বে এই সময়ে সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী একটি খবরটি হলো, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের হাদিস সংস্কারের সিদ্ধান্ত সহিহ হাদিসগুলি খতিয়ে দেখতে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ‘কিং সলমান কমপ্লেক্স’ নামে  তিনি একটি কমিটি গঠন করেছেন কমিটিকে দেখতে বলেছেন কোন হাদিসগুলি মুহাম্মদের বাণীর সঙ্গে খাপ খায় না, এবং হিংসা ও হত্যাকাণ্ডকে যথার্থ প্রমাণ করতে মুহাম্মদের বাণীকে বিকৃত করেছে। যে সব হাদিস রক্তারক্তি ও হানাহানির কথা বলে, মহম্মদের বার্তাকে বিকৃত করে সেগুলি তিনি হাদিস থেকে বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রায় বিশ্বাস্য সংবাদটির কথা জানিয়েছেন সৌদির আরবের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী। হাদিস থেকে হিংসা ও ঘৃণা মুছে ফেলে একটি হিংসামুক্ত মার্জিত হাদিস তৈরী করার এই উদ্যোগকে বিশ্বের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মুসলিমরা নিশ্চয় স্বাগত জানাবেন কারণ, এ কথা অনস্বীকার্য যে, এই সময়ে সারা বিশ্বে শান্তি, সহবস্থান ও গণতন্ত্রের পক্ষে ইসলাম এবং ইসলামি সন্ত্রাসবাদ একটি বিরাট বড়ো হুমকি রূপে আবির্ভূত হয়েছেসৌদি আরবের এই উদ্যোগে বোধ হয় সব চেয়ে বেশী খুশী হবেন মডারেট মুসলিমরা। কারণ, মুসলিম জঙ্গিদের জিহাদি সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডকে অনৈসলামিক বলে তাঁরাই সবচেয়ে বেশী সোচ্চার। অবশ্য এ যাবৎ তাঁরা তাঁদের দাবির সপক্ষে জোরালো কোন দালিলিক প্রমাণ দাখিল করতে পারেন নি। সৌদি রাজার সৌজন্যে এবার তাঁরা তাঁদের সপক্ষে একটি আস্ত হাদিস পেতে চলেছেন যেটা তাঁরা দালিলিক প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন  
হাদিস মুসলমানদের ২য় ধর্মগ্রন্থ। হাদিস গুরুত্ব ও মর্যাদার দিক থেকে প্রধান ধর্মগ্রন্থ কোরানের প্রায় সমতুল্য। কারণ, হাদিস হলো মুহাম্মদের বাণী ও জীবনাচরণ। তারা মনে করে যে কোরানের মতো হাদিসের প্রতিটি কথা নির্ভুল ও সত্য। তাদের কাছে হাদিসের অসম্ভব গুরুত্বের আরো একটি বড়ো কারণ রয়েছে। সেটা এ রকম কোরানে বহু অস্পষ্ট, অসংলগ্ন ও দ্ব্যর্থবোধক আয়াত আছে যার বাখ্যা হাদিস লিপিবদ্ধ রয়েছে। তাছাড়া রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা ও প্রশ্নের উত্তর কোরানে পাওয়া যায় না, হাদিসে সেগুলির কিছু কিছু পাওয়া যায়। সেজন্যে বলা হয় যে, ইসলাম দাঁড়িয়ে আছে মূলতঃ দু’টি প্রধান স্তম্ভের উপর যার একটি কোরান, আর অন্যটি হাদিস। সৌদি আরবে যে সংবিধান চালু রয়েছে তারও প্রধান ভিত্তি হলো এই দু’টি ধর্মগ্রন্থ - কোরান ও হাদিস। এর অর্থ হলো, মুসলমানদের কাছে কোরান যতখানি অপরিহার্য, হাদিসও ঠিক ততটাই অপরিহার্য।
মুসলিমদের নিকট হাদিস অপরিহার্য আর একটি কারণে। সেটা হলোঃ মুহাম্মদ কোরান লিপিবদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু নিষেধ করেছিলেন হাদিস লিপিবদ্ধ করতে। তথাপি মুহাম্মদের অনুগামী খলিফারা হাদিস সংকলন করার অনুমতি দেন। সেটা এজন্যে যে, মুহাম্মদের পরের যুগে খলিফাগণকে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে এমন বহু সমস্যার মুখমুখি দাঁড়াতে হয়েছিলো যার সমাধান সূত্র কোরানে উপলব্ধ হয় নি। সাহাবি ও তাবেয়ী পরবর্তী যুগের খলিফাগণের পক্ষে তাই মুহাম্মদের বাণী ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত হওয়া একান্ত অপরিহার্য হয়ে ওঠে। তখন তাঁরা বিশ্বস্ত ও অনুগত ধর্মগুরুদের হাদিস সংগ্রহ ও সংকলিত করার নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশানুসারে কতিপয় ধর্মগুরু হাদিস সংগ্রহ করে খলিফার নিকট জমা দেন। খলিফাদের কাছে যে সব হাদিস জমা পড়ে তার মধ্যে ছ’জন ধর্মগুরুর সংগৃহীত হাদিসগুলি সহিহ (সত্য, নির্ভুল ও সঠিক) হাদিস হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সেই হাদিস ছ’টি হলো - সহিহ বুখারী, সহিহ মুসলিম, জামি’আত তিরমিযি, সুনানে আবু দাউদ, সুনানে নাসাই এবং সুনানে ইবনে মাজাহ।   
উক্ত হাদিসগুলির মধ্যে প্রাচীনতম হাদিসটির নাম বুখারী হাদিস। বুখারী হাদিস যিনি সংগ্রহ করেন তাঁর জন্ম ১৯৪ হিজরীতে (৮১৬ খৃঃ), অর্থাৎ মুহাম্মদের মৃত্যুর (৬৩২ খৃঃ) ১৮৪ বছর পর। এর অর্থ হলো মুহাম্মদের মৃত্যুর কমপক্ষে ২০০ বছর পর হাদিস হাদিস সংগ্রহ ও সংকলন করা হয়েছিলো। স্বভাবতই এমনটা হওয়া স্বাভাবিক যে বহু সঠিক হাদিস যেমন সহিহ হাদিস থেকে বাদ পড়ে গেছে, তেমনি কিছু ভুল ও জাল হাদিসও সহিহ হাদিসে অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছে। শিয়া মুসলমানরা তো এই সহিহ হাদিসগুলির একটিকেও সহিহ হাদিস বলে গণ্য করে না। তারা হাদিসগুলিকে খেলাফতি হাদিস (ফরমায়েশি হাদিস) বলে প্রত্যাখান করেছেন। তাদের মূল অভিযোগ হলো, খলিফাদের নির্দেশে বহু সত্য হাদিসকে বাদ দেওয়া হয়েছে, বহু হাদিসকে বিকৃত করা হয়েছে এবং বহু জাল হাদিস অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
হাদিস সম্পর্কে উক্ত অভিযোগগুলিকে মিথ্যে ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে যেমন এক কথায় উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তেমনি সমস্ত অভিযোগই যে সত্যি ও বাস্তব তাও নয়। ইসলামের ইতিহাস, মুহাম্মদের বাণী ও কর্মকাণ্ড এবং কোরান পর্যালোচনা করলে এটা বোঝা যায় যে, সহিহ হাদিসগুলের মধ্যে কিছু অসত্য ও জাল হাদিস থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে হাদিসগুলি সহিহ হাদিসই। মূলতঃ সে কারণেই প্রায় ১২০০ বছর যাবত এই হাদিসগুলিকে সুন্নি মুসলমানগণ সহিহ হাদিস রূপে গণ্য ও সমাদর করে আসছে এবং সৌদি আরবও এতদিন তাইই করেছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে বিশ্বের মুসলিম জনসংখ্যার নব্বই শতাংশই হলো সুন্নি মুসলমান, এবং ৪/৫ টি দেশ বাদে মুসলিম বিশ্বের সবগুলি দেশই সুন্নি মুসলমানদের দেশ। আর এই দেশগুলির শরিয়া আইন রচিত হয়েছে কোরান ও হাদিসের ভিত্তিতেই। সৌদি আরবও তার ব্যতিক্রম নয়। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, সৌদি রাজা তা হলে এতকাল বাদে হাদিস সংস্কার করার সিদ্ধান্ত নিলেন কেন? কোনো সন্দেহ নেই যে এটা একটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ। হাদিসের প্রতি মুসলমানদের বিশ্বাস, আনুগত্য ও আবেগ এতটাই প্রবল যে এর প্রতিক্রিয়া মারাত্মক হতে পারে। এমনকি দেশের অভ্যন্তরে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিও তৈরী হতে পারে।                                  
তা হলে সৌদি রাজা কেন এরূপ ঝুঁকি নিলেন? এর উত্তর সন্ধান করতে গেলে প্রথমেই আইএস এর হুমকির কথা মনে আসতে পারে। কারণ, আইএস একদিকে যখন ঝড়ের গতিতে সিরিয়া ও ইরাকে তার খেলাফত বিস্তার করে চলেছে, শিয়া মুসলিম-সহ সমস্ত অমুসলিমদের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা নির্বিশেষে গলা কাটছে, তাদের বন্দি করে  ক্রীতদাস বানাচ্ছে , বিক্রি করছে, সমস্ত প্রাচীন স্থাপত্য ও ভাস্কর্য ধ্বংস করছে, তখন আর একদিকে আইএস খলিফা আবুবকর আল বাগদাদী ঘোষণা করছেন যে ইরাক ও সিরিয়ার পর তাদের পরবর্তী টার্গেট হলো সৌদি আরব। শুধু আইএস নয়, মিশরের জঙ্গি সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডেরও  টার্গেট সৌদি আরব। তাছাড়া আরও বহু মুসলিম জঙ্গি সংগঠন আছে যারা সৌদি আরবকে প্রকৃত ইসলামি রাষ্ট্র বলে মানে না। তারা সবাই সৌদি রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে সৌদি আরবে ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর 
সৌদি রাজপুত্রের কাছে এই জঙ্গি সংগঠনগুলিই কি প্রবল ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছে? জঙ্গিদের মোকাবিলায় তিনি কি আর শুধু রাষ্ট্রীয় শক্তির উপর আস্থা রাখতে পারছে না? তার জন্যেই  কি তিনি রাষ্ট্রীয় শক্তির পাশাপাশি তত্ত্বগতভাবেও (ideologically) জঙ্গিদের মোকাবিলা করার কথা ভাবছেন? তাই কি হাদিস থেকে তিনি জিহাদের নাম-নিশানা মুছে ফেলতে চান?      
এমনটা হওয়া অসম্ভব নয়। জিহাদি সংগঠনগুলি সামরিক ও সাংগঠনিক দিক থেকে উত্তরোত্তর যেভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠছে তাতে ওদের ভয় পাওয়ারই কথা। তবে শুধু জঙ্গিদের ভয়েই সৌদি রাজা হাদিস সংস্কার করতে চাইছেন এমনটা ভাবলে তা হবে অতি সরলীকরণ। জঙ্গি সংগঠনগুলিকে ভয় পাওয়া  হয়তো একটা বড়ো কারণ, কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ মোটেই নয়।
অন্য কারণ নিশ্চয়ই য়েছে। কী সে কারণ তা বোঝার জন্যে সৌদি আরব সরকার সাম্প্রতিক কালে সরকারি নীতি ও আইনে যে পরিবর্তিনগুলি এনেছে তার প্রতি আমাদের দৃষ্টি রাখতে হবে। পরিবর্তনগুলি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে সৌদি সরকার কট্টর ইসলামি নীতি ও বিধিগুলি একে একে পরিত্যাগ করে সেগুলির স্থলে প্রগতিশীল আইন প্রণয়ন করেছে। এই শতাব্দীর প্রথম দশক থেকেই পরিবর্তনের এই ধারা চোখে পড়ছে। ২০০৮ সালে সৌদি আরবের বাদশা আবদুল্লাহ বিন আজিজ সৌদ ভ্যাটিকানে গিয়ে পোপ ষোড়শ বেন্ডিক্টটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পোপ বাদশাকে সৌদি আরবে খৃস্টানদের জন্যে গীর্জা স্থাপন ও ধর্মাচরণ করার অনুমতি দেবার অনুরোধ জানালে বাদশা তাতে তৎক্ষণাৎ সম্মতি জানান। এই সংবাদে মুসলিম বিশ্ব তখন কেঁপে ওঠেছিল। কারণ, বাদশার পোপের কাছে যাওয়া এবং খৃস্টানদের গীর্জা স্থাপন ও ধর্মাচরণ করার অনুমতি দেওয়া দুটোই স্পষ্টতঃই ইসলামি নীতিবিরুদ্ধ কাজ ও গর্হিত অপরাধ। কারণ, ২য় খলিফা ওমর ফারুক মুহাম্মদের মৃত্যুকালীন অছিয়ত অনুসারে আরব থেকে সমস্ত কাফের ও মুশরিকদের বিতাড়িত ও তাদের ধর্মীয় উপাসনালয়গুলিকে ধ্বংস করেছিলেন। তারপর থেকেই আরবে অমুসলিমদের ধর্মাচারণ করা ও ধর্মীয় উপাসনালয় স্থাপন করা চিরদিনের জন্যে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ভ্যাটিক্যান থেকে ফেরার মাত্র তিন বছর পর ২০১১ সালে বাদশার আরো তিনটি সিদ্ধান্ত বিশ্বকে ফের চমকে দেয়। তিনি ঘোষণা করেন - সৌদি নারীকে ভোটাধিকার দেওয়া হবে, তারা ভোটে লড়তেও পারবে এবং মজলিসে শুরার সদস্যও হতে পারবে। ২০১৪ সালে আর এক ধাপ এগিয়ে তিনি নারীর খেলাধূলার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন। বলা বাহুল্য যে এই পদক্ষেপগুলি সম্পূর্ণ ইসলামি মূলনীতির পরিপন্থী। ২০১৪ সালে সৌদি বাদশা বিদেশীদের অনুকূলে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনেন। তা হলো এরূপঃ সৌদি আরবের সংবিধানে বিদেশীদের নাগরিকত্ব ও বসবাসের অনুমতি দেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সেই নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে তিনি সীমিত সংখ্যককে বিদেশীকে স্পেশাল রেসিডেন্সি কার্ড ইস্যু করেন।  
বাদশা আবদুল্লাহর এই বৈপ্লবিক কাজগুলি এখন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বর্তমান সৌদি রাজা, তাঁরই সৎ ভাই, সালমান বিন আজিজ সৌদ। তিনি আবদুল্লাহর অসমাপ্ত কাজগুলি যেমন সম্পূর্ণ করছেন একে একে, তেমনি সৌদি নারীকে অধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রগুলি আরো কিছুটা প্রসারিত করছেন। যেমন, সম্প্রতি নারীকে গাড়ি চালানো এবং স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখার অধিকার প্রদান করেছেন। সর্বশেষ খবর হলো, সৌদি রাজা এবার থেকে মুসলিম নারীদের পুরুষ সঙ্গী ছাড়াই হজ্বে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করেছেন।
সৌদি রাজা আবদুল্লাহ বিন আজিজ ও সালমান বিন আজিজ যে পরিবর্তনগুলি এনেছেন সেগুলি শুধু আইনি পরিবর্তন ভাবলে ভুল হবে। এগুলি হলো সৌদি রাষ্ট্র ও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার। এ সংস্কার তাঁরা করছেন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও আধুনিক যুগের অপরিহার্য চাহিদাগুলি পূরণ করার বাধ্যবাধ্যকতায়। কিন্তু সমস্যা হলো, এই সংস্কার প্রক্রিয়ার অন্তর্গত প্রতিটি পদক্ষেপই ইসলামি আইন ও আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সৌদি রাজতন্ত্রের সামনে তাই উভয়সংকট। সংস্কার না করলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এবং দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে, আবার সংস্কার করতে গিয়ে গুরুতর অভিযোগ উঠছে ইসলামি আইন ও মতাদর্শ লঙ্ঘনের।
সৌদি রাজার কাছে পরিস্থিতির অপরিহার্য দাবি হলো সংস্কার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে, আবার ইসলাম লঙ্ঘনের অভিযোগও নস্যাৎ করতে হবে। অর্থাৎ যাবতীয় সংস্কার যে ইসলাম সম্মত পথেই হচ্ছে তা প্রমাণ করতে হবে। সেজন্যেই হাদিস সংস্কার করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। আর এটাই সৌদি রাজার হাদিস সংস্কারের দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পশ্চাতে প্রধান কারণ। তাই অবশেষে সে পথেই পা বাড়ালেন সৌদি রাজা সালমান বিন আজিজ সৌদ। তাঁর পক্ষে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান রাজার অনুগত হাদিস বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে দিয়ে সে কাজের সূচনা করলেন। হাদিস সংস্কারের এই কাজটিকে যুক্তিগ্রাহ্য করে তোলার জন্যে যুবরাজ জানিয়েছেন যে, যে সব হাদিসে মহম্মদের বাণী ও কাজকে বিকৃত করা হয়েছে সেগুলি বাতিল করে একটি বিশুদ্ধ হাদিস তৈরী করা হবে। সৌদি রাজতন্ত্রের লক্ষ্য হলো এমন একটি হাদিস রচনা করা যেটা সংস্কার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে সাহায্য করবে এবং যারা  হিংসার মাধ্যমে সৌদি রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করতে চায় তাদের মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।         
১২০০ বছর ধরে যে হাদিসগুলি মুসলিমদের বুকে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে রয়েছে তাকে সংশোধন করে মার্জিত ও পরিশীলিত করা খুবই কঠিন কাজ। তবুও সৌদি রাজার এ প্রয়াস সফল হবে বলে মনে হয়। কারণ, এ প্রয়াসের পেছনে রয়েছে রাজার ঐকান্তিক ইচ্ছা ও রাষ্ট্রের পূর্ণশক্তি। আর এ প্রয়াস যদি সফলকাম হয় তবে সমগ্র বিশ্বেই মুসলিম সমাজে সংস্কারের কাজ অনেকটাই সহজ ও সুগম হয়ে উঠবে।
এ নিবন্ধটি শেষ করবো আর একটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিবেশন করে। সেটা এ রকমঃ উপরে উল্লেখ করেছি যে, সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এমন অনেক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে যে সেক্ষেত্রে কী করণীয় তার উত্তর কোরান দিতে পারে নি এবং তার জন্যে খলিফাগণ অনন্যোপায় হয়ে হাদিস সংগ্রহ ও সংকলন করতে বাধ্য হন। কিন্তু খেলাফত চালানোর ক্ষেত্রে কোরানের সীমাবদ্ধতাটাই একমাত্র সমস্যা ছিলো না। সাম্রাজ্যের বিস্তার ও তার সুরক্ষার প্রশ্নে কোরান বহু ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক ও প্রতিবন্ধকও হয়ে উঠেছিলো। তাই পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতা হেতু খলিফাদেরও ইসলামি নীতির সংস্কার করতে হয়। ইসলামি নীতির সংস্কার করার অর্থ হলো কোরানের আদেশ ও উপদেশের পরিপন্থী আইন-কানুন তৈরী করা ও প্রবর্তন করা। ইসলামি নীতির সংস্কার যাঁরা করেন তাঁদের মধ্যে ২য় খলিফা ওমর ফারুক ও ৩য় খলিফা ওসমান গণিও ছিলেন। ওসমান গণির বিরুদ্ধে মুসলিমদের একাংশ বিদ্রোহ করে এবং বিদ্রোহীরা তাঁকে ৪০ দিন রাজপ্রাসাদে বন্দী রেখে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রধান কারণ ছিলো এই যে, তিনি ইসলামি নীতি থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। অর্থাৎ তিনি ইসলামি নীতির যে সংস্কার করেন তাকেই বিদ্রোহীরা ইসলাম থেকে বিচ্যুতি হিসবে গণ্য করে। ২য় খলিফা ওমর ফারুক কোরানের তালাক আইনের সংস্কার করেছিলেন। কোরানের আইনে তিন মাসে তিন তালাক দেওয়ার আইন রয়েছে। তিনি সেই আইনে সংযোজনী আনেন যাতে বলা হয়েছে, একসঙ্গে তিন তালাক দিলেও তা বৈধ হবে। ৫ম খলিফা মুয়াবিয়া বহু সংস্কার করে গিয়েছেন। তাঁর করা সবচেয়ে বড়ো সংস্কারটি ছিলো ইসলামি রাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষ নীতির প্রবর্তন করা। তিনি মজলিসে শুরা ও সৈন্যবাহিনীতে বহু অমুসলিমদের নিয়োগ করেন। উমাইয়া বংশের খলিফা ২য় ওমরকেও সৎ খলিফা মানা হয়। তিনিও অনেক সংস্কার করেন ইসলামি নীতিতে। মুয়াবিয়া যে ধর্মনিরপেক্ষ নীতির প্রবর্তন করেছিলেন তাকে আরো বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যান খলিফা ২য় ওমর। তিনি অমুসলমান বা বিধর্মীদের ধর্মীয়স্থানগুলোকে (ইহুদিদের ‘সিনাগণ’, খ্রিস্টানদের গীর্জা প্রভৃতি) অত্যন্ত যত্ন সহকারে রক্ষা করার ব্যবস্থা করেন। মাঝে মাঝে সেগুলির সংস্কার ও সংরক্ষণের জন্য তিনি অর্থ বা অনুদান বরাদ্দ করেন। এমনকি জিহাদি অভিযানে ইহুদী ও খ্রিস্টানদের যে ধর্মস্থানগুলি তাঁর সাম্রাজ্যের অধীনে এসেছিল সেগুলি তিনি তাদের হাতে প্রত্যর্পণ করেন। সকল অমুসলমানকে যেমন জিজিয়া কর দিতে হত, তেমনি বিনিময়ে সকল মুসলমানের উপর খারাজ (ভূমিকর) আরোপ করেন। ৭১৮-৭১৯ খৃস্টাব্দে তিনি আইন করে অমুসলমানদের নিকট থেকে জমি ক্রয় করা নিষিদ্ধ করেন। এক সময় তিনি সাম্রাজ্য বিস্তারের ইসলামের মূল নীতি পরিত্যাগ করেন এবং পূর্ববর্তী খলিফাদের সমস্ত সামরিক অভিযান বাতিল করে দিয়ে বিদেশে যে সব সেনাপতি রাজ্য বিস্তারে ব্যাপৃত ছিলেন তাদের গৃহে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেন। ইসলামি রাষ্ট্রে এই সংস্কার প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় এক সময় খলিফাদের হাত ধরেই এসেছিলো মুতাজিলা নীতি। মুতাজিলা নীতির মূল কথা ছিলো, মানুষের যুক্তিভিত্তিক চিন্তার ফসলগুলি কোরানের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
মূল কথা হলো, মুহাম্মদের মৃত্যুর কয়েক বছর যেতে না যেতেই খলিফাদের হাত ধরেই ইসলামি নীতি ও আইনের সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছিলো। এবং রাষ্ট্র ও সমাজের অগ্রগতি ও বিকাশে কোরান যখনই অপ্রাসঙ্গিক ও প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছে তখনই খলিফাগণ সচেতনভাবেই কোরানের আইনের সংস্কার করেন এবং নতুন নতুন আইনকানুন তৈরী ও প্রবর্তন করেন। কিন্তু তাঁরা তা করেন চুপিসারে, কোরানে অনেক জাল আয়াত ঢুকে গেছে বা কিছু আয়াতকে বিকৃত করা হয়েছে এমন অভিযোগ তাঁরা কেউ আনেন নি। সৌদি আরবেও ইসলামি নীতি ও আইনের সংস্কারের কাজটি এতদিন চুপিসারে হচ্ছিলো। এবার সৌদি রাজা সালমান বিন আজিজ সৌদ সংস্কারের কাজটি করতে চাইছেন সোচ্চারে।    

Friday, October 6, 2017

রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান করা শুধু মায়ানমার সরকারের দায় নয়, রোহিঙ্গাদেরও দায় নিতে হবে



অন লাইনে চোখ রাখলে চোখের সামনে ভেসে উঠছে রোহিঙ্গাদের ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের হাড় হিম করা একের পর এক দৃশ্য ভেসে উঠছে রোহিঙ্গা স্মরণার্থীদের ক্রন্দনরত বিবর্ণ মুখের মর্মস্পর্শী ছবির মিছিল খবরের কাগজগুলিতেও প্রথম পাতা দখল করে থাকছে রোহিঙ্গাদের খবর। দুরদর্শনেও তাই। রোহিঙ্গা ইস্যু ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। হওয়াটাই যে স্বাভাবিক। কারণ তাদের ওপর মায়ানমার সরকারের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন মানবতা ও মানবাধিকারের সমস্ত সীমা অতিক্রম করে গিয়েছে। তাদের গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। অভিযোগ যে তাদের টার্গেট করে গুলি করা হচ্ছে হত্যা করার জন্যে বাংলাদেশে বিদেশমন্ত্রী দাবী করেছেন যে রাখাইন প্রদেশে অন্ততঃ তিন হাজার রোহিঙ্গা নিধন হয়েছে।  রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন সত্যিই এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে প্রাণ বাঁচাতে প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই বিপজ্জনক পথ ধরে রোহিঙ্গারা দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেফলে রোহিঙ্গারা শয়ে শয়ে মারা যাচ্ছে হয়  জলে ডুবে না হয় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর গুলিতে। এ অভিযোগ রোহিঙ্গারা শুধু করছে তা নয়, অভিযোগ করেছে সংবাদ মাধ্যমগুলিও। এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক অষ্ট্রেলিয় মানবাধিকার সংগঠন বলেছে -  Many people are risking their lives to escape using perilous routes – some are badly injured, and with children.  মানবাধিকার সংগঠনটি আরো বলেছে যে গতো দু সপ্তাহেরও কম সময়ে ৩,৭০,০০০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশের সীমান্তে পৌঁছে গেছেসংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে - In less than two weeks, 370,000 Rohingya people have had to flee Myanmar to nearby Bangladesh. রোহিঙ্গাদের উপর রাষ্ট্রীয় নৃশংস দমন-পীড়নের যে সব বীভৎস খবর আসছে তাতে কিছু অতিরঞ্জন হয় তো আছে, কিন্তু তথাপি পরিস্থিতি যে ভয়াবহ তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ মনে হয় নেই।  সম্প্রতি বৌদ্ধ ধর্মগুরু দালাই লামাও  মায়ানমারে শান্তি ও সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনার জন্যে আং সূচী ও মায়ানমারের অন্যান্য নেতাদের পদক্ষেপ নেবার আহ্বান জানিয়েছেন।  গতো ১১ই সেপ্টেম্বর  তিনি  আং সান সূচি ও মায়ানমার সরকারের উদ্দেশ্যে বলেছেন, “আপনারা শান্তি এবং সৌহার্দ্যের মাধ্যমে জনমানসে সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনুন।” পরিস্থিতি এতোই ভয়াবহ হয়ে উঠেছে যে ১৩ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে অবস্থিত ৪০টি দেশের রাষ্ট্রদূত একসঙ্গে রাষ্ট্রসঙ্ঘকে রোহিঙ্গা সংকটে হস্তক্ষেপ করার আবেদন জানিয়েছেন পরিস্থিতি যে ভীষণ রকম ভয়াবহ তা বোঝা যায় রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার সংক্রান্ত হাইকমিশনার জায়েদ আল হুসেনের মন্তব্যেও  তিনি বলেছেন –
মায়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপরে যা চলছে তা “জাতি নিধনের আদর্শ উদাহরণ  
হুসেন মায়ানমার সরকারের পাশাপাশি ভারত সরকারেরও তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, “মায়ানমারে যখন রোহিঙ্গারা আক্রমণ ও হিংসার শিকার হচ্ছেন, ঠিক তখনই ভারত নিজেদের এলাকা থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বহিষ্কার করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা অন্যায়।” প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে ভারতে চল্লিশ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রশ্নে ভারত সরকারের ভূমিকা সত্যিই খুবই হতাশাজনকএই ভূমিকায় ভারতবাসী হিসেবে আমি লজ্জিত ভারত সরকার প্রধানতঃ সাম্প্রদায়িক মনোভাব থেকে এমন লজ্জাজনক হীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে বলে আমার ধারণা। আমার এই ধারণা ভ্রান্ত বা অভ্রান্ত যাই হোক না কেনো, এই সিদ্ধান্তের আমি তীব্র প্রতিবাদ করছি। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া যে কোনো দেশের পক্ষেই ঝুঁকির, এটা জেনে ও মেনেও বলছি যে, যারা ইতিমধ্যেই ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে তাদের আশ্রয় দেওয়া আমাদের রাষ্ট্রীয় নৈতিক মানবিক কর্তব্য। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া কেনো ঝুঁকির কারণ সে প্রসঙ্গে পরে আসবো, কিন্তু  ঝুঁকি সত্ত্বেও ছিন্নমূল অসহায় চল্লিশ হাজার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা একটু আশ্রয় ও অন্নের জন্যে যখন দরজায় এসে কড়া নাড়ে তখন তারা শত্রু হলেও তাদের আর্তিতে সাড়া দেওয়াটা সভ্য সমাজের ন্যূনতম রীতি ও কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। উল্টে তাদেরকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেয়াটা চরম নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতা  রূপ অমানবিক সিদ্ধান্ত নিয়ে মোদিজি  বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের মাথা হেঁট করে দিলেন। 
মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের উপর যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও নিপীড়ন চালাচ্ছে তার নিন্দা করার ভাষা নেই কিন্তু তা বলে মায়ামমার সরকারের বিরুদ্ধে মুসলমান নিধনের যে অভিযোগ উঠেছে তার সঙ্গে  আমি সহমত নই। কারণ, রোহিঙ্গা মুসলমান ব্যতীত অন্য গোত্রের মুসলমানরা সেখানে নিরাপদেই আছে। অবশ্য আমার এটা মনে হচ্ছে যে মায়ামমার সরকার তাদের মাটি থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্মূল করতে চাইছে। এ কথা আমি এর আগের নিবন্ধেও লিখেছি। সে লেখায়  আমি অভিযোগ আরও করেছি যে, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের পাশাপাশি মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের পরিকল্পিতভাবে ভয়ঙ্কর মানসিক নিপীড়নও চালাচ্ছে যাতে তারা মায়ানমার ছেড়ে পালিয়ে যায়। সেই উদ্দেশ্যে মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সহ সকল মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে। আমি এও বলেছি যে, শুধু জঙ্গী ও সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারাই নয়, মায়ানমার সরকারের রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের  শিকার হচ্ছে সাধারণ নিরীহ রোহিঙ্গারাও। আগের লেখায় তাই আমি দাবী জানিয়েছি যে, জঙ্গী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মায়ানমার সরকার যতো খুশী কঠোর হোক, কিন্তু নির্দোষ ও নিরীহ রোহিঙ্গাদের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে এবং তাদের নিরাপত্তা দিতে হবে    
আমার সে লেখায় মুসলিম মৌলবাদীরা বেজায় রুষ্ট। রুষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও সেক্যুলার তকমাধারী বন্ধুরাও। তাঁদের রোষের কারণ আমি বলেছি যে –
এক). মায়ানমার সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে ঠিকই, কিন্তু রোহিঙ্গারাও ধোওয়া তুলশী পাতা নয়।
দুই). রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে মায়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে দুনিয়া জুড়ে একপেশে আলোচনা হচ্ছে।
তিন). মুসলমান বলেই রোহিঙ্গাদের উপর রাষ্ট্রীয় নির্যাতন হচ্ছে এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও অবাস্তব অভিযোগএবং
চার). মুসলিম মৌলবাদীরা রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বিশ্বজুড়ে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়াচ্ছে।       
আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আবার জানাতে চাই যে, মায়ানমার সরকারের কাছে রোহিঙ্গাদের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন বন্ধ করা এবং তাদের নাগরিকত্ব-সহ সমস্ত মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার যে দাবী উঠেছে তার প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন আছে। তারপরেও খুবই বেদনার সাথে আমাকে বলতে হচ্ছে যে,  আন্তর্জাতিক মহল ও রাষ্ট্রপুঞ্জ নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ না করে মায়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ একপেশে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই আমি দাবী জানাচ্ছি যে, পূর্বানুমানের ভিত্তিতে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে একপেশে মনোভাব ও অবস্থান থেকেসরে এসে রাষ্ট্রসংঘ ও আন্তর্জাতিক মহলকে একটি  নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে হবে। এবং অনুসন্ধান করে দেখতে হবে কেনো মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গা নিধন-যজ্ঞ শুরু করেছে? সে কি শুধুই ধর্মীয় বিদ্বেষ থেকে, না কি অন্য কোনো কারণ রয়েছে এর পশ্চাতে? তা না হলে রোহিঙ্গা-সংকট নিয়ে যে একপেশে ও একবগ্গা আলোচনা হচ্ছে তা রোহিঙ্গা- সংকটের সমাধানকে ত্বরাণ্বিত করার বদলে আরো জটিল করে তুলবে। একপেশে ও একবগ্গা   আলোচনা ও সমালোচনার ফলে রোহিঙ্গারা মায়ানমারে কী ভূমিকা  পালন করছে সে সম্পর্কে বিশ্ববাসী  বিন্দুবিসর্গও জানতে পারছে না। রোহিঙ্গা-সংকট নিরসনে রাষ্ট্রসংঘকে কার্যকরী উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে  হলে মায়ানমার রাষ্ট্রের ভূমিকার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের ভূমিকা সম্পর্কেও সঠিকভাবে অবহিত হতে হবে। রোহিঙ্গাদের ভূমিকাটাও জানা অবশ্যই দরকার, কারণ মায়ানমার ও  রোহিঙ্গাদের পূর্ব ইতিহাস ঘেঁটে যে তথ্য ও খবর উঠে আসছে তাতে এটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে রোহিঙ্গা-সংকটের জন্যে শুধু মায়ানমার সরকারই দায়ী নয়, দায়ী রোহিঙ্গারাও। রোহিঙ্গাদের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের ঘটনাগুলি পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে যে, মায়ানমার সরকার বিনা প্ররোচনায় রোহিঙ্গাদের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন করেছে এমনটা বলা যাচ্ছে না।  বরং অপ্রিয় ও  নির্মম সত্যিটি হলো এই যে, মৌলবাদি ও জঙ্গী রোহিঙ্গাদের বৌদ্ধ ও রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপই মায়ানমার সরকারকে বাধ্য করেছে বারবার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযানের সিদ্ধান্ত নিতেএ প্রসঙ্গে দুটো টাটকা উদাহরণ হাতের কাছেই দেখা যাচ্ছে।
(এক). গতো বছর (২০১৬) অক্টোবর মাসে মায়ানমার যখন সরকার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনা অভিযানের নির্দেশ দেয় তার আগে ৯ই অক্টোবর সন্ত্রাসবাদী রোহিঙ্গারা ৩টি সীমান্ত  চৌকিতে হামলা চালিয়ে ৯জন সীমান্তরক্ষীকে হত্যা করে
(দুই). এবারও মায়ানমার সরকারকে সেনাভিযানের নির্দেশ দিতে বাধ্য করেছে জঙ্গী রোহিঙ্গারাই। রোহিঙ্গাদের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন ‘আরসা’ (আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি) গতো আগষ্ট মাসের শেষের দিকে ত্রিশটি পুলিশ চৌকি ও একটি সেনা ছাউনিতে ভয়াবহ সশস্ত্র হামলা চালিয়ে ১৫০ জন পুলিশ ও সেনাকে হত্যা করে এবং সেই হামলায় আহত হয় আরো অনেকে (http://www.anandabazar.com/international/un-raised-their-voice-on-rohingya-crisis-issue-1.673312)
শুধু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই নয়, রোহিঙ্গাদের জিহাদি জঙ্গী হামলার শিকার বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অসামরিক লোকজনও। রোহিঙ্গা মুসলমানরা সবাই মোটেই যে শান্তিপ্রিয় নয় এবং তারা রাষ্ট্র ও বৌদ্ধ সমাজের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী হিংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে সরকারকে সেনা নামাতে বাধ্য করছে এ কথাটা সবাই চেপে যাচ্ছে। সবাই কেবল মায়ানমার সরকার ও আং সান সূচীর  উপর রোহিঙ্গাদের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন বন্ধ করার জন্যে চাপ সৃষ্টি করছে, কিন্তু কেউ রোহিঙ্গাদের উপর তাদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্যে চাপ দেয়া তো দূরের কথা তাদের সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের কথাই মুখে আনছে না। রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের ভূমিকা নতুন কিছু নয়। সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। সে ইতিহাস আলোচনা করার প্রয়োজনীয় পরিসর এই নিবন্ধ নেই। তবুও একান্ত প্রাসঙ্গিক বলে সেই ইতিহাসের পাতায় এক ঝলক চোখ বুলানো যাক।       
১৯৮২ সালে মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়। কোনো অবস্থাতেই কোনো জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার ঘটনা সমর্থনযোগ্য নয়। তথাপি কেনো ও কোন পরিস্থিতিতে মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো তা আমাদের একটু খতিয়ে দেখার দরকার আছে আর সেজন্যে আমাদের একটু পেছনে যেতে হবে। ১৯৪৮ সালে মায়ানমার স্বাধীন হয়। খুবই দুঃখজনক ঘটনা হলো, রোহিঙ্গারা মায়ানমারের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছিলো। ১৯৪৭ সালে মায়ানমারের আকাশে বৃটিশ-সূর্য যখন অস্তমিত প্রায় তখন রাখাইন প্রদেশকে মায়ানমার থেকে বিচ্ছিন্ন করে পাকিস্তানের অঙ্গরাজ্য করার পরিকল্পনা করে রোহিঙ্গারা। সে উদ্দেশ্যে তারা বার্মিজ মুসলিম লীগ গঠন করে মুজাহিদ বাহিনী গড়ে তোলে এবং ভারতের মুসলিম লীগ নেতা মহম্মদ জিন্নার সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিন্তু জিন্নাহ তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। ফলে সেবার তাদের সেই দেশবিরোধী জিহাদি মিশন ব্যর্থ হয়তথাপি স্বাধীন মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে কুণ্ঠিত হয় নি। মায়ানমার সরকার ও মায়ানমারের মানুষদের এই ক্ষমাশীলতা, সহিষ্ণুতা, উদারতা ও মহানুভবতাকে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয় রোহিঙ্গা মুসলমানরা। ওদের ধর্মীয় গোঁড়ামি ও প্রবল রক্ষণোশীলতাই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো মায়ানমারকে তাদের নিজের দেশ ও তার সরকারকে নিজের সরকার বলে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে। উল্টে মায়ানমারকে তারা ভেবেছে দারুল হারব (শত্রু দেশ) এবং তাই মায়ানমারকে দারুল ইসলাম (ইসলামি রাষ্ট্র) বানাবার লক্ষ্যে সন্ত্রাসবাদী জিহাদি কার্যকলাপ তারা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। তার জন্যে বার্মিজ মুসলিম লীগের পরিবর্তে তারা তৈরী করে একটি জিহাদি সংগঠন ‘আরসা’ (আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি)। আরসা-র লক্ষ্য জিহাদের মাধ্যমে মায়ানমারকে বার্মিজদের হাত থেকে মুক্ত করে সেখানে ইসলামি রাষ্ট্র গঠন করা। রোহিঙ্গাদের এই জিহাদি সংগঠন ও হামলা দমন করার জন্যে নে উইন সামরিক সরকার রোহিঙ্গাদের উপর প্রথম রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন শুরু করেছিলো  ১৯৬২ সালে। এই নে উইনের সরকারই রোহিঙ্গাদের প্রথম বাংলাদেশী আখ্যা দিয়ে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মাধ্যমে তাদের বিতাড়নের প্রক্রিয়া শুরু করে সেই রাষ্ট্রী নিপীড়নের ধারাবাহিকতায় ১৯৮২ সালে  মায়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়। জঙ্গী রোহিঙ্গার জন্যে সমস্ত রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার ঘটনা নিশ্চয় নিন্দাজনক, কিন্তু এ কথাও তো অনস্বীকার্য যে মায়ানমার সরকারকে উক্ত কঠোর পদক্ষেপ নিতে প্ররোচিত করেছে রোহিঙ্গা মুসলমানরাই।      
১৩ হাজার বছর ধরে বৌদ্ধরা মায়ানমারের অধিবাসী। আর মায়ানমারে আরবদের আগমন মাত্র ১৩শো বছর আগে ৮ম কিংবা ৯ম শতাব্দীতেতারা এসেছিলো বাণিজ্য উপলক্ষ্যে। সেদিক থেকে বিচার করলে বৌদ্ধরা মায়ানমারের আদি ও মূল অধিবাসী, এবং মুসলমানরা বহিরাগত। মায়ানমার সরকার তাই রোহিঙ্গারা বহিরাগত বলে তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে চাইছে না। মায়ানমার সরকারের এই দাবী কিন্তু সমর্থনযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নয়। দাবীটি সম্পূর্ণ অবাস্তব ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কারণ হলো,  
এক). যারা বাণিজ্য করার জন্যে এসেছিলো তাদের অনেকেই নিজের দেশে ফিরে না গিয়ে মায়ানমারেই থেকে গিয়েছিলো
দুই). মায়ানমারের অধিকাংশ মুসলমানই ভারত,পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মুসলমানদের মতো ধর্মান্তরিত মুসলমান সুতরাং তারা যে মায়ানমারেরই অধবাসী, এবং বহিরাগত নয় তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
বৌদ্ধদের একটা অংশ কেনো ইসলাম গ্রহণ করেছিলো সেটা একটু দেখা যাক। কারণ আজকে রোহিঙ্গাদের যে সংকট তার সঙ্গে তার কিছুটা হলেও যোগসূত্র রয়েছে।      
১৪৩০ খৃষ্টাব্দে সুলায়মান শাহ ২৫০০০ হাজার সৈন্য নিয়ে অতর্কিতে আরাকানে হামলা চালিয়ে সেখানে ইসলামি রাষ্ট্র স্থাপন করেছিলো এবং সে রাষ্ট্রটি টিকেছিলো ১৪৭৮ সাল পর্যন্ত। সুলায়মান শাহ ছিলেন একদা একজন বৌদ্ধ রাজা যাঁর নাম ছিলো নরমখিলা। ১৪০৪ খৃস্টাব্দে মাত্র ২৪ বছরের আরাকানের যুবরাজ নরমখিলা পিতার সিংহাসনে আরোহণ করেন। এক সামন্তরাজার বোনকে অপহরণ করার জন্যে আরাকানের সমস্ত সামন্তরাজারা জোট বেঁধে তার উপর আক্রমণ চালালে তিনি আরাকান ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে গৌড়ের সুলতানের কাছে আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি ইসলাম গ্রহণ করে সুলায়মান শাহ নাম নেন এবং ২৪ বছর ধরে ইসলাম ধর্ম অনুশীলন ও  চর্চা করে একজন ঈমানদার মুসলমান হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেনতারই পুরস্কার হিসেবে গৌড়ের সুলতান নাসিরুদ্দিন শাহ (মতান্তরে জালালুদ্দিন শাহ) তাঁকে তাঁর রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্যে একজন সেনাপতির নেতৃতে ২৫০০ হাজার সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেন। বলা বাহুল্য যে, সুলায়মান শাহের শাসন কালে বৌদ্ধদের উপর ব্যাপক অকথ্য ও অমানবিক নিপীড়ন চালানো হয়েছিলোমুসলমানরা বৌদ্ধ  হিন্দুদের  ব্যাপকহারে  লুট হত্যা করেফলে প্রাণভয়ে বহু বৌদ্ধ ধর্মান্তরিত হয় এবং অনেকেই অন্য কোথাও পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় সেই নিপীড়নের ইতিহাস বৌদ্ধরা নিশ্চয় ভোলে নি। বৌদ্ধদের উপর রোহিঙ্গাদের সেই নিপীড়নই বৌদ্ধদের একাংশের মধ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও আক্রোশের জন্ম দিয়েছে। আরাকানে মুসলিম শাসন ফিরিয়ে আনার জন্যে রোহিঙ্গারা আজো মায়ানমার সরকার ও অসামরিক বৌদ্ধদের উপর সমানে সন্ত্রাসবাদী হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। যারা আরাকানের মূল জনগোষ্ঠী বৌদ্ধদের উপর ইসলামি শাসন, শিক্ষা ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে রোহিঙ্গারা জিহাদি সন্ত্রাস তথা যুদ্ধাভিযান সংগঠির করে থাকে মায়ানমার রাষ্ট্র ও বৌদ্ধদের উপর। রোহিঙ্গাদের উপর রাষ্ট্রীয় অত্যাচার থেকে বাঁচতে লাখে লাখে রোহিঙ্গারা যখন মায়ানমার ছেড়ে যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে তখনও জঙ্গী রোহিঙ্গারা তাদের জিহাদি কর্মকাণ্ডে অটল রয়েছে। অনলাইনে জঙ্গী নেতারা জিহাদের বার্তা দিয়ে রোহিঙ্গাদের মনোবল ধরে রাখার প্রয়াস জারি রেখেছে। একজন নেতার ভিডিও রেকর্ডিং – এর মাধ্যমে  রোহিঙ্গা মুজাহিদিনদের উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণ ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। তিনি যে ভাষণ দিয়েছেন তার বাংলা অর্থ হলো –
যতোক্ষণ পর্যন্ত একজন কাফির এই দেশে (মায়ানমারে) আছে, ততোক্ষণ পর্যন্ত তাদের এই জিহাদ চলবে। সময় এখন এদের কতল করার  ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার পরেই তাদের এই জিহাদ শেষ হবে মায়ানমারের এটাই হলো সত্যিকারের বাস্তব পরিস্থিতি
রূপ পরিস্থিতিতে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে রোহিঙ্গা-সংকট এর সমাধান শুধু মায়ানমার সরকারের হাতে নেই। রোহিঙ্গারা যতোদিন না জিহাদ ও জিহাদের আদর্শ পরিত্যাগ করে মায়ানমারকে নিজের দেশ মনে করবে, মায়ানমারের উদারতা, সহিষ্ণুতা, ক্ষমাশীলতা ও মহানুভবতার আদর্শ ও সংস্কৃতিকে সম্মান ও মান্য করতে শিখবে এবং সর্বোপরি দেশের সংবিধানকে স্বীকার ও মান্য করবে ততোদিন রোহিঙ্গা-সংকটের সমাধান আশা করা যায় না। মায়ানমারের সরকারের উপর হাজার রকমের চাপ প্রয়োগ করলেও হওয়া সম্ভব নয় বলেই মনে হয়।  
রোহিঙ্গা-সংকটের নেতিবাচক প্রভাব সারা বিশ্বেই পরিলক্ষিত হচ্ছে যা যথেষ্ট উদ্বেগের। রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়ন চালাচ্ছে মায়ানমার সরকার, কিন্তু মুসলিম মৌলবাদীরা ঘৃণা ও হিংসা ছড়াচ্ছে সমগ্র বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যা খুবই উদ্বেগের বিষয়রোহিঙ্গাদের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নকে অস্ত্র করে মুসলিম সংগঠনগুলো নিজ নিজ জায়গায় অমুসলিমদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। ভারতে ও পশ্চিমবঙ্গেও তারা এ কাজ করছে বেপরোয়াভাবে গতো ১২ই সেপ্টেম্বর কলকাতায় মুসলিম সংগঠনগুলো রোহিঙ্গাদের পক্ষে মিছিল করেছে যেখানে  তারা আওয়াজ তুলেছে - ‘নাড়া – এ - তকবির’, আর লক্ষাধিক কণ্ঠ আকাশ ফাটিয়ে মুসলমানরা জবাব দিয়েছে,  ‘আল্লাহু আকবার’। মিছিলে তো কিছু অমুসলিমও ছিলো, তাহলে এই জিহাদি ‘নাড়া’ কেনো? কেন এবং  কাদের বিরুদ্ধে এই ‘নাড়া’?         
ভারত থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর সরকারেরএটা সব হিন্দুরাই সমর্থন করে বলে মনে হয় না। কিন্তু মুসলিম সংগঠনগুলির প্রচারের ধরণ এমনই যেনো রোহিঙ্গা ইস্যুতে গোটা হিন্দু সমাজ রয়েছে মোদির পেছনে। মুসলিম সংগঠগুলির দাবি  করছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবাধে ভারতে আশ্রয় দিতে হবে। এ দাবী কি সুবিবেচনা প্রসূত? কোটি কোটি মানুষ যে দেশে আজো বাস করে খোলা আকাশের নীচে, কোটি কোটি বেকার যে দেশে কাজের অভাবে ধুঁকতে ধুঁকতে এক সময় অসামাজিক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ে, যে দেশে প্রতিদিন কতোশত শিশু অচিকিৎসা ও অপুষ্টিতে মারা যায় তার ইয়ত্তা নেই, যে দেশ জনস্ফীতির ভারে ন্যুব্জ, সে দেশের পক্ষে ভিন দেশের লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়া সম্ভব? একই কারণে বাংলাদেশও তো রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে প্রচণ্ড অনিচ্ছুক। যারা ঢুকেছে তারা লুকিয়ে চুরিয়ে। অথচ বাস্তব সমস্যাকে অস্বীকার করে মুসলিম সংগঠনগুলি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্যে ভারতের দরজা হাট করে খুলে দেবার অবাস্তব দাবী জানাচ্ছে মানবতার দোহাই দিয়েআসলে মানবতার মুখোশ পরে তারা সাম্প্রদায়িক তাস খেলার চেষ্টা করছে। কথায় আছে কারো সর্বনাশ তো কারো পৌষ মাস। রোহিঙ্গাদের সংকটকে তারা হাতিয়ার করে  সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়াচ্ছে। সত্যিই কি রোহিঙ্গারা মুসলিম বলে তাদের দরদ উথলে উঠছে? রাহলে যখন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অন্যায় যুদ্ধ করে ত্রিশ লাখ মুসলমানকে হত্যা করে, তিন লাখ মুসলিম নারীর সম্ভ্রম নষ্ট করে, এক কোটি মানুষ দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয়, তখন তাদের মুসলিম-দরদ কোথায় গিয়েছিলো? বিশ্বজুড়ে সুন্নি মুসলমানরা প্রায় প্রতিদিনই তো শিয়া মুসলমান ও আহমদিয়া মুসলমানদের হত্যা করছে, তখন তাদের মুসলিম-দরদ  দেখতে পাওয়া যায় না কেনো?  
আর একটা কথা বলে শেষ করবো। প্রধানমন্ত্রীর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বহিষ্কার করার সিদ্ধান্তের পেছনে অর্থনৈতিক কারণ ছাড়া আরও দুটি কারণ আছে বলে মনে হয়। তার একটি হলো, মুসলিম-বিদ্বেষ এবং আর একটি হলো রোহিঙ্গাদের ভয়।  প্রধানমন্ত্রীর মুসলিম-বিদ্বেষ নিঃসন্দেহে অতীব ঘৃণ্য ও নিন্দনীয় কিন্তু দ্বিতীয়টি কারণটিকে তো অমূলক বলা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকারও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিতে একদমই চাই না। যারা ঢুকে পড়েছে তাদের নিয়ে তারা রীতিমতো ভয়ে ও আশংকায় রয়েছে। বাংলাদেশের যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কথাতে তা স্পষ্ট। তিনি বলেছেন –
শরণার্থীর সাথে ষড়যন্ত্র, অবৈধ অস্ত্র, মাদক দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র অনুপ্রবেশ করতে পারে।
একাত্তরের টিভি-র বার্তা পরিচালক সৈয়দ ইশতিয়াক রেযা এ কথাটাই আরো স্পষ্ট করে বলেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন –
এসব রোহিঙ্গার একটি বড় অংশ সন্ত্রাসি, মাদক চোরাচালান ও অসামাজিক কাজে জড়িত। এবং বড় ভয়টা হলো কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় থাকা বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে এরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। যেকোন উপায়ে সাম্প্রদায়িক  সম্প্রীতি নষ্ট করার পায়তারা করছে এরা। শুধুমাত্র বাংলাদেশেই নয়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে এরা নানা রকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে এরা জড়িয়ে পড়ছে। রোহিঙ্গারা মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছে বাংলাদেশী পাসপোর্ট ব্যবহার করে। ফলে তাদের এসব অপকর্মের জন্যে আন্তর্জাতিক বিশ্বে ভাবমূর্তি খারাপ হচ্ছে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশী শ্রমিকদের। দেশের একটি গোষ্ঠী, মূলত, ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতি যারা করে, তারা রোহিঙ্গা সমস্যাকে রোহিঙ্গাদের সাথে বিবাদ হিসেবে দেখিয়ে উত্তেজনা তৈরি করতে চাচ্ছে। ফেসবুকে, অনলাইনে তারা ফটোশপ করে উত্তেজনা ছড়াতে ব্যস্ত।      (সূত্রঃ http://www.latestbdnews.com/only-opening-the-gate-is-not-solutions/)
ভারতের ক্ষেত্রেও রোহিঙ্গা স্মরণার্থীরা এখানকার জঙ্গী সংগঠনগুলোর সাথে জোট বাঁধবে না এ কথা হলপ করে কেউ বলতে পারে না। শুধু বাংলাদেশ বা ভারত নয়, আজ গোটা বিশ্বই মুসলমান শরণার্থীদের নিতে ভয়ে কম্পমানএকদিন যে দেশগুলি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইরাক ও সিরিয়ার লক্ষ লক্ষ মুসলিম রণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিল, আজ তারা সবাই ভয়ে প্রকম্পিত কেনো? শুধু মুসলিম-বিদ্বেষ বা ইসলাম-ফোবিয়া বলে চিৎকার করলে হবে না, কেনো মুসলিমদের সম্পর্কে অমুসলিমদের মধ্যে ভীতি তৈরী হয়েছে ও হচ্ছে এবং তা দ্রুতগতিতে বাড়ছে এবং এক দেশ থেকে আর এক দেশে ছড়িয়ে পড়ছে তা খতিয়ে দেখতে হবে মুসলিমদের নিজেদেরই
       
  


 


 

বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাইনি – পাঁচ

  দ্বিতীয় অধ্যায় শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবের প্রতি তীব্র গণরোষের নেপথ্যে ২০২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে ৩৬ দিন পর (৫ই ...